আমরা তাঁকে ছাদেকুল নামেই চিনি। অবশ্য তাঁর অন্য কোনো নাম আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। ছাদেকুল, এই নামটা শুনলে পাড়ার ছোট-বড় অনেকের চোখেই ভেসে ওঠে ছয় ফুটের মতো লম্বা আর মাঝারি গড়নের একটা লোক, যে সকাল নয়টার দিকে পাড়ার শেষের বাড়িটা থেকে উধাও হয়, আর দুপুরের শেষে কারও সঙ্গে কোনো বাক্যব্যয় না করে কিছুটা দ্রুতপায়ে সিধা বাড়ি ফেরে।
সপ্তাহের সাতদিনই তাঁর একই রকম চাল-চলন। এর ফলে তাঁর পেশা কী, আদৌ তিনি কোন চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন কিনা, করলেও কী করেন, কোথায় করেন—এসব বিষয়ে আমাদের আগ্রহ জন্মে। অবশ্য মাসের ৩০ দিন তিনিও যখন একইভাবে আমাদের পাড়ার মোড়ে জটলা পাকাতে দেখেন, তখন তাঁর মনেও কী আমাদের সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে না! হয়তো জাগে, হয়তো জাগে না। তবে প্রথম যখন আমরা তাঁকে লক্ষ্য করতে শুরু করি, তখন আমাদের দলের অনেকেই বিএ ক্লাসের ছাত্র। আর আমরা তখন রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কক্ষবন্দী শিক্ষার পরিবর্তে খোলা হাওয়ায় আনন্দের সঙ্গে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে পাড়ার মোড়টাকে আবিষ্কার করি। পাশাপাশি আবিষ্কার করি ছাদেকুলকেও। পাড়ার রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় চলমান ঘটনাগুলোর প্রতি তার নির্লিপ্ততা দেখে দেখে অভ্যস্ত আমরা তাঁর প্রতি একসময় বেশ মনোযোগী হয়ে উঠি।
ছাদেকুলের সঠিক বয়স আমাদের জানা নেই। তবে আমরা ধারণা করি, বয়স ৪০ থেকে ৪২ হবে। কারণ মাটির দিকে তাকিয়েই তিনি পথ চলেন। আর আমরা তো জানি, চল্লিশোর্ধ্ব মানুষমাত্রই ধীরে ধীরে চোখ নামাতে শুরু করেন। মাঝবয়সী এই লোকটা কারও আগেও নেই, পিছেও নেই। কিন্তু আমরা প্রায়ই তাঁর পেছনে লেগে থাকি। তার নির্লিপ্ত চলাফেরা আমাদের কৌতূহল বাড়ালে আমরা পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর গতিবিধি লক্ষ্য করি। তাঁকে দেখেও না দেখার ছল করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। তিনিও বিষয়টি বুঝতে পারেন। আবার না-বোঝার ভান করে আপন গতিতে হেঁটে যান।
এই যে বুঝেও না বোঝার ছল করা, এটা আমাদের জন্য ছিল সুখকর। হয়তো বা তাঁর জন্যও। এতে করে আমরা নির্ভাবনায় একপক্ষ অন্যপক্ষের দৃষ্টিগ্রাহ্য হই। আর এই পদ্ধতির অনুসরণ দুপক্ষের জন্যই নিরাপদ। যেমন নিরাপদে থেকে শৈশবে একবার আমরা পাড়ার পুরোনো বাড়িটার পেছনে হারিয়ে যাওয়া ক্রিকেট বল খুঁজতে গিয়ে এক জোড়া কিশোর-কিশোরীর দেহঘটনার সাক্ষী হয়ে যাই। তখনো আমরা ওদের দেখেও না দেখার মতো বল নিয়ে চলে আসি। তারাও না দেখার ছলে তাদের কাজে মগ্ন থাকে। আমরা শুধু এই কথা বলাবলি করি, আমাদের কী, ওদের অনেক পাপ হবে। আমাদের মধ্যে দীপু ছিল পণ্ডিত ধাঁচের। ও কোনো কথা বললে আমরা তা ভেবে দেখার দরকার মনে করি না। তাই দীপু যখন বলল, তাহলে যাঁরা বিয়ে করে তাঁরা তো অনেক পাপ করে। আমরা তখন বুঝতে পারি কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ও যা বলে তার পেছনে অনেক যুক্তি থাকে এবং অতীতেও আমরা ওর জ্ঞানের পরিচয় পেয়েছি। যেমন—একবার দীপু আমাদের বলল, আচ্ছা বল তো পাখি কেন আকাশে ওড়ে? আমরা তো প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম। এত সাধারণ বিষয়টা কখনোই কেউ ভেবে দেখিনি। আসলে যাঁরা অসাধারণ তাঁরা সবসময় সাধারণ বিষয় নিয়েই চিন্তা করে। আমাদের বিজ্ঞানী নিউটনের কথা মনে পড়ে। নইলে তিনি কেন ভাবতে গেলেন, আপেল আকাশের দিকে না গিয়ে মাটিতেই কেন পড়ে। যাই হোক, সেদিন দীপুই আমাদের কাছে আকাশে পাখি ওড়ার বিষয়টি খোলাসা করে। বলে—শোন্, এই যে আকাশ, এর বিরাট এলাকা ফাঁকাই পড়ে থাকে। তাই তো পাখিরা আকাশের ফাঁকা জায়গাটা পূরণ করার জন্য আকাশে ডানা মেলে দেয়। আমরা ওর কথায় পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসি এবং পরবর্তী ১৫ বছর পর্যন্ত এই ধারণাই পোষণ করি, যাঁরা বিয়ে করে তাঁরা অনেক পাপ করে। কিন্তু আমাদের পাড়ার মাদ্রাসাপড়ুয়া সজীবকে তার বাবা কোন পাপ কাজ করার আগেই যখন বিয়ে দিয়ে দেয়, তখন আমরা বুঝতে পারি বিয়ের পর মানুষ পাপ করে না, করে পুণ্য।
ছাদেকুল লোকটা পাপ-পুণ্যের কোনটা করেন তা আমাদের অজানাই রয়ে যায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত। পরে অবশ্য আমরা জানতে পারি, তিনি অবিবাহিত এবং কয়েক বছর আগে ইহলোক ত্যাগ করা মা-ই ছিলেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তিনি নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন। তবে তাঁর বাসায় দুটো পরিবার ভাড়া থাকে। আর শুনি, ওই ভাড়াটেরাও পাড়ার কারও সঙ্গে ওঠবস করেন না। সম্ভবত ছাদেকুলের পাশাপাশি থেকে তাঁরাও নিরুত্তাপ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তা তাঁরা না হয় পারিবারিকভাবে বসবাস করেন আর নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালান। কিন্তু ছাদেকুল কথাবার্তা চালান কার সঙ্গে। অবশ্য রাস্তা দিয়ে তিনি যখন চলাফেরা করেন, তখন তাঁকে দেখে বেশ সুখী বলেই মনে হয়। কারণ, তাঁর চোখেমুখে সবসময় একটা হাসির রেখা ফুটে থাকে। তার সঙ্গে মেশানো থাকে খানিকটা কৌতুক, যেমনটা আমরা কবি জীবনানন্দের ছবিতে লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ছাদেকুল তো কবি নন। অবশ্য তিনি কবিতা-টবিতা লেখেন কিনা তাও আমরা জানি না।
সে যাই হোক, আমরা ভাবি, ছাদেকুলের কি কোনো দুঃখ নেই। আমরা তো শুনেছি এক মাস পাগলের কোনো দুঃখ থাকে না। সুখ-দুঃখের অনুভূতিসম্পন্ন মানুষই স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ছাদেকুলকে কেন আমাদের অস্বাভাবিক মনে হয়, তার কোন কূলকিনারা আমরা খুঁজে পাই না। যা পাই তা আমাদের পাড়ার মোড়কে, আমাদের সন্দেহের আবরণ থেকে বের করতে পারে না। ফলে আমরা এক দিন পাড়ার মোড় থেকে আরও কিছুটা অগ্রসর হয়ে ছাদেকুলের পেশা অথবা গন্তব্য সম্পর্কে অবগত হওয়ার আশায় তাঁর পিছু নিই এবং তাঁর গন্তব্য হিসেবে পাড়া থেকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরের শরেয়ারতল বাজারকে চিহ্নিত করি।
আমরা দেখি, বাজারের ভগ্নস্বাস্থ্য একটা চায়ের দোকানের মালিকের পাশে বসে কেবল দোকান মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই ছাদেকুল সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত কাটিয়ে দেন। তাঁদের মধ্যে কথা চালাচালি হয় কিছুটা নিচুস্বরে এবং থেমে থেমে। পরবর্তী কয়েকদিনও আমরা তাকে অনুসরণ করে বুঝতে পারি শুক্র থেকে বৃহস্পতি অর্থাত্ সপ্তাহের সাত দিনই তার গন্তব্যের স্থল শরেয়ারতল বাজারের সেই চায়ের দোকান। কিন্তু কেবল আড্ডা দিয়েই কি একটা লোক সারাটা জীবন পার করে দিতে পারে? আমাদের ভাবনা বাড়ে।
অনেকগুলো প্রশ্ন ফুলে-ফেঁপে তাড়িয়ে বেড়ায় আমাদের। সেই তাড়নায় এক দিন আমরা আমাদের এলাকায় ঘোরাফেরা করা পুলিশের গোপন বিভাগের লোক যাঁর সঙ্গে পাড়ার মোড়ে আড্ডা দেওয়ার সুবাদে বেশ ভাব হয়ে যায়, সেই আলী আকরামের সঙ্গে দেখা করে ছাদেকুলের জীবন যাপনের ফিরিস্তি টেনে, তাকে কেন্দ্র করে আমাদের নিত্যদিনের ভাবনা ও ব্যবহারিক কার্যক্রমের কথা উপস্থাপনের পর জানতে চাই, ছাদেকুল সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কিনা। তিনি আমাদের বলেন, ছাদেকুল সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণা নেই। তখন আমরা আলী আকরামের গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কেও সন্দিহান হয়ে পড়ি, যা তিনি আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন এবং একপর্যায়ে বলে ফেলেন, তোমরা কি ছাদেকুলের মতো আমাকেও সন্দেহ কর? এই কথা বলে তিনি তাঁর ফতুয়ার ভেতর থেকে অনুমোদিত পিস্তলটি বের করে দেখালে আমরা দৃষ্টি স্বাভাবিক করি এবং তাঁর গোপন পেশার বিষয়টি গোপন রাখার অঙ্গীকার করি।
এরপর আমরা পাড়ার মোড় ত্যাগ করে যে যার ঘরে ফিরি এবং আমাদের দীর্ঘদিনের অস্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য যখন রীতিমতো অনুতপ্ত হই, ঠিক তখনকার এক সকালে পাড়াটা বেশ উত্তপ্ত মনে হলে ধীরে ধীরে আমরা পাড়ার মোড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে শুনতে পাই, রাতে ছাদেকুলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আমরা তখন এই ধারণা পোষণ করি, আমাদের এতদিনের সন্দেহ তাহলে অবান্তর ছিল না। আসল ঘটনা জানার জন্য আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠ মাধ্যম আলী আকরামের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাদের জানান, আসলে পাড়ায় জঙ্গি সংগঠনের এক আসামি ধরতে আসে পুলিশ। সেই আসামিকে ধরতে না পেরে তারা আমার কাছে একজন নিরীহ লোক চায়। আমি ছাদেকুলকে দেখিয়ে দিই—এই কথা বলে আলী আকরাম তীর্যক চোখে আমাদের দিকে তাকালে আমরা চল্লিশোর্ধ্ব ছাদেকুলের মতো মাটির দিকে তাকিয়ে আবার ঘরমুখো হই।
আহমেদ মওদুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১১, ২০০৯
Leave a Reply