ওকালতি ও জজিয়তি জীবনের জলরেখা—গোলাম রব্বানী \ অক্টোবর ২০০৮ \ অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: আনওয়ার ফারুক \ ৭২ পৃষ্ঠা \ ১২০ টাকা
পশ্চিমে লেখালেখির কাজটি কেবল সাহিত্যিকদের ভেতরই সীমাবদ্ধ নয়। প্রধানত কবি বা লেখক নন, কিন্তু বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ লোকজন সেখানে নিয়মিত বই বের করে, সেগুলো নিয়ে হইচই হাঙ্গামাও আছে প্রচুর। বিশেষত রাজনীতিবিদদের ভেতর এই বই লেখার প্রচলনটা বেশি। ভারত এবং পাকিস্তানেও আজকাল এই জোয়ারটি দেখা যাচ্ছে। এই চর্চার একটা মস্ত সুবিধা আছে। বিভিন্ন পেশার মানুষের লেখালেখির ভেতর দিয়ে পাঠক একটি বিস্তীর্ণ ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ পান।
বাংলাদেশে লেখালেখির প্রচল কেবল সাহিত্যিকদের। কিন্তু বিভিন্ন পেশার লোকেরা নিয়মিত লিখলে পাঠক কীভাবে সমৃদ্ধ হতে পারতেন—তার একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হাজির করেছেন গোলাম রব্বানী। তিনি পেশায় একজন বিচারপতি। তাঁর পরিচিতিও কম নয়, বিশেষত ফতোয়া নিষিদ্ধ করে তিনি একটি রায় দিয়ে আলোচিত হয়েছেন।
ওকালতি ও জজিয়তি জীবনের জলরেখা বইটির ভেতর দিয়ে লেখক বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পর্কে কিছু খুচরো ছবি আঁকতে পেরেছেন। বিচার বিভাগ নিয়ে সাধারণ মানুষের আতঙ্কের শেষ নেই। আতঙ্কের নানামুখী কারণ আছে। একটি কারণ বোধ হয় আইন-আদালত নিয়ে মানুষের অজ্ঞতা। গোলাম রব্বানীর এই বইটি সেই অজ্ঞতার অন্ধকার কিছুটা হলেও ঘোচাবে।
ভূমিকায় গোলাম রব্বানী একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা পেড়েছেন। স্বৈরশাসকমাত্রই আইনকে ভয় করেন, পোষ মানাতে চান। পাকিস্তানি যুগে সামরিক জান্তা আইয়ুব খান মূর্খ ব্যক্তিদের আইনজীবী হওয়ার রাস্তাটি খুলে দেন। এতে করে আইন জানা আইনজীবীদের সংখ্যা কমতে শুরু করল। তার যথার্থ উত্তরসূরি স্বৈরনায়ক এরশাদ হাইকোর্ট বিভাগকে ভেঙে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন। এতে করে নতুন আইনজীবীর প্রশিক্ষিত হওয়ার পথ থাকল না। দলীয় কোটায় আইনজীবীর ঢেউ আছড়ে পড়ল আদালতের এজলাসে। বিচার বিভাগের এ রকম কিছু সংকট তিনি ভূমিকায় উপস্থিত করেছেন।
বইটিতে লেখক মূলত বিভিন্ন মামলার বিবরণী লিখেছেন। এসব বিবরণীর ভেতর দিয়ে পাঠক আদালত প্রসঙ্গে একটি আবছা চিত্র পাবেন। আদালতে ব্যবহূত বিভিন্ন শব্দ সম্পর্কেও সচেতন হবেন। গোলাম রব্বানী ইসলামি আইনে একজন বিশেষজ্ঞ। তাই বিবরণীগুলোয় ইসলামি আইনের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে।
একজন বিচারক কেবল আইন প্রয়োগ করেন না। তিনি আইনটিকে সম্পূর্ণ করে তোলেন। লেখক তাঁর বইতে বিচারকের এই ধীশক্তির প্রয়োজনীয়তাকে সুস্পষ্ট করেছেন। তাঁর দেওয়া বিভিন্ন রায়ের মাধ্যমে তিনি ইসলামি আইনের যুগোপযোগী প্রয়োগ দেখিয়েছেন। যা পরবর্তী সময়ে অনেকক্ষেত্রে অনুসৃত হয়েছে। কোরআন সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা ইসলামি আইনে বিচার করার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। লেখক কোরআন পাঠের সাতটি নিয়ম উদ্ধৃত করেছেন। মুসলিম সম্পত্তি আইন, তালাক প্রসঙ্গে তাঁর দৃষ্টান্তমূলক কিছু রায়ের কথা এই বইতে আলোচিত হয়েছে।
নীতিবিদ্যা নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন। বিচার বিভাগ গভীরভাবে সম্পর্কিত নীতিবিদ্যার সঙ্গে। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি নীতিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত। শাস্তি এবং বিচার প্রসঙ্গে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গত কয়েক দশকে অনেক বদলেছে। গোলাম রব্বানী সংক্ষেপে এসব প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন।
যৌন নিপীড়ন প্রসঙ্গে আদালতের অবস্থান নিয়ে নিন্দা অনেক পুরোনো। ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন নিপীড়নের ঘটনায় আদালত আগে থেকেই নিপীড়কের পক্ষ নিয়ে ফেলে। গোলাম রব্বানীর কোরআনের বরাত দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে আদালতের এই দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয়।
হেরে যাওয়া কোনো মামলার বিবরণী গোলাম রব্বানী লিখেননি। কিন্তু তিনি লিখেছেন একটি দরকারি বই।
পবন চক্রবর্তী
সূত্র: প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০০৯
Leave a Reply