শীতের সকালে ঘরের সামনে মাদুরে বসে মুড়ি খাচ্ছিল আমেনা। গত পরশু শ্বশুরবাড়ি থেকে বাড়ি এসেছে। পোয়াতি। উঠোনে পাশের বাড়ির জমিলা ভাবিকে দেখতে পেল আমেনা। কোথায় যেন যাচ্ছে।
কই যাও ভাবি?
যাই রহিমাগো বাইত্তে।
খাড়াও, আমিও যামু।
না, তোর যাওনের কাম নাই, পোয়াতি মানুষ।
না, আমি যামু।
ঘরের ভেতর থেকে আমেনার মাও নিষেধ করল আমেনাকে, কিন্তু এমন খবর শোনার পরে রহিমাদের বাড়িতে না গিয়ে থাকতে পারল না আমেনা। আমেনার মা জমিলাকে বলে দিল ‘মাইয়াডারে লগে নিয়া আইস বউ।’
মূল রাস্তা ধরে রহিমাদের বাড়ি আমেনাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে হলেও বিভিন্ন বাড়ির ওপর দিয়ে শর্টকাটে দশ মিনিটের পথ। হালদার বাড়ি, খনকার বাড়ি, আম্বিয়াবুদের বাড়ি; তারপর বড় রাস্তা ধরে একটু আগালেই হাতের ডানে রহিমাদের বাড়ি। জমিলা সে পথ ধরে। আম্বিয়াদের বাড়ির ওপর দিয়ে যেতেই পথ আগলায় আম্বিয়া বু।
আমেনা কই যাস?
এই যাইতাছি একটু রহিমাবুগো বাড়ি।
খাড়া, আমিও যামু। আহারে, মাইয়াডা কত ভালা আছিল।
জমিলাকে সাথে নিয়ে বড় রাস্তায় নামতেই দশ-বারোজনের একটা-একটা দল পায় আমেনা। বেশির ভাগই মহিলা, বাচ্চা কোলে দুইজন। অপরিচিত লাগছে বলে আমেনার নিষেধ অগ্রাহ্য করেই জমিলা তাদের সাথে কথা বলে।
আপনেগো তো চিনলাম না। কোন বাইত্তে বেড়াইতে আইছেন?
আমাগোরে চিনবেন না। আমরা শিদলকুরার থেইকে আইছি। রহিমাগো বাড়িডা কোন দিকে কইতে পারবেন?
রহিমাগো বাইত্তে ক্যান? রহিমা কি আপনেগো আত্মীয় লাগে?
আরে না, হুনলাম বেটি নাকি ভাতাররে খুন করছে। এই লেইগ্যা দেখতে আইলাম।
আমেনা ও জমিলা একটু আশ্চর্য হয়। সকালবেলা মাত্র শুনল সবাই। এর মধ্যে খবর এত দূর চলে গেছে। সেই শিদলকুরা পর্যন্ত।
রহিমাদের বাড়িতে ঢুকতেই আমেনা একটু হকচকিয়ে যায়। কম করে হলেও এক-দেড় শ মানুষ। বেশিরভাগই মহিলা। অল্প কিছু পুরুষ মানুষ একটু দূরে জটলার মতো করে আছে। ভিড় ঠেলে একটু আগাতেই বিভিন্নজনের বিভিন্ন মন্তব্য শুনতে পেল আমেনা বেগম।
এই কামডা কেন করতে গেল…
আরে সোয়ামি তো সোয়ামিই, খারাপ হইলেও সোয়ামি…
জাহান্নামেও ওর জায়গা হইব না…
বেটির তেজ আছে…
মাইয়া মাইনষের বেশি তেজ থাকন ভালা না…
উচিত কাম হইছে, বেটা হেরে যেই মারণটা মারত…
আরে মাইয়া হইতাছে দেইখ্যাই এত মারতে হইব…আল্লায় যেইডা দিছে হের ওপরে কাউরো হাত আছে…
আসল কথা কওনাকা বু, আসল কথা হইল বেডার নতুন বিয়া করনের খায়েশ হইছে…
হেদিনও আমাগো বাইত্তে আইয়া আমারে ধইরা কী কান্দন, চলা দিয়া বাইরাইছে…
এমন পুরুষ মানুষরে আরও আগেই মারণ উচিত আছিল…
দাও দিয়া কোপাইয়া মারছে! দাওডা কই?…
মাইয়াগুলার যে কী হইব অহন…
রহিমার শাশুড়ি আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন বসে আছে ডান দিকের পাকের ঘরের সামনে। একটু পরপর রহিমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে বিলাপ করছে। দেবর তেড়ে আসছে রহিমাকে মারার জন্য, গ্রামের লোকজন তাকে থামাচ্ছে। রহিমার মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। আত্মীয়স্বজন কেউ আসেনি। খুনির আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিপদ ডেকে আনতে কে চায়?
পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মাতবর শ্রেণীর লোকজন এ নিয়ে খুব রোমাঞ্চিত। পুলিশ আনতে কেউ কেউ থানায় চলে গেছে। মেম্বর সাহেব সকাল থেকেই এখানে। তারই পরামর্শে রহিমাকে পিছমোড়া করে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। বলা তো যায় না, কখন আবার পালায়ে যেতে পারে। দা-টাও যেভাবে ছিল সেভাবেই রাখা আছে। লাশটাও। চেয়ারম্যান সাহেবও রেডি হয়ে বসে আছে, লোক ঠিক করা আছে, পুলিশ প্রথমে তার বাড়িতে আসবে, তারপর একসাথে খুনির বাড়িতে যাবে।
যাকে ঘিরে এত কথাবার্তা সে রহিমা বানু বসে আছে মাটিতে। কপাল দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। কাপড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। শীতের কারণে খুব দ্রুত জমাট বেঁধে গেছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটু দূরে সাত বছর বয়সী বড় মেয়েটার কোলের সাত মাসের মেয়েটার দিকে। পাশে বসে কাঁদছে চার বছরের মেয়েটা। সেই রাতে মেয়েটাকে বুকের দুধ খাইয়েছে, এখন এত মানুষের সামনে কীভাবে খাওয়ায়। তার থেকেও বড় কথা, হাতটা পিছমোড়া করে বাঁধা ঘরের খুঁটির সাথে। নড়তেও পারছে না। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ, ভাবলেশহীন। যেন একটা জড়বস্তু বসে আছে। নড়েও না, চড়েও না।
গত রাতটাও আর দশটা রাতের মতোই ছিল। মেয়েদের শুইয়ে দিয়ে রহিমা বসে ছিল চোকিটায়। সে সময় রহিমার স্বামী আয়নাল মাঝির ঘরে প্রবেশ। মাতাল হয়ে। লোকটা আগের থেকেই খচ্চর টাইপ, তবুও মাতলামিটা এখন বেড়ে গেছে।
আবারও খাইছো?
খাইমু না তো কী? মনের দুককুগুলারে মারতে হইব তো।
তোমার আবার কিয়ের দুককু
কিয়ের দুককু মানে! পোলা দিতে পারছ না, আবার কস দুককু কিয়ের?
এভাবেই শুরু। এক কথা দুই কথা। তারপর দরজার খিল খুলে যখন রহিমাকে মারছিল, তখনো সব ঠিক ছিল। এর পরের কোনো কিছু রহিমার মনে নাই। খালি মনে আছে, তিনটা মাইয়াই চিল্লাইতেছিল। মনে আছে সাত মাসের মাইয়াটার দিকে তেড়ে আসছিল আয়নাল মাঝি। মেরে ফেলবে বলে। বাপ মেয়েকে মারতে পারবে কি না সে বিচারের জ্ঞান তখন ছিল না রহিমার। শুধু আগের অনেক ঘটনা মনে পড়তেছিল। দা-টা কখন হাতে নিয়েছিল তাও জানে না সে। শুধু জানে, একটা সময় কোপ দিয়েছিল স্বামীর গায়ে, তারপর আরও। তারপর আর কিছু জানে না রহিমা।
আমেনা ভিড় ঠেলে সামনে আসতেই রহিমার সাথে চোখাচোখি হলো। আমেনা চোখটা নামিয়ে ফেললেও রহিমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমেনার দিকে। অস্পস্ট স্বরে ডাকল, ‘আমেনা, ছোড মাইয়াটারে একটু আইন্যা দিবি, দুধ খাওয়াইতাম।’ খুনির মুখে কথা শুনে জটলার কোলাহল হঠাত্ করে থেমে গেল। সবাই যেন শুনতে চাচ্ছে কী বলছে খুনিটা। আমেনাও বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। অন্য সময় হলে কত কিছু বলতো। যদিও আমেনার থেকে রহিমা বছর তিনের বড়, কিন্তু পড়েছে একই সাথে। আমেনা ডিগ্রি পাস করেছে আর রহিমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ক্লাস সিক্সে থাকতে। তারও বছরখানেক আগে রহিমার মা-বাবা দুজনেই মারা গিয়েছিল বলে ভাইয়েদের কথার ওপরে কোনো কথা বলতে পারে নাই রহিমা। এই সময় ‘পুলিশ এসেছে’, ’পুলিশ এসেছে’ শব্দের সুযোগে আমেনা লুকিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
পুলিশ আসার পরেই ভিড়টা আস্তে আস্তে কমতে লাগল। পুরুষ মানুষেরা থাকলেও মহিলারা ফিরতে লাগল তাদের বাড়ির দিকে। জমিলা ভাবির ডাক পেয়ে আমেনা হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে। অন্যমনস্কভাবে। জমিলা যেন বুঝতে পারল আমেনার অন্যমনস্কতা। ‘কইছিলাম আহনের দরকার নাই। প্যাটের মইধ্যে বাচ্চা। অহন কিছু হইলে…’
আমেনার চোখে তখন রহিমার সেই চাউনি। কানের মধ্যে ক্রমাগত শব্দ— ‘ছোড মাইয়াডারে একটু আইন্যা দিবি, দুধ খাওয়াইতাম।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৫, ২০১০
debjani
darun!!!!!!!!!!!!!!!!!!!