নিসর্গবিদ্যা চর্চা
ভোরের ফুল সন্ধ্যার পাখিরা—মোকারম হোসেন; ঐতিহ্য, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি ২০০৯; প্রচ্ছদ: বীরেন সোম; ১৩৬ পৃষ্ঠা; ১৬০ টাকা।
কিছুকাল আগেও বাংলা ভাষার বইয়ের জগত্ ছিল বিষয়বৈচিত্র্যে প্রায় দীনহীন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কিছু সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ বা ইতিহাসধর্মী রচনার বাইরে সাহিত্যের বই পাওয়া যেত খুবই কম। বৈচিত্র্যময় বিষয়ের বই দু-একটা কখনো পাওয়া গেলে তাকে উজ্জ্বল ব্যতিক্রমের বেশি বলা বোধ হয় ঠিক হবে না।
বিগত বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির নানা ক্রিয়ার ফলে, প্রযুক্তির অভাবিত ও বিচিত্র সুযোগের সহজলভ্যতার কারণে এবং বৈষয়িকতার উন্নতির চাপে মানুষের আগ্রহের ক্ষেত্র বেড়েছে। আগ্রহের ক্ষেত্র বাড়ার হয়তো একটি কারণ হতে পারে মানুষের দ্রুত উন্নতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজাত সংকট থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু কারণ যা-ই হোক, বাংলা বইয়ের জগতে সাম্প্রতিককালে যে বিষয়বৈচিত্র্য আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে সে কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। মোকারম হোসেনের লেখা ভোরের ফুল সন্ধ্যার পাখিরা বইটি পড়তে পড়তে উপর্যুক্ত কথাগুলো মনে এল। কারণ, বাংলাদেশের সাহিত্যে বিজ্ঞানচেতনা-উজ্জীবিত নিসর্গ-সাহিত্যের দৃষ্টান্ত প্রাপ্তির ইতিহাস বেশি দিন আগের নয়। দ্বিজেন শর্মার শ্যামলী নিসর্গ বইটির ভাগ্যে নিসঙ্গতা ছিল দীর্ঘকালের। প্রবীণতায় সমসাময়িক হলেও নওয়াজেশ আহমদের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ সমৃদ্ধ নিসর্গসাহিত্য, কিংবা বিপ্রদাশ বড়ুয়ার কতিপয় নিসর্গবিষয়ক গ্রন্থ শ্যামলী-নিসর্গ-এর নৈঃসঙ্গ্য খানিকটা দূর করলেও সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতা, কিংবা সাহিত্যিক চারিত্রে সমধারার হয়ে উঠতে পারেনি। তবে সাম্প্রতিককালে আবদুস শাকুরের গোলাপ সংগ্রহ এই ধারার এক উজ্জ্বল সংযোজন বলা যেতে পারে। মোকারম হোসেন এই ধারারই অনুপ্রাণিত একজন লেখক।
ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে গাছফুল-পাখিরও সংখ্যাবৈচিত্র্য বিপুল। দুই পর্বে বিভাজিত মোকারম হোসেনের ভোরের ফুল সন্ধ্যার পাখিরা বইয়ের প্রথম পর্বে লেখক এই বৈচিত্র্যকে একদিকে সন্ধান করেছেন, অন্যদিকে নিসর্গপ্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যকে ষড়ঋতুর পটভূমিকায় চেয়েছেন অনুভব করতে। তাঁর রচনাসমূহের লক্ষ্য একদিকে বাংলাদেশের গাছপালা-ফুল-পাখির বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ, অন্যদিকে কথাসাহিত্যিকের দৃষ্টি দিয়ে এর প্রাকৃতিকতাকে অবলোকন। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে নাগরিকজীবনে নিসর্গের ভূমিকা ও নগরনিসর্গের রূপসমূহের যথাপ্রয়োগের সূত্রসন্ধান। এই যুগপত্ দায়িত্ব পালনে তাঁকে চূড়ান্ত সিদ্ধকাম ব্যক্তি হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু সিদ্ধির দিকেই যে তাঁর যাত্রার অভিমুখতা অনুভব করা গেছে।
বইটি দুই পর্বে বিভাজিত হওয়ার কারণ এর প্রথম পর্বের রচনাসমূহ বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের আর দ্বিতীয় পর্বের রচনাসমূহ প্রতিবেদকের অনুসন্ধানের উপজীব্য। একদিক থেকে উভয় পর্বেরই সাধারণ অনুসন্ধেয় নিসর্গ হলেও দুই ধরনের রচনা মিলে একটা সম্পন্ন ঐক্য সৃষ্টি করতে পারেনি। নিসর্গ নিয়ে পর্যবেক্ষক ও সংবেদনশীল মনের পরিচয় বইটির মধ্যে পাওয়া গেলেও তা কতটা সহূদয়সংবেদ্য হয়ে উঠেছে তা নিয়ে একটু গভীরভাবে ভেবে দেখার অবকাশ রয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। তবে এই বইয়ে লেখকের ভাবনায় সমাজসচেতন মনের পরিচয় পাওয়া যায়, পাওয়া যায় পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক তত্পরতার খবর। মোকারম হোসেনের এই বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, নিসর্গবিদ্যা চর্চায় আন্তরিক আগ্রহ এবং সাহিত্যিক সামর্থ্য বাংলা ভাষায় এই ধারার চর্চাকে গতিমান করে তুলবে এই আশা করা যায়।
আহমাদ মাযহার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৫, ২০১০
Leave a Reply