ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ব—বদিউর রহমান \ জুলাই ২০০৯ \ প্যাপিরাস, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: মাইদুল ইসলাম সিজু \ ২৫৪ পৃষ্ঠা \ ২৮০ টাকা
বদিউর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় বরিশালে। আমি তখন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছি। শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমি মাঝেমধ্যে যোগ দিয়েছি। সেই সূত্রেই বদিউর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তিনি একাধিক শিশু-কিশোর সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। লেখালেখিও করতেন। কিন্তু তিনি যে একদিন প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যতত্ত্ববিদদের রচনা সম্পর্কে উত্সাহী হয়ে উঠবেন এবং বাংলায় তাঁদের কাজের অনুবাদে প্রবৃত্ত হবেন তার কোনো ইঙ্গিত আমি ওই সময় তাঁর মধ্যে লক্ষ করিনি।
প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হোরেস এবং লঙ্গিনাসের মতো গ্রিক ও রোমান ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ববিদের রচনার অনুবাদ ছাড়াও বদিউর রহমান আরও কয়েকটি অনুবাদ করেছেন। এসবের মধ্যে আছে এম এন রায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং নয়া মানবতাবাদ। আছে এককালের বহুল আলোচিত বামপন্থী সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী র্যালফ ফক্সের গ্রন্থের অনুবাদ উপন্যাস ও জনগণ। ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ব বইয়ে তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন গ্রিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটল এবং রোমান হোরেস ও লঙ্গিনাসের সাহিত্যতত্ত্ব। তিনি শুধু ভাষান্তরের মধ্যে তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ রাখেননি, বিস্তারিত টীকাভাষ্যও যোগ করেছেন। এখানে বদিউর রহমান তাঁর নিজের পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি এবং নিজের মূল্যায়ন ও উপলব্ধি ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। ভূমিকায় বদিউর রহমান চারজন ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ববিদের পরিচয় যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা পাঠককে প্রীত করবে এবং তাঁদের অনুসন্ধিত্সাকে জাগ্রত করবে। যেমন—প্লেটোর একটি উক্তির প্রতি অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তিনি কবিকে তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে নির্বাসন দেওয়ার কথা বলেছেন। বদিউর রহমান ওই উক্তির গূঢ়ার্থ বিশ্লেষণ করেছেন। ‘কাব্য আবেগ এবং কল্পনানির্ভর আর দর্শন যুক্তিনির্ভর।’ প্লেটো কাব্যকে বলেছেন মিথ্যার সূতিকাগার। তাঁর মতে, কাব্য সত্য থেকে তিন ধাপ দূরে। ‘মানুষ যখন আবেগানুভূতিতে বিহ্বল হয়ে পড়ে, তখন কাব্য সেই বিহ্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে আরও আবেগময় করে তোলে।’ প্লেটোর মতে, বুদ্ধিবৃত্তির কাছে কাব্যের কোনো আবেদন নেই। প্রচলিত কাব্যে জনগণের জন্য উপযোগী কোনো উপদান নেই, এ কথা বলার পর প্লেটো একটি চমত্কার মন্তব্য করেছেন। আমি বদিউরের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘কবি এবং কাব্যের পক্ষের উকিলকে উদ্দেশ করে তিনি (প্লেটো) বলেন, তাকে প্রমাণ করতে হবে যে কাব্যদেবী আমাদের মধ্যে কেবল উপভোগের সৃষ্টি করে না, সে মানুষের জীবন এবং রাষ্ট্রের জন্য স্থায়ী মঙ্গলও বহন করে নিয়ে আসে। এমন যুক্তিকে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাব। কারণ, কাব্য যদি আমাদের আনন্দ এবং উপকার—এই উভয়েরই উত্স হয়, তাহলে কাব্যের কাছ থেকে আমাদের লাভ ছাড়া লোকসান হবে না।’
প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের তত্ত্বাদি সম্পর্কে আমাদের অল্পবিস্তর জানা থাকলেও হোরেস এবং লঙ্গিনাসের তত্ত্বগুলো সম্পর্কে আমাদের অনেকের জ্ঞান প্রায় শূন্য, যদিও হোরেসের আর্স পোয়েটিকা বা দ্য আর্ট অব পোয়েট্রি ও লঙ্গিনাসের পেরি হিপসস বা অন দ্য সাবলাইম-এ যেসব কথা বলা হয়েছে তা আমাদের সাহিত্যের নানা উপাদান ও গুণ উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। বদিউর রহমান ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ব-এর দীর্ঘ বিশ্লেষণমূলক ভূমিকার একেবারে শেষদিকে লঙ্গিনাস প্রসঙ্গে একটি কৌতূহলোদ্দীপক উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘লঙ্গিনাসের সাবলাইম-এর সঙ্গে ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রের ধ্বনিবাদ বা ধ্বনি ব্যঞ্জনার যথেষ্ট মিল লক্ষ করা যায়।’
কবীর চৌধুরী
সূত্র: প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০০৯
Leave a Reply