মেয়ে না মহিলা, ঠাহর করা মুশকিল; নিচের দিকে বয়সটা যদি বাইশ হয়, ওপর দিকে বত্রিশ হওয়া বিচিত্র নয়। চোখের দৃষ্টিতে দিশেহারা একটা ভাব, এতটা দূর থেকেও তা স্পষ্ট লক্ষ করা গেল, কিংবা সেটাকে অতি সতর্কতা বলেও তরজমা করা যায়। এসআই মাসুদুল করিম তা-ই করল।
থানার উঁচু আর খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেনসন টানছে মাসুদুল, ঊরু চুলকানোর ছলে বাম পকেটে সদ্য ভরা ঘুষের টাকার স্পর্শ নিচ্ছে খানিক পরপর, তাতে বাড়তি ভালো লাগার একটা অনুভূতি হচ্ছে তার, এই সময় বাইশ অথবা বত্রিশকে রাস্তা পার হতে দেখল সে।
মাসুদুল যে টাকার স্পর্শ নিয়ে এত মজা পাচ্ছে, খানিক আগে সেই মজাটা পাচ্ছিল ল্যালা মুননা। আর দুই বছর পর চল্লিশে পড়বে মুননা, একহারা গড়ন, মাথায় কুচকুচে কালো খুলি কামড়ানো চুল, পেশা বেশির ভাগ সময় ছিনতাই, মাঝেমধ্যে পুলিশের সোর্স হিসেবে অপরাধ করার কিছু বাড়তি সুবিধে। তবে প্রতি মাসের ৫ তারিখে মিরপুর থানায় নিজের ট্যারা বদনটা দেখাতে আসতে হয় তাকে, তা না হলে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কোর্টে চালান করে দেবে পুলিশ।
আজ অবশ্য ল্যালা শুধু চেহারা দেখাতে আসেনি, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়া তার ডানহাত বদি উল্লাকে ছাড়াতে এসেছে। যেখানে যে নিয়ম, মুখ খোলার আগে হাত খালি করতে হয়, সেটা সে করেছে; কিন্তু আলাপটা এখনো শেষ করতে পারেনি। এর মাঝখানে এই বাধা—এসআই মাসুদুলের দৃষ্টি অনুসরণ করে ওই মেয়ে বা মহিলাকে রাস্তা পার হতে দেখল সে-ও।
বলাই বাহুল্য যে ওদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়।
জানা কথা, মুননার নজর মেয়েটার বড়সড় নকশাদার হাতব্যাগটার দিকে। সে ভাবছে, এত যখন দামি ব্যাগ, না জানি ভেতরে কত কী আছে। ভাগ্যে থাকলে এক জোড়া সোনার বালাও পাওয়া যেতে পারে।
মাসুদুলের চোখে প্রথমেই ধরা পড়ল মহিলার মাথার চারদিকে এই উড়ি এই উড়ি করা একরাশ বেয়াড়া চুল। কালো নয়, নীল রং করা। রাস্তা পার হওয়ার সময় হঠাত্ থেমে ওড়না দিয়ে ওই চুল ঢাকা দিতে গেল মেয়েটা, তাতে ধেয়ে আসা বিপদ দেখতে না পাওয়ায় মাঝ রাস্তায় মারাত্মক একটা দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল—তবে তার নয়।
ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ব্রেক কষায় জখম হলো তিন-চারটে গাড়ি; তাতে এক সহকারী সচিবের ড্রাইভারের কপাল ফাটল, চিড় ধরেছে হাড়ে; আরেক গাড়ির ডেথ-সিটে বসা নববধূ জ্ঞান হারাল, ড্যাশবোর্ড কিংবা উইন্ডস্ক্রিনে বাড়ি খেয়ে তার নাক ভেঙে গেছে, ঠোঁট গেছে থেঁতলে; তবে সুখবর হলো, জায়গামতো সিটবেল্ট থাকায় কোলের বাচ্চাসহ এক মা বেঁচে গেলেন।
আর মেয়েটা, এ যাত্রা সে বেঁচে গেল বটে, কিন্তু এভাবে পথ চললে বারবার কি বাঁচবে?
মাপমতো কাটা দামি কাপড়ের সালোয়ার-কামিজ পরেছে মেয়েটা; আচরণে যতই পাগলাটে কিংবা নার্ভাস ভাব থাকুক, তার দেহসৌষ্ঠব মাসুদুলের মধ্যে অন্য আরেক রকম ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে দিল। কিন্তু তা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কারণ, দুর্ঘটনাকে পেছনে ফেলে মেয়েটা রাস্তা পেরোনোর পর চমকে উঠতে হলো মাসুদুলকে। কী সর্বনাশ, এ তো ফারজানা!
ফারজানা তার ছোট বোন।
তারপর মনে পড়ল, ফারজানা স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় গেছে গত মাসে। আরও কাছে আসতে তার মনে হলো, হুবহু না হলেও, প্রায় ফারজানার মতোই দেখতে মেয়েটা।
রাস্তা দিয়ে একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, হোক ফারজানার মতো দেখতে, নিজেকে দরবেশ বানিয়ে ফেলার কোনো কারণ খুঁজে পেল না মাসুদুল—খাই খাই দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল সে।
কিন্তু তারপর যখন থানার খোলা গেট দিয়ে মেয়েটাকে ভেতরে ঢুকতে দেখল মাসুদুল, তার মধ্যে আশ্চর্য একটা পরিবর্তন শুরু হলো। পুলিশ জনগণের সেবক, এ ধরনের কোনো বোধ তার ভেতর কাজ করছে না, বরং মনে হলো, এই মেয়েটা তার বোন হতে পারত, কাজেই তার দৃষ্টিটাকে শাসন করা দরকার।
কিন্তু তা যখন বেশ কঠিন লাগল, ঘুরে দাঁড়াল এসআই; চোখ নয়, নিজেকেই প্রত্যাহার করে নিল সে।
নিজের অফিস কামরায় ঢুকে ডেস্কের পেছনে গিয়ে বসল মাসুদুল। অস্ট্রেলিয়ায় মদ্যপ স্বামীর সঙ্গে ফারজানা কেমন আছে বা থাকবে, এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই বুকে একটা মোচড় অনুভব করল সে, সেটা থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসও তৈরি হলো। ওই লোক তার বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও জানা ছিল না এত বেশি মদ খায় সে, এত তার হাত চলে। পায়ের খসখস শব্দে চোখ তুলতে দেখল, চৌকাঠ টপকে ঘরে ঢুকছে ল্যালা মুননা। হাত নেড়ে তাকে বিদায় করে দিল সে। তারপর একটা ফাইল টেনে নিয়ে খুলল।
এক মিনিটও পার হয়নি, আবার খসখস শব্দ। মাসুদুল বলল, ‘অ্যাই, তোমাকে না ভেতরে ঢুকতে মানা…’ চোখ তুলে তাকাতেই থেমে যেতে হলো। অফিসে সেই মেয়েটা ঢুকছে।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মাসুদুল। ‘আসুন। বসুন, প্লিজ।’ ডেস্কের সামনে ফেলা খালি চেয়ারটা দেখাল সে, নিজের এ রকম আচরণে একটু বিস্মিতই হয়েছে।
মেয়েটা একটা চেয়ার টেনে এমন ভঙ্গিতে বসল, যেন অনুরোধ করা না হলেও বসত সে, বসবে বলেই এসেছে। তার পিছু পিছু ল্যালা মুননাও ঢুকে পড়েছে কামরার ভেতর।
‘আমি মিসেস ফিরোজা রব্বানি,’ বলল মেয়েটা, ‘এই তো, কাছেই আমার বাসা: ১-কে/৫-১৪ মিরপুর। আমার স্বামী আমাকে মেরে ফেলছে।’
‘আমার বউ আমারে মাইরালাইলো,’ মেয়েটার দুই হাত পেছন থেকে বলল মুননা, তবে মনে মনে। তার প্রথম বউটার এত খাই আর জিদ যে সত্যি সত্যি তার সন্দেহ হয় সে মারা যাচ্ছে।
‘জি?’ মেয়েটার কথা শুনে মাসুদুল সামান্য বিভ্রান্ত। ‘আপনি কি জিডি করতে এসেছেন, মিসেস…কী যেন নাম বললেন…’
‘ফিরোজা। মিসেস ফিরোজা রব্বানি। আমার স্বামীর নাম রব্বানি শিকদার। ঠিকানা, ১ নম্বর সেকশন, কে ব্লক, ৫ নম্বর রোড, ১৪ নম্বর বাড়ি, মিরপুর…আপনি এসব লিখে নেবেন না?’
‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না করলে…তা ছাড়া, জিডি করতে চাইলে আপনাকে একটা দরখাস্ত লিখতে হবে…তা কেসটা কী? আপনার স্বামী কি আপনাকে খুন করতে চেষ্টা করেছেন?’
‘না। বললাম না, সে আমাকে মেরে ফেলছে। এখন, এই যে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এখনো আমাকে মেরে ফেলছে সে। আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন না?’
‘না,’ বলল এসআই মাসুদুল, ‘বুঝতে আমার একটু সমস্যা হচ্ছে। আপনার স্বামী আপনার ওপর হামলা করেছেন, এ কথা বলতে চাইছেন?’
‘না না না,’ বলল মিসেস রব্বানি, কোলের ওপর ফেলা ঢাউস হাতব্যাগটা অযথাই নাড়াচাড়া করছে। তার পেছনে দাঁড়ানো মুননার খুব সাধ হলো, ব্যাগটা একবার খুলুক না বেটি, দেখে রাখি কী রকম মালপানি আছে। “কিছুই করেনি, শুধু সারাক্ষণ বলছে আমি তোমাকে খুন করব, আমি তোমাকে খুন করব, আমি তোমাকে খুন করব। গত তিন হপ্তা ধরে প্রতিদিন এক শ বার। মুখোমুখি, টেলিফোনে, এসএমএসে, বাড়িতে, গাড়িতে, চায়নিজে। যখনই সে সুযোগ পায়। রোববার রাতে সিনে কমপ্লেক্সে ছবি দেখতে গিয়েছিলাম, ঠিক যখন প্রচণ্ড রোমান্টিক একটা দৃশ্য শুরু হয়েছে, আমার দিকে ফিরে সে বলল, ‘তোমাকে আমি খুন করব, ফিরোজা।’ ছবিটাই আর দেখা হলো না আমার।”
ভ্রূ কোঁচকাল মাসুদুল। বোঝার চেষ্টা করছে কার পাল্লায় পড়েছে। ‘তিনি কারও সামনে কখনো এ রকম করেছেন?’ জিজ্ঞেস করল সে।
“করেছে বৈকি। আপনাকে না বললাম যখনই সুযোগ পায়। আশপাশে কেউ থাকুক বা না থাকুক তাতে তার কিছু আসে-যায় না। দু হপ্তা আগে আমার বোন এসেছিল বাড়িতে, সবাই ডিনার খাচ্ছি, ওর এক প্রতিবেশীর ক্যানসার নিয়ে কিছু বলছিল ও, এই সময় আমার স্বামী বলল, ‘এক সেকেন্ড মাফ করো, আফরোজা।’ তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘আমি তোমাকে খুন করব, ফিরোজা।’ বলেই গলা ছেড়ে হেসে উঠল সে, আমার বোনকে বলল, এবার বলো কী বলছিলে।”
মিসেস ফিরোজা খুবই নার্ভাস ভঙ্গিতে হাত দুটো কচলাচ্ছে।
‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না,’ বলল সে। ‘আপনি এখনই তাকে ফোন করে ডেকে পাঠাতে পারেন। ০৩৭৭২০১১৯৬…। সে নিজেই বলবে। এ নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। সে বলছে, কাউকে খুন করার জন্য এর চেয়ে সহজ বুদ্ধি আর কারও মাথায় আসেনি। ডাকুন তাকে, কথাটা বলার পর গলা ছেড়ে হাসবে সে। মাগো, ওই হাসি! যেন প্রাইভেট একটা জোক, আর সে ছাড়া আর কেউ জানে না। ওই হাসি আবার যদি আমাকে শুনতে হয়, আমার ব্রেন বোধহয় নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘ভদ্রলোক সিরিয়াস, আপনার সঙ্গে স্রেফ কৌতুক করছেন না?’
‘নিজেই যখন বলছে সিরিয়াস, আমি কী করে বলি সিরিয়াস নয়। আপনি তাকে ডাকুন না, নিজেই জেনে নিতে পারবেন। ০৩৭৭…’
‘আভাস পেয়েছেন, কীভাবে আপনাকে খুন করবেন তিনি?’
“কী বলছেন আভাস পেয়েছি! পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে রাস্তায় আমি গাড়িচাপা পড়ে মারা যাব। আর তা নয়তো সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ঘাড় মটকে মারা পড়ব। এভাবেও যদি না মরি, একগাদা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে মরব। ট্যাবলেট আমি খাই, কিন্তু এই ব্যাপারটা শুরু হওয়ার পর থেকে হিসাবও রাখতে পারছি না রোজ কটা করে খাচ্ছি। হয়তো খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার পরও তো ঘুম আসে না। দু-একবার এমনও হয়েছে, ঘুমে বুজে আসছে চোখ দুটো, গায়ে খোঁচা মেরে জাগিয়ে আমাকে বলেছে, ‘ফিরোজা, তোমাকে আমি খুন করব।’ তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে, আর আমি সারা রাত উদ্বেগে ছটফট করেছি। ঠিক এভাবেই আমাকে মেরে ফেলছে সে।”
‘তার মানে আতঙ্কিত করা হচ্ছে, যাতে আপনি মারা যান?’
‘ঠিক তাই,’ বলল ফিরোজা। ‘উদ্বেগে ফেলে দিয়ে আমাকে মেরে ফেলার রাস্তা করেছে। সে চাইছে আমি এতটাই উদ্বেগের মধ্যে থাকি, যেন হঠাত্ কোনো গাড়ির সামনে পড়ে যাই, কিংবা সিঁড়ির ধাপে পা পিছলে যায়…শুনুন, আরে, আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। কাল রাতে বলেছে, খুব জোর এক হপ্তা সময় দিচ্ছে আমাকে। এর মধ্যেই আমি মারা যাব। আরেকটা কথা শুনবেন?’
‘কী?’
‘তার কথা আমি বিশ্বাস করি। সত্যি বিশ্বাস করি।’ ফিরোজার আঙুলগুলো হাতব্যাগটাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল। ‘এমন কি আজও, থানার ঢোকার আগে, একটুর জন্য বেঁচে গেছি…’
মাসুদুল আর বলল না যে ঘটনাটা দেখেছে সে।
‘ভাগ্যই বলতে হবে আমার হার্ট দুর্বল নয়, তা হলে অনেক আগেই ওর আশা পূরণ হয়ে যেত। তার পরও কোথাও একটা শব্দ হলে হয়, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠি আমি। এখন সমস্যা হলো, মাত্র একটা হপ্তা সময় বেঁধে দিয়েছে। আপনাদের কাছে এসেছি, এর একটা বিহিত করে দিন।’
‘বুঝতেই তো পারছি না কী ব্যবস্থা করব,’ বলল মাসুদুল। ‘আপনি যদি স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, সে ক্ষেত্রে আমরা…’
‘আবার কিসের অভিযোগ? আমি বলছি সে আমাকে মেরে ফেলছে, এটা যথেষ্ট বড় অভিযোগ নয়? আমি চাই আপনারা তার সঙ্গে কথা বলুন, বলুন সে যেন এভাবে আমাকে খুন করা বন্ধ করে।’
‘আপনি চাইলে তা আমরা করতে পারব। কিন্তু প্রথমে ব্যাখ্যা করতে হবে আপনার স্বামী কী কারণে আপনাকে খুন করতে চান। মোটিভ দেখাতে হবে।’
‘কারণ আমি তাকে ডিভোর্স দিতে রাজি হচ্ছি না। এই একটাই তো কারণ। আমি তাকে ডিভোর্স দিচ্ছি না বলে। কাউকে খুন করার এটা কোনো কারণ হলো, আপনিই বলুন? এই কারণে কেউ কাউকে খুন করার কথা ভাবতে পারে!’
মাসুদুলের ঠোঁটে সবজান্তার আধো হাসি। ‘অমন কত আছে।’
‘তবে আমাকে কিন্তু সে ডিভোর্স দিতে রাজি নয়। সমাজে সে অন্য রকম পোজপাজ দেখিয়ে চলে, ডিভোর্স দিলে তার প্রেস্টিজে হানি হবে, আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবরা নাকি খারাপ বলবে। আর দেনমোহরের ব্যাপারটা তো আছেই। ডিভোর্সটা হয় আমি দেব, তা না হলে আমাকে মেরে ফেলবে সে। বেশ, আগে আমাকে মেরে ফেলুক, কারণ আমি কখনোই তাকে ডিভোর্স দেব না। কল্পনা করুন,’ হঠাত্ গলা একেবারে খাদে নামিয়ে মিসেস ফিরোজা বলল, ‘এই বয়সে আর কে আমাকে বিয়ে করবে?’
মাসুদুল ঘাড় চুলকাল।
‘কাজেই,’ বলল ফিরোজা, ‘০৩৭৭২০…’
‘কিন্তু আপনার স্বামী কেন চাইছেন আপনি তাঁকে ডিভোর্স দিন?’
‘বলছে এক হাজার একটা কারণ আছে। সবগুলোই উদ্ভট। তার দু-একটা কারণ শুনতে চান? তুমি ভালো রাঁধতে জানো না। বিয়ের পর বারো বছর পার হয়ে গেছে, আজ হঠাত্ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাল আমি রাঁধতে জানি না। আচ্ছা, আপনি বিয়ে করেছেন?’
‘জি।’
‘আপনার স্ত্রীর রান্না ভালো?’
‘মন্দের ভালো আর কি।’
‘দেখলেন, নিখুঁত আসলে কেউ নয়। আরেকটা কারণ, বিয়ের সময় আমার যে রূপ ছিল তা এখন আর নেই। আচ্ছা, রূপ কি সব সময় এক রকম থাকে? আপনার স্ত্রীর রূপ সেই আগের মতো আছে?’
‘না, তা থাকে না…’
‘বুঝুন তা হলে। আরেকটা উদ্ভট কারণ, আমার সঙ্গে কথা বলার কোনো বিষয় খুঁজে পায় না সে। আচ্ছা, এটা ডিভোর্স করতে বলার কোনো কারণ হলো? তারপর…আমি নাকি বাথরুমে নিজের জিনিসপত্র গাদা করে রাখি…’
‘মাফ করবেন, সমস্যাটা আমি বোধহয় এবার বুঝতে পারছি,’ বলল মাসুদুল। ‘আপনি চাইলে তাঁর সঙ্গে আমি আলাপ করতে পারি।’
‘ওহ্, দারুণ! সত্যি আমি খুশি! আপনার কথায় হয়তো তার খানিকটা সেন্স ফিরবে। ০৩৭৭২০১১৯৬৩। রব্বানি শিকদার। এখনই কথা বলবেন, আমি এখানে অপেক্ষা করব?’
‘না, তার কোনো দরকার নেই। একটু হয়তো রাফ ভাষা ব্যবহার করতে হবে, আপনার সে সব না শোনাই ভালো। আবার, আমি তাকে এখানে ডেকে পাঠাতেও পারি। ভেবে দেখি।’
‘ধন্যবাদ।’ প্রায় টলতে টলতে সিধে হলো ফিরোজা, তার চোখের দৃষ্টিতে দিশেহারা সেই ভাবটা ফিরে এসেছে, কিংবা সেটাকে অপার আনন্দের অন্য রকম প্রকাশ হিসেবেও তরজমা করা যায়—মাসুদুল তা-ই করল। ‘অসংখ্য ধন্যবাদ।’
‘আপনাকে একটা রিকশায় তুলে দিতে বলব, মিসেস ফিরোজা?’
‘না, না, কোনো দরকার নেই, আমি নিজেই পারব। আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলাতেই সুস্থ বোধ করছি আমি। শুধু যদি তোমাকে খুন করব বলাটা বন্ধ করত সে, প্রতি মিনিটে, প্রতি সেকেন্ডে… সারাক্ষণ আমি তার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই…যা-ই হোক, ধন্যবাদ। নম্বরটা লিখে নিয়েছেন তো? ০৩৭৭২০১১৯৬৩।’
‘০৩৭৭২০১১৯৬৩। রব্বানি শিকদার,’ বলল মাসুদুল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এই একটা ভালো কাজ তাকে করতে হবে। নাসিমুল গণির ওপর তার যে আক্রোশ জমে আছে, সেটার প্রতিশোধ নেবে রব্বানি শিকদারের ওপর। নাসিমুল গণি ওর বোনের স্বামী।
ফিরোজার পিছু নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল ল্যালা মুননা, ভাবছে থানা থেকে একটু দূরে গিয়ে ওর হাতব্যাগটায় ছোঁ মারবে। কিন্তু তার কপাল খারাপ, খালি রিকশার জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফিরোজার সামনে একটা প্রাইভেট কার এসে থামল, সুদর্শন এক লোক দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘এই ফিরোজা, এই যে, আমি এদিকে।’
লোকটাকে দেখে কালো হয়ে গেল ফিরোজার চেহারা। সন্ত্রস্ত বিড়ালের মতো গাড়ির দিকে এগোল সে, সামনের সিটে লোকটার পাশে উঠে বসল। খানিকটা হকচকিত মুননার চোখের সামনে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এই সময় তার কানে ঢুকল, ‘এখানে কী করছিলে? তোমাকে না আমি সত্যি খুন করব।’
শিকার হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়ায় মুননার মনটা তেতো হয়ে গেল, থানায় না ফিরে চিড়িয়াখানা রোডে নিজের বস্তিতে ফিরল সে, শরীরটাকে বিশ্রাম দেবে। স্বামীকে অসময়ে ঘরে ফিরতে দেখে বড় বউ অবাক হয়ে তাকাল। মুননা তাকে বলল, ‘তরে আমি মাইরালাম। দেহিস, তরে আমি মাইরালাম।’
বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে
শেখ আবদুল হাকিম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৪, ২০০৯
hasnat
valo vabe pathok ke dhore rekhe sesh belay asahoto korlo.