৫৬. মরণ ছোবল ২ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৫৬
প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর, ১৯৭৬
এক
খুলনা-আস্তানার ইনচার্জ হেদায়েত উল্লী রওনা হয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক আগে সুন্দরবনের দিকে। ওয়্যারলেস সেট নিয়ে গেছে সঙ্গে। স্পীডবোট নিয়ে রওনা হয়েছে সে, ‘আশা করা যায় আরও ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সুন্দরবনের ক্যাম্পে পৌঁছে যাবে সে।’
| হেদায়েত উল্লার সহকারী ওসমান কুয়াশাকে অভ্যর্থনা জানাল। পথ দেখিয়ে নিচে নিয়ে গেল সে। মাত্র ঘন্টাখানেকের মধ্যে রাজকীয় ব্যবস্থা করেছে সে। খানাপিনার ।
খিদে পেয়েছিল ওদের। বিনাবাক্যব্যয়ে খেতে বসল সবাই। খেতে খেতেই কুয়াশা স্থানীয় সমস্যাবলী সম্পর্কে প্রশ্ন করে জেনে নিল বিশদ। * কুয়াশা বলল, আচ্ছা, ওসমান, খবরের কাগজে খবর বেরিয়েছিল খুলনার আকাশে লম্বা চুরুটের মত একটা অদ্ভুত আকৃতির আকাশযান দেখা গেছে কিছুদিন আগে। দেখেছ নাকি তুমি?
| ওসমান বলল, দেখেছি, ভাইয়া। খালিচোখে এক কি দুবার মাত্র দেখা গেছে। আমরা দেখেছি বিনকিউলার দিয়ে। অনেক উপর দিয়ে যাচ্ছিল সেটা। খুব ছোট দেখাচ্ছিল, সূর্যের আলোয় চকচক করছিল। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বলে মনে হচ্ছিল…।’
কোন্দিক যাচ্ছিল? ‘পশ্চিম দিকে। শহীদ বলল, তার মানে সুন্দরবনের দিকে।’
ঘণ্টা দেড়েক পর ওয়্যারলেসে যোগাযোগ স্থাপন করল কুয়াশা হেদায়েত উল্লার সঙ্গে।
| উৎসাহব্যঞ্জক খবর পাওয়া গেল । হেদায়েত উল্লা জানাল, ভাইয়া, ক্যাম্পের লোকজন এখন থেকে কয়েক ঘন্টা আগে একটা প্লেনের আওয়াজ পেয়েছে। ক্যাম্পটা মরণখোলার ত্রিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। প্লেনটা অর্ধনগাশিয়ার দিকে গেছে বলে ওদের ধারণা। ওদিকটা খুবই দুর্গম মানুষজন নেই, কেউ পা বাড়াতে সাহস পায় না।’
কুয়াশা বলল, “ঠিক আছে। আমরা ‘কপ্টার নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ওখানেই থাকো। আবার যদি প্লেনের শব্দ পাও, সঙ্গে সঙ্গে জানাবে।’
হেদায়েত উল্লা বলল, ভাইয়া, আর একটা খবর। ক্যাম্পের লোকেরা কদিন আগে লম্বা আকারের একটা আকাশযান দেখেছে বলছে•••।’
৪৩
কুয়াশা ৫৬
কোন দিকে যেতে দেখেছে? দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, অর্থাৎ অর্পনখাশিয়ার দিকেই।
“ঠিক আছে। আমরাও ক্যাম্প থেকে স্পীডবোট নিয়ে অর্ধনগাশিয়ার দিকে যাব। বোটটাকে তৈরি রাখো। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছুচ্ছি আমরা।’
সকাল হয়ে এসেছে।
ঘন সবুজ বনভূমির উপর দিয়ে ছুটে চলেছে হেলিকপ্টার নিচের দিকে চেয়ে আছে সবাই। ডি কস্টা বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে দেখছে।
| দুঃখ রহিয়া গেল, আজ অবডি একটা বলেবেঙ্গল টাইগার শিকার করিটে পারিলাম না।’
রাসেল বল, সে চেষ্টা করলে দু’রকম বিপদে পড়বেন আপনি। এক, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আপনাকে পেটে পুরে ফেলবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবে। দুই, স্থানীয় পুলিস আপনার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করবে। বাঘ শিকারকরা এখন নিষিদ্ধ।
শহীদ লক্ষ করছিল, ‘কুয়াশা বারবার পুব দিকে তাকাচ্ছে। পুবাকাশে এক খণ্ড কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে।’
“কি দেখছ, কুয়াশা?’
কুয়াশা বলল, স্পীডবোট নিয়ে হাদি হুসেনদেরকে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে। জঙ্গলের ঠিক কোথায় তারা কে জানে। সবচেয়ে ভাল হত যদি কপ্টার নিয়ে সন্ধান চালানো যেত। কিন্তু তাও সম্ভব নয়। কপ্টারকে ওরা দেখে ফেলবে। সহজেই। সেক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্যই আমাদের ব্যর্থ হবে।’ | একটু বিরতি নিয়ে কুয়াশা আবার বল, ‘পুবাকাশে একটুকরো কালো মেঘ দেখতে পাচ্ছ? ভাবছিলাম, আকাশটা যদি মেঘে ঢাকা পড়ে যেত তাহলে বড় সুবিধে হত আমাদের। কপ্টার নিয়েই খোঁজ করতে পারতাম। * মিনিট সাতেক পর শহীদ বলল, তোমার আশা পূরণ হতে যাচ্ছে সম্ভবত, মেঘ দ্রুত এগিয়ে আসছে, ঢেকে ফেলছে আকাশ। * রাসেল পিছন থেকে মন্তব্য করল, ‘প্রকৃতি দেখা যাচ্ছে আমাদের স্বপক্ষেই
রয়েছে।’
আরও খানিক পর নিশ্চিত হওয়া গেল। ঘনকালো মেঘ গোটা আকাশটাই প্রায় ঢেকে ফেল | * ওয়্যারলেসে জানিয়ে দিল কুয়াশা হেদায়েত উল্লাকে, আমরা ক্যাম্পে নামছি
আপাতত । তুমি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এখুনি রওনা হয়ে যাও অর্পশ্যাশিয়ার দিকে। সতর্ক থেকো।
– কানেকশান বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে কুয়াশা বলল, “বৃষ্টি আসবে। ঝড় এলেই কিন্তু বিপদ।’
ক্রমশ উপরে উঠতে লাগল ‘কপ্টার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মেঘের উপর চলে গেল ওরা। নিচের বনভূমি ঢাকা পড়ে গেল বিশাল মেঘের আড়ালে। মেঘের ফাঁক-ফোকর দিয়ে মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে নিচটা ।
ইতিমধ্যে সবাই চোখে বিনকিউলার লাগিয়ে তৈরি হয়ে গেছে। এক একজন
ভলিউম ১৯,
এক একটা দিক বেছে নিয়েছে। নিচের দিকে চেয়ে আছে সবাই অসীম ধৈর্য নিয়ে। মেঘের ফাঁক দেখলেই সেদিকে তাকাচ্ছে, যদি দেখা যায় কিছু।
ম্যাপের দিকে চোখ রেখে কপ্টার চালাচ্ছে কুয়াশা। ‘অর্পনগাশিয়ার উপর দিয়ে যাচ্ছি আমরা,’ বলে উঠল সে এক সময়।
শহীদ বলল, মালঞ্চ নদীর উপর রয়েছে কপ্টার। কুয়াশা, আরও উত্তর দিকে এগিয়ে যেতে হবে মাইল দুয়েক।’ মাইল ছয়েক এগিয়ে ‘কপ্টারকে শূন্যে দাঁড় করাল কুয়াশা।
‘কিছুই দেখা যাচ্ছে না? চোখে বিনকিউলার ঠেকিয়ে জানতে চাইল সে।
মেঘ এদিকটায় খুব হালকা। নিচের বনভূমি বেশ দেখা যাচ্ছে। তবে, ঘন মেঘের টুকরো এসে প্রায়ই আড়াল সৃষ্টি করছে।
শহীদ বলল, এবার পশ্চিম দিকে যেতে হবে। পশ্চিমে যাত্রা করল কপ্টার।
মিনিট দুয়েক পরই চেঁচিয়ে উঠল কামাল, ইউরেকা! পেয়েছি! শহীদ, দেখতে পাচ্ছিস? আমাদের ঠিক নিচে!’
কেউ দেখছিল পুবদিকটা, কেউ পশ্চিম দিকটা। কামালের চিৎকার শুনে সবাই ব্যস্ত সমস্ত হয়ে তাকাল সরাসরি নিচের দিকে।
কিন্তু প্রকাণ্ড একটা কালো মেঘ ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে ‘কপ্টারের নিচে। ঢাকা পড়ে গেছে বহু নিচের বনভূমি।
কি দেখেছিস?’
কামাল বলল, সাদা, লম্বা বিরাট কিছু একটা দেখছি। উঁচু মাটির ঢিবির ওপর রয়েছে। আশপাশটা সমতল, গাছপালাহীন মাঠের মত।
‘প্লেনটাকে দেখিসনি?’
। হয়তো আছে–দেখতে পাইনি।’ অপেক্ষা করতে হলে অনেকক্ষণ। প্রকাণ্ড মেঘটা গদাইলস্করী ভঙ্গিতে এগোচ্ছে। মিনিট দশেক পর বিদায় নিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে সবাই দেখতে পেল নিচেরবনভূমি।
. কেউ কোন কথা বলল না। লম্বা, চুরুটের মতই দেখতে বটে জিনিসটা। তবে ঠিক সাদা নয়, রূপোর মত রঙ। ঝকঝক করছে। উঁচু একটা মাটির পাহাড়ের উপর রয়েছে সেটা। প্লেনটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
প্লেনটা সম্ভবত অন্য কোন পথ দিয়ে ফিরে গেছে,’ বলল শহীদ। ওমেনা জানতে চাইল, কুয়াশা, কি ওটা?’
কুয়াশা বলল, আরও কাছাকাছি থেকে না দেখলে ঠিক বলা যাচ্ছে না ওটা কয়েক বছর আগে আফ্রিকার জঙ্গলে বা ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া জেপলিন জাতীয় আকাশ যান ব্লু বার্ড কিনা।
শহীদ বলল, কয়েক মাইল দূরে নামতে হবে আমাদেরকে। হাদি হুসেনদেরই আকাশযান ওটা, ধরে নেয়া যায়। নিশ্চয়ই গার্ড আছে আশপাশে। খুব সন্তর্পণে ওটার দিকে এগোতে হবে আমাদের।’
কুয়াশা বলল, ঠিক বলেছ। মাইল তিনেক দূরে নামব আমরা। হেঁটে এগোতে
কুয়াশা ৫৬
হবে।’
কপ্টার ছুটল আবার। শহীদ বলল, “খুবই আশ্চর্য লাগছে একটা কথা ভেবে। ওটা ৰু-বার্ড হোক বা হোক, এই ধরনের আকাশযান আভাকাল একেবারেই অচল, তাই না? হাদি হুসেনরা আধুনিক কোন আকাশযান ব্যবহার করছে না কেন?
কুয়াশা বলল, নিশ্চয়ই সঙ্গত কোন কারণ আছে। এই ধরনের জেপলিন জাতীয় আকাশযানের কিছু সুবিধে অবশ্যই আছে। ল্যাণ্ডিং স্পেস অর্থাৎ রানওয়ে লাগে না এটাকে নামাতে বা ওড়াতে। অনেক উঁচু দিয়ে উড়তে পারে। কোথাও না নেমে অনেক বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। এতগুলো সুবিধে একসঙ্গে আধুনিক কোন আকাশযান দিতে পারছে না। এটার একমাত্র অসুবিধে, এর গতি খুব মন্থর, এই যা।
শহীদ বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। হাদি হুসেনরা অবৈধ কাজে লিপ্ত। ওদের জন্য এই ধরনের আকাশযানই দরকার। আধুনিক প্লেনতা জেটই হোক বা বোয়িংই হোক, প্রচণ্ড শব্দ করে। সেগুলো ব্যবহার করলে মানুষের চোখে পড়বার ভয় আছে ওদের। জেপলিনে শব্দ খুব কম হয়।
কুয়াশা বলল, নিচে ছোট একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে, নামছি আমরা ওখানে। ডি কস্টা কামালের উদ্দেশে বলল, ডর লাগিতেছে!
কেন?’
ডি কস্টা বলল, ‘এনিমিডেরকে টো, আই মিন, এনিমিডের আকাশ যানের সন্ধান টো পাইলাম, কিট্ হামরা পৌঁছাইবার আগেই যডি উহারা পলাইয়া যায়?
কামাল বলল, ‘পালিয়ে যাবে কোথায়? ওদেরকে আমরা নরক পর্যন্ত ধাওয়া করব।
বাট, হামি টাহাটে রাজি নই। নরক ইজ ভেরি ব্যাড প্লেস!
ওমেনা ওদের কথা শুনছিল, মৃদু হেসে বলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তে না গিয়ে উপায় নেই আপনার। কুয়াশার সঙ্গে পরিচয় হবার আগে যা পাপ করেছেন তার শাস্তি তো পেতেই হবে আপনাকে। সৃষ্টিকর্তা নরকে আপনাকে একদিনের জন্য হলেও পাঠাবেন।’ [ ইমপসিবল! পাপ করিলে কি হইরে, আমি ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বাঁচিয়া যাইব থুড়িলনা। কে বলিয়াছে হামি পাপ করিয়াছি! জীবনে একটিও মিঠ্যা কঠা বলি নাই, কখনও চুরি করি নাই…’ খেপে গেল ডি কস্টা।
কামাল বলল, শান্ত হোন, মি. ডি.কস্টা। অমন উত্তেজিত হতে নেই। সবাই ভাববে নরকে যাবার ভয়ে আপনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আসলে কি জানেন, নরকে আপনি গেলেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমরা তো আছি। হাজার হোক, আপনার বন্ধুবান্ধবই তো আমরা। আপনি নরকে গেলে আমরা কি চুপ করে বসে থাকব? কখনও না। আমরা সবাই ছুটব আপনাকে নরক থেকে উদ্ধার করে আনতে।’ | ডি.কস্টা চেয়ে রইল কামালের দিকে। তারপর ফিস ফিস করে বলল, ‘হাপনি সত্যি হামার গুড ফ্রেণ্ড। একটা কঠা বলি, অটীটে সংসার চর্ম পালন করিবার জন্য ডু’ একটা ক্রাইম করিয়াছি। হয়টো সেজন্য নরকে যাইটে হইটে পারে। মি.
৪৬
ভলিউম ১৯
কামাল, সটি আমাকে মুক্ত করিটে যাইবেন হাপনারা? কঠা ডিটেছেন?
হাসি চেপে কামাল বলল, “নিশ্চয়ই যাব। কথা দিচ্ছি।
যাক, শান্টিটে মরিটে পারিব টাহা হইলে। মনে ভরসা রহিল, নরকে যাইলেও হাপনারা আমাকে মুক্ট করিয়া আনিবেন। একটা কঠা, হামাকে উড়টার করিটে আপনি যড়ি নরকে একা যাইটে ভয় পান টাহা হইলে হামার বসকে শুড় মনে করাইয়া ডিবেন। টিনি যডি জানিটে পারেন যে হামি নরকে গিয়াছি টাহা হইলে এক সেকেও ডেরি না করিয়া টিনি ছুটিয়া গিয়া হামাকে মূক্ট করিয়া আনিবেন–আই অ্যাম ভেরি শিওর অ্যাবাউট দ্যাট! একমাট্ট টিনিই পারিবেন নরক হইটে হামাকে মুক্ট করিটে। টবে হাপনারাও যাইবেন সাঠে, কেমন? ভ্রমণ করিয়া আসিতে ক্ষটি
কি…
কামাল বলল, কিন্তু যদি স্বয়ং কুয়াশা নরকে যায়? ‘হোয়াট! নো-দ্যাটস ইমপসিবল!’
বলা তো যায় না,সৃষ্টিকর্তার বিচার কেমন হয়। যদি যায়?’
ডি কস্টা বলল, ‘টাহা হইলে নরক বেশিডিন নরক ঠাকিবে না। মি. কুয়াশা নিজের চেষ্টায় নরককে স্বর্গে পরিণট করিয়া ফেলিবেন। যেমন এই দুনিয়াটাকে টিনি সং মানুষের, বুডটিমান মানুষের বসবাসের যোগ্য করিটে চেষ্টা করিটেছেন, টেমনি নরকটাকেও
নামো সবাই! কুয়াশা চেঁচিয়ে উঠল।
লাফ দিয়ে নামল শহীদ, রাসেল, ওমেনা। তাদের পিছু পিছু নামল কামাল, ডি কস্টা ।
কুয়াশা ইতিমধ্যেই ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করে হেদায়েত উল্লার অবস্থান জেনে নিয়েছে। সে বলল, ‘হেদায়েত এখান থেকে মাইল খানেক দূরে আছে। এদিকেই চলো।’
যে-যার ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়েছে। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। বিপদ কোন দিক থেকে হঠাৎ আসে বলা তো যায় না।
| শহীদ সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বলল, ‘সুন্দরবনের সবচেয়ে দুর্গম এলাকা এটা। খুব সাবধান। | কুয়াশা অস্বস্তি বোধ করছিল একটা কারণে। দ্রুত এগিয়ে যেতে চাইছে সে। উঁচু উঁচু নিচ্ছিদ্র কাঁটাওয়ালা ঝোঁপ, ঘন সন্নিবেশিত বৃক্ষরাজি অতিক্রম করে যাচ্ছে। সে ঠিকই, কিন্তু দলের বাকি সবাই পিছিয়ে পড়ছে। সে জন্যে মাঝে-মধ্যেই থামতে হচ্ছে কুয়াশাকে।
. একমাইল অতিক্রম করতেই লেগে গেল প্রায় দেড় ঘণ্টা। নদীর কিনারায় এসে পৌঁছুল ওরা। স্পীডবোটের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে এদিকেই। খানিক পরই দেখা গেল সেটাকে।
হেদায়েত উল্লা বলল, ভাইয়া কি স্পীডবোটে চড়ে আরও গভীরে যেতে চান?
কুয়াশা ৫৬
৪৭
কুয়াশা বলল, পায়ে হেঁটে আমি একাই যাব। শহীদ, তোমরা সবাই অপেক্ষা করো এখানে। আরও মাইল দুই এগোতে হবে আমাকে। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে ফিরব। যদি না ফিরি, ধরে নেবে আমি বিপদে পড়েছি।
শহীদ বলল, কিন্তু তুমি একা যাবে কেন? আমিও যাই তোমার সঙ্গে।’
কুয়াশা বলল, তোমাকে সঙ্গে নিলে ভালই হত। কিন্তু এদের সঙ্গে তোমার থাকা দরকার, শহীদ।’
শহীদ আর কথা বাড়াল না।
কুয়াশা আর বৃথা কালক্ষেপ না করে দ্রুত পা বাড়াল। দেখতে দেখতে গহীন বনভূমি তাকে গ্রাস করল।
এগিয়ে যেতে খুবই অসুবিধে হচ্ছিল কুয়াশার। জঙ্গল এদিকে এমনই গভীর যে সামনে দেখা যায় না, কয়েক হাত দূরের জিনিসও গাছের ডাল, শাখা প্রশাখা, অসংখ্য মোটা মোটা প্যাচানো ঝুরি, এবং ঝোঁপ-ঝাড়ে ঢাকা পড়ে আছে। কিন্তু অসুবিধে হলেও এর চেয়ে গভীর বনভূমির উপর দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাবার অভিজ্ঞতা আছে কুয়াশার।
দ্রুত এগিয়ে চলেছে সে। কখনও লাফ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে সে ঝাঁপ-ঝাড়, কখনও ঝুরি ধরে ঝুলতে ঝুলতে অতিক্রম করছে দূরত্ব, কখনও গাছের শাখার উপর চড়ে অন্য গাছের শাখায় লাফিয়ে পড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এইভাবে মাইল দেড়েক
এগোবার পর থামল কুয়াশা।
বাতাসে সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছে সে। উঁচু একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল নিঃশব্দে। কাঠবিড়ালির মত উঠতে শুরু করল গাছটার কাণ্ড বেয়ে।
গাছের মগডালে উঠে এদিক ওদিক তাকাতেই লোকটাকে দেখতে পেল কুয়াশা। লোকটার গায়ের রঙ আলকাতরার মত কালো, চকচকে। সিগারেট খাচ্ছে একটা গাছের মোটা ডালে বসে।লোকটা আফ্রিকান নিগ্রো । তার এক হাতে রয়েছে একটা রাইফেল।
লোকটাকে দেখে খুশিই হলো কুয়াশা। হাদি হুসেন এই গভীর জঙ্গলেও প্রহরী মোতায়েন রেখেছে। হাদি হুসেনরা এখুনি আফ্রিকার উদ্দেশে যাত্রা করছে না বুঝতে পারা গেল। যাত্রার আগে প্রহরীরা আকাশযানের কাছে ফিরে যাবে। এটাই কুয়াশার খুশির কারণ। “ গাছের মগডাল থেকে আরও কয়েকজন প্রহরীকে দেখল কুয়াশা। চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে দূরে একজন করে প্রহরী । হাদি হুসেনদের লোক সংখ্যা কম নয় দেখা যাচ্ছে।
| গাছ থেকে নেমে সন্তর্পণে এগোতে শুরু করল কুয়াশা । খুব সাবধানে এগোচ্ছে সে। খানিক পরই দেখা গেল নিচের ভূমি ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে উপর দিকে। ভাগ্য ভাল যে পাহাড়টা খাড়া নয়। ঢালু ভূমিতে গাছপালা, ঝোঁপ-ঝাড় যেন অধিকতর ঘন সন্নিবেশিত। পাতার উপর দিয়ে হাঁটছে কিন্তু যাতে এতটুকু শব্দ না। হয় তার দিকে মনোযোগ প্রখর। প্রায় নিঃশব্দে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে কখনও ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে অল্প অল্প করে এগোতে হচ্ছে। দুই গজ জায়গা অতিক্রম করতে কখনও লেগে যাচ্ছে চার পাঁচ মিনিট সময়।
ভলিউম ১৯
অগ্রগতি মন্থর হয়হোক, কিন্তু কোন শব্দ করা চলবে না।
অবশেষে বনভূমির এমন এক জায়গায় পৌঁছুল কুয়াশা যেখান থেকে বিশাল একটা গাছপালাহীন, ফাঁকা জায়গা দেখতে পাওয়া যায়। ঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ফাঁকা জায়গাটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করল সে।
সমতল জায়গার প্রায় মাঝখানে প্রকাণ্ড আকাশযানটাকে দেখা যাচ্ছে। প্রকাণ্ড একটা গাছের শুকনো কাণ্ডের সঙ্গে লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে আকাশযানের সামনেটা। পিছন দিকটাও তেমনি বাধা রয়েছে একটা লোহার ভারি নোঙরের সঙ্গে।
কুয়াশা লক্ষ করল চুরুটের মত লম্বা আকাশযানটার পিছন দিকে একটা গরাদহীন জানালা দেখা যাচ্ছে। জানালার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে লোহার মোটী শিকল। সেই শিকল জড়ানো রয়েছে নিচের নোঙরের সঙ্গে।
লম্বা আকৃতির প্রকাণ্ড আকাশযানটা ভাসছে শূন্যে ।
কন্ট্রোল-কেবিনের জানালা দেখা যাচ্ছে। কে একজন বসে রয়েছে ভিতরে। একটি মেয়েই হবে। কিন্তু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।
আকাশযানটার গায়ে বড় বড় অক্ষরে আবছা লেখা, BLUE-BIRD-YX03.
কয়েক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া জেপলিন রুবার্ড তাহলে এটাই! ব্লু-বার্ড তাহলে ভূমধ্যসাগরে ডোবেনি বা আফ্রিকার জঙ্গলে ধ্বংস হয়েও যায়নি।
কন্ট্রোল-কেবিনের দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতেই মেয়েটিকে চিনতে পারল কুয়াশা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে শায়লা পারভিন। পায়চারি করছে সে অস্থিরভাবে। কুয়াশা দেখল শায়লা পারভিনের দুই হাত সরু লোহার শিকল দিয়ে রাধা রয়েছে।
হাদি হুসেন বা উত্তালকে কোথাও দেখতে পেল না কুয়াশা।
বু-বার্ডের পেটের কাছে একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। সিঁড়ি লাগানো রয়েছে দরজার সঙ্গে। আফ্রিকান লোকেরা মালপত্তর ওঠাচ্ছে উপরে। বোঝা যাচ্ছে, যাত্রার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে এরা।
পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা চলছে কুয়াশার মাথার ভিতর । পনেরো বিশ-মিনিট কেটে গেল। এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল হাদি হুসেন আর উত্তাল ।
ওদেরকে দেখেই আশপাশের কর্মীরা ব্যস্ত হয়ে নিজের নিজের কাজে উঠে পড়ে লাগল। যমের মত, ভয় করে সবাই ওদেরকে, বুঝতে অসুবিধে হলো না কুয়াশার।
ভুরু কুঁচকে উঠল কুয়াশার। ব্যাপার কি! হাদি হুসেন আর উত্তাল সোজাসুজি তার দিকেই এগিয়ে আসছে। | ওদের দুজনের হাতেই রিভলভার। হাবভাব দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না ওরা কুয়াশার অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছে। শান্তভাবে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে তারা। | কাছাকাছি এসে একটু ডান দিকে সরে গেল। ফাঁকা জায়গাটার কিনারায় এসে দাঁড়াল। মাত্র আট-দশ হাত দূরত্ব কুয়াশার কাছ থেকে।
বনভূমির ভিতর থেকে একজন আফ্রিকা লাফ দিয়ে ফাঁকা জায়গাটায় উঠে
৪-কুয়াশা ৫৬
৪৯
গেল, দাঁড়াল হাদি হুসেন আর উত্তালের মুখোমুখি।
একটু অবাকই হলো কুয়াশা। তার কাছ থেকে মাত্র আট-দশ হাত দূরে একজন প্রহরী রয়েছে বনভূমির আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে, তা সে টেরই পায়নি।
| হাদি হুসেন নিচু স্বরে কিছু বলল নোকটাকে। লোকটা ঘাড় কাত করে সায়। দিল বলে মনে হলো। তারপর আবার সে বনভূমির ভিতর প্রবেশ করল।
হাদি হুসেন আর উত্তাল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সিগারেট বের করে ধরাল উত্তাল। ব্লু-বার্ডের দিকে মুখ করে দাঁড়াল, বলল, “ওই মেয়েলোকটা! ওকে দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কেন যে ওর জন্যে তুমি এমন পাগল হয়ে উঠেছ তা বুঝি না। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় নাকি? ও আর কি সুন্দরী, ওর চেয়ে হাজার গুণ সুন্দরী মেয়ে পেতে পারো তুমি!
চুপ করো।
গম্ভীর হয়ে উঠেছে হাদি হসেন। প্রকাণ্ড, মেদবহুল, ভারি দেহটা নড়ে উঠল তার, আবার ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠল, ওকে আমার ভাল লাগে, উত্তাল। কথাটা হাজার বার তোমাকে বলেছি।’
উত্তাল বলল, ‘যে পোষ মানবে না তাকে নিয়ে কেন খামোকা এত এনার্জি ক্ষয় করছ? আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি–ওকে খতম করে ফেলো। আমার কথা শোনোনি বলেই এই বিপদে পড়তে হয়েছে আমাদেরকে। তোমার ওই ডাইনী মেয়েলোকটাই সব সর্বনাশের মূল। সেই আফ্রিকা থেকে এই এত দূরে ছুটে আসতে হয়েছে আমাদেরকে ওরই জন্যে। তবু তোমার চোখ খুলছে না। সুযোগ রয়েছে, ইচ্ছা করলেই ওকে খুন করে ফেলতে পারো। তা করবে না। বেশ, এ ব্যাপারে আমি আর কিছু বলতে চাই না। কিন্তু এ-ও বলে রাখছি, ওই ডাইনীর জন্যে আবার আমরা বিপদে পড়ব।’
হাদি হুসেন বলল, থামো তুমি। আমাকে বোঝাতে এসো না। শখের জিনিসের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা আমি স্বীকার করছি। ওকে আমার ভাল লেগেছে, ওকে আমি বিয়ে করব। আবার ওকে আমাদের আস্তানায় নিয়ে গেলে ওর মন বদলাবে। বাধ্য হয়ে হলেও আমাকে বিয়ে করবে ও। এখন ভালয় ভালয় এই দেশ ত্যাগ করে আফ্রিকায় পৌঁছুতে চাই আমি।’
কখন রওনা হব আমরা? ‘আজই। আজ রাতেই। ব্লু-বার্ডের দিকে পা বাড়াল দুজন।
যা জানবার জেনেছে কুয়াশা। শায়লা পারভিন ওদের কাছে আপাতত নিরাপদেই থাকবে জানতে পেরে স্বস্তি বোধ করল সে।
নিঃশব্দে ঢালু বনভূমি থেকে নামতে শুরু করল কুয়াশা। ফিরে যেতে হবে তাকে স্পীডবোটে। সবাইকে নিয়ে আবার আসতে হবে। মনে মনে একটা পরিকল্পনা তৈরি করেছে সে। পরিকল্পনাটা বাস্তবায়িত করতে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু তা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই এখন।
৫০
ভলিউম ১৯
মাত্র দেড় ঘণ্টা পর ফিরে এল কুয়াশা।
“ বলল, হেদায়েত, তোমার লোকদের তুমি বোট নিয়ে ফিরে যেতে বলল। কাম্পে। তুমি শুধু একজনকে নিয়ে চলে যাও আমাদের কপ্টারের কাছে। ওখানে তমি অপেক্ষা করবে। আজ রাতে শত্রুরা বু-বার্ড নিয়ে যাত্রা শুরু করবে। আমরা ব-বার্ডে চডব, ভিতরে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করব। যদি সফল হই তাহলে তো কথাই নেই, তুমি কপ্টার নিয়ে ফিরে যাবে খুলনায়। আর যদি ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয় তাহলে কপ্টার নিয়ে যতদূর সম্ভব ওদেরকে ধাওয়া করব। তুমি ‘কপ্টার নিয়ে সারাটা রাত এখানেই থাকবে। সকাল নাগাদ যদি আমরা না ফিরি তাহলে ধরে নেবের-বার্ডে চড়তে পেরেছি আমরা–তখন তুমি ফিরে যাবে।
ঠিক আছে, ভাইয়া।’
কালবিলম্ব না করে রওনা হলো ওরা সবাই কুয়াশার নেতৃত্বে। যেতে যেতে কুয়াশা যা যা দেখেছে সব বলল ওদেরকে।
সব শেষে সে বলল, ‘ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে র-বার্ডের কাছাকাছি। পৌঁছুনোটাই বড় কথা। উপরে ওঠা খুব একটা কঠিন হবে না। আমি লক্ষ করেছি বু-বার্ডের ঠিক পিছনে একজন প্রহরী আছে আধঘণ্টার মধ্যে দু’বার তাকে সিগারেট খাবার জন্যে জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে দেখেছি আমি। ব্লু-বার্ড হাইড্রোজেন গ্যাসের একটা ট্যাঙ্ক বিশেষ, তাই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। লোকটার সিগারেটের প্রতি এই যে অত্যধিক আসক্তি–এটাই আমাদের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।’
দলে কত লোক ওদের? ‘পনেরো বিশ জনকে দেখেছি। আরও বেশি থাকতে পারে। চেহারা দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় সব ক’টা অপরাধী, গুণ্ডা-বদমাশ। শক্ত-সমর্থ শরীর, ক্ষতবিক্ষত মুখ, বেপরোয়া অঙ্গভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি, নির্মম। সবাই সশস্ত্র। দু’একজন ইউরোপিয়ানকেও দেখেছি। বাঙালী বলতে একমাত্র উত্তাল চৌধুরী। বাকি সবাই আফ্রিকান।’
এবারের এগিয়ে যাবার গতি ধীর, মন্থর। কুয়াশার মত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারছে না কেউ। ফলে কুয়াশাকেও ধীরে ধীরে এগোতে হচ্ছে। তবে অক্লান্ত
পরিশ্রম করে এগোচ্ছে সবাই।
ঘণ্টাখানেক পর কুয়াশা চাপা স্বরে বলল, আর কোন কথা নয়। কোন শব্দ নয়। আশপাশেই রয়েছে প্রহরীরা।
একটা গাছে চড়ল কুয়াশা। চারদিক দেখে নেমে এল সে। দিক পরিবর্তন করল দলটা। একটু একটু করে, প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে চলল সবাই কুয়াশার পিছু
খানিকপর ক্রমশ উঁচু ভূমির দেখা মিলল। আরও সতর্ক, আরও সাবধান হলো
পিছু।
কুয়াশা ৫৬
সবাই। পরিশ্রমে ক্লান্ত ওরা। কিন্তু কেউ জোরে নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলছে না।
একশো গজ চড়াই অতিক্রম করতে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে গেল ওদের। তারপর সামনে দেখা গেল ফাঁকা জায়গাটা।
কুয়াশা বলল, ‘সবাই গা ঢাকা দিয়ে থাকে। কোন শব্দ নয়–সাবধান! রাত নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদেরকে।’
অপেক্ষার পালা শুরু হলো। বিরক্তিকর, একঘেয়ে ভাবে কাটছে সময়। সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে সামনের সবকিছু। ব্লু-বার্ডটা সত্যি আশ্চর্য এক জিনিস। পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের পাত দিয়ে মোড়া সেটা। দশটা বড় বড় গোলাকার গম্বুজ রয়েছে উপরে, পাশাপাশি। ওগুলোর কোনটা ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক, কোনটা হাইড্রোজেন গ্যাস-ট্যাঙ্ক।
কুয়াশা ফিসফিস করে বলল, রুবার্ডের পঁচটা ইঞ্জিন, সর্বক’টা নিচে, পাশাপাশি { ফুয়েল ট্যাঙ্কগুলো উপরের দিকে।’
আফ্রিকান প্রহরীরা ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সবাই লক্ষ করল ব্লু-বার্ডের পিছনে মোতায়েন প্রহরীটা ক’মিনিট পরপরই ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকছে সিগারেট খাবার জন্যে। মিনিট চার-পাঁচ পর আবার ফিরে আসছে সে লোহার শিকলের কাছে।
সূর্য অস্ত গেল একসময়। হঠাৎ করেই সন্ধ্যা নেমে এল চারদিকে।
‘গাঢ় হোক অন্ধকার, তারপর,’ বলল কুয়াশা। কেউ কথা বলল না। উত্তেজনা বোধ করছে সবাই এতক্ষণে। সকলেই ভাবছে, এতগুলো লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ব্লু-বার্ডে ওঠা কি সম্ভব হবে? ওঠা সম্ভব হলেও লুকিয়ে থাকা সম্ভব কতক্ষণ? ধরা পড়লে কি হবে?
কিন্তু ধরা পড়বার ভয়ে ভীত নয় ওরা কেউ। সে-কথা ভেবে কাউকে দুশ্চিন্তা করতে দেখা গেল না। সকলেই ভাবছে কিভাবে শত্রুদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ব্লু বার্ডে ওঠা যায় ।
‘বেতের ঝুড়িটা কিন্তু দেখিনি আমি।’ কুয়াশা বলল।
কামাল জানতে চাইল, কোন বেতের ঝুড়ির কথা বলছ? যেটায় রক্তচোষা বাদুড়টা রাখে ওরা?
শহীদ বলল, সেটা ব্লু-বার্ডের কোথাও আছে নিশ্চয়। ডি.কস্টা জানতে চাইল, কোঠায় যাইটে চাহি হামরা? আফ্রিকায়?
অবশ্যই,’ বলল কামাল। ‘হেটু?
কামাল বলল, “হেতু? শায়লা পারভিনের মুখ থেকে একদল দূর্ভাগা লোকের কথা শুনেছি আমরা। লোকগুলোকে সম্ভবত আফ্রিকার কোন দুর্গম জায়গায় বন্দি করে ক্রীতদাসের মত আটকে রাখা হয়েছে। তাদেরকে মুক্ত করাই আমাদের এই অভিযানের উদ্দেশ্য।
ডি কস্টা বলল, ‘ভেরি গুড।’ ঘন অন্ধকার ঢেকে ফেলল চারদিক। আফ্রিকান প্রহরীরা টর্চ হাতে নিয়ে ঘুরে
হা।’
ভলিউম ১৯
বেড়াচ্ছে। রুবার্ডের পেটের কাছে জ্বলছে একটা বৈদ্যুতিক আলো।
এমন সময় বৃষ্টি এল তুমুলবেগে। সেই সঙ্গে জোর বাতাস। মিনিট পনেরেী একনাগাড়ে বৃষ্টি হবার পর মেঘ কেটে গেল।
ভিজে গেছে ওরা সবাই। কিন্তু কেউ নড়েনি নিজের জায়গা ছেড়ে, কেউ কোন শব্দ করেনি।
“ওই যে, লোকটা আবার সিগারেট খেতে যাচ্ছে। এই সুযোগে আমরাও এগোব।
কুয়াশা পা বাড়াল। জঙ্গল থেকে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল সে। ফিসফিস করে বলল, হামাগুড়ি দিয়ে এসো সবাই।
কুয়াশা নিজেও শুয়ে পড়ল সমতল ভূমিতে। বুকে হেঁটে দ্রুত এগোতে লাগল। সে তির্যকভাবে, ৰু-বার্ডের পিছনের লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা নোঙরটার দিকে।
আফ্রিকান ভাষায় প্রহরীরা হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠছে। পরস্পরের উপস্থিতি, অবস্থান সম্পর্কে খবরাখবর নিচ্ছে তারা।
বিরতি না নিয়ে এগিয়ে চলল ওরা ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে। গোটা দলটা প্রায় একসঙ্গে পৌঁছে গেল রুবার্ডের পিছনে। | লোহার মোটা শিকল ধরে ঝুলতে ঝুলতে উঠতে শুরু করল কুয়াশা । গরাদহীন জানালার কাছে পৌঁছে মাথা তুলে উঁকি দিল সে। কেউ নেই কামরার ভিতর। জানালা গলে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
কামরাটা বেশ বড়সড়। কোন দরজা দেখল না কুয়াশা। বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। সেই আলোয় দেখল সে কামরার মুখোমুখি সরু সরু প্যাসেজের মত অনেকগুলো টানেল দেখা যাচ্ছে। মোটা পাইপের টানেল। পাইপগুলো ক্রমশ ঢাল হয়ে নেমে এসেছে এই কামরার দিকে, প্রবেশ করেছে কামরার দেয়ালের পাশে রাখা বড় বড় টিনের পাত্রে। পাইপের মুখগুলোয় ফিল্টার লাগানো। টিনের প্রকাণ্ডাকার পাত্রগুলোয় পানি জমে রয়েছে। টিনের পাত্রগুলোর নিচে ছোট ছোট ছিদ্র আছে, সেই ছিদ্র পথে পানি পড়ছে নিচে, মাটিতে।
পাইপের টানেলগুলো ক্রমশ উঁচুতে উঠে গেছে। সোজা তাকালে দেখা যাচ্ছে একটা সিঁড়ি। সিঁড়ির দু’পাশে অখ্য মোটা মোটা পাই। সিঁড়ির মাথা থেকে শুরু হয়েছে করিডর। লম্বা করিডর। করিডরের দু’পাশে কেবিন। শেষ মাথায় কন্ট্রোল রূম। করিডরের উপর হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি ট্যাঙ্ক। টানেলের মোটা পাইপগুলো গিয়ে মিশেছে সেই ট্যাঙ্কগুলোয় ।
পাইপলো মোটা হলেও পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের পাত দিয়ে তৈরি। নেমে এল কুয়াশা। বলল, একে একে উঠে পড়ো সবাই।
বলতে যা দেরি, ডি.কস্টা শিকল ধরে ঝুলতে ঝুলতে উঠতে শুরু করল, তাকে অনুসরণ করল কামাল।
কুয়াশা দল ছাড়া হয়ে সরে গেল একটু দূরে। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে সে, সতর্ক দৃষ্টি রাখছে প্রহরীদের দিকে। | দূরে, জঙ্গলের কিনারায়, ছোট্ট একটা আগুনের টুকরো দেখা যাচ্ছে। প্রহরীটা সিগারেট খাচ্ছে। মাঝে মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে সেটা।
কুয়াশা ৫৬
দ্রুত তাকাল কুয়াশা শিকলের দিকে। উঠে যাচ্ছে শহীদ। আবার তাকাল সে জঙ্গলের দিকে। ছোট্ট আগুনের টুকরোটা ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ল। বোঝা গেল, প্রহরী তার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে–এবার সে এগিয়ে আসছে।
অন্ধকারে দুই লাফে শিকলটার কাছে চলে এল কুয়াশা। দুই হাত ধরে স্কুলে পড়ল সে শিকল ধরে, উঠতে শুরু করল দ্রুত।
এই! কে? কে ওখানে?’ আফ্রিকান ভাষায় প্রহরীটা চিৎকার করে উঠল। সর্বনাশ! প্রমাদ গুণল কুয়াশা। ধরা পড়ে গেছে সে। “থামো! যেই হও, নোড়া না বলছি!
কুয়াশা আরবী ভাষায় ভারি গলায় বলে উঠল, ‘চুপ করো, গাধা কোথাকার! কাজের সময় গোলমাল করতে পারো শুধু তোমরা। কানা নাকি? দেখতে পাচ্ছ না শিকলটা পরীক্ষা করছি আমি।’
‘ও, ঠিক আছে, ঠিক আছে। অন্ধকার কিনা, বুঝতে পারিনি।’ কুয়াশা হাঁফ ছেড়ে আবার উঠতে শুরু করল।
এমন সময় গরাদহীন জানালায় একটা হাত দেখা গেল। ঘড়িটা দেখে হাতটা চিনতে পারল কুয়াশা। শহীদের হাত।
শহীদের হাতের আঙুলগুলো নড়ছে। একমুহূর্ত পরই হাতটা সরিয়ে নিল ও।
চমকে উঠল কুয়াশা। আঙুল নেড়ে সঙ্কেতের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে শহীদ, আমরা ধরা পড়ে গেছি।
গৃতি এতটুকু শ্লথ হলো না কুয়াশার। মুহূর্তের জন্য একটা হাত তার আলখেল্লার পকেটে ঢুকল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল সেটা।
পরমুহূর্তে সেই হাত দিয়ে জানালার কারনিস ধরল সে, মাথা তুলল জানালা বরাবর । ঠ করে মৃদু শব্দ হলো একটা।
একটা রিভলবারের নল দেখতে পে কুয়াশী। তার মাথার দিকে লক্ষ্য করে ধরা রয়েছে।
উঠে এসো, বাছাধন!
মাথার উপর থেকে আফ্রিকান লোকটা কর্কশ কণ্ঠে, চিবিয়ে চিবিয়ে হুকুম করল। কুয়াশা দেখল কামরার ভিতর রিভলভারধারী আরও একজন লোক রয়েছে।
| শহীদ, কামাল, ওমেনা, রাসেল এবং ডি কস্টা দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। তাঁদের সকলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে রিভলভার উঁচিয়ে দ্বিতীয় নিগ্রোটা।
শিকল ধরে উঠে পড়ল কুয়াশা জানালার উপর। লাফ দিয়ে নামল কামরার মেঝেতে।
‘মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও!’ নির্দেশ দিল সামনের নিগ্রোটা ।
মাথার উপর হাত তুলল কুয়াশী। নিজের বুকের দিকে তাকাল সে। তারপর তাকাল শহীদ, কামাল, ওমেনা–ওদের প্রত্যেকের দিকে একবার করে। তারপর আবার নিজের বুকের দিকে তাকাল।
৫৪
ভলিউম ১৯
কুয়াশার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধে হুলো না কারও। সবাই লম্বা শ্বাস নিয়ে দম বন্ধ করে রাখল।
“কি ব্যাপার শুনি?’
প্রথম নিগ্রোটা কথা শেষ করতে পারল না, টলে উঠল সে। চোখের পলকে পড়ে গেল সে মেঝের উপর সশব্দে। চিৎকার করার জন্য মুখ হাঁ করল দ্বিতীয় নিগ্রোটা, কিন্তু হঠাৎ সে-ও টলে উঠল, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল প্রথম জনের মতই সশব্দে।
বলাই বাহুল্য, জানালার সামনে পৌঁছেই কুয়াশা একটা ক্ষুদ্রাকার গ্যাস বোমা ছেড়ে দিয়েছিল হাতের মুঠো থেকে কামরার মেঝেতে। সেই গ্যাসেই আক্রান্ত হয়েছে নিগ্রো দু’জন।
মিনিট খানেক পর দম ছাড়ল ওরা সবাই। ‘দেহ দুটোকে নিয়ে সমস্যা হবে।’ গভীর শোনাল ওমেনার কণ্ঠস্বর, ‘ওদেরকে পেলে সন্দেহ সৃষ্টি হবে শত্রুদের মনে, তন্ন তন্ন করে খুঁজবে ওরা। ধরা পড়তে আমরা বাধ্য।
কামাল জানতে চাইল, মি. ডি.কস্টা, কি করছেন শুনি?
নিজের ব্যাগ খুলে ডি.কস্টা একটা সিরিজ আর একটা ওষুধের শিশি বের করেছে। জিনিস দুটো নিয়ে বসেছে সে অচেতন লোক দুটোর পাশে। শিশি থেকে সিরিঞ্জে পরিমিত ওষুধ নিয়ে একজন নিগ্রোর বাহুতে ইঞ্জেকশন দিতে যাচ্ছে সে।
শহীদ বলল, বাধা দিসনে ওকে। ব্রেন-প্যারালাইজার মেডিসিন ঢুকিয়ে দিচ্ছে ও নিগ্রোদের শরীরে। জ্ঞান ফিরলেও ওরা অতীতের কোন কথা স্মরণ করতে পারবে না। নেশাগ্রস্ত মানুষের মত আচরণ করবে। বেশ কয়েকদিন থাকবে,
ওষুধটার প্রভাব।’
“ ওমেনা বলল, আমি তাহলে ডি কস্টাকে সাহায্য করি।
বলেই সে তার ব্যাগ খুলে বড় একটা হুইস্কির বোতল বের করল। ছিপি খুলে নিগ্রো দু’জনের জামা-কাপড়ে, চোখে মুখে হুইস্কি ছিটিয়ে দিল সে খানিকটা করে।
বলল, “হাদি হুসেন গন্ধ শুঁকেই বুঝতে পারবে এরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেছে।
এমন সময় বিদ্যুৎবেগে লাফ দিল কুয়াশা। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। একমুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর তার লম্বা, বলিষ্ঠ হাতটা জানালার নিচে নামিয়ে দিয়ে কিছু যেন খপ করে ধরে ফেলল সে। দ্বিতীয় হাতটাও নামিয়ে দিল সে।
– প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল কুয়াশা দুই হাত দিয়ে টেনে আনছে একজন নিগ্রোকে।
– কামরার মেঝেতে দাঁড় করিয়ে দিল কুয়াশা লোকটাকে। লোকটার হাতের রাইফেলটা আগেই কুয়াশা কেড়ে নিয়েছে। ভয়ে, আতঙ্কে, অবিশ্বাসে হাঁ করে। দেখছে লোকটা ওদেরকে। কুয়াশা হাত তুলে লোকটার নাকে একটা ঘুসি মারল।
পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল শহীদ, ধরে ফেলল সে অজ্ঞান দেহটাকে। কুইক, মিডি.কস্টা!
জানালার উপর উঠে দাঁড়াল কুয়াশা কথাটা বলেই। কুয়াশা ৫৬
শহীদ এবং কামাল এক নম্বর নিগ্রোর অচেতন দেহটা ধরাধরি করে জানালার কাছে নিয়ে এল।
জানালার উপর বসে পড়ল কুয়াশা। এক হাত দিয়ে শিকলটা ধরে আছে সে।
কামাল এবং শহীদ কুয়াশার কাঁধে চাপিয়ে দিল অজ্ঞান দেহটা। কুয়াশা শিকল বেয়ে সড় সড় করে নেমে গেল নিচে।
এই ভাবে তিনটে দেহই নামিয়ে দিয়ে ফিরে এল কুয়াশী।
কামরার আলো নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। অজ্ঞান দেহগুলো খানিক আগে বা পরে আবিষ্কৃত হবেই। আবিষ্কৃত হবার পর শত্রুদের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া হয় না হয় সেটাই জানতে চায় ওরা। সব কিছু নির্ভর করছে এর উপর।
মিনিট পনেরো পর নিচ থেকে শোরগোলের শব্দ ভেসে এল। কামাল এবং রাসেল জানালার দিকে পা বাড়াল, কুয়াশা দুই হাত দিয়ে ধরে পিছনে সরিয়ে দিল দুজনকেই। নিজে সাবধানে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু উঁকি দিয়ে না
তাকিয়ে নিচ থেকে ভেসে আসা শব্দগুলো শোনার চেষ্টা করুল সে মন দিয়ে।
বেশ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে হাদি হুসেনের কণ্ঠস্বর ।
“গাধার বাচ্চারা কি কাণ্ড করেছে দেখো। ব্যাটারা চুরি করে মদ খেয়ে উচিত শাস্তি ভোগ করছে। আল্লা মালুম, জ্ঞান ফেরে কিনা! এই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিস কেন ব্যাটারা! তোল, দেহগুলো তুলে নে। যাত্রা করার সময় হয়ে এসেছে সেদিকে বুঝি খেয়াল নেই…’
তিন পাইপ টানেলের শেষ প্রান্তে সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানটা বেশ প্রশস্ত।
কুয়াশার পিছু পিছু সবাই সেই প্রশস্ত জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। সিঁড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে সরু একটা প্যাসেজ। ইন্সপেকশন টানেল ওটা।
প্যাসেজ বা টানেলের দেয়ালগুলো মসৃণ লিনেন দিয়ে মোড়া। গ্যাস ব্যাগ পাশাপাশি বসানো রয়েছে, লিনেন দিয়ে ঢাকা। | টানেলের শেষ মাথায় পৌঁছে বাঁক নিল ওরা। তির্যকভাবে উঠে গেছে টানেলের মেঝে উপর দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর সেলুলয়েডের পর্দা দিয়ে আড়াল করা অবজারভেশন পোর্টের সামনে উপস্থিত হলো ওরা।
পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল কুয়াশা। নোঙর তুলে ফেলা হয়েছে দেখল সে। নিচে অন্ধকার, টর্চের আলোও নেই কোথাও। তারমানে সবাই উঠে পড়েছে ব্লু-বার্ডে। যাত্রা শুরু হতে দেরি নেই আর।
‘আমরা জাহাজের পিছনের দিকেই থাকব। যাতে প্রয়োজন দেখা দিলে সহজে কন্ট্রোলরুমটা দখল করতে পারি।’
শহীদ বলল, একটা জিনিস লক্ষ করেছ, কুয়াশা? প্রতিটি প্যাসেজের সিলিংয়ের গায়ে গর্ত রয়েছে। কেউ উঁকি দিলেই দেখতে পাবে নিচে কি হচ্ছে না।
ভলিউম ১৯
হচ্ছে।’
কুয়াশা বলল, দেখেছি।
একটা ইন্সপেকশন টানেলে আশ্রয় নিল ওরা। মোটর গনভোলা এবং পাইপ টানেল থেকে জায়গাটা একটু দূরে, কারও চোখে পড়বার সম্ভাবনা কম।
ভারসাম্য রক্ষার জন্যে ওয়াটার ব্যালাস্ট রয়েছে–বার্ডে। সগর্জনে পাইপ বেয়ে পানি পড়ছে নিচে, হালকা করা হচ্ছে আকাশযানটাকে।
খানিক পরই ব্লু-বার্ডের পিছন দিকটা উঁচু হয়ে উঠল। তারপর স্টার্ট নিল ইঞ্জিনগুলো। একে একে চালু হয়ে গেল পাঁচটা ইঞ্জিন।
ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করল। ক্রমশ বেগ বাড়ছে তার। একটানা এক হাজার ফুট উপরে উঠে গেল সে, তারপর আরও এক হাজার ফুট।
| বাতাসের চাপ কমে যাওয়াতে গ্যাস-ব্যাগগুলো ফুলে উঠল। মৃদু, থরথর করে কাঁপছে দেয়াল, মেঝে, সিলিং।
একটা পোর্টহোলের পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল কুয়াশা। মেঘ-মুক্ত নির্মল আকাশ। তারাগুলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কুয়াশা। বলল, “পশ্চিম দিকে যাচ্ছি আমরা।’
রাত গম্ভীর হলো।
ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। কেরল একজন রইল জেগে। পালা করে জেগে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা। বিপদ যখন-তখন আসতে পারে, তাই।
এগিয়ে আসছে বিপদ। কুয়াশা এবং তার দলের সবাই অনুভর করছে ব্যাপারটা। আর বড় জোর দু’এক ঘণ্টা, তারপরই ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটবে। ঘটবেই।
বিপদ ঘটবে জেনেও করার কিছু নেই। গম্ভীর, চিন্তিত সবাই। অপেক্ষা করে আছে ধৈর্যের সঙ্গে।
দুইদিন অতিবাহিত হয়েছে। আজ নিয়ে তিনদিন কাটছে। উপমহাদেশের উপর দিয়ে অনুকূল বাতাস পেয়ে সাবলীল গতিতে প্রচুর দূরত্ব অতিক্রম করেছে ব্লু-বার্ড। ঝড়-ঝাঁপটার মুখোমুখি হয়নি একবারও। ইঞ্জিনগুলো কাজ করছে চমৎকারভাবে। | আফ্রিকায় প্রবেশ করেছে ওরা ঘণ্টা কয়েক আগে। আফ্রিকার অভ্যন্তরে এখন ওরা। ঘণ্টা দুয়েক ধরে নিচে তাকালেই মরুভূমি দেখা যাচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়েছে অনেক। নিচের দিকে তাকালেই চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। প্রখর রৌদ্রে মরুভূমির বালি যেন জ্বলছে আগুনের মত ।
দীর্ঘ যাত্রাপথ–রু-বার্ড তার ওজন কমিয়ে ফেলেছে প্রয়োজন অনুসারে। পানির ট্যাঙ্কগুলো এখন প্রায় শূন্য। বিশেষ করে পিছনের ট্যাঙ্কগুলোয় পানি একেবারেই নেই। কিন্তু, তা সত্ত্বেও পিছনের দিকটা অস্বাভাবিক ভারি রয়ে গেছে। কারণ, কুয়াশা এবং তার দলবল রয়েছে পিছনে। * হাদি হসেন এবং উত্তালের চোখ এড়ায়নি রহসটা। পিছনের ওজন কমছে না। কেন? ভাবছে তারা। কি আছে পিছন দিকে।
অনুসন্ধানকারীরা ঘুরঘুর করছে কিছুক্ষণ থেকে। বারবার তার শব্দ ভেসে আসছে। কাছাকাছি আসছে কেউ কেউ, কাউকে না দেখে, কিছু না দেখে ফিরে
কুয়াশা ৫৬
৫৭
যাচ্ছে তারা। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবছে সম্মুখভাগের কোন একটা গ্যাস
বেলুন লিক হয়ে গেছে হয়তো••• ||
পাইপ-টানেল থেকে ঘুরে এল কামাল।
বললু, আরও কয়েকজন লোক আবার এদিকে আসছে। প্রতিটি প্যাসেজ, টানেলু পরীক্ষা করতে করতে আসছে ওরা। শেষ রক্ষা বুঝি আর হলো না।
| ডি কস্টা দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসল। বল, টব ভাল। এই টিন ডিন চুপচাপ শুইয়া-বসিয়া হাটে-পায়ে মরিচা ঢরিয়া গিয়াছে–স্টার্ট হউক ফাইট! এনিমিরা আক্রমণ না করিলে হামরাই আগাইয়া গিয়া অ্যাটাক করিব–টাই না? কারণ, হামাডের খাবার নাই, ওয়াটার নাই ।
কথাটা সত্যি। ঘণ্টা দুয়েক আগে খাবার পানির শেষ ফোঁটাটাও গলায় ঢালা হয়ে গেছে। শুকনো খাবায় এখনও কিছু আছে বটে কিন্তু তা স্বাদহীন, অরুচিকর ঠেকছে ওদের মুখে।
শহীদ বলল, একটা কথা সবাই মনে রেখো। প্যাসেজ, ইন্সপেকশন টানেল বা করিডরে কেউ যেন গুলি না করে। গুলি করা কোনমতেই চলবে না। পাইপের দিক থেকে বেরিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস সব জায়গা প্রায় ভিজিয়ে রেখেছে। আগুনের একটা ফুলকিই যথেষ্ট চোখের পলকে গোটা ব্লু-বার্ডকে ধ্বংস করে দিতে।
| কুয়াশা বলল, ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো সবাই। শত্রুদেরকে ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব বলে আমি মনে করি না। প্যাসেজ, বা টানেলগুলো খুবই সরু–ওরা এগোতে পারবে না দলবদ্ধভাবে। ওরাও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার ঝুঁকি নেবে না।
কয়েকটা গ্যাস বোমা নিয়ে টানেল থেকে বেরিয়ে প্যাসেজে ঢুকল কুয়াশা।
কুয়াশা বেরিয়ে যেতে বাকি সবাই ব্যাগ খুলে গ্যাস বোমা বের করে পকেটে ভরতে শুরু করল।
কুয়াশা প্যাসেজের তেমাথায় এসে থামল। ডান দিকে চলে গেছে প্যাসেজটা সোজা, শেষ মাথায় একটা সিঁড়ি। বা দিকে প্যাসেজটা সোজা গিয়ে বাঁক নিয়েছে। আবার।
মৃদু একটা শব্দ হতে বাঁ দিকে তাকাল কুয়াশা। একজন লোককে দেখল সে। চিৎকার করতে যাচ্ছে লোকটা। এইমাত্র বাক নিয়ে কুয়াশাকে দেখতে পেয়েছে
সে। | হাতের গ্যাস বোমাটা ছুঁড়ে দেবার জন্য মাথা নিচু করে ঝুঁকে পড়ল কুয়াশা, মেঝের উপর দিয়ে গড়িয়ে দিল বোমাটাকে।
কুয়াশা নিচু হতেই ওর মাথার উপর দিয়ে কি যেন তীরবেগে উড়ে গেল বাতাসে শিস কেটে।
সামনের লোকটার দিকে চেয়ে ছিল কুয়াশা। অবিশ্বাস ফুটে উঠল তার দুই চোখে। লোকটা দাঁড়িয়েই আছে, কিন্তু তার মুণ্ডুটা খসে পড়ে গেল মেঝেতে। একমুহূর্ত পর ধড়টাও পড়ে গেল। প্যাসেজের শেষ মাথায়, কাঠের দেয়ালে বিদ্ধ হলো একটা ভোজালি।
ঝট করে পিছন দিকে তাকাল কুয়াশা।
ডান দিকের প্যাসেজের মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে উত্তাল। সেই কুয়াশাকে লক্ষ করে ভোজালিটা ছুঁড়েছিল। ভাগ্য ভাল, ঠিক সেই সময় মাথা নিচু করে ফেলেছিল
৫৮
ভলিউম ১৯
কুয়াশা, তাই বেঁচে গেছে সে। উত্তালের নিক্ষিপ্ত ভোজালি তার নিজের দলেরই একজন প্রহরীকে হত্যা করেছে।
সিঁড়ির দিকে একটা গ্যাস বোমা ছুঁড়ে দিল কুয়াশা। উত্তাল পঁাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে বলতে পিছিয়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য হয়ে গেল সে সিঁড়ির মাথায় উঠে।
পরমুহূর্তে দেখা গেল কয়েকজন লোক হুড়মুড় করে নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। তাদের পিছন থেকে উত্তাল চিৎকার করছে, ধরে আনো শয়তানটাকে। ওকে আমি জ্যান্ত পোড়াব। যাও! এগোও! ভয়ের কিছু নেই।’
সিঁড়ি থেকে প্যাসেজে নেমে এল নিগ্রোর দলটা। একসঙ্গে তীরবেগে। “ড়ে আসছে তিন চারটে ভোজালি। কুয়াশা বিদ্যুৎবেগে একপাশে সরে দাঁড়াল।
নিগ্রোদের দলটা হঠাৎ থামল। কাটা কলা গাছের মত ধূপ ধুপ ক; প্যাসেজের উপর পড়ে গেল কয়েকজন। পিছনে যারা ছিল তারা ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে••• |
| উত্তাল আবার একটা ভোজালি ছুঁড়েছে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে শূন্য থেকে নিক্ষিপ্ত ভোজালিটার হাতল ধরে ফেলল কুয়াশা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেটা উত্তালের দিকে ছুঁড়ে দিল সে।
লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো কুয়াশা। ভোজালিটা গিয়ে লাগল সিঁড়ির পাশে পাশাপাশি সাজানো একটা গ্যাস বেলুনে। লিনেনের আচ্ছাদন, মোটা চামড়ার আবরণ ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেল ভোজালি, বিরাট একটা গহ্বর সৃষ্টি হলো প্রকাণ্ড বেলুনটার গায়ে।
আতঙ্কিত শত্রুরা পড়িমড়ি করে সিঁড়ির ধাপ টপকে উঠে যাচ্ছিল উপর দিকে, তাদের একজন পা পিছলে পড়ে গেল সেই বেলুনের গায়ে। পড়ল তো পড়ল বেলুনের গায়ে যে গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে তার ভিতর। হাইড্রোজেন গ্যাস সেই মুহূর্তে খুন করল তাকে।
কুয়াশার পাশে এসে দাঁড়াল শহীদ এবং কামাল। ওদের পিছনে বাকি তিনজন।
‘তোমরা দু’জন কো পিছনে, আর তিনজন এগোও বাঁ দিকে। নির্দেশ দিল কুয়াশা, চারদিকে ছুঁতে শুরু করে গ্যাস বোমা।’ হাদি হুসেন মস্তু একটা চেয়ারে তার বিরাট দেহ নিয়ে বসে আছে। কালো মুখটা ঘামে ভিজে গেছে তার।
উত্তাল পায়চারি করছে অস্থিরভাবে। চিৎকার করছে সে, তোমার লোকগুলো সব হারামখোর। ওদেরকে টুকরো টুকরো করে শকুনদেরকে খাওয়ানো উচিৎ। একজন নয়, দুইজন নয়-ছয়জন মানুষ এতগুলো লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে জাহাজে উঠে বসে আছে-কেউ জানতেই পারল না। এ-ও কি সম্ভব? এ-ও কি সহ্য করা যায়?
| হাদি হুসেন মুখ তুলে তাকাল।
চেঁচিয়ো না। যা হবার হয়েছে। এখন দেখো, কিভাবে কুকুরগুলোকে খতম করা যায়।
কুয়াশা ৫৬
উত্তাল বলল, “খতম করবে, না খতম হবে? ওদের কাছে গ্যাস বোমা আছে। কেউ এগোতেই পারছে না কাছাকাছি।
হঠাৎ কোদালের মত বড় বড় দাঁত বের করে হাসল হাদি হুসেন।
তুমি হাসছ!’
হাদি হুসেন বলল, তোমার এই এক দোষ, বড় তাড়াতাড়ি নিরাশ হয়ে। পড়ো। ওদের কাছে গ্যাস বোমা আছে, ভাল কথা । আমরা কাছাকাছি যেতে পারছি না, ভাল কথা। আমরা আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করতে পারছি না, ভাল কথা। কুয়াশা এবং তার দলবল এবার দুঃসাহসী হয়ে উঠবে, এগিয়ে আসবে তারা। কন্ট্রোলরুম দখল করার জন্য–সে-ও খুব ভাল কথা।’
তার মানে! হাদি, তুমি কি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গেলে?’ | হাদি হুসেন হাসছে, না, বন্ধু, না। হাদি হুসেন এই রকম সামান্য বিপদে পাগল হয় না। উত্তাল, তুমি একটা গাধা। আচ্ছা, আমাদের আসল অস্ত্রের কথাটা কি তোমার মনে পড়েনি একবারও?
‘আসল অস্ত্র?
হ্যাঁ। ভ্যাম্পায়ার! উত্তাল উল্লাসে চিৎকার করে উঠল, আরে! তাই তো! মনেই পড়েনি••!
হাদি হুসেন বলল, যাও, নিয়ে এসো ঝুড়িটা। দেখি কুয়াশা কত বড় বাহাদুর।
শায়লা পারভিন ওদের কথা শুনছিল। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল, না! না! মি. কুয়াশা, সাবধান! এরা আপনাদের।’
‘ কথা শেষ করতে পারল না শায়লা পারভিন, হাদি হুসেন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল চেয়ার থেকে।
চার
যাই বলিস শহীদ, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এমন হঠাৎ সব থেমে গেল কেন? কোথাও কোন মানুষের সাড়া শব্দ নেই, ছায়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না কারও।
গভীর দেখাচ্ছে শহীদকে।
কুয়াশাও চিন্তিত যেন। জানতে চাইল সে, ‘খানিক আগে শায়লার চিৎকার শুনেছ তোমরা কেউ?
কেউ শোনেনি।
কুয়াশা তার ব্যাগ থেকে আরও গ্যাস বোমা বের করে পকেটে ভরল। বলল, তোমরা এখানেই থাকো। আমি ঘুরে দেখে আসি।’
একা যাবে?’ জানতে চাইল শহীদ।
হ্যাঁ। আমার সন্দেহ হচ্ছে, শত্রুরা তাদের শেষ অস্ত্র ব্যবহার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই একসঙ্গে বেরিয়ে ঝুঁকি বাড়িয়ে লাভ কি।
৬০
ভলিউম ১৯
সামনের পথ রোধ করে দাঁড়াল সুন্দরী রাজকুমারী ওমেনা, সংক্ষেপে বলল, ‘না।
চোখ তুলে ওমেনার চোখের দিকে তাকাল কুয়াশা। বলল, “ছি, ওমেনা। কাজের সময় বাধা দিতে নেই।’
| ওমেনা দৃঢ় গলায় বলল, একা যাওয়া চলবে না তোমার। বিপদ জেনেও একা যেতে দেব না তোমাকে আমি।’
বিপদের মুখোমুখি হতেই হবে, ওমেনা। সবাই মিলে যদি বিপদের মুখোমুখি হই তাহলে সকলের প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়বে। তা আমি হতে দিতে পারি না। যে বিপদের আশঙ্কা করছি আমি সেটা ভয়ঙ্কর। সেই ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে তোমাদেরকে আমি টেনে নিয়ে যেতে পারব না। আমি যাচ্ছি কেন জানো? যাচ্ছি, বিপদটা এখানে যাতে আসতে না পারে, যাতে বিপদটাকে আমি মাঝপথে বাধা দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে পারি, সেই জন্য। ভাল কথা, আমার কাছ থেকে নির্দেশ না
পেলে কেউ এই টানেল ছেড়ে বেরুবে না।
| মাথা নিচু করে এক পাশে সরে দাঁড়াল ওমেনা। কেউ লক্ষ না করলেও কুয়াশা লক্ষ করল, ওমেনার দু’চোখ ভরে উঠেছে নোনা জলে।
| অবিচলিত ভঙ্গিতে টানেল থেকে বেরিয়ে প্যাসেজ ধরে হাঁটতে শুরু করল কুয়াশা সিঁড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় থমকে দাঁড়াল সে। কান পাতল।
| সত্যি ভারি আশ্চর্য লাগছে। কোথাও লোকজনের কোন শব্দ নেই। কাউকে দেখাও যাচ্ছে না কোথাও।
ব্যাপার কি?
সিঁড়ির পাশ দিয়ে একটা প্যাসেজ চলে গেছে। প্যাসেজটা শেষ হয়েছে একটা করিডরে।
প্রশস্ত করিডরটা খা খা করছে। কেউ নেই।
করিডরের মাঝামাঝি গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। কন্ট্রোলরূমটা এই করিডরের উপরেই কোথাও হবে, অনুমান করল। উপর দিকে তাকাল সে।
তাকাতেই কুয়াশা দেখল সিলিংয়ের এক জায়গা থেকে কাঠের একটা গোলাকার ঢাকনি সরে যাচ্ছে। | ব্যাপারটা কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারল না কুয়াশা। কিন্তু দ্রুত একটা গ্যাস গ্রেনেড় বের করে ফেলল সে। | ঢাকনিটা সরে গেছে। একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে। গ্যাস গ্রেনেডটা উপর দিকে ছুঁড়ে দিল কুয়াশা। গর্তের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা।
* কয়েক সেকেণ্ড কাটল। তারপর সেই গর্তের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল বিশাল একটা কালো কুচকুচে বড় আকারের বাদুড়-রক্তচোষা বাদুড়!
ভ্যাম্পায়ার! | এই রকম কিছুর জন্যে যেন তৈরি হয়েই ছিল কুয়াশা। নড়ল না সে। দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়।
প্রকাণ্ড বাদুড়টা ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে উড়ে গেল করিডরের উপর দিয়ে। তারপর বাঁক নিয়ে ফিরে আসতে শুরু করল আবার সেটা।
তীরবেগে উড়ে আসছে বাদুড়টা। এই বাদুড়ের নখে বিষ আছে, জানে কুয়াশা। নখ দিয়ে আঁচড় কাটা মাত্র মৃত্যু অবধারিত।
কুয়াশা ৫৬
এসে পড়েছে বাদুড়টা। কুয়াশার মাথা লক্ষ্য করে সোজা উড়ে আসছে কদাকার প্রাণীটা।
শেষ মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল কুয়াশার শরীরে। এক পাশে সরে গেল সে লাফ দিয়ে।..
বাদুড়টা কুয়াশাকে ছাড়িয়ে চলে গেল দূরে। আবার সেটা ফিরে আসছে।
এক পলকে বসে পড়ল কুয়াশা।
কিন্তু এভাবে কতক্ষণ মৃত্যুকে ফাঁকি দেয়া যাবে। দ্বিতীয়বারও স্পর্শ করতে পারেনি তাকে বাদুডটা। কিন্তু আবার সেটা ফিরে আসছে।
আবার সরে গেল কুয়াশা। এবার সরে গেলেও, বাদুড়টা তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া। মাত্র বাঘের মত লাফ মারল সে। শূন্যে উঠে গেল তার শরীর। তার হাতটা শকুনের ঠোঁটের মত ছোঁ মারল, বাদুড়টার পিছন দিকটা ধরে ফেলল সে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে সবেগে ছুঁড়ে দিল মেঝের উপর।
থ্যা করে পড়ল বাদুড়টা মেঝেতে। এবং নিঃসাড় পড়ে রইল। এক আছাড়েই খতম হয়ে গেছে ভয়ঙ্কর ভ্যাম্পায়ারটা।
কালবিলম্ব না করে ছুটল কুয়াশা। প্যাসেজের তেমাথায় দেখা হলো শহীদের সঙ্গে। গ্যাস মাস্ক খুলে কথা বলল সে।
আমি কন্ট্রোলরুমে যাচ্ছি, বলল কুয়াশা, “তোমরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সম্ভাব্য সব জায়গায়, সব কেবিনে, সব প্যাসেজে গ্যাস বোমা ব্যবহার করো। শত্রুদের একজনও যেন নিষ্কৃতি না পায়।’
কথাগুলো বলেই সিঁড়ির দিকে ছুটল কুয়াশা।
উপরে উঠে একটা গ্লাস বোমা ফাটাল কুয়াশা। পাশাপাশি কয়েকটা দরজা। দেখা যাচ্ছে। হালকা হার্ডবোড দিয়ে তৈরি দরজা। হাতের ধাক্কাতেই খুলে গেল দরজাগুলো। প্রতিটি কেবিনের ভিতর একটা করে গ্যাস বোমা নিক্ষেপ করল কুয়াশা ।
কেউ বাধা দিল না তাকে। কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করল সে। শায়লা পারভিনের অজ্ঞান দেহটা চোখে পড়ল প্রথমেই।
হাদি হুসেন বা উত্তাল–কেউ নেই। ইস্ট্রমেন্ট প্যানেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। প্রথমেই চোখ পড়ল ফুয়েল ইণ্ডিকেটরের দিকে।
| ফুয়েল প্রায় শেষ হয়ে গেছে। ওয়াটার ট্যাঙ্কগুলো প্রায় শূন্য। গ্যাস ভর্তি বেলুনগুলো ঢিলে হয়ে পড়েছে। আর বড় জোর ঘণ্টা দুয়েক শূন্যে ভাসতে পারবে ব্লু-বার্ড।
শায়লার হাতের বাধন খুলে ফেলল কুয়াশা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। তার অচেতন দেহটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে এল সে বাইরে।
ইন্সপেকশন টানেলে ফিরে এসে কুয়াশা কাউকে দেখতে পেল না। অবশ্য মিনিট তিনেক পরই ফিরল ওমেনা এবং রাসেল, ওদের পিছু পিছু এল শহীদ, কামাল এবং ডি কস্টা।
হাদি হুসেন বা উত্তালকে দেখেছ তোমরা?’ শহীদ বলল, না। বু-বার্ডে সম্ভবত একটা নিরাপদ গোপন কুঠরি আছে,
ভলিউম ১৯
সেখানেই লুকিয়েছে ওরা।
ওমেনা বলল, ওদের দুজনের কথা বলতে পারি না। কিন্তু বাকি সবাই গ্যাসে আক্রান্ত হয়েছে।
কুয়াশা শায়লা পারভিনের জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। বলল, শহীদ, বুবার্ড সম্ভবত ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। দেখো তো, নিচের দুনিয়াটা কি রকম?’
শহীদ একা নয়, ওর সঙ্গে ওমেনা এবং ডি.কস্টাও বেরিয়ে গেল।
টানেলের শেষ মাথায় গিয়ে পোর্টহোলের পর্দা সরিয়ে নিচের দিকে তাকাল ওরা চোখে বিনকিউলার লাগিয়ে।
মাই গড!’
আশ্চর্য একটা দৃশ্য ওদের চোখের সামনে ফুটে উঠল নিচের দিকে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে। | ব্লু-বার্ড এখনও হাজারখানেক ফুট উপরে রয়েছে। বহু নিচে দেখা যাচ্ছে বনভূমি। এমন গভীর ঘন সবুজ বনভূমি এর আগে ওরা কেউ দেখেনি। গাছগুলো। এমন অস্বাভাবিক ভাবে ঘনসন্নিবেশিত যে মনে হচ্ছে একটা গাছের গা থেকে আর একটা গাছ গজিয়েছে, গাছে গাছে এতটুকু কাঁক নেই। গাছগুলোও দৃষ্টি আকর্ষণ করল,ওদের। কিছু কিছু প্রকাণ্ড হলুদ ফুল চোখে পড়ল, এক একটা হাতির কানের মত বড়।
| মরুভূমির কোন চিহ্ন নেই কোথাও। বহুদুরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়শ্রেণী। আফ্রিকা মানেই মরুভূমি এবং বনভূমি। এর আগে একাধিক বার আফ্রিকার জঙ্গলে এসেছে ওরা। কিন্তু সেই জঙ্গলের সঙ্গে নিচের এই জঙ্গলের যেন কোন মিলই নেই। তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে ওদের সকলের মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। নিচের এই বনভূমির ভিতর কিছু একটা যেন আছে। এমন একটা কিছু যা ভয়ঙ্কর, যা স্বাভাবিক নয়।
বনভূমির আয়তনটা বিশাল নয়। বনভূমি না বলে প্রকাণ্ড একটা মরুদ্যান বলা চলে, এটাকে।
| অনাবিষ্কৃত মরুদ্যান হয়তো এটা। সভ্য দুনিয়ার মানুষ হয়তো এই মরুদ্যানের কথা জানে না আজও।
ছোট ছোট কালো কালো বিন্দু উড়ে বেড়াচ্ছে মরুদ্যানের উপর। বিন্দুর মত দেখতে ওগুলো পাখি জাতীয় কিছু হবে বলে মনে হলো।
শহীদ বলে উঠল, “ফেরাউনের মুরগী ওগুলো। হোয়াট!” ডি.কস্টার সঙ্গে ওমেনাও জানতে চাইল, ফেরাউনের মুরগী মানে?
শকুন। লক্ষ করে দেখো, আমরা যে ধরনের শকুন সাধারণত দেখে থাকি এগুলো সে রকম নয়। ওদের বৈশিষ্ট্য ওদের ঠোঁটে এবং ডানায়। ডানাগুলো সাধারণের চেয়ে বড় এবং ঠোঁটগুলো সরু, ছুঁচাল। এই ধরনের শকুনকে ফেরাউনের মুরগী বলা হয়।’
ওমেনা বলল, শকুন বা ফেরাউনের মুরগী যাই বলো–ওরা মড়া খায়।
কুয়াশা ৫৬
‘খায় বৈকি।’ বলল কামাল।
মরুদ্যানের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন ওরা? ওই গভীর জঙ্গলে কি আছে? শহীদ বলে উঠল, ‘একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করছিস, কামাল? “কি রে?’
শকুনগুলো মরুদ্যানের উপর ঘুরছে আর ‘ঘুরছে। কিন্তু জঙ্গলের কাছাকাছি নামছে না একটাও। কি কারণ? আমার যেন মনে হচ্ছে শকুনগুলো জঙ্গলটাকে ভয় করছে রীতিমত।
রাসেল বলল, ‘তাজ্জব ব্যাপার, সন্দেহ নেই। কোথাও আর কোন রকম পাখি জাতীয় কিছু নেই। শুধু শকুন দেখা যাচ্ছে।
যট্টো সব ফালটু কঠাবার্টা! ওই টো একটি শকুন জঙ্গলে নামিটেছে।
ডি.কস্টা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রায় চিৎকার করে উঠল। মিথ্যে বলেনি সে। সত্যি সত্যি দেখতে পেল সবাই দৃশ্যটা, একটি শকুন জঙ্গলের দিকে তীরবেগে নামছে।
সবুজ বনভূমিতে নামল শকুনটা। বসল সে এক জায়গায়। ঠোঁট দিয়ে কি যেন তুলে নিচ্ছে সে। নিশ্চয়ই খাদ্য জাতীয় কিছু।
কয়েক সেকেণ্ড পরই শকুনটা শুন্যে ডানা মেলে ওড়ার চেষ্টা করল। সবেগে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে সে। কিন্তু শূন্যে উঠতে পারছে না। সবুজ একটা বড় আকারের পাতা, যেটার উপর নেমেছে শকুনটা, তাকে আটকে রেখেছে। উন্মাদের মত নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে শকুনটা। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে গ্রাস করছে তাকে প্রকাণ্ড পাতাটা। চিৎ করে মেলে রাখা ছাতা যেন সেটা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাপার, শকুনটাকে গ্রাস করে ফেলল সেই পাতা। অদৃশ্য হয়ে গেল শকুনটা।
কী সাংঘাতিক! এ যে খুনী কারনিভেরোস প্ল্যান্ট। দুর্গম বনভূমিতে জন্মায় সাধারণত। পোকা মাকড়, ছোট ছোট পশু-পাখি পর্যন্ত খেয়ে ফেলে।
শহীদ থামতেই কামাল বলে উঠল, কিন্তু শকুনটা তো ছোটখাট নয়•••।’
তা বটে। বিশেষ কোন কারণে প্ল্যান্টগুলো বিরাটাকার পেয়েছে সম্ভবত!’ | ডি.কস্টা আঙ্গুল দিয়ে অন্য একটা দিক দেখাল, ‘ওই ডিকটাই হামাডের। গন্টব্যষ্ঠান, আই গেল।
মরুদ্যানের মাঝখানে তাকাল সবাই ডি কস্টার কথা শুনে।
চারপাশে সবুজ জঙ্গল থাকলেও মাঝখানটায় সবুজের ছিটেফোঁটাও নেই। বনভূমির চেয়ে মধ্যবর্তী জায়গাটা অপেক্ষাকৃত উঁচু। পাথরের কঠিন চেহারা এত উঁচু থেকেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
জায়গাটা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় সমানই হবে। মাইল খানেক দীর্ঘ, চওড়া একটু বুঝি কমই। ছোট বড় অসংখ্য পাথরের খণ্ড দেখা যাচ্ছে।
-বার্ড মৃদু মন্দ বাতাস পেয়ে সেদিকেই এগোচ্ছে। বিনকিউলারের সাহায্যে ওরা পাথুরে জায়গাটার নানারকম বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করতে শুরু করল।
শহীদ বলল, ঠিক মাঝখানটায় ওটা কি? একটা মঞ্চের মত দেখতে যেন?
৬৪
ভলিউম ১৯
কামাল চিৎকার করে উঠল, মানুষ! মঞ্চের উপর মানুষ? সত্যি তাই। কালো একদল মানুষ মঞ্চের উপর উঠে আসছে দেখা গেল। ওটা সম্ভবত রবার্ডের ল্যাণ্ডিং স্টেজ।’ শহীদ সমর্থন করল ওমেনাকে, তোমার অনুমানই ঠিক বলে মনে হচ্ছে।’
রাসেল আবিষ্কার করল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জিনিসটা। প্রকাণ্ড একটা কারাকক্ষের মত দেখতে সেটা। চার কোনা কারাকক্ষই ওটা। লোহার মোটা এবং লম্বা পিলার পাশাপাশি মাটিতে পুঁতে তৈরি করা হয়েছে কারাকক্ষটাকে। এক দিকে প্রকাণ্ড একটা লোহার গেট। পিলারগুলোর মাথা উঁচাল।
কারাকক্ষের ভিতর অসংখ্য মানুষ শুয়ে বসে আছে। এক একটা দলে দশ বারোজন করে লোক। দলের প্রতিটি লোককেই লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।
বু-বার্ড কারাকক্ষের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। একটু পরই সেটা চোখের আড়ালে, পিছনে সরে গেল।
সামনে দেখা গেল আরও একটা জিনিস। গভীর গহ্বর একটা। সরু সরু পথ নেমে গেছে প্রকাণ্ড খাদের ভিতর দিকে। খাদটার উপর দিয়ে রুবার্ড উড়ে যাচ্ছে, ওরা দেখল খাদের নিচে শিকল দিয়ে বাঁধা আরও কিছু বন্দি রয়েছে।
খাদের পাশে উঁচু হয়ে রয়েছে মাটি। খাদের ভিতর থেকে খুঁড়ে তুলে আনা হয়েছে এই মাটি। মাটিগুলো নীল রঙের। সবুজ ভাবও রয়েছে একটু।
শহীদ বলল, ক্রীতদাস সম্পর্কিত কথাটা তাহলে মিথ্যে নয়। ‘খাদটার ভিতর কি করছে ওরা?’
মাটি খুঁড়ছে। নীল রঙের মাটি বুঝতে পারছিল না রহস্যটা? কামাল বলল, ওহ হো! বুঝেছি! ডায়মণ্ড মাইন!
নীল মাটি মানেই ডায়মন্ডের খনি! শায়লা পারভিন নিশ্চয়ই এই খনি থেকে ডায়মণ্ডগুলো সংগ্রহ করেছিল।
শহীদ বলল, তার জ্ঞান ফিরেছে কিনা দেখা দরকার এবার।
পাঁচ শায়লা পারভিনের জ্ঞান আগেই ফিরেছে। ওরা যখন ফিরল তখন সে বলছিল, ‘মি. কুয়াশা, আমার দুর্ভাগ্য যে, বিউটি কুইনে আপনাকে আমি চিনতে পারিনি। আপনাকে আমি শত্রু মনে করেছিলাম•••|
। কুয়াশা বলল, শায়লা, তোমার কথা পরে শুনব। জরুরী কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে আমাদের এখুনি।
উঠে দাঁড়িয়ে পোর্টহেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা।
একি! হাদি হুসেন আর উত্তাল নিচে নামল কিভাবে।
পরমুহূর্তে শোনা গেল রাইফেলের শব্দ। বিদ্যুৎবেগে সরে গেল কুয়াশা জানালার সামনে থেকে।
৫”কুয়াশা ৫৬
কিন্তু অঘটন একটা ঘটে গেছে তখন। রুবার্ডের উপরকার একটা গ্যাস ভর্তি গম্বুজ ফুটো হয়ে গেছে বুলেট লেগে।
বার্ড নামছে, নিচে নামা মাত্র আক্রান্ত হব আমরা,’ শহীদ বলে উঠল। কুয়াশা বলল, হাদি হুসেন আর উত্তাল সম্ভবত প্যারাসুটের সাহায্যে নেমে গেছে।
কুয়াশা বলল, বু-বার্ডের সামনে এবং পিছনের দিকে দুটো মোটা শিকল ঝুলছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ লম্বা। ওগুলো ধরে টেনে মঞ্চে নামাবে রু-বার্ডকে শত্রুরা। ওমেনা, কন্ট্রোলরূমে চলো তুমি আমার সঙ্গে।
কন্ট্রোলরূমে গিয়ে ঢুকল সবাই।
দ্রুত নামছে ব্লু-বার্ড। অসাবধানবশত একজন লোক রাইফেলের গুলি ছুড়লেও হাদি হুসেনের ধমক খেয়ে সবাই সাবধান হয়ে গেছে। গুলি ছোড়বার ঝুঁকি আর নেবে না কেউ ভুলেও
পোর্টহোল দিয়ে সবাই চেয়ে আছে নিচের দিকে। আফ্রিকান নিগ্রোর দলটা হাদি হুসেন আর উত্তালের নেতৃত্বে উত্তেজিতভাবে অপেক্ষা করছে। লোহার শিকল আওতার মধ্যে আসার অপেক্ষায় আছে ওরা। শিকলগুলো আওতার মধ্যে পেলেই ধরে মঞ্চের উপর নামিয়ে আনবে ব্লু-বার্ডকে।
কন্ট্রোলরূমে কুয়াশাকে সাহায্য করছে ওমেনা। আর, কয়েল, সুইচবোড নিয়ে দ্রুত কাজ করছে ওরা।
ব্লু-বার্ডের দুই প্রান্তের শিকল মাটির কাছাকাছি নেমে গেল। চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছে হাদি হুসেন।
নিগ্রোর দল শিকল দুটো ধরে ফেলেছে। প্রাণপণ শক্তিতে টানছে তারা, মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ব্লু-বার্ড।
মঞ্চের উপর থেকে ব্লু-বার্ড আর মাত্র কয়েক গজ উপরে–এমন সময় সুইচ:অন করল কুয়াশা।
নিগ্রোর দুলটা বৈদ্যুতিক ধাক্কা খেয়ে তীরবেগে ছিটকে পড়ল চারদিকে।
কুয়াশা নির্দেশ দিল, গ্যাস বোমা। নির্দেশ পেতে যা দেরি, সবাই নিচের দিকে ছুঁড়তে শুরু করল গ্যাস বোমা।
নামো।
লাফু দিয়ে নামল কুয়াশা মঞ্চের উপর। তার পিছু পিছু শহীদ, শায়লা পারভিন, কামাল, ডি.কস্টা, ওমেনা এবং রাসেল। মঞ্চ থেকে নেমে ছুটল সবাই।
দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। হাত বাড়িয়ে শ’খানেক গজ দূরের একটা জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছে সে সবাইকে, ওদিকে! ওদিকে শেলটার নিতে হবে।’
– গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে ঢলে পড়েছে শত্রুদের কেউ কেউ সাময়িক ভাবে। বাকিরা সবাই পিছিয়ে গেছে।
কুয়াশা আর তার দলবল–বার্ডের পিছন দিকে পৌঁছে গেছে, ছুটছে তারা। দেখেও কেউ গুলি করল না। গুলি করার ঝুঁকি নিতে রাজি নয় শত্রুরা। রুবার্ড তাদের একমাত্র ভরসা। ওটা ধ্বংস হয়ে গেলে যাতায়াত, খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থা, সব অচল হয়ে যাবে।
বেশ খানিকটা দূরত্ব অতিক্রম করে থামল ওরা। বড় বড় পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বসে পড়ল, কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রাখল একপাশে।
‘পাথর দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করতে হবে।’ কথাটা বলে সবার আগে কাজে
৬৬
ভলিউম ১৯
|
লেগে গো শহীদ। সবাই ওর সঙ্গে যোগ দিল। ছোটরড় পাথরের টুকরো সাজিয়ে চার-পাঁচ হাত উঁচু একটা পাঁচিল তৈরি করে ফেলল ওরা নিজেদের সামনে। | দশ মিনিট কেটে গেছে। সন্ধ্যা নামছে দ্রুত।
শত্রুপক্ষ দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। কিন্তু এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে না কেউ।
কি এখানে এভাবে ব্যারিকেড তৈরি করে কতক্ষণ বাধা দিয়ে রাখতে পারব আমরা শত্রুদেরকে? খাবার নেই, পানি নেই–শেষ পর্যন্ত তো আত্মসমর্পণ করতেই হবে।’
সমনা আসুক, তখন দেখা যাবে। এই মুহূর্তে আমরা বেশ শান্তিতে আছি।’
কামালের কথার উত্তরে বলল কুয়াশা। শায়লা পারভিনের দিকে তাকাল সে, ‘এবার তোমার কথা শোনা যেতে পারে।
শায়লা পারভিন একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল। একটু ভেবে নিয়ে শুরু করল সে, হাদি সেনের কথা দিয়ে শুরু করি। তার আগে বলে নেই, আমি ওদের সম্পর্কে ওদের মুখেই ছাড়া ছাড়া ভাবে সব শুনেছি। হাদি হুসেন আসলে একজন বেদুইন সার ছিল। মরুভূমিতে পথ হারিয়ে ফেলা। লোকজনের ধন-সম্পদ লুঠ করাই ছিল তার এবং তার দলের লোকের পেশা। আজ থেকে বারো বছর আগে, আফ্রিকার এক জঙ্গলে আস্তানা ছিল ওদের। সেই সময় ওই রু-বার্ড আফ্রিকার উপর দিয়ে যাচ্ছিল আরও পশ্চিম দিকে। গোলমাল দেখা দেয়ায় পাইলট বাধ্য হয়ে বনভূমিতে নামায় ব্লু-বার্ডকে। হাদি হুসেনের দল রু বার্ডকে দেখতে পায়। লুঠ করার এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে না তারা। রাত্রির অন্ধকারে দলবল নিয়ে হাদি হসেন আক্রমণ করে–বার্ডকে। সু-বার্ডের অধিকাংশ আরোহীকে হত্যা করে ওরা। বন্দি করে পাইলট আর উত্তাল চৌধুরীকে। ওদের দুজনকে হাদি হুসেন হত্যা করেনি, কারণ, সে বা তার কোন লোক ব্লু-বার্ডকে চালাতে পারবে না তা সে জানত। পাইলট ও উত্তালকে দলে যোগ দেবার প্রস্তাব দেয় হাদি হুসেন। উত্তাল তার প্রস্তাব গ্রহণ করে কিন্তু পাইলট ঘৃণার সঙ্গে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এরপর হাদি হুসেন উতালের সাহায্যে রু বার্ডের ইঞ্জিন মেরামত করে। পাইলটকে হত্যা করে ফেলে দেয় ওরা ভূমধ্যসাগরে!’
তারপর? এই মরুদ্যানের সন্ধান পেল কিভাবে ওবা?’ কামাল জানতে চাইল।
বলছি। র-বার্ড দখল করে ওর সিদ্ধান্ত নেয় দাস-ব্যবসা শুরু করবে। আফ্রিকার বিভিন্ন অসভ্য দেশ থেকে অসহায় নর-নারীকে কিনে অন্যত্র বিক্রি করার ব্যবসা করতে শুরু করল ওরা। দুতিন বছর এভাবে কাটল। হাদি হুসেন এবং উত্তাল পরস্পরের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হয়ে উঠল। এমন সময়, একদিন গোটা আফ্রিকায় দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো। নিষিদ্ধ হলেও ব্যবসাটা ত্যাগ করল না ওরা। ফলে বিভিন্ন দেশের পুলিস বিভাগ ওদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগল। গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হলো ওদের বিরুদ্ধে। পুলিসের ভয়ে অতিষ্ঠ হয়ে ওরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগল। তারপর, একদিন এই এলাকায় এসে মরুদ্যানটা আবিষ্কার করে ওরা। লক্ষ করে শকুনগুলোকে। শকুনগুলো তখন উজ্জল ডায়মণ্ড পায়ের
কুয়াশা ৫৬
৬৭
আঙ্গুলে নিয়ে উড়ে বেড়াত। শকুনের পায়ে ডায়মণ্ড দেখে এই পাথুরে জায়গায় নামে ওরা। আবিষ্কার করে ডায়মণ্ড মাইন।
বলে যাও।
‘খনি দেখে এই জায়গায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় ওরা। দূর এলাকা থেকে ধরে আনে অসহায় লোকজন, বন্দি করে রাখে তাদেরকে, খনির নিচে নামিয়ে মাটি কাটায়। তাদেরকে খেতে দেয় চব্বিশ ঘটায় মাত্র একবার। অকারণে বেদম প্রহার করে। ওদের নিজস্ব লোক আছে কায়রোয়। তাদের মাধ্যমেই ডায়মণ্ড বিক্রি করে ওরা। তাদের সাহায্যেই নতুন নতুন ক্রীতদাস সংগ্রহ করে। বন্দিরা এখানে কেউই বেশিদিন বেঁচে থাকে না। তাই নতুন নোক দরকার হয়।
তুমি কিভাবে ওদের হাতে পড়লে?” শায়লা পারভিন বলল, ‘ফ্লাইং ক্লাবের একটা প্লেন নিয়ে ঢাকা থেকে আসছিলাম আমি। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছিল না। আকাশ পথে আফ্রিকা পাড়ি দেব, এটা ছিল আমার প্রচণ্ড একটা শখ। সেই শখের বশবর্তী হয়েই যাত্রা করি আমি। এই মহাদেশের সর্ব পশ্চিমে যাবার পরিকল্পনা ছিল আমার। কিন্তু ইঞ্জিনে গোলযোগ দেখা দেয়ায় আমি এখান থেকে মাইল দশেক পুবে একটা সমতল ভূমিতে প্লেন নামাতে বাধ্য হই। আমার সঙ্গে মালেক আর এনায়েত ছিল। আমাদের তিনজনকেই বন্দি করে হাদি হুসেনের লোকেরা। আমার সঙ্গী দু-জনকে ক্রীতদাস হিসেবে বন্দি করে রাখলেও, আমাকে হাদি হুসেনু বন্দি করেনি। আমি বিনা বাধায় সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। হাদি হুসেনের উদ্দেশ্য ছিল খারাপ, সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি নানা অজুহাত দেখিয়ে শুধু সময় নিচ্ছিলাম। সেই ফাঁকে গোপনে আমি একটা গ্যাস বেলুন তৈরি করতে চেষ্টা করছিলাম। প্রচুর হাইড্রোজেন গ্যাস মওজুদ ছিল এখানে, ব্লু-বার্ডের জন্যে ওরা কিনে এনে রেখেছিল। সেই গ্যাস চুরি করে আমি একটা বেলুন তৈরি করি। এবং এক সুযোগে আমার সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে যাই। বাতাস অনুকূল ছিল, আমরা বনভূমি পেরিয়ে বহু দূরের একটা লোকালয়ে নামি। সেখান থেকে নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে পৌঁছাই একটা সামুদ্রিক বন্দরে। বিউটি কুইন সেই সময় যাত্রা করার জন্য তৈরি হচ্ছিল, আমরা তাতে আরোহণ করি। কিন্তু হাদি হুসেন আর উত্তাল রু-বার্ড নিয়ে আমাদেরকে ধাওয়া করে। আকাশে মেঘ ছিল বলে তারা বিউটি কুইনকে দেখতে পায়নি। যাক, ওরা আমাদেরকে হত্যা করার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে আসছে বুঝতে পেরে আমি বিউটি কুইনের রেডিওর সাহায্যে চট্টগ্রামের সংবাদপত্রগুলোতে আপনার সন্ধান পাবার জন্য দশ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে বিজ্ঞাপন ছাপার ব্যবস্থা করি।’
কুয়াশা বলল; বুঝতে পারছি সব। আর বলতে হবে না। কিন্তু ভ্যাম্পায়ার সম্পর্কে কিছু বললে না যে?’,
| শিউরে উঠল শায়লা পারভিন। সিধে হয়ে বসল সে। আঁকড়ে ধরল পাশে বসা ওমেনার একটা হাত। অন্ধকারে চাপা কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল সে।
ওই বাদুড়গুলো–ওরা রক্ত শুষে নেয়। প্রথমে ভেবেছিলাম পায়ের নখে বিষ নিয়েই জন্মায় ওরা। আসলে তা নয়। ওদের নখে বিষ মাখিয়ে দেয়া হয়। বড়
৬৮
ভলিউম ১৯
ভয়ঙ্কর বিষ-রক্তের সংস্পর্শে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটে। অসভ্য একটা জংলী উপজাতি এই রক্তচোষা বাদুড় পোষে। সেই উপজাতির সর্দাররা নিজেদের পদ্ধতিতে পোষ মানায় এদেরকে। হাদি হুসেন সেই উপজাতির সঙ্গে কিছুদিন ছিল। উপজাতির সর্দাররা শত্রুদের হত্যা করার জন্য এই বাদুড় পাঠাত। সেখান থেকে পালিয়ে আসার সময় কয়েক জোড়া বাদুড় নিয়ে আসে হাদি হুসেন। তাদের বাচ্চা হয়–অসংখ্য। হাদি হুসেন নিজে পোষ মানিয়েছে সবকটাকে। পোষ মানানো ঠিক যায় না এদেরকে। এরা কয়েকটা শব্দ শুনে সাড়া দেয়-এই যা। সামনে যাকে পাবে তাকেই আক্রমণ করবে এরা। হাদি হুসেন বাদুড়গুলোকে ব্যবহার করে ক্রীতদাসদের বিরুদ্ধে। কেউ পালাবার চেষ্টা করলে তাদের ধাচা খুলে দেয়।
সে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা আছে।
শায়লা পারভিন থামতে শহীদ বলল, অবাক লাগছে বড়, কুয়াশা। শত্রুরা চুপচাপ কেন? হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার কথা নয় ওদের!
কামাল বলল, “উই-নিশ্চয়ই ওরা কোন প্ল্যান করছে।
চিৎকার করে উঠল শায়লা পারভিন, ভ্যাম্পায়ার! রক্ত চোষা বাদুড় ছেড়ে দিয়েছে ওরা। মি. কুয়াশা, বাঁচান! বাঁচান!
ঘন অন্ধকারে ঢাকা চারদিক। বাদুড় আসছে দলে দলে। দেখা যাচ্ছে না, শোনা। যাচ্ছে খসখসে শব্দ, ডানা ঝাঁপটাবার আওয়াজ।
গ্যাস-মাস্ক পরবার সময় নেই। সুতরাং গ্যাস বোমা ব্যবহার করার প্রশ্নই উঠল না।
শহীদের মোটা ব্যাগটা টেনে নিল কুয়াশা নিজের কাছে। ইনফ্রারেড হ্যারিকেন এবং ফুরোস্কোপিক চমশা বের করল সেটা থেকে।
হ্যারিকেনের সুইচ অন করে চশমা পরে নিল কুয়াশা। চশমা পরো–সবাই!’
কুয়াশা দেখল মাথার উপর দুটো রক্তশোষক বাদুড় চক্কর মারছে। স্টেনগানটা উঁচু করে ধরল সে। গর্জে উঠল সেটা।
গর্জে উঠল আরও দুটো স্টেন। বাশ ফায়ারের অবিরাম শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাবে যেন। ধুপ ধাপ শব্দ হচ্ছে। ওদের চারদিকে পড়ছে অসংখ্য বাদুড়ের নিষ্প্রাণ দেহ, রক্ত পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটার মত।
কিন্তু কত আর মারা যায়। বাদুড়ের দল আসছে তো আছেই।
নতুন ম্যাগাজিন ক্লিপ লাগাবার সময় শহীদ লক্ষ করুল হাত দুটো কাঁপছে ওর। চিৎকার করে উঠল কামাল, শহীদ!’
স্টেন ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শহীদ। কামালের গলায় ঠোকর মারার জন্য একটা বাদুড় নেমে এসেছে। ডান হাত দিয়ে আঘাত করল শহীদ। ভাগ্য ভাল, ওর হতে বাদুড়টা নখ বসাতে পারেনি। হাতের বাড়ি খেয়ে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল
কুয়াশা ৫৬
৬৯
সেটা, কিন্তু পরমুহূর্তে শূন্যে উড়ল। আবার এগিয়ে আসছে সেটা মাথার উপর দিয়ে।
কুয়াশার স্টেন গর্জে চলেছে। বাদুড়টা নেমে আসছে তীর বেগে শহীদকে লক্ষ্য কর ।
কামাল সামনে নিয়েছে নিজেকে। হাতের রিভলবার তুলে ধরল সে। লক্ষ্য স্থির করেই গুলি করল। অব্যর্থ লক্ষ্য। বাদুড়টা ধুপ করে পড়ে গেল কয়েক হাত দূরে।
, কুয়াশার ট্রেন থেকে কোন শব্দ আসছে না দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শহীদ। দেখল গ্যাস-মাস্ক পরে নিয়েছে সে কখযেন। গ্যাস-বোম দেখা যাচ্ছে তার হাতে।
| ‘আমি স্টেন চালাচ্ছি,’ বলে উঠল কুয়াশা, তোমরা সবাই গ্যাস মাস্ক পড়ে নাও জলদি!’।
সবাই পালন করল কুয়াশার নির্দেশ।
বাদুড়ের দল আরও আসছে। কুয়াশা বলে উঠল, ‘এভাবে হবে না। গ্যাস বোমা ব্যবহার করছি আমি
কুয়াশার স্টেন থামতে গর্জে উঠল শহীদ এবং রাসেলের স্টেন।
কুয়াশা দাঁত দিয়ে পিন খুলে ডিম্বাকৃতি সাদা গাণ-বোমা ছুঁড়ে দিল আকাশের। দিকে। শূন্যে গিয়ে বিস্ফোরিত হলো সেটা। পরপর আরও দুটো বোমা ছুড়ল সে।
সাদৗ ধোয়ায় ঢাকা পড়ে গেল আকাশ। বাদুড়ের দলগুলো বোটাচ্যুত ফলের মত পড়তে লাগল চারদিকে।
কয়েকমুহূর্ত পর নিস্তব্ধতা নামলু। বাদুড়ের দল বেশির ভাগই এতম হয়ে গেছে। অল্প কিছু সংখ্যককে সঙ্কেত পাঠিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে হাদি হসেন।
গভীর শোনাল শহীদের গলা, শত্রুরা এরূপর কি করবে সেটাই ভাবনার বিষয়। ওদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রও ব্যর্থ হয়েছে। মরিয়া হয়ে উঠবে এবার ওরা।’
কাম। বলল, কিছু না করাটাও সবচেয়ে বড় করা, শহীদ। এভাবে কতক্ষণ থাকতে পারব আমরা? পানি নেই খাবার নেই.••
সময় বয়ে চলল। রাত গম্ভীর হচ্ছে। অবন্তির নীরবতা চারদিকে।
রাসেল বলল, ইনফ্রারেড হারিকেনের আলো বেশিক্ষণ পাব না আমরা। ব্যাটারি ক্ষয় হচ্ছে।’
‘নিভিয়ে দিলেই হয় আপাতত।’ রাসেল নিভিয়ে দিল হ্যারিকেনা। আধঘন্টা পর শহীদ ডাকল, কুয়াশা?’ কুয়াশার তরফ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। হ্যারিকেনের সুইচ অন করল রাসেল।
সবাই দেখল, ওদের সঙ্গে তুয়াশা কেন, কুয়াশার ছায়া পর্যন্ত নেই। বুকে হেঁটে এগিয়ে চলেছে কুয়াশা। আফ্রিকান প্রহরীরা টর্চ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে কুয়াশা ব্লু-বার্ডের দিকে। গতি খুব মন্থর। একহাত, মাযহত করে এগিয়ে যাচ্ছে সে, দেখে নিচ্ছে চারদিক, আবার
.
:
৭০
ভলিউম ১৯
এগোচ্ছে।
“র-বার্ডের কাছাকাছি একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলে উঠল। একজন প্রহরী সিগারেট ধরাল। সেই আলোয় ব্লু-বার্ডের কাঠামোেটা দেখে নিল কুয়াশী। আরও এগিয়ে যাবার পর কুয়াশা বুঝতে পারল বু-বার্ডের উপর বহু লোক রয়েছে। বৈদ্যতিক আলো জ্বেলে মেরামতের কাজ করছে হাদি হুসেনের লোকেরা। ব্লু-বার্ড শত্রুদের সবচেয়ে বড় ভরসা। মেরামতের কাজে হাত দিতে তাই দেরি করেনি।
পিছনের শেকলের কাছে কোন প্রহরী নেই দেখে খুশি হলো কুয়াশা। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল সে। শেকলটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কেউ লক্ষ করছে কিনা দেখার
ন্য দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর শিকল ধরে ঝুলতে ঝুলতে উঠতে শুরু করল উপরে। নিরাপদে উঠে গেল কুয়াশা। টানেল ধরে এগোল সে। বু-বার্ডের বহিরাবরণ মেরামতের কাজ চলছে। অভ্যন্তরে লোকজন নেই। থাকলেও কাউকে দেখতে পেল না কুয়াশা। মই বেয়ে সে সোজা নেমে গেল ইঞ্জিন রূমে। আলখেল্লার পকেট থেকে একটা রেঞ্চ বের করে পাঁচটা ইঞ্জিন থেকেই একটা করে ঘোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পার্ট খুলে নিল সে। পকেট থেকে রুমাল বের করে পার্টগুলো বাধল। ব্লু-বার্ড থেকে নেমে এল কুয়াশা নিরাপদেই।
নিচে নেমে কাছাকাছি বালির নিচে পুঁতে রাখল সে রুমালসহ পার্টগুলো।
বেছে বেছে এমন কয়েকটা যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে এসেছে কুয়াশা, যেগুলো ছাড়া রবার্ড আকাশে উড়তে পারবে না। ইঞ্জিনগুলো স্টার্টই নেবে না ।
বু-বার্ডের সাহায্যে ওদের উপর বোমা ফেলতে পারবে না শত্রুরা, এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে এখন।
পিছিয়ে না গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল কুয়াশা লোহার পিলার দিয়ে তৈরি বিশাল কারাকক্ষের দিকে।
দূর থেকেই একজন প্রহরীকে দেখতে পেল কুয়াশা। লোকটা পায়চারি
কাছাকাছি গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। কটু গন্ধ ঢুকছে নাকে। সূতর্ক হয়ে উঠল ওর দৃষ্টি এবং কান। বাদুড়ের গন্ধ।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও বাদুড়ের আগমন ঘটল না। আবার এগোতে শুরু করল সে। প্রহরীটা ফিরে আসছে আবার কারাকক্ষের গেটের দিকে।
দূর থেকে নিক্ষেপ করল কেউ উজ্জ্বল টর্চের আলো। কারাকক্ষের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রহরীটা। তার গায়ে পড়েছে টর্চের আলো।
এক মুহূর্ত পর নিভে গেল আলো। কিন্তু এই এক মুহূর্তে অত্যাশ্চর্য একটা জিনিস দেখে ফেলেছে কুয়াশা।
প্রহরীটা একটা খাঁচার ভিতর পায়চারি করছে। লোহার শিক দিয়ে তৈরি খাঁচার তল নেই। খাঁচাটা এমনভাবে তৈরি যে তার ভিতরে একজন লোক অনায়াসে দাঁড়াতে পারে! লোকটার হাঁটা-চলার কোন অসুবিধে হয় না।
| খাঁচার ভিতর প্রহরী! রহসটা কি! রহস্যটা অনুমান করতে অসুবিধে হলো না কুয়াশার । রক্তচোষা বাদুড়ের কবল থেকে রক্ষার ব্যবস্থা হলো ওই খাঁচা।
টর্চের আলো মাঝে মধ্যেই জ্বলছে। প্রহরীরা নিজেদের লোকের গায়ে আলো
করছে।
কুয়াশা ৫৬
৭১
ফেলে দেখে নিচ্ছে–শ না মিত্র।
সেই আলোয় কুয়াশা দেখল কারাকক্ষের কাছ থেকে পনেরো বিশ গজ দূরে বাঁশের ঝুলন্ত মাচার উপর সারি সারি সাজানো রয়েছে ছোট ছোট চারকোনা লোহার শিক দিয়ে তৈরি করা খাঁচা।
বাদুড়ের গন্ধ পাবার কারণ পরিষ্কার হয়ে গেল। পাশাপাশি পঁচিশ ত্রিশটা খাঁচা দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি খাঁচায় একটি করে রক্তশোষক বাদুড় রয়েছে। প্রতিটি খাঁচার সঙ্গে তার-এর যোগাযোগ রয়েছে। বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে খাঁচার দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় প্রয়োজনের সময়।
প্রহরীটা আবার টহল দিতে দিতে দূরে সরে গেছে। কারাকক্ষের দরজার দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল কুয়াশা। গেটের কাছে গিয়ে থামল সে। দুই হাত দিয়ে বালি সরিয়ে একটা গর্ত করল। আলখেল্লার পকেট থেকে ভারি, বড় একটা প্যাকেট বের করে সেই গর্তের ভিতর রাখল। দ্রুত বালি চাপা দিয়ে জায়গাটাকে সমতল করে ফেলল।
কারাকক্ষের সামনে থেকে ডায়মণ্ড খনির দিকে এগোতে লাগল কুয়াশা। খানিক দূর যাবার পর সে দেখল পাশাপাশি অনেকগুলো তলহীন খাঁচা দাঁড় করানো রয়েছে। একটা খাঁচায় প্রবেশ করল কুয়াশা। হাঁটল খানিকদূর। কোন অসুবিধাই
অনুভব করল না সে।
* পঞ্চাশটা খাঁচা, গুণে দেখল কুয়াশা। খাঁচাগুলোর কাছে আধঘণ্টারও বেশি সময় কাটাল সৈ। তারপর পা বাড়াল।
এবার ফিরতে হয় ।
শত্রুদের চোখে ধুলো দিয়ে নিরাপদে ফিরে এল কুয়াশা তার বন্ধু এবং সহকারীদের কাছে।
সকলের প্রশ্নের উত্তরে কুয়াশা বলল, সকাল হোক, নিজেরাই বুঝতে পারবে, কেন, কি করতে গিয়েছিলাম আমি।
সাত
ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে শত্রুরা আক্রমণ করল।
কুয়াশার ডাকে সজাগ হয়ে উঠল সবাই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কামাল। রিভলবার দিয়ে গুলি করল সামনের দিকে পর পর দুবার।
শহীদ স্টেন নিয়ে অপেক্ষা করছে। বাকি সবাই তৈরি। হঠাৎ দেখা গেল শত্রুপক্ষকে। একজন দুজন নয়, দল বেঁধে এগিয়ে আসছে
ব্যাপার কি! প্রকাশ্যে এগিয়ে আসছে ওরা!
সত্যিই তাই। গা-ঢাকা দেবার কোন চেষ্টাই করছে না শত্রুরা। সোজা হেঁটে আসছে তারা।
শহীদ হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল।
१२
ভলিউম ১৯
কুয়াশা! শয়তানরা মস্ত একটা কৌশল খাঁটিয়েছে। ওরা নয়, আসছে ক্রীতদাসের দল। বন্দিদেরকে সামনে রেখে পিছু পিছু আসছে ওরা। দেখতে পাচ্ছিস, কামাল? বন্দিদের প্রত্যেকের গলায় শিকল বাধা।
মাই গড! ডুশমনরা ভারি বুড্ডি খাটাইয়াছে, স্বীকার করিটেই হইবে।’
রাসেল বলল, ‘ওরা জানে বন্দিদের লক্ষ করে আমরা গুলি করব না; করলে নিরীহ একদল লোক মারা যাবে।
এখন উপায়?’
কুয়াশাকে অস্বাভাবিক গভীর দেখাচ্ছে। থমথমে গলায় বলল সে, কোন উপায় নেই। বন্দিদের কোন ক্ষতি করতে পারি না আমরা।
| এগিয়ে এসেছে দলটা। বন্দিদের পিছনে সশস্ত্র শত্রুপক্ষ। তাদের মধ্যে হাদি হুসেন আর উত্তাল চৌধুরীকেও দেখা যাচ্ছে।
বন্দিরা শারীরিক ভাবে ভীষণ দুর্বল। ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে আসছে তারা। ভাবলেশহীন চেহারা তাদের। জীবন এবং মৃত্যু দুটোই যেন তাদের কাছে সমান। প্রতি মুহূর্তে পিঠে চাবুক খেয়েও তারা শান্ত থাকছে।
কুয়াশা এগিয়ে গেল সবাইকে পিছনে রেখে। খানিকটা এগিয়ে দুই কোমরে হাত দিয়ে বুক টান করে দাঁড়াল সে। চিৎকার করে জানতে চাইল, কি চাও তোমরা?’
ইতিমধ্যে কুয়াশাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে শত্রুপক্ষ। তাদের সামনের বন্দিও দাঁড়িয়ে পড়েছে।
-বার্ডের যন্ত্রগুলো চাই! তোমরাই সরিয়েছ ওগুলো,’ উত্তাল জবাব দিল।
কুয়াশা বলল, স্বীকার করছি, সরিয়েছি। কিন্তু ফিরিয়ে দেবার জন্য সরাইনি। হাজার চেষ্টা করলেও খুঁজে পাবে না তোমরা, ওগুলো। ওগুলো ছাড়া রু বার্ড অচল। খাবার, পানি, কিছুই পাবে না তোমরা। না খেয়ে মরতে হবে
তোমাদের।’ | হাদি হুসেন আর উত্তাল অনেকক্ষণ ধরে নিচু গলায় কথা বলল নিজেদের মধ্যে ।
তারপর উত্তাল বলল, ‘আত্মসমর্পণ করো তোমরা। আমাদেরকে ফিরিয়ে দাও যন্ত্রাংশগুলো। তার বদলে, কথা দিচ্ছি, তোমাদেরকে হত্যা করব না আমরা। শুধু তাই নয়, এই দুর্গম জায়গা থেকে নিরাপদ লোকালয়ে রেখে আসব তোমাদেরকে।
কুয়াশা অপ্রত্যাশিত ভাবে বলল, “ঠিক আছে। প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখো। আমরা আত্মসমর্পণ করছি।’
কামাল অস্থির গলায় বলে উঠল, ‘একি করলে তুমি, কুয়াশা! আত্মসমর্পণ করব! কিন্তু ওরা বেঈমান-প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী কাজ করূবে না।
কুয়াশা নিচু গলায় শুধু বলল, জানি। কিন্তু পার্টগুলো না পাওয়া অবধি ওরা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। সেগুলোর কথা এত তাড়াতাড়ি ওদেরকে বলছি না আমি।
সশস্ত্র শত্রুপক্ষ ওদেরকে ঘিরে ফেলল। ওদের ব্যাগ-ব্যাগেজ দখল করল সব।
কুয়াশা ৫৬
৭৩
কড়া পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল নিজেদের আস্তানার অভ্যন্তরে। শায়লা পারভিনকে নিয়ে চলে গেল হাদি হুসেন। একপ্রান্তের একটা জানালাহীন পাথরের কামরার ভিতর তাকে নিয়ে ঢুকল হাদি হসেন। খানিক পর বাইরে বেরিয়ে এল সে। দরজাটা
বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে।
| কুয়াশা আর বাকি সবাইকে অন্য একটা পাথরের কামরায় ঢোকানো হলো । প্রত্যেকের গায়ের এবং পরনের কাপড় খুলে নিল শত্রুরা, বদলে রতে দিল একখণ্ড চাদর। ওদের কাপড়-চোপড়. সব পুড়িয়ে ফেলা হলো। ওদের ব্যাগ-ব্যাগেজগুলো নিয়ে চলে গেল উত্তালের নির্দেশে আফ্রিকান নিগ্রোরা। সেগুলো নিয়ে গিয়ে কোথায় রাখা হলো তা জানার সুগে পন না কেউ।
সাবান এবং পানি নিয়ে এল নিগ্রোর দল। স্নান করল ওরা! শুকনো রুটি এবং মধু এল প্রচুর।
পেট ভরে খেলো ওরা তাই।
ওদের খাওয়া শেষ হতে একসঙ্গে হাদি হুসেন আর উত্তাল প্রবেশ করল কামরার ভিতর।
এবার বলো, কোথায় রেখেছ পাটগুলো। হাসল কুয়াশা। বলল, ‘এত সহজে? পাটগুলো তোমাদেরকে দিলে তোমরা যদি আমাদেরকে মুক্তি না দাও? না, আমরা কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নই। দুটো দিন সময় দাও আমাদের। আমরা চিন্তা ভাবনা করে দেখি কি পদ্ধতিতে তোমাদেরকে পার্টগুলো দিয়ে তার বদলে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারি।’
হাদি হুসেন দাতে দাঁত চাপল।
কিন্তু উত্তাল বলল, “ঠিক আছে। তাই। কিন্তু বসে বসে খাবার আর পানি ধ্বংস করবে তা চলবে না। তোমাদেরকে কাজ করতে হবে খনিতে।
‘আপত্তি নেই। আমরা কাজেরই মানুষ,’ বলল কুয়াশা। বনির দিকে যাবার পথে দিনের আলোয় চারিটা দিক ভাল করে দেখে নেবার সুযোগ পেল ওরা।
রক্তচোষা বাদুড়ের খাঁচাগুলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় কুয়াশা জানতে চাইল, ‘আরও বাদুড় আছে নাকি তোমাদের?’
| আরও আছে মানে? অসংখ্য আছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল হাদি হুসেন!
খনিতে নামার অনেকগুলো পথ। সরু, ঢালু, বিপজ্জনক পধগুলো। নামার সময় ওরা একদিকের দেয়ালে বড় একটা গর্ত দেখল। সেই গর্তে আরও অনেক তারের খাঁচা রয়েছে। প্রতিটি খাঁচাতেই রয়েছে বাদুড়।
খনির নিচে নামল ওরা। আগে থেকেই কঙ্কালসার বন্দিরা মাটি কাটছিল। লোকগুলোর অবস্থা দেখে দুঃখে ভারি হয়ে উঠল ওদের সকলের বুক। মানুষের সব গুণ, সব উপলব্ধি, সব আবেগ-উত্তেজনা হারিয়ে ফেলেছে অভাগারা–এক একজন এক একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে যেন।
কোদাল আর শাবল দেয়া হলো,ওদেরকে। নীল রঙের মাটি কেটে বালতিতে ভরতে শুরু করল ওরা।
.
৭৪
ভলিউম ১৯
এই নীল মাটি সূর্যের তাপে শুকানো হয় প্রথমে। কয়েক হপ্তা ফেলে রাখা হয় উন্মুক্ত আকাশের নিচে-যতদিন না নীল মাটি শুকিয়ে গুঁড়ো গুড়ো হয়ে ওঠে। শুকনো-গুড়োগুলোকে এরপর ছিদ্র যুক্ত রিভলভিং পাত্রে তোলা হয়। ছাঁকাহাঁকির পর যা অবশিষ্ট থাকে সেগুলোকে পালসৌর মেশিনে ঢালা হয়।
খনির নিচে সারাটা দুপুর এবং বিকেল মাটি কাটল ওরা। বন্দিদের বিরুদ্ধে যে অকথ্য অত্যাচার চালানো হয় তার সামান্য নমুনা দেখেই আগুন জ্বলে উঠল ওদের প্রত্যেকের শরীরে। কিন্তু কেউ ব্যাপারটা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করল না!
চারজন বন্দি চাবুকের আঘাত খেয়ে জ্ঞান হারাল। তাদের মধ্যে একজনের জ্ঞান ফিরল না। মারা গেছে সে।
মাঝে মাঝে উত্তালকে দেখল ওরা। তদারক করে গেল সে কয়েকবার। | কুয়াশার পাশে কয়েকজন বন্দি মাটি কাটছিল। আলাপ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। বোবা, মূক, বধির বলে মনে হলো লোকগুলোকে। কুয়াশার প্রশ্নের উত্তরে শ্বেতাঙ্গ বন্দিরা কোন কথাই বলল না।
বন্দিদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ অশ্বেতাঙ্গ সব ধরনের লোকই রয়েছে। সন্ধ্যা নামল। কড়া পাহারা দিয়ে তুলে আনা হলো ওদেরকে।
পালসেটর মেশিনের কাছে একটা ট্রে-র উপর জমা করে রাখা হয়েছে সারাদিনের সঞ্চিত ডায়মণ্ড। পাশ ঘেঁষে যাবার সময় একজন প্রহরীর পায়ে ল্যাঙ মারল শহীদ।
| আছাড় খেয়ে পড়ল প্রহরী। চারদিক থেকে ছুটে এল অন্যান্য প্রহরীরা। শহীদকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল একজন। শহীদ কনুই চালালু পিছন দিকে ।
প্রচণ্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠল লোকটা। ছেড়ে দিল সে শহীদকে। শহীদ যেন খেপে গেছে। লাফ দিয়ে ডায়মণ্ড ভর্তি ট্রে-এর কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও মুঠো ভর্তি করে তুলে নিল ট্রে থেকে বেশ কয়েকটা ডায়মণ্ড, পরমুহূর্তে সেগুলো ছুঁড়ে দিল খনির ভিতরে।
ওর দেখাদেখি কামালও একই ধরনের পাগলামি শুরু করল ।
ওদের দুজনকে ঘিরে ফেলল প্রহরীর। খুনের নেশা তাদের দুই চোখে। এমন সময় উত্তাল এল ছুটতে ছুটতে।
অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করল সে প্রহরীদের। | ‘গাধার বাচ্চারা? এরা আমাদের রুবার্ডের পার্ট লুকিয়ে রেখেছে, জানিস না? এদেরকে মেরে ফেললে সেগুলো ফিরে পাবার আর কোন আশাই থাকবে না।’
কুয়াশা বলল, “তোমাদের লোকদের এ ব্যাপারে পরিষ্কার জানিয়ে দাও, উত্তাল। আমি আবার তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমার দলের কারও গায়ে আঁচড়টি লাগলে আমি পার্টগুলো ফিরিয়ে দেব না!
আট
নতুন একদল প্রহরী এল । উক্তি বেয়োনেটের মুখে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল ওরা। বিরাটাকৃতি কারাকক্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওদেরকে।
কুয়াশা ৫৬
৭৫
যাবার পথে ওরা লক্ষ করল প্রহরী এবং অনুচরদল তন্ন তন্ন করে চারদিক খুঁজছে ৰু-বার্ডের চুরি যাওয়া মেশিনারী পার্টস। এখানে-সেখানে অনেক গর্ত খোঁড়া হয়েছে, নতুন আরও অনেক গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। যে জায়গায় পার্টগুলো লুকানো আছে সেই জায়গা বা তার আশপাশে সন্ধান নেয়নি বা নিচ্ছে না এখনও-লক্ষ করল কুয়াশা।
রবার্ডের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো মেরামত করার কাজ অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। গম্বুজের উপর লোকজন চড়েছে মই বেয়ে। পরীক্ষা করে দেখছে কোথাও কোন ছিদ্র সৃষ্টি হয়েছে কিনা। কারাকক্ষটার চারদিকে দেয়াল বা পাচিল নেই, তার বদলে মোটা মোটা ইস্পাতের পিলার দাঁড়িয়ে আছে, একটার সঙ্গে অপরটার দূরত্ব মাত্র চার ইঞ্চি। পিলারগুলো তৈলাক্ত, পিচ্ছিল। সোজা উঠে গেছে আকাশের দিকে। পাঁচ-ছয় মানুষ উঁচু। প্রত্যেকটির মাথা উঁচাল।
কারাকক্ষের ভিতরেও এখানে সেখানে অনেকগুলো পিনার রয়েছে। সেগুলো তেমন উঁচু নয়। এই পিলারগুলোর সঙ্গে লোহার শিকল বাধা। সেই শিকলের সঙ্গে বাধা দশ বারোজন করে হাড্ডিসার মৃতপ্রায় লোক।
কুয়াশাকে একটি পিলারের সঙ্গে বাঁধা হলো। তার কোমরে জড়িয়ে দেয়া হলো লোহার শিকল। শিকলটা খুবই ছোট। বসার কোন উপায় নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে সে বাধ্য। শুধু কুয়াশার জন্য নয়, এই একই ব্যবস্থা বাকি সকলের জন্যও। | ডি কস্টা দূরের একটি পিলারের কাছ থেকে বলল, ভেরি ব্যাড, ইনভীড় । খোদ শয়টানের চেলা এনিমিরা। মি. কামাল, হামুরা যখুন মুষ্ট হইব টখন এনিমিডেরকে কি রকম শাস্টি ডিটে হইবে টাহা চিন্তা করিয়া বাহির করুন, প্লীজ!’
| কামাল বলল, ‘চুপ করুন । আমি ঘুমোবার চেষ্টা করছি।’
রাসেল বলে উঠল কারাকক্ষের দূর প্রান্ত থেকে, ঘুমোবার চেষ্টা করছেন। সেকি! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?
ডি. কস্টা বলল, ‘দ্যাটস্ ইমপসিবল!
কামাল বলল, যখন যা অবস্থা। বাস্তবকে মেনে নেয়া দরকার। ঘুম না হলে দুর্বল হয়ে পড়ব, তা আমি চাই না।’
হঠাৎ সবাই চুপ করুল। কুয়াশার গলা শোনা যাচ্ছে। কার সঙ্গে যেন কথা বলছে সে।
কুয়াশা তার পাশের একজন বন্দির সঙ্গে আলাপ করছিল। কখনও পালাবার চেষ্টা করোনি এখান থেকে?’
| বন্দি লোকটা বলল, না। পালাবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। যারা সে চেষ্টা করেছে তাদের কপালে কি ঘটেছে তা আমরা সবাই জানি।
বন্দি লোকটা ভাল উর্দ বলতে পারে। সে মিশরের লোক। কুয়াশা প্রশ্ন করল, “কি ঘটেছে তাদের কপালে?’
তারা সবাই মারা গেছে। কেউ মরেছে বাদুড়ের কামড় খেয়ে-কেউ মরেছে জঙ্গলে সাপের কামড়ে বা মানুষখেকো গাছের কবলে পড়ে। ওই জঙ্গলে-ওটার ভিতর কেউ ঢুকে আজ পর্যন্ত বেরুতে পারেনি।’
কুয়াশা বলল, কিন্তু পালানো একেবারে অসম্ভব কি? শায়লা পারভিন এবং
৭৬
ভলিউম ১৯
তার দুই সাথী…।’
বন্দি লোকটা বলল, মিস শায়লাকে ওরা সন্দেহ করত না। সেজন্যেই ওর পালাবার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছে ভেবে দেখুন। মিস শায়লাকে ফিরিয়ে এনেছে ওরা। তার সাথীদেরকে খুন করেছে।
“আপনারা এখানে মোট কতজন আছেন?’ ‘দুই শত এগারো জন।
আরও কিছু প্রশ্ন করুল কুয়াশা। বন্দি লোকটি খানিক পর বেশ বিরক্তির সঙ্গেই বলল, এত কথা জানতে চাইছেন কেন? জেনে কি লাভ? ভেবেছেন পালাতে পারবেন ওদের হাত থেকে? তা যদি ভেবে থাকেন, তাহলে বলব আপনি এখনও বিপদের গুরত্ব টের পাননি। ধরে নিন, আপনি শেষ হয়ে গেছেন, মারা গেছেন।
ওদের হাতে বন্দি আপনি, চিরকাল এই বন্দি হয়েই থাকতে হবে।’
| কুয়াশা লোকটার কথার উপর কিছুই বলল না।
চাঁদ বা নক্ষত্র–কিছুই নেই আকাশে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার চারদিকে। ঢং ঢং করে
দুটো ঘন্টা পড়ল।
রাত দুটো।
মাঝে মাঝে প্রহরীদের পদশব্দ ভেসে আসছে কারাকক্ষের বাইরে থেকে। কখনও কখনও টর্চের আলো দেখা যাচ্ছে-আলো নিভে যাচ্ছে।
মৃদু কণ্ঠে কুয়াশা বলল, শহীদ। শহীদ অন্ধকার থেকে শুধু বলল, ইয়েস।
পরনের চাদরের এক কোণায় গিট বাধা, সেটা খুলল শহীদ। বেরিয়ে এল একটুকরো ডায়মণ্ড।
খনির উপর উঠে ট্রে থেকে ডায়মণ্ডের টুকরোগুলো নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করার সময় একটা করে টুকরো লুকিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল শহীদ এবং কুয়াশা। শত্রুদেরকে বোকা বানিয়ে ডায়মন্ডের টুকরো সংগ্রহ করাই ছিল তখনকার উদ্ভট আচরণের একমাত্র কারণ। | কুয়াশার কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে শহীদ ডায়মণ্ডের টুকরো দিয়ে কেটে ফেলল শিকল। নিজেকে মুক্ত করে এগিয়ে গেল সে কামালের দিকে। অস্ফুটে ডাকল,
কোথায় তুই, কামাল?’।
কামাল সাড়া দিল, এইদিকে!
এদিকে কুয়াশাও নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছে। রাজকুমারী ওমেনাকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে সে।
মিনিট বিশেকের মধ্যে সকলকেই মুক্ত করল ওরা।
যা করার দ্রুত করতে হবে আমাদের। প্রহরীরা যে কোন মুহূর্তে ঢুকতে পারে ভিতরে চেক করার জন্য। কুয়াশা, পিরামিড তৈরি করি আমরা, কেমন?
শহীদের প্রশ্নের উত্তরে কুয়াশা বলল, একটু পর। আমার যন্ত্রপাতির প্যাকেটটা বের করি আগে।
অন্ধকারে পা ফেলে ফেলে কারাকক্ষের গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা।
কুয়াশা ৫৬
৭৭
চিন্তা করল একমুহূর্ত। জায়গাটা কোথায় তা অনুমান করে এগিয়ে গেল ডান পাশে খানিকটা। তারপর হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল।
একটি হাত বাইরে বের করে মাটি খুঁড়তে শুরু করুল কুয়াশা। কয়েকমুহূর্ত পর প্যাকেটটা ঠেকল হাতে |
ফিরে এল কুয়াশা। চাপা কণ্ঠে বলল, ‘প্রহরীটা গেটের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে । আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।’
কথাগুলো বলে কুয়াশা গেটের কাছে ফিরে গেল নিঃশব্দে। মিনিট তিনেক পর কুয়াশার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘এসো!’ | গেটের সামনে ওরা পরস্পরের কাঁধে উঠে দাঁড়াল। সকলের উপর দাঁড়াল ডি. কস্ট।
কুয়াশা ওদের শরীরের উপর দিয়ে উঠে গেল, দাঁড়াল ডি. কস্টার কাঁধে।
চাপা, যন্ত্রণাক্ত কণ্ঠে অভিযোগ করল ডি-কস্টা, গোটা দুনিয়াটা আমার উপর চাপাইয়া ডেয়া হইয়াছে বলিয়া মনে হইটেছে। যডি সেন্সলেস হইয়া যাই হামার কোন দোষ নাই।’
হঠাৎ ডি কস্টা অনুভব করল তার কাঁধে কুয়াশা নেই।
পিলার ধরে উঠে গেছে উপরে কুয়াশা, ডিগবাজি খেয়ে অতিক্রম করেছে সে পিলারের ছুঁচাল মাথাগুলো।
পিলারগুলো টপকে গিয়ে তরতর করে নেমে পড়ল কুয়াশা কারাকক্ষের বাইরের প্রাঙ্গণে।
টহলদানরত প্রহরীটা এগিয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে দেখে ফেলার আশঙ্কা, নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল কুয়াশা।
প্রহরী বেশ খানিকটা দূর দিয়ে চলে গেল। চারকোনা কারাকক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সুে। গেটের পাশ দিয়ে প্রতি তিন মিনিটে একবার করে হেঁটে যাচ্ছে।
| প্রহরী অদৃশ্য হয়ে যেতে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও মানুষ সমান উঁচু মাচাটা কোন দিকে তা অনুমান করে সন্তর্পণে পা বাড়াল
সে । কয়েক গজ এগিয়েই থামল। মাচার সামনে পৌঁছে গেছে সে।
মাচার উপর পাশাপাশি সাজানো রয়েছে লোহার শিকের বাঁচাগুলো।
খচাগুলোর খুব একটা কাছাকাছি এগোল না কুয়াশা। হাতের প্যাকেটটা খুলল সে। বের করল একটা বড়সড় বোতল, খানিকটা তুলো এবং সিগারেটের মত ছোট একটা পেন্সিল টর্চ।
বোতলের ক্লোরোফর্ম দিয়ে তুলোর খানিকটা ভিজিয়ে নিল কুয়াশা। তারপর ইনফ্রা-রেডআলো নিক্ষেপক ছোট্ট পেন্সিল টর্চটা জ্বালল। প্যাকেট থেকে বের করে চশমা জোড়া আগেই সে পরে নিয়েছে।
মৃদু আলোয় কুয়াশা দেখলবাদুড়গুলো সতর্ক, সন্দিহান হয়ে উঠেছে। একটি খাঁচার ভিতর ক্লোরোফর্ম ভেজানো তুলোর করোটা ঢুকিয়ে দিল কুয়াশা। খাঁচার বাদুড়টা তুলোটাকে জীবন্ত কিছু মনে করে ঠোকর মারল ঠোঁট দিয়ে পর পর দুবার। তৃতীয়বার ঠোকর মরতে গিয়েও পারল না সে, ঢলে পড়ল জ্ঞান হারিয়ে।
আঙুল দিয়ে খাঁচার ভিতর থেকে ভিজে তুলোটা বের করে নিল কুয়াশা।
ভলিউম ১৯
পাশের খাঁচার ভিতর সেটাকে ঢুকিয়ে দিল এবার। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। দ্বিতীয় খাঁচার রক্তশোষক বাদুড়টিও জ্ঞান হারাল।
এইভাবে একের পর এক আঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ক্লোরোফর্মে ভেজানো তুলো ব্যবহার করে ভ্যাম্পায়ারগুলোকে সাময়িক ভাবে অজ্ঞান করে দিল কুয়াশা। | শান্তু কিন্তু এ নিজের কাজ করে চলেছে কুয়াশা। মনে মনে চঞ্চল হয়ে উঠলেও কাজের মধ্যে তার কোন প্রকাশ দেখা গেল না। খাঁচার সংখ্যা একটা দুটো নয়–অসংখ্য। প্রচুর সময় লাগছে। যত দেরি হচ্ছে ততই ভয়ঙ্কর বিপদের আশঙ্কা করে বাড়ছে।
অবশেষে কাজটা শেষ হলো। এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটল সে খনির দিকে।
খনির মুখে দুইজন স্টেনগানধারী প্রহরীকে দেখা গেল। সন্তর্পণে এগোল কুয়াশ। লোক দুজন উঁচু একটা পাথরের উপর বসে গল্প করছে। ইনফ্রারেড পেন্সিল টর্চের মৃদু আলোয় ওদেরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কুয়াশা। নিঃশব্দ পায়ে লোক দুজনের ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দুই হাত দিয়ে দুজনের মাথা ধরে
আচমকা ঠুকে দিল সে সজোরে।
দুই মাথা জোরে ঠোকর খেলো-সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল লোক দুজন।
খনির ভিতর নামতে শুরু করুণ কুয়াশা। খানিক দূর নেমেই প্ৰকওি একটা গষর দেখল সে একপাশে। লাফ দিয়ে সেই গহ্বরের ভিতর ঢুকল। অসংখ্য খাঁচা রয়েছে পাশাপাশি। ক্লোরোফমে ভেজানো তুলো ব্যবহার করতে শুরু করল আবার কুয়াশী।
আধঘণ্টা পর খনির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল সে। দ্রুত পায়ে ফাঁকা উঠানটা পেরিয়ে একটা পাথরের তৈরি কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
দরজাটার গায়ে হাত দিতেই সেটা খুলে গেল। অবাক হলো কুয়াশা দরজাটা খোলা দেখে ।
ভিতরে ঢুকল, না সে। ঢোকার আগে জেনে নিতে হবে ভিতরে প্রহরীরা কেউ আছে কিনা । এই কামরায় শায়লাকে ঢোকানো হয়েছিল, দেখে রেখেছিল সে। কিন্তু দরজাটা খোলা কেন?
কামরার ভিতর থেকে কীপা কুণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে ওখানে! শায়লার গলা। গুলাটা চিনতে পেরেই দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল কুয়াশা। দূরজাটা ভিজিয়ে দিল। শায়লা তাকে দেখতে না পেলেও সে শায়লাকে দেখতে পাচ্ছিল ইনফ্রা-রেড
পেন্সিল টর্চের আলোয়।
দরজাটা খোলা কেন? একজন প্রহরী দুমিনিট পর পর আসে, উঁকি মেরে দেখে যায় আমাকে•••
কুয়াশা শায়লার কোমরে জড়ানো শিকল ডায়মন্ডের টুকরো দিয়ে কাটতে কাটতে বলল, বুঝেছি।
| শিকলটা কাটা হতেই দরজার কাছে টর্চের আলো পড়ল। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা ঢুকল কামরার ভিতর।
আঁতকে উঠল শায়লা পারভিন, ‘প্রহরীটা ফিরে আসছে। কি হবে!’ লাফ দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। পরমুহূর্তে সশব্দে খুলে গেল
কুয়াশা ৫৬
৭৯
কবাট দুটো।
বিদ্যুৎবেগে ঘুসি চালাল কুয়াশা। প্রহরীর নাকে গিয়ে লাগল ঘুলিটা। বিশ্রী একটা শব্দ হলো। থ্যাচ করে ভেঙে গেল নাকটা।
প্রহরীর অচেতন দেহটা সশব্দে ধরাশায়ী হলো ।
কুয়াশা বলল, “শায়লা, তুমি এখানেই অপেক্ষা করো। খানিক পরই শোরগোলের শব্দ পাবে। দেরি না করে এখান থেকে বেরিয়ে ছুটবে তুমি রুবার্ডের দিকে। ভুল কোরো না।’
কথাগুলো বলেই বেরিয়ে পড়ল কুয়াশা। | ফাঁকা উঠানের মাঝখান দিয়ে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে কুয়াশা, সোজা কারাকক্ষের দিকে যাচ্ছে সে। আচমকাদটো টর্চের আলো জ্বলে উঠল।
আলোকিত হয়ে উঠল কুয়াশার শরীর। ‘কে! ইয়ান্না…’
ইয়াল্লা!’। পরমূহুর্তে গর্জে উঠল একটা রাইফেল।
ডাইভ দিয়ে সরে গেছে কুয়াশা ইতিমধ্যে, বালির উপর শুয়ে পড়েছে সে। প্যাকেট থেকে বেরিয়ে এসেছে তার হাতে ছোট আকারের একটি রিভলবার।
রাইফেলের শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই গর্জে উঠল কুয়াশার হাতের রিভলবার।
নিভে গেল একটি টর্চ।
অপর টর্চটি নিভে গেছে আগেই। কিন্তু সেদিক থেকে ভেসে আসছে ধস্তাধস্তির
শব্দ।
হঠাৎ শোনা গেল শায়লা পারভিনের আর্ত চিৎকার! বাঁচাও!’
ছুটল কুয়াশা। কয়েক গজ এগিয়েই সে দেখল শায়লার দেহের উপর একটা পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে একজন প্রহরী। তার হাতের রাইফেলের ডগায় ফিট করা বেয়োনেটটা শায়লার বুক বরাবর খাড়া নেমে আসছে।
গুলি করল কুয়াশা। প্রহরীটা টলে উঠন। পড়ে গেল সশব্দে বালির উপর শায়লা পারভিনের পাশে। শায়লা পারভিন তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
কুয়াশা তার একটা হাত ধরে ছুটল কারাকক্ষের দিকে, চাপা কণ্ঠে বলল, আমার পিছু পিছু আসছিলে বুঝি?’
হ্যাঁ। কাজটা কিন্তু খারাপ করিনি। লোকটা আপনাকে গুলি করছে দেখে পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম আমি। হাত কেঁপে গিয়েছিল বলে গুলি লাগেনি আপনার•••।’
‘ধন্যবাদ!
এদিকে শোরগোল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। ব্যাপারটা কি জানার চেষ্টা করছে শত্রুরা। প্রহরীরা টর্চ জ্বেলে ছুটোছুটি করছে।
কারাকক্ষের গেটের সামনে সৌছুল ওরা।
শহীদ! কুয়াশার গলা শুনে শহীদ গেটের ওপার থেকে বলে উঠল, “সব বন্দিকে মুক্ত
৮০
ভলিউম ১৯
করেছি। এখন শুধু গেটটা খুললেই হয়। কি করতে হবে বলেছি সবাইকে।
রিভলবার ব্যবহার করল কুয়াশা। এখন আর নিঃশব্দে কাজ করে কোন লাভ হবে না।
গেটের তালা ভেঙে গেল।
গেট খুলে বেরিয়ে এল শহীদ, কামাল, ওমেনা, ডি. কস্টা, রাসেল। তাদের পিছু পিছু কঙ্কালসার বন্দিরাও বেরুল। শহীদের হাতে নিজের একমাত্র রিভলবারটা ধরিয়ে দিয়ে বলল কুয়াশা, রুবার্ডের দিকে সবাইকে নিয়ে এগোও!’
সামনে শহীদ এবং রাজকুমারী । বন্দিরা ভয়ে ভয়ে পা বাড়াল। সকলের পিছনে কামাল, রাসেল, ডি. কস্টা এবং শায়লা পারভিন।
কুয়াশা চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেছে কোন দিকে যেন।
অন্ধকারে ছুটছে কুয়াশা। টর্চ জ্বলছে এদিক-ওদিক থেকে। কাছাকাছি এক জায়গা থেকে একটা টর্চ জ্বলে উঠেই নিভে গেল। ছুটতে সুরু করল কুয়াশা সেদিকে।
“ শত্রুপক্ষ এখনও সঠিক ঠাহর করতে পারেনি কোথায় কি ঘটেছে। প্রহরীরা সংখ্যায় দশ বারোজন হবে। তারা বিশৃংখল ভাবে ছুটোছুটি করছে শুধু।
চার হাত দূর থেকে একজন প্রহরীর উপর লাফিয়ে পড়ল কুয়াশা। লোকটাকে নিয়ে বালির উপর পড়ল সে। ঘূসিটা কপালের ডান দিকে লেগেছে, জ্ঞান হারিয়েছে সে সঙ্গে সঙ্গেই। উঠে দাঁড়াল কুয়াশা প্রহরীর রাইফেলটা নিয়ে। অদূরে আরও একজন প্রহরী, টর্চের আলো ফেলল সে কুয়াশার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল কুয়াশার হাতের রাইফেল।
‘ আর্তচিল্কারে কেঁপে উঠল চারদিক।
ছুটল কুয়াশা। আহত প্রহরীর রাইফেলটা সংগ্রহ করল সে। দুটো রাইফেল হলো। আবার টর্চের আলো দেখে গুলি করল সে।
মিনিট পাঁচেক পর শহীদ হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। আচমকা আলোকিত হয়ে উঠল চারদিক।
শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠেছে এতক্ষণে। | প্রমাদ গুণল শহীদ। একটা রিভলবার মাত্র সম্বল তাদের। শত্রুপক্ষ সবাই সশস্ত্র। তবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে মরতে হবে বোকার মত। অদূরের বৈদ্যুতিক বাল্ব লক্ষ্য করে গুলি করল সে।
অব্যর্থ লক্ষ্য। চুরমার হয়ে গেল বালবটা।
চমকে উঠল শহীদ ওর পাশ থেকে একটি রাইফেল গর্জে উঠতে শুনে। ঝট করে তাকাল সে। কামালের হাতে একটি রাইফেল দেখে আরও অবাক হলো ও।
কুয়াশা দিয়ে গেল।’ কথাটা বলেই কামাল গুলি করল। দ্বিতীয় একটা বালব নিভে গেল পরমুহূর্তে। চারদিক থেকে গুলি বর্ষণ শুরু হলো। বালবের সংখ্যা একে একে কমছে।
সকলের পিছন থেকে রাজকুমারী, রাসেল এবং ডি. কস্টাও রাইফেলের গুলি ছুঁড়ছে। কুয়াশা ওদেরকেও দিয়ে গেছে একটা করে রাইফেল।
বন্দিরা হতভম্ব হয়ে পড়েছে। শহীদ এবং কামাল একটু একটু করে এগোলেও,
৬-কুয়াশা ৫৬
সবাই তাদেরকে অনুসরণ করছে না। কেউ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে, কেউ পিছু হটছে।
কুয়াশা দলের সঙ্গেই রয়েছে। কঙ্কালসার মানুষগুলোকে আশ্বাস দিচ্ছে সে, দলের সঙ্গে থাকার জন্য পরামর্শ দিচ্ছে, সেই সঙ্গে শনিধনের জন্য রাইফেলের গুলি ছুঁড়ছে এদিক-সেদিক। ব্লু-বার্ডের দিকে এগোচ্ছে গোটা দলটা
চারদিক থেকে এলোপাতাড়ি গুলি হচ্ছে। কঙ্কালসার লোকগুলোর মাঝখানে এসে পড়ছে দুএকটা বুলেট। | আর্তচিৎকার, কাতরানি, গোঙানি-কান পাতা দায়। এমন সময়, সব শব্দকে ছাপিয়ে লাউডস্পিকারে ভেসে এল উত্তালের কণ্ঠস্বর, ‘শয়তান কুয়াশা! ভেবেছ প্রহরীদেরকে হত্যা করে কয়েকটা রাইফেল যোগাড় করতে পারলেই মুক্তি পাবে। বোকা তুমি একটা অস্তি বোকা! আমাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া তোমাদের কারও পক্ষে কোন কানো সম্ভব নয়। এখনও সময় আছে–শেষবারের মত সুযোগ দিয়ে বলছি তোমাকে-আত্মসমর্পণ করো! তা না হলে আমরা আমাদের চরম অস্ত্র
ব্যবহার করব।’
উত্তালের কথা শেষ হতেই গর্জে উঠল কুয়াশার রাইফেল। সেই সঙ্গে শুনি ছুড়লো শহীদ, কামাল, রাজকুমারী, ডি, কস্টা, রাসেল–ওরা সবাই।
কুয়াশা,বলছে, জলদি! জলদি! কেউ পিছিয়ে পোড়ো না! পিছিয়ে পড়া মানে মৃত্যু। বুবার্ডে গিয়ে উঠতেই হবে আমাদের। ওখানে একবার পৌঁছুতে পারলেই হলো-বেঁচে যাব সবাই। জলদি! এগোও সবাই!
গোটা দলটা হঠাৎ যেন গতি লাভ করল নতুন করে। সবাই ছুটছে দল বেঁধে, দ্রুত বেগে। | শত্রুপক্ষ পিছিয়ে গেল টিকতে না পেরে। সামনের পথ কঁকা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ব্লু-বার্ডের সামনে পৌঁছে গেল গোটা দলটা।
| শহীদ থমকে দাঁড়িয়েছে। লু-হাওয়ার মত ছুটে এসে থামল ওর সামনে কুয়াশা।
| শহীদের কণ্ঠস্বর কাঁপছে, ব্যাপার কি! শত্রুরা গেল কোথায়? হঠাৎ চুপ মেরে গেছে ওরা-কেন?
কুয়াশা কপালের ঘাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে দ্রুত বলল, চরম অস্ত্র ব্যবহার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা! শহীদ, সবাইকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব : বার্ডের ভিতরে ওঠাতে হবে।’
সবাই কঙ্কালসার মানুষগুলোকে সুশৃংখল ভাবে ব্লু-বার্ডে ওঠাবার কাজে লেগে গেল।
এমন সময় শোনা গেল ঘণ্টাধ্বনির শব্দ। চারদিক থেকে ভেসে আসছে সেই শব্দ!
ভ্যাম্পায়ারদের খাঁচা থেকে ছাড়বে এবার ওরা! কুয়াশা বলল, নিজেদের লোককে খাঁচার ভিতর আশ্রয় নিতে বলছে হৃদি হুসেন এবং উত্তাল ঘণ্টা বাজিয়ে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠছে কঙ্কালসার মানুষগুলো।
৮২
ভলিউম ১৯
কুয়াশা নিজের কাজে ব্যস্ত। রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করছে সে এদিক-সেদিক। একটার পর একটা বালব চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে গোটা জায়গাটা।
ঘণ্টাধ্বনি থাম খানিক পরই। কুয়াশা ঘাড় ফিরিয়ে দেখল রু-বার্ডের সিঁড়ি বেয়ে প্রায় সব লোকই উঠে গেছে।
চিন্তা করতে দেখা গেল কুয়াশাকে। বাদুড়গুলোর নিকি ফিরে এসেছে ইতিমধ্যে? শহীদ সিঁড়ির মাথা থেকে ডাকল, চলে এসো, কুয়াশা
লিড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল কুয়াশী। সিঁড়ির মাথায় গিয়ে দাঁড়াল। বলল, সবাইকে বলে দাও কোন জানালা, পোর্ট, গর্ত, ভেন্টিলেটর যেন খোলা না থাকে। প্রতিটি জানালা পরীক্ষা করতে হবে।’
ভিতরে ঢুকল ওরা দরজা পেরিয়ে। বন্ধ করে দিল দরজা। শহীদ, কামাল, রাসেল, ওমেনা এবং ডি কস্টাকে পাঠিয়ে দিল দরজা জানালা ইত্যাদি পরীক্ষা করার জন্য।
নিস্তব্ধতা অটুট হয়ে রয়েছে।
কোথাও কোন শব্দ নেই।
ভয়ে এখনও জড়সড় হয়ে রয়েছে কঙ্কালসার মানুষগুলো। এখনও তারা বিশ্বাস করতে পারছে না যে শেষ পর্যন্ত তারা মুক্ত হতে পারবে। রক্তচোষা বাদুড়–এদের হাত থেকে মুক্তি নেই, তাদের বদ্ধমূল ধারণা।
জানালা, দরজা, গর্ত, ভেন্টিলেটর সব বন্ধ করে দেয়া হলো। কঙ্কালসার মানুষগুলোকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে এক একটা কেবিনে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সবাই ফিরে এসেছে কুয়াশা এবং শহীদের কাছে। কোথাও কোন শব্দ নেই।
শায়লা পারভিন জানতে চাইল, কি ঘটছে বাইরে? কোন শব্দ নেই-শত্রুরা করছে কি?
কুয়াশাকে কেমন যেন ম্লান দেখাচ্ছে। যেন কোন ব্যাপারে দুঃখ বোধ করছে সে।
শায়লা পারভিন আবার বলল, আপনার হয়েছে কি? কথা বলছেন না কেন। মন খারাপ করে চুপচাপ।
কামাল বলল, ব্যাপার কি, কুয়াশা? মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটার জন্য অপেক্ষা করছ যেন তুমি?
কুয়াশা ভারি কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ। অপেক্ষা করছি। নাটকের শেষদৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করছি। দৃশ্যটা খুবই মর্মান্তিক তাই খারাপ লাগছে। তবে, এছাড়া করার কিছু ছিলও না আর।
তারমানে!’ কামাল জানতে চাইল। এমন সময় আর্তনাদ ভেসে এল বাইরে থেকে। প্রথমে একজন লোক চিৎকার
কুয়াশা ৫৬
করে উঠল। তারপর একযোগে বহু লোক।
কি হলো?’ ওমেনা উত্তেজিতভাবে জানতে চাইল! শহীদ বলল, জানালাটা একটু ফাঁক করে দেখলে হয়.••।’ দেখতে চাও? কিন্তু না দেখাই ভাল। জানালাটা খুলল শহীদ। কুয়াশা হাত উঁচু করে সুইচবোর্ডের একটা সুইচ চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল বাইরেটা। জানালার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। সত্যিই দৃশ্যটা মর্মান্তিক।
সকলে দেখল তলহীন যে সব খাঁচার ভিতরে শত্রুপক্ষের লোকেরা আশ্রয় নিয়েছিল সেগুলো ভেঙে পড়েছে অজ্ঞাত কোন কারণে।
রক্তচোষা বাদুড়ের দল গোটা এলাকার উপর ঘুরছে। দল-বেধে নেমে আসছে তারা লোকগুলোর উপর।
মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে শত্রুপক্ষের লোকেরা। মৃত্যুভয়ে ছুটোছুটি করছে তারা অন্ধের মত।
কিন্তু রেহাই নেই কারও। রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের দল কাউকে নিষ্কৃতি দিচ্ছে ।
কী সাংঘাতিক! শহীদ নিস্তব্ধতা ভাঙল। কামাল জানতে চাইল, কিন্তু খাঁচাগুলো ভেঙে পড়ল কিভাবে?
কুয়াশা বলল, ‘প্রতিটি খাঁচার জয়েন্টে অ্যাসিড ছিটিয়ে দিয়ে এসেছিলাম, নাড়াচাড়া করতে ভেঙে গেছে সব।
লোমহর্ষক কাণ্ডটা দেখতে দেখতে থামল। শত্রুপক্ষের একজনকেও রেহাই দেয়নি বাদুড়ের দল।
হাদি হুসেন আর উত্তালওরা পালিয়েছে। নিস্তব্ধতা ভাঙল রাসেল। কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। পালিয়েছে। পৃথিবী থেকে পালিয়েছে শয়তান দুটো। ওই যে, ডান দিকের লাইট পোস্টটার দিকে তাকাও, ওদের লাশ দুটো পড়ে রয়েছে।
সবাই তাকাল সেদিকে।
Leave a Reply