কুয়াশা ৫৭ – দানব ১
প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর, ১৯৭৬
এক
দেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত টেকনাফ। ছোট্ট শহর। টেকনাফের পুবে নাফ নদী। পশ্চিমে উত্তাল বঙ্গোপসাগর।
আবদুল্লা এমাম রাউ এই টেকনাফের লোক। এমাম রাউ লোকটা একটু খাপছাড়া ধরনের। একটু-আধটু লেখাপড়া জানে সে। শীতকালে টুরিস্টদের সাহায্য করে বেশ দু’পয়সা কামায়। বছরের বাকি সময়টা সে মাছ ধরে। একা লোক, সংসারধর্ম নেই–অভাব নেই কেন। কিন্তু অভাব না থাকলে কি হবে, এমাম রাউয়ের একটা খারাপ স্বভাব আছে। লোভ সামলাতে পারে না লোকটা। সুযোগ পেলেই চুরি করে। জিনিসটা কম দামী হোক বা বেশি দামী হোক, হালকা হোক বা ভারি হোক-সুযোগ পেলেই চুরি করবে সে ঠিক।
চোর হলেও, রাউ কিন্তু পাকা চোর। চুরি করে আজ অবধি ধরা পড়েনি সে। কেউ তাকে চোর বলে ভাবতেই পারে না।
রাউ তেমন মিশুক লোক নয়। লোকজন সে পছন্দ করে না। জঙ্গলের ধারে, পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট একটা দুই চালার নিচে সে থাকে। কাছে পিঠে আর কোন বাড়ি ঘর নেই। সবচেয়ে কাছের বাড়িটাও প্রায় আধ মাইল দূরে। সে বাড়ির মালিক ইউনুস আদাং।
রাউ যাচ্ছিল ইউনুস আদাঙের সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য। চলতি মউসুমে মাছ ধরার কাজটায় সুবিধে করা যাচ্ছে না। রাউয়ের ইচ্ছা ইউনুসের মত গো-সাপের চামড়ার ব্যবসা করবে সে-ও। এ ব্যাপারেই ইউনুসের সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছে।
ইউনুস আদাং ভিন গায়ের লোক। এই এলাকায় একা পড়ে আছে সে ব্যবসার কারণে। উপজাতীয়দের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে গো-সাপের চামড়া কিনে দৃরাঞ্চলের শহরে পাঠায় সে। এতে তার ভাল লাভ হয়।
রাউ নিরাশ হলো। ইউনুসের দোচালার সামনে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে। ঘরের দরজা বন্ধ। তালা ঝুলছে। ইউনুস আদাং বাড়িতে নেই।
ঘরের তালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুষ্ট বুদ্ধি চাপল হঠাৎ রাউয়ের মাথায়। এর আগে ইউনুসের ঘরের ভিতর ঢোকেনি সে। ইউনুস ভাল রুজি রোজগার করে। তার ঘরের ভিতর নিশ্চয়ই দামী দামী নানা রকম জিনিসপত্র আছে। তালা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখলে হয় কি কি আছে। তালা খোলাটা খুব একটা সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। এই রকম তালা তার ঘরেও আছে।
যেই ভাবা সেই কাজ । পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে তালা খুলে ভিতরে ঢুকল রাউ। ঘরের ভিতর ঢুকে নিরাশই হলো সে। দামী জিনিস বলতে কিছুই দেখতে পেল না। তবে দুই ব্যাগ ভর্তি গো-সাপের চামড়া রয়েছে। কি আর করা, খালি হাতে তো আর বিদায় নেয়া যায় নারাউ ব্যাগ দুটো দুই হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। এই যে চুরি-এটাই হলো তার কাল। আসলে চুরি করে মৃত্যুর দিকে এক পা এগোল আউ।
হাঁটা পথ ধরে সোজা শহরে পৌঁছুল রাউ। গো-সাপের দাম সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না। শহরের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে চিনত সে। তারা তার কাছ থেকে চোরাই মাল কেনে মাঝে-মধ্যে। রাউ তাদের একজনের কাছে গিয়ে গো-সাপের চামড়ার দাম জানতে চাইল।
আশার চেয়ে সাতগুণ বেশি দাম পেল রাউ। আনন্দে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ল সে। এত টাকা এক সঙ্গে এর আগে রোজগার করেনি। রাউ জীবনে এই প্রথম সিদ্ধান্ত নিল-কিছু টাকা সে আনন্দ করার জন্য খরচ করবে। তার এই সিদ্ধান্ত-মৃত্যুর দিকে এটা তার দ্বিতীয় পদক্ষেপ।
শহরে মিরাকল সার্কাস পার্টি এসেছে। নানারকম চমকপ্রদ শারীরিক কসরত, ট্রেনিংপ্রাপ্ত জীব-জন্তুদের আশ্চর্য ধরনের খেলা খোনো হচ্ছে। রাউ টিকেট কেটে ঢুকে পড়ল মিরাকল সার্কাস পার্টির ছাউনিতে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আরও এক পা এগিয়ে গেল রাউ নিজের মৃত্যুর দিকে।
ছাউনিতে ঢোকার পর থমকে দাঁড়াল রাউ। চারদিকে হইচই, চিৎকার, শোরগোল। এখানে সেখানে বড় বড় তাবু ফেলা রয়েছে। তাবুর সামনে খুব ভিড়। প্রত্যেকটি তাঁবুর সামনে একটা করে টুল। সেই টুলের উপর দাঁড়িয়ে টিনের চোঙ মুখে ঠেকিয়ে ঘোষরা ঘোষণা প্রচার করছে। | রাউ দেখল একটি তাবুর সামনে একটা প্রকাশ টেবিল রয়েছে। টেবিলের উপর তিনটে বনমানুষ। তাদের পায়ে লোহার শিকল। সেদিকে এগিয়ে গেল রাউ। ভিড় ঠেলে গিয়ে দাঁড়াল একেবারে বনমানুষ তিনটের সামনে নিজের অজ্ঞাতে মৃত্যুর দিকে আরও এক পা এগেল রাউ।
ঘোষক টিনের চোঙ মুখের পানে তুলে ধরে ঘোষণা করছিল:
ভাই সকল! ভাই সকল দেখে যান! দেখে যান আফ্রিকার গহীন জঙ্গল থেকে ধরে আনা নরমাংসখেকো বনমানুষদের থেকে সাবধান! বেশি কাছে আসবেন না কেউ! এরা বনমানুষ! এরা মানুষ খায়। মানুষের মাংস খায়। কিন্তু চেয়ে দেন-কত যেন শান্তশিষ্ট সুবোধ বালক! আসলে কিন্তু তা নয়। এদেরকে সুযোগ দেবেন না–সুযোগ পেলেই এরা খেয়ে ফেলবে আপনাকে। ভাই সকল! ভাই সকল•••!’
রাউ আরও একটু সামনে এগোল। এমন কুৎসিত জীব সে এর আগে অরি দেখেনি। লম্বা রাউয়ের বুক অবধি হবে বনমানুষ তিনটে। ভীষণ মোটা। ঘন কালো গায়ের রঙ কালো লম্বা লোমে সারা গা ভর্তি।
তিনজনই টেবিলের উপর সারাক্ষণ লাফালাফি করছে, মুখ বাঁকিয়ে ভ্যাঙচাচ্ছে। দুর্বোধ্য শব্দ বেরিয়ে আসছে তাদের মুখ থেকে।
শব্দ করে হেসে উঠল রাউ। এই হাসিটা হলো তার মৃত্যুর দিকে পঞ্চম পদক্ষেপ।
হাসির শব্দ শুনে কিন্তু কিম্ভুতকিমাকার বনমানুষ তিনটে তাকাল রাউয়ের দিকে। রাউয়ের হাসির অর্থ তারা ধরতে পারেনি। অবোধ জীব তারা। কিন্তু হাসির শব্দ শুনে তারা খুশি হয়ে উঠল। লাফাতে শুরু করল টেবিলের উপর আগের চেয়ে বেশি করে।
আবার হেসে উঠল রাউ। বনমানুষগুলো তার সঙ্গে যোগ দিল হাসিতে। চিৎকার করতে শুরু করল তারা বিকট স্বরে।
ব্যাপারটা চোখে পড়ল এবার ঘোষকের। রাউয়ের দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইল সে খানিকক্ষণ। রাউয়ের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ময়লা পোশাক, কদাকার মুখের চেহারা এবং বনমানুষগুলোর সঙ্গে তার ব্যবহার দেখে যোষকের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলল তার মাথায়। রাউকে সে জব্দ করতে চাইল।
ভাই সকল! ভাই সকল! কান পেতে শুনুন। কান পেতে শুনুন আফ্রিকার জঙ্গলের বনমানুষরা কি বলছে । দুঃখের বিষয় আপনারা এদের ভাষা বোঝেন না। কিন্তু নো চিন্তা, আমি অনুবাদ করে বাংলায় বলে দিচ্ছি ওদের বক্তব্য।
ঘোষক চোঙে মুখ ঠেকিয়ে চিৎকার করে বলে চলেছে। রাউকে দেখিয়ে সে বলছে, এই যে লোকটাকে দেখছেন-ভাল করে দেখুন লোকটার চেহারা! বনমানুষরা দাবি করছে এই লোকটা এককালে আফ্রিকায় বাস করত। এই লোক স্বয়ং বনমানুষ ছিল! শুধু তাই নয়, বনমানুষরা দাবি করছে, এই লোকই ছিল তাদের বড় ভাই–একই মায়ের পেটে ওদের চারজনের জন্ম।
উপস্থিত দর্শকরা গলা ছেড়ে হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল। বনমানুষগুলো থমকে গেল। সবাইকে শব্দ করে হাসতে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছে তারা। কিন্তু পরমুহূর্তে তারা আবার লাফাতে শুরু করল। হঠাৎ তিনজনই হাত বাড়িয়ে দিল রাউয়ের দিকে।
ঘোষক বলে উঠল, দেখুন, ভাই সকল, দেখুন। বনমানুষরা তাদের হারিয়ে যাওয়া বড় ভাইকে কেমন সাদরে কাছে টানবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে•••
রাগে, অপমানে দিশেহারা হয়ে পড়ল রাউ। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। রাগে গালিগালাজ করতে করতে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেল সে।
হন হন করে হাঁটছিল রাউ। রাগে জলছে, কেউ যেন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বেশ খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়াল সে। এদিকেও বেশ ভিড়। একটা তাবুর সামনে উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে আছে হাতির মত প্রকাণ্ড একজন লোক নেংটি পরা লোকটার গায়ে কোন কাপড় নেই। চোখ পড়লে চোখ ফেরানো মুশকিল। সত্যিই লোকটা দৈত্যের মত দেখতে।
ঘোষক বলে চলেছে, মাত্র চার আনা। মাত্র চার আনা দিয়ে আপনারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যায়ামবীর লৌহমানবের দৈহিক কসরৎ দেখতে পারেন! জ্বী-না হজুর, এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না আমি। আমাদের ব্যায়ামবীর লৌহমানব পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালী মানুষ। পৃথিবীর সব ব্যায়ামবীরের সঙ্গে লড়েছেন ইনি। কেউ আমাদের লৌহমানবকে পরাজিত করতে পারেনি। তবে, একমাত্র স্বনামধন্য বীরপুরুষ কুয়াশার সঙ্গে আমাদের লৌহমানব শক্তি পরীক্ষা করার সুযোগ পাননি।
“ কুয়াশা! ‘কুয়াশা কে? রাউ চিন্তা করতে শুরু করল। নামটা সে বহুবার শুনেছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার। কুয়াশা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, আদর্শবান এক মানুষ, গরীবের বন্ধু, অপরাধীদের যম।
ঘোষক বলে চলেছে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর কুয়াশাকে দেখবার সুযোগ আপনারা নাও পেতে পারেন। তার বদলে আমাদের লৌহমানবের দৈহিক কসরৎ দেখে নয়ন সার্থক করুন । মাত্র চার আনা।’
তাঁবুটার সামনে থেকে সরে গেল রাউ। বনমানুষগুলোর কথা সে ভুলতে পারছে না। রাগ তার দূর হয়নি এখনও। তার ধারণা সত্যি সত্যি বনমানুষগুলো তাকে তাদের বড় ভাই বলে দাবি করেছিল।
হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াল রাউ। তার সামনে দিয়ে একটা যুবতী মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। নীল, টাইট প্যান্ট যুবতীর পরনে। গায়ে আঁটো নান গেঞ্জি। পায়ে হাঁটু অবধি রাবারের জুতো। মাথায় চকচকে স্টিলের তারের নেট। মেয়েটি খুবই সুন্দরী, তার কোমরে ঝুলছে একটা চকচকে রিভলবার।
সুন্দরী মেয়েদের প্রতি রাউয়ের দুর্বলতা আছে। মেয়েটির পিছু নিল সে। লম্বা, পুরুষালি পদক্ষেপে মেয়েটি গিয়ে দাঁড়াল একটি তাঁর মনে।
এই তাঁবুটার সামনে দুটো বিরাট বিরাট লোহার খাঁচা দাঁড় করানো রয়েছে। খাঁচার ভিতর দুটো করে চারটে সিংহ। মেয়েটি সোজা গিয়ে ঢুকল একটি আঁচার ভিতর। সিংহ দুটো তাকে দেখেই গর্জে উঠল, আক্রমণাত্মক নানারকম ভঙ্গি করতে শুরু করল। ঘোষক ঘোষণা করে চলে, “মিস লাকীর দুঃসাহসিক খেলা দেখুন। বনের হিংস্র সিংহকে মিস লাকী কেমন চাবুক মেরে বশ করে রাখে তা দেখতে হলে টিকিট কিনে ঢুকে পড়ুন তাঁবুর ভিতর একটি টিকেটের দাম মাত্র আট আনা ।
খানিকপর মেয়েটি খাঁচা থেকে বেরিয়ে এল । তাঁবুর ভিতর ঢুকল সে। আট আনা দিয়ে টিকেট কিনে রাউও ঢুকল তাঁবুর ভিতর।
আধঘণ্টা ধরে সিংহের খেলা দেখাল মিস লাকী। খেলা দেখিয়ে তাবুর বাইরে। বেরিয়ে গেল সে। ভিড় ঠেলে রাউও বেরিয়ে এল । কিন্তু বাইরে এসে সে মিস লাকীকে কোথাও দেখতে পেল না।
আবার বনমানুষগুলোর কথা মনে পড়ে গেল রাউয়ের। মেজাজটা আবার খারাপ হয়ে গেল তার। সার্কাস পাটির ছাউনি থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি ফিরল সে।
আবদুল্লা এমাম রাউ জানল না নিজের মৃত্যুর জন্য যতগুলো ভুল করা দরকার তার প্রায় সবগুলোই করে বসেছে সে।
দুই
কয়েক দিন কেটে গেল। মিরাকল সার্কাস পার্টি দর্শকের অভাবে লাল বাতি জেলেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু সে খরব রাখে না রাউ। সে তার দো-চালায় বসে কদিন থেকে শুধু গান গায়। নিজের হাতেই রান্না-বান্না করে সে। টাকার এখন অভাব নেই তার। খায় দায়, গান গায়–আর ঘুমায়।
সে রাতেও গলা ছেড়ে গাইছিল আবদুল্লা এমাম রাউ। দরজাটা বন্ধই ছিল। হঠাৎ একটা শব্দ হলো। গান থামিয়ে কান পাতল রাউ। আবার শব্দ। এবার পরিষ্কার শুনতে পেল সে শব্দটা। দুর্বোধ্য স্বরে কারা যেন কথা বলছে ঘরের বাইরে।
ঘরের দেয়ালের অর্ধেকটা কাঠের, অর্ধেকটা বেড়ার। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাউ। বাইরের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল ওদের। তিনটে বনমানুষ দাঁড়িয়ে আছে জানালার অদূরে।
বনমানুষগুলোকে দেখেই মাথায় রক্ত চেপে গেল রাউয়ের। পুরানো রাগটা তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল। রক্ত চক্ষু মেলে ওদের দিকে চেয়ে রইল সে। বনমানুষ তিনটেকে অসহায় দেখাচ্ছে। সামনের দুটো হাত নেড়ে, মাথা ঘনঘন কাত করে, করুণ সুরে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছিল ওরা। মাঝে মাঝে নিজেদের পেটে হাত দিয়ে থাবা মেরে ইঙ্গিতে বলবার চেষ্টা করছিল…আমাদেরকে খেতে দাও।
আমরা ক্ষুধার্ত!
জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা বল্লমটা নিল রাউ। ছুটে গিয়ে দরজা খুলল। বাইরে বেরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, শালারা! আমাকে সুযোগ পেয়ে অপমান করেছিলি–এবার মজা দেখাচ্ছি।’
কথাগুলো বলে রাউ প্রচণ্ড জোরে লাথি মারল একটা বনমানুষকে। ছিটকে দুই হাত দূরে গিয়ে পড়ল সেটা। অপর দুটো লুটিয়ে পড়ল রাউয়ের পায়ের উপর। কিন্তু রাউয়ের মনে এতটুকু দয়ামায়ার উদ্রেক হলো না। বল্লমের আগা দিয়ে, পা দিয়ে আঘাত করতে লাগল সে বনমানুষগুলোকে। খেপে গেছে রাউ। অন্ধের মত আঘাত করে চলেছে সে। একসময় বনমানুষরা বুঝতে পারল, এই মানুষের কাছ থেকে দয়ামায়া আশা করা বৃথা। এ লোক খেতে তো দেবেই না বরং মেরে খুনই করে ফেলবে। আহত, রক্তাক্ত বনমানুষরা খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল। তাদের করুণ কান্নার শব্দ শোনা গেল অনেকক্ষণ ধরে।
তারপর, হঠাৎ তাদের চিৎকার একেবারে থেমে গেল।
শালারা দুইজন মিলে একজনকে খেয়ে ফেলছে সম্ভবত! দাঁতে দাঁত চেপে মন্তব্য কল রাউ। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল সে।
রাউ জানল না এইমাত্র সে তার মৃত্যুর সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করল।
কয়েক মাস কেটে গেল। টেকনাফ থেকে কাজের সন্ধানে কক্সবাজারে গেল রাউ। বছরের পাঁচ মাস সে কক্সবাজারেই থাকে। টুরিস্টদের সাহায্য করে এই পাঁচ মাস ভাল টাকা কামায় সে।
কিন্তু এবার ঘটনা অন্য রকম ঘটল। কক্সবাজারে মাস দুয়েক রইল রাউ। একজন বিদেশী শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোককে কক্সবাজার এবং সংলম এলাকার দ্রষ্টব্য স্থানগুলো দেখবার দায়িত্ব নিয়েছিল সে। এই টুরিস্ট ভদ্রলোকের একটা দামা ঘড়ি এবং একটা পিস্তল চুরি করল সে। চুরি করার পর কক্সবাজারে থাকা সম্ভব নয়, তাই অসময়ে ফিরে এল সে টেকনাফে। রাউ নির্দিষ্ট সময়ের আগে ফিরে আসায় ইউনুস আদাং একটুও অবাক হয়নি। কারু, রাউ খাপছাড়া ধরনের লোক। যখন যা ইচ্ছা তাই করে। নিজের ব্যবসা মন্দা যাচ্ছিল বলে নে এ ব্যাপারে মোটেই মাথা ঘামাল না। হঠাৎ একদিন রাউকে নিজের বাড়িতে ঢুকতে দেখে সে অবাক হলো।
রাউ এর আগে কখনও তার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। ইউনুসের অবাক হবার কারণ এটাই। সহাস্যে, সাদরে ঘরের ভিতর ডেকে বসাল ইউনুস রাউকে।
রাউয়ের চেহারা দেখে ইউনুস বুঝতে পারল লোকটা কোন খারাপ খবর নিয়ে এসেছে। রাউয়ের চোখেমুখে ফুটে রয়েছে ভয় ভয় ভাব। ঘামে ভিজে রয়েছে তার পুরো শরীর।
“ ইউনুস, তুমি কোন শব্দ পাওনি? মিনিট কয়েক আগে আশ্চর্য ধরনের কোন শব্দ কানে ঢোকেনি তোমার?
শব্দ? আশ্চর্য ধরনের শব্দ? কই, না তো!
রাউ হঠাৎ জানতে চাইল, ‘আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি, ইউনুস। আচ্ছা, পাগনের লক্ষণ কি জানো তুমি?’
ইউনুস অবাক হয়ে চেয়ে রইল রাউয়ের দিকে। রাউ আবার বলল, ‘পাগল হয়ে গেলে মানুষ আজেবাজে জিনিস দেখতে পায়?’
ইউনুস বলল, ‘ব্যাপার কি? কি হয়েছে তোমার?’
উত্তর দিল না রাউ। পকেট থেকে দশটাকার নোটের কয়েকটা বাণ্ডিল বের করল সে। সেগুলো বাড়িয়ে দিল উনুসের দিকে ।
এই টাকাগুলো রাউ ইউনুসেরই গো-সাপের চামড়া বিক্রি করে পেয়েছিল।
ইউনুস, আমার পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র তুমিই সত্যিকার সৎ, ভাল লোক। একটা উপকার করতে হবে আমার।’
‘উপকার করতে বলছ–একশোবার করব। কিন্তু তার বদলে টকা দিচ্ছ কেন?’
রাউ ইউনুসকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, টাকাগুলো তোমার কাছে থাক। ইউনুস, হঠাৎ হয়তো দেখবে আ-আমি নে-নেই! মানে আমি মরে যেতে পারি। আমার কথা বুঝতে পারছ তো, ইউনুস! আমি মরে যেতে পারি। শোনো, যদি আমার কিছু হয়, এই টাকা দিয়ে তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ডিটেকটিভকে নিয়োগ করবে। সে যেন আমার মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করে।
ইউনুস টাকাগুলো নিল। কিন্তু বিস্ময়ের ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারেনি সে, ‘রাউ, তোমার হয়েছে কি বলো তো! তোমার পেছনে কি শত্রু লেগেছে?’
রাউ বলল, সে-সব কথা শুনতে চেয়ো না। যা বললাম–কোরো। সবচেয়ে বড় ডিটেকটিভকে নিয়োগ করবে তুমি। কথাটা মনে রেখো। ছোটখাট কাউকে নয়-তারা পারবে না রহস্যটা ভেদ করতে। তুমি বরং সম্ভব হলে কুয়াশার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো। কথা দাও, ইউনুস।
‘দিলাম কথা। কিন্তু…’
ইউনুসের কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিল না রাউ। চলে গেল সে। ইউনুস লক্ষ করল, রাউ ভয়ে একেবারে চুপসে আছে।
ঘরে ফেরার পথে ঘনঘন পিছন ফিরে এমনভাবে তাকাচ্ছিল রাউ যে, মনে হচ্ছিল কেউ বুঝি তাকে ধাওয়া করছে।
ঘরে ঢুকে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল সে। জানালা বন্ধই ছিল। আলন, টেবিল, চেয়ার-যা কিছু আসবাব ছিল সব টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এল সে দরজার কাছে। জিনিসগুলো দরজার গায়ে ঠেকিয়ে এমনভাবে রাখল যাতে বাইরে থেকে কেউ দরজা খোলার চেষ্টা করলে সহজে যেন তা না পারে।
এরপর রাউ কাঠের দেয়াল থেকে নামাল টুরিস্টদের কাছ থেকে চুরি করা পিস্তলটা। সেটা রাখল বিছানার উপর। তারপর শুয়ে পড়ল।
শুলো বটে রাউ কিন্তু ঘুম এল না তার। রাত ক্রমশ বাড়তে লাগল। কান খাড়া করে আছে সে। যেন কিছু একটা ঘটবে।
রাত আরও গম্ভীর হলো। ঘুম নেই রাউয়ের চোখে। কান খাড়া করে আছে সে। দূরের বনভূমি থেকে ভেসে আসছে বাঘের হুঙ্কার। ধস্তাধস্তির শব্দ। শোনা যাচ্ছে অদূরবর্তী সাগরের গর্জন।
একসময় ভোর হলো। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল রাউ। ঘুম ভাঙল তার বেশ বেনা করে। নাস্তা তৈরি করল সে। দুপুরের খাবার জন্য চুলোয় ভাত চড়াল । সারাটা দিন ঘরের বাইরে বের হলো না সে। দরজা-জানালা খুলল না ভুলেও।
দিনটা কেটে গেল। রাত এল আবার। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ল রাউ। বিড়বিড় করে একবার বলল, ইউনুসকে ঘটনাগুলোর কথা বলে হত। পরশু রাতে যা দেখেছি কিন্তু সেকথা বলা না বলা সমান। আমার কথা বিশ্বাস করবে না কেউ আমাকে পাগল মনে করবে ।
রাত গম্ভীর হলো। ঘুমিয়ে পড়েছে রাউ।
বাইরে অদ্ভুত সব শব্দ হচ্ছে। দুর থেকে ভেসে আসছে মাঝে মাঝে বাঘের গর্জন। অচেনা পাখি ডাকছে। তার সঙ্গে ঝিঁঝি পোকার শব্দ আর সাগরের একটানা গর্জন তো আছেই। কিন্তু এসব সাধারণ শব্দ ছাড়াও আরও একটা শব্দ! | ঘুম ভেঙে গেল রাউয়ের। ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানার উপর। কান পাতল। মনে হচ্ছে বাতাস ধাক্কা মারছে তার ঘরের দেয়ালে । আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে গরল রাউ পিস্তলটা। হাতের মুঠোয় নিল সেটাকে নিঃশব্দে। শব্দটাকে বাতাসের মনে হলেও রাউ জানে, ওটা বাতাসের শব্দ নয়।
থরথর করে কেঁপে উঠল রাউয়ের দেহটা। ঢোঁক গিলল সে অন্ধকারে। পিস্তলটা ধরে আছে সে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে। হাতের তালু দুটো ভিজে গেছে ঘামে।
এতটুকু শব্দ না করে বিছানা থেকে মেঝেতে নামল রাউ। পা টিপে কাঠের দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। কাঠের গায়ে সরু ফাঁক। সেই ফাঁকে চোখ রেখে বাইরে তাকাল।
বাইরে জ্যোত্স্নালোকিত রাত্রি। কি দেখল রাউ, তা সেই জানে। হাঁ করে, চোখ কপালে তুলে বিকট রবে আর্তচিৎকার করে উঠল সে। আতঙ্কে কাঁপতে লাগল তার শরীর। লাফ দিয়ে পিছনে এল সে কয়েক পা। তারপর দেয়ালের দিকে পিস্তল তুলে গুলি করল। কাঠের গায়ে একটার পর একটা ফুটো সৃষ্টি হতে লাগল।
গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামল না রাউ।
নতুন করে গুলি ভরল সে পিস্তলে। আবার শুরু করল গুলি। এবার একটা করে গুলি করার পর খানিকক্ষণ বিরতি নিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘আমাকে খেয়ে ফেলতে এসেছে ওরা!’
গুলির শব্দ ছাপিয়ে আর একটি শব্দ শোনা গেল। শব্দটা আসছে উপরের দিক থেকে। বিস্ফারিত চোখে উপর দিকে তাকাল রাউধা ঠকঠক করে কাঁপছে সে। টিনের ছাদ দুলছে। মোটা মজবুত কাঠের ফ্রেম মড়মড় করে ভেঙে যাচ্ছে। কে বা
কারা যেন খুলে নিচ্ছে ছাদের টিন।
ছাদের একটা অংশ তুলে ফেলা হলো। আকাশ দেখা যাচ্ছে তারা দেখা যাচ্ছে।
উন্মাদের মত গুলি করতে করতে পিছিয়ে গেল রাউ। পাশের কামরায় গিয়ে ঢুকল সে। সেই একই অবস্থা। ছাদ ভেঙে ফেলছে কারা যেন। এবার কাঠের ফ্রেম এবং টিন নেমে এল হুড়মুড় করে নিচের দিকে। পালাতে গিয়েও পারল না রাউ। চাপা পড়ে গেল সে। | রাত গম্ভীর হলে কি হবে, রাউয়ের গুলির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেতে নিকটবর্তী প্রতিবেশি ইউনুস আদাং রওনা হয়ে গেল এমাম রাউয়ের বাড়ির দিকে।
রাউয়ের দো-চালার কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই ইউনুস লক্ষ করল, সব রকম শব্দ থেমে গেছে। খানিক আগে সে রাউয়ের একটানা আর্তনাদের শব্দ শুনেছে। এখন কোন শব্দই নেই।
দো-চালার কাছে পৌঁছে ইউনুস অবাক হয়ে গেল। দো-চালাটা নেই, আছে কেবল কাঠ আর টিনের স্তূপ। কাঠগুলো ভেঙেচুরে ছোট ছোট টুকরো হয়ে গেছে। টিনগুলো দোমড়ানো মোচড়ানো। যেন একদল দানব, দানবীয় শক্তিতে টিনগুলোকে ধরে কাগজের মত দুমড়ে ফেলেছে, মুচড়ে ফেলে দিয়েছে। মোটা মোটা এক একটা বাশ শত টুকরো হয়ে পড়ে রয়েছে। টর্চের আলোয় চারদিক দেখতে লাগল ইউনুস। তার সন্দেহ হলো–এসব কি সত্যিই দেখছে সে, না স্বপ্ন দেখছে?
একসময় একটু চমকে উঠল ইউনুন অদূরবর্তী সাগরের পানিতে কে বা কারা যেন দাপাদাপি করছে বলে সন্দেহ হলো তার। শব্দটা সে পরিষ্কার শুনল। মাছ বা হাঙর হবে মনে করে সেদিকে পা বাড়াল না সে। পানিতে দাপাদাপির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। দাপাদাপির শব্দটাও ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে–একসময় তা-ও আর শোনা গেল না!
রাউ কোথায়? কাঠ, টিন আর বাঁশের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে নাকি?
কোন রকম সাহায্য পাওয়া যাবে না এত রাতে, জানত ইউনুস। কাছে পিঠে আর কোন বাড়ি-ঘর নেই। অগত্যা একাই সে স্তূপ সবার কাজে হাত লাগাল। ঘন্টা খানেক পরিশ্রম করার পর কাদার মত খানিকটা নরম জিনিস হাতে ঠেকল ইউনুসের। তারপর সে বুঝতে পারল কাদা নয়, জিনিসটা মাংসপিণ্ড। আরও ভাল করে দেখার পর আতঙ্কিত হয়ে পড়ল ইউনুস। মাংসপিণ্ডটা যে রাউয়ের দেহ ছাড়া আর কিছু নয় তা বুঝতে পারল সে। বুঝতে পেরে ভয়ে কেঁপে উঠল সে, দৌডুতে লাগল নিজের বাড়ির দিকে।
দৌড়ে পালাবার সময় ইউনুস বুঝতে পারল-রহস্যটা একমাত্র কুয়াশা ছাড়া আর কারও পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়।
তিন
তিনদিন পর এক সকালে বি,আর,টি,সি-র একটা কোচে উঠল ইউনুস আদাং। কক্সবাজার হয়ে কোচ যাবে চট্টগ্রাম শহরে।
কক্সবাজারে কোচ পৌঁছুল বেলা এগারোটায়। আধঘণ্টা বিরতি। নিচে নেমে সেদিনের দৈনিক পত্রিকা কিনল ইউনুস। হকারের কাছে গত কয়েক দিনের পুরানো কিছু পত্রিকা দেখল সে। সেগুলোও কিনে নিল। একটা রেস্তোরাঁয় বসে হালকা খাবার খেলো। তারপর আবার উঠল কোচে।
ইউনুস নিজের সীটে বসে খবরের কাগজে মনোনিবেশ করল। কয়েক দিনের পুরানো কাগজগুলোয় কুয়াশা সম্পর্কে ছোটখাট কিছু খবর ছিল। এই খাবগুলো। পড়ার জন্য পত্রিকা কিনেছে সে। একটা একটা করে পড়তে শুরু করল সে খবরগুলো।
একটা খবরে বলা হয়েছে, কুয়াশা আড়াই হাজার পিতা-মাতাহীন এতিম কিশোর-কিশোরীকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে নিজের প্রতিষ্ঠিত মডেল স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। তারা সেখানেই থাকবে এবং পড়াশোনা করবে। তাদের খাওয়া, থাকা এবং বিদ্যা অর্জনের জন্য যা খরচ হবে তার সবটাই দেবে কুয়াশা। আর একটা খবরে জানানো হয়েছে, মারাত্মক একটা মারণাস্ত্র আবিষ্কার করেছে কুয়াশা, সেই আবিষ্কারের ফর্মুলা সে দান করেছে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে।
ময় হয়ে খবরগুলো পড়ছিল ইউনুস আদাং। পাশের সীটে বসা লোকটা তাকে অনেকক্ষণ থেকে আড়চোখে দেখছে তা সে বুঝতেই পারেনি।
পাশের সীটের লোকটা তার পিছু পিছু কোচে চড়েছে সেই টেকনাফ থেকেই। লোকটার বয়স হবে পঁয়ত্রিশ। স্বাস্থ্যটা খুবই ভাল । চেহারাটা একটু রুক্ষ ধরনের। মাথায় ছোট ছোট চুল। ট্রাউজার এবং শার্ট পরে আছে। দামী সিগারেট খাচ্ছে লোকটা। কোলের উপর পড়ে রয়েছে একটা স্প্যানিশ গিটার। লোকটার মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, কপালে লম্বা একটা ক্ষতচিহ্ন।
ইউনুস আদাং পুরানো খবরের কাগজগুলো পড়া শেষ করল। সেদিনের পত্রিকাটা খুলল সে এবার।
পত্রিকাটা খুলতেই বড় বড় কয়েকটা অক্ষর লাফ দিয়ে চোখের সামনে চলে এল যেন। পুরানোগুলোর মতই, এ পত্রিকাটিতেও বিদঘুঁটে একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে।
বড় সড় চারকোনা একটা জায়গায় কয়েকটা মাত্র শব্দবাকি অংশটা সাদা, ফাঁকা। শব্দ কয়েকটা এইরকম:
সাবধান!
দানবের দল এল বলে। পাশের সীটের লোকটা হঠাৎ ইউনুসের উদ্দেশে কথা বলে উঠল, কি ভাই, কোথায় যাবেন?’
ইউনুস তাকাল । মৃদু হাসল সে। বলল, যাব চট্টগ্রাম। আপনি?, ‘আমিও! তা পুরানো খবরের কাগজ পড়ছিলেন কেন বলুন তো? দেখলাম বেছে বেছে কুয়াশা সংক্রান্ত খবরগুলো পড়লেন…
ইউনুস নড়েচড়ে বসল। বলল, কুয়াশা সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। তার সম্পর্কে সব কথা জানতে ইচ্ছা করে। তাই পড়ছিলাম। প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, মহৎ হৃদয়ের অধিকারী, শক্তিতেও অদ্বিতীয়–সত্যি এযুগে এমন গুণী লোক বোধহয় দ্বিতীয়টি নেই। বাংলাদেশ কুয়াশার জন্যে গর্বিত।
তা ঠিক। কুয়াশা সৃত্যি বাংলাদেশের গর্ব। ইউনুস জানতে চাইল, আচ্ছা, কুয়াশা কি ডিটেকটিভ?
না। ডিটেকটিভ নয় সে। নিরাশ হলো ইউনুস। একটু যেন চিন্তিত দেখাল তাকে।
পাশের লোকটা বলল, কি ব্যাপার, কুয়াশা ডিটেকটিভ নয় শুনে আপনি যেন মুষড়ে পড়লেন।
না..হ্যাঁ, মানে..আসলে বুঝলেন, আমি যাচ্ছি একটা কেস নিয়ে কুয়াশার সঙ্গে দেখা করতে…।
ইউনুস আদাং গড় গড় করে বলে ফেলল আদ্যোপান্ত সব ঘটনা। রাউ-এর বিদঘুঁটে আচরণ, তার রহস্যময় মৃত্যু–সব কথাই বলল সে।
ইউনুস সাদাসিধে মানুষ, সে লক্ষই করল না তার কথা শুনতে শুনতে লোকটার চেহারার পরিবর্তন ঘটে গেছে, গম্ভীর হয়ে উঠেছে সে। সব কথা শুনে লোকটা বলল, হু।
আর কিছু না বলে লোকটা অন্যদিকে মুখ ফেরাল।
ইউনুস আবার খবরের কাগজে মন দিল। হঠাৎ একটা খবর দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। আবদুল্লা এমাম রাউয়ের মৃত্যু সম্পর্কে পুলিসের ধারণা কি তা লেখা হয়েছে বিস্তারিত। খবরটা পড়ল ইউনুস। বাঁকা হয়ে গেল তার মূর্খ। পুলিস কর্তৃপক্ষের ধারণা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হলো না তার। সাংবাদিকরাও তাদের ধারণার কথা ছেপেছে। দুই দলেরই বক্তব্য একরকম। ওদের ধারণা অদ্ভুত ধরনের একটা টর্নাডোের আক্রমণে নিহত হয়েছে রাষ্ট্র।
গোটা ব্যাপারটাই অবাস্তব এবং হাস্যকর। টুর্নাডো না ছাই। টুর্নাডো হলে সে ঠিকই জানতে পারত। তাছাড়া আকাশ ছিল সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত। টুর্নাডোর প্রশ্নই ওঠে নাঃ..। পকেট থেকে কলম বের করে খবরটার হেডিংগুলোর নিচে দাগ দিয়ে রাখল সে!
বেলা পাঁচটার সময় চট্টগ্রাম শহরে থামল কোচ। খবরের কাগজগুলো বগলদাবা করে উঠে দাঁড়াল ইউনুস। এমন সময় তার সামনে একটা যুবতী মেয়েকে দেখল সে। মেয়েটর পরনে শাড়ি নয়, প্যান্ট। গায়ে লাল শার্ট। মাথার চুলে স্টিলের তারের নেট। মেয়েটির স্বাস্থ্যটা খুবই ভাল। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে। ব্যাগটার গায়ে লেখা রয়েছে: মিরাকল সার্কাস পার্টি।
মিরাকল সার্কাস পাটি-মনে পড়ে গেল ইউনুসের। টেকনাফে খেলা দেখাচ্ছিল এই পাটি। বেশ কয়েক মাস আগের কথা অবশ্য। খেলা দেখাতে দেখাতেই টাকার অভাবে, প্রতিষ্ঠানটা ভেঙে গেছে। সার্কাস দলটা ভেঙে যাবার পর একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল টেকনাফ শহরে। গুজবটার কথা বিশেষ করে মনে আছে তার। গুজবটা হলো মানুষ সম্পর্কিত। সার্কাস পার্টির তিনটে বনমানুষ ছিল। পাটি ভেঙে যাবার কদিন পর বনমানুষ তিনটে নাকি রহস্যময় ভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়।
ভিড়ের সঙ্গে নিচে নামল ইউনুস আদাং। চট্টগ্রাম শহরে এর আগে আসেনি সে। অপরিচিত শহর। ভয় ভয় লাগে। ইউনুস এদিক-ওদিক তাকাল। তার পাশের সীটে বসা লোকটা গেল কোথায়? লোকটার সঙ্গে বেশ পরিচয় হয়ে গেছে। তাকে জিজ্ঞেস করে কয়েকটা কথা জেনে নিলে হত। কুয়াশার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সে-কিন্তু কুয়াশার ঠিকানাই তো সে জানে না। কিন্তু লোকটাকে সে দেখতেই পেল না।
ইউনুস দেখতে না পেলেও লোকটা কিন্তু ঠিকই দেখতে পাচ্ছিল ইউনুসকে। কোচ থেকে নেমে আড়াল থেকে দেখছে লোকটা তাকে।
খানিকক্ষণ ইতস্তত করার পর ইউনুস পা বাড়াল একটা ট্যাক্সির দিকে। ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। বলল, দেখো ভাই, এই শহরে আমি নতুন। আমি যাব কুয়াশার কাছে। কিন্তু তার ঠিকানা…।’
ড্রাইভার সহাস্যে বলল, কুয়াশার ঠিকানা? দরকার নেই। গাড়িতে উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন। কুয়াশার ঠিকানা এই শহরের সবাই জানে।
ট্যাক্সিতে চড়ল ইউনুস। ড্রাইভার স্টার্ট দিল। এমন সময় একটা হকার চিৎকার করে উঠল, নতুন খবর! দানবের দল আসছে। ঢাকার পত্রিকায় নতুন খবর।
‘এই ড্রাইভার, দাঁড়াও ভাই। একটা পত্রিকা কিনে নিই আগে। ইউনুস হকারকে ডাকল গাড়ির ভিতর বসে বসেই। চল্লিশ পয়সা দিয়ে একটা পত্রিকাকিনল ইউনুস।
ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘কি যে ব্যাপার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এমন আশ্চর্য বিজ্ঞাপনের কথা বাপের কালে শুনিনি। সবগুলো কাগজে ছাপা হচ্ছে!
কাগজটা মেলে ধরতেই ইউনুস দেখতে পেল বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে:
হুশিয়ার! দানব বা দৈত্য যাই বলুন যে-কোন মুহূর্তে আপনার শহরে হানা দিতে পারে।
ট্যাক্সি ছুটে চলেছে। ট্যাক্সিকে অনুসরণ করছে একটা সাদা রঙের ফোক্সওয়াগন গাড়ি। গাড়ির পিছনের সীটে বসে আছে যে লোকটা সেই টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামে আসার সময় কোচে ইউনুসের পাশের সীটে বসে ছিল।
ড্রাইভারের উদ্দেশে কথা বলে উঠল লোকটা, শরীফ, লোকটা যাচ্ছে। কুয়াশার সঙ্গে দেখা করতে। কুয়াশাকে রাউয়ের হত্যা-রহস্যের কথা বলবে ও। এ হতে দেয়া যায় না। অথচ বসের সঙ্গে পরামর্শ না করে আমি কোন ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারছি না ।’
ড্রাইভার শরীফ বলল, বসের সাথে ফোনে কথা বলুন, সার। গাড়ি থামাই। কোন দোকান থেকে ফোন করুন। ট্যাক্সিটা এগিয়ে যাবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকই ধরে ফেলব আমি।’
তাহলে থামাও দেখি।’
থামল ফোক্সওয়াগেন। গাড়ি থেকে নেমে একটা ডাক্তারখানায় ঢুকে ফোন করার জন্য অনুমতি নিয়ে ডায়াল করল লোকটা। অপরপ্রান্ত থেকে কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘হ্যালো।’
‘আমি জগদীশ বলছি, বস্। টেকনাফের ইউনুস-যা ভয় করেছিলাম তাই সে করতে যাচ্ছে।’
ঠিক জানো? ‘জানি, বস্ সব কথা বের করে নিয়েছি ব্যাটার পেট থেকৈ কোচে এখানে আসার সময়…।’
কর্কশ কণ্ঠস্বর থেকে নির্মম নির্দেশ ভেসে এল, সেক্ষেত্রে উপায় নেই। শেষ করে দাও। কুয়াশার কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই পাঠিয়ে দাও ব্যাটাকে যমের বাড়ি।
ট্যাক্সি ছুটছে। ব্যাকশীটে চুপচাপ বসে আছে ইউনুস আদাং। রীতিমত উত্তেজিত এবং নার্ভাস হয়ে পড়েছে সে ভিতরে ভিতরে। কুয়াশার মত পৃথিবী বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সে। ঘাবড়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। অতবড় একটা প্রতিভাতার সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হবে, কি ভাবে তাকে সম্মান জানাতে হবে–এই সব ঠিক করতে হিমশিম খাচ্ছিল সে। তাছাড়া বারবার সন্দেহ, হচ্ছিল তার-কুয়াশা কি সময় পাবেন তার মত মূল্যহীন একটা লোকের সঙ্গে দেখা করার?”
হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থামল ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, পৌঁছে গেছি! জানালা পথে বাইরে তাকাল ইউনুস আদাং। রাস্তার দু’পাশেই সারি সারি।
সুউচ্চ অট্টালিকা। ট্যাক্সি থেমেছে পাঁচ তলা একটা প্রকাণ্ড বিল্ডিংয়ের সামনে।
‘এই বিল্ডিংয়ের ওপরের তলায় কুয়াশার হেডকোয়ার্টার।’
ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নামল ইউনুস। এগিয়ে গেল সে সামনে।
পাঁচ তলায় ওঠার জন্য দুটো এলিভেটর আছে। একটি এলিভেটর ব্যবহার করে সকলে, অপরটি কুয়াশা একা। কিন্তু এলিভেটরের দিকে এগোল না ইউনুস।
সে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।
এক তলা, দুই তলা, তিন তলা… পাঁচ তলায় উঠল ইউনুস অবশেষে। চওড়া করিডর ধরে এগোল সে। কয়েকটা রূমের দরজা দেখল সে। কিন্তু থামল যে দরজার গায়ে ড. মনসুর আলী লেখা রয়েছে সেটার সামনে।
দরজার গায়ে একটা বোতাম দেখা যাচ্ছে। ইউনুস আদাং সেই বোতামটা চেপে ধরল।
কয়েক সেকেণ্ড পর খুলে গেল দরজা। দরজার সামনে দেখা গেল দীর্ঘকায় ঋজু, বলিষ্ঠ চেহারার একজন সুপুরুষকে। ইউনুস মুগ্ধ, সম্মোহিত হয়ে পড়ল যেন চেহারাটা দেখে। এমন স্বাস্থ্য, এমন রূপ–জীবনে দেখেনি সে। এই মানুষই যে পৃথিবী বিখ্যাত কুয়াশা তা তাকে বলে দিতে হলো না।
তবু পরিচয়টা জেনে নিতে চাইল ইউনুস, আপনি স্বনামধন্য কুয়াশা?’ কৃয়াশ বলল, আমি কুয়াশা।’
ইউনুস বলল, আমি টেকনাফ থেকে এসেছি আপনাকে একটা রহস্যময় ব্যাপারে।’
করিডরের প্রান্তে ক্লিক করে শব্দ হলো একটা। এলিভেটরের দরজা খুলে যাবার শব্দ ওটা। এলিভেটর থেকে করিডরে নামল জগদীশ। তার হাতের গিটারটা লম্বালম্বিভাবে ধরেছে সে, সোজা ইউনুসের দিকে, অনেকটা রাইফেল ধরার ভঙ্গিতে।
জগদীশ গিটারের তারে আঙ্গুল পেঁচিয়ে টান দিল । বিকট শব্দ হলো একটা। | জগদীশের গিটারটা আসলে মোটেই গিটার নয়। রাইফেলেরই রূপান্তরিত সংস্করণ ওটা।
পিঠে গুলি খেয়ে পড়ে গেল ইউনুস আদাং। হার্ট ভেদ করে গেছে বুলেট। সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছে তার।
চার
ইউনুস আদাং করিডরের উপর পড়ে যেতেই খুনী জগদীশ কুয়াশাকে দেখতে পেল । কুয়াশা দরজার ওপারে, কামরার ভিতর দাঁড়িয়ে রয়েছে। কালো আলখেল্লা ঢেকে রেখেছে তার সর্বাঙ্গ, শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। উন্নত ললাটে দু’একটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। এত বড় একটা ঘটনা চোখের সামনে ঘটে গেল–কিন্তু আশ্চর্য! কুয়াশার মধ্যে বিশেষ কোন চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে না।
খুনী জগদীশ লক্ষ করল কুয়াশা অনড় দাঁড়িয়ে থাকলেও তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাবার ভঙ্গির মধ্যে ভয়ঙ্কর একটা বিপদ যেন ওত পেতে রয়েছে। কুয়াশা নিরস্ত্র। জগদীশের হাতে রয়েছে মারাত্মক মারণাস্ত্র। কুয়াশা তাকে দেখে ফেলেছে–সুতরাং তার অপরাধের একমাত্র সাক্ষী সে। কুয়াশাকে মেরে ফেলতে পারে সে অনায়াসে।
এতসব কথা এক কি দুই সেকেন্ডের মধ্যে ভেবে নিল খুনী জগদীশ। গিটারটা আবার তুলল সে। গুলি করল।
পর পর চারটে গুলি ছুটে গেল কুয়াশার বুক বরাবর।
কিন্তু একি! একি জাদু! কুয়াশা এতটুকু নড়েনি, সেই আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। অথচ একটা বুলেটও তাকে স্পর্শ করেনি। দরজার কাছে গিয়ে বুলেটগুলো ছিটকে ফিরে আসছে।
করিডরে পড়ে রয়েছে বুলেটগুলো।
আবার গুলি করল জগদীশ। হাত কাঁপছে তার। সেই একই দশা হলো বুলেটগুলোর। দরজার কাছে অদৃশ্য কিছুতে বাধা পেয়ে ফিরে আসছে প্রত্যেকটি বুলেট, ছিটকে পড়ছে করিডরে।
ভয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে লাফ দিয়ে এলিভেটরের ভিতর ঢুকল জগদীশ। বন্ধ হয়ে গেল এলিভেটরের দরজা। পালাচ্ছে সে। জগদীশ অদৃশ্য হয়ে যেতেই কুয়াশা দীর্ঘ পদক্ষেপে কামরার টেবিলের সামনে গিয়ে দাতাল। ইন্টারকমের সুইচ অন করে বলল সে, করিডরে কি ঘটে গেল দেখেছ, ওমেনা?’
রাজকুমারী নয়, উত্তর দিল ডি. কস্টা, বলল, আমরা দুইজনই ডেকিয়াছি। রাজকুমারী ফলো করিয়াছেন মার্ডারারকে, হামিও যাইটেছি।’
দীর্ঘ পদক্ষেপে দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। সুইচ বোর্ডের গায়ে অসংখ্য বোম দেখা যাচ্ছে। একটা ধূসর রঙের বোতাম চেপে ধরল সে। সরে গেল কাঁচ, কোন শব্দ হলো না। কুয়াশা জানে, ব্রজার সামনের বুলেট প্রুফ কাঁচের দেয়ালের জন্য জগদীশের বুলেট আঘাত করতে পারেনি ওকে। কাঁচটা এমনই স্বচ্ছ যে আধহাত দূর থেকেও এটার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না।
দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল কুয়াশা। ইউনুস আদাং-এর মৃতদেহটা দুই হাত দিয়ে তুলে নিল বুকের কাছে। কামরার ভিতর, কার্পেটের উপর ধীরে ধীরে লাশটা শুইয়ে দিল। তারপর বন্ধ করে দিল দরজা।
ইউনুস আদাংয়ের দেহটা পরীক্ষা করল কুয়াশা। গুলি খেয়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে লোকটার। তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দশ টাকার নোটের কয়েকটা তোড়া বের করল কুয়াশা। কট্ট একটা গন্ধ ঢুকল নাকে। নাকের কাছে নোটের বাণ্ডিলগুলো ধরল সে।
গো-সাপের চামড়ার গন্ধ চিনতে পারল কুয়াশা। ইউনুসের হাতে ছিল কয়েকটা খবরের কাগজ। কাগজগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করল কুয়াশা। খবরের হেডিংগুলোর নিচে কলম দিয়ে দাগ দেয়া হয়েছে।
খবরটা এইভাবে ছাপা:
টেকনাফে রহস্যময় টর্নাডোয় এক ব্যক্তি নিহত আরদুন্না এমাম রাউ নামক এক স্বল্পশিক্ষিত টুরিস্ট গাইড গত তিন দিন আগে রহস্যময় কারণে মৃত্যুবরণ করেছে বলে জানিয়েছেন আমাদের স্থানীয় সংবাদদাতা। পুলিস কর্তৃপক্ষ সূত্রে প্রকাশ, অপরিচিত ধরনের ভয়ঙ্কর একটা টর্নাডো এমাম রাউয়ের দো-চালা বাড়িটাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে। সেই বাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায় এমাম রাউ। এমাম রাউয়ের নিকটবর্তী প্রতিবেশী ইউনুস আদাং আশ্চর্য ধরনের কিছু শব্দ শুনে গভীর রাতে অকুস্থলের দিকে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে সে দেখে দো-চালাটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। নাশটা সে আবিষ্কার করে ধ্বংস কূপের নিচে। ইউনুস আদাংয়ের ধারণা টুর্নাডো নয়; রাউয়ের মৃত্যুর জন্য অন্য কোন কারণ দায়ী। কিন্তু পুলিস কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে একমত নয়।
পুলিস সূত্রে আরও প্রকাশ, টুর্নাড়ো শুধু মাত্র দোচালাতেই আক্রমণ চালায়। আশে পাশের গাছ পালার একটি পাতাও খসে পড়েনি। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে টুর্নাডোই যে এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
এমাম রাউ টুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করলেও মাছ ধরার কাজও সে করত। টেকনাফ বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, কিছুদিন আগে সে প্রচুর পরিমাণে গো-সাপের চামড়া বিক্রি করে।
খবরটা পড়া শেষ করে কুয়াশা অনুমান করল টাকার বাণ্ডিলে যেহেতু গো সাপের চামড়ার গন্ধ রয়েছে সেইহেতু টাকাগুলো এমাম রাউয়ের হলেও হতে পারে।
টাকার বাণ্ডিলগুলো ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করল কুয়াশা। দেখা গেল ইউনুসের হাতের ছাপ রয়েছে নোটগুলোয়। কিন্তু তা খুব অল্প কয়েকটা নোটে। বেশিরভাগ নোটে পাওয়া গেল অন্য এক লোকের হাতের ছাপ। কুয়াশা অনুমান করল অন্য হাতের ছাপগুলো এমাম রাউয়ের হতে পারে।
ইউনুস আজই টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম শহরে এসেছে তা বোঝা গেল তার পকেটে পাওয়া কোচ সার্ভিসের টিকেট দেখে।
সেদিনের খবরের কাগজটা আবার একবার মেলে ধরল কুয়াশা। বড় বড় অক্ষরে লেখা বিজ্ঞাপনটা পড়ল।
এই বিজ্ঞাপন আগেও সে লক্ষ করেছে। দেশের প্রায় প্রত্যেকটি দৈনিক পত্রিকায় গত কয়েকদিন থেকে এই অদ্ভুত বিজ্ঞাপনটা ছাপা হচ্ছে। কে এই বিজ্ঞাপন প্রচার করছে, কেন করছে, কিছুই জানা যাচ্ছে না।
উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল সে।
পর পর কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা অফিসে ফোন করে বিশেষ কিছু জানতে পারল না কুয়াশা। জানা গেল, ডাকযোগে আসে বিজ্ঞাপনগুলো পত্রিকা অফিসে। ছাপা বাবদ খরচের টাকা অগ্রিম পাঠিয়ে দেয়া হয়। আরও জানা গেল, প্রত্যেকটি বিজ্ঞাপন এসেছে টেকনাফ থেকে। বিজ্ঞাপন দাতা তার নাম বা নির্দিষ্ট ঠিকানা জানাননি।
পাঁচ
ঘণ্টা দুয়েক পর প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। ওয়্যারলেস সেটের ভিতর থেকে ভেসে এল ডি. কস্টার সরু কণ্ঠস্বর, বস, আমি বহু ডুর হইটে কঠা বলিটেছি। মার্ডারারকে ফলো করিয়া হামরা রাঙ্গামাটি চলিয়া আসিয়াছি।’
কুয়াশা বলল, রাঙ্গামাটি? অতদূর? ঠিক কোথায়?
মিস ওমেনাকে রাখিয়া আসিয়াছি একটি পাহাড়ের উপর। হামি হাপনার জন্য উষা রোত ওয়েট করিটেছি।’
‘আসছি আমি।’
সেট অফ করে দিয়ে তৈরি হলো কুয়াশা। নিজের ব্যক্তিগত এলিভটরে চড়ে নিচে নামল সে। নিচে মানে, একেবারে আণ্ডার গ্রাউণ্ড, গ্যারেজে। সেখান থেকে নীল রঙের একটা ঝকঝকে মার্সিডিস নিয়ে বেরিয়ে গেল কুয়াশা শহরের রাস্তায়।
মার্সিডিস তুমুল বেগে ছুটে চলল রাঙ্গামাটির দিকে।
রাঙ্গামাটি পৌঁছুতে দেড় ঘন্টার মত লাগল কুয়াশার। উষা রোডে অপেক্ষা করছিল ডি. কস্টা। গাড়িতে তুলে নিল সে তাকে।
‘সিটে যাইটে হইবে, তারপর ডাইন ডিকে, টারপর বাম ডিকে, তারপর আবার ডাইন ডিকে এবং এগেন বাম ডিকে..
কুয়াশা বলল, ‘ক’মাইল?”
ডি. কস্টা বলল, দুই মাইল। মাই গড, বস, টপ ইমপরট্যান্ট কোশ্চেনটাই করিটে ভুলিয়া গিয়াছি। টিভিটে টো ডেকিলাম লোকটাকে মার্ডার করিল গিটারের মটো ডেকিটে রাইফেল ডিয়া । বাট হিস্টরিটা কি বলুন টো? দ্যাট আনলাকী ম্যান-সে মার্ডার হইল কেন-হোয়াই? বস্, ডাইন ডিকে টার্ন নিন।’
কুয়াশা বলল, মুখ বন্ধ করার জন্য খুন করা হয়েছে । আমার সন্দেহ, খুনী লোকটা ভাড়াটে । সেইজন্যেই ওকে আমি ধরবার চেষ্টা করিনি। যার হয়ে কাজ করছে তার কাছে পৌঁছুতে চেয়েছিলাম আমি। আপনারা অনুসরণ করে লোকটাকে যেখানে ঢুকতে দেখেছেন সেখানে নিশ্চয়ই লোকটার ওপরওয়ালাকে পাওয়া যাবে।
ডি. কস্টা জানতে চাইল, মার্ডার ম্যান হাপনাকে কিছু বলিটে আসিয়াছিল। কি বলিটে আসিয়াছিল?
‘গত কয়েকদিন থেকে খবরের কাগজগুলোয় যে রহস্যময় বিজ্ঞাপনগুলো বের হচ্ছে-লক্ষ করেছেন?
‘মাই গড! হাপনি বলিটে চাহিটেছেন, “ডানব হইটে সাবান?” “হুশিয়ার! ডৈট্য আসিটেছে,” “টেরর! দ্যাট ইজ হোয়াট দ্য মনস্টার ব্রিং’–এই সকল অ্যাডভার্টাইজমেন্টের কঠা?’
হ্যাঁ। সারা দেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে বিজ্ঞাপনগুলো। টেকনাফের পোস্ট অফিসের ছাপ পাওয়া গেছে এনভেলাপগুলোয়। তারমানে টেকনাফ থেকে ডাকযোগে এগুলো পত্রিকা অফিসে আসছে। যে লোকটা খুন হলো সে-ও টেকনাফের লোক।
টেকনাফের লোক! মাই গড! টাহলে এই বিজ্ঞাপনগুলোর সাঠে টার খুন হবার কানেকশান ঠাকিটে পারে-টাই না? বাট টেকনাফের এই লোক আপনাকে কি বলিটে আসিয়াছিল? বাম ডিকে।
সভবত এমাম রাউ নামের এক লোকের রহস্যময় মৃত্যু সম্পর্কে কিছু তথ্য জানাতে এসেছিল লোকটা। এমাম রাউ মারা গেছে টেকনাফে। পুলিস আর স্থানীয় সংবাদদাতাদের মতে রহস্যময় ধরনের একটা টুর্নাড়ের কবলে পড়ে এমাম রাউয়ের বাড়ি। সেই বাড়ি ধসে পড়ে, ধ্বংস্তূপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয় এমাম রাউ। আমাদের হেডকোয়ার্টারের করিডরে যে তোক খুন হয়েছে তার নাম ইউনুস আদাং। রাউয়ের মৃত্যু সম্পর্কে তার ধারণা ছিল অন্যরকম। টুর্নাডোর কবলে মারা গেছে রাউ-একথা সে বিশ্বাস করত না।
‘টুর্নাডো নয়টো কি? টার মটমট কি ছিল?
কুয়াশা বলল, তার মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ সে পায়নি।’
পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। পাহাড়ের ঢালু গায়ে ঝোঁপ-ঝাড় আর গাছপালা। নির্জন চারদিক। নিশ্চুপ।
ডি. কস্টার নির্দেশে গাড়ি থামাল কুয়াশা।
হাউ স্ট্রেঞ্জ। রাজকুমারীকে ডেকিটেছি না কেন! টাহাকে হামি এই জায়গায় রাখিয়া গিয়াছিলাম।
কুয়াশা গাড়ি থেকে নামল। বলল, জায়গা চিনতে ভুল হয়নি আপনার?
নো! মাই গড! হামার বাচ্চা শুটনিককেও ডেকছি না!
স্পটনিক ডি. কস্টার পোষা কুকুর। মাত্র তিন মাস বয়স পুটনিকের। ডি কস্টা বলল, রাজকুমারী নিশ্চয়ই বিপড়ে পড়িয়াছেন! টাহাকে মুষ্ট করিটে ছুটিয়া গিয়াছে হামার পুটনিক!
এমন সময় দেখা গেল রাজকুমারী একটা পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে। দ্রুত হাঁটছে সে। দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে, হাপাচ্ছে। তার বুকের কাছে দেখা যাচ্ছে স্পুটনিককে।
কাছে এসে রাজকুমারী ছুঁড়ে ফেলে দিল স্পুটনিককে। ঝাঁঝাল গলায় বলে উঠল, মি. ডি. কস্টা, এরপর যদি আপনি আপনার স্পুটনিককে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বের হন, তার ফল ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। বাব্বা! আপনি চলে যাবার পর সেই যে ছুটোছুটি শুরু করেছে, থামায় কার সাধ্যি! | ডি. কস্টা আদর করে শুটনিককে কোলে তুলে নিল। বলল, ছোট্ট বাচ্চা, খেলাটুলা টো করিবেই। ও কি আর হামাডের মটো বড় হইয়াছে? বড় হইলে এটো ডুষ্টার্মি করিবে না।
রাজকুমারী বলে উঠল, ‘আপনার কুকুর, আপনিই সামলে রাখুন। দয়া করে আমার দায়িত্বে ওকে আর কখনও রেখে যাবেন না।’
কুয়াশা ওদের কথা শুনছিল না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে পাহাড়গুলো দেখছিল সে। রাজকুমারীর দিকে তাকাল এবার। জানতে চাইল, বাড়ি ঘর তো কোথাও দেখছি না? ডি কস্টা বলে উঠল, ‘এখান হইটে ডেকা যাইবে না। হামাডেরকে হাঁটিটে হইবে খানিকটা।’
হাঁটতে শুরু করল ওরা।
রাজকুমারী বলল, কুয়াশা, খুনী নোকটা আশ্চর্য একটা জায়গায় গিয়ে ঢুকেছে।
ডি. কস্টা বলল, ‘প্রকাণ্ড একটা পাহাড়ের উপর চল্লিশ ফুট টল একটা পাচিল…।
রাজকুমারী বলল, “খুবই অবাক কাণ্ড। পাহাড়ের উপর অত উঁচু পাঁচিল তৈরি করার কি কারণ বুঝতে পারলাম না।’
কুয়াশা বলল, চল্লিশ ফুট উঁচু পাচিল?’
রাজকুমারী বলল, ‘বেশি হবে, কম তো নয়ই। পাচিল ঘেসে গোটা এলাকাটা ঘুরেছি। গেটটা পাহাড়ের অপর দিকে। একটা রাস্তাও নেমে গেছে। আরও অবাক কাণ্ড, গেটটা পাচিলের চেয়েও উঁচু এবং মনেহয় দশ টনের কম ওজন হবে না। স্টিলের মোটা পাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বাইরে থেকে খোলার কোন উপায় নেই।’
কুয়াশা জানতে চাইল, ‘পাচিলের ওপারে কি আছে তা বোধহয় দেখার চেষ্টা করোনি?
ডি. কস্টা বলল, ‘না। আপনার জন্য ওয়েট করাই হইবে বুডিচমানের কাজ ভাবিয়া.. ওই যে, ওই যে ডেকা যায় পাহাড়টা!
দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে পাহাড়টা আর সবগুলোর চেয়ে বড়। পাহাড়ের গায়ে এবং মাথায় ঝোঁপ-ঝাড়। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য গাছ। পাহাড়টার উপর যে চল্লিশ ফুটে উঁচু পাঁচিল আছে তা বিশ্বাস করা কঠিন।
ঢালু গা বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে ওরা। কুয়াশার দু’পাশে ডি. কস্টা আর রাজকুমারী।
পাহাড়ের উপর উঠল ওরা। পাচিলটা দেখতে পেল কুয়াশা। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল সে। কংক্রিটের পাচিল। পাচিলের উপর কাঁটাতারের বেড়া–সেটাও হাত তিনেক উঁচু হবে।
খুবই রহস্যময় বলে মনে হলো ব্যাপারটা। জায়গাটাকে এমন দুর্ভেদ্য দুর্গের মত করে ঘিরে রাখার কারণ কি?
‘গেটটা কোন্ দিকে? গেট কি এটাই? |
রাজকুমারী বলল, “একটাই। সেটা ঠিক উল্টো দিকে। গেটের কাছে গিয়ে লাভ নেই। ভিতরে ঢুকতে হলে পঁচিল টপকাতে হবে। এখান থেকেই তা করা যেতে পারে।’
চুপ।
কান পাতল কুয়াশা। সাধারণ মানুষের চেয়ে তার শ্রবণ শক্তি অনেক প্রখর।
মিনিট খানেক চুপচাপ কান পেতে রইল কুয়াশা। তারপর বলল, ভিতরে কি যে আছে ঠিক বলতে পারছি না। তবে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পাচ্ছি আমি। অস্বাভাবিক দীর্ঘ নিঃশ্বাস। কোন মানুষ অত বড় নিঃশ্বাস ফেলে না।
মানুষের নিঃশ্বাস নয়। তাহলে কিসের?
উত্তর না দিয়ে আলখেল্লার পকেট থেকে আঙুলের মত সরু নাইলনের কর্ড বের করল কুয়াশা। কর্ডের একপ্রান্তে একটা হক। সেটা পাঁচিলের মাথার দিকে ছুঁড়ে দিল সে।
কাঁটা তারে গিয়ে আটকে গেল হুকটা। সরু কর্ড ধরে উপরে উঠতে শুরু করল কুয়াশা।
পঁচিলের মাথার কাছে কুয়াশার মাথা পৌঁছুল। মাথা তুলল না সে আর । পাচিলের ওপারে কেউ আমেয়াস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে কিনা কে জানে। উঁকি দিল কুয়াশা।
পাচিলের ওপারের দৃশ্যটা এমনই অস্বাভাবিক যে স্বয়ং কুয়াশারই বেশ কয়েক মূহুর্ত সময় লাগল বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে।
*
পাচিলের ঠিক নিচেই অস্বাভাবিক মোটা স্টীলের জাল। গোটা জায়গাটাকে তিন ইঞ্চি মোটা জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। দেখেই বোঝা যায় ইলেকট্রিফায়েড। জায়গাটার এক প্রান্ত য়েকে অপর প্রান্ত অবধি লম্বা লম্বি ভাবে ঝুলছে মোটা কেবল, তার উপর আড়াআড়ি ভাবে দুই হাত পর পর একই ধরনের, তিন ইঞ্চি মোটা স্টীলের পাত ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। চারকোনা ফাঁক বিশিষ্ট জালটা গোটা এলাকাটার উপর ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে।
জালের নিচে, অনেকটা নিচে, একটা মস্ত বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়িটা দোতলা। ছাদটা প্রায় জালের কাছাকাছি পৌঁছেছে। বাড়িটা দুই ভাগে বিভক্ত। দুই ভাগের মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা আপাদমস্তক ঢাকা সুড়ঙ্গ বা প্যাসেজ দেখা যাচ্ছে।
বাড়ির একটা অংশে কামরার সংখ্যা কম করেও গোটা বিশেক তো হবেই। দ্বিতীয় অংশটা অদ্ভুত ধরনের। প্রকাণ্ড একটা কংক্রিটের বাক্সের মত দেখতে। না। আছে জানালা, না আছে ভেন্টিলেটার। দরজা থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু তা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না ।
নিচের দিকে তাকিয়ে কুয়াশা দেখল চারদিকে উঁচু-নিচু, ছোট-বড় নানা সাইজের ঝোঁপ-ঝাড়ে ভর্তি বাড়িটার যত্ন নেওয়া হয়নি অনেকদিন, বোঝা যায়।
বাড়িটার প্রথম অংশের নিচ তলাটা শক্ত পাথর দিয়ে তৈরি। উপরের অংশটা মজবুত কাঠের। কিন্তু বাক্সের মত দেখতে দ্বিতীয় অংশটা সম্পূর্ণ পাথরের।
কুয়াশা আলখেল্লার পকেট থেকে একটা যন্ত্র বের করল। যন্ত্রটা সঁড়াশির মত দেখতে। সেটা কাঁটাতারের গায়ে ঠেকাতেই নিচে কাঁচের বালবটা জ্বলে উঠল।
কাটাতারের বেড়ায় বিদ্যুৎ রয়েছে। স্পর্শ করা মাত্র নির্ঘাৎ মৃত্যু। যন্ত্রটা দিয়ে কাটাতার কাটতে শুরু করল কুয়াশা।
বেশ খানিকটা কাটা হলো। পাঁচিলের উপর উঠে এক পাশে সরে দাঁড়াল কুয়াশা। নাইলনের কর্ড বেয়ে উঠে এল রাজকুমারী। তারপর ডি কস্টা।
মাই গড! রাজকুমারী বলল, কল্পনা করা যায় না, তাই না কুয়াশা? এত মোটা স্টীলের জাল-কারণ কি?
ডি. কস্টা বলল, হামার সন্দেহ, এই স্থানে যাহারা ঠাকে টাহারা ক্রিমিন্যাল। ইনোসেন্ট মানুষডেরকে ধরিয়া বণ্ডি করিয়া রাখে। বণ্ডিরা যাহাটে ভাগিটে না পারে টাহার জন্য ইলেকট্রিফায়েড এটো মোটা স্টীলের নেট ডিয়া ঘিরিয়া রাখিয়াছে।
কুয়াশা বলল, না। তারগুলো অত ঘন সন্নিবেশিত নয়, দেখতে পাচ্ছেন না? চারকোনা ফাঁকগুলোর আকার দেখতে পাচ্ছেন? অনায়াসে একজন মানুষ গলে আসতে পারে।
তাহলে…
রাজকুমারীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কুয়াশা বলল, আমার মনে হয় মানুষ নয়, মানুষের চেয়ে অনেক বড় কোন প্রাণীকে বাধা দেবার জন্য এই তারের ব্যবস্থা।
মানুষের চেয়ে অনেক বড়! কি সেই প্রাণী?’ | রাজকুমারীর প্রশ্নের উত্তর দিল না কুয়াশা। প্রসঙ্গ বদলে সে বলল, মি. ডি. কস্টা, লাফ দিয়ে চারকোনা ফাঁক দিয়ে গলে বিল্ডিংটার ছাদে নামতে পারবেন?’
নো…আই মীন…নো, বস-হামি পারিবে না।’ রাজকুমারী জানতে চাইল, ইলেকট্রিফায়েড কিনা পরীক্ষা করে দেখলৈ হয় না?’
কুয়াশা বলল, ‘পরীক্ষা না করেও অনুমানে বোঝা যাচ্ছে হাই-ভোল্টেজ ইলেকট্রিক কারেন্ট চলাচল করছে তারগুলোয়।’
পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের লম্বা পেন্সিল বের করল কুয়াশা । পেন্সিলের মাথাটা গোলাকার। সেটা ধরে টানতে শুরু করল সে। পেন্সিলের ভিতর থেকে সড় সড় করে বেরিয়ে আসতে লাগল সরু ইস্পাতের তার।
সেই তার নামিয়ে দেয়া হলো নিচে । জালের গায়ে ইস্পাতের তার স্পর্শ করা মাত্র অত্যুজ্জ্বল নীল অগ্নিশিখা দেখা গেল।
কুয়াশা তুলে নিল ইম্পাতের তারা বলল, মৃত্যু-জাল। ডি,. কস্টা জানতে চাইল, কি করিটে চান, বস? বিল্ডিংয়ের ছাডে নামিবেন?”
রাজকুমারী বলে উঠল, ‘বোকার মত প্রশ্ন করবেন না। একজন খুনী এই বিল্ডিংয়ের ভিতর লুকিয়ে আছে। তাকে ফলো করে এসেছি আমরা। নিশ্চয়ই ইলেকট্রিফায়েড তারের জাল দেখে ভয়ে পালিয়ে যাবার জন্য আসিনি। লোকটাকে চাই আমরা।’
কুয়াশা বলল, মি. ডি. কস্টা, আপনার স্পুটনিককে আপনি ভাল করে ধরুন বুকের সঙ্গে। আপনার কোমর ধরে আমি আপনাকে শূন্যে তুলে ধরব, সিধে করে রাখবেন দেহটা, আমি ছুঁড়ে দেব আপনাকে। ভয় নেই, হিসেব করে এমন ভাবে ছুঁড়ব আমি আপনাকে যে চারকোনা ফাঁক দিয়ে চলে যাবেন, তারে লাগবে না শরীর।’
আতঙ্কে নীল হয়ে গেল ডি কস্টার মুখের চেহারা। কি যেন বলতে চাইল সে, কিন্তু কুয়াশা তাকে সে সুযোগ দিল না। ডি. কস্টার কোমর দুই হাত দিয়ে ধরে শনে তুলল, লক্ষ্য স্থির করল গভীর মনোযোগের সঙ্গে, তারপর সজোরে ছুঁড়ে দিল জালের চারকোনা একটা ফাঁকের দিকে।
গাছের একটা লম্বা কাণ্ডের মত চারকোনা ফাঁক দিয়ে চলে গেল ডি. কস্টা। জালের মোটা তার তাকে স্পর্শ করল না। অব্যর্থ লক্ষ্য কুয়াশার। ডি. কস্টা খাড়াভাবে গিয়ে নামল ছাদের উপর। দেখা গেল বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসছে সে।
‘ফর গডস সেক! হামি বাঁচিয়া আছি!’
একই পদ্ধতিতে রাজকুমারীকে ছুঁড়ে দিল কুয়াশা। কোন দুর্ঘটনা ঘটল না। সবশেষে বাদুড়ের মত শূন্যে উড়ল কুয়াশা। পাখি যেমন উড়তে উড়তে তার ডানা শরীরের সঙ্গে সাটিয়ে নেয়, তেমনি ভাবে দেহের দুপাশে হাত দুটো লম্বা করে সঁটিয়ে নিল সে, ফাঁক গলে নিখুঁত ভঙ্গিতে নেমে গেল। কয়েক সেকেণ্ড মাত্র, তারপরই দেখা গেল সে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডি. কস্টা ও রাজকুমারীর মাঝখানে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে এদিক-ওদিক তাকাল ওরা। ছাদ থেকে নামতে হবে,’ বলল রাজকুমারী।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল ডি. কস্টা। একই সঙ্গে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে আনল। দেখা গেল তার হাতে একটা কালো চকচকে রিভলভার।
মাই গড! বস্, রাইফেল! কিন্তু কোথায় কুয়াশা!
ডি. কস্টা বিল্ডিংয়ের সর্ব দক্ষিণের একটি কামরার জানালার দিকে রিভলভার তুলল।
গুলি করার আগেই গর্জে উঠল বিকট শব্দে একটা রাইফেল।
কুয়াশা ওদের অজ্ঞাতেই ছাদ থেকে নেমে পড়েছিল ইতিমধ্যে। বুক সমান উঁচু ঝোঁপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখে নিচ্ছিল সে। ডি, কস্টার চেয়েও আগে সে দক্ষিণ দিকের জানালার সামনে দাঁড়ানো রাইলেফধারী লোকটাকে দেখেছে। লোকটা তাকে লক্ষ্য করেই রাইফেল তাক করছে তা বুঝতে পেরেই বিদ্যুৎবেগে লাফ দিয়ে সরে গেছে সে। বুলেটটা ছুটে গেল, কুয়াশা যেখানে এক সেকেণ্ড আগে দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেই জায়গা দিয়ে। এক সেকেণ্ড দেরি হলেই মহা সর্বনাশ ঘটে যেত । বুলেট সরাসরি প্রবেশ করত কুয়াশার মাথায়। একটা পাঁচিলের আড়ালে চলে গেল কুয়াশা।
রাইফেলের শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই গর্জে উঠল ডিকস্টার রিভলভার। পরপর দুবার গুলি করল সে। কিন্তু জানালার সামনে থেকে সরে গেছে লোকটা। রাইফেলের ব্যারেলটাও আর দেখা যাচ্ছে না।
রাজকুমারী বলে উঠল, “এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মরতে হবে। মি. ডি. কস্টা, লাফ দিয়ে নামতে হবে।’
‘ওরে বাপরে! ইমপসিবল! ক্রমশ ঢালু হয়ে গেছে ছাদটা। কিনারায় দাঁড়িয়ে আঁতকে উঠল ডি. কস্টা।
রাজকুমারী চটে উঠল। বলল, ন্যাকামি করছেন কেন? এর চেয়ে উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়েছেন আপনি বহুবার।
মাফ চাই, রাজকুমারী! প্লীজ। হামি পারিব না…
রাজকুমারী কথা না বলে ডি. কস্টাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে সহ লাফ দিল নিচের দিকে।
দুজনই সশব্দে ঝোঁপের উপর নামল। এক গাল হেসে ডি. কস্টা বলল, হাপনার কোলে চড়িয়া নামিলাম-এইটুকুই আনন্দ।
স্পুটনিক হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “ঘেউ! রাজকুমারী হেসে উঠল। বলল, মি. ডি. কস্টা, স্পুটনিক কি বলতে চাইছে বুঝতে পারছেন?
কি?’
‘ও বলতে চাইছে আপনি একটা পুরুষ, ভীতুর ডিম!’ গম্ভীর হয়ে উঠল ডি. কস্টা।
কুয়াশা বলল, “ভিতরে ঢুকতে হবে, ওমেনা। অন্য কোন জানালা থেকে গুলি করতে পারে লোকটা আবার।’
“চিনতে পেরেছ লোকটাকে?’
কুয়াশা বলল, “পেরেছি। এই লোকই ইউনুস আদাংকে খুন করে এসেছে।’
নিকটবর্তী একটা জানালার কবাট খোলা দেখে সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। লোহার, শিকগুলো কলের পাইপের মত মোটা। দুই হাত দিয়ে ধরে টান মারতে লাগল কুয়াশা সেগুলো। তিনটে লোহার শিক টেনে খুলে ফেলল ফ্রেম থেকে। একটা মানুষ যাবার মত ফাঁক হলো। জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকল সে। তার পিছু পিছু ভিতরে ঢুকল রাজকুমারী এবং ডি. কস্টা।
কামরাটা বিরাট। চামড়া দিয়ে মোড়া বেশ কয়েকটা চেয়ার রয়েছে। আলমারি এবং সোফাগুলো দেখে মনে হয় বহুকালের পুরানো। ফার্নিচার এবং মেঝেতে ধুলোর পাতলা স্তর চোখে পড়ে। যেন অনেকদিন থেকে এই কামরা ব্যবহার করা হয় না।
একটা দরজা খুলল কুয়াশা। চওড়া একটা করিডরে বেরিয়ে এল সে নিঃশব্দ পায়ে। বিনাবাক্যব্যয়ে অনুসরণ করছে তাকে তার সহকারী এবং সহকারিণী।
কেউ কোথাও নেই। কোন শব্দও ঢুকছে না কানে।
যে কামরা থেকে রাইফেলের গুলি ছোঁড়া হয়েছিল সেই কামরায় প্রবেশ করল কুয়াশা। বারুদের গন্ধ এখনও ভাসছে কামরার বাতাসে। কিন্তু রাইফেল বা রাইফেলধারী নেই এখানে। উচ্চ শক্তি সম্পন্ন কাট্রিজের একটা শেল পড়ে রয়েছে মেঝেতে।
*
সিঁড়ির দিক থেকে মৃদু খসখসে একটা শব্দ ভেসে এল। কুয়াশা দীর্ঘ পদক্ষেপে কামরা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল।
কাঠের সিঁড়ি, কিন্তু লাল কার্পেটে মোড়া ধাপগুলো। পা ফেললেই ধুলো উড়ছে।
উপরে উঠে একটা করিডর দেখল ওরা। দু’পাশে অনেক দরজা। প্যাসেজও চলে গেছে দুদিকে অনেকগুলো।
তিনজন হাঁটছে করিডর ধরে। একটার পর একটা দরজা পেরিয়ে যাচ্ছে ওরা।
ওদের ঠিক পিছনের বন্ধ দরজাটা খুলে গেল নিঃশব্দে। প্রথমে বেরিয়ে এল একটা রিভলভারের নল। তারপর রিভলভারধারী যুবতী মেয়েটিও দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে এল করিডরে।
তীক্ষ কণ্ঠে হুকুম করল মেয়েটি, সাবধান! মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও সবাই।
ছয়
মেয়েটির কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি এখনও বাতাসে ভাসছে, কুয়াশা তার বিশাল দেহটাকে ঘূর্ণিঝড়ের মত তীব্র বেগে নিক্ষেপ করল পিছন দিকে। কোথা থেকে কি হয়ে গেল টেরই পেল না মেয়েটি, কুয়াশার দেহটা তার শরীরের একপাশে ধাক্কা মারল। ছিটকে তিন হাত দূরে গিয়ে পড়ল সে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে করিডরের মেঝেতে উঠে বসল, দেখল তার হাত থেকে খসে পড়া রিভলভারটা তুলে নিয়ে ঋজু ভঙ্গিতে পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে আছে কালো আলখেল্লা পরিহিত একজন পুরুষ।
কুয়াশা জিজ্ঞেস করল, কে তুমি? ‘রাজকুমারী এবং ডি. কস্টা মেয়েটির দু’পাশে এসে দাঁড়াল। মেয়েটির পোশাক দেখে অবাকই হয়েছে ওরা দুজন।
নীল প্যান্ট এবং লাল শার্ট পরে আছে মেয়েটি। মাথায় ইস্পাতের তারের তৈরি নেট। পায়ে হাঁটু অবধি লম্বা জুতো। কাঁধে ঝুলছে একটা ব্যাগ।
আমার নাম লাকী তরফদার।’
লাকীর চোখে মুখে ভয়ের ছাপ পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। কুয়াশা দ্বিতীয় প্রশ্ন করার আগেই আবার মুখ খুলল, ‘আপনারা কে?’
কুয়াশা তীক্ষ্ণ চোখ লক্ষ করছিল মেয়েটিকে। ভয়ে কাঁপছে মেয়েটি। ঢোক গিলছে ঘন ঘন।
‘আমি কুয়াশা। এরা আমার বন্ধু-বান্ধব। তোমার সম্পূর্ণ পরিচয় দাও।
মেয়েটি বলল, ‘কুয়াশা! আ-আপনি কুয়াশা! হায় খোদা… কী আশ্চর্য! আপনাকে দেখার সুযোগ পাব তা স্বপ্নেও ভাবিনি…! আ-আমি মিরাকল সার্কাস এ চাকরি করতাম। বুনো সিংহ, বাঘ, ভাল্লুক, বনমানুষ-এই সব প্রাণীকে পোষ মানাবার জন্য ট্রেনিং কোর্স শেষ করেছি আমি। বর্তমানে বেকার–মিরাকল সার্কাস পার্টি ভেঙে যাবার পর থেকেই চাকরির সন্ধানে ঘুরছি। এখানে এসেছি চাকরির আশাতেই।
মিরাকল সার্কাস পার্টিতে চাকরি করতে তুমি? মেয়েটি বলল, হ্যাঁ। কিন্তু পার্টিটা টাকার অভাবে ভেঙে যায়… টেকনাফে এই পার্টি খেলা দেখিয়েছিল কিনা জানো?’ “জানি না মানে! ওখানে খেলা দেখাতে দেখাতেই তো পার্টির লাল বাতি জ্বলে। সেই থেকে বেকার আমি।’ বাধা দিয়ে কুয়াশা জানতে চাইল, টেকনাফের একজন লোক তার নাম ইউনুস আদাং, চেন লোকটাকে? কিংবা এমাম রাউ নামে কাউকে?
না তো। | ডি. কস্টা শুটনিককে বুকের কাছ থেকে নামিয়ে দিল মেঝেতে। বলল, বাবা শুটনিক, যাও টো, ঘুরে ডেকে আসো টো খুনী ব্যাটা কোঠায় কি করিটেছে। ব্যাটার ছায়া ডেকিটে পাইলেই ঘেউ ঘেউ করিয়া সিগন্যাল ডিও।
শুটনিক ডি. কস্টার কথা বোঝে বলে মনে হলো। ছুটল সে চার পায়ে। দেখতে দেখতে একটা প্যাসেজে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
মেয়েটি যে কামরা থেকে বেরিয়েছিল সেটার ভিতর প্রবেশ করুল কুয়াশা । এটা একটা শয়নকক্ষ। খাটের উপর না আছে তোষক না আছে চাদর-বালিশ। সবখানে ধুলো-ময়লা দেখা যাচ্ছে। পর্দাহীন একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা।’
দূরে দেখা গেল বিল্ডিংয়ের গেটটা। সেদিকে নজর রেখে কুয়াশা বলল, তুমি এখানে কিভাবে এলে?
লাকী বলল, একটা চাকরির বিজ্ঞাপন দৈনিক পত্রিকায় দেখে দরখাস্ত করেছিলাম। সেই দরখাস্তের উত্তরে এই জায়গায় আসতে বলা হয়েছিল আমাকে টেলিগ্রাম করে। দরখাস্ত আহ্বানের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল চাকরি প্রার্থীকে বনমানুষের দুর্বোধ্য ভাষা বোঝবার এবং উচ্চারণ করবার যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে।’
কুয়াশা জানতে চাইল, তুমি বনমানুষের ভাষা বোঝো?
অল্প স্বল্প বুঝি। মিরাকল সার্কাস পার্টিতে তিনটে বনমানুষ ছিল। ওদের ভাষা আমি বুঝতাম।
‘কোত্থেকে আসছ তুমি?
লাকী বলল, ‘সার্কাসের চাকরি চলে যাবার পর আমি টেকনাফেই একটা হোটেলে ছিলাম। আজই আমি রাঙ্গামাটিতে পৌঁছেছি। চট্টগ্রাম শহরে একটা কাজ ছিল, সেখান থেকে বাসে এসেছি এখানে।
টেলিগ্রাম করে এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছে তোমাকে। দেখি স্টো।’
ব্যাগ থেকে টেলিগ্রামের কাগজটা বের করে দিল লাকী। কুয়াশা সেটা পড়ল। টেলিগ্রামটা নিম্নরূপ:
মিস লাকী তরফদার,
কেয়ার অব গাইড হোটেল। চাকরি হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসুন। রাঙ্গামাটির তালি পাহাড়ের উপর আমার অফিস।
সৈয়দ ইমদাদুল কবীর।
টেলিগ্রামটা ফেরত দিয়ে কুয়াশা জানতে চাইল, এই জায়গাটা তাহলে সৈয়দ ইমদাদুল কবীরের?
‘ট্যাক্সি ড্রাইভার তো তাই ব্ললেছে আমাকে।
বস, নামটা কিন্টু পরিচিট মনে হইটেছে।’
কুয়াশ বলল, স্বাভাবিক। ভদ্রলোক সমুদ্রগামী একটা শিপিং কোম্পানীর মালিক। বিরাট ধনী। বহুলোক তাকে চেনে।
লাকী বলল, এখানে আসার পর কয়েকজন লোক কথা বলেছে আমার সঙ্গে। ইমদাদুল কবীর সাহেব কোথায়, কখন আসবেন–আমার এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বাড়ির এদিক-ওদিক হঠাৎ ছুটোছুটি শুরু করে দেয় ওরা। আমি একা বসে থাকি, তারপর…’
কুয়াশা বাধা দিয়ে জানতে চাইল, ‘তোমাদের সার্কাস পার্টিতে তিনটে বনমানুষ ছিল, বলেছ। সেগুলো এখন কোথায়?
বলতে ভুলে গেছি-বনমানুষ তিনটে সার্কাস বন্ধ হয়ে যাবার পর হঠাৎ একদিন গায়েব হয়ে যায়। মানে, হারিয়ে যায়। শুনেছিলাম টেকনাফ শহরের এখানে সেখানে তাদেরকে দুএকদিন দেখা গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কোন সন্ধান মেলেনি।
কত দিন আগের কথা? তা… বেশ কিছুদিন তো হবেই।
কুয়াশা জানালা পথে আঙুল দিয়ে বিল্ডিংটার মাথার উপরকার মোটা তারের জাল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এসব কি? জানো কিছু?
লাকী বলল, “কিছুই বুঝতে পারছি না। জায়গাটা কেমন যেন–এখানে ঢোকার পর থেকেই ভয়ে আধমরা হয়ে আছি!
‘ফর ল্ডস সেক! হামার স্পুটনিকের বিপড় হইয়াছে! প্রায় আর্তনাদ করে উঠল ডি. কস্টা।
‘থামো! ধমকে উঠল রাজকুমারী। কুয়াশার উদ্দেশে ঘাড় ফেরাল সে। কিন্তু আশ্চর্য! কামরার ভিতর কোথাও নেই সে। সকলের অজ্ঞাতে বেরিয়ে গেছে কখন।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে কুয়াশা নিচ তলায়। লাইব্রেরীর মত একটা কামরায় ঢুকে টেবিলের উপরকার কাগজপত্র পরীক্ষা করছে সে। মেঝেতেও পড়ে রয়েছে চিঠিপত্র, এনভেলাপ, ছেঁড়া টেলিগ্রাম ইত্যাদি।
বিভিন্ন জায়গা থেকে চিঠি, টেলিগ্রাম এসেছে। সবই সৈয়দ ইমদাদুল কবীরের নামে। বেশির ভাগ চিঠিপত্রই ‘ফ্রেণ্ড শিপিং কোম্পানী সংক্রান্ত।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার বোঝা গেল। সৈয়দ ইমদাদুল সাহেব কোম্পানীর অফিসে সশরীরে দীর্ঘ দিন উপস্থিত হননি। ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব তিনি চিঠিপত্রের মাধ্যমে পালন করেছেন। কারণ অবশ্য জানা গেল না।
*
লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে একের পর এক কামরায় ঢুকে কামরাগুলো পরীক্ষা করতে লাগল কুয়াশা। কিচেন এবং প্যাট্রিতে ঢুকে অবাক হলো সে। খাদ্য দ্রব্যের। পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশি। চাল, ডাল, শুঁটকি মাছ–বস্তা বস্তা রয়েছে। দুটো প্রকাণ্ড আকারের চুলো দেখা গেল। হাড়ি পাতিল নেই, বদলে বড় বড় ডেক রয়েছে।’
কিচেনের মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে কান ঠেকাল কুয়াশা কাঠের মেঝেতে।
ভুরু কুঁচকে উঠল তার। অস্বাভাবিক দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ পেল সে। কোন মানুষ এমন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে না।
এই রহস্যময় বাড়িটার কোথাও না কোথাও মৃত্যু ওত পেতে আছে। সেই ভয়ঙ্কর বিপদকে দেখা না গেলেও, অনুভব করতে পারছে কুয়াশা।
শুটনিকের ঘেউ ঘেউ শব্দও পেল কুয়াশা। শব্দটা আসছে যেন নিচের দিক থেকে।
একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। জানালা পথে দেখা যাচ্ছে বিল্ডিংটার প্রকাণ্ড গেট। গেটের গায়ে বড় বড় যন্ত্রপাতি ফিট করা। স্বয়ংক্রিয় গেট, মেশিনের সাহায্য খোলা বা বন্ধ করা হয়।
গেটের কাছ থেকে গাড়ির চাকার দাগ সোজা চলে গেছে বিন্ডিংটার দ্বিতীয় অংশে–যে অংশটা পাথরের প্রকাণ্ড বাক্সের মত দেখতে।
দরজা দিয়ে যেতে ঘুরতে হবে অনেক, কুয়াশা তাই জানালার শিক তুলে ফেলল ফ্রেম থেকে মাথা বের করে বাইরেটা দেখে নিল সে ভাল করে। তারপর দেহটা গলিয়ে মাটিতে নামল।
প্রকাণ্ড পাথরের বাক্সটার চারদিকে চক্কর মারল সে। দরজা মাত্র একটা। আকারে প্রকাণ্ড । কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মেরে পরীক্ষা করল কয়েকবার। ভাঙা তো দূরের কথা, দরজাটাকে নড়ানোই গেল না। দরজার গায়ে কান ঠেকিয়ে শব্দ পাওয়া যায় কিনা পরীক্ষা করল সে।
কোন শব্দ নেই। তবে দূর থেকে যেন ভেসে আসছে সেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস পতনের শব্দ। | ফিরে এল কুয়াশা। জানালা গলে কিচেনে ঢুকল আবার। সেখান থেকে একের পর এক বাকি কামরাগুলোয় ঢুকে পরীক্ষা করতে লাগল। শুটনিকের কাতর কণ্ঠের চিৎকার এখনও শোনা যাচ্ছে। একনাগাড়ে চিৎকার করে চলেছে সে। বহু নিচে থেকে উঠে আসছে শব্দটা।
বিল্ডিংয়ের নিচে পাতালপুরী আছে, কুয়াশা বুঝতে পারল। পাতালপুরীতে নামার জন্য নিশ্চয়ই গোপন পথ আছে, সেই পথের সন্ধানে এ কামরা থেকে সে কামরায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।
এদিকে, দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝখানে ডি. কস্টা এবং রাজকুমারী তর্ক জুড়ে দিয়েছে।
ওদের কথাবার্তা শুনে কুয়াশা বুঝতে পারুল লাকীকে দোতলায় রেখে নেমে আসছে ওরা। ভারি গলায় ওদের উদ্দেশে কুয়াশা বলে উঠল, “নিচে নেমো না, ওমেনা। তোমরা লাকীর সঙ্গে থাকো।’
দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সিঁড়িতে। উপর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আশ্চর্য সব শব্দ। পরস্পরের দিকে বোকার মত তাকিয়ে রইল ডি, কস্টা ও রাজকুমারী । দোতলার কোথাও কে বা কারা যেন কাঠের পাটাতনে চাপ দিয়ে মড় মড় করে ভেঙে ফেলছে।
ছুটল ওরা সিঁড়ির মাথার দিকে। পরমুহূর্তে থমকে দাঁড়াল আবার। বিকট শব্দে ভাঙতে শুরু করেছে কাঠের খুঁটি, পাটাতন, ফ্রেম।
ভূমিকম্প বলেও তো মনে হচ্ছে না!’
আবার ছুটল ওরা। করিডরে উঠল দুজন। দেখল ওদের কাছ থেকে দশ পনেরো হাত সামনে, করিডরে কাঠের মেঝে উঁচু হয়ে আছে এক জায়গায়। ক্রমশ উঁচু হচ্ছে মেঝেটা। সেই সঙ্গে ফেটে যাচ্ছে চার ইঞ্চি মোটা তক্তা, ভেঙে যাচ্ছে। প্রচণ্ড একটা দানবীয় শক্তি যেন নিচ থেকে ধাক্কা মারছে মেঝের গায়ে।
লাকী ছুটে বেরিয়ে এল একটা কামর থেকে। দুই চোখে আতঙ্ক তার। কিন্তু ধমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো তাকে। মেঝেটা উঁচু হয়ে উঠতে উঠতে মড় মড় শব্দে ভেঙে যাচ্ছে। ছিটকে পড়ছে বড় বড় পেরেক, ভাঙা কাঠের টুকরো । মেঝেটা দফাঁক হয়ে গেল।
পলকের জন্য একটা হাত দেখতে পেল রাজকুমারী। হাতটা ডি. কস্টার চোখেও পড়ল। নিচের দিক থেকে হাতটা দোতলার মেঝের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলছে কাঠের পাটাতন!
দানব!
স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে ওরা। হাতটা নেমে গেছে, অদৃশ্য হয়ে গেছে নিচের দিকে। সেটা যেমন অবিশ্বাস্য রকম আকারে বড় তেমনি বড় বড় ঘন কালো লোমে ঢাকা। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে বলে আলোর অভাব, ভাল দেখতে পাচ্ছে না ওরা। কিন্তু যে হাতটা ওরা দেখেছে সেটা কোন মানুষের যে নয় তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। হাতটা খুব কম করে হলেও রাজকুমারীর গোটা দেহটার মত প্রকাণ্ড তো হবেই, আরও বড় হওয়া বিচিত্র নয়।
লাকীকে দেখা যাচ্ছে না এখন। মেঝের পাটাতন উঁচু হয়ে গেছে, মাঝখানে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট একটা গম্বর। গহ্বরের ওপারে আটকা পড়ে গেছে লাকী। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে এক নাগাড়ে চিৎকার করছে সে।
লাকীর কান ফাটানো চিৎকার ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে ফো-ও-ও-ও-স, ফো-ও ও-ও-স্–অস্বাভাবিক দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ। নিঃশ্বাস তো নয়, যেন ঝড় বয়ে যাবার শব্দ ভেসে আসছে নিচের দিক থেকে।
নিঃশব্দে উঠে এসেছে কুয়াশা ওদের পিছনে। ‘পিছিয়ে এসো, ওমেনা!
সবেগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওরা। ডি. কস্টা কাঁপা গলায় বলল, বস্! কি ওটা? হার্টটা আপনার বডির চেয়েও বিগ সাইজের! আই হ্যাভ সীন উইথ মাই ওউন আইজ!
কুয়াশা নিজেও বিস্মিত কম হয়নি। নিচু গলায় বলল সে, এই বিল্ডিংয়ের একধারে পাথরের বিরাট একটা বাক্সের মতু চারকোনা কামরা আছে। সেখান থেকে সুড়ঙ্গ পথে নিচতলায় চলে এসেছে প্রাণীটা। সবুকিছু ভেঙেচুরে মুক্ত করতে চাইছে সম্ভবত নিজেকে… সরো তোমরা, লাকীকে বাঁচাবার চেষ্টা করা দরকার।’
দুই হাত মুখের কাছে চোঙের মত করে ধরে বিশাল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল কুয়াশা। কিছু যেন নির্দেশ দিল সে লাকীকে। কিন্তু কি যে বলল তা ঠিক বুঝতে পারল না ডি. কস্টা বা রাজকুমারী।
যাদুমন্ত্রের মত কাজ হলো।
একটা টর্চ বের করে জ্বালল কুয়াশা। বিরাট গহ্বরটার ভিতর আলো ফেলল সে।
থেমে গেছে লাকীর চিৎকার। থেমে গেছে প্রকাণ্ড দানবটার লম্ফঝম্ফ। কিছুই দেখা গেল না গহ্বরের ভিতর।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা। কোথাও কোন শব্দ নেই।
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল ওরা কান পেতে। ভীতিকর একটা পরিবেশ বাড়িটার সর্বত্র। বিপদ কোত্থেকে কখন ঘাড়ে এসে পড়বে আগে থেকে বোঝার উপায় নেই।
হামার শুটনিক কাডিটেছে!’ খোলা জানালা পথে বাইরে তাকাল কুয়াশা। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। হঠাৎ ভুরু কুঁচকে উঠল তার। ছুটে গেল জানালার একেবারে সামনে।
দূরে দেখা যাচ্ছে প্রায় দশটন ওজনের সুউচ্চ গেটটা । কেউ নেই সেখানে। কিন্তু গেটটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে।
কুয়াশার দুই পাশে ডি. কস্টা এবং রাজকুমারী দাঁড়াল।
অটোমেটিক গেট। বিদ্যুচ্চালিত। রাজকুমারী ফিসফিস করে বলল। কুয়াশা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় অংশের দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল, ‘দেখো!
বাক্সের মত প্রকাণ্ড পাথরের কামরার বিশাল দরজাটা খুলে গেছে কখন যেন। ওরা সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখল দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে পঁচিশ-ত্রিশ ফুট উঁচু প্রায় সেইরকমই লম্বা একটা ভ্যান। এইরকম প্রকাণ্ড আকারের ভ্যান সচরাচর দেখা যায় না। ভ্যানের গায়ের রঙ নীল। দেখে বোঝা যায় ইস্পাতের মোটা পাত দিয়ে তৈরি বডিটা।
গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এল ভ্যানটা, থামুল। পায়ে হেঁটে এরপর পাথরের কামরা থেকে বেরুল একজন পিস্তলধারী লোক। লোকটা পিছু হেঁটে বেরুল। এরপর পিছু হেঁটে বেরুল লাকী। দূর থেকেও বোঝা গেল কাঁপছে সে আতঙ্কে। তারপরই বিস্ময়কর দৃশ্যটা দেখল ওরা। পাথরের কামরার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল আট মানুষ সমান উঁচু প্রকাণ্ড একটা দানব।
রুদ্ধশ্বাসে সম্মোহিতের মত চেয়ে রইল ওরা। দানবটা এক পা এক পা করে এগোচ্ছে। ভ্যানের ভিতর উঠল সে, অদৃশ্য হয়ে গেল আড়ালে।
ভ্যানের ড্রাইভিং সীটে পাশাপাশি কয়েকজন লোক বসে রয়েছে। তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারল ওরা। এই লোকটাই ইউনুস আদাংকে খুন করেছে। এই লোকটাই খানিক আগে রাইফেল দিয়ে গুলি করেছিল কুয়াশাকে। লোকটার মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, কপালে লম্বা একটা ক্ষতচিহ্ন।
এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেল ডি. কস্টা। তার হাতের কালো চকচকে রিভলভারটা গর্জে উঠল পর পর দুবার।
লাভ নেই। বুলেটপ্রুফ কাঁচ।
উইস্ক্রীনে গিয়ে লাগল বুলেট দুটো, কিন্তু কাঁচ ভেদ করে শত্রুদের গায়ে লাগল না। বন্ধ হয়ে গেছে ভ্যানের পিছনের গেট। লাকীকে তুলে নেয়া হয়েছে সামনের সীটে। ছুটতে শুরু করেছে ভ্যান। গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মস্ত গাড়িটা।
ছোঁ মেরে ডি. কস্টার হাত থেকে কেড়ে নিল কুয়াশা রিভলভারটা। আলখেল্লার পকেট থেকে দুটো কাঁচের বুলেট বের করে রিভলবারে ভরল সে।
ভ্যানটা গেট পেরিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গর্জে উঠল কুয়াশার হাতের রিভলভার।
ভ্যানটার কোন ক্ষতিই হলো না। কাঁচের বুলেটটা ভ্যানের গায়ে লেগে শত সহ টুকরো হয়ে ভেঙে গেল শুধু।
গেট অতিক্রম করে বেরিয়ে গেল ভ্যানটা সবেগে! হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে।
এরপর অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা ঘটল। শব্দ এবং ধাক্কা–দুটোই একসঙ্গে আক্রমণ করল ওদেরকে। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাবার উপক্রম হলো। তিনজন ছিটকে পড়ে গেল কামরার মেঝেতে। | ঘনঘন কাঁপছে কামরার দেয়াল, ছাদ, মেঝে। চারদিকে ধুলো উড়ছে। সন্ধ্যার গ্লানিমাকে তাড়িয়ে দিল আগুনের শিখা।
তিনজন উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল আবার জানালার দিকে। বাইরে তাকাতেই ওরা ধোয়া আর আগুন দেখতে পেল। পাথরের তৈরি বাক্সের মত চারকোনা কামরাটাকে দেখা যাচ্ছে না। সেখানে নৃত্য করছে আগুন। কালো ধোয়ায় চারদিক ঢাকা পড়ে যাচ্ছে দ্রুত।
জানালা পথে বাইরে বেরিয়ে ছুটল ওরা।
বিশাল অগ্নিকুণ্ডের চারদিকে ঘুরে বেড়াল ওরা কিছুক্ষণ। আগুনের ভিতর কেউ যদি থেকেও থাকে, তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা সম্ভব নয়। আগুনের চারদিকে কাঁচের টুকরো, ভাঙা কাঁচের জার, অসংখ্য টেস্ট-টিউব এবং বোতল দেখতে পেল ওরা। বাক্সের মত জায়গাটার ভিতর ল্যাবরেটরি ছিল, অনুমান করা যায়।
বিল্ডিংয়ের প্রথম অংশে ফিরে এল ওরা। স্পুটনিকের কাতর ক্রন্দন ধ্বনি অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কিন্তু কান পাতলে শোনা যাচ্ছে এখনও।
কুয়াশার সঙ্গে ওরাও যোগ দিল পাতালপুরীতে নামার গোপন পথ খুঁজে বের করতে। খানিক পরই আবিষ্কৃত হলো পখটা। কিচেনের মিটসেফটা সরাতেই দেখা গেল একটা সিঁড়ি পথ নেমে গেছে নিচের দিকে।
নিচে নামতে শুরু করল ওরা। প্রত্যেকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র এবং টর্চ। যতই নামছে ওরা, একটা যান্ত্রিক শব্দ উচ্চকিত হয়ে উঠছে। পোড়া গন্ধ এবং ধোয়ায় খাস নেয়া কষ্টকর হয়ে উঠল। বোঝা গেল পাথরের যে কামরাটাকে বোমা ফাটিয়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে সেটা থেকে একটা সুড়ঙ্গ পথ বিল্ডিংয়ের প্রথম অংশে এসে মিলিত হয়েছে। ধোয়া আসছে এদিকে সেই পথেই। কুয়াশা একসময় বলে উঠল, শব্দটা কিসের বুঝতে পারছ, ওমেনা?
পাসেজ ধরে এগোচ্ছে ওরা। রাজকুমারী বলল, “ইলেকট্রিক জেনারেটর।
প্যাসেজের শেষ মাথায় একটা দরজা। দরজাটা সাধারণ যে কোন দরজার চেয়ে আকারে দশ-বারোগুণ বড়। দরজার গায়ে কাঁচের একটা জানালা।
সেই জানালার সামনে দাঁড়াতেই ওরা স্পুটনিককে দেখতে পেল। বিশাল কামরার এক কোণায় বসে ঘেউ ঘেউ করছে সে।
কামরার ভিতর আরও লক্ষণীয় জিনিস দেখা যাচ্ছে। যান্ত্রিক শব্দটাও আসছে কামরার ভিতর থেকে। জেনারেটরটা কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। জেনারেটরের সামনে, খালি মেঝেতে, হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে মোটাসোটা একজন মানুষ। একটু একটু নড়ছে যেন সে। কিন্তু মাথা তোলার চেষ্টা করলেও, পারছে না। লোকটা ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে, দেখেই বোঝা যায়।
দরজাটা মজবুত ও ভাঙা সম্ভব নয়। আলখেল্লার পকেট থেকে ক্ষুদ্রাকার একটা শিশি বের করল কুয়াশা। সাদা তরল পদার্থ শিশি থেকে ঢেলে দিল সে তালার উপর ।
বড় আকারের ইস্পাতের তালাটা গলে গেল। দরজার কবাট খুলতেই স্পুটনিক তিন লাফে ছুটে এল.ডি. কস্টার কাছে। সাদরে বুকে তুলে নিল ডি. কস্টা শুটনিককে।
কুয়াশা ইতিমধ্যে মোটাসোটা মানুষটাকে দুই হাত দিয়ে তুলে নিয়েছে নিজের কাঁধে। বলল, এখানে থাকা নিরাপদ নয় । আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
রাজকুমারীকে চিন্তিত দেখাল। বলল, আমি ভাবছি স্পুটনিক এখানে ঢুকল। কিভাবে?”
কুয়াশা উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল প্যাসেজে। সিঁড়ির দিকে এগোল সে। তার কাঁধের লোকটা নিঃসাড় হয়ে গেছে, সম্ভবত জ্ঞান নেই তার। ডি.কস্টা ও রাজকুমারী অনুসরণ করল কুয়াশাকে।
উপরে উঠে ওরা দেখল বিল্ডিংয়ের প্রথম অংশটাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে আগুন। ধোঁয়ায় চারদিক ঢাকা পড়ে যাচ্ছে দ্রুত। ছুটল ওরা।
গেটটা খোলাই ছিল। গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এল ওরা পাহাড়ী রাস্তায় ।
রাজকুমারী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কী সাঙ্ঘাতিক! প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারব বলে আশা করিনি। বাড়ি তো নয়, যেন প্রকাণ্ড একটা খাঁচা!
ডি. কস্টা বলল, প্রোপ্রাইটার–সৈয়দ ইমদাদুল কবীর, লোকটা ক্রিমিন্যাল না হইয়া পারে না। ব্যাটাকে একবার হাটে পাইনে হয়, টারে আমি মজা ড্যাখাব।’
কুয়াশার কাঁধের উপর নিঃসাড় পড়ে থাকা লোকটা হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল। দুর্বল কণ্ঠে সে বলল, “আ-আমিই সৈয়দ ইমদাদুল কবীর…!
সাত
চারদিকে অন্ধকার নেমেছে। সুউচ্চ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা রহস্যময় বিল্ডিংটা জ্বলছে দাউ দাউ করে। আগুনের আভায় চারদিক লালচে দেখাচ্ছে। গেটের সামনের সমতল রাস্তার উপর সৈয়দ ইমদাদুল কবীরকে শুইয়ে দিল কুয়াশা। কাউকে কিছু না বলে দ্রুত, নিঃশব্দ পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সে। অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।
মিনিট বিশেক পর ফিরল কুয়াশা।
কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবার আগে কুয়াশাই প্রশ্ন করল, কবীর সাহেব কথা বলেছেন?’
সৈয়দ কবীর উঠে বসেছে রাস্তার উপর। কুয়াশার দিকে তাকাল সে। বলল, শয়তানের দল আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল ইঞ্জেকশন দিয়ে।
কুয়াশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল সৈয়দ কবীরকে। লোকটার পোশাক শত ছিন্ন, ময়লা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চক্ষু কোটরাগত।
বলতে শুরু করল সে, আপনাদেরকে শয়তানরা পাচিলের উপর দেখেই আমাকে ইঞ্জেকশন দেয়। উপরতলায় ছিলাম তখন আমি। আমাকে বাধ্য করছিল ওরা তখন রোজকার মত কাগজপত্রে সই করতে। ঘুমিয়ে পড়ার পর কি ঘটেছে তা আর মনে নেই।’
কুয়াশা প্রশ্ন করুল, ‘এ বাড়িটা কার?
‘আমার। কিন্তু এটার চেহারা এরকম ছিল না। পঁচিল, তারের জাল, পাথরের কামরা, সব ওরা তৈরি করেছে। ওদের হাতে গত এক বছরেরও বেশি হলো আমি বন্দি হয়ে আছি। আমাকে ওরা ভয় দেখিয়ে, শারীরিক অত্যাচার। চালিয়ে চেকবইয়ে সই করায়, চিঠিপত্র লেখায়। ওদের অবাধ্য হলে মেরে ফেলবে এই ভয়ে হুকুম মত সব করে গেছি আমি। মি. কুয়াশা, আপনাকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন আমাকে বাঁচাবার জন্যে! দয়া করে আপনি আমাকে নিরাপদ কোথাও নিয়ে চলুন…
আপনাকে বন্দি করে রেখেছে কে?”
সৈয়দ কবীর বলল, সানাউল হক।
সানাউল হক? কে সে?’
লোকটা আমাদের শিপিং কোম্পানীতে চাকরি করত। একজন কেমিস্ট। টেকনাফে ছোট একটা ওয়ার্কশপ আছে আমাদের। সেখানকার ওয়ার্কশপে কাজ করত সে। অযোগ্য এবং অনুপযুক্ত বলে আমরা তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলাম।’
কুয়াশা বলল, আপনাকে বন্দি করে রেখেছিল কেন?
সৈয়দ কবীর বলল, নিজের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য। যদিও তার উদ্দেশ্য যে কি তা আজও আমি জানতে পারিনি। এই বাড়িটা সে দখল করে। নিজে সে কিছুই করেনি। সর্ব করিয়েছে আমাকে দিয়ে। আমাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলিয়ে বাড়িটাকে নিজের ইচ্ছে মত দুর্গ করে তুলেছে সে।’
অস্বাভাবিক বড় আকৃতির কোন প্রাণী দেখেছেন আপনি বাড়িতে? বড় আকৃতির প্রাণী?
ডি. কস্টা বলল, ‘যা–ডৈট্য-টৈট্য? মনস্টার?”
‘দৈত্য! মনস্টার!’
‘হ্যাঁ–ডেকেছেন?’
হায় খোদা! তার মানে আপনারাও বুঝতে পেরেছেন…মানে,না, দেখিনি। কারণ শয়তানরা আমাকে আণ্ডার গ্রাউণ্ডের একটা সেলে বন্দি করে রেখেছিল। একটা মাত্র দরজা ছিল, কোন জানালা ছিল না। তবে পায়ের আওয়াজ পেতাম আমি। থপথপ করে হাঁটাহাঁটি করত, বড় বড় নিঃশ্বাসের শব্দ পেতাম। ভেবেছিলাম হাতি জাতীয় কোন প্রাণী…
কুয়াশা জানতে চাইল, দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপা সংক্রান্ত কোন ব্যাপারে ওদেরকে আলোচনা করতে শুনেছেন কখনও?
‘হ্যাঁ, শুনেছি। পত্রিকা অফিসে বিজ্ঞাপন পাঠাত ওরা–তবে এখান থেকে নয় । বিজ্ঞাপনগুলোর বিষয় সম্পর্কে কিছু বলতে শুনিনি আমি।’
‘সানাউল হক দেখতে কেমন? ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, কপালে লম্বা ক্ষতচিহ্ন..!’
ওই লোকটা সানাউল হকের ডান হাত। ওর নাম জগদীশ। সানাউল হক লম্বা, একহারা চেহারার লোক। নাকটা খাড়া, ফর্সা রঙ।’
আগুন সম্পূর্ণ প্রাস করেছে বাড়িটাকে। ধোয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। নেমে এল ওরা ঢালু রাস্তা বেয়ে।
কুয়াশা বলল, কবীর সাহেব, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব এখন থেকে আমাদের উপর। সানাউল হক বা আর কেউ, সে যত বড় শক্তিশালীই হোক, আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’
সৈয়দ কবীর শুষ্ক গলায় বলল, আমি বড় ভীতু লোক, মি. কুয়াশা। আপনি আমাকে নতুন জীবন দান করেছেন। আপনার ঋণ আমি জীবনে পরিশোধ করতে পারব না।’
হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশার মার্সিডিসের কাছে পৌঁছুল ওরা। ড্রাইভিং সীটে বসল কুয়াশা। তার পাশে রাজকুমারী । ব্যাক সীটে স্পুটনিককে নিয়ে ডি. কস্টা এবং সৈয়দ কবীর উঠল । গাড়িতে স্টার্ট দিল না কুয়াশা। রেডিও-টেলিফোনের সুইচ অন করল সে। লাউডস্পীকারের মাধ্যমে ভেসে এল একটা যান্ত্রিক শব্দ। হেলিকপ্টার যে রকম শব্দ করে, অনেকটা সেই রকম।
কুয়াশা কথা বলল মুখের সামনে মাউথপীস ধরে, হ্যালো, তোমাদের খবর কী?
লাউডস্পীকারে ভেসে এল রাসেলের গলা, ভাইয়া, আপনার নীল রঙের ভ্যানের ছায়া পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না কোথাও! নীল রঙের একটা ভ্যান দেখেছিলাম বটে কিন্তু সেটা তেমন বড় নয়। ভ্যানটার গায়ে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি নিক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু ফুরোসকোপিক চশমা পরেও কেমিক্যাল দেখলাম না। জ্বলজ্বল করে জ্বলবার কথা কেমিক্যাল, তাই না?’
ইউনুস আদাঙের খুনী জগদীশ যখন ভ্যান নিয়ে গেট পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল, বিল্ডিংয়ের বাইরে তখন কুয়াশা ডি. কস্টার হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিয়ে বিশেষ একধরনের কাঁচের বুলেট নিক্ষেপ করেছিল। বুলেটগুলোর ভিতর একধরনের কেমিক্যাল ছিল। খালি চোখে তা দেখা যায় না। ফুরোসকোপি চশমা পরে টর্চের সাহায্যে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি নিক্ষেপ করলে সেই কেমিক্যাল দেখতে পাবার কথা।
গেটের বাইরে সৈয়দ কবীরকে শুইয়ে রেখে বিশ মিনিটের জন্য অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল কুয়াশা। সেই সময়টা গাড়ির কাছে ফিরে এসে রেডিও-টেলিফোনের সাহায্যে শহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে। শহীদকে সব কথা ব্যাখ্যা করে জানিয়ে সে অনুরোধ করে তার আস্তানা থেকে দুটো হেলিকপ্টার নিয়ে দুইজন মিলে যেন নীল রঙের ভ্যানটাকে খুঁজে বের করে। শহীদ এবং রাসেল দুটো কপ্টার নিয়ে আকাশে ওড়ে।
শহীদ কোন্দিকে গেছে?
‘পশ্চিম দিকে।
কুয়াশা বিনকিউলার ‘লাগাল চোখে, তাকাল পুবাকাশের দিকে। আকাশের গায়ে ছোট একটা বিন্দু দেখল সে। বলল, রাসেল, তোমার মিনি কপ্টারকে আরও ওপরে ওঠাও।’
রাসেল জানতে চাইল, বিন্ডিংটার অবস্থা কি? ছাই হয়ে গেছে?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। তবে আমরা সৈয়দ কবীর সাহেবকে উদ্ধার করেছি।’ সৈয়দ কবীর সম্পর্কে সংক্ষেপে বলল কুয়াশা রাসেলকে।
ডি. কস্টা বলল, টেকনাফে যে পওর ম্যানটি মারা গিয়াছে–টুর্নাডো নহে, টাহার বাড়ি ভাঙ্গিয়া ডিয়াছে মনস্টার হিমসেলফ! দ্যাট ভেরি ডৈট্যই খুন করিয়াছে ডুর্ভাগা এমাম রাউকে!’
“ সৈয়দ কবীর হঠাৎ বলে উঠল, বন্দি দশার কথা মনে পড়লেই ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় আমার। জানেন, মি, কুয়াশা, শয়তানরা যে আমাকে কাগজপত্রে সই করতে বাধ্য করত শুধু তাই নয়, কাগজপত্রগুলো আমাকে পড়তেও দিত না তারা।’
কুয়াশা বলল, সানাউল হক টেকনাফের ওয়ার্কশপে কাজ করত। সেই ওয়ার্কশপটা টেকনাফের কোনদিকে?’
সৈয়দ কবীর জানাল, ওয়ার্কশপটা এখন আর নেই। স্থানান্তরিত করা হয়েছে চট্টগ্রামে।
পুবাকাশ থেকে রাসেলের মিনি কপ্টার অদৃশ্য হয়ে গেছে।
.
রেডিও-টেলিফোনে এমন সময় ভেসে এল শহীদের ভারি কণ্ঠস্বর, কুয়াশা, ভ্যানটাকে দেখতে পেয়েছি।’
কোথায়?’
বান্দরবনের দিকে যাচ্ছে। কাপ্তাই এবং বান্দরবনের মধ্যবর্তী বনভূমির ভিতর দিয়ে ছুটছে। রাস্তাটা একেবারে বাজে। এই রাস্তা কেন বেছে নিয়েছে ঠিক বুঝতে পারছি না।’
কুয়াশা বলল, “যোগাযোগ রাখো সর্বক্ষণ। চোখের আড়াল কোরো না। আমরা এগোচ্ছি।’
মার্সিডিসে স্টার্ট দিল কুয়াশা। পরমুহূর্তে শহীদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কুয়াশা।’
মাঝপথে থেমে গেল শহীদের কণ্ঠস্বর। শোনা গেল ঠা-ঠা-ঠা-ঠা, ঠা-ঠা-ঠা ঠা–মেশিনগানের অনল গুলিবর্ষণের আওয়াজ।
শহীদ! শহীদ।
কুয়াশা মাউথপীসের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বারবার ডাকতে লাগল। কিন্তু শহীদ সাড়া দিল না। রেডিও-টেলিফোনের মাধ্যমে ভেসে আসছে শুধু মেশিনগানের, ঠা-ঠা-ঠা-ঠা, ঠা-ঠা-ঠা-ঠা শব্দ, অবিরাম । তারপর, প্রচণ্ড একটা সংঘর্ষের শব্দ। হলো। তারপর–সব স্তব্ধ। রেডিও-টেলিফোনের মাধ্যমে এতটুকু শব্দ আসছে না আর।
মার্সিডিসের গতি বাড়তে লাগল। স্পীডমিটারের কাঁটা কাঁপতে কাঁপতে 100 লেখা জায়গাটায় পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যে। মার্সিডিস যেন উড়তে শুরু করেছে রাস্তার উপর দিয়ে।
আট
ফুরোসকোপিক চশমা তো চোখে ছিলই, শহীদ নাইট বিনকিউলারও ব্যবহার করছিল। তবু ভাগ্যগুণেই দেখতে পেয়েছে ভ্যানটাকে ও।
রাস্তাটা প্রশস্ত হলেও দু’পাশে ঘন বনভূমি। গাছপালার প্রসারিত শাখা-প্রশাখা এবং পাতায় ঢাকা পড়ে আছে রাস্তাটা। উপর থেকে রাস্তাটার অস্তিত্ব টের পাওয়া মুশকিল।
“ আলট্রাভায়োলেট রশ্মির বদৌলতে জ্বলজ্বলে কেমিক্যাল চোখে পড়েছিল শহীদের। সঙ্গে সঙ্গেই মিনি কপ্টার নিচে, অনেক নিচে নামিয়ে আনে সে। বিশেষ ধরনের ইঞ্জিন ফিট করা আছে, শব্দ হয় না। শহীদ ভ্যানটার প্রায় পঞ্চাশ ফুট উপরে নামিয়ে আনল কপ্টারকে। তারপর রেডিও-টেলিফোনের মাধ্যমে সুখবরটা জানাল কুয়াশাকে।
*
কুয়াশাকে খবরটা দেবার কয়েক মুহূর্ত পরই শহীদ বিপদ টের পেল। ভ্যানের জানালা দিয়ে দুটো মেশিনগানের ব্যারেল বেরিয়ে আসতে দেখল ও। | বিপদ টের পেয়েই শহীদ নিজের কোলের উপর রাখা স্টেনগানটা তুলে নিয়ে গুলি করতে শুরু করে। শত্রুরাও প্রায় একই সময়ে মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে।
প্রথম ঝাকের প্রায় সব কটা বুলেট কপ্টারের গায়ে, এঞ্জিনে বিদ্ধ হয়। কপ্টারের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে শহীদ। স্টেনগান ফেলে দিয়ে কপ্টারকে সামলাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে ও। কিন্তু শেষ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। ইতিমধ্যে কপ্টারের এঞ্জিনে আগুন ধরে গেছে।
নিচের দিকে তাকিয়ে পরবর্তী কর্তব্য স্থির করে ফেলল শহীদ। কপ্টারের মায়া ত্যাগ করতে হবে। প্রাণ বাঁচানোই এখন প্রধান কর্তব্য। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ‘কপ্টারের গায়ে, করার দেরি না করে করতে হবে।
সবেগে তির্যক ভাবে নিচের দিকে নামছে কপ্টার। সামনে একটা উঁচু পাহাড়। সংঘর্ষ অবধারিত। কন্ট্রোল প্যানেলের একটা লাল বোতামে চাপ দিল ও। পরবর্তী সেকেণ্ডে দেখা গেল সীট সহ শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে শহীদ।
শূন্যে খুলে গেল প্যারাসুট। কয়েকমুহূর্ত পর জঙ্গলের মধ্যে নামল শহীদ। দ্রুত প্যারাসুট মুক্ত হয়ে ঝোঁপের ভিতর নিঃশব্দে পড়ে রইল ও। কপ্টারটা পঁচিশ গজ দূরে গিয়ে পড়েছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে সেটা। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের ঝোঁপঝাড়ে।
ভ্যানের আরোহীরা আশেপাশেই আছে। নিশ্চয়ই তারা ‘কপ্টারের ধ্বংসাবশেষ দেখতে আসবে। ‘কপ্টারে শহীদ বা শহীদের লাশ নেই দেখলেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে তারা ওর সন্ধানে…।
শহীদ দ্রুত ভাবছিল–কি করা উচিত এখন। কুয়াশা নিশ্চয়ই রওনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু তার পৌঁছুতে সময় লাগবে। এদিকে ওর কাছে কোন আগ্নেয়াস্ত্র নেই ।
শহীদ সিদ্ধান্ত নিল। কপ্টারের কাছ থেকে সরে যাবে ও যতদূর সম্ভব। ঝোঁপের ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হলো ও।
এগিয়ে চলল পুব দিকে ক্রল করে।
“থামো! থামো! পালিয়ে যাবে কোথায় বাছাধন!” ডান দিক থেকে ভেসে এল কর্কশ কণ্ঠস্বর। পরমুহূর্তে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল পাঁচজন কুৎসিত দর্শন লোক। তাদের হাতে রিভলভার, দু’জনের হাতে স্টেনগান। পাঁচজনের দলটা ঘিরে ধরল শহীদকে।
ধীরে ধীরে মাথার উপর হাত তুলল শহীদ। প্রশ্ন করল জগদীশ, কে তুমি?
উত্তর দিল না শহীদ। জগদীশ কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করার পর প্রচণ্ড একটা ঘুসি মারল শহীদের চোয়ালে। চিৎকার করে উঠল, কথা বল! কে তুই? নাম কি তোর?
মুখ দিয়ে নয়, শহীদ উত্তর দিল ওর হাত এবং পা দিয়ে। চোখের পলকে বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর শরীরে। জগদীশের পেটে সবুট লাথি মারল, দুই পাশের দুই শয়তানের নাকে দুই হাত দিয়ে দুটো ঘুসি চালাল একই সঙ্গে। পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই ধরাশায়ী হলো। কিন্তু এক সেকেণ্ড পরই ওর পিছন থেকে গর্জে উঠল একজন শত্ৰু, নড়েছ কি মরেছ?
শহীদ অনুভব করল, ওর মাথার পিছনে কঠিন ধাতব পদার্থের স্পর্শ। রিভলভারের নল।
জগদীশ উঠে দাঁড়াল। শহীদের পিছন থেকে রিভলভারধারী হিংস্র কণ্ঠে অনুমতি চাইল, দেব শেষ করে, জগদীশ বাবু?’ দাঁতে দাঁত চেপে জগদীশ বলল, না। শালাকে তো মারতেই হবে, একটু পর। আতঙ্কে দগ্ধে মরুক শালা, তাই আমি চাই!
নাইলনের কর্ড দিয়ে হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ভ্যানে তোলা হলো ওকে। ভ্যানের পিছনে ছোট্ট একটা কামরা, সেই কামরার মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটি মেয়ে–লাকী। লাকীর মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। তাকে নামানো হলো নিচে। সেই জায়গায় তোলা হলো শহীদকে। পা দুটোও বেঁধে ফেলা হলো ওর। বন্ধ করে দেয়া হলো বাইরে থেকে ইস্পাতের দরজা।
ভ্যান ছুটতে শুরু করল আবার।
মেঠো পথ ধরে ঘণ্টাখানেক এগোল ভ্যান। ঝাঁকুনি কমল এরপর। শহীদ অনুমান করল, পাকা রাস্তায় উঠে এসেছে ভ্যান ।
দু’বার মাত্র বাঁক নিয়ে ঘণ্টাখানেক ঝড়ের বেগে ছুটল গাড়িটা। তারপর থামল।
ড্রাইভিং সীট থেকে নামল সবাই, শব্দ শুনে বুঝতে পারল শহীদ। জগদীশ বলছে, নকীব, তুই চিনবি তো জায়গাটা?
নকীব বলল, চিনব না মানে! এই এলাকায় জন্ম আমার…
জগদীশ বলল, “মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। নকীব, তুই আর ফিচেল–দু’জনে পারবি না কাজটা সারতে?’
‘পারর। কিন্তু ভ্যানটা সহ দানবটাকে বোমা ফাটিয়ে ধ্বংস করা–এটা ঠিক ভাল মনে হচ্ছে না আমার। | জগদীশ নিচু গলায় বলল, বড় বেশি কথা বলিস তুই, নকীব। বসের নির্দেশ যা, তাই তো করব আমরা? এই দানবটা বসের কথা ঠিকমত পালন করছে না, গোলমাল করছে–তাই একে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। চট্টগ্রামে হামলা করার সময় আমরা সবগুলো দানবকে একত্রিত করব…যাক সে কথা.. পরিকল্পনা বদলাতেও হতে পারে। ভাল কথা, বন্দি কুত্তাটাকে দাটার সঙ্গেই বুঝলি তো?’
নকীব বল, বুঝেছি। ওদেরকে খতম করে যাব কোথায় আমরা?’
কতবার বলব? আগেই তো বলেছি, টেকনাফে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা যাই। ঠিক মত করা হয় যেন কাজটা। কোথাও কোন ভুল হলে আস্ত রাখব না কাউকে।
ভ্যান আবার ছুটতে শুরু করল। মিনিট পাঁচেক পর আবার ঘনঘন হেলতে দুলতে শুরু করল সেটা। শহীদ বুঝতে পারল, মেঠো পথে নেমেছে আবার। গাড়িটা।
আরও পনেরো মিনিট কাটল। হঠাৎ ভ্যানের ইঞ্জিনের শব্দ বেড়ে গেল। কান পেতে শোনার চেষ্টা করুল শহীদ। একমুহূর্ত পরই রহস্যটা বুঝতে পারল ও।
ভ্যান প্রশস্ত একটা সুড়ঙ্গের ভিতর ঢুকে পড়েছে। গতি কমে গেছে অনেক।
এই প্রথম ভ্যানের ভিতর থেকে শব্দ আসছে, টের পেল শহীদ ভ্যানের প্রকাণ্ড খাঁচায় প্রকাণ্ডদেহী কোন প্রাণী আছে অনুমান করল ও। সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলছে। নড়ে চড়ে উঠছে। | হঠাৎ কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেলো ভ্যানটা। তীব্র ঝাঁকুনি লাগল। মাথাটা ঠুকে গেল শহীদের ইস্পাত্বের দেয়ালের সঙ্গে। চোখমুখ বিকৃত হয়ে উঠল ব্যথায়।
ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে ভ্যানের।
নকীব এবং ফিচেলের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে সে। পদশব্দ এগিয়ে আসছে। ছোট্ট কামরাটার কাছে এসে থামল পদশব্দ, শহীদের উদ্দেশে লোকটা কথা বলে উঠল, ওহে হিরো, কেমন বোধ করছ? | ফিস ফিস করে আবার বলল লোকটা, বারুদ লাগানো সুলতেতে আগুন দিয়ে পালাচ্ছি আমরা ট্যানেল থেকে। বোমা ফাটবে। তার মানে, আজ তোমার মরণ- হাঃ, হাঃ, হাঃ হাঃ!’
নকীব চলে গেল। কান পেতে রইল শহীদ। কোথাও কোন শব্দ নেই। ভয়ঙ্কর অস্বস্তিকর এই নিস্তব্ধতা। ভ্যানের প্রকাণ্ড খাঁচার রহস্যময় প্রাণীটাও কোন শব্দ করছে না।
খ! দেশলাই জ্বালল কেউ, অস্পষ্ট শব্দটা কানে ঢুকল শহীদের। একমুহূর্ত কাটল। তারপর দুজন লোকের ছুটন্ত পদশব্দ কানে ঢুকল। দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে পায়ের শব্দ।
বিপদের গুরুত্ব অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে শহীদ। মৃত্যু দ্রুত এগিয়ে আসছে।
মাথা খারাপ করে লাভ নেই। অপেক্ষা করতে হবে এখন ওকে। রিস্টওয়াচের দম দেয়ার জন্যে ক্ষুদ্র চাকাটার পাশে আরও একটি চাকা আছে, সেটা ইস্পাতের মেঝের সঙ্গে চেপে ধরে অন করে দিয়েছে ও। ঘূর্ণায়মান একটা গোল ধারালো রেড বেরিয়ে এসেছে ঘড়ির ভিতর থেকে। নাইলনের কর্ড ধীরে ধীরে কাটছে।
গভীর অন্ধকার। শত্রুরা যখন ভ্যানের পিছনের ছোট্ট এই জায়গাটায় ওকে তোলে, ক্ষুদ্র একটা ভেন্টিলেটার দেখেছিল শহীদ। বাধনমুক্ত হলে, ভেন্টিলেটারে চোখ রেখে প্রাণীটাকে দেখার চেষ্টা করবে ও। জানার চেষ্টা করবে বোমা। ফাটাবার জন্যে বারুদের সলতেতে সত্যি আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে কিনা।
বুকের ভিতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। ঘামছে শহীদ। হাতের বাঁধন মুক্ত হলো কয়েক মুহূর্ত পর। পায়ের বাধন খুলতে আরও অল্প সময় লাগল।
পায়ের জুতো জোড়া খুলল ও। একটি জুতোর গোপন কুঠরি থেকে বের করল পেন্সিল টর্চ। | ছোট্ট জায়গাটা টর্চের আলোয় দেখল শহীদ ভাল করে । ইস্পাতের দেয়াল, দরজাটাও তাই। মানুষ তো দূরের কথা, দানবের পক্ষেও ভাঙা সম্ভব নয়। | ভেন্টিলেটারটা অনেক উঁচুতে। দুই দিকের দেয়ালে দুই পা দিয়ে একটু একটু করে উঠতে শুরু করল শহীদ।
পাশাপাশি ছোট ছোট তিনটে ফুটো, ভেন্টিলেটার বলতে ওইগুলোই। একটা ফুটোয় চোখ রাখল শহীদ।
কোন প্রাণী বা কিছুই চোখে পড়ল না। শুধু লাল একটা আগুনের উজ্জ্বল টুকরো দেখা গেল। আগুনটা ক্রমশএগোচ্ছে।
সলতে! বারুদের সলতে! সত্যিই তাহলে বোমা ফাটবে! পেন্সিল টর্চটা অপর একটি ফুটোর মুখে ঠেকিয়ে বোতামে চাপ দিল শহীদ। আলোকিত হয়ে উঠল ভিতরটা।
বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল শহীদ। রুদ্ধশ্বাসে দেখল প্রকাণ্ড, লোমশ প্রাণীটাকে। বনমানুষ ওটা? কিন্তু অমন প্রকাণ্ড দেহ কিভাবে সম্ভব? কম করেও একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে সাত-আটগুণ বেশি লম্বা প্রাণীটা, সেই অনুপাতে চওড়াও।
*
পরমুহূর্তে মৃত্যু চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল শহীদ। উপর থেকে রূপ করে নামল সে মেঝেতে। দ্বিতীয় জুতোটার গোপন কুঠরি থেকে বের করল অতি ক্ষুদ্র একটি ওয়্যারলেস।
পার্টনগুলো জোড়া লাগাতে ত্রিশ সেকেণ্ড সময় লাগল। ঘামে ভিজে যাচ্ছে হাতের তালু। দ্রুত কাজ করার চেষ্টা করলে কি হবে, হাত দুটো কাঁপছে বলে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সেট অন করে মেসেজ পাঠাতে শুরু করল শহীদ। ‘আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার। শহীদ খান স্পিকিং! শহীদ খান টু কুয়াশা। আই আম ইন ডেঞ্জার!’
মিনি স্পিকার থেকে ভেসে এল কুয়াশার যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, তোমার লোকেশন বলো শহীদ। বিপদটা কি ধরনের?
‘লোকেশনটা ঠিক বলতে পারব না। কার যেখানে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সেখান থেকে একটানা গাড়ি চালিয়ে এই জায়গায় আসতে লেগেছে এক ঘণ্টা বিশ মিনিট। সম্ভবত কোন পাহাড়ের মধ্যে, সুড়ঙ্গের ভিতর রয়েছে ভ্যানটা। ভ্যানের ভিতর প্রকাণ্ড একটা••দানবই বলব, রয়েছে। পাশের ছোট একটা কামরায় রয়েছি আমি। দানবটা যেখানে রয়েছে সেখানে জলছে বারুদের সলতে। বোমাটা ফাটাবার ব্যবস্থা করে শত্রুরা ছুটে পালিয়ে গেছে।’
কুয়াশা কথা বলল না পাঁচ সেকেণ্ড। এই পাঁচ সেকেণ্ডকে মনে হলো পাঁচ পাঁচটা যুগ। | শহীদ, হিসেব করে বুঝতে পা, তুমি আমাদের কাছ থেকে চল্লিশ মাইল দূরে রয়েছ। আমরা পৌঁছুবার আগেই… কুইক। তুমি দেখে বলো সলতে আর কতটা বাকি আছে পুড়তে?
দুই দেয়ালের গায়ে পা দিয়ে আবার উঠতে শুরু করল শহীদ। বুকের ভিতর কেমন যেন একটা অচেনা অনুভূতি দুর্বল করে তুলছে ওকে। এই যে’চেষ্টা করছে ওসব বৃথা! মৃত্যুকে আজ আর ঠেকানো যাবে না।
‘গজ দু’য়েক! মাত্র গজ দুয়েক, কুয়াশা।’ কুয়াশা বলল, ‘শহীদ, মাথা ঠাণ্ডা রাখো।
বলল বটে কুয়াশা, কিন্তু তার নিজের কণ্ঠস্বরই কেঁপে গেল। মুহূর্তে বলল, দরজা, ভাঙার কোন উপায়ই নেই?
না! দেয়াল এবং দরজা স্টিলের।’
দানবটাকে উত্তেজিত করা যায় না? তাকে দিয়ে ইস্পাতের দেয়াল ভাঙানো যায় না?’
শহীদ আবার উঠল দেয়ালের গায়ে পা দিয়ে ভেন্টিলেটারের কাছে। পেন্সিল টর্চ জ্বেলে দেখল, বারুদের সলতেটা পুড়ছে নির্দিষ্ট গতিতে। ক্রমশ, ছোট হয়ে আসছে সেটা।
চিৎকার করে উঠল ও, এই! আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করো। তুমি আর আমি..আমাদেরকে খুন করার ব্যবস্থা করেছে ওরা।’ | শব্দ পেয়ে ভেন্টিলেটারের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল বটে প্রকাণ্ডদেহী দানবটা, কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না তার মধ্যে।
ছেলেমানুষি ব্যাপার মনে হলো শহীদের। বনমানুষের মত প্রকাণ্ড একটা দানব, সে ওর ভাষা বুঝবে এটা আশা করা বোকামি!
কাজ হচ্ছে না কুয়াশা!
শহীদের কণ্ঠে নৈরাশ্য ভেঙে পড়ছে ও। বুঝতে পারছে, শেষ রক্ষা আজ আর হবে না।
কুয়াশার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ঘণ্টায় আশি মাইল স্পীডে এগোচ্ছি আমরা গাড়ি নিয়ে, শহীদ। কিন্তু সময় মত পৌঁছুতে পারব না, তার আগেই বোমা ফাটবে।
আমি চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করছি, কোন উপায়…
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে শহীদ। বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। কুয়াশার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার সময় আশা করেছিল, কোন একটা রাস্তা সে দেখিয়ে দেবে, যার ফলে অতীতের মত এবারও অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবে ও।
সে-ভুল ভেঙে গেছে। এখনও কুয়াশা পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে। বোমা ফাটতে সময় নেবে বড়জোর আর দেড় মিনিট। আর দেড় মিনিট। মাত্র দেড় মিনিট।
দেড় মিনিট! আর.. এক মিনিট। মাত্র এক মিনিট!
স্পিকার থেকে কুয়াশার কণ্ঠস্বর বের হচ্ছে না! ভাবছে কুয়াশা। বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর সময় নেই। সময় নেই! সময় নেই!
এখনও আশা করছ তুমি, শহীদ? নিজেকে প্রশ্ন করুন শহীদ। না, আশা করছি না-নিজেকে জানাল ও।
মৃত্যু!
কুয়াশা চুপ করে আছে। কি বলবে সে? এই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে কোন মানুষ কোন মানুষকে রক্ষা করতে পারে না।
অবশেষে মুখ খুলল শহীদই। মহুয়াকে বোলো বোলো…’ কথা শেষ করতে পারল না শহীদ, কুয়াশার যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর কানে ঢুকল।
তোমার ওয়্যারলেস সেটের স্পিকারটি ভেন্টিলেটারের কাছে নিয়ে গিয়ে ধরে রাখো, শহীদ। কুইক! ইক!
“কি লাভ••• | প্রায় ধমকে উঠল কুয়াশা, জীবনে এই প্রথম, যা বলছি করো-কুইক!
আবার ভেন্টিলোরের কাছে উঠল শহীদ। স্পিকারটা ধরল একটা ফুটোর দিকে মুখ করে। ধরে হ।’
সঙ্গে সঙ্গে দুর্বোধ্য শব্দ বেরিয়ে এল স্পিকারের ভিতর থেকে।
কণ্ঠস্বরটা কুয়াশার, চিনতে পারছে শহীদ। কিন্তু শব্দগুলোর অর্থ এতটুকু বুঝতে পারছে না ও।
কুয়াশা কিচির মিচির করে অনর্গল শক্ত করে চলেছে। এমন সময় লাফিয়ে উঠল পাহাড় প্রমাণ দানব। সিধে হয়ে দাঁড়াল প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু দানব। দুই বটবৃক্ষের মত মোটা হাত দিয়ে আঘাত করল সে ইস্পাতের দেয়ালে।
.
দুলে উঠল ভ্যান। পা পিছলে যাওয়ায়, উপর থেকে মেঝেতে পড়ে গেল শহীদ
টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল ও। না, ও টলছে না। ভ্যানটা অসম্ভব দুলছে বলে মনে হচ্ছিল সেইরকম।
কান ফাটানো বিস্ফোরণের মত আওয়াজ করছে দানবটা। সেই সঙ্গে ভ্যানের গায়ে লাথি মারছে, ঘুসি মারছে, শরীর দিয়ে ধাক্কা মারছে…!
মোটা ইস্পাতের দেয়াল, ভাঙবে কেন! উল্টে পড়ে যাবার উপক্রম হলো ভ্যানটা। প্রমাদ গুণল শহীদ। কুয়াশা কিভাবে কে জানে খেপিয়ে দিয়েছে বটে দানবকে, কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে না।
এমন সময় শহীদ্ব দেখতে পেল-দরজার ইস্পাতের কবাট ফাঁক হয়ে গেছে ইঞ্চি ছয়েক।
ভ্যানটা ধাক্কা খাচ্ছে সুড়ঙ্গের দুই দিকের দেয়ালের সঙ্গে। তারই ফলে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে জায়গায় জায়গায়। দুই বাটের মধ্যবর্তী সংযোগ ঢিলে হয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ ফাঁক হচ্ছে।
কিন্তু সময় দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আর বোধহয় কয়েক সেকেণ্ড বাকি আছে বোমাটা ফাটতে।
অথচ মানুষ গলবার মত ফাঁক সৃষ্টি হচ্ছে না… শহীদ! কাজ হচ্ছে কিছু?
আরও অন্তত কয়েক মিনিট সময় লাগবে। কিন্তু তার আগেই… কথা শেষ করতে পারল না শহীদ, দেখল, কবাট দুটোর মধ্যবর্তী ফাঁকটা আচমকা বড় হয়ে গেল।
মাথা গলিয়ে দিল শহীদ। কিন্তু হা হতোস্মি। মাথা গলল বটে, কিন্তু দেহটা আটকে গেল। কোন মতে সেটা গলছে না। ভ্যানটা প্রতিমুহূর্তে ধাক্কা খাচ্ছে বলে ফাঁকটা আবার ছোট হয়ে গেছে।
প্রতি সেকেণ্ডে শহীদ আশঙ্কা করছে–এই ফাটল বুঝি বোমাটা!
দেহটা আটকা পড়ে গেছে ফাঁকের মধ্যে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। প্রাণপণ চেষ্টা করছে শহীদ বেরিয়ে যাবার হঠাৎ ছিটকে পড়ে গেল ও ভ্যানের বাইরে।
ফাঁকটা বড় হয়ে যাওয়ায় ঘটনাটা ঘটল।
মাটিতে পড়েই উঠে দাঁড়াল শহীদ। মাথা নিচু করে দিক নির্ণয় না করেই অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ছুটল ও। সামনে সুড়ঙ্গের বাক, বুঝতে না পারায় ধাক্কা খেল ভীষণভাবে। ঘুরে উঠল মাথা, পড়ে গেল ছিটকে। কিন্তু পরমুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে বাক নিল, দৌড়ুতে লাগল তীর বেগে।
খানিক পর আলো দেখতে পেল ও। সুড়ঙ্গের মুখ দেখা গেল। নিক্ষিপ্ত তীরের মত সেই মুখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল ও] ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটল বিস্ফোরণ। | সুড়ঙ্গের মুখটা যেন কামানের মুখ, ভিতর থেকে পাথরের টুকরো, ধুলোর পাহাড় বেরিয়ে এল সবেগে। আশপাশের গাছপালা, মাটি কেঁপে উঠল থরথর করে। পাহাড়ের উপর ফাটল সৃষ্টি হলো কয়েকটা বিস্ফোরণের শব্দ ক্রমশ মিলিয়ে গেলেও নিক্ষিপ্ত পাথর পড়ার শব্দ আরও খানিকক্ষণ পর্যন্ত শোনা গেল।
আচমকা, প্রায় কানের কাছে, গর্জে উঠল একটা রিভলভার। চরকির মত ঘুরে দাঁড়াতেই শহীদ দেখতে পেল কুয়াশাকে।
‘কংগ্রাচুলেশনস্, শহীদ। শহীদ মুখোমুখি দাঁড়াল কুয়াশার, গুলি করলে যে?
শত্রুরা তোমাকে দেখছিল আড়াল থেকে। ভেগেছে। আচ্ছা, গ্যাসোলিনের গন্ধ পাচ্ছ কি? সম্ভবত শত্রুদের ‘কপ্টার আছে আশপাশে। শত্রুরা ওতে চড়ে পালাবে।’
শহীদ জানতে চাইল, তুমি এত তাড়াতাড়ি এলে কিভাবে?
রাসেল ‘কপ্টারে তুলে নিয়েছিল আমাকে। নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে সৈয়দ কবীর, রাজকুমারী এবং মি. ডি কস্টাকে নিয়ে আসতে।’
শহীদ জিজ্ঞেস করল, দানবটাকে তুমি কিচিরমিচির করে কি এমন বললে যে…?’
কুয়াশা হাসল। বলল, আমার পোষা গরিলা গোগীর সঙ্গে কথা বলতাম আমি এই ভাষায়। আকারে প্রকাণ্ড হলেও দানবটা বনমানুষ বলেই মনে হয়েছিল আমার। শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি গোগীর ভাষায় দানবটাকে নির্দেশ দিই ভ্যানটাকে ভেঙে ফেলার জন্যে। বিপদের কথাটাও বলি। তাতেই কাজ হয়।’
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটের মত একটা মিনি ওয়্যারলেস বের করল কুয়াশা। সেটটা অন করে কথা বলল সে, রাসেল।
রাসেলের কণ্ঠস্বর অস্পষ্টভাবে শোনা গেল, আমরা উপরে এসে পৌঁছেছি।’
ফ্লাড লাইট জ্বালো। শত্রুদের একটা ‘কপ্টার আছে এই এলাকায়। খুঁজে পাও কিনা দেখো চেষ্টা করে।’
কুয়াশার কথা শেষ হবার আগেই কাছাকাছি থেকে একটা ইঞ্জিনের শব্দ ভেসে এল। দৌড়ে গিয়ে লাভ নেই, আকাশে উঠতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে ‘কপ্টারটা।
খানিকপর নিকষ কালো আকাশের গায়ে কপ্টারটাকে দেখতে পেল কুয়াশা। ছোট ছোট দুটো বালব জ্বলছে ককপিটে! একমুহূর্ত পর দুটো অত্যুজ্জ্বল ফ্লাড লাইটের আলো শত্রুপক্ষের কপ্টারে গিয়ে পড়ল।
পরিষ্কার দেখতে পেল কুয়াশা এবং শহীদ কপ্টারটাকে। ককপিটে জগদীশকে দেখে একটু অবাকই হলো শহীদ! জগদীশ আসলে কপ্টার নিয়ে এসেছে খানিক আগে তার সহকারীদের তুলে নিতে।
ওরা দেখল জগদীশের পাশে বসে রয়েছে লাকী। ঝড়ের বেগে দূরে সরে যাচ্ছে কালো রঙের কপ্টারটা।
কুয়াশা নির্দেশ দিল রাসেলকে ফলো করবার দরকার নেই। ওরা সুযোগ পেলেই গুলি করবে। তুমি গুলি করতে পারবে না–কারণ লাকী রয়েছে ওদের সঙ্গে। নেমে এসো ‘কপ্টার নিয়ে।
খানিক পর ফাঁকা জায়গায় নামল দুটো মিনি কপ্টার। সৈয়দ কবীর শুকনো গলায় বলে উঠল, ভয়ে মরেই যাচ্ছিলাম আমি! প্লেন বা কপ্টারে চড়তে ভীষণ ভয় করে আমার।’
শহীদ বলল, শত্রুরা রওনা হয়েছে টেকনাফের দিকে। কুয়াশা আমরা নিশ্চয়ই…!’
কুয়াশা বলল, ‘অবশ্যই।’
সৈয়দ কবীর আঁতকে উঠল, আবার আবার আকাশে উঠতে হবে?
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। আমরা টেকনাফে যাব। শত্রুরা ওখানেই যাচ্ছে। আপনি কি চান না যারা আপনাকে বন্দি করে রেখেছিল তাদের উপযুক্ত শাস্তি হোক?
চাই না মানে! একশোবার চাই। কিন্তু, মি, কুয়াশা, আমি একজন ভীতু লোক! আমি এই গোলাগুলি, হাঙ্গামা-ফ্যাসাদের মধ্যে থাকলে নির্ঘাৎ মরে যাব। ওরা–মি. কুয়াশা, ওদেরকে আপনি চিনতে পারেননি! ভয়ঙ্কর হিংস্র ওরা। কথায় কথায় খুন করে। ওদের বিরুদ্ধে লাগার কোন ইচ্ছা আমার নেই। ওদের শাস্তি হোক তা চাই, কিন্তু আমি নিজে ওদের বিরুদ্ধে যেতে পারব না, সে সাহস আমার নেই। মি. কুয়াশা, আমি বরং ঢাকায় চলে যাই। যতদিন না এই সব বিপদ কাটে ততদিন ঢাকাতেই থাকব আমি।’
কুয়াশা বলল, আপনার যেমন ইচ্ছা। যাক-রাসেল, শোনো। তুমি রাঙ্গামাটিতে যাবে, এখনই। ওখানে গিয়ে সৈয়দ কবীর সাহেবের শিপিং কোম্পানির হেড অফিসের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করবে। যাবতীয় কাগজপত্র, দলিল দস্তাবেজ-সব পরীক্ষা করবে তুমি। সৈয়দ সাহেব জানতে চান গত এক বছরে বাধ্য হয়ে যেসব কাগজে তিনি সই করেছেন, সেগুলো কি ধরনের কাগজ, সেগুলোয় সই করে তিনি কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
সৈয়দ কবীর বলল, শয়তান সানাউল হক সম্পর্কে কোন খবর নেবার দরকার নেই। আমি জানি সে-ই এই সব গণ্ডগোলের মূলে আছে।
কুয়াশা রাসেলের উদ্দেশে বলতে শুরু করল, ‘সানাউল হক একজন কেমিস্ট…।’
‘কেমিস্ট না ছাই! নামে মাত্র কেমিস্ট। শয়তানটার মাথায় গোবর ভরা। পাগলের প্রলাপ বকত সারাক্ষণ। সবাই বলত বদ্ধ উন্মাদ লোকটা। কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করত যখন-তখন। তার ধারণা ছিল, গৃহপালিত গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগী সহ সব প্রাণীকে আকারে দশ গুণ বড় করা সম্ভব।
‘প্রাণীদেরকে দশগুণ বড় আকারে পরিণত করার কথা বলত সানাউল হক?’
বলত। তার ধারণা ছিল, তা করতে পারলে গরুর দুধও হবে দশগুণ, মুরগীর ডিম হবে এখুনকার চেয়ে দশগুণ বড়। এই সব আবোলতাবোল বকত বলেই তো তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আমরা তাকে পাগল ভাবলেও সে পাগল নয়, সে আসলে শয়তান। ক্ষমতার পূজারী। পাওয়ার চায় সে।
নয়
রাতের বাকি অংশ এবং পরদিন বিকেল অবধি মহা ব্যস্ততার মধ্যে কাটল।
‘সকালে রাসেল গেল সৈয়দ কবীরকে নিয়ে ফ্রেণ্ডস শিপিং কোম্পানীর হেড অফিসে। সৈয়দ কবীরকে দেখে অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে দারুণ আনন্দের ঢেউ উঠল। কিন্তু সৈয়দ কবীরকে খুব বিমর্ষ দেখাল সারাক্ষণ । বিশেষ কারও সঙ্গে বেশি কথা বলল না সে।
কাগজপত্র পরীক্ষা করতে শুরু করল রাসেল। উল্লেখযোগ্য নানা ব্যাপার জানতে পারল সে। রহস্যময় ব্যাপার হলো, কোম্পানি গত বছরখানেক আগে ব্যাঙ্ক থেকে মোটা টাকা তুলে অস্বাভাবিক বেশি পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য কিনেছে। সেই খাদ্যদ্রব্য বার্জ যোগে পাঠানো হয়েছে কক্সবাজারে। বাজের গন্তব্যস্থান সম্পর্কে অবশ্য কিছুই জানা গেল না। এসব কাজ কোম্পানির ম্যানেজার সম্পন্ন করেছেন, সৈয়দ কবীরের লিখিত চিঠির নির্দেশ অনুযায়ী। সৈয়দ কবীর বললেন, শয়তানের দল আমাকে সই করিয়ে নিয়ে এই সব কাণ্ড করেছে, বুঝতে পারছি।
কোম্পানির একাউন্ট থেকে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ টাকা তোলা হয়েছে। প্রতিটি চেকে সই ছিল সৈয়দ কবীরের। চেকের টাকার প্রাপক ছিল সানাউল হক।
‘শয়তানটার নামে বাধ্য হয়ে চেক কাটতে হত আমাকে। টাকার অঙ্ক সেই বসিয়ে নিত।
সন্ধ্যার বেশ খানিক আগে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হলো ওরা। কুয়াশার নিজস্ব ‘কপ্টারে চড়ল সবাই। সৈয়দ কবীর বিদায় জানাল হাত নেড়ে ।
কুয়াশাকে সৈয়দ কবীর জানিয়েছে, পরবর্তী প্লেনে সে ঢাকায় যাবে।
হেলিকপ্টারে কুয়াশা ছাড়াও রয়েছে শহীদ, রাজকুমারী, রাসেল, মি. ডি. কস্টা এবং তার বাচ্চা স্পুটনিক।
কামাল নেই শুধু। সে ঢাকাতে আছে প্রথম থেকেই। এবার শহীদ চট্টগ্রামে একাই বেড়াতে এসেছে। হেলিকপ্টারের কন্ট্রোল কেবিনে রয়েছে কুয়াশা।
সোফায় বসে ডি. কস্টা স্পুটনিককে শিক কাবাব খাওয়াচ্ছে। শহীদ এবং রাসেল গল্প করছে। রাজকুমারী ওমেনা বিজ্ঞান বিষয়ক একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছে একমনে।
লাউডস্পীকারে ভেসে এল শান্ত অথচ গমগমে একটা কণ্ঠস্বর, টেকনাফের উপর পৌঁছে গেছি আমরা।’ টেকনাফ। ও ওর ঝধ্বপাহাড়, বনভূমি, সাগর এবং নদী–সবই আছে টেকনাফে। শহরটা অত্যন্ত ছোট। ডাল হোটেল নেই বললেই চলে। মন্দের ভাল একটাই, সেটার নাম মডার্ন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। লোকসংখ্যা খুবই কম। শহরে উপজাতীয়দের দেখা পাওয়া যায়।
শহীদ এবং রাজকুমারী কন্ট্রোল কেবিনে গিয়ে ঢুকল। পিছন পিছন গেল রাসেল এবং ডি. কস্টা, কুয়াশা বলল, আমরা সাগরের কাছাকাছি ইউনুস আদাঙের বাড়ির সামনে গিয়ে নামব। রাতটা কাটাতে হবে তাঁবুতে। সকাল থেকে তদন্তের কাজ শুরু করা হবে।
ইউনুস আদাঙের বাড়ি চিনবেন কিভাবে আপনি? জানতে চাইল রাসেল।
চিনব। দৈনিক একটা পত্রিকায় ইউনুস আদাং এবং এমাম রাউয়ের বাড়ির লোকেশান মোটামুটি বর্ণনা করা হয়েছিল।
সাগরের উপর দিয়ে উড়ছে কুয়াশার স্পেশাল হেলিকপ্টার ধীর গতিতে । নিচে সাগর, পাশেই বালুকাবেলা, তারপরই বনভূমি।
আরও মাইলখানেক পরই একটা দো-চালা দেখা গেল বনভূমির ভিতর।
কুয়াশা বলল, ইউনুস আদাঙের বাড়ি।
আরও আধমাইলটাক এগিয়ে সাগরে নামল। ভাসতে লাগল সি-প্লেনের মত । তীরের দিকে এগিয়ে চলল স্পেশাল কিপ্টার।
নোঙর ফেলে বালুকাবেলায় নামল ওরা।
কুয়াশা বলল, ‘শহীদ, ইউনুস আদাঙের বাড়ির কাছে নয়, আমরা তার ফেলব এমাম রাউয়ের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির কাছে। দুর্ঘটনা ঘটেছে যেখানে সেখানে রাতটা কাটাতে চাই আমি।’
কেউ আপত্তি করল না। সকলের আগে আগে চলল কুয়াশা। বিশ-পঁচিশ গজ এগোতেই ধ্বংসস্তূপ দেখা গেল। দো-চালাটা চেনবার কোন উপায়ই নেই। ভাঙা বাঁশ, ভাঙা তক্তা, কাঠের টুকরো, দোমড়ানো-মমাচড়ানো ঢেউ টিন-সুপীকৃত হয়ে আছে।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে টর্চের আলোয় ধ্বংসস্তূপটা দেখতে লাগল ওরা।
সবাই যে যার কাঁধের বোঝা নামিয়ে রাখল ঘাসের উপর। জায়গাটা এমাম রাউয়ের ধংসপ্রাপ্ত দো-চালার কাছ থেকে হাত দশেক দূরে, অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায়। তাবু ফেলার কাজ শেষ হলো ঘন্টাখানেকের মধ্যে। বুনো জীব জানোয়ারের আক্রমণ হতে পারে বলে তাঁবুর চারধারে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা। করা হলো। কাঠ সংগ্রহ করে সাজানোই হলো শুধু, তাতে আগুন ধরানোর কাজটা বাকি রইল। রাসেল বলল, আগুন না ধরালেও চলে।
ডি. কস্টা বলল, আগুন জ্বালিয়েও লাভ নেই। ডেকিটেছেন না আকাশের অবষ্টা কেমন ক্লামজি রূপ ঢারণ করিটেছে।
সকলে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল। সাগরের গর্জন বাড়ছে যেন ক্রমশ। আকাশের দিকে তাকাল সবাই। তাইতো! বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। কালো মেঘ। দ্রুত ঢেকে ফেলছে গোটা আকাশটাকে।
সুন্দর পরিবেশ। তাঁবুর ভিতর স্পঞ্জের ফাঁপা বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল সবাই।
ক্লান্ত শরীর, দু’চোখ জুড়ে ঘুম নামল সকলের।
Leave a Reply