গ্লেন হাবার্ড ও উইলিয়াম ডুগান রচিত দ্য এইড ট্র্যাপ: হার্ড ট্রুথ্স অ্যাবাউট এন্ডিং পভারটি বইটি বেরিয়েছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে। দ্য ইকোনমিস্ট এই বইয়ের আলোচনা ছেপেছে ৫ জানুয়ারি ২০১০ সংখ্যায়। আলোচনাটির অনুবাদ ছাপা হলো
উন্নয়ন সাহায্যের সমস্যা নিয়ে অনেক পেটমোটা বই বাজারে আছে। যেগুলো উপাত্তের আড়ম্বরে পূর্ণ। জর্জ বুশের অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রধান ও কলম্বিয়া বিজনেস স্কুলের বর্তমান ডিন গ্লেন হাবার্ড ও তাঁর সহকর্মী উইলিয়াম ডুগান রচিত বইটি কিন্তু সেদিক দিয়ে আশ্চর্য ব্যতিক্রম। মোটে ১৯৮ পৃষ্ঠার এই বইটি প্রকাশ করেছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। আরও অনেকের মতো এই দুই প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতও গরিব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশি সাহায্য প্রদানে বিদ্যমান কাঠামোর ব্যর্থতায় অসন্তুষ্ট ও হতাশ। কিন্তু বিকল্প হিসেবে তাঁরা এই কাঠামোর সম্পূর্ণ অপসারণ না চেয়ে চান এর সংস্কার। তাঁদের মতে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের সম্প্রসারণই হতে পারে একে কার্যকরী করার মোক্ষম উপায়।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিদেশি সাহায্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। যেমন মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের কিছু অংশ তিনি ব্যয় করেন গ্রামীণ দরিদ্র মহিলাদের জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ প্রদানে। তাঁর এই ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেছে। দারিদ্র্য নিরসনে এখন পর্যন্ত তাঁর এই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমই সর্বাধিক প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু এটা নেহাত ব্যতিক্রম। দেখা গেছে, ব্যক্তিমালিকানা খাতে গতিশীলতার অভাব থাকা সত্ত্বেও এদের সংবর্ধন ও সংরক্ষণে সে দেশের সরকার ও সাহায্য সংস্থাগুলোর মনোযোগে ঘাটতি আছে। উপরন্তু, ব্যক্তিমালিকানা খাতে তাঁদের কার্যক্রমের প্রভাব কী, দাতাসংস্থাগুলো এই পাল্লায় কখনো তাঁদের প্রকল্পকে মূল্যায়িত করে না।
পরিস্থিতি উন্নয়নে একটা বিকল্প প্রস্তাব অবশ্য তাঁরা পেশ করেছেন। তাঁরা নজর ফিরিয়েছেন ‘মার্শাল প্ল্যানে’র দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠনে এই পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল। মার্শাল প্ল্যানে প্রাপ্ত অর্থের একটা অংশ ব্যয় করা হয়েছিল বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য ঋণ দেওয়ার কাজে। এই টোটকা কাজে লেগেছিল। পরবর্তী সময়ে কোম্পানিগুলো সরকারকে আঞ্চলিক মুদ্রায় এই ঋণ পরিশোধ করে। সরকার তা কাজে লাগায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে। তো দেখা যাচ্ছে, একটু এদিক-সেদিক করে গরিব দেশগুলোর জন্য তাঁরা মার্শাল প্ল্যানের দাওয়াই দিচ্ছেন। তাঁরা চাচ্ছেন, দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পাওয়া অর্থ সরকার ব্যয় করুক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে। এভাবে ব্যাষ্টিক অর্থনীতিতে আসবে ইতিবাচক পরিবর্তন, রাষ্ট্রগুলোও মুক্তবাজার ব্যবস্থায় নিজেদের অবস্থান সংহত করতে পারবে।
সবই বোঝা গেল। কিন্তু খয়রাতের রাজনীতি যে দানব-বাণিজ্য কায়েম করেছে এই ব্যবস্থা তার মনঃপূত না হওয়ারই কথা। এখানেই শেষ নয়। গরিব দেশগুলোর বাস্তবতাও বিবেচনায় আনতে হবে। ইউরোপে এটা কাজ করেছে। তাঁদের ছিল একটি প্রতিষ্ঠিত বাজার অর্থনীতি। সংস্থাগুলো শুধু সেই পালে হাওয়া দিয়েছে। এ ছাড়াও তাঁদের হাতে ছিল দক্ষ মানবসম্পদ। এশিয়া বা আফ্রিকার গরিব দেশগুলো এগুলো কোথায় পাবে? দেশগুলোও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে কোনো মুনশিয়ানার পরিচয় দিতে পারে না। এ রকম অনেক দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো নির্ধারণ করে থাকে। দেখা গেছে, সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত এসব দেশের অর্থনীতিবিদেরা দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে তাঁদের মূল বিবেচ্য বিষয় হওয়া দরকার রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক কে হবে, রাষ্ট্র না বাজার—সেটা নির্ধারণ করা।
যাই হোক, বইটিতে বিদেশি সাহায্য প্রদানে কিছু অবকাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাব তাঁরা করেছেন। দাতা সংস্থাগুলোর সমালোচনাকারীরা হয়তো এতে কিছু আমোদ পাবেন। কিন্তু তাঁরা আবার হতাশ হয়ে পড়বেন এই দেখে যে এর থেকে বেরিয়ে আসার সত্যিকার কোনো রাস্তা এই দুই পণ্ডিত দেখাতে পারেননি।
অনুবাদ: তামিম ইয়ামীন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৫, ২০১০
Leave a Reply