ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহ কবিতা, নাটক, গান ও গজল লিখতেন। জীবনের শেষ ৩০ বছর দিনলিপি লিখেছেন। ১৬ ডিসেম্বর ছিল তাঁর ১০৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তাঁর ডায়েরির কিছু অংশ নিয়ে একটি রচনা, সঙ্গে একটি কবিতার অনুবাদ ছাপা হলো
ঢাকার খাজা বংশের নবাবদের মধ্যে আহসান উল্লাহ (১৮৪৬—১৯০১) ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রচুর বিত্ত-বেসাতের মালিক ছিলেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর চিত্ত ছিল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায়ও নিবেদিত। মুনশী রহমান আলী তারেক তাঁর কবি-প্রতিভা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তাঁকে ‘কাব্যের বাদশাহ’ বলেছেন। তিনি কবিতা লিখতেন, লিখতেন নাটক, গান ও গজল; পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সংগীত ও নাটকের। তিনি ছিলেন একজন আলোকচিত্রীও। খাজা পরিবারের ইতিহাস রচনা করেছেন তিনি। ‘তাওয়ারিখ-এ কাফিলরিয়াহ’ নামে তিনি নিয়মিত ডায়েরি বা দিনলিপি লিখতেন। তাঁর লেখক নাম ছিল ‘শাহীন’ অর্থাত্ বাজপাখি। অন্যদিকে ঢাকার উন্নয়ন ও কল্যাণে নবাব আহসান উল্লাহর অবদান ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
নবাব স্যার খাজা আহসান উল্লাহর লিখিত ডায়েরির সন্ধান পাওয়া যায় বিভিন্ন লেখক ও গবেষক সূত্রে। জানা যায়, তিনি ১৮৭১ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত ডায়েরি লিখেছেন। এসব ডায়েরি আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার এবং খাজা পরিবারের বিভিন্নজনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে, যা রক্ষিত আছে। ডায়েরিগুলো মূলত উর্দু ভাষায় লেখা হলেও মাঝেমধ্যে ইংরেজিতেও লেখা রয়েছে। ডায়েরিতে বর্ণিত বেশির ভাগ তথ্যই নবাব আহসান উল্লাহর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পরিচিতজনের জীবন ও কর্মসংক্রান্ত হলেও এসবের মধ্যে বিবৃত হয়েছে সমকালীন সমাজ-সংস্কৃতির বিবরণ। এসব তথ্য ঢাকা তথা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার উত্স ও উপাদানের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।
ড. মুহম্মদ আবদুল্লাহ, ড. মো. রেজাউল করিমের অনুবাদে এবং ড. মোহাম্মদ আলমগীরের সহায়তা নিয়ে নবাব আহসান উল্লাহর বিভিন্ন ডায়েরির নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো।
শাহবাগের মেলা, বিবির পরনে সাদা শাড়ি: ১৮৮৩ সালের ১ জানুয়ারি নবাব আহসান উল্লাহ ডায়েরিতে লিখেছেন:
‘আজ ভোর সাতটায় ঘুম থেকে উঠেছি। চিঠিপত্র লিখে গোসল সারলাম। খাবারদাবার খেয়ে আমি, হাফিজুল্লাহ (জ্যেষ্ঠ পুত্র), শ্রদ্ধেয় আব্বা (নওয়াব আবদুল গণি), সলিমুল্লাহ (পুত্র) প্রমুখ শাহবাগে (মেলায়) গেলাম। সেখানে গিয়ে একবার চারদিকে ঘুরে বেড়ালাম। কয়েকটি খেলনা কিনলাম। অতঃপর বাড়ি এসে পশ্চিমের বারান্দায় বসে কমলা খেলাম এবং নাচ দেখলাম। বেলা দুটোর পর হতে সঙরা আসতে থাকে। তিনটা পর্যন্ত বেশ সমাবেশ হলো। আমি বারান্দা থেকে চলে এসে আব্বার সঙ্গে দেখা করলাম। পরে ডাক্তার সাহেবের ছেলের জানাজায় যাই। মাগরেবের নামাজের সময় বাসায় ফিরে এলাম। রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। বিবি সাহেবাও ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু পরে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। রাত বারোটা পর্যন্ত দুজনে কথাবার্তা বললাম। বেশ ঠান্ডা লাগছিল। তবে খুব বেশি বা কম নয়। আজ আমার স্ত্রী সাদা শাড়ি পরেছিলেন। সাহেবরা বাইগুন বাড়ি গিয়েছিলেন শিকার করতে। তাঁরা দুটো হরিণ শিকার করে পাঠিয়েছেন—একটি নর ও অন্যটি মাদি। দুটো হরিণই জজ সাহেবের বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।’
বিদেশিনীর সঙ্গে নৈশনৃত্য: নবাব আহসান উল্লাহর ডায়েরিতে নাচ-গানের অনেক তথ্য রয়েছে। রয়েছে সঙ, কৌতুক, সার্কাস, নাটক ও অন্যান্য আমোদ-প্রমোদের কথাও।
১৮৮৩ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি লিখেছেন, ‘এ দিন দুপুরে মেমগণ এসেছেন এবং তাঁরা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ভোজের টেবিল সাজিয়েছেন। রাতে ভোজ ও নাচ হয়েছে।’ তিনি লিখেছেন:
‘আমি প্রথমবার মিসেস আলেকজান্ডারের সঙ্গে, দ্বিতীয়বার মিসেস স্টিভেন্সের সঙ্গে ও তৃতীয়বার মিসেস জুজুবীরের সঙ্গে নেচেছি। ভোজের টেবিলে মিসেস আলেকজান্ডারকে নিয়ে গেছি।’
দুই দিন পর তাঁর ডায়েরিতে আরও একটি নৈশ-নৃত্যানুষ্ঠানের খবর পাওয়া যায়। ১১ জানুয়ারি রাতেও নবাব আহসান উল্লাহ একের পর এক তিনজন লেডির সঙ্গে নেচেছেন! রাত আড়াইটায় নাচ বন্ধ হয়। ১৩ জানুয়ারির ডায়েরিতেও তিনজন বিদেশিনীর সঙ্গে নৈশ-নৃত্যের কথা আছে। লিখেছেন তিনি:
‘রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত নাচ চলল। সকলেই খুশি ও আনন্দমুখর ছিল। আমি তিনজন লেডির সঙ্গে বল-নাচ নেচেছি ও একজনকে খাওয়ার টেবিলে নিয়ে গেছি।’
নাচের আরও খবর পাওয়া যায় বিভিন্ন সালের ডায়েরিতে। ১৮৮৩ সালের ২০ জানুয়ারি রাতে তিনি ঢাকার জমিদার রূপলাল দাসের বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে নাচ-গান উপভোগ করেছেন। ১৮৯৭ সালের ২৪ মে রাত তিনটা পর্যন্ত আহসান মঞ্জিলে তামাশা এবং নাচ চলে।
ঢাকায় টেলিফোন ও ট্রেন লাইন চালু: নবাব আহসান উল্লাহর ডায়েরিতে ঢাকায় প্রথম টেলিফোন লাইন চালুর সংবাদ রয়েছে। ১৮৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি লিখেছেন:
‘আজ থেকে ঢাকায় টেলিফোন লাইন চালু হয়েছে। আমি ঢাকা থেকে দিলকুশায় হাফিজুল্লাহর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। এরপর বিবি সাহেবাগণও ফোনে কথাবার্তা বলেন।’
১৮৮৫ সালের ৩ জানুয়ারির ডায়েরিতে পাওয়া যায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ট্রেন লাইন চালুর সংবাদ।
ভূমিকম্প: ১৮৯৭ সালের জুন মাসে ঢাকায় প্রবল ভূমিকম্প হয়। এ সালের ১২ জুনের ডায়েরিতে নবাব আহসান উল্লাহ তাঁর কথা লিখেছেন। ভূমিকম্পের সময় ভয়ে তিনি সেজদায় পড়েছিলেন বলে জানিয়েছেন।
বইপ্রেম ও গ্রন্থাগার: আগেই জানিয়েছি নবাব আহসান উল্লাহ লেখালেখি করতেন। তিনি খুব পড়াশোনা করতেন। ছিলেন সিরিয়াস পাঠক। তাঁর বাড়ি আহসান মঞ্জিলে একটি বড় পাঠাগার ছিল। পাঠাগারটি এখনো আছে। পাঠাগারটি ছিল দেশি-বিদেশি বইয়ে সমৃদ্ধ। ওখানে তিনি পড়াশোনা করতেন।
১৮৯১ সালের ডায়েরিতে ৫০টি ইংরেজি বইয়ের নাম আছে যেগুলো তিনি সে বছর পাঠ করেছেন।
সূর্যগ্রহণের আলোকচিত্র গ্রহণ: নবাব আহসান উল্লাহ ছিলেন ভারতীয় ফটোগ্রাফ সোসাইটির (১৮৮৮) একমাত্র দেশীয় সদস্য। পরে তাঁর ছেলে সলিমুল্লাহও ওই সমিতির সদস্য হন। দুজনই ভালো আলোকচিত্রী ছিলেন। আহসান উল্লাহর ডায়েরিতে দেখা যায়, ১৮৯৬ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকায় যে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয় তার আটটি আলোকচিত্র তিনি নিজে ধারণ করেছিলেন।
কুকুরের পুরস্কার লাভ: নবাব আহসান উল্লাহ একদল শিকারি-কুকুর পুষতেন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটির নাম ছিল জ্যাক, ড্যাশ, হিলদা, স্পোকার। ১৮৮৩ সালের ২ জানুয়ারির ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, তাঁর চারটি কুকুর পুরস্কার লাভ করেছে। এর মধ্যে জ্যাক পেয়েছে প্রথম পুরস্কার আর বাকিগুলো দ্বিতীয় পুরস্কার।
ময়ূরের কাবাব ভক্ষণ: ১৮৯৪ সালের ১৭-১৮ জানুয়ারি তিনি লিখেছেন:
‘নৌকায় বাইগুন বাড়ি গেলাম। আজ (১৭ জানুয়ারি) আট বছর পর আমি হরিণ ও ময়ূর শিকার করলাম। আট বছর পর আজ (১৮ জানুয়ারি) রাতে ময়ূরের কাবাব খাওয়ার ভাগ্য আমার হলো।’
উল্লেখ্য, রমনা ও মতিঝিলে নবাবদের হরিণ, খরগোশ, মোরগ-মুরগি ও ময়ূরের খোঁয়াড় ছিল এবং শাহবাগে ছিল বাঘ-ভালুক-উটপাখির চিড়িয়াখানা।
ঘোড়া ও ঘোড়দৌড়: নবাব আহসান উল্লাহর ডায়েরিতে বার বার ঘোড়া ও ঘোড়দৌড় প্রসঙ্গ রয়েছে। ১৮৯৩ সালের ডিসেম্বরে তাঁর ডায়েরিতে কয়েকটি ঘোড়ার নাম পাওয়া যায়। যেমন: অ্যাসটারিসড, স্পেনডল, জুলেখা, জেল, ইশপাহান, লেডি অ্যান ইত্যাদি। এসব ঘোড়া বিভিন্ন রেসে অংশ নিত। বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল নবাবদের ‘রমনা রেসকোর্স’।
জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে: নবাব আহসান উল্লাহর ডায়েরিতে অনেক জন্ম-মৃত্যু ও বিয়ের সংবাদ রয়েছে। ১৮৮২ সালের ৯ অক্টোবর তিনি লিখেছেন:
‘আমার স্ত্রী নওয়াব বেগম (ফরহাত জান) ইন্তেকাল করেছেন।’ একই সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি লিখেছেন, ‘আমি কামরুন বিবিকে বিয়ে করেছি।’
১৮৮৪ সালের ৮ জুলাইয়ের ডায়েরিতে নবাবের জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা হাফিজুল্লাহর মৃত্যু সংবাদ এবং ১৮৮৫ সালের ১ জুলাই রয়েছে কন্যা পরীবানুর জন্মের কথা। পরীবানুর মা কামরুন বিবি ১৯০০ সালের ২২ জুন মৃত্যুবরণ করেন। এই তথ্যটিও রয়েছে ওই দিনের ডায়েরিতে। সেই সঙ্গে রয়েছে একটি ‘শের’ও।
কন্যাদের নাক ফোটানো: নবাব আহসান উল্লাহ তাঁর ডায়েরিতে অনেক সাধারণ ঘটনাও লিখে রেখেছেন। যেমন দান-খয়রাতের বিবরণ, শুভেচ্ছাপত্র-দাওয়াতপত্র বিলিবণ্টনের তথ্য, নাক ফোটানো এবং খত্নার কথাও।
১৮৮৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি লিখেছেন, ‘আমার কন্যাদের নাক ফোটানো হয়েছে।’ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি লিখেছেন, ‘খাজা ওয়াজির আলী সাহেবের পুত্রদের খাতনা করা হয়েছে।’
নবাব আহসান উল্লাহ ১৮৭১ থেকে মৃত্যুর আগে ১৯০১ সাল পর্যন্ত ডায়েরি লিখেছেন বলে জানা যায়। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে তাঁর সব ডায়েরি নেই। সব ডায়েরি উদ্ধার করার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সেই সঙ্গে দরকার ডায়েরিগুলোর বঙ্গানুবাদসহ প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়ার। এ ব্যাপারে আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং বাংলা একাডেমী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।
অনুপম হায়াৎ
সূত্র: প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৮, ২০০৯
Leave a Reply