গত এক দশক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে একটা ধারণা চালু ছিল যে বইয়ের জগত্ সংকীর্ণ হয়ে আসবে। কারণ, বই পড়বে পাঠক অনলাইনে, গাড়ি চালাতে চালাতে শ্রুতি বই শুনবে। বাসায় শুধু সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু বইয়ের জগত্ সংকীর্ণ হয়নি। অন্তিমে মানুষ মানুষই। হালে বই নিয়ে বসে বা শুয়ে পড়ার যে আনন্দ, তা প্রযুক্তিতে মিলবে না।
ওই সব ধারণা থেকে আমরা অনেক দূরে। নিয়মিত বই প্রকাশই এখানে ঘটনা। জনসংখ্যা বাড়ছে, শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে পাঠকের সংখ্যা বাড়েনি। এর কারণ কী, তা আমরা কখনো খতিয়ে দেখিনি। না, এখানে আমি হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল বা আনিসুল হকের বেস্ট সেলার বই ধরছি না, বেস্ট সেলার সব সময়ই বেস্ট সেলার। তাহলে কি অধিকাংশ লেখকের বই পাঠককে আকৃষ্ট করে না? এ কথা বলছি এ কারণে যে, বেস্ট সেলার বাদে পরিচিত লেখকদের উপন্যাস তো বছরে ৫০০ কপি বিক্রি হতে পারে। মাত্র ৫০০, তা-ও বিক্রি হয় না। ননফিকশন, কবিতার অবস্থা আরও খারাপ। ননফিকশন বছরে ৪০০ কপি গেলে বেস্ট সেলার হিসেবে বিবেচিত। এ ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, বিষয়বৈচিত্র্যও একটি কারণ। আরেকটি কারণ বিশেষভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। তা হলো, বিপণনব্যবস্থা। বাংলাদেশে অধিকাংশ প্রকাশকের বিপণনব্যবস্থা খুব খারাপ। বইয়ের কমিশন, মধ্যস্বত্ব, বিক্রি—সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। কিন্তু আবার এটাও দেখা গেছে, পরিচিত লেখকদের ফিকশন বা ননফিকশন যদি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে তা বছরে ৭০০-৮০০ কপি বিক্রি হয়।
আলোচনাটা এখন ধারাবাহিকভাবে করা যাক। বছরে বাংলাদেশে কত বই বের হয়? এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে, বই প্রকাশনা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে একুশের বইমেলার ওপর। বছরে যদি তিন হাজার নতুন বই [পুনমুর্দ্রণসহ] বের হয় এবং বিভিন্ন তথ্যে দেখি এ পরিমাণ বই-ই প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যা অনেককে অবাক করতে পারে। এই ধারণার সৃষ্টি করতে পারে যে, এখানে প্রকাশকের সংখ্যা অগণিত এবং বই-ও বিক্রি হয় প্রচুর। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে, অনেক অলেখক কম খরচে নিজের বই বের করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। অনেক লেখক, যাঁরা ততটা পরিচিত হননি, তাঁরা পুরো বই প্রকাশের খরচটি নিজে বহন করেন, তারপর কোনো প্রকাশককে অনুনয় করে সেই প্রকাশকের ব্যানারে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এ দুটির সংখ্যাই দুই-তৃতীয়াংশ। বাকি বই প্রকাশকেরা আগ্রহ করে অথবা অনুরোধের ঢেঁকি গিলে প্রকাশ করেন। প্রকাশকেরা যাঁরা বেস্ট সেলার লেখকদের বই পান, তাঁরা বেস্ট সেলারের সঙ্গে অন্য আরও দু-একটি বই বিক্রি করতে পারেন। প্রতিবছর শুনি, বাংলা একাডেমীতে কয়েক কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। হিসাব মিলে দেখা যাবে, এর সিংহ ভাগ আসে বাংলা একাডেমীর বই [প্রধানত ডিকশনারি] ও বেস্ট সেলার থেকে।
অধিকাংশ পাঠক বই কেনে লেখকের নাম দেখে, বিষয়বৈচিত্র্য দেখে, বা যে লেখকের বই তাকে টানে। বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখকের গদ্য আমার ধারণা পাঠকদের পছন্দ নয়। একজন উঁচুদরের লেখক হতে পারেন, তাঁর ভাষা সাহিত্যে উদাহরণ হতে পারে, কিন্তু তাঁর বই পাঠক না-ও কিনতে পারে। বই একটি পণ্য। ক্রেতা পণ্য দেখেশুনে কিনবে। দু-একটি সাজিয়ে রাখার জন্য কিনতে পারে। লেখক যদি পাঠকের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে না পারেন, তবে পাঠকের বয়েই গেছে তাদের বই কিনতে। সামগ্রিকভাবে, অনেকের ধারণা, পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের পাঠক এখানে বেশি। এর কারণ, সেখানকার লেখকদের নির্ভার গদ্য। হুমায়ূন আহমেদ বা জাফর ইকবাল যে পাঠকচিত্ত হরণ করেছেন, তার কারণ যতটা না বিষয় তারচেয়ে বেশি তাঁদের নির্ভার গদ্য।
আমাদের চোখে অনেক খ্যাতিমান লেখক আমার এ মন্তব্যে যারপরনাই অসন্তুষ্ট হতে পারেন। কিন্তু সত্যটা হলো, তাঁদের পাঠক নেই। সাধারণ পাঠক। গুটি কয় এলিট পাঠকের চোখে তাঁরা খ্যাতিমান। কিন্তু সেই এলিট পাঠকেরাও বাংলা বই কেনেন কম। তাঁরা খ্যাতিমান হতে পারেন, তবে পাঠকহারা খ্যাতির কোনো অর্থ নেই। তা ছাড়া তাঁদের গ্রন্থে বিষয়বৈচিত্র্যের নিদারুণ অভাব। এখনো তারাশঙ্কর, মানিক বা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই বিক্রি হয়। কারণ, বিষয়বৈচিত্র্য; পাঠক আনন্দের সঙ্গে তাঁদের বই পড়তে পারে, পাঠককে তাঁরা ধরে রাখেন।
আমাদের প্রকাশকদের কেন্দ্র বাংলাবাজার। অধিকাংশ এখানে অ্যামেচার প্রকাশক। তাঁদের দোকানে যান, সেখানে তাঁদের সব বই পাবেন না, বই বিক্রির নিয়মিত হিসাব নেই, তাঁদের কোনো কপি এডিটর, নির্দিষ্ট প্রুফ রিডার নেই। পাশ্চাত্যে লেখক তাঁর পাণ্ডুলিপি এজেন্টকে দিয়েই খালাস। সেই পাণ্ডুলিপি বাজারে আসে অনেক ধাপ পেরিয়ে। সেখানে একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলেছে, তাই বই বিক্রির পরিমাণটা বেশি। এখানে কয়েকজন ছাড়া বাকি লেখকদের প্রায় সবাইকে বই প্রকাশের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে হয়। সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল এক অবস্থা। প্রকাশকদের মধ্যে একটি বড় অংশ আগে নোটবই, ধর্মীয় বই, চালু বইয়ের ব্যবসা করতেন। খানিকটা সম্মান অর্জনের জন্য পরে সৃজনশীল বই প্রকাশনায় এসেছেন। বই, আধুনিক জগত্, সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা তাঁদের কম। তাঁদের বিপণনব্যবস্থা খারাপ, পাঠকের হাতে বই পৌঁছায় না। বাংলা একাডেমীর বইমেলা যে জমজমাট হয়, তার একটা কারণ যতটা না একুশে ফেব্রুয়ারি, তারচেয়ে বেশি বইয়ের খারাপ বিপণনব্যবস্থা। অর্থাত্ পাঠক মেলায় এমন অনেক বই দেখতে পান, যেগুলো সম্পর্কে তাঁরা জানতেনই না।
বিপণনব্যবস্থা খারাপ হওয়ার একটি কারণ মধ্যস্বত্ব প্রথা বা বিক্রেতার অসততা। সব প্রকাশকই বই প্রকাশের পর বইয়ের দোকানে তা পৌঁছে দিতে চান। বিক্রেতা আগ্রহে তাঁর বই নেন, কিন্তু বিক্রি হওয়ার পর টাকা দেন না। বা দিলেও ওই টাকার জন্য যে পরিশ্রম বা ঘোরাঘুরি করতে হয়, তার দাম বই বিক্রির টাকার চেয়ে বেশি। বইয়ের কমিশন ২৫ থেকে এখন ৪০ শতাংশ। প্রকাশকেরা এই কমিশন দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে বইয়ের দাম বাড়ছে। ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর প্রকাশকের লাভের মার্জিন কমে যাচ্ছে। নানা ধরনের এবং নতুন লেখকের বই প্রকাশে তখন তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বিক্রেতারাও তাদের ভাষায় ‘চালু’ বই ছাড়া কোনো বই রাখতে চান না। ঢাকা ছাড়া অন্যান্য শহরে বই বিক্রির যথেষ্ট পরিমাণ দোকানও নেই, কারণ বই তেমন বিক্রি হয় না। পাঠকের কাছে বইয়ের খবর পৌঁছে দেওয়ার একটা মাধ্যম বইয়ের বিজ্ঞাপন। দেখা গেছে, যে বইয়ের নিয়মিত বিজ্ঞাপন হয়, তার বিক্রি বেশি। কিন্তু পত্রিকায় বইয়ের বিজ্ঞাপনের হার এত বেশি যে অধিকাংশ প্রকাশক নিয়মিত বইয়ের বিজ্ঞাপন দিতে পারেন না, আগ্রহ থাকলেও।
আমাদের এখানে লেখক-প্রকাশকের সম্পর্কটাও প্রফেশনাল নয়। অধিকাংশ প্রকাশক লেখকের বই বিক্রির হিসাব নিয়মিত দেন না, বিক্রি হলে রয়্যালিটি দেন না, চুক্তি করেন না ইত্যাদি। অনেক প্রকাশক বলেন, বই বিক্রি হলে তো রয়্যালিটি দেব। আমি মনে করি, একজন প্রকাশক যদি একজন লেখকের একটি বই বের করেন, তখন তার ওপর কিছু দায়িত্বও বর্তায়। সে কারণে এক বছরে একজন লেখকের যদি ১০ কপি বইও বিক্রি হয়, সেই ১০ কপির হিসাব দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। অনেক প্রকাশক আগ্রহ করে বইয়ের পাণ্ডুলিপি নেন, ছাপেনও, তারপর তাঁর সঙ্গে আর লেখকের যোগাযোগ হয় না, যদি না বইটি বেস্ট সেলার হয়। অধিকাংশ লেখক-প্রকাশকের মধ্যে যে অবিশ্বাসের ব্যাপারটি আছে, তা অস্বাস্থ্যকর।
আগের চেয়ে বইয়ের বাজার প্রসারিত হয়েছে, বই বিক্রির সংখ্যাও বেড়েছে। সে হিসাব দেখলে সহজেই অনুমান করা যেতে পারে, আগে প্রকাশনার জগিট কত অকিঞ্চিত্কর ছিল। স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য সব বিষয়ের মতো প্রকাশনা জগতের পরিধি বেড়েছে। বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলা এখন বাত্সরিক একটি ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
বাংলা একডেমীর বইমেলা প্রমাণ করে, বই সম্পর্কে মানুষের একটা আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। এখন লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের যদি একটি মেলবন্ধন গড়া যায়, তাহলে বইয়ের জগতে তা শুভ অভিঘাতের সৃষ্টি করবে। অর্থাত্ মেলাটা যদি সুচারু হয়, মেলায় যদি পাঠযোগ্য, বৈচিত্র্যময় বই প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশকও যদি নতুন লেখকদের পাঠযোগ্য বই হাজির করতে পারেন এবং সেই সময় যদি পত্রপত্রিকায় নিয়মিত বিজ্ঞাপন বেরোয়, তাহলে বইয়ের পাঠকের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যাবে। বই বিক্রিও বাড়বে। প্রকাশক সব ধরনের লেখকের বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন। সুশৃঙ্খল বিপণনব্যবস্থা গড়ে না ওঠা পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর বইমেলা পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের বড় আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাহলে প্রথমেই মেলার কথা বলতে হয়। ক্রমেই বাংলা একাডেমীর খালি স্পেস সংকুচিত হচ্ছে, বইয়ের স্টলের সংখ্যা বাড়ছে। এ মেলা আর কয় বছর পর করা দুরূহ হবে। মেলাটা এমন হওয়া দরকার, যেখানে প্রকাশক তাঁর পছন্দমতো স্পেস পাবেন, পাঠক ঘুরে ঘুরে বই দেখতে পারবে। এখন একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বই ছাড়া প্রকাশক আগে প্রকাশিত বই রাখতে পারেন না। পাঠক, বিশেষ করে, মহিলা ও শিশুকিশোরেরা স্বচ্ছন্দে মেলায় ঘুরতে পারে না। বাংলা একাডেমীর কাজ নয় বছরে তিন মাস তাদের মূল কাজ বন্ধ রেখে বইমেলা করা। এ কাজটি গ্রন্থকেন্দ্রের। একুশে বইমেলা থাকুক এবং তার জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করা হোক। পশ্চিমবঙ্গে তা হয়েছে। এবং বইমেলা কলকাতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নেওয়ায় ক্ষতি হয়নি। শুধু আবেগ দিয়ে কাজ হবে না। শুধু আবেগের ওপর ভিত্তি করে গঠনমূলক কোনো কাজও এগিয়ে নেওয়া যায় না।
প্রশ্ন জাগতে পারে, এই যদি অবস্থা প্রকাশনা ও বিপণনের তাহলে এখনো প্রকাশনাশিল্পে এত প্রকাশক আছেন কীভাবে? অনেকে তো খুব ভালোভাবে আছেন। জনা ১০-১৫ প্রকাশক আছেন, যাঁদের কিছু পুঁজি ছিল এবং বেস্ট সেলার লেখক ছিল, তাঁরা মোটামুটি একটা অবস্থা করে নিয়েছেন। তাঁদের বইয়ের সংখ্যা অনেক। ফলে প্রতিদিন কোনো না কোনো বই বিক্রি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের এবং অধিকাংশের সাইড বিজনেসের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেটি হচ্ছে পাঠ্যবই, রেফারেন্স বই, সাপ্লাই বা অন্যান্য ব্যবসা। আমাদের দেশের লেখকদের মতো আর কি! লেখাটা সাইড বিজনেস, মূল অন্য পেশা। প্রকাশকেরা যেমন প্রকাশনার ওপর নির্ভর করতে পারছেন না, লেখকেরাও শুধু লেখার ওপর নির্ভর করতে পারছেন না। যদি লেখক-প্রকাশক নির্ভরশীল হতেন নিজ নিজ পেশা ও পরস্পরের ওপর, তাহলে হয়তো প্রকাশনার জগতের চালচিত্রটা অন্যরকম হতো।
সাপ্লাইয়ের ব্যাপারটা একটু বলি। সরকারি অনেক সংস্থা, অনেক এনজিও বই কেনে। এসব ক্রয়-বিক্রয়ে স্বচ্ছতা প্রায় থাকে না। যিনি কিনবেন, তাঁর সঙ্গে প্রকাশকের একটা ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ হয়। প্রকাশক বইয়ের ইনার বদলে ফেলেন। কর্মকর্তা কিছু টাকা পান, প্রকাশকও। লেখক জানলে লেখকও। প্রকাশকদের একটা বড় অংশ প্রতিনিয়ত এই সাপ্লাইয়ের খোঁজে ঘর্মাক্ত হন। পাবলিক লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগার বই কেনে। তবে তাদের বাজেট কম। আগে যখন প্রকাশনা ও প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম ছিল, তখন গণগ্রন্থাগার কবে বই কিনবে তার জন্য প্রকাশকেরা হা-পিত্যেশ করতেন। এখন তেমন করেন না।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আমাদের কয়েকজনের অনুরোধে শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়মিত সৃজনশীল বই কিনে কলেজে বিতরণের বন্দোবস্ত করেছিলেন। প্রথম দুই বছর প্রকল্পটি ভালোভাবে চলছিল। প্রকাশকেরা খুশি। লেখকেরাও খুশি, কারণ প্রকাশক রয়্যালটি দিয়ে যাচ্ছেন। তারপর গুঞ্জন এবং খবরের কাগজে সংবাদ বের হতে লাগল, আবদুর রহিমের তিনটি বই গেছে, আবদুল করিমের দুটি বই। ঝলমল প্রকাশনীর পাঁচটি বই সরকার কিনেছে, কলকল প্রকাশনীর মাত্র একটি। শুরু হয়ে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড। প্রকল্প বন্ধ হওয়ার অবস্থা। বিএনপির আমলে কিছু প্রকাশক এক ধাপ এগিয়ে ‘কাটিং পেস্টিং’ পদ্ধতিতে স্রেফ জাতীয়তাবাদী বই প্রকাশ করে সাপ্লাই দিতে লাগলেন। বইয়ের দাম কোনো কোনোটির হাজারের অঙ্ক ছাড়িয়ে গেল। অনেক প্রকাশক ইনার বদলে ফেললেন। এ সবই হয়েছে কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। এর পর কোনো আমলার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে নতুন ফর্মুলা বের হলো। এক প্রকাশকের কাছ থেকে এত টাকার বেশি বই নেওয়া যাবে না। একজন লেখকের এতটির বেশি বই নেওয়া যাবে না। এটি ভ্রান্ত নীতি। বই কেনা উচিত বই দেখে, প্রকাশক দেখে নয়। তাতে একজন লেখকের ১০টি বই এবং ভালো প্রকাশকের ৩০টি বইও যেতে পারে। এর ফলে গজিয়ে ওঠা লেখক ও প্রকাশক বাদ পড়বেন। প্রকাশনায় সুস্থ আবহাওয়া ফিরে আসবে। তবে সরকারি বই কেনার পদ্ধতিটি যে নষ্ট করে ফেলা হলো, এর জন্য দায়ী কিছু প্রকাশক ও লেখক। ফলে বর্তমান সরকার এসে সেই প্রকল্প ফের চালু করার ব্যাপারে ইতস্তত বোধ করছে।
বাংলাদেশে গ্রন্থ উন্নয়নের জন্য গ্রন্থকেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। গ্রন্থ উন্নয়নের ব্যাপারে গত এক দশক তারা কোনো অবদান রেখেছে বলে মনে হয় না। বছরে তারা একটি ফ্লপ গ্রন্থমেলা করে—এটুকুই যা অবদান।
এক কথায়, প্রকাশনা জগতে এক অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। এ জগতে একটি শৃঙ্খলা, একটি সুদৃঢ় অবস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার। এর জন্য প্রয়োজন লেখক, প্রকাশক, বিক্রেতা, মিডিয়া ও সরকারের সমন্বিত পরিকল্পনা। এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা হয়তো গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এর জন্য সৃজনশীল প্রকাশকদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ, দায়টা বেশি তাদের। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রকাশকেরা সাময়িক লাভে যতটা আগ্রহী, স্থায়ী লাভে ততটা নন এবং তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ বেশি। এই নিয়ে আমার প্রস্তাব হলো:
১. সৃজনশীল প্রকাশকদের আলাদা একটি সমিতি বা সংগঠন থাকা দরকার, যা সৃজনশীল প্রকাশনার উন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করবে। পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি একটি অদ্ভুত সংস্থা। প্রকাশক ও বিক্রেতাদের কাজ আলাদা। তাঁদের সমিতিও আলাদা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
২. প্রকাশক লেখকের সঙ্গে প্রতিটি বইয়ের জন্য চুক্তি করবেন এবং তাগাদা ছাড়াই যথাসময়ে লেখকের দায় মিটিয়ে দেবেন। পাণ্ডুলিপি পাওয়ার পর সম্পাদনা থেকে প্রকাশনা পর্যায় পর্যন্ত কাঠামো তিনি তৈরি করবেন। লেখক-প্রকাশকের পরস্পরের আস্থাহীনতাটা কোনো সুস্থ ব্যাপার নয়।
৩. বই বিক্রির জন্য অতি কমিশন, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তাঁরা অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। তাঁরা এককাট্টা হলে বিক্রেতারা তাঁদের শর্তে আসতে বাধ্য হবেন। কারণ, বিক্রেতাদের বই বিক্রি করতে হবে। বইয়ে উল্লিখিত মূল্যে নির্দিষ্ট কমিশন দেওয়া হবে বিক্রেতাকে। সে ক্ষেত্রে টেন্ডারে বই কেনা বস্তাপচা বিষয়টি এড়ানো যাবে।
এ পরামর্শ দেওয়া সোজা, কিন্তু কার্যকর করতে গেলে বই বিক্রি হতে হবে। অর্থাত্ বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হবে। বই পৌঁছালে পাঠক বইয়ে আগ্রহী হবে, পড়বে, বই কিনবে। প্রায় সব দেশে সরকার বিভিন্নভাবে গ্রন্থজগতের পৃষ্ঠপোষকতা করে। পশ্চিমবঙ্গে গ্রন্থাগারের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় আছে, যারা পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশনা জগেক টিকিয়ে রেখেছে। কলেজ স্ট্রিটে বহুতলবিশিষ্ট একটি বইয়ের মার্কেট গড়ে তোলা হচ্ছে বিদ্যাসাগরের নামে। সুতরাং সরকারকে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে—
১. ১৯৯৮ সালে একটি জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণয়ন ও গ্রন্থনীতির বাস্তবায়ন, অগ্রগতি ও পর্যালোচনা কমিটি করা হয়েছিল। এ নীতিতে গণগ্রন্থাগার উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত করার কথা বলা হয়েছিল। গণগ্রন্থাগারের পরিধি ও কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেলে স্বাভাবিকভাবে বই কেনা বাড়বে। সরকার এখনো সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়নি। ব্যবস্থাটা নেওয়া উচিত গ্রন্থজগতের স্বার্থে।
২. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বই কেনার প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করা দরকার। সরকার বাজেটে সে ব্যবস্থা রেখেছে। এখন একটি পদ্ধতি নির্মাণ প্রয়োজন। বই দেখে অর্থাত্ বিষয়বস্তু দেখে বই কেনা, প্রকাশক বা লেখক দেখে নয়। এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট টাকার বা বইয়ের অঙ্ক থাকবে না, যা আগে ছিল। আগের নীতি থাকলে প্রকাশক, লেখক, পাঠক কেউ উপকৃত হবেন না। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে বইগুলো পাঠানো হোক। কারণ কলেজগুলো অর্থের অভাবে গ্রন্থাগারের জন্য বই কিনতে পারে না। এর ফলে কলেজের ছাত্র-শিক্ষকেরা উপকৃত হবেন। লেখক-প্রকাশকেরাও। কোনো লেখকের বই বেশি গেলে সমালোচনা হতে পারে, হোক। নীতি ও পদ্ধতি ঠিক থাকলে সেই সমালোচনা গ্রহণযোগ্য হবে না।
৩. গণগ্রন্থাগার ও গ্রন্থকেন্দ্রকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে আনা, তাদের বাজেট বৃদ্ধি করা দরকার। আগ্রহী যারা, তাদের এসব সংস্থায় নিয়োগ দেওয়া উচিত। তিনি ক্যাডার সার্ভিসের হতে পারেন, না-ও হতে পারেন। গ্রন্থকেন্দ্রের একটি কাজ হতে পারে ঢাকা ছাড়া বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় নিয়মিত বইমেলা করা, যাতে বইয়ের খবর ঢাকার বাইরের মানুষজনও পেতে পারে। ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার আগে বিপুল অর্থ খরচ করে ডিসেম্বরের ফ্লপ বইমেলা করা অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
৪. একুশে বইমেলা এখন জাতীয় বইমেলা। এ মেলার জন্য নির্দিষ্ট একটি জায়গা ঠিক করা প্রয়োজন। বাংলা একাডেমী থেকে এ মেলা সরিয়ে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। মেলাটি সফল করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।
৫. মিডিয়াকে বইবান্ধব করা। মিডিয়া প্রতি সপ্তাহে তৃতীয় শ্রেণীর চলচ্চিত্রের জন্য এক পাতা বরাদ্দ করতে পারলে শুধু বই ও লেখকের জন্য আধা পাতা বরাদ্দ করতে পারবে না কেন? বিশেষ করে, বইয়ের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে তাদের নমনীয় হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। পাঠক পড়লে তারাও তো উপকৃত হবে।
৬. বই আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ নীতিমালা প্রয়োজন।
৭. ব্যাংক, বিমা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নববর্ষ, স্বাধীনতা-বিজয়-শহীদ দিবস, ঈদ-ক্রিসমাস-পূজায় কার্ড না পাঠিয়ে ক্লায়েন্টকে একটি বই পাঠান শুভেচ্ছা জানিয়ে। এতে বইয়ের বাজার গতিশীল হবে।
আমরা যতই বলি বা লিখি না কেন, কারও হয়তো কিছু আসে-যাবে না। কিন্তু বইয়ের জগত্ বিবর্ণ হয়ে গেলে আমরা সমষ্টিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। বই একটি জাতির সৃজনশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তি, সভ্যতা ও রুচির পরিচয় তুলে ধরে। রাজনীতিবিদ বা স্টার-সুপারস্টারের জীবনপ্রদীপ নিভে গেলে তাঁরা হারিয়ে যান। কিন্তু বই থেকে যায়, সঙ্গে সঙ্গে লেখকও।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২১, ২০১০
Leave a Reply