অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পর্যটনশিল্পের প্রসার, সংরক্ষণে অবহেলা আর অসচেতনতার কারণে স্থানীয় ঐতিহ্যগুলো চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব নিদর্শন স্থানীয় লোকসংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার পাশে দ্রুতগতিতে গড়ে উঠছে আকাশস্পর্শী বহুতল ভবন। এসব অপরিকল্পিত ভবন তৈরিতে প্রচলিত নিয়মকানুন মানছে না ডেভেলপিং কোম্পানিগুলো। প্রাচীন স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণ-সম্পর্কিত সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে বলে জানা যায় না। গুটিকয় ঐতিহ্যপ্রেমী ও পরিবেশবাদী শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজেদের সংগঠনের মাধ্যমে এই সব ধ্বংসপ্রায় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মারাত্মক পরিবেশ দূষণ, অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ ও পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি স্থাপনাগুলোকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়হীনতাও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর ঝুঁকিতে পড়া এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ।
এ নিয়ে নয় সপ্তাহব্যাপী এক আয়োজন ছিল বৃত্তের। এই আয়োজনে অংশগ্রহণকারী ৩৮ জন অগ্রজ ও অনুজ শিল্পী প্রথমে কনসেপ্ট নির্মাণ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে শিল্পকর্ম নির্মাণ ও উপস্থাপনের প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করেন। পরে ধাপে ধাপে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমকে কেন্দ্র করে নানা নিরীক্ষায় নিজস্ব শিল্পভাষানির্ভর শিল্পকর্ম উপস্থাপন করেন। এসব উপস্থাপনা সাধারণ দর্শকদের ব্যাপকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
পুরোনো ঢাকার আদি বাসিন্দাদের অনেকেই ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের শিল্পী হিসেবে খুব সরু একচিলতে ঘরে বাস করেন; আধাবেলা উপোস করে আধাবেলার খেয়েও পৈর্তৃক বৃত্তিকে আঁকড়ে ধরে আছেন তাঁরা। পরম্পরার এসব শিল্পী ও তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের অন্তর্গত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য বর্জ্যময় নিথর, নিস্তরঙ্গ বুড়িগঙ্গার মতো আমাদের প্রায় নিশ্চল শহুরে জড়ভরত মনকে চাঞ্চল্য দেয়, আবেগে প্লাবিত করে। কিছু দিনের জন্য হলেও আমাদের মন বহতা নদী হয়ে উঠতে চায়। এই অসাধারণ গুণী মানুষগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা আর বিনম্র ভালোবাসায় আমাদের মন আপনিতেই নত হয়ে আসে। ইচ্ছে করে ওদের মতো হতে। কিন্তু সে সহজে হবার নয়। নিজের শেকড়ের প্রতি দরদ ও চিত্তশুদ্ধির এই চেতনাকে শিল্পীর মনে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে বৃত্ত আর্টস ট্রাস্ট।
তরুণ শিল্পীরা প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে শিল্প রচনায় তাঁদের নিজস্ব শিল্পভাষাদর্শনির্ভর ‘আইডিয়া আর্টে’র ব্যাপক ব্যবহার করেছেন।
পুরোনো ঢাকার কর্মশালায় ছিল শিল্পীদের নির্মিত ডিজিটাল ইমেজ এবং ভিডিও আর্ট ওয়ার্কশপ, তথ্যচিত্র, আলোকচিত্র, ভিডিও তথ্যচিত্র এবং শব্দ ও বস্তুনির্ভর মনস্তাত্ত্বিক স্থাপনা। মধুপুরে ছিল চুনিয়া গ্রামের অধিবাসীদের চিরন্তন গান, ভাষা, হাসি, কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম প্রভৃতি জীবনঘনিষ্ঠ চিত্রকল্প; সেখানে দড়ির মুখোশ পরে শিল্পীর ঘোড়াগাড়ি চালনা আর বোবা পশুর আহাজারি ঝরে পড়ে মান্দি নারীদের আপাত কর্কশ অথচ বিষাদ-আক্রান্ত গানে। বনের গাছগুলোকে বনের বালাই বন বিভাগের নিষ্ঠুর চতুর লোকগুলোর কুঠার-কঠোর দৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য গভীর মমতায় মাটির পাত্রে বনদেবীর তৃতীয় নয়ন এঁকে যেন রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শিল্পী নিজেই। গাছের আড়ালে আদিবাসী নারীর লালবর্ণ পোশাকে বাঙ্ময় শিল্পী নিজেই হয়ে ওঠেন শিল্পকর্মের উপাত্ত। শিল্পী মাহবুবুর রহমান, কাজী সালাহউদ্দীন আহমেদ, আমিরুল রাজিব, খন্দকার নাসির আহমেদ, ঊর্মি বসাক শুক্লা, মইনুল ইসলাম পল, রাশেদুল হক, কামরুজ্জামান স্বাধীন, হারুন-আর-রশিদ টুটুল,সালেহ মাহমুদ, আয়েশা সুলতানা, মোল্লা সাগর, সুলেখা চৌধুরী, হামিমুল ইসলাম খোকন, রাশেদুল হুদা, রবি খান, তৈয়বা বেগম লিপি, সালেহ মাহমুদ, নাজমুল আহসান, ইমরান হোসেন পিপলু, রায়হান আহমেদ রাফি, অয়ন মজুমদার, ইসমাইল হোসেন নিলয়, সারা খাতুন মিয়া প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীদের বিভিন্ন মাধ্যমে করা শিল্পকর্ম, বিশেষ করে বিভিন্ন প্রকৃতিনির্ভর স্থাপনাগুলোতে বেশ নিরীক্ষাধর্মী সৃজনপ্রবণতার স্বাক্ষর লক্ষ করার মতো। এই ধরনের স্থাপনাশিল্প উপভোগ্য দর্শনীয়তার জন্ম দিয়েছে। এই দর্শনীয়তা মানুষের অন্তর্লোকের স্বভাবকে প্রকাশ করতে সহায়তা করে।
শিল্পীরা লিপি, সংখ্যা, রং, শব্দ, স্থিরচিত্র, দ্বিমাত্রিক চিত্র, ভিডিও, এমনকি ল্যাপটপের ওয়েব ক্যামেরায় (রবি খানের নিরীক্ষাপ্রবণ তথ্যচিত্র ‘স্বপ্নশিকারি’) হাস্যমুখর মান্দি শিশুদের মুখ ভেঙেচুরে দেখিয়ে বয়সকালে তাদের স্বপ্নের অপমৃত্যুকে বোঝাতে চেয়েছেন। রবি নিজেই যেন সেই স্বপ্নচোরের পিছু ধাওয়াকারী এক গোয়েন্দা। তাঁদের শিল্পকর্মে স্ট্রাকচার বা আকারের সততার চেয়ে শিল্পকর্মের উপাত্ত যেন ক্ষতবিক্ষত নাগরিক সত্তার অন্তর্গত দহন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এর ফলে প্রথাগত শিল্পরীতি রক্ষা পায়নি। সেভাবে শিল্পীদের এই ধরনের স্থাপনা দেখে মনে হয়েছে চুনিয়ার সান্নিধ্যে তাদের নির্জন বনে ঘটে যাওয়া প্রতিক্রিয়ার স্বতঃস্ফূর্ত অনুরণন।
এই কর্মশালার মূল পরিকল্পক বৃত্তের শিল্পী মাহবুবুর রহমান, তৈয়বা বেগম লিপি ও সহযোদ্ধা তরুণ শিল্পীবৃন্দ। বুড়িগঙ্গার তীরে পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাসমূহ, জন সমাবেশস্থল ও শিক্ষায়তননির্ভর প্রদর্শনীস্থলে অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত নয় সপ্তাহের কর্মশালার বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অপেক্ষাকৃত নবীন শিল্পীরা তাঁদের নিরীক্ষাধর্মী শিল্পকর্ম উপস্থাপন করেন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ঢাকার অধিবাসীদের চালচিত্র অতিদ্রুত পাল্টে গেছে, যাচ্ছে। সংক্ষিপ্ত অবসরে চারপাশকে জানার উত্স হয়ে উঠেছে সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন আর বিজ্ঞাপন। এ সবকিছু পুরোনো ঢাকার জনজীবনকেও প্রবলভাবে অধিকার করেছে। ফলস্বরূপ নগরজনেরা সম্ভাব্য সকল খবরের উত্স হিসেবে শ্রতি-চিত্রণের (ডিজিটাল চিত্র ও শব্দ) ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। শিল্পীরাও তাঁদের কাজে বেশি করে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন। ভিজুয়াল শিল্পী মনির মৃত্তিকের ঐতিহ্যবাহী ভবন ধ্বংস করে বহুতল ভবন নির্মাণের দুর্মোহকে কেন্দ্র করে নির্মিত কম্পিউটার গেম ‘হিট অ্যান্ড মিস’। এই কম্পিউটার খেলাটিতে পুরোনো দালানভাঙা দেখানো হয়েছে। মনির এতিহ্য ধ্বংসের সংবাদটি সবার কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন।
সুলেখা চৌধুরীর কবি নজরুল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহূত ব্রিটিশ সময়কালের বড় ব্যবসায়ী জ্যোতিনচন্দ্র দাসের বাড়ি মঙ্গলাবাসে অতীত ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা থেকে ইনস্টলেশন উপস্থাপন করেন। তিন হাজার প্লাস্টিকের খালি পানির বোতল দিয়ে তৈরি কামরুজ্জামানের নৌকা। এটি ভাসানো ছিল বীণাস্মৃতির ঘাটে। তাতে অনেকে চড়ে নৌভ্রমণও করেছে। কাজী সালাহউদ্দীন আহমেদের ভিডিও স্থাপনাশিল্প উপস্থাপন করা হয় ঐতিহাসিক নর্থব্রুক হলে। একই স্থানের গ্রিনরুমে ওয়েন বুশের স্থাপনাশিল্প আমাদের বৌদ্ধযুগে নিয়ে যায়। অধ্যাত্মবাদের রহস্যময়তা যেন মূর্ত হযে ওঠে তাঁর উপস্থাপিত ফুল, ধূপ ও সুগন্ধীর অনুষঙ্গে।
শিল্পীদের সঙ্গে পরিবেশবিদ, স্থাপত্যবিদ ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে বসবাসরত সচেতন জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা নির্মাণের একটা সচেতন প্রয়াস নেওয়া হয়েছে এই দীর্ঘ কর্মশালাভিত্তিক শিল্পকলা প্রদর্শনীর আয়োজনের মধ্য দিয়ে। শিল্পীদের মূল লক্ষ্য এই কর্মশালার মধ্য দিয়ে নিজেদের মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় মানবিক মূল্যবোধ ও চেতনাগুলোকে উসকে দেওয়া। নিজেদের আবাসভূমিকে বসবাসযোগ্য করে তোলার জন্য এই সব মানবিক বিষয়ের অবিরাম চর্চার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষের মধ্যে একটি ঐক্যসূত্র তৈরি করতে চান বাংলাদেশের সমকালীন, বিশেষ করে তরুণ শিল্পীরা। শিল্পীদের সঙ্গে সাধারণ জনমানসের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপনের যে উদ্যোগ বৃত্ত গ্রহণ করেছে তা অভূতপূর্ব।
মানবতাবাদী সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে শিল্পী হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা এই ‘এক বর্গমাইল’ শীর্ষক কর্মশালা আয়োজনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনের ফলে দর্শক উপলব্ধি করতে পারছেন যে, সমাজের কল্যাণের জন্য সমকালীন শিল্পীসমাজ, বিশেষ করে তরুণ শিল্পীরা সচেতন ও নিবেদিত এবং সাধারণজনের পাশেই তাঁরা আছেন।
ঢাকায় এই কর্মশালায় দেশের মোট ৩৮ জন শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন।
১২ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মধুপুরের চুনিয়া গ্রামের সবুজ প্রকৃতি ও মান্দি আদিবাসীদের জীবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থাপনাশিল্পের অর্থবহ উন্মুক্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনে স্থানীয় মান্দি জনগোষ্ঠী আন্তরিক সহযোগিতা দিয়েছে। এদিকে ঢাকায় পুরান ঢাকাকে কেন্দ্র করে অক্টোবর মাসের ১ তারিখ শুরু হওয়া কর্মশালার কমিউনিটিভিত্তিক বিভিন্ন স্থাপনা, ভিডিও, সাউন্ড এবং ইমেজভিত্তিক শিল্পকর্মগুলো ২-৩ ডিসেম্বর সিটি কর্মশালায় ও ৪ ডিসেম্বর ওপেন স্টুডিওতে সকলের জন্য প্রদর্শনী করা হয়। সিটি কর্মশালার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্থান ধোলাইখাল, কোতোয়ালি, সদরঘাট, ওয়াইজঘাট সংলগ্ন বাফা, আহসান মঞ্জিল, শাঁখারীবাজারের কল্পনা বোর্ডিং, বড় কাটরা সংলগ্ন বিউটি বোর্ডিং, এর উল্টো দিকের কমিউনিটি ক্লাব, তাঁতীবাজারের পান্নিটোলার লোকশিল্পী শঙ্করকুমার ধরের বাড়ি, মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে বুড়িগঙ্গার ধার ঘেঁষে সেতুর নিচে, আহসান মঞ্জিলের উল্টো দিকে বুড়িগঙ্গায়, শ্যামবাজার (রূপলাল হাউস), ঢাকা মুসলিম হাইস্কুল ও ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণ, জুবিলী হাইস্কুল প্রাঙ্গণ, কাজী নজরুল ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণ (শ্যামবাজার), লালকুঠি, বীণাস্মৃতির ঘাট প্রভৃতি।
বিদেশী শিল্পীও এই আয়োজনে অংশ নিয়েছেন। ইংল্যান্ডভিত্তিক ভিজিটিং আর্টস ইউকে এই কর্মশালার সঙ্গে একই লক্ষ্যে কাজ করছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯
Leave a Reply