সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঐ তালিকা মিলিয়ে একবার করে এর কাছে ওর কাছে ঢুঁ মারা ওর নিত্য কর্মের প্রধান অঙ্গ। সবচেয়ে মজার হল ওর উৎসাহ নানান দিকে ছোটে। একবার স্টেটসম্যানে সম্পাদকের বরাবরে লিখিত এক চিঠির সূত্র ধরে কিছুদিন ধরে রানা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে ডিরোজিয়ো এবং তরু দত্তের কবর খোঁজার কাজে। ফিরিঙ্গি যুবক ভিভিয়ান ডিরোজিয়ো ছিলেন একাধারে নব্যযুগের নব্য বাংলার নবজাগরণের আদি এবং দীক্ষাগুরু, এ দেশের পরাধীনতার বন্ধন মুক্তির প্রথম চারণ কবি, নবজাগৃতির শিক্ষক, দার্শনিক, সমাজকর্মী, কবি এবং বিদ্রোহী। ১৮০৯ খৃষ্টাব্দে এই কলকাতা শহরেই তার জন্ম। বিদ্যাশিক্ষা ও কর্মজীবন, এই কলকাতাতেই ১৮১৩ খৃস্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে তার মৃত্যু
আপনি কত দ্রুত কথা বলতে পারেন? হিসেব করে দেখেছেন কখনো? মিনিটে কত শব্দ? এবং এক নাগাড়ে কতক্ষণ বলতে পারবেন? এই প্রশ্নগুলো খানিকটা উদ্ভট শোনালেও কথাগুলো আমার মনে এসেছে রানা ঘোষের সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকে। আমি অন্তত আমার জীবনে এর আগে কাউকে দ্রুত কথা বলতে দেখিনি। অনর্গল, অবিরাম সমুদ্রের ঢেউ-এর মতোই তার কথার তোড়। একেক সময় মনে হয় কখনো থামবার নয়। রানা একটানা কথা বলে যেতে পারে। শুধু একবার শুরু করারই যা অপেক্ষা।
আমার জানা মতে ওরকম আর একজন মাত্র লোক আছেন তিনি হচ্ছেন স্বনামধন্য সৈয়দ মুজতবা আলী। বাকপটুত্বে এদের জুড়ি মেলা ভার। ভূ-ভারতে খুঁজলেও আর দুটি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এঁরা অনেকটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে যন্ত্রেরও বোতাম টিপতে হয়, এদের তাও দরকার হয় না। আরও একটা আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এরা দু’জনেই কিন্তু সিলেটি। আদি ও অকৃত্রিম সৈয়দ সাহেব আবার, রানার সার্বজনীন সম্পর্কিত চাচা। গতির দিক থেকে ভাইপো চাচার চেয়ে এক কাঠি সরেশ। চাচা অবশ্য পাণ্ডিত্যে এবং মেধায় ভাইপোর চেয়ে বড়। কালেভদ্রে দু’জনের মুখোমুখি সাক্ষাৎ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। তবে দু’জনই পরস্পর থেকে দূরতম দুই বিপরীত মেরুতে বসবাস করেন তাই রক্ষে।
রানাকে চেনে না কলকাতার এমন লোকের সংখ্যা বোধ করি বিরল। শুধু কলকাতা কেন আশেপাশের সমস্ত রাজ্যের বড় বড় শহরগুলোতেও রানা প্রায় সকল স্তরের লোকদের কাছেই অতি চেনা একজন। অথচ রানা এমন কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি নয় যে, রোজই খবরের কাগজে তার নাম বা ছবি ছাপা হয়। তাহলে রহস্যটা কি! রহস্যটা আর কিছুই নয়, কোনও ঘোরপ্যাঁচের ব্যাপার নয় একেবারে সাদামাটা ও সহজ-সরল ব্যাপার অর্থাৎ ওর ওই অনর্গল কথা বলার আশ্চর্য ক্ষমতাই তাকে সর্বজন পরিচিত করে তুলেছে।
রানা কলকাতায় আছে গত পনেরো বছর ধরে। তার আগে ছিলো শিলং-এ। তার আগে সিলেটের সুনামগঞ্জে। বিখ্যাত ঘোষ চৌধুরী পরিবারের ছেলে। প্রথম জীবনে কিছুদিন সরকারি চাকরি করে ছিলো। পরে একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গ্রিসীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধির কাজ নিয়ে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা ও মহারাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি শহরই চষে বেড়িয়েছে। বর্তমানে রানা সেই প্রতিষ্ঠানেরই আরো উচ্চপদে কর্মরত।
রানার আর একটি সহজাত ক্ষমতা হচ্ছে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই যে কোনো আঞ্চলিক কথ্যভাষায় রপ্ত হওয়ার অলৌকিক দক্ষতা। হাতে-কলমে না শিখেও একটি ভাষা যে কত নিপুণভাবে আয়ত্ত করা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রানা ঘোষ। খই ফোটার মতো অনর্গল সে অসমিয়া, ওড়িয়া, হিন্দী, উর্দু ও মরাঠি ভাষায় কথা বলতে পারে। অবশ্যই সিলইট্টা উচ্চারণভঙ্গিতে।
কেবল পারে না কলকাতার চালু কথ্য বুলিতে কথা বলতে। সেখানে সে আদি ও অকৃত্রিমভাবে সিলইট্টা। টেনে টেনে বিলম্বিত লয়ে যখন সে জোর কদমে তার সিলইট্টা ভাষার ঘোড়া চালায় তখন তার সামনে দাঁড়ায় কার সাধ্য।
রানা সাধারণত ঝড়ের গতিতে কাজ করে। তা সে প্রয়োজনের কাজই হোক আর অকাজই হোক। সব সময়ে পায়ে যেন চাকা লাগিয়ে ঘুরছে। তার সঙ্গে কথার তুবড়ি বাজি চলছে অনর্গল।
আমি এখন অনেক লোককে জানি যারা রানাকে দেখলে ইষ্ট নাম জপতে থাকেন মনে মনে। তার কথার তোড় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে তারা রানার যে কোনও কাজই নির্বিচারে আর অকাতরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেনে নিতে দ্বিধা করেন না।
আমার মতো অকাজের লোকও রানাকে দেখলে ভয়ে পালাই পালাই করি। কোনোদিন খপ্পরে পড়ে গেলে আর উপায় থাকে না। তার বকবকানির চোটে অস্থির হয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখি। অনেকক্ষণ রানার সঙ্গে থাকার পর যদি একলা আমি কলকাতার সবচেয়ে ব্যস্ততম জনবহুল প্রচন্ড শব্দময় রাস্তার মাঝখানেও দাঁড়াই মনে হয় যেন কোনো নির্জন নিরিবিলি স্থানে এসে পৌঁছে গেছি।
ব্যক্তিগতভাবে রানা অত্যন্ত বন্ধুবৎসল এবং সহৃদয়।
কিছু সময়ের জন্য অতিশয় প্রিয় সঙ্গী। মাত্র দুটি বিষয়ে রানার কিঞ্চিৎ ঈর্ষা আর দুর্বলতা আছে। একটি যে কোনো বিদেশ প্রত্যাগত লোকের প্রতি তার অযাচিত সম্ভ্রম বোধ আর অপরটি হল যে কোনো ধরনের জ্ঞানান্বেষণের প্রতি তার বিস্ময়কর ছেলেমানুষি কৌতূহল।
ছিপছিপে, টানটান, দীর্ঘদেহী রানাকে সুপুরুষই বলা যায়। বিবাহিত এবং একটি পুত্র সন্তানের জনক রানাকে বয়সের তুলনায় অনেক তরুণই দেখায়। অদ্ভুত কতকগুলো বাতিক আছে তার।
প্রায় প্রতিদিন, একবার নিয়ম করে কলকাতায় যত নীলামের দোকানগুলো ঘোরা চাই, ছোটখাটো টুকিটাকি জিনিসের প্রতি ওর তীব্র আকর্ষণ। সেগুলো কিনে নিজের জন্য যে রাখে, তাও নয়।
কারু সঙ্গে হয়তো হঠাৎ দেখা হয়ে গেল রাস্তায়, চট করে তাকেই হয়তো উপহার দিয়ে দিলো একটা ছাইদানি কিংবা বেলজিয়ান কাটগ্লাসের দোয়াত, এমনিতর অসংখ্য জিনিস। আর নিজের জন্য সংগ্রহ বলতে কার নতুন নতুন অ্যাটাশে, যেটা ওর প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী।
আর বাংলা সাহিত্যের বিশেষ কয়েকজন লেখকের বই। অন্নদাশঙ্কর, রাজশেখর বসু ও মুজতবা আলীর প্রতিটি বই ওর সংগ্রহে অবশ্য থাকার তালিকায়। অন্যদের মধ্যে ধুর্জটি প্রসাদ, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধের বই, কমল কুমার মজুমদারের গল্প ও উপন্যাস এবং কয়েকজন বিতর্কিত তরুণ লেখকের বই তার বিশেষ পছন্দের। রোজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই রানার প্রথম কাজ সেদিনকার ইংরেজি দৈনিকের পার্সোনাল কলামের বিজ্ঞাপন এবং শহর ও শহরতলীতে কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে এসব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা এবং লাল পেন্সিলে কোনোটাতে তারকা চিহ্নিত করা, কোনোটাতেবা শুধুই দাগটানা।
পরে এক টুকরো কাগজে সেগুলোকে গুরুত্ব অনুযায়ী পরপর টুকে নেওয়া। এই হচ্ছে তার দৈনন্দিন অবশ্য কর্তব্যের একটি। কোথায় কোন সাহেব সমস্ত জিনিস জলের দরে বেচে দিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছেন, কোথায় আলো দত্তর শাড়ির প্রদর্শনী, কোথায় টালিগঞ্জ ক্লাবে এ্যানুয়াল হর্স শো, কোথায় কোন মহাজন ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যুতিথি উপলক্ষে জাতীয় শোকসভা, নিখিল ভারতীয় দারুশিল্পী সংঘের বার্ষিক মিলনী, হর্টিকালচারে ফুলের মেলা ইত্যাদির ফাঁকে সত্যজিৎ রায় কিংবা মৃণাল সেন, সুনীল গাঙ্গুলী কিংবা পুর্ণেন্দু পত্রী, অফিসের কাজে বেলগাছিয়া পঞ্চ মহাবিদ্যালয়ের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
বেলা দশটার মধ্যে কিছু নাকে-মুখে গুঁজে দিয়ে, খাস ভৃত্য বান্দাকে দিয়ে হাত-পা টিপিয়ে বেরিয়ে পড়ে একটা মেট্রোপলিটন এলাকার হলুদ ট্যাক্সি ধরে। তারপর সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঐ তালিকা মিলিয়ে একবার করে এর কাছে ওর কাছে ঢুঁ মারা ওর নিত্য কর্মের প্রধান অঙ্গ। সবচেয়ে মজার হল ওর উৎসাহ নানান দিকে ছোটে। একবার স্টেটসম্যানে সম্পাদকের বরাবরে লিখিত এক চিঠির সূত্র ধরে কিছুদিন ধরে রানা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে ডিরোজিয়ো এবং তরু দত্তের কবর খোঁজার কাজে। ফিরিঙ্গি যুবক ভিভিয়ান ডিরোজিয়ো ছিলেন একাধারে নব্যযুগের নব্য বাংলার নবজাগরণের আদি এবং দীক্ষাগুরু, এ দেশের পরাধীনতার বন্ধন মুক্তির প্রথম চারণ কবি, নবজাগৃতির শিক্ষক, দার্শনিক, সমাজকর্মী, কবি এবং বিদ্রোহী। ১৮০৯ খৃষ্টাব্দে এই কলকাতা শহরেই তার জন্ম। বিদ্যাশিক্ষা ও কর্মজীবন, এই কলকাতাতেই ১৮১৩ খৃস্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে তার মৃত্যু। এছাড়া অনেক রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের নায়ক ছিলেন তিনি।
ফকিরস অফ জাঙ্গাহীরা তার রচিত অন্যতম গ্রন্থ। বর্তমানে বইটি দুষ্প্রাপ্য। আর তরু দত্ত ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি ইংরেজি ও ফরাসী ভাষায় কবিতা লিখে দেশে-বিদেশে প্রভূত সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনিও মাত্র একুশ বছর বয়সে ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে পরলোকগমন করেন। ফরাসী ভাষায় কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ এবং ‘বিআংকার রাজা’ নামে একটি মধুর প্রণয়োপাখ্যান তার উল্লেখযোগ্য রচনা।
বহু ঘোরাঘুরি এবং খোঁজাখুঁজির পর ডিরোজিয়ো সাহেবের কবর আবিষ্কার করতে পারলেও তরু দত্তের কবর কিন্তু বহুদিন অবধি অনাবিষ্কৃতই থেকে গিয়েছিল। তবু হাল ছাড়েনি রানা ঘোষ। প্রতিদিন বিকেলের দিকে তাকে দেখা যায় কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের খৃষ্টান সিমেট্রিগুলোতে নিবিষ্ট মনে একের পর এক প্রতিটি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নাম খোদাই করা প্রস্তর ফলকগুলো পড়ে চলেছে। তারপর একদিন আকস্মিকভাবে মানিকতলায় রামমোহন রায়ের বাড়ি বর্তমানে পুলিশ মিউজিয়ামের উল্টোদিকে এক সিমেট্রিতে পাশাপাশি দু’বোনেরই সমাধি রয়েছে। কিন্তু না জানলে বাইরে থেকে কিছুই বুঝবার উপায় নেই।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারী ০৫, ২০১০
Leave a Reply