আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এখানে আনুষ্ঠানিক অধিবেশনে আমার অংশগ্রহণ নির্ধারিত থাকলেও মনে হয়েছিল, সরাসরি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে ভালো হতো। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে আমি আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। ১৬ নভেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে বাংলা বিভাগের থার্ড সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে গিয়ে যখন হাজির হই, তখন মনে হয়, ওরা বুঝি আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরই (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রছাত্রী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপু বা অপরাজিতকে যেমন বলা হয়েছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকলেও জেন তুমি পৃথিবীর নাগরিক, আমারও নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ও এখানকার শিক্ষার্থীদের সে রকমই মনে হয়। জিজ্ঞাসু ও অনুসন্ধিত্সু শিক্ষার্থীরা বুঝি দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতা সত্ত্বেও তাদের শিক্ষকের কাছে পৃথিবীর সর্বত্র এক। হূদয়ের সঙ্গে হূদয়ের সংযোগ বুঝি একেই বলে। আমরা উভয় পক্ষই একমত হই যে পরের মুখে ঝাল না খেয়ে মূল টেক্সট পড়ার বিকল্প নেই এবং তাতে যদি আমরা ভুলও করি, সেটিই হবে আমাদের সঠিক পথ।
১৫ নভেম্বর রাতে সিলেট অবস্থানের পর ১৬ তারিখ সকালে সীমান্ত অতিক্রমের জন্য জকিগঞ্জ রওনা হই। লোকাল বাস বলে সেখান থেকে কুশিয়ারা পেরিয়ে সীমান্তের অন্য পার করিমগঞ্জ পৌঁছুতে দুপুর। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি অপেক্ষা করছিলেন সেখানে। যখন ক্যাম্পাস ও অতিথিশালায় পৌঁছুই, তখন প্রায় অপরাহ্ন।
১৬ তারিখ রাতে একটু দেরিতে ঘুমোতে গেলেও ১৭ নভেম্বর ভোরেই জেগে উঠি এবং নতুন জায়গা হলেও যথারীতি প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। খুব জরুরি ও প্রয়োজনীয় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জেগেছে বলে মনে হয়নি। এখানে টাউনশিপ গড়ে উঠেছে বলেও মনে হচ্ছিল না। ফলে সড়ক ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর গানের শব্দ শুনতে পাই। বুঝতে পারি, পাহাড়ের ওপর স্থাপিত আখড়ায় গান হচ্ছে।
দল বেঁধে বিপিন পাল মিলনায়তনে এসে হাজির হই। শুরুতে একটি দুঃসংবাদ আসে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চল্লিশোত্তর অচ্যুত মণ্ডল আগের রাতে আত্মহত্যা করেছেন। সে জন্য সবার মন খারাপ। অচ্যুত কেমন ছিলেন সেটা তাঁর ‘লেখকের লেখক’ (দ্বিরালাপ, অক্টোবর ২০০৯) পড়লে বোঝা যায়। অচ্যুত লিখেছেন, ‘ফিওদোর দস্তয়েভস্কি আমাদের পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আর যদি বা পড়ি, নিজেরা রাস্কলনিকভ, কিরিলভ, কারামাজো যেন না হই।’ কিন্তু অচ্যুত তাই হয়েছিলেন। ফলে জীবনানন্দের ভাষায় জ্যোত্স্নায় তিনি দেখেছিলেন কোনো ভূত। উদ্বোধনী অধিবেশনের শুরুতেই তাই প্রয়াতের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে মূল ভাষণ দেন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির পবিত্র সরকার। সম্মানিত অতিথির ভাষণ দেন কলকাতার বিশ্বভারতীর সুতপা ভট্টাচার্য। আমার ছিল উদ্বোধনী ভাষণ।
সুতপা ভট্টাচার্যের ভাষণের সময় আমার তাঁর ‘মেয়েলি পাঠ’ ও ‘রোকেয়া’র কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল এই বইতে তিনি রোকেয়ার অনুজা হোমায়রার কথা স্মরণ করেছেন যাঁর পুত্র আমির হোসেন চৌধুরী ১৯৬৪ সালে ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উত্পীড়িত মানুষকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। পদ্মরাগ উপন্যাসের ‘নিবেদন’ অংশে রোকেয়া তাঁর অগ্রজ ইব্রাহিম সাবেরের—যিনি তাঁকে লেখাপড়া শিখতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন—একটি গল্পের যে উল্লেখ করেন সুতপা তাঁর বইতে সেটিও বলেন। সেখানে দেখা যায়, হিন্দু সাধকের গুরু মুসলমান দরবেশ। দরবেশ ব্যাখ্যা করে বলেন, নিচের তলায় যদি হিন্দুরা থাকেন, দ্বিতীয় তলায় মুসলমান, তৃতীয় তলায় তবে শুধুই মানুষ। ‘সূক্ষ্মভাবে ধরিতে গেলে কিছুই থাকে না—সব “নাই” হইয়া কেবল আল্লাহ থাকেন।’
মূল ভাষণে পবিত্র সরকার প্রশ্ন তুলে বলেন, লেখক বা শিল্পীরা তত্ত্ব জেনে বা বুঝে সাহিত্য বা আখ্যান রচনা করেন না। তবে তত্ত্ব বুঝলে রচনা বোঝাও সহজ হয়। আমার মনে হচ্ছিল এ ক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তিই যথার্থ: ‘আমার লেখায় যে অনেক ভুল, ভ্রান্তি আর অসম্পূর্ণতার ফাঁকি আছে আগেও তা জানতাম। কিন্তু মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচয় হবার আগে এতটা স্পষ্ট ও আন্তরিকভাবে জানবার সাধ্য হয়নি।’ কিন্তু অধিকতর তাত্পর্যপূর্ণ ছিল মার্কসবাদ থেকে এটা শেখা যে, ‘এ জন্য আফসোস করলেও নিজেকে ধিক্কার দেবার প্রয়োজন নেই। মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিত হবার আগে কেন সাহিত্য করতে নেমেছিলাম ভেবে আত্মগ্লানি বোধ করলে সেটা মার্কসবাদের শিক্ষার বিরুদ্ধেই যাবে, যান্ত্রিক একপেশে বিচারে সৃষ্টি হবে আরেকটা বিভ্রান্তির ফাঁদ।’
উদ্বোধনী ভাষণে আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ও নেতা আবদুল মতিনের বক্তব্য তাঁর বই থেকে তুলে ধরি। তিনি বলেছেন, ‘বাহ্যত ধর্মের কিন্তু মর্মত শ্রেণী ও শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।’ তিনি একে সাত-আট হাজার বছর পূর্বেকার আমাদের কৃষি উত্তরাধিকার বলে মনে করেন। সে জন্যও ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয় লাভের পর ১৯৭১-এ বাংলা একাডেমীর একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিভাষার অপেক্ষা না করেই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা চালুর ঘোষণা দিলেও পঁচাত্তরে, তাঁর মৃত্যুর বছরে সরকার বাংলা প্রচলনের যে সার্কুলারটি জারি করে তাও করা হয় ইংরেজিতে, যার ‘forthwith’ কথাটি ছিল ওই সার্কুলারেরই লঙ্ঘন। যে বছর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে, সেই ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমীর ২০ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে রুশ ভাষার প্রতিনিধি গাগায়েভা কিজিল গুল বলেছিলেন, বাঙালিরা ভাষার অধিকার অর্জনের জন্য প্রাণ দিতে পারেন, কিন্তু ভাষার উন্নতির জন্য পরিশ্রম করতে রাজি নন। সে জন্য আমরা দেখি ঢাকায়ই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দুটি রেফ (র্ ) দরকার সেখানে মাত্র একটি রেফ ব্যবহার করে ব্যানারে তা হয় ‘নর্দান’। অথচ ইংরেজি বানানে দুটি আর (r) লিখতে কোনো ভুল হয় না। একে কী বলব, বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা, না শ্রদ্ধাবোধ? এ জন্য বিজ্ঞাপনে ‘গায়ে হলুদ’ অনর্থক চন্দ্রবিন্দু যুক্ত হয়ে যায় ‘গাঁয়ে হলুদ’।
আমি আরও স্মরণ করি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হওয়ার বেশ আগে থেকেই বাংলাদেশের প্রতিবেশী ত্রিপুরা রাজ্যে বলা হয়েছে তোমার মাতৃভাষা, আমার ভ্রাতৃভাষা। আমাদের পূর্বজরা ভাষা আন্দোলনের সময়ই সব ভাষার সমান মর্যাদা দাবি করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলা ও সব ভাষার প্রতি যে সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে তার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চাকমা ভাষায় উপন্যাস লেখার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর সেখানকার বিধানসভায় পাস হওয়া অহমিয়া ভাষার সমান মর্যাদা দাবি করে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির মানুষ ১৯৬১ সালের মে মাসে যে আন্দোলন গড়ে তোলে তাতে ১৯ মে শহীদ হওয়া ১১ জনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাই। পরেও ভাষার দাবিতে আরও কজন শহীদ হন। আসাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানত বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং শিক্ষার্থীদের মূল অংশ এই ভাষার মানুষ বলে ভাষার প্রতি তাদের আবেগ ও ভালোবাসা অত্যন্ত প্রবল। ১৯ নভেম্বর, আমার ফেরার দিন শিলচর থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনকণ্ঠ থেকে জানতে পারি, শিগগিরই শিলচর রেলস্টেশনের নতুন নাম হবে ‘ভাষা শহীদ স্টেশন’। দীর্ঘদিন থেকে বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিককর্মী ও জনগণের দাবির পর এখন আসাম রাজ্য সরকার তাতে সম্মতি জানিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও তত্পরতা শুরু করেছে। উল্লেখ্য, শিলচর-আগরতলা এক্সপ্রেস ট্রেনকে ‘ভাষা শহীদ এক্সপ্রেস’ হিসেবে নামকরণের জন্য ত্রিপুরা সরকার অনেক আগেই তাদের সম্মতি জানিয়ে রেখেছে।
দুই
এটা ছিল একটা আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্র—‘সমসাময়িক বাংলা আখ্যান: অস্তিত্বের ভাষা, ভাষার অস্তিত্ব’। তারিখ ১৭ ও ১৮ নভেম্বর। মোট পাঁচটি একাডেমিক সেশন হয়। বিষয়সমূহ ছিল: সমসাময়িক বাংলা আখ্যান ও ভাষা, উত্তর-উপনিবেশিকতা ও সাম্প্রতিক বাংলা আখ্যান, এই পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ বাস্তবতা, নারী দৃষ্টিকোণ ও নারীবাদী ব্যাখ্যা এবং এ ক্ষেত্রে নিম্নবর্গের চেতনা। আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ও বাংলাদেশের লেখকদের আখ্যান ও কথাসাহিত্য রচনার প্রসঙ্গও উঠে আসে। দুটি প্রবন্ধে সরাসরি বাংলাদেশের লেখকদের আখ্যানও আলোচিত হয়। বিশ্বতোষ চৌধুরীর ‘হাসান আজিজুল হকের আগুন পাখি: সমকালীন আখ্যানের অন্তঃসর’ এবং আলাউদ্দিন মণ্ডলের ‘শহীদুল জহিরের উপন্যাস: কথাকারের পারাপার।’ রামী চক্রবর্তীর লেখায় মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস প্রধান গুরুত্ব পেলেও উদয়চাঁদ দাশের প্রবন্ধে ‘এই সময় ও দেশভাগের আখ্যান’-এ ‘আগুনপাখি’ও অন্যতম মূল বিবেচ্য হয়েছে। তবে এখানে আলোচিত সুনন্দা শিকদারের আখ্যানটির পটভূমি বাংলাদেশের জামালপুরের গ্রাম দিগপাইত। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন অবস্থান করেও তিনি এপারের যে মানুষকে ভুলতে পারেননি তারাই এখন হয়ে ওঠে তাঁর আখ্যানের কুশীলব।
যে অধিবেশনে আমি সভাপতিত্ব করি তাতে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে প্রান্তিক মানুষ ও চরিত্র প্রসঙ্গে শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সূক্ষ্ম কিন্তু অত্যন্ত রূঢ় বাস্তব এবং মঞ্জু সরকারের ‘প্রিয় দেশবাসী’ বা ‘উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা’র মানুষদের ‘অবিনাশী আয়োজন’-এর কথা বলি। আমার প্রবন্ধে উল্লিখিত সমরেশ মজুমদার বা কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মঞ্জু সরকার, আনিসুল হক বা জাকির তালুকদারের কথাসাহিত্যের কনটেন্ট ও ভাষায় বিষয়ের অথবা এপার-ওপারের যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তুলে ধরেছি তার প্রতিও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
তিন.
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যা-পরবর্তী সময় অত্যন্ত আনন্দে কেটেছে। ১৬ নভেম্বর ক্লাস নেওয়ার পর বাংলা বিভাগের অনেকের সঙ্গে ইতিহাসের প্রজিতকুমার পালিত অথবা ইংরেজির দু-একজন ক্যাফেটরিয়ায় চা, কফি, স্ন্যাকস খেতে খেতে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দেন, পরে অতিথিশালায় গিয়েও তা চলতে থাকে। পবিত্র সরকারের সঙ্গে আড্ডা হয়েছে এক সন্ধ্যা। ১৮ তারিখ সকালেই তিনি ফিরে গেছেন। তবে সাধন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের আড্ডা জমেছিল তিন দিনই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রফিকউল্লাহ খান ও আমি ছিলাম পাশাপাশি কক্ষে, সাধনদাও কাছাকাছিই। ফলে এ-ওর কক্ষে চলে গেছি এবং আড্ডার চরিত্রানুযায়ী তার কোনো সময়-অসময় থাকেনি। ফিরে যাওয়ার আগের দিন রাতে সাধনদার বিছানায় এসে বসেন তপোধীর, তিনি আমাদের সঙ্গে তুমুল আড্ডা দেন। উল্লেখ্য, সাধনদা, তপোধীরের আরেকজন বন্ধু রণবীর পুরকায়স্থ। বয়সের কিছুটা তফাত্ থাকলেও এই তিনজন অভিন্নহূদয় মানুষ যখনই সুযোগ পেয়েছেন, আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন।
এখানে এসে জেনেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তনু সরকারের পূর্ব পুরুষ ও তাঁর বাবা-মায়ের বাড়ি বাংলাদেশে, কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ ও কোম্পানিগঞ্জে। বাবা এখন যেতে না পারলেও মা প্রায়ই বাংলাদেশে যান। হয়তো এবারও সহসাই যাবেন।
বয়স যাই হোক, এই বিশ্ববিদ্যালয় ও আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছে স্বর্ণস্মৃতি হয়ে থাকবে তাঁদের পরস্পরের সান্নিধ্য ও মন খুলে আড্ডা দেওয়ার কথা। স্বল্পসংখ্যক রিসার্চ-স্কলার ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশার সুযোগ না হলেও চারপাশে সর্বক্ষণ ওদের উপস্থিতি অনুভব করছি। ওদের হাস্যলাস্য গাম্ভীর্য—সবই ছিল উপভোগ্য। মনোযোগী শ্রোতা হিসেবেও তারা ছিল অসাধারণ।
যেদিন চলে আসছি—সেদিন বেশ সকালে সস্ত্রীক অতিথিশালায় এসে উপস্থিত হন উপাচার্য। কিন্তু পেশাগত জীবনে ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তা হলেও স্বপ্না ভট্টাচার্যের আসল পরিচয়, তিনি গল্পকার। রণবীর পুরকায়স্থ তাঁর বই সমান্তরাল আমাকে দিয়ে বললেন, তিনি সসংকোচে এটা আমাকে দিচ্ছেন। সসংকোচে কেন, স্বপ্না ভট্টাচার্যের কোনো কোনো গল্প তো আমি আগেই পড়েছি।
বিদায় মুহূর্তটি ঈষত্ বেদনাঘন হয়ে উঠতে চাইলেও তাকে গুরুত্ব না দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। করিমগঞ্জ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অতিথিশালা এবং সেখান থেকে আবার আমাকে করিমগঞ্জ নিয়ে এসেছেন রিসার্চ-স্কলার আলীম। ফেরার পথে শিলচরে আলাউদ্দিন মণ্ডলের বাসায় ওঁর স্ত্রী লিলি, শিশু কন্যাদ্বয় ও শ্যালকের সঙ্গে দেখা ও কথা হলো। সেখানেই প্রাতঃরাশ সেরে আবার যাত্রা। পথে উঠলেন দেবাশিস ভট্টাচার্য, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদয়চাঁদ দাশ। করিমগঞ্জ পৌঁছে দেবাশিসের বাড়ি গেলাম, ওঁর নৃত্যশিল্পী স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো। জানলাম, ১৮৫৭ সালের জাতীয় মহাবিদ্রোহ এবং বিংশ শতাব্দীর চট্টগ্রাম বিদ্রোহের সৈনিক ও কুশীলবেরা এই অঞ্চলে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তা নিয়ে বইও লেখা হয়েছে, কিন্তু বহুল প্রচারিত নয়। করিমগঞ্জে এসে পরিচয় হই মুজিব স্বদেশীর সঙ্গে। তিনি এই অঞ্চলের বাসিন্দা ও আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
কুশিয়ারা নদী দিয়ে যখন আবার বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছি, তখন মনে হয়, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভক্ত হলেও সত্তা ও সংস্কৃতির অনেক কিছুই বুঝি ওই পারে ফেলে যাচ্ছি। নাহলে যে পূর্বপুরুষদের কোনো অবয়ব এখন আর উত্তরপুরুষদের মনে নেই, তাঁদের ভেবেই বা কেন করিমগঞ্জের সীমান্তে থাকবে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ আর নিউমার্কেট কমপ্লেক্সে গড়ে উঠবে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লাইব্রেরি’।
শান্তনু কায়সার
সূত্র: প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০০৯
Leave a Reply