৫৫. মরণ ছোবল ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৫৫
প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৭৬
কোথায়?
সকাল হতেই চমকপ্রদ সেই খবর বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। ঘর-বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল মানুষ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, হোটেলের সামনে, হাটে-মাঠে ঘাটে-বন্দরে মানুষের ভিড় জমে উঠল। সকলের মুখেই এক প্রশ্ন–কোথায় কুয়াশা?
ঘর্মাক্ত কলেবরে সাংবাদিকরা চরকির মত ঘুরছে। চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র, বেকার যুবক–গোটা শহরের প্রায় সব মানুষ মরিয়া হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দিল কুয়াশার সন্ধান পাবার জন্য।
কিন্তু কোথায় কুয়াশা?
বেলা ক্রমশ বাড়তে লাগল। উত্তেজনা চরমে উঠল। ছটফট করছে মানুষ। সবাই চাইছে সবার আগে কুয়াশার দেখা পেতে। কিন্তু চাওয়াটাই সার, কুয়াশার ছায়াও কেউ আবিষ্কার করতে পারছে না।
পুলিস বিভাগও বসে নেই। বড় কর্তারা হুকুম জারি করছেন-কুয়াশাকে দেখামাত্র রিপোর্ট করো। পুলিস বিভাগের ঊর্ধ্বতন অধঃস্তন কর্মচারীরা ব্যক্তিগত স্বার্থেই শহরময় ছড়িয়ে পড়েছে। দশ লক্ষ টাকার ব্যাপার-ছেলে খেলা কথা নয়। যে কুয়াশার সন্ধান দিতে পারবে সে-ই পাবে দশ লক্ষ টাকা। প্রতিটি মানুষ চেষ্টা করছে সুযোগটা গ্রহণ করার। কার ভাগ্যে কি আছে, কেউ তা বলতে পারে না। একজন ভিখারী হয়তো দেখা পেয়ে যাবে কুয়াশার। একবার দেখা পেলেই হলো, দশ লক্ষ টাকার মালিক বনে যাবে সে এক মুহূর্তে!
কেউ জানে না কার ভাগ্যে আছে পুরস্কারের এই দশ লক্ষ টাকা।
চেষ্টা করছে সবাই। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। হাজার হাজার টেলিফোন কল বুক করা হচ্ছে। খবর আসছে ঢাকা থেকে, খুলনা থেকে, দিনাজপুর থেকে, রাজশাহী থেকে। সব খবরই নেতিবাচক। কোথাও নেই কুয়াশা। কেউ তার সন্ধান পাচ্ছে না। এমন বিশাল চেহারার মানুষটা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
দুপুর নাগাদ জেগে উঠল গোটা দেশ। রেডিও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে প্রচার করা হলো পুরস্কারের ঘোষণাটা।
ঘোষণায় বলা হলো:
চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে অগ্রসরমান সমুদ্রগামী জাহাজ বিউটি কুইনের ওয়্যারলেস থেকে একটি মেসেজ পাঠানো হয়েছে দেশের সংবাদপত্রে ছাপার জন্য এবং রেডিও স্টেশন থেকে প্রচার করার জন্য।
কুয়াশা ৫৫
মেসেজে মি. কুয়াশার সন্ধান চাওয়া হয়েছে। মি. কুয়াশার সন্ধান পাওয়ামাত্র তাকে জানাতে হবে তিনি যেন অনতিবিলম্বে বিউটি কুইনের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। তাঁকে জানাতে হবে, এই ব্যাপারের সঙ্গে শতাধিক লোকের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। যে ব্যক্তি। সর্ব প্রথম মি, কুয়াশার সন্ধান পাবেন এবং তাঁকে এই মেসেজের বক্তব্য জানাতে পারবেন তিনি পুরস্কার স্বরূপ দশ লক্ষ টাকা পাবেন। ঘোষণা
প্রচারকারীর নামের জায়গায় লেখা আছে–বিপদ গ্রস্ত। বিকেল বেলা দেশের বড় বড় শহর থেকে দৈনিক সংবাদপত্রগুলো টেলিগ্রাম বের করল। বড় বড় হেডিং দিয়ে ছাপা হলো:
কুয়াশার সন্ধান পাওয়া যায় নাই। দ্রুত বয়ে যাচ্ছে সময়। বুকে আশা নিয়ে মানুষ অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু চেষ্টা করাই বুঝি সার। কেউ জানে না, কেউ বলতে পারছে না কোথায় আছে। কুয়াশা।
| সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণে ভিড় জমে উঠলু চট্টগ্রাম পোর্টে। দলে দলে মানুষ ছুটে চলেছে বন্দরের দিকে। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরীরা মানুষের মোতকে বাধা দিয়ে আটকাতে পারল না। সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার না থাকলেও সেদিন সন্ধ্যায় কেউ মানল না বন্দরের আইন কানুন, সবাই সাগরের তীরের দিকে ছুটল।
কয়েক শত ট্রাফিক পুলিশ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে যানবাহনের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে, অফিসাররা গলদঘর্ম হয়ে পড়ছেন নির্দেশ দিতে দিতে।
সাগরের তীরে জেটির উপর হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, সবাই অপেক্ষা করছে বিউটি কুইনের জন্য ।
. বিউটি কুইন জাহাজ থেকেই পুরস্কারের ঘোষণা প্রচার করা হয়েছে। কৌতূহলী মানুষ জানতে চায় কে সেই মানুষ যে কুয়াশার সন্ধান পাবার জন্য দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করেছে। দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে কেন সে কুয়াশার দেখা পেতে চায়? কি এমন বিপদে পড়েছে সে?
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। পার্কিং এলাকা থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে একটা উজ্জ্বল নীল রঙের ঝকঝকে মার্সিডিজ গাড়ি মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে থামল। হাতের স্টিক উঁচিয়ে তেড়ে এল একুজন সেপাই। | কী আশ্চর্য! আপনারা পেয়েছেন কি! গাড়ি পার্ক করার জায়গা পেলেন না আর ।
সেপাই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। মুখের ভাব বদলে গেল তার। নিখুঁত ভঙ্গিতে স্যালুট করে অপ্রতিত হাসল সে। ড্রাইভারের সীটে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে সবিনয়ে উচ্চারণ করল, দুঃখিত, স্যার। আপনাকে আমি চিনতে পারিনি।
| মার্সিডিজের ড্রাইভার প্রখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান। শহীদের পিছনে আর একজন আরোহী রয়েছে। দীর্ঘদেহী, সুদর্শন লোকটা তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। একটু যেন অন্যমনস্ক বা চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।
একটু ঝুঁকে পড়ে গাড়ির দ্বিতীয় আরোহীর দিকে তাকাল সেপাই। ভদ্রলোক
ভলিউম ১৯
সম্ভবত ইউরোপিয়ান, অনুমান করল। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে চশমা, ধূসর রঙের একটা ট্রপিক্যাল স্যুট পরনে।
শহীদের দিকে চোখ ফেরাল সেপাই। বলল, মি. কুয়াশার সন্ধান পেয়েছেন নাকি, স্যার? দশ লক্ষ টাকার ব্যাপার।’
মুচকি হাসল শহীদ। বলল, ‘পুরস্কারের ঘোষণাটা ঢাকায় পৌঁছয় সকাল দশটায়। সভাব্য সব জায়গায় সন্ধান চালিয়েও ব্যর্থ হই। ঘণ্টা দুয়েক পর বাড়ি ফিরে দেখি সে আমার বাড়িতে বসে আছে। বুঝতেই পারছেন কুয়াশাকে আবিষ্কার করার কৃতিত্ব আমার নয়–সে স্বইচ্ছায় আত্মপ্রকাশ করেছে। তারমানে, দশ লক্ষ টাকা দাবি করতে পারছি না আমি। তা যাই হোক, এদিকের খবর কতটুকু কি জানেন আপনি? রেডিওর ঘোষণা শুনেছি আমি, তার বেশি কিছু জানি না এখনও।’
সেপাই বলল, সবাই এইটুকুই জানে এখন পর্যন্ত, স্যার! দুঃখিত, আপনাকে নতুন কোন তথ্য জানাতে পারলাম না। তা মি. কুয়াশা কি আপনার সঙ্গেই চট্টগ্রামে এসেছেন, স্যার?’
সেপাই আবার তাকাল শহীদের পাশে বসা সুদর্শন, দীর্ঘদেহী আরোহীর দিকে।
শহীদ বলল, না! ঢাকাতেই রয়ে গেছে সে।’ স্যালুট করে ফিরে গেল সেপাই নিজ কর্তব্যে।
মার্সিডিজের ভিতর থেকে ভেসে এল ভরাট গলার মৃদু হাসি। দ্বিতীয় আরোহী গাড়ি থেকে নামল। তার হাতে একটা ব্রীফকেল দেখা যাচ্ছে। বলল, ‘শহীদ, এখানেই অপেক্ষা করো তুমি।
| শহীদ বলল, “ঠিক আছে। _ বলাই বাহুল্য, ইউরোপিয়ান চেহারার গাড়ির দ্বিতীয় আরোহী ছদ্মবেশধারী স্বয়ং কুয়াশা ছাড়া আর কেউ নয়।
যানবাহন এবং সহস্রাধিক লোকজনের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশা । হকাররা ছুটোছুটি করছে টেলিগ্রাম নিয়ে। তাদের চিৎকারে কানপাতা দায়। গাড়ির ভিতরে বসে একজন হকারকে হাতছানি দিয়ে ডাকল শহীদ | দশ পয়সা দিয়ে একটা
টেলিগ্রাম কিনল।
কুয়াশার সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি এই খবরটা বড় বড় হেডিংয়ে ছাপা হয়েছে। তার পাশে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কারের ঘোষণাটা ছাপা হয়েছে। কিন্তু শহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল অন্য একটি খবর।
খবরটা বেশ বড় বড় অক্ষরেই ছাপা হয়েছে।
| খুলনার আকাশে ভৌতিক আকাশযান! হেডিংয়ের নিচে খবরটা এই রকম:
নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত । গত কয়েক দিন যাবৎ খুলনার আকাশে অদ্ভুত আকৃতির একটি আকাশযান দেখা যাইতেছে। গত পরশু বেলা দুইটার সময় কয়েক মিনিটের জন্য ইহাকে দেখা যায়। গতকালও কেউ কেউ নাকি ইহাকে দেখিতে পাইয়াছেন। আকাশের অনেক উপর দিয়া উড়িয়া যায় বলিয়া
কুয়াশা ৫৫
ইহাকে খালি চোখে পরিষ্কার দেখা যায় না। আকাশযানটি দেখিতে লম্বা আকৃতির, অনেকটা চুরুটের মত। খুলনা শহরে এই রহস্যজনক আকাশযানটিকে কেন্দ্র করিয়া মানারকম অলৌকিক গুজব ছড়াইয়া
পড়িয়াছে। খবরটা পড়ে চিন্তিত হলো শহীদ। চুরুটের মত দেখতে জিনিসটা। মনে পড়ে গেল কাউন্ট জেপলিনের কথা। ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে কাউন্ট জেপলিন আশ্চর্য ধরনের একটা আকাশযান আবিষ্কার করেন। সেটা দেখতে ছিল প্রকাণ্ড আকারের একটা চুরুটের মত । তাঁর সেই আকাশযানের নাম রাখা হয়েছিল জেপলিন।
| কিন্তু সেই যুগ গত হয়েছে। এই রকেটের যুগে জেপলিন আসবে কোত্থেকে? হঠাৎ শহীদের মনে একটা প্রশ্ন জাগল। দশ লক্ষ টাকা পুরস্কারের সঙ্গে কি এই ভৌতিক আকাশযানের কোন সম্পর্ক আছে?
সন্দেহটা শুধু শহীদের মনে নয়, আরও বহু লোকের মনেই উদয় হলো।
সাংবাদিকরাও তুমুল তর্কে মেতে উঠেছে জেটির ওপর দাঁড়িয়ে। দৈনিক প্রভাতের বয়স্ক সাংবাদিক তার সহকারীর উদ্দেশ্যে বলছিলেন, ‘ভৌতিক আকাশযানের সঙ্গে এই দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণার কোন যোগাযোগ থাকা বিচিত্র কিছু নয়, যাই বলো।’
তরুণ সাংবাদিক আনিস বলল, দূর! দশ লক্ষ টাকা পুরস্কারের ব্যাপারটা স্রেফ পাবলিসিটি স্টান্ট! আমার বিশ্বাস, কুয়াশা তার নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াবার জন্যে চালাকি করে নিজেই ঘোষণা করেছে।’
| কি! তুমি দেখছি এক নম্বরের একটা গাধা! যা জানো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না।
| আনিস দমল না । বলল, আপনি যাই বলুন, আমার ধারণা, এমন কোন পাগল পৃথিবীতে থাকতে পারে না যে শুধু কুয়াশার সন্ধান পাবার জন্য দশ লক্ষ টাকা দিতে পারে।’, প্রবীণ সাংবাদিক এনায়েত খেপে গিয়ে বললেন, ছেলে মানুষ আর বলে কাকে। কখনও সামনাসামনি দেখেছ কুয়াশাকে? তার সাক্ষাৎকার নেবার ভাগ্য হয়েছে’কখনও তোমার? তাকে নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা কুয়াশা সিরিজের বইগুলো পড়েছ?
না•••।’
তাহলে কথা না বলে চুপ করে থাকে। তার সম্পর্কে আমি বলছি, মন দিয়ে শুনে যাও শুধু। কুয়াশা একজন বিজ্ঞানী। পৃথিবীতে জীবিত যত বিজ্ঞানী আছেন তাদের মধ্যে তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করা হয়। বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাতে সে আর সবার চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে। শুধু তাই নয়, তার শরীর সম্পর্কে আরও বিস্ময়কর তথ্য তোমাকে শোনাতে পারি। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে লাফ দিয়ে কতটুকু উপরে উঠতে পারে সে তা জানো? এগারো ফুট! বিশ্বাস হয়? যে কোন মোটর গাড়িকে সে দুই হাত দিয়ে শূন্যে তুলে ফেলতে পারে। ছুটন্ত সাত টন ওজনের ট্রাককে সে পিছন থেকে ধরে থামিয়ে দিতে পারে। তার একটা ঘুসির ওজন সাড়ে পাঁচ মণ। বিরতি না নিয়ে ৪৮ ঘণ্টা দৌড়ুতে পারে সে। আরও শুনবে?
ভলিউম ১৯
পৃথিবীর সব প্রচলিত ভাষা জানা আছে তার। পৃথিবীর একমাত্র লোক সে-যে এই পৃথিবী ত্যাগ করে অন্য এক গ্রহে গিয়েছিল। জানো তুমি, কুয়াশা সূর্যের ভিতর দিয়ে টইন আর্থে গিয়েছিল। যে কোন লোককে সে হিপনোটাইজ করতে পারে। লিপ রিডিং জানে সে। থট রিডিংয়ে তাকে জিনিয়াস বলা হয়। আরও শোনো। পৃথিবীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যাডভেঞ্চারার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সে। ভয় ডর বলে কিছু জানা নেই কুয়াশার। ন্যায়ের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়া তার ধর্ম। সে মানবতাবাদী। আরও শুনবে? কত বলব। তার সম্পর্কে সব বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে।’
| তরুণ সাংবাদিক আনিস গম্ভীর হয়ে উঠল। প্রবীণ সাংবাদিকের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি সে। শেষ পর্যন্ত সে বলল, জানি না। একজন মানুষ
একাধারে এতগুলো গুণের অধিকারী হতে পারে না। অসম্ভব।
কে বলল পারে না? চেষ্টা করলে সবাই পারে। এই সব গুণ অর্জন করার জন্য কুয়াশা সাধনা করেছে, চর্চা করেছে, অনেক কিছু ত্যাগ করেছে। তুমিও সাধনা করো, তুমিও পারবে।’
আনিস অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
এমন সময় সাগরের দিকে আলো ফেলল একটা সার্চ লাইট। তীর থেকে বেশ কিছুটা দূরে দেখা গেল একটি মাঝারি আকারের জাহাজকে। উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক শোরগোল করে উঠল।
জাহাজটার গায়ে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজীতে লেখা রয়েছে, বিউটি কুইন। আনিস প্রশ্ন করল, জেটিতে ভিড়ছে না কেন জাহাজটা?’।
প্রবীণ সাংবাদিক বললেন, কারণটা অজ্ঞাত। জাহাজের ক্যাপ্টেন চায় না কেউ জাহাজে উঠুক। এ ব্যাপারে ওয়্যারলেসে আগেই সাবধান করে দেয়া হয়েছে। কোন লোককে বিউটি কুইনে ওঠার অনুমতি দেয়া হবে না।’
তাহলে।
সব–চুপ! আমি একটা বুদ্ধি করে রেখেছি। খবর যেভাবে যোক সংগ্রহ করতেই হবে। একটা মটরবোট ভাড়া নিয়ে রেখেছি । জাহাজের পেছন দিকে চলে যাব, চেষ্টা করব উপরে উঠতে•• |’
চমৎকার। তবে আর দেরি কেন? দুই সাংবাদিক দ্রুত পা বাড়াল।
দুই জেটিগুলোর কাছ থেকে অনেক দূরে অন্ধকার একটা খাদের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুয়াশা। তার পরনে সুইমিং কস্টিউম। ব্রিফকেস থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে তার ভিতর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে নিল সে। ব্রীফকেসটা একটা পাথরের আড়ালে রেখে প্লাস্টিকের ব্যাগটা জিপ এঁটে হক দিয়ে আটকে নিল কোমরের সঙ্গে, তারপর পানিতে নামল ।
কুয়াশা ৫৫
দ্রুত সাঁতার কেটে এগুচ্ছে কুয়াশা। এদিকটা ঘন অন্ধকারে ঢাকা। দূর থেকে ভেসে আসছে মানুষজনের শোরগোলের শব্দ। বহুদূরে সাগরের উপর ভাসছে বিউটি কুইন! কুয়াশা সেদিকেই সাঁতার কেটে এগুচ্ছে।
“ বিউটি কুইনকে বহুদূর থেকে পাশ কাটিয়ে আরও সামনে এগিয়ে গেল কুয়াশা। প্রায় পঞ্চাশ গজ এগিয়ে থামল সে। পিছন ফিরে তাকাল। তারপর বাঁক নিয়ে আবার সাঁতার কাটতে লাগল।
| দ্রুত বিউটি কুইনের পিছন দিকে পৌঁছুল কুয়াশা। মাইল দেড়েক সাঁতার কেটেও এতটুকু ক্লান্ত হয়নি সে। নিঃশ্বাস পড়ছে, কিন্তু কোন শব্দ হচ্ছে না।
| উপর দিকে তাকিয়ে জাহাজের রেলিং দেখতে পেল কুয়াশা। পানির উপর প্লাস্টিকের ব্যাগটা তুলে খুলল সেটা। বের করে আনল এক প্রস্থ নাইলনের কর্ড। কর্ডের এক প্রান্তে একটা হুক দেখা গেল। হুক সহ কর্ডটা সে ছুঁড়ে দিল উপর দিকে। এদিকে কোন মই বা সিঁড়ি নেই, কর্ড ধরে ঝুলতে ঝুলতেই উঠতে হবে।
| রেলিংয়ের সঙ্গে আটকে গেল হুকটা। কর্ড ধরে উপরে উঠতে শুরু করল সে।
কয়েক মুহূর্ত পর দেখা গেল কুয়াশা রেলিং টপকে অন্ধকার ডেকের উপর নামছে। ডেকে নেমে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে একটা ড্রামের পিছনে আত্মগোপন করল সে।
আবার প্লাস্টিকের ব্যাগ খুলল কুয়াশা। তোয়ালে বের করে গা মুছল। ভিজে পায়ে ডেকে হাঁটাহাঁটি করলে তার উপস্থিতি প্রকাশ হয়ে পড়বে–তা সে চায় না।
চাঁদহীন, তারাহীন আকাশ। ডেকেও কোন আলো নেই। অন্ধকারে পা ফেলে ড্রমের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কুয়াশা। দীর্ঘদেহী একটা ছায়ামূর্তি, দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
ডেক থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশা।
পরমুহূর্তে ডেকের বিপরীত প্রান্ত থেকে অপর একটি ছায়ামূর্তিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ছায়ামূর্তিটি বেশ লম্বা কিন্তু তার শরীরে মাংস বলতে কিছু নেই যেন! প্রায় কঙ্কালই বলা যায় লোকটাকে। লোকটার হাতে বড় আকারের একটা কালো রিভলভার। শক্ত হাতে ধরে আছে সেটাকে। অস্থির, ভীত বলে মনে হচ্ছে তাকে। প্রতি মুহূর্তে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাচ্ছে সে। হঠাৎ থমকে দাঁড়াচ্ছে, দম বন্ধ করে কিছু শোনার চেষ্টা করছে। অকারণেই চমকে উঠে এদিক
ওদিক তাকাচ্ছে ঘনঘন। | ডেক পেরিয়ে একটা প্যাসেজে ঢুকল সে। দাঁড়াল একটা দরজার সামনে। এদিক-ওদিক তাকাল দ্রুত। তারপর দূরজার গায়ে টোকা মারল–প্রথমে ঠক করে একবার, তারপর ঠক ঠক ঠক করে তিনবার, তারপর ঠক ঠক করে দুবার।
বোঝা যায়, এটা একটা সঙ্কেত।
বন্ধ দরজার ভিতর থেকে একটা ভাঙা গলা ভেসে এল। কণ্ঠস্বরটা চাপা এবং সন্দিগ্ধ।
কে দরজায়?’ রিভলভারধারী লোকটা প্যাসেজের এদিক-ওদিক দেখে নিতে নিতে দ্রুত কিন্তু
ভলিউম ১৯
ফিসফিসে গলায় বলল, আমি! আমি ইয়াকুব!
দরজা খুলে গেল। দেখা গেল দরজার ভিতর যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তার হাতেও একটা উদ্যত রিভলভার রয়েছে।
ইয়াকুব দ্রুত কামরার ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল সে। হাঁপাচ্ছে ঘনঘন। লোকটা যে শারীরিক ভাবে অস্বাভাবিক দুর্বল তা দেখেই বোঝা যায়।
দ্বিতীয় লোকটাও প্রথম লোকটার মত লম্বা, কিন্তু সে-ও অস্বাভাবিক রোগ। গাল ভেঙে গেছে দুজনেরই। চোখগুলো ঢুকে গেছে ভিতরে। ঝুলে পড়েছে বাহুর চামড়া। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকালে এখনও বোঝা যায় যে এরা এককালে স্বাস্থ্যবান। এবং সুদর্শন ছিল। কিন্তু দুজনেরই চেহারা হয়েছে কবর থেকে উঠে আশা কঙ্কালের মত। ত্রিশের কাছাকাছি বয়স ওদের, কিন্তু দেখে মনে হয় পঞ্চাশ
পেরিয়ে গেছে কবে। মালেক, খারাপ খবর আছে!
চাপা স্বরে বলল ইয়াকুব, দরজার ফাঁক দিয়ে এই একটু আগে দেখলাম একজন লোক ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল। লোকটাকে দেখে…।”
কেঁপে উঠল ইয়াকুবের সর্বশরীর থরথর করে।
বড় বড় আতঙ্ক ভরা চোখে মালেক চেয়ে আছে ইয়াকুবের দিকে। প্রায় শোনা যায় না, এমনি নিচু গলায় সে জানতে চাইল, কে? হাদি হুসেন, না উত্তাল?”।
চিনতে পারিনি। ওদের কেউই হবে মনে হয়•• | মালেক, আমার ভয় করছে বজ্ঞ। এভাবে একা একা থাকতে পারব না আমি। তিনজন একসঙ্গে থাকলে তবু
বুকে সাহস পাব।’
মালেক ঢোক গিলল। বন্ধ জানালা দরজাগুলোর দিকে তাকাল সে। বলল, শায়লার কাছে যাব বলছ? কিন্তু এখান থেকে বেরুনো কি উচিত হবে?’
ইয়াকুব নিরাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মালেকের দিকে। খানিক পর ইয়াকুব বলল, দুজনে একসঙ্গে যাই, চলো। শায়লাকে খবটা জানানো দরকার।’
সাবধানে দরজা খুলল ওরা। উঁকি মেরে দেখে নিল প্যাসেজটা। কেউ নেই। কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল দুজনেই অনেকক্ষণ ধরে।
সেই শব্দটা–পাচ্ছ?’ ইয়াকুব বলল, না।’
তবে চলো।’
প্যাসেজে বেরিয়ে এল দুজন। দরজার তালা লাগিয়ে এলোমেলো পা ফেলে। প্রায় ছুটতে শুরু করল ওরা। প্যাসেজের শেষ মাথায় গিয়ে থামল ওরা। এইটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতেই হাঁপিয়ে গেছে। সামনের দরজায় টোকা মারল ইয়াকুব। প্রথমে একবার তারপর ঘনঘন তিনবার তারপর বিরতি নিয়ে আবার দুবার।
দরুজার কবাট দুটো সামান্য একটু ফাঁক হলো। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা রিভলভারের নল।.
মিষ্টি একটা নারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে••ওহ, তোমরা!’
দরজাটা খুলে গেল। ইয়াকুব এবং মালেক প্রায় ধাক্কাধাক্কি করে ঢুকল কামরার ভিতর। শায়লা পারভিন বন্ধ করে দিল দরজা।
কুয়াশা ৫৫
শায়লা পারভিন দেখতে অসাধারণ সুন্দরী। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স হবে তার। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, সুগঠিত শরীর। রীতিমত ব্যায়াম করে নিজের স্বাস্থ্যটাকে এমন সুগঠিত করেছে তা দেখলেই বোঝা যায়।
ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে?’ দুজনকে ভাল করে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল শায়লা পারভিন।
মিস শায়লা! হাদি হুসেন অথবা উত্তাল ডেকের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে খানিক আগে•••নিশ্চয়ই ওদের কেউ একজন হবে।’
| দ্রুত বদলে গেল শায়লা পারভিনের মুখের চেহারা। কি যেন ভেবে শিউরে উঠল সে। ভয়ে ভয়ে তাকাল বন্ধ-জানালা দরজাগুলোর দিকে।
বলো কি? স্পষ্ট দেখেছ তুমি?’
না। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখব কিভাবে! তবে মনে হলো লোকটা লুকিয়ে উঠেছে জাহাজে
| ‘লুকিয়ে উঠেছে? তাহলে ওদের মধ্যে কেউ একজন, সন্দেহ নেই।’
মালেক ফিসফিস করে জানতে চাইল, কিন্তু ওরা জানবে কিভাবে আমরা বিউটি কুইনে আছি?
শায়লা পারভিন বলল, ‘খুব সহজেই জানতে পেরেছে। আমরা যে সময় ওদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে পালিয়ে আসি সেই সময় আফ্রিকা থেকে একটিমাত্র জাহাজ বন্দর ত্যাগ করেছে-সুতরাং আমরা যে এই জাহাজে আছি তা অনুমান করে নিতে অসুবিধে হয়নি ওদের। আসার পথে মাঝে মাঝে আকাশ থেকে প্রপেলারের যে মৃদু গুঞ্জনধ্বনি ভেসে আসতে শুনেছিলাম, তখনই সন্দেহ হয়েছিল আমার। ওরা আমাদের জাহাজটাকে খুঁজছিল। ভাগ্য ভাল যে সর্বক্ষণ আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, আবহাওয়া ছিল খারাপ। তা না হলে ওরা জাহাজটাকে ঠিকই দেখতে পেত। আর দেখতে পেলে-বোমা ফেলে চুরমার করে দিত নির্ঘাৎ।’
মালেক বুলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার ধারণা ওরা জেপলিন নিয়ে এসেছে। জেপলিন নিয়ে এসেছে বলেই আমাদের আগে পৌঁছে গেছে ওরা।
কি হবে এখন তাহলে। নরক থেকে ফিরে এসেও কি বাঁচার আশা নেই?’
শায়লা পারভিন বলল, ‘ওরা চেষ্টা করবে আমাদেরকে যেমন করে পারে খুন করতে। সুতরাং, খুব সাবধানে থাকতে হবে আমাদের। আমরা বেঁচে থাকলে ওদের অপরাধের কাহিনী প্রকাশ হয়ে পড়বে–এই ভয়ে ওরা মরিয়া হয়ে ছুটে এসেছে আফ্রিকার সেই দুর্গম নরক থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে••
ইয়াকুব হঠাৎ উন্মাদের মত আচরণ শুরু করল। নিজের মাথার চুল মুঠো করে ধরে সজোরে টানতে শুরু করল সে, আর সহ্য হয় না। ভয়ে ভয়ে এভাবে মানুষ বাঁচতে পারে না? মিস শায়লা, বিদায় দিন আমাকে। আমি আত্মহত্যা করব।’
কথাটা বলে পকেট থেকে দ্রুত রিভলভারটা বের করে ফেলল ইয়াকুব। নিজের কপালের পাশে ঠেকাল সে রিভলভারের নল। কেঁদে ফেলল হাউ হাউ করে।
ছোঁ মেরে ইয়াকুবের হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নিল শায়লা পারভিন। চোখ দুটো জ্বলে উঠল যেন তার। ঠিকরে বেরিয়ে আসছে যেন আগুন।
১২
ভলিউম ১৯
ইয়াকুব! তুমি এত বড় স্বার্থপর তা আমার জানা ছিল না। আত্মহত্যা করবে? বুঝেছি, আত্মহত্যা করে নিজেকে বাঁচাতে চাও তুমি। ইয়াকুব, তুমি একটা কাপুরুষ। আশ্চর্য! নিজের কথাটাই ভাবছ শুধুভুলে গেছ ইতিমধ্যে দুর্ভাগা সেই দেড়শো লোকের কথা? দেড়শো মানুষ ক্রীতদাস বানিয়ে রাখা হয়েছে যাদেরকে। ভুলে গেছ প্রতিজ্ঞার কথা? তুমিই না বলেছিলে যে ওদেরকে যতদিন না মুক্ত করতে পারবে ততদিন পেট ভরে খাবে না, মন খুলে হাসবে না?’
নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল ইয়াকুব।
শায়লা পারভিন তার একটা হাত ধরল। নরম, শান্ত হয়ে উঠল এবার তার কণ্ঠস্বর, নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করো, ইয়াকুব। সংগ্রাম করে এতদূর পালিয়ে এসেছি আমরা। পিছু পিছু ওরা এসেছে ঠিক, কিন্তু এখানে ওদের শক্তি খুব বেশি নয়। জানি, ওরা আমাদেরকে হত্যা করার জন্যে সবরকম চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে ভয় পেলে চলবে কেন। বেঁচে থাকতে হবে আমাদেরকে, ইয়াকুব। নিজেদের জন্যে নয়, বেঁচে থাকতে হবে অভাগা সেই দেড়শো ক্রীতদাসের জন্য।
ওদেরকে মুক্ত করার জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করতে হবে।’
ভিজে চোখ তুলে ইয়াকুব তাকাল শায়লা পারভিনের দিকে। বল, মাফ করুন, মিস শায়লা। আমি ওদের কথা ভুলে গিয়েছিলাম।’
মালেক বলল, আচ্ছা, দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলো অথচ এখনও কুয়াশার তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। ব্যাপারটা কি হতে পারে? এমনও হতে পারে, কুয়াশা হয়তো আমাদেরকে সাহায্য করতে উৎসাহী নন।’
‘অসম্ভব! কুয়াশা তেমন মানুষই নন। আমি অবশ্য তাকে কখনও দেখিনি। তবে তার সম্পর্কে যা যা শুনেছি তা থেকে বলতে পারি যে অসহায়, বিপদগ্রস্ত লোককে সাহায্য করাই তাঁর আদর্শ। তাঁর কানে আমাদের আবেদন পৌঁছুলে তিনি নিশ্চয়ই সাড়া দেবেন।
‘ ইয়াকুব রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি বরং কন্ট্রোল-রূমে যাই একবার, দেখি কোন মেসেজ এসেছে কিনা।
শায়লা পারভিন রিভলভারটা ফিরিয়ে দিল ইয়াকুবকে। বলল, সাবধানে যেয়ো, ইয়াকুব।
মালেক বলল, আমি মিস শায়লাকে পাহারা দিই।’
দরজা খুলে প্যাসেজে বেরোল ইয়াকুব। দরজা বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে মালেক। তালা লাগাবার শব্দ হলো–ক্লিক!
এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে দ্রুত এগিয়ে চলল ইয়াকুব।
রেডিও কেবিনটা ডেক হাউসের উপর অবস্থিত। উপরে উঠে প্যাসেজ ধরে এগিয়ে চলল সে। যেতে যেতে তিন চার বার থমকে দাঁড়াল সে, কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল। তারপর আবার পা বাড়াল।
রেডিও অপারেটর ইয়াকুবকে দেখে মৃদু হাসল। বলল, কোন খবর এখনও আসেনি, স্যার।
কুয়াশা ৫৫
নিরাশ হয়ে বেরিয়ে এল ইয়াকুব।
সান-ডেকে নামল সে। অন্ধকারে ঢাকা চারদিক। রেলিংয়ের পাশ ঘেঁষে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ফিরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সে।
মৃদু পদশব্দ ভেসে এল কোথাও থেকে। তারপরই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল খসখসে ধরনের অদ্ভুত একটা আওয়াজ। আওয়াজটা খুবই মৃদু। ঠিক পাখা ঝাঁপটাবার শব্দও নয়–সিল্কের কাপড়ের ভাজ খোলবার সময় নরম যে ধরনের শব্দ হয় অনেকটা সেই রকম। সেই সঙ্গে বাতাস ভারি হয়ে উঠল অসহ্য একটা কটু গন্ধে।
ইয়াকুব দাঁড়িয়ে পড়েছে। উন্মাদের মত আচরণ করছে সে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। হাত দুটো শূন্যে তুলে নিজেকে অদৃশ্য বিপদের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য সবেগে দোলাচ্ছে সে, ভয়ে সর্বশরীর ঠক ঠক করে কাঁপছে তার।
‘না! না! না! না…।’
বিড় বিড় করে না শব্দটা অবিরাম উচ্চারণ করছে সে, পিছিয়ে যাচ্ছে এলোমেলো পা ফেলে।
অদ্ভুত শব্দটা দ্রুত বাড়ছে। এগিয়ে আসছে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে। বিকট শব্দ হলো রিভলভারের।
ইয়াকুব গুলি করছে। এলোপাতাড়ি গুলি করে চলেছে সে। ছুটতে শুরু করেছে এতক্ষণে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের অন্ধকারে তাকাচ্ছে, আর গুলি করছে।
কিন্তু সেই অদ্ভুত শব্দ কাছাকাছি চলে এসেছে। ইয়াকুব উপর দিকে গুলি করল।
চিৎকার করছে সে, বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও…!’
সেই অদ্ভুত শব্দটা উপর থেকে নামছে। মনে হলো শব্দটা নেমে এল ইয়াকুবের উপর। ইয়াকুব মরিয়া হয়ে ছুটল, হোঁচট খেয়ে পড়ল, হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে লাগল উন্মাদের মত, স্পিঙয়ের মত লাফ দিয়ে দাঁড়াল আবার।
পরমুহূর্তে শব্দ হলো একটা-ধ।
আবার পড়ে গেছে ইয়াকুব ডেকের উপর। চিৎকার করছে সে। দুর্বোধ্য স্বর বেরিয়ে আসছে তার গলার ভিতর থেকে। হাত-পা খিচছে সে, দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছে শরীর।
| কয়েক মুহূর্ত পর গোঙাতে শুরু করল ইয়াকুব। গোঙাবার শব্দও একসময় স্তিমিত হয়ে এল।
তারপর নিস্তব্ধতা নামল।
আরও খানিক পর, জাহাজের দূর প্রান্ত থেকে মৃদু, অস্পষ্ট শিস দেয়ার শব্দ ভেসে এল।
| ইয়াকুবের নিঃসাড, প্রাণহীন দেহটার কাছ থেকে এরপর আবার সেই শব্দ উঠল–সিল্কের কাপড়ের ভাঁজ খুলছে যেন কেউ। শব্দটা ক্রমশ মিলিয়ে গেল দূরে। | দূর থেকে ভেসে আসছে লোকজনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। জাহাজের যাত্রী এবং
কর্মীরা ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না কোন দিক থেকে এসেছে গুলির শব্দ।
ভলিউম ১৯
তিন।
অন্ধকার ডেকে পড়ে আছে দুর্ভাগা ইয়াকুবের লাশ। এমন সময় উজ্জল টর্চের আলো এসে পড়ল লাশটার উপর। মৃতদেহটা উপুড় হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। চোখ দুটো এখনও আতঙ্কে বিস্ফারিত, হাতে এখনও ধরা রয়েছে রিভলভারটা ইয়াকুবের গলায় একটা ফুটো দেখা যাচ্ছে। গলার ফুটোটার দিকে চেয়ে রইল কুয়াশা কয়েক সেকেণ্ড । দেখে মনে হয় ওই ক্ষতস্থান থেকে রক্ত টেনে বের করে নেয়া হয়েছে।
হত্যাকারীর পায়ের চিহ্ন খুঁজছে কুয়াশা।
বিমূঢ় দেখাল কুয়াশাকে। ডেকের উপর তার নিজের ছাড়া আর কারও পায়ের চিহ্ন নেই। | কয়েক সেকেণ্ড নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। নিহত ব্যক্তির কাছাকাছি না এলে হত্যাকারী হত্যা করল কি ভাবে?
উপর দিকে তাকাল কুয়াশা। প্রায় বিশ ফুট উপরে মোটা তার ঝুলছে একটা। টর্চের আলো ফেলতে দেখা গেল তারের গায়ে তাজা লাল রক্তের দাগ রয়েছে।
তারটা মোটা হলেও এমন মোটা নয় যে কোন লোক ওখানে দাঁড়িয়ে ওটা দিয়ে কাউকে খুন করতে পারে।
ডেকের দূর প্রান্তের দিকে এগোল কুয়াশা। স্টিলের একটা পিলারের নিচে গিয়ে দাঁড়াল। টর্চের আলো ফেলে পরীক্ষা করল পিলারটা। কেউ যদি পিলার ধরে উপরে উঠত তাহলে হাতের বা পায়ের ছাপ থাকত। চকচক করছে পিলারের গা। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এই পিলার কেউ স্পর্শ করেনি বেশ কয়েক ঘন্টার মধ্যে।
পিলার ধরে উপরে উঠতে শুরু করল কুয়াশা। কাঠবিড়ালীর মত তরতর করে উঠে গেল সে পিলারের মাথার কাছে। এইবার মোটা তারটা ধরে ঝুলে পড়ল সে। তার ধরে ঝুলতে ঝুলিতে এগিয়ে চলল কুয়াশা। থামল একসময়। টর্চ জ্বালল এক হাতে। অপর হাত দিয়ে ধরে রেখেছে সে মোটা তারটাকে।
| আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেল সে-রক্তই। কার রক্ত বলা মুশকিল। সম্ভবত নিহত লোকটারই। কিন্তু এই রক্ত এত উপরের ঝুলন্ত.তারে এল কিভাবে সেটা
একটা দুর্ভেদ্য রহস্য।
কুয়াশা এই রহস্যের কোন ব্যাখ্যাই খুঁজে পেল না। গোটা ব্যাপারটাই ভৌতিক, অলৌকিক বলে মনে হয়।
আলো নিভিয়ে ফেলল কুয়াশা। ছুটন্ত পদশব্দ এগিয়ে আসছে। কয়েক মুহূর্ত পর একদল লোককে দেখা গেল। জাহাজের কর্মচারী এরা সবাই। কয়েক জনের হাতে টর্চ রয়েছে।
ঝুলন্ত কুয়াশার নিচ দিয়ে হেঁটে গেল লোকগুলো। তারা টেরই পেল না কুয়াশার অস্তিত্ব।
কুয়াশা ৫৫
| ‘ওই দেখো? ওদিকে তাকাও••• কে অমন ভাবে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে।’
লাশের কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকগুলো।
কে•••খুন হয়েছে?
একজন স্টুয়ার্ড রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল, গলাটা দেখো-ধুনী ফুটো করে দিয়েছে।’
| ‘বারো নম্বর কেবিনের প্যাসেঞ্জার ইয়াকুব চৌধুরী। কিন্তু খুন করল কে ওকে••?’ | ঝুলতে ঝুলতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল কুয়াশা নিঃশব্দে। আট-দশ গজ এগোবার পর একটা অপেক্ষাকৃত উঁচু পিলার পেল সে। পিলারের সঙ্গে ঝুলে থাকা তার ধরে এগোল খানিকদূর, তারপর একটা দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে চলে গেল জাহাজের অপর এক প্রান্তে।
| নিচে নামল কুয়াশা। খুঁজে বের করল বারো নম্বর কেবিন। দরজাটা খোলা দেখে একটু আশ্চর্য হলো সে। কিন্তু কেবিনের ভিতর ঢুকে দরজা খোলা থাকার কারণটা বুঝতে অসুবিধে হলো না তার।
নিহত ব্যক্তির কেবিনে ইতিমধ্যেই কেউ প্রবেশ করেছিল। কেবিনের সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, এলোমেলো করে রেখে গেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গোটা কোনটা পরীক্ষা করল কুয়াশা। বুক শেলফটা প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। ওই একটিমাত্র জিনিসে হাত দেয়া হয়নি। বুক শেলফের বইগুলো সুন্দরভাবেই সাজানো রয়েছে। কেউ কোন জিনিসের খোঁজে এই কেবিনের সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে। কিন্তু জিনিসটা আর যাই হোক, কাগজ জাতীয় কিছু যে নয় তা বুঝতে পারল সে।
ড্রেসিং টেবিলের উপর উল্টে পড়ে আছে একটা শেভিং লোশনের শিশি। টেবিলের উপর থেকে কার্পেটে টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা লোশন পড়ছে তখনও। তারমানে যে লোক এই কেবিনের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করেছে সে মাত্র কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে এখান থেকে।
কার্পেটের উপর সেই লোকের পায়ের ছাপ পাওয়া দুষ্কর। প্যাসেজে বেরিয়ে এল কুয়াশা। কেবিনের দরজার সামনে উবু হয়ে বসল সে। প্রাস্টিকের ব্যাগ খুলে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে মেঝেতে পায়ের ছাপ আছে কিনা পরীক্ষা করতে লাগল ।
প্যাসেজের অদূরবর্তী বাকে একটা হাত দেখা গেল। রিভলভার ধরা নোমশ একটা হাত। রিভলভারটা কুয়াশার মাথা লক্ষ্য করে ধরা রয়েছে। বিকট শব্দে গর্জে উঠল সেটা।
ধোয়া এবং বারুদের গন্ধে ভারি হয়ে উঠল বাতাস। রিভলভারের শব্দটা বজ্রপাতের মত শোনাল। চারদিক থেকে ভেসে এল ধ্বনি প্রতিধ্বনি। বুলেটটা সোজা গিয়ে বিদ্ধ হলো কাঠের দেয়ালে।
কুয়াশা যথাসময়ে লাফ দিয়ে সরে গেছে কেবিনের ভিতর। রিভলভারের
ভলিউম ১৯
সেফটি ক্যাচ সরাবার সময় একটা শব্দ হয়েছিল-ক্লিক। সেই শব্দ পেয়েই নাফ দিয়েছিল কুয়াশা।
কেবিনের ভিতর থেকেই একটা গ্যাস-বোম দুড়ে মরুল কুয়াশা প্যাসেজের শেষ মাথার দিকে। বুম করে শব্দ হলো একটা। সাদা ধোয়ায় ঢাকা পড়ে গেল প্যাসেজ।
রিভলরের শব্দ হলো আবার। ব্যয় আততায়ী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ধোয়ার বাইরে থেকে এলোপাতাড়ি গুলি করছে সে।
পর পর ছয়টা গুলির শব্দ হলো। তারপর স্ব নিস্তব্ধ। ইতিমধ্যে ছুটতে শুরু করেছে কুয়াশা প্যাসেজ ধরে। গ্যাসের ভিতর দিয়ে দম বন্ধ করে ছুটতে ছুটতে শেষ মাথায় পৌঁছুল সে। দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে পদশব্দ। শত্রু পালাচ্ছে। ধাওয়া করুল কুয়াশ।
বাঁক নিয়ে ছুটতে ছুটতে একটা বন্ধ দরজার সামনে বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়াল সে। সরলার গায়ে কাঁধ ঠেকিয়ে চাপ দিল। মড় মড় করে ভেঙে পড়ল দরজার পা দুটো। দরজার ওপাশে.প্রশস্ত একটা করিডর। করিডরটা গিয়ে মিশেছে ডেকের সঙ্গে।
ডেকের দিক থেকে ভেসে আসহে লোজনের শোরগোলের ফুটন্ত পায়ের শ। ওই ডেকেই ইয়াকুবের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। গুলির শব্দ শুনে জাহাজের কর্মচারীরা লাশ ফেলে ছুটেছে আবার কোথায় কি ঘটল দেখার জন্য।
ডেকের উপর লাশটা পড়ে রইল। আশপাশে কেউ নেই আর। আততায়ীর সন্ধান না পেয়ে ডেকে উঠে এল কুয়াশা। মৃতদেহের পাশে হাঁটু মুড়ে বল সে। লাশের শাট এবং প্যান্টের পকেটগুলো সার্চ করে বের করে অনিল কিছু খুচরো পয়সা।
| পয়সাগুলো বাংলাদেশের নয়। টর্চের আলো ফেলে পয়সার গায়ে আরবী অক্ষর দেখতে পেল কুয়াশা।
মিশরীয় মুদ্রা এলৈ, বুঝতে পারুল সে।
নিহত ব্যক্তির কোটের ভিতরের পকেট থেকে পত্রিকার কিছু কাটিং ও সাদা কাগজে আঁকা মন্না পাওয়া গেল। পত্রিকার কাটিংগুলোর উপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল কুয়াশা। প্রতিটি কাগজের টুকরোতেই এরোপ্লেন, বেলুন বা জেপলিন জাতীয় আকাশযান সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক রাখবর রয়েছে। সাদা একটা কাগজে হাতে আঁকা একটা বেলুনের ছবি দেখা গেল। অপর একটি কাগজে জেপলিন জাতীয় চুরুটের মত দেখতে একটা আকাশযানের ছবি আঁকা রয়েছে। ছবিটার পাশে সাঙ্কেতিক চিহ্ন রয়েছে। চিহ্নটা এই রকম: YX03.
| নিহত ব্যক্তির প্যান্টটা অস্বাভাবিক চওড়া দেখে সন্দেহ হওয়ায় কুয়াশা ঋয়ের দিক থেকে প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিল। ক্ষীণ একটা সন্দেহ ছিল তার, কিছু লুকানো থাকতে পারে লোকটার হাঁটুর পিছন থেকে। সন্দেহ সত্যে পরিণত হলো। সেনোফিন পেপারে মোড়া একটা ছোট থলি বের করে আনল কুয়াশা মৃতদেহের হাটুর পিছন থেকে।
থলিটা খুলতেই ঝলসে উঠল চোখ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কুয়াশা থলির
২-কুয়াশা ৫৫
১৭
ভিতরের মহামূল্যবান জিনিসগুলোর দিকে।
এদিকে জাহাজের অপর দিকে দারুণ গোলমাল শুরু হয়েছে। কুয়াশার গ্যাস বোমায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচ ছয়জন জ্ঞান হারিয়েছে। ধোয়া দেখে জাহাজে আগুন লেগে গেছে মনে করে সবাই ভয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। মহাঃহই-চইয়ের মধ্যে ইয়াকুবের হত্যাকারী–সে মানুষ হোক বা ভ্যাম্পায়ার হোক–জাহাজ থেকে নিরাপদে চলে গেল সকলের অগোচরে।
মহামূল্যবান থলিটা প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। বিউটি কুইনের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলোচনা করতে চায় সে এবার। তার সন্ধান পাবার জন্য দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল কে বা কারা তা জানতে হবে।
পা বাড়াতেই বাধা পেল কুয়াশা। একটা প্যাসেজের দিক থেকে তীক্ষ্ণ নারী কণ্ঠের আর্তচিৎকার ভেসে এল।
পরমুহূর্তে শোনা গেল একটি দরজা বন্ধ হবার শব্দ। নারী কন্ঠের চিৎকার আরও উচ্চকিত হয়ে উঠল।
ছুটল কুয়াশা। ডেক থেকে প্যাসেজে পা ফেলেই টর্চের আলোয় দেখল একটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করছে একটি অপরূপ সুন্দরী যুবতী, শূন্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁড়ছে সে উন্মাদিনীর মত। * যুবতীটি ভীষণ ভয় পেয়ে অমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে বুঝতে পারল কুয়াশা। সম্ভবত কেবিনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে যুবতী নিজেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে চিৎকার করছে। | যুবতীর আশপাশে কেউ নেই, কিছু নেই। কিন্তু তার হাত ছেঁড়া ও বিস্ফারিত চোখে আতঙ্কের ছায়া দেখে কুয়াশারও মাথার পিছনের চুল খাড়া হয়ে উঠল। দৃশ্যটা ভীতিকর, ভৌতিক।
কুয়াশার টর্চের আলো যুবতীর চোখে পড়ায় চোখ ধাধিয়ে গেল তার। কুয়াশাকে দেখতে পেল না সে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দুপা সরে গেল সে একপাশে। কুয়াশাকে ছুটে আসতে দেখে ছুটল সে-ও। আতঙ্কিত হরিণীর মত ছুটছে সি প্যাসেজ ধরে চিৎকার করতে করতে। * খানিকদূর এগিয়ে দাঁড়াল যুবতী। একটি কেবিনের দরজায় ঘনঘন মুষ্ট্যাঘাত করুল। খুলে গৈল দরজা, যুবতী অদৃশ্য হয়ে গেল কেবিনের ভিতর। | পরমুহূর্তে বেরিয়ে এল প্যাসেজে একটি লোক। লোকটার হাতে একটি উদ্যত রিভলভার রয়েছে। যুবতীও বেরিয়ে এল, দাঁড়াল সে লোকটার পিছনে।
টর্চের আলোয় দূর থেকেই লোকটাকে এবং তার হাতের রিভলভারটাকে দেখতে পেল কুয়াশা। থমকে দাঁড়াল সে।
কে? কে তুমি? দাঁড়াও••! দাঁড়াল না কুয়াশা। পিছন দিকে লাফ দিল সে।
গর্জে উঠল রিভলবার। কুয়াশার মাথার এক ইঞ্চি উপর দিয়ে বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট। আবার লাফ দিল কুয়াশা ক্যাঙ্গারুর মত। ডেকে পৌঁছে গেল সে। একটা লাইফবোটের পিছনে গা ঢাকা দিল দ্রুত।
শায়লা পারভিন কাঁপা গলায় বলে উঠল, লোকটাকে দেখতে পাইনি আমি!
ভলিউম ১৯
কেবিনের জানালা ভাঙার চেষ্টা করছিল কেউ, ভয়ে বেরিয়ে আসি আমি দরজা খুলে। এমন ভয় পেয়েছিলাম যে কি করছি না করছি খেয়াল ছিল না। মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপর দেখি টর্চ নিয়ে ওই লোকটা ছুটে আসছে•••। হাদি হুসেন কিংবা উত্তাল মনে করে আমি।’
মালেক বলল, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকুন। দেখছি শয়তানটা কে! লাইফবোটের আড়ালে লুকিয়েছে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে লোকটা নিরস্ত্র। দেখাচ্ছি মজা•••।
| এগিয়ে চলল মালেক। পিছু পিছু ভয়ে ভয়ে এগোল শায়লা পারভিন।
লাইফবোটের কাছাকাছি এসে মালেক চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসে বলছি! তা-না হলে গুলি করে মাথার খুলি ফুটো করে দেব।’
কোন সাড়া নেই। লাইফবোটের আড়াল থেকে কেউ বৈরিয়ে এল ন।
সন্তর্পণে এগিয়ে গেল মালেক। রিভলভারটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। আরও দু’পা এগিয়ে ঝুঁকে পড়ল সে। লাইফবোটের ওদিকটা শূন্য–কেউ নেই।
| ‘একি! শয়তানটা পালাল কোন পথে।
শায়লা পারভিন এগিয়ে এল। লাইফবোটের পাশেই রেলিং। রেলিং ধরে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকাল সে। দোতলার ডেক দেখা যাচ্ছে, কেউ নেই
সেখানে। আরও নিচে দেখা যাচ্ছে পানি।
| জাহাজের গায়ে লেগে রয়েছে ছোট একটা মোটরবোট। মোটরবোটে ডাইভার ছাড়াও দুজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাত ছুঁড়ে তর্ক করছে তারা দোতলার ডেকে দাঁড়ানো একজন নাবিকের সঙ্গে। মিস শায়লা শুনল ওদের কথাবার্তা। নাবিক লোক দুজনকে জাহাজে উঠতে দিতে রাজি নয়। নোক দুটো সাংবাদিক। তারা বলছে, সাংবাদিকদের অধিকার আছে খবর সংগ্রহ করার। গোলাগুলির আওয়াজ পেয়েছে তারা। ব্যাপারটা কি জানার জন্য তারা জাহাজে উঠতে চায়। দ্রুত চিন্তা করুল শায়লা পারভিন্।
মালেকের দিকে তাকাল সে। বলল, বুদ্ধি এসেছে মাথায়। পালাতে হবে এই জাহাজ থেকে। এই জাহাজ কোন মতেই নিরাপদ নয় এখন আমাদের জন্যে। বেচারা ইয়াকুবকে শয়তানরা খুন করেছে। তার মানে হাদি হুসেন এবং উত্তাল রয়েছে এই জাহাজে। দ্বিতীয় কোন অঘটন ঘটাবার আগেই নিরাপদ জায়গায় সরে। যাওয়া দরকার আমাদের।
কিন্তু পালাব কিভাবে!
সাংবাদিকদের ওই মোটরবোট-ওটা দখল করব আমরা। এসো।
লাইফবোটের কাছ থেকে একহাত দূরে সরে যায়নি কুয়াশা। লাইফবোটটা উপুড় করে রাখা ছিল। প্রথমে সে ওটার আড়ালে গা ঢাকা দিলেও কয়েক মুহূর্ত পর লাইফবোটটা ধীরে ধীরে উঁচু করে ওটার ভিতর ঢুকে যায় সে।
শায়লা পারভিন এবং মালেকের কথাবার্তা সবই শুনতে পায় সে। ওরা ডেকের উপর দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই লাইফবোটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে সে, খানিক দূর এগিয়ে রেলিং টপকায়, দ্রুত নেমে পড়ে দোতলার ডেকে। কুয়াশা ৫৫
দোতলার ডেকে দাঁড়িয়ে নাবিকটা তখনও তর্ক করছে সাংবাদিক আনিস এবং এনায়েতের সঙ্গে-সে কুয়াশার উপস্থিতি লক্ষই করল না। দোতলা থেকে নিচে নামল কুয়াশা সিঁড়ি বেয়ে। অন্ধকার রেলিংয়ের উপরে দাঁড়িয়ে ব্যাগ খুলে নাইলনের কর্ড বের করল সে। তারপর নেমে পড়ল পানিতে।
নিঃশব্দে সাঁতার কেটে মোটরবোটের পিছন দিকে পৌঁছুল সে। নাইলনের কর্ড বাঁধল সে বোটের সঙ্গে। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল পরবর্তী ঘটনার
জন্য।
কয়েক মুহূর্ত পরই রেলিংয়ের ধারে হাজির হলো শায়লা পারভিন এবং মালেক। মালেকের হাতে উদ্যত রিভলবার। রেলিং টপকে দড়ির মই বেয়ে তরতর করে নামল সে মোটরবোটের উপর। সাংবাদিকদ্বয়ের দিকে রিভলবার উঁচিয়ে কঠিন কণ্ঠে নির্দেশ দিল সে, কোন কথা নয়। যা বলছি, তাড়াতাড়ি করো। মই বেয়ে জাহাজে ওঠো, দুজনেই। তা না হলে ।
শায়লা পারভিন নামল বোটে।
নাবিক লোকটা বোবা বনে গেছে। অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে দেখহেসে শায়লা পারভিন আর মালেককে। সাংবাদিকদ্বয় ভিজে বেড়ালের মত দড়ির মই বেয়ে উঠে পড়ল জাহাজে।
ড্রাইভার! বোট স্টার্ট দাও।’
বিনাবাক্যব্যয়ে স্টার্ট দিল ড্রাইভার বটে। বাঁক নিয়ে তীরের দিকে এগিয়ে চলল মোটরবোট।
| জাহাজের উপর থেকে নাবিক এবং সাংবাদিকদ্বয় স্তম্ভিত হয়ে দেখল বোটের পিছু পিছু একটা ছায়ামূর্তি তীরবেগে এগিয়ে চলেছে।
* তীরে অসংখ্য মানুষের ভিড়। যেদিকে মানুষজন প্রায় নেই বললেই চলে সেদিকে ছুটে চলেছে মোটরবোট। তীরভূমি পঁচিশত্রিশ গজ দুরে থাকতে নাইলনের কর্ড খুলে নিল বোটের গা থেকে কুয়াশী। সাঁতার কেটে উঠল সে তীরে। রেখে যাওয়া ব্রিফকেস থেকে ঝটপট পোশাক বের করে পরে নিল সে, নকল দাড়ি আবার
লাগাল মুখে, তারপর ছুটতে শুরু করল ব্রিফকেস হাতে নিয়ে।
ভাগ্যক্রমে মোটরববাটুটা যেখানে ভিড়েছে সেখান থেকে কুয়াশার মার্সিডিজ গাড়িটা খুব বেশি দূরে নয়। গাড়ির কাছে পৌঁছে সে শহীদের উদ্দেশে বল, ডানদিকের তীরে এইমাত্র একটা মোটরবোট ভিড়েছে। একটি যুবতী এবং একজন লোক রাস্তার দিকে আসছে। সম্ভবত গাড়ি দরকার হবে ওদের। দেখো তো টোপ ফেলে, ওরা তোমার ফাঁদে পা দেয় কি না। এইমুহূর্তে আমি বলতে পারছি না ওরা। শত্রু না মিত্র। ওদের গন্তব্য স্থানটা জানতে চাই আমি। ওরা নিজেদের মধ্যে কি আলাপ করে শোনার চেষ্টা করো। সাবধান, ওরা কিন্তু আক্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে তুমি। আক্রান্ত তুমিও হতে পারো-যাও!’
| এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামল কুয়াশা। তার কথা শেষ হতে হুস করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা তীরবেগে।
, গাড়ি নিয়ে খানিক দূর যাবার পরই হেড লাইটের উজ্জ্বল আলোয় শহীদ সামনে একটা ভাড়াটে ট্যাক্সি দেখতে পেল। ট্যাক্সির ব্যাক ডোর খুলে ধরেছে
ভলিউম ১৯
ড্রাইভার, ভিতরে উঠছে একটি যুবতী, তার সঙ্গে একজন পুরুষমানুষ। শহীদের গাড়ি কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই ড্রাইভার উঠে পড়ল ট্যাক্সিতে। ছুটতে শুরু করল ট্যাক্সি। দেবি হয়ে গেছে, সুতরাং কাজ হলো না। অগত্যা ট্যাক্সিকে অনুসরণ করতে শুরু কলে ও।
দূর থেকে সবই লক্ষ করুল কুয়াশা। ট্যাক্সি এবং মার্সিডিজ খানিক দূর এগিয়েছে মাত্র, এমন সময় দুজন নোক রাস্তার উপর এসে দাঁড়াল। দ্রুত অদৃশ্যমান গাড়ি দুটোর দিকে দুজনেই তাকিয়ে আছে, দেল কুয়াশা।
লোক দুজনের একজন অস্বাভাবিক মোটা। উচ্চতাবড়জোর পাঁচ ফুট হবে, চওড়ায় প্রায় সেই রকমই। এমন মেদ সর্বস্থ লোক এর আগে দেখেনি কুয়াশা। লোকটা দেশী নয়, বিদেশী। সম্ভবত, আফ্রিকান। তার সঙ্গের লোকটা সাড়ে পাঁচ ফুটের মত লম্বা। ভাল স্বাস্থ্য! এ লোকটা বাঙালী।
নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে শুরু করল কুয়াশা। আলো এড়িয়ে ছায়ার ভিতর দিয়ে লোক দু’জনের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছুতে চায় সে। বাঙালী লোকটাকে চিনতে পারছে সে। জাহাজে এই লোকই তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল।
মোটা লোকটার পিঠে কিছু একটা ঝোলানো রয়েছে, লক্ষ করল কুয়াশা। আরও কয়েক পা এগোবার পর জিনিসটা পরিষ্কার দেখতে পেল সে। একটা বেতের ঝুড়ি। ঝুড়িটা আকারে অস্বাভাবিক বড়। “ আরবী ভাষায় কথা বলছে মোটা লোকটা, সত্যিই কি তুমি ছুঁড়িটাকে দেখেছ, উত্তাল? ভুল করোনি তো?” | বাঙালী লোকটার নাম উত্তাল। সে বিরক্তির সঙ্গে দ্রুত বলে উঠল, ‘কী আশ্চর্য! ভুল দেব কেন! পরিষ্কার দেখলাম ট্যাক্সিতে উঠল দুজন।
| তাহলে তো বিপদ। দেখো দেখি চেষ্টা করে, কোন গাড়ি পাওয়া যায় কিনা। ওদেরকে, বিশেষ করে ছুঁড়িটাকে কোন মতেই পালাতে দেয়া চলে না। একবার চোখের আড়ালে ল গেলে খুঁজে পেতে দেরি হয়ে যাবে।’
রাস্তার এদিক-ওদিক তাকাল উত্তাল।
দেখা গেল দূর থেকে ওদের দিকেই ছুটে আসছে একটা ট্যাক্সি। হাত দেখিয়ে স্বামাবার চেষ্টা করছে ওরা গাড়িটাকে।
ট্যাক্সিটা থামল।
এমন সময় কুয়াশার পিছন থেকে ছুটে আসতে দেখা গেল একটা গাড়িকে। গাড়িটার উজ্জল হেড লাইটের আলো পড়ল কুয়াশার গায়ে।
হেড লাইটের আলো পড়ল উত্তাল এবং হাদি হুসেনের গায়েও। ট্যাক্সিতে চড়ার আগে দুজনেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। তাকাতেই দেখতে পেল দীর্ঘদেহী কুয়াশাকে।
ইয়ান্না! আঁতকে উঠল হাদি হুসেন।
সেই শয়তানটা! পিছু পিছু এসেছে ব্যাটা! উত্তাল বলে উঠল।
কুয়াশা ৫৫
কুয়াশার পাশ ঘেঁষে ছুটে গেল একটা মরিস গাড়ি। আবার অন্ধকার গ্রাস করুল তাকে। অন্ধকারে মিশে গিয়ে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে সরু একটা গলিতে প্রবেশ করুল
সে। দাঁড়াল। এখান থেকে দেখতে চায় সে শত্রুরা কি করে না করে।
অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। উঁকি দিয়ে তাকাতে গিয়েও ক্ষান্ত হলো কুয়াশা। কান পাতল সে। অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে এল কানে। সিল্কের কাপড়ের ভাজ খোলার সময় এই ধরনের শব্দ হয়। মৃদ, খসখসে শব্দ। ক্রমশ তার দিকে
এগিয়ে আসছে। তীব্র একটা দুর্গন্ধ ঢুকল নাকে।
জীবনে সহস্রাধিক বার সহস্র ধরনের বিপদে পড়েছে কুয়াশা। লক্ষণ দেখামাত্র সে বুঝতে পারে বিপদটা কি ধরনের।
এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। হঠাৎ কুয়াশা ঘুরে দাঁড়িয়ে গলির ভিতর দিকে ছুটতে শুরু করুল।
কুয়াশা যেন প্রাণ ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছে। প্রাণপণে দৌড়চ্ছে সে। গলির দু’পাশে উঁচু পাঁচিল। পঁচিল টপকে কোন বাড়িতে আশ্রয় নেবার কথা ভাবল সে। কিন্তু যে বিপদ পিছু ধাওয়া করে আসছে তার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে দ্রুত এবং নিখুঁত আশ্রয় দরকার। পাঁচিল টপকালেই যে নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
ছুটছে কুয়াশা অন্ধকার গলির ভিতর দিয়ে। কিন্তু সেই রহস্যময় শব্দটা তার চেয়েও দ্রুত বেগে ধাওয়া করে আসছে তাকে।
নিজের পায়ের শব্দ হঠাৎ যেন অন্যরকম শোনাল। সেই মুহূর্তে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কুয়াশা। ঝুঁকে পড়ে পথের গায়ে হাত বুলাল।
ইট নয়, লোহা ঠেকল হাতে। বুঝতে অসুবিধে হলো না, একটা ম্যানহোলে পা পড়েছিল তার। বসে পড়ল কুয়াশা। ম্যানহোলের ঢাকনিটা খোলার চেষ্টা করল।
এগিয়ে আসছে সবেগে সেই রহস্যময় শব্দ। দুর্গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস। শ্বাস গ্রহণ করা অসম্ভব মনে হচ্ছে।
ম্যানহোলের ঢাকনির চারদিকে ধুলোবালি জমে থাকায় সেটা জাম হয়ে গেছে, চেষ্টা করেও এতটুকু নড়তে পারছে না কুয়াশা।
প্রতিটি সেকেণ্ডের দাম লক্ষ কোটি টাকার সমান বলে মনে হচ্ছে কুয়াশার। সাক্ষাৎ মৃত্যু ছুটে আসছে তার দিকে, পরিষ্কার বুঝতে পারছে সে। এই বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ম্যানহোলের ভিতর ঢুকে আশ্রয় নেয়া। বিপদটার প্রকৃত রূপ সম্পর্কে কোন ভুল ধারণা নেই তার। অন্ধকারে এই অগ্রসরমান বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কিছুই করবার নেই তার।
এগিয়ে আসছে শব্দটা।
দরদর করে ঘামছে কুয়াশা। সর্ব উপায়ে চেষ্টা করছে সে ঢাকনিটা তুলে ফেলতে, কিন্তু•••
মাথার উপর চলে এসেছে সেই রহস্যময় খসখসে শব্দ। এমন সময় খুলে ফেললকুয়াশা ঢাকনি। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল তার দেহটা ম্যানহোলের ভিতর। ঢাকনিটা টেনে বসিয়ে দিল ম্যানহোলের মুখে।
২২
ভলিউম ১৯
ঢাকনির উপর নখ দিয়ে আঁচড়াবার শব্দ হচ্ছে, শুনতে পেল কুয়াশা। কোন পাখি যেন ঢাকনিটা খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। দূর থেকে ভেসে এল দীর্ঘ শিস দেবার আওয়াজ। ঢাকুনির উপর থেকে কি যেন উড়ে গেল শূন্যে-সেই রহস্যময় খখসে শব্দটা ক্রমশ মিলিয়ে গেল দৃরে।
ম্যানহোলের ঢাকনি সামান্য একটু উঁচু করে রেখেছিল বলে শব্দগুলো শুনতে কোন অসুবিধূে হয়নি কুয়াশার।
অসহ্য দুর্গন্ধটাও ক্রমশ মিলিয়ে গেল বাতাসে, অনুভব করুল সে।
কয়েক মুহূর্ত পর ঢাকনি সরিয়ে উঠে এল কুয়াশা পথের উপর। গলির মাথায় পৌঁছুল দ্রুত। কিন্তু ট্যাক্সি বা শত্রুদের কাউকে কোথাও দেখতে পেল না সে।
চার কুয়াশার আস্তানাটা কর্ণফুলী নদীর ধারে। পাঁচতলা বিল্ডিং।
ড্রয়িংরূমে ঢুকতে দেখা গেল কুয়াশাকে। কুয়াশাকে দেখে রাজকুমারী ওমেনা বলল, কি খবর, কুয়াশা? দ্রুত কুয়াশার মাথা থেকে পা অবধি চোখ বুলিয়ে নিল সে।
কুয়াশা বলল, “খবর ভাল নয়। নতুন ধরনের বিপদের মুখোমুখি হবার জন্য তৈরি হও। মি. ডি. কস্টা কোথায়?
লাইব্রেরীতে। ঢাকা থেকে রাসেল এসেছে, তার সঙ্গে গল্প করছেন।’
কুয়াশা সোফায় বসল। বলল, রাসেল এসেছে ভালই হয়েছে। ডাকো ওদেরকে।’
ওমেনা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ড্রয়িংরূম থেকে। একমিনিট পরই ফিরে এল সে সঙ্গে ডি, কস্টা এবং রাসেলকে নিয়ে।
বসো, রাসেল।
রাসেল বসল, দশ লক্ষ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা শুনে ভাবলাম এখানে অ্যাডভেঞ্চারাস কিছু ঘটবেই ঘটবে। পাছে থ্রিলু থেকে বঞ্চিত হই, তাই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। তা আসল ব্যাপারটা কি, কুয়াশা দা?’
© ডি. কস্টা মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে সে সিলিংয়ের দিকে। ভুলেও সে তাকাচ্ছে না কুয়াশার দিকে।
কুয়াশা বলল, মি. ডি. কস্টা, আপনার রাগ এখনও কমেনি দেখছি।’
ঝট করে তাকাল ডি. কস্টা। থমথম করছে মুখের চেহারা। ভারি, অভিমানহত স্বরে সে বলল, রাগ করিয়া লাভ নাই। আমি রাগ করি নাই। কিন্টু হামি মনে করি হাপনি হামার প্রটি অন্যায় অবিচার করিয়াছেন।’
‘ব্যাপার কি? রাসেল জানতে চাইল।
উত্তর দিল ওমেনা। হাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে সে বলল, ‘মি. ডি. কস্টা অনুরোধ করেছিলেন পুরস্কারের দশ লক্ষ টাকা যাতে তিনি পান তার ব্যবস্থা যেন কুয়াশা করে দেয়। কিন্তু কুয়াশা রাজি হয়নি।’
| কুয়াশা বলল, দশ লক্ষ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা শোনার পর নানারকম
কুয়াশা ৫৫
সন্দেহ জাগে আমার মনে। পুরস্কারের ঘোষণাটা আমাকে বিপদে ফেলার একটা ফাঁদ হতে পারে মনে করে আমি শহীদের সঙ্গে পরামর্শ করে আসল রহস্য জাবার জন্য সরাসরি যেতে চাই বিউটি কুইনে। কিন্তু মি. ডি. কস্টা চেয়েছিলেন স্বয়ং বিউটি কুইনে গিয়ে পুরস্কারের ঘোষককে জানাতে যে তিনি আমার সন্ধান পেয়েছেন। এতে দশ লক্ষ টাকা তিনি পেতেন। কিন্তু ওর প্রস্তাব আমি মেনে নিতে পারিনি। আমার নিজস্ব পদ্ধতি অনুযায়ী রহস্যটার সমাধান করার চেষ্টা করি।’
রাসেল জানতে চাইল, আপনি এখন বিউটি কুইন থেকে এলেন বুঝি? রহস্য কি? জানতে পেরেছেন?
| কুয়াশা ব্রিফকেস খুলে সেলোফিন পেপারের থলিটা বের করে রাসেলের দিকে বাড়িয়ে ধরল, বলল, এই থলির ভিতর কিছু মূল্যবান ডায়মণ্ড আছে। তুমি তো জিওলজির ওপর প্রচুর পড়াশোনা করেছ; পরীক্ষা করে জানাও আমাকে বিস্তারিত জানো তো বিভিন্ন দেশের ডায়মণ্ড বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে। এগুলো কোন্ এলাকা থেকে এসেছে বলে।
| রাসেল হাত বাড়িয়ে ডায়মন্ডের থলিটা নিল। পকেট থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে দেখল সে ডায়মগুলো। পনেরো টুকরো আনকাট ডায়মণ্ড।
রাসেল বলল, আফ্রিকার ডায়মণ্ড এগুলো। কিন্তু এর দাম যে অনেক। কোত্থেকে পেলেন?
কুয়াশা বলল, আফ্রিকান, তা আমিও অনুমান করেছি। কিন্তু আফ্রিকার কোন্ এলাকার?’
তা জানতে হলে সময় নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে, রেফারেন্স বুক ঘাঁটতে হবে।’
কুয়াশা বলল, “ঠিক আছে। তার আগে বিউটি কুইনে কি কি ঘটেছে শুনে নাও তোমরা সবাই।
| কুয়াশা একে একে সব ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করল। কুয়াশার কথা শেষ হতে প্রত্যেকে একাধিক প্রশ্ন করল। কিন্তু বেশির ভাগ প্রশ্নেরই উত্তর দিতে অস্বীকার করল কুয়াশা। কারণ অনুমানের উপর নির্ভর করে কোন মর্তব্য করতে অভ্যস্ত নয়।
সে ।
শুধু ওমেনার প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, রক্তশোষক বাদুড় বা ভ্যাম্পায়ারের খুব বড় একটা ভূমিকা আছে এই রহস্যে। বিউটি কুইনে যে নিহত হয়েছে সে ওই রক্তশোষক বাদুড় বা ভ্যাম্পায়ারের শিকার, এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। মৃতদেহের গায়ে কিছু ক্ষত দেখেছি। ছোট ছোট নখের আঁচড় সম্ভবত।’
রাসেল বলল, কি সাঘাতিক! ভ্যাম্পায়ারের কথা এতদিন গল্প কাহিনীতেই শুনে এসেছি। এখন দেখছি ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে সংঘর্ষে নামতে হবে।’
কুয়াশা বলল, ওমেনা, আমাদেরকে সংঘর্ষের জন্য সবদিক থেকে তৈরি থাকতে হবে। উড়ন্ত ভ্যাম্পায়ারের বিরুদ্ধে অন্ধকারে লড়তে হবে আমাদের। বুঝতেই পারছ, রাতের অন্ধকারে মৃত্যু-ঠোকর মারার জন্য ওরা আসবে। সুতরাং ইনফ্রারেড প্রজেক্টর প্রস্তুত রাখো তুমি। অন্ধকারে সবকিছু দিনের আলোর মত পরিষ্কার দেখতে পেতে হবে। ফুয়োরোসকোপিক চশমা আর এমন সি
।
২৪
ভলিউম ১৯
তৈরি করবে যা ফুসফুসে প্রবেশ করা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে মানুষ জ্ঞান হারায়। গ্যাসটা যেন মারাত্মক না হয় অর্থাৎ ওই গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে কেউ যেন মারা না যায়। গ্যাস মালোও পরীক্ষা করে দেখবে, সব ঠিক ঠাক আছে কিনা।
কুয়াশা এবার নিহত ইয়াকুবের পকেট থেকে পাওয়া জেপলিন আঁকা এক টুকরো কাগজ বের করল। চুরুটের মত লম্বা আকাশযান দেখল কিছুক্ষণ। YX03-সাঙ্কেতিক চিহ্নটার দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর কাগজটা ডি. কুস্টার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘YX03-এটা একটা সাঙ্কেতিক চিহ্ন; জেপলিন ধরনের একটা আকাশযানের পাশে লেখা রয়েছে। আপনি ঢাকায়, সিভিল এভিয়েশন দফতরে এ ব্যাপারে ফোন করুন। এই সাঙ্কেতিক চিহ্নের বিশেষ কোন অর্থ আছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখবেন। আমার ধারণা, জেপলিন ধরনের কোন আকাশযানের আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার এটা। আর একটা ব্যাপার। এখানে হেলিকপ্টার আমাদের মাত্র একটা। ঢাকার আস্তানা থেকে আর একটা কপ্টার নিয়ে সরাসরি এখানে চলে আসতে বলুন কামালকে।
খানিক পর লাইব্রেরীতে দেখা গেল কুয়াশাকে। দৈনিক সংবাদপত্রের কাটিং-এর ফাইলগুলো নিয়ে কাজ শুরু করল সে। ফাইলের উপর লেখা হেডিং দেখে স্মরণ করার চেষ্টা করছিল সে এর আগে শায়লা পারভিনের নামটা কোথায় শুনেছে বা দেখেছে। ঠিক মত মনে না পড়লেও, নামটা যে এর আগে সে শুনেছে বা কোথাও লেখা দেখেছে তাতে কোন সন্দেহ ছিল না তার মনে।
মাস ছয়েক অতীতের উল্লেখ্য ঘটনা সমূহের একটা ফাইল হাতে তুলে নিল কুয়াশা। এই ফাইলে অভিযানমূলক ঘটনার পেপার কাটিং সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। ফাইলের উপর বন্ধনীর মধ্যে লেখা রয়েছে, শুধুমাত্র বাঙালীর দ্বারা পরিচালিত অভিযানমূলক ঘটনার টুকরো সংবাদ।
ফাইলটা খুলল কুয়াশা। খানিক পরই একটা পেপার কাটিং দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখের চেহারা। শুধু খবর নয়, পাইলটের, পোশাক পরা শায়লা পারভিনের ছবিও রয়েছে পেপার কাটিংয়ে। এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট একটা বিমানের সামনে সহাস্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে শায়লা পারভিন। ছবির নিচেই খবটা ছাপা হয়েছে।
খবরের হেডিংটা এই রকম:
মিস শাফা পারভিনের নিখোঁজ সংক্রান্ত সকল তদন্তের সমাপ্তি। সরকারী মুখপাত্রের সহিত এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রকাশ যে ফ্লাইং ক্লাবের সদস্য! মিস শায়লার সন্ধান লাভের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্ধারকারী সংস্থা। একযোগে তদন্ত কার্যের সমাপ্তি ঘোষণা করিয়াছেন। এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে মাস ছয়েক পর্বে মিস শায়লা অপর দুইজন সদস্যসহ ফ্লাইং ক্লাবের একটি বিমান লইয়া ঢাকা হইতে সিয়ারালিয়ন যাত্রা করেন। তুরস্কের ইজমীর বিমানবন্দর হইতে সর্বশেষবার তেল নিয়া আকাশে উড্ডয়নের পর বিমানটির আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই।
কুয়াশা ৫৫
২৫
বিমান এবং বিমানের আরোহীদের ভাগ্যে কি ঘটিয়াছে তাহা জানিবার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। তদন্ত কার্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাহারও কাহারও ধারণা, বিমানটি ভূমধ্যসাগরে নিমজ্জিত হইয়াছে। তবে ইত্যা অনুমান মাত্রই। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন প্রকার ধারণা পোষণ করেন, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় নাই। বিমানটি এবং বিমানের আরোহীত্রয়ের ভাগ্যে কি ঘটিয়াছে তা রহস্যাবৃতই থাকিয়া
গেল । এই রহস্যের সমাধান আর কোনদিন হইবে বলিয়া আশা করা যায়
। খবরটা এখানেই শেষ নয়। খবরের শেষাংশে শায়লা পারভিন, আবদুল মালেক এবং ইয়াকুব চৌধুরীর ব্যক্তিগত পরিচয় ছাপা-হয়েছে।
পদশব্দ শুনে মুখ তুলল কুয়াশা। দোরগোড়ায় রাজকুমারী ওমেনাকে দেখা গেল। বলল, শহীদ খান ফোনে ডাকছেন তোমাকে।’
উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল কুয়াশা। ড্রয়িংরুমে ঢুকে ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলল সে, বলল, কুয়াশা বলছি।
শহীদের গলা ভেসে এল, ওদের পরিচয় জানতে পেরেছি আমি কুয়াশা। ওদেরকে অনুসরণ করুলেও, ট্রাফিক জ্যামের জন্য হারিয়ে ফেলি: ট্যাক্সিটাকে। খানিক পর ট্যাক্সিটাকে হোটেল রেক্স-এর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামাই। ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে কয়েকটা তথ্য পেয়েছি। সে ওদের কথাবার্তা শুনেছে। শায়লা পারভিন, আবদুল মালেক এবং নিহত ইয়াকুব চৌধুরী সম্মিলিতভাবে তোমার সন্ধান লাভের জন্যে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।’
কোত্থেকে বলছ তুমি?’
শহীদ বলল, হোটেল রেক-এর লবি থেকে। ওরা এই হোটেলে উঠেছে। শায়লা পাঁচতলায়, মালেক ছয়তলায়। একই ফ্ল্যাটে কামরা খালি নেই বলে এই ব্যবস্থা। | কুয়াশা দ্রুত হাদি হুসেন এবং উত্তালের চেহারার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইল, ‘এই রকম চেহারার দু’জন লোককে দেখেছ হোটেলে?’
| শহীদ বলল, ব্যাপার কি, কুয়াশা। এই তো কয়েক মিনিট আগে দুজন লোককে হোটেলে ঢুকতে দেখলাম। তোমার বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে••• | মোটা লোকটার পিঠে সৌখিন একটা বেতের ঝুড়িও দেখেছি।’
দ্রুত কণ্ঠে কুয়াশা বলে উঠল, শায়লা এবং মালেকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করো, শহীদ। ‘কুইক! ওদেরকে বলো, হাদি হসেন এবং উত্তাল ওই হোটেলে ঢুকেছে। ওদেরকে হোটেল থেকে বের করে আনো-না, তুমি বরং ওদেরকে দরজা-জানালা বন্ধ করে আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলো। ওদের সঙ্গে তুমিও থাকো। আমি যাচ্ছি এখুনি।
সশব্দে ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিয়ে তীরবেগে বেরিয়ে গেল সে ড্রয়িংরূম থেকে।
| আট-দশ মিনিট পর হোটেল রেক্স-এর সামনে সশব্দে ব্রেক করে থামল একটা
ভলিউম ১৯
ট্যাক্সি।
হোটেলের সামনে প্রচুর লোকজনের ভিড়। উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে সবাই। কুয়াশা ট্যাক্সি থেকে নেমে সেই ভিড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিছু একটা খারাপ ঘটনা ঘটে গেছে, বুঝতে অসুবিধে হলো না তার।
উত্তেজিত লোকগুলোর কথাবার্তা কানে গেল তার। ‘পুলিসে খবর দেয়া হয়েছে? গোলাগুলির ব্যাপার, তার ওপর কিডন্যাপিং!’ বলল হোটেলের একজন বেয়ারা। | অপর একজন বলে উঠল, আর খবর দিয়ে কি হবে? ভদ্রমহিলাকে নিয়ে গুণ্ডা দুজন এতক্ষণে বহুদূরে চলে গেছে।
কে যেন ভিড়ের মধ্যে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘গুণ্ডারা ঢুকল কিভাবে হোটেলে। আর গোলাগুলিই বা হলোটা কার সঙ্গে?’
| ‘চেহারা দেখে কি বোঝা যায় নাকি সাহেব কে গুণ্ডা কে ভাল মানুষ। লোক দুজন খানিক আগে হোটেলে ঢুকে দুটো রুম ভাড়া নিয়েছিল। গুলি বোধহয় ওরাই ছুঁড়েছে লোকজনকে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করার জন্য।
একজন বয় বলে উঠল, আমিই তো ওদের বেতের ঝুড়িটা উপর তলায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমার কথা শুনে খেপে উঠেছিল দুজনই। তখনই কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল আমার।
কি ছিল বেতের ঝুড়িতে?
“তা জানি না। তবে এটা ছুঁতে দিতেও রাজি নয় বলে মনে হচ্ছিল। ভিতর থেকে কেমন ভ্যাপসা, খারাপ গন্ধ বেরুচ্ছিল।
শহীদ ব্যর্থ হয়েছে বুঝতে পারুল কুয়াশা। হোটেলের ভিতর প্রবেশ করল সে। শহীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল মনে মনে একটা অশুভ চিন্তায়ু ছেয়ে গেল তার মন।
রিসেপশনে ঢুকল কুয়াশা। রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করে শায়লা পারভিন এবং মালেকের রূম নাম্বার জেনে নিয়ে এগোল এলিভেটরের দিকে।
পাঁচতলায় নামল কুয়াশা এলিভেটর থেকে। নাম্বার মিলিয়ে শায়লা পারভিনের রূমের সামনে দাঁড়াল। কাঁধের ধাক্কায় ভেঙে ফেলা হয়েছে দরজাটা। ভিতরে প্রবেশ করার আগেই সে দেখল রূমের কার্পেটটা গুটিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এক ধারে। রূমের আর সূব আসবাবপত্রও উল্টে দেয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিটি জিনিস স্থানচ্যুত করেছে শত্রুরা। এমনকি টেলিফোন যন্ত্রটাও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
শায়লার কাছে এমন কিছু ছিল যা শত্রুরা খুঁজে বের করার জন্য সম্ভাব্য সব জায়গায় সন্ধান চালিয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না। নিহত ইয়াকুবের কাছে মূল্যবান ডায়মণ্ড ছিল। শায়লার কাছেও ছিল নাকি? কিসের সন্ধানে রূমটা এমন তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে শত্রুরা?
শায়লা পারভিনের রূম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছয়তলায় উঠল কুয়াশা। নাম্বার মিলিয়ে মালেকের রূমে ঢুকল সে।
মালেকের প্রাণহীন দেহ পড়ে রয়েছে কার্পেটের উপর। প্রথমেই লক্ষ করল কুয়াশা, মালেকের প্যান্ট হাটু অবধি তোলা। মৃতদেহের পাশে হাঁটু মুড়ে বসল সে। মালেকের ডান পায়ের হাঁটুর পিছনে মনোযোগ দিয়ে দেখল | দড়ির দাগ দেখল সে। কিছু একটা বাঁধা ছিল হাঁটুর পিছনে, বোঝা যায়। ইয়াকুবের মত মালেকও
কুয়াশা ৫৫
২৭
মূল্পবান ডায়মণ্ড লুকিয়ে রেখেছিল হাঁটুর পিছনে, অনুমান করল সে।
ইয়াকুবের মতই, মালেকের গলায় একটা ফুটো দেখা যাচ্ছে। রক্তশোষক বাদুড় বা ভ্যাম্পায়ারই যে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ
নেই।
কামরাটা পরীক্ষা করল কুয়াশা। শহীদের ছায়া পর্যন্ত নেই কোথাও। জানালাগুলো ভিতর থেকে বন্ধ রয়েছে, লক্ষ করল সে।
নিচের তলায় নেমে এল কুয়াশা। হোটেল ম্যানেজার, রিসেপশনিস্ট, বয় বেয়ারদের সঙ্গে কথা বলল সে। জানা গেল হাদি হসেন এবং উত্তাল শায়লা পারভিনকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে হোটেল থেকে হোটেল থেকে বেরুবার আগে তারা ইলেকট্রিকের মেনসুইচ অফ করে দেয়, গোটা হোটেল অন্ধকারে ডুবে যায়। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেছে তারা। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই এমুনই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল যে ট্যাক্সির নাম্বার লক্ষ করার কথা কারও মাথায় ঢোকেনি।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অনেকেই শহীদকে হোটেলের ভিতর কতে দেখেছে, কিন্তু ওকে বেরুতে দেখেনি কেউ। টর্চের আলোয় হাদি হুসেন, উত্তাল এবং শায়লা পারভিনকে দেখেছে সবাই। কিন্তু তাদের সঙ্গে বা পিছনে শহীদকে কেউ হোটেল থেকে বেরুতে দেখেনি।
সকলের সঙ্গে কথা বলে কুয়াশা সিদ্ধান্তে পৌঁছুল, শহীদ হোটেলের ভিতরই আছে কোথাও। এতগুলো লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে বেরিয়ে গেছে তা বিশ্বাস করা যায় না।
পাঁচতলায় উঠে এল আবার কুয়াশা। শায়লা পারভিনের কামরায় ঢুকল। আগেই সে লক্ষ করেছিল, কামরার খাটের উপর চাদর এবং বালিশ নেই। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। এত বড় হোটেল, বয়-বেয়ারারা বোর্ডারদের সুবি অসুবিধের দিকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখে। চাদর এবং বালিশ কোন কারণে যাদ সরিয়ে ফেলা হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে নতুন ব্যবস্থা করার কথা।
কিন্তু তা করা হয়নি।
কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল কুয়াশা। জানালাগুলো সবই বন্ধ, কেবল একটি ছাড়া। এগিয়ে গেল সে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাতেই ছাত্ করে উঠল কুয়াশার বুক। নিচে একটা একতলা বাড়ির প্রশস্ত হাদ দেখা যাচ্ছে। সেই ছাদের উপর একজন পড়ে রয়েছে লম্বা হয়ে। চারদিক থেকে আলো পড়েছে ছাদটার উপর। শহীদের প্যান্ট এবং শার্ট পরিষ্কার চিনতে পারুল কুয়াশা। উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে সে।
পাঁচতলা থেকে একতলার ছাদে ফেলে দেয়া হয়েছে শহীদকে। বেঁচে থাকার কথা নয় ওর।
পাঁচ জানালার বাইরে মাথা বের করে দিয়ে উপর দিকে তাকাল কুয়াশা। জানালার পাশ ঘেঁষে একটা পানির পাইপ উঠে গেছে উপর দিকে।
২৮
ভলিউম ১৯
জোর গলায় ডেকে উঠল কুয়াশা, শহীদ।
হাদ বা উপরতলার কোন জানালা থেকে নয়, শহীদের গলা ভেসে এল কুয়াশার পিছন থেকে, আমি এদিকে, কুয়াশা।
ঘুরে দাঁড়িয়ে কুয়াশা দেখল শহীদ রূমের ভিতর ঢুকছে। প্যান্ট-শার্টের বদলে শুধু একটা চাদর জড়ানো রয়েছে ওর গায়ে।
ব্যাপার কি বলো তো শহীদ?’
শহীদ বলল, তোমার মতই ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছি রক্তশোষক বাদুড়ের হাত থেকে, কুয়াশা। নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও মালেককে পারিনি। ইতিমধ্যেই জেনেছ নিশ্চয়ই, খুন হয়েছে সে? আর শালাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে শয়তানরা•••
কুয়াশা মন দিয়ে শহীদের কথা শুনছে।
তোমাকে ফোন করার পরই হঠাৎ দেখি আলো অফ হয়ে গেল। শায়লার চিৎকার শুনি আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময়। রিভলভার নিয়ে এই কামরায় ঢুকি, দেখি শায়লা নেই। শায়লাকে এখানে না দেখে আমি করিডর ধর্নে ছুটতে শুরু করি ছয়তলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে।
অন্ধকার সিঁড়ির কাছে যেতেই গুলি করা হয় আমাকে। একটা পিলারের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে গুলি করি আমি সিঁড়ির মাথার দিকে। শুরুরা অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে নেমে আসছিল নিচের দিকে গুলি করতে করতে। আমিও গুলি। করছিলাম। খানিক পর ছয়টা বুলেটই শেষ হয়ে গেল।শত্রুরা তা টের পেয়েই ধাওয়া করল আমাকে।
| বিপদ টের পেয়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্য ফিরে আসি আমি এই কামরায়। কাপড় চোপড় খুলে ফেলি। প্যান্ট-শার্টের ভিতর কয়েকটা বালিশ গলিয়ে দিয়ে লম্বা একটা ডামি তৈরি করি। জানালার শার্শি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিই নিচের একতলা বাড়িটার ছাদে, যাতে শরা উপর থেকে দেখে ধরে নেয় আমি পালাতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে গেছি। তারপর পানির পাইপ বেয়ে উঠে যাই উপরে। একটা জানালা গলে আশ্রয় নেই একটি কামরায়।
বুদ্ধিমানের কাজ করেছ তুমি শহীদ। ট্যাক্সি ড্রাইভার, শায়লা পারভিন এবং মালেকের কথা শুনে আর কিছু জানতে পেরেছে?’
– ওদের কথা পরিষ্কার বুঝতে পারেনি। একদল লোক ক্রীতদাসের চেয়েও কষ্টে দিন কাটাচ্ছে–এই ধরনের কিছু বলেছে ওরা। ড্রাইভারের কথা শুনে মনে হলো, শায়লা পারভিন ইয়াকুব, মালেক-বহু লোকের সঙ্গে ওরা তিনজনও বন্দি ছিল কোথাও। ওরা পালিয়ে এসেছে কোনক্রমে। বাকি সবাই এখনও বন্দি হয়ে আছে।
কুয়াশাকে গভীর দেখাল। বলল, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, রহস্যের গভীরতা ক্রমশ বাড়বে আরও।
কুয়াশার আস্তানায় ফিরে এল ওরা।
রাসেল অপেক্ষা করছিল ড্রয়িংরুমে। শহীদকে দেখে সহাস্যে বলল, শহীদ ভাই, রহস্যের গন্ধ পেয়ে এসে পড়েছি ঢাকা থেকে।
কুয়াশা ৫৫
শহীদ বলল, ভাল করোনি। শুধু রহস্য নয়, রহস্যের সঙ্গে রক্তশোষক বাদুড়ও আছে।
রাসেল বলল, রক্তশোষক বাদুড়ই থাক আর মানুষখেকো রাক্ষসই থাক, আপনাদের সঙ্গে থাকলে ভয় করি না কাউকে।
কুয়াশী বলল, তোমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে?
রালে পকেট থেকে বের করে ডায়মন্ডের খওগুলো টেবিলের উপর রাখল। কলল, হয়েছে। কিন্তু বিশেষ কিছু জানতে পারিনি, ভাইয়া। এগুলো আফ্রিকার জিনিস, সন্দেহ নেই। কিন্তু আফ্রিকার কোন এলাকার জিনিস তা বলা সম্ভব নয়। এর আগে বিশ্ববাজারে এই ধরনের মূল্যবান পাথর খুব কম দেখা গেছে। গত চার পাঁচ বছর আগে থেকে এই ধরনের পাথর বাজারে আসতে শুরু করে। অন্য সব ডায়মন্ডের চেয়ে এগুলো আলাদা। এগুলোর ঔজ্জ্বল্য অস্বাভাবিক বেশি। ডায়মন্ডের মধ্যে এগুলো সেরা ডায়মণ্ড। কিন্তু এর উৎসস্থল বা রপ্তানী কেন্দ্র সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। আপনার লেটেষ্ট রেফারেন্স বুকে মন্তব্য করা হয়েছে এই ডায়মন্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে যে বা যারাই বিশ্ববাজারে এই ডায়মণ্ড ছেড়ে থাকুক, এর। উৎসস্থল গোপন রাখার জন্য পরিকল্পিত উপায়ে সে বা তারা চেষ্টা করছে। কারণটাও অজ্ঞাত।’
কুয়াশা বলল, ভারি আশ্চর্য ব্যাপার, তাই না? রাসেল বলল, ‘বই।’
ওমেনা ড্রয়িংরূমে ঢুকল। তার হাতে হ্যারিকেন দেখা যাচ্ছে একটা। হ্যারিকেনের মত দেখতে হলেও চিমনি নেই। চিমনির জায়গায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রযুক্ত ইস্পাতের একটা জাল দেখা যাচ্ছে। ওমেনার অপর হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ।
হ্যারিকেনটা টেবিলের উপর রাখল সে। তারপর চামড়ার ব্যাগ থেকে বের করল কয়েক জোড়া বড় আকারের চশমা। সেগুলো নামিয়ে রাখল সে টেবিলের
ডি. কস্টা ড্রয়িংরুমে ঢুকে, খুক করে কাশল।
মুখ না তুলেই মুচকি একটু হেসে কুয়াশা জানতে চাইল, কি খবর, মি. ডি. কস্টা?
| ডি, কস্টা এগিয়ে এসে কুয়াশার মুখোমুখি একটা সোফায় বসল ধীরেসুস্থে। বলল, ‘মি. কামালকে ফোন করিয়াছি। টিনি আসিটেছেন, ‘কপ্টার উড়াইয়া। সিভিল এভিয়েশন ডফটর হইটে বলি-টার আগে বলন:টো বস, রবার্ড নামক একটি আকাশযানের কঠা হাপনার মনে আছে কিনা?
কুয়াশা বলল, মনে নেই মানে? ব্লু-বার্ড জেপলিন জাতীয় আকাশযান ছিল। ব্রিটেনের গ্লাসগো থেকে আফ্রিকার আবিদ অভিমুখে যাত্রা করে জেপলিন রু-বার্ড। পরীক্ষামূলক অভিযান পরিচালনা করছিল ফ্লাইং ক্লাবের একদল শৌখিন সদস্য। তাদের মধ্যে, যতদূর মনে পড়ে, একজন বাঙালীও ছিল। সে আজ বছর বারো আগের কথা। ব্রিটেন থেকে রওনা হবার তিন চার দিন পর নিখোঁজ হয়ে ফল বার্ড। সন্দেহ করা হয় ভূমধ্যসাগরে বিধ্বস্ত হয়েছে সেটা। আজ পর্যন্ত ব্লু-বার্ড এবং
ভলিউম ১৯
তার আরোহীদের কোন খবর পাওয়া যায়নি। শুধু পাইলটের লাশ আবিষ্কৃত হয়েছিল ভূমধ্যসাগরে। রুবার্ডের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা আজও একটা বিরাট রহস্য হয়ে রয়েছে মানুষের মনে।
| ডি, কস্টা সবজান্তার মত মাথা দোলাল। বলল, কারেক্ট। আপনি ঠিকই সব নিউজ রাখেন। হাউএভার, দ্যাট ব-বার্ড, টাহারই সাঙ্কেটিক নাম ছিল Yx03। ইয়েস, একজন বাংলাদেশীও ছিল, টাহার নাম উড়াল চৌভুরী।
কুয়াশা কথা বলল না। কিন্তু তাকে বেশ চিন্তিত দেখল। অকস্মাৎ ঝনঝন শব্দে সবাই চমকে উঠল। ক্রিং ক্রিং••• ফোনের বেল বাজছে। হাত বাড়িয়ে রিসিভার ধুরুল কুয়াশা। বলল, কুয়াশা বলছি।
অপরপ্রান্ত থেকে কেউ দাতে দাঁত চেপে শাসিয়ে উঠল, আমাকে তুমি চিনবে । আমি উত্তাল। তোমার মৃত্যুদূত। কথা বলে অকারণে সময় নষ্ট করার লোক নই আমি। শুধু জানতে চাই, ডায়মণ্ডগুলো দেবে কি দেবে না। হ্যাঁ বা না-একটা উত্তর শুনতে চাই।’
কয়েক সেকেন্ড কথা বলল না কুয়াশা। কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারছে সে–উত্তালই কথা বলছে।
কুয়াশা শান্ত গলায় বলল, ইয়াকুবকে খুন করেছ তোমরা ওই ডায়মন্ডের জন্য, তাই না? মালেককেও খুন করেছ…” | উত্তালের কঠিন কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ইয়াকুবকে বা মালেককে কেন খুন করেছি তার ব্যাখ্যা তোমাকে দিতে হবে নাকি? তবে শুনে রাখো, যাকে আমরা পছন্দ করি না তাকে খুন করতেই আমরা অভ্যস্ত। দরকার হলে তোমাকে, তোমার বন্ধু-বান্ধবকেও খুন করব। এই কাজটা আমরা খুব সহজেই সারতে পারি। ইয়াকুবের.এবং মালেকের হত্যাকাণ্ড দেখে নিশ্চয়ই তা বুঝতে পেরেছ। যাক, এই প্রথম এবং শেষবার তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, কুয়াশা, আমাদের সঙ্গে টক্কর দিতে এসো না। তুমি যত বড়ই বাহাদুর হও, তোমার বিষ দাঁত ভেঙে দিতে মাত্র কয়েক সেকেও লাগবে আমাদের। যাক, ডায়মণ্ডগুলো ফেরত চাই আমরা। ইয়াকুবের ডায়মণ্ডগুলো নয়-শায়লার ডায়মগুলো। ইয়াকুবেরগুলো রেখে দিতে পারো নিজের কাছে। তোমাকে ভিক্ষা দিলাম ওলো। কিন্তু শায়লার ডায়মগুলো ফেরত চাই আমরা। শায়লার কাছে ওগুলো নেই। কোথায়, কার কাছে রয়েছে জিনিসগুলো তা সে বলতে চাইছে না। আমাদের সন্দেহ তোমার বা তোমার কোন লোকের কাছে কোন না কোন উপায়ে পাচার করে দিয়েছে সে গোপনে। এখন জানতে চাই শুধু ফেরত দেবে কিনা।
কুয়াশা বলল, দুঃসাহসের সীমা নেই তোমার, স্বীকার করছি। মরবার জন্য পাখা গজিয়েছে তোমার। দুজন লোককে খুন করেছ, শায়লাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছ–জানো এর শাস্তি কি হতে পারে?
মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করো না বলছি! শাস্তির ভয় উত্তাল বা হাদি হুসেন করে । ডায়মওগুলো ফেরত দেবে না তাহলে তুমি?’
না। তবে শায়লাকে মুক্তি দিলে ডায়মগুলো ফেরত দেবার কথা ভেবে
কুয়াশা ৫৫
দেখতে পারি।’
‘অসম্ভব। ওকে হয় খুন করব, নয়তো হাদির সঙ্গে বিয়ে দেব। হাঃ হাঃ হাঃ .•• |
উকট উল্লাসে গলা ছেড়ে হাসতে শুরু করল উত্তাল। একসময় হাসি নিয়ে সে বলল, “এই তোমার শেষ কথা? দেবে না ফেরত?
না। এই আমার শেষ কথা। উত্তাল অপরপ্রান্তের রিসিভার নামিয়ে রাখল।
মুখ তুলল কুয়াশা। সবাই চেয়ে আছে অধীর উত্তেজনায় তার দিকে। কিন্তু শহীদকে ড্রয়িংরুমের কোথাও দেখল না সে। | একমুহূর্ত পরই লাইব্রেরী থেকে ড্রয়িংরূমে ফিরে এল শহীদ। দ্রুত বলল, লাইব্রেরীর ফোন ব্যবহার করে অপারেটরের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। উত্তাল এই মাত্র ফোন করেছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ থেকে।
সপ্রশংস দৃষ্টিতে শহীদের দিকে তাকিয়ে থেকে কুয়াশা বলল, ধন্যবাদ, শহীদ। এখুনি ছাদের উপর চলে যাও তুমি। “কপ্টার তৈরি আছে-খুঁজে বের করো উত্তালকে।’
ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল শহীদ ড্রয়িংরূম থেকে।
শহীদ বেরিয়ে যেতেই প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হলো সবাই। কিন্তু কুয়াশা চোৰ বন্ধ করে কিছু চিন্তা করছে দেখে কেউ কোন প্রশ্ন করল না।
একমূহত পরই চোখ খুলল কুয়াশা।
মুচকি একটু হাসল সে। লল, মি. ডি. কস্টা, এখুনি আপনাকে হোটেল রেক্স এর কাছে যেতে হবে। হোটেলের পিছনে একটা একতলা বাড়ি আছে, সেই বাড়ির ছাদে পড়ে আছে কয়েকটা বালিশ একত্রিত অবস্থায়, প্যান্ট-শার্ট পরানো। তাড়াতাড়ি যান, নিয়ে আসুন•••
ইয়েস, বসু।’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল ডি কস্টা সোফা ছেড়ে। লাফাতে লাফাতেই বেরিয়ে গেল সে ড্রয়িংরুম থেকে।
ওমেনা জানতে চাইল, কি ব্যাপার, কুয়াশা?
মুচকি হাসিটা আর একবার দেখা গেল কুয়াশার ঠোঁটে। বলল, একটু পরই জানতে পারবে।’
‘ও কিসের শব্দ। রাসেল হঠাৎ বলে উঠল? ওমেনাও শুনল শব্দটা। ছাদে ভারি কিছু পতনের শব্দ হলো যেন।
‘শহীদ ভাই তো অনেক আগেই চলে গেছেন কপ্টার নিয়ে। তিনি কি ফিরে এলেন?
কুয়াশা বলল, না। কামালের আসার কথা ঢাকা থেকে একটা কপ্টার নিয়ে, সেই এসেছে বোধহয়।
কুয়াশার অনুমানই ঠিক। তিন মিনিট পর পাইলটের পোশাকে সজ্জিত সদা হাস্যময় কামাল প্রবেশ করল ড্রয়িংরূমে। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল সে, কেমন
আছ?”
ভলিউম ১৯
এসেছে সে।
কুয়াশা মৃদু হেসে বলল, ভাল।
বসল কামাল কুয়াশার মুখোমুখি। বলল, “কি ব্যাপার বলো তো? এমন জরুরী তলব?”
কুয়াশা সংক্ষেপে সকল ঘটনা বলণ কামালকে।
গল্প গুজবে মিনিট পনেরো কাটল। একসময় ডি কস্টাকে দেখা গেল দোরগোড়ায়। প্যান্ট-শার্ট পরানো তিনটে বালিশ বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে নিয়ে
প্যান্ট শার্ট খুলে ফেলুন, মি. ডি. কস্টা। কুয়াশা নির্দেশ দিল । ডি, কস্টাকে সাহায্য করুল রাসেল।
‘একটা একটা করে তিনটে বালিশের কভার, খোলস ছুরি দিয়ে ছিঁড়ে ফেলো, রাসেল।
পকেট থেকে ছোট একটা ছুরি বের করল রাসেল। একটা বালিশের কভার রাশ রাশ তুলো বেরিয়ে পড়ল। ‘ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেখো কিছু পাও কিনা।
তুলোর ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিতেই কিছু একটা ঠেকল হাতে, বের করে আল সেটা রাসেল।
সেলোফিন পেপারের একটা থলি তুলে ধরুল রালে চোখের সামনে। কি এটা? কি আছে এর ভিতরে? ‘ডায়মণ্ড!’ কুয়াশা বল।
রাসেল দ্রুত পলির মুখের ধাঁধন খুলে ফেলল। থলিটা উপুড় করে ধরতেই অস্বাভাবিক বড় বড় ডায়মন্ডের চল্লিশ-পয়তাল্লিশটা খণ্ড ছড়িয়ে পড়ল কার্পেটের
হিড়ল সে।
উপর।
‘মাই গড! মিলিয়নস স্যাণ্ড মিলিয়ন ডলারের ডায়মণ্ড হামি কাঁধে করিয়া বহিয়া আনিয়াছি, অঠ টাহা জানিটে পারি নাই।
কুয়াশা বলল, দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার পাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন আপনি। তার বদলে দশ লক্ষ ডলারের বেশি মূল্যের ডায়মণ্ড পেয়ে গেছেন। মনে কোন খেদ নেই তো আর?
ওমেনা বলল, কিন্তু ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, কুয়াশা।’
কুয়াশা বলল, এই বালিশগুলো শহীদ শায়লা পারভিনের হোটেল রূমের জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল নিচে, শত্রুদেরকে ধোকা দেবার জন্য। শায়লা বালিশের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিল ডায়মণ্ডগুলো কিন্তু শহীদের তা জানবার কথা নয়। ব্যাপারটা আমার মনেও উদয় হয়নি। উত্তাল ফোন করে জানাল যে শায়লার ডায়মণ্ডগুলো তারা পায়নি কথাটা শুনেই বুঝলাম জিনিসগুলো হোটেলেই থাকার কথা। কিন্তু হোটেলের কামরায় সেগুলো নেই। তাহলে গেল কোথায়? অনুমান করলাম, ওই বালিশের ভিতরই আছে•• ||
বুঝেছি।’ টেবিলের উপর রাখা ওয়্যারলেস সেটটা জীবন্ত হয়ে উঠল হঠাৎ।
৩~-কুয়াশা ৫৫
ভেসে এল শহীদের কণ্ঠস্বর।
ছয়
কপ্টার থেকে তরল ফুরোসেন্ট লোশন উত্তালের ট্যাক্সির ছাদে স্প্রে করে দিয়েছি আমি। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে তীরবেগে ছুটছে ট্যাক্সিটা। ‘কপ্টার নিয়ে অনুসরণ করতে কোন অসুবিধেই হচ্ছে না আমার। ফুরোসকোপিক চশমা পরে আছি, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, জ্বলজ্বল করে রেডিয়ামের মত জ্বলছে ট্যাক্সির ছাদে লোশন। একাই ছিল ট্যাক্সিতে উত্তাল সম্ভবত। খানিক আগে অন্ধকার একটা গলির মুখে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়েছিল। আলোর অভাবে কিছুই দেখতে পাইনি আমি। তবে, মনে হয়, হাদি হুসেন এবং শায়লাকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়েছে সে গলির মুখ থেকে। ট্যাক্সি ছুটছে দক্ষিণ দিকে।
, কুয়াশা বলল, “উত্তাল বা হাদি হুসেন মুখে যত বড় বড় কথাই বলুক, ওদের পরিকল্পনা অন্যরকম বলে মনে করি আমি। ইয়াকুব এবং মালেককে খুন করেছে ওরা, শায়লাকে বন্দি করেছে–সূতরাং এখন ওরা অকারণে বিপদে জড়িয়ে পড়তে চাইবে না। হুমকি দিলেও আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করবে বলে মনে হয় না। আমার বিশ্বাস, ওদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেছে–এখন ওরা কেটে পড়বার চেষ্টা করবে। শহীদ, অনুসরণ করে যাও। আমরাও গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছি। ওদেরকে পালাতে দেয়া হবে না।’
কুয়াশার শেষের কথাগুলো কঠিন শোনাল। উঠে দাঁড়াল সবাই সোফা ছেড়ে।
কুয়াশা বলল, তোমরা সবাই তৈরি তো? প্রয়োজনীয় কোন জিনিসই নিতে যেন ভুল না হয়।
ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। যে যার ব্যাগ ভরে লি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে। ডায়মণ্ডগুলো তুলে রাখল কুয়াশা একটা আয়রন সেফে।
আচমকা ভেসে এল শহীদের কণ্ঠস্বর। কুয়াশা। আবছা আলোয় দেখলাম ছুটন্ত ট্যাক্সি থেকে উত্তাল কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল রাস্তার পাশে! দেহটা পরিষ্কার দেখেছি আমি।’
সবাই চেয়ে আছে কুয়াশার দিকে। সবাই গম্ভীর, চিন্তান্বিত।
ইতিমধ্যেই দুজন লোককে খুন করেছে উত্তাল এবং হাদি হুসেন। সম্ভবত আরও একজন খুন করল সে। বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছে শয়তানদুটো।
নির্দেশ দিল কুয়াশা, নিচে নামো, শহীদ। দেখো কার দেহ ওটা। “ঠিক আছে। বলল শহীদ।
কুয়াশার পিছন পিছন রাজকুমারী ওমেনা, কামাল, ডি. কস্টা এবং রাসেল বেরিয়ে এল করিডরে। এলিভেটরে চড়ে নামল ওরা নিচে।
মার্সিডিসে চড়ল ওরা সবাই। ড্রাইভিংসীটে উঠে বসল কুয়াশা। রেডিও ওয়্যারলেস সেটটা অন করল সে।
শহীদের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, রাস্তার পাশে উঁচু একটা মাটির ঢিবিতে নামছি
৩৪
ভলিউম ১৯
আমি…।’
ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে কপ্টারের যান্ত্রিক কোন শব্দ ভেসে আসছে না। কারণ, রকেটে যে ধরনের সলিড ফুয়েল ব্যবহার করা হয়, কুয়াশার ‘কপ্টারের বিশেষ ধরনের এঞ্জিনে সেই সলিড ফুয়েল ব্যবহার করা হয়। নামার বা ওঠার সময়ই শুধু রোটর রেড ব্যবহার করা হয় তখন শব্দ শোনা যায়।
খানিক পর আবার শহীদের গলা শোনা গেল, কুয়াশা! লোকটা ট্যাক্সি ড্রাইভার | ড্রাইভার ট্যাক্সিতেই ছিল–এখন বুঝতে পারছি।
বেঁচে আছে? কুয়াশা জানতে চাইল।
না। মাথায় একটা ক্ষতচিহ্ন, সম্ভবত বুলেটের। ওরা জাত-ধুনী! ঠাণ্ডা মাথায় অকারণে খুন করতে এদের হাত কাঁপে না।’
কুয়াশা থমথমে গলায় বলল, ওদের খুন করতে আমাদের হাতও এতটুকু কাপবে না! তুমি এখন ঠিক কোথায়, শহীদ?
সাতকানিয়ার কাছাকাছি। সম্ভবত মাইল তিনেক সামনে সাতকানিয়া শহর।
মার্সিডিজের স্পীড বাড়িয়ে দিল কুয়াশা। স্পীডমিটারের কাটা কাঁপতে লাগল ৯০-এর ঘরে পৌঁছে।
তিন মিনিট পর শহীদ জানাল, হাইওয়ে ছেড়ে ট্যাক্সি একটা সাইড রোডে ঢুকেছে। এদিকে অনেকগুলো কৃষি ফার্ম আছে বলে জানি।’
কুয়াশা একহাতে ধরে আছে গাড়ির হুইল। তার অপর হাতে ওয়্যারলেস সেটের মাউথপীস, সেটা মুখের সামনে তুলে ধরে কথা বলে উঠল সে, সাতকানিয়া থেকে মাইল দশেক পিছনে এখনও আমরা। তুমি পিছিয়ে এসে তুলে নিতে পারবে আমাদেরকে কপ্টারে? ট্যাক্সিটাকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকলে দরকার নেই।
‘হারাবার ভয় নেই। বাক নিচ্ছি আমি।’
দুই মিনিট পর মাথার উপর দেখা গেল ‘কপ্টারের লাল আলো। গাড়ি থামাল কুয়াশী।
প্রশস্ত রাস্তার উপর নেমে এল ‘কপ্টার।
ইতিমধ্যে ফুরোসকোপিক চশমা পরে নিয়েছে সবাই। যে যার ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। কপ্টারের দিকে ছুটল সবাই একসঙ্গে।
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আবার আকাশে উড়ল ‘কপ্টার। মিনিট পাঁচেক পর শহীদ বলল, ‘ওই যে দেখা যাচ্ছে সামনে।
সবাই দেখল জ্বলজ্বল করে জ্বলছে লিকুইড ফুরোসেন্ট লোশন ট্যাক্সির ছাদে। অন্ধকারে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। মাটি থেকে অনেক উঁচুতে কপ্টারটা। | নিচের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে ট্যাক্সিটা। হেডলাইট জ্বলছে, কিন্তু সেই আলোয় সামনের রাস্তার কিছুটা আলোকিত দেখাচ্ছে মাত্র। রাস্তা বা রাস্তার আশপাশের এলাকা সম্পর্কে কিছুই জানার উপায় নেই। দুরে দুরে দুটো একটা আলোর ক্ষীণ টুকরো কদাচ চোখে পড়ছে কি পড়ছে না।
কুয়াশা ৫৫
কুয়াশা বলল, শহীদ, এক কাজ করো। ট্যাক্সিটাকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাই আমরা। বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে রাস্তার ওপর নামাও ‘কপ্টার। ওমেনার তৈরি কয়েকটা গাস বোমা রাস্তার উপর ফাটিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করব আমরা। ট্যাক্সি রাস্তা অতিক্রম করার সময় শত্রুর আক্রান্ত হবে গ্যাসে। কপ্টার এমন এক জায়গায় নামাও যেখানে রাস্তা খুব সুবিধের নয়। ভাঙাচোরা রাস্তা দেখে ওরা স্পীড কমাবে–তখনই আক্রান্ত হবে গ্যাসে। ফলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা। থাকবে না। ওদেরকে আমরা জীবিত বন্দি করতে চাই।’ | ডি. কস্টা বলে উঠল, বণ্ডি করিবার পর উহাড়েরকে হামার হাটে ছাড়িয়া ডিবেন, প্লীজ। ইহা হামার অনুরোড । উহাড়ের চামড়া টুলিয়া নিয়া হামি লঙ্কা.গুড়া ছিটাইয়া ডিটে চাই!
রাসেল বলল, ‘ওদেরকে বন্দি করে জেরা করলেই জানা যাবে ডায়মণ্ডগুলো কোথা থেকে এসেছে।’
| কুয়াশা বলল, আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ওদের কাছ থেকে পেতে চাই আমি। শতাধিক লোক ক্রীতদাসের মত বন্দি জীবন কাটাচ্ছে–এ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য না জানা পর্যন্ত দুর্ভাগা লোকগুলোকে উদ্ধারের কোন চেষ্টা করা সম্ভব হবে না। ওদের সম্পর্কে জানার পর থেকে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছি।’
শহীদ কপ্টারের কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ, লিভার ইত্যাদি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত করে তুলেছে। ট্যাক্সিকে পিছনে ফেলে মাইল কয়েক সামনে চলে এসেছে। কপ্টার। মাটির খুব কাছাকাছি দিয়ে উড়ছে এখন ‘কপ্টার। সার্চ লাইট জ্বেলে নিচের রাস্তা পরীক্ষা করছে সে। মিনিট দুয়েক পর কথা বলল ও, কপ্টার নামাচ্ছি।’
খুব সুন্দর জায়গা পেয়েছ,’ মন্তব্য করল কুয়াশা। রাস্তার উপর নামল কপ্টার। রাস্তার দু’পাশে হালকা বনভূমি। রাত বেশ হয়েছে, এদিকের রাস্তায় যানবাহন বড় একটা দেখা যায় না!
নির্জন, অন্ধকার রাস্তা। সার্চ লাইট অফ করে দিল শহীদ। একে একে নামল সবাই নিচে। কুয়াশার হাতে হ্যারিকেনের মত দেখতে ইনফ্রারেড আলোক নিক্ষেপক যন্ত্রটা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার রাস্তা আলোকিত হয়ে উঠেছে। ওদের প্রত্যেকের চোখে রয়েছে ফুরোসকোপিক চশমা।
খালি চোখে ইনফ্রারেড আলো দেখা সম্ভব নয়।
দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে কুয়াশা। সবাই অনুসরণ করছে তাকে। কিছুদূর এগিয়েই পাল সে। সামনেই একটা বাক। এদিকে রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো, উঁচু-নিচু।
বাকের কাছাকাছি দাঁড়াল কুয়াশা। গ্যাস-মা পরল সে। কাউকে কিছু বলতে হলো না, সবাই তার মত একটা করে গ্যাস-মাস্ক পরে নিল।
সকলের দিকে একবার করে তাকাল কুয়াশা। তারপর নিজের ঢোলা আলখেল্লার পকেট থেকে বের করুল গোটা চারেক গ্যাস বোমা।
একটা একটা করে চারটে বোমাই সামনের বাকের দিকে ছুঁড়ে দিল কুয়াশা। চুপ চুপ শব্দে বিস্ফোরিত হলো বোমাগুলো।
বাতাস নেই বললেই চলে। বোমাগুলো ফাটতেই সাদাটে ধোয়ায় ঢাকা পড়ে গেল সামনের জায়গাটা।
৩৬
ভলিউম ১৯
হালকা কুয়াশার মত ধোয়া দেখে শত্রুরা কোনরকম সন্দেহ করবে বলে মনে হয় না। সন্দেহ করবার সময়ও তারা পাবে না। বাক নিলেই ধোয়ার মধ্যে প্রবেশ করবে ট্যাক্সি।
অপেক্ষার পালা এখন।
সময় বয়ে চলেছে। কান পেতে আছে সবাই। ঘনঘন তাকাচ্ছে সবাই কুয়াশার দিকে। সবাই জানে, অত্যন্ত শক্তিশালী শ্রবণেন্দ্রিয় রয়েছে কুয়াশার। সাধারণ মানুষ যা শুনতে পায় না, কুয়াশী তা অনায়াসে শুনতে পায়।
‘কিছু শুনতে পাচ্ছ?’ জানতে চাইল ওমেনা । কুয়াশা বল, ‘না।’
ওমেনা গভীর মনোযোগের সঙ্গে চেষ্টা করলে অনেক অদৃশ্য ঘটনা সম্পর্কে প্রায় সত্যের কাছাকাছি বর্ণনা দিতে পারে। চোখ বন্ধ করে ধ্যান করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল সে কুয়াশার পাশে।
চিন্তিত দেখাচ্ছে কুয়াশাকে। এত দেরি হবার তো কথা নয়। এতক্ষণে ট্যাক্সিটা পৌঁছে যাবার কথা রাস্তার বাকে।
চোখ মেলল ওমেনা। বলল, ট্যাক্সিটা অন্য দিকে চলে গেছে। অন্তত এদিকে আসছে না সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি।’
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। কারও মুখে কোন কথা নেই। কি ঘটেছে বুঝতে বাকি রইল না কারও। শত্রুরা হয় তাদের ফাঁদের কথা টের পেয়ে গেছে নয়তো তাদের গন্তব্যস্থান অন্য দিকে বলে এদিকে আসেনি••• |
ছুটল কুয়াশা। তাকে অনুসরণ করল সবাই। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কুশী। বলল, ‘ও কিসের শব্দ। সবাই শুনতে পেল যান্ত্রিক শব্দটা। রাসেল বলল, ট্যাক্সিটা আসছে নাকি?
কুয়াশা বলল, না। ট্যাক্সির শব্দ নয় ওটা রাসেল । শব্দটা ভাল করে লক্ষ করো। ওটা একটা প্লেনের শব্দ। এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট সেনা প্লেন, সম্ভবত।’
সাত
ঝোঁপ-ঝাড়, হালকা ভূমির পর উন্মুক্ত প্রান্তর।
বিরাট, বিস্তীর্ণ এই পাহাড়ী এলাকায় প্রচুর পরিমাণে কাজুবাদামের চাষ হচ্ছে। প্রতি বছর এই সময়টায় বাদাম খেতে এক ধরনের ক্ষতিকারক পোকার আক্রমণ হয়। বিশাল এলাকা জুড়ে খেত, তাই ওষুধ ছিটাবার জন্য কৃষি দফতর একটা প্লেন ঢাকা থেকে এখানে বছরের এ সময়টায় পাঠায়। তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে ওষুধ ছিটাবর কাজ শেষ করে সেসনা প্লেনটা আবার ঢাকায় ফিরে যায়।
ঘন অন্ধকারে ঢাকা চারদিক। প্লেন রাখার অস্থায়ী হ্যাঁঙ্গারটা শূন্য। হ্যাঁঙ্গারের সামনে কয়েকজন শার্ট-প্যান্ট পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে। নিচু স্বরে কথা বলছে তারা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রায়ই চোখ তুলে তাকাচ্ছে অন্ধকার আকাশের দিকে। খুব বেশিক্ষণ হয়নি, প্লেনটা আকাশে উড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
কুয়াশা ৫৫
কয়েকশো একর জমির মালিক ওবায়দুল সরকার কথা বলছে। কৃষি দফতরের অফিসার জাকির হোসেনের সঙ্গে প্রায় তর্কই হচ্ছে তার।
ওবায়দুল সরকারের বক্তব্য, কাজটা ভাল হয়নি।’
‘খারাপটা হয়েছে কি? হাদি হুসেন আর উত্তাল বলছে, ডায়মণ্ড খনির মালিক ওরা। অদূর ভবিষ্যতে তারা আমাদেরকে টাকা রোজগারের ব্যবস্থা করে দেবে আরও। ওদেরকে বিশ্বাস করা দোষের কিছু হয়নি। তাছাড়া, ওরা প্লেন চালাতেও জানে না। আমাদের লোককে নিয়ে গেছে তাই। আমাদের পাইলট এনামূল কবীর বুদ্ধিমান তো বটে, সাহসীও | সে ওদেরকে সুন্দরবনে পৌঁছে দিয়েই ফিরে আসবে। তোমার ভয়ের কারণটা আমি এখনও বুঝতে পারছি না। এমন কল্পনাতীত সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিত হত? চার লাখ টাকা। আমরা দুজন এক লাখ করে, এনামূল কবীর দু’লাখ । ছেলেখেলা কথা নাকি! সারাজীবনে এক লাখ টাকার মুখ দেখার কথা ভাবতে পারতে? তুমি কি ভাবছ ওরা প্লেনটা নিয়ে পালাবে? কিন্তু স্বাভাবিক বুদ্ধিতে কি মনে হয় বলো তো? আফ্রিকায় যাবে ওরা। ছোট্ট একটা প্লেন নিয়ে কেউ আফ্রিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবার কথা ভাবতে পারে?
ওবায়দুল সরকার বলল, বেশ। যা হবার হয়েছে। দেখা যাক কি হয়। ভালয় ভালয় এনামুল কবীর প্লেন নিয়ে ফিরে এলেই হয় এখন। কবে নাগাদ ফিরবে বলে মনে করো?
‘আগামীকালই ফিরবে। সুন্দরবনে ওরা আজ রাতেই পৌঁছে যাবে। সকালে রওনা হবে, পৌঁছে যাবে বেলা বারোটা একটার দিকে।
ওবায়দুল বলল, তাহলে ভালই। আমি কিন্তু চুপ! হঠাৎ উত্তেজিত চাপা কণ্ঠে বলে উঠল অপর একজন লোক। “কি হলো।’ কাছাকাছি কেউ থাকলেও, অন্ধকারে তাকে দেখতে পাবার কথা নয় । ওবায়দুল বলল, আমিও কেমন যেন একটা শব্দ পেলাম। হ্য। পায়ের শব্দ। কিন্তু এই অন্ধকারে কে আসবে? জাকির হোসেন চিৎকার করে উঠল, কে?’ কেউ সাড়া দিল না। কিন্তু নিকটবর্তী জঙ্গলের ঝোঁপ-ঝাড় নড়ে উঠল। কিছু না, শিয়াল-টিয়াল হবে।’
জাকির হোসেন বলল, তবু, সাবধানের মার নেই। হাদি হুসেনরা নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করছিল মনে আছে? কারা যেন অনুসরণ করছিল ওদেরকে। যাকগে, আমাদেরকে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না। সব আলোচনার শেষ হোক
এখানেই। যে-যার বাড়ি ফিরি চলো।’
ইনফ্রারেড হ্যারিকেন নিয়ে ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এল কুয়াশা। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।
শহীদ ছাড়া বাকি সবাই প্রশ্ন করতে শুরু করল। কোথায় গিয়েছিল কুয়াশা, কি কি জানতে পেরেছে সে-ইত্যাদি প্রশ্ন।
ভলিউম ১৯
কুয়াশা কারও কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘আমাদেরকে যেতে হবে সুন্দরবনে। কিন্তু তার আগে ওয়্যারলেসে খবর পাঠাতে হবে আমার লোকদের।’
আকাশে উড়ল কপ্টার। চট্টগ্রাম শহরের দিকে চলল ওরা।
সবাই গভীর। কুয়াশা অনেক ব্যাপার জানতে পেরেছে, অথচ কিছু প্রকাশ করছে না।
খানিক পর অবশ্য নিজে থেকেই মুখ খুলল কুয়াশা। বলল, “হাদি হুসেন আর উত্তাল চৌধুরী স্থানীয় একদল অসৎ লোকের সহযোগিতায় পালিয়েছে। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই এদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল ওরা, বোঝা গেছে। ছোট্ট একটা প্লেন নিয়ে সুন্দর বনের দিকে গেছে ওরা । সুন্দরবনের ঠিক কোথায় তাদের গন্তব্যস্থান তা আমি জানতে পারিনি।
ওবায়দুল এবং জাকিরের কথোপকথন ওদের কাছ থেকে মাত্র পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে শুনেছে কুয়াশা। যা যা সে শুনেছে সব বলল ধীরে ধীরে।
এরপর ওদের মধ্যে বিশেষ কোন কথাবার্তা হলো না। ডি. কস্টা গুন গুন করে গান গাইতে শুরু করল। কিন্তু বিশ মিনিট পর দেখা গেল সীটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে
সে। তার নাক ডাকার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
কমিনিট পর সবাই নড়েচড়ে বসল। কপ্টার পৌঁছে গেছে। ডি. কস্টা ঘুমাচ্ছে দেখে রাজকুমারী ধাক্কা দিল তার গায়ে। চোখ মেলে পিট পিট করে তাকাল ডি. কস্টা। ভীষণ বিরক্ত হয়েছে সে। চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলে উঠল সে, কালারফুল স্বপ্ন ডেকিটেছিলাম। হামি আফ্রিকার রানী ইনাপুটিককে বিবাহ করিয়া কিং হইয়া গিয়াছি’ • হাড়ে অ্যাও টোয়েনটি ফোর সন্টানের পিটা হইয়াছি••• ||
ব্যস! ব্যস!’ ওমেনা বলে উঠল, ‘ভালই করেছি ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে। নইলে আর কমিনিট স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেলে আপনি কয়েক হাজার সন্তানের পিতা হয়ে যেতেন। ফ্যামিলি প্ল্যানিং আপনি একাই ব্যর্থ করে দিতেন আর একটু হলে।
কুয়াশা কপ্টার থেকে নামতে নামতে বলল, ‘ওমেনা, ফুয়েলের ব্যবস্থা করো তোমরা। শহীদ, আমার সঙ্গে এসো। যার যার ব্যাগ-ব্যাগেজ পরীক্ষা করে দেখে নাও তাড়াতাড়ি। আমরা খানিক পরই রওনা হব।’
কন্ট্রোলরূম থেকে শক্তিশালী ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে কুয়াশা তার বিভিন্ন আস্তানায় খবর পাঠাতে সময় ব্যয় করুল প্রায় আধঘণ্টা }
খুলনার আস্তানায় লোকজনের সংখ্যা এই মুহূর্তে কম। যে দশ-বারো জন আছে তাদের মধ্যে থেকে আবার পাঁচজন গেছে সুন্দরবনে। সেখানে তারা অস্থায় ক্যাম্প তৈরি করে আছে। ওয়্যারলেস সেট একটা আছে বটে, কিন্তু সেটা তেমন
শক্তিশালী নয়।
কুয়াশা খুলনার অনুচর হেদায়েত উল্লাকে নির্দেশ দিল, ‘তুমি একটা স্পীডবোট নিয়ে এখুনি রওনা হয়ে যাও আমাদের সুন্দরবনের ক্যাম্পের উদ্দেশে। ওয়্যারলেস সেটটা নিতে ভুলো না। আমি আজ রাতেই পৌঁছুব খুলনায়, তারপর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব। ইতিমধ্যে তুমি সুন্দরবনে কোন প্লেন বা সন্দেহজনক চরিত্রের
কুয়াশা ৫৫
লোকজন দেখা গেছে কিনা জেনে নেবে। আমার বিশ্বাস, হাদি হুসেন আর উত্তাল চৌধুরীর একটা আস্তানা আছে ওখানে। অদ্ভুত আকৃতির কোন আকাশযান নামতে পারে সুন্দরবনের কোথাও।’
এরপর কুয়াশা পটুয়াখালির আস্তানার সঙ্গে যোগাযোগ করল। সেখান থেকে তার অনুচর বাহাদুর খান মজলিশ জানাল, বেশ খানিক আগে শহরের উপর দিয়ে ছোট একটা প্লেন উড়ে গেছে।•••না, দেখিনি, ভাইয়া, শব্দ শুনেছি শুধু।
কোনদিকে গেছে বলে মনে হয়? মজলিশ জানাল, পশ্চিম দিকে, ভাইয়া।
কুয়াশা বলল, ঠিক আছে। আবার সেই প্লেনের শব্দ পেলে আমাকে জানাবে। আমি খুলনায় যাচ্ছি।’
সেট অফ করে দিয়ে কুয়াশা শহীদের দিকে তাকাল। বলল, হার্দি হসেন আর উত্তাল আফ্রিকার উদ্দেশে পাড়ি দেবার আগেই ধরতে হবে ওদের। ওদের সঙ্গে কিংবা ওদের পিছু পিছু যেতে হবে আমাদের।
শহীদ বলল, অবশ্যই। কিন্তু ওদের সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না, কুয়াশা। তাছাড়া, রক্তচোষা বাদুড়:এর সঙ্গে ক্রীতদাস বা ডায়মণ্ড মাইন-এর কি
যে সম্পর্ক তাও কিছু বুঝতে পারছি না।’ | কুয়াশা বলল, বুঝতে আমিও পারছি না। সেই জন্যেই হাদি হুসেনদেরকে পালিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। ওরা একবার চোখের আড়ালে চলে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
ইতিমধ্যে কতদূর চলে গেছে ওরা তাই বা কে জানে।
কুয়াশা বলল; নিরাশ হয়ো না। আমার বিশ্বাস এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ ত্যাগ করে যেতে পারেনি ওরা। শহীদ, তুমি সবাইকে নিয়ে কপ্টারে চড়ো। আমি মহুয়াকে ফোন করেই যাচ্ছি।
মেঘে ঢাকা নিকষ কালো রাত। উঁচু আকাশ দিয়ে প্রায় নিঃশব্দে ছুটে চলেছে কুয়াশার কপ্টার। শহরগুলোর উপর দিয়ে যাবার সময় দুটো একটা ক্ষীণ আলোর বিন্দু অনেক নিচে দেখা গেল, তারপর আবার নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের ঘন দেয়াল, কিছুই
দেখবার উপায় নেই।
‘খুলনায় প্রবেশ করেছি আমরা,’ কামাল বলল।
ওমেনা জানতে চাইল, ‘আস্তানায় পৌঁছেই আমরা কিছু না কিছু খবর পাব, তাই না, কুয়াশা?’
কুয়াশা সংক্ষেপে উত্তর দিল, আশা করছি।’
চোখ দুইটিকে নিয়া বড্ডই প্রবলেমে পড়িয়াছি। কামাল জানতে চাইল, “কি রকম?’। বণ্ড হইয়া যাইটেছে বারবার, আই মীন ঘুম পাইটেছে।
ওমেনা বলল, “বিছুটি পাতা, লবণ আর লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে তৈরি একটা পাউডার আছে আমার ব্যাগে। ছড়িয়ে দেব খানিকটা আপনার চোখে? অন্তত আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুম আসবে না।
৪০
ভলিউম ১৯
হেসে উঠল কামাল, বলল, “ঘুম তো আসবেই না, মহানন্দে ধেই ধেই করে নাচবেন আপনি।
| ডি, কস্ট অগ্নিদৃষ্টি হানল ওমেনা এবং কামালের দিকে। রাগে সে কথাই বলতে পারল না কিছুক্ষণ। তারপর, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, হামি আগেই সহে করিয়াছিলাম, আপনারা আমার বিরুডেড একটা ডল টৈরি করিয়াছেন। ইচ্ছা করিলে হামিও একটা ডা টৈরি করিটে পারি, কি বৃহট্টর স্বার্টে মি টা চাহি না। টবে, হামাকে আপনারা ডুর্বল মনে করিবেন
। ইচ্ছা করিলে আমি আপনাদেরকে এক হাত দেকাইটে পারি।’
রালে বলল, মি. ডি কস্টা, আমি আপনার •ঙ্গে আছি।’ | ঝট করে তাকাল ডি, কস্টা রাসেলের দিকে, মুখ ভেংচে বলে উঠল, হামি আপনার সাটে নাই! হানি একাই একশো, হাপনাকে ডলে নিব কোন ভুঃখে?। | নড়েচড়ে বসল ডি. কস্টা, টবে শুনুন, হামার নিজের সম্পর্কে ডুটো একটা কঠা বলি। আজি হইটে ডশ বছর পূর্বে হামি জেরুজালেমের এক অভিজাট। এলাকায় বাস করিটাম। মুসলিম এবং খ্রীষ্টানডের মড্যে একবার টুমুল ডাঙ্গা লাগিল । হামি খ্রীষ্টান হইলেও খ্রীষ্টানডের পক্ষে ডাঙ্গায় যোগ ছিলাম না, নিউট্রাল। রহিলাম, ফলে, খ্রীষ্টানরা হামার উপর খেপিয়া গেল। টাহার উপর হামি ডুই ডলকে একট্রিট করিয়া বাগড়া মিটাইয়া ডিবার চেষ্টা করিটেছি ডেকিয়া উভয় সম্প্রড়ায় হামার উপর খেপিয়া উঠিল। ডুই ডলই ডিসিশন নিল, আমাকে মার্ডার করিবে, কারণ হামি টাহাড়ের উভয় পক্ষের দুশমন। একডিন, রাস্টা ডিয়া একা হাঁটিটেছি, ডেকি দুই ডিক হইটে দুই ডলের গুণ্ডা পাণ্ডারা আমাকে মার্ডার করিবার জন্য ছুটিয়া আসিটেছে।’
. তারপর!’ সাগ্রহে জানতে চাইল কামাল, আপনি নিশ্চয়ই হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলবেন?
| ডি কস্টা কামালের কথায় কান না দিয়ে বলে চলল, ডুই ডলু হামার কাছাকাছি আসিয়া ডাইল। দুই ডলের মাঝখান হামি একাখ্রীষ্টানরা বুলিল, মি. ডি কস্টা, হাপনি হামাডের উলে যোগ ডিন। মুসলিমরা বলিল, মি. ডি. কস্টা, হাপনি হাড়ের ডলে যোগ ডিন
আপনি কি করলেন?’
‘হামি বলিলাম, টোমরা দুই ভুলই নীটিহীন, অডর্শ হীন। হামি ন্যায়ের ডলের লোক, হামি কাহারও ডলে যোগ ডিব না। টোমরা আমার ডলে যোগ ড়াও। হামার এই কঠা শুনিয়া ডুই ডলই হৈ-হৈ রৈ রৈ করিটে করিটে আমার ডিকে ছোরা, টরোয়াল, বর্শা উচাইয়া ছুটিয়া আসিল। বুঝিটে পারিলাম, উহারা আমাকে মার্ডার
করিবে। হামি হোঃ হোঃ শব্দে হাসিয়া উঠিলাম।’
| ‘হেসে উঠলেন? বলেন কি? পাগল হয়ে গিয়েছিলেন বুঝি?’ ওমেনা সবিস্ময়ে জানতে চাইল।
কামাল বলল, মৃত্যু অবধারিত জেনেও আপনি হেসে উঠলেন? অব…!
ডি. কস্টা বিরক্তির সঙ্গে ধমকে উঠল, “আহ! ঠামুন! হামার কঠা শুনুন, টারপর যটো পারেন ক্রিটিসাইস করিবেন।’
বলুন তাহলে। কি হলো তারপর?
কুয়াশা ৫৫
কামাল এবং ওমেনা সাগ্রহে চেয়ে রইল ডি. কস্টার দিকে। ডি. কস্টা হাসতে হাসতে শুরু করল আবার, হাসিটে হাসিটে হামি.হামার কোটের দুই পকেট হইটে বাহির করিলাম ডুইটি মহামূল্যবান পুস্টক। একটি পট্রি কোরান, অন্যটি পবিট্র বাইবেল। দুই হাট ডিয়া পুস্টক দুইটি দুই ডলের ডিকে বাড়াইয়া ঢারিয়া রাখিলাম। ডেকিলাম, দুই ডলই ঠমকাইয়া ভঁড়াইয়া পড়িয়াছে। হামি মুসলিমদের ডিকে টাকাইয়া বন্ধ কণ্ঠে বলিলাম, টোমরা যাহারা খোডাকে মানো, যাহারা পট্রি কোরান পাকে বিশ্বাস রাখো, টাহারা হামার ডলে যোগ ডাও। খ্রীষ্টানডের দিকে টাকাইলাম টারপর। বলিলাম, টোমরা যাহারা সত্যিকার যীশুর সন্টান, যাহারা
পট্রি বাইবেলে বিশ্বাস রাখো, হারা হামার ডলে য়োগ ডাও।’
তারপর।’ | যাডুমরে মটো কাজ হইল। ডুইজন একজন করিয়া আগাইয়া আসিল ডুইডল হইটেই। টাহার পর, ডেকাডেকি, সকলেই আমার ডলে যোগ ডিল। উহাডেরকে হামি বলিলাম, খ্রীষ্টান অ্যাণ্ড মুসলিম ভাই ভাই। টোমরা অকারণে ডাঙ্গ করিটেছ। হামার উপর এই ডাঙ্গা ঠামাইবার ডাট্টি ডাও, টোমাডের উপকার হইবে টাহাটে। বলিলাম, কামন, সবাই প্রতিজ্ঞা করি, আজ হইটে ভাঙ্গা করিব।
। শুডু টাহাই নহে, যাহারা ডাঙ্গা করিবে টাহারা হামাডের এনিমি, টাহাড়েরকে শায়েস্টা করিব। বলিলাম, এই ডাঙ্গার জন্য মুসলিম বা খ্রীষ্টানরা ডায়ী নহে, ডায়ী। ইহুডিরা। টাহাড়ের চর আমাডের মডে লুকাইয়া আছে। টাহাড়েরকে খুঁজিয়া। বাহির করিটে হইবে। আমার শেষ কঠাটা সকলের মনে দাগ কাটিল। সডলবলে হামরা শহরে প্রবেশ করিলাম, খুঁজিয়া খুঁজিয়া বাহির করিলাম ইহুডি চরডের, টাহাডের বণ্ডি করা হইল। সেই ডিন হইটে ডাঙ্গা ঠামিল। হামি মুসলিম এবং খ্রষ্টানডের মডে পপুলার হইলাম। হামার জনপ্রিয়টা এটই বাড়িয়া উঠিল যে দুই সম্প্রডায়ের টোরা আমাকে লাটসাহেব পডের জন্য ইলেকশনে উঁড়াইবার জন্য অনুরোড করিটে লাগিল–বাধ্য হইয়া আমাকে পলাইটে হইল। জেরুজালেম হইটে পালাইয়া হামি ঢাকায় চলিয়া আসিলাম•••’।
‘পালাতে হলো? সে কি! কেন?’
ডি, কস্টা মৃদু হাসিতে বাকাচোরা মুখটাকে আরও এবড়োখেবড়ো করে তুলে বলল, “জানেনই টো, হামি ক্ষমটালোভী নই। ক্ষমটা পাইলে মানুষ আর্শহীন হইয়া পড়ে, জনপ্রিয়টা হারাইয়া ফেলে । হামি তখনও টাহা চাহি নাই, আজও টাহা চাই
। পাওয়ারের প্রটি আমার লোভ ঠাকিলে কটো ডেশ জয় করিটে পারিতাম, কটো রাজা-উজীরকে পরাজিট করিয়া আলেকজাণ্ডার ডি গ্রেটকে স্নান করিয়া ডিটে পারিটাম, কিন্টু টাহা করি নাই শুড় একটি কারণে-ক্ষমতার প্রটি আমার কোন লোভ নাই। হাঁপনারা আমাকে জবড় করিটে চেষ্টা করেন, প্রায়ই ব্যাপারটা লক্ষ করি, কিন্তু কিছু বুলি না। ইচ্ছা করিলে, হামি একাই হাপনাডেরকে ঘোলাপানি খাওয়াইটে পারি, কিন্টু।
কুয়াশার কণ্ঠস্বর শোনা গেল এমন সময়। ডি, কস্টা চুপ করে গেল তাই। কুয়াশা বলল, ‘কপ্টার নামছে। আমরা খুলনার আস্তানায় পৌঁছে গেছি।’
Leave a Reply