অবেলার দিনক্ষণ—সেলিনা হোসেন \ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ \ অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ১৭৫ টাকা।
‘স্বীকার করি যে, শারীরিক দুর্ব্বলতাবশতঃ নারীজাতি অপর জাতির সাহায্যে নির্ভর করে। তাই বলিয়া পুরুষ ‘‘প্রভু’’ হইতে পারে না।’— বেগম রোকেয়া
সেলিনা হোসেনের অবেলার দিনক্ষণ এগারোটি গল্পের সংকলন। ব্যক্তিসংকটের আড়ালে সেলিনা হোসেন নারীকে গড়েন সম-অধিকারে; ‘অবেলার দিনক্ষণে’র মাজেদা, রাশেদা, মুনিরা কিংবা রুকি, কুকি তাদের অবস্থানে স্বতন্ত্র। স্বনির্ভরতা না থাকা এবং সন্তানের দায়বদ্ধতা মাজেদাকে প্রতিবাদী করতে পারে না। কিন্তু সন্তানের স্বনির্ভর হওয়ার পরই সে বিদ্রোহ করে। প্রথমে বিছানা আলাদা করে, পরে পরিত্যাগ করে জীবনে। দাম্পত্যের দ্বৈরথের সমঝোতায় অবিশ্বাসী মিনহাজউদ্দিনের দুটি দাম্পত্য তাই পর্যবসিত হয় সময়ের দোলাচলে।
অবেলার দিনক্ষণের বৈপরীত্যে নিজের মানসিক দৈন্য অন্বেষণে মিনহাজউদ্দিনের বিপরীতে দাঁড় করানো যায় আলিমকে। অশিক্ষিত মূর্খ আলিমের সাম্যবোধ পাঠককে নাড়া দেয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রায় দুই দশক পার করলেও নিম্নবিত্তের জীবনে আসেনি কোনো আমূল পরিবর্তন। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেসরকারীকরণ, উন্নয়নের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবলুপ্তি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাটশিল্পের অবনমনের জন্য দায়ী সরকার, কেননা পাটশিল্পের আধুনিকায়ন না করে, নতুন বাজার তৈরি না করে তা বন্ধ করে শত-সহস্র মানুষের জীবিকা ও দায়ভারকে অস্বীকার করা একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। ‘লঙ্গরখানা’র নূর আলীরা তাদের প্রাপ্য বেতন পায় না, পাটকল বন্ধ হলে পায় না নতুন কোনো কাজ। পুরো পরিবার নিয়ে সময়ের অচলায়তনে থাকা মানুষেরা রক্তমাংসে উঠে আসে লঙ্গরখানায়।
অবাধ গাছ কাটা, জৈব যৌগের ব্যবহার, নগরায়ণের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে এবং এ কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের নিত্যনৈমিত্যিক সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। খরা-বন্যা-সামুদ্রিক ঝড় প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষের জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। সাম্প্রতিককালে সিডরের আঘাতে উপকূলবর্তী প্রায় সবকটি জেলা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। উত্তপ্ত জলে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের সহায়-সম্বল। লাশের মিছিল পড়ে থাকে ধানক্ষেতে। ‘মৃত্যু’ গল্পের সগীর সিডরের আঘাত থেকে অচল মাকে বাঁচাতে ঘরের খুঁটি-চাটাইয়ের সঙ্গে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়। কিন্তু সিডরের কড়াল আঘাতে মা-স্ত্রী-সন্তান হারানো সগীর ছুটতে থাকে অজানার পথে।
নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত ‘অচেনা’ গল্পটি। পুরান ঢাকার নার্গিস জাহান স্মৃতিময় বাড়িটিতে তার জীবনের চরম স্বস্তি খুঁজে পায়। কিন্তু কসমোপলিটন ঢাকার আকাশমুখী অট্টালিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সন্তানের উচ্চাশা বাড়ে; সময়ের আবর্তনে তারা মাকে ছাড়তে বাধ্য হয়। নাগরিক ব্যস্ততায় ক্রমশ বিচ্ছিন্ন মানুষের কথকথায় ঋদ্ধ ‘অচেনা’ গল্পটি।
আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-ভৌগোলিক ইতিহাস প্রায় চার দশকের; কিন্তু সুদীর্ঘ সময় পার করলেও যুদ্ধাপরাধের অদ্যাবধি বিচার হয়নি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ পায়নি রাষ্ট্রের সম্মান, কিংবা প্রদেয় সুযোগ-সুবিধা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিরা এখন মহাশক্তিধর হয়ে উঠছে। শাসনযন্ত্রে থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন, যোগাযোগমাধ্যম। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন থেমে নেই। ‘মা-মেয়ের যুদ্ধ’ ও ‘কেঁদোনা’ গল্প এই প্রেক্ষাপট প্রসূত গল্প। ‘কেঁদোনা’ গল্পের চেয়ারম্যানের ঔদ্ধত্যে বিস্ময় প্রকাশ করে না মানিক। তেমনি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ব্যবহার করে রাজাকারের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তি হয় এবং দাপটের সঙ্গে এই চরম সত্য প্রকাশও করে। কিন্তু মানিকের মতো আমরাও প্রতিবাদ করতে পারি না। কেননা আমরা সবাই ক্রমশ সত্য থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না; অবক্ষয়ের এই কালকেই কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন অবেলার দিনক্ষণ-এ উপস্থাপন করেছেন।
রাহেল রাজিব
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১১, ২০০৯
Leave a Reply