নাজিয়া আন্দালিব প্রিমার একক চিত্রপ্রদর্শনী চলছে বেঙ্গল গ্যালারিতে। এই আয়োজনে প্রদর্শিত চিত্রগুলো কলাকৌশল-বর্জিত কিন্তু তাঁর কল্পনাময় পরিকল্পনায় রয়েছে সরলীকরণ। চারদিকের চেনা মহল নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করায়, সেখানে স্বচ্ছন্দে বিকশিত হয়েছে বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত রূপ। দ্বিধাহীন সততার সঙ্গে ভাব প্রকাশের জন্য তা বাস্তবানুগ নয়, যা খালি চোখে অবলোকন করেছে তাও নয়। তাই তাঁর কল্পনাশক্তিতে বাহ্যিক পরিপ্রেক্ষিত পায় ভিন্নতা। চিত্রপট বা ক্যানভাস পেপারের ওপর চরিত্রগুলো পুনরুজ্জীবিত হয় দ্বিমাত্রিক বিন্যাসে।
তাঁর চিত্রের অপলক রমণীরা বুকে সীমাহীন ব্যথা নিয়ে থাকলেও শিল্পীর সৃষ্টিতে তারা বেদনার মুখোশ ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে সোচ্চার প্রতিবাদে। এই বাকরুদ্ধ নারীর চেহারা আঁকার ভেতর দিয়ে শিল্পী দুঃখ বা সুখাভিলাষ প্রকাশ করেন না, প্রকাশ করেন প্রতিবাদের অগ্নিশিখা। তাই আমাদের ইন্দ্রিয়গোচরে উদ্দীপ্ত হয় অন্ধকার জগতের ভেতরে আলোর বিচ্ছুরণ, কখনো বিদ্যুতের নানা রেখায় ঝলকিত আলোর পাশে নিবিড় আঁধার। এভাবেই রঙের বিন্যাস পায় উন্মথিত যৌবন।
ইতিপূর্বে তাঁর চিত্রকলায় ছিল পটভূমির বিস্তৃত স্পেসে নানা বর্ণের আবরণে বিমূর্ততার সমাহার। বিশেষ করে সোনালি, লাল, কমলা ছাড়াও বেশির ভাগ ক্যানভাসে ছিল কালো বর্ণের ছোঁয়া। ছবিগুলোর টেকশ্চার এসেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে নানা স্তরে রং প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। তাই টেকশ্চারগুলো সংগতিপূর্ণভাবে বিরাজমান ছিল, বিচ্ছিন্নভাবে করণ-কৌশল ছিল না। এই কৃষ্ণবর্ণ রূপ নিয়েছিল ছাপচিত্রের অ্যাকুয়াটিন্টের মতো ভেলভেটের মতো দীপ্তিময়, ম্যাড়মেড়ে নয়।
ভারতশিল্পে কৃষ্ণবর্ণ হলো গভীরতা ও ভীতির রূপক। শিল্পী এই রূপককে ব্যবহার করেছেন তাঁর শিল্পকলায়। তিনি রূপায়িত করেছেন নারীর চারপাশের ভীতিময় পরিবেশ, প্রকাশ করেছেন নারীর জীবনের একাকিত্বের গভীরতা। এই নির্বাক নারীরা কখনো কাচের শার্শি চূর্ণ করে বেরিয়ে আসতে চায়, আবার কখনো অন্ধকারে শতছিন্ন কাপড়ের ফাঁক দিয়ে অন্বেষণ করে বাইরের ঝলমলে আলো। তাঁর সাম্প্রতিক শিল্পকর্মে মেলবন্ধন ঘটেছে দ্বিধা ও সন্দেহের তরঙ্গায়িত রেখার সঙ্গে গোলকধাঁধার জটিল রেখা। এই প্রতীকী রেখার ভেতর দিয়ে শিল্পী নারীর স্থবিরতাকে তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে ক্যানভাসে নতুনভাবে স্থান পাওয়া সবুজ, নীল, গোলাপি ও বেগুনি রঙের ভেতর দিয়ে প্রকাশ ঘটেছে তাদের অবদমিত বাসনার।
তাঁর রচনাশৈলীতে এক সাবলীল চিত্রনৈপুণ্য প্রতিভাসিত, যা মনোমুগ্ধকর ও অনন্যসাধারণ। ছবিগুলোয় নারীসুলভ রঙের বাহার নেই, নেই মিষ্টি রঙের হালকা পরশ। এই রংগুলো যেন সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করা এক বিক্ষুব্ধ নারীশিল্পীর আত্মার জাগরণ। তাঁর চিত্রে ফর্ম ও স্পেস অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একদিকে যেমন সব ফর্মই স্পেসের ভেতর গড়ে উঠেছে, তেমনি ফর্মের আকার রূপ নিয়েছে কখনো কালো কখনো সাদা রেখার মাধ্যমে। জালের মতো এই রেখাগুলো কখনো বর্ণনামূলক, কখনো সত্যনিষ্ঠ। এভাবে শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভূতি ফিগরের দেহরেখাকে দিয়েছে সীমানা। রঙের বর্ণচ্ছটায় আলো-আঁধারিতে ফর্মগুলো নান্দনিক রহস্যে প্রকাশিত হয়েছে। চিত্রবিচিত্র ছবিগুলো একটা সুরের ঝংকার না তুললেও একে অপরের প্রতিধ্বনিরূপে রসের আস্বাদ থেকে দৃষ্টিকে বঞ্চিত করে না।
নাজিয়া আন্দালিব প্রিমার এবারের প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু নারী। তিনি তাঁর শিল্পকর্মে পুরুষশাসিত সমাজকে তীব্র অবলোকনের ভেতর দিয়ে চাবুক মেরে নারীর অবস্থানকে জাগিয়ে তুলেছেন। এই পলকহীন চোখগুলো শক্তির আধাররূপে চিত্রপটে ঠাঁই নিয়েছে, তাই চারপাশের বাস্তবধর্মী দৃশ্যাবলি পরিহার করে সহজ ও সারল্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সমাজের নিষেধের ঘেরাটোপে আবদ্ধ নারীর হূদয়ের সুগুপ্ত মনোরম প্রত্যাশা।
মুর্তজা বশীর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২১, ২০১০
Leave a Reply