দেওঘাটা থেকে ইটবিছানো রাস্তাটা এসে হাটের পাশ দিয়ে খালের এপারে যেখানটায় থেমেছে, সেখানে কঠের পুল পেরিয়ে থানা শহরে ঢুকতে হয়। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল আর একটা বাজার নিয়েও প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই শহরটা বেশ শান্ত। এখনো বিদ্যুত্ কিংবা মোটরযান আসার ব্যবস্থা হয়নি। ফলে থানার সদর রাস্তা গাঙের খাড়ির যে জায়গায় থেমেছে, সেখানে তক্তার ঘাটলায় দারোগার একটা স্পিডবোট সব সময় বাঁধা থাকে। ঘাট থেকে একটু দূরেই গোটা দুই চালকল। হাটবারে ধান ভানাতে আসা নৌকাগুলো সেখানেও সার বেঁধে দাঁড়ায়।
থানার ঘাটে আজ বোট নেই, একখানা কেরায়া নাও বাঁধা। বোট নিয়ে দারোগা সাহেব সকালে পড়িমড়ি দৌড়েছেন শিমুলতলী। বিষয় ছোট নয়, জোড়াখুন। সেজন্য সশরীরে তাকে যেতেই হলো। কিন্তু সারা গাঁয়ের লোক যা করেছে, তার তদন্ত কি অত সোজা! তাই দারোগার বোট কখন আসবে কে জানে। কিন্তু হোগলায় মোড়ানো জোড়া লাশ কেরায়া নায়ে থানার ঘাটে পৌঁছেছে অনেকক্ষণ। খুনোখুনির কথা বাতাসে ওড়ে, তাও আবার হাটের বাতাস। কারও আর জানতে বাকি থাকে না শিমুলতলীতে ডাকাত পড়লে গ্রামবাসী ওদের দুটোকে টেঁটায় গেঁথে চোখ উপড়ে নিয়েছে। থানার ঘাটে তাই হাটুরেদের কৌতূহল উপচে পড়ে। দারোগা সাহেব না থাকায় ভিড় বাড়তে বাড়তে বেসামাল হট্টগোল। চোখ উপড়ানো, টেঁটায় গাঁথা ডাকাত দুটোকে দেখতে না পেলেও নৌকাটা ঘিরে মানুষের কল্পনার আর শেষ নেই। যে যেমন করে পারছে এমন গল্প ফাঁদছে যেন রাত্তিরে ওরা সে লঙ্কাকাণ্ডে শরিক ছিল। হয়তো বা ছিলও—যাদের কেউ কেউ মাথায় আঁঁটিবাঁধা সবজির সাজি কিংবা কয় সের চাল আর আট-দশটা ডিমের পোঁটলা ঘাড়ে ফেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনার শেষটায় একবার সাক্ষী থেকে নিঃশব্দে খালের ওপারে হাটে চলছে। যারা নায়ে আসা হাটুরে, তারা কিছুটা ভয়ে ভয়ে বৈঠায় চাড়ি দিয়ে নিবিড় কৌতূহলে ঘাটে বাঁধা কেরায়া নাওয়ের কাছ ঘেঁষে এগিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে—মোড়ানো হোগলার দৈর্ঘ্যে আঁটেনি বলে ডাকাত নয়, নায়ের পাটাতনে শক্ত-শীতল-স্থবির চারটে ধুলোমাখা থ্যাবড়া পা শুধু।
দুপুর হতে না হতে প্রখর রোদ চুঁইয়ে নামে। হাটবার বলেই তাপটা আরও তেতে ওঠে প্রতিটা গলিতে বিশেষ করে পেঁয়াজ-রসুন আর কামারপট্টির চিপায়। কিন্তু নদীর দিকটায় গাছের ছায়া। সেখানে ধানের ব্যাপারিরা পেটমোটা বিশাল বিশাল নাও থেকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে চেয়ার পেতে বসে হাওয়া খায়। ছোট্ট ছোট্ট ডিঙি ভরে আসে সোনা রঙের ধান। বেশির ভাগই আমন আর বালাম। কেনাকাটা যা করার, মহাজনের সাগরেদরাই করে তখন। হাটের দুদিন ছাড়া এদিকটায় শিলকড়ই আর অশথের ছায়ায় কাকপক্ষীও থাকে না। শুধু বেওয়ারিশ বাজারি কুত্তাগুলো এসে প্রগাঢ় আলস্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে নির্বিঘ্নে চোখ মুদে ঘুমায়।
কিন্তু আজ নদীর পার ঘেঁষে ধানবোঝাই নাওগুলোর দুপুর থেকেই ডুবুডুবু ভাব। সকাল সকালই এত ধান এসেছে, এখন আর দরদামে বুনছে না তেমন। না বুনুক, এ হাটে বেঁচতে পারল না যারা, পরের হাটে ঠিকই বেচবে বলে নিরাপদে নাও বেঁধে নেমে পড়ে। এখন গাঁটের পাকা পয়সা খুলে ভেবেচিন্তে দরদাম কষে তবে সদাইপাতি কিনতে হবে। কিন্তু এমন কেনাকাটায় কি হাউস মেটে? মিটবে না তো না মিটুক, গৃহস্থের পোলারা এমন হাউসের ঘাড় মারে না।
জাঙ্গালিয়া যেখানটায় বাঁক নিয়ে চিতলখালির দিকে ছুটেছে, সে বাঁকের পাঁজরে বদনীকাঠির মেয়াবাড়ি। কিন্তু মেয়ারা সব বিদেশে পাড়ি জমানোয় তাদের বর্গাচাষিরা ঘরবাড়ি বেঁধে থাকে। আবু হানিফও তেমন একজন বর্গাদার। খোরাকি চালাতে একটুখানি জমি সে চষে মেয়াদের। নদীর পাড়ে, হিজলগাছের ওপারে ধনচেখেতের পিছে ছনে ছাওয়া দুখানা ঘর তার। পাশেই দু-তিনটি ডোবা, ওতে মাছ মারতে গিয়ে এক হালি কাউঠ্যা পেয়ে বাড়ির উঠানে পলোর নিচে রেখে দিয়েছে আবু হানিফ। হাটবারে ও-কটা প্রাণেশকে দিয়ে খেউড়ি হবে, চুল ছাঁটাবে সে। প্রাণেশ গালে ক্ষুর চালাতে চালাতে গদগদ হয়ে বলবে, তোমার বউদি যা রান্দে, কী আর বলব, দাদা।
আবু হানিফও বেঁচে যাবে, কেননা কদুটা-কুমড়াটা আর দু-দশ সের চাল বেচা পয়সায় তো আর খেউড়ি হওয়া চলে না।
কিন্তু আজ ওই কাউঠ্যা আর কয়েকটা কুমড়া নিয়ে হাটে এসে কী গোলমালেই না পড়ল আবু হানিফ।
প্রথমে থানার ঘাটের বিপুল ভিড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই আবু হানিফের বুকটা বেদনায় মুচড়ে যায়। আর এমনই জিদ হয়, যেন পারলে ওই দুটোকে আবার টেঁটায় গাঁথে। আবু হানিফ ভাবে, ব্যাডারা যা জ্বালান জ্বালাইছে, চউক্ষ্যে দুয়ার দেওনের উপায় আলেহ! ভাবনার ভাবখানা এমন যেন, তার সর্বনাশ যা ছিল তা সব ওদের হাতে।
বেশি দিনের কথা নয়। গাঁওগেরামের রাতের গভীর অন্ধকারে ডাকাত পড়লে দলবলসহ রামদা-বল্লম নিয়ে হইহই করে তেড়ে গিয়েছিল তার বাপ। কিন্তু টর্চ জ্বেলে নিশানা খুঁজে গুলি করতেই মেয়াদের ধানখেতে লুটিয়ে পড়ে সে। কাদায় লেপ্টানো মুখটা ভোরের আলোয় আর মানুষের ছিল না, যেন কুমারের বানানো কোনো মূর্তির নিথর মুখ। এর পরও চার-চারবার ডাকাতের আক্রমণে মেয়ারা গ্রামের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেল।
ছেলেবেলায় বাপ বেঁচে থাকা অব্দি ফিবছর ভানাবে বলে নাও ভরে মেয়াদের ধান নিয়ে বাপ-বেটা আসত তারাবুনিয়ায়, নয়তো এই রাজাপুরে। কলে লাইন পেতে ভোররাতে রওনা হওয়া লাগত। মা এক হাঁড়ি পান্তা, কটা শুকনা মরিচ আর কিছুটা নারিকেল কুড়িয়ে দিত। খাওয়ার সময় হলে খুচইন জাল দিয়ে ভেসে চলা কচুরিপানার তলায় দু-একটা খ্যাও দিলেই উঠে আসত ছোট ছোট চিংড়ি। তুষের তাওয়ায় চিংড়ি আর শুকনা মরিচ পুড়ে সেই পান্তা খাওয়া যেন একটা নিয়মই হয়েছিল ওদের। সব ফেলে কেন যে এটাই মনে পড়ল তার, আবু হানিফ কি তা জানে? না জানলেও আজ এখানে দাঁড়িয়ে সেসব কাঁচা স্মৃতির ভারে ঝাপসা চোখও ধকধক করে জ্বলে ওঠে তার। বাপ গেল, মেয়ারা গেল, তার সব গেল, শালার ডাহাইত!
বেদেবহরটা বাঁধা ছিল গাঙের অপর পাড়ে। ঠিক পাড়ে নয়, পাড় থেকে একটু দূরে হোগলাবনের কাছাকাছি নিস্তরঙ্গ নিরাপদ জায়গায়। গৃহস্থরা ঘরে ফসল তুলেছে এখন। বছরের এ সময়টায়ই ওরা এদিকটায় আসে। বহরের সঙ্গে বাঁধা ডিঙিতে চড়ে ওদের একদল হাটে এসেছে তাগা-তাবিজ, গাছ-গাছড়ার পসরা সাজিয়ে, সাপখেলা দেখিয়ে দু পয়সা কামাবে বলে। অন্যদল, যাদের বেশির ভাগই মেয়ে, তারা গেছে গ্রামের পথে, বাড়ি বাড়ি বউ-ঝিদের কাছে। দক্ষিণের ভাটির দেশে যখন ওরা আসে তখন ভাটির মন বুঝে কথা সাজায়; উজানে যখন তখন উজানের। শহর আর গ্রামের পার্থক্যেও ওরা বেশ টনটনে। পুরুষানুক্রমে নাওবাসী বেদেরা যেমন পেশাদার তেমনই দলচেতন।
গেল হাটে আবু হানিফ তার বউয়ের জন্য কামরূপের একটা তাবিজ নিয়েছিল সাড়ে তিন টাকায়। প্রায় পাঁচ কেজি চালের দাম! সেদিন মনটা খচখচ করছিল তার। আজ আবার খেউড়ি-টেউড়ি হয়ে এসে হাউসের পোলা সাপে খাওনের কেচ্ছা শুনতে শুনতে আনমনে ভাবছিল তার ঝিমিয়ে পড়া সংসারটার কথা, আজাইড়া খাটাখাটনির কথা। তবু বাঁজা বউটার জন্য কেমন দরদ জাগে আবু হানিফের। ডাক্তার-বৈদ্য সে কম করে নাই। আর বংশডাই যে তার কেমন, হেয়ও তো বাপের একমাত্র পোলা। বাপও ছিল দাদার একমাত্র সন্তান। বংশভইরা পোলাপান না থাকলে সমাজে জোর থাহে? এমন আবোলতাবোল ভাবনা ফুঁড়ে কড়ইতলা বরাবর গাঙপাড়ে একটা জটলার গোল উড়ে এলে আবু হানিফ উঠে দাঁড়ায়। শুধু সে নয়, সাপ খেলার মেলা ফেলে সেদিকে ছোটে অনেকেই।
গাঙের হেই পাড়ে বাইদাদের নাওয়ের ওই দূরে কার মাথা দেখা যায়? ক্রমে ক্রমে স্রোতের তোড়ে জলের ওপর বসে ভেসে আসে ও কে? এক হাট মানুষের যে আকুলতা, তাতে মনে হয় যেন কত যুগের চেনা মানুষ আজ মানুষের কাছে এসেছে! ওর পেছন পেছন এগিয়ে আসছিল দুখানা ধানের ডিঙি। বেদেবহর ছেড়ে ভাসমান মানুষটি এগিয়ে একেবারে তেমাথার ঘূর্ণিতে আসি আসি। এ সময় আর একটি নাও থেকে লাফিয়ে পড়েছে কে একজন! বলতে গেলে কীর্তিমান সেই সাঁতারু বগলদাবা করে ভাসমান মানুষটিকে ধীরে ধীরে তীরের দিকে নিয়ে আসতে চায় কিন্তু জলে কি অবিরল স্রোত আর উদ্ভ্রান্ত পাক!
এরই মধ্যে দেখতে না-দেখতে নাওয়ে নাওয়ে গাঙ ভরা মানুষ। তাদের উদ্বেগ, আকুতি, ভক্তি আর উল্লাসের কাঁধে চেপে জল থেকে ওঠা বিবস্ত্র ভেজা মানুষটি যখন লম্বা দাড়ি আর বাবরি চুলের ফাঁকে দর্শন দিলেন, তখন কে কাকে দেখে? কে বোঝে কার কথা? বাবার মুখেও কোনো রা নেই। উনি কথা তো বলেনই না, কোনো ইশারাও দেন না। কুক্কার লাল চোখ নিয়ে নির্নিমেষ শুধু তাকিয়ে থাকেন। আবু হানিফও তখন বেদিশা। এর কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে, ওর মাথা তার ঘাড়ের ফাঁক গলে, প্রবল চাপে চ্যাপ্টা হতে হতে উঁকি দিয়ে একনজর মাত্র দেখতে পায় ফকির বাবাকে। কিন্তু মন ভরে আর দেখা হয় না তার। পেছন থেকে শার্টের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে প্রায় চ্যাংদোলা করে আবু হানিফকে জনস্রোত থেকে বার করে আনে এসহাক। বাল্যবন্ধুর আচরণে মেজাজ খিঁচে গেলেও নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো খোলা জায়গায় এসে আবু হানিফ খোশ না হয়ে পারে না। বলে, দোস্ত, কহোন আইলা?
এই তো আইলাম, কিন্তু তুমি হুমড়ি খাইয়া কী দ্যাহো? ল্যাংডার ধোন দ্যাহো?
এ কথায় ছ্যাঁক করে জিভ কাটে আবু হানিফ, কও কী? বাবার কথা কেডা না জানে? খানজাহান আলীর মাজার, বারো আউলিয়ার দরগা, শাহজালাল-শাহ পরান-শাহ মখদুম কোনহানে না হের কথা অয়! তয় তেনার দেহা পাওয়া… এইডা ভাগ্যের ব্যাপার।
শরীর জাপটে ধরতে না পেরে তাতানো রোদের ঝাঁজ গাঙের হাওয়ায় উড়ছে। এসহাক পকেট হাতড়ে বিড়ি ধরায়। ছয়-সাত বছর ধরে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি করা ছেলে। পাইত্রাবন আর গইয়া বাগানে লুকিয়ে লুকিয়ে যে সেয়ানা হয়েছে সে কি আর ভাগ্যটাগ্য বোঝে? বলে, চোদনা, এত্তো বুঝাইলাম, কিছুই বুঝলি না, পানিতে ভাইস্যা বেড়ায় একটা মানুষ, ওর মন চায় ও ভাইস্যা বেড়ায়। ওর কাম কী ক দেহি? যার কাম নাই হের দাম আছে?
এসব কম শোনেনি আবু হানিফ, বন্ধু হলে কি সব কথা মানতে হবে? রক্ষীবাহিনীর চোদন খেয়ে ঝোপঝাড়ে জঙ্গলে মশার কামড় যখন খেয়েছে, তখন সাঙ্গোপাঙ্গসমেত তার বাড়িতে সে জায়গাও তো দিয়েছে। তখনো রাইত-বিরাইতে এসব সে কম শোনে নাই। বিশ্বাসে আঘাত লাগে এমন কথা মন থেকে মানতে পারে না আবু হানিফ। বলে, কার মনে কী আছে, দোস্ত, কেডা জানে! তোমার বিশ্বাস ভাইঙা গেছে। তুমি কম্যুনিস্ট। আল্লা-রসুল মান না। তোমার কথা আলাদা। এইডা পীর-পয়গম্বরের দ্যাশ, অলি-আউলিয়ার দ্যাশ, মনে বিশ্বাস না থাকলে চলে? বিশ্বাসের জোরই তো মনের জোর।
যা হোক, এসহাক এ নিয়ে আর কথা বাড়ায় না। ওদিকে ল্যাংটা বাবাকে ঘিরে উত্সব লেগে গেছে তখন। কে বাবার কতটুকু কাছে যেতে পারে, রীতিমতো লড়াই যেন। সেদিকে আর না গিয়ে আবু হানিফ বন্ধুকে নিয়ে কাপড়পট্টির সালুঘেরা দোকানে ঢুকে বেছে বেছে একখানা গামছা কেনে শুধু। কিছু সদাই কিনে আগেই প্রাণেশের দোকানে রেখেছিল। গোটা হাট মাড়িয়ে আবার এদিকে এসে গরম চায়ে টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে খায় দুজনে। আর গপ্পো করে। যত গপ্পোই করুক, জোড়া খুনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ল্যাংটা বাবার ছবি আবু হানিফের মন থেকে সরে না কিছুতেই।
ফিরতি পথে তাতানো গরমটা বেজায় কষ্ট দিয়েছে! বউ ঠিলা থেকে ঠান্ডা জল এনে দিলে আবু হানিফ ঘরের বারান্দায় পিঁড়িতে বসে ল্যাংটা বাবার গল্প পাড়ার আগেই জোড়া খুনের যাবতীয় কাহিনী সংক্ষেপে বলে নেয়।
ঠিলার ঠান্ডা জলে তেষ্টা মিটিয়ে হাটের তরতাজা গপ্পে মাতলেও আতালে ফেরা গরুর খুড়ায় ধুলাওড়া সন্ধ্যা অগ্রাহ্য করবে কী করে গৃহস্থের পোলায়? উঠানে টানানো গুনা থেকে গামছাটা টেনে কোমরে পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়ে আবু হানিফ। গরু-ছাগলগুলো ঠিকঠাক বেঁধে, খৈল দেওয়া চাড়ির জাবনা ঘেঁটে তবে যায় নদীর ঘাটে, নেয়েটেয়ে বাদে বাড়ি ফিরবে সে। ঘাটের অশথে, হিজলে, বটে ঘরে ফেরা পাখিদের খ্যাঁচখেঁচিতে কান ঝালাপালা। প্রতিদিন এমন কোলাহলে আবু হানিফ মজা পায় বেশ, কেমন একটা শোর ওঠে তার কানে। ক্রমে ঘনিয়ে ওঠা অন্ধকারের ওপার থেকে ধীরলয়ে নেমে আসে স্তব্ধতা, আবু হানিফ তখন পথ ঠুকে ঠুকে ঘরে ফেরে। কিন্তু আজ নদীর পানিতে নেমেই তার চোখ যায় দূরে একগোছা পানার কোল ঘেঁষে ভেসে আসা বস্তুটায়। নিজের চোখেও আর বিশ্বাস রাখতে পারে না সে। গোমস্তাপুর খালের মুখ থেকে সাউদপুরের ঘোপ পেরিয়ে প্রায় তিন মাইল পথ গাঙের জলে ভেসে হাটের বাবা এখন এই ঘোর সন্ধ্যায় তাদের ঘাটে? কোনোদিকে না তাকিয়ে লুঙ্গিটা মালকোচা বেঁধে ঝপাত করে গাঙে লাফিয়ে পড়ে আবু হানিফ। জোয়ারের সময় হয়েছে বলে সরভাসা জলে স্রোতও থমথমে। ওনাকে তীরে আনতে তেমন বেগ পেতে হলো না তার। পায়ের নিচে মাটি পেয়ে বুকপানিতে খামি আঁটতে আঁটতে দাঁড়ায় আবু হানিফ। ওর ডান হাতে গলা পেঁচিয়ে ধরা বাবার, গরিবের ঘরে যদি এট্টু পাড়া দেতেন। কান্ধে কইরা নিমু আপনেরে।
অকস্মাত্ যেন আকাশ থেকে বাণী বয়ে আনে বাবায়, বাগবিমুখের কণ্ঠে কীভাবে যে কথা ফোটে! খাওয়াবি? অনেক ক্ষিদা রে…
ব্যস, এটুকুই। আবু হানিফের পৃথিবী ঘোলা হয়ে যায়। কী যে করবে সে, ভাবনায় বুদ্ধিতে আর কুলায় না তার। এতক্ষণে ধেয়ে এসেছে অন্ধকার, চারদিকে পোকার ডাক আর ব্যাঙের ঘুড়ুতঘাড়ুত। ওজন বওয়ার অভ্যাস থাকলেও ধনচেক্ষেত পার হয়ে এসে ঘরের বারান্দায় উঠতে উঠতেই হাঁপিয়ে ওঠে আবু হানিফ। বাবার গায়ের মাছুয়া গন্ধটা নাকের কাছে সুরসুর করে। এ ঘরে খেজুরপাতার একটা চাটাই পাতা থাকে, খেয়েদেয়ে এসে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খায় সে। বাবাকে ওখানে বসিয়ে আলো আনতে রান্নাঘরে ছোটে আবু।
হাটের জিনিসপত্র গুছিয়ে কুপির আলোয় চুলো থেকে ভাত নামিয়েছে কেবল মোমেনা। স্বামীর কাছে যেটুকু শুনেছে তাতেই ভারি কৌতূহল তার। চুলার জ্বালটা সামলে নিয়ে অন্ধকার উঠানে এসে বেড়ার ফাঁকে চোখ রেখে দাঁড়ায় সে।
ঘরে হারিকেন জ্বলছে। ম্যাড়মেড়ে আলোর সামনে আসন পেতে বসে আছেন বাবা, চোখ মুদে মাথা নিচু করে গভীর ধ্যানতায় ডোবা। চুলদাড়িতে ঢাকা তার চেহারা দেখা না গেলেও আবু হানিফের চোখে ঘোর। চিমনির পেটের নরম আলোর ওপর উপচে পড়া বাবার দেহের বিভায় আচ্ছন্ন সে। আচমকা বেড়ার ওপারে বউয়ের পায়ের শব্দে ঘোর ভাঙে তার। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আবু হানিফ ফিসফিসিয়ে বলে, ভালোমন্দ যা রানছ, তড়াতড়ি দ্যাও। প্যাটভরা ক্ষিদা বাবার।
বউ বেড়ার ফাঁকে আবারও চোখ রেখে আঁতকে ওঠে। আবু হানিফের কানের কাছে মুখ এনে বলে, আপনের বাবায় দেহি উদলা!
এ কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না আবু হানিফ। বউকে চাপা ধমক লাগায় সে, বেলাজ নজর দেহি! তেনারে থুইয়া উদলায় চউখ গ্যালো তোমার?
নিজের আহাম্মকিতে ভয় পায় মোমেনা। স্বামীকে নিয়ে ধীর পায়ে রান্নাঘরে যায়। ঠান্ডা তরকারির পাতিলটা চুলায় চাপিয়ে গরম ভাত বেড়ে দিতে দিতে বলে, ডাক্তার-বৈদ্য, তাগা-তাবিজ তো কম করলেন না। আন্ধার ঘরে বাবায় যহন আইছে তেনারে কননা এট্টু।
আবু হানিফ বউকে বলে না কিছু। ভাতের থালা আর পানির জগ নিয়ে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে আসে।
রাত এখন গভীর। খেয়েদেয়ে আবু হানিফের কাঁধে চড়ে এসে গাঙভরা জোয়ারের জলে নেমে গেলেন বাবা। ওপারের পানের বরজে শেয়ালের হল্লা। বাড়ি বাড়ি কুপির আলো তখনো মিটমিট করছে। তীরে দাঁড়িয়ে ফুসফুস ভরে নদীর বাতাস নেয় আবু হানিফ। ছোট ছোট ঢেউয়ের ভাঁজে জলের ছায়া ছাড়া অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না, তবুও অনেকক্ষণ এখানে থাকে সে। টের পায় শরীরজুড়ে কাঁধ থেকে নামানো একটা উদোম মানুষের ভার। সেই ভার আর সরে না কিছুতেই। না সরুক, গায়ে তার জোয়াল ঠেলার ক্ষমতা। প্রাণভরা উদ্যম নিয়ে ঘরে ফেরে আবু হানিফ। হারিকেনের আলোটা নামিয়ে কোলে করে মোমেনাকে চৌকিতে তুলে নেয়। গোয়ারের মতো গা ভরা ভার বউয়ের ওপর ঝেড়ে চৌকির শীতল পাটিতে পাশ ফিরে শোয় সে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৫, ২০১০
Leave a Reply