৫৩. তুষার নগরী ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৫৩
প্রথম প্রকাশ: জুলাই, ১৯৭৬
এক
বন্দর শহর চট্টগ্রাম। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। মানুষ-জন যে-যার বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে। ঝড়ের পূর্বাভাস ঘোষণা করা হয়েছে রেডিও থেকে। নিম্নচাপ ক্রমশ এগিয়ে আসছে উপকূলের দিকে।
নিস্তব্ধ, নিঝুম চারদিক। পথে ঘাটে লোকজন নেই বললেই চলে। রাতও বড় একটা কম হয়নি। এই খানিক আগে নিকটবর্তী একটা গির্জা থেকে রাত এগারোটার ঘণ্টা বেজেছে।
আকাশে মেঘ থাকলেও বাতাস নেই এতটুকু। থমথম করছে পরিবেশটা।
রাস্তাঘাটে কোথাও আলো আছে, কোথাও ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আর সব শহরের মত, এই বন্দর শহরেও ছিঁচকে চোর-ছাচোড়েরা লাইট পোস্ট থেকে বাল চুরি করে।
শহরের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিকতম হোটেল আগ্রাবাদের সামনে আলোর কোন অভাব নেই। কিন্তু হোটলের কাছ থেকে সত্তর পঁচাত্তর গজ দূরে আলো একেবারে নেই বললেই চলে। জায়গাটা প্রায় অন্ধকারে ঢাকা।
সেই অন্ধকারে একটি বন্ধ কফেকশনারী দোকানের কাঁচের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক।
| আঁধারে লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তার ডান হাতটা যে বিদঘুঁটে ভঙ্গিতে নড়ছে সারাক্ষণ তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
অদ্ভুত, ভৌতিক হাত লোকটার। একজন মানুষের হাত ফড়িংয়ের মত দেখতে, বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও অন্ধকার রাস্তায় অপেক্ষারত লোকটার হাত সম্পর্কে কথাটা সত্যি। হাতটা শুধু দেখতেই ফড়িংয়ের মত নয়, যেভাবে সর্বক্ষণ নড়ছে, বাতাসে ভর দিয়ে উড়ু উড়ু ভঙ্গিতে দুলছে–প্রকাণ্ড একটা উড়ন্ত ফড়িং ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না ওটাকে। ‘
| হাতটার রঙও বিচিত্র। লোকটার গায়ের রঙ লালচে। কিন্তু হাতটা সম্পূর্ণ সাদা। অনুজ্জ্বল, লাবণ্যহীন, ফ্যাকাসে ধরনের সাদা। কুৎসিত, ভীতিকর ভঙ্গিতে বাতাসে ভর দিয়ে অবিরাম নড়ছে সেটা। ড্রেনের সাদা একধরনের তুলতুলে সদা চঞ্চল পোকার কথা মনে পড়ে যায় হাতটার দিকে তাকালেই–গা ঘিনঘিন করে
ওঠে। | অন্ধকার কুঁড়ে হঠাৎ একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। দ্রুত, অস্থির ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে সে। বারবার তাকাচ্ছে পিছন দিকে। কুয়াশা ৫৩
কিন্তু বিপদ পিছনে নয়, অপেক্ষা করছে সামনে।– কনফেকশনারীর কাঁচের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো লোকটা তার অস্বাভাবিক বড় বড় চোখ দুটো মেলে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিল রাস্তার দিকে। একজন লোক এদিকে এগিয়ে আসছে, বুঝতে পেরেছে সে। নিঃশব্দে, অস্বাভাবিক দ্রুত বেগে, প্রায় চোখের পলকে রাস্তার মাঝখানে চলে এল লোকটা।
নবাগত পথিক থমকে দাঁড়াল। সাদা হাতওয়ালা লোকটা তার তিন হাত সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পেল সে। লোকটার একটা হাত বাতাসে ভর দিয়ে উড়ছে দেখেই চিনতে পারল সে মৃর্তিমান যমকে। দ্রুত পিছিয়ে গেল সে দু’পা, কাঁপা গলায় বলে উঠল, উলন! আ-আপনি••!’
কিভাবে এগিয়ে এল উলন টের পেল না আতঙ্কিত লোকটা, হঠাৎ সে উলনকে দেখল তার একেবারে আধহাতের মধ্যে। উলনের ডান হাতটা উড়তে উড়তে আরও উপর দিকে উঠে গেল।
মৃত্যুভয়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল লোকটার চোখ দুটো। না••••••আ-আমি..না!’
উলনের ডান হাতটা আরও উপর দিকে উঠছে ক্রমশ। বাঁ হাতটা এতটুকু নড়ছে না, সেটা যেন প্যারালিসিসে আক্রান্ত, নিঃসাড়, অবশ।
হাত দুটোই শুধু নয়, উলনের মধ্যে অস্বাভাবিক আরও কিছু ব্যাপার রয়েছে। তার চোখ দুটো সাধারণ মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ বড় আকারের। চোখের রঙও অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাসে প্রায় পানির মত রঙ। মুখটা ছুঁচালো, বড় বেশি সরু। রাস্তার দূরবর্তী বাকে একটা গাড়িকে দেখা গেল। বক নেবার সময় মুহূর্তের জন্য হেডলাইটের আলো এসে পড়ল উলনের উপর।
| রাস্তার উপর উলনের ছায়া পড়ল। ছায়াটা, লম্বা, কঙ্কালের মত-অস্বাভাবিক সরু।
উলনের কণ্ঠস্বরটা মৌমাছির গুঞ্জনের মত, পাতলা সিল্কের কাপড় নাড়াচাড়া করলে যেমন নরম শব্দ ওঠে, তেমনি।
কোথায় সেটা? ইউনুস, চুরি করার মজা দেখাচ্ছি তোকে।’ ‘আমি জা-জানি না! খোদার ককসম•••। উলন, বিশ্বাস করুন•••!
উলন শান্তভাবে বলল, আমি জানি জিনিসটা তোর কাছেই আছে। কোথায় রাখতে পারিস সেটা, তাও অনুমান করতে পারি। জিনিসটা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিস তুই। জানি, তোদের মহাবীর কুয়াশার কাছে ওটা তুই বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছিস। ওটা তোর কোমরে জড়ানো টাকা লুকিয়ে রাখার বেল্টের ভিতর রেখেছিস…।
ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল ইউনুস।
‘উলন ঠি-ঠিক আছে। আসুন, আমরা ঝগড়াটা মিটিয়ে ফেলি! একটা ভু-ভুল করে ফে-ফেলেছি নাহয় আ-আমি…।’
উলনের সাদা ডান হাতটা সর্বক্ষণই বাতাসে ভর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল ধীরে ধীরে, ফড়িংয়ের মত। হঠাৎ সেই হাত বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে গেল। …
উলনের হাত ইউনুসকে স্পর্শ করল কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু পরমুহূর্তে
ভলিউম ১৮
তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ইউনুস। পালাতে চাইছে সে। লাফ দিয়ে সরে, গেল এক পাশে, তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল কন্ফেকশনারী দোকানের কাঁচের দেয়ালের উপর।
কাঁচ ভেঙে পড়ল সশব্দে। ইউনুস তার পকেট থেকে রিভলবারটা বের করার চেষ্টা করছে। অর্ধেক দেহ কন্ফেকশনারী দোকানের ভিতর ঢুকে গেছে তার। উন্মাদের মত পা দুটো চুড়ছে দিকবিদিক। এগিয়ে এসে ভাঙা কাঁচের ভিতর মাথা। গলিয়ে দিল উলন। বাঁ হাতটা নিঃসাড় ভঙ্গিতে শরীরের পাশে ঝুলছে। ডান হাত দিয়ে ইউনুসের শার্ট ধরে টান মারল সে। শার্টের দুটো বোতাম ছিটকে গিয়ে পড়ল রাস্তার উপর। প্যান্টের সঙ্গে বাঁধা চওড়া, ফাপা বেল্টটা দেখা গেল এবার। সেটা ধরে টান মারল উলন। অসুরের শক্তি উলনের শরীরে। চামড়ার বেল্টটা ছিঁড়ে নিল
সে। ইউনুসের পেটে একটা পা তুলে দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে সে।
ফাঁপা বেল্টটার ভিতর থেকে বের করে আনল উলন একটা গগল।
গগটা ভারি অদ্ভুত আকৃতির। যে দুটো কনডেনসড মিল্কের পাত্র দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ওটা। লেনস দুটোকে ঠিক কাঁচ বলে মনে হয় না। রঙটা ঘন কালো।
উলন গগলটা চোখে পরল। কিম্ভুতকিমাকার হয়ে উঠল তার চেহারা। দুর্বোধ্য একটা শব্দ বেরিয়ে এল তার গলা থেকে। দ্রুত গগটা চোখ থেকে নামিয়ে পকেটে রাখল।
পরদিন সকালের দৈনিক পত্রিকাগুলোয় ইউনুসের মৃত্যু বাদ বের হলো।
রাত্রে টহলরত একজন পুলিস কনেস্টবল ইউনুসের মৃতদেহ আবিষ্কার করে। মৃতদেহের কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন না দেখে তার ধারণা হয়, লোকটা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল কাঁচের দেয়ালের উপর, মারাত্মক ভাবে জখম হয় সে–মারা যায় সেই জখমের জন্য। পরে, সেই রাতেই, একজন পুলিশ বিভাগের ডাক্তারও |
এই অভিমত ব্যক্ত করেন।
ইউনুসের পকেটে একটা রিভলবার ছিল একথা কেউ জানল না। কিন্তু তার বেল্টের ভিতর তিন হাজার টাকা পাওয়া গেল। টাকা পেয়ে থানা কর্তৃপক্ষ ধরে নিল এটা খুন নয়। খুনী খুন করতে পারে টাকার জন্য। টাকা যখন রয়েছে তখন ইউনুস খুন হয়নি।
“ কিন্তু রাত তিনটের দিকে ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিল। আগ্রাবাদ এলাকার একটা গুদামের নাইটগার্ড থানায় হাজির হলো। কয়েকঘণ্টা চিন্তা করে অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে যা চাক্ষুষ দেখেছে তা পুলিসকে জানাবে।
গোটা ঘটনাটাই পাহারাদার কাছাকাছি থেকে দেখেছিল।
কুয়াশা ৫৩
গতরাতের ঘটনা।
, শহরের অভিজাত এলাকার একটি তিনতলা বাড়ি। তিনতলার সুসজ্জিত একটি কামরায় মোটাসোটা মাহবুব উল্লাহ শিকদার সোফায় বসে ভ্যাট 69-এর বোতল থেকে গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বিড়বিড় করে আপন মনে বলে উঠল, ব্যাপার কি! আসছে না কেন সে!
| বিরাট দেহের অধিকারী মাহবুব উল্লাহ শিকদার। পোশাক-আশাক দামী এবং রুচি সম্পন্ন। তার চেহারা দেখে সন্দেহ করার কোন উপায় নেই যে সে একজন ক্রিমিন্যাল। দুটো জিনিসের প্রতি শিকদারের ভয়ানক দুর্বলতা আছে। ঘড়ি ও মদ। আরও একটা দুর্বলতা আছে শিকদারের। সেটা হলো লোভ। টাকার লোভ দমন করার ক্ষমতা শিকদারের নেই।
চার-পাঁচটা ঘড়ি থাকে শিকদারের পকেটে।
দরজায় করাঘাত হলো। চমকে উঠে মুখ তুলল শিকদার। ঢোক গিলল দ্রুত। বলল, “ভিতরে এসো।’ ।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল উলন। শিকদার দ্রুত তাকাল উলনের হাতের দিকে। বুকের ভিতর একটা ভয়ের ঢেউ উঠল তার। জোর করে হাসল সে, দেরি হলো কেন?’
পকেট থেকে একটা রিভলবার এবং কয়েকটা চকলেট বের করুল উলন।
দুটো চকলেট মুখে পুরে চুষতে চুষতে রিভলবারটা শিকদারকে দেখিয়ে জানতে চাইল খসখসে গলায়, এটা চিনতে পারো, শিকদার?’।
ঝুঁকে পড়ে উলনের হাতের রিভলবারটা দেখল শিকদার। বাঁকা হয়ে গেল মুখটা। বলল, ই-ইউনুসের রিভলবার–কিন্তু••• * উলন অতি শান্তভাবে চকলেট খাচ্ছে। জানতে চাইল, এই যে আমি খাচ্ছি-তোমরা এ জিনিসকে কি বলো?’
চকলেট। কিন্তু ইউনুস?’
উলন বলল, বড় মজার জিনিস তোমাদের এই চকলেট-খেতে বড় স্বাদ। কি যেন বুলছিলে? ওঃ, ইউনুস-হ্যাঁ।’
শিকদার ঢোক গিলল। আড়চোখে তাকাল উলনের ডান হাতের দিকে। তারপর নিচু গলায় জানতে চাইল, তুমি..তুমি ইউনুসকে কি…কি…?’।
আরও একটা চকলেট মুখে পুল উলন। চোখ বুজে চুষতে লাগল সে। তারপর চোখ মেলল, কি বললে? ওঃ,–হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুন করেছি আমি ইউনুসকে।’
| ‘আঁ! ইউনুসকে তুমি•••মানে খুন করেছ? খুন করে••একজন মানুষকে খুন করে তুমি অমন নিশ্চিন্তে চকলেট খাচ্ছ••!
“দেখো শিকদার, আমি এমন এক জাতির লোক যে জাতির সভ্যতা তোমাদের সভ্যতার চেয়ে কয়েক হাজার বছরের পুরানো।
৫৪
ভলিউম ১৮.
‘বেশ। বুঝলাম। কিন্তু কি এমন অপরাধ করেছিল ইউনুস?’
‘আমাদের পরিকল্পনার কথা সে জানত, এটা তার প্রথম অপরাধ। সে লোভী হয়ে উঠেছিল, এটা তার দ্বিতীয় অপরাধ।’
‘লোভী হয়ে উঠেছিল? ইউনুস? কিভাবে বুঝলে?’
উলন চকলেট খেতে খেতে হাসল। বলল, তুমি যে যন্ত্রটাকে আমার গগলস বলো সেটা ইউনুস চুরি করেছিল। শুধু তাই নয়, সে জানত তোমাদের এই পৃথিবীতে একজন মাত্র মানুষ আছে যে আমার এই গগলসূকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে সফল হতে পারে। বড় বেশি চালাকি করার চেষ্টা করছিল ইউনুস। আমার গালসটা চুরি করে সে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছিল।
বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছিল! কার কাছে? কে তোমার এই গগলস্ কিনতে চায়?’ | উলনের চকলেট খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কঠিন হয়ে উঠল তার মুখের চেহারা । বলল, ইউনুস কুয়াশার কাছে যাচ্ছিল। কুয়াশার কাছে বিক্রি করার ইচ্ছা ছিল তার গ টা••|’
হোয়াট!’
মদের গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে গেল টেবিলের উপর, ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গেল সেটা।
উলনের দিকে অবিশ্বাস ভরা চোখে চেয়ে রইল শিকদার। ঘাম ফুটেছে তার কপালে।
| উলনের লালচে তুকের নিচ থেকে ফুটে বেরিয়ে আসছে নীল রঙের শিরাগুলো। নিশ্চিন্ত মনে চকলেট চুষতে শুরু করেছে আবার সে। উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় তার মাথার সাদা ধবধবে রেশমের মত চুলগুলো চকচক করছে।
শিকদার ভ্যাট 69-এর বোতলের মুখটা মুখে পুরে ঢক ঢক করে খানিকটা মদ গিলে বলল, “উলন, বিপদটা কি ঘটতে যাচ্ছিল তা জানো? কুয়াশার নামই শুনেছ
তুমি, কিন্তু তার সম্পর্কে কিছুই জানো না? ইউনুসকে শেষ করেছ–খুব ভাল হয়েছে। কিন্তু, আমি ভাবছি, ইউনুস খুন হবার আগে আশার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি তো?’
না। তা তোমাদের কুয়াশা খুব ভয়ঙ্কর লোক বুঝি? তার কথা কিছু শোনাও তো?’ | শিকদার বলল, কুয়াশার গুণের কোন সীমা নেই। এমন হাজার হাজার লোক তুমি খুঁজে পাবে যাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে কুয়াশা এই দুনিয়ার মানুষই নয়। সে নাকি পৃথিবীর মানুষের চেয়ে হাজার গুণ বেশি উন্নত এবং আধুনিক অন্য এক দুনিয়ার বাসিন্দা। আবার কেউ কেউ মনে করে সে দেবতা । অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী সে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, সাইকোলজি এবং এঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে তার মত পণ্ডিত পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তার শরীরের শক্তি সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। শুনেছি আড়াই-তিন হাত মোটা গাছের কাণ্ড দুই হাতে ধরে ভেঙে ফেলতে পারে সে। মোটা কংক্রিটের পিলারকে ভেঙে ফেলতে পারে এক ঘুসিতে।’
কুয়াশা ৫৩
। আমাদের মত লোকের জন্য সে কি ভয়ঙ্কর? | শিকদার বলে উঠল, ‘শুধু ভয়ঙ্কর নয়, সাক্ষাৎ যম। তার কাজই হলো সারা পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা। তাকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যাডভেঞ্চারার। তার সহকারী এবং বন্ধু-বান্ধবরাও এক একজন এক একটা প্রতিভা। তাদের সম্পর্কে শোনা, বলি।
চুপ করে রইল উলন। পকেট থেকে আর একটা চকলেট বের করে মুখে পূরুল সে। সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে দাঁড়াল খোলা জানালার সামনে। শিকদারের কথা। গুনছে সে একমনে।
গভীর রাত। গোটা শহর ঘুমিয়ে আছে অঘোরে। সবেগে বাতাস বইছে। আকাশের থমথমে চেহারা পাল্টে গেছে। দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে মেঘের পুর। দিকে।
| শিকদার থামতে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল উলন। বলল, ‘প্ল্যান পরিকল্পনা কেমন এগুচ্ছে?’
শিকদার বলল, এগুচ্ছে না।’ উলন বিরক্তির সঙ্গে জানতে চাইল, মানে?’
শিকদার বলতে লাগল, আমি গত হপ্তায় যেসব কোম্পানীতে আর্জেন্ট টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম সেগুলোর উত্তর পেয়েছি আজ। প্রত্যেকটি এয়ারক্রাফট ফ্যাক্টরীই জানিয়েছে, গোলাকার এয়ারক্রাফট তারা তৈরি করে দিতে পারবে। তাদের তৈরি প্লেন রানওয়ে ছাড়াই সোজা উঠে যাবে, রানওয়ে ছাড়া নামতেও পারবে। কিন্তু প্লেনটা হবে একেবারেই ছোট। বড়জোর দুজন মানুষ বসতে পারবে তাতে। এবং ফুয়েল থাকবে মাত্র ঘন্টাখানেক উড়বার মত। তাদের সকলের বক্তব্য, এই ধরনের প্লেন তৈরির ব্যাপারটা এখনও এক্সপেরিমেন্টাল পর্যায়ে রয়েছে। মোটকথা, ওরা যেগুলো দিতে চাইছে সেগুলোয় কাজ হবে না।
উলন হঠাৎ হাসল। বলল, একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়। বুদ্ধিটা কি জানো? কুয়াশার এরকম অত্যাধুনিক আকাশযান আছে। এই আকাশযান নিয়ে। ফিরে এসেছে সে কয়েক মাস আগে টুইন আর্থ আনতারা থেকে। আমরা যে ধরনের আকাশযান চাইছি-সেটা হুবহু সেই রকম। শুনেছি, এই রকম স্পেসশিপ তার একটা নয়, দুটো আছে।’
কি বলতে চাইছ তুমি, উলন?’ প্রায় চিৎকার করে উঠল শিকদার। বলতে চাইছি, কুয়াশার একটা স্পেসশিপ নেব আমরা।’ শিকদার চিৎকার করে বলল, হয় তুমি পাগল হয়ে গেছ, নাহয় ঠাট্টা করছ আমার সঙ্গে। উলন, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। বলছ কি! আমি তো গোটা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও লড়তে রাজি আছি প্রাণ বাঁচাবার জন্য কিন্তু কুয়াশার বিরুদ্ধে লড়তে রাজি নই।’
তুমি ভয় করতে পারো, করা উচিতও। সত্যিই কুয়াশা অপরাজেয়। কিন্তু আমি কাউকে ভয় করি না। সে আমার ক্ষমতার প্রমাণ পেলে ভাল মানুষের মত সরে দাঁড়াবে। যদি সরে না দাঁড়ায়, বোকামি করবে। আমার ক্ষমতা এমনই, তুমি
ভলিউম ১৮
ততা কিছুটা জানো। যে কোন মানুষকে হত্যা করতে পারি চোখের পলকে–তাই
? কুয়াশা যদি ভালয় ভালয় সরে না দাঁড়ায় আমার রাস্তা থেকে-করার কিছু নেই, মরতে হবে তাকে।
কথাগুলো বলে ঘুরে দাঁড়াল উলন। ধীর পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দরজা খুলে বারান্দায় পা দেবার পূর্ব মুহূর্তে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শিকদারের দিকে, আমি যাচ্ছি।’
ব্যাকুল কণ্ঠে পিছু ডাকল শিকদার, উলন? উলন! উলন, শোনো! কিন্তু উলন শিকদারের ডাক শুনেও শুনল না।
আধঘণ্টা পর দেখা গেল একটা ডিঙি নৌকায় একা বসে বৈঠা চালিয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে এগুচ্ছে উলন। | চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার। নদীর কলকল ধ্বনি ছাড়া শব্দ নেই কোথাও।
মিনিট পনেরো বৈঠা চালাবার’পর সুউচ্চ একটা পাচিলের গায়ে নৌকা ঠেকাল উলন। পাঁচিলটা সোজা উঠে গেছে নদী থেকে। প্রায় দুই আড়াই মানুষ সমান উঁচু হবে পাচিল।
পাচিলটা বহুকালের পুরানো। প্লাস্টার খসে পড়েছে, খসে পড়েছে এখান সেখান থেকে এক আধটা ইট। ছোটখাট গর্ত দেখা যাচ্ছে পাঁচিলের গায়ে। সেই সব গর্তে বিষাক্ত সাপ থাকাও বিচিত্র নয়।
প্রকাণ্ড একটা বিল্ডিংয়ের পিছন দিকের পাঁচিল এটা। পিছন দিকটা পুরানো এবং একতলা হলেও সামনের দিক পাঁচতলা উঁচু এবং অত্যাধুনিক আর্কিটেকচারের সাক্ষ্য বহন করছে।
একটা কাঠের খুঁটি তুলে নিল উলন নৌকার পাটাতন থেকে। সেটা পুরানো পাচিলের একটা গর্তে ঢুকিয়ে দিল সজোরে। সেই খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে নৌকাটা বাঁধল সে। তারপর পাচিলের গর্তে পা দিয়ে দিয়ে বিড়ালের মত উপর দিকে উঠতে শুরু করল।
দেখতে কঙ্কালের মত হলেও উলনের শরীরে অসাধারণ শক্তি আছে। গর্তগুলোয় হাত-পা রেখে দ্রুত উঠে যেতে লাগল সে।
পাচিলের একেবারে উপর দিকে একটা বড় আকারের ভেন্টিলেটার দেখা যাচ্ছে। সেই ভেন্টিলেটারের কাছে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল উলন। ভেন্টিলেটারটায় লোহার শিক লাগানো। ভিতরটা অন্ধকার। উলন এক হাত দিয়ে শিকগুলো ধরে টানতে লাগল। ভেন্টিলেটারের লোহার কিগুলো কয়েক মুহূর্তের মধ্যে খুলে এল উলনের হাতে। ভেন্টিলেটারের জায়গায় একটা বড়সড় ফাঁকের সৃষ্টি হলো। অনায়াসে দেহটা সেই ফাঁকে গলিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারবে এখন
উলন। ফাঁকের ভিতর মাথাটা গলিয়ে দিল সে।
• ছাদের উপর থেকে একটা হাত নেমে এল এমন সময়। ফর্সা, গোলাকার নরম একটা হাত। উলনের ঘাড় ধরে ফেলল সেই মেয়েলি হাতটা। ঘাড় ধরে টানতে লাগল উলনকে উপর দিকে। কুয়াশা ৫৩
৫৭
উলনের মাথাটা বেকায়দা ভাবে আটকে গেল ফাঁকের মধ্যে। আক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতটা রহস্যময় ভঙ্গিতে ফড়িংয়ের মত সামনে পিছনে উড়তে শুরু করেছে। কিন্তু হাতটা অন্য কাজে লাগাতে বাধ্য হলো উলন। দেহটাকে সঙ্কট থেকে মুক্ত করার জন্য পাচিলের একটা গর্ত আঁকড়ে ধরল সে।
কিন্তু নরম, ফর্সা হাতটা তাকে টানছে তো টানছেই। ফড়ফড় শব্দে ছিঁড়ে গেল উলনের গায়ের শার্ট। শূন্যে ঝুলতে লাগল তার দেহটা।
ফর্সা হাতটা ধরে অাছে উলনের ঘাড়। ঘাড় ধরেই উলনকে ছাদের উপর তুলে নিল হাতটা।
দুই হাত দূরে জ্বলে উঠল একটা টর্চ। শোনা গেল একটা ব্যাঙ্গাত্মক কবর। হ্যালো!
তিন
টুইন আর্থের রাজকুমারী অর্থাৎ কুয়াশার বান্ধবী ওমেনা বলে উঠল, মি. ডি. কস্টা, লোকটা কিন্তু হুবহু পাটখড়ির মত, মানে অনেকটা আপনারই মত রোগা পটকা!
| ডি, কস্টা মুচকি মুচকি হাসছিল। রাজকুমারীর কথা শুনে গম্ভীর হয়ে উঠল সে। হাতের লম্বা, সরু ছড়িটা ঘোরাল বাতাসে। উলনের পিঠে ছড়িটার ডগা চেপে ধরল। বলল, হ্যালো!’ | উলন চোখ পিটপিট করে দেখছে ডি, কস্টাকে। কথা বলে উঠল সে খসখসে, কিন্তু একেবারে শান্ত ভাবে, তুমি কুয়াশার সহকারী, ডি, কস্টা, তাই না?
| ডি. কস্টা উত্তর না দিয়ে তাকাল রাজকুমারীর দিকে, ডেকুন টো মিস ওমেনা, হারামজার কাছে আর্মস-অমুনেশন রহিয়াছে কিনা।
দ্রুত সার্চ করল রাজকুমারী। উলনের পকেট থেকে বের করল সে গগলটা। বলল, আর কিছু নেই। কিন্তু এটা কি জিনিস বলুন তো?’
| উলন উঠে বসার চেষ্টা করল। ডি. কস্টার কালো রঙের ছড়িটা চেপে বসল উলনের পিঠে।
বোটাম টিপিয়া ডিব কি!
স্থির হয়ে গেল উলনের দেহ। ডি. কস্টা সম্পর্কে সে সব কথাই জানে, জানে তার এই কালো ওয়াকিং স্টিকটি সম্পর্কেও। ছড়িটার ডগার ভিতর লুকানো আছে ক্ষুদ্র একটা সুচ। সুচের মাথায় মাখানো আছে মারাত্মক বিষ। ছড়ির মাথায় আছে একটি ছোট্ট বোতাম। সেই বোতামে চাপ দিলেই বিষ মাখানো সুচটা বেরিয়ে প্রবেশ করবে শরীরে। মৃত্যু ঘটবে মুহূর্তের মধ্যেই।
তুমি রাজকুমারী ওমেনা, তাই না? উলন আবার কথা বলে উঠল। ডি. কস্টা খেঁকিয়ে উঠল, “টুমি কে?
উলন শান্তভাবে হাসল । জানতে চাইল, তোমরা টেরপেলে কিভাবে আমার আগমন?
ভলিউম ১৮
এবার হাসার পালা ডি কস্টার। এক গাল হেসে সে বলল, “যাডু জানি, যাডু! হামাডেরকে না জানাইয়া একটি পিপড়াও এই বিল্ডিংয়ে ঢুকিটে পারে না। হামাডের অ্যালার্মিং সিস্টেম অটুলনীয়।’
উলন বলে উঠল, ও, সত্যি ভুল হয়েছে আমার। তোমাদের ফটো-ইলেকট্রিক আই আর ম্যাগনেটিক ফিল্ড সম্পর্কে ভাবা উচিত ছিল আমার।’
রাজকুমারী বলল নীচু গলায়, ইলেকট্রিসিটি সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখো দেখছি! | উলনের ডান হাতটা ছাদের মেঝে থেকে উপরে উঠল কয়েক ইঞ্চি, ফড়িংয়ের মত ওড়ার ভঙ্গিতে একবার পিছিয়ে যাচ্ছে হাতটা, একবার সামনে এগুচ্ছে।
| ‘মাই গড! হোয়াইট হ্যাঁণ্ড!
উলনের সাদা হাত দেখে বিমুঢ় হয়ে উঠল ডি কস্টা এবং রাজকুমারী। উলন ঠিক সেই সময় তার মাথাটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ডি. কস্টার পায়ের আঙুলের উপর রাখল, চাপ দিতে লাগল মাথা দিয়ে আঙুলের উপর।
তীব্র ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠল ডিকষ্টা। তার হাতের ছড়িটা সরে গেল উলনের পিঠ থেকে।
উলন এই সুযোগে উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বেগে উড়তে শুরু করল তার ডান হাতটা বাতাসে ভর দিয়ে।
রাজকুমারী পিছিয়ে গেল একপা। দ্রুত বলে উঠল, “মি. ডি. কস্টা, সাবধান! এ কোন সাধারণ লোক নয়।’
| ডি কস্টাও পিছিয়ে গেল এক পা।
টাই টো! মানুষের মটো ডেকিটে, বাট মানুষ নয় মোটেই। ডেকুন মিস ওমেনা, ব্যাটার চোক দুটো কটো বড় বড় । ডেকুন গায়ের রঙটা কেমন আগুনের মটো রেড! ডেকুন হাটের ডিকে টাকিয়ে–হ্যাঁেয়াইট! ফ্লাইং হ্যাঁণ্ড! ডেকুন মাঠার ডিকে টাকিয়ে-চুলগুলো কেমন ব্রইট অ্যাও হোয়াইট।
| ডি. কস্টাকে সাবধান করে দিয়ে, প্রায় চিৎকার করে উঠল রাজকুমারী, সাবধান! ওর হাতের মুঠোয় কি যেন রয়েছে! | লাফ দিয়ে উলনের বাঁ পাশে চলে গেল ডি কস্টা। উলন তাকিয়ে ছিল রাজকুমারীর দিকে, তাই ডি কস্টার সঙ্গে সঙ্গে নিজের দেহটা ঘুরিয়ে নিতে পারেনি সে। দেহটা সে যোরাল ঠিকই কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ডি, কস্টা উলনের ঘাড়ের মাংসে হাতের ছড়ির ডগাটা চেপে ধরেছে।
বিপদ টের পেয়ে স্থির হয়ে গেল উলন। তার ডান হাতটা ধীরে ধীরে ফিরে এল দেহের পাশে, স্থির হয়ে গেল সেটাও।
উলন তিক্ত হাসল। বলল, “আমি জানি, মেরে ফেলতে পারবে না তুমি আমাকে। মেরে ফেলার আগে তোমার বসের কাছে নিয়ে যাবে আমাকে তুমি-ঠিক বলিনি?
শাটআপ! ইউ, শয়টাম! হাটের মুঠো খোলো-কুইক! ঘাড়ে ছড়ির ডগা চেপে বসল আরও। উলন তাড়াতাড়ি ডান হাতের মুঠো খুলল।
কুয়াশা ৫৩
ওরা দুজনই দেখল, উলনের হাতে কিছু নেই।
রাজকুমারী উলনের পকেট থেকে পাওয়া গগলটা চোখের সামনে ধরে বলে উঠল, কি রকম গগল্স্ এটা? কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না?
উলন কথা বলল না।
কেন এসেছ তুমি এখানে? কে তুমি?’ | রাজকুমারীর দিকে তাকিয়ে আছে উলন। কথা বলল না সে।
| ডি. কস্টা বলল, বসের নিকট লইয়া যাইটে হইবে ব্যাটাকে। কিন্টু, টার আগে, এই ব্যাটা হাফ ম্যান, মাঠার উপর হাট ডুটো টুলিয়া ঢরো!
পাঁচতলা বিল্ডিংটা কুয়াশার নিজের হলেও গ্রাউন্ড ফ্লোর সহ থার্ড ফ্লোর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেয়া হয়েছে। ফোর্থ ফ্লোরটা, সম্পূর্ণ নিজের কাজে ব্যবহার করে কুয়াশা। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় আস্তানা তার এটা।
| পাঁচতলায় কামরার মোট সংখ্যা একশ। নিজৰ আলাদা এলিভেটর আছে তার পাঁচতলায় ওঠার জন্য। সাধারণত কুয়াশা ছাড়া সেটা অন্য কেউ ব্যবহার করে
।
উলনকে পাঁচতলায় নিয়ে যাওয়া হলো কুয়াশার ব্যক্তিগত এলিভেটরের সাহায্যে।
প্রশস্ত করিডর ধরে এগিয়ে চলল ওরা। একটি দরজার সামনে দাঁড়াল রাজকুমারী। দরজার গায়ে ছোট্ট একটা নেমপ্লেট। পিতলের অক্ষরে বাংলায় লেখা: ড. মনসুর আলী। | কুয়াশার প্রকৃত নাম ওটা। “ উলনও দাঁড়াল। উলনের পিছনে রয়েছে ডি. কস্টা। তার হাতের ছড়ির ডগাটা উলনের শিরদাঁড়ার উপর চেপে বসে আছে। উলন একটু নড়াচড়া করলেই ডি., কস্টা আরও চেপে ধরছে ছড়ির ডগাটা।
চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলল রাজকুমারী। | বড় আকারের, অত্যাধুনিক আসবাবপত্রে সুসজ্জিত একটা কামরার ভিতর ঢুকল ওরা। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল একটা বড় আকারের রেডিও থেকে ঘোষণা হচ্ছে: টহলদানরত সব পুলিস-কারকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে। জিঞ্জির খান জেল থেকে পালিয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে শহরেই কোথাও আশ্রয় নিয়েছে সে। শহর থেকে পালাবার চেষ্টা করবে। নির্দেশ দেয়া হচ্ছে সে যেন কোনমতেই শহর ছেড়ে পালাতে না পারে। জিঞ্জির খানের চেহারার বর্ণনা এইরকম, প্রকাণ্ডদেহী সে। চুল কালো, চোখ দুটো ঢালো। মুখে তিনটে ক্ষতচিহ্ন আছে। ভয়ঙ্কর বেপরোয়া লোক সে। ডান পা-টা সামান্য খোঁড়া। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে•••| | ঘোষণা প্রচার করা হচ্ছে পুলিস কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়্যারলেসের সাহায্যে। পুলিসকারগুলোর উদ্দেশ্যে। কুয়াশা তার নিজস্ব রেডিওতে জরুরী ঘোষণাগুলো নিয়মিত শোনে। অপরাধীদের গতিবিধি সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারে সে
৬০
ভলিউম ১৮
এইভাবে।
রেডিওর শব্দ ছাপিয়ে শোনা গেল ডি কস্টার কণ্ঠস্বর, বস! প্লীজ একবার এই রূমে পড়ার্পণ করুন। এক ব্যাটাকে হামরা পাকড়াও করিয়াছি স্পেসক্রাফটের যাঙ্গারের নিকট হইটে। রিভার সাইডের ডেয়াল••।’
কুয়াশা হাতে ধূমায়িত পাইপ নিয়ে একটি দরজা পেরিয়ে কামরায় প্রবেশ করল।
উলন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কুয়াশার দিকে। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ কুয়াশাকে দেখে তার চোখ দুটো কুঁচকে উঠল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কুয়াশার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করছে সে। সাধারণ কোন মানুষের সঙ্গে এ লোকের কোন তুলনা হয় না, বুঝতে পারুল সে। কুয়াশার চোখ দুটোর দিকে তাকাল বটে সে কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ সরিয়ে নিল সে দ্রুত। কুয়াশার চোখ দুটোয় যেন যাদু আছে। চোখ দুটোর দৃষ্টি এমনই অদ্ভুত, যেন অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখে ফেলছে তার। এ চোখ সম্মোহন করার চোখ, বুঝতে পারুল উলন।
কালো সিল্কের আলখেল্লা পরে আছে কুয়াশা।
রাজকুমারী সম্পূর্ণ ঘটনাটা ব্যক্ত করল নিচু গলায়। কথা শেষ করে কুয়াশার হাতে তুলে দিল সে রহস্যময় গগলসটা।
গগলসটা নিয়ে উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করল কুয়াশা। পরীক্ষা করতে করতে বারবার তাকাল মেঝেতে বসা উলনের দিকে। গগটা চোখে পরল কুয়াশা একবার। কয়েক মুহূর্ত পর চোখ থেকে নামিয়ে নিল সেটা। ভুরু জোড়া একটু কুঁচকে উঠল যেন। তাকাল উলনের দিকে আবার।
‘কি এটা?’
উলন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, খেলনা। মূল্যহীন, গুরুত্বহীন, বাচ্চাদের একটা খেলনা ওটা।’
কুয়াশা কি মনে করে আপনমনে মাথা নাড়ল। তারপর জানতে চাইল, কি মনে করে তুমি স্পেক্রাফট হ্যাঁঙ্গারের কাছে এসেছিলে?’
উলন হঠাৎ হাসল। হাসলে তাকে কুৎসিত, ভয়ঙ্কর দেখায়। বলল, খুলেই বলি। বিশেষ একটা জরুরী ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ–আপনি আমার মত একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করবেন না এই ভেবে আমি নদীপথে নৌকা নিয়ে আপনার আস্তানায় ঢোকার চেষ্টা করি। আমি জানতাম আপনার অ্যাল্যামিং সিস্টেমে আমার অনুপ্রবেশ ধরা পড়বে, আপনার লোকেরা আমাকে ধরবে এবং আপনার কাছে হাজির করবে। আপনার দেখা পাবার এটাই একমাত্র উপায়–ভেবেছিলাম আমি।
ডি.’কস্টা গর্জে উঠল, লায়ার!
কুয়াশা কথা না বলে তার হাতের গগল্স্টার দিকে আবার তাকাল। আবার তার ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল।
এদিকে রেডিও থেকে তখনও ঘোষণা প্রচারিত হচ্ছে। জিঞ্জির খানের চেহারার
কুয়াশা ৫৩
বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। প্রকাগুদেহী সে। চুল কালো, চোখ দুটো কালো। মুখে তিনটে ক্ষতচিহ্ন আছে। ভয়ঙ্কর বেপরোয়া নোক সে•••
রেডিওর শব্দ মান হয়ে গেল কুয়াশা ভরাট গলায় কথা বলে উঠতে। কে তুমি?’
উলন উত্তর দিল, ইকবাল আহমেদ আমার নাম। তবে তাইওয়ানে আমাকে লোকে চেনে চেংফাঃ নামে।
কুয়াশার মুখের চেহারা দেখে মনের ভাব বোঝা গেল । | উলন আবার কথা বলে উঠল, জানি আপনি কি ভাবছেন, মি. কুয়াশা। পুরোপুরি বাঙালীদের মত দেখতে নই আমি। তার কারণ, আমি জন্মসূত্রে চাইনীজও। আমার বাবা বাঙালী ছিলেন, কিন্তু মা চাইনীজ। আর একটা কথা। দু ধরনের রক্ত মিশ্রণের ফলে আমার চেহারা এমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে তা নয়। আমি কঠোর পরিশ্রম করে, কল্পনাতীত বিপদের মধ্যে থেকে বেচে এসেছি। এমন সব ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছিলাম আমি, এমন সব যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে আছি আমি–আর কোন মানুষ হলে একবার নয়, হাজারবার মরে যেত।’
বলে যাও।
বলে চলল উলন, কেউ বিশ্বাস করবে না বলে আমার অতীতের কথা আমি কাউকে বলতে চাই না। কিন্তু আপনাকে আমি সব কথা বলতে পারি। আমার বিশ্বাস, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন। আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন, খালি চোখে আমরা যা দেখি তাছাড়াও এমন অনেক জিনিস আছে যেসব জিনিসকে অগ্রাহ্য করা চলে না, যে-সব জিনিসের ক্ষমতা, শক্তি সম্পর্কে কারও কোন রকম সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তাই না? মি. কুয়াশা আপনি কি অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন?
উলন প্রশ্নটা করে মুহূর্তের জন্য থামল। কুয়াশা উত্তর দিল না দেখে আবার বলতে শুরু করল সে, আপনি নিশ্চয়ই আইস অভিযানের কথা শুনেছেন? নর্থ কানাডার প্যাক আইসে অভিযাত্রী দলটা নিখোঁজ হয়ে গেছে, তাই না? আমি, ইকবাল আহমেদ সেই অভিযাত্রী দলের একমাত্র সদস্য, যে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছি। কয়েক মাস আগে, আপনি শুনেছেন কিনা জানি না, আমি প্লেন নিয়ে নর্থ কানাডায় যাই নিখোঁজ অভিযাত্রী দলটিকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু। সেখানে গিয়ে মহাবিপদে পড়ি। কোন প্লেনকে সেখানে ল্যাণ্ড করানো সম্ভব নয়।’ বরফ ছাড়া আর কিছুই নেই এলাকাটায়। এয়ারক্রাফট কোম্পানীগুলো যে ধরনের প্লেন তৈরি করছে সেগুলো দিয়ে কাজ হবেনা। হারানো অভিযাত্রী দলটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করতে হলে দরকার অন্য ধরনের আধুনিক স্পেসক্রাফট। সে ধরনের
স্পেসক্রাফট একমাত্র আপনার কাছেই আছে।
বলে যাও।’
উলন বলল, আপনার স্পেসক্রাফটটা ধার চাইব বলেই আপনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছি আমি। অবশ্য আরও একটা কারণ আছে।
কি সেটা?
ভলিউম ১৮
উলন একটু বিরতি নিয়ে বলল, ‘আমি জানি, পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃসাহসী মানুষ আপনি। আপনার জ্ঞান-গরিমার তুলনা হয় না। মি, কুয়াশা, আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করছি।’
| উলন থামতেই রাজকুমারী জানতে চাইল, কুয়াশা, আইস অভিযান–কথাটা কি বানানো?’– | কুয়াশা বলল, ‘না। পেপারে খবরটা বেরিয়েছিল। কিন্তু খবরটার মধ্যে আরও কিছু তথ্য ছিল। অভিযাত্রী দলের লীডারের নাম ছিল প্রফেসর স্টিডেনসন। কানাডিয়ান।’
উলন দ্রুত জানায়, খবরের কাগজে তো, এ কথাও লেখা হয়েছিল যে আইস অভিযাত্রীরা সাধারণ কোন বিপদে পড়ে হারিয়ে যায়নি, তারা হারিয়ে যায় অলৌকিক একটা বিপদে পড়ে••।’
সবাই চুপ করে রইল। এমন কি, কুয়াশার চোখেও প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।
উলন নড়েচড়ে বসল, বলি তাহলে। আমরা নর্থ কানাডার বরফাচ্ছাদিত জগতে যে রসহ্যময় জিনিসের দেখা পাই তার নাম–কি বলব-কি বলব-জিনিস” বলাই ভাল তাদেরকে। জিনিসগুলো আসত রাতের অন্ধকারে। সেগুলো আকারহীন•••আর ভয়ঙ্কর। জিনিসগুলো আসত রাতে আমাদের একজন করে লোককে নিয়ে যেত তারা প্রতিবার। আমাদের মধ্যে একজন করে কমতে লাগল লোক। তারপর, আমি পালালাম•••একমাত্র আমিই শেষ পর্যন্ত পালাতে
পারি।’
কুয়াশা প্রশ্ন করুল, স্টিভেনসনের আইস অভিযানে তুমি ছিলে, বলছ। কোনও প্রমাণ দেখাতে পারে?
উলন বলল, না তেমন কোন প্রমাণ আমি এই মুহূর্তে দেখাতে পারব না। কিন্তু চেষ্টা করলে আপনি আমার দাবির সত্যতা যাচাই পারবেন। কানাডা
সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই জানতে পারবেন আমি আইস অভিযানের সদস্য ছিলাম কিনা। ব্যাপারটা খুলেই বলি। আইস অভিযানে যোগ দিয়েছিলাম অনেকটা ঘটনাচক্রে। কানাডায় পড়াশোনা করছিলাম আমি। স্টিভেনসন ভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন। খুবই স্নেহ করতেন তিনি আমাকে। কথায় কথায় একদিন তিনি। তাঁর অভিযানের কথা বললেন। আমাকে উৎসাহী দেখে তিনি অভিযানে যোগ দেবার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটা আমি সানন্দে গ্রহণ করি।’
চার থামল উলন, আবার শুরু করার আগে কুয়াশার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে চাইছে সে তার গল্পটা কিভাবে গ্রহণ করছে। | রাজকুমারী এবং ডি. কস্টার চোখেমুখে অবিশ্বাস ফুটে উঠলেও কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বোঝা গেল না তার মনের কথা।
এদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
কুয়াশা ৫৩
টেবিলের উপরের রেডিওটা থেকে নতুন একটা ঘোষণা প্রচার করা হচ্ছে তখন: জরুরী ঘোষণা! সকল টহলদানরত পুলিস কারের প্রতি জরুরী বেতার বার্তা! ইউনুস নামক একজন লোককে অস্বাভাবিক রোগা, সাদা হাত এবং সাদা চুলওয়ালা একজন লোক খুন করে পালিয়ে গেছে। খুনীর চেহারাটা খুবই অসাধারণ। বেশ লম্বা সে, প্রায় ছয় ফুটের মত। খুনীর পরনে নীল রঙের সার্ট এবং গ্যাবার্ডিনের সাদা প্যান্ট।
| ডি, কস্টা উলনকে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে গর্জে উঠল, ব্যাটা পাকা খুনী অটিশয়!
সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলে কুয়াশা। যে ভাষা একমাত্র তার সহকারীরা ছাড়া আর কারও বোঝার সাধ্য নেই। কুয়াশা যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, পালাচ্ছে লোকটী! সাবধান! খুব সাবধান! আটকাতে হবে ওকে, কিন্তু সাবধানে এগোঁও।
চোখের পলকে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে উলন ইতিমধ্যে।, ধাওয়া করল কুয়াশার নির্দেশ পেয়েই রাজকুমারী এবং ডি. কস্টা।
| এরপরই অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটতে শুরু করল।
রাজকুমারী এবং ডি. কস্টা দুজন দুদিক থেকে ছুটে গেল উলনের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে উলনের কাছে পৌঁছে গেল তারা। উলনের কোন উপায় নেই। ধরা পড়েই গেছে সে বলতে গেলে। কিন্তু এক সেকেণ্ডেরও অল্প সময়ের মধ্যে উলন ওদের দুজনের হাতের আওতা থেকে সরে গেল। সরে যাবার আগে চিলের মত ছোঁ মেরে কেড়ে নিল সে ডি, কস্টার হাতের ছড়িটা, দুই হাতে ধরে মট করে ভেঙে দু’টুকরো করে ফেলে দিল সেটাকে টেবিলের নিচে।
ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। এত অল্পসময়ে কেউ, নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়-কল্পনা করাই কঠিন। উলনের শরীর যেন বিদ্যুতের মত, পলক ফেলার আগে সরে যাচ্ছে সে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়।
ব্যাপারটা লক্ষ করে কুয়াশাও বিস্মিত না হয়ে পারছে না। আলখেল্লার পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে ফেলেছে সে ইতিমধ্যে। কিন্তু একান্ত প্রয়োজন
হলে গুলি করবে না সে। লোকটাকে জীবিত বন্দী করতে চায়।
উলনকে হাতের আওতায় পেয়েও স্পর্শ করতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে রাজকুমারী এবং ডি. কস্টা। কুয়াশা একলাফে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে।
উলনের বেরিয়ে যাবার রাস্তা বন্ধ।
রাজকুমারী এবং ডি. কস্টা আবার এগোল উলনের দিকে। এবার ধীরে ধীরে, সতর্কতার সঙ্গে।
ব্যাটার দেহটা ইলেকট্রিসিটি ডিয়ে টৈরি, আই গেস! ডি. কস্টা সন্দিহান কণ্ঠে বলে উঠল।’
উলনও এবার এগিয়ে আসছে ওদের দু’জনের দিকে। তার ডান হাতটা বাতাসে ভর দিয়ে ফড়িংয়ের মত থেমে থেমে উড়তে শুরু করেছে এতক্ষণে
৬৪
ভলিউম ১৮
আবার।
কুয়াশা অকস্মাৎ বলে উঠল, সাবধান! পিছিয়ে যান, মি. ডি. কস্টা!
পিছিয়ে এল ডি কস্টা এবং রাজকুমারী। কিন্তু উলন থামল না, এগিয়ে আসছে। সে দ্রুত। তার ডান হাতটা বাতাসে ভর দিয়ে নাচছে অবিরাম, অবিরত। হঠাৎ আবার সেই কল্পনার অতীত গতিতে লাফ দিল, চোখের পলকে রাজকুমারী ওমেনার। সামনে চলে এল সে। তার ডান হাতটা উপর দিকে উঠল, রাজকুমারীর ঘাড়ের দিকে হাতটা বিদ্যুৎবেগে ছুটে যাচ্ছে। কুয়াশা দরজার কাছ থেকে এক লাফে চলে
এসেছে ইতিমধ্যে রাজকুমারীর পাশে। সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল সে। ওমেনাকে, নিজেও লাফ দিয়ে সরে গেল উলনের কাছ থেকে দূরে।
কুয়াশার ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে গেছে রাজকুমারী।
উলন এবার ছুটে গেল ডি কস্টার দিকে। কুয়াশা লাফিয়ে গিয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারুল উলনের ডান পাশের কোমরে।
হালকা দেহটা কুয়াশার লাথি খেয়ে শুন্যে উঠে গেল, ছুটে গিয়ে ধাক্কা খেলো। দেয়ালের গায়ে, দেয়াল থেকে পড়ল মেঝেতে। পরমুহূর্তে স্প্রিংয়ের মত মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল উলন। সেই অবিশ্বাস্য বেগে আবার ছুটল সে আক্রমণ করতে । তার ডান হাত আগের মতই রহস্যময়, ভীতিকর ভঙ্গিতে বাতাসে ভর দিয়ে উড়ছে।
এরপর যা ঘটতে লাগল তা এককথায় সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। প্রশস্ত কামরার ভিতর যেন কয়েক শত দৈত্যদানব হিংস আক্রোশে লাফালাফি করছে।
উলন প্রতি সেকেণ্ডে আক্রমণ করছে তিনজনের একজনকে। কুয়াশা বিদ্যুতের মত ছুটোছুটি করে রক্ষা করার চেষ্টা করছে ওমেনা এবং ডি, কস্টাকে–নিজেকেও।
রাজকুমারী! হুশিয়ার! কাউকে যেন স্পর্শ করতে না পারে ও।’
আতঙ্ক, ভয় বলে কোন জিনিসের সঙ্গে পরিচিত নয় ওরা। কিন্তু আজকের মত বিপদে এর আগে পড়েনি কেউ। ডি কস্টার চোখ দুটো ডিমের মত বড় বড়, হয়ে গেছে। ভয়ে বিকৃত হয়ে গেছে তার সরু মুখটা। ‘
| রাজকুমারী ঘামছে দরদর করে। সাবসোনিক রেডিয়েশন নামক ব্যক্তিগত অস্ত্রটা ব্যবহার করার সুযোগও পাচ্ছে না সে। এই অস্ত্র ব্যবহার করতে হলে কিছু সময় দরকার। ‘.
উলন খসখসে গলায় কথা বলে উঠল হঠাৎ, ‘আমার গগলস! দিয়ে দাও ওটা, নয়তো তোমাদের সবাইকে খুন করে ফেলব আমি!
কুয়াশার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে।
সে কথা বলে উঠল সাঙ্কেতিক ভাষায়। কামরার দুই কোণায় সরে গেল রাজকুমারী আর ডি কস্টা।..’।
কুয়াশা হাত দিল আলখেল্লার পকেটে। হাতটা বেরিয়ে এল, গণস্টা দেখা গেল তার হাতে। উলনের দিকে ছুঁড়ে দিল সে গগলসটা।
শূন্য থেকে লুফে নিল গগলটা উলন। ঠিক সেই মুহূর্তে ঠন্ করে কাঁচ ভাঙার একটা শব্দ হলো।
৫–কুয়াশা ৫৩
হঠাৎ উলনের পা দুটো ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটুর কাছে। শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে পড়ে গেল মেঝেতে। স্থির, নিঃসাড় হয়ে গেছে কঙ্কালসার দেহটা। দেখে মনে হয়–খতম হয়ে গেছে উলন।
নড়ল না কেউ। দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা তিনজন।
* ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। দীর্ঘ পদক্ষেপে গিয়ে দাঁড়াল একটা জানালার সামনে। জানালাটা খুলে দিয়ে ফিরে এল সে উলনের নিঃসাড় দেহের কাছে। হাঁটু ভাজ করে বসল সে দেহটার পাশে। | খানিক আগে কুয়াশা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই জায়গার মেঝেতে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে দেখা গেল।
পকেট থেকে উলনের গগলসটা বের করার সময় কুয়াশা সেই সঙ্গে একটা ক্ষুদ্র কাঁচের অ্যানেসথেটিক বম্ব বের করে এনেছিল। গগলসটা উলনের দিকে ছুঁড়ে দেবার সময় হাতের বোমাটা মেঝেতে ফেলে দেয় সে। তার আগে সাঙ্কেতিক ভাষায় রাজকুমারী এবং ডি কস্টাকে দম বন্ধ করে থাকার নির্দেশ দেয়।
বিষাক্ত গ্যাসটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। ছড়িয়ে পড়বার সময়। কেউ যদি শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে ফুসফুসে এই গ্যাস গ্রহণ করে, জ্ঞান হারাবে সে। কমপক্ষে দুঘন্টা অজ্ঞান হয়ে থাকতে হবে তাকে। এই গ্যাসের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাজা বাতাসের সংস্পর্শে আসার খানিক পরই এর কার্যক্ষমতা লোপ পায়।
কথা বলে উঠল ডি কস্টা, ‘লোকটা–গড় নোজ হোয়েদার হি ইজ এ ম্যান অর নটপালাইবার সুযোগ পাইয়াও পালায় নাই! গগলস্টা রিটার্ন লইবার জন্য সে•••।’
| কুয়াশা উলনের পাশে বসে তাকে দেখছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। হাত বাড়াল সে উলনের ডান হাতটা ধরার জন্য।
| বিদ্যুৎবেগে, চোখের পলকে, উঠে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ল উলন। তার ডান। হাতটা দুলছে, নাচছে। হঠাৎ সেই হাত কব্জির কাছে ভাঁজ হয়ে গেল। হাড্ডিসার আঙুলগুলো লোহার শিকের মত দেখাচ্ছে। ভঙ্গিটা সাপের ফণার মত। সেই সাপের ফণার মত হাতটা ছোবল মারল কুয়াশার ঘাড় লক্ষ্য করে।
| গ্যাসের প্রভাব মুক্ত হয়ে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে উলন। কুয়াশা এন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় অবাক না হয়ে পারল না। উলনকে উঠে দাঁড়াতে দেখেও নড়ল না সে। কিন্তু উলনের ডান হাতটা সবেগে ঘাড়ের উপর েেম আসছে দেখে লাফ দিয়ে সরে
গেল সে। সরে গিয়েই রিভলবার তুলল গুলি করার জন্য।
চোখের পলকে চলে এল উলন তার সামনে। কুয়াশা বসে পড়ল ঝট করে। উলন ডান হাতটা দিয়ে আবার ছোবল মারল। কুয়াশাকে স্পর্শ করতে না পারলেও তার হাতের রিভলবারটা এক ঝটকায় কেড়ে নিল। রিভলবারটা হাত ছাড়া হয়ে যেতে কুয়াশা বিদ্যুৎবেগে সামনে এগোল, ডান পাটা বাড়িয়ে দিল সে। ছিটকে পড়ল উলন, তার হাতের রিভলবারটা ছুটে গেল, অদৃশ্য হয়ে গেল সোফার নিচে।
উলনকে ল্যাং মেরে কুয়াশা সরে গেছে কামরার এক প্রান্তে। উঠে দাঁড়িয়ে
৬৬
ভলিউম ১৮
আবার উলন এগিয়ে আসছে। এবার ধীরে ধীরে। কিন্তু তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, এখুনি সে তার গতির খেলা দেখাবে।
লাফ দিয়ে রাজকুমারী আর ডি কস্টার কাছে চলে গেল কুয়াশা। দুই হাত দিয়ে দুজনকে ধাক্কা মারল সে।
কঠোর আদেশের মত শোনল কুয়াশার কণ্ঠস্বর, মি. ডি. কস্টা, পাশের কামরায় চলে যান। রাজকুমারী, তুমিও! কুইক!’
কিন্তু কুয়াশা! কুয়াশার ধাক্কা খেয়ে তাল সামলাতে সামলাতে রাজকুমারী বলল। কুয়াশা••• ||
হাতের ইশারায় সরে যেতে বলল কুয়াশা ওদের দুজনকে। কিন্তু দুজনের কারও মধ্যেই নড়বার লক্ষণ দেখা গেল না। কুয়াশাকে একা এই ভয়ঙ্কর বিপদে ফেলে রেখে পালাতে রাজি নয় ওরা।
টের পেয়ে কুয়াশা পিছিয়ে এল খানিকটা। উলনের দিক থেকে চোখ সরায়নি সে মুহূর্তের জন্যও।
দুদিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়ে রাজকুমারী এবং ডি. কস্টাকে ধরল কুয়াশা। পাশের কামরায় ঢোকার দরজার দিকে ঠেলে দিল দু’জনকে। সেই সঙ্গে হাতের গালটা পাশের কামরার দিকে ছুঁড়ে দিল।
সবেগে দরজা টপকে পাশের কামরার মেঝেতে গিয়ে পড়ল দুজন।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল ওরা। ছুটল দরজার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।
| চিৎকার করে উঠল, ডি, কস্টা, বস! মাই বস!
হায়! হায়! হায়! হায়!
ডি. কস্টা উন্মাদের মত মাথা নাড়তে নাড়তে প্রলাপ বকতে শুরু করল। গগলসটা কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখল সে।
বন্ধ দরজার ওদিক থেকে নানারকম শব্দ ভেসে আসছে। চেয়ার উল্টে পড়ছে, কাঁচ ভাঙার শব্দ হচ্ছে।
হঠাৎ শোনা গেল খসখসে একটা কণ্ঠস্বর। উলন কথা বলছে, এই গগলসের জন্য ছয় ঘণ্টা আগে একজন লোককে খুন করেছি আমি! এখন তোকে খুন করব!’
এরপর আবার হুটোপুটির শব্দ হতে লাগল।
তারপর হঠাৎ, ছুটন্ত পদশব্দ পাণ্ডয়া গেল। হলরুমের দরজা খোলার এবং বন্ধ হবার শব্দ ভেসে এল।
পাশের কামরায় কেউ নেই এখন, বুঝতে পারল ওরা। মৃদু শব্দ ভেসে আসছে শুধু রেডিওটা থেকে। | ‘জিঞ্জির খানের চেহারার বর্ণনা এই রকমঃ প্রকাণ্ডদেহী সে। চুল কালো, চোখ দুটো কালো। মুখে তিনটে ক্ষত চিহ্ন আছে। ভয়ঙ্কর লোক সে। ডান পাটা সামান্য খোঁড়া, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে।
কুয়াশা ৫৩
৬৭
পাঁচ মাহবুব উল্লাহ শিকদারের বাড়ি। বাড়িটা তিনতলা। নিচের তলায় একটি রেস্তোরাঁ। উপর তলাগুলো শিকদার ব্যবহার করে।
ভোর হয়ে গেলেও রেস্তোরাঁটা খোলেনি তখনও। গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকল উন।
উ বারান্দায় উঠে উলন দাঁড়াল একটি বড় আকারের দরজার সামনে। দরজার মাথায় নিওন সাইন জ্বলছে-শিকদার রেস্তোরাঁ।
দরজার গায়ের বোয়ামে এই সাদা আঙুল রেখে চাপ দিল উলন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা।
কে কাকে চাই?’: | গরিলর মত দেখতে একটা লোক দরজা খুলে দিয়ে জানতে চাইল। উলন বলল, তুমি হাক্কা?
হাকা।’ “আমি শিকদারের সঙ্গে দেখা করব।’
হাক্কা ভোরের মৃদু আলোয় উলনকে পরিষ্কার চিনতে পারল না। বলল, কে তুমি?
খেপে গেল উলন। তার ডান হাতটা নাচতে নাগল শুন্যে ফড়িংয়ের মত। *. ছিটকে পিছিয়ে গেল হাক্কা। রেস্তোরাঁর ভিতর থেকে কথা বলে উঠল সে,
‘মাফ চাই, ইজর! ভুল করে ফেলেছি। এবারটির মত মাফ করে দিন।
উলন নিঃশব্দে প্রবেশ করল রেস্তোরাঁর ভিতর। কাস্টমারদের জন্য রেস্তোরাঁ এখন বন্ধ হলেও ভিতরে বেশ কয়েকজন লোককে দেখা গেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে চেয়ার দখল করে বসে আছে। | প্রত্যেকটি লোককে একবার করে দেখে নিল উলন। একজন লোক একা একটা টেবিলে বসে সিগারেট টানছে। তার কোলের উপর পড়ে রয়েছে চকচকে একটা রিভলবার।’’
. উলনের পিছন থেকে হাক্কা বলে উঠল, ৭ সাত নম্বর কেবিনের ভিতর। “ উলন এগিয়ে গেল সাত নম্বর কেবিনের দিকে।
কেবিনে ঢুকে ঊলন দেখল মাহবুব উল্লাহ শিকদার বোতল থেকে গ্লাসে মদ ঢালছে।
. উলনকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকাল শিকদার। অপ্রতিভ দেখাল তাকে। বলল, বসো।
* বসল না উলন। বলল, শিকদার, একটা কথা তোমাকে আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করছি।
শিকদার বোকার মত চেয়ে রইল উলনের মুখের দিকে। উলন জানতে চাইল, তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করো?
1
৬৮
ভলিউম ১৮
শিকদার ঢোক গিলল। মদের গ্লাসটা তুলে চুমুক দিয়ে অর্ধেক খালি করে ফেলল সেটা। বলল, কী আশ্চর্য! এসব কথা, এমন হঠাৎ, সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করার মানে?’
‘একটা টেবিল দখল করে অচেনা একজন লোক বসে রয়েছে দেখলাম। তার কোলের ওপর রয়েছে একটা রিভলবার। শিকদার, তুমি কি সন্দেহ করো-আমি তোমার শত্রু?”
উলনের মুখোমুখি দাঁড়াল শিকদার। একটা হাত রাখল উলনের কাঁধে। বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হলো! ওর নাম আমীর খান। আমার দলের লোক ও । ছিঃ ছিঃ, তুমি এসব কথা ভাববে জানলে•••যাক গে, তোমার খবর কি?’
• উলন বলল, ব্যর্থ হয়েছি। ‘ | শিকদার তিক্ত কণ্ঠে বলল, “জানতাম। তুমি তো আমার কথা শুনলে ল। কোথাকার পানি কোথায় গড়িয়েছে শুনি।
বলতে শুরু করল উলন। তার শেষ দিকের কথাগুলো এই রকম, কুয়াশাকে চিনলেও, আসলে চিনতাম না। সত্যি কথা বলতে কি, তার ক্ষমতা অসীম। যাই হোক, এক সময় সে তার সহকারীদের পাশের কামরায় পাঠিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। খানিকক্ষণ লড়াই হয় আমাদের মধ্যে। সর্বক্ষণই সে আমার ডান হাতের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বিদ্যুতের মত চোখের পলকে মুভ করার
অসাধারণ সমতা তার। শেষ পর্যন্ত পালিয়ে আসতে বাধ্য হই আমি।’
পরপর দুবার ঢোক গিলল শিকদার। বলল, সে তোমাকে অনুসরণ করেনি তো?’
সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে মুখে পুল
উলন।
দুঃখের বিষয় গুগলটা আনতে পারিনি।’
“ উলন বলল। তার কথা শেষ হতেই ঝন ঝন শব্দে ওয়ার্নিং বেল বেজে উঠল। ল্ডিংয়ের মত লাফিয়ে উঠল শিকদার।
কি হলো!’ শিকদারের মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে। কাঁপছে সে।
বিপদ সঙ্কেত! উপরতলায় গার্ড দিচ্ছে ভোমর আলী। একমাত্র পুলিস হানা দিলেই এই বিপদ সঙ্কেত বাজাবার নির্দেশ আছে তার ওপর।
ঝড়ের বেগে কেবিনের ভিতর ঢুকল আমীর খান। রিভলবারের বদলে তার হাতে একটা স্টেনগান দেখা যাচ্ছে এখন।
দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গর্জে উঠল শিকদার, এখানে কি? পুলিস হানা দিয়েছে বুঝতে পারছ না! যাও, যতক্ষণ পারো ঠেকিয়ে রাখো, পালাবার সময় দরকার আমাদের।’
ঝড়ের বেগে আবার বেরিয়ে গেল আমীর খান। কুয়াশা ৫৩
শিকদার নিজের মাথার চুল ধরে টানতে টানতে বলল, “যত কিছুই করি, পুলিসের খাতায় আমার নামে কোন অভিযোগ নেই। এর জন্য তুমি দায়ী, উলন। ইউনুসকে খুন করার জন্যে পুলিস তোমাকে খুঁজছে। এখানে আসার সময় নিশ্চয়ই
পুলিসের লোক তোমাকে অনুসরণ করে এসেছে।
অসম্ভব। আমাকে কেউ অনুসরণ করেনি! শিকদার চিৎকার করে উঠল, এই তোমার এক দোষ। নিজের ভুল স্বীকার করতে চাও না।
উলনকে এতটুকু উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে না। সে সহজ ভাবেই বলল, তোমার বিরুদ্ধে বড় জোর বেআইনী অস্ত্র রাখার অভিযোগ আনতে পারে পুলিস। এক কাজ করো
হয়। আমাকে তুলে দাও পুলিসের হাতে। ওরা আমাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না। ঠিক বেরিয়ে আসব আমি।’ | শিকদার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল উলনের দিকে, কি ভাবো তুমি আমাকে, উলন? বেঈমান? তুমি জানো না, আমি সে ধরনের লোক নই? এসো, দেখা যাক কি করা যায়।’
কেবিন থেকে বেরিয়ে এল ওরা। সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে আসছে একটা লোক! শিকদার তার দিকে তাকাল, জানতে চাইল, কি ব্যাপার, তোমর?
‘পুলিস! ঘিরে ফেলেছে গোটা বাড়ি!’’
শিকদার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আমীর খান দরজার গায়ে ছোট্ট একটা খোপের ঢাকনি খুলে গর্তের ভিতর স্টেনগানের নল ঢুকিয়ে দিয়ে গুলিবর্ষণ করছে।
‘থামাও।’ গর্জে উঠল শিকদার।..
স্টেনগানের গুলিবর্ষণ থামল। এমন সময় বাইরের বারান্দা থেকে একটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “পুলিস ইন্সপেক্টর আরিফুর রহমান বলছি। সারোর করো সবাই। গুলি করে কোন লাভ নেই। আমরা ঘিরে ফেলেছি চারদিক থেকে। তোমাদের গোপন পথগুলোও বন্ধ করে দিয়েছি আমরা।’
| শিকদার তার দলের লোকদের উদ্দেশে বলল, আমীর খান যতক্ষণ পারে ঠেকাবার চেষ্টা করুক। উপরে যাচ্ছি আমরা। দেখি পালাবার কোন উপায় করা। যায় কি না। ভোমর, দেখে এসো আণ্ডারগ্রাউণ্ড সুড়ঙ্গ পথে পুলিস আছে কিনা।
| অনুচরদের নির্দেশ দিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটল শিকদার। তার পিছু নিল উলন এবং হাক্কা।
| সিঁড়ির মাথায় গিয়ে পৌঁছুল ওরা। এমন সময় আমীর খান চিৎকার করে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে সিঁড়ির মাথা থেকে ওরা দেখল দরজার গায়ের গর্ত থেকে, স্টেনগানের নলটা সরে এসেছে। আমীর খান শুয়ে পড়েছে মেঝেতে। দরজার গায়ের গর্ত দিয়ে বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকে পড়েছে একটি রিভ বারে নল।
আমীর খানের বাহুতে গুলি লেগেছে। অপর হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে উঠে বসার চেষ্টা করছে সে। | মরতে হবে আজ সবাইকে।
ভলিউম ১৮
৭০
কথাটা বলেই ছুটল শিকদার করিডর ধরে তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে।
তিনতলায় উঠে প্রকাণ্ড একটি হলরুমের ভিতর ঢুকল. ওরা। শিকদার একটি জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিচে রাস্তা, আবছা অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। তবে একজন মুনিফর্ম পরা পুলিস অফিসারকে ঠিকই দেখতে পেল সে। অফিসারের হাতের রিভলবারটাও তার দৃষ্টি এড়াল না।
| বাড়ির পিছন দিক এটা। রাস্তার ওপারে, জানালার বিপরীত দিকে, পাঁচতলা উঁচু বিল্ডিং একটা। মধ্যবর্তী ফাঁকটা প্রায় বিশ ফুটের মত। এই দূরত্ব লাফিয়ে অতিক্রম করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
‘ জানালার কাছ থেকে সরে এল শিকদার। তীরবেগে হলরুমে প্রবেশ করল ভোমর আলী, বস্ সুড়ঙ্গ পথের দরজার বাইরেও পুলিস!’ :
করিডরে শব্দ হচ্ছে। কে যেনব্যথায় ককাতে ককাতে হেঁটে আসছে এদিকে। সবাই দরজার দিকে তাকাল।
হাক্কা ঢুকল হলরূমে। তার পিছু পিছু স্টেনগান হাতে নিয়ে আমীর খান।
আমীর খানের বাহুর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে অবিরাম। ফ্যাকাসে হয়ে শেছে তার মুখের চেহারা। গায়ের শার্টটা ছেঁড়া দেখা যাচ্ছে। শার্টটা ছিঁড়ে
তস্থানে বেঁধে দিয়েছে হাক্কা।
চলে এলে কেন! হাক্কা উত্তর দিল, নিচের দরজা প্রায় ভেঙে ফেলেছে পুলিস। উলন শান্তভাবে বলে উঠল, “আমি জানতাম!’ ‘আমীর খান মুখ বিকৃত করে বলল, সবগুলো দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছি আমরা। এতগুলো দরজা ভেঙে বা পুড়িয়ে তিনতলায় উঠতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে ওদের। এর মধ্যে পালাতে হবে আমাদেরকে।
কুৎসিত ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল শিকদার, ‘পালাতে হবে আমাদেরকে। পালাতে আর হবে না, মরতে হবে সবাইকে! পালাবার কোন উপায় নেই।
এমন সময় অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বেশ খানিক দূর থেকে ভেসে আসছে শব্দটা।
‘ওহে, শুনছ! তাকাও, এদিকে তাকাও। | কে কথা বলছে, কোত্থেকে বলছে প্রথমে তা কেউই বুঝতে পারল না। শিকদার এগিয়ে গেল জানালার দিকে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাল সে। অবাক কাণ্ড! পুলিস অফিসারটা তো মাত্র কয়েক মিনিট আগেও বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়েছিল গলিটায়। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে অফিসার হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে পথের উপর। এতটুকু নড়ছে না সে।
‘এই যে, ওহে, এদিকে তাকাও।’
মুখ তুলে বিপরীত দিকে পাঁচতলা বিল্ডিংটার দিকে তাকাল শিকদার। বিল্ডিংটার তিনতলায় একটি জানালা খোলা দেখা যাচ্ছে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকাণ্ডদেহী একজন লোক। লোকটার হাতে একটা মোটা হোস পাইপ।
লোকটার চেহারাটা ভয়ঙ্কর। তার চুল কালো, চোখ দুটোও কালো। মুখে
কুয়াশা ৫৩
৭১
তিনটে ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
শিকদার তাকাতেই লোকটা বলে উঠল, ‘কোণঠাসা করে ফেলেছে তোমাদেরকে, তাই না? সাহায্য চাও?’
শিকদার কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল।
লোকটা তার হাতের হোস পাইপটা সজোরে নিক্ষেপ করল। প্রথমবারের চেষ্টায় পাইপটা পৌঁছুল না, কিন্তু দ্বিতীয়বার সফল হলো সে। শিকদার পাইপটা ধরে ফেলল । পাইপের প্রান্তটা বেঁধে ফেলল সে জানালার রডের সঙ্গে।
বিপরীত দিকের বিল্ডিংয়ের জানালা থেকে লোকটা বলে উঠল, ভয় পেলে চলবে না। সাহস করে ঝুলে ঝুলে এগিয়ে আসতে হবে। দাঁড়াও, তোমাদের ভয়টা দূর করে দিই।’
পাইপ ধরে ঝুলে পড়ল প্রকাণ্ডদেহী লোকটা। ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে আসছে ‘ সে।
অবলীলাক্রমে পৌঁছে গেল সে শিকদারের কাছে। লাফ দিয়ে নামল জানালা থেকে হলরুমের ভিতর। বলল, ‘সময় নষ্ট করলে মারা পড়বে। কথা পরে হবে। যদি বাঁচতে চাও, এগিয়ে যাও একজন একজন করে।’
উলন বলে উঠল, চিনেছি তোমাকে। তুমি জিঞ্জির খান। জিঞ্জির খান হাসল।
শিকদার এগোল সবার আগে। পাইপ ধরে ঝুলে পড়ল সে। ঝুলতে ঝুলতে এগোল বিপরীত দিকের বিল্ডিংয়ের দিকে।
একে একে সবাই পাইপ ধরে ঝুলতে ঝুলতে দুই বিল্ডিংয়ের মধ্যবর্তী দূরত্বটা অতিক্রম করল।
| বিপদ দেখা দিল আমীর খানকে নিয়ে।
সে বলল, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জিঞ্জির খান, তুমিও চলে যাও। আমি স্টেনটা নিয়ে এখানেই থাকি। মরবই যখন, দুচারজনকে মেরে মরব। ‘
জিঞ্জির খান আমীর খানের ক্ষতস্থানের দিকে তাকিয়ে বলল, “মাথা খারাপ কোরো না। আমি থাকতে তোমার কোন চিন্তা নেই।
কিন্তু আমি পাইপ ধরে ঝুলতে পারব না–না, অসম্ভব!
‘পাইপ ধরতেই হবে না তোমাকে। তুমি আমার কাঁধের উপর আরাম করে বসে থাকবে। পাইপ ধরে ঝুলব আমি।’
হাঁ হয়ে গেল আমীর খানের মুখ। লোকটা পাগল নাকি! পাইপ ধরে ঝুলতে ঝুলতে একা এগোনোই দুষ্কর–আর একজনকে কাঁধে বসিয়ে যাবার চেষ্টা করা মানে দুজনেরই মৃত্যু।
| দূর•••!
| জিঞ্জির খান কথা না বলে সবল দুটো হাত দিয়ে আমীর খানকে তুলে নিল নিজের কাঁধে।
‘খবরদার! নড়বে না একটুও!
পাইপ ধরে ঝুলে পড়ল জিঞ্জির খান।
ভলিউম ১৮
৭২.
রুদ্ধশ্বাসে জিঞ্জির খানের কাঁধের উপর বসে আছে আমীর খান। চোখ বুজে | আছে সে। কাঁপছে তার গোটা দেহ। মৃত্যু অবধারিত, বুঝতে পারছে সে। ভাবছে,
লোকটা পাগল, নিজেও মরবে আমাকেও মারবে•• |
রুদ্ধশ্বাসে বিপরীত দিকের বিল্ডিংয়ের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে জিঞ্জির খানের দুঃসাহসিক কাণ্ডটা অবিশ্বাসভরা চোখে প্রত্যক্ষ করছে উলন, শিকদার এবং হাক্কা। এই পড়ল! এই পড়ল!–আশঙ্কায় দম বন্ধ করে আছে সবাই। ‘ কিন্তু দ্রুত এবং নিপুণ ভঙ্গিতে জিঞ্জির খান পাইপ ধরে ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে আসছে। ভয় পাওয়া দূরের কথা, হাসছে সে।
পৌঁছে গেল জিঞ্জির খান। জানালা গলে একটা মাঝারি আকারের কামরায় নামল সে। কাঁধ থেকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল আমীর খানকে মেঝেতে।
চোখ মেলল আমীর খান এতক্ষণে, বেঁচে আছি না মরে গেছি!’
হেসে উঠল জিঞ্জির খান। তারপর দ্রুত কণ্ঠে কলল, এই বিল্ডিঙেও পুলিস হানা দেবে। তার আগেই কেটে পড়তে হবে আমাদের!
এক ঘণ্টা পর দেখা গেল শিকদার তার নতুন আস্তানা ইয়ট মাছরাঙায়, সদলবলে বসে আছে। কথা বলছে সবাই। কিন্তু শিকদার মদ খাচ্ছে চুপচাপ। বোতল প্রায় । শেষ করে ফেলল সে। তাকাল প্রকাণ্ডদেহী জিঞ্জির খানের দিকে। বলল, জিঞ্জির, খান–তোমার বক্তব্য বলে যদি কিছু থাকে।
‘আমি খুন করেছি, তাই জেলের ভাত খেতে হচ্ছিল কিন্তু নিজেকে আমি খুনী বলে মনে করি না। যাকে আমি খুন করেছি সে ছিল আমারই দলের লোক। আমার সঙ্গে সে বেঈমানী করে। বেঈমানকে খুন করা অপরাধ বলে মনে করি না আমি।’
উলন বলে উঠল, ‘তোমাকে আমি সমর্থন করি।’
শিকদার বলল, ঠিক আছে। তুমি কি করেছ না করেছ, জানার দরকার নেই । আমার। আমরাও তোমার মত বেপরোয়া লোক। তুমি আমাদেরকে নির্ঘাৎ মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছ। আমরা তোমাকে বন্ধু বলে স্বীকার করে নিচ্ছি। ইচ্ছা করলে তুমি আমাদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে। আমরা কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি। তুমি যত দিন ইচ্ছা আমাদের সঙ্গে থাকতে পারো।
জিঞ্জির খান বলল, ‘পুলিস আমাকে খুঁজছে। নিরাপদ আশ্রয় দরকার আমার কিছু দিনের জন্য।’
এই ইয়টের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা আর কোথাও পাবে না তুমি। তুমি এখানেই ইচ্ছা করলে থাকতে পারো।
জিঞ্জির খান হাসল।, শিকদার বলল, একটা ব্যাপারে একটু কৌতূহল আছে আমার। ঠিক আমাদের প্রয়োজনের সময় তুমি কোত্থেকে হাজির হলে বলো তো?’
জিঞ্জির খান মৃদু মৃদু হাসছিল। হাসিটা তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ‘পুলিসের ভয়ে তোমাদের আস্তানার পিছনে খালি বিল্ডিংটায় আত্মগোপন
কুয়াশা ৫৩
१७
করেছিলাম। গুলির শব্দ পেয়ে ভাবলাম, পুলিসের দল বুঝি আমাকে ঘেরাও করেছে। পালাবার জন্য নিচে নামি, একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে ফেলি। এর আগে পর্যন্ত বুঝতে পারিনি পুলিশ আমাকে নয়, তোমদেরকে ঘেরাও করেছে। বুঝতে পেরে চুপিসারে আবার উপরে উঠে যাই। উপরে উঠে জানালা দিয়ে তোমাদের অসহায় অবস্থা দেখে দয়া হলো আমার। হাজার হোক, তোমাদের মতই আমিও একজন। আমাদের পেশাও সম্ভবত একই ধরনের। তাই তোমাদের জন্য কিছু একটা করা কর্তব্য বলে মনে করি বুঝতেই পারছ।’
শিকদার সহাস্যে রলল, বুঝেছি। আর বলতে হবে না। আজ থেকে তুমি আমাদের বন্ধু।
শিকদার এবং উলন ইয়টের একটা সুসজ্জিত কেবিনে বসে কথা বলছে। হাক্কা, আমীর খান এবং ভোমর ঘুমিয়ে পড়েছে। জিঞ্জির খান নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এই নতুন পরিবেশে। বসে নেই সে। ইয়টের সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে কেবিনেও ঢুকছে সে। তাকে কাছাকাছি দেখলেই কথা বন্ধ করে চুপ করে থাকছে শিকদার আর উলন। তা সত্ত্বেও, দু’একটা শব্দ জিঞ্জির খানের কানে ঢুকছে। কুয়াশা’ ব্ল্যাক গগলস্-এই দুটো শব্দ সে পরিষ্কার শুনতে পেল। খানিক পর বুঝতে পারল কুয়াশা এবং কুয়াশার বন্ধু-বান্ধবদেরকে খতম করার পরিকল্পনা করছে শিকদার আর উলন।
আলোচনা শেষ হলো কয়েক ঘণ্টা পর। ঘুম থেকে ওঠানো হলো অনুচর আর বডিগার্ডদের। সবাই এক সঙ্গে মাছরাঙা থেকে নেমে গেল।
শিকদার বলে গেল, জিঞ্জির খান, ইয়ট রইল তোমার হেফাজতে। তুমিই সর্বময় কর্তা, আমরা না ফেরা অবধি।
জিঞ্জির খান বুক ফুলিয়ে বলল, ‘পুলিসের ছায়াও যদি দেখি, সেই ছায়াকেও প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে দেব না এখান থেকে।
শাব্বাশ! চলে গেল ওরা সবাই।
মাত্র মিনিট দশেক অপেক্ষা করল জিঞ্জির খান। শিকদারের দল অদৃশ্য হয়ে গেছে বুঝতে পেরে দ্রুত ইয়ট ত্যাগ করে তীরে নামল সে। অদৃশ্য হয়ে গেল সে-ও।
ছয় হোটেল ইন্টারন্যাশনাল। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বেড়াতে এসে শহীদ, মহুয়া, কামাল
এবং লীনা এই হোটেলেই উঠেছে।
স্নান সেরে বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল মহুয়া। পিঠে এলোচুল। মুখে স্নিগ্ধ হাসি। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল
সে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল বিছানার দিকে।
ভলিউম ১৮
শহীদ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। চোখ তুলে তাকাল মহুয়া ওয়ালকুকের দিকে। সাড়ে ছয়টা বাজে। শহীদ বিছানা ছাড়ে পাঁচটায়। দেড় ঘন্টা লেট আজ। মুচকি হাসল সে। যেন বুঝতে পেরেছে শহীদের আজ দেরি করে ওঠার কারণ।
ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাল সে। বিয়ে হয়েছে আজ ওদের বেশ কবছর হয়ে গেছে। মাতৃত্বের সাধ মেটেনি তার এতদিন। কিন্তু সে সাধ এবার মিটতে, যাচ্ছে। রাতে শুভ সংবাদটা প্রকাশ করেছে সে শহীদের কাছে। দশ হাজার টাকা। বাজী ধরেছে ওরা। শহীদ বলেছে, মেয়ে হবে। মহুয়া বলেছে, ছেলে। এই নিয়ে বাজী ধরা হয়েছে। যার কথা ফলবে সে পাবে দশ হাজার টাকা।
| ভাবী! নিজের রূপে নিজেই পাগল হয়ে গেলে নাকি!’
চমকে ঘাড় ফেরাল মহুয়া। দোরগোড়ায় কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে লীনা।
মহুয়া মিষ্টি হেসে বলল, ‘আহা! রূপ আমার আবার দেখলে কোথায়? তোমার তুলনায় তো আমি…।’ | লীনা এগিয়ে এসে মহুয়ার একটা হাত ধরল। বলল, তোমার মত সুন্দরী তো আর একটাও চোখে পড়ল না। আমাকে কেন যে তুমি সুন্দরী বলো বুঝতে পারি
! কই, আর তো কেউ বলে না।
হেসে উঠে মহুয়া বলল, “তাই নাকি? আমি কিন্তু একজনের কথা জানি•• | | লীনা ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল। কামালের কথা বলছে মহয়াদি। তাড়াতাড়ি লীনা একহাত দিয়ে মহুয়ার মুখ চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল, ভাবী! দাদা রয়েছে••!
টেলিফোনের শব্দ ভেসে এল ড্রয়িংরূম থেকে। ‘এত সকালেকে আবার ফোন করছে!
মহুয়া বলল, “কে আবার! নিশ্চয়ই সিম্পসন সাহেব। এই ভদ্রলোক জ্বালিয়ে মারলেন। দিন নেই রাত নেই, হয় ফোন করবেন নয়তো স্বয়ং উপস্থিত হবেন। উদ্দেশ্যও সেই একটাই–শহীদ, মাই বয়. হেলপ মি! কেসটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার শার্প ব্রেনের সাহায্য দরকার। ব্যস বয়ও অমনি খাওয়া দাওয়া ভুলে কেস-এর মীমাংসা করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেল!
লীনা বলল, কিন্তু ভেবে দেখো ভাবী, দাদার কত দাম। কই, সিম্পসন সাহেব তো আর কোন প্রাইভেট ডিটেকটিভের কাছে যান । | ‘কিন্তু বিপদের কথাটা ভেবে দেখেছ? একের পর এক এই সব খুন-খারাবির কেস নিয়ে কাজ করার ঝুঁকি কতটুকু তা জানো?’
লীনা বলল, ঝুঁকি তো থাকবেই। পুরুষ মানুষ•••।’
মহুয়া কৃত্রিম রাগে চোখ পাকাল, “ঠিক আছে। বিয়েটা হয়ে যাক–তখন দেখব স্বামীদেবতাকে রাতদুপুরে খুনীর পিছনে ছুটতে দিতে আপত্তি করো কিনা?
ভাবী, আবার।
কামালের সঙ্গে লীনার মন দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটা বেশ পুরানো। মাত্র কয়েকদিন আগে ওরা শহীদের আব্বা, মহুয়া এবং শহীদকে ব্যাপারটা আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে বিয়ের অনুমতি চেয়েছে। বলাবাহুল্য, সবাই সানন্দে অনুমতি
কুয়াশা ৫৩
৭৫
দিয়েছে। তারিখ ঠিক হয়নি এখনও। তবে মাস দুয়েকের মধ্যেই শুভকর্ম সেরে
ফেলা হবে।
করিডরে পদশব্দ শোনা গেল। কেউ যেন দৌড়ে আসছে। মহুয়া এবং লীনা চিনতে পারল পায়ের শব্দটা। কামাল আসছে। লীনা পা বাড়াল অপর দরজার । দিকে। | মহুয়া বলে উঠল, ‘পালাচ্ছ কেন? কদিন পর তো কাছ ছাড়া হতে দেবে
কামাল কালবৈশাখীর ঝড়ের মত কামরায় ঢুকল। চিৎকার করে কিছু বলার জন্য মুখ হাঁ করে আছে যেন সে। কিন্তু মহুয়া এবং লীনাকে দেখে নিজেকে সামলে নিল।
মহুয়া বলে উঠল, ‘অমন হাঁ করে রইলে কেন! কি বলবে বলো! লীনাকে দেখে অমন:••।’
কামালের মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। গভীর শোনাল তার কণ্ঠস্বর, ‘মহুয়াদি, কামরা থেকে বেরিয়ে যাও তোমরা। এখুনি!’ | কামালের গলায় এমন একটা ভীতিপ্রদ সুর ছিল যা শুনে ধ্বক করে উঠল মহুয়ার বুক।
কি হয়েছে••• কোন খারাপ খবর নাকি?” বেরোও!’ | অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল কামাল।
শহীদ জৈগেই ছিল। মশারীর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ও। নামল মেঝেতে।! জানতে চাইল, কামাল?’
কামালের অস্বাভাবিক আচরণে শহীদও বুঝতে পেরেছে, বিপদের খবর পেয়েছে কামাল।
মহুয়া কয়েক সেকেণ্ড দ্বিধা করার পর দরজার দিকে পা বাড়াল। লীনাও তার অনুসরণ করল।
কামাল কথা বলে উঠল, ‘ডি. কস্টা এইমাত্র ফোন করেছিল। কুয়াশা বিপদে পড়েছে।’
কুয়াশা বিপদে পড়েছে?
হ্যাঁ। আর কিছু বলেনি ডি. কস্টা। এখুনি যেতে বলেছে আমাদেরকে কুয়াশার আস্তানায়•••।’.. পনেরো মিনিট পরের ঘটনা। কুয়াশার আস্তানা। পাঁচতলার একটি কামরার মাঝখানে প্রস্তর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে শহীদ, কামাল, রাসেল। ওদের তিনজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমারী ওমেনা আর ডি কস্টা। * শহীদের চেহারা পনেরো মিনিটের মধ্যে আমূল বদলে গেছে। ইস্পাতের মত একটা কাঠিন্য তার সারা মুখে। চোখ দুটো বাঘের চোখের মত জ্বলছে। | প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছে শহীদ। ডি. কস্টা এবং রাজকুমারী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে প্রশ্নের উত্তর দিতে নিতে।
ভলিউম ১৮
‘নিজের পরিচয় দেয়নি লোকটা?’
শহীদের প্রশ্নের উত্তরে ডি কস্টা বলল, “ডিয়েছিল। আইস অভিযানের মেম্বার নাকি সে। নাম ইকবাল আহমেড। সেই একমাট্ট অভিযাট্টি, যে বেঁচে গেছে।’
লোকটার হাত সাদা? গায়ের রঙ লালচে? মাথার চুল সাদা? বয়স ত্রিশ বত্রিশ? রোগা? ডান হাতটা ওড়ে ফড়িংয়ের মত?
রাইট-রাইট! আর কোন বৈশিষ্ট্য। ডি. কস্টা বলল, ‘চোক দুটো মুরগীর ডিমের মটো। টাল গাছের মটো টল।’
আচমকা, সম্ভবত বাইরের করিডর থেকে, আর্তনাদ ভেসে এল, বাঁচাও! মেরে ফেলল। বাঁচাও! বাঁচাও•••{।
অচেনা একটা কণ্ঠস্বর। কিন্তু চিৎকারটার মধ্যে এমন একটা সুর ছিল যে ওদের প্রত্যেকের শরীরে ভয়ের শিহরণ খেলে গেল। | সবাই ছুটল দরজার দিকে। রিসেপশন রূম থেকে বেরিয়ে এল শহীদ এবং কামাল, বাকী সবাই ওদের পিছনে। কিন্তু করিডর ফাঁকা, কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
ছুটল ওরা সিঁড়ির দিকে।
সিঁড়ির সামনে পৌঁছুবার আগেই একজন সুবেশী লোক সিঁড়ির ধাপ টপকে করিডরে আছড়ে পড়ল। করিডরে উপুড় হয়ে পড়েও থামল না লোকটা। আহত, ভীত কুকুরের মত হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে কামালের পায়ের উপর পড়ল সে।
| ‘আমাকে বাঁচান! মেরেফেলল…আমাকে বাঁচান?
দ্রুত লোকটাকে দুই হাত দিয়ে খাড়া করে তুলল কামাল। লোকটা আতঙ্কে কাঁপছে, উন্মাদের মত চেঁচাচ্ছে, মেরে ফেলবে? বাঁচান! মেরে ফেলবে।’
• লোকটাকে টেনে হিঁচড়ে করিডর ধরে দরজার দিকে নিয়ে চলল কামাল। | সিঁড়ির কাছে পৌঁছে থমকে দাঁড়িয়েছিল সবাই কিন্তু শহীদ একলাফে তিনটে করে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে নিচের দিকে নেমে গেছে।
সবাই দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির মাথায়।
মিনিট পাঁচেক পরই ফিরল শহীদ। বলল, ভদ্রলোকের পিছু পিছু সত্যি কয়েকজন লোক আসছিল। আমাদের সাড়া পেয়ে পালিয়ে গেছে। ধাওয়া করেও সুবিধে করতে পারলাম না। নিচে নেমে দেখি.গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে ওদের।
. অপ্রত্যাশিতভাবে কুয়াশার ব্যক্তিগত এলিভেটরের দরজাটা খুলে গেল। এলিভেটর থেকে বেরিয়ে এল স্বয়ং কুয়াশা!
| ‘আরে! কোথায় ছিলে তুমি?
কামাল জানতে চাইল। ফিরে এসেছে সে এইমাত্র করিডরে, আগন্তুক ভদ্রলোককে রিসেপশনে বসিয়ে রেখে।
কুয়াশা বলল, সে অনেক কথা। পরে শুনো। তোমরা এখানে জটলা করছ কেন?’
সব কথা বলা হলো কুয়াশাকে।
কুয়াশা জানতে চাইল, কই, সে তোক কোথায়? কুয়াশা ৫ত
৭
কামাল বলল, লোকটাকে তোমার বিসেশপন রূমে বসিয়ে রেখে এসেছি আমি। নিরাপদেই আছে সে।
সবাই পা বাড়াল রিসেশপন রূমের দিকে। রিসেপশনে ঢুকল সবার আগে কুয়াশা। রূমটা খালি দেখে সে জানতে চাইল, কই? কোথায় সে লোক?
কামালের চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, কী আশ্চর্য! এক মিনিট আগে এখানে বসিয়ে রেখে গেছি আমি•••।’
পাশের কামরার দরজার দিকে পা বাড়াল সে। পাশের কামরাটা কুয়াশার লাইব্রেরী। প্রকাণ্ড হলরূমের মত আকার। বইয়ের পাহাড় গড়ে উঠেছে রূমের সর্বত্র। মেঝে থেকে সিলিং অবধি শুধু বই, বই আর বই। একেবেঁকে এগিয়ে চলেছে। কামাল। তার পিছনে কুয়াশা এবং শহীদ। “. কামাল থমকে দাঁড়াল। সুবেশী লোকটা ওদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা কাঁচের শোকেসের দিকে ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছে সে।
| কামালকে পাশ কাটিয়ে নিঃশব্দ পায়ে লোকটার ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। শান্ত গলায় জানতে চাইল, কিছু দেখছেন বুঝি?’ চমকে উঠে লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। দ্রুত বেগে ঘুরে দাঁড়াবার ফলে মাথার চুল নেমে এসেছে কপালে। চোখের গগলসটা কালো চুলে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। ঝট করে গগলসটা চোখ থেকে নামিয়ে শোকেসের উপর রেখে দিল সে।
লোকটার শরীরের গঠন বেশ মজবুত। অনেক ঝড়ঝাঁপটা গেছে তার উপর দিয়ে, গায়ের তামাটে রঙ দেখলেই বোঝা যায়।
‘গগলস্টার প্রতি আগ্রহ আছে আপনার, মনে হচ্ছে? লোকটা বলে উঠল, হ্যাঁনা!
কুয়াশা বলল, “নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন গগল্সটা সাধারণ কোন গগল্সের মত নয়। লেন্সগুলো দু’ইঞ্চি মোটা, তার উপর কালো। এমন কালো যে কোন ধরনের আললাই, তা যতই শক্তিশালী হোক, ওটার ভিতর দিয়ে যেতে পারে না।’
কিন্তু এ জিনিসের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। আসলে হয়েছে কি জানেন, আমার গগলসটা পড়ে গেছে কোথায় যেন। এটাকে দেখে চোখে পরেছিলাম। আমি আবার চোখে কম দেখি।’
নিজেকে সামলে নিয়েছে লোকটা ইতিমধ্যে।
কুয়াশা বলল, ‘লেন্সগুলো যে পদার্থের ভিতর আটকানো, সে পদার্থটা চিনতে পারেন? প্লাস্টিক বা হাতির দাঁত নয়••• { | লোকটা অপ্রতিভ হাসল, না, চিনতে পারছি না। আমি আসলে ভুলক্রমে ওটা
চোখে লাগিয়েছিলাম•••।’
‘পদার্থটা মনে হয় মাছের চামড়া বা ওই জাতীয় কিছু। আমার অনুমান যদি ভুল হয়ে থাকে, আর্কটিক সাগরের গভীর জলে এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়, এ পদার্থটা সেই মাছেরই স্কিন।’
লোকটা কামালের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘গুণ্ডা লোকগুলো এখনও
৭৮
ভলিউম ১৮
আছে?
কামাল বলল, না। তারা পালিয়ে গেছে।’
কুয়াশার দিকে তাকাল লোকটা, ‘আমি জানি না আপনাদের মধ্যে মি. কুয়াশা কে। আমি দেখা করতে এসেছি।’
কুয়াশা বলল, আমিই কুয়াশা। কিন্তু, একদল লোক আপনার পিছু ধাওয়া করেছিল কেন বলুন তো?’
‘ওরা আমাকে খুন করতে চাইছিল। না, ঠিক যে খুন করতে চাইছিল তাও মনে হয় না। তা যদি চাইত পিছন থেকে গুলি করলেই তো পারত। ওদের একজনের হাতে আমি রিভলভার দেখেছিলাম। আমার মনে হয়, ওরা আমাকে কিডন্যাপ করার জন্য পিছু ধাওয়া করছিল।’
| কারণ?
লোকটা বলল, তা বলতে পারব না। অনেক ভেবেও আমি কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আমি বড়লোকও নই বা আমার মূল্যও এমন বেশি কিছু নয় যে কেউ আমাকে কিডন্যাপ করে..’
কাশা বলল, “আসুন। ড্রয়িংরূমে বসে কথা বলি আমরা।’ ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। লোকটা পিছন থেকে কথা বলে উঠল। ‘গগটা শোকেসের ভিতর তালাবন্ধ করে রাখলে ভাল হত না?
কুয়াশা পিছন ফিরে না তাকিয়েই বলল, কি দরকার। ওখানেই থাক। ওটা এমন কিছু মূল্যবান জিনিস নয়।’
ড্রয়িং রুমে এসে বসল ওরা সবাই। । কুয়াশার প্রশ্নের উত্তরে লোকটা বলল, আমার নাম ইকবাল আহমেদ।
ডি, কস্টা প্রতিবাদ করে উঠল, ‘ইমপসিবল! লোকটা বলল, ইম্পসিবল? হোয়াই!’
রাজকুমারী কথা বলে উঠল এবার, এর আগে একজন লোক এসেছিল, সে-ও নিজেকে ইকবাল আহমেদ বলে দাবি করে। সে বলে, আইস অভিযানের একমাত্র
জীবিত মেম্বার সে•••।’
‘মিথ্যে কথা! সে যাই হোক, মস্তবড় জালিয়াত সে। ইকবাল আহমেদ আমি স্বয়ং। আইস অভিযানের একমাত্র জীবিত সদস্য আমিই।’
কুয়াশা বলল, সে লোকটা যে ইকবাল আহমেদ নয় তা আমি জানি। যাক, আপনি কি নিজের পরিচয় প্রমাণ করার জন্য কাগজপত্র দেখাতে পারেন?
‘পারি। এই যে, দেখুন।’
ইকবাল আহমেদ প্যান্টের পকেটে হাত ভরতে গেলে কুয়াশা বলল, “থাক, থাক। দেখার দরকার নেই। প্রমাণ আপনার কাছে আছে এটা জানাই যথেষ্ট। ভাল, কহ্, আপনাদের অভিযান ব্যর্থ হলো কেন, ব্যাখ্যা করে বলুন তো? শুনেছি, অলৌকিক কি একটা ব্যাপার ঘটার ফলেই•••
ইকবাল চৌধুরী সবিস্ময়ে বলে উঠল, কিন্তু সে-কথা আপনি জানলেন কিভাবে!
কুয়াশা ৫৩
কুয়াশা বলল, “সেই ভুয়া ইকবাল আহমেদ গল্পটা বলে গেছে।
ইকবাল বলল, ‘লোকটা এত সব কথা জানল কিভাবে আমি তো.এর কোন ব্যাখ্যাই খুঁজে পাচ্ছি না। যাই হোক, লোকটা ভূয়া হলেও তার গল্প কিন্তু ভুয়া.নয় । সত্যিই আমাদের অভিযান ব্যর্থ হয়ে গেছে অলৌকিক একটা শক্তির আক্রমণে…।’
জানতে চাইল রাজকুমারী, দারুণ ইন্টারেস্টিং, তাই না?’
ইকবাল বলল, বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে তাকে, অবিশ্বাস করি কিভাবে। জিনিসগুলোকে আমি নিজে দেখেছি।
দেখতে কি রকম?’
বর্ণনা করা অসম্ভব। আকারহীন, প্রাণী বা অদ্ভুত এক মহাশক্তি বলে মনে হয়। এর বেশি বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। যে দেখেনি সে বুঝতে পারবে না জিনিসগুলো ঠিক কি রকম দেখতে। এমন কোন জিনিস নেই, যার সাথে তাদের চেহারার তুলনা দেয়া যায়। তাদের অস্তিত্ব আছে, তারা বাস্তব সত্য বলে মনে হয় না। অথচ সত্যি তাদের অস্তিত্ব আছে, তাদের দেখা যায়। কোত্থেকে যে আসে তাও বোঝার কোন উপায় নেই। কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ তাদেরকে দেখা যায়। দু’এক মুহূর্তের জন্য দেখা যায়। তারপরই নেই হয়ে যায়। আপনারা কি ভাবছেন আমি পাগল হয়ে গেছি? বলা যায় না, হয়তো সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। কিন্তু যা | ঘটেছে, পরিষ্কার মনে আছে আমার। একমাত্র আমিই সেই মহাশক্তির হাত থেকে বেঁচে গেছি। আমার বন্ধুরা সবাই হারিয়ে গেছে। তাদেরকে নিয়ে গেছে সেই আকারহীন অদ্ভুত মহাশক্তি। জানি না তারা বেঁচে আছে কিনা…’ | ইকবাল আহমেদ বিরতি নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, জানেন, আমার বয়স বত্রিশ।কিন্তু চেহারাটা কেমন হয়েছে দেখছেন? মনে হচ্ছে ষাট বছরের বুড়ো আমি। মাত্র একদিনে মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এই চেহারা হয়েছে আমার••• | সবাই অবাক হয়ে শুনছে কথাগুলো। ইকবাল থামতেও কথা বলল না কেউ অনেকক্ষণ। ইকবাল পকেট থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে কুয়াশার দিকে বাড়িয়ে দিল। সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা করল কুয়াশা। ইকবাল আহমেদের পরিচয় সংক্রান্ত প্রমাণপত্র।
. খানিক পর মুখ তুলল কুয়াশা, মি. ইকবাল, যে লোকটা আপনার নাম ধরে এখানে এসেছিল সে কে হতে পারে, ভেবে দেখুন তো?
“ ভেবে দেখব কি! আমি কাউকে আমার পরিচয়ই দিইনি। বুঝতেই পারছি না কে হতে পারে সে। তাছাড়া, আপনার এখানে আসার সময় যারা তাড়া করেছিল। তারা কারা, কি তাদের উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারছি না আমি!
“তারা সম্ভবত চাইছিল আপনি যেন আমার সঙ্গে দেখা করতে না পারেন।’ কিন্তু তাতে লাভ কি তাদের?’ কুয়াশা জানতে চাইল, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কেন?’..
‘অভিযানে আমার বন্ধুরা হারিয়ে গেছে। আমার সন্দেহ কেউ বেঁচে নেই ওবা। কিন্তু তবু আশা ত্যাগ করতে পারছি না। বেঁচে তো থাকতেও পারে। ফিরে
•
৮০
ভলিউম ১৮
এসেছি একমাত্র আমি, সুতরাং ওদেরকে উদ্ধার করার দায়িত্ব আমার কাঁধেই বর্তেছে। ওদেরকে উদ্ধার করার চেষ্টা না করা পর্যন্ত শান্ত হতে পারব না আমি। তাছাড়া, আর্কটিক সাগরের ভৌতিক রহস্যের একটা কিনারা না করা পর্যন্তও যেন স্বস্তি পাচ্ছি না। মোট কথা, আবার আমি যেতে চাই সেই বরফের জগতে। এ ব্যাপারে, মি. কুয়াশা, আমি আপনার সাহায্য ভিক্ষা চাই। সেজন্যই অনেক আশা নিয়ে এসেছি আমি। আপনার স্পেসক্রাফট আছে। নর্থ কানাডার ওই অঞ্চলে পৌঁছুতে হলে আপনার স্পেসক্রাটটা দরকার। বলুন, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন•••?’।
‘এটা আমার কর্তব্য, মি. ইকবাল। একদল মানুষ দুর্গম অঞ্চলে হারিয়ে গেছে-তাদেরকে উদ্ধার করা মানবতার কাজ। আমরা সাহায্য করব।’
‘ধন্যবাদ! ধন্যবাদ!
আনন্দে কেঁদে ফেলল ইকবাল চৌধুরী।
কুয়াশা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি এবং আমার বন্ধু-বান্ধবরা বেলা একটার সময় নিচের কাফে ওরিয়েন্টালে লাঞ্চ খাব। আপনিও নিমন্ত্রিত। সেই সময় বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে, কি বলেন?
ইকবাল বলল, কিন্তু জরুরী একটা অ্যাপয়েনমেন্ট আছে ঠিক একটার সময়। এক কাজ করুন, আমি বরং এখানেই আসব, আজ সন্ধ্যার পর•••।’
কুয়াশা বলল, তবুও, লাঞ্চ খাওয়ার দাওয়াতের কথাটা মনে রাখবেন। যদি সময় পানকাফের ডান দিকের কর্ণারে কসব আমরা, ঢুকলেই দেখতে পাবেন।
ইকবাল উঠে দাঁড়াল। বিদায় নিয়ে গেল চলে গেল সে। ডি কস্টা বলে উঠল, বস, আমি আপনাকে সাপোর্ট করিটে পারিলাম না। আপনি জানেন, লাঞ্চ খাবার সময় হামি কাহাকেও ভাগ ডিটে রাজি নই••• |’
কুয়াশা বলল, লাঞ্চ খাওয়া আমাদের কপালে নেই সম্ভবত, মি. ডি. কস্টা।’
ইয়ট মাছরাঙায় ফিরে এসেছে জিঞ্জির খান। শিকদার এবং উলন ফেরার আগেই ফিরেছে সে।
শিকদার এবং উলন ফিরুল আরও কিছুক্ষণ পর। সাথে হাক্কা, আমীর খান, ভোমর ছাড়াও তাদের আরও কয়েকজন অনুচর এল। খুশি খুশি দেখাচ্ছে শিকদারকে। জিঞ্জির খানের পিঠে চাপড় মেরে দরাজ গলায় সে বলে উঠল, ‘তোমার পয় আছে, ‘জিঞ্জির খান।
বোঝা গেল, কাজকর্ম বেশ সন্তোষজনক ভাবে এগোচ্ছে।
আবার আলোচনা করতে বসল শিকদার এবং উলন। এবার আর জিঞ্জির খানকে কাছে দেখে তারা চুপ করে গেল না। জিঞ্জির খানের সামনেই তারা নিজেদের পরিকল্পনার ছক কষতে শুরু করল।
, জিঞ্জির খানেরও কৌতূহলের কমতি নেই। তাদের সব কথাই বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনল সে।
৬-কুয়াশা ৫৩
* ৮১
সাত
দু’ঘন্টা পর হাক্কা, ভোমর এবং আরও কয়েকজন অনুচরকে দেখা গেল কাফে ওরিয়েন্টালের দরজার কাছে ঘুরঘুর করতে। কাফের বাইরে থেকেই তারা দেখতে পেল কুয়াশা এবং তার বন্ধু-বান্ধবরা ডান কোণার একটা টেবিলে বসে লাঞ্চ খাচ্ছে।
পাবলিক এলিভেটরে চড়ে হাক্কার নেতৃত্বে গুণ্ডা দলটা উঠে এল কুয়াশার পাঁচ তলার আস্তানায়। ফাঁকা করিডর ধরে এগিয়ে গেল তারা। দাঁড়াল দরজার সামনে। দরজার গায়ে ছোট্ট একটা কাগজ সঁটা রয়েছে। তাতে লেখা : নিচের কাফে ওরিয়েন্টালে লাঞ্চ করছি আমরা-কুয়াশা।
হাক্কা এবং ভোমর পরস্পরের দিকে তাকাল। হাল্কা পকেট থেকে চাবির গোছা বের করল। কিন্তু ভোমর দরজার গায়ে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল সেটা।
‘একি! হাক্কা, ভাল ঠেকছে না কিন্তু••!’ চিপ! তোর সব কিছুতেই শুধু ভয়?
হাক্কা দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে উঁকি মেরে ভিতরটা দেখে নিল। কেউ নেই রিসেপশন রূমে।. পা বাড়াল সে। ঢুকে পড়ল ভিতরে। সবাই অনুসরণ করল তাকে।
সবাই খুঁজতে শুরু করো। জিনিসটা নিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে হবে!
চাপা স্বরে কথাগুলো বলে রূমের মধ্যবর্তী একটা দরজা পেরিয়ে পাশের লাইব্রেরীতে গিয়ে ঢুকল হাক্কা। অন্যান্য সবাই ছড়িয়ে পড়ল এ কামরায় সে কামরায়।
খানিক পরই হাক্কার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, পেয়েছি। কিন্তু•••।’ লাইব্রেরী রূমে ঢুকল সবাই।
হাক্কা দাঁড়িয়ে আছে একটা কাঁচের শোকেসের সামনে। গগল্সটা দেখতে পেয়েছে সে।
দাঁড়িয়ে আছ যে! তুলে নাও। চলো, পালাই তাড়াতাড়ি।’ | ঘাড় ফিরিয়ে মেরের দিকে তাকাল হাক্কা। তার মুখে অদ্ভুত একটা বিমূঢ়তা ফুটে উঠেছে। বোকার মত জিজ্ঞেস করল সে, সবাই দেখতে পাচ্ছিস গগটাকে?’
তার মানে?
হাক্কা উত্তর না দিয়ে গগলসটা ধরতে গেল। কাঁচের সেলফের উপর রয়েছে গগলসূটা।
| বিদ্যুৎবেগে হাতটা সরিয়ে নিল হাকা। এবার নিয়ে দুবার ব্যর্থ হলো সে গটা ধরতে। গগসের ভিতর দিয়ে চলে যাচ্ছে হাতটা ধরতে গেলেই, কিন্তু
স্পর্শবোধ নেই একদম। গগলসটা যেন গা নয়, বাতাস। অথচ দেখা যাচ্ছে জিনিসটাকে। কিন্তু স্পর্শ করা যাচ্ছে না।
ভলিউম ১৮
৮২
কি হলো? হাক্কা সরে গিয়ে জায়গা করে দিল ভোমরকে, যাদু জানে কুয়াশা। তখনই বলেছিলাম–আমরা পারব না।’
| ভোমর হাত বাড়াল গগলসটা ধরার জন্য। সেও সবেগে ফিরিয়ে নিল হাত। ছুতে পারা যাচ্ছে না গগলটাকে, অথচ রয়েছে সেটা সেই একই জায়গায়। গগসের ভিতর দিয়ে হাতটা এগিয়ে যাচ্ছে, যেন বাতাসের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে হাতটা, শেষে গিয়ে ঠেকছে সেলফের কাঁচের দেয়ালে। কোন মতেই স্পর্শ করা যাচ্ছে না গগটাকে।
বারবার চেষ্টা করল ওরা। সবাই একবার করে পরীক্ষা করল ব্যাপারটা। কিন্তু যাকে-তাই, কোন লাভ হলো না। ঘেমে উঠল সবাই। নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত।
কিছুই বুঝতে পারছি না।’ | হাল ছেড়ে দিয়ে হাল্কা বলে উঠল, ‘চল্ পালাই। এখানে আর এক সেকেণ্ডও নয়। জিনিসটা রয়েছে, অথচ নেই!
এমন সময় পদশব্দ ভেসে এল। তৈরি থাকো সবাই!’ হাক্কার কথা শেষ হওয়ামাত্র সবাই পকেট থেকে লোডেড রিভলবার বের করল। পা বাড়াল সবাই দরজার দিকে।
সবার আগে ছিল হাক্কা এবং ভোমর। কি যে দেখল ওরা কে জানে, লাফিয়ে পিছিয়ে এল দুজনেই। পিছনের অনুচরদের সঙ্গে ধাক্কা খেলো দুজনই। তিনজন তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল।
হাক্কা এবং ভোমরের হাতে রিভলবার থাকা সত্ত্বেও গুলি করল না তারা। ভীষণ আতঙ্কে ছানাবড়া হয়ে গেছে তাদের দুজোড়া চোখ। জীবনে হাজার রকম বিপদের। মুখোমুখি হয়েছে তারা কি সামনে যে বিপদ দেখতে পাচ্ছে, তেমন দেখা তো দূরের কথা, শোনেনি কোন কালে। লাইব্রেরী রূমের মোট তিনটে দরজা। জানালা চারটে। প্রতিটি দরজা এবং জানালার ঠিক সামনে, মেঝের উপর, পেন্সিলের মত সরু কিন্তু দেড় গজ করে লম্বা গর্ত দেখা যাচ্ছে। গর্তগুলো নতুন নয়। তবে হাক্কা বা তার দলের কেউ আগে এগুলো লক্ষ করেনি।
সিলিংয়ের উপরও, জানালা-দরজাগুলোর ঠিক উপরই তেমনি গর্ত দেখা যাচ্ছে। পেন্সিলের মত সরু এবং দেড় গজ করে লম্বা। সিলিংয়ের উপরকার গর্তগলো থেকে নেমে আসছে নীল রঙের অত্যুজ্জ্বল অগ্নিশিখা। নীল রঙের পর্দার মত ঝুলছে প্রতিটি দরজা আর জানালার সামনে সেই অত্যাশ্চর্য অগ্নিশিখা। সেই সঙ্গে তীব্র, একঘেয়ে, হিস হিস শব্দ শোনা যাচ্ছে।
পালাবার পথ বন্ধ।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। বিকট অট্টহাসির শব্দ শুনে শত্রুদের সবাই চমকে উঠে তাকাল ঘাড় ফিরিয়ে। কুয়াশা ৫৩
দেখা গেল ডি কস্টাকে। একটা প্রকাণ্ড বুক সেলফের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা,শহীদ, কামাল, রাসেল এবং রাজকুমারী ওমেনা। ওদের প্রত্যেকের হাতে অস্বাভাবিক বড় আকারের একটা করে রিভলবার।
হাক্কা এবং ভোমর নিশ্চল পাথরের মত দাঁড়িয়েই রইল। নড়বার শক্তি নেই তাদের। কুয়াশা তার হাতের রিভলবার উঁচিয়ে ধরল। গুলি করল সে। একটা•••দুটো-তিনটে•••চারটে…
হাক্কা ছাড়া বাকী সবাই লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।
শান্ত গলায় কুয়াশা বলল, ওদেরকে রৈখে বাকী লোকটাকে আমার সামনে নিয়ে এসো। কামাল এবং রাসেল যাও।’
হাক্কাকে গিয়ে ধরল ওরা। টেনে নিয়ে এল তাকে কুয়াশার সামনে। তার রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে পকেটে ভরুল রাসেল। ডি কস্টাকে কিছু বলতে হলো |
। এগিয়ে গিয়ে তুলে নিল সে শত্রুদের বাকী রিভলবারগুলো।
ওমেনা, কারেন্ট অফ করে দাও।’
রাজকুমারী দেয়ালের সুইচ বোর্ডের একটা বোতামে চাপ দিতেই জানালা দরজার সামনে থেকে নীল অগ্নিশিখা অদৃশ্য হয়ে গেল।
হাক্কা কুয়াশার সামনে, মেঝের উপর বসে আছে।
কেন এসেছ তোমরা?কে পাঠিয়েছে তোমাদেরকে?’.
হাক্কা কথা বলল না। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে সে। মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করার চেষ্টা করছে সে। কথা বলা হবে আত্মহত্যারই সামিল। শিকদার
জানতে পারলে কাঁচা চিবিয়ে খাবে তাকে।
কুয়াশা বলল, রাসেল, একটা চেয়ারের সঙ্গে বাধো একে। তারপর একটা জানালার সামনে টেনে নিয়ে যাও চেয়ারটা। মি. ডি, কস্টা, হাই-ফ্রিকোয়েন্সি ইলেকট্রিসিটি অন করে দেবেন তারপর।
হাক্কা চিৎকার করে উঠল, না!’
কুয়াশা বলল, এখনও ভেবে দেখো কি করবে। যা জিজ্ঞেস করব তোমাকে, সঠিক উত্তর দেবে। তাহলে শাস্তি দেব না। কিন্তু•••।’
| কিন্তু আমাকে শিকদার সাহেব মেরে ফেলবে।’
কুয়াশা বলল, শিকদার কেন, শিকদারের ছায়াও তোমার কাছে ঘেঁষতে পারবে না। সে দায়িত্ব আমার।’
হাক্কা বলল, ‘গগটা চুরি করে নিয়ে যাবার জন্য পাঠিয়েছে আমাদেরকে শিকদার আর উলন•••।’
‘উলন কে?
উলন লোকটা ঠিক মানুষ নয়। শহীদ বলে উঠল, মানুষ নয় মানে?
হাক্কা বলল, লোকটার গায়ের রঙ লালচে। হাত দুটো সাদা। তার ডান হাতটা•••
কুয়াশা বলে উঠল, ফড়িংয়ের মত ওড়ে সব সময়, না?’
.।– .,
।
৮৪
ভলিউম ১৮
“হ্যাঁ।’ ‘গালটা কি কাজে লাগে? কেন তাদের দরকার সেটা?
‘তা জানি না। তবে যতটুকু শুনেছি, গগলসটা দরকার হবে বরফের দেশে পৌঁছুলে। ওরা বরফের দেশে যেতে চায়। কেন, তা জানি না। শিকদার এবং উলন, ওরা আমাদেরকে ওদের সব কথা বলে না।
কুয়াশা জানতে চাইল, উলন কে? কোত্থেকে এসেছে সে?’
তাও আমি জানি না। হঠাৎ একদিন ওরা দৃজন এসে হাজির হলো। কালো রঙের ভূতের কথা বলে ওরা।’
কুয়াশা জানতে চাইল, বরফের দেশে কবে যাবে ওরা? বরফের দেশ–নির্দিষ্ট করে নাম বলো জায়গাটার। ঠিক কোথায় যেতে চায় ওরা?’
| কবে যাবে জানি না। আপনার স্পেসক্রাফটটা দখল করতে চায় ওরা। ওটা ছাড়া নাকি সেখানে যাওয়া কঠিন। জায়গাটার নাম জানি না। ওরা বলেনি।
আর্কটিক না কি যেন নাম আছে এক সাগরের, সেদিকেই যাবে বুঝি।’ | কুয়াশা জানতে চাইল, আজ সকালে যে লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল–দ্বিতীয় ইকবাল আহমেদ, কে সে? | ‘শিকদার সাহেব নিজে। ছদ্মবেশ নিয়ে এসেছিল সে। আপনার কাছে প্রথম আসে উলন। সে ব্যর্থ হয়ে শিকদারকে পাঠায়। ভুল বুঝিয়ে আপনার স্পেসক্রাফটটা অধিকার করাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। শিকদার আজ সকালে এখানে আসার সময়, তাকে যারা ধাওয়া করে তারা আমাদেরই লোক। তারা অভিনয় করে ঘটনাকে বাস্তব রূপ দেবার চেষ্টায়…’।
• সব কথা গড়গড় করে বলে যেতে লাগল হাক্কা। ‘ সবশেষে জানতে চাইল সে, কিন্তু জানালা দরজার সামনে নীল আগুন•••কি ওটা? আর গগটা রয়েছে দেখতে পেয়েও ধরতে পারলাম না কেন?
কেউ উত্তর দিল না।
আসলে গগলসটা রাখা ছিল অন্যত্র। আয়নার যাদু বলা চলে পদ্ধতিটাকে। গগলসটা অন্যত্র রেখে আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখাবার ব্যবস্থা করে রেখেছিল কুয়াশা। আর হাই-ফ্রিকোয়েন্সি কারেন্ট-এর ব্যাপারটা খুবই সাধারণ। বিদ্যুৎকে ইচ্ছা মত ব্যবহার করার সাধ মেটাতে গিয়ে রাজকুমারী এই ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে।
• কুয়াশার মার্সি পিস্তলের বুলেটে আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে হাক্কার সহযোগিরা। বুলেটগুলো সীসা বা কোন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি নয়। পিস্তলগুলো দেখতে বিরাট হলে হবে কি, নল থেকে বেরোয় সুচের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বর্শা। সেগুলো শরীরে বিধে যায়। বিষ মেশানো থাকে ক্ষুদ্র বর্শালোর মাথায়। এই বিষ রক্তের সংস্পর্শে আসা মাত্র আক্রান্ত ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণের জন্য অচেতন হয়ে পড়ে।
জ্ঞান ফিরে এসেছে এতক্ষণে সকলের। মেঝের উপর উঠে বসল সবাই। শহীদ জানতে চাইল, কুয়াশা, এইসব গাধা-গরুগুলোকে। য়ে কি করবে
কুয়াশা ৫৩
৮৫
এখন?’
কুয়াশা বলল, ‘পাঠিয়ে দেয়া যাক আমার দিনাজপুরের আস্তানায়।’
শহীদ জানে এ কথার অর্থ। দিনাজপুরে কুয়াশার একটা আস্তানা গড়ে উঠেছে কিছুদিন আগে। সেখানে অপরাধীদের পাঠায় কুয়াশা। পৃথিবী বিখ্যাত ডাক্তার এবং
কেমিষ্টরা সেখানে কাজ করছেন। অপরাধীদের রেন অপারেশন এবং ব্রেন ওয়াশ করা হয় সেখানে। অপরাধীরা তাদের অতীত জীবনের কথা বেমালুম ভুলে যায় অপারেশন এবং ওয়াশের পর। তারা সৎ, সুন্দর এবং নিরাপদ জীবন যাপনের জন্য সম্পূর্ণ উপযুক্ত হয়ে ওঠে। কুয়াশা তাদেরকে দক্ষ কারিগর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রচুর টাকা ব্যয় করে। দু’বছর পর কুয়াশার আস্তানা থেকে বেরোয় তারা, কুয়াশাই তাদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। কেউ হয় টিভি মেকানিক, কেউ লেদ মেশিন অপারেটর, কেউ হয় ডাইভার, কেউ হয় ইলেকট্রিশিয়ান। সমাজের সং, সুখী আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই দিন কাটতে থাকে তাদের।
হঠাৎ কামাল বলে উঠল, “পালাচ্ছে!
শহীদ পা বাড়াল, কিন্তু কুয়াশা ধরে ফেলল ওর একটা হাত। অবাক বিস্ময়ে কুয়াশার মুখের দিকে তাকাল শহীদ।
‘পালাতে দাও। ফিসফিস করে বলল কুয়াশা।
হাক্কা সুযোগের সন্ধানেই ছিল। কুয়াশা এবং বাকী সবাইকে এক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক দেখেই সুযোগটা নিয়েছে। তার দেখা দেখি বাকী শত্রুরাও হাক্কার পিছু পিছু ছুটতে শুরু করেছে।
দরজা পেরিয়ে পাশের রূমে, সেখান থেকে করিডরে বেরিয়ে তীরবেগে ছুটল তারা সিঁড়ির দিকে।
কেউ ওদেরকে বাধা দিল না। | শত্রুরা অদৃশ্য হয়ে যেতেই ডি. কস্টা কোমরে দুই হাত রেখে কুয়াশার সামনে দাঁড়াল।
শহীদ বলল, কি ব্যাপার, কুয়াশা? ডি. কস্টা দাবি জানাল, ইয়েস! এক্সপ্লেন দ্যাট!’
কুয়াশা বলল, সবকথা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। দুর্ভাগ্যক্রমে সবকথা বলার সময় ঠিক এই মুহূর্তে নেই।’
| সবাই তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। রহস্যময় নিস্তব্ধতা নামল কামরার ভিতর। কারও মুখে কোন কথা নেই। কুয়াশা যতটুকু বলতে চায় ততটুকু বলেছে।
এর বেশি তার কাছ থেকে আদায় করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
আট
কুয়াশার আস্তানার কাছ থেকে সামান্য দূরে রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে
অপেক্ষা করছিল উলন এবং শিকদার।
ভলিউম ১৮
হাক্কা এবং অন্যান্য অনুচররা ঘর্মাক্ত কলেবরে গাড়িতে এসে উঠল। উত্তেজিত, আতঙ্কিত গলায় ব্যাখ্যা করল তারা নিজেদের ব্যর্থতা।
গর্জে উঠল শিকদার, তোরা এক একজন এক একটা অপদার্থ! এই একটু আগে দেখে এসেছি আমি কুয়াশা তার দলবল নিয়ে লাঞ্চ খাচ্ছে।’
হাক্কা বলল, “আমরাও দেখেছি। কিন্তু যারা লাঞ্চ খাচ্ছে তারা কুয়াশা এবং তার দলবলের মত দেখতে হলেও তারা আসলে অন্য লোক সবাই। কুয়াশা কিছু লোককে ডামি বানিয়ে হোটেলে বসিয়ে রেখেছে।’
বলো কি! ভারী বুদ্ধিমান লোক দেখছি এই কুয়াশা। দেখা যাচ্ছে, লোকটাকে আমি এখনও ভাল করে চিনতে পারিনি!
| কথাগুলো বলল উলন।
শিকদার বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল, ‘উলন, তুমি কিন্তু মোটেই সিরিয়াস নও। বারবার ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। এভাবে কি করে কাজ হবে?’
উলন বলল, “ঠিকই বলেছ। এভাবে এগোলে কাজ হবে না। চলো, আমাদের আস্তানায় ফিরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করি। এখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, কুয়াশাকে খতম না করে আমরা অভিযানে বেরুতে পারব না।’
দলবল নিয়ে মাছরাঙায় ফিরে এল শিকদার। তার গভীর চেহারা দেখে জিঞ্জির খান বুঝতে পারল, অবস্থা সুবিধের নয়। কেবিনের দূরপ্রান্তের একটা চেয়ারে গিয়ে বসল সে।
উলনের দিকে তাকিয়ে শিকদার বলল, কুয়াশাকে খুন করার কথা ভাবো, বুঝলে! ওই শয়তানকে শেষ না করতে পারলে কোন কাজই এগোবে না।’
উলন বলল, একটা বুদ্ধি বের করেছি আমি। শোনো।
ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল উলন। মাঝে মাঝে উলনকে প্রশ্ন করল শিকদার। তাও নিচু গলায়। যাতে কেউ শুনতে না পায় তাদের গোপন পরামর্শ।
জিঞ্জির খান দূরে বসে আছে। চেয়ে আছে সে উলন এবং শিকদারের দিকে।, তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না সে। কিন্তু শুনতে না পেলেও জিঞ্জির খান ওদের সব কথা বুঝতে পারছে। চেয়ে আছে সে শিকদার এবং উলনের ঠোঁট দুজোড়ার দিকে।
জিঞ্জির খান একজন পারদর্শী লিপ-রিডার। মানুষের ঠোঁটের নড়াচড়া দেখেই সে বলে দিতে পারে কি বলা হচ্ছে।
তিন ঘণ্টা পরের ঘটনা। কুয়াশার আস্তানা।
শহীদ বসে আছে কুয়াশার পাশে। কুয়াশা আর্কটিক অঞ্চল অর্থাৎ উত্তর মেরুর একটা ম্যাপ দেখছে গভীর মনোযোগের সঙ্গে। টেবিলের উপর কাগজ আর পেন্সিল রয়েছে। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট মানচিত্র আঁকছে সে কাগজে। টেবিলের উপর বেশ কমাস আগের খবরের কাগজ স্তূপীকৃত, সেগুলোও মেলে ধরে দেখে নিচ্ছে সরকার হলেই। ।
কাজ শেষ করে মুখ তুলে তাকাল কুয়াশা।
কুয়াশা ৫৩
৮৭
শহীদ জানতে চাইল, গত কয়েক ঘণ্টা তোমার কোন খবরই পাইনি। ছিলে কোথায়?’ * কুয়াশা মৃদু হেসে বলল, বুঝলে, শহীদ, আমরা বোধহয় আবার অভিযানে বেরুব। এখনও ঠিক বলতে পারছি না। অভিযানে যেতে ভালই লাগবে, কি বলো? উত্তর মেরুর দিকে এর আগে গেলেও, এতটা গভীরে যাইনি। নতুন ধরনের একটা অভিজ্ঞতা অর্জন হবে, সন্দেহ নেই। কি যেন জানতে চাইছিলে? হ্যাঁ, উলন এবং ইকবাল চৌধুরী সম্পর্কে। আইস অভিযান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত ছিলাম গত কয়েক ঘন্টা। রাজকুমারী এবং মি. ডি. কস্টাকে পাঠিয়েছি আমার অন্যান্য আস্তানায়। ওরা অভিযানের জন্য মোটামুটি তৈরি হয়েই আছে। কখন যে রওনা হতে হবে, ঠিক নেই। তোমরাও যাচ্ছ।’
শহীদ জানতে চাইল, কালো গগলসটা সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছ? | ‘না। লেনসগুলো অসাধারণ। স্ফটিক মণি জাতীয় পদার্থ দিয়ে জিনিসটা তৈরি বলে মনে হয়। স্ফটিক কিনা তাও বুঝতে পারছি না। স্ফটিক জাতীয় হলেও প্রাকৃতিক নয়, কৃত্রিম।
কামাল ওদের মুখোমুখি বসে শুনছিল। সে বলে উঠল, আমরা অন্তত এটুকু জানি যে শত্রুরা তোমার স্পেসক্রাফট দখল করতে চায়।
কামালের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন শব্দে অ্যালার্ম বেল বেজে উঠল। কুয়াশা টেবিলের পায়ার সঙ্গে ফিট করা সুইচবোর্ডের একটা বোম টিপে
দিল।
কামরার দেয়ালের টিভি পর্দাটা সজীব হয়ে উঠল। করিডরের ছবি ফুটে উঠল পদায়। দেখা গেল এলিভেটর থেকে নামছেন সি.আই. ডি ডিপার্টমেন্টের প্রখ্যাত অফিসার মি. সিম্পসন।
দরজা খুলে দিল কামাল।
সহাস্যে মি. সিম্পসন রিসেপশন রূমে প্রবেশ করলেন। বললেন, হ্যালো, শহীদ, মাই বয়। হ্যালো, কুয়াশা।’
কুয়াশা মুচকি হেসে মুখোমুখি সোফা দেখিয়ে বলল, বসুন। তা কি মনে করে কুখ্যাত কুয়াশার আস্তানায় আপনার পদধুলি পড়ল আজ, মি. সিম্পসন?’
“ মি. সিম্পসন বললেন, দেখো, কুয়াশা, তোমার বিরুদ্ধে আমাদের তেমন কোন অভিযোগ আর নেই।
কুয়াশা হাসল, তাই নাকি? আমি কি তবে ভাল মানুষ হয়ে গেছি? তা ভাল মানুষের কাছে কি উদ্দেশ্যে আগমন? নিশ্চয়ই উদ্দেশ্য ছাড়া আপনি মুভ করেন না?’
মি. সিম্পসন একটু যেন গম্ভীর হলেন। বললেন, কর্তব্যের তাগিদে দৌড়োদৌড়ি করতেই হয়, কুয়াশা। শিকদার মাহবুব উল্লাহর নাম জানো তো? তার দলের একজন লোক, লোকটার নাম ইউনুস মিয়া, খুন হয়েছে। আমি জানি, এ খবরও তোমার কাছে অজ্ঞাত নয়। ইউনুসের খুনী কে তা আমরা জানি। লোকটার চেহারা সাধারণ মানুষের মত নয়। কিন্তু তার পরিচয় জানি না আমরা। খবর। পেয়েছি, সেই খুনী তোমার এই আস্তানায় এসেছিল। সত্যি কিনা বলো?
কুয়াশা বলল, এসেছিল। গত ভোর রাতে।
৮৮
ভলিউম ১৮
‘কেন এসেছিল সে?’
কুয়াশা বলল, “মি. সিম্পসন, ইউনুসের হত্যাকারীর উদ্দেশ্য,, গুণ্ডাসর্দার শিকদার মাহবুব উল্লাহর তৎপরতা–উপর থেকে দেখে এসব সম্পর্কে কোন ধারণাই করা সম্ভব নয়। এসবের পিছনে গভীর, কল্পনাতীত রহস্য আছে। রহস্যের কিনারা করার চেষ্টা করছি আমি। যদি সফল হই, সব আপনাকে জানাব। এই মুহূর্তে আপনার কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার পক্ষে ভব নয়।
কুয়াশার উত্তরে মি. সিম্পসন যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তা তার চেহারা দেখেই বোঝা গেল। বললেন, একজন খুনী তোমার কাছে এসেছিল। তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি শুধু এইটুকুই? জানতে চাই আমি বিশেষ কারণে। তুমি যদি উত্তর না দাও তাহলে সেটা হবে খুবই দুঃখজনক।’ | কুয়াশা বলল, “আপাতত আপনাকে দুঃখ দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই, মি. সিম্পসন। যা বলেছি তার বেশি বলা সম্ভব নয় এই মুহূর্তে।’
গম্ভীর হয়ে গেলেন মি. সিম্পসন। কথা না বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
‘বেশ। তুমি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি নও, বুঝতে পারছি। চলি। আবার দেখা হবে।
দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন। বললেন, তোমার ফোনটা কি ব্যবহার করতে পারি?
অবশ্যই।
মি. সিম্পসন এগিয়ে এসে ক্রাড়ল থেকে রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। অফিসের কোন অধঃস্তন অফিসারের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। একটা দলের আস্তানায় হানা দেবার কথা ছিল, তার ফলাফল জানতে চাইলেন। কথা শেষ করে রিসিভারটা ক্রাড়লে রাখবার সময় হাত ফসকে সেটা পড়ে গেল টেবিলের উপর। সরি,’ বলে রিসিভারটা যথাস্থানে রেখে দিলেন তিনি। তারপর কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ।’
দৃঢ় পায়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন মি. সিম্পসন রিসেপশনরূম থেকে। | কুয়াশা বলে উঠল, শহীদ, আমার প্রাইভেট এলিভেটরে চড়ে তুমি নিচে নেমে যাও। মি. সিম্পসনকে অনুসরণ করবে তুমি।
মি. সিম্পসনকে অনুসরণ করব! শহীদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। কুয়াশা ব্যাখ্যা করল না। বুলল, যা।’ কালবিলম্ব না করে দ্রুত বেরিয়ে গেল শহীদ রিসেপশন রূম থেকে।
শহীদ রাস্তায় নেমে মি. সিম্পসনকে একটা জীপে চড়ে বসতে দেখল। অপেক্ষারত,
একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল ও । ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল সামনের জীপকে অনুসরণ করে যেতে।
শহরের মধ্যস্থলে একটা রেস্তোরাঁর সামনে থামল জীপটা। মি. সিম্পসন জীপ থেকে নেমে রেস্তোরাঁর ভিতর ঢুকলেন। ট্যাক্সি থেকে নেমে শহীদও রেস্তোরাঁর ভিতর ঢুকল।
কুয়াশা ৫৩
৮৯
রেস্তোরাঁটা আধুনিক। ভিতরে ঢুকে শহীদ দেখল মি. সিম্পসন দ্রুত পায়ে একটা ফোন বুদের ভিতর ঢুকছেন। পা বাড়াল শহীদ। ফোন বুদটা দুইভাগে ভাগ করা, মাঝখানে হার্ডবোর্ডের দেয়াল। উপরে তারের জাল। মি. সিম্পসন কার সঙ্গে কথা বলবেন, কি বলবেন শুনতে চায় শহীদ। বুথের অপর অংশে প্রবেশ করে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল সে।
. মি. সিম্পসন ডায়াল করছেন, বুঝতে পারল ও। হঠাৎ ওর মাথার পিছনে শীতল ধাতব পদার্থের স্পর্শ অনুভব করল ও। পকেটে হাত দিতে গিয়ে বাধা পেল, পিছন থেকে কর্কশ কণ্ঠে শিকদার মাহবুব উল্লাহ বলে উঠল, ‘আমি শিকদার সাবধান! নড়েছ কি, মরেছ।’
শহীদ স্থির দাঁড়িয়ে রইল।
মি. সিম্পসন যে আসলে মি. সিম্পসন নয় তা ধরে ফেলেছ দেখছি! বাহ! চমৎকার মেধা তোমাদের। কিন্তু ওই পর্যন্তই! তোমাদের মেরুদণ্ড গুড়ো করে দিচ্ছি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দাঁড়াও!
শহীদ বলল, অর্থাৎ?’
অর্থাৎ পুলিশ অফিসারের ছদ্মবেশে আমাদের দলের লোকটা কুয়াশার টেলিফোনের মাউথপীসে এমন একধরনের সাংঘাতিক পয়জন ছড়িয়ে দিয়ে এসেছে, যে পয়জন মানুষের নিঃশ্বাসের সংস্পর্শে এলেই গ্যাসে রূপান্তরিত হবে, সেই গ্যাস নাক দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করা মাত্র মৃত্যু অবধারিত…।
বিপদের গুরুত্বটা বুঝতে পেরে শহীদের মুখ ঘেমে উঠল। পাশের বৃদে শিকদারের লোক ডায়াল করে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। তার গলা শোনা যাচ্ছে, কুয়াশা? কুয়াশা বলছ? আমি মি.সিম্পসম•••একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি বলে ফোন করছি•••শুনতে পাচ্ছি না আমি তোমার কথা•••মুখটা আরও এগিয়ে আনো মাউথপীসের কাছে আমি জানতে চাই, ইকবাল চৌধুরী নামে কোন লোক••।’
শহীদ মরিয়া হয়ে উঠেছে। মাত্র একটা উপায়ই আছে কুয়াশাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার। সেই উপায়টাই কার্যকরী করার চেষ্টা করল ও। চিৎকার করে উঠলে কুয়াশা হয়তো সাবধান হয়ে যাবে। | চিৎকার করার জন্য হাঁ করল শহীদ। কিন্তু ওর গলা থেকে কোন শব্দ বের হলো না। শিকদার তার হাতের রিভলবারের ব্যারেল দিয়ে ওর মাথায় প্রচণ্ড এক ঘা মারল।
| মাথাটা ঘুরে উঠল শহীদের রক্তের স্রোত নেমে এল মাখার ক্ষতস্থান থেকে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল শহীদ। সময় থাকতে দেহটা ধরে ফেললু শিকদার। পাজাকোলা করে দেহটা তুলে নিল। বেরিয়ে এল সে বুদের বাইরে। চিৎকার করে উঠল, হেপ! হেল্প! আমার বন্ধু পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।
দ্রুত চারপাশ থেকে এগিয়ে এল কয়েকজন লোক। কেউ জানল না, এরা সবাই শিকদারের পোষমানা কুকুরের দল। রেস্তোরাঁর ম্যানেজারও ছুটে এল। শিকদারকে সে ভাল করেই চেনে। বন্ধু বলে দাবি করলেও জ্ঞানহীন আহত লোকটা যে রে বন্ধু নয় তা সন্দেহ করলেও শিকদারকে জেরা করার বা বাধা
৯০
ভলিউম ১৮
দেবার সাহস তার নেই। এই ধরনের খুনী লোকদের সঙ্গে লাগতে গেলে খুন হয়ে যেতে হবে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।
শিকদার শহীদের অজ্ঞান দেহটা নিয়ে বেরিয়ে এল রেস্তোরাঁর বাইরে। কেউ তাকে বাধা দিল না বা কোন প্রশ্ন করল না।
গাড়িতে এসে উঠল সবাই। গাড়ি ছুটে চলল দ্রুতবেগে।
এদিকে শিকদারের ডান হাত ভোমর মি. সিম্পসনের ছদ্মবেশে কথা বলছে তখন কুয়াশার সঙ্গে।
কুয়াশা বলছিল, মি. সিম্পসন, আপনি বড় বেশি বিরক্ত করছেন আমাকে। আগেই তো বলেছি, যতটুকু আপনাকে জানাবার জানিয়েছি।’
হঠাৎ কুয়াশার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেল। ভোমর শুনতে পেল অপরপ্রান্তের রিসিভারটা সশব্দে পড়ে গেল মেঝেতে। পরমূহুর্তে শোনা গেল কামালের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর, কুয়াশা! কি হলো তোমার, কুয়াশা পড়ে গেলে কেন কুয়াশা! হায় খোদা!
সাফল্যের হাসি ফুটে উঠল ভোমরের মুখে। রিসিভার রেখে দিয়ে বেরিয়ে এল সে বুঁদ থেকে।’
দেখা গেল দূরের একটা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল উলন। দ্রুত এগিয়ে আসছে সে ভোমরের দিকে।
নয়। মাছরাঙায় ফিরে এল শিকদার আর তার দলবল। জিঞ্জির খান নেই তখন ইয়টে। অবশ্য কয়েক মিনিট পরই ফিরল সে। শিকদার জানতে চাইল, ‘কিহে, যাওয়া হয়েছিল কোথায়?
জিঞ্জির খান একগাল হেসে বলল, সারাদিন চুপচাপ বসে থাকতে কার ভাল লাগে? এই একটু বাতাস খেতে বেরিয়েছিলাম।
শিকদার মেঝেতে শোয়ানো শহীদের জ্ঞানহীন দেহটা দেখিয়ে বলল, তোমার কেবিনে নিয়ে যাও ব্যাটাকে। চেষ্টা করে দেখো জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারো কিনা।
হিংস্র হয়ে উঠল জিঞ্জির খানের চেহারা। বলল, জ্ঞান ফিরিয়ে এনে কি লাভ। তুমি অনুমতি দিলে কেটে টুকরো টুকরো করে পানিতে ভাসিয়ে দিই।’
না। ওর কাছ থেকে তথ্য আদায় করতে হবে।’
জিঞ্জির খান হাসল, তাই বলো। ঠিক আছে, টরচারের দায়িত্বটা আমাকে দিয়ো।
শহীদের দেহটা অনায়াসে কাঁধে তুলে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল সে।
খানিক পরই এল ভোমর এবং উলন। কথা বলে উঠল উলন, সাকসেসফুল।. কুয়াশা খতম!’
শিকদারের হিংস্র মুখটা কদাকার হয়ে উঠল। গলা ছেড়ে হেসে উঠল সে।
কুয়াশা ৫৩
তার কুৎসিত অট্টহাসি থামল একসময়। বলল, ‘প্রথম বাধা দূর হয়েছে। এখন মৃত শয়তানটার স্পেসক্রাফটটা চাই আমার। আর চাই গগলসটা। ওই দুটো পেলেই আমরা রওনা হতে পারি উত্তর মেরুর দিকে–কি বলো?’ | ফোনের বেল বৈজে উঠল কর্কশ শব্দে। হাত বাড়িয়ে রিসিভার ধরল শিকদার। বলল, হ্যালো? ও, আমীর খান। কি! কি বললে? কুয়াশাকে এইমাত্র। দেখেছ? অসম্ভব! বলো কি তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে!•••অ্যাঁ। তাকে অনুসরণ করে এইমাত্র টেলিগ্রাম অফিসে পৌঁছেচ তুমি! কিন্তু•••এসব কি বলছ। তুমি•••হায়! হায়!•••টেলিগ্রাম অফিসে কি করছে সে?•••রেডিওগ্রাম পাঠাচ্ছে? কোথায়?•••তুমি একটা কুকুরের বাচ্চা। শোনো, ওকে চোখে চোখে রাখো…আর যদি বাঁচতে চাও তো কোথায়, কার কাছে রেডিওগ্রাম পাঠিয়েছে সে, রেডিওগ্রামের বক্তব্য কি সব জেনে যত তাড়াতাড়ি পারো ফিরে এসো আস্তানায়।’
সশব্দে রিসিভার নামিয়ে রেখে শিকদার গর্জে উঠল, উলন! তোমার পয়জন ব্যর্থ হয়েছে।
| অসম্ভব! তা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই তোমরের দোষ•••
ভোমর প্রতিবাদ জানাল, অসম্ভব। কোথাও ভুল করিনি আমি। মাউথপীসে পাউডারটুকু ঠিকই ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছি।’
উলন বলল, যাই হোক, কোথাও কোন ভুল নিশ্চয়ই হয়েছে। মোটকথা, দোষ আমার পয়জনের নয়।’
দাতে দাঁত চেপে শিকদার বলল, “এখন উপায়?
উলন বলল, আমার কাছে আরও একধরনের মারাত্মক বিষ আছে। এটার নাম হতে পারে, তোমাদের ভাষায়, হিট পয়জন। আমি এবার সেটা ব্যবহার করব।
দেখো, উলন, বারবার ব্যর্থ হতে চাই না আমি। যে বিষই তুমি এবার ব্যবহার করো:’ব্যর্থতার মুখ যেন আর দেখতে না হয়।
| কথাগুলো বলে শিকদার তার কোটের হাতার কাছে গোপন পকেট থেকে একটা টাইমপীস বের করল। টাইমপীসটা অস্বাভাবিক বড় আকারের, সিভারের তৈরি মান্দাতা আমলের জিনিস বলে মনে হয়। শিকদার নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টাইমপীসটার দিকে–যেন এই প্রথম দেখছে ওটা সে। • •
| কটা বাজে?’।
জিঞ্জির গানের গলা শুনে চমকে উঠে টাইমপীসটা তাড়াতাড়ি গোপন পকেটে লুকিয়ে ফেলল শিকদার। চড়া গলায় বলল, সাড়া না দিয়ে কেবিনে ঢোকা খুব খারাপ কথা, জিঞ্জির খান। আমি এসব পছন্দ করি না। যে টাইমপীসটা দেখেছ সেটা সময় দেয় না। ঘড়ি আমার অনেকগুলো। এক একটা এক এক কাজে ব্যবহার করি। যাও, নিজের কাজ করো গে।’ | জিঞ্জির খান তার প্রকাণ্ড দেহটা নিয়ে চলে যাচ্ছিল, পিছন থেকে জিজ্ঞেস করল শিকদার, অজ্ঞান লোকটার খবর কি?
‘এখনও জ্ঞান ফেরেনি তার। সন্ধ্যার খানিক আগে আমীর খান মাছরাঙায় উপস্থিত হলো। কুয়াশার পাঠানো
ভলিউম ১৮
রেডিওগ্রামের কপিগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে সে। চার জায়গায় একই মেসেজ পাঠিয়েছে কুয়াশা। একটা পাঠিয়েছে সে আকলাভিকস্থ (Aklavik) রয়েল ক্যানাডিয়ান মাউন্টেন্ট পুলিস ব্রাঞ্চে। আলকাভিক ম্যাকেঞ্জি নদীর তীরে অবস্থিত–আর্কটিক উপকূলের নিকটবর্তী স্থান। বাকি তিনটে পাঠিয়েছে আলাস্কা এবং অ্যালিউটিয়ান আইল্যাণ্ডস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তাদের কাছে।
রেডিওগ্রামের বক্তব্য হুবহু এই রকম: প্লিজ সেও অ্যাডেলেবল ইনফরমেশন রিগার্ডিং আইস এক্সপিডিশন অর এনি আদার এক্সপিডিশন অপারেটিং খু ইওর টেরিটোরি উইদিন লাস্ট সিক্স মা স্টপ হ্যাভ ইউ এনি রেকর্ড অব অ্যাবনরম্যালি, রেড-স্কিনড ম্যান, হুজ হ্যাঁণ্ডস আর হোয়াইট, ফাইন গোল্ডেন হেয়ার, টল বোনি রিমার্কেবলি স্ট্রং, ফ্ল্যাট আনন্যাচারাল। ভয়েস হোয়েন স্পিকিং বেঙ্গলী, মোন পারহ্যাপস অ্যাজ উলন স্টপ দিস ইনফরমেশন ইজ অফ আটমোস্ট আর্জেন্সী স্টপ ভ, মনসুর আলী বাংলাদেশ।
পড়া শেষ করে উলন মুখ তুলে তাকাল। বলল, হু। বুঝেছি। রেডিওগ্রামের উত্তর আসার আগেই শয়তানটাকে বিদায় নিতে হবে দুনিয়া থেকে!
সি, আই, ডি, অফিসার মি. সিম্পসনের ছদ্মবেশ আর সকলের মত কুয়াশাও ধরতে পারেনি। কিন্তু লোকটার যখন টেলিফোনের রিসিভারটা টেবিলের উপর ফেলে দেয় তখন কুয়াশা একটা ব্যাপার লক্ষ করে। লোকটা মাউথপীসের ভিতর ডান হাতের মুঠো থেকে পাউডার জাতীয় কিছু ফেলে দিচ্ছে দেখতে পায় সে। সন্দেহ হয়। তার। শহীদকে অনুসরণ করতে বলে সে। তারপর ফোনের রিসিভারটা বদলে ফেলে।
খানিক পর ফোন আসে। কুয়াশাও ফোন ধরে। ইচ্ছা করেই সে হাত থেকে রিসিভারটা ফেলে দেয়। সেই সঙ্গে কামালও চিৎকার করে ওঠে। এসবই ছিল
ওদের অভিনয়। শত্রুদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করার কৌশল মাত্র।
রাত দশটা বাজতে তখনও কয়েক মিনিট বাকী।
কুয়াশা উত্তরমেরুর মানচিত্র সামনে নিয়ে বসে আছে। পাশে রয়েছে। রাজকুমুরী, কামাল,রাসেল এবং ডি কস্টা।
শহীদের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা।
ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোনের বেল। ডি কস্টা কৃত্রিম ভয়ে কণ্ঠস্বর বিকৃত করে বলে উঠল, ‘এগেন এনিমিরা কোন ষড়যন্ত্র করিটে চায় বোঢ় হয়।
ফোন ধরল কুয়াশা। দ্রুত কণ্ঠে একটা লোক বলতে লাগল, “আপনি কুয়াশা, আমি জানি। আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। শুধু জেনে রাখুন, আমি ইউনুস মিয়ার বন্ধু। তাকে যারা হত্যা করেছে তাদেরকে আমি দেখে নেব। কিন্তু আমার ক্ষমতা কম। তাই ওদের সঙ্গে পেরে উঠছি না। আমি••• ||
কোত্থেকে বলছেন আপনি? লোকটা কুয়াশার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে চলল, আমি যাদের শত্রু বলে
কুয়াশা ৫৩
মনে করি আপনারাও তাদেরকে শত্রু বলে মনে করেন। স্টেশন রোডে চলে যান। একটা লাল মরিস দেখতে পাবেন। ওই পথ দিয়েই যাবে মরিসটা। এখন থেকে দশ মিনিট পর। গাড়িটায় থাকবে উলন•••|
‘এ খবর পেলেন কোথায় আপনি?’ উত্তর না দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল লোকটা।
রিসিভার নামিয়ে রেখে কুয়াশা বলল, ব্যাপারটা ঈদও হতে পারে। তবু, চলো সবাই, দেখা যাক উলনকে ধরা যায় কিনা।
দশ মিনিটের কম সময়ের মধ্যে স্টেশন রোডে পৌঁছে গেল কুয়াশার কালো রঙের প্রকাণ্ড মার্সিডিজ । রাস্তার এক পাশে গাড়ি পার্ক করল কুয়াশা। গাড়িটা থামার পরপরই রাজকুমারী পাশ থেকে বলে উঠল, ‘ওই যে! লাল মরিস!’
উলনকেও দেখা যাচ্ছে।’
কামাল বলে উঠল পিছনের সীট থেকে। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই তীর বেগে ছুটে গেল একটা লাল মরিস রাস্তার মাঝখান দিয়ে। | মার্সিডিজ ছুটতে শুরু করল। কুয়াশা নিপুণ হাতে চালাতে শুরু করেছে গাড়ি। লাল মরিস বহুদূর চলে গেছে। অবশ্য মার্সিডিজের স্পীডও বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে। কামাল, রাজকুমারী, ডি. কস্টা, রাসেল–সবাই জানে কুয়াশার কাছ থেকে মরিসের পালাবার কোন উপায় নেই।
শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা রাস্তায় পড়ল মার্সিডিজ। কুয়াশা ছাড়া প্রত্যেকের হাতে রিভলবার বেরিয়ে এসেছে।
কুয়াশা বলে উঠল, ‘গুলি কোরো না। প্রায় আশি মাইল স্পীডে ছুটছে মরিস। গুলি করে চাকা ফাটিয়ে দিলে আরোহীরা কেউ বাঁচবে না।’ | ফাঁকা রাস্তা পেয়ে মার্সিডিজ মাক্সিমাম স্পীডে ছুটছে। মিনিট সাতেক পর ভুরু কুঁচকে উঠল কুয়াশার। মরিস প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে ছিল, এখনও তাই আছে, অর্থাৎ দূরত্ব কমছে না। এদিকে মার্সিডিজের স্পীড মিটারের কাটা একশোর ঘর ছুঁই ছুঁই করছে।
মরিসের নিচে পাওয়ারফুল ইঞ্জিন রয়েছে ওদের। কুয়াশা বলি। আরও বাড়াল সে স্পীড।
দূরতু একটু কমল বটে, কিন্তু মরিস ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। রাজকুমারীর চিৎকার সকলের কানে ঢুকল সেই সময়, কুয়াশা! ধোয়া!’ | চিৎকার করে না উঠলেও চলত রাজকুমারীর। সবাই দেখতে পেল মরিসের পিছনের এগজস্ট পাইপ থেকে ঘন কালো ধোয়া বেরিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে কালো ধোয়া সামনের রাস্তাকে সম্পূর্ণ ঢেকে দিল।
মার্সিডিজের স্পীড একটু কমাল বটে কুয়াশা, কিন্তু খুব সামান্যই। উলনকে পালিয়ে যেতে দিতে রাজি নয় সে। ধোয়ার মাঝখান দিয়ে ছুটছে গাড়ি। | সামনের দৃশ্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। পরিচিত রাস্তা, স্মরণ শক্তির উপর নির্ভর করে গাড়ি চালাচ্ছে কুয়াশা।
৯৪
ভলিউম ১৮
পিছনের সীটে কামাল, ডি-কস্টা এবং রাসেল দম বন্ধ করে সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। উত্তেজনায়, বিপদের আশঙ্কায়, বিস্ফারিত ওদের তিনজোড়া চোখ। রাজকুমারী কুয়াশার পাশে বসে চোখ দুটো একবার বুজছে, পরমুহূর্তে খুলছে। রাজকুমারী ওমেনার অসাধারণ গুণ আছে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে চেষ্টা করলে ভবিষ্যৎ দেখতে পায় সে, দেখতে পায় সামনের বিপদকে। চোখ বুজে সামনের রাস্তার অবস্থা জানার চেষ্টা করছে সে, সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিচ্ছে কুয়াশাকে, ডান দিকে, সামান্য বাঁ দিকে••এবার বড় একটা গর্ত ডান দিকে।
| কুয়াশা গভীর মনোযোগের সঙ্গে রাজকুমারীর নির্দেশ অনুযায়ী গাড়ি চালাচ্ছে। স্টিয়ারিং হুইলটা বিদ্যুৎবেগে একবার এদিকে, একবার ওদিকে ঘুরছে।
| হঠাৎ রাজকুমারী চিৎকার করে উঠল, সামনে বাধা! সবাই একসাথে দেখতে পেল বিপদটা। রাস্তার মাঝখানে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে একটা নিশ্চল ট্রাক। ধোয়ার জন্য আগে দেখা যায়নি ট্রাকটাকে। মাত্র বিশ গজ সামনে সেটা। রাস্তার দুপাশেই গভীর খাদ।
লকের মধ্যে সবাই বুঝতে পারল-প্রাণ বাঁচানো অসম্ভব। এরপর চিন্তা করার শক্তি রইল না কারও। ডি কস্টা, কামাল এবং রাসেল ডান দিকে ছিটকে পড়ল। তিনজনের মাথা ঠুকে গেল গাড়ির জানালার সঙ্গে। তীৰ শব্দ উঠল কংক্রিটের রাস্তার সঙ্গে মার্সিডিজের চাকার ঘর্ষণে। তারপর, গোটা গাড়িটা বাঁ দিকে কাত হয়ে গেল। মনে হলো উল্টে যাচ্ছে গাড়িটা। ডি কস্টার চিৎকার শোনা গেল, ওই গড়।
পরমুহূর্তে স্থির হয়ে গেল যেন সব কিছু। শোনা গেল কুয়াশার শান্ত কণ্ঠস্বর, কে কোথায় ব্যথা পেলে? | সীটের নিচে পড়ে গিয়েছিল সবাই। রাজকুমারী সামনের সীটে উঠে বসল। পিছনের সীটে উঠে বসল বাকি সবাই। সবাই অবিশ্বাস ভরা চোখে দেখল, সামনে। পরিষ্কার রাস্তা। না আছে ধোয়া, না আছে ট্রাক। মার্সিডিজ তীরবেগে ছুটছে। লাল মরিসটাকে দেখা যাচ্ছে সামনে। মাত্র দশ গজ সামনে এখন সেটা।
কুয়াশা বলল, বড় জোর বেঁচে গেছি। ট্রাকের বাঁ দিকে মাত্র হাত তিনেক জায়গা ছিল। তিন হাত জায়গা দিয়ে কি আর গাড়ি চালানো যায়। তাই করলাম কি জানো? গাড়ির বা দিকটা শূন্যে তুলে ফেললাম। ডান দিকের চাকাগুলো রইল ওই তিনহাত জায়গায় গাড়ি সম্পূর্ণ কাত করে পেরিয়ে এলাম বিপদটা।’
কথা বলছিল বটে কুয়াশা, কিন্তু মার্সিডিজের স্পীড ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছিল।
তৈরি হলো ওরা। মরিসকে ধরা এখন খুবই সহজ। রেডী!’ এক মুহূর্ত পরই দেখা গেল মরিসের পাশে পৌঁছে গেছে মার্সিডিজ।
উলন কোথায়? এ লোক উলন নয়!’ চিৎকার করে উঠল রাজকুমারী। মরিসের আরোহীদের দেখা যাচ্ছে। মোট দুজন। একজন গাড়ি চালাচ্ছে, সে দেখতে হুবহু শিকদারের মত। তার পাশে যে বসে আছে সেও হুবহু উলনের মত দেখতে।
কুয়াশা রাজকুমারীর কথা শুনেও যেন শুনল না। হঠাৎ সে ভয়ঙ্কর বিপদের কুয়াশা ৫৩
৯
সম্মুখীন হলো। মরিসের ড্রাইভার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দ্রুতবেগে মরিসের স্টিয়ারিং ঘুরাচ্ছে সে।
দুর্ঘটনা অনিবার্য। কুয়াশা উন্মাদের মত স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাতে শুরু করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা বুঝি হলো না।
প্রচণ্ড শব্দ হলো দুটো গাড়ির সংঘর্ষে। গাড়ির ভিতর টর্নেডো শুরু হলো যেন। ডি. কস্টার পা দুটো উঠে গেল উপরে, মাথাটা নেমে গেল সীটের নিচে। রাসেলের দেহটা একবার ডান দিকের কোণায় গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে, পরমুহূর্তে ছিটকে যাচ্ছে বা দিকের কোণায়… ।
এরপর মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে পড়ল শেষবার তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে।
সবাই যে-যার জায়গায় উঠে বসল। কি যে ঘটেছে তা কেউ বুঝতে পারেনি এখনও। | ওমেনা, ড্রাইভিং সীটে বসো তুমি। গাড়ি নিয়ে ফিরে যাও আস্তানায়।’
কথাগুলো রলে গাড়ি থেকে নেমে গেল কুয়াশা। অবাক বিস্ময়ে পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। কুয়াশা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
উপায় নেই। কুয়াশার আদেশ শিরোধার্য।’ রাজকুমারী গাড়ি ঘুরিয়ে নিল, ছুটে চলল শহরের দিকে।
রাস্তা থেকে নীচু ধানখেতে নেমে গেছে ইতিমধ্যে কুয়াশা। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে অদুরে। সেই আগুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে মরিসটার দুজন আরোহীকে দেখতে পেল। দুজনই মারা গেছে। মরিসের গায়ে আগুন ধরে গেছে, সেই আগুন গ্রাস করছে লাশ দুটোকে।
মার্সিডিজকে রাস্তা থেকে ফেলে দিতে গিয়ে নিজেদের গাড়ির তাল ঠিক রাখতে পারেনি ওরা, ফলে যা হবার তাই হয়েছে।
চেয়ে চেয়ে দৃশ্যটা দেখছিল কুয়াশা। এমন সময় একটা যান্ত্রিক গুঞ্জন কানে ভেসে এল। ঝট করে তাকাল সে আকাশের দিকে। ঠিক মাথার উপর একটা টু সিটার হেলিকপ্টার উড়ছে, দেখতে পেয়েই লাফ দিয়ে একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল সে।
গাছের গায়ের সঙ্গে শরীর ঠেকিয়ে রইল কুয়াশা। মিনিট তিনেক শুন্যে দাঁড়িয়ে থাকার পর হেলিকপ্টারটা ফিরে যেতে শুরু করল। কুয়াশা তাকিয়ে রইল সেন্টার দিকে। পশ্চিম দিকে চলে যাচ্ছে ‘কপ্টারটা। খানিক দূর যাবার পর শূন্যে দাঁড়াল, তারপর নিচে নামতে শুরু করল।
গাছের নিচে থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে চলল কুয়াশা। হেলিকপ্টার কোথায় নেমেছে অনুমান করতে পেরেছে সে। দেখতে চায় আরোহীদের উদ্দেশ্য কি।
মিনিট দুয়েক হাঁটার পরই কপ্টারটাকে দেখতে পেল কুয়াশা। মাটির উঁচু একটা ঢিবির উপর নেমেছে সেটা। | সন্তর্পণে ঢিবির গা বেয়ে উপরে উঠল কুয়াশা। কাছাকাছি থেকে দেখল, কেউ নেই কপ্টারের ভিতর। ঢিবির অপরদিকে গিয়ে পৌঁছুল সে। নিচে দেখা যাচ্ছে।
৯৬
ভলিউম ১৮
একটা বাড়ি । বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। একটা জানালা দেখা যাচ্ছে–খোলা। হঠাৎ সেটা বন্ধ হয়ে গেল।
ঢিবি থেকে নিঃশব্দে নামতে শুরু করল কুয়াশা। কালো আলখেল্লা বাতাসে উড়ছে তার। রহস্যময়, অলৌকিক একটা মূর্তির মত দেখাচ্ছে তাকে।
কোথাও কোন শব্দ নেই। বাড়িটার চারপাশে বড় বড় গাছপালা। | টিবি থেকে নেমে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল কুয়াশা। দুজন লোক কথা বলছে নিচু গলায়। লোক দুজনকে দেখতে পাচ্ছে না কুয়াশা। একজন লোক কুয়াশা’ শব্দটা উচ্চারণ করল। পরমূহুর্তে দ্বিতীয় নোকটা বলে উঠল, জহীর, হেলিকপ্টারে সুবিধে হবে না। আমরা যেখানে যেতে চাই সেখানে হেলিকপ্টার নামানো সম্ভব নয়। চলো, গাড়ি নিয়ে বাই রোডে যাই।’
তাই চলো।’..
কথাগুলো বেশ জোরে জোরে বলল ওরা। তারপর তাদের ছুটন্ত পদশব্দ শোনা গেল। কুয়াশা অনুসরণ করল তাদেরকে। কিন্তু লোকগুলোকে দেখতে পাচ্ছিল না সে। খানিক পরই থমকে দাঁড়াল সে। রাস্তাটা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। রাস্তার দিক থেকে একটা গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ ভেসে এল। এখন আর অনুসরণ করা সম্ভব নয়।
| বাড়িটার কাছে ফিরে এল কুয়াশা। নিঃশব্দে প্রবেশ করল ভিতরে। প্রতিটি কামরা পরীক্ষা করল সে। সবগুলোই খালি-মাত্র একটি ছাড়া। সেই কামরায় ঢুকে কুয়াশা দেখল টেবিলের উপর জ্বলছে একটা হ্যারিকেন। টেবিলের উপর কিছু কাগজপত্র পড়ে রয়েছে। মানচিত্রও দেখা যাচ্ছে কয়েকটা।
| টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হ্যারিকেনটা সামনে টেনে এনে কাগজপত্র এবং মানচিত্রগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ল সে। | কাগজপত্র এবং মানচিত্রগুলো দেখতে এমনই মগ্ন হয়ে পড়ল কুয়াশা যে হ্যারিকেনের ভিতর থেকে হালকা হলুদ রঙের মৃদু মৃদু ধোয়া বের হচ্ছে তা তার নজরেই পড়ল না।
অবশ্য আরও খানিক পর, ব্যাপারটা লক্ষ করল সে ঠিকই। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিধে হয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। তার হাতটা বিদ্যুতের মত নড়ে উঠল। হাতের ধাক্কায় হ্যারিকেনটা ছিটকে গিয়ে পড়ল দেয়ালের গায়ে, সেখান থেকে মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। নিভে গেল সেটা তারও আগে।
কুয়াশা দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। পা বাড়াতে গিয়ে ব্যর্থ হলো সে। টলে উঠল দীর্ঘ, প্রকাণ্ড দেহটা। কিছু একটা ধরার জন্য হাত দুটো সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে বাতাসে ছটফট করল কিছুক্ষণ, তারপর সশব্দে মেঝের উপর পড়ে গেল দেহটা।
নিঃসাড়, মৃতবৎ পড়ে রইল কুয়াশা অন্ধকার কামরার মেঝেতে।
Leave a Reply