তাঁরা তিনজনই স্বনামখ্যাত এবং একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এ কে খন্দকার ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি, মঈদুল হাসান অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী এবং এস আর মীর্জা মুক্তিযুদ্ধের জন্য গঠিত যুবশিবিরের মহাপরিচালক।
তাঁরা যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেন কিংবা সে সম্পর্কে নিজস্ব মতামত তুলে ধরেন, তখন তা গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হয়। তাঁরা কেবল ইতিহাসের কথক নন, নির্মাতাও। বিবরণের চেয়ে অন্তরালের ঘটনা পাঠকের মধ্যে অনেক বেশি আগ্রহ সৃষ্টি করে, প্রসারিত করে তাঁদের ভাবনার দিগন্তকে।
এ প্রেক্ষাপটে মক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন বইটি ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে। এতে এমন কিছু আছে, যা আগে কেউ বলেননি, আবার এমন কিছু বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে, যা বিতর্কও সৃষ্টি করতে পারে।
ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দীন আহমদ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘যখন কোনো ঐতিহাসিক আন্দোলন বা রূপান্তরের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিপুলসংখ্যক মানুষ যুক্ত হয়ে পড়েন, তখন তাঁদের সাক্ষ্য ও প্রতিবেদনাদি সংগ্রহ করা যথার্থ ইতিহাস রচনার জন্য প্রয়োজনীয় পন্থা হিসেবে স্বীকৃত।’
তাঁর ভূমিকা থেকে আমরা আরও জানতে পারি, যথার্থ ইতিহাস লেখার দায় থেকেই মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকেন্দ্র প্রায় ৫০০ প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারীর মৌখিক বিবরণ সংগ্রহ করে, যা ২২ খণ্ডে প্রায় পাঁচ হাজার পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন সেই প্রকল্পেরই অংশ। বইটির অধ্যায়গুলো বিন্যস্ত হয়েছে এভাবে—অসহযোগ আন্দোলন প্রতিরোধ যুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা, সশস্ত্র লড়াই, সেনাবাহিনীর মনস্তত্ত্ব, পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা সেনাসদস্য প্রসঙ্গ, গেরিলা তত্পরতা, যৌথ সামরিক নেতৃত্ব, অন্যান্য বাহিনী প্রসঙ্গ, যুবশিবির প্রসঙ্গ, মুজিববাহিনী ও স্বাধীনতার পরবর্তী প্রসঙ্গ। শিরোনাম দেখেই ধারণা করা যায়, মক্তিযুদ্ধের নানা দিক কথকদের আলোচনায় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। এত কাছাকাছি সময়ে সেটি হয়তো সম্ভবও নয়। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি যুক্ত ছিলেন, তাঁদের বর্ণনায় ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ও রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি পক্ষপাত থাকা অস্বাভাবিক নয়। এ বইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
তবে এখানে তিন কথকই সাহস করে অনেক অপ্রিয় সত্য বলেছেন। ব্যক্তি বা সংগঠনের ত্রুটির পাশাপাশি সার্বিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের দুর্বলতাগুলোও তুলে ধরেছেন। তাঁদের কথোপকথন থেকে আমরা এও জানতে পারি যে একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশে বাড়তি সেনা ও অস্ত্র আনা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক প্রস্তুতি নেয়নি, রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রেও ছিল সীমাহীন সমন্বয়হীনতা। মুজিবনগর সরকারে নেতৃত্বের কোন্দলের কথাও সবার জানা। কিন্তু প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর স্বেচ্ছাচার যে মুক্তিযুদ্ধকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছিল সেই সত্যটিও উঠে এসেছে তাঁদের বর্ণনায়। ওসমানী নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি, আবার ব্রিগেড গঠন নিয়েও তুঘলকি কাণ্ড করেছেন। তাঁর প্রতি সেক্টর অধিনায়কদের যেমন আস্থা ছিল না, তেমনি তিনিও তাঁদের বিশ্বাস করতেন না। এ ব্যাপারে এস আর মীর্জার সাক্ষ্য হচ্ছে, ‘আসলে সদর দপ্তরের যুদ্ধ পরিকল্পনা বলতে তেমন কিছু ছিল না। বরং কর্নেল ওসমানীর ছিল খামখেয়ালিপূর্ণ পদক্ষেপ।’
সব মিলিয়ে তিন কথক যে তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ হাজির করেছেন, তাতে এ উপসংহারে আসা অসম্ভব নয় যে স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক হানাহানির সূচনা হয়েছিল একাত্তরেই। সে সময় সব শ্রেণী-পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে অন্তরে ধারণ করলেও সবাই সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেননি দলীয় ও উপদলীয় কোন্দলের কারণে। এ কোন্দল শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বে সীমিত ছিল না, ছড়িয়ে পড়েছিল সামরিক অধিনায়কদের মধ্যেও।
মুজিবনগর সরকারের প্রতি আওয়ামী লীগের তরুণ অংশের অনাস্থা কিংবা সেক্টর অধিনায়কদের মধ্যকার বিরোধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অব্যাহত ছিল স্বাধীনতার পরও। রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের অধিকাংশই জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তির কৃতিত্ব জাহির করতে অধিক সক্রিয় ছিলেন। একজন তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সব কিছু সামাল দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। তার পরও বলব, অসাধারণ প্রজ্ঞা ও অসীম ধৈর্যের সঙ্গে একের পর এক সংকট মোকাবিলা করে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ সর্বোতভাবে সহায়তা পেয়েছেন ভারত সরকারের কাছ থেকে। তবে এ সহায়তার পেছনেও যে উদ্দেশ্য ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ প্রসঙ্গে এ কে খন্দকারের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘আসলে মুজিব বাহিনী বাংলাদেশ সরকারের বা বাংলাদেশ বাহিনীর নেতৃত্বের আওতায় আসুক, এটা বোধ হয় ভারত সরকার চায়নি তাদের কৌশলগত কারণেই। মুজিব বাহিনী চলমান যুদ্ধের বিষয়ে যতটা না আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী বা তত্পর ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের করণীয় বা ভূমিকা নিয়ে।’
এত দ্বন্দ্ব-দুর্বলতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধ সফল হলো কীভাবে? এ প্রশ্নের জবাব রয়েছে মঈদুল হাসানের বক্তব্যে, ‘মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতর পাকিস্তানিদের প্রায় অচল করে ফেলেছিল। এটা হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের, যারা অধিকৃত এলাকায় ছিল, তাদের সহযোগিতার ফলেই।’ অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষের ভূমিকাই হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক অধিনায়কেরা যে প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে সংকীর্ণতা ও স্বার্থবাদিতার পরিচয় দিয়েছেন তারই অসংখ্য প্রমাণ আছে এ বইয়ে।
এসব ইতিবাচক বিষয় সত্ত্বেও বইটির দুর্বলতার দিক হলো স্বাধীনতার প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানেব অনুপস্থিতি। তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে তিনি কিছু করেননি এ কথাও ঠিক নয়। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও মঈদুল হাসান সে কথা স্বীকার করেছেন। তার সাক্ষ্য এখানে তুলে ধরছি, ১৯৬৯ সালে লন্ডনে শেখ মুজিব-ইন্ধিরা গান্ধী বৈঠকে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমরা জানি, নির্বাচনে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতব। কিন্তু ওরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না। ঠিক ১৯৫৪ সালের মতো হবে। আবার কেন্দ্রীয় শাসন জারি করবে। ধরপাকড় করবে। কিন্তু এবার আমি তা হতে দেব না। আমার কিছু ছেলেকে তোমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে হবেই, আর একটা বেতার যন্ত্র দিতে হবে, যেখান থেকে তারা যাতে প্রচার করতে পারে যে বাংলাদেশকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।’
অতএব শেখ মুজিব কেবল গণসংগ্রাম, সত্তরের নির্বাচন ও অসহযোগ আন্দোলনেরই কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা ও ভরসাস্থল।
ইতিহাসকে আমরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না, বদলাতে পারব না। অনেক সময় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ঘটনা ভুলভাবে উত্থাপিত হয়; সত্য হারিয়ে যায়। এই আশঙ্কা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন বইটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি সত্যানুসন্ধানের প্রয়াসও বটে।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন—এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা; ডিসেম্বর ২০০৯; প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরী; ১৪৮ পৃষ্ঠা; ২২ টাকা।
সোহরাব হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৫, ২০১০
Leave a Reply