তিরিশোত্তর আধুনিক কবিতার ধারায় আহসান হাবীব বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক কবি। ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়র এবং ইংরেজ কবি টি.এস. এলিয়টের প্রবর্তনায় যে আধুনিকতার উদ্বোধন বাংলা কবিতায় ঘটেছিলো তিরিশের কবিদের রচনাকর্মেণ্ড তারই যথার্থ উত্তরপুরুষ বাংলাদেশের কবি আহসান হাবীব
আহসান হাবীব তাঁর অস্তিত্বের মৌল সংকট ও সংশয়-বেদনাকে নিজের আবেগ-অনুভূতি-সংবেদনা সহযোগে ফলিয়ে তোলেন তাঁর রচিত কবিতায়। চারপাশে ছড়ানো জীবন, সময়-সংকটে দীর্ণ স্বদেশ ও পৃথিবী এবং কাল-স্পৃষ্ট মানুষের আনন্দ-বেদনা তাঁর অনুভব-আবেগের স্পর্শ পেয়ে রূপান্তরিত হয়েছে কবিতায়। আসলে অভিজ্ঞতা,অভিজ্ঞান ও উপলব্ধির সারাৎসারই কবিতার মূল বিষয়। আহসান হাবীবের কবিতার বিষয়ও তাই।
তিরিশোত্তর আধুনিক কবিতার ধারায় আহসান হাবীব বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক কবি। ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়র এবং ইংরেজ কবি টি.এস. এলিয়টের প্রবর্তনায় যে আধুনিকতার উদ্বোধন বাংলা কবিতায় ঘটেছিলো তিরিশের কবিদের রচনাকর্মেণ্ড তারই যথার্থ উত্তরপুরুষ বাংলাদেশের কবি আহসান হাবীব। আধুনিক কবিতার অন্তর্গত জীবনদর্শন ও প্রকরণকলা তাঁর কবিতায় অঙ্গীকৃত হয়েছে। ড. হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন : তিনি ..‘প্রথম প্রকৃত আধুনিক কবি। ..আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রিশেষ বেরোয় ১৯৪৭-এ এবং এ কাব্যেই সর্বপ্রথম একজন মুসলমান কবি ব্যাপক বিশ-শতকী চেতনাসহ আত্মপ্রকাশ করেন।’ [শামসুর রাহমান: নিঃসঙ্গ শেরপা]।
আসলে আহসান হাবীবের কবিতা আধুনিকতা চর্চার প্রকৃত সোপান তৈরি করেছে। তবে এ কথাও মানতে হয় যে আহসান হাবীব তিরিশোত্তর কাব্যধারায় শুধু অবগাহন করেননি। তিনি বেরিয়ে এসেছেন তিরিশি কাব্যধারা থেকে। তিরিশি কবিরা তাদের রচনাকর্মে স্বকালের বন্ধ্যাত্ব, নৈরাশ্যবাদ, বিশ-শতকীয় বিনষ্টি, বিমানবিকীকরণ এবং জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্নতার নানা দেয়াল তুলেছিলেন। আহসান হাবীব তাঁর রচনায় ব্যক্ত করেন প্রবল আশাবাদ। কবিতায় স্বদেশলগ্নতা ও পুনঃমানবিকীকরণের উদ্বোধন ঘটান তিনি। এই অর্থে আধুনিক কবিতার বক্তব্যের ভুবনকে তিনি বহুদূর সম্প্রসারিত করেছেন। কলাকৈবল্য এবং আত্মজৈবনিক কাতরোক্তিই আধুনিক কবিতার সূচকণ্ড এ কথা আর সত্য নয়। এই বোধ এবং এই সত্য প্রথম উপলব্ধি করেছেন আহসান হাবীব। জীবনঘনিষ্ঠ, সমাজচেতন ও স্বদেশলগ্ন অজস্র কবিতা লিখেছেন এই কবি। তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে খালেক নিকিরি, কদম আলী এবং জমিলার মায়ের ঘনিষ্ঠ জীবনসত্য। নাগরিক আবহাওয়ায় বিশ শতকীয় রোদ পোহালেও তাঁর গায়ে লেগে আছে পচা পাট, কচুরিপানা ও ডানকানা মাছের আঁশটে গন্ধ, পায়ে লেপ্টে আছে শিশিরসিক্ত কাদা। এই কবি যে তিরিশের নেতিবাদী দর্শনকে ভেঙে বেরিয়ে আসবেন তাতে সন্দেহের কিছু নেই। তিরিশের শেষদিকের এই কবি তিরিশি কবিতার আত্মরতি বা নান্দনিকতার প্রভাব রক্তে ধারণ করেননি। তিনি যে চল্লিশের সমাজচেতনার যুগধর্মকেই আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন এর প্রমাণ মেলে তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থে (১৯৮৫) উপস্থাপিত বক্তব্যে : ‘শ্রেণীবৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্রিমতা এবং উদভ্রান্ত উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা আজো পর্যন্ত আমার কবিতার বিষয়বস্তু।’ চল্লিশের দশক ছিল নানামুখী আন্দোলনে মুখর। ঔপনিবেশিক শক্তির অত্যাচার এবং তার রক্তাক্ত প্রতিফলন ছিল একদিকে, অন্যদিকে ছিল সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন। ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নানামুখি অভিঘাত এবং স্বাধীনতা ও সামাজিক মুক্তির তীব্র আকাঙক্ষার প্রকাশ। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির যুদ্ধবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকাও আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ছায়া ফেলেছিল। প্রগতিবাদী শিল্প-সাহিত্য চর্চার এটাই ছিল উর্বর সময়। এই আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কালগত চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে আহসান হাবীবের কবিতা। আহসান হাবীবকে বলা হয় চল্লিশের সমাজ চেতনার কবি। তাঁর কবিতার মূল প্রবণতা চল্লিশের চেতনার সমান্তরাল ধারাতেই প্রবহমান।
তিরিশের কাব্যঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়েই শুরু করেছিলেন আহসান হাবীব। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রিশেষ-এ তিরিশোত্তর কাব্যধারার স্পন্দন সুস্পষ্টণ্ড তবে সেখানে নতুন স্বপ্ন নির্মাণের আকুলতাও রয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার উন্মাদনা, স্বৈরাচারী শাসকের ভূমিকা, সাম্প্রদায়িকতা রোমান্টিক সংবেদনশীল আহসান হাবীবের হৃদয়কে বেদনার্ত করেছে। তাই কবি এক সময় মৃত্তিকার সাহচর্যেই আশ্রয় খুঁজেছেন। তিনি তিরিশের কাব্যধারারই প্রতিনিধি। তাঁর ‘এই মনণ্ড এই মৃত্তিকা’ কবিতায় এলিয়টীয় আধুনিক কাব্যভাবনার স্পর্শ রয়েছে। ‘বন্ধ্যা মাটি’ শব্দদ্বয়ও তারই চেতনাবাহী। কিন্তু একই কবিতায় আহসান হাবীবের মন মৃত্তিকার সাহচর্যই কামনা করেছে। স্বদেশের মৃত্তিকার সাহচর্যেই প্রাণশক্তি খুঁজে পায় তাঁর কবিতা। মাটির গন্ধ তাঁর তনুমনে আনে সীমাহীন সমারোহ। কবির শিল্প-বিশ্বাস এখানে সমন্বয় ও সমগ্রতাবাদী। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমন্বয়-প্রয়াসই একালে কবির অন্বিষ্ট ছিলো। তবে তাঁর চারপাশের প্রতিবেশণ্ড বাংলার মাটি-জল-মানুষ ও নিসর্গ তাঁর কবিতায় প্রথম থেকেই জীবন ও শিল্পের বিভা জ্বেলেছে। দেশীয় উপকরণ ব্যবহারের মধ্য দিয়েই তিনি ধীরে-ধীরে হয়ে উঠেন সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ।
আহসান হাবীব বেড়ে উঠেছেন প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তী অস্থির আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটপরিসরে। যৌবনে প্রত্যক্ষ করেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। দুই-দুটি মহাযুদ্ধের অভিঘাত তাঁর মনন চৈতন্যে সংবেদনশীল কবিদের মতোই ছাপ ফেলেছে। সময়-সংকটে মুহ্যমান মানবজীবনকে তিনি কবিতায় রূপ দিয়েছেন। সমকালকে আহসান হাবীব তাঁর কবিতায় অন্তরঙ্গ আঙ্গিকেই তুলে এনেছেন। ‘সমকাল’ ও ‘সময়’ তাঁর রচনায় বিচিত্র অবয়বে ধরা দিয়েছে। তিনি লিখেছেন : ‘সময়ের পদধ্বনি আমাদের পুরোভাগে’।
বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে ক্রুর কঠিন সময় মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। কবি এর চিত্র এঁকেছেন।
সুগভীর কালচেতনা আহসান হাবীবের অন্তর্গত শিল্পচেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কবিতাকে শিল্পিত করেছে। এই সুগভীর কালচেতনাই তাঁকে চল্লিশের কবিদের মধ্যে অনন্য করে তুলেছে। রাত্রিশেষ কাব্যে যে-চেতনা উচ্চকিত , ক্ষুব্ধ ও বর্তমানপীড়িতণ্ড শেষ পর্যায়ের কাব্যে সেই জীবন-অভিজ্ঞতাই তাঁর কবিতার অন্তর্গত শক্তি হয়ে উঠেছে।
শিল্প এবং জীবন কবিতায় গভীরভাবে সম্পর্কিত। আহসান হাবীবের কবিতায়ও জীবন ও শিল্পের গভীর সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত ব্যক্তিজীবন বেদনায় ভারাক্রান্তণ্ডকিন্তু একই সঙ্গে সেখানে অনুভূত হবে মানব সভ্যতার ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অনুরণন। আহসান হাবীব ‘রক্তের অক্ষরে পথে স্বাক্ষরিত বহু ইতিহাস’- এর স্মৃতি নিয়ে কবিতার অন্য একটি পর্যায়ে উপনীত হন। কর্ডোভা, মিশর বা দূর ব্যাবিলনের স্মৃতিচারণ করে সভ্যতার এক-একটি সংঘাত ও পরিণামকেই যেন চিহ্নিত করেন। ইতিহাসের শিক্ষাকে তিনি হতাশার কার্যকারণ হিসেবে গ্রহণ করেননিণ্ডনিয়েছেন ইতিবাচক হিসেবেই। কাল প্রবহমান ও বৈনাশিক হলেও তিনি তার সঙ্গেই থাকতে চান।
আহসান হাবীবের কবিতার পটভূমিতে রয়েছে সঙ্কটময় সমাজ-রাজনীতি, হতাশা-বেদনা, পাবন-ধ্বংস ও রক্তপাত। এই পটভূমি পেরিয়ে, গতিশীল জীবনাবর্তের মধ্য দিয়ে তিনি পৌঁছে যান সমুদ্রে:
নদীর সামান্য স্রোতে ভেসে ভেসে এইখানে এসে
অতঃপর সমুদ্রের পেয়েছি সন্ধান।
[বিচ্ছিন্ন দ্বীপের আমরা/ আশায় বসতি]
আহসান হাবীবের কবিতায় জীবন ও গতির প্রতীক হয়ে আসে নদী, মিছিল এবং জোয়ার। মেঘ বলে চৈত্রে যাবো কাব্যে আহসান হাবীবের কাব্যদর্শন যেমন মানবিক সমগ্রতাবোধে স্পন্দিত, তেমনি প্রচণ্ড আশাবাদও ব্যক্ত হয়েছে এখানে : ‘আমি এই পথ থেকে ফিরবো না, কেননা,/ মানুষকে কোথাও না কোথাও যেতেই হয়/ অকাল সমৃদ্ধ এক সুস্থির আবাস তাকে/ অবশ্যই গড়ে নিতে হয়/ কোনোখানে’।
আহসান হাবীবের শেষ পর্যাযের কাব্যগ্রন্থ দু’হাতে দুই আদিম পাথর সময়-সমকাল-জীবন ও স্বদেশ চিন্তার শিল্পসফল সমন্বয়ে ঋদ্ধ। জীবনের সঙ্গে তিনি লেপ্টে থাকেন মাছির মতো। মানব সভ্যতার বহমান ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে তিনি সংলগ্ন করেন। তাঁর পক্ষে এ-জন্যেই খুব সহজে আবহমান মানবজীবনের বেদনা-আনন্দ-অভিলাষ ও বিষাদের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা করা সহজ হয়ে ওঠে। ‘আবহমান’ কবিতায় ইলিশ শিকারী খালেক নিকিরির জীবনের সঙ্গে কবির নিজস্ব জীবন একাকার হয়ে যায়। মহৎ শিল্পী আহসান হাবীব নিজেকে আবিষ্কার করেছেন স্বদেশের চিরচেনা জীবনপটেণ্ড শিল্প ও জীবন তাঁর কবিতায় অঙ্গাঙ্গীসূত্রে আবদ্ধ।
মাহবুব সাদিক
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জানুয়ারী ০১, ২০১০
পরিবেশ বন্ধু
কবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কবিতা
**********
মন রাঙ্গানো ভোরের আলো
এম জি আর মাসুদ রানা
কবি সমাজ বাংলাদেশ
আমি যদি ভোরের বেলায় উটে
ধুলির মাঝে আয়েশে যাই ছুটে
সবুজ কানন ডাকবে আমায় দুলে
চৈতি হাওয়া বইবে ফুলে ফুলে
মন পবনে সাঁজায়ে দৃশ্য ঘুড়ি
দূর দিগন্তে উড়ব গগন জুড়ি
পাখির ডানায় আবির রাঙ্গা পালক
ভোরের চিঠি খুজব রবির ঝলক
মুটু মুটু স্বপ্ন ছায়া এঁকে
উড়িয়ে দেব এই বাংলার বুকে
নিত্য তাই নদীর জলে ভেসে
মন রাঙ্গাব ভোরের আলোয় হেসে ।