শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন। হুসেন নামেই সবাই তাঁকে চেনে। গত ৫০ বছরে ভারতের সবচেয়ে নামী চিত্রকর; চিত্রকর্ম ও জীবনযাপন মিলিয়ে জীবন্ত কিংবদন্তি।
প্যারিস থেকে টেলিফোন করি তাঁকে। প্রথম আলাপেই শিল্পীকে খুব উত্সাহী মনে হলো। জানালাম, প্যারিসের কাগজে নয়, বাংলাদেশের কাগজে লিখব। ফেব্রুয়ারিতে আসছি। শুনে বললেন, তখন কলকাতায় আসার সম্ভাবনা আছে। ওখানেও দেখা হতে পারে।
পরে অবশ্য দেখা হয় দিল্লিতেই। কথা ছিল, দিল্লির হ্যাবিটাট সেন্টারে আসবেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সন্ধ্যার মুখে জানালেন, আটকে গেছেন কাজে। কনটপ্লেস মার্কেটের একটা ঠিকানা বুঝিয়ে দিলেন ড্রাইভারকে। মার্কেটের নিচতলার অফিসঘরে শিল্পীর মুখোমুখি হলাম।
১৯৫০ সালে একক প্রদর্শনীর পর হুসেনের বিশ্বভ্রমণ শুরু। প্যারিসে পিকাসোর সঙ্গে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। তাঁকে এক কথায় বলা যায়, সাম্প্রতিক। মানুষ চাঁদে গেল, সে বিষয়ে তিনি ছবি এঁকেছেন। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাদ্দামের পক্ষে করেছেন মার্কিনবিরোধী চিত্রকর্ম। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর আততায়ী সিরিজচিত্র এঁকেছেন; তেমনি মাদার তেরেসা, লাতিন আমেরিকার নোবেল বিজয়ী কবি অক্টাভিয় পাজের স্মৃতিতেও ছবি এঁকেছেন।
অফুরন্ত প্রাণশক্তি তাঁর, বয়স ৯৪ বছর, কিন্তু বৃদ্ধ বা পৌঢ়—এসব শব্দ তাঁর ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। আলাপে স্বতঃস্ফূর্ত; পছন্দ না হলে চোখে খানিকটা অসহিষ্ণুতার ছাপ পড়ে, আবার সহজ স্ফুর্তি ধরে রাখেন মেজাজে।
৩৬ বছর ধরেই সংবাদপত্রের শিরোনাম। খালি পায়ে হাঁটেন। ছড়ির মতো লম্বা একটা তুলি হাতে ঘোরেন। নিজের মতো করে সরস্বতী বা সীতাকে এঁকে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন।
পিকাসোর প্রতিবাদী ছবির প্রেরণায় বা গোইয়ার চিত্রের অনুষঙ্গে যে ছবি আঁকেন, তাতে হুসেনের চেতনা স্পষ্ট। হুসেন মূলত পোস্ট মডার্ন ব্যাপারগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, ব্যবহার করেন।
১৯৫০ সালে একাডেমি অব ফাইন আর্টের বার্ষিক প্রদর্শনীর জন্য আঁকা তাঁর ১৫০ রুপির ছবি বিক্রি হতো না। সেই হুসেনের ছবি রাখাটা সংগ্রাহকদের জন্য এখন স্ট্যাটাস সিম্বল। তাঁর মাঝারি মাপের একটি ছবি এখন ১৫ লাখ রুপি।
অনেকের ধারণা, তিনি ইস্যু চান। রাজনৈতিক, সামাজিক অথবা বলিউডের তারকাদের সান্নিধ্যে তিনি খবরের শিরোনাম হন। কিন্তু তিনি যে সস্তা প্রচারণার পথে পা রাখেননি—প্রতিটি চিত্রকর্মে তার স্বাক্ষর আছে। মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়ে মাতামাতি, পরে নিজের তৈরি চলচ্চিত্র গজগামিনীর নায়িকা কিংবা নির্বাসনকালে দুবাইতে নায়িকা অমৃতা রাওকে মডেল করে ছবি আঁকা—অনেকের ভাবনায় এসব বালখিল্য ব্যাপার। কিন্তু হুসেন ৯৪ বছরেও চিরযুবা।
সাক্ষাত্কার নিয়ে প্যারিসে ফিরে টেলিফোনে দিল্লি, মুম্বাইয়ের নাম্বারে কথা হয়েছে কয়েকবার।
হুসেনের জন্ম মহারাষ্ট্রের পন্দোহরপুরে। ১৯২৫ সালে। কথা বলেন মারাঠিতে। পছন্দ করেন মহারাষ্ট্রীয় খাবার। ছয় বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু। তাঁর বাবারও ছিল চিত্রশিল্পের প্রতি ভালোবাসা। তিনিই হুসেনকে উত্সাহ ও অনুপ্রেরণা দিতেন। ছোটবেলার প্রসঙ্গে বললেন, ‘সব সময় আমি ছবি আঁকতাম। খেলার কোনো সময়ই ছিল না। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০-১২ ঘণ্টা ছবি এঁকেছি বিরতি ছাড়া। এমনকি এখনো তা-ই করি।’
সাফল্যের চূড়ায় বসেও তিনি ফেলে আসা দিনগুলোকে ফিরে ফিরে দেখেন। শিল্পীজীবনের খেটে খাওয়া সময়ের কথা—‘তখনো বিয়ে করিনি। থাকতাম বোম্বের গ্রান্ট রোডের কাছে বাদরবাগে। হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য পোস্টার করতাম। দৈনিক পেতাম ছয় পয়সা। পাঁচ পয়সা যেত খাবারে, রাস্তার ধারের ধাবাতে খেতাম। একদিন ধাবাওয়ালা তার মায়ের প্রতিকৃতি করে দিতে বলে। সে কোনায় বসে ছিল। বৃদ্ধা মহিলার জীবনে কোনো ছবি তোলা হয়নি। আমার নিজের মায়ের কথা মনে হলো। মারা গেছেন, স্মৃতি রাখার মতো কোনো ফটোও নেই। আমি ধাবাওয়ালার মায়ের ছবি আঁকলাম। পারিশ্রমিক হিসেবে বিনা পয়সায় খাবার খেয়েছি ধাবাতে এক মাস। বিদায় নেওয়ার সময় তিনি বাইরের খোলা বারান্দা পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দিলেন।
কথা হলো, টেলিফোনে যোগাযোগ হবে। তার অনাড়ম্বরতা ও সৌজন্যবোধে আমি মুগ্ধ। গাড়িচালক বিহারের যুবক সঞ্জয়ের চোখে খানিকটা বিস্ময়, নিজেই স্বগতোক্তির মতো করে বলল—‘হুসেন ছাব।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৫, ২০১০
Goonjohn Chwodhury
সত্যমিথ্যা জানি না। একবার ভারতীয় একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান উপস্থাপকের কথায় জানতে পেরেছিলাম, মকবুল ফিদা হুসেনের চিরকাল খালি পায়ে থাকার রহস্যটি। ফিদা হুসেনের মা তাঁর জন্য একজোড়া জুতো কিনেছিলেন, যে জুতো তিনি পরার আগেই মা গত হন। ফিদা হুসেন এই কথা জানতে পারেন অনেক পরে, প্রায় পরিণত বয়সে। সেই মুহূর্তে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আর কোনওদিন জুতো পরবেন না। গর্ভধারিনী মা’ই তো তাকে জুতো পরিহিত দেখে যেতে পারেন নি, পৃথিবীর আর সব লোককে দেখানোর জন্য জুতো পরে কী হবে? মা’র চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিশ্চয়ই পৃথিবীর আর কেউ হতে পারেন না…।
এই ঘটনা সত্যি কিনা জানি না। কেউ নিশ্চিত করে জানালে খুশি হবো। ধন্যবাদ