কল্যাণীয়াসু,
তুমি কবিতা ও গল্প চেয়েছ বোধ হয় তোমার বিশ্বাস আমার বয়স ৭২-এর উল্টো অর্থাত্ ২৭। দেহমন দুই ক্লান্ত অথচ অপরিহার্য কাজের দায় আমার বিশ্রাম এবং সমস্ত অবকাশ চেপে বসে আছে। মস্তিষ্কের প্রতি অতিমাত্র অত্যাচার করেছি বলে সম্প্রতি সে হরতাল করেচে—তাকে ঠেলা দিলেও সে সাড়া দেয় না। স্থির করচি ঠিকানা না রেখে দূরে কোথাও অজ্ঞাতবাসে যাত্রা করব। তোমরা নিশ্চয়ই কঠিন হূদয় নও, তোমাদের কাছে করুণা প্রত্যাশা করতে পারি। আমার আশীর্ব্বাদ গ্রহণ করো। ইতি—১৩ অক্টোবর ১৯৩৩।
শুভাকাঙ্ক্ষী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা: ভূঁইয়া ইকবাল
জাহানারা চৌধুরী (১৯১৩-২৮) রূপ-রেখা (১৩৩৯-৪০) ও বর্ষবাণী (১৩৪২-৬১) নামে দুটি বার্ষিকীর সম্পাদক হিসেবে বিশ শতকের চতুর্থ দশকে কলকাতার সাহিত্যিক মহলে পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। অনিন্দ্য সুন্দরী অভিজাত পরিবারের জাহানারা রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, নজরুলসহ বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপনে সমর্থ হন।
তাঁর বড় ভাই আলতাফ চৌধুরী কলকাতায় এক সাক্ষাত্কারে আমাকে বলেছিলেন, রূপ-রেখার নামকরণ করেন রবীন্দ্রনাথ। এই বার্ষিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘মূল্যশোধ’ কবিতাটি (তোমাকে পেয়েছিলেম বলে জেনেছিলেম); পরে কবির শেষ সপ্তক কাব্যের প্রথম কবিতারূপে এটি সামান্য পরিমার্জিত হয়ে প্রকাশ পায় (স্থির জেনেছিলেম)। ১৩৮ লেক রোড, বালিগঞ্জ, কলকাতা থেকে মুদ্রিত ও আলতাফ চৌধুরী কর্তৃক প্রকাশিত রূপ-রেখা-র দ্বিতীয় সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ-তরজমাকৃত সুইনবার্নের ‘দি গার্ডেন অব প্রসপারিন’ কবিতার শেষ দুই স্তবকের বাংলা রূপান্তর ‘কৃতজ্ঞতা’ মুদ্রিত হয়েছিল (প্রাণধারণের ইচ্ছা ছেদন করি) (দেখুন, ভূঁইয়া ইকবাল সংকলিত ‘রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত পত্র ও একটি অগ্রন্থিত কবিতার পাঠভেদ’ দেশ, শারদীয় সংখ্যা, কলকাতা ১৪১৬, পৃ. ৪৯-৫৩)।
১৪ অক্টোবর ১৯৩৩-এ প্রেরিত তরজমা-কবিতা ‘কৃতজ্ঞতা’র সঙ্গে সম্পাদিকাকে একটি ছোট চিঠিও লিখেছিলেন কবি। তার আগের দিনই ১৩ অক্টোবর ১৯৩৩-এ লেখা আরেকটি চিঠি রূপ-রেখার সূচনা পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছিল (দ্বিতীয় বর্ষ ১৩৪০)।
জাহানারা তাঁর বড় ভাই আলতাফ চৌধুরীর মাধ্যমে কবির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আলতাফ ছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র এবং রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহভাজন (তাঁকে লেখা কবির একটি চিঠি প্রবাসী পত্রিকায় ও পরে বাংলা শব্দতত্ত্ব বইয়ে প্রকাশিত)।
জাহানারা সম্পাদিত বর্ষবাণী-র তৃতীয় সংখ্যায় (১৩৪২) কবির ‘দিশাহারা’ কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। আগেই লেখন সংকলনেও রবীন্দ্র-হস্তাক্ষরে শিরোনামহীন কবিতাটি প্রকাশ পায় (১৩৩৪)।
জাহানারাকে প্রদত্ত স্বাক্ষরলিপি (অটোগ্রাফ) উপহার প্রদান উপলক্ষে কবিতাটি লেখা হয়েছিল বলে অনুমান করি। লেখন-এর ১৫৭ সংখ্যক শিরোনামহীন কবিতাটির সঙ্গে বর্ষবাণীর ‘দিশাহারা’র বিন্যাসে ও পাঠে সামান্য ভেদ আছে (চাঁদ কহে, ‘শোন শুকতারা, রজনী যখন হোলো সারা—’) বর্ষবাণীর পাঠ; আর লেখন-এর বিন্যাস; চাঁদ কহে, ‘শোন্
শুকতারা,
রজনী যখন
হল সারা’
১৯৩৩-এর ১৩ অক্টোবর এই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথের কোনো পত্রসংকলনের বা অন্য কোনো বইয়ে গ্রথিত হয়নি। চিঠিটি পেয়েছি অনাথনাথ দাসের সৌজন্যে।
(প্রথমা প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিতব্য রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ গ্রন্থ থেকে)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৫, ২০১০
Leave a Reply