একটি সাধারণ বস্তুকে উপস্থাপনার মাধ্যমে কতটা যে অসাধারণ করে তোলা যায়, যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম সম্প্রতি রঙধনু আয়োজিত জাতীয় জাদুঘরে তাদের সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে। যদিও প্রদর্শনটি ছিল আমাদের চতুষ্পার্শ্বের দৃশ্যজগতে রঙের উল্লসিত উদ্ভাসকে ঘিরে। নানা রঙের সমাহার আমাদের সামাজিক জীবনে প্রকৃতিকে ঘিরে কখনো স্বতঃস্ফূর্ত, কখনো তৈরি করা। দেখে কখনো উজ্জীবিত হই। আনন্দিত হই। আবার কখনো মনে হয়, এটাই স্বাভাবিক। এখানে প্রদর্শনীর মূল বীজটি রোপিত হয়েছে এই স্বাভাবিকতাকে উপস্থাপনার মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে সুন্দর করে তোলায়। পরিকল্পিত যোজনার মাধ্যমে যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গে প্রদর্শনীটি উপস্থাপিত হয়েছে। শিল্পরস পিপাসুদের মুগ্ধ করেছে, হতবাক করেছে, আর সৃষ্টিশীলদের করেছে অনুপ্রাণিত নতুন সৃষ্টির উদ্ভাবনে। শুধু রঙের ব্যবহারই নয়, রঙের উপাদান হিসেবে উপস্থাপিত বিভিন্ন বস্তুর নিজস্ব কৃতিকে ছাড়িয়ে নতুন মূল্যায়নের দ্বার উন্মোচন করেছে। এতে একজন সৃষ্টিশীল শিল্পীর ব্যবহূত উপাদানে নতুন মাত্রা যোগ করতে সহায়তা করেছে।
প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত কালোর বিভিন্ন স্তর যেটা পাটের তৈরি চটের বুনটের ভিন্নতায় তৈরি, তার ওপর একই রঙের ভিন্নমাত্রা লক্ষণীয়। তেমনি সাদার বিপরীতে এবং কালোর বিপরীতে রঙের গাঢ়তা থেকে হালকা, নতুন দ্যোতনার সৃষ্টি করে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, উপাদানের সাংগঠনিক বিন্যাস যে তরঙ্গ সৃষ্টি করে, সেটাও রঙের বিভিন্নতা প্রকাশে সহায়ক। পালকের তিন সারি, কাঠের তক্তার ভেতর বিন্যাস, শিরীষের সহায়তায় মসৃণবৃত্ত এবং খোদাইয়ের উচ্চাবচ একটি শিল্পকৃতি। একজন সৃষ্টিশীল শিল্পীকে নতুন পথের সন্ধান দেয়।
লোকশিল্পের বিভিন্ন নিদর্শন যেমন লক্ষ্মীর সরায় অঞ্চলের বিভিন্নতা নতুন মাত্রায় ধরা দেয়। ফরিদপুরের সরায় কালো রেখার স্বতঃস্ফূর্ততা এবং যশোরের বর্ণলেপন থেকে কামরুল হাসানের চিত্রপটের ঐতিহ্য অনুধাবন করা যায়। তেমনি কাঠের তৈরি হাতি-ঘোড়ার সরলীকরণ স্পেস ও ফর্মের নতুন কাঠামো তৈরি করে দেয়। লোকশিল্পীকে মাধ্যম যে সরলীকরণের নির্দেশনা দেয় তা থেকে নতুন ভাবনারও জন্ম দেয়। নকশী কাঁথার যথাযোগ্য উপস্থাপনার আরও বড়ো সুযোগ ছিল, যা থেকে নতুন প্রতীকের উদ্ভাবনা শিল্পীর ক্যানভাসে এবং বুটিকের উদ্ভাবিত নতুন ফ্যাশনে এমনকি প্রকাশনাশিল্পে নন্দিত নকশায় নতুন মাত্রা এনে দিতে পারত। নকশী পাখায় অঞ্চল ভেদের উদ্ভাবনা আমাদের চমত্কৃত করে। সবচেয়ে চমত্কারিত্বের নিদর্শন এই প্রদর্শনীতে কৃষিজাত পণ্যের উপস্থাপনা। কাঁচা বাঁশে তৈরি ধামার মতো সবুজ খাঞ্চার নির্মাণ কুশলে যে নকশা আধুনিকতার চরম পরাকাষ্ঠা। তার ওপর বেতের ডালায় মালসায় সাজানো বৃত্তাকারে রকমারি মসুর ডাল, একসঙ্গে যা কখনো দেখিনি—রঙের ভিন্নতা, তার দানাদার বিন্যাস ছবির নতুন মাত্রা যেন। তেমনি সাদা আতপ চালের বৃত্তাকার বেষ্টনীতে খয়েরি বিন্নি-মাঝখানে কালো বিন্নির বিন্যাস মোহাম্মদ কিবরিয়ার ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। বিমূর্ত ছবির উত্সমূল আবিষ্কৃত হয় যেন। কালো জিরা, পেঁয়াজের বিচি, পালংশাকের বিচি, মূলার বিচির উপস্থাপন নতুন ভাবনাতে ইন্ধন জোগায়। রং-বেরঙের শিকায় শখের হাঁড়ির ঝুলন্ত পরিবেশনা দেখে মনে হলো স্বর্ণাভ আঁশের আসল শিকার অনুপস্থিতি। পাটজাত দ্রব্যের রকমারি রঙের অভাব অনুভূত হলো। পরিবেশবান্ধব পাটের চাহিদা বহির্বিশ্বে উত্তরোত্তর বাড়ছে। পাটের তৈরি পাতলা সূক্ষ্ম সোনালি চট বুনট-বিন্যাসে ওয়ালপেপার হিসেবে ইউরোপে খুব জনপ্রিয়। ডিজাইন সেন্টারে থাকাকালীন একজন অভ্যন্তরীণ নকশাবিদ যিনি হল্যান্ডের অধিবাসী, তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন সেন্টার দেখে, মুগ্ধবিস্ময়ে অবলোকন করেছিলেন পাট-সামগ্রী দেখে, বিশেষ করে সূক্ষ্মচটের ওয়ালপেপার হিসেবে ব্যবহারের অপার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন। নির্মম পরিহাস, পাটের চাহিদা নেই বলে আমরা আদমজি জুট মিলের মতো মিল বন্ধ করে দিলাম।
চরকায় কাটা সুতোর রঙিন মেলা রূপগঞ্জের জামদানি কারিগরের কথা মনে করিয়ে দিল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ গিয়েছিলাম জামদানি পল্লিতে। জামদানি শাড়ির রঙের উজ্জ্বলতা মুগ্ধ করেছিল শিল্পাচার্যকে। এই রঙিন সুতোর উজ্জ্বলতা কী করে হলো? শিল্পাচার্যের প্রশ্নের জবাবে তাঁতীর উত্তর ছিল শীতলক্ষ্যার পানি। তাঁতীজায়ার কাটা সুতোয় রং করে শীতলক্ষ্যার পানিতে ধোয়া রঙের উজ্জ্বলতার রহস্য এখানেই।
উপাদানের বৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে আরেকটি প্রদর্শনী সামগ্রীতে। প্লাস্টিকের বলের ওপর খবরের কাগজ সাঁটা হয়েছে এলোমেলোভাবে, ৩৬ পয়েন্ট টাইপের বল আর আট পয়েন্ট টাইপে ছাপা কাগজের বল উপাদানের বুনট নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা উত্সাহিত হবেন নতুন সৃষ্টিতে।
নানা রঙের স্পঞ্জের স্যান্ডেল ছোট সাইজ থেকে বড় সাইজে—একটি দেয়ালে সাজানো হয়েছে। দেয়ালটি দেখে অ্যান্ডি ওয়ারহলের কথা মনে হলো। এই মার্কিনি শিল্পী পানিয়ের ক্যান নিয়ে কাজ করেছেন তাঁর শিল্পকর্মে। বিষয় বৈচিত্র্যে এই স্যান্ডেল ওয়াল অবশ্যই একটি শিল্পকর্ম। তেমনি বাহারি রঙিন কাচের চুড়ির সমাহার আরেকটি দেয়ালে। চুড়ির দোকানে যেভাবে সাজানো থাকে, ঠিক তেমনি। কিন্তু এখানে উঠে এসেছে শিল্পকর্ম হিসেবে।
স্থাপনা শিল্পের নানান নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রদর্শনী কক্ষে। অবশ্যই বৈচিত্র্যপূর্ণ। সাধারণকে সাধারণ জিনিসের অসাধারণত্ব উপলব্ধি করানোর জন্য এই প্রদর্শনী। কিন্তু আমাদের মিডিয়াতে উল্লিখিত হয়েছে রঙের খেলার প্রদর্শনী হিসেবে। এর অন্তর্নিহিত উপাদানটি খুঁজে বের করার প্রয়োজন ছিল। এটি যে একটা সাধারণ প্রদর্শনী নয়, এটি বোঝানোর প্রয়োজন ছিল। এর গুরুত্ব যেমন সাধারণের কাছে, তেমনি শিল্পীদের কাছে, গ্রাফিকস ডিজাইনারদের কাছে, অভ্যন্তরীণ সজ্জাকরদের কাছে, ফ্যাশন ডিজাইনারদের কাছে অপরিসীম। সাধারণ দর্শক উপলব্ধি করতে পারবেন সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টির উপাদানের উত্স কোথায়। এ প্রদর্শনীটি অবিকলভাবে যেকোনো মিউজিয়মে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি রাখে। ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে শিল্প বিষয়ে, সংস্কৃতি বিষয়ে ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সুশিক্ষিত করার জন্য এর প্রয়োজন আছে।
পুরো প্রদর্শনীটির পরিকল্পক নকশাবিদ চন্দ্রশেখর সাহার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং রঙধনুর বিপ্লব সাহা ও সৌমিক দাসের সহযোগিতা সৃষ্টি-উদ্দীপক এ রকম একটি প্রদর্শনী দেখার সৌভাগ্য হলো। উপাদান সংগ্রহে সারা বাংলাদেশ চষে বেড়ানো মাহফুজুল করিম শ্যামলের ধৈর্য এবং কর্মনিষ্ঠার নান্দনিক রূপ এই প্রদর্শনী। ভবিষ্যতে সংস্কৃতির উত্সমুখে যাওয়ার নানা কর্মসূচির প্রত্যাশায় আমরা অপেক্ষমাণ রইলাম।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৯, ২০১০
Leave a Reply