ইতিহাসচর্চায় নতুন সংযোজন
মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস— গোলাম মুরশিদ, জানুয়ারি ২০১০, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপর লেখা একটি বই হাতে পড়ল সম্প্রতি। বইটির নাম মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস এবং লেখক গোলাম মুরশিদ, যাঁর মধুসূদন দত্তের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে লেখা আশার ছলনে ভুলি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। এ গ্রন্থটিও একান্ত ঝরঝরে ভাষায় লেখা এবং তথ্যবহুল ও অন্তর্দৃষ্টি সমৃদ্ধ।
মুরশিদ বইটিতে ইতিহাস বলে গেছেন ধারাবাহিকভাবে, চারটি মূল পর্বে ২৬টি ছোট ছোট অধ্যায়ের মধ্যে। শুরু করেছেন প্রাক-ইংরেজ যুগ থেকে এবং শেষ করেছেন জিয়াউর রহমানের তিরোধানকালে এসে। উপসংহারে অবশ্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সুবিধাবাদী রাজনীতির ওপরও কিছু ধারালো মন্তব্য আছে।
বইটির মূল থিম বাংলাদেশের জন্ম হলেও এটার জোর পড়েছে কীভাবে বাঙালি মুসলমান তার পরিচিতি-সংকট কাটিয়ে উঠে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কায়েম করল। হিন্দু-মুসলমান দ্বান্দ্বিকতাপূর্ণ সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আলোচনা এগিয়েছে। ইংরেজরা ভারতে প্রতিষ্ঠা পেলে শুরুতে কলকাতার উচ্চবিত্তের হিন্দুরা ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করে ব্যবসা, চাকরি ও শিক্ষায় এগিয়ে যায়, কিন্তু মুসলমানেরা ইংরেজ-বিরোধিতা ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ না করাতে পিছিয়ে থাকে। তবে ইংরেজি ভাষা দ্বিবিধ ফলার মতো কাজ করল। কারণ, ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের ফলে হিন্দুদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধেরও উন্মেষ হয়। তারা রাজনৈতিক অধিকার দাবি করে। ভারসাম্য আনার জন্য ইংরেজরা ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি গ্রহণ করে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের কিছু রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হিন্দুদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করায়। আগে যেখানে বঙ্গীয় আইন সভায় সদস্য হতো মেধা ও পারিবারিক আভিজাত্যের ভিত্তিতে, সেখানে ইংরেজরা মুসলমানদের জন্য আসন নির্ধারণ করে দেয় জনসংখ্যার অনুপাতের হারে। ফলে মুসলমানেরা পূর্ববঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়। কিন্তু যে সমস্যাটা হিন্দুদের জন্য ছিল না, সেটা বাঙালি মুসলমানের জন্য হলো। মধ্যবিত্ত ও সাধারণ বাঙালি মুসলমান দেখল যে তাদের ভালোমতো একটা পরিচিতি-সংকট যাচ্ছে। তারা কারা? তাদের ভাষা কী? তারা কি বাঙালি নয়, তাদের ভাষাও কি বাংলা নয়? উচ্চবিত্ত ভারতীয় মুসলমানদের এ সংকট ছিল না, যেহেতু তাদের ভাষা বাংলা ছিল না। সাধারণ বাঙালি মুসলমানেরা ক্রমে অনুধাবন করল যে বাংলাই তাদের ভাষা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখ এ বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সৈয়দ এমদাদ আলী ১৯১৮ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মিলনে সভাপতির ভাষণে বললেন: ‘দুনিয়াতে অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে। “বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দ্দু না বাঙ্গালা?’ এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা অদ্ভুত।’
মুরশিদের সঙ্গে এ পরিপ্রেক্ষিতে আহমদ ছফার চিন্তাশীল গ্রন্থ বাঙালী মুসলমানের মন-এ প্রদত্ত বক্তব্যের পার্থক্য আছে। ছফা পুরো বিষয়টাকে নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে রায় দিয়েছিলেন যে বাঙালি মুসলমান হলো বেশির ভাগ নিম্নবর্ণের হিন্দু গোষ্ঠী থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান, সে জন্য তাদের মধ্যে কখনো নেতা জন্মায়নি এবং রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। তাদের মধ্যে সে জন্য জাতীয়তাবোধও জাগ্রত হতে পারেনি। পক্ষান্তরে মুরশিদ বলছেন, ইংরেজি সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে হিন্দুদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হলেও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে ভাষা সংক্রান্ত চেতনা দৃঢ় হয় ইংরেজ কর্তৃক তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পর।
তার পরও ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয় ধর্মীয়ভাবে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। দ্বিতীয় ভাগের এ আলোচনায় মুরশিদ ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে ভাষার প্রশ্নটাই মৌলিক ইস্যু হয়ে দেখা দেয়। জিন্নাহ্র ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্টভাষা’—এই অবিবেচক উক্তিটি অবশ্যম্ভাবীরূপে একুশে ফেব্রুয়ারিকে অনিবার্য করে তোলে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অভিঘাত তখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের দাবিতে রূপান্তরিত হয়। তার পরও পাকিস্তান সরকার আরবি, উর্দু এমনকি ইংরেজি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করে একের পর এক। যা হোক, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন দ্রুত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। স্বৈরশাসক আয়ুবের সঙ্গে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংঘাতের নিটোল বর্ণনা দিয়ে মুরশিদ তৃতীয় ভাগে আলোচনায় আসেন মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে।
পঁচিশে মার্চের রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার, অপারেশন সার্চলাইট, তাজউদ্দীনসহ অন্য নেতাদের কলকাতায় গমন, মুক্তিযুদ্ধের শুরু, মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার গঠন, খন্দকার মোশতাক, শেখ মণি ও কিছু নেতার তাজউদ্দীনবিরোধিতা—এসবের যেমন উল্লেখ আছে, তেমনি আছে শরণার্থীসমস্যা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের উদ্বেগ এবং তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির সফল প্রচেষ্টা। এই তৃতীয় ভাগেই মুরশিদ স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে স্পষ্ট বলেন যে জিয়ার ঘোষণাটি ঐতিহাসিক হলেও বেলাল মোহাম্মদ যদি ২৭ মার্চ কালুরঘাট থেকে জিয়াকে ডেকে নিয়ে না আসতেন, জিয়া রেডিওতে আসতেনই না। এর আগেই এম এ হান্নান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। জিয়ার প্রতি ভাগ্যদেবী প্রসন্ন থাকার ব্যাপারে মুরশিদ ১৯৭৫ সালের সাতই নভেম্বর কর্নেল তাহের কর্তৃক জিয়াকে মুক্ত করে আনার ব্যাপারটিও উল্লেখ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ের সক্রিয় অপারেশনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মুরশিদ মনে করেন, মেজর রফিকুল ইসলাম, মেজর জিয়া, মেজর খালেদ মোশারফ বা মেজর আবু ওসমান যেমন ত্বরিত মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন, সে রকম কিন্তু ঢাকার খুব কাছে থেকেও মেজর শফিউল্লাহ করেননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে তিন দিন সময় নেন এবং শফিউল্লাহর সেক্টরই ছিল একমাত্র সেক্টর, যেখান থেকে কোনো মুক্তিযোদ্ধা কোনো খেতাব পাননি। এ প্রসঙ্গে মুরশিদ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সময় সকালে শেখ মুজিবের টেলিফোন পেয়েও যে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ত্বরিত কোনো ভূমিকা রাখেননি, সে কথারও উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে জেনারেল ওসমানী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ওসমানকে পছন্দ করতেন না বলে তাঁকে তাঁর বীরত্বের জন্য কোনো খেতাব দেননি। অর্থাত্ মুক্তিযোদ্ধাদের পুরস্কার সব সময় ন্যায্য জায়গায় পৌঁছায়নি।
গেরিলাযুদ্ধের বিশদ বিবরণ আছে। বদি, রুমি প্রমুখ গেরিলার বিভিন্ন অপারেশনের যেমন উল্লেখ আছে, তেমনি আছে সম্মুখযুদ্ধের বর্ণনা, আর তেমনি আছে ‘গৃহবধূ’ জাহানারা ইমামের স্মৃতিচারণা থেকে উদ্ধৃতি ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্রে’র উল্লেখ। এবং মুরশিদের এ ধারণার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবোদ্ধারা একমত হবেন যে গেরিলাযুদ্ধের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় ও তাদের মনোবল দারুণভাবে মার খায়। সে জন্য ডিসেম্বরের যুদ্ধে তারা অত সহজে হার মানে।
চতুর্থ ভাগে আছে বাংলাদেশ হওয়ার পর স্বপ্নভঙ্গের বিবরণ। শেখ মুজিব সম্পর্কে বলছেন, তিনি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের কিছুই দেখেননি, তাঁর উচিত ছিল তাজউদ্দীনকে জিজ্ঞেস করা। কিন্তু শেখ মুজিব সেটা একবারও করেননি; করেছিলেন তাজউদ্দীনের বিরোধিতা যারা করেছিলেন তাদের। ফলে শেখ মুজিব এমন লোক দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লেন, যারা তাঁর মোসাহেবি করেছে, কিন্তু তাঁকে একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করে (যেমন বাকশাল গঠন) জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেন। তিনি তাজউদ্দীনকে ঠেলে দেন আর খন্দকার মোশতাককে কাছে টানেন। এ ব্যাখ্যার আলোকে বলা যায়, শেখ মুজিবের এ ভুলটা এখনকার শাসকদেরও অনুধাবন করা উচিত। ইংরেজ লেখক ফ্রান্সিস বেকন তাঁর ‘অব গ্রেট প্লেস’ (১৬১২) শীর্ষক রচনায় যেমন বলেছিলেন, একজন শাসক ক্ষমতায় গেলে নিজের প্রশংসা শুনতে চাইলে তার লোকের অভাব হবে না।
মুরশিদের গ্রন্থটি নিয়ে আমার একটি পর্যবেক্ষণ আছে। সেটি হলো চতুর্থ ভাগে শেখ মুজিব ও জিয়ার চরিত্র চিত্রণসহ ফারুখ, রশিদদের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করেছেন তিনি সম্পূর্ণ অ্যান্টনি মাসকারেনহাসের আ লিগেসি অব ব্লাড (১৯৮৬) গ্রন্থটির অবলম্বনে। সেটি ঠিক আছে, তিনি সূত্রও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শুধু যে তিনি তথ্যগুলো নিয়েছেন তা নয়, মাসকারেনহাসের নিজস্ব মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্তগুলোও (যেমন মাসকারেনহাসের শেখ মুজিব ও জিয়ার রাজনৈতিক চরিত্র চিত্রণ: বিশেষ করে তাজউদ্দীন সম্পর্কে শেখ মুজিবের ধারণা বা কালো চশমার পেছনে জিয়ার সাপের মতো ঠান্ডা ক্রুর চোখ) তাঁর সিদ্ধান্ত হিসেবে এসে গেছে। আমরা জানি, একজনের ভাব আরেকজন অনুবাদ করলেই সেটা নিজের হয়ে যায় না।
দ্বিতীয় কথাটি হলো, পাকিস্তানি সামরিক লেখক সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার বইটির উল্লেখ বারবার এসেছে, কিন্তু বইটির আসল মজা হলো, এটি পড়ে জানা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কী রকম ভয়ের মধ্যে দিন কাটাত।
তৃতীয় হলো: ১৬০-সংখ্যক পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ছবিতে অরোরা আর নিয়াজির বাঁ পাশে তেজোদীপ্ত পদক্ষেপে আগুয়ান যুবকটি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ টি এম হায়দার, যিনি কে ফোর্সের অধীনে বহু মক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেন, যিনি প্রথম ষোলোই ডিসেম্বর সকালে ঢাকা টিভিতে দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেন এবং যিনি দুর্ভাগ্যজনকভাবে খালেদ মোশাররফসহ শেরেবাংলা নগরে কাউন্টার ক্যুতে নিহত হন। তাঁর নামটি ফটো ক্যাপশনে থাকতে পারে।
মোহীত উল আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৫, ২০১০
Leave a Reply