১ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা। বইমেলা নিয়ে কথা হয় প্রকাশকদের সঙ্গে। তাঁরা তাঁদের প্রস্তুতির কথা বলেছেন, বলেছেন মেলা নিয়ে সমস্যা-সংকটের কথাও।
মহিউদ্দিন আহমদ, ইউপিএল
আমরা বইমেলা উপলক্ষে আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিই না। বছরজুড়ে বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ করি। অমর একুশে বইমেলা আমাদের সংস্কৃৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলা একাডেমী চত্বরে ছোট্ট পরিসরে বইমেলা হচ্ছে। সেখানে সব প্রকাশককে সুযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একাডেমী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা প্রসারিত করতে চেয়েছিল। হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পায়নি। ছোট্ট জায়গার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে আমরা মেলা করছি। বাংলাবাজারকে যেন বাংলা একাডেমী চত্বরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অন্যান্য দেশে একটি থিম অনুযায়ী মেলা হয়। সেখানে প্রকাশক, লেখকসহ প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত সবার সমাবেশ ঘটে।
মেলায় যাবে ইউপিএল বাংলা চিরায়ত গ্রন্থমালা সিরিজের ২১টি বই।
মাজহারুল ইসলাম, অন্যদিন
আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট ভালো। মেলার প্রথম থেকেই অধিকাংশ প্রকাশনা পাওয়া যাবে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রকাশকেরা বইমেলার আয়োজন করে। একটা নির্দিষ্ট স্থানে মেলা হয়। আমাদের বাংলা একাডেমী আয়োজিত বইমেলা হয় একটি উন্মুক্ত স্থানে। প্রতিবছর প্রকাশক বাড়ছে, লেখক বাড়ছে, জনসংখ্যা বাড়ছে, সে তুলনায় মেলার জায়গা বাড়ছে না। একাডেমী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা বাড়াতে চেয়েছিল; কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। আগামীদিনের বইমেলার জন্য আমাদের এখনই ভাবতে হবে।
মেলায় যাবে আনিসুজ্জামান সম্পাদিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ দাশের সেরা পাঁচ উপন্যাস, হুমায়ূন আহমেদের ডিজিটাল হিমু, শুভ্র গেছে বনে, ইমদাদুল হক মিলনের শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু, নাসরীন জাহানের সেই সাপ জ্যান্ত।
আলমগীর রহমান, অবসর
আমরা একুশের বইমেলার জন্য বছরজুড়ে প্রস্তুতি নিই। দেশের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের বই প্রকাশ করার চেষ্টা করি। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী বাংলা একাডেমী জায়গা দিতে পারে না। ছোট্ট একটা জায়গায় মেলা হয়। ভিড় ঠেলে পাঠক পছন্দমতো বই কিনতে পারে না। আমরা অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছি মেলার আয়তন বাড়াতে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। দিন দিন প্রকাশকেরা নতুন নতুন বই করছেন, পাঠক বাড়ছে আর বাংলা একাডেমী মেলার পরিসর ছোট হয়ে আসছে। এ ব্যাপারে এখনই ভাবা দরকার।
মেলায় প্রথম সপ্তাহেই পাওয়া যাবে প্রদীপ রায়ের দর্শনকোষ, হায়াত্ মামুদের শিশু-কিশোর রচনাসমগ্র, সিতারা ফেরদৌসের ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রান্না।
ওসমান গণি, আগামী
মেলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি বরাবরের মতো ভালো। এবার আমরা চল্লিশটি বই প্রকাশ করছি। কাগজের দাম বাড়তি আছে। সরকার কাগজের দামে ট্যাক্স না বসালে আমরা একটু কম দামে বই বেচতে পারি। পাঠকেরা একটু কম দামে বই কেনার সুযোগ পেলে অনেক বই কিনতে পারেন। বাংলা একাডেমী সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রধান কাজ গবেষণামূলক কাজ ও গ্রন্থ প্রকাশ। বাড়তি বইমেলা করতে গিয়ে তারা হিমশিম খায়। এরপর তাদের যে জায়গা রয়েছে, সেখানে দেশের সব প্রকাশককে মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। সেই সুযোগ বাড়ানোর কথা এখনই ভাবতে হবে।
মেলায় যাবে আহমদ শরীফের রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড, ফরাসউদ্দিনের প্রথম দর্শনে বঙ্গবন্ধু, ড. হুমায়ুন আজাদের ভাষাশিক্ষা ও ভাষাবিজ্ঞান, মিজানুর রহমান খানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার: এক অশনিসংকেত, হাসনাত আবদুল হাইয়ের সাত দিনের আমেরিকা।
আহমেদ মাহমুদুল হক, মাওলা
মেলার প্রস্তুতি বেশ ভালো। আমরা দেশের সেরা লেখকদের বই প্রকাশের চেষ্টা করি। সৃজনশীল, মননশীল বিভিন্ন রকমের বই বছরজুড়ে আমরা প্রকাশ করি। আমার বিশ্বাস, এবারের একুশে বইমেলা পরিপাটি হবে। সমস্যা একটাই—মেলার সময় এসএসসি পরীক্ষা। অর্থাত্ বড়সংখ্যক পাঠক মেলায় আসতে পারবে না। জায়গার স্বল্পতার কারণে বাংলা একাডেমী আমাদের স্বল্প পরিসরের স্টল বরাদ্দ দেয়, তাই আমরা সব বই ডিসপ্লে করতে পারি না। এতে বড় প্রকাশনী এবং যাদের বই বেশি তাদের সমস্যা হয়। মেলার পরিসর বাড়ানোর ব্যাপারে একাডেমীকে অচিরেই উদ্যোগ নিতে হবে।
মেলার প্রথম সপ্তাহে চলে আসবে মোনাজাত সমগ্র, শেখ হাসিনার রচনাসমগ্র প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাসসমগ্র, কবীর চৌধুরীর আমার নজরুল, আমার রবীন্দ্রনাথ, সেলিনা হোসেনের নারীবাদী গল্পসমগ্র, নাসরীন জাহানের নারীবাদী গল্প।
মিলন নাথ, অনুপম
বইমেলার প্রস্তুতি বেশ ভালো। আমরা দেশের প্রবীণ ও নবীন লেখকদের বেশ রুচিশীল বই প্রকাশ করি। বাংলা একাডেমী দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। তাদের জায়গার সমস্যা। আগে আমরা দিন ইউনিট পেতাম, এখন সে জায়গা কমে গেছে। আমাদের সব বই ডিসপ্লে করতে পারি না। মেলার জায়গা বাড়ানোর জন্য এখনই উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
মেলায় যাবে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের রবীন্দ্রভাবনা, রবীন্দ্রনাথের চীন সফর ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, রশিদ হায়দারের চিম্বুকের নিচে আলোর আঁধার, মোহীত উল আলমের অনুবাদ শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভূতসমগ্র, মুনতাসীর মামুনের ঢাকার প্রথম।
মনিরুল হক, অনন্যা
মেলার প্রথম সপ্তাহে আমাদের অধিকাংশ বই বেরিয়ে যাবে। আমাদের প্রস্তুতি বেশ ভালো। গত বছর থেকে কাগজের দাম একটু বেশি। বাংলা একাডেমীর স্বল্প আয়তনে বড় প্রকাশকদের জন্য মেলাটা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা পিছিয়ে পড়ছি। একাডেমীর সিদ্ধান্ত আমাদের মেনে নিতে হয়। তাদের উদ্যোগী হয়ে সমস্যার সমাধান করা দরকার।
মেলায় আসবে জিল্লুর রহমান সিদিকীর রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড), আব্দুল মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধসমগ্র, ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতাসমগ্র, শাহরিয়ার কবিরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, হাসনাত আবদুল হাইয়ের গল্পসমগ্র ইত্যাদি।
ফরিদ আহমেদ, সময়
বইমেলা নিয়ে এ মুহূর্তে কোনো সংকট দেখছি না। তবে বাংলা একাডেমীর স্বল্প জায়গায় বইমেলা করা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এখনই সময় বইমেলা নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার। দিন দিন লেখক বাড়ছে, প্রকাশক বাড়ছে। বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলা একাডেমীকে উদ্যোগী হতে হবে। বাংলা একাডেমীর বইমেলা বাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করার প্রস্তাব দিয়েছি। এখন কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলেই হয়ে যায়। মেলার প্রকাশনার জন্য আমরা ভালো প্রস্তুতি নিয়েছি।
মেলায় যাবে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বিষয় ইতিহাস, মুনতাসীর মামুনের পাকিস্তানী জেনারেলের মন: বাঙালি, বাংলাদেশী ও মুক্তিযুদ্ধ , আনিসুল হকের জননী সাহসিকা ১৯৭১।
সৈয়দ জাকির হোসাইন, অ্যাডর্ন
বইমেলা এলেই শুধু বই প্রকাশ করা—আমাদের ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়। বছরজুড়ে আমাদের প্রকাশনা বাজারে আসে। এ বছর বাংলা একাডেমীর বইমেলার পরিধি বেশ ছোট। একাডেমীর নতুন ভবন তৈরির কারণে জায়গা কমে গেছে। পাঠক এসে বইমেলায় নিজের মতো ঘুরতে পারেন না। এবার সে সংকট আরও বাড়বে। প্রকাশক লেখক বাড়ছে। আমাদের বইমেলা বাংলা একাডেমীর ঐতিহ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ জন্য এখনই একাডেমীকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালার প্রথম ও দ্বিতীয় সম্ভার মেলায় প্রকাশিত হবে। সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালায় বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ১২ বই একত্র হয়েছে।
আরিফুর রহমান, ঐতিহ্য
একুশে বইমেলা প্রকাশকদের জন্য উত্সবের মতো। আমরা বইমেলার জন্য বছরজুড়ে নানা রকমের প্রস্তুতি নিই। গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের সেরা রচনা আমরা পাঠকের কাছে তুলে দিই। এবার আশিটি বই বের হচ্ছে। বাংলা একাডেমীর বইমেলা নিয়ে একটাই সমস্যা—জায়গার অভাব। দিন দিন প্রকাশক, পাঠক বাড়ছে। সে তুলনায় মেলার পরিসর বাড়ছে না। আমরা একুশে বইমেলাকে আরও পরিপাটি করার নানা প্রস্তাব একাডেমীকে দিয়েছি। সে ব্যাপারে বাংলা একাডেমীকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
মেলায় যাবে আবদুুশ শাকুরের উত্তর-দক্ষিণ সংলাপ, সিরাজুর রহমানের এক জীবন এক ইতিহাস, রিজিয়া রহমানের আল বুরজের বাদ।
রাজীব নূর, পাঠসূত্র
এবার পঁচিশটি বই প্রকাশ করছি আমরা। মেলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি বেশ ভালো। বাংলা একাডেমীর স্টল ইউনিট বরাদ্দ নিয়ে সমস্যা ছিল, তা অচিরেই সমাধান হবে। যোগ্য নয় এমন অনেক প্রকাশককে বাংলা একাডেমী দুই ইউনিট স্টল বরাদ্দ দিয়েছে। তাদের বইমেলাসংক্রান্ত যে নীতিমালা রয়েছে তা কোনোবারই মানা হয় না। ফলে বাংলাদেশে প্রকাশনাশিল্পের কোনো পেশাদারি গড়ে উঠছে না। কিছু প্রকাশকের ধান্দাবাজি রাজনীতি রয়েছে; যা প্রকাশনাশিল্পের পেশাদারিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অচিরেই যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।
মেলায় যাবে শান্তনু কায়সারের পাঁচ দশক, হামিদ কায়সারের আদম হাওয়ার বন্দুক, শিবব্রত বর্মণের ছায়াহীন দেহহীন ইত্যাদি।
জহিরুল আবেদীন, ইত্যাদি
অমর একুশে বইমেলা প্রকাশকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করি। বছরজুড়ে নানাবিধ বই প্রকাশ করলেও একুশের মেলা উপলক্ষে আমাদের বাড়তি কিছু আয়োজন থাকে। এবারও আমাদের প্রস্তুতি বেশ ভালো। নবীন প্রকাশক হিসেবে দেশের সেরা লেখকদের কিছু রচনা প্রকাশ করে আমরা পাঠকদের চমক দিই। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী বাংলা একাডেমীর জায়গা বরাদ্দটা বেশ কম। সেটা বাড়াতে হবে।
মেলার প্রথম দিন পাওয়া যাবে সৈয়দ শামসুল হকের আত্মজীবনী প্রণীত জীবন, বেলাল চৌধুরীর নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায় ইত্যাদি।
—শেখ মেহেদী হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২১, ২০১০
Leave a Reply