বিজয় সরণির মোড়ে পাইরেটেড বইয়ের একজন হকার। ঠিক একই শিরোনামে প্রাতঃস্মরণীয় সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি রসজ্ঞ প্রবন্ধ আছে, যেখানে তিনি এ বিখ্যাত উক্তিটি করেছেন যে বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। বাংলাদেশের গরিব সমাজের প্রেক্ষাপটে এটা একটি বৈপ্লবিক উচ্চারণই বটে। সম্প্রতি বই প্রকাশনার জগতে ঢাকায় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, পৃথিবীর একটি প্রাচীন প্রকাশনা সংস্থা ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস (১৫৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত) ও বুক ভিলেজ বাংলাদেশ লিমিটেডের মধ্যে ১৪টি ইংরেজি ভাষা শিক্ষাবিষয়ক গ্রন্থ ছাপানোর চুক্তি। বাংলাদেশি প্রকাশনা সংস্থাটি আসলে দেশের সাতটি নামকরা প্রকাশনী ঘরের জোট।
এ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী সভার স্লোগান ছিল, বইয়ের ‘পাইরেসি’ বন্ধ করা। ‘পাইরেসি’র বাংলা শুনলাম তাস্কর্য। সোজা কথায় বইয়ের ডাকাতি বন্ধ করার ওপর আলোচনা নিবদ্ধ ছিল। মুজতবা আলীর যুগে হয়তো একজনের বই আরেকজন নকল করেছে, কিন্তু মূল বইয়ের অবৈধ উপায়ে সস্তা সংস্করণ বের করা তাঁর সময়ে সম্ভব ছিল না। তখন ছাপাখানা, ছাপার যন্ত্র ও মুদ্রণপ্রণালী ছিল, কিন্তু ফটোকপিয়ার, কমপিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টার, অর্থাত্ আধুনিক প্রযুক্তি তখনো বইয়ের বাজারের নিয়ন্ত্রক হয়ে বসেনি। মুজতবা আলী তাই বই কেনার সঙ্গে বিত্তের সম্পর্ক ধরে আলোচনা করেছেন, বই নিয়ে তস্করবৃত্তি সম্পর্কে তাঁর কিছু বলার উপায় ছিল না। আবার তিনি জানতেন, বই পড়ার নেশা যাদের তাদের টাকার প্রতি নেশা কম। সরস্বতী আর লক্ষ্মীর সেবানসুলভ সম্পর্ক। তাই যাঁরা বই পড়তে ভালোবাসতেন, তাঁরা প্রায়শই বই কিনতে পারতেন না। সহজ কাজটি ছিল বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতিজনের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে ফেরত না দেওয়া।
মেজাজে সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েনের (পাঠক জানেন, টোয়েনের আসল নাম স্যামুয়েল লেগহনর্স ক্লিমেন্স) মেজাজে অনেক মিল। দুজনই তুখোড় বুদ্ধিমান ও রসপ্রবণ। তো মুজতবা আলী ‘বই কেনা’য় মার্ক টোয়েনের জীবন থেকে একটি আখ্যানের বর্ণনা দিলেন। জনৈক বন্ধু মার্ক টোয়েনের ঘরে ঢুকে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত স্তূপীকৃত বইয়ের পাহাড় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রে বইগুলোর জন্য কিছু শেলফ কিনতে পারিস না।’ মার্ক টোয়েন বললেন, ‘বন্ধু, বই যেভাবে জোগাড় করেছি, সেভাবে তো শেলফ জোগাড় করতে পারি না।’
রোমান্টিক যুগের ইংরেজ গদ্যলেখক চার্লস ল্যাম্বের একটি রসালো প্রবন্ধ আছে, নাম ‘দ্য টু রেইসেজ অব মেন’। তাতে তিনি বলছেন, পৃথিবীতে মানুষ হলো আসলে দুই জাতের: যারা ধার নেয়, আর যারা ধার দেয়। টাকা-পয়সা ধার নেওয়া আর দেওয়ার বিষয়ে আলাপ করতে করতে শেষে তিনি বইয়ের প্রসঙ্গে এলেন। চার্লস ল্যাম্বের বোন মেরি ল্যাম্ব। দুজনে মিলে লিখেছেন টেইলস ফ্রম শেক্সপিয়ার গ্রন্থটি, মেরিও বিখ্যাত। ভাইবোন দুজনে প্রথম জীবনে বেশ অর্থকষ্টে ছিলেন। তবু তাঁদের বই পড়ার নেশা মেটাতে তাঁরা নানা কিছু ত্যাগ করে বই কিনতেন। এক তীব্র শীতকাল। ল্যাম্বের একটি গরম কোট কেনা দরকার। তিনি কোট না কিনে এলিজাবেথীয় যুগের নাট্যকার বিউমন্ট আর ফ্লেচারের ঢাউস ফোলিও সংস্করণটি কিনেছিলেন। প্রসঙ্গটি অবশ্য তাঁর অন্য প্রবন্ধ ‘ঔল্ড চায়না’তে আছে। কালক্রমে ল্যাম্ব ও মেরির টাকা-পয়সার উন্নতি হয়, বাসায় বুক শেলফ-টেলফ আসে। কিন্তু সবিস্ময়ে তাঁর শেলফ দেখিয়ে ল্যাম্ব পাঠকের উদ্দেশে বলছেন, দাঁতের সারিতে দু-একটা দাঁত না থাকলে মুখটাকে যেরকম দেখায়, তাঁর বইয়ের তাকগুলো দেখতে হয়েছে সেরকম। বইয়ের সারিতে মাঝে মাঝে ফাঁক। ঐ বইগুলো লোকে মেরে দিয়েছে। (আমরা দুষ্টুমি করে বলি ‘মারাফাইড’)। দুই দিনের জন্য পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। তখন তিনি বললেন, অমুক লোকটি বই মেরে দিলে তাঁর আপত্তি আছে, কিন্তু এসটিসি, মানে বিখ্যাত রোমান্টিক কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ বই নিলে তাঁর আপত্তি নেই। কোলরিজ বই নিলে কখনো ফেরত দেন না, কিন্তু যদি দেন, তা হলে ল্যাম্ব খুব উপকৃত হন। কারণ কোলরিজ খুব নিবিড় পড়ুয়া ছিলেন, পড়ার সময় বইয়ের মার্জিনে এন্তার মন্তব্য টুকে রাখতেন, যা পড়ে খুব জ্ঞান লাভ করতেন ল্যাম্ব।
গ্রন্থ তাস্কর্যের যুগে, আমি নিশ্চিত, ওপরে উল্লিখিত কৃতীমান পুরুষেরা, যথাক্রমে স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ, মার্ক টোয়েন এবং আমাদের মুজতবা আলী, বই মারা বা না মারার বিষয়ে নৈতিক প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে পছন্দ করতেন। কারণ তাঁদের ছিল পড়ার নেশা, কীভাবে বই তাঁদের হাতে আসছে বা সে আসাটা নৈতিক হলো কী অনৈতিক হলো, সে প্রশ্নটা তাঁদের কাছে ছিল অবান্তর। বেশির ভাগ বই-পাগল পাঠকেরই কিন্তু চিন্তাটা এরকমেরই হওয়ার কথা। সে জন্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যদিও বক্তারা শ্রোতাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের পাঠকসমাজের কাছে এ আবেদনটি রেখেছেন যে তারা যেন পাইরেটেড বা তস্করকৃত বই না কেনেন, কিন্তু এটা মূলত অর্থনৈতিক একটি প্রশ্ন, যার সঙ্গে বই পাঠের নেশার সম্পর্ক নেই। পাঠক বই কেনার সময় তাঁর নিজস্ব রুচির বিচারে ও পকেটের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বই কেনে, কখনো এ বিচার-বিবেচনা থেকে বই কেনে না যে পাইরেটেড কপি কিনলে লেখক, প্রকাশক এবং সরকার তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হবে।
একটা উদাহরণ দিই। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের প্রথম দিকে একটি মোটা বই পড়তে হয়। বইটির নাম লিটেরেচার: অ্যান ইন্ট্রুডাকশান টু ফিকশন, পোয়েট্রি অ্যান্ড ড্রামা। এটির প্রথমে একক সম্পাদক ছিলেন আমেরিকান কবি ও সমালোচক এক্স জে কেনেডি। ডানা জিয়োইয়া পরে এর সহযোগী সম্পাদক হন। বইটি বাংলাদেশে ইংরেজির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা খুব ভালোবাসেন। এটার শোভন কপি লংম্যান প্রকাশনীর মূল সংস্করণ ঢাকার বাজারে পাওয়া যায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়, অথচ এটার ফটোকপি সংস্করণের দাম মাত্র ৭০০ টাকা। এটা এবং ওটা দুটোই যদি পাওয়া যায়, তাহলে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকেরা কোনটা কিনবেন? হ্যাঁ, যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে একটি পরিচ্ছন্ন ঘরোয়া পাঠাগার গড়ে তুলতে চান, তাঁরা নিশ্চয় প্রতিটি বইয়ের শোভন কপি রাখবেন। কিন্তু যাঁদের অগ্রাধিকার বই পড়া, ডিগ্রির জন্য হোক বা নেশার জন্য হোক, তাঁদের ঘরে ফটোকপির পাইরেটেড বইয়ের সংগ্রহও কিন্তু কম নয়।
সপ্তাহখানেক আগে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেখা হলো দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক হরিষ ত্রিবেদীর সঙ্গে। ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ে বিরাট পণ্ডিত তিনি। তাঁর একটি বই কলোনিয়াল ট্রানজেকশনস আমার খুব প্রিয়। তাকে বললাম, মানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত তোমার এ বইটি আমার সংগ্রহে আছে। তবে পাইরেটেড কপি। তারও নাকি একই দশা। তার প্রিয় এবং দরকারি বইগুলো প্রায় পাইরেটেড এবং ফটোকপি, সে জানাল।
আসলে এটা হবেই। ভারতীয় পেঁয়াজের দামে সস্তা হলে মানুষ যেমন বাংলাদেশি পেঁয়াজ না খেয়ে সেটা খাবে, তেমনি বারাক ওবামার অডাসিটি অব হোপ বা ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার দুই-তিন হাজার টাকার দামের বই মানুষ যদি গুলশান, শাহবাগ, সোনারগাঁ হোটেলের মোড় বা বিজয় সরণির ট্রাফিক বাতিতে গাড়ি দাঁড়ানোর সময় ২০০ টাকা দিয়ে কিনতে পারে, মানুষ সেটাই কিনবে। যুগ যুগ ধরে মানুষের এ অর্থনৈতিক ব্যবহারের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। প্রকাশকেরা হলো বিক্রেতার পক্ষ আর পাঠকেরা হলো ক্রেতার পক্ষ। এ সম্পর্কের মধ্যে নৈতিকতা কাজ করে না, করে লাভ-ক্ষতির বিবেচনা।
তাহলে বই পাইরেসি বন্ধ হবে কীভাবে, এবং কীভাবেই বা এর বিক্রি বন্ধ করা যায়। উত্তরটা সহজ: বাংলাদেশের পেঁয়াজ সস্তা হলে মানুষ আর ভারতের পেঁয়াজ কিনবে না, তেমনি মুদ্রিত বই দামে সস্তা পড়লে মানুষ আর তস্করকৃত বই কিনবে না। বই উত্পাদনে খরচ পড়ে জায়গা, আবাসন, মুদ্রণযন্ত্র, কাগজ, কালি আর বিদ্যুতের। এর ওপর আছে শ্রমিকের বেতন। বেতন ছাড়া অন্য সব উপকরণের ওপর শুল্ক তুলে নিলে বই উত্পাদন অনেক সস্তা হয়ে যাবে।
তবে সবকিছু বিবেচনায় আনলে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রকাশকদের মেলবন্ধনটা শুভলক্ষণ বলতে হবে। কারণ পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক নামকরা প্রকাশকদের মধ্যে ক্যামব্রিজ এখনো ওপরের দিকে। অন্য প্রতিযোগীরা হলো অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড এবং শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস। এরা সবাই ছাপায় খুব মানসম্মত এবং নিখুঁত তথ্যবহুল ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই বের করে।
তবে, চিন্তার মধ্যে একটা কাঁটাও আছে। যারা এসেছে তারা কিন্তু ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ইন্ডিয়া এবং এখানে শুধু বই বের করতে চাইছে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাবিষয়ক। ভারতে ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষার ওপর বিশাল বাজার। এটাকে কবজা করার জন্য অক্সফোর্ড, লংম্যান, ম্যাকমিলানসহ ক্যামব্রিজ বহু আগেই ইন্ডিয়ায় এসে নিজেদের শাখা খুলে বই প্রকাশ ও বিক্রি করছে। সে ধারায় বাংলাদেশও এখন এসব আন্তর্জাতিক পুস্তক প্রকাশকদের বাজার হবে। তাতে আমার আপত্তি নেই, কারণ দেশে জ্ঞানার্জনের বিশাল পথ খুলে গেলে অবশেষে জাতি হবে উপকৃত। কিন্তু আমার আপত্তিটা এখানে, তারা যে ১৪টি বই বের করতে যাচ্ছে সবগুলো ইংরেজি ভাষা শিক্ষাবিষয়ক। সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ও সমাজবিষয়ক বইগুলোও প্রকাশ করা উচিত বৃহত্তর পাঠকসমাজের জন্য।
ক্যামব্র্রিজের একজন অধিকর্তা মানস সাথিয়া। ওই সভায় তিনি জানালেন, তাঁদের নামকরা প্রকাশনার মধ্যে আছে দেড় শ বছর আগে প্রকাশিত চার্লস ডারউইনের দ্য অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থটি। আমার কথা হলো, এ ধরনের ক্লাসিক বইগুলোও তাঁরা এখান থেকে প্রকাশ করে আমাদের পাঠকদের হাতে ধরিয়ে দিক না কেন।
বাংলাদেশে দরকার চিন্তার জগত্টা খোলা। চিন্তা জাগ্রত হলে, এর বাহন হিসেবে ভাষা আপনাতেই দোরগোড়ায় হাজির হবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯
ফয়সাল
মুল লেখককে বিষয়টা উত্থাপন করার জন্য ধন্যবাদ।
আমারা দামী বই চাইনা, ভাল বই চাই।
বই এর কাগজ এর মানের চেয়ে বই এর মানই বেশি গুরুত্তপূর্ন।