দেশের কয়েকজন লেখকের সঙ্গে কথা হয় মূলত তিনটি বিষয়ে—মেলায় নিয়মিত যান কি না, কী বই বেরিয়েছে বা বেরোবে এবং মেলার পরিসর সম্পর্কে আপনি কী ভাবছেন। তাঁদের মন্তব্য এখানে ছাপা হলো
আবুল হোসেন কবি
আমার অনেক বয়স হয়েছে। ভিড়ের মধ্যে বইমেলায় যেতে পারি না। বাসায় থেকেও বইমেলা খুব অনুভব করি। প্রথমা থেকে বের হয়েছে আমার কবিতার বই যাবার আগে। নিজের কবিতার পাশাপাশি কিছু অনুবাদ-কবিতাও তাতে থাকবে।
বইয়ের জন্য আমি প্রকাশকদের কাছ থেকে রয়্যালটি পাই। তবে মাঝেমধ্যে প্রকাশকদের মনে করিয়ে দিতে হয়। আমি মনে করি, দিনে দিনে বইয়ের লেখক ও প্রকাশক বাড়ছে। সে অনুযায়ী মেলার আয়োজনটা তেমন বড় নয়। মেলাকে আরও সমৃদ্ধ, আরও পরিচ্ছন্ন করা প্রয়োজন।
হাসান আজিজুল হক কথাশিল্পী
আমি বইমেলায় ঘুরতে যাব। অবশ্যই যাব। অসম্ভব ভিড়ে সব বই ঠিকমতো দেখতে পারি না। বইমেলায় অনেক কিছু সুশৃঙ্খলভাবে হয় না। মেলায় নানা মানুষ আসে, বাংলা একাডেমী চত্বর উত্সবে পরিণত হয়। আর আমি তো বইমেলাকে সামনে রেখে বই তৈরি করি না। গেল বছর ইত্যাদি থেকে বের হয়েছিল আমার আত্মজীবনীমূলক রচনা ফিরে যাই ফিরে আসি। এবার ইত্যাদি থেকে বেরিয়েছে তিনটি উপন্যাসের একটি সংকলন।
রয়্যালটি ঠিকমতো পাই না। এ ব্যাপারে প্রকাশকেরা নিয়মনীতি মেনে চলেন না। তা ছাড়া প্রকাশকদের মধ্যেও ভালোমন্দ আছেন। বই প্রকাশ করার পর অনেক প্রকাশক লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগও করেন না। বইমেলার ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাড়ানো দরকার। কারণ গ্রন্থজগত্ জাতিকে এগিয়ে নেয়।
সৈয়দ শামসুল হক
কবি, কথাশিল্পী
আমি তো বইমেলায় নিয়মিত যাই। এবার শুরুতেই গেছি। তবে আগের মতো বেশি যাওয়া হবে না। আমি মনে করি নতুনদের সুযোগ দেওয়া দরকার। তাদের সম্মিলনে আমাদের মননের চর্চা বৃদ্ধি পাবে। প্রথমা প্রকাশনী বের করেছে কবিতার বই নিনাদ, পাঞ্জেরি বের করছে ভালোবাসার দিন।
রয়্যালটির ব্যাপারে আমাকে আজও তাগাদা দেওয়া লাগে। তবে আমরা লেখা শুরু করার পর অনেক সময় গেছে, অনেক কিছু বদলেছে। অনেক আশার সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশের উন্নতি হয়েছে। অনেক শিক্ষিত ও তরুণ প্রকাশক এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আমাদের দেশে মানসম্পন্ন বই বের হচ্ছে। তবে আমাদের প্রকাশনাশিল্প আজও পেশাদার হিসেবে গড়ে ওঠেনি। কোটি কোটি টাকা লগ্নি করেও এ শিল্পকে ইন্ডাস্ট্রি বলা হচ্ছে না। আজও দেশের বড় ব্যবসায়ীরা প্রকাশনাশিল্পে অর্থ লগ্নি করেন না।
আমি মনে করি কঠোর নিয়ম মেনে বাংলা একাডেমী বইমেলার স্টল বরাদ্দ দেওয়া দরকার।
রফিকুল ইসলাম
প্রাবন্ধিক-গবেষক
অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অন্যতম অংশ। বইমেলায় আমি নিয়মিত যাই। নতুন কী বই এল, প্রবীণ-নতুনদের কে কী লিখল এ জন্য উত্সুক থাকি। ফ্রি থাকলে মেলায় যাই, প্রয়োজনীয় বই কিনি। এবার বাংলা ব্যাকরণ সমীক্ষা নামে আমার একটি বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বের করছে গ্লোব লাইব্রেরি। এ ছাড়া আমাদের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী থেকে নজরুল রচনাবলি ১১তম খণ্ড বের হচ্ছে।
প্রকাশকেরা বইয়ের রয়্যালটি ঠিকমতো দেন না। হয়তো দু-চারজন জনপ্রিয় লেখক রয়্যালটি ঠিকমতো পান। আমার মতো সাধারণ লেখক পান না।
কয়েক বছর ধরে প্রশ্ন উঠছে, বইমেলার জায়গাটা খুব কমে গেছে। বইমেলার জন্য আণবিক শক্তি কমিশনের জায়গাটা দিলে সমস্যা সমাধান হতে পারে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে।
আবুল আহসান চৌধুরী গবেষক
বাংলা একাডেমীর বইমেলার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা যখন মেলার সূচনা করেছিলেন তখন থেকে। একুশে বইমেলা বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষা আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে জড়িত। এবার প্রথমা প্রকাশন সুফিয়া কামাল: অন্তরঙ্গ আত্মভাষ্য, শোভা প্রকাশনী অবিদ্যার অন্তপুরে, পাঠক সমাবেশ থেকে কবির অন্তরমহল: উনিশের কবিদের চক্রাবলী, মনন প্রকাশনীর বাংলার লোকসংস্কৃতির চালচ্চিত্র এবং ইত্যাদি প্রকাশনীর হুমায়ুন কবীর জন্মবর্ষ স্মরণ বের করছে।
কেবল বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত বইয়ের রয়্যালিটি পাই। অন্য প্রকাশনীর ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা তিক্ত। রয়্যালিটির ব্যাপারে আমাদের প্রকাশকরা নানা অজুহাত দেখায়।
একুশে বইমেলার পরিসর দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমীর অট্টালিকা হচ্ছে। সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় স্টল বরাদ্ধ দেওয়া হয়। দিনে দিনে প্রকাশক, লেখক বাড়ছে। আমি মনে করি কেবল গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনীর বই নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে বইমেলা করা প্রয়োজন।
শান্তনু কায়সার প্রাবন্ধিক
৫ ফেব্রুয়ারি মেলায় থাকবো। আলোচনা সভায় প্রবন্ধ পড়ব। তা ছাড়া অন্যান্য দিন সময় পেলে বইমেলায় যাব। মেলায় জনপ্রিয় বইয়ের নামে একটা হুজুক তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো স্টলে ঢুকতে পারি না। ফলে উত্সাহ হারিয়ে ফেলি। অটোগ্রাফ শিকারির একটা ব্যাপার থাকে, যা মেলার চরিত্রকে নষ্ট করে। এটা বন্ধ করা দরকার। এবার আমার গল্পগ্রন্থ অর্ধ শতাব্দী বের করছে পাঠসূত্র।
আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রকাশক লেখকদের সঙ্গে বই নিয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেন না। রয়্যালটিও ঠিকমতো দেওয়া হয় না। ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য বই প্রকাশ করেন। অথচ বাংলা একাডেমীর বইমেলার পথিকৃত্ চিত্তরঞ্জন সাহা একসময় লেখককে নিয়ম অনুয়ায়ী সম্মানী দিতেন।
বাংলা একাডেমীতে বইমেলার জন্য স্থানসংকুলানের ব্যাপারটি এখনই ভাবতে হবে।
আলতাফ হোসেন কবি
শনিবার প্রথম মেলায় যাব। বইমেলায় যেতে অবশ্যই ভালো লাগে। এটা আমাদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক উত্সব। প্রতিবছর এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করি। মেলায় অনেক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয়। নবীন লেখকদের বই কিনি, তাদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হই। এ বছর শুদ্ধস্বর বের করছে প্রবন্ধগ্রন্থ যুবক রবি ভিন্ন রবি ছিন্নপত্রে।
আমাদের প্রকাশকেরা পেশাদারি মনোভাব নিয়ে বই প্রকাশ করতে কম উত্সাহী। একসময় মুক্তধারা নিয়মিত রয়্যালটি দিত। বছর শেষে লেখককে বইয়ের হিসাব দিত। এখন বড় প্রকাশকেরা রয়্যালটি ঠিকমতো দেন না।
বাংলা একাডেমীতে নতুন ভবন নির্মিত হচ্ছে এ জন্য মেলার জায়গা কমে গেছে। এত ভিড় হয় যে অনেক সময় ভিড় ঠেলে প্রয়োজনীয় বই কিনতে পারি না। মেলাটাকে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত কর গেলে ভালো হয়।
শাহীন আখতার কথাশিল্পী
বইমেলায় কবে যাব এখনো জানি না। নিজের নতুন বই আসার দিন মনে হয় যাব। আমার তৃতীয় উপন্যাস সখী রঙ্গমালা এবার বেরোচ্ছে প্রথমা থেকে। তালাশ উপন্যাস ছাড়া অন্য কোনো বইয়ের রয়্যালটি আমাদের এখানে পাই না। আমার সম্পাদিত বই জানানা মহফিল—মুসলমান লেখিকাদের নির্বাচিত রচনা (১৯০৪-১৯৩৮)-এর ভারতের প্রকাশক বছর বছর হিসাব-পত্তর করে রয়্যালটি পাঠান। বইটির ইংরেজি সংস্করণেরও রয়্যালটি পাচ্ছি।
মেলার পরিসর এত কম! ভিড়-ভাট্টা তো আছেই। একুশে বইমেলার একটাই ভালো দিক—এখানে পাঠক আসে বিস্তর। বছরের এই একটি মাস মানুষ বই কেনার, বই সংগ্রহের কথা ভাবে। নানামুখী প্রচারের মধ্য দিয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া একটা বই বই আবহ তৈরি করে রাখে পুরো মাস। তবে মেলাকে কেন্দ্র করে পাঠকের রুচির মান বাড়ানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ পাঠকই নামী লেখকদের নাম ধরে বই কিনতে আসে। তারা উত্কৃষ্ট বইয়ের হদিস পায় না।
মেলার পরিসর বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। মেলা প্রাঙ্গণে বইপত্র নিয়ে বেশি বেশি আলোচনার ব্যবস্থা থাকা দরকার। লেখক-পাঠকদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য একটা কর্নার থাকতে পারে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও এ সময় বই নিয়ে আলোচনা ও বই রিভিউ ইত্যাদির আয়োজন করতে পারে।
—হাসান শেখ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৫, ২০১০
Leave a Reply