কাজী গিয়াসউদ্দিনকে নানা কারণে নিঃসঙ্গ এক শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে জাপানপ্রবাসী এই শিল্পী সময় ধরে নিজ দেশের শিল্পকলার জগত্ থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। যদিও বাংলাদেশে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেশের আত্মপ্রকাশের আগে, ১৯৭০ সালে। এরপর দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে কোনোরকম প্রদর্শনী আয়োজনের উদ্যোগ তিনি আর নেননি। নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার সেই পর্যায়ে তাঁর নিঃসঙ্গ পরিক্রমণ অনেকটা যেন ছিল আত্মানুসন্ধানের এক পর্যায়ে, যখন তিনি নিয়োজিত ছিলেন ছবি আঁকার নিজস্ব ফর্ম ও স্টাইল ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার সন্ধানে।
সেই নীরবতা ভেঙে ১৯৯৩ সালে নতুনভাবে তিনি দেশের শিল্পকলার ভক্তদের সামনে আবারও উপস্থিত হন শিল্পকলা একাডেমীতে আয়োজিত এক প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। ততদিনে অবশ্য জাপানে তাঁর প্রদর্শনীর সংখ্যা কুড়িটি ছাড়িয়ে গেছে এবং জাপানে তিনি সার্বিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন প্রতিভাবান এক অগ্রগণ্য শিল্পী হিসেবে। শিল্পকলা একাডেমীর ১৯৯৩ সালের সেই প্রদর্শনী তাই অনেকটা যেন ছিল দেশ থেকে দূরে সরে থাকা বরেণ্য এক শিল্পীকে আবারও দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার এক প্রক্রিয়া। এরপর থেকে অবশ্য কাজী গিয়াসউদ্দিনের ছবির একাধিক প্রদর্শনীর আয়োজন বাংলাদেশে বসেছে, দেশেও খ্যাতিমান এক শিল্পীর স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন এবং জাপানের মতোই সেখানেও তিনি হয়ে উঠেছেন শিল্পকলার জগতের খুবই পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব।
তবে তারপরও বলা যায়, কাজী গিয়াসউদ্দিন থেকে গেছেন নিঃসঙ্গ সেই ব্যক্তিত্ব, নিজের আপন ভুবনে, যিনি নিমগ্ন আছেন রঙ-তুলির এমন এক খেলায়, যা থেকে প্রায়ই বের হয়ে আসছে শিল্পীর অসাধারণ কিছু সৃষ্টি। গত দশ বছরে আঁকা ছবির ভান্ডার থেকে নিজের বাছাই করে নেওয়া গোটা চল্লিশেক ছবি নিয়ে জানুয়ারি মাসে আবারও তিনি উপস্থিত হচ্ছেন দেশবাসীর সামনে।
২৯ জানুয়ারি বেঙ্গল গ্যালারিতে কাজী গিয়াসউদ্দিনের যে প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে সেটি নানা দিক থেকেই খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। প্রদর্শনীর সার্বিক শিরোনাম তিনি দিয়েছেন ‘শান্তির সন্ধানে’। গত দশ বছরে ছবি আঁকার প্রক্রিয়ায় নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর মধ্য দিয়ে অনেকটা যেন মনের শান্তি খুঁজে পাওয়ার প্রয়াসে নিয়োজিত ছিলেন এই শিল্পী, খুঁজে পেতে চেয়েছেন নিজের সেই সত্তার প্রতিফলন, যা কিনা তাঁকে বলে দেবে মনের মতো ছবি তিনি আদৌ আঁকতে পেরেছেন কি না। এ যেন অশান্ত এক সময় পার হয়ে যাওয়া, যার শেষটায় রয়েছে স্নিগ্ধ শীতল এক প্রস্রবণকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল সব বৃক্ষ, যার ছায়াঢাকা পাদদেশ সহজেই সন্ধান দেয় শান্তির প্রকৃত সংজ্ঞার। বেঙ্গল গ্যালারির প্রদর্শনীর নামকরণ তাই সব দিক থেকেই হচ্ছে অর্থবহ। ছবি তো কেবল একমুখী বার্তা বহন করে না, শিল্পীর আঁকা ছবির দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে দর্শক মনে তৃপ্তির অনুভূতি না পেলে, শান্তির কোমল স্পর্শের দেখা সেখানে খুঁজে না পেলে, সেই ছবি পরিপূর্ণ ছবি হয়ে উঠতে পারে না বলেই কাজী গিয়াসউদ্দিন মনে করেন। জীবনের দীর্ঘপথ পরিক্রমণে ছবি আঁকায় নিয়োজিত থেকে এই শিক্ষা তিনি পেয়েছেন এবং এটাকেই এখন তিনি তাঁর চলার পথের সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ দিক হিসেবে গণ্য করছেন।
বেঙ্গলের প্রদর্শনীর জন্য গত দশ বছরে আঁকা ছবির ভান্ডার থেকে যেসব ছবি তিনি বেছে নিয়েছেন, সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই হচ্ছে শিল্পীর পছন্দের ছবি। এসব ছবি নিজেও তিনি তাঁর শৈল্পিক সত্তার এক দশকের প্রতিনিধিত্বশীল উপস্থাপনা হিসেবে মনে করছেন। ফলে গত এক দশকে শিল্পীর পথপরিক্রমণের স্পষ্ট প্রতিফলন এসব ছবির মধ্য দিয়ে ফুটে উঠবে, যা কি না নিঃসঙ্গ এবং নিজেকে সচেতনভাবে দূরে সরিয়ে রাখা এই শিল্পীকে আরও ভালোভাবে বুঝে উঠতে বাংলাদেশের শিল্পবোদ্ধাদের সাহায্য করবে।
কাজী গিয়াসউদ্দিনের কাজের প্রায় সবটায় রয়েছে বিমূর্ত এক ধারার প্রতিফলন, রঙের লুকোচুরি খেলা হচ্ছে যার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক। রঙের বাহারি ছোঁয়ায় ক্যানভাসের পর্দায় কখনো ফুটে উঠছে বর্ষার ঘন মেঘে ঢাকা প্রকৃতি, কখনো আবার বসন্তের জাদুময় স্পর্শে মুহূর্তের মধ্যে প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠা আমাদের পারিপার্শ্বিকতা। সেসব ছবিতে শিল্পী সবই যে খুলে বলছেন, তা তো নয়। বিমূর্ত প্রকাশের এটাই হচ্ছে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ দিক, যা কিনা দর্শকদের মনের বন্ধ দুয়ার খুলে দিয়ে তাদের নিয়ে যেতে পারে অবচেতন এক জগতে, যেখানে তারা সহজেই খুঁজে পেতে সক্ষম আমাদের বাস্তবের জগতে যার অভাব আমরা নিয়ত বোধ করছি, সেই শান্তির।
টোকিওতে কাজী গিয়াসউদ্দিনের প্রদর্শনীতে শিল্পীর আঁকা কোনো কোনো ছবির সামনে দর্শকদের আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখেছি। তারা যে কেবল ছবির দিকে তাকিয়ে তা তো নয়! সেই ছবি যেন হঠাত্ করে খুলে দিচ্ছে মনের বন্ধ হয়ে থাকা কোনো দুয়ার, আর দর্শক যেন পাচ্ছেন সেই দুয়ার বরাবর বয়ে যাওয়া শান্ত স্নিগ্ধ হাওয়ার পরশ, যা কিনা জুড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর পুরো মনকে। এটাই তো হচ্ছে সেই শান্তি, শিল্পী যার কথা বলছেন। নাই বা সেখানে থাকল যুদ্ধের হানাহানি, বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরের থমথমে শান্ত অবস্থা।
কাজী গিয়াসউদ্দিনের জাপানে আগমন আজ থেকে ঠিক পঁয়ত্রিশ বছর আগে, ১৯৭৫ সালে। এর আগে শুরুতে ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ শেষ করে ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটেই শিক্ষকতায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন। জাপানে তিনি আসেন চারুকলা বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষালাভ করতে, যে সূত্র ধরে দেশের সবচেয়ে নামী চারুকলা বিদ্যাপীঠ, টোকিও চারুকলা ও সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন তিনি। কাজী গিয়াসউদ্দিন হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি লাভকারী ছাত্র, যে দিকটাও হচ্ছে বিরল এক সাফল্যের দিক।
ছবি আঁকায় তিনি জড়িয়ে আছেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। দীর্ঘ এ সময়ে নানারকম বিবর্তনের পর্যায় পার হয়ে যেখানে এখন তিনি দাঁড়িয়ে, সেটাকে বলা যায় জীবনের অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে সযত্নে তুলে নেওয়া নানারকম বৈচিত্র্যের এক সমাহার। এই পথ পরিক্রমণে ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শিল্পী তাই কখনো কখনো অবাক হয়ে ভাবেন, জাপানে না এলে যেকোনো দিকে প্রবাহিত হতে পারত তাঁর কাজের ধারা। তবে জাপানের অভিজ্ঞতা যে নিজের শিল্পী সত্তার পরিচয় খুঁজে পেতে নানাদিক থেকে তাঁকে সাহায্য করেছে, তা তিনি অস্বীকার করছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই যেমন তাঁর এক শিক্ষক বলেছিলেন, ছবি আঁকা তিনি যেন চালিয়ে যান। নিজের আঁকা ছবিই একসময় তাঁকে বলে দেবে, কোথায় তাঁর ঠিকানা এবং কোন পথ ধরে তাঁর যাত্রা করা উচিত। জাপানি শিক্ষকের সেই উপদেশ শিল্পী আজও ভুলে যাননি। ছবি আঁকায় তিনি নিয়োজিত আছেন বিরতিহীন এবং নিজের তাঁর আঁকা ছবিই তাঁকে বলে দিচ্ছে, কোথায় আছে কাজের ত্রুটি কিংবা ছবি নিয়ে আর তাঁর কী করা দরকার।
সে রকম শিক্ষার আলোকে কাজী গিয়াসউদ্দিন আরও মনে করেন, শিল্পীকে অবশ্যই হতে হয় সাহসী। সাহসের অভাব থেকে গেলে ভালো শিল্পী হওয়া সম্ভব নয়। রঙ-তুলি নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার সাহস যে শিল্পীর নেই, নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সেই বিশ্বাস থেকে এমনকি শেষ হয়ে আসার পর্যায়ে থাকা ছবিও নিজের মনের মতো না হলে, তা মুছে ফেলতে দ্বিধা করেন না কাজী গিয়াসউদ্দিন। এই অভিজ্ঞতা অবশ্য নতুন কিছু আঙ্গিকের দুয়ারও তাঁর সামনে কখনো কখনো খুলে দিয়েছে। সাদা ক্যানভাসের ওপর রঙের হালকা প্রলেপ দেওয়া কাজ হচ্ছে এর একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
সেটা ছিল আশির দশকের শেষ দিকের এক ঘটনা। একের পর এক ছবি এঁকে যাওয়ার পরও কাজের তৃপ্তি সেসব ছবিতে তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ছবি মুছে ফেলার জন্য ক্যানভাসের ওপর তিনি বুলিয়ে দিচ্ছিলেন সাদা রঙের প্রলেপ, যে কাজ করতে গিয়ে মনে তাঁর একসময় হঠাত্ প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, সাদা দিয়েই কাজ করা নয় কেন? সেই থেকে ধ্বংসের ছবির পথে তাঁর অগ্রসর হওয়া, শিল্পীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ যে পর্যায়টির প্রতিফলন দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকের অনেকটা সময় ধরে তাঁর আঁকা সাদা ক্যানভাসের ওপর হালকা রঙের প্রলেপ বুলিয়ে দেওয়া অসাধারণ বেশ কিছু ছবিতে।
যেকোনো শিল্পীর সত্তাই প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বিমূর্ত শিল্পকলার বেলাতেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যায় না এবং কাজী গিয়াসউদ্দিনের অবস্থানও এর বাইরে নয়। প্রকৃতি থেকে তিনি খুঁজে নিচ্ছেন ছবির বিষয়াবলি এবং রঙের বাহারি উপস্থাপনার প্রেরণা। ফলে প্রকৃতির সঙ্গে বসবাসকে তিনি শিল্পীর সত্তার বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করে থাকেন। অন্যদিকে আবার এ রকম বিশ্বাস বিভক্ত এক জীবন তাঁর জন্য নিয়ে এসেছে। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় তিনি কাটাচ্ছেন বাংলাদেশে, যেখানে সাভারের বিস্তৃত পরিসরে, প্রকৃতির অনেকটা কাছাকাছি তিনি তৈরি করে নিয়েছেন নিজের স্টুডিও। বড় আকারের ছবির কাজ তিনি আজকাল বাংলাদেশে থাকা অবস্থাতেই করছেন। জাপানে থাকা অবস্থায় সাধারণত ছোট আকারের ছবি নিজের আবাসিক ভবনের স্টুডিওতে তিনি করে থাকেন।
বড় ধননের ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য তিনি বোধ করেন বলে নিজেকে মেলে ধরা, মুক্ত বোধ করার অনুভূতি সেসব কাজ তাঁকে এনে দেয়। তৃপ্তির অনুভূতিও তাই বড় কাজে অনেক বেশি। ফলে বাংলাদেশে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একাকী কাটলেও ছবি আঁকার কাজে প্রায় সার্বক্ষণিক জড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে পাওয়া আনন্দ সেই দুঃখ বোধ থেকে তাঁকে মুক্ত রাখছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে শিল্পীর পরিচয়ের গণ্ডি ইদানীং আরও বেশি সম্প্রসারিত হয়ে আসায় তিনি অনুভব করতে পারছেন, দেশ আছে বলেই তাঁর নিজের পরিচিতিও সেখানে রয়ে গেছে। ফলে আমরা বলতে পারি, অনেকটা যেন নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠে দেশের অনেক কাছাকাছি এখন তিনি চলে আসছেন এবং কাজই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখছে, দিয়ে যাচ্ছে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা।
বেঙ্গল গ্যালারিতে ২৯ জানুয়ারি ২০১০ যে প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে তাতে সে রকম এক কাজী গিয়াসউদ্দিনকেই দর্শকেরা নিশ্চয় খুঁজে পাবেন, শিল্পী যেখানে তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন আমাদের জীবনের যা কিছু ভালো, তা দেখিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জীবনকে ভালোবাসার গুরুত্ব। পাশাপাশি নিঃসঙ্গ সেই শিল্পী সত্তার দেখাও একই সঙ্গে দর্শকদের মিলবে, দেশের মাটির প্রতি অনুভব করা গভীর একটান, যাকে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করছে ছবি আঁকার কাজে জড়িত থাকায়, ছবি নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ায়।
টোকিও, ২২ ডিসেম্বর ২০০৯
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৯, ২০১০
Leave a Reply