চাঁদপুর উপজেলার ছোট সুন্দর বাজার, এই বাজারেই রাজাকাররা গুলি ছোড়ে আবদুর রশীদের ওপর কতশত ত্যাগ আর অগণিত মানুষের হাহাকারের বিনিময়ে রচিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস। ওঁরা তাঁদেরই কয়েকজন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে তাঁরা এসেছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফের মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন অনুষ্ঠানে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে যুদ্ধদিনের সেই সব দুঃসহ স্মৃতির কথা লিখেছেন জাহীদ রেজা নূর।
চ্যানেল আইয়ের টিভি ক্যামেরার সামনে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ কাঁদছেন! বিশ্বাস করা যায়!
তাঁর সামনে কাননবালা। একটু আগেই কাননবালা চ্যানেল আইয়ের দর্শক-শ্রোতাদের জানিয়েছেন জীবনের ট্র্যাজেডির কথা। কীভাবে একটি বাংকার তাঁর মতো চারজন নারীর জীবনকে নরক বানিয়েছিল, সে কথা বলেছেন তিনি।
একটু আগেই তিনি বলেছেন, ওই বাংকার থেকে ফিরে আসার পর তাঁর মা-বাবা তাঁকে পরিত্যাগ করেছিল। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দুই মুসলিম ও দুই হিন্দু নারীকে যে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করেছিলেন, তাঁদেরই একজন আহত মুক্তিযোদ্ধা বিয়ে করেন কাননবালাকে। তাঁদের তিন সন্তান। সুখেই আছেন তাঁরা। যদিও এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেটির ফরম ফিলাপ করার টাকা নেই তাঁদের হাতে। কথা বলতে বলতে একসময় কাননবালা, যিনি এখন নাজমা বেগম, হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকেন। এই কান্না কেন, তা জানেন না মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। বলেন, আপনি কাঁদছেন কেন?
প্রশ্নের উত্তরে আরেক প্রস্থ কান্না।
‘আপনার স্বামী কি আপনাকে আদর করে না?
করে।
স্নেহ করে না?
করে।
তাহলে কাঁদছেন কেন?
আমি ভাবি, একাত্তরে কেন আমার মৃত্যু হলো না!
এ কথা শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। বলেন, আমি সম্মুখসমরে অংশ নিয়েছি, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কেটেছে জীবন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনুষ্ঠান করতে করতে জনমানুষের ইতিহাস জানছি আগ্রহের সঙ্গে। কিন্তু কাননবালার কথা শুনে আবিষ্কার করলাম, এই একটি স্পর্শকাতর জায়গায় কখনোই হাত দিতে পারব না আমরা! কেউ কষ্ট দেয় না কাননবালাকে, সুখেই আছেন তিনি। কিন্তু একাত্তরে মরে গেলেই ভালো হতো, এই ভাবনা থেকে বের হতে পারেন না কাননবালা।
নাসিরউদ্দিন ইউসুফকে বলি, তিন বছরের বেশি তো অনুষ্ঠানটা করছেন। প্রতিদিন নতুন মানুষ। মনে দাগ কেটে গেছে, এমন কয়েকজনের কথা কি বলবেন?
তিনি কয়েকজনের বিভীষিকাময় জীবনের গল্প করে তাঁদের ফোন নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ঢাকা থিয়েটারের একদল তরুণ গবেষক আমাদের কাজে সহায়তা করেন।
আসুন, মহাকাব্যের মতো বিশাল এই মুক্তিযুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার স্পর্শ নিই আমরা।
২.
কুয়াশায় ঢাকা ভোরে আজ স্বাধীনতা নিয়ে কথা হবে।
একদিন এই দেশে মুক্তি এসেছিল, প্রাণে প্রাণে ডানা মেলে পাওয়া গেল আকাশের সীমা। বীরের এ রক্তস্রোতে, মাতার এ অশ্রুধারায় লেখা হয়ে গেল ইতিহাস। এখন আসুন, সেই দিনটিকে স্পর্শ করা যাক।
বাঙালির নাকি কোনো মহাকাব্য নাই! বায়ান্ন-একাত্তর মিলেমিশে তৈরি করে মহাকাব্য, সে কথা কি আমাদের কারও জানা নাই? একাত্তরের সেই ভয়াল দিনগুলোয় কত কিছু ঘটে গেল; আসুন, আজ তার সঙ্গে একাত্ম হই। এ কথা বলতে পারে তারাই, মৃত্যু যাকে ছুঁয়ে গেছে, মারতে পারেনি। এ কথা শুনতে হবে তাদেরই মুখ থেকে, যাদের ত্যাগের ঋণ শোধ করা হয়নি এখনো।
চলুন, সবাই মিলে খুলনার চুকনগরের কাছে যাই। হাজার হাজার লোক গাঢ় হয়ে বসেছে সেখানে। সীমান্ত পার হয়ে মুক্তির খোঁজে তারা উন্মুখ-ব্যাকুল। অথচ হঠাত্ করে শোনা যায় ট্রাকের চিত্কার। সকাল ১০টার দিকে দুই ট্রাক পাকিস্তানি সেনা এসে অস্ত্র তাক করে। তারপর শুধু গুলি, পাখির মতো টুপটাপ একে একে ঝরে যায় হাজারটা দেহ। এরশাদ আলী মোড়ল নামের একজন লুকিয়ে ছিলেন। দেখেছেন, তাঁর বাবা একটু আগেই চলে গেল। পিতার মৃত্যুশোক বুকে বেঁধে নিথর এরশাদ শুধু হাহাকার করেন। দেড় ঘণ্টা ধরে চলে মানুষ নিধন। এদের বেশির ভাগ সনাতন ধর্মের লোক, হিন্দু বলেই যেন পাকিস্তানিরা আজ আক্রোশে লাল। ২০ মে একাত্তর চুকনগরকে যেন করে দিল রক্তস্রোতে দিকহারা নদী।
দেড় ঘণ্টা ধরে অবিরাম গুলিবর্ষণ শেষে একসময় স্তব্ধ হয় চারদিক। মাঠজুড়ে লাশ আর লাশ। এরশাদ আলী এগিয়ে যান মৃত্যুকূপের দিকে। হঠাত্ একটি দৃশ্যে চমকে ওঠেন। ফুটফুটে এক শিশু নিহত মায়ের বুকে মিশে আছে, করছে স্তন্যপান। বেদনায় ভরে যায় এরশাদের মন। শিশুটিকে কোলে নিয়ে এরশাদ খুঁজে ফেরে শিশুর ঠিকানা। মায়ের সিঁথিতে ছিল গাঢ় লাল রঙের সিঁদুর। এ মেয়েকে বাঁচাতে হবে। কী করে বাঁচবে এই অমল শিশুটি? বাড়ির কাছেই এক হিন্দু ঘরে রাখা হলো এই শিশুটিকে। এরশাদ আলীই করেন তার ভরণ-পোষণ। শিশুটির নাম দেন ‘সুন্দরী’। বাবা-মাকে হারিয়েও এই শিশু ফিরে পায় আপন শৈশব। ‘সুন্দরী’ বলেই তাকে ডাকে পাড়ার সবাই। মুক্তিযুদ্ধ ঘটিয়ে দিল আত্মীয়তার মেলবন্ধন।
৩.
আগস্টের আট তারিখটি কখনোই ভুলতে পারবেন না চাঁদপুরের রামপুর ইউনিয়নের আবদুর রশীদ মিয়াজী। বাজারে দোকান ছিল তাঁর। সেদিন যে যার মতো দোকানে বসেছে। কাজ শুরু হয়েছে কেবল। এমন সময় ৬০-৭০ জন রাজাকার এসে বাজারের সব লোক ধরে, জড়ো করে মক্তবের দিয়ে নিয়ে গেল। বাজারের দোকানগুলোতে দিল আগুন। দাউ দাউ আগুনে দোকানগুলো পুড়ে ছাই, সঙ্গে হূদয়ও। এই ক্ষতি কি কাটিয়ে ওঠা যাবে? পরক্ষণেই রশীদ মিয়াজীর মনে হয়, নিজেই তো বাঁচব না, দোকান বাঁচল কি না সে প্রশ্নে কার কী এসে যায়!
রাজাকারদের চোখে-মুখে তখন খুনের নেশা। মোট আঠারজন মানুষকে দাঁড় করানো হলো এক সারিতে। দাঁড়ানো মানুষগুলোকে একের পর এক গুলি করা হলো। রশীদ ছিলেন সতের নম্বরে। লাঠির কয়েকটা বাড়ি আগেই পড়েছিল শরীরে। ব্যথায় বসে পড়েছিলেন। যখন গুলি ছুটে এল, তখন দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। তাই গুলি লাগল দুই পায়ে। পড়ে গেলেন রশীদ। পরের গুলিটি শেষজনের শরীর ভেদ করে বেরিয়ে গেল। রক্তে লাল মাটি। দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ রশীদ পড়ে রইলেন সেখানে। সবার মৃত্যু নিশ্চিত জেনে রাজাকারেরা ততক্ষণে চলে গেছে দূরে। এরপর আত্মীয়রা এসে লাশগুলো বুঝে নিয়ে গেল। বেঁচে ছিল মাত্র দুজন। মকবুল হোসেন এই ঘটনার দুই বছর পর মারা গেলে ছোট সুন্দর বাজার গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ বলতে থেকে যান একজনই—আবদুর রশীদ মিয়াজী।
৪.
‘হ্যালো, সূর্য বেগম বলছেন?’
‘হ্যাঁ। আপনি কি সিরাজগঞ্জে এসেছেন?’
‘না, মা। ঢাকা থেকেই আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
বলেন।
আপনি কি সেই দিনটির কথা একটু বলবেন?
এইখানে তো অনেক মানুষ। সব কথা কি সব জায়গায় বলা যায়?
তারপর নিজের মনেই বলেন, ‘তারিখ-টারিখ তো আমার মনে নাই। আমার তখন যুব বয়স। বোধহয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাস দুই পরের কথা। সিরাজগঞ্জ মহিলা কলেজপাড়ায় তখন আমরা। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাড়ির দিকে যেই রাস্তা চলে গেছে, তারই এক পাশে রাস্তার ধারে ছিল আমাদের বাড়ি। বাড়িতে যখন পাকিস্তানি সেনারা এল, আমরা সবাই লাফ দিলাম পুকুরে। কচুরিপানার মধ্যে পালায় ছিলাম। ২০-৩০ জন পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে গেল। যে রাজাকারেরা ছিল, তারা বলল, কিছুই হবে না, তোমরা বাড়িতেই থাক। এরপর তারা যখন ফিরল, তখন আমরা বাড়িতেই ছিলাম। ওরা যখন চলে যাচ্ছে, তখন ছয়জন পাকিস্তানি সেনা বাড়ির সামনে দাঁড়ায়ে পেচ্ছাব করছিল। জানালা দিয়া দেখলাম।’
‘বাড়িতে আর কে ছিল?’
‘আব্বা, আম্মা, বড় বোন ছিল, ভাই ছিল।’
‘তারপর কী হলো?’
‘দেখি, নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে ওরা আমাদের বাড়ির দিকে আসতেছে। বুটের মচমচ শব্দ কইরে আসতেছে। আমার মায়ের কোলে একটা বাচ্চা ছিল, মা তাড়াতাড়ি ওরে দিয়ে দিল বড় বোনের কোলে। কিন্তু পাকিস্তানিরা বলল, বাচ্চাটারে মায়ের কোলে দাও। বোন তো দেয় না। একটা ঘরে ছিলাম আমরা। বাচ্চাটাকে মা-ও নেয় না। তখন মাকে বন্দুক দিয়ে ধাক্কা মারল। মা পড়ে গেল। আমরা দুই বোন তখন একটা ঘরে। পাকিস্তানিরা ঢুকতে চাইল। বাবা আইসে দরজার সামনে দাঁড়াল। বাবাকেও রাইফেলের গুঁতো দিয়ে ফেলে দিল। এরপর ভাই দাঁড়াল। ভাই আমার স্বাস্থ্যবান ভাই। কিন্তু ও কী করবে! পাকিস্তানিদের হাতে রাইফেল। ওর হাতে তো কিছু নাই। ওরেও ফেলে দিয়ে ঢুকল আমাদের ঘরে।’
‘মা, ওরা চলে যাওয়ার পর কি আবার এসেছিল?’
‘না। ওরা চইলে যাওয়ার পর গ্রামবাসী আগায় আসল। আমার বোনটা বাইরে আইসে ভাইটারে ধইরে মারতে লাগল! তখন ওর মনের অবস্থা কেমন ছিল, বুঝতে চান না কেন?’
‘আর কিছু বলবেন?
‘হ্যাঁ। বলব। সে সময় গাছে ছিল ছোট ছোট আম। আমরা আম পাইড়ে খেতাম।’
এরপর আরও কিছুক্ষণ ফোন থাকে হাতে, কিন্তু সূর্য বেগম আর কিছু বলেন না।
৫.
তিনটি গুলি ছুটে এল ফারুকুল ইসলামের দিকে। একটিও তার শরীর ভেদ করল না।
এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আশপাশে যাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়েছে, তাদের কেউ বাঁচেনি। ফারুক দেখেছে, ওর ভাই নাসিরুদ্দীনের পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে গুলি। বেরিয়ে এসেছে ভুঁড়ি। রক্তের দিঘিতে ভাসছে ফারুক। নাসিরুদ্দীন তখনো মরেননি। বললেন, ফারুক, তুই আছস?
হ্যাঁ।
তোর গায়ে গুলি লাগে নাই।
না।
লাগছে। তুই ভালো কইরা দ্যাখ। তোর শরীরে তো রক্ত।
গুলি করার পর যারা একটু নড়াচড়া করছিল, তাদের ওপর বেয়নেট চার্জ করে ততক্ষণে জেলখানার মহিলা ওয়ার্ডের দিকে চলে গেছে পাকিস্তানিরা। ফারুক নিজ হাতে ভাইয়ের পেটে ঢুকিয়ে দেয় ভুঁড়ি। ভাই বলে, কাজ হবে না। তোরে হয়তো আল্লায় ফিরাইয়া দেতে পারে। একটু পানি দিবি?
ফারুক চারদিকে তাকায়। পানি কোথায়? বারুদ আর রক্তের গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়াই দুষ্কর। সেখানে পানি! ফারুক ভাইয়ের মুখে পানি দিতে পারে না। নাসির বলে, ঠিক আছে। লাগবে না। আমি আর শ্বাস নিতে পারতাছি না। মায়েরে দেইখ্যা রাখবি।
এ সময় রাজাকারেরা এল। ওরাও পরিচিত, একজন বলল, তুমি এহনো বাইচ্যা আছো? তোমার গুলি লাগে নাই?
ওরা পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের কাছে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা জানায়। পাকিস্তানিরা দৌড়ে এসে ওকে ঘিরে দাঁড়ায়। যেন ওরা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে সাপখেলা দেখছে। যে লোকটির হাতে টমিগান ছিল, সেই পাকিস্তানি ইকবাল বলে, ওঠ।
ফারুক উঠতে পারে না। জমাটবাঁধা রক্তে আটকে গেছে সে।
ওরা ফারুককে নিয়ে এল জেলখানার ওয়ার্ডে। গোসল করালো। বিস্কুট খেতে দিল। রাতে পাকিস্তানিরা মদ খেল। মহিলা ওয়ার্ড থেকে মেয়েদের নিয়ে গেল ফুর্তি করার জন্য।
পরদিন ১৭ জন হিন্দু তরুণকে গুলি করে মারল ওরা।
ফারুক ক্যাপ্টেনকে বলল, স্যার, আমার দুই ভাইরে মারিয়া ফ্যালছেন। মায়ের কাছে থাকতে দ্যান আমারে। আমারে মারিয়েন না।
ক্যাপ্টেন কিছু বলার আগেই ইকবাল বলে, ওকে বাঁচিয়ে রাখলে আমাকে মেরে ফেলুন।
বিহারি ওসি আনোয়ার বলে, ওকে বাঁচিয়ে রাখলে পরে ও আমাকেই মেরে ফেলবে।
সুতরাং আবার ওকে দাঁড় করানো হলো টমিগানের সামনে। লক্ষ্যভেদ করার জন্য ওকে বসানো হলো দেয়ালের সামনে। এরপর গুলি। প্রথম গুলিটি চলে গেল কানের বাঁ পাশ দিয়ে।
ক্যাপ্টেনের চিত্কার: এগেইন শুট!
এবার গুলিটা বেরিয়ে গেল মাথার ডান পাশ দিয়ে।
সবাই তাজ্জব হয়ে ফারুককে দেখতে লাগল। ক্যাপ্টেন বললেন, তোমহারা পাস তবজ হ্যায়?
তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো ওর শরীর। না কোনো কবজ নেই।
ধরা পড়ার ২৮ দিন পর ফারুকের মা এসডিওকে ধরাধরি করে ছাড়িয়ে আনেন ফারুককে।
এই স্মৃতি ফারুক ভুলতে পারে না।
ফারুকুল ইসলাম এলাকায় পরিচিত ফারুক ভেন্ডার নামে। একাত্তরের ২১ মে তিনি তার দুই ভাই নাসিরুদ্দীন ও মোশাররফ হোসেন শানুসহ গিয়েছিলেন বরগুনার ওয়ারলেস অফিসে। সঙ্গে ছিলেন ওহিদুল ইসলাম পান্না আর গিয়াসুদ্দীন। পটুয়াখালীতে তখন পাকিস্তানি মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী এসেছে। তাদের সঙ্গে ওয়ারলেস সংযোগ যেন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করতেই ওরা গিয়েছিল ওয়ারলেস অফিসে। সেখানেই ধরা পড়ে দুই ভাইকে হারান ফারুক। হিন্দু সম্প্রদায়ের শত শত নাগরিক গণহত্যার শিকার হয়।
৬.
আফরোজা নার্গিস তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়েন। যশোরে পুলিশ বিভাগের ডিএসপি ছিলেন ওঁর বাবা। ২৫ মার্চ রাতে প্রচণ্ড গোলাগুলি। ২৬-২৭ তারিখেও পাকিস্তানি বাহিনী ছিল রাস্তায়। এরপর ওরা ঢুকে যায় সেনানিবাসে। নার্গিসদের বাড়ি ছিল জেলখানা থেকে ৩০০ গজের মধ্যে। ওরা বাড়ির জানালা দিয়ে দেখল দলে দলে মানুষ যশোর ছেড়ে যাচ্ছে। ৩০ মার্চ দুপুর তিনটায় জেলখানায় বেজে উঠল পাগলাঘণ্টি। তখন প্রায় ৩০ হাজার বন্দী ছিল এখানে। তখন বন্দীরা জেলখানায় দেওয়া খাবার ফেলে একসঙ্গে বেরিয়ে এল। আক্ষরিক অর্থেই ওদের পদভারে প্রকম্পিত হচ্ছিল যশোর শহরের রাস্তাগুলো।
১ এপ্রিল যশোর শহর খাঁ খাঁ করছে। তখন এসপি ছিলেন ড. এনামুল হক (পরে আইজি)। পাকিস্তান থেকে সদ্য বদলি হয়ে এসেছেন। তাঁরা সবাই মিলে ঠিক করলেন, একত্রে থাকতে হবে। জেলখানা যেহেতু খালি, সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হলো। ১ এপ্রিল দুপুরের পর সবাই জেলখানায় এলেন। নার্গিসের বাবা বললেন, মরলে নিজের বাড়িতেই মরব। তাই আবার তাঁরা ফিরে এলেন বাড়িতে।
৪ এপ্রিল পর্যন্ত গোলাগুলি চলছিল। দড়াটানার ওপাশে বইয়ের দোকানগুলো ছিল বাঁশের। সেগুলো পুড়িয়ে দিল হানাদার বাহিনী। চারদিকে শুধু আগুন। এরপর শুনুন নার্গিসের বয়ানে: ‘আমরা শুধু আগুন দেখতে পাচ্ছি। গোলাগুলি। বাবাসহ সবাই ছিলাম খাটের নিচে। খাওয়াদাওয়া কিচ্ছু করিনি। ভয়ে সারা রাত জেগে ছিলাম। এ সময় বুটের আওয়াজ। সেনাবাহিনীর লোকজন পরদিন খুব ভোরে দরজায় লাথি মারতে লাগল। আটটার দিকে দরজা ভেঙে ওরা ঢুকে পড়ল বাড়িতে। ওরা প্রথমে আবার আব্বা, বড় ও ছোট ভাইটাকে নিয়ে গেল। আমাদের দুই বোনকে কিছু বলল না। ঘণ্টা দুই পর ওরা আবার এল। যত্রতত্র গুলি করল। সেই গুলি এখনো রেখে দিয়েছি। টাকা-পয়সা যা ছিল, নিয়ে গেল। এরপর বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ওরা আবার আমাদের বাড়ি এসে সবাইকে নিয়ে গেল জেলখানায়। রাস্তা দিয়ে চলেছি, পথে অগুনতি লাশ। ক্রসফায়ারের মধ্যেই আমরা দৌড়ে চলেছি। মাথার উপর দিয়ে ঝাঁ ঝাঁ করে গুলি চলে যাচ্ছে। একসময় জেলখানার সামনে পৌঁছালাম। তরুণদের সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের বসতে দিয়েছে জেলার সাহেবের বাড়ির বারান্দায়। আব্বা, এসপি ও ডিসি সাহেবকে ধরে নিয়ে গেল সেনানিবাসে। আর যে কর্মকর্তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁদের হত্যা করেছে। জেলখানায় তরুণদের হত্যা করল ওরা। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণদের দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করতে লাগল। ১৫ দিন ধরে এই বিভীষিকা দেখলাম। ২০ এপ্রিল আমাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। সেই সময়ের কথা মনে হলে এখনো ঘুমাতে পারি না। পথে লাশের দুর্গন্ধে জীবনকে মনে হতো বৈচিত্র্যহীন।
৭.
এভাবেই ছোট ছোট এক এক ঘটনায় রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এভাবেই ছোট ছোট একেক ঘটনায় বাংলার সবুজ মাঠে চলেছে রক্তের উত্সব। যুদ্ধের বিভীষিকা কেটে গেছে, কিন্তু নিয়তই চলতে থাকে রক্তক্ষরণ।
জাহীদ রেজা নূর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১২, ২০০৯
Leave a Reply