রাজনীতিকেরা সত্যকে ভয় পান বলেই সম্ভবত কিছু লিখে রেখে যেতে চান না। গত ৫০-৬০ বছরে এ দেশে অনেক নামকরা রাজনীতিকের আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখেছেন হাতেগোনা কয়েকজন। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন। আতাউর রহমান খান লিখেছেন। অলি আহাদ লিখেছেন। ইকবাল আনসারী খান লিখেছেন। বামপন্থী রাজনীতিকদের মধ্যে কমরেড মণি সিং, বদরুদ্দীন উমর, অমল সেন লিখেছেন। শরদিন্দু দস্তিদার লিখেছেন। সেসব আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথায় ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের চেয়ে তাঁর সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোড়ন-বিলোড়নই বেশি উঠে এসেছে।
এ কালের রাজনীতিকদের মধ্যে লেখালেখির অভ্যাস একেবারেই কম। তাঁরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে কথার তুবড়ি ছোটান। কলম হাতে নিলেই বিপদ। সেদিক থেকে মওদুদ আহমদকে ব্যতিক্রম বলতে হবে। তিনি খ্যাতনামা আইনজীবী ও প্রতিষ্ঠালব্ধ রাজনীতিক। দেশের উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। দল ক্ষমতায় এলে হয়তো আরও বড় কোনো পদে অধিষ্ঠিত হবেন। তবে মওদুদ আহমদের আরেকটি গুণ হলো, তিনি একই সঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকও। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই বাংলাদেশ: এরা অব শেখ মুজিবর রহমান; বাংলাদেশ: কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অ্যাটোনমি; ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট; সাউথ এশিয়া: ক্রাইসিস অব ডেভেলপমেন্ট। ইংরেজিতে লেখা এসব বই বাংলায়ও অনূদিত এবং পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে।
মওদুদ আহমদের উল্লিখিত বইগুলো পাঠকপ্রিয় না হওয়ার কারণ নির্মোহ ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। নিজ দলের ও নেতার বিরুদ্ধে গেলেও সত্য বলতে দ্বিধা করেননি। শেখ মুজিবের শাসনকাল বইয়ে তিনি আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবের কঠোর সমালোচনা করেছেন, তাঁদের শ্রেণী-চরিত্রের দোদুল্যমানতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। সেই প্রশ্নটি বোধকরি মওদুদ আহমদকে করাও অন্যায় হবে না। তবে একটি কথা অকপটে স্বীকার করেছেন তা হলো, শেখ মুজিবই স্বাধীনতার নেতা, তিনি না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। অনেক সময় মওদুদ আহমদের লেখার সঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্বাস মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি একাধিক সামরিক শাসকের অধীনে মন্ত্রিত্ব করেছেন, তাঁদের তথাকথিত গণতান্ত্রিকব্যবস্থার জোরালো সমর্থক ছিলেন। তার পরও তিনি এ কথা বলতে দ্বিধা করেননি যে কোনো সামরিক একনায়কই স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেন না, ন্যায়সংগত বিরোধিতাও সহ্য করেন না।
মওদুদ আহমদের সাম্প্রতিক বই চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময়, কিছু কথা ১৯৮৩—১৯৯০। এটি পুরোপুরি স্মৃতিকথা নয়। খণ্ডিত স্মৃতিকথা, খণ্ডিত বিশ্লেষণ। এ ধরনের বইয়ের সমস্যা হলো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় না, মওদুদ আহমদও পারেননি। তিনি যখন কারাগারে আটক কয়েদিদের দুর্দশার কথা বলেন, যখন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের আনন্দ ও বেদনার ছবি আঁকেন তখন তাঁকে খুবই আন্তরিক মনে হয়। কখনো তাঁর কলমে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বিদেশভ্রমণ কিংবা বন্ধুদের সাহচার্যের বিষয়াদিতে। এমনকি মওদুদ আহমদ প্রতিবন্ধী শিশুপুত্র আসিফের কষ্টের যে বর্ণনা দেন, তা পাঠককেও নাড়া দেয়। কিন্তু স্মৃতিকথা রেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে গেলেই কোথায় যেন খটকা লাগে। মনে হয়, তিনি যা বলতে চেয়েছেন তার সবটা বলেননি। মওদুদ আহমদের লেখায়ই আমরা জানতে পারি বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভা থেকে তাঁকে অত্যন্ত অবমাননাকরভাবে বিদায় নিতে হয়েছিল। তিনি সরাসরি না বললেও আভাস-ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছেন, নেপালের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা এবং ভারত তাঁর প্রতি বিরাগভাজন ছিল বলেই তাঁকে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে। তাঁর এই বিবৃতিতে দোষের কিছু নেই। এটি তাঁর পর্যবেক্ষণ। কিন্তু একই সঙ্গে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তুলে ধরা কতটা সমীচীন তা এ বইয়ের পাঠকেরাই ভেবে দেখবেন।
মওদুদ আহমদের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য স্ববিরোধিতা আছে। ১৯৭৪ সালে যে রাজনীতিক নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় সিভিল রাইটস মুভমেন্ট করে কারাগারে যান, তিনি কীভাবে সামরিক শাসনের মধ্যে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ খুঁজে পান। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে মওদুদ আহমদ ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এরপর মহলবিশেষের গভীর ষড়যন্ত্রের কারণে দল থেকে বহিষ্কার হন, এ যুক্তি মেনে নিলেও এরশাদের মন্ত্রিসভায় তাঁর যোগদান সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। দুই সামরিক শাসকের চরিত্র বিশ্লেষণেও মওদুদের কোথায় যেন আড়ষ্ঠতা। একই ধরনের কাজ করে একজন সাচ্চা গণতন্ত্রী হয়ে যান, অপর জন স্বৈরশাসক।
মওদুদ আহমদের চলমান ইতিহাস বিন্যস্ত হয়েছে ৩০টি অধ্যায়ে। এতে তাঁর শৈশব-কৈশোর, ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, লন্ডনে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলন, যুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহও আছে। অন্তত মওদুদ আহমদ নিজে যেসব ঘটনায় সংযুক্ত ছিলেন তার কিছুই বাদ দেননি।
কি আইনজীবী হিসেবে কি রাজনীতিক হিসেবে মওদুদ আহমদ সব সময় ক্ষমতার কেন্দ্রের অত্যন্ত কাছে থেকেছেন এবং এখনো আছেন। তাঁর সময়কার রাজনৈতিক কুশীলবেরা এখনো বেঁচে আছেন। সে কারণে তিনি সব সত্য বলতে পারেননি। তাঁর নিজেরই স্বীকারোক্তি, ‘পুরোপুরিভাবে যেসব বর্ণনা দিতে পেরেছি বা সব কিছুই যে লিখতে পেরেছি তাও নয়। যা মনে এসেছে বা প্রাসঙ্গিক মনে করেছি সেটারই স্মৃতিচারণ করেছি।’
কিন্তু চলমান ইতিহাস তো খণ্ডিত সত্য দিয়ে হয় না। সময়ের ভালো-মন্দ দুটো মিলেই ইতিহাস। সময়ের বিশ্লেষক হিসেবে মওদুদ আহমদের দায়িত্ব ছিল সবটাই তুলে ধরা, ভবিষ্যতের গবেষকেরাই ইতিহাস ঝাড়াই-বাছাই করবেন। আগের বইগুলোর নিরপেক্ষ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ এখানে অনেকটাই অনুপস্থিত।
তা সত্ত্বেও দুই দশকের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি জানতে-বুঝতে চলমান ইতিহাস সহায়ক হবে।
চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৮৩-১৯৯০—মওদুদ আহমদ; ইউপিএল, ঢাকা, ২০০৯; ৫৩৪ পৃষ্ঠা, ৪৮০ টাকা।
সোহরাব হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১১, ২০০৯
Leave a Reply