‘ট্রায়াড’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে এসেথটিক মুহূর্ত তৈরি করার ক্ষমতাওয়ালা শিল্প নেই। গ্যালারি কায়ায় প্রথম কক্ষে ঢুকেই যে দৃষ্টিগ্রাহ্য জগতে চোখ রাখা গেল, তা গত শতকের ভারতীয় ও ইউরোপীয় আধুনিক কিছু করণকৌশল-নির্ভর চিত্রকল্প। এই কক্ষে পর পর সারিবদ্ধভাবে সাজানো কায়সার সেলিমের মুখাবয়বগুলো জর্মন অভিব্যক্তিবাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। অপরদিকে পাশের দেয়ালে সাজানো লালা রুখ সেলিমের দ্বিতীয় প্রস্থ পুরাণকেন্দ্রিক চিত্রমালা ভারতীয় প্রবীণ কিছু শিল্পীর নতুন অধ্যায় হিসেবে ধরা দেয়।
তবে, পূর্ণাঙ্গ প্রদক্ষিণের পর প্রদর্শনীটি সম্পর্কে কিছুটা হলেও পুনর্বিবেচনায় পৌঁছানো সম্ভব হয়।
কায়সার সেলিম অপরিচিত হলেও, লালা রুখ সেলিম ও নাসিমা হক মিতু তাদের ভাস্কর্যকর্মের সূত্রে যথেষ্ট পরিচিত দুটি নাম। লালা রুখের একক-ফিগারনির্ভর ভাস্কর্য যদিও মানবের শরীরী অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে আত্মিক শক্তির প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম, মিতুর নবযাত্রার জড়জীবনধর্মী কম্পোজিশন আকৃতি ও ঘনত্বের মধ্য দিয়ে জীব-অতিক্রমী আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটিয়ে স্পিরিচুয়াল জগত সম্পর্কে খোঁজ দেয়। তবে দুই শিল্পীই বর্তমান অয়োজনে চিত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন। লালা রুখের ক্ষেত্রে তাঁর ভাস্কর্যের কলেবর নির্মাণের সহায়ক ড্রইং বা চিত্র এই প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে, মিতুর চিত্রে তেমনটা দেখা যায় না। পূর্বস্মৃতি—অর্থাত্ যেসব ভাস্কর্য দেখে এই শিল্পীর দিক-নিশানা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল, সেই ধারা বর্তমান প্রবণতার সঙ্গে যদি তফাত্ তৈরি না করে থাকে, তবে মিতুর ড্রইং ছাপচিত্র ও কালি/তুলির স্কেচগুলো ভাস্কর্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নয়।
তিনের এই সমারোহে তিন চিত্রীর প্রকাশভঙ্গির মিলই বেশি দেখি। এমনকি চিত্রকর্মের আকৃতির দিক বিচার করলেও প্রত্যেকেই ছোট কাজের পক্ষে রায় দিয়ে শিল্প সৃষ্টির যজ্ঞে ঝাঁপ দিয়েছেন বলে মনে হতে পারে।
তিন শিল্পীর কাজেই একক এলিম্যান্ট বা ফিগারের প্রাধান্য প্রদর্শনীর বৈচিত্র্য ব্যাহত করেছে। বৈচিত্র্যের খাতিরে যে বিভিন্নতা জোরপূর্বক তৈরি হয়, তেমনটা না থাকায় একটি বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে এই ত্রয়ী মূলত শিল্পের যে সিনোগ্রাফিক মডেল তাঁদের শিল্পভাবনার কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন তা হয়তো একই। অর্থাত্ যে সাযুজ্য বা মিল তাঁদের কাজে লক্ষ্য করা গেল, তা হয়তো সমমনোভঙ্গির সূত্রে জায়মান।
এবার শক্তিমত্তার দিকে চোখ রাখা যায়—লালা রুখ মিথ বা পুরাণের সূত্রে গৃহীত প্রাণীর পিঠে মানবীয় যে চিত্রকল্প তৈরিতে সচেষ্ট হয়েছেন তার চেয়ে একক ও বলশালী মানব-মানবীর চিত্রগুলোয় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। অর্থাত্ আদিম সত্তার সার উদ্ঘাটনের চেয়ে তিনি মানবতার শক্তি চিহ্নিত করতেই বেশি সক্ষম বলে মনে হয়। অপরদিকে, মিতু ব্রাশ ও কালিতে যে লুকোচুরির ভঙ্গিতে নারী-ফিগারের সৌন্দর্য দর্শকের সামনে হাজির করতে চেয়েছেন, তার চেয়ে ভিন্নখাতে তাঁর এসেথটিক ব্যয় সার্থকতর।
এই প্রদর্শনীতে মিতুর কিছু নতুন উেক্ষপের পাটাতন তৈরি হয়েছে। ‘দেখা ৩’ শিরোনামের একটি ছাপচিত্রে রেখার জটিলতার আদিম ম্যামথ-সুলভ ফর্ম ও তার সম্মুখভাগে পদস্খলন ঘটার আগের মুহূর্তের এক আদমসন্তান এই চিত্রকল্পে মিথিক মাত্রা তৈরি করে। তাঁর ভাস্কর্যের শান্ত-ভাবের বাইরের এই অস্বাভাবিক রসসঞ্চারী ড্রইং নব-মাত্রার ইঙ্গিতবাহী।
এই শিল্পীর ভাস্কর্যের মনোলিথিক মনোভাবের সঙ্গে এই চিত্রের মিল পাওয়া যায়—অথচ এর আরেকটি নতুন পর্বের সূচনা করতে সক্ষম বলে মনে হয়। বোর্ডকাট—অর্থাত্ মোটা কাগজ কেটে কাঠখোদাইয়ের ভঙ্গিতে করা শিল্পীর ‘নৃত্য’ শিরোনামের শিল্পটি অনেক সম্ভাবনা ধারণ করে। এ প্রদর্শনীতে বোর্ডকাট মাধ্যমটির সূত্রে যে রেখার সচলতানির্ভর কিছু ড্রইং সম্ভবপর হয়ে উঠেছে, তা অন্তত কিছুটা ভিন্নতা তৈরি করে।
প্রদর্শনীর সত্যিকার চিত্রী হলেন কায়সার সেলিম, যিনি নারী শরীরকে তার দুই প্রস্থ মাত্রা সহকারে আঁকতে চেয়েছেন। প্রথম মাত্রাটি হলো: আদিম মাত্রার চৈতন্যের প্রক্ষেপণে শিল্পী তেমন সার্থক নন। দ্বিতীয় মাত্রাটি হলো, আধুনিক সময় আক্রান্ত নারী-শরীর। এই দ্বিতীয় মাত্রা মূলত ডি-কুনিত্-এর সূত্রে যে বিমানবিকীকরণ আমাদের চেনা হয়ে গেছে—তারই একটি স্রোতধারা। এর সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর হলো, ‘কালোতে ফিগার’ শিরোনামের কালি/ব্রাশে আঁকা চিত্রকর্মটি।
সব সত্ত্বেও এই শিল্পী পূর্ণাঙ্গ চিত্রকল্পের শক্তিমত্তা উদ্ধারে যে কয়েকটি চেষ্টা সামনে হাজির করেছেন, এসেথটিক মুহূর্ত তৈরির আকাঙ্ক্ষা থেকেই তার ব্যুত্পত্তি বলে ধারণা করা যায়। তার ‘রাউন্ড ড্যান্স’ বা ‘নৃত্য চক্র’ নামের কাজের সুমো কুস্তিগিরের আদলে উদাম শরীরের পাত্র-পাত্রীরা এক নির্বাক নাটকের কুশীলবের মতো নিষ্ক্রিয়, অথচ চিত্রকল্পটি কিছু ঘটবে—এমন সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে। এটি ‘ট্রায়াড’ নামের প্রদর্শনীর সবচেয়ে সম্ভাবনা ধারণকারী ইমেজ। একই শিরোনামের শিল্পীর দ্বিতীয় ও ক্ষুদ্রতর চিত্রটিতে ফিগারে লাল রঙ ও রেখার সৌন্দর্যের বিলোপ জর্মন অভিব্যক্তিবাদের কথা মনে আনলেও এর সম্ভাবনার দিকেও নির্দেশ করে। উপরোক্ত দুটি চিত্রকর্ম ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে বড় মাত্রার অনুভূতি তৈরি করে; এমনটি বড় পরিসরে পুনর্বিন্যস্ত হলে এর ভাব আরও কত স্পষ্টতর হতে পারত, এমন ভাবনাও মনে জাগায়।
‘ট্রায়াড’ প্রদর্শনীতে প্রত্যাবর্তনের আয়োজন নেই। কারণ, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এটি একটি একমাত্রিক আয়োজন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯
Leave a Reply