প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের যত ভাবালুতা, যত প্রেম— সবকিছু ধ্বস্ত করে দিয়েছেন চার্লস ডারউইন তাঁর ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ তত্ত্বে। তিনি যে ভয়ঙ্কর বাস্তবতা উন্মোচন করেছেন, তা হলো প্রকৃতি এক নির্মুখ শক্তি, জীবের প্রতি তার প্রেম বা ঘৃণা কোনোটাই নেই। প্রকৃতির যে সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ ও আবিষ্ট করে, সেটা সৃষ্টির প্রেক্ষাপট একেবারেই অন্যরকম—নিষ্ঠুরতা ও মৃত্যুতে ঠাসা। নওয়াজেশ বংশানুবিদ্যার গবেষক—বিবর্তনের এই অমোঘ নিয়মটি তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। তবু তিনি প্রকৃতিকে ভালোবেসেছেন সব জেনেশুনেই। কেননা প্রকৃতিকে জানার তাগিদে তাঁকে ভালোবাসা আমাদের জন্য বড়ই জরুরি। বিজ্ঞান এ জন্য আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। বহু বছর আগে সিপি স্নো টু কালচার গ্রন্থে বিজ্ঞান ও মানববিদ্যার তথা কলাবিদ্যার মধ্যকার ফাঁরাকের বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তাঁকে আমল দেওয়া হয়েছে, বলা যাবে না। যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা নিতান্তই সংখ্যালঘু, আর বলাবাহুল্য নওয়াজেশরা এ দলেরই মানুষ। তাঁকে এই অর্থে একজন পূর্ণ মানুষ বলা কোনো অত্যুক্তি নয়। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী ও শিল্পী। এমন সংশ্লেষ বড়ই দুর্লভ, আমাদের দেশে দুর্লভতম।
নওয়াজেশের প্রকৃতি-বিষয়ক কয়েকটি বই আছে। এগুলোতে যতটা বিজ্ঞান আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি আছে সাহিত্য। তিনিই আমাকে বলেছেন, একসময় গল্প লিখতেন এবং কয়েকটি ছেপেছে কলকাতার সেকালের বামপন্থী সাময়িকী, সম্ভবত পরিচয়, চতুষ্কোণ কিংবা নতুন সাহিত্য-এ। তাঁর সব লেখাতেই আছে মূর্ত বা বিমূর্ত ‘মহাবনস্পতি’ বটবৃক্ষ। পাঠক, বট শুধু ঝুড়িওয়ালা বটগাছই নয়, পাকুড় এবং অশ্বত্থও। তাঁর জন্মভিটে পারিল গাঁয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে একাধিকবার গিয়েছি, দেখেছি সেখানকার প্রাচীন পাকুড় বৃক্ষটি, যেখানে প্রতি বছর মেলা বসে, লোকে গাছতলায় রেখে যায় মানতি ঘোড়ার পুতুল। কৈশোরের এই বৃক্ষটি হতে পারে প্রকৃতির প্রতি তাঁর প্রথম প্রেমের ঘটক বা অনুঘটক। ছায়ানটের নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য রমনার বটমূল তাঁরই আবিষ্কার। ভারতের বন ও প্রকৃতি মন্ত্রকের প্রধান মেনকা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে তিনিও দেশের বটসম্পদ রক্ষার গুরুত্বের কথা জানান এবং শ্রীমতি গান্ধী তা রক্ষার আশ্বাস দেন।
এই প্রকৃতিপ্রেমী রাজনীতি-অনীহ ছিলেন না। সচেতন ও প্রাজ্ঞজন একটি ঔপনিবেশিক দেশে রাজনীতি এড়াতে পারেন না। আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা শেষ বিচারে রাজনীতিও বটে, তাতে সর্বদাই সম্পৃক্ত ছিলেন নওয়াজেশ। মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। মার্কসবাদ সম্পর্কে তাঁর মতামত আমার জানা হয়নি, তবে নিখাদ মানবতাবাদী হিসেবে অনুমান করি, তাঁর অবস্থান ছিল সমাজ বিপ্লবের পক্ষে। বৌদ্ধদর্শনের প্রতি তাঁর অনুরাগ অপ্রকাশ্য ছিল না। মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়ায় অনেক দিন কাজ করেছেন। তাঁর কাছে সেসব দেশের অনূঢ় অরণ্যের অনেক গল্প শুনেছি, কিন্তু আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বৌদ্ধসংস্কৃতি। তিনি চৈত্য ও মূর্তির অনেক ছবি তুলেছেন, একটি চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন।
আমরা অনেক দিন একসঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বাংলাপিডিয়া’ প্রকল্পে কাজ করেছি। ১০ খণ্ডের এ গ্রন্থমালার অসংখ্য ছবি সংগ্রহ ও সংযোজনের দায়িত্ব ছিল তাঁর। আমি ছিলাম জীববিজ্ঞান বিভাগের অনুবাদক ও সম্পাদক। বিবিধ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, বেশির ভাগই জীব-ইতিহাস। ঈর্ষণীয় ছিল তাঁর জ্ঞান। নিজের বিশাল গ্রন্থসংগ্রহের একটা বড় অংশই ছিল জীবজগত্-সম্পর্কিত এবং অধিকাংশ বই-ই দুর্লভ। জানি না, এগুলোর কী ব্যবস্থা করে গেছেন।
এই প্রকৃতিপ্রেমীর নারীপ্রেম সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। শুধু একটিই আছে আমার স্মৃতিতে, তাঁর কাছেই শোনা। পাকিস্তান টি-বোর্ড থেকে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল ভারত ও শ্রীলঙ্কায়। তিনি আমেরিকা-ফেরত নবীন যুবক। দার্জিলিংয়ে ছিলেন কয়েক দিন, আর সেখানে দেখা আসাম টি-বোর্ডের চেয়ারম্যানের মেয়ের সঙ্গে। পরিচয় প্রেমে পরিণত হলেও মিলন আর ঘটেনি। নওয়াজেশের প্রকৃতি-বিষয়ক কোনো কোনো গল্পে এক নারীর দেখা মেলে, সুদর্শনা ও বিদুষী। এই প্রতিমা কি ওই আসামকন্যা? এইটুকুই।
চা যেহেতু ভেষজ উদ্ভিদ, সম্ভবত সেই সূত্রেই নওয়াজেশ এ জাতীয় গাছগাছালির প্রতি সবিশেষ আকৃষ্ট ছিলেন। অতিসম্প্রতি কাজ করেছেন থাইল্যান্ডের কয়েকটি ভেষজ উদ্যানে। সেসব বাগান ও গবেষণার পরিসর রীতিমতো বিস্ময়কর। সেখানে নাকি আছে গোটা পৃথিবীর ভেষজ গাছের সংগ্রহ, এবং সেই সঙ্গে হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি; তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ওষুধ, চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তিনি সেখান থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, তা নিয়মিত লিখতে শুরু করছিলেন একটি দৈনিকে। কিছুদিন হলো আমরা রমনা পার্কে গাছপালা পরিচিতির একটি অনুষ্ঠান শুরু করেছি। সেটি উদ্বোধন করেন নওয়াজেশ এবং উপস্থিত সবাইকে প্রকৃতি সংরক্ষণে গাছপালার গুরুত্বের সঙ্গে উদ্ভিদের ভেষজগুণ সম্পর্কেও বিস্তারিত জানান। অনুষ্ঠান শেষে আমাদের অনুরোধে তিনি ছায়ানট বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হাতে মাধবীলতার একটি চারা তুলে দিয়েছিলেন। আশা করি, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি তাদের স্মারকগ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে রাখবে।
ওয়াহিদুল হকের কাছেই আমরা জানতে পারি, বঙ্গে পারুলবৃক্ষ নেই। খোঁজাখুঁজি শুরু করি। নওয়াজেশ যান শান্তিনিকেতনে, আমিরুল আলম খান আরও দূরে—ভারতের মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত। সবই বৃথা। আমি পাথারিয়া পাহাড় থেকে পারুল নামের দুটি প্রজাতি ঢাকায় এনে লাগাই, বছর দশেক অপেক্ষার পর ফুল দেখে হতাশ হই। শেষে পারুলের খোঁজ মেলে কুষ্টিয়ায়। নওয়াজেশকে ফুলের ছবি দেখাই, সবই সাদা, তাতে সন্দেহ থেকেই যায়। অনেক পরীক্ষার পর তিনি আশ্বস্ত করেন, এটা ফটোগ্রাফের ত্রুটি, ফুলগুলো তামাটেই হবে। আরও খোঁজখবর নিয়ে কাগজে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনও লেখেন এবং ঠিক হয় আগামী বসন্তে আমরা সদলবলে সেখানে যাব। চিঠিপত্র লিখে কয়েক দিন থাকার ব্যবস্থাও করে ফেলেন। কিন্তু যাওয়া আর হলো না, হঠাত্ করেই গেলেন ‘অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’—যেন বড় তাড়া ছিল।
দ্বিজেন শর্মা
উত্তরা, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৯
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৫, ২০০৯
Leave a Reply