৫৪. তুষার নগরী ২ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৫৪
প্রথম প্রকাশ: জুলাই, ১৯৭৬
কুয়াশার পতনের শব্দ হবার পরপরই দুটো টর্চ জ্বলে উঠল। লাফাতে লাফাতে কামরার ভিতর প্রবেশ করল উলন এবং শিকদার।
কুয়াশা যাদের কথা শুনেছিল টিবি থেকে নামার পর তারা আর কেউ নয়, উলন। এবং শিকদারই। কুয়াশা আশেপাশেই আছে অনুমান করে অভিনয় করছিল ওরা, কুয়াশাকে ভুল বুঝিয়ে ফাঁদে ফেলবার জন্যই তাদের এই অভিনয়।
বাছাধন এবার আর ফাঁকি দিতে পারেনি আমার বিষকে!’ উলন বলে উঠল। কিন্তু সত্যি মরেছে তো?’ শিকদার কুয়াশার সামনে বসে পড়ল। বসল উলনও।
পরমুহূর্তে কি যে ঘটল, বুঝতে পারল না ওরা। উলন এবং শিকদারের মাথা প্রচণ্ডভাবে ঠকে গেল স্পরের সঙ্গে। টু-শব্দ করবারও ফুরসত পেল না তারা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল দুজনই।
মেঝে থেকে টর্চ তুলে নিয়ে জ্বালল কুয়াশা। মরেনি বা জ্ঞানও হারায়নি সে। সে-ও অভিনয় করছিল এতক্ষণ। কাগজপত্রগুলো আলখেল্লার পকেটে ভরে নিয়ে দুই কাঁধে দুটো অজ্ঞান দেহ তুলে কামরা থেকে বেরিয়ে এল কুয়াশা।
| মাটির ঢিবিতে উঠে হেলিকপ্টারের সামনে থামল কুয়াশা। দেহ দুটো নামিয়ে রেখে ইঞ্জিনটা পরীক্ষা করতে গিয়ে একটা টাইম বোমা আবিষ্কার করল সে। স্টার্ট নেয়া মাত্রই বোমাটা বিস্ফোরিত হবার কথা।
বোমা আরও আছে কিনা পরীক্ষা করল কুয়াশা। নিশ্চিত হয়ে হেলিকপ্টারের সীটের উপর তুলে দিল অচেতন দেহ দুটো। তখুনি কপ্টার নিয়ে আকাশে উড়ল না। সে। আলো অন করে গভীর মনোযোগর সঙ্গে উলনের হাত দুটো, বিশেষ করে ডান হাতটা, পরীক্ষা করল সে। | . কিন্তু অসাধারণ কিছুই পেল না সে হাতটায়। হাতের সাদা রঙটা যেন
অকৃত্রিম বলেই মনে হয়।
পকেট থেকে সিরিঞ্জ এবং অ্যামপূল বের করল কুয়াশা। দুজনের শরীরে ঘুমের ওষুধ ইঞ্জেক্ট করল সে। তারপর স্টার্ট দিল হেলিকপ্টারে।
হেলিকপ্টার নিয়ে নিজের আস্তানার ছাদে নিরাপদে ল্যাণ্ড করল কুয়াশা।
কুয়াশার ড্রয়িং রুম। মেঝের উপর উলন এবং শিকদারের অচেতন দেহ পড়ে রয়েছে।
৯৮
ভলিউম ১৮
কুয়াশা সোফায় বসে তার পাঠানো রেডিওগ্রামের উত্তর সম্বলিত কাগজপত্র পড়ছে। খানিক আগে উত্তরগুলো এসেছে।
• প্রতিটি মেসেজ দীর্ঘ এবং বিশদ। চার জায়গা থেকেই উত্তর এসেছে-আইস অভিযান ছাড়া আর কোন অভিযান গত ছয় মাসের মধ্যে উত্তর মেরুর গভীরতম এলাকায় পরিচালনা করা হয়নি। আইস অভিযানের অভিযাত্রীদের ভাগ্য সম্পর্কে কেউ কোন তথ্য দিতে পারেনি। তবে অভিযাত্রীদের একজন শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেছে, লোকটার চেহারার বর্ণনা রয়েছে একটা মেসেজে।
• সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, চেহারার বর্ণনাটা শিকদার মাহবুব উল্লাহর সঙ্গে হবহু মিলে যাচ্ছে। তারমানে আইস অভিযানের একমাত্র জীবিত সদস্য স্বয়ং শিকদার ওরফে ইকবাল। এই মেসেজে আরও জানানো হয়েছে, ইকবাল ওরফে শিকদারের সঙ্গে একজন লোককে মাঝে মধ্যে দেখা গেছে। এই লোকটারও চেহারার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। চেহারার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে উলনের।
পয়েন্ট ব্যারো, নর্থ আলাস্কান উপকূল থেকে যে মেসেজটা এসেছে তাতে উলন সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেল। লালচে রঙের তুকবিশিষ্ট, সাদা হাতওয়ালা একটা লোক রহস্যজনকভাবে কোথা থেকে কেউ জানে না ওখানকার আমেরিকান গবেষণাগারে উপস্থিত হয় কয়েক মাস আগে। লোকটার কাছে অদ্ভুত আকৃতির একটা কালো গগলস দেখা গেছে। তার আচার ব্যবহার সম্পূর্ণ রহস্যময়। আধুনিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই, মনে হয়েছিল। পৃথিবীর কোন প্রচলিত ভাষায় কথা বলতে পারত না সে। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে মানিয়ে নেয় সে। অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে শিখে ফেলে ইংরেজি ভাষাটা। লোকটা নিজের সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে রাজি হয়নি কখনও। সে শুধু বলত, উত্তর মেরুর অভ্যন্তর ভাগ থেকে এসেছে সে। বলাই বাহুল্য, কথাটা মিথ্যে। কারণ উত্তর মেরুর গভীরতম অভ্যন্তরে কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে
। লোকটা যেমুন রহস্যজনকভাবে এসেছিল তেমনি রহস্যময়ভাবে একদিন অদৃশ্য হয়ে যায়।
এর কিছুদিন পর এলাকার এস্কিমোরা গবেষণাগারের কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করে যে তাদের কিছু লোককে হত্যা করেছে রহস্যময়, লালচে গায়ের রঙ বিশিষ্ট, সাদা হাতওয়ালা একজন লোক। কিন্তু এস্কিমোরা সেই লোককে ধাওয়া করেও ধরতে পারেনি। তারপর লোকটা সম্পর্কে আর কোন খবর পাওয়া যায়নি।
কুয়াশা মেসেজগুলো পড়ে মুখ তুলল। বলল, আমরা উত্তর মেরু জয় করতে যাচ্ছি, রাজকুমারী। মি. ডি. কস্টা, তৈরি হোন।’
কামাল এবং রাসেল একযোগে বলে উঠল, সত্যি!’ কুয়াশা অপ্রত্যাশিতভাবে আদেশ দিল, মি. ডি. কস্টা! লাফ দিন!
কালবিলম্ব না করে, নিজের জায়গা থেকে লাফ দিল ডি. কস্টা। কিন্তু যা ঘটবার ঘটে গেছে ততক্ষণে। শূন্যে থাকতেই উলনের একটা হাত ডি. কস্টার ডান
কুয়াশা ৫৪
হাতটা ধরে ফেলেছে।
| ‘সাবধান, নড়বেন না!’ কুয়াশা বলে উঠল ডি কস্টার উদ্দেশ্যে।
ডি. কস্টা শূন্যে উঠে গিয়েছিল লাফ দিয়ে কুয়াশার নির্দেশ পেয়েই। সোফাতেই পড়েছে সে।
হাসছে উলন। প্রস্তর মূর্তির মত যে যার জায়গায় বসে আছে সবাই। এতটুকু নড়ছে না কেউ। কুয়াশাও যেন পাথর বনে গেছে। ডি, কস্টা পিটপিট করে চেয়ে আছে উলনের দিকে। ভয়ের কোন চিহ্ন নেই তার মধ্যে।
| কথা বলে উঠল উলন, তুমি বুদ্ধিমান, কুয়াশা। জানোই তো, আমার ক্ষমতা অসাধারণ। চালাকি করবার চেষ্টা করে দেখো, সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলব তোমার সহকারীকে। ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করলেই যথেষ্ট।
• “কি চাও তুমি?’
এই তো লাইনে এসেছ। প্রথমে চাই গগটা। তারপর আমার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাই। দেখো, আমি একবারে একটা কাজ করি। ইচ্ছা করলে এই সুযোগে তোমার স্পেসক্রাফটটা আদায় করে নিতে পারতাম। কিন্তু তা করছি না। পরে আসব আমি স্পেসক্রাফটের জন্য। তোমার সহকারীকে নিচে নিয়ে যাব এখন আমি। কেউ আমাকে অনুসরণ করবে না। রাজি?’
কুয়াশার ঠোঁট দুটো নড়ল শুধু, রাজি।
ডি. কস্টা তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করে আনছিল, কুয়াশা গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ দিল, মি. ডি. কস্টা, পকেট থেকে হাত বের করুন-খালি হাত!’
| ডি কস্টা বের করল না হাত। বলল, বস আমি আপনার পরাজয় মানিয়া নিটে পারিটেছি না। বিলিভ মি, হামি এই উজবুক ব্যাটাকে ভয় করি না। আপনি অনুমটি ডিন••• :
কুয়াশা বলে উঠল, না। যা বলছি শুনুন।’
তবু দ্বিধা করতে দেখা গেল ডি. কস্টাকে। কুয়াশা প্রমাদ গুণল মনে মনে। ডি. কস্টাকে চেনে সে। ভয় বলে কোন জিনিস নেই লোকটার ভিতর। কি না কি করে বসে।
‘বের করুন খালি হাত! ধমকে উঠল কুয়াশা। ডিকস্টা গভীর ভাবে বসে রইল। হাত বের করছে না সে। তারপর, আস্তে আস্তে হাতটা বের করল সে। খালি হাত।
উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। পা বাড়াল লাইব্রেরি রূমের দিকে। যাবার সময় বলল, নড়বেন না। এটা আমার আদেশ।’
ফিরে এল কুয়াশা লাইব্রেরি থেকে অদ্ভুত আকৃতির গগলসটা নিয়ে। সেটা ‘ছুঁড়ে দিল উলনের দিকে। বলল, “আর কি বক্তব্য আছে তোমার?
‘একটা বক্তব্য আছে। শিকদারের বদলে তোমাকে যদি বন্ধু হিসেবে পেতাম, তাহলে আমার উদ্দেশ্য সুচারুভাবে এবং আরও অল্পসময়ে বাস্তবায়িত হত।’
১০০
ভলিউম ১৮
হাসল কুয়াশা। * শিকদারের অচেতন দেহটা ডান হাত দিয়ে অনায়াস ভঙ্গিতে তুলে নিল উলন নিজের কাঁধে। তার এই কাণ্ড দেখে স্বয়ং কুয়াশাও বিস্ময় মানল। কঙ্কালসার একটা লোকের গায়ে এমন অস্বাভাবিক শক্তি থাকতে পারে তা কল্পনা করা কঠিন।
উলন অপর হাতে ধরে রেখেছে ডি. কস্টাকে।
বিদায়। কেউ যদি আমাকে অনুসরণ না করে তাহলে ডি. কস্টাকে আমি ঠিকই ছেড়ে দেব…।’ বলতে বলতে করিডরে বেরিয়ে গেল উলন। +
| এক মিনিট কেটে গেল। কেউ নড়ল না এতটুকু, তারপর ছুটল কুয়াশা। এক লাফে করিডরে গিয়ে পড়ল। দীর্ঘ পদক্ষেপে ব্যক্তিগত এলিভেটরের দিকে ছুটল সে।
ইয়ট মাছরাঙা। শিকদারের জ্ঞান ফিরে এসেছে। উলনের সঙ্গে গোপন পরামর্শ করছে সে। তার বক্তব্য, যতবারই কুয়াশাকে খুন করবার চেষ্টা করলাম, ততবারই ব্যর্থ হলাম। কিন্তু রহস্য থাকতে পারে এর পিছনে? দেখে শুনে মনে হচ্ছে, কুয়াশা যেন আগে থেকেই আমাদের ফাঁদের কথা, পরিকল্পনার কথা জেনে যাচ্ছে।
এই সময় জিঞ্জির খান প্রবেশ করল কেবিনে।
নীচু গলায় কথা বলতে লাগল শিকদার, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি জিঞ্জির খানের দিকে, এই হাতির মত লোকটাকে কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে আমার। উলন, এ লোক কুয়াশার দলের কেউ নয় তো?’
| উলন হাসল, সন্দেহ,রেখে লাভ কি। তুমি চাইলে ওর সঙ্গে করমর্দন করতে পারি।’
কথাটার অর্থ খুবই সোজা। উলনের করমর্দন করা মানে প্রতিপক্ষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু।
* শিকদার বলল, কোন ঝুঁকি নিতে চাই না আমি। লোকটা হয়তো সত্যি নির্দোষ । কিন্তু উপায় কি। উলন, দাও ওকে খতম করে। ব্যাটা একটা উপকার
করে ঘাড়ে চেপে বসেছেনড়বার নাম নেই।
উলন সহাস্যে জিঞ্জির খানকে জোর গলায় ডাকল, জিঞ্জির খান, এদিকে এসো। তোমার জন্য সুখবর আছে।’
এগিয়ে এল জিঞ্জির খান। হাসছে সে। তোমাকে আমরা আমাদের দলে নেব, ঠিক করেছি। তোমার কি মত?
জিঞ্জির খানের মস্ত দেহটা নড়ে উঠল। সশব্দে হেসে বলল সে, সে তো আমার সৌভাগ্য।’
উলন বলল, আজ থেকে তুমি আমাদের দলেরই একজন অনুচর। এসো•••। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল উলন।
জিঞ্জির খান যেন এই রকম একটা কিছুর জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। এগিয়ে এল সে। তারপর বিদ্যুৎ বেগে ডান পা তুলে সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারল কুয়াশা ৫৪
৫ ১০১
উলনের পাঁজরে। | ফুটবলের মত নিক্ষিপ্ত হলো উলনের দেহটা। দেয়ালে গিয়ে সশব্দে ধাক্কা খেলো, তারপর পড়ল মেঝেতে। কিন্তু মাত্র এক সেকেণ্ড পরই দেখা গেল উলন দাঁড়িয়ে আছে কেবিনের মেঝের উপর। তার ডান হাতটা ক্রমশ উপরে উঠছে। বাতাসে ভর দিয়ে, ফড়িংয়ের মত উড়তে শুরু করছে সেটা। | শিকদার তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলে উঠল সে, কুয়াশা! কুয়াশা! জিঞ্জির খান না-এ নোক স্বয়ং কুয়াশা!
ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল শহীদ খান।
‘একটা চেয়ার তুলে সামনে ধরো শহীদ! উলনের ছোঁয়া মানেই মৃত্যু!
সতর্ক করে দিল কুয়াশা। শিকদার তার কোর্টের গোপন পকেট থেকে বের করে ফেলেছে ইতিমধ্যে বড় আকারের একটা টাইমপীস। টাইমপীসের মাঝখানে একটা ক্ষুদ্র বোতাম। টাইমপীসটা বাড়িয়ে ধরে বোমটায় চাপ দিতেই তীব্রবেগে তরল অ্যাসিড ছুটে গেল শহীদের দিকে। লাফ দিয়ে সরে গেল শহীদ। দাঁড়াল একটা চেয়ারের পিছমে, সেটা তুলে নিল দ্রুত। তারপর পা বাড়াল শিকদারের দিকে।
কুয়াশার লাথি খেয়ে উলনের যেন কিছুই হয়নি। এগিয়ে আসছে সে। তার ডান হাতটা আশ্চর্য ভঙ্গিতে উড়ছে বাতাসে ভর দিয়ে।
আলখেল্লার পকেট থেকে ছোট্ট একটা গ্যাস বোমা বের করে দেয়ালে ছুঁড়ে মারল কুয়াশা।
উলন চিৎকার করে উঠল শিকদারের দিকে তাকিয়ে, দম বন্ধ করে রাখো শিকদার।’
| উলন শিকদারের দিকে তাকাতেই সুযোগটা নিল কুয়াশা। লাফ দিয়ে শুন্যে উঠে গেল সে। উড়ন্ত দানবের মত দেখাল তাকে। দুই পা দিয়ে শূন্য থেকে উলনের বুকের উপর জোড়া লাথি মারল।
ছিটকে পড়ে গেল উলন। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সিধে হয়ে দাঁড়াল আবার। তাজ্জব হয়ে গেল কুয়াশা, লোকটার মরে যাবার কথা তার জোড়া লাথি খেয়ে!
অথচ••• |
| আবার এগিয়ে আসছে উলন। ডান হাতটা এখন আরও দ্রুত, আরও অস্থির ভাবে উড়ছে। সাপের মত ফণা তুলে আছে হাতটার আঙুলগুলো। সুযোগ পেলেই
সে মৃত্যু ছোবল মারবে।
এদিকে শিকদারের অ্যাসিডের ছোঁয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্য দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে শহীদ। দুই হাত দিয়ে চেয়ারটা নিজের সামনে ধরে রেখেছে সে। পিছিয়ে যেতে যেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকল ওর। শিকদার হাসছে। কুৎসিত মুখটা ভিজে গেছে ঘামে। টাইমপীসটা তার প্রিয় অস্ত্র। অ্যাসিড ছোঁড়ার জন্য এই টাইমপীসই ব্যবহার করে সে।
১০২
ভলিউম ১৮
এবার কোথায় যাবে বাছাধন!
শিকদার দাঁতে দাঁত চেপে হাতের টাইমপীসটা বাড়িয়ে ধরল সামনের দিকে। ঠিক সেই সময় বিদ্যুৎ খেলে গেল শহীদের দেহে। চোখের পলকে শহীদের হাত
থেকে চেয়ারটা উড়ে এসে লাগল শিকদারের মাথায় পড়ে গেল সে।
| দেয়ালের কাছ থেকে লাফিয়ে শিকদারের বুকের উপর এসে বসল শহীদ।
এমন সময় কুয়াশার গলা কানে ঢুকল ওর, শহীদ!’
ঘাড় ফিরিয়ে শহীদ দেখল, উলন তার ডান হাত বাতাসে নাচাতে নাচাতে ছুটে আসছে তার দিকে।
লাফ দিয়ে সরে গেল শহীদ। ঠিক একই সময়ে লাফ দিল কুয়াশা। উননের পাজরে পরপর আড়াই মণ ওজনের দুটো ঘুসি মারল সে ডান..এবং বাঁ হাত দিয়ে, উলন পড়ে গেল ঘুসি খেয়ে।
কিন্তু আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল সে।
এদিকে উঠে দাঁড়িয়েছে শিকদারও। নাক মুখ কেটে রক্ত ঝরছে তার। উলনের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল সে। পরমুহূর্তে তীরবেগে ছুটল দুজন দরজার দিকে।
• ধাওয়া করল কুয়াশা এবং শহীদ।
ডেকে বেরিয়ে ওরা পলকের জন্য দেখতে পেল শত্রুদেরকে। ডেকের রেলিং পেরিয়ে নিচের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুজনই।
রেলিংয়ের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল কুয়াশা এবং শহীদ। পরমুহূর্তে এক ঝাক স্টেনগানের বুলেট ওদের মাথার কাছ দিয়ে ছুটে গেল।
রেলিংয়ের কাছ থেকে পিছিয়ে এল ওরা।
আগে থেকেই মটরবোটটা তৈরি করে রেখেছিল ওরা। স্টেনটাও রাখতে ভোলেনি।’
পরমুহূর্তে শোনা গেল মটরবোট স্টার্ট নেবার শব্দ।
‘ওই পালাচ্ছে!’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল শহীদ। এক ঘণ্টা পর নয়জন আরোহীকে নিয়ে একটা চার্টারড বিমান চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করল। কুয়াশার নির্দেশে দু’ঘণ্টা পর এয়ারপোর্টে এসে সন্ধান চালাতে গিয়ে কামাল খবরটা সংগ্রহ করল। আরোহীদের চেহারার বর্ণনা শুনে কুয়াশা বুঝতে পারল শিকদার এবং উলনের দল দেশ ত্যাগ করেছে।
| সেই মুহূর্তে সকলকে দ্রুত প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিল কুয়াশা। বলল, উত্তর মেরুতে টিকে থাকার জন্য যাবতীয় যা দরকার–সব সঙ্গে নাও। অস্ত্র-শস্ত্র বেছে নেব আমি। আমরা রহস্যময় একটা অলৌকিক মহাশক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করতে। যাচ্ছি।
কুয়াশা ৫৪
১০৩
দুই
—
–
।
। ।
।
[
{1
|
“
“
মেঘ মুক্ত নির্মল আক???পর ‘চাকতির মত একটা আকাশযান আকাশের গায়ে লেপটে রয়েছে যেন; “Aল ওয়ে চরছে যেন সেটা ধীরে ধীরে। কয়েক হাজার ফুট নিচে সাদাটে
বেবি । আরও নিচে শক্ত, পাথরের মত বরফ। বরফ আর বরফ। যেদিক {::::”T! বরফের সাগর ছাড়া আর কিছু চোখে পড়বার নয়। মাঝে মাঝে দেখা | . .’র মাঝখানে ধূসর রঙের লম্বা, এবড়োখেবড়ো, আঁকাবাঁকা দাগ। ওগুলো জ্যে পাথরের পাহাড়।
দুশো মাইল স্পডে :ৈ ::4ার স্পেসক্রাফট। কানাডার উত্তর-পশ্চিমের আকাশে রয়েছে ওরা-কুয়াশ,, কামাল, রাসেল, ডি, কস্টা এবং রাজকুমারী ওমেনা।
গ্রেট স্লেভ লেকে নামল পেটু। স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে আলাপ করল শহীদ। কথায় কথায় শহীদ প্রশ্ন করা কয়েকটা। তারা জানাল পাইলট সহ দশজন আরোহী নিয়ে একটি বিমান ঘণ্টা দুয়েক আগে রিফুয়েলিংয়ের জন্য নেমেছিল এয়ারপোর্টে।
কুয়াশাকে খবরটা দিতে সে বলল, ‘শিকদার এবং উলনের দল।
দুই প্রাণের বণু-হামাডের প্রাণের ডুশমন?
মন্তব্য করল ডি, কস্টা। ডি কস্টার কোলের উপর আবেশে চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে প্রিন্স। ডি, কস্টা তার নরম গায়ে সাদরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এ হলো ডি. কস্টার পোষা কুকুরটা। নাম দিয়েছে সে প্রিন্স।
আবার উত্তর পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু হলো। ঘণ্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে স্পেসক্রাফট। কখনও আকাশে থামছে সেটা। রেডিও অন করছে কুয়াশা। কিছু শোনার প্রয়াস পাচ্ছে সে। তারপর আবার ছুটছে নির্মল আকাশ পথ ধরে সামনের দিকে, আরও সামনের দিকে। আলাস্কান বর্ডারের কাছাকাছি এসে স্পেসক্রাফট ক্রমশ আরও উপরে উঠে যেতে লাগল। ইউকন। পর্বতমালা ঠিক নিচেই। নির্জন, প্রাণহীন বরফাচ্ছাদিত পার্বত্য এলাকার উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে দুঃসাহসী, মৃত্যুভয়হীন বাংলাদেশী অভিযাত্রীরা উত্তর মেরুর দিকে।
স্পেসক্রাফটের ভিতরে যে-যার কাজে মগ্ন সবাই। রাজকুমারী ওমেনা পরিচালনা করছে স্পেসক্রাফট। রাসেল রেডিও কমিউনিকেশনের দায়িত্বে রয়েছে। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে সে গ্রাউণ্ড স্টেশনগুলোর সঙ্গে, ওরা যে দুর্গম এলাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে সেখানকার আবহাওয়ার পূর্বাভাষ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
শহীদকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে কুয়াশা। অভিযানের নেভিগেটর ও। চার্ট, ম্যাপ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করতেই সারাক্ষণ ব্যস্ত।
কোন দায়িত্ব নেই ডি.কস্টার। সে তার প্রিন্সের আরাম আয়েশের ব্যবস্থা
১০৪
ভলিউম ১৮
করতেই অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছে। কামাল কন্ট্রোলরূমে সাহায্য করছে রাজকুমারী ওমেনাকে।
ডি. কস্টা জানতে চাইল, ‘এনিমিডের এগোনেস্টে হামরা হামলা চালাইব কখন, বলিটে পারেন, বস?
‘পারি।’ | ডি কস্টা অবাক হলো, হোয়াট! আপনি জানেন এনিমিরা কোঠায় যাইটেছে? হামার টো ঢারণা ছিল পয়েন্ট ব্যারো-এর পর অনুমানের উপর ডিপেন্ড করিয়া
অগ্রসর হইটে হইবে হামাডেরকে।
কুয়াশা বলল, না, তা নয়। শিকদারের আস্তানায় জিঞ্জির খানের ছদ্মবেশে থাকার সময় কিছু তথ্য পাই আমি। আইস প্যাকের উপর দিয়ে বহুদুর যেতে হবে আমাদের। যাবার সময় আমরা ব্যবহার করব আমাদের রেডিও ডাইরেকশন ফাইণ্ডার। শিকদার উত্তর মেরুর কোন এক জায়গায় একটা রেডিও সেট অন করে রেখেছে, সেটা থেকে নির্দিষ্ট স্ট্যাটিক ডিসটারবেশ সৃষ্টি হবে। আমাদের রেডিওতেও স্বভাবতই ধরা পড়বে সেই ডিসটারবেন্স। ওটার সন্ধান পেলেই আমরা শত্রুদের সন্ধান পাব।’
‘ভেরি গুড। এনিথিং এলস? হোয়ট অ্যাবাউট ব্ল্যাক গগল্স? অ্যাণ্ড হোয়াট অ্যাবাউট ব্ল্যাক ভূট অর ব্ল্যাক থিংস?’
কুয়াশা হাসল। বলল, ‘এসব ব্যাপারে এখনও বিশেষ কিছু জানতে পারিনি আমি।” আমি ।’
,, ‘ ‘, রাসেল হঠাৎ প্রশ্ন করল, কুয়াশাদা, আপনার হুকুমে তো অভিযানে অংশ গ্রহণ করলাম–কিন্তু আমরা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে কি উদ্দেশ্যে, কিসের বিরুদ্ধে লড়তে যাচ্ছি বলুন তো?
কুয়াশা বলল, সত্যি কথা বলতে কি, রহস্যময় একটা শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে যাচ্ছি আমরা। এর বেশি কিছু এখনও জানি না আমি নিজেও।
পয়েনন্ট ব্যারো উত্তর আলাস্কান উপকূল। পয়েন্ট ব্যারো-তে একটা এয়ারপোর্ট আছে, এটিই শেষ এয়ারপোের্ট। পয়েন্ট ব্যারো-কে সভ্যতার শেষ সীমা বলা যেতে পারে। আরও খানিকদূর অবধি এস্কিমোদের দেখা পাওয়া যায় বটে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তারা এখনও পরিচিত নয় তেমন।
ঢাকায় বসে পয়েন্ট ব্যারো থেকেই উলন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেডিওগ্রামের মাধ্যমে পেয়েছিল কুয়াশা। আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য স্পেসক্রাফট নিয়ে নামার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু স্পেসক্রাফট নামার আগেই এয়ারপোর্টের
কন্ট্রোলরুম থেকে রেডিও মেসেজ এল। |
মেসেজটার মূল অর্থ, আমাদের এয়ারপোর্টে একটা অঘটন ঘটেছে। সে সম্পর্কে আপনাদেরকে সাবধান করে দেয়া দরকার। দয়া করে আপনাদের স্পেসক্রাফট নিচে নামান।’
কুয়াশা ৫৪
১০৫
কানাডা সরকারের অনুমতি নিয়ে বর্ডার ক্রস করেছে কুয়াশা। পয়েন্ট ব্যারো-র কর্মকর্তাদেরকে কুয়াশা, তার স্পেসক্রাফট ইত্যাদি সম্পর্কে আগেই অবহিত করানো হয়েছে। কুয়াশার সঙ্গে সম্ভাব্য সবরকম সহযোগিতা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদেরকে।
নেমে এল স্পেসক্রাফট। এয়ারপোর্ট ম্যানেজার জানাল, ‘ঘণ্টা তিনেক আগে একটা বিমাম না করে এখানে। বিমান থেকে দশজন সশস্ত্র লোক নামে। অকারণে গোলাগুলি ছুঁড়ে কার্যরত লোকদের আতঙ্কিত করে তোলে তারা। রানওয়েতে একটা হেলিকপ্টার ছিল, সেটা নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। রহস্যটা বোধগম্য হচ্ছে না। প্লেন রেখে হেলিকপ্টার নিয়ে গেল কেন, তাদের গন্তব্যস্থান কোথায়, কি উদ্দেশ্য তাদের।’
কুয়াশাকে অস্বাভাবিক গভীর দেখাল। বলল, বুঝেছি। বরফের উপর প্লেন ল্যাণ্ড করানো সম্ভব নয় বলে ওরা ‘কপ্টার হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে।’
এয়ারপোর্ট ম্যানেজারকে যতটুকু না বললে নয় ততটুকু বলল কুয়াশা উলন এবং শিকদারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। তারপর সে উলন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্ন করতে শুরু করল। | আলোচনার ফলে একজন ফার ব্যবসায়ীর কথা জানা গেল। ফার ব্যবসায়ী, প্রৌঢ় স্কুব উলনকে শুধু দেখেইনি, তাকে কিছু দিনের জন্য আশ্রয়ও দিয়েছিল।
লোক পাঠিয়ে দিল এয়ারপোর্ট ম্যানেজার। আধঘণ্টা পর প্রৌঢ় স্কুব হাজির হলো কুয়াশার সামনে।
| পরিচয় করিয়ে দিল এয়ারপোর্ট ম্যানেজার।
প্রৌঢ় ঋব বলল, আপনার মত স্বনামধন্য ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি গর্বিত••• |
| কুয়াশা বলল, আমি উলন সম্পর্কে তোমার কাছ থেকে সব কথা শুনতে চাই। শুনেছি, সে নাকি মেরুর গভীরতম এলাকা থেকে এখানে আসে?
প্রৌঢ় বলল, “সে তো তাই দাবি করেছিল। কিন্তু কথাটা মিথ্যে। ওদিকে কোন মানুষ বাস করতে পারে না। না আছে খাবার, না আছে জ্বালানি-বাঁচবে কিভাবে? বরফের মাঝে মাঝে চোরা-গর্ত, পা দিলেই নির্ঘাৎ মৃত্যু। ওদিকের আবহাওয়াও ভয়ঙ্কর-চব্বিশ ঘণ্টা ঝড় বইছে। মানচিত্রে জায়গাটাকে দেখানো হয়েছে সাদা শূন্যতা হিসেবে।
“তোমার ধারণা কি? উলন তাহলে কোত্থেকে এসেছিল? তার জন্মস্থান কোথায়? | প্রৌঢ় চুপ করে রইল। বিমূঢ় দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে সে বলল অবশেষে, আশ্চর্য জিনিস জীবনে কম দেখিনি, মি, কুয়াশা। কিন্তু উলনের মত আশ্চর্য প্রাণী আমি কখনও দেখিনি। লোকটাও ঠিক মানুষ নয়। ‘
তার মানে? প্রৌঢ় বলল, ওর কিছু কিছু আচরণ সত্যি ব্যাখ্যার অতীত আগুনের কথাই
ভলিউম ১৮
১০৬ :
ধরুন। আগুন দেখে সে বিচলিত হয়ে ওঠে। হাত দিয়ে ধরতে যায় আনকে। জিজ্ঞেস করতে কি বলল জানেন? বলল, সে যেখান থেকে এসেছে সেখানে নাকি
আগুন নেই!
চুপ করে রইল কুয়াশা। রহস্যের কিনারা হওয়া তো দূরের কথা, রহস্য যেন আরও ঘনীভূত এবং জটিল হয়ে উঠছে। পকেট থেকে উলনের অদ্ভুত আকৃতির গগলসটা বের করে প্রৌঢ়কে দেখাল সে, এটা আগে কখনও দেখেছ?’
দেখিনি মানে! উলনের জিনিস! ওটা হাতে নিয়ে দেখছিলাম একদিন, উলন আমার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ে কেড়ে নিল জোর করে। ভয়ানক দামী জিনিস ওটা উলনের। কিন্তু আমার কাছে কোন কাজেরই নয়। ওটা চোখে পরলে কিছুই দেখা যায় না। সেদিন উলনের ব্যবহার দেখে যেমন ভয়ও পেয়েছিলাম, তেমনি রাগও হয়েছিল। রাইফেল উঁচিয়ে ধরেছিলাম ওর বুকের দিকে, বলেছিলাম বিদায় হয়ে যেতে। মাত্র হপ্তা দুয়েক ছিল সে আমার কাছে। সেই ঘটনার পর তাকে আর দেখিনি।’
পয়েন্ট ব্যারো থেকে আকাশে উড়ল রূপালি স্পেসক্রাফট। বীনফোর্ট সীর উপর দিয়ে উত্তর দিকে উড়ছে এবার। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। নিচে, অনেক নিচে সাদা ধবধবে বিস্তীর্ণ, সীমাহীন বরফের কঠিন সমতলভূমি। আশি-নব্বই মাইল সামনে আর্কটিক মহাসাগর।
কুয়াশা রেডিও ডাইরেকশন ফাইণ্ডার সেট অন করল। লাউডস্পীকার থেকে বেরিয়ে এল অদ্ভুত ধরনের যান্ত্রিক উচ্চকিত শব্দসমষ্টি। একঘেয়ে ঘরঘরে, পিক পুক-পুক-পুক, শো-সা-শো, দ্রুম-দ্রুম, তিরিক-চুই, তিরিক চুই–আশ্চর্য ধরনের শব্দে কান পাতা দায়।
আরও ঘণ্টাখানেক কাটল এভাবে। নির্দিষ্ট স্ট্যাটিক ডিসটারব্যান্স বলতে যা বোঝায় তা এখনও কানে আসছে না। রেডিওটা অন করে রেখেছে কুয়াশা।
সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। নির্দিষ্ট সিগন্যাল পাওয়ার উপর নির্ভর করছে সব। সিগন্যাল পাওয়া না গেলে শিকদার এবং উলনের ন্তব্যস্থান সম্পর্কে বিন্দু বিসর্গ জানবার উপায় নেই। এই বরফময় রাজ্যে কোথায় কি আছে তা জানা
নেই সভ্য জগতের কারও। “ আরও আধঘণ্টা পর রেডিওর শব্দ বদলে গেল। ট্রিক-টিকটিক-ট্রিক, ট্রিক টিকটিক-ট্রিক। কুয়াশা ইন্টারকমের মাধ্যমে রাজকুমারীর কাছে নির্দেশ পাঠাল, ‘পশ্চিম দিকে ঘুরিয়ে নাও স্পেসক্রাফট। আই মীন, নর্থ-ওয়েস্ট অ্যাঙ্গেলে এগোও। সিগন্যাল পাচ্ছি আমরা।
স্পেসক্রাফট দিক পরিবর্তন করল। সেই সঙ্গে সিগন্যাল-এর শব্দ স্পষ্ট এবং উচ্চকিত হয়ে উঠল। বোঝা যাচ্ছে, সিগন্যালের উৎসের দিকে এগোচ্ছে ওরা।
সবাই পরবর্তী ঘটনার জন্য তৈরি হয়ে আছে। সিগন্যাল যখন পাওয়া গেছে তখন আর পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। এবার নামবে ওরা
কুয়াশা ৫৪
১০৭
বরফের রাজ্যে। কোন সন্দেহ নেই, শত্রুদের সঙ্গে একটা সংঘর্ষ অনিবার্য ভাবে ঘটবে। শত্রুদের ধ্বংস করাই অবশ্য একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। ওরা কয়েকটা রহস্যের সমাধান চায়। উলনের অলৌকিক ক্ষমতার স্বরূপ কি, কোথা থেকে আর্বিভাব ঘটেছে তার, এই দুটো প্রশ্নের উত্তর দরকার। আর দরকার রহস্যময় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মহাশক্তির খবর।
. একমাত্র ডি কস্টাই এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে না। একটা জানালার সামনে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। নরম সীটের উপর, তার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে প্রিন্স। তাকে আদর করার কথাও ভুলে গেছে সে। মুগ্ধ, সম্মোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল।
মাই গড!’ ।
আমূল বদলে গেল ডি, কস্টার চেহারা। শক্ত হয়ে উঠল দেহ। মুখটা বাঁকা হয়ে যাওয়ায় বিকৃত দেখাচ্ছে। বুকের ভিতর যেন তড়পাচ্ছে তার হৃৎপিণ্ড।
ট্রান্সমিটারের পাশ থেকে রাসেল সহাস্যে বলে উঠল, কি হলো, মি. ডি. কস্টা? আপনার প্রিন্স পড়ে গেছে নাকি নিচে।’
ডি. কস্টা রাসেলের কথায় কান না দিয়ে চিৎকার করে উঠল, বস! মি. শহীদ-এডিকে আসুন। কুইক।’
“কি ব্যাপার!’ মুখ তুলে তাকাল শহীদ। চার্ট এবং ম্যাপ এক পাশে সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল ও। উঠে দাঁড়াল কুয়াশাও। সবাই এগোল ডি, কস্টার দিকে।
ডেকুন! মাই গড! টাকিয়ে ডেকুন। ফায়ার! আগুন!’ জানালা দিয়ে সবাই তাকাল নিচের দিকে।
কই, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না! বরফ ছাড়া আর কিছুই তো নেই। আগুন আসবে কোত্থেকে বরফের রাজ্যে!
কামালও বেরিয়ে এসেছে কন্ট্রোল কেবিন থেকে। কথাগুলো সেই বলল।
কুয়াশাও সেই কথা বলল, কই কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না বরফ ছাড়া! | ডি. কস্টা খেঁকিয়ে উঠল, হাপনারা সবাই রাইণ্ড হইয়া গেছেন। মাই গড! এই কানাডের লইয়া আমি এখন কি উপায় করি। ডেকিটে পাইটেছেন না! বরফের ভিটর হইটে আগুন বাহির হইয়া আসিটেছে। সাডারণ আগুনের শিখা বলিয়া মনে হইটেছে না–রৈল, লিকুইড অগ্নিশিখার মটো মনে হইটেছে…।’
সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইল সবাই ডি. কস্টার দিকে। কারও মুখে কোন কথা নেই। ডি. কস্টা সবার মনোভাব বুঝতে পারল কেউ কথা বলছে না দেখে।
‘হামাকে আপনারা পাগল ভাবিটেছেন। ভাবিটেছেন হামি ম্যাড হইয়া গিয়াছি। কি টাহা সট্যি নয়। পাগল এবং রাইও হাপনারাই…!’
| ডি, কস্টা ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকাল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল সে। সে কি অন্ধ হয়ে গেছে?
কিন্তু ভয়টা দূর হয়ে গেল একটা কথা মনে পড়ে যেতেই।
, সে অন্ধ হয়ে যায়নি। তার চোখে উলনের গগলসটা রয়েছে-কথাটা সে
১০৮
ভলিউম ১৮
ভুলেই গিয়েছিল।
চোখ থেকে গগল্সটা এক টানে নামিয়ে আনল সে। তারপর আবার তাকাল জানালা দিয়ে নিচের দিকে। চিৎকার করে উঠল সে, নেই! এখন উহাকে ডেকা যাইটেছে না আর।’,
আবার গগলসটা চোখে লাগিয়ে তাকাল ডি. কস্টা, ‘আছে। এখন এগেন ডেকা যাইটেছে!’
কুয়াশার গলা শোনা গেল, ‘দিন, আমাকে দিন গগলস্টা!’
এরপর রহস্যটা আর রহস্য রইল না। নতুন এক বিস্ময়কর রহস্যের মধ্যে নিপতিত হলো ওরা।
সত্যিই আগুন! ডি, কস্টা ভুল দেখেনি। | গগনসটা চোখে লাগিয়ে নিচের দিকে তাকাল কুয়াশা। কয়েক মুহূর্ত পর গগলস্টা চোখ থেকে খুলে শহীদের হাতে দিল সে। শহীদ দেখল। তারপর গগটা দিল রাসেলকে। এভাবে সবাই কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দেখল ব্যাপারটা।
| মিথ্যে বলেনি ডি, কস্টা। বরফের ভিতর থেকে দীর্ঘ, লম্বা অগ্নিশিখা বেরিয়ে আসছে। সোজা উপরে অনেক দূর উঠে এসেছে শিখাটা। অমিশিখাটা সাধারণ অগ্নিশিখা নয়। যেন তরল আগুনের লম্বা একটা স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। গগল্স্ হাড়া, খালি চোখে কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না।
কি ওটা?’ কামাল নিস্তব্ধতা ভাঙল। কুয়াশা বলল, বুঝতে পারছি না। গ্যাস নয়, আমি শিওর।’
ইন্টারকমে নির্দেশ দিল কুয়াশা, রাজকুমারী, কামালের হাতে গগটা পাঠাচ্ছি। ওটা চোখে লাগালেই তুমি লিকুইড অগ্নিশিখা দেখতে পাবে নিচে। যতটা
সভব ওটার কাছাকাছি নিয়ে যাও স্পেসক্রাফটাকে।
গগলস নিয়ে চলে গেল কামাল। একটু পর সকলেই কন্ট্রোল কেবিনে গিয়ে প্রবেশ করল। শহীদ বলল, “গগল্স্টার কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া গেল, তাই না, কুয়াশা?’
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। উলন এইজন্যই গগলসটার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। অগ্নিশিখাটা একটা আলোক-সঙ্কেতও হতে পারে। এ জায়গা চেনার জন্য গগটা প্রয়োজন ছিল উলনের। তবে, শহীদ, শুধু আলোক-সঙ্কেত হিসেবেই নয়, ওই
অগ্নিশিখার আরও অনেক বেশি তাৎপর্য আছে বলে আমার বিশ্বাস।’
কাছাকাছি থেকে আরও বিশদ জানা গেল অগ্নিশিখা সম্পর্কে। রঙটা মূলত, সোনালি। একটু যেন হলদেটে। কিন্তু আগুন হোক বা রহস্যময় আলো হোক, স্ততটার ভিতর লাল, সবুজ, নীল, বেগুনী আভাও রয়েছে। আলো বা অগ্নিশিখা যাই থোক, ভিজে ভিজে বলে মনে হয়। প্রায় দু’শো ফিট উচ্চতা হবে শুটার। গোলাকার। চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত হবে ওটার ব্যাস।’
গগটা এখন রাজকুমারী ওমেনার চোখে। কুয়াশার নির্দেশ পেয়ে স্তম্ভটার আরও কাছাকাছি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে স্পেসক্রাফটাকে। কিন্তু প্রতিবাদ করে
কুয়াশা ৫৪
১০৯
উঠল সে এক সময়, “আর বোধহয় এগোনো উচিত হবে না।’
কুয়াশা কেবিনের দেয়ালে লটকানো সেনসিটাইজড থারমোমিটার-এর দিকে চোখ রেখে বলল, ভয় নেই। এগিয়ে যাও! দেখতে যাই হোক, শুভটা উত্তপ্ত নয়, বোঝা যাচ্ছে।’
‘আগুন, অথচ উত্তাপ নেই।’
কামাল অবিশ্বাস ভরা চোখে তাকাল শহীদের দিকে। শহীদ বলল, আগুন নয়, এখন বোঝা যাচ্ছে। আগুন হলে তাপ থাকত।
কুয়াশার কণ্ঠস্বর ভারি শোনাল, রাজকুমারী, স্তম্ভটার ।ভতর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাও এবার স্পেসক্রাফটাকে।’
চমকে উঠল এবার সবাই। রাজকুমারী ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল একবার। কিন্তু তর্ক করল না সে। কুয়াশার নির্দেশ শিরোধার্য।
রহস্যময় স্তটার ভিতর প্রবেশ করল স্পেসক্রাফট।
সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। অতি ধীর গতিতে স্তম্ভের ভিতর দিকে স্পেসক্রাফট চলে গেল–কিছুই ঘটল না।
কিছু না ঘটায় ওরা সবাই যেন একটু নিরাশই হলো।
আরও নিচে নামল স্পেসক্রাফট। কুয়াশা শুভটার উৎস মুখ আবিষ্কার করতে চায়।
| আরও খানিক নিচে নেমে ওরা দেল বরফের উপর প্রকাণ্ড একটা গহ্বর দেখা যাচ্ছে। তারই ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে শুভটা। গহ্বরটার চারপাশে কালচে পাথর দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত কোন সুড়ঙ্গের মুখ। প্রায় দশগজ প্রস্থ সুড়ঙ্গ-মুখটা কিন্তু
আধ মাইলের মত চওড়া।
‘রাজকুমারী, সরে যাও! কুয়াশা বলে উঠল। “কি ব্যাপার?’ সবাই একযোগে জানতে চাইল। “ওই দেখো একটা কপ্টার। নিশ্চয়ই শিকদার এবং উলন।’ স্পেসক্রাফটের দায়িত্ব নিল কুয়াশা।
সবাই দেখতে পেল দূরাকাশে ছোট্ট একটা বিন্দুর মত হেলিকপ্টারটাকে। এদিকেই উড়ে আসছে সেটা।
রাসেল বলে উঠল, সাবধান! ওরা রকেট ছুঁড়তে পারে!
কুয়াশা-বলল, মনে হয় না। এই স্পেসক্রাফটের ওপর লোভ আছে ওদের। এটাকে বাধ্য না হলে নষ্ট করতে চাইবে না ওরা।
ডি. কস্টা কঠিন কণ্ঠে বলে উঠল, ‘হামাড়েরকে ধ্বংস না করে স্পেসক্রাফট ডখল করটে পারবে না ওরা।
স্পেসক্রাফট নামছে। সুড়ঙ্গের আশপাশে পাথরের সমতল ভূমি, সেখানেই সরাসরি নামল সেটা।
লাফ দিয়ে নিচে, পাথরের উপর নামল সবাই। হাতির মত মোটা দেখাচ্ছে সবাইকে। গরম কাপড়ে মোড়া প্রত্যেকের দেহ। তবু নিচে নামতেই, ঠাণ্ডায় ঠক
১১০
ভলিউম ১৮
ঠক করে কাঁপতে লাগল সবাই।
বরফ হইয়া যাইটে পারি, টাই না?
ঠাণ্ডায় জমে বরফ হবার ভয়ে সবাই অস্থির হয়ে উঠছে। বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয় এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতে। প্রতি মুহূর্তে অবশ হয়ে আসছে শরীর।
কুয়াশা শহীদকে নিয়ে আবার উঠল স্পেসক্রাফটের উপর। মিনিট সাতেক পর ফিরল ওরা। স্পেসক্রাফটের কয়েকটা যন্ত্রাংশ খুলে পকেটে ভরে নিয়েছে ওরা। এগুলো ছাড়া স্পেসক্রাফট অচল।
তিন।
‘স্থির থেকো না কেউ। নড়েচড়ে বেড়াও।’
কুয়াশা কথাগুলো বলে সুড়ঙ্গ মুখের দিকে পা বাড়াল। সবাই যে-যার ব্যাগ ব্যাগেজ কাঁধে নিয়ে অনুসরণ করল তাকে।
সুড়ঙ্গের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। তাকে হাসতে দেখে অবাক হয়ে গেল সবাই।
কাপড়-চোপড় খুলে ফেলো এবার।’
সবাই কুয়াশার কাছাকাছি পৌঁছে কথাটার অর্থ বুঝতে পারল। সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে উত্তাপ বেরিয়ে আসছে।
সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে নিচের দিকে।
মাথার উপর চক্কর মারছে কপ্টারটা। বরফের উপর নামার চেষ্টা করবে ওরা, জায়গা খুঁজছে।
ডি কস্টা তার কোটের পকেটে আশ্রয় দিয়েছে প্রিন্সকে। কথা বলে উঠল সে, ব! সুড়ঙ্গের ভিটরটা না দেখিয়া এইখান হইটে ফিরিটে চাই না।’
কপ্টার নামছে।
বরফের সমতলভূমি স্পর্শ করল ‘কপ্টার। চারদিকে তীরবেগে ছড়িয়ে পড়ল বরফের ছোট ছোট অসংখ্য টুকরো ।
ওদের কাছ থেকে ত্রিশ গজ দূরে ‘কপ্টারটা। লাফ দিয়ে নামল প্রথমে উলন। তারপর শিকদার। তারপর অনুচরবৃন্দ।
আক্রমণটা এল আচমকা। তৈরি ছিল না ওরা। কপ্টার থেকে নেমেই শত্রুপক্ষ আক্রমণ করে বসবে তা ওরা ভাবেনি। কিন্তু তাই ঘটল। স্টেনগানের বুলেট আঁকে ঝকে ছুটে এল ওদের দিকে।
পিছিয়ে গিয়ে সিঁড়ির ধাপে নামল ওরা। পাথরের গায়ে বুলেটের বৃষ্টি পড়ছে। পাথরের টুকরো ছুটে আসছে চারদিক থেকে ওদের দিকে।
সবচেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল প্রিন্স। এখনও একেবারে বাচ্চা সে। ডি. কস্টার পকেট থেকে লাফ দিয়ে পড়ল সে সিঁড়ির ধাপে। আর এক লাফ দিয়ে সিঁড়ির মাথায় উঠে ছুটল সে।
কুয়াশা ৫৪
চেঁচিয়ে উঠল ডি কস্টা, ও গড! প্রিন্স! ছুটল ডি কস্টাও। কুয়াশা দ্রুত বলে উঠল, হল্ট। এক পাও এগোবেন না আর।
ফাঁকা জায়গায় উঠে গিয়ে থমকে দাঁড়াল ডি, কস্টা, দেখল দিশেহারার মত কয়েক গজ সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রিন্স। এলোপাতাড়ি গুলির শব্দে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সে।
ঝাকে ঝাঁকে বুলেট, এগিয়ে আসছে। হঠাৎ ডি, কস্টা পড়ে গেল। না, গুলি বিদ্ধ হয়নি তার শরীরে। কয়েকটা বুলেট তার মাথার হ্যাটটাকে ফুটো করে দিয়েছে মাত্র, মাথা থেকে খসে পড়েছে হ্যাটটা। এরপর ইচ্ছা করেই পড়ে গেছে ডি. কস্টা। হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে সে।
| কুকুরটার কাছে যেতে হলো না। সে নিজেই লাফ দিয়ে চলে এল ডি. কস্টার কাঁধের উপর।
খপ করে এক হাত দিয়ে প্রিন্সকে ধরে ফেলল ডি:কস্টা।
নিরাপদেই ফিরে এল ডি কস্টা প্রিন্সকে নিয়ে সুড়ঙ্গের সিঁড়ির ধাপে। সবাই ভীষণ রাগারাগি করলেও কুয়াশা কিছু বলল না। সে জানে, রাগ করলে লাভ নেই। বিপদকে ভয় করতে শেখেনি ডি. কস্টা, শিখবেও না কোনদিন। যাকে ভালবাসে সে তার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছ পা হবে না কোনদিন। এটা একটা মগুণ ডি কস্টার।
শহীদ মনোকল ম্যাগনিফাইয়ার-এর সাহায্যে পাথরের প্রকৃতি বিচার করার কাজে মগ্ন হয়ে পড়েছে সুড়ঙ্গের অকৃত্রিম সিঁড়ির ধাপে পা দেবার পর থেকে। কুয়াশা প্রশ্ন করতে ও বলল, কুয়াশা, এই গ্যানিট পাথরের গায়ে মানুষের বা মানুষ জাতীয় কোন প্রাণীর ছোঁয়া পড়েছে–প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি আমি। পাথরের প্রকৃতি বিচার করে যতদুর বুঝতে পারছি, সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথ আরও থাকা সম্ভব। আমরা সম্ভবত অচিহ্নিত একটা থ্যানিট পাথরের আইল্যাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। উপরের বরফগুলো আছাদন মাত্র-নিচে পাথর। অর্থাৎ বরফের রাজ্যে এটা একটা পাথরের দ্বীপ। সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে উত্তাপ আসছে দেখে আমি মনে করি এর ভিতর প্রাণী আছে। সুড়ঙ্গটা সম্ভবত কোন পাতালপুরীতে প্রবেশ করার পথ।
কুয়াশা মেনে নিল শহীদের বক্তব্য। | মাথা উঁচু করে শত্রুদের গতিবিধি দেখছিল কুয়াশা খানিক পরপরই। ‘কপ্টারের ভিতর থেকে কয়েকটা ভারী কাঠের বাক্স বের করছে লোকগুলো, দেখতে পাচ্ছে।
সে। গুলিবর্ষণ বন্ধ রেখেছে তারা।
কয়েক মুহূর্ত পর কুয়াশা মাথা নামিয়ে নিল। দ্রুত বলে উঠল, আরও নিচে নেমে যেতে হবে আমাদেরকে! ওরা গ্রেনেড গান ব্যবহার করবে।’
কাঠের বাক্স থেকে কয়েকটা বড় আকারের ভাঁজ করা রাইফেল বের করে তাতে হ্যাঁণ্ড গ্রেনেড ফিট করে লক্ষ্য স্থির করছে শত্রুরা, দেখেছে কুয়াশা। খানিক পরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটল সুড়ঙ্গের কাছাকাছি। কেঁপে উঠল পায়ের নিচের
১১২
ভলিউম ১৮
পাথর।
কুয়াশা হঠাৎ দুটো হাত একত্রিত করে মুখের সামনে চোঙ এর মত করে ধরল, তারপর উঁচু গলায় বলে উঠল, শিকদার! স্পেসক্রাফটের কিছু পার্টস আমরা
সরিয়ে ফেলেছি।
শত্রুদেরকে তথ্যটা জানিয়ে কুয়াশা শহীদের উদ্দেশে বলল, ওদের সঙ্গে বোঝাপড়াটা পরে হবে, কি বলো? আমরা সুড়ঙ্গের ভিতরটা দেখি আগে।’
রাসেল বলল, শত্ৰু পিছনে রেখে এগিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে? | কামালও বলে উঠল, ব্যাটাদেরকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য ছটফট করছে। হাত দুটো। মারামারি না করে ভিজে বেড়াল হয়ে থাকলে যে শরীরে মরচে ধরে। যাবে।
রাজকুমারী ওমেনা বলল, শক্তি যতটুকু আছে, জমিয়ে রেখে দাও, কামাল ভাই, বুঝলে? অলৌকিক মহাশক্তিরা যখন হামলা করবে তখন লড়তে হবে না?
কথা বলতে বলতে সিঁড়ির ধাপ কটা টপকে পাথরের সুড়ঙ্গে নেমে এল সবাই। শহীদ, কামাল এবং কুয়াশার পকেট থেকে বেরিয়ে এল টুর্চ। ওদের দেখাদেখি বাকি সবাই টর্চ জ্বালল। দশ-পনেরো গজ যাবার পরই একটা বাঁক পাওয়া গেল। বাঁক পেরিয়ে ওরা দেখল সুড়ঙ্গ এরপর অস্বাভাবিক চওড়া হয়ে
গেছে।
| এগিয়ে চলল ওরা। শীত তো দূরের কথা, ঘামতে শুরু করেছে সবাই। সুড়ঙ্গের সিলিং এবং দেয়ালে ভেজা ভেজা চুনা পাথরের চাইগুলোকে হাতির দাঁতের মত দেখাচ্ছে। * প্রশস্ত সুড়ঙ্গ এক এক জায়গায় এক এক আকার নিয়েছে। লম্বা-চওড়া কামরা– বলে মনে হয় এক একটাকে। কোন কোন জায়গায় ছাদ এত বেশি উঁচুতে যে টর্চের আলো সেখানে পৌঁছায় না। দু’পাশে অসংখ্য নানা আকারের অলিগলি, প্যাসেজ দেখা যাচ্ছে।
কথা বলছিল ওরা। সবিস্ময়ে এক একজন এক একটা মন্তব্য করছিল। প্রতিটি কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে আরও উচ্চকিত শব্দে ফিরে আসছিল ওদের কাছে। কথার শব্দই নয়, পদশব্দ এমন কি নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ-সবই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
মিনিট চারেক এগোবার পর কুয়াশার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল চারদিক থেকে, দাঁড়াও!’
সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। যথাসম্ভব স্থির হয়ে গেল সবাই। নিঃশ্বাসের শব্দও করছে না কেউ। অথচ প্রতিধ্বনির শব্দ থামল না।
‘শুনতে পাচ্ছ, শহীদ?’
শহীদ বলল, ‘পাচ্ছি। আমরা ছাড়াও এই সুড়ঙ্গে আর একদল মানুষ আছে। সম্ভবত শিকদারের দল। ওরা বোধহয় শর্টকাট কোন পথ দিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকেছে।’
কুয়াশা নিচু কিন্তু দ্রুত কণ্ঠে বলল, একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। এগিয়ে চলো! ৮ কুয়াশা ৫৪
১১৩
এগিয়ে যেতে শুরু করল ওরা। কুয়াশা শহীদের কানের কাছে মুখ নামিয়ে কিছু যেন বলল। শহীদ মাথা নেড়ে সমর্থন জানাল তাকে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। কুয়াশা বলে উঠল, দাঁড়াও সবাই। সর্বনাশ! শহীদ, সামনের বাঁকের পর সুড়ঙ্গের দেয়াল। এখন উপায়? পিছনে শত্রুরা, সামনে এগোবার পথ নেই–আটকা পড়ে গেছি দেখা যাচ্ছে।’
কুয়াশার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসির আওয়াজ পাওয়া গেল পিছন থেকে শিকদারের।
বিকট অট্টহাসির প্রতিধ্বনিত শব্দে কানে তালা লাগার অবস্থা হলো। তারপরই ঠা ঠা ঠা ঠা শব্দে গর্জে উঠল একাধিক স্টেনগান।
| ‘আলো অফ করো!’ নির্দেশ দিল কুয়াশা, ক্রল করে এগিয়ে এসো সবাই এদিকের বাঁকে। এখান থেকে আত্মরক্ষার জন্য পালটা আক্রমণ চালাতে হবে।
| কল করে পিছিয়ে যেতে শুরু করল সবাই।
ডি. কস্টা বলে উঠল, কিন্টু এনিমিডের সুবিডা অটিক মনে হইটেছে। উহারা হামাডেরকে ফাঁড়ে ফেলিয়াছে।
কামাল বলল, সুড়ঙ্গ এখানে শেষ হয়ে গেছে তা সম্ভবত ওরা জানে•••।’
কুয়াশা বলে উঠল, ‘আন্তে! আমরা আটকা পড়ে গেছি তা ওদেরকে জানানো চলবে না!
কিন্তু শিকদার এবং তার দলবল খানিক আগেই ব্যাপারটা জেনে ফেলেছে। কুয়াশার কথা তারা শুনতে পেয়েছে পরিষ্কার। সামনের একটা প্রকাণ্ড গুহার ভিতর
সে এবং তার দলবল পজিশন নিয়ে আছে।
শিকদার কঠিন কণ্ঠে বলে উঠল, তোমাদের খেলা খতম হয়ে গেছে, কুয়াশা। সুড়স থেকে বেরুবার এই একটাই রাস্তা। এ রাস্তা আমরা ছাড়ছি না। ভালোয় ভালোয় সারেন্ডার করো সবাই। তা না হলে না খেয়ে পচে মরতে হবে। তোমরা সারেণ্ডার না করলে আমরা গ্রেনেড দিয়ে সুড়ঙ্গের ছাদ আর দেয়াল ধসিয়ে দিয়ে একমাত্র বেরুবার পথটাও বন্ধ করে দেন। পচে মরবে তোমরা। চার-পাঁচ দিন পর আবার গ্রেনেডের সাহায্যে পথটা উন্মুক্ত করব। সংগ্রহ করব স্পেসক্রাফটের পার্টসগুলো। ভেবে দেখো কি করবে, দুমিনিট সময় দিলাম তোমাদের।’
উত্তর দিল না কুয়াশা। ফিসফিস করে রাজকুমারী বলল, কি ভাবছ, কুয়াশা?’ ‘ ডি. কস্টা ঢোক গিলল, ‘পচিয়া মরিটে ঘৃণা লাগে। হামাডের এই শরীর হইটে। পচা ডুকাও বাহির হইবে–আনবিয়ারেবল!
কামাল অস্থির কণ্ঠে বলল, “কিন্তু সারেণ্ডার করতেও রাজি নই আমি।’ রালে মরিয়া হয়ে জানতে চাইল, আমরা কি যুদ্ধ করব না, কুয়াশাদা? শান্ত কণ্ঠে বলল কুয়াশা, লাভ নেই।’ তাহলে!’
এদিকে উলনের সঙ্গে পরামর্শ করছে শিকদার। তাদের কথা পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আলোচনা শেষে তারা সিদ্ধান্ত নিল, গ্রেনেড মেরে একমাত্র
১১৪
ভলিউম ১৮
বেরুবার পথটা এক হপ্তার জন্য বন্ধ করেই দেবে তারা।
কুয়াশা কথা বলল, “কিছু করার নেই আমাদের, রাসেল। গ্রেনেড ফাটুক, দেখা যাক পথটা সম্পূর্ণ বন্ধ হয় কিনা। ভাগ্যের উপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ।
কয়েক মুহূর্ত পর প্রথম গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো। কুয়াশার নির্দেশে আরও খানিকটা পিছিয়ে এল ওরা সবাই। এরপর গ্রেনেড ফাটতে লাগল একটার পর একটা। প্রতিটি বিস্ফোরণের সঙ্গে থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল সুড়ঙ্গের দেয়াল এবং মেঝে।
মোট চারটে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো। ধোয়া আর বারুদের গন্ধে দম আটকে এল ওদের।
কুয়াশা নির্দেশ দিল, সবাই এখানে থাকো। শহীদ, এসো আমার সঙ্গে। সামনের দিকে এগিয়ে গেল ওরা দুজন।
মিনিট তিনেক পর ফিরে এল ওরা। শহীদ বলল, “উঠে পড়ো সবাই। শিকদাররা সত্যি বন্ধ করে দিয়েছে পথটা।
| ‘এখন উপায়? *
শহীদ সহাস্যে বলল, ‘চলো, এগিয়ে যাই ভিতর দিকে। কুয়াশা বলেছিল বটে সুড়ঙ্গের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি আমরা। কিন্তু তা সত্যি নয়। শত্রুদেরকে ভুল ধারণা দেবার জন্যে কথাটা বলেছিল ও। সামনে কোন দেয়াল নেই।
সবাই আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠল।
কুয়াশা বলল, শত্রুরা জানবে আমরা আটকা পড়ে গেছি। ফলে অনেক সুবিধে পাব আমরা।
রে শহীদ বল, ৪৮ পক্ষে দাহ
উলনের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে শত্রুদল। সুড়ঙ্গে হাজারটা অলিগলি, অসংখ্য প্যাসেজ। কিন্তু উলন দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে থমকে দাঁড়াচ্ছে সে। দেখে নিচ্ছে দেয়ালের কিছু সাঙ্কেতিক চিহ্ন।
এই চিহ্নগুলো উলন অনেক আগেই রেখে গিয়েছিল দেয়ালে। শিকদার বলল, ঠিক পথে যাচ্ছ তো?’
উলন বলল, বিশেষ করে এই সুড়ঙ্গটা খুবই জটিল। পাঁচ হাজার প্যাসেজ আছে এর ভিতর। এই জায়গাকে বলা হয় ল্যাণ্ড অব দ্য লস্ট। এখানে কেউ ঢুকে আজ অবধি বেরিয়ে যেতে পারেনি। একমাত্র আমিই সফল হয়েছি। চিহ্ন রেখে গেছি আমি। পথ হারাবার কোন ভয় একমাত্র আমারই নেই।
এগিয়ে চলেছে দলটা। কোথায় কোন্ দিকে তা একমাত্র উলনই জানে। হাঁটার, এগিয়ে যাবার বিরাম নেই তার।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা একনাগাড়ে হাঁটার পর হঠাৎ থমকে দাঁড়াল উলন। শিকদার এবং তার পিছনের অনুচরবৃন্দও দাঁড়িয়ে পড়ল। শিকদার ক্লান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল, কি ব্যাপার? কুয়াশা ৫৪
১১৫
উলন নিচের দিকে পাথরের গায়ে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের গায়ে পায়ের ছাপ।
‘সোনা! সোনার পায়ের ছাপ! কিন্তু সোনা এখানে এল কি ভাবে! কী আশ্চর্য! শিকদার জানতে চাইল, সোনা? সোনা কে?’
সিধে হয়ে দাঁড়াল উলন। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। বলল, সোনা, একমাত্র সোনাই রাজকীয় চিহ্ন খোদাই করা স্যাণ্ডেল পায়ে দেয়। চিনতে ভুল হয়নি আমার। সোনা কে? তোমরা যাকে রাজকুমারী বলো, সোনা তাই। সে এখানকার রাজকন্যা। এই সোনাকেই আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে।’
শিকদার বলে উঠল, রাজকন্যা!
উলনের মুখটা ভয়াবহ হয়ে উঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল সে, ‘সোনাকে চাই আমার পায়ের ছাপ দেখে বুঝতে পারছি, খানিক আগেই সে এই পথ দিয়ে গেছে। ওকে ধরতে হবে। ওকে ধরে জিম্মি হিসেবে রাখব আমরা।’
শিকদার মাথা নেড়ে চাপা স্বরে বলে উঠল, বুঝেছি! রাজকুমারী সোনাকে জিম্মি রেখে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।’
উলন বলল, শুধু তাই নয়। সোনাকে আমরা পেলে দর কষাকষি করতে পারব এখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আমরা যেটা নিতে এসেছি সেটা পাওয়া খুবই সহজ হয়ে যাবে সেক্ষেত্রে। তাছাড়া সোনাকে বিয়ে করার সাধও আমার পূরণ হবে।
উলন ছুটতে শুরু করল। তার ধারণা, সোনা খুব বেশি দূর যায়নি এখনও। তাকে ধরা সভব।
ধারণাটা মিথ্যে নয় উলনের। পনেরো মিনিট পরই সোনাকে দেখা গেল। উলনের পদশব্দ পেয়ে রাজকন্যা দৌড়ুতে শুরু করল।
কিন্তু রাজকন্যা সোনা উলনের সঙ্গে পারবে কেন? চোদ্দ কি পনেরো বছর বয়স তার। কোমর অবধি সোনালি চুল। গায়ে আঁটো পোশাক। পোশাকটা যেমন নরম তেমনি উজ্জল কিন্তু কাপড়ের নয়। রাজকুমারীর চোখে অদ্ভুত আকৃতির একটা গগলসও রয়েছে। | ধরা পড়ে গেল সোনা। মূলত ইচ্ছা করেই ধরা দিল সে। ঘাড় ফিরিয়ে উলনের দিকে তাকাল সে। দেখল উলনের ডান হাতটা বাতাসে ভর দিয়ে ফড়িংয়ের মত উড়ছে, অমনি দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বোঝা গেল, হাতের ফড়িংয়ের মত উড্ডয়ন এর আগেও দেখেছে সে।
| উলন দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করল সোনাকে। সোনা ভীতা হরিণীর মত চেয়ে রইল, কথা বলল না। তার চোখ থেকে ছো মেরে গগটা কেড়ে নিল উলন। ঠিক সেই সময় ওদের কাছ থেকে বিশ হাত দুরের একটা বাকের মাথার নিকটবর্তী প্রশস্ত গুহা থেকে সশব্দে ছুটে এল কয়েকটা গুলি।
শিকদার এবং হাক্কার হাতের টর্চ দুটো নিভে গেল।বুলেট কারও গায়ে নয়, টর্চে লেগেছে।
১১৬
ভলিউম ১৮
অপ্রত্যাশিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ল শত্রুদল। এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল সবাই শেলটার নেবার জন্য। শিকদার চেঁচিয়ে উঠল, ‘গুলির শব্দ। রিভলবারের! তার মানে শয়তান কুয়াশা আর তার দলবল বেঁচে আছে এখনও।
চার
শিকদার এবং তার দল চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও কয়েক মুহূর্ত পরই তৈরি করে নিল নিজেদেরকে। রাইফেল, স্টেন, রিভলবার-প্রত্যেকে নিজের নিজের অস্ত্র। ব্যবহার করতে শুরু করল ওরা।
কুয়াশার নির্দেশে গুলি করছিল সুপার মেশিন পিস্তল দিয়ে রাজকুমারী ওমেনা, কামাল এবং রাসেল । শত্রুদের কাউকে লক্ষ্য করে নয়, গুলি করছিল ওরা শত্রুদের হাতের টর্চগুলো লক্ষ্য করে।
খণ্ড যুদ্ধে যোগ দেয়নি উলন। রাজকুমারী সোনার একটা হাত ধরে এক পাশে | দাঁড়িয়ে আছে সে। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। সর্বশেষ টর্চটাও গুলির আঘাতে নিভে গেল। উলন শক্ত করে চেপে ধরল সোনার হাতটা। এর এক মুহূর্ত পরই সে অনুভব করল, কে যেন সবেগে ছিনিয়ে নিল তার হাত থেকে সোনাকে। পর মুহূর্তে, হাড্ডিসার চোয়ালে আড়াই মণ ওজনের একটা প্রচণ্ড ঘুসি খেলো। ছিটকে গিয়ে পাথরের দেয়ালে পড়ল ঈলন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উঠে সে দাঁড়াল বটে কিন্তু অন্ধকারে হাতড়ে সোনার সন্ধান পেল না;
শিকদার গর্জে উঠল, ‘থামো! থামে সর্বাই!’
শিকদার হঠাৎ বুঝতে পেরেছে, কুয়াশার দল গুলি ছোঁড়া বন্ধ করে দিয়েছে। নির্দেশ পেয়ে থামল অনুচরেরা।
কুয়াশা ক্রল করে এগিয়ে যাচ্ছিল, শত্রুদের শেষ টর্চটা নিভে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উলনের সামনে গিয়ে পড়ে সে। আগে থেকেই উলনের অবস্থান দেখে রেখেছিল। সোনাকে নিরাপদে সরিয়ে আনাটা জরুরী বিবেচনা করেই শত্রুদের। ঘাড়ে লাফিয়ে পড়েনি এতক্ষণ। শুধু উলনের চোয়ালে একটা ঘুসি মেরে লাফ দিয়ে সরু একটা প্যাসেজে ঢুকে গা ঢাকা দিল কুয়াশা।
প্যাসেজের ভিতর থেকেই সাঙ্কেতিক ভাষায় নির্দেশ দিল, কুয়াশা।নির্দেশ। পেয়ে শহীদ ও কামালসহ ওরা পাঁচজনই সুপার মেশিন পিস্তলের মার্সি-বুলেট ছুঁড়তে শুরু করল। সেই সঙ্গে, স্বয়ং কুয়াশা আলখেল্লার পকেট থেকে পর পর কয়েকটা আগুনে বোমা বের করে ছুঁড়ে দিল শত্রদলের তিনদিকে।
আগুনে বোমা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। পরমুহূর্তে দেখা গেল তিন দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে। পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো শত্রদল।
কুয়াশার নির্দেশ পেয়ে শহীদের নেতৃত্বে প্রশস্ত কামরা থেকে বেরিয়ে ক্রল করে এগিয়ে যেতে লাগল ওরা। ওদের সামনেও আগুন জ্বলছে। কিন্তু কুয়াশা পকেট থেকে একটা প্রে-মেশিন বের করে খানিকটা তরল কেমিক্যাল সেদিকে স্প্রে করে। দিতেই নিভে গেল আগুন।
কুয়াশা ৫৪
১১৭
এগিয়ে চলল ওদের দলটা।
এদিকে পিছিয়ে যেতে যেতে শত্রুদল হঠাৎ টের পেল, পিছনে তাদের পাথরের দেয়াল, বেরুবার কোন উপায় নেই।
শহীদের দল গুলি করতে করতে এগোচ্ছিল। হঠাৎ শোনা গেল কুয়াশার কণ্ঠস্বর, থামো!’
থামল সবাই। অটুট নিস্তব্ধতা নামল পাতালপুরীর সুড়ঙ্গের সর্বত্র। ‘একি ব্যাপার! শত্রুরা পেল কোথায়! কোন টু শব্দ নেই…’
কুয়াশা বলল, ওরা আটকা পড়ে গেছে একটা সরু প্যাসেজে। গ্যাস বোমা ফাটিয়ে অজ্ঞান করে দিয়েছি ওদেরকে।
কুয়াশার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল দুটো টর্চ। টর্চের আলোয় সবাই দেখল কুয়াশার পাশে অপরূপ সুন্দরী একটি কিশোরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজকুমারী ওমেনা সবিস্ময়ে জানতে চাইল, কে ও? কোথায় পেলে ওকে?
কুয়াশা বলল, উলন একে বন্দী করেছিল। কে এ, কি এর পরিচয় জানি না। কথা বলে বটে, কিন্তু ভাষাটা পৃথিবীর কোন ভাষা নয়। ওর কোন কথাই আমি বুঝতে পারছি না। আমার কোন কথাও বুঝতে পারছে না ও।
কুয়াশা থামতেই ডি কস্টার হাতের টর্চটা নিভে গেল।
হাউ স্ট্রেঞ্জ! হামার টর্চ কে ছিনাইয়া নিল, মি. কামাল।
কামাল বলে উঠল, “আমি? আমি কোন দুঃখে আপনার কী আশ্চর্য! আমার টর্চ কেন কেড়ে নিলেন? এ কি ধরনের ঠাট্টা। মি. ডি…!’
| প্রথম ডি কস্টা, পরে কামালের হাত থেকে কে যেন টর্চ দুটো গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিয়ে নিভিয়ে ফেলেছে।
বী কেয়ার ফুল, মি. কামাল। হাপনাকে সাবান করিয়া ডিটেছি, হামার সাঠে মস্করা করিবেন নাঃহাউ স্ট্রেঞ্জ! হামার পকেট হইটে কে বাহির করিয়া নিল প্রিন্সকে।
গোলযোগটা এইভাবেই শুরু হলো।
রাজকুমারী খেপে উঠে চিৎকার করে উঠল, কী আশ্চর্য! কার এমন নীচ সাহস শুনি! আমাকে চিমটি কাটছেন–আশ্চর্য!
কুয়াশার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল সোনা। কুয়াশা তার একটা হাত ধরে রেখেছিল। হঠাৎ, কে যেন সবেগে ছিনিয়ে নিয়ে গেল সোনাকে কুয়াশার কাছ থেকে।
অন্ধকার। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ওরা। কুয়াশা দ্রুত ছুটোছুটি করল এদিক ওদিক। নেই সোনা! আলখেল্লার পকেট থেকে একটা পেন্সিল টর্চ বের করল সে। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেটাও ছিনিয়ে নিল কেউ তার হাত থেকে।
| কুয়াশা দ্রুত, বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠল, মেশিন পিস্তল কেউ ব্যবহার করো না। নিজেরাই মারা পড়বে তাতে। আগে আলোর ব্যবস্থা করো।’
১১
ভলিউম ১৮
‘এই–যাহ্! শহীদের গলা শোনা গেল, আমার পেন্সিল টর্চটা কেড়ে নিল
কে?’
কামাল চিৎকার করে জানতে চাইল, এসব ঘটছে কি!’
মহাশক্তি! অলৌকিক মহাশক্তি!’ চিৎকার করে উঠল রাসেল। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড একটা ঘুসি খেয়ে পাথরের মেঝের উপর পড়ে গেল সে।
পিছিয়ে এসো সবাই! সবাই একত্রিত হও!’ সকলের পিছন থেকে কুয়াশার কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া হলো কারও! আশ্চর্য ধরনের নরম ভেজা ভেজা এটেল মাটির মত কিছু একটা ঘিরে ফেলেছে ওদেরকে প্রশস্ত সুড়ঙ্গের চারদিক থেকে। অন্ধের মত হাত ছুঁড়ে, মুঠো করে ধরার চেষ্টা করছে ওরা অদৃশ্য শত্রুদের। কিন্তু কোন চেষ্টাই সফল হচ্ছে
। ক্রমশ চেপে বসছে নরম, ভেজা ভেজা জিনিসটা প্রত্যেকের মুখের উপর। জিনিসটা দুর্গন্ধ যুক্ত। ধরতে পারা যায় না।
| অসহায়ের মত ছুটোছুটি করতে লাগল ওরা। মুখে, গলায়, বুকে, হাতে, কোমরে–শরীরের সর্বত্র সেই বিচিত্র অচেনা নরম জিনিসগুলো চেপে বসছে। আতঙ্কে, ভয়ে সবাই দিশেহারা হয়ে পড়ল।
দুর্গন্ধটা চেনা চেনা, কিন্তু চিনতে পারল না কেউ। একের পর এক, সবাই পাথরের মেঝেতে পড়ে গেল। নিঃসাড়, মৃতবৎ পড়ে রইল সবাই।
একমাত্র কুয়াশা তখনও পরাজয় স্বীকার করেনি। দম বন্ধ করে সংগ্রাম করে চলেছে সে। বিদ্যুৎবেগে ছুটোছুটি করছে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না কিছু। তবু,
অদৃশ্য শত্রুদের ধরার জন্য চেষ্টার বিরাম নেই তার।
কিন্তু দম বন্ধ করে কতক্ষণ থাকতে পারে একজন মানুষ! শেষ পর্যন্ত শ্বাস গ্রহণ করতে হলো তাকে।
আর সবার মত, কুয়াশার প্রকাণ্ড দেহটা সশব্দে পড়ে গেল পাথরের মেঝেতে। অটুট নিস্তব্ধতা নেমে এল রহস্যময় পাতালপুরীতে।
পাঁচ জ্ঞান ফিরে পেয়েও ওরা চারদিকে গাঢ় এবং নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। মেঝেটা মনে হলো অপেক্ষাকৃত সমতল। কুয়াশা ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেককে প্রশ্ন করে জেনে নিন কার অবস্থা কেমন। আঘাত পেয়েছে এক-আধটু সবাই। তবে কারও আঘাতই মারাত্মক ধরনের নয়। সবার পকেটগুলো শুন্য আবিষ্কার করল ওরা। কিন্তু আশ্চর্য বোধ করল এই দেখে যে কারও হাতপা-ই বাধা হয়নি।
কামালের প্রশ্নের উত্তরে কুয়াশা বলল, “অলৌকিক মহাশক্তিই হোক বা আর
কুয়াশা ৫৪
১১৯
যেই হোক, যারা আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে তারা হয়তো জানে পালাবার কোন উপায় নেই আমাদের, তাই হয়তো বাধার প্রয়োজন বোধ করেনি।
মাই গড! হামার প্রিন্স কোঠায়!’
কুকুরটা ডি. কস্টার কণ্ঠস্বর চেনে। কার যেন পদশব্দ শোনা গেল। ডি কস্টা অন্ধকারে হাতড়াতে শুরু করল, ধরে ফেলল প্রিন্সকে। কামাল বলে উঠল, আল্লাই জানে শিকদারের দলের ভাগ্যে কি ঘটেছে! কুয়াশা, আমরা এখন কোথায় বলতে, পারো?
‘যেখানে ছিলাম সেখান থেকে আরও নিচে নিয়ে আসা হয়েছে আমাদেরকে। টেম্পারেচার অনুভব করে বুঝতে পারছি। এই মুহূর্তে আমরা একটা বড়সড় কামরার মত জায়গায় রয়েছি।’
ডি কস্টা খেপে উঠে বলল, “বী কেয়ারফুল। আর একবার যডি আমার মাঠায় গাট্টা মারো…।’
‘কে গাট্টা মারল তোমার মাথায়!’ জানতে চাইল রাজকুমারী ওমেনা। | এই.. •! হোয়াট ইজ দিস। হামার প্রিন্সকে কে… | মাই গড! এগেন সেই ভৌটিক কাণ্ড•••।’
প্রচণ্ড একটা ঘুসি খেলে কুয়াশা ঠিক কপালের পাশে, ডান কানের উপরে। মাথাটা ঘুরে উঠল তার! ‘আরে। আমার চুল ধরে টানছে কে••••।’
কামাল তার মাথার পিছন দিকে ঘুসি চালাল। কিন্তু ঘুসিটা বাতাসেই লাগল।
এরপর ওরা একযোগে আক্রান্ত হলো। সব দিক থেকে ওদের কাপড়-চোপড় ধরে টানাটানি করতে লাগল কারা যেন। সেই সঙ্গে চারদিক থেকে হাতুড়ির বাড়ির মত ঘুসি এসে পড়তে লাগল চোখে-মুখে-নাকে। রহস্যময়, বিচিত্র ধরনের শব্দ ‘শুনতে পেল ওরা। ফিসফিসে, দুর্বোধ্য আওয়াজ। একবার মনে হলো, কারা যেন চাপা স্বরে হাসছে। একবার মনে হলো শিস দিচ্ছে। একবার মনে হলো পাখিদের কলরব চারদিকে–সবই দুর্বোধ্য ব্যাখ্যার অতীত রহস্য ।
কুয়াশা!’ রাজকুমারীর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর। অজানা ভয়ে সবাই ভীত।
‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো সবাই।’ কুয়াশার কণ্ঠস্বর কানে ঢুকতে সবাই এই অলৌকিক বিপদে একটু স্বস্তি পেল।
| রাসেল কাঁপা গলায় বলে উঠল, “কি এগুলো-এরা দেখতে কেমন? কি দিয়ে তৈরি এদের শরীর। কুয়াশাদা, আমি বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছি। বাতাসের মত-হাত ঢুকে যাচ্ছে জিনিসগুলোর ভিতরে অথচ অনুভব করা যাচ্ছে না।’
কুয়াশা বলে উঠল, সম্ভবত তা নয় ব্যাপারটা। আমরা এমন একধরনের প্রাণীর সঙ্গে মোকাবিলা করছি যাদের পেশী অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে, বিদ্যুৎবেগে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। আমাদের কল্পনার চেয়েও দ্রুত বেগে সরে যেতে পারে এরা। ফলে আমাদের স্পর্শ করার চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।’
শহীদ প্রশ্ন করল, কিন্তু অন্ধকারে আমাদেরকে দেখছে কিভাবে ওরা?
১২০
ভলিউম ১৮
সেটাই হলো রহস্য!
কুয়াশা সর্বক্ষণ জায়গা বদল করে এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে সেদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একমুহূর্ত পর সকলের পিছন থেকে ভেসে এল তার কণ্ঠস্বর, পিছিয়ে এসো সবাই। এদিকে একটা সরু প্যাসেজ রয়েছে।’
কুয়াশার কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে পিছিয়ে যেতে শুরু করল সবাই।
প্রচণ্ড ঘুসি খেতে খেতে রক্তাক্ত, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সবাই। কিন্তু আত্মরক্ষার সহজাত তাগিদে সবাই মরিয়া হয়ে উঠেছে। বারবার ছিটকে পড়ছে ওরা ঘুসি খেয়ে। বারবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। অবশেষে কুয়াশার কাছে, সরু প্যাসেজে একত্রিত হতে সমর্থ হলো ওরা সবাই।
মন দিয়ে শোনো সবাই।’ কুয়াশা পরিষ্কার গলায় বলতে শুরু করল, কেউ কোন অবস্থাতেই ঘাবড়ে যেয়ো না। মাথা ঠাণ্ডা রাখার উপর নির্ভর করছে আমাদের জীবন-মৃত্যু। এ-জাতীয় বিপদে এর আগে আমরা পড়িনি। এবার কি করতে হবে শোনো। পাশাপাশি, গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়াও সবাই। পরস্পরের হাত ধরো। প্যাসেজটা সরু। একটা দেয়ালের মত হয়ে যাও সবাই মিলে । তারপর ধীরে ধীরে সামনে এগোও। সাবধান, কোন ভাবেই যেন তোমাদের শরীরের পাশ দিয়ে তোমাদের পিছনে কেউ যেতে না পারে, একটা পিঁপড়েও নয়।’
অশরীরী আক্রমণ বন্ধ হয়েছে এইমাত্র। দ্রু, কুয়াশার কথা মত পরস্পরের হাত ধরে পাশাপাশি দাঁড়াল ওরা একটা পাচিলের মত। তারপর এগোতে লাগল
ওরা এক পা এক পা করে সামনের দিকে।
‘এগোও, এগোতে থাকো। হাত ছেড়ো সবাই মুঠো পাকিয়ে! সম্ভব হলে, সামনে যা পাও ধরবার চেষ্টা করো…’
কুয়াশার নির্দেশ মত কাজ করতে লাগল ওরা।
থ্যাত্ করে শব্দ হলো একটা। সঙ্গে সঙ্গে শহীদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘অশরীরী নয়-এদের শরীর আছে। এইমাত্র আমার ঘুসি লেগেছে একটার গায়ে…’
থ্যাত! থ্যাত! পরপর শব্দ হলো দুটো। রাসেল, এবং কামালের দুটো ঘুসি লেগেছে |
ধরেছি। আমি ধরে ফেলেছি একটাকে। কামাল উল্লাসে ফেটে পড়ল। কুয়াশা বলে উঠল, ‘সাবধান, ছেড়ো না, কামাল। পারবে একা সামলাতে?’
‘পারব, আঁ! কুয়াশা, কামড় দিচ্ছে হাতে•••। ধুত্তোরী ছাই–এটা যে মি. ডি. কস্টার প্রিন্স।
কুয়াশা বলল, ‘সাবধান, লাইন ভেঙো না কেউ। আমরা প্যাসেজের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি।’
প্যাসেজও শেষ হয়ে এসেছে, অদৃশ্য শত্রুদের আক্রমণও সেই সঙ্গে বেড়ে গেছে। বুকে, পেটে, মাথায় ঘুসির পর ঘুসি খাচ্ছে ওরা। কিন্তু লাইন ভেঙে কেউ পিছিয়ে পড়ছে না। সর্বশক্তি ব্যয় করে অটল হয়ে আছে প্রত্যেকে। হঠাৎ শত্রুদের আর কুয়াশা ৫৪
কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
দরজা!’ | কুয়াশার বিস্মিত কণ্ঠর শোনা গেল, কী আশ্চর্য! বুঝলে, শহীদ, দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছে ওরা।
শহীদ প্রশ্ন করল, দরজা–কিন্তু এখানে কাঠ পেল কোথায় ওরা?’
কাঠ নয়। অপরিচিত, কৃত্রিম কোন জিনিস দিয়ে তৈরি করেছে ওরা দরজাটা। এগিয়ে এসো, ভাঙতে হবে দরজা।’
দরজাটা ভাঙতে বিশেষ সময় লাগল না ওদের। দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগল ওরা। অদৃশ্য শত্রুরা কি ভেবে, কে জানে, নতুন করে আক্রমণ চালাচ্ছে না আর। নির্দিষ্ট আকৃতি বিশিষ্ট সিঁড়ির ধাপ অনুভব করল ওরা। নিচে নামল। যেন একটা কামরায় প্রবেশ করল। কামরার ভিতর উঁচু নিচু নানারকম জিনিস স্পর্শ করে ওরা বুঝতে পারল এগুলো নানা
ধরনের ফার্নিচার। কিন্তু ফার্নিচারগুলো অস্বাভাবিক হালকা।
‘একটা গন্ধ পাচ্ছ? চিনতে পারো গন্ধটা?’ কুয়াশার প্রশ্নের উত্তর দিল শহীদ, পারছি। ব্যাঙের ছাতা!
হ্যাঁ। ব্যাঙের ছাতা। কিন্তু এখানকার ব্যাঙের ছাতাগুলো অন্য জাতের। অস্বাভাবিক বড় এবং নতুন জাতের। আমার ধারণা, বুঝলে, শহীদ, এই ব্যাঙের ছাতাকে রূপান্তরিত করে তৈরি করা হয়েছে দরজা, ফার্নিচার ইত্যাদি।
সামনে এগিয়ে চলেছে ওরা একটু একটু করে।
এদিকে আর একটা দরজা••।’
প্রচণ্ড একটা ঘুসি খেলে কুয়াশা। পরমুহূর্তে বাকি সবাই আক্রান্ত হলো একসঙ্গে।
নরম, আঠাল, ভিজে ভিজে কিছু একটা ওদের প্রত্যেকের চোখে মুখে-নাকে এসে লাগল। চেপে বসছে সেগুলো। গন্ধটা অসহ্য•••।
কুয়াশার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, দম বন্ধ করে থাকো সবাই, যতক্ষণ পারো•••।’
কুয়াশা আর একটা ঘুসি খেলো ডান দিকের চোয়ালে। সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎবেগে লাফ দিল সে। কিছু একটা ধরে ফেলল সে, কিন্তু জিনিসটা কি তা সে প্রথমে বুঝতে পারল না। একমুহূর্ত পর, টের পেল ব্যাপারটা। জিনিসটা আর কিছু নয়, একটা গগল!
গগলসটা চোখে পরল কুয়াশা।
তী, অত্যুজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল কুয়াশার। আলোটা সয়ে এল খানিক পর। তীব্র সোনালি আলোয় সে দেখতে পেল, তার বন্ধু-বান্ধবরা কাদের বিরুদ্ধে প্রাণরক্ষার জন্য যুদ্ধ করছে। ব্যাঙের ছাতা! এক একটা মানুষ সমান উঁচু।
সম্পূর্ণ অন্ধকারে, কয়লাখনিতে এক ধরনের ব্যাঙের ছাতা জন্মায়, জানা আছে কুয়াশার। সেই জাতীয়, কিন্তু অনেক বেশি বড় এবং অদ্ভুত আকৃতির এখানকার
১২২
ভলিউম ১৮
ব্যাঙের ছাতাগুলো।
শহীদ, কামাল–ওদের পাঁচজনকেই দেখতে পাচ্ছে কুয়াশা। তীব্র সোনালি আলোয় ওদেরকে কালো, অস্পষ্ট মূর্তির মত দেখাচ্ছে। ওরা সবাই প্রকাণ্ড আকারের ব্যাঙের ছাতার বিরুদ্ধে লড়ছে।
পা বাড়াল কুয়াশা। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। মানুষ সমান ব্যাঙের ছাতাগুলো নড়ে উঠল, সেগুলোর আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একের পর এক, অসংখ্য কালো মূর্তি।
এরাই অলৌকিক সেই শক্তি!
এগুলো মানুষের সমানই লম্বা। তাদের কারও কারও হাতে লম্বা ছড়ি দেখা যাচ্ছে। ছড়ির মাথাগুলো সাড়াশির মত। সেই সাড়াশিতে আটকে রয়েছে ব্যাঙের হাতার ভগ্নাংশ! ছড়ির মাথার সাড়াশি দিয়ে ধরে ব্যাঙের ছাতা চেপে ধরছিল কুয়াশাদের মুখ, নাক, গলায়।
চারদিক থেকে লাফিয়ে পড়ল অলৌকিক শক্তিগুলো কুয়াশার উপর। আড়াই মণ ওজনের ঘুসি চালাতে শুরু করল সে। কিন্তু ওরা একটা দুটো নয়, অসংখ্য। দেখা গেল কুয়াশাকে ধরে টানা-হেঁচড়া করছে।
পড়ে গেল কুয়াশা। মৃত পোকার উপর যেমন পিঁপড়ের দল চড়াও হয় তেমনি তার শরীরের উপর চেপে বসল ওরা।
ছয়।
কুয়াশা একা নয়, আক্রান্ত হলো ওরা সবাই।
মিষ্টি কিন্তু তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ওরা। পরমুহূর্তে সবাই অনুভব করল, অলৌকিক সেই শক্তিগুলো ওদেরকে ছেড়ে দিয়েছে।
| অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কেউ। একমাত্র কুয়াশা ছাড়া। আবার সেই মিষ্টি কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
পরমূহুর্তে সবাই অনুভব করল ওদের চোখের উপর কি যেন এটে বসেছে।
তীৰ, অতুল সোনালি আলো ঝলসে উঠল প্রত্যেকের চোখের সামনে। কয়েক সেকেণ্ড পর ব্যাপারটা টের পেল ওরা, কারা যেন ওদের চোখে পরিয়ে দিয়েছে একটা করে গগ।
এবার পরিষ্কার দেখা গেল ওদেরকে। ওদের প্রত্যেকের চোখে একটা করে। গগলস রয়েছে। প্রথমে কালো বলে মনে হলেও তাদের চেহারা খানিক পর অন্য রকম হয়ে উঠল। তীর আলো চোখে সয়ে আসছে, সেই সঙ্গে সব জিনিসেরই আসল রঙ দেখতে পাচ্ছে ওরা।
| আশ্চর্য জীবগুলো মোটেই কালো নয়। তাদের রঙ লালচে। এবং তারা হুবহু মানুষের মতই দেখতে।
কুয়াশার গলা শোনা গেল, সবাই নিজেদের পিছন দিকে তাকাও।
কুয়াশা ৫৪
১২৩
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওরা। একদল মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি অপরূপ সুন্দরী কিশোরী মেয়ে।
মেয়েটি আর কেউ নয়, রাজকন্যা সোনা। হাসছে সে। বন্ধুত্বের হাসি।
কুয়াশা বলে উঠল, আলো নেই, অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি! অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা, তাই না? বাতাসের সঙ্গে যে ধূলিকণা থাকে সেই ধূলিকণাকে কি পদ্ধতিতে ঠিক জানি না, উজ্জ্বল করার বৈজ্ঞানিক কৌশল আয়ত্ত করেছে এরা।
রাজকন্যা সোনা এগিয়ে এসে কুয়াশার একটা হাত ধরল। ইঙ্গিতে সে কুয়াশাকে এবং অন্যান্যদেরকে অনুরোধ করল অনুসরণ করার জন্য।
‘ সোনার পিছু পিছু এগোল ওরা। গগলস পরা লোকেরা একপাশে সরে গিয়ে পথ করে দিল ওদেরকে। সকলেরই গায়ের রঙ লালচে, তবে কিছু লোকের হাত ধবধবে সাদা। দরজা, পেরিয়ে একটা প্যাসেজে বেরিয়ে এল ওরা। হঠাৎ দুজন লোককে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল গোটা দলটা।
লোক দু’জন দ্রুত এগিয়ে আসছে, তাদের হাত দুটো সাদা। দুজনেরই ডান হাত বাতাসে ভর দিয়ে ফড়িংয়ের মত উড়ছে।
সোনা তীর কণ্ঠে কিছু বলতেই লোক দু’জন দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের ডান হাতও সেই সঙ্গে স্থির হয়ে গেল।
রহস্যটা বুঝলে?’ রাজকুমারী জানতে চাইল। কামাল বলল, উলনকে এই রকম করতে দেখেছি!’
কুয়াশা বলল, উলনের পরিচয় পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। এই পাতালপুরীরই একজন সে। কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে কেন সে গিয়েছিল, শিকদারকে সঙ্গে নিয়ে আবার কেনই বা ফিরে আসল তা এখনও জানা যাচ্ছে না।
একটার পর একটা দরজা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা পাতালপুীর অভ্যন্তর ভাগে। প্রতিটি দরজার সামনে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা।
একসময় কুয়াশা মন্তব্য করল, ব্যাঙের ছাতা এবং শ্যাওলা-এ দুটো জিনিস এদের কাছে অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রথম যেখানে ধরা পড়ি সেখানে এই দুই জিনিসের চাষ হয় বৈজ্ঞানিক উপায়ে। তাই ওখানে পাহারার ব্যবস্থা। পাহারাদারদের হাতেই আমরা প্রথম আক্রান্ত হই।
| প্রকাণ্ড একটা হলরুমে ঢুকল সোনা। পিছন পিছন ঢুকল কুয়াশা এবং অন্যান্যরা। রূমের ভিতর লম্বা ডিভান রয়েছে, রয়েছে চেয়ার, পালঙ্ক-নানারকম সব ফার্নিচার। সবগুলোই হালকা কিন্তু ভারি মজবুত। সোনার ইঙ্গিত পেয়ে ডিভানে বসল ওরা। সোনা সহাস্যে কথা বলল একজন লোকের সঙ্গে। লোকটা দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেল রূম থেকে। মিনিট তিনেক পর আরও দু’জন লোককে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল লোকটা। তিনজনেরই হাতে খাবার ট্রে।
পাঁচ ছয় রকমের অচেনা খাদ্য। পাঁচটারই পাঁচ রকম রঙ।
খেতে কেমন স্বাদ কে জানে। ভয়ে ভয়ে মুখে দিল ওরা। খানিক পর দেখা গেল গ্রোগ্রাসে গিলতে শুরু করেছে সবাই।
১২৪
ভলিউম-১৮
কী অবাক কাণ্ড। এসব খাবারের নাম কি? কি দিয়ে তৈরি? এমন স্বাদ বাইরের দুনিয়ার কোন খাবারে পাইনি…!’
কামালকে সমর্থন করল সবাই একবাক্যে । খাওয়া শেষ হতে কুয়াশা বলল, আমরা কি খেলাম জানো?’
‘কি?’. | খেলাম পাঁচটা নয়, একটাই জিনিস। একঘেয়েমি কাটিয়ে বৈচিত্র্য আনার জন্য এরা, একই খাবারের মধ্যে বিভিন্ন রঙ এবং বিভিন্ন সুগন্ধ ব্যবহার করে। আমরা আসলে খেলাম রান্না করা ব্যাঙের ছাতা।’.
হোয়াট! কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। অবশ্য ব্যাঙের ছাতার সঙ্গে শ্যাওলাও মেশানো আছে।’
শহীদ জানতে চাইল, ‘কিন্তু শুধু ব্যাঙের ছাতা আর শ্যাওলা খেয়ে ওরা বেঁচে আছে কিভাবে?’
কুয়াশা বলল, সম্ভবত ব্যাঙের ছাতা ছাড়াও অন্য কিছুর চাষ করে এরা। তবে তাও ওই ছাতা জাতীয় কিছুই হবে। ব্যাঙের ছাতা এবং শ্যাওলা থেকে কেমিক্যাল নিয়ে, প্রাকৃতিক কেমিক্যাল মিশিয়ে সার তৈরি করা হয় সেই বিশেষ সারের সাহায্যে ব্যাঙের ছাতা চাষ করা হয়। এদের দৈহিক শক্তি আমাদের চেয়ে অনেক
বেশি। ব্যাঙের ছাতা, এবং এই অন্ধকারময় পাতালপুরীতে আর যে সব জিনিস পাওয়া যায় সেগুলোকে, এরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে নিজেদের জীবন ধারণের জন্য উন্নত উপকরণে রূপান্তরিত করতে সমর্থ হয়েছে। অবশ্য এ সবই আমার অনুমান।
রাজকুমারী বলল, বাতাসেও কেমন একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে-এটার কি ব্যাখ্যা?
‘এখানকার বাতাস জীবাণুমুক্ত। এরা সম্ভবত নদীর পানি থেকে অক্সিজেন তৈরি করে। অক্সিজেন বা বাতাস তৈরি করার কারখানা থাকা খুবই সম্ভব।’
শহীদ বলল, একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। বিজ্ঞানের কোন কোন শাখায় এরা বাইরের দুনিয়ার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। আমরা যেসব সমস্যা নিয়ে ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছি সমাধান বের করার জন্য, এরা সেসব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে বহু বছর আগে।
সোনা আবার এগিয়ে এসে কুয়াশার হাত ধরল। সবাই উঠে দাঁড়াল। প্রকাণ্ড হলরূমের অপর দরজার দিকে এগিয়ে চলল সবাই।
| বাইরে বেরিয়ে অবাক বিস্ময়ে সবাই যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। কুয়াশার চোখেও মুগ্ধ দৃষ্টি ফুটল। সামনে দীর্ঘ একটা মাঠ। মাঠের পর সুউচ্চ অট্টালিকা। একটা নয়, পাশাপাশি অনেকগুলো। সোনালি আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। আশ্চর্য এক স্বর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওরা। অট্টালিকাগুলো অত্যাধুনিক আর্কিটেকচারের সাক্ষ্য বহন করছে। দেয়াল এবং পাচিলগুলো মসৃণ এবং কয়েক মানুষ সমান উঁচু। অট্টালিকার স্ট্রাকচার, দেয়াল, পাঁচিল, কার্নিস, জানালা, দরজা, ভেন্টিলেটার–সব কিছুই এমন নিখুঁত, এমন জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন যে তাজ্জব কুয়াশা ৫৪
১২৫
হয়ে উপায় নেই।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র রাসেল বলে উঠল, ‘ওয়াণ্ডারফুল! ফাংশন্যাল আর্কিটেকচারের এমন উন্নত দৃষ্টান্ত কল্পনাও করতে পারি না।’
ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ওরা সবাই মৃদু অস্পষ্ট একটা টিক টিক শব্দ শুনতে পেল। ঘড়ির ভিতর থেকে এই ধরনের শব্দ বেরিয়ে আসে। এখানকার শব্দটা অবশ্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। অবিরাম শোনা যাচ্ছে–টিক, টিক, টিক, টিক•• |
অট্টালিকাগুলো পাঁচতলা সমান উঁচু। কোন কোনটা মারও বেশি।
শহীদ আঙুল দিয়ে দূরবর্তী একটা অট্টালিকা দেখাল। এটার গায়ে অনেক বেশি জানালা। পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ অট্টালিকা। নিচে খরস্রোতা নদী। গায়ে মাছের ছবি আঁকা রয়েছে।
| কুয়াশা বলল, ওটা একটা কারখানা বলে মনে হচ্ছে। ওখানে সম্ভবত নদীর মাছকে ড্রাই-ফুডে রূপান্তরিত করা হয়।’
‘ডান দিকের ওই বিল্ডিংটা–আরে, ওটার দেয়ালে আঁকা রয়েছে ব্যাঙের ছাতা।
| রাজকুমারী থামতে কুয়াশা বলল, একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? পাশাপাশি এতগুলো বড় বড় ফ্যাক্টরী রয়েছে অথচ ধোয়া নেই, ধুলো নেই, দুর্গন্ধ নেই। কোথাও কোন আবর্জনাও চোখে পড়ছে না। এসবের অর্থ হলো, এখানকার মানুষরা সব জিনিসকেই কাজে লাগাতে পারে। এদের কাছে কোনটাই অকাজের নয়।
মাঠের উপর নামল ওরা। চারদিক থেকে কালো গগলস পরিহিত লোকজন এগিয়ে এল। ওদেরকে কেন্দ্র করে বড়সড় একটা ভিড় জমে উঠল দেখতে দেখতে। এগিয়ে চলল ওরা সামনের দিকে।
| ভবনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে যেটা বড় ওদেরকে নিয়ে সেটার দিকে এগোচ্ছে সোনা। ভবনটার কাছাকাছি পৌঁছে কয়েকটা জিনিস লক্ষ করুল ওরা। ভবনটার চেহারা দেখে মনে হলো, পাতালপুরীর অধিবাসীদের জীবন ধারণের জন্য যাবতীয় জরুরী জিনিসের সরবরাহ এখান থেকেই বুঝি হয়। ভবনটার যত কাছাকাছি যাচ্ছিল ওরা সেই ছন্দবদ্ধ টিক টিক শব্দটা ততই উচ্চকিত হয়ে উঠছিল। এদিকের বাতাস অপেক্ষাকৃত তাজা। ভবনটা অনেকটা গোলাকার। মাথার উপর মোটা মোটা পাইপ, এরিয়াল ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে।
‘এটা সম্ভবত সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল প্ল্যান্ট। টিক টিক শব্দটা এর ভিতর থেকেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। খনিজ পদার্থ অর্থাৎ লোহা ইত্যাদির ব্যবহারও তাহলে জানে এরা। কুয়াশা বলল।
আরও কাছাকাছি যেতে মৃদ, অস্পষ্ট একটা গুঞ্জন ধ্বনি শুনতে পেল ওরা। ধ্বনিটা বেরিয়ে আসছে কুয়াশার দেয়া নাম সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের ভিতর থেকেই।
শহীদ হঠাৎ বলে উঠল, “ও কিসের শব্দ? কুয়াশাও থমকে দাঁড়িয়েছে, মেশিনগানের শব্দ। মনে হচ্ছে সেন্ট্রাল
১২৬
ভলিউম ১৮
মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের পিছন দিক থেকে গুলির শব্দ হচ্ছে। এখানকার মানুষের আগ্নেয়াস্ত্র নেই–তারমানে শিকদার আর উলনের দল!’
সাত মেশিনগানের শব্দ শুনেই শিকদার এবং উলনের উদ্দেশ্য অনুমান করতে পেরেছে কুয়াশা। সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল প্ল্যান্ট-পাতালপুরীর অধিবাসীদের প্রধান শক্তির উৎস এটা। শত্রুরা এটা দখল করতে চাইছে।
রাজকুমারী সোনাকে প্রাসাদে ফিরে যেতে বলে উপস্থিত পাতালপুরীর লোকদের অনুরোধ করল কুয়াশা সোনাকে যেন তারা একা ছেড়ে না দেয়। ভাষা দিয়ে নয়, ইশারায়-ইঙ্গিতে কাজ সারল সে।
দল সঙ্গে নিয়ে ছুটল এরপর কুয়াশা। যাবার পথে একটা সুদৃশ্য বাগান চোখে পড়ল। কুয়াশার নির্দেশে বাগানে প্রবেশ করল সবাই। ব্যাঙের ছাতার একটা করে কাণ্ড হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল সবাই। ভেঙে সুপারমেশিন পিস্তলের সাইজ করে নিল। ওরা কাণ্ডগুলোকে। কুয়াশা বলল, তীব্র সোনালি আলোয় ভাল দেখা যায় না, অভ্যাস না থাকলে। শত্রুরা এগুলোকেই পিস্তল বলে মনে করবে। ‘
| এদিকে সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের পিছনের গেটে রক্তস্রোত বইতে শুরু করেছে। শিকদার এবং তার দলবল গেটের বারোজন প্রহরীকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের চোখ থেকে খুলে নিয়েছে গগগুলো। গগল্সু পরে তারা উজ্জ্বল আলোয় হঠাৎ দেখল, দূর থেকে ছুটে আসছে কুয়াশার দল। দিশেহারা হয়ে পড়ল। শিকদার। মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের গেট বন্ধ। গেটটা ভাঙাও সম্ভব নয়। প্রচুর সময় লাগবে। এদিকে নাছোড়বান্দা কুয়াশার দল ছুটে আসছে। তাদের হাতে। সুপারমেশিন পিস্তলও দেখতে পাচ্ছে সে।
“ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল শিকদার। দলবল নিয়ে পিছিয়ে গেল সে। কাছাকাছি একটা আবাসিক ভবনের সামনে গিয়ে চিন্তা করতে লাগল পরবর্তী পদক্ষেপ কি নেয়া যেতে, পারে। কুয়াশাকে সে ভয় করে যমের মত। তার হাত থেকে আত্মরক্ষা করাটাই সবচেয়ে জরুরী। শিকদার সিদ্ধান্ত নিল, পাশের ভবনটার ছাদে উঠে যাবে তারা।
দুই মিনিট পরই দেখা গেল শিকদার আর তার দল পাঁচতলা সমান উঁচু একটা ভবনের ছাদে উঠে গেছে। সেখান থেকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করছে তারা নিচের দিকে।
ইতিমধ্যে মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের গেটের সামনে পৌঁছে গেছে কুয়াশার দল। নিহত লোকগুলোকে দেখে দাঁতে দাঁত চাপল কুয়াশা। বলল, শহীদ, তুমি সবাইকে নিয়ে প্ল্যান্টের ভিতর ঢোকার চেষ্টা করো। ভিতরের লোকদের বিপদের গুরুত্ব বুঝিয়ে একত্রিত হতে বলে সবাইকে।
তুমি কি করবে? কুয়াশা বলল, আমি শিকদারের সন্ধানে যাচ্ছি। মেশিনগানের গুলি বন্ধ
কুমাশা ৫৪
১২৭
করতেই হবে। এখানকার মানুষ আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত নয়, সবাই কেমন, দিশেহারার মত ছুটোছুটি করছে। আমি চললাম। খুনী শিকদারকে কঠোর শাস্তি না দিয়ে শান্তি পাচ্ছি না আমি।’
কথাগুলো বলে যে-পথে এসেছিল সেই পথে ছুটতে শুরু করল কুয়াশা। খানিক পরই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
প্ল্যান্টের ছাদ থেকে কালো টুপি পরা একজন লোক শহীদদেরকে রাজকুমারী সোনার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল খানিক আগে। গেটের সামনে ওদেরকে দেখে লোকটা ধরে নিল, এরা শত্রু নয়, মিত্র। তার চিৎকারে গেটের ভিতরে দাঁড়ানো প্রহরীরা গেট খুলে দিল। একে একে সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের ভিতর প্রবেশ করল ওরা। সবার শেষে ভিতরে ঢোকার জন্য পা বাড়াল কামাল । হঠাৎ সে একটা উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল। দেখল, একজন লোক চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে গেটের দিকে। লোকটার মাথায় কালো টুপি রয়েছে। লোকটাকে চেনা চেনা লাগলেও চিনতে পারল না কামাল। গেটের ভিতর ঢুকল সে। গেট বন্ধ করে দিল প্রহরীরা।
প্রকাণ্ড উঠানের উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। ওদেরকে দেখে চারদিক থেকে লোকজন এগিয়ে আসছে।
গেটের বাইরে থেকে ভেসে আসছে সেই উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। হঠাৎ কামাল থমকে দাঁড়াল। চিৎকার করছে দুর্বোধ্য ভাষায়–কে ও? চেনা চেনা মনে হলো। হঠাৎ চেহারাটা চিনতে পারল সে। উলন।
‘উলন চিৎকার করছে। শহীদ বলল, সাবধান!
সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। চারদিক থেকে যারা ওদেরকে দেখার জন্য এগিয়ে আসছিল তাদের মুখে এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল হাসি হাসি ভাব। কিন্তু উলনের চিৎকার শুনে তাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে।
লোকগুলো ঘিরে ফেলল ওদেরকে।
দাঁড়িয়ে পড়েছে শহীদের দল। আতঙ্কিত, বিস্ফারিত চোখে ওরা দেখল চারদিক থেকে লোকগুলো ওদের দিকে এগিয়ে আসছে দ্রুত। যারা এগিয়ে আসছে তাদের প্রত্যেকের হাত ধবধবে সাদা। প্রত্যেকের ডান হাত বাতাসে ভর দিয়ে ফড়িংয়ের মত রয়ে সয়ে উড়ছে।
যোরা পথ ধরে ভবনটার নিচে এসে দাঁড়াল কুয়াশা। এই ভবনের ছাদেই আশ্রয় নিয়েছে শিকদারের দল। সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করা যেতে পারে কিন্তু সেটা নিরাপদ হবে না ভেবে কুয়াশা সিদ্ধান্ত নিল অসংখ্য সরু সরু যে পাইপগুলো ভবনের দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে সেগুলো ধরেই উঠে যাবার চেষ্টা করবে সে।’ •
ভলিউম ১৮ ১২৮
বৃষ্টি এবং রোদের অস্তিত্ব নেই বলে জানালাগুলোর কবাট নেই। তবে পর্দা আছে। প্রতিটি জানালায় প্রবেশ করেছে একাধিক সরু পাইপ। পাইপগুলোও দেয়ালের মত সোনালি রঙের বলে দূর থেকে দেখা যায় না। যাই হোক, সরু পাইপ ধরে উঠতে শুরু করল কুয়াশা। দ্রুত উঠছিল সে। পাইপগুলো সরু এবং রাবারের মত নরম হলেও, বেশ মজবুত। ছিড়বার ভয় নেই।
চারতলা অবধি উঠে গেল কুয়াশা। এমন সময় একটা অঘটন ঘটল। একটা জানালার পাশ ঘেঁষে উঠছিল কুয়াশা। এক মহিলা কামরার ভিতর থেকে কুয়াশাকে দেখতে পেয়েই আর্তচিৎকার করে উঠল।
| মহিলার দুর্বোধ্য চিৎকার কানে গেল শিকদার আর তার দলের লোকদের। ছাদের কিনারায় বসে ছিল আমীর খান তার স্টেনগান বাগিয়ে ধরে। উঁকি মেরে নিচের দিকে তাকাল সে। তাকিয়েই দেখতে পেল কুয়াশাকে। দ্রুত উঠে আসছে কুয়াশা উপর দিকে।
এ শয়তান কুয়াশা নিজেই মরতে এসেছে। ফিসফিস করে বলে উঠল সে। ঠিক ‘সেই মুহূর্তে মোনালি আলো নিভে গেল।
শিকদার বলল, কি হলো! গগলটা কি খারাপ হয়ে গেল আমা?’,
সবাই একসাথে বলে উঠল, না। আমরাও তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’
শিকদার বলল, বড় কারখানাটায় গোলমাল হয়েছে নিশ্চয়ই। ওখান থেকেই। শীতল আলো সরবরাহ করা হয়।
শিকদারের কথা চাপা পড়ে গেল আমীর খানের স্টেনগানের বিকট শব্দে। অন্ধকারেও সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া করেনি সে। কুয়াশা মাত্র হাত দশেক নিচে ছিল। অব্যর্থ লক্ষ্য আমির খানের। এত কাছ থেকে তার লক্ষ্য ব্যর্থ হবার নয়।
স্টেনগানের শব্দ থামল। কান পেতে রইল আমীর খান। নিচে দেহটা পড়বে কুয়াশার, নিশ্চয়ই শব্দ শোনা যাবে।
“ শোনা গেল শব্দ। অস্পষ্ট হলেও শব্দটা শুনে আমীর খান বুঝতে পারল কুয়াশার মৃতদেহ নিচের রাস্তায় পড়ে গেছে।
চিৎকার করে উঠল সে, কুয়াশা নেই! কুয়াশাকে খতম করে ফেলেছি!’ ‘কি! কি বলছ তুমি? শিকদার চমকে উঠল।
সব কথা ব্যাখ্যা করে বলল আমীর খান। শিকদার সব শুনে প্রথমে কথাই বলতে পারল না। উত্তেজিত বোধ করছিল সে। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতেও দ্বিধা বোধ করছিল। নিস্তব্ধতা ভেঙে ডাকল সে, “আমীর!
আমীর খান সাড়া দিল না।, আমীর খান?
শিকদার ডাকল। তবু সাড়া নেই আমীর খানের। কথা বলে উঠল হাক্কা, আরে, আমীর খান আমার পাশে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে যে•••।’
ভোমর হঠাৎ বলে উঠল, কানের পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে কি সব যেন ছুটে যাচ্ছে।
৯-কুয়াশা ৫৪
১২৯
হাক্কা বলল, আমীর খানের ঘাড়ে কি যেন বিঁধে রয়েছে একটা। টেনে বের করতে পারছি না।’
শিকদার কাঁপা গলায় বলে উঠল, “শুয়ে পড়ো! শুয়ে পড়ো! এখানকার পুলিসবাহিনী বিষাক্ত তীর ছুঁড়ছে•••।’
হাক্কা চিৎকার করে উঠল, ফজলা! ফজলা! সর্দার, ফজলা আমার পাশে ছিল, পড়ে গেছে ও, নড়ছে না।
| ‘শুয়ে পড়ো!’
দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল শিকদার, দু-জন কমে গেছে দল থেকে। যদি বাঁচতে চাও, মাথা তুলো না কেউ!
সময় বয়ে যেতে লাগল । ছাদের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে ওরা সবাই। খানিক পর নিস্তব্ধতা ভাঙল শিকদার, আচ্ছা, টিক টিক শব্দটা যেন কমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, না?’
‘আমিও বলতে চাইছিলাম কথাটা। অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে শব্দটা!’ হাক্কা বলে উঠল।
একজন অনুচর বলল, হাঁপিয়ে যাচ্ছি আমি, কি ব্যাপার!
শিকদার বলল, “টিক টিক শব্দটার সঙ্গে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের সম্পর্ক আছে। সাপ্লাই বন্ধ বা কমিয়ে দিচ্ছে কারখানা থেকে। চলো, নিচে নেমে যাই সবাই। নিচে অক্সিজেন এখানকার চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু সাবধান, টর্চ জ্বালবে
।’ | সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ওরা। মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের পাশ ঘেঁষে দ্রুত এগিয়ে চলল দলটা। অন্ধকারেও অকারণে স্টেনগানের গুলি এদিক ওদিক ছুঁড়তে লাগল ওরা। পাতালপুরীর অধিবাসীদের আতঙ্কিত চিৎকার ভেসে আসছে চারদিক থেকে।
কোথায়, কোন দিকে যাচ্ছে সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা রয়েছে শিকদারের। মিনিট পনেরো একনাগাড়ে হাঁটার পর থামল সে। পাতালপুরীর কেন্দ্রস্থল থেকে বহুদুরে চলে এসেছে তারা। এখানকার সিলিং অপেক্ষাকৃত নিচু। উপর দিকে তাকিয়ে শিকদার কথা বলে উঠল, আকরাম! মইটা নামিয়ে দাও।
| ‘দিচ্ছি, সর্দার!
একটা মই নেমে এল। সিলিংয়ের গায়ে একটা গর্ত, সেই গর্তের ভিতর দিয়ে উঠে গেল ওরা। এই সেই সুড়ঙ্গ। পাঁচ হাজার প্যাসেজ এবং অলিগলি আছে এই সুড়ঙ্গে। এই সূড়ই বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ।
উলন আসেনি?’ জানতে চাইল শিকদার।
, সর্দার। এত গোলমালের শব্দ কেন হচ্ছিল? ‘আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না।’
খেঁকিয়ে উঠল শিকদার। দল নিয়ে সুড়ঙ্গ পথ ধরে এগিয়ে চলল সে। প্রশস্ত, সুদীর্ঘ একটা কামরা পেরিয়ে গেল ওরা। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর এক জায়গায় থামল সবাই।
১৩০
ভলিউম ১৮
শিকদার বলল, বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বিশ্রাম নেব আমি। উলন কি গোলমাল যে বাধিয়ে বসেছে–খোদা মালুম।
আট শিকদারের কথা শেষ হতেই সিন্ধু বলে উঠল, আমি আর নিচে নামতে রাজি নই,
সর্দার। আশ্চর্য ধরনের বিপদ ওখানে। এবার নামলে নির্ঘাৎ মারা পড়ব।’ | হাক্কা বলল, আমিও ভয় পেয়ে গেছি! সর্দার, চলো পালিয়ে যাই।’
শিকদার শুয়ে পড়েছিল। উঠে বসল সে। বলল, তোদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা এসেছি এমন একটা জিনিস পাবার জন্য যেটা পেলে ধনী তো হবই, এমনকি, পৃথিবীর সব ক্ষমতা আমাদের হাতে এসে যাবে।– হাক্কা বলল, তোমার ওই এক কথা। ধনী হব? কিন্তু কিভাবে? ব্যাখ্যা করে বলো তো, সর্দার? কি এমন জিনিস আছে এখানে যা পেলে আমরা দুনিয়াটা দখল করে নিতে পারব?
সবাই একযোগে দাবি জানাল, ‘বলো, সর্দার। আমরা সব জানতে চাই।
শিকদার অস্বস্তি বোধ করল। তার দলের লোকেরা বিদ্রোহী হয়ে উঠছে, টের পেল সে। উলন অবশ্য সব ব্যাপার ব্যাখ্যা করে কাউকে বলতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু এখন তার নিষেধ মান্য করা সম্ভব নয়। শিকদার অবশেষে বলল, শোন
তাহলে। পাতালপুরীতে যে সোনালি আলো দেখেছিস-ওই আলোর ফরমুলাটা। নিতে এসেছি আমরা। পৃথিবীতে যত সোনা আছে, তার যা দাম, তার চেয়েও বেশি দামী জিনিস ওই শীতল সোনালি আলোর ফরমুলাটা।’
কিছুই বুঝলাম না! এই সোনালি আলো জিনিসটা কি?’ ‘উলনের কাছ থেকে যতটুকু জেনেছি আমি, বলছি।
শিকদার বলতে শুরু করল, এই পাতালপুরীর অধিবাসীদের পূর্ব পুরুষরা এখানে প্রবেশ করে কয়েক হাজার বছর আগে। বাইরের ঠাণ্ডার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এই পাতালপুরীতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা। তবে তখনকার দিনে ঠাণ্ডা খুব বেশি ছিল না এই অঞ্চলে। পরে, ধীরে ধীরে, শত শত বছর ধরে বাড়তে বাড়তে ঠাণ্ডা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পাতালপুরীতে, আটকা পড়ে যায় উলনের পূর্বপুরুষেরা। অবশ্য বিপদ হঠাৎ আসেনি। হাজার হাজার বছর সময় লেগেছে বিপদ আসতে। যাই হোক, উলনের পূর্বপুরুষরা নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য গবেষণা করতে থাকে। শত শত বছর পেরিয়ে যায়। অবশেষে তাদের গবেষণা
সফল হয়। তখন তারা বসবাস করত এই সুড়ঙ্গ-জগতে–ল্যাণ্ড অব স্টে। এখানে থেকেই তারা অন্ধকারে দেখতে পাবার যন্ত্র আবিষ্কার করে। এরপর তারা আবিষ্কার করে বাতাস অর্থাৎ অক্সিজেন তৈরি করার কৌশল। এই দুটো আবিষ্কার করে তারা সুড়ঙ্গ-জগৎ থেকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। সুড়ঙ্গের নিচে তারা
. কুয়াশা ৫৪
১৩১
পাথর কেটে তৈরি করে একটা ছোটখাটো শহর–পাতালপুরী।
‘এ তো ইতিহাস! আমরা জানতে চাইছি সোনালি আলোর কথা।
বলছি। উলন আমাকে বলেছে, এখানকার সবচেয়ে বড় কারখানায় বড় বড় তরল বাতাসের ট্যাঙ্ক আছে অসংখ্য। যেগুলোর সাহায্যে ঢাকার মত পঁচিশটা শহরকে গরমের দিনে বরফের মত ঠাণ্ডা করে দেয়া সম্ভব। এবার সোনালি আলো সম্পর্কে যা জানি, বলছি। এই যে সোনালি রঙ বা আলো আমরা এখানে দেখেছি এটা আসলে এক ধরনের ফসফরেসেন্ট ছাড়া আর কিছু নয়। বাতাসের সঙ্গে লক্ষ কোটি ধুলিকণা ভাসে, তা তো জানিস? এই ধূলিকণাগুলোকে কিভাবে জানি না উজ্জ্বল করা হয়। তারপর, অদৃশ্য আলো বা এক্স-রে জাতীয় কিছু একটা ফেলা হয় সেগুলোর উপর। এরপর বিশেষ পদার্থ দিয়ে তৈরি গগলস পরলেই যে-কেউ অন্ধকারে সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পায়। বাতাসের ধূলিকণাকে উজ্জ্বল করা হয় এবং সেগুলোর উপর অদৃশ্য আলো নিক্ষেপ করা হয় কারখানার বিরাট আকারের মেশিনের সাহায্যে।
হাক্কা বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল, “এসব আমাদের মাথায় ঢুকবে না, সর্দার। আমরা জানতে চাই, টাকা কোত্থেকে, কিভাবে আসবে।’
‘তুই একটা গাধা! সোনালি আলোর ফরমুলা আমরা যদি পাই, যদি সেই ফরমুলার সাহায্যে সোনালি আলো তৈরি করতে পারি, তাহলে কি অদ্ভুত কাণ্ড ঘটবে বুঝতে পারছিস না? যেহেতু সোনালি আলো একমাত্র আমাদের হাতেই থাকবে, সেহেতু অন্ধকারে সব কিছু দিনের আলোর মত দেখতে পাব আমরা। ইচ্ছা করলে, সেই আলো ব্যবহার করে আমরা বড় বড় শহরের ব্যাঙ্ক লুঠ করতে পারব। ইচ্ছা করলে সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ঘঁটিগুলো দখল করে নিতে পারব। ইচ্ছা করলে ফরমুলা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা রোজগার করতে পারব। ভেবে দেখ, ইলেকট্রিকের কোন দামই থাকবে না। এই সোনালি আলোর ব্যবহার শুরু হলে বড় বড় ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি তৈরি করার ফ্যাক্টরীগুলোকে আমরা অচল করে দেবার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেলিং করতে পারব।’ | সবাই একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, বুঝেছি। বুঝেছি। নাহ্, সত্যি তোমার মাথায়
বুদ্ধি আছে, সর্দার।’
| শিকদার বলল, ধৈর্য হারাবি না কেউ। মেকানিক্যাল প্ল্যান্টটা দখল করতে প্রথমবার ব্যর্থ হয়েছি আমরা। কিন্তু নিরাশ হলে চলবে না। উলনের সঙ্গে পরামর্শ করে আবার আমরা চেষ্টা করব। আমাদের কাছে অস্ত্র আছে, সুতরাং সফল আমরা হবই।’
| হাতের টর্চটা নাড়ছিল শিকদার। আঙ্গুলের চাপ পড়তে হঠাৎ সেটা জ্বলে উঠল। পরমুহূর্তে নিভিয়ে ফেলল সেটা শিকদার। দম বন্ধ করে চুপ করে রইল সে। কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল।
ভুল দেখেনি শিকদার। আলো জ্বলে উঠতেই কুয়াশার আলখেল্লার একটা প্রান্ত চোখে পড়েছে তার। একটা প্যাসেজের আড়ালে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল ১৩২
ভলিউম ১৮
আলখেল্লাটা।
কুয়াশার উপস্থিতি টের পেয়েও চুপ করে রইল শিকদার। কিছুক্ষণ পরে সে বলে উঠল, আমাদের থাকার কথা পাতালপুরীতে নামার’ গর্তটার কাছাকাছি লম্বা কামরাটায়। উলন ওখানেই আসবে। কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। যাক গে। শরীর বড্ড দুর্বল লাগছে। হাঁটাহাঁটি করার শক্তি পাচ্ছি না। ওখানে আমাদেরকে না দেখে উলন নিজেই আসবে এদিকে…’
শিকদারের ষড়যন্ত্র ধরতে পারল না কুয়াশা। উলন লম্বা কামরায় আসবে শুনে নিঃশব্দ পায়ে প্যাসেজ ধরে চলে এসেছে সে।
| লম্বা কামরার গাঢ় অন্ধকারে অপেক্ষা করছে কুয়াশা, উলনকে কাবু করাটাই তার উদ্দেশ্য। উলনই সব ষড়যন্ত্রের হোতা।
আবাসিক ভবনের দেয়াল বেয়ে কুয়াশা ছাদে ওঠবার সময় আমীর খান গুলি করেছিল ঠিক, কিন্তু গুলির শব্দ হবার আগেই সে লাফ দিয়ে পাশের জানালা গলে একটা কামরার ভিতর ঢুকে যায়। শত্রুদেরকে ভুল ধারণা দেবার জন্য কামরা। থেকে একটা ডিভান জানালা গলিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিল সে। সেই ডিভান পতনের শব্দ শুনেই আমীর খান ধরে নিয়েছিল কুয়াশার মৃতদেহ নিচের রাস্তায় পড়ে গেছে।
অন্ধকারের সুযোগে কুয়াশা এরপর আবার,কামরাটা থেকে জানালা গলে দেয়াল বেয়ে ছাদে উঠতে শুরু করে। ছাদে ওঠে সে নিঃশব্দে। তারপর থেকে কিছুক্ষণ আগে অবধি সে শিকদারের দলের সঙ্গে সঙ্গেই ছিল। অন্ধকারে কেউ তাকে দেখতে পায়নি। শিকদার হঠাৎ টর্চ জ্বালতে দ্রুত সরে যায় সে একটা প্যাসেজের আড়ালে।
কিন্তু শিকদার তার আলখেল্লার একটা প্রান্ত দেখে ফেলেছে, তা কুয়াশা জানে । জানে না বলেই শিকদারের কথাগুলো মিথ্যে অভিনয়ের অংশ বিশেষ বলে। সন্দেহ হয়নি তার।
• অপেক্ষা করছে কুয়াশা। উলন আসবে এখানে।
মিনিট সাতেক কেটে গেল। এরপর শোনা গেল পদশব্দ। কেউ যেন আসছে এদিকে। পদশব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। খানিক পর একটা আলো দেখতে পেল কুয়াশা। টর্চের আলো। দ্রুত এগিয়ে আসছে আলোটা।
শিকদার।’ | একটা প্যাসেজের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। এগিয়ে আসতে আসতে শিকদারের নাম ধরে ডাকল একবার উলন।
উলনের কণ্ঠস্বর চিনতে ভুল হলো না কুয়াশার। দেরি করার কোন মানে হয়, কুয়াশা দূরত্ব হিসেব করে বাঘের মত লাফিয়ে পড়ল উলনের উপর।
পাশ থেকে লাফিয়ে পড়ে কুয়াশা দুই হাত দিয়ে ধরে ফেলল উলনের দুটো হাত। কুয়াশা ৫৪
ধস্তাধস্তি শুরু করুল উলন। কিন্তু কুয়াশা এমন কায়দায় ধরে রেখেছে তাকে, সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করল সে।
উলনের হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেছে। গাঢ় অন্ধকার চারদিকে। হঠাৎ কুয়াশা চমকে উঠল।
উলন হাসছে শব্দ করে। পরমুহূর্তে চার পাঁচটা টর্চ জ্বলে উঠল। টর্চের আলোয় কুয়াশা দেখল বিশ-পঁচিশজন তোক ঘিরে ফেলেছে তাদেরকে। প্রত্যেকের হাতের রঙ সাদা। প্রত্যেকে এগিয়ে আসছে তাদের ডান হাতটা বাতাসে ফড়িংয়ের মত নাচাতে নাচাতে।
‘ছেড়ে দাও আমাকে! তা না হলে বুঝতেই পারছ। তুমি ছেড়ে দিলে তোমাকে হত্যা করা হবে না।’
| উপায় দেখল না কুয়াশা। উলনকে ছেড়ে দিল সে।
উলন বলে উঠল, এরা এখানকার পুলিসবাহিনীর লোক। কুয়াশা, তোমাকে রাজা আনায়াসার বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। রাজা তোমার অপরাধের শাস্তি দেবেন। তুমি এখন বন্দী।
দুর্বোধ্য ভাষায় পুলিসবাহিনীকে নির্দেশ দিল উলন। পুলিসবাহিনী কুয়াশাকে কড়া প্রহরার মধ্যে জেল-হাজতের দিকে নিয়ে চলল। শীতল সোনালি আলো আবার জ্বলে উঠেছে। শত্রুদের একজন কুয়াশাকে একটা গগলস দিতে সে দেখতে পেল। | জেল-হাজতে পৌঁছুতে মিনিট বিশেক লাগল ওদের। পাতালপুরীর কেন্দ্রস্থলেই
বস্থিত সেটা।
সেলে ঢুকিয়ে দেয়া হলো কুয়াশাকে। সেলে পা দিয়েই কুয়াশা সবাইকে দেখতে পেল । শহীদ, কামাল, রাজকুমারী, ডি, কস্টা, রাসেল কুয়াশার আগেই পৌঁছে গেছে জেল-হাজতের সেলে।
পনেরো মিনিট পরের ঘটনা। স্থান: রাজা আনায়াসার রাজদরবার।
রাজদরবার দেখবার মত জিনিস বটে। প্রকাণ্ড একটা টকটকে লাল সিংহাসনে বসে আছেন রাজা আনায়াসা। তার পোশাকও টকটকে লাল। লাল পোশাকের সর্বত্র ছোট ছোট সোনালি তারকা চিহ্ন খচিত রয়েছে। সিংহাসনের এক পাশে বসে আছে রাজকুমারী সোনা। সোনার মুখটা শুকনো। উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাকে। সোনার পাশে বসে আছে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা।
রাজদরবারের রঙের বাহার লক্ষণীয়। মোটা আর সুউচ্চ স্তম্ভগুলো এক একটা এক এক রঙের। সিলিংটা সম্পূর্ণ সোনালি। অত্যুজ্জ্বল আলোয় চারদিক ঝলমল
সিংহাসনের সামনে গোলাকার একটি মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে উলন। উলনের পিছনে পুলিসবাহিনীর সদস্যরা। তাদের হাতে আধহাত লম্বা একটা
ভলিউম ১৮
করে মোটা লাঠির মত জিনিস দেখা যাচ্ছে। লাঠির মাথায় ছোট্ট একটা ছিদ্র। বিষাক্ত বর্শা নিক্ষেপক যন্ত্র এই লাঠি।
কথা বলছিলেন রাজা আনায়াসা।
উলন, নাগরিকদের মধ্যে তুমি ছিলে সবচেয়ে অনুপযুক্ত। কিছুদিন পর পর একটা করে কুবুদ্ধি খেলত তোমার মাথায়, অমনি তুমি ষড়যন্ত্রে মেতে উঠতে। ক্ষমতার প্রতি তোমার লোভ ছিল অস্বাভাবিক। তুমি নরাধম এমনই শয়তান যে রাজকন্যাকে বিয়ে করার কল্পনাও মনে ঠাই দিয়েছিলে। ভেবেছিলে রাজ জামাতা হয়ে পরবর্তী রাজা হতে পারবে, যেহেতু আমার কোন পুত্র সন্তান নেই। যাই হোক, ষড়যন্ত্র এবং বেঈমানী তুমি একবার নয়, বহুবার করেছ। তোমার অপরাধের জন্যই তোমাকে আমরা ল্যাণ্ড অব লস্টে পাঠিয়েছিলাম। সেবার তুমি রাজ। পরিবারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করেছিলে আরও কিছু অপরাধীদের নিয়ে। যাক, অতীতে তোমাকে বহুবার সাবধান করা হয়েছে, ক্ষমা করা হয়েছে কিন্তু তুমি কান দাওনি আমাদের কথায়। আমরা…’
উলন সবিনয়ে বলে উঠল, মহামান্য রাজা, অতীতের কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন না। লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে অতীতের কথা ভাবলে। এই উলন আর সেই উলন নেই। আমি যে অপরাধ করেছি, তার জন্য মহামান্য রাজা এবং মহামান্য মন্ত্রী পরিষদের কাছে ক্ষমা চাইছি। আমি শুধু বলতে চাই, অপরাধ আমি করেছিলাম ঠিক, কিন্তু তার বদলে আজ যে মহৎ কাজ আমি করেছি–সে কথাও আপনারা বিবেচনা করুন। বাইরের দুনিয়ার একদল গুণ্ডা, ক্ষমতালোভী, মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত মহাশত্রুকে আমি বন্দী করতে সাহায্য করেছি।
রাজা আনায়াসা জানতে চাইল, ‘এই গুণ্ডার দল, ক্ষমতালোভীর দলের সাক্ষাৎ পেলে কিভাবে তুমি?’ | উলন বলল, “ল্যাণ্ড অব লস্টে এদের সাক্ষাৎ পাই আমি। ওদের সঙ্গে, ওদের দলে যোগ দেই আমি। ওদের ভাষা শিখি। তারপর আমি জানতে পারি ওদের ষড়যন্ত্রের কথা। ওরা আমাদের পাতালপুরী দখল করার মতলব আঁটে। আমি ওদেরকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করি। আমি চেয়েছিলাম কুয়াশী এবং তার দলবল যেন কোনক্রমেই আমাদের পাতালপুরীতে নামার পথ খুঁজে না পায়। কিন্তু আমি ওদেরকে বেশি দিন ভুল পথে চালিত করতে পারিনি। একদিন হঠাৎ ওরা পাতালপুরীতে প্রবেশ করার পথ পেয়ে যায়।’
এবার কথা বলে উঠল রাজকন্যা সোেনা, মিথ্যে কথা! কুয়াশা এবং তার দল গুণ্ডা নয়। কুয়াশা এবং তার দলবল একবারও আমাদের নাগরিকদের বিরুদ্ধে রহস্যময় অস্ত্র ব্যবহার করেনি। রহস্যময় অস্ত্র, যে অস্ত্র প্রচণ্ড শব্দ করে এবং মানুষকে হত্যা করে, সেগুলো যারা ব্যবহার করেছে তারা উলনেরই দলের লোক। আমি তাদের সঙ্গে উলনকে দেখেছি।’
উলন বলে উঠল, রাজকুমারী সোনা, আপনি ভুল দেখেননি। আমি শত্রু কুয়াশা এবং তার দলবলের সঙ্গে মাঝে মাঝে ছিলাম, তাদের পরিকল্পনা জানার কুয়াশা ৫৪
১৩৫
জন্য।
রাজা আনায়াসা বললেন, সোনা, থামো তুমি। আমি মন্ত্রী-পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করছি। তারা উলনের কথা বিশ্বাস করে কিনা জানতে চাই আমি।’
নিচু গলায় রাজা তার মন্ত্রী-পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করলেন বেশ কিছুক্ষণ।
রাজা অবশেষে বললেন, “উলনকে আমরা মুক্তি দিচ্ছি। তার সকল অপরাধ ক্ষমা করা হলো। সে, আসলে বীরত্বপূর্ণ একটা কাজ করেছে। সেজন্যে আমরা তাকে পুরস্কৃত করব।’
উলন চিৎকার করে উঠল, ‘মহামান্য রাজা দীর্ঘজীবী হোন। মহামান্য রাজা, আমি আপনার কাছে একটা জিনিস ভিক্ষা চাইব। অনুমতি দিলে বলি।
বলো।’ রাজা একটু যেন গম্ভীর হলেন। সোনালি আলোর ফরমুলাটা জানতে চাই আমি।’ রাজা বললেন, ‘ফরমুলা চাও? সোনালি আলোর? কেন? তা ছাড়া, বিজ্ঞানের তুমি কি বোঝো? খুবই জটিল ব্যাপার ওটা। তোমাকে আমি বিশেষভাবে বোকা এবং বুদ্ধিহীন হিসেবে জানি। এ সব বিজ্ঞান বিষয়ক জটিলতা তোমার মাথায় ঢুকবে
।’
উলন নিরাশ হলো। কিন্তু তার মুখ দেখে কিছুই বোঝা গেল না। সে বলল, জ্ঞান আহরণের তীব্র ইচ্ছা হয়েছে বলেই ভিক্ষাটা চাইছি আমি, মহামান্য রাজা। তবে আপনি যদি আমাকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান বলে মনে না করেন-থাক তাহলে। আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন, এতেই আমি সুখী। কিন্তু আরও একটা প্রার্থনা আছে আমার। এটা আপনাকে পূরণ করতেই হবে। আমি চাই কুয়াশা এবং তার দলবলকে শান্তি দেয়া হোক। ভয়ঙ্কর এরা। যে কোন দুর্বলতার সুযোগে দখল করে নেবার চেষ্টা করবে আমাদের এই পাতালপুরী। আমি প্রার্থনা করছি, ওদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হোক।’
“ রাজা আনায়াসা আবার আলোচনা করলেন তার মন্ত্রী-পরিষদের সঙ্গে। খানিক পর তিনি বললেন, কুয়াশা এবং তার পাঁচজন সহকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। প্রচলিত পদ্ধতিতে হত্যা করা হবে ওদেরকে।
সভা ভেঙে গেল। উলন মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে এল রাজপ্রাসাদের বাইরে। বেরুবার সময় রাজকুমারীর কান্না শুনতে পেল সে।
| বাইরে বেরিয়ে এসে উলন দ্রুত হাঁটতে লাগল। শিকদারের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে তাকে। রাজা আনায়াসা বড় বেশি বুদ্ধিমান, বাধ্য না হলে সে ফরমুলা দেবে না।
যুদ্ধই করতে হবে সোনালি আলোর ফরমুলা পাবার জন্য।
ভলিউম ১৮
নয় কুয়াশা নিচু গলায় আলোচনা করছিল শহীদের সঙ্গে। সেল থেকে নিজেদেরকে কিভাবে মুক্ত করা যায়, সেটাই ওদের আলোচ্য বিষয়।
এমন সময় সেলের দরজা খুলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করল রাজকুমারী সোনা। সোনাকে দেখে নড়েচড়ে উঠল সবাই।
দরজা ভিজিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসছে রাজকুমারী সোনা।
সোনা দ্রুত কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর কোন কথা না বলে তার টোলা.লাল ফ্রকের ভিতর থেকে বের করল কৃত্রিম কাপড়ের একটা থলে। থলের ভিতুর হাত ঢুকিয়ে সে যে জিনিসটা বের করল তা দেখতে ময়দার মণ্ড বা ওই রকম
জাতীয় কিছু।
কুয়াশার দিকে তাকিয়ে হাসল সোনা। কুয়াশার একটা হাত লম্বা করে ধরল সে, ইঙ্গিত করল হাতটাকে লম্বা করে রাখার জন্য।
থলের ভিতর থেকে এরপর একটা শিশি বের করল সোনা। শিশির ভিতর দুধের মত সাদা তরল পদার্থ দেখা যাচ্ছে।
‘ ময়দার মণ্ডের মত দেখতে প্রায় সের দেড়েক ওজনের পদার্থটা মেঝেতে রাখল সোনা। তারপর শিশির ছিপি খুলে মণ্ডের উপর ঢেলে দিল সবটুকু সাদা তরল কেমিক্যাল।
মণ্ডটা বেশ শক্ত। সোনা দুই হাত দিয়ে সেই মণ্ড ছানতে শুরু করল। দেখতে দেখতে নরম, আঠাল হয়ে উঠল সেটা।
| মেঝে থেকে নরম, ভীষণ আঠাল সেই মণ্ড তুলে নিয়ে কুয়াশার ডান হাতে মাখিয়ে দিতে লাগল সোনা। দ্রুত, নিপুণ হাতে কাজ করে চলেছে সে। কুয়াশার হাতের উপর সাদা মণ্ডের একটা স্তর তৈরি হচ্ছে আস্তে আস্তে।’
| অবাক বিস্ময়ে সোনার কাণ্ড দেখছিল সবাই। সোনা কি করছে তা প্রথমে বুঝতে না পারলেও খানিক পর সবাই বুঝতে পারল ব্যাপারটা। উলনের এবং এখানকার নিরাপত্তা রক্ষীদের কারও কারও হাত সাদা। তাদের হাতগুলো কি দিয়ে সাদা করা হয়েছে তা বুঝতে পারছে যেন, ওরা।
দেখতে দেখতে কুয়াশার ডান হাতটা সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেল মণ্ডের স্তরের নিচে।
. সোনা হাসছে। থলে থেকে এবার সে বের করল একটা ছোট্ট কৌটা। কৌটা খুলে সোনা এবার বের করল অতি সূক্ষ্ম একটা সুচ।
সুচটা চুলের চেয়েও যেন সরু। দেড় ইঞ্চি মত লম্বা। সোনাকুয়াশার ডান হাতের তালুতে, মণ্ডের স্তরের ভিতর আড়াআড়িভাবে সেই সূক্ষ্ম সুচটা প্রবেশ করিয়ে দিল।
এরপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল সোনা। কুয়াশা ডান হাতটা একবার নাড়তেই খপ করে কুয়াশার কোমর ধরে ফেলল সোনা, হাত নেড়ে নিষেধ কুয়াশা ৫৪
১৩৭
করল, না, নাড়াচাড়া কোরো না।
সময় বয়ে যেতে লাগল। মিনিট দশেক পর সোনা কুয়াশার ডান হাতের মণ্ডের স্তরে চিমটি কাটতে শুরু করল সর্বত্র।
কী আশ্চর্য! চিমটি কাটছে সোনা, অথচ তার নখের সঙ্গে এক কণাও মণ্ড উঠে আসছে না।
নরম মণ্ড অদ্ভুতভাবে রাবারের মত একটা পদার্থে পরিণত হয়েছে। এরপর সোনা মুখ নামিয়ে কুয়াশার ডান হাতে কামড় দিল।•••সাদা মণ্ডের মত পদার্থটা কুয়াশার হাতের চামড়ার সঙ্গে নিপুণভাবে মিশে গেছে, দাঁতের কামড়েও তা আর খসছে না।
এরপর সোনা নিজের ডান হাতের আঙুলগুলো সাপের ফণার মত করে বাকিয়ে ফড়িংয়ের মত বাতাসের উপর নাচাতে লাগল, কুয়াশাকেও সেই রকম করার জন্য ইঙ্গিতে অনুরোধ করল সে।
উলনের মত কুয়াশাও তার সাদা ডান হাতটা ফড়িংয়ের মত শূন্যে ওড়াতে লাগল। আঙুলগুলো বাঁকা করতেই সে দেখল তার হাতের তালুর ভিতর থেকে সৃন্ম সুচটা বেরিয়ে এসেছে। হাত সোজা করলেই সেটা ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। | কুয়াশা বলল, রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। উলনের হাতের তালুতে এইরকম একটা সুচই ছিল। সুচের ডগায় বিষ মাখানো আছে•••
| সোনা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল। থলে থেকে দ্রুত আরও কয়েকটা জিনিস বের করল সে। তার মধ্যে একটা জিনিস দেখে সবাই আকাশ থেকে পড়ল।
জিনিসটা আর কিছু নয়, ওদেরই একটা সুপার মেশিন পিস্তল।
কৃত্রিম কাগজ এবং রঙ বের করে সোনা দ্রুত ছবি আঁকতে শুরু করল। গোটা পাতালপুরীর নকশা আঁকল সে। জেল-হাজত ভবনটা আঁকল তারপর-সবশেষে আঁকল সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের নকশা। মেকানিক্যাল ভবনের একটা বিশেষ অংশে ক্রশ চিহ্ন এঁকে উঠে দাঁড়াল সে। তারপর হাসতে হাসতে দরজার দিকে ছুটল।
কোন কথা না বলে সেল থেকে বেরিয়ে গেল সোনা।
তুলনা হয় না। ভয়ানক বুদ্ধিমতী মেয়ে।’ মন্তব্য করল শহীদ।
কুয়াশা বলে উঠল, “সোনা ক্রশ চিহ্ন আঁকল কেন মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের এই অংশে? ও কি আমাদেরকে ওই বিশেষ জায়গায় যেতে বলে গেল?
শহীদ বলল, নিশ্চয়ই তাই।’ কুয়াশা বলল, সবাই তৈরি? একসঙ্গে বলে উঠল সবাই, তৈরি।
শহীদ এবং কুয়াশার দেহের এক ধাক্কাতেই ভেঙে গেল দরজাটা। দরজা ভেঙে পড়তেই দেখা গেল বিষাক্ত বর্শা নিক্ষেপক অস্ত্রধারী প্রহরীদের। শহীদ কালবিলম্ব না করে সুপার মেশিন পিস্তল দিয়ে গুলি করল।
১৩৮
ভলিউম ১৮
বিকট শব্দ হলো। একজন প্রহরী জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল করিডোরে। পরমুহূর্তে আতঙ্কিত চিৎকার উঠল চারদিক থেকে। আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দকে এখানকার মানুষরা ভীষণ ভয় করে।
| চারদিকে ছুটন্ত পদশব্দ। কুয়াশা সবার আগে। তার ডান হাতটা ফড়িংয়ের মত শূন্যে নাচছে। হাঁটছে না ওরা, দৌড়ুচ্ছে সবেগে। করিডোরের শেষ মাথায় পৌঁছল ওরা। এমন সময় কিড়িং কিড়িং, কিড়িং কিড়িং বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠল। শুধু জেল-এলাকায় নয়, গোটা পাতালপুরীতে সেই শব্দ বাজছে।
রাস্তায় নেমে ওরা প্রমাদ গুণল। লোকে লোকারণ্য চারদিক। বিপদ সঙ্কেত শুনে সবাই বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে।
শহীদের হাতের মেশিন পিস্তল গর্জে উঠতেই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া ঘটল। হুলুস্থুল কাণ্ড হয়ে গেল। যে যেদিকে পারছে-পালাচ্ছে। | সামনে, ডানে, পিছনে–সবদিকেই গুলি ছুঁড়ছে শহীদ। দাঁড়িয়ে নেই ওরা।
অবিরাম ছুটছে। ‘ কুয়াশা বলে উঠল, পিছু ছাড়েনি পুলিসের দল। আসছে তারা আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে।
‘আমি ভাবছি এভাবে কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে এদেরকে! শহীদ বলল। | কুয়াশা বলল, সোনার নির্দেশ মত ক্রশ চিহ্নিত জায়গাটা দেখি আগে। তারপর চিন্তা করা যাবে নতুন করে।
সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল প্ল্যান্টে ঢোকার সময় কেউ বাধা দিল না ওদেরকে। আড়াল থেকে কিছু লোক চিৎকার করছে শুনতে পেল ওরা।
সিঁড়িটা কোনদিকে? | কামালের প্রশ্নের উত্তরে কুয়াশা বলল, ‘সিঁড়ি খোঁজার সময় নেই। ওই দেখো,
মই!’
মইটা সোজা উঠে গেছে পাঁচতলার উপব পর্যন্ত, ভবনের মাঝামাঝি উচ্চতায়। ‘পাঁচ তলারই একটা অংশে ক্রশ চিহ্ন এঁকেছিল সোনা।’ মই বেয়ে উঠে যাচ্ছে ওরা। সবার আগে কুয়াশা। শহীদ সবচেয়ে নিচে।
ত্রিশ ফিটের মত উপরে উঠে শহীদ নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল দলে দলে এগিয়ে আসছে লোকেরা। সবাই মারমুখো, পেলে বুঝি কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। গুলি করল শহীদ।
তীরবেগে আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল সবাই।
পাঁচ তলায় উঠে করিডোর ধরে ছুটল ওরা। শেষ প্রান্তে একটি দরজা। সেটা খোলা দেখে ভিতরে ঢুকল।
কামরার ভিতর ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেল সবাই। বিরাট বড় কামরা। প্রথম দর্শনেই বোঝা গেল, এটা সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল প্ল্যান্টের ল্যাবরেটরি। ছোট বড় হাজার রকম যন্ত্রপাতি, মেশিন, কেমিক্যাল ভরা পাত্রকোন কিছুরই অভাব নেই।
শহীদ হঠাৎ ছুটল। প্রায় চিৎকার করে উঠল সে, ‘একি!,
কুয়াশা ৫৪
১৩৯
সবাই দেখল ব্যাপারটা। ওদের স্পেসক্রাফটের ভিতর ওরা কিছু অস্ত্র, কিছু অতি প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল রেখে এসেছিল। সেগুলো একটা টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল কুয়াশা। বলল, ‘আমাদের জিনিসপত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য স্পে-ক্রাফট থেকে এখানে নিয়ে এসেছে এগুলো। যাক, সোনা কেন এখানে আসতে বলেছিল, বোঝা গেল
এবার।’
কুয়াশা!’ চিৎকার করে উঠল রাজকুমারী । তাকিয়ে আছে সে ল্যাবরেটরির সিলিংয়ের দিকে। সবাই তাকাল উপর দিকে।
সিলিংয়ের গায়ে অনেকগুলো পাইপ দেখা যাচ্ছে। একই ধরনের পাইপ দেয়ালের গায়েও অনেক রয়েছে। সিলিংয়ের একটা পাইপ দিয়ে মেঝেতে তরল পানির মত কিছু পড়ছে। মেঝেতে পড়েই তরল পানি কঠিন বরফে পরিণত হচ্ছে, হু-হুঁ করে বাম্প ছড়াচ্ছে চারদিকে। পানি পড়ছে সামান্য, কিন্তু সেই সামান্য পানি থেকে বাষ্প তৈরি হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে।
শহীদ বলে উঠল, লিকুইড এয়ার। তরল বাতাস!
ক্ষতিকর?’ জানতে চাইল কামাল।
ক্ষতিকর মানে? ওই লিকুইড এয়ার লোহার গায়ে পড়লে লোহাও বরফ হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে!
কুয়াশা বলল, “অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। টের পাচ্ছ তোমরা?’ শহীদ বলল, ‘ওই বাস্পগুলো খেয়ে ফেলছে অক্সিজেনকে!’
তারমানে এই ল্যাবরেটরিতে মরবার জন্য ঢুকেছি আমরা!’ কামালের কথার উত্তর দিল না কেউ। কুয়াশা বলল, শহীদ, আত্মসমর্পণ করাই এখন একমাত্র উপায়, কি বলো?’
শহীদ বলল, এখন প্রশ্ন হলো, ওরা “মৃত্যুফাঁদে আটকে ফেলেছে। আমাদেরকে। আমরা আত্মসমর্পণ করতে চাইলেও কি রাজি হবে ওরা?’
রাসেল তড়াক করে লাফ দিয়ে সরে গেল একপাশে। দেয়ালের একটা পাইপ থেকে খানিকটা লিকুইড এয়ার পড়ল মেঝের উপর, খানিকটা একটা টেবিলের উপর।
টেবিলের উপর কয়েকটা পাত্র ছিল। সেগুলোর উপর শক্ত বরফের মোটা আস্তরণ সৃষ্টি হলো। বরফে ঢাকা পড়ে গেল টেবিলসহ সব কিছু।
আতঙ্ক ফুটে উঠল ওদের চোখেমুখে। কুয়াশা! কিন্তু কোথায় কুয়াশা। প্রথমে ওরা কুয়াশাকে দেখতেই পেল না। এদিক ওদিক তাকাল ওরা। দেখল, কুয়াশা একটা প্রকাণ্ড টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন পাত্র থেকে কেমিক্যাল একটু একটু করে অপর একটি পাত্রে ঢালছে। শহীদ দরজার
১৪০
ভলিউম ১৮
দিকে ছুটে গেল। ধাক্কা দিয়ে দেখল ও। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে
পুলিসবাহিনী। * মিনিট দুয়েক পর মুখ তুলল কুয়াশা। বলল, ‘এটা এখানকার সবচেয়ে বড় ল্যাবরেটরি। লিকুইড এয়ার ঢেলে ল্যাবরেটরিটাকে নষ্ট করবে না ওরা পারতপক্ষে। ওরা আসলে আমাদের ভয় দেখিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে চাইছে। ভাল কথা, এই ওষুধটা এক চুমুক করে খেয়ে নাও সবাই।
বিনাবাক্যব্যয়ে কুয়াশার হাত থেকে ওষুধভরা পাত্র নিয়ে সবাই তা পান করল।
দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। টোকা দিল সে দরজার গায়ে। আশ্চর্য, খুলে গেল দরজা।
মাথার উপর হাত তুলে করিডোরে বেরিয়ে এল ওরা। সাদা হাতওয়ালা পুলিসবাহিনী তৈরি হয়েই ছিল। সর্বমোট প্রায় পঞ্চাশজন। ঘিরে ফেলল তারা ওদেরকে। | কড়া প্রহরার মধ্যে ওদেরকে নামিয়ে আনা হলো এক তলায়।
প্রকাণ্ড একটা হলরুমের মাঝখানে দাঁড় করানো হলো ওদেরকে। চারদিক থেকে ভেসে আসছে উগ্র কণ্ঠস্বর। সবাই চাইছে, কুয়াশার দলকে উচিত শাস্তি দেয়া হোক।
কুয়াশা এবং শহীদ হলরুমটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল সেই সময়। আকারে এত বড় হলরুমটা যে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তু পরিষ্কার দেখা যায় না। হলরুমের উচ্চতাও অস্বাভাবিক। প্রায় দশ মানুষ সমান উঁচুতে রয়েছে সাত থেকে দশ টন ওজনের সারি সারি ঝুলন্ত ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কগুলোর ভিতর থেকে মোটা মোটা পাইপ বেরিয়ে এসেছে। পাইপগুলো দেয়াল বেয়ে খানিকদূর নেমে এসেছে, তারপর। বেরিয়ে গেছে বাইরের দিকে।
পুলিসবাহিনী ঘিরে রয়েছে ওদেরকে। এই মুহূর্তে তারা শাস্তি দিতে চায় কুয়াশার দলকে, দেখে তা মনে হয় না। মনে হচ্ছে, তারা যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে।
সত্যিই তাই। তারা অপেক্ষা করছিল স্বয়ং মহামান্য রাজা আনায়াসার জন্য।
রাজা আনায়াসা এবং রাজকুমারী সোনা হলরূমে ঢুকল। পুলিসবাহিনী জয়ধ্বনি উচ্চারণ করল। রাজার পিছু পিছু এল মন্ত্রী-পরিষদের কয়েকজন সদস্য।
রাজা আনায়াসা দ্রুত কিছু বললেন। সম্ভবত একটা ছোট্ট বক্তৃতা দিলেন তিনি। হঠাৎ থামলেন তিনি। তারপর দুর্বোধ্য একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন, কুম! কুম!
চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাটা।
দশ-পনেরো জন সাদা হাতওয়ালা পুলিস হঠাৎ লাফিয়ে উঠে তাদের ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করল কুয়াশাকে এবং কুয়াশার বন্ধু-বান্ধবকে।
ঘটে গেল চরম সর্বনাশ! বিষাক্ত, সূক্ষ্ম সুচের আক্রমণে টলে উঠল কুয়াশা,
কুয়াশা ৫৪
১৪১
শহীদ, কামাল, ডি. কস্টা, রাজকুমারী এবং রাসেল। নিষ্প্রাণ মহীরূহের মত সবাই একসাথে টলতে টলতে পড়ে গেল।
তীক্ষ, একটা চিৎকার বেরিয়ে এল রাজকুমারী সোনার কণ্ঠ থেকে। পরমুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল সে।
রাজা আনায়াসা গভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, শত্রুদের উচিত, শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।’
ন্যায়ের পথে যারা নিবেদিত প্রাণ, আজ বুঝি তাদের পরাজয় ঘটল।
এরপরও ঘটনা ঘটল। কিন্তু তা ঘটল ন্যায়ের বিরুবই–তা ঘটল অন্যায়ের স্বপক্ষেই।
রাজার ঘোষণা শেষ হবার পরপরই দোরগোড়া থেকে গর্জে উঠল শিকদারের স্টেনগান। | আর্তচিৎকারে কান পাতা দায় হয়ে উঠল। স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে একে একে পলিসবাহিনীর সদস্যরা।
শিকদার একা নয়, গুলি করছে হাক্কা, গুলি করছে উলন, গুলি করছে খুনীদের আর সব অনুচরেরা।
কয়েক সেকেণ্ড পর দেখা গেল হলরূমে দাঁড়িয়ে আছে শুধু রাজা আনায়াসা, তার মেয়ে সোনা এবং মন্ত্রী-পরিষদের মাত্র একজন সদস্য। বাকী সবাই হয় আহত নয় নিহত হয়েছে।
বেঁধে ফেলো রাজাকে! উলনের নির্দেশ পেয়ে শিকদারের পোষা গুণ্ডারা পকেট থেকে নাইলনের কর্ড বের করে বেঁধে ফেলল রাজা, সোনা এবং মন্ত্রীকে।
‘উলন! তুই আবার বেঈমানী..’। রাজাকে ধমক মারুল ঊলন, চুপ শালা! এখন বল, ফরমুলা দিবি কি না?’
“কি আর করবি তুই আমার বড় জোর মেরে ফেলবি! তাই কর-মেরে ফেল। কিন্তু ফরমুলা আমি দেব না…’
শিকদারস্টেন উঁচিয়ে ধরল, শালা বড় হারামি! মর ব্যাটা রাজা…’,
! গর্জে উঠল উলন। রাজাকে এখুনি মারতে চায় না সে। ফরমুলা আদায় করতে হলে রাজাকে আপাতত বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু স্টেনের ট্রিগারে আঙুলের যথেষ্ট চাপ দিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে শিকদার।
উলন শিকদারের স্টেনগান ধরা হাতটা উপর দিকে ঠেলে দিল। এক ঝাক বুলেট গিয়ে বিদ্ধ হলো মাথার উপরের লিকুইড এয়ার ট্যাঙ্কে। জলপ্রপাতের মত লিকুইড এয়ার নেমে এল নিচের দিকে। শিকদার, উলন, তাদের সব ক’জন অনুচরের গায়ে পড়ল লিকুইড এয়ার।
ঠিক সেই সময় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল স্বয়ং কুয়াশা। প্রায় একই সময়ে উঠে দাঁড়াল শহীদ, কামাল, ওমেনা, ডি. কস্টা এবং রাসেল।
| সূক্ষ্ম, বিষাক্ত সুচের আঘাতে মরেনি ওরা। বিষের ক্রিয়া যাতে মৃত্যু ডেকে না
১৪২
ভলিউম ১৮
আনে তার জন্য কুয়াশা ল্যাবরেটরিতে থাকার সময় একটা অ্যান্টিডোট তৈরি করে সবাইকে খাইয়ে দিয়েছিল। ফলে এযাত্রা বেঁচে গেছে ওরা। বিষ ক্রিয়ায় সাময়িকভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল মাত্র!
কুয়াশার দেখাদেখি সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে আহত পুলিসবাহিনীর লোকদের সরিয়ে নিয়ে গেল হলরুমের বাইরে। ডি, কস্টা সোনার অচেতন দেহটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেল করিডোরে। | কুয়াশা মহামান্য রাজা এবং মন্ত্রী মহোদয়কে লিকুইড এয়ারের স্রোতের আওতা থেকে সরিয়ে নিয়ে এল।
করিডোেরে এসে দুজনকে কাঁধ থেকে নামাল কুয়াশা। তারপর হাত এবং পায়ের বাঁধন খুলে দিল তাদের।
শহীদ হলরূমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভিতরে তাকাল সে। আপনা থেকেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল ওর।
শিকদার এবং উলনের দল দাঁড়িয়ে আছে হলরুমের মেঝেতে। তাদের শরীরে মাংস, হাড়, রক্ত, চুল কিছুই নেই। বরফ দিয়ে তৈরি মূর্তি, নিষ্প্রাণ মূর্তি ছাড়া কিছুই নয় ওরা। উত্তর মেরুর বরফাচ্ছাদিত জগতের নিচে, পাতালপুরীতে কেটে গেল সুদীর্ঘ দুটো মাস।
কুয়াশার দল পাতালপুরীর অধিবাসীদের ভাষা শিখে ফেলেছে ইতিমধ্যে। শুধু ভাষাই নয়, তাদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর রহস্য সম্পর্কেও বিশদ জ্ঞান আহরণ করল ওরা। বাইরের পৃথিবীতে সোনালি আলো আসলে কোন কাজেই লাগবার নয়, জানতে পারল ওরা। কারণ এই আলো সেখানেই জ্বলবে যেখানকার বাতাস, সম্পূর্ণ শুষ্ক । তেমন শুষ্ক বাতাস বাইরের পৃথিবীর কোথাও নেই।
“কিন্তু এই তথ্যটা উলন বা শিকদার জানত না। আর জানত না বলেই তারা অমন ভয়ঙ্কর ভাবে মৃত্যুবরণ করেছে।
রাজা আনায়াসার কাছ থেকে একটি তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্যটা হলো, উলনকে পাতালপুরীর গোলক ধাঁধায় রেখে আসার প্রায় মাস দুয়েক পর কয়েকজন প্রহরী গোলক ধাঁধায় যায় বিশেষ একটি কারণে। সেখানে গিয়ে তারা কয়েকজন বিদেশী লোকের লাশ দেখে।
কুয়াশা বলল, ‘বুঝেছি। শিকদার এবং উলনই ওদের মৃত্যুর জন্য দায়ী সম্ভবত। ওরাই আইস অভিযানের সদস্য ছিল।
| পাতালপুরীর অধিবাসীদের সংখ্যা নিয়ে কথা উঠল। কুয়াশা প্রস্তাব দিল কিছু লোককে বাইরের দুনিয়ায় স্থানান্তরিত করার।
পাতালপুরীর বাসিন্দারা বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে হাজারটারও বেশি প্রশ্ন করল। কুয়াশা এবং শহীদ তাদের সব প্রশ্নেরই যথাসাধ্য উত্তর দিল।
রাজা জানালেন, না, আমরা আমাদের এই পূর্বপুরুষদের তৈরি
.
.
কুয়াশা ৫৪
১৪৩
পাতালপুরীতেই থাকব। তোমাদের দুনিয়াটা, তোমাদের বর্ণনা অনুযায়ী খুব একটা সুখের বা আকর্ষণীয় বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু, কুয়াশা, বন্ধু আমার-আমার একটা প্রার্থনা আছে তোমার কাছে।
বলো!’ | রাজা আনায়াসা কুয়াশার গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছেন। বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিলে কুয়াশা তা গ্রহণ করে।
রাজা বললেন, ‘আমি প্রার্থনা করছি, আমাদের এই পাতালপুরীর অস্তিত্বের কথা তুমি বাইরের দুনিয়ায় গিয়ে কাউকে বোলো না। বেশ শান্তিতে আছি আমরা। কেউ আমাদেরকে বিরক্ত করুক তা আমরা চাই না।’
কুয়াশা বলল, তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে আনায়াসা!
বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এল।
| রাজা, রাজকন্যা সোনা, বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ ওদের সঙ্গে সুড়ঙ্গের শেষ সীমা পর্যন্ত হেঁটে এল।
রাজা আনায়াসা রূদ্ধকণ্ঠে বললেন, “আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। তোমার কাছে অনুরোধ, আমি বেঁচে থাকতে থাকতে আর একবার এসে দেখা করে যেয়ো।
কুয়াশা বলল, নিশ্চয়ই আসব, অনায়াসা। তোমার কথা আমি ভুলতে পারব না। বিদায়, বন্ধু!
‘বিদায়, বন্ধু!
সুড়ঙ্গের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে রইল রাজা দলবল নিয়ে।
কুয়াশার দল স্পেসক্রাফটের দিকে এগিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে স্পেসক্রাফটের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা।
খানিক পর স্পেসক্রাফট আকাশে উঠতে শুরু করল। “ওহে, ডি, কস্টা, তোমার প্রিন্স কই? অবাক হয়ে জানতে চাইল কামাল। | ডি. কস্টা উত্তর দিল না। ভীষণ বিষণ্ণ দেখাচ্ছে তাকে।
কুকুরটাকে পাতালপুরীতে রেখে এসেছে ডি, কস্টা। না, ভুলে রেখে আসেনি। ওটা দান করেছে সে রাজকুমারী সোনাকে।
Leave a Reply