বাংলা ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ। প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে তার নৈসর্গিক রূপ যেমন বর্ণাঢ্য, তেমনি বিচিত্র। এমন সম্পন্ন প্রকৃতির দেশটি স্বভাবতই গ্রামপ্রধান এবং এই লোকসমাজের রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। প্রকৃতিধন্য এ দেশের সংস্কৃতিও একইভাবে বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময়। বর্ষা এখানকার প্রধান ঋতু। প্রকৃতি তাই প্রাণপ্রাচুর্যে সরস ও উদ্দীপক। গ্রামজীবন বহুকাল ধরে কেবল প্রকৃতি সন্নিহিত নয়, একইভাবে রসময় এবং প্রাণসম্পদে ভরপুর। বাঙালির প্রাণের সম্পদের মূল দুটি রস—ভক্তি ও প্রেম। এ যেমন রস, তেমনি ভাবও। আর এ দুয়ের মধ্যে বাঁধভাঙার শক্তি ও প্রবণতা থাকায় এদের প্রেরণা ও তাগিদে ভাবুকের মন অহর্নিশ সৃষ্টিলীলায় বুঁদও হয়, ক্ষণে ক্ষণে হয় জাগরিত।
সুর আমাদের সংস্কৃতির আত্মা। এর সঙ্গে ভাব যুক্ত হলে বাণী আসে, বাণী গতি পায়, জোর পায় কাহিনির বুননে। এভাবে গানে-নাট্যে জমে উঠে যা দাঁড়ায়, সেটাই লোকজীবনের সংস্কৃতি, শিল্প। এ একেবারে চর্যাপদ হয়ে পদাবলী কীর্তন ছুঁয়ে পালাগান, বারমাস্যা, গম্ভীরা—সবকিছুতেই একই রকম। গ্রামবাংলা বহুকাল এই ভক্তি ও প্রেমের ভাবসম্পদে মশগুল ছিল।
মোটা দাগের এই পল্লিপ্রধান নদীমাতৃক দেশের জনপদ মাত্রের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, আর তার ছাপ পড়েছে জীবনযাত্রায়, ভাবনায় এবং সৃষ্টিতে। চারটি বড় ধর্মমত এখানে বিভিন্ন সময়ে কখনো বিচ্ছিন্নভাবে, কখনো একযোগে ঠাঁই গেড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় তাদের মধ্যে বৈপরীত্য অনেক, বিবাদ-ফ্যাসাদ কম নয়। কিন্তু লোকসমাজের ভাবুকতা, সৃষ্টিশীলতায় সব ধারা মিলেমিশে একাকার হয়েছে।
বাংলার গ্রাম আবহমান কাল ধরে যার চর্চা করেছে, তার নাম মানবতা। কিংবা নানা চর্চায় যা কিছু ফসল ফলিয়েছে, তার মূল প্রণোদনা মানবতার। মানবতারই জয়গানে বাঙালি কবি-শিল্পীরা মাতোয়ারা ছিলেন বহুকাল। এ জীবনে মানুষ ও তার সমাজই মুখ্য। আমমানুষ দেবদেবী, পীর-দরবেশ, ফকির-সন্ন্যাসীকে মাথায় তুলে নিয়েছে নেহাত মানুষ হিসেবেই। তাতে তাঁদের আদর কমেনি, কদরেও তাঁরা খাটো হননি। সহজেই এমন মানুষ তার ভাবনার কেন্দ্রে এসেছে—চরিত্রটা কোন ধর্মের, কোন তরিকার, সেটা মূল বিচার্য বিষয় হয়নি।
বাঙালির এই লোকজীবনের জগত্টা বিশাল ও বিচিত্র। তাকে বোঝা, চেনা ও ব্যাখ্যা করা কঠিন—এমন একটি কঠিন কাজে সাইমন জাকারিয়া নেমেছেন সহজে। সহজে বলছি এ কারণে, কাজটি যেন তাঁর সহজাত। এটা কোনো গবেষণার শিকে ছেঁড়ার লক্ষ্যে করা কাজ নয়, তাঁর ভালোবাসার ও আনন্দের ক্ষেত্র এটি। ভক্তি ও প্রেমের আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের সহজিয়া গাঙে সাইমন তাঁর ভালোবাসার তরণি ভাসিয়েছেন। তিনি এক মুগ্ধ রসিক নাইয়া, যিনি সমঝদার হিসেবে বঙ্গমাতার ভান্ডারের মণিরত্নের খোঁজ নিতে বেরিয়েছেন।
গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি আস্বাদ করেছেন লোকসংস্কৃতির রস—তাত্ক্ষণিক, তাজা। পত্রিকার পাতায় ‘প্রণমহি বঙ্গমাতা’ শিরোনামে প্রকাশিত তাঁর এসব অভিজ্ঞতার বিবরণী পড়ে বোঝা যেত, তিনি এ সংস্কৃতির ভেতরেরই মানুষ। গ্রামে জন্ম ও বড় হলেই কেউ সংস্কৃতির অন্দরের মানুষ হতে পারে না। কারণ, শিক্ষিত মানুষের সহজাত প্রবণতা হলো ক্রমেই নাগরিক পরিশীলন রপ্ত করা ও তার ঘেরাটোপে আবদ্ধ হওয়া।
লোকসংস্কৃতির তাত্ক্ষণিকতা, মুক্তপ্রবাহের অনিঃশেষ ধারা, বিপরীত ও বিচিত্রের সংমিশ্রণ, পরিবর্তমানতা একেবারে মাঠপর্যায়ের দেখাশোনা ও ভালোবাসার অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়। জাকারিয়ার বই বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও আঙ্গিক-বৈচিত্র্য মূলত গবেষণাগ্রন্থ। ‘প্রণমহি বঙ্গমাতা’র লেখক তাঁর ভালোবাসার অভিজ্ঞতাকে ইতিহাস ও বিষয়ের সীমায় বেঁধে একটু আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, ধারাবাহিকতা ও বিন্যাসে বাঁধতে চেয়েছেন। তিনি অবশ্য ভালোভাবেই জানেন, লোকসমাজের মতোই এ সংস্কৃতির ফসলগুলো নিতান্ত ইনফরমাল শিল্প—ঘরোয়া, তাত্ক্ষণিক ও পরিবর্তমান।
সাইমন ধরিয়ে দিয়েছেন, আমাদের মূল ফর্মটি গীতিনাট্যের, যে নাটক মূলত গানের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ইউরোপীয় চর্চা থেকে ধার করা ‘লোকনাটক’ শব্দে তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েছেন সাইমন এবং তাঁর ষোল আনা সমর্থন যে ‘ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা’ শব্দবন্ধের প্রতি সেটিও জানিয়েছেন। বুঝিয়ে বলেছেন, তা সত্ত্বেও কোন বিবেচনায় তিনি বইয়ের শিরোনামে ‘লোকনাটক’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।
নামে কী বা আসে যায়। আমাদের একটা আশঙ্কা হয়, একদিকে নগরায়ন, আধুনিকায়ন ও বিশ্বায়নের আগ্রাসন, আর অন্যদিকে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের উত্থানে-বিস্তারে লোকসংস্কৃতি একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, যেসব মুসলিমপ্রধান গ্রামে একসময় শীতকালে প্রতিবছর দু-চারটি নাটক, যাত্রা, বিচিত্রানুষ্ঠান হতো, সেসব ইদানীং ধর্মানুষ্ঠানের ঠেলায় ও স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের চোখরাঙানিতে বন্ধ হয়ে গেছে। সামাজিক-পারিবারিক অনুষ্ঠানে যেসব গীতিনৃত্য-নাট্যাশ্রিত আচার-অনুষ্ঠান ছিল, তাও উচ্ছেদ হয়েছে, উচ্ছন্নে গেছে। সেখানে দখল নিয়েছে শহুরে ব্যান্ড।
সাইমন এসব প্রবণতার খবর নিশ্চয় রাখেন। তা সত্ত্বেও দেখি, তাঁর মধ্যে জোরালো আশাবাদ টিকে আছে। তিনি ভূমিকায় লিখেছেন, ‘ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার একটি বড় বিশেষত্ব এই যে, নতুন নতুন যুগে উত্তীর্ণ হয়ে এর মধ্যে নতুন নতুন উপাদান-উপকরণ সংগৃহীত হয়। ফলে জীর্ণতা তাঁকে খুব একটা স্পর্শ করতে পারে না।’ পোড় খাওয়া মনের ঘরপোড়া গরুর অবস্থা, চারিদিকে যে সিঁদুরে মেঘ দিগন্ত ও গগন ছেয়ে ফেলছে! শিল্পের নিজস্ব শক্তিতে বেঁচে থাকার, জেগে ওঠায় বিশ্বাস রেখেও প্রশ্ন তুলতে হয়, কিন্তু যে সমাজ তাকে ধারণ ও লালন করবে, সে কি টিকে থাকছে, থাকতে পারছে? সদুত্তর মেলে না।
সাইমনের চমত্কার একটি পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরতে চাই, এতে বেঁচে ওঠার রসদও মিলতে পারে বলে বিশেষভাবে তা চাইছি। তিনি লিখেছেন, ‘এদেশীয় ধর্মনির্ভর নাট্য প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায়—তাতে কোনো একক ধর্মমতের কথা আসে না, অন্যান্য ধর্মমতের প্রসঙ্গও ঘুরে ফিরে আসে।’ তারপর তাঁর একটি বিশ্বাসের কথা বলেছেন, ‘এক্ষেত্রে মনে রাখা ভালো, বৃহত্তর ধর্ম মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এ সকলের অন্তরালেও এদেশের মানুষের একটি নিজস্ব ধর্মবোধ আছে, এখানে প্রায় সকল দেশবাসীই একাকার হয়ে আছে, সেই সূত্রে এর ভেতর দিয়ে এদেশের মানুষ এক অখণ্ড ঐক্য অনুভব করে থাকে।’
অনৈক্য বিভেদ বিবাদের এই দেশে এমন বিশ্বাসের জন্য তাঁর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক, যেন এ বিশ্বাস সত্য হয়। অন্তত আজ না হলেও একদিন হয়।
সাইমন যে বিস্তৃত সাংস্কৃতিক সম্ভারের বিশাল সংগ্রহ গড়েছেন, তার সামান্য এ বইতে ধরাতে পেরেছেন। তাঁর কাছ থেকে এ বিষয়ে আরও বই ও লেখা নিশ্চয় পাব, যা আমাদের নিজেকে জানতে সাহায্য করবে। কারণ, দ্রুত বাংলার এসব সম্পদ ধরে না রাখলে হারিয়ে যেতে পারে। সাইমনের আশাবাদ সত্ত্বেও এই শঙ্কা ব্যক্ত করা জরুরি মনে হচ্ছে।
আসলে আমরা দিনে দিনে সাংস্কৃতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছি। এ পরিণতি ঠেকাতে সাইমনের আয়োজন সত্যিই বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, তাঁর সংগ্রহের প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য এতই যে, তাকে উপেক্ষা করা মুশকিল, উদাসীন নাগরিকের অন্তরেও তা নাড়া দিতে সক্ষম। এখানেই সাইমনের ভালোবাসায় জারিত গবেষণার জোর ও সার্থকতা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply