ফিলাটেলি-ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ—মোমিনুল আজম \ প্রকাশক: মাহমুদা
আনোয়ার, ঢাকা \ নভেম্বর ২০০৮ \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ১৬৮ পৃষ্ঠা \ ১৭৫ টাকা
ডাকটিকিট আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৮৪০ সালে। তার অনেক আগে থেকেই অবশ্য ডাক ব্যবস্থা চালু ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে ডাক ব্যবস্থা প্রবর্তন হয় মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে (১৩২৫-১৩৫১)। ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতেও ভারতীয় ডাক হরকরাদের কর্মতত্পরতার বিবরণ পাওয়া যায়। পরে সম্রাট শেরশাহ ভারতবর্ষে ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন (কৌতুক প্রচলিত আছে কোনো এক ছাত্র নাকি পরীক্ষার খাতায় লিখেছিল—শের শাহের শাসনের আগে ভারতবর্ষে ঘোড়া ডাকত না!)। শের শাহ সোনারগাঁ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত যে দুই হাজার মাইল দীর্ঘ ‘গ্রান্ড ট্রাংক রোড’ তৈরি করেছিলেন, তা মূলত ডাক চলাচলের জন্যই।
ডাকটিকিটের জন্মের পর থেকেই ফিলাটেলির কর্মকাণ্ড শুরু হয়, যদিও তার দুই যুগ পর ১৮৬৪ সালে ‘ফিলাটেলি’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি ডাকটিকিট সংগ্রাহক জর্জ হার্পিন। কালের পরিক্রমায় ফিলাটেলি বলতে এখন কেবল ডাকটিকিট জমানোকেই বুঝায় না, বরং অন্যান্য ডাকসামগ্রী সংগ্রহ এবং এ সম্পর্কিত বিষয়ে গবেষণাকেও বোঝায়।
তাই দেখা যাচ্ছে, ডাকটিকিট শুধু জমিয়ে রাখলেই হবে না। প্রতিটি ডাকটিকিটের ধরন ও বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করতে হবে। টিকিটের নকশাটি কার করা, কোন ধরনের কাগজে ছাপা, গাম, ছিদ্রক দূরত্ব, কোন প্রিন্টার থেকে ছাপা, কতটি রঙে ছাপা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে হবে।
যেমন: ২০০৮ সালের এপ্রিলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের চারটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এ টিকিট সংগ্রহ করার পর জানতে হবে—সুন্দরবনকে কেন বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করা হলো, এর বিশেষত্ব কী, আয়তন কত, মূল সম্পদ কী, এ বনের কতটুকু বাংলাদেশে আর কত অংশ ভারতে পড়েছে—ইত্যাদি। এ সম্পর্কিত জ্ঞানভাণ্ডার যারা সমৃদ্ধ করতে চান অর্থাত্ বেশি বেশি তথ্য জানার চেষ্টা করেন তারাই আসলে ফিলাটেলিস্ট। বিদেশী টিকিট হলে সেই দেশটি কোথায়, রাজধানী কি, কবে স্বাধীন হলো, ভূ-প্রকৃতি কেমন ইত্যাদি বিষয়ে জানতে হবে।
অনেকে আবার বিষয়ভিত্তিক ডাকটিকিট সংগ্রহের ওপর জোর দেন। কেউ শুধু ফুল বা পাখি, কেউ যানবাহন, কেউ খেলাবিষয়ক ডাকটিকিট জমান। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ১০ বছর বয়স থেকে ডাকটিকিট জমানো শুরু করেন। তিনি শুধু হংকংয়ের ডাকটিকিট জমাতেন। কারণ সে দেশে থাকা তাঁর এক ফুপু যে চিঠি লিখতেন সেখান থেকেই টিকিট জমানোর প্রতি আগ্রহ জন্মে রুজভেল্টের। কথিত আছে, মিসরের সাবেক রাজা ফারুক তাঁর ডাকটিকিটের সংগ্রহ সমৃদ্ধ করার জন্য ডাক প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে ভুলে ভরা ডাকটিকিট ছাপিয়ে নিতেন।
ব্রিটিশ রাজপরিবারেও ডাকটিকিটের সমৃদ্ধ সংগ্রহ আছে। রাজা পঞ্চম জর্জের ডাকটিকিট সংরক্ষণের জন্য ৩২৮টি অ্যালবাম লেগেছিল, প্রতি অ্যালবামে ছিল ৬০টি করে পাতা। তাঁর অ্যালবামগুলো লাল রঙের ছিল বলে এ সংগ্রহ বিখ্যাত হয়ে আছে ‘রেড কালেকশন’ নামে। তারপর রাজা ষষ্ঠ জর্জ ব্লু অ্যালবামে এবং রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ গ্রিন অ্যালবামে টিকিট জমান। ডাকটিকিট সংরক্ষণের জন্য বাকিংহাম প্যালেসে তো আলাদা কক্ষই বরাদ্দ রাখা হয়। রাজা পঞ্চম জর্জের চাচাতো বোনের স্বামী ছিলেন স্পেনের রাজা ত্রয়োদশ আলফানসো। সুতরাং তিনিও ডাকটিকিট জমানোর নেশায় বিখ্যাত হয়ে আছেন। ফিলাটেলিবিষয়ক জানা-অজানা বিচিত্র সব তথ্য আর এ সেক্টরের আদ্যোপান্ত নিয়ে মোমিনুল আজম বইটি লিখেছেন। তিনি নিজেও পেশাগত জীবনে ডাক বিভাগের কর্মকর্তা। সূচিপত্রের বিন্যাসে চোখ বুলালেই টের পাওয়া যায় লেখকের দায়িত্বশীলতা ও নিষ্ঠার নমুনা। ফিলাটেলির ক্রমবিকাশ, শ্রেণীবিভাগ থেকে শুরু করে ডাকটিকিট সংগ্রহের পদ্ধতি, ফিলাটেলির উন্নয়নে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন, ফিলাটেলির পরিভাষা, বাজারজাতকরণ, বাংলাদেশের ডাকটিকিট প্রসঙ্গ, বিশ্ববিখ্যাত কয়েকজন সংগ্রাহকের পরিচিতি…ইত্যাদি অনেক কিছুই তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। ফিলাটেলিকে যারা কাঠখোট্টা বিষয় বলে মনে করেন, প্রাঞ্জল ভাষায় লিখিত এ বইটি তারা পড়ে দেখতে পারেন। আশা করা যায়, তাদের ধারণা পাল্টে যাবে। বইটির বর্ণনা সুন্দর, অঙ্গসজ্জা চমত্কার। লেখক-প্রকাশক উভয়পক্ষই যথেষ্ট যত্নশীলতার ছাপ রেখেছেন।
আবু ঈশপ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১১, ২০০৯
Leave a Reply