১৯৭১: বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া—হাসান ফেরদৌস, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৯
১৯৭১ আমাদের জাতীয় জীবনের পরম গৌরবময় পর্ব, চরম দুঃসময়ের কালও বটে। একাত্তরের সেই ঘটনাধারার ছিল স্বাদেশিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক তাত্পর্য। আমরা একাত্তরকে দেখি মূলত আমাদের জাতীয়-বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে, কিন্তু এর ব্যাপকতর তাত্পর্য অনুধাবনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থান থেকে একাত্তর-অবলোকন বয়ে আনতে পারে ভিন্নতর উপলব্ধি, সঞ্চার করতে পারে গভীরতর তাত্পর্য। ভেতর থেকে দেখা ইতিহাস এবং বাইরের বিবেচনা ও ঘটনাধারার মিলনেই পাওয়া যেতে পারে পূর্ণাঙ্গ এক ছবি, যদিও ইতিহাস-বিচারে পূর্ণতায় পৌঁছার মতো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধি নেই, নিরন্তর চলে এর পুনর্বিচার, পুনর্মূল্যায়ন, যার ভিত্তি রচনা করে আহরিত নতুন নতুন তথ্য, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকসম্পাত এবং এভাবে চলে অভ্যস্ত-ভাবনার পরিধিকে ক্রমাগত প্রসারিত করা, পাল্টে দেওয়া।
একাত্তর নিয়ে ভাবনার তোলপাড় জাগানিয়া গ্রন্থ সংখ্যায় বেশি মেলে না, আমাদের সৌভাগ্য তেমন একটি উপহার মিলল হাসান ফেরদৌস প্রণীত ১৯৭১: বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া গ্রন্থের সুবাদে। এ গ্রন্থের অবলম্বন একান্তভাবে বাইরের অবলোকন, ক্ষমতার বিভিন্ন বিশ্বকেন্দ্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসৃষ্ট অভিঘাত এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছে মূল বিবেচ্য। বিগত প্রায় এক দশকজুড়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধের বাছাইকৃত সংকলন এটি। বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ছোট-বড় বিভিন্ন রচনা মিলে গ্রন্থ আকারেও বেশ ভারিক্কি হয়েছে। তবে পাঠকের জন্য বড় পাওনা অনেক নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণের নতুন দৃষ্টিকোণের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। ভারত, পাকিস্তান, চীন এবং সর্বোপরি আমেরিকা ও জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ প্রশ্ন নিয়ে নানা বিবেচনা, বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে লেখকের বিবেচ্য। তবে এর অনেকটাই পর্দার অন্তরালের ছবি, যে চিত্র ধারণে প্রধান সূত্র হয়েছে সাম্প্রতিককালে অবমুক্ত বিভিন্ন গোপন দলিল, ইতিহাসের অংশীদারদের রচিত স্মৃতিভাষ্য, বিদেশে প্রকাশিত বইপত্র এবং সংবাদপত্রের রিপোর্ট। ফলে প্রচুর পাঠ নিতে হয়েছে লেখককে এবং তথ্যের জোগান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস-বিশ্লেষকের দায়ও তাঁকে মেটাতে হয়েছে। এমন রচনা কোনো সহজ কাজ নয়, তদুপরি অধিকাংশ নিবন্ধ রচিত হয়েছে দৈনিক সংবাদপত্রের চাহিদা ও পাঠকের দিকে লক্ষ রেখে। ফলে তাত্ক্ষণিকতার সঙ্গে মিশেল ঘটাতে হয়েছে ইতিহাস-চেতনার এবং এই কাজে হাসান ফেরদৌস রেখেছেন অনায়াস-দক্ষতার পরিচয়। অন্যদিকে এমনি দক্ষতা এক ধরনের সীমাবদ্ধতাও আরোপ করে। এ ধরনের রচনার একটি ঘাটতির দিক হলো, শেষ বিচারে তা আর হয়ে ওঠে না ইতিহাসের বই, হয় ইতিহাস-বিষয়ক বই, নিদেনপক্ষে রিপোর্টিং অন হিস্টরি। বিচ্ছিন্ন সব ফুল নিয়ে পূর্ণ এক মালা গাঁথার কাজটুকু থেকে যায় আরদ্ধ, পাঠককে তা করার মতো পুষ্পহার জোগান দিয়ে যান লেখক, মালা তিনি গাঁথেন না, তবে সেই পুষ্পাঞ্জলিও এক বড় পাওয়া বটে।
একাত্তরে বন্ধু ও শত্রুর পরিচয়দায়ক নিবন্ধগুলো মেলে ধরেছে বিশাল ব্যাপ্তি। নিক্সন প্রশাসনের অন্দরমহলের ছবি এঁকেছেন লেখক, সেই সঙ্গে গণচীনের ভূমিকা উন্মোচন করেছেন, ভারতের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন আর বিবেচনায় নিয়েছেন পাকিস্তানি শাসকমহলের ভেতরকার বাস্তবতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো সাম্প্রতিক প্রকাশনা অথবা উদ্ঘাটিত নতুন তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনার অবতারণা ঘটেছে, সংশ্লিষ্ট অন্য কিছু তথ্য বা গ্রন্থও পর্যালোচনায় ব্যবহূত হয়েছে। ফলে হাসান ফেরদৌসের ইতিহাস উদ্ঘাটন অর্জন করেছে বহুমাত্রিকতা এবং সুখপাঠ্য হওয়ার পাশাপাশি দৃষ্টি উন্মোচকও হয়েছে। গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য রচনা ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হোয়াইট হাউস’, যেখানে একাত্তরের নয় মাসজুড়ে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের পক্ষে যে অবস্থানে অনড় ছিল তার নানা বিবরণ মেলে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী মহলের বিভিন্ন গোপন বৈঠকের আলোচনার সম্প্রতি অবমুক্ত দলিলই কেবল নয়, আরও অনেক গ্রন্থসূত্র ব্যবহার করেছেন লেখক। এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে কিসিঞ্জারের হোয়াইট হাউস ইয়ার্স, নিক্সনের আত্মজৈবনিক মেমোয়ার্স, সেইমোর হার্শের কিসিঞ্জার ইন হোয়াইট হাউস, আর্চার ব্লাডের ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, রজার মরিসের আনসার্টেন গ্রেটনেস, পাকিস্তানি আমলা এফ এস আইজাজুদ্দিনের ফ্রম এ হেড, থ্রু এ হেড, টু এ হেড, অপর আমলা হাসান জহিরের দ্য সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান, মঈদুল হাসানের মূলধারা ’৭১ ইত্যাদি। এ ছাড়া ব্যবহার করেছেন নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার বিভিন্ন রিপোর্ট। তবে এত সব তথ্যসূত্র ব্যবহারের পরও হাসান ফেরদৌস মূলত এক বর্ণনাত্মক রীতি অনুসরণ করেছেন। ইতিহাসের বৃহত্তর বোধসঞ্জাত সমগ্রদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি মিলিয়ে ক্ষমতা-কেন্দ্রের এমন সব আচরণের ঐতিহাসিক যোগসূত্র ও ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর প্রয়াস তিনি নেননি। বিভিন্ন সময়ে প্রণীত গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলোয় সামগ্রিক বিশ্লেষণ প্রদানের তেমন কোনো চেষ্টা বিশেষ লক্ষিত হয় না এবং তা কোনো ঘাটতির দিকও নয়। ইতিহাসের এ এক ধরনের উপস্থাপন বটে, সেই সঙ্গে এটাও মনে হয় প্রসারিত দৃষ্টিতে ইতিহাস বিশ্লেষণের যে যোগ্যতা লেখকের রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিরিখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্লেষণের একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনায় ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারে।
তবে সেসব তো আগামী দিনের প্রত্যাশা, বর্তমান গ্রন্থে আমরা যা পেয়েছি সেটাও অনেক বড় পাওয়া। বিশেষভাবে নতুন তথ্যের জোগানদাতা হিসেবে লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন জানাতে হয়। তত্কালীন জাতিসংঘ মহাসচিব উ-থান্টের ভূমিকা আলোচনাকালে উল্লিখিত হয়েছে ২৩ এপ্রিল ১৯৭১ মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ওআইসির মহাসচিব টিংকু আবদুর রহমানকে লেখা তাঁর অত্যন্ত গোপনীয় ব্যক্তিগত চিঠি যা কেবল চমকপ্রদ তথ্যই নয়, কূটনীতিক ইতিহাসের ভিন্নতর মাত্রাও প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গে এই চিঠির উল্লেখ হাসান ফেরদৌস ছাড়া আর কেউ এর আগে করেছেন বলে আমার জানা নেই। একই কথা বলতে হয়, পঞ্চাশের দশকের পাকিস্তানি রাজনীতিতে বহুল আলোচিত নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা জেমস কালাহানের রিপোর্ট প্রসঙ্গে। এই রিপোর্টের সুবাদে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে আরোপ করা হয় কেন্দ্রীয় শাসন। ১৯৫৪ সালের মে মাসে পূর্ব পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাক্ষাত্কার কালাহান বিকৃতভাবে ছেপেছিলেন, এই ছিল গণতান্ত্রিক মহলের অভিযোগ। কালাহানের এই রিপোর্ট ও আগের-পরের আরও কতক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন হাসান ফেরদৌস, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের রাজনৈতিক ইতিহাস কাউকে লিখতে হলে যেসব তথ্য ব্যবহার অপরিহার্য বিবেচিত হবে। পরিশিষ্ট হিসেবে সংযোজিত হয়েছে পঞ্চাশের দশকের পটভূমি সংক্রান্ত এমনি দুটি নিবন্ধ, পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট প্রভাব রোধে করণীয় বিষয়ে সিআইএ-র রিপোর্ট এবং নিউইয়র্ক টাইমসে ফজলুল হক সংক্রান্ত রিপোর্ট। ফজলুল হকের উক্তি নিউইয়র্ক টাইমস সঠিকভাবে ছেপেছে, অথবা কালাহান বিকৃতি ঘটানোর কাজ করেছেন পত্রিকায় প্ল্যান্ট করা গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে, এই দুই অবস্থান বরাবরই হয়ে আছে বিতর্কের বিষয়। হাসান ফেরদৌস বিতর্কে না গিয়ে বরং মেলে ধরেছেন অনেক তথ্য। কলকাতায় ফজলুল হকের বক্তব্য বিষয়ে ১৯৫৪ সালের ৮ মে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট, ২৩ মে প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তান মুক্তি চায়’ শীর্ষক আরেক রিপোর্ট এবং ১ জুনের সম্পাদকীয় একসঙ্গে পাওয়ায় নিবন্ধের আলোকে অতীত সেই ঘটনাকে আরও তলিয়ে দেখার সুযোগ মেলে। তবে মূল ইংরেজির যে বাংলা ভাষ্য প্রদত্ত হয়েছে সেখানে কিছু জিজ্ঞাসা থেকে যায়। যেমন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুক্তি চায়’ শীর্ষক যে সংবাদ শিরোনাম সেখানে প্রশ্ন হলো ইংরেজিতে আদতে কোন্ শব্দ ব্যবহূত হয়েছিল, ‘ফ্রিডম’ অথবা ‘ইনডিপেন্ডেন্স’। অথবা এই যে বলা হয়েছে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী ‘স্বাধীন দেশ’ চান, এই স্বাধীন দেশ বলতে কি ফ্রি কান্ট্রি বোঝানো হয়েছিল অথবা ইনডিপেন্ডেন্ট কান্ট্রি? অর্থাত্ একই রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে বা বন্ধনে আবদ্ধ প্রদেশ দাবি করেছিল ‘মুক্তি’ নাকি ‘স্বাধীনতা’? মুক্তি দাবি করার মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের উপাদান ততটা নিহিত নেই, স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যতটা রয়েছে। তাই মূল ইংরেজি সংবাদভাষ্য সম্পর্কে কিছুটা অস্বচ্ছতা থেকেই গেল বঙ্গানুবাদের কারণে। তবে লেখক ঠিকই নির্দেশ করেছেন, ১৯৫৪ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার প্রয়াসের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে একাত্তরের মার্চের ঘটনাধারার। যেখানে এটাও তো লক্ষ করতে হয়, ৭ মার্চ প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা’ উভয় শব্দকে রাষ্ট্রনায়কোচিতভাবে ব্যবহার করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রদর্শন করেছিলেন আগামী সংগ্রামের পথ। সেখানে কি ফজলুল হক আবেগের বশে অসাবধানী উক্তি করেছিলেন ১৯৫৪ সালে, অথবা হয়েছিলেন সংবাদ-বিকৃতির শিকার, এই প্রশ্ন বিবেচনায় হাসান ফেরদৌস প্রদত্ত তথ্য কাজে লাগবে নিঃসন্দেহে।
ইতিহাসের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয়েছে হাসান ফেরদৌসের গ্রন্থে, এমন এক গ্রন্থের পাঠ ইতিহাসে আগ্রহী পাঠকদের জন্য ফলপ্রসূ হবে বিপুলভাবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply