৫১. ব্রক্ষাস্ত্র ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৫১
প্রথম প্রকাশ: মে, ১৯৭৬ এক
সেই রহস্যময় মৃত্যুর প্রথম শিকার মনির। মনিরের সাথে জঙ্গলে তার দুই বন্ধু ছিল। ব্যাপারটা তারাও লক্ষ্য করে। কিন্তু তাদের কাছে ওটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি। মনিরের মৃত্যুর আসল কারণ নিয়ে তারা মাথাই ঘামাল না।
ওরা তিনজন শহরের বাইরে, একটা জঙ্গলে ঢুকে আমোদ-ফুর্তি করছিল। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মদ খাওয়া, নিরালায় নেশা করে মাতলামি করা। তিনজনই অবৈধ উপায়ে টাকা পয়সা রোজগার করে জীবন যাপন করে। তাতে বেশ কিছু পয়সা এলেই মদ খেয়ে তা ওড়ায়। বাকি দু’জনের মতই, সিনেমার টিকেট ব্ল্যাকে বিক্রি করত মনির।
বেশ নেশা হয়েছিল ওদের। টলছিল তিনজনই। নেশা হয়েছিল বলেই চোখের সামনে যা দেখল তা চোখের ভুল বলে ধরে নিল, কোন গুরুত্ব দিল না। নেশা করলে, সামনের দৃশ্য বিদঘুঁটে ভাবে বদলে যায়, যা নয় তাই দেখে, সে অভিজ্ঞতা ওদের ছিল। ব্যাপারটাকে ওরা তার বেশি কিছু মনে করল না।
ঘটনাটা ঘটল ঠিক সন্ধ্যার সময়। মনির হাঁটছিল সকলের আগে আগে। বহু পুরাতন একটি হিন্দি ছবির গান থেমে থেমে আওড়াবার চেষ্টা করছিল সে। পা টলছিল। মনিরের দুই বন্ধু ছিল একটু পিছনে।
হঠাৎ মনিরের লম্বা দেহটা বেঁকে গেল। চোখ দুটো হয়ে উঠল বিস্ফারিত। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। তার হাত দুটো সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে মাথার উপরে ঘুরল দু’একবার, তারপর দৌডুবার চেষ্টা করল সে।
| মনিরের পিছনে বাকি দুজনও দাঁড়িয়ে পড়েছে, হাঁ হয়ে গেছে তাদের মুখ। অল্প অল্প পোড়া গন্ধ ছিল তখন বাতাসে। এবং সামনের দৃশ্য এমন অদ্ভুত হয়ে উঠেছিল যে তেমন দৃশ্য তারা তাদের জীবনে আর কখনও দেখেনি। মনে হচ্ছিল, বাতাসকে দেখতে পাচ্ছে তারা, ঢেউ খেলানো বাতাসের পর্দা তাদের চোখের সামনে আলোড়িত হচ্ছে।
মনির আর্তনাদ করে উঠল। আর্ত চিৎকারের শব্দটা উচ্চকিত হয়ে ওঠার আগেই, মাঝপথে, থেমে গেল। কেউ যেন গলা চেপে ধরেছে মনিরের, তাই আর চিৎকার বের হচ্ছে না।
মনিরের বন্ধুরা পিছন ফিরেই দৌড় মারল। ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে দুজনই।
খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। মনিরকে দেখা যাচ্ছে। ঘাসের উপর পড়ে
৮৬
ভলিউম ১৭,
আছে সে। নড়াচড়ার কোন লক্ষণ নেই।
আরও খানিক পর সাহস ফিরে পেয়ে মনিরের কাছে এসে হাজির হলো ওরা। কোথাও তখন আর কোন রকম ভয়ের কিছু নেই। মনিরের দেহ পোড়েওনি, হাড় পাজরাও সব ঠিক আছে, এক ফোঁটা রক্তও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কিন্তু তবু,
মনির বেঁচে নেই। নিঃশ্বাস পড়ছে না তার, পালসও নেই। | রাতে মনিরের লাশ উদ্ধার করা হলো। থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ভদ্রলোক মনিরকে চিনতেন। তিনি জানতেন মনির ইদানীং পকেট মারার কাজ ছেড়ে দিয়ে সিনেমার টিকেট ব্ল্যাক করত। মৃতদেহ দেখে খুব একটা দুঃখ পেলেন না অফিসার। মদের গন্ধ পেলেন, পাম্প করে মদ বেরও করা হলো বেশ খানিকটা। ডেথ রিপোর্টে লেখা হলো: acute alcoholism.
পোস্ট মর্টেমের অর্ডার দিলেন না তিনি।
সুতরাং, মনিরের মৃত্যুর কারণ অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেল। রহস্যটার সমাধান হলো না।
অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমানও একটা অদ্ভুত রহস্যের সন্ধান পেলেন। প্রথমে তিনি ব্যাপারটাকে মোটেই রহস্যময় বলে মনে করেননি।
অদ্ভুত একটা আলো গত কয়েকদিন থেকেই দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। তেমন মনোযোগ দেননি। কিন্তু হঠাৎ যেদিন আবিষ্কার করলেন যে আলোটা একমাত্র তিনিই দেখতে পাচ্ছেন, আর কারও চোখে পড়ছে না, অমনি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
কৌতূহলী হয়ে উঠলেন বটে কিন্তু তিনি যে প্রকৃত পক্ষে কি আবিষ্কার করে ফেলেছেন তা জানলেন না। যদি জানতেন তাহলে ঘটনা অন্যরকম ঘটত। কয়েকশো লোকের প্রাণ অন্তত বাঁচানো যেত অনায়াসে।
টিকেট ব্ল্যাকার মনিরের মৃত্যু সম্পর্কে মোখলেসুর রহমান কিছু জানতেন না। অবশ্য জানলেও এই রহস্যময় আলোক-সঙ্কেতের সাথে তার মৃত্যুর কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে করার কোন কারণ ছিল না।
আলোটা আপাতদৃষ্টিতে তাৎপর্যহীন। দেখতে অনেকটা লম্বা সূর্যকিরণের মত। মোখলেসুর রহমান ব্যতীত অন্য কেউ হলে আলোটাকে সূর্যকিরণ বলে ভুল করত হয়তো।
মোখলেসুর রহমানের অফিসটা এক দশতলা বিল্ডিংয়ের সাততলায়। সূর্যকিরণ সেখানে প্রবেশ করার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া, মোখলেসুর রহমান তো সূর্যকিরণ দেখতেই পান না। তিনি বেশ কিছুদিন থেকে স্নো-রাইও।
| বড়, রঙিন কাঁচের চশমা পরে থাকেন তিনি। কিছুদিন আগে কানাডা থেকে বেড়িয়ে ফিরেছেন, সাথে করে নিয়ে এসেছেন এই অসুখ। কানাডার স্কিয়িং দেখতে গিয়ে সাবধান না হওয়ায় চোখের এই অসুখ হয় তাঁর। লিখতে পড়তে পারেন না
একদম। নিজের উপর বিরক্তিতে অফিস কামরার মেঝেতে পায়চারি করেন। অ্যাডভোকেট তিনি, বেশ নামডাক আছে। লিগ্যাল ডকুমেন্ট রচনা করার জন্য, ল
কুয়াশা ৫১
৮৭
বুক পড়ার জন্য দৃষ্টিশক্তি একান্ত দরকার তার–কিন্তু নিজের দোষে স্লো-রাইণ্ড হয়ে বসে আছেন। সুতরাং মহা খাপ্পা হয়ে আছেন নিজেরই উপর।
তবে চোখ দুটো ধীরে ধীরে ভাল হয়ে আসছে। যদিও এখনও তিনি প্রায় কিছুই দেখতে পান না খালি চোখে।
কিন্তু অদ্ভুত, রহস্যময় আলোটা তিনি ঠিকই দেখতে পাচ্ছিলেন।
গত কয়েকদিন ধরেই দেখছিলেন, সেদিন হঠাৎ ব্যাপারটা মনোযোগ আকর্ষণ করল তাঁর। চোখ থেকে চশমা খুলে জানালার বাইরে তাকালেন তিনি। না, দেখা যাচ্ছে না। আবার পরলেন চশমা। হ্যাঁ, দেখা যাচ্ছে। রহস্যময় ব্যাপার। সন্দেহ হলো।.ডাকলেন জুনিয়র উকিলকে। বললেন, ‘দেখো তো কোন আলো দেখতে পাও কিনা?’
| • জুনিয়র উকিল বলল, না, কোন বিশেষ আলো সে দেখতে পাচ্ছে না।
. অবাক কাণ্ড! মনটা খুঁত খুত করতে লাগল মোখলেসুর রহমানের। কিন্তু ওই । পর্যন্তই। তিনি এ ব্যাপারটা নিয়ে আর বিশেষ মাথা ঘামালেন না।
মোখলেসুর রহমানকে দোষ দেয়া যায় না। কারণ তিনি নিজের পেশা সংক্রান্ত একটি ব্যাপারে গত কয়েকদিন থেকে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। গত কয়েকদিন আগে একজন মক্কেলের আসার কথা। কিন্তু তিনি আসেননি। না আসার কোন কারণ নেই, তবু ভদ্রলোক কেন আসছেন না–এই কথা ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন
পরদিন আবার সেই আলো লক্ষ্য করলেন মোখলেসুর রহমান। তিনি দেখলেন, সব সময় আলোটাকে দেখা যায় না। বিশেষ বিশেষ সময়ে দেখা যায়। আলোগুলোও বিভিন্ন রকমের। কোন কোনটা ছোট, কোনটা আবার বড়।
হঠাৎ তার সন্দেহ হলো, আলোগুলো কোন সঙ্কেত নয় তো?
সন্দেহটা মনে জাগতেই সিরিয়াস হয়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু এ ব্যাপারে সন্ধান চালাবার আগেই আলো নিক্ষেপ বন্ধ হয়ে গেল। তা হোক, মোখলেসুর রহমান ইতিমধ্যে পুরোপুরি সজাগ হয়ে উঠেছেন। কাজের কথা, মক্কেলের কথা ভুলে গেছেন তিনি। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে, আবার যদি আলোটা দেখতে পান।
একটা জিনিস আগেই লক্ষ্য করেছেন তিনি। আলোটা নিচের দিক থেকে উপরের দিকে নিক্ষেপ করা হয়। একটু কোণাকুণি, তির্যকভাবে। আশপাশে উঁচু উঁচু অনেক বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কোন বিল্ডিংয়ের গায়েই আলোটা লাগে না। | বিল্ডিংগুলোকে পাশ কাটিয়ে আলোটা সোজা আকাশের দিকে উঠে যায়।
চিন্তা করতে করতে ভুরু জোড়া কুঁচকে ওঠে মোখলেসুর রহমানের। * আলোগুলো যদি কোন ধরনের সঙ্কেত বা সিগন্যাল বলে ধরে নেয়া যায় তাহলে
প্রশ্ন ওঠে কার বা কাদের উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছে এই সঙ্কেত?
রহস্যটা বুঝতে পারেন না তিনি। নিঃশব্দে, প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে, চেয়ে আছেন সামনের দিকে। রাস্তার ওপারের বিল্ডিংটার আউটলাইন কোনরকমে দেখতে পাচ্ছেন। চোখের দোষে প্রকাণ্ড বিল্ডিংটার আর কোন বৈশিষ্ট্য দেখতে
ভলিউম ১৭
৮)
পাচ্ছেন না। কিন্তু অকস্মাৎ ঝলসে উঠল তাঁর চোখ, আবার তিনি দেখতে পেলেন সেই রহস্যময় আলো।
দ্রুত সেই আলো জ্বলছে আর নিভছে। আশ্চর্যবোধক একটা শব্দ বেরিয়ে এল মোখলেসুর রহমানের গলা থেকে। ব্যস্ততার সাথে পকেট থেকে একটা পেন্সিল বের করলেন তিনি। পরমুহূর্তে অসহায়ের মত এদিক ওদিক তাকালেন মাথা ঘুরিয়ে। তারপর চিৎকার করে ডাকলেন সহকারীকে। | জুনিয়র উকিল ছুটে এল তার রূম থেকে। কথা বলার অবসর দিলেন না মোখলেসুর রহমান তাকে। ডিকটেক করতে শুরু করলেন ঝড়ের বেগে। তিনি যা বলে গেলেন আপাতদৃষ্টিতে তার কোন অর্থই হয় না। তবু জুনিয়র উকিল হুকুম পালন করে গেল। দ্রুত লিখল সে প্রতিটি অক্ষর। তারপর অক্ষর লেখা কাগজটা বাড়িয়ে দিল বসের দিকে।
অক্ষরগুলো এইভাবে সাজানো: OPWDZ– BRHYZ
BBOPD WICGI WGBUF QXPUM WBEIE
CHAUK EBROS
LTGJP
RINDU
LYLMF QETYM
FINDP
BDTCZ
VPTQD BMSSS আলোক সঙ্কেত থেমেছে।
মোখলেসুর রহমান প্রায় চিৎকার করে উঠলেন উত্তেজিত ভাবে, কপি করো, কপি করো। বড় বড় করে লেখো অক্ষরগুলো। তারপর একটা একটা করে পড়ে শোনাও!
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রেডিও অপারেটর হিসেবে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল কোড়ে পাঠানো মেসেজ অনায়াসেই পড়তে পারতেন তিনি। যুদ্ধের পর শখের বশবর্তী হয়ে সাইফার কোডও শিখে ফেলেছেন।
| বর্তমান আলোক সঙ্কেত করা হয়েছে মাঝারি ধরনের কঠিন সাইফার কোড়ে। কিন্তু প্রথম দুটো শব্দ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এ থেকেই সূত্র পেয়ে যান তিনি। শব্দ দুটো সাইফার কোডে নয়। শব্দ দুটোর অর্থ:
ডেথ টুডে। অর্থাৎ: আজ মৃত্যু।
রাস্তার ওপারের বিল্ডিংয়ের সাততলার একটি রুমের জানালার সামনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল একজন লম্বা, স্বাস্থ্যবান, সুবেশী লোক। ঘুরে জানালার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল সে। মুখের হাসিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে উঠল চেহারাটা। হাতের সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে জুতো দিয়ে চেপে ধরল। মুখ তুলে তাকাল তার সঙ্গীর দিকে। কঠিন গলায় বলে উঠল, ‘কানা উকিল নোকটা সম্পর্কে তোমার ধারণাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে।’
‘এখন কর্তব্য কি?’ সঙ্গী লোকটা চাপা গলায় প্রশ্ন করল।
কর্তব্য একটাই।’
কুয়াশা ৫১
লম্বা লোকটা দরজার দিকে পা বাড়ান, আমাদের ব্যাপারে কেউ কৌতূহল দেখালে তাকে তার পরিণাম ভোগ করতেই হবে। সে পরিণাম অবশ্যই চরম কিছু হতে বাধ্য। আমি কর্তব্যটা সেরে আসি।’
দৃঢ় পায়ে অফিস রূম থেকে বেরিয়ে গেল সে।
এদিকে মোখলেসুর রহমানের সহকারী উকিল অক্ষরগুলো বড় বড় করে লিখে দিয়েছে একটা কাগজে। মোখলেসুর রহমান টেবিলে ঝুঁকে পড়ে গভীর মনোযোগের সাথে অক্ষরগুলোর অর্থ উদ্ধার করছেন। সফল হচ্ছেন তিনি। কিন্তু প্রচুর সময় খরচ হচ্ছে। আস্তে আস্তে, অক্ষরগুলোর অর্থ পাশাপাশি প্রকাণ্ড আকারে লিখে লিখে মেসেজটা আবিষ্কার করছেন তিনি।
| খানিকপর মাথা তুললেন মোখলেসুর রহমান। এদিক ওদিক তাকালেন। সহকারী নেই রূমে। লাঞ্চ আওয়ার। চলে গেছে সে। আবার ঝুঁকে পড়লেন টেবিলের উপর। মেসেজটা আবিষ্কার করেছেন তিনি। বড় বড় অক্ষরে লিখেছেন। আবার পড়লেন। এবার নিয়ে পাঁচবার পড়লেন। মাথা তুলে কি যেন চিন্তা করার চেষ্টা করছেন। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে তার কপালে। বিড়বিড় করে বললেন,
অসম্ভব। এ হতে পারে না।’
মেসেজের অর্থটা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি অবিশ্বাস্য। মোখলেসুর রহমান আবার ঝুঁকে পড়লেন টেবিলের উপর। নিশ্চয়ই কোথাও কোন মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। মেসেজের অর্থটা এমনই ভয়ঙ্কর, এমন বিভীষিকাময় যে কাউকে বললে সে ভাববে লোকটা পাগল হয়ে গেছে।
| মুহূর্তের জন্য আরও একটা প্রশ্ন মাথায় এল। আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত এই আলোক সঙ্কেত কার উদ্দেশ্যে? কাকে উদ্দেশ্য করে পাঠানো হচ্ছে? এই আলো দেখতে পাবার কোন উপায় নেই, কারণ মহাশূন্যের দিকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। আবার কাছাকাছি কারও উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছে বলেও মনে হয় না। কাছাকাছি মেসেজ পাঠাবার দরকার হলে টেলিফোন ব্যবহার করলেই তো হয়।
| এ চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে ফেললেন মোখলেসুর রহমান। চিন্তা করলেন, এখন তার প্রয়োজন একজন সাহায্যকারীর। তিনি পুলিসকে ডেকে ব্যাপারটা জানাতে পারেন কিন্তু অনুসন্ধানের পর যদি প্রমাণ হয় গোটা ব্যাপারটাই একটা ভুল, একটা ভিত্তিহীন অবাস্তবতা, একটা ফুল অ্যালার্ম তাহলে নিতান্তই হাসির খোরাক হবেন তিনি। | কিন্তু ব্যাপারটা যে ফলস অ্যালার্ম নয় তাও তিনি বুঝতে পারছেন। তবু.. পুলিশকে জানানোর চেয়ে আর একজনকে জানালে রহস্যটা ন্যূনতম সময়ে উন্মোচিত হবে বলে ভাবলেন তিনি।
গোটা ব্যাপারটাই নতুন করে আগাগোড়া ভাবলেন তিনি। তারপর মনস্থির করে ফেললেন। | না, আর দেরি করবার কোন মানে হয় না। কুয়াশাকে সব কথা জানাবেন, ঠিক করলেন তিনি। একমাত্র কুয়াশার উপরই এ ব্যাপারে ভরসা করতে পারা যায়। এই ধরনের রহস্যময় কাণ্ড নিয়েই কুয়াশার কারবার।
ভলিউম ১৭
যেই ভাবা সেই কাজ। টেলিফোনের দিকে ছুটলেন তিনি। হোঁচট খেলেন টেবিলের পায়ার সাথে। কোন মতে টাল সামলে নিয়ে আবার পা বাড়ালেন, এমন সময়••• |
দরজায় খুট করে শব্দ হলো একটা। কেউ যেন অফিস রূমে ঢুকল। ‘কে।’
রিসিভারের দিকে হাত বাড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন মোখলেসুর রহমান। হাতটা স্থির হয়ে গেল তার। পাথর হয়ে গেল দেহটা। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল। আবছা দেখছেন, কিন্তু জিনিসটা চিনতে পারলেন ঠিকই। আগন্তুকের হাতে পিস্তল। অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন মোখলেসুর রহমান•••
ধুপ করে মৃদু শব্দ হলো একটা। বুকের বামদিকে ধাক্কা খেলেন মোখলেসুর রহমান। কেঁপে উঠল দেহটা। পরমুহূর্তে হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন তিনি। সাইলেন্সর ফিট করা পিস্তলের বুলেট বুকে বিদ্ধ হবার তিন সেকেণ্ডের মধ্যেই প্রাণ ত্যাগ করেছেন তিনি।
মোখলেসুর রহমানের সহকারীর বক্তব্য শুনে পুলিস কোন রহস্য উদ্ধার করতে পারল না। সহকারীর নোট বইটা পাওয়া যাচ্ছে না শুনে তারা যেন আরও সময় পড়ে গেল। সরকারী গোয়েন্দারা চিন্তা করেও বের করতে পারল না বড় বড় করে লেখা কয়েকটা অক্ষরের সাথে মোখলেসুর রহমানের হত্যার কি সম্পর্ক।
দোষ গোয়েন্দাদের নয়। কারণ সহকারী উকিল তাদেরকে বলতেই পারল না অক্ষরগুলো কোত্থেকে, কিভাবে পেয়েছিলেন মোখলেসুর রহমান।
সেদিনই বিকেলে আর্মি প্রুভিং গ্রাউণ্ডে যে ঘটনাটা ঘটল সেটা আরও ভয়ঙ্কর, আরও অবিশ্বাস্য। কিন্তু পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ সেই ঘটনার সাথেও মোখলেসুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের কোন সম্পর্ক দেখল না। অথচ সম্পর্ক একটা ছিল।
সেদিন বিকেলের ঘটনা।
প্রভিং গ্রাউণ্ড ব্যবহার করা হয় সামরিক যন্ত্রপাতি, নতুন আবিষ্কার, নতুন বিস্ফোরক পরীক্ষা করার জন্য। লোকচক্ষুর অন্তরালে জায়গাটা। কড়া প্রহরার ব্যবস্থা, কোথাও শৈথিল্য নেই। আশপাশ থেকে প্রুভিং গ্রাউণ্ডের ভিতরটা দেখার কোন উপায় নেই।
কিন্তু দূরের একটা মাটির উঁচু ঢিবির উপর দু’জন লোক আগেই উঠে বসে আছে। তাদের দু’জনের চোখেই হাই-পাওয়ারড বিনকিউলার। ঢিবির ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে প্রুভিং গ্রাউণ্ডের দিকে চেয়ে আছে তারা।
এই লোক দু’জনই রাস্তার ওপারের বিল্ডিংয়ের পাঁচতলার একটি অফিস রূম থেকে মোখলেসুর রহমানকে লক্ষ্য করেছিল। এদের মধ্যে লম্বা লোকটাই মোখলেসুর রহমানকে খুন করেছে।
নিজের মধ্যে কথা বলছিল তারা। কি যে ঘটতে যাচ্ছে তা তারা বেশ ভাল কুয়াশা ৫১
৯১
করেই জানে। যে বিয়োগান্ত, মর্মন্তুদ নাটক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সে নাটকের উদ্যোক্তা তারাই। বোধহয় সেই কারণেই সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তারাও উত্তেজিত হয়ে উঠছে।
দুইশো সেনা রয়েছে মাঠে। সেনারা সবাই নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে এক্সপেরিমেন্ট শুরু হবার জন্য।
| সেনাদল এখনও জানে না এক্সপেরিমেন্টের বিষয়টা কি। তবে গুজব এই যে নতুন এক ধরনের স্মোক স্ক্রিন পরীক্ষা করা হবে। সকলের সাথে রয়েছে একটি করে গ্যাস-মাস্ক। নির্দেশ পাওয়া মাত্র সেগুলো পরে নেবে সবাই।
গ্যাস-মাস্কের কোন প্রয়োজন নেই, একজন অফিসার জানিয়েছেন। মাস্কের সাথে যে কাঁচের চশমাটা আছে শুধু সেটাই দরকার। যে ধোয়াটা পরীক্ষা করা হবে সেটা এতটুকু বিষাক্ত নয়। তবে খুবই গাঢ় এবং ঘন ধোয়া। সেই ধোয়ার ভিতর দিয়ে যাবার সময় যাতে পখ দেখা যায়, সামনের দৃশ্য অবলোকন করা যায়, তারই জন্য এই বিশেষ ধরনের কাঁচের চশমা। অফিসাররা আশা করছেন ঘন ও গাঢ় ধোয়ার ভিতর দিয়ে এই চশমা পরে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাওয়া সম্ভব হবে। পরীক্ষার বিষয়বস্তু এটাই।
এক্সপেরিমেন্টটা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা প্রমাণ হয় উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের উপস্থিতির হার দেখে। অফিসাররা প্রুভিং গ্রাউণ্ডের বাইরের উঁচু বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, প্রত্যেকের হাতে ফিল্ড গ্লাস।
• মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। এক্সপেরিমেন্ট শুরু করার জন্য চমৎকার আবহাওয়া। কোথাও কোন অনিয়ম নেই। সব রেডি।
| প্রুভিং গ্রাউণ্ডের উপরে, অনেক উঁচুতে, যে এরোপ্লেনটা চক্কর মারছে সেটা কারও নজরে পড়ল না। অনেক বেশি উঁচুতে রয়েছে বলে প্লেনটার ইঞ্জিনের আওয়াজ নিচে আসছে না। পাতলা মেঘের পর্দা রয়েছে, তার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে সেটা–তাই কারও দেখতে পাবার কথাও নয়।
এক মিনিট পর শুরু হলো স্মোক-স্ক্রিন টেস্ট।
এক ডজন গর্ত থেকে বিপুল বেগে বেরুতে শুরু করল ধুম্রকুণ্ডলী। মৃদু বাতাস পেয়ে ঘন গাঢ় ধোয়ারাশি গ্রাস করতে শুরু করল ধীরে ধীরে গোটা মাঠটাকে।
অস্বাভাবিক গাঢ় ধোয়া। খালি চোখে এই ধোয়ার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে কিছুই দেখবার উপায় নেই। মাঠের এক প্রান্তে সরিয়ে নেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র। দলটিকে। গ্যাস মাস্ক পরবার নির্দেশ পেয়ে সবাই পরে নিয়েছে ইতিমধ্যে। দলটির দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে ধোয়া রাশি। মাঠের ঘাস থেকে প্রায় তিন-চার মানুষ উঁচু ধোয়া। অফিসাররা আর্ম সিগন্যাল দিলেন। দুইশো সেনার দলটি মার্চ করে এগিয়ে যেতে শুরু করল।
সেনাদের প্রথম সারিটা স্মোক-স্ক্রিনের ভিতর দিয়ে সফলতার সাথে মার্চ করে বেরিয়ে গেল। পর্যবেক্ষক হাই কমাণ্ড লক্ষ্য করলেন ধোয়ার ভিতর দিয়ে মার্চ করে বেরিয়ে যেতে সৈন্যদের পনেরো মিনিট সময় লাগল। পরীক্ষা নিখুঁতভাবে সফল
৯২
ভলিউম ১৭
হয়েছে। সেনাদের লাইন একটুও বাকা হয়নি। কেউ পিছিয়ে পড়েনি বা সামনে এগিয়ে যায়নি। বোঝা যাচ্ছে ধোয়া যত গাঢ়ই হোক, চশমাটা খুবই কাজের জিনিস হয়েছে, পরিষ্কার সবকিছু দেখা যায় ধোয়ার ভিতর থেকেও।
অফিসাররা দ্রুত সঙ্কেত দিলেন আবার। ঘুরে দাঁড়াল সেনাদল। আবার মার্চ করে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। স্মোক-স্ক্রিনে প্রবেশ করার জন্য।
এরপরই ঘটল ভয়ঙ্কর ঘটনাটা।
এমন ভাবে ঘটতে শুরু করল যে তা বর্ণনা করা প্রত্যক্ষদর্শীদের পক্ষেও কঠিন। প্রথমে তাদের মনে হলো, চলমান ছবির মত সবকিছু নড়ে উঠল। শোক-স্ক্রিন, অমন প্রকাণ্ড প্রুভিং গ্রাউণ্ড এবং যাবতীয় সবকিছু যেন পিছন দিকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। মনে হলো, সিনেমা দেখছে তারা, দৃশ্যটা ফেডআউট হয়ে যাচ্ছে। যেন ক্যামেরা অকস্মাৎ পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে–ক্লোজআপে দৃশ্যটা দেখছিল তারা, এখন দূরবর্তী কোন দৃশ্য দেখছে যেন।
কয়েকজন অফিসার ব্যাপারটা কি বুঝতে না পেরে এক ঝটকায় নামিয়ে ফেললেন চোখ থেকে ফিল্ড-গ্লাস। কিন্তু খালি চোখেও সেই একই দৃশ্য। সব কিছু কেমন দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে যেন।
| পরমুহূর্তে বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলেন অফিসাররা। তাদের সামনে অপ্রত্যাশিত আতস বাজির খেলা শুরু হয়ে গেল। মাঠের প্রায় পঞ্চাশ ফুট উপরে শুরু হলো আতস বাজির সেই খেলা। মাঠের উপর সর্বত্র চলল আলোক উৎসব। অসংখ্য লক্ষ লক্ষ নীল আর লাল আলোক বিন্দু ভাসছে মাঠের উপর। স্মোক-স্ক্রিন প্রায় ঢাকা। পড়ে গেছে আলোক বিন্দুতে। স্মোক-স্ক্রিনের ভিতর সেনাদলটিকে দেখাই যাচ্ছে।
।
অপ্রত্যাশিত এবং ব্যাখ্যার অতীত না হলে দৃশ্যটা সত্যি উপভোগ্য হতে পারত।
অদ্ভুত আলোক বিন্দুগুলো আগুনের ফুলকির মত স্মোক-স্ক্রিনকে চারদিক থেকে ঘিরে চর মারছে বিদ্যুৎ বেগে। ছোট ছোট আগুনের বর্শা যেন এক একটা।
| একজন জেনারেল গর্জে উঠলেন। অফিসাররা ছুটলেন যানবাহনের দিকে। যানবাহন স্টার্ট নিয়ে ছুটল প্রুভিং গ্রাউণ্ডের দিকে ।.
‘ মাঠের মাঝখানে পৌঁছুতে কয়েক মিনিট লেগে গেল। আলোক বিন্দু বা আগুনের ফুলকি, যাই হোক সেগুলো ইতিমধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। স্মোক-স্ক্রিন তেমনি আছে মাঠের মাঝখানে-গাঢ় এবং ঘন। যোয়ানরা এখনও তার ভিতরে। তাদের দেখা যাচ্ছে না বাইরে থেকে।
তৎপরতা শুরু হলো। অফিসাররা নির্দেশ দিতে লাগলেন। টেকনিশিয়ানরা নির্দেশ পেয়ে প্রকাণ্ড আকারের বিদ্যুৎচালিত পাখার সুইচ অন করল। গো গো আওয়াজ তুলে ঘুরতে শুরু করল পাখাগুলো। | পাখার তীব্র বাতাসে স্মোক-স্ক্রিন ভাঙতে শুরু করল। দেখতে দেখতে ধোয়ারাশি সরে গেল মাঠের উপর থেকে।
* এতক্ষণে দেখতে পাওয়া গেল দুইশো সেনানীর দলটিকে। তারা এখন আর
কুয়াশা ৫১
মার্চ করছে না। দুইশো সেনা হাত পা ছড়িয়ে অসহায় ভঙ্গিতে পড়ে আছে ঘাসের উপর। কেউ কেউ গ্যাস-মাস্ক খুলে ফেলেছে। বেশির ভাগ সেনাকে দেখা গেল গলায় হাত দিয়ে পড়ে আছে।
| খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে এল অ্যাম্বুলেন্স গাড়িগুলো। বিমূঢ় ডাক্তাররা পরীক্ষা করতে শুরু করলেন সৈন্যদের।
| মাত্র কয়েকজন সেনাকে বাঁচানো সম্ভব হলো। সর্বমোট সাতজন। একশো তিরানব্বই জনই মারা গেছে। তাদেরকে বাঁচাবার কোন রাস্তাই আর নেই।
মত সেনাদের কারও শরীরে কোন রকম ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেল না। আগুনের সংস্পশে মারা গেছে তারা তাও প্রমাণিত হলো না। কারও জামা-কাপড় বা তুক, পোড়েনি।
| যারা বেঁচে গেছে তারাও বিশেষ কিছু বলতে পারল না। তাদের সাতজনেরই বক্তব্য এক রকম। হঠাৎ তারা টের পায়, শ্বাস নিতে পারা যাচ্ছে না, আশপাশে কোথাও বাতাস নেই যেন। এর বেশি মনে করতে পারছে না কেউ।
এর বেশি আবিষ্কার করা সম্ভব হলো না মেডিক্যাল এবং ল্যাবরেটরির কর্মীদের পক্ষেও। রাতের বেলা তাদের রিপোর্টে তারা জানাল মৃত্যুর কারণ : অক্সিজেনের অভাব।
এক্সপেরিমেন্টে যে ধোয়া ব্যবহার করা হয়েছে তা পরীক্ষা করা হলো পুংখানুপুংখভাবে। রিপোর্টে দেখা গেল ধোয়াটা সব রকম বিষমুক্ত গ্যাস-মাস্ক ছাড়াও ক্ষতিকর নয়। মাস্কগুলোও পাঠানো হলো ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার জন্য। না, মাস্কগুলোও নির্দোষ।
টেলিগ্রাম বেরুল সন্ধায়।-সংবাদপত্রে বড় বড় কলামে মর্মন্তুদ কাহিনীটা ছাপা হলো। হৈ-চৈ পড়ে গেল দেশময়। একটি সংবাদপত্র প্রশ্ন উত্থাপন করল এটা কি কোন রাষ্ট্রের শত্রুতামূলক আক্রমণ?
| সামরিক বাহিনীর অফিসাররাও বসে নেই। তারাও সেনাদের মৃত্যুর কারণ আবিষ্কার করলেন। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হলো সেনাদের মৃত্যুর কারণ।
কারণটা সত্যি অবিশ্বাস্য।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে গোপন বৈঠক শুরু হয়েছে। বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়ে গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার মি. সিম্পসনও যোগ দিয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা চলছে সেখানে।
| অফিসাররা টিকেট ব্ল্যাকার মনির বা অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমানের হত্যা রহস্য সম্পর্কে কিছুই জানতেন মা। মোখলেসুর রহমান ভয়ঙ্কর একটা ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন, সে সম্পর্কেও তারা অবগত ছিলেন না। সমস্যার প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে কারও কোন অজ্ঞতা নেই। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি তা সত্ত্বেও গোটা পরিস্থিতিটা বর্ণনা করলেন গোড়া থেকে।
আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আর্মি ইন্টেলিজেন্স ব্ৰঞ্চ এবং সরকারী গোয়েন্দা বিভাগ মিলিতভাবে এই সমস্যার সমাধান বের করার জন্য কাজ
৯৪
ভলিউম ১৭
করবে। আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে সমস্যাটা যেহেতু বৈজ্ঞানিক সমস্যা, সেইহেতু একজন বিজ্ঞানীর সাহায্য নেয়া হবে।
প্রখ্যাত বিজ্ঞানীকে হতে পারে সে?
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি প্রস্তাব দিলেন, আমার মনে হয় কুয়াশার সাহায্য চাইতে পারি আমরা। কুয়াশা শুধু বিজ্ঞানী নয়, বিশ্বের জীবিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম সে। তার মত প্রতিভাবান কেমিস্ট আর দ্বিতীয়টি নেই।’
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? কুয়াশা বিজ্ঞানী হলেও সে সৎ নাগরিক নয়। একজন অপরাধীর কাছে আমরা-সাহায্য চাইতে পারি না।’
একজন জেনারেল জানতে চাইলেন, তার অপরাধটা কি?’
মি. সিম্পসন একটু আমতা আমতা করে বললেন, ‘অপরাধ অনেক। তবে, আমরা আজ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ খাড়া করতে পারিনি। বড় বুদ্ধিমান সে। অপরাধ করে সে ঠিকই, কিন্তু পিছনে কোন প্রমাণ কখনও রেখে যায় না। সে যাই হোক, উপর থেকে হুকুম আছে আমার প্রতি, সুযোগ পেলেই তাকে বন্দী করবে। আগে বন্দী করতে হবে, প্রমাণ পরের কথা।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি বললেন, শুনেছি কুয়াশা শুধু বড় বিজ্ঞানীই নয়, তার মত বুদ্ধিমান, তার মত দুঃসাহসী মানুষও নাকি হয় না। আমরা যে বিপদে পড়েছি সেই বিপদ থেকে হয়তো কুয়াশাই একমাত্র আমাদের উদ্ধার করতে পারে। মি. সিম্পসন, কুয়াশার বিরুদ্ধে যখন কোন প্রমাণই নেই, তখন আর খামোকা। তাকে বিরক্ত করার কোন মানে হয় না। আগে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করুন, তারপর তাকে অভিযুক্ত করুন। আমি বলি কি।’ ..
| মি. সিম্পসন বললেন, তার উপর থেকে গেফতারী পরোয়ানা তুলে না নিলে সে সাহায্য করতে রাজি হবে না।’
সেক্রেটারি বললেন, আমি আপনার বসের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব। মি. সিম্পলন, আপনি কুয়াশার সাথে যোগাযোগ করুন। তাকে জানিয়ে দিন, পুলিস বা
গোয়েন্দা বিভাগ তাকে বিরক্ত করবে না। | মি. সিম্পসন বললেন, বর্তমান বিপদটা কেটে না যাওয়া পর্যন্ত। ঠিক আছে, খবরটা যাতে ওর কাছে পৌঁছোয় সে ব্যবস্থা করছি আমি। ও কখন কোথায় থাকে তা কেউ বলতে পারে না কিন্তু ওকে সংবাদ দেয়ার একটা কৌশল জানা আছে আমার।’
খুলনা শহরের তিনতলা একটা বাড়ির ড্রয়িংরূমে ইংরেজি পত্রিকার উপর চোখ বুলাচ্ছে ডি. কস্টা। পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কুয়াশা। ঢাকা থেকে কয়েক হাত ঘুরে সরকারী গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চ পদস্থ অফিসার মি. সিম্পসন শেষ পর্যন্ত পেয়েছেন ওকে ফোনে। তার সাথে কথা বলছে সে।
মিনিট সাতেক পর ফোন ছেড়ে দিল কুয়াশা। কালো সিল্কের আলখেল্লার পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে মেঝেতে পায়চারি শুরু করল সে। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে রয়েছে। কুয়াশা ৫১
দীর্ঘ ঋজু, বিশাল লোকটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল ডি. কস্টা। তারপর উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখের চেহারা। বলল, কে ফোন করিয়াছিল টাহা আমি বলিটে না পারিলেও কেন ফোন করিয়াছিল টাহা হামি বলিয়া ডিটে পারি, বস্। আজকে আফটারনুনের সময় হামাডের সোলজাররা মারা গিয়াছে, ওয়ান হানড্রেড অ্যাণ্ড নাইনটি খ্রী মেন•••।’
| পায়চারি থামিয়ে সবেগে ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। বলল, সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা সৈন্যদের মৃত্যুর কারণ জানতে পেরেছে, মি. ডি. কস্টা।
ভেরি গুড। কারণটা কি? ‘লোকগুলো মারা গেছে কিন্তু গ্যাস, আগুন, বিষ বা অন্য কোন পরিচিত অস্ত্রের আক্রমণে নিহত হয়নি তারা। বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত যে ব্যাপারটা দুর্ঘটনা নয়। সম্পূর্ণটাই আসলে পূর্ব পরিকল্পিত। একটা ষড়যন্ত্র।’
অস্থিরভাবে আবার পায়চারি করতে শুরু করল কুয়াশা।
তিন
সেনাদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সামরিক দফতরের মতামত পরদিন সকালের খবরের কাগজে ছাপা হলো। সাংবাদিকরা ছুটল বিজ্ঞানীদের কাছে। বিজ্ঞানীরা তাদের যে যার নিজস্ব মতামত দান করলেন। অধিকাংশই বললেন যা ঘটেছে তা এক কথায়
অভূতপূর্ব, সেনারা মারা গেছে কিভাবে তা তারা বুঝতে অক্ষম। | সামরিক হাই কমাণ্ড থেকে নির্দেশ দেয়া হলো দেশের সবগুলো আর্মি পোস্টে, অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বনের জন্য। বলা যায় না, যে কোন সময় যে কোন স্থানে পরবর্তী আক্রমণ হতে পারে।
প্রতিবেশি এবং এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রেও খবরটা তুমুল হৈ-চৈ-এর সৃষ্টি করল। বহু রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চকে নির্দেশ দেয়া হলো বাংলাদেশে গুপ্তচর পাঠিয়ে রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ আবিষ্কার করার জন্য। | সারা পৃথিবীতে কুয়াশার সুনাম ছড়িয়ে আছে। বহু ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের বাংলাদেশস্থ স্পাইকে নির্দেশ দেয়া হলো কুয়াশা এবং তার সহকারী ও বন্ধু বান্ধবদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে।
নির্দেশ পেয়ে বিদেশী স্পাইরা ছুটল। কিন্তু হা হতোস্মি। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী কুয়াশা খুলনায় ছিল। স্পাইরা তার আস্তানায় সন্ধান নিতে গিয়ে বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে গেল। আস্তানা শূন্য, কুয়াশা বা তার সহকারীরা সেখানে
নেই।
| এদিকে মি. সিম্পসন খবর পেলেন কুয়াশার কাছ থেকে। কুয়াশা হোটেলের নাম বলে সেখানে ছদ্মবেশে পৌঁছুতে বলল তাঁকে। পথে তিনি রাসেলকে গাড়িতে তুলে নেবেন। কুয়াশা রাসেলকেও ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিয়েছে।
মি, সিম্পসন যখন রাসেনের বাড়িতে পৌঁছুলেন তখন সকাল সাড়ে নয়টা। মি. সিম্পসন দাড়িওয়ালা বোম্বাইয়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ নিয়েছেন।
৯৬
ভলিউম ১৭
কলিংবেল টিপতে দরজা খুলে দিল এক যুবতী মেয়ে। রাসেলকে গিয়ে বলো মি. সিম্পসন এসেছেন।
মেয়েটি সুন্দরী। মি. সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল সে। বলল, ড্রয়িংরুমে এসে বসুন।
| ড্রয়িংরূমে ঢুকলেন মি. সিম্পসন। বসলেন সোফায়। মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘ দেখে তিনি বললেন, রাসেল কি…?
| মেয়েটি হেসে উঠল। বলল, “চিনতে পারছেন না আমাকে তাহলে? সত্যি কি এতই নিখুঁত হয়েছে ছদ্মবেশটা?
মাই গড, তুমি রাসেল!
রাসেল বলল, কুয়াশার ফোন না পেলে আমিও কিন্তু বুঝতে পারতাম না আপনিই মি. সিম্পসন। চেনাই যাচ্ছে না আপনাকে।
মি. সিম্পসন ঘড়ি দেখলেন। বললেন, “চলো, দেরি করে লাভ কি?’
রাসেল বলল, চলুন। ভাল কথা, শহীদ আর কামাল ভাইয়ের খবর কি? ওঁরা কি নেপাল থেকে ফিরেছেন?
মি. সিম্পসন সোফা ত্যাগ করতে করতে বললেন, কুয়াশা ওদেরকে ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়েছে কাল রাতেই। আজকের ফার্স্ট ফ্লাইটেই ঢাকা এয়ারপোর্টে নামবে ওরা।
গাড়িতে এসে উঠল দুজন।
রাসেল বল, এবারের বিপদটা খুবই ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে। কুয়াশাদ সবাইকে। নিয়ে এই বিপদের মোকাবিলা করার কথা ভাবছেন। এর আগে এমন হয়নি কিন্তু।
হোটেলের সামনে গাড়ি থেকে নামল ওরা। ‘কেউ ফলো করেনি, রাসেল বলল।
, ফলো করেনি। কিন্তু হোটেলের লবিতে বেটে একজন লোক বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল, সে কাগজের আড়াল থেকে ঠিকই লক্ষ্য করল মি. সিম্পসন
ও রাসেলকে। মুচকি হাল লোকটা।
লোকটার চেহারার মধ্যে কোন বৈশিষ্ট্য নেই। পোশাকও সাধারণ লোকের মত। উল্লেখযোগ্য বিষয় শুধু একটিই, লোকটার কব্জিতে বেল্ট দিয়ে আটকানো হাতঘড়িটা অস্বাভাবিক বড়। মি. সিম্পসন এবং রাসেল হোটেলের এলিভেটরে ঢুকতেই সে তার হাতঘড়ির দম দেবার বোতামটা দ্রুত ঘোরাতে শুরু করল।
কয়েক মিনিট পর হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল প্রকাণ্ড একটা কালো অক্সফোর্ড মরিস। ড্ডারম্যান ছুটে এল কোন সম্মানীয় অতিথি এসেছেন নিশ্চয়ই। ডোরম্যান গাড়ির দরজা খুলে ধরে নিখুঁত ভঙ্গিতে স্যালুট মারল। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একজন নিগ্রো। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ, পরনে সাদা গ্যাবার্ডিনের স্যুট, হাতে ওয়াকিং স্টিক। দেখে মনে হয় আফ্রিকান কোন রাষ্ট্রের অ্যামব্যাসাডর বা প্রিন্স।
দৃঢ় পা ফেলে সুইং ডোর ঠেলে হোটেলে প্রবেশ করল নিগ্রো লোকটা।
লবিতে তখনও বসে আছে সেই বেঁটে লোকটা। তখনও সে খবরের কাগজ
৭-কুয়াশা ৫১
১৭
পড়ার ভান করছে। খবরের কাগজের আড়ালে মুখ লুকিয়ে আসলে সে লক্ষ করছে হোটেলে কে ঢুকছে, কে বেরিয়ে যাচ্ছে।
নিগ্রো লোকটা লবিতে ঢুকতেই বেঁটে লোকটার চোখ দুটো কুঁচকে উঠল। পরমুহূর্তে সবজান্তার মত হাসল সে। নিগ্রো ইতিমধ্যে এলিভেটরে উঠে গেছে। | বেটে লোকটা আবার তার কব্জিতে বাধা অস্বাভাবিক বড় আকারের হাতঘড়ির দম দেবার বোতামটা ঘোরাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে চেহারাটা গম্ভীর হয়ে উঠছে তার।
নিগ্রো লোকটার ছদ্মবেশ ধরতে অসুবিধে হয়নি তার। কুয়াশার বিশিষ্ট সহকারী স্যানন ডি. কস্টা কালো ভূত সেজে এনে কি হবে, তার রোগা পাতলা শরীর এবং হাঁটার ভঙ্গি দেখেই সে তাকে চিনে ফেলেছে।
প্রখ্যাত ডিটেকটিভ শহীদ খান এবং তার সহকারী কামাল গত হপ্তায় নেপালে গেছে, রাজ পরিবারের একটি গুপ্তধনের নকশা উদ্ধার করে দেবার অনুরোধ পেয়ে। নকশাটার মূল্য কয়েক কোটি টাকা, সেটা চুরি গেছে দিন পনেরো আগে।
নকশা উদ্ধারের কাজ শেষ করে অর্থাৎ নকশাটা উদ্ধার করে রাজার হাতে সেটা তুলে দিয়ে ওরা নেপালে ভূ-সৌন্দর্য অরলোকনের জন্য আরও কটা দিন কাঠমুণ্ডুতে থাকার কথা ভাবছিল। রাজ পরিবারের সদস্যরাও ওদেরকে ছাড়তে চাইছিল না। তাদের অতিথি হয়ে আরও বেশ কিছুদিন থেকে যাবার জন্য অনুরোধ করছিল ওদেরকে। এমন সময় কুয়াশার মেসেজ পেল শহীদ।
| কুয়াশা ডাকছে, সুতরাং সবকিছু ভুলে ছুটতে হয়। সকালের ফ্লাইটেই রওনা হলো ওরা ঢাকার উদ্দেশে।
কুয়াশা মেসেজে জানিয়েছিল ওদেরকে খুব সাবধানে ঢাকায় নামতে হবে, যাতে কেউ ওদেরকে চিনতে না পারে। | ছদ্মবেশ নিতে ভুল করেনি ওরা। কিন্তু শুধু ছদ্মবেশ নিয়ে ওরা নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। | ঢাকার উদ্দেশে প্লেন কাঠমুণ্ডু এয়ারপোের্ট থেকে আকাশে ওড়ার বিশ মিনিট পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিল ওরা।
শহীদ এবং কামাল, দুজনেই, গুরুতর রকম অসুস্থ হয়ে পড়ল। ছুটে এল দু’জন স্টুয়ার্ড। একজন একটু পরই ক্যাপ্টেনকে গিয়ে খবর দিল দু’জন প্রৌঢ় নেপালীঃ ব্যবসায়ী ফুড পয়জনিংয়ের শিকার হয়ে পড়েছেন। একজনের জ্ঞান নেই, আর একজন কোনমতে কথা বলতে পারছেন।
ছুটে এলেন স্বয়ং ক্যাপ্টেন। স্টুয়ার্ডদের নির্দেশ দিলেন বোগীদেরকে বমি করাবার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু বয়স্ক নেপালী ব্যবসায়ী, যে তখনও জ্ঞান হারায়নি, বলল, বমি তো আমরা আগেই করেছি। আমার বমি হবেও না, সে চেষ্টা করে লাভ নেই। আপনি ঢাকা এয়ারপোর্টে ওয়্যারলেসে খবর পাঠান, যেন অ্যাম্বুলেন্স তৈরি থাকে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে আমাদেরকে। পাম্প করে পেটের ভেতর যা কিছু আছে সব বের করতে পারলেই বাঁচব, নয়ত•••।’
৯৮
ভলিউম ১৭
.
.-.—
ক্যাপ্টেন তৎক্ষণাৎ ছুটলেন ওয়্যারলেসে ঢাকা এয়ারপোর্টকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে।
. কয়েক মিনিট পর প্লেন নামল ঢাকা এয়ারপোর্টে। অ্যাম্বুলেন্স তৈরিই ছিল। স্ট্রেচারে করে নামানো হলো নেপালী ব্যবসায়ী দুজনকে প্লেন থেকে। অ্যাম্বুলেন্সে শুইয়ে দেয়া হলো দুজনকে। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় নেপালীও জ্ঞান হারিয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্স তীরবেগে ছুটে চলল হাসপাতালের দিকে। অ্যাম্বুলেন্সটা দুই ভাগে বিভক্ত। সামনের দিকে ড্রাইভিং সীট। যেখানে বসেছে ড্রাইভার এবং একজন মেল নার্স। ওদের পিঠের কাছেই পার্টেক্সের দেয়াল। ওদিকে দুটো রেডে শুয়ে আছে দুই
নেপালী ব্যবসায়ী। ওদের সাথে রয়েছে একজন ফিমেল নার্স।
ফিমেল নার্স ঘুমিয়ে পড়ল। কেন, কিভাবে ঘুম পেল তার, তা সে পরে ব্যাখ্যা করে বলতে পারেনি। নেপালী ব্যবসায়ীদ্বয় অর্থাৎ শহীদ ও কামাল অবশ্য বলতে পারত, কিন্তু ফিমেল নার্সের ঘুম যখন ভাঙল তখন অ্যাম্বুলেন্সের ভিতর দুজনের একজনও নেই। চলন্ত গাড়ি থেকে কখন যে ওরা নেমে গেছে তা কেউ টেরই পায়নি।
ছোট্ট একটা ক্যাপসুল পকেট থেকে বের করে ফাটিয়ে দিয়েছিল শহীদ। ক্যাপসুল থেকে অদৃশ্য গ্যাস বের হওয়ায় সেই গ্যাস নার্সের শ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করে। গ্যাসটা ছিল ঘুমপাড়ানিয়া। ফলে সাথে সাথে গভীর ঘুমে ডুবে যায় নার্স। শহীদ ও কামাল দম বন্ধ করে রেখেছিল, তাই ওরা ঘুম পাড়ানিয়া গ্যাসে আক্রান্ত হয়নি।,
অ্যাম্বুলেন্স ট্রাফিক জ্যামের জন্য পথিমধ্যে একবার থামতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে নেমে পড়ল ওরা। কাছেই পাওয়া গেল একটা ট্যাক্সি, সেটায় চড়ে বসল দুজন। ট্যাক্সি ছুটে চলল শহরের প্রথম শ্রেণীর একটি হোটেল অভিমুখে।
সবাই একত্রিত হয়েছে ওরা। নেপালী ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে শহীদ ও কামাল, সুন্দরী যুবতীর ছদ্মবেশে রাসেল, দাড়িওয়ালা বোম্বাইয়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে মি. সিম্পসন, নিগ্রোর ছদ্মবেশে ডি, কস্টা।
হোটেলের রূম কুয়াশা আগেই ওদের জন্য রিজার্ভ করে রেখেছিল ফোনে। সবাই এখন অপেক্ষা করছে। কুয়াশা যেকোন মুহূর্তে পৌঁছে যাবে। রাজকুমারী ওমেনাও সম্ভবত তার সাথেই আসবে। | মি. সিম্পসন বর্ণনা করছিলেন গত বিকেলে প্রুভিং গ্রাউন্ডের মর্মান্তিক ঘটনার কথা। এমন সময় নক হলো দরজায়।
দরজা খুলে দিল নিগ্রো-অর্থাৎ ডি, কস্টা। হোটেলের উর্দি পরা বেলবয় বরফ দেয়া পানি নিয়ে এসেছে। ডি. কস্টা জানত না ঠাণ্ডা পানির অর্ডার কে দিয়েছিল। কথা না বলে রূমের মাঝখানে ফিরে এসে সকলের সাথে আলোচনায় যোগ দিল
সে।
| বেলবয় বরফ দেয়া পানির পাত্রটা রাখল টেবিলের উপর। তোয়ালে দিয়ে আসবাবপত্রের উপর জমা ধুলো সাফ করে কয়েক মুহূর্ত পর বেরিয়ে গেল সে। কুয়াশা ৫১
৯৯
কেলবয়টা বয়সে ছোকরাই বলা চলে, বড় জোর বিশ বাইশ বছর বয়েস হবে। বেঁটেই বলা চলে তাকে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, তার হাতের কব্জিতে বেল্ট দিয়ে আটকানো হাতঘড়িটা অস্বাভাবিক বড়।
ডা. মনসুর আলি ওরফে কুয়াশা ঢাকায় পৌঁছুল সকাল সাড়ে ন’টায়। খুলনা থেকে যশোরে মোটরসাইকেলে, যশোর থেকে ঢাকায় এরোপ্লেনে।
| যশোর থেকে আগত প্লেন থেকে নামল একজন অধর্ব জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ। বৃদ্ধ আবার অন্ধ। দুটো চোখে ছানি পড়েছে তার। নিখুঁত, সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছদ্মবেশ। কুয়াশার। তার সাথে রয়েছে উনিশ বছরের স্বাস্থ্যবান একটি যুবক। বুদ্ধের সন্তান সে। বলাই বাহুল্য, যুবকের ছদ্মবেশে এ হলো রাজকুমারী ওমেনা।
বৃদ্ধের হাত ধরে প্লেন থেকে নেমে এল যুবক। ধীরে ধীরে হাঁটছে ওরা। হাঁটতে হাঁটতে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়াল, রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি গাড়ি। গাড়িটা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। যুবক বৃদ্ধের হাত ধরে সেই গাড়ির দিকে এগোল।
| রাস্তার ওপারে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটাকে অস্বাভাবিক চঞ্চল দেখাচ্ছে। কোন ব্যাপারে সে যেন ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছে, যেন মনস্থির করতে পারছে না। একবার মনে হলো, রাস্তা পেরিয়ে ছুটে আসবে সে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গাড়ির দিকে। কিন্তু মনস্থির করার আগেই বৃদ্ধ এবং যুবক গাড়ির ভিতর উঠে বসল। তাদের পিছন পিছন আসছিল একজন লোক। সে-ও। উঠল গাড়িতে। সাথে সাথে স্টার্ট নিয়ে ছুটতে শুরু করল লাল টয়োটা গাড়িটা।
| গাড়ির শোফার ছাড়া সামনের সীটে আর কেউ নেই। সামনের এবং পিছনের সীটের মাঝখানে একটি কাঁচের পর্দা, খুঁটিয়ে না দেখলে সেটার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না।
পিছনের সীটে বৃদ্ধের ছদ্মবেশে কুয়াশা, মাঝখানে সরকারী গোয়েন্দা দফতরের একজন গুপ্তচর, অপর জানালার পাশে যুবকের ছদ্মবেশে রাজকুমারী ওমেনা বসেছে।
তীরবেগে ছুটে চলেছে টয়োটা।
অকস্মাৎ গাড়ির পিছনের অংশে আগুনের ফুলকির মত নীল এবং লাল আলোক বিন্দু দেখা গেল। অসংখ্য আলোক বিন্দু ভাসছে চারদিকে। সরকারী গোয়েন্দা
ককিয়ে উঠল, চেপে ধরল দুই হাত দিয়ে নিজের গলা।
পলকের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল কুয়াশার শরীরে। দরজার নবে হাত দিয়ে ঘোরাল সেটা। কিন্তু ঘুরল না দরজা। লক আপ করী।
এমন সময় গাড়ির ড্রাইভার ঘাড় ফিরিয়ে ইনভিজিবল গ্লাসের ভিতর দিয়ে তাকাল পিছন দিকে। বাঁকা হাসি হাসল সে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল নিজের হাতঘড়ির দিকে। হাতঘড়িটা তার স্বাভাবিক আকারের চেয়ে বেশ বড়। | গোয়েন্দা ভদ্রলোক পকেট থেকে পিস্তল বের করার চেষ্টা করতে করতে চিৎকার করে উঠল, নকল। নকল ড্রাইভার!
ভলিউম ১৭
১০০
গুলি করল সে। কিন্তু মাঝখানের কাঁচের পার্টিশনে চিড় ধরল শুধু, বুলেটপ্রুফ কাঁচের আর কোন ক্ষতি হলো না। গোয়েন্দা ভদ্রলোক হঠাৎ দেহটা উঁচু করে তোলার চেষ্টা করতে গেল, কিন্তু সীটের নিচে, পাদানিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে।
দ্রুত কাজ করছিল কুয়াশা। পকেট থেকে ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে তার হাতে একটি অদ্ভুত দর্শন রিভলভার। দরজার তালায় রিভলভারের নল ঠেকিয়ে গুলি
করল সে।
* বিস্ফোরক বুলেট তালায় আঘাত খেয়ে সশব্দে ফেটে গেল। ভেঙে গেল তালা।
ঠিক সেই সময় দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠল ড্রাইভার সামনের সীট থেকে। সেই বাঁকা হাসি উবে গেছে তার মুখ থেকে। একটা দৈত্যাকার সাত টন ওজনের ট্রাক সামনের দিক থেকে তীর বেগে ছুটে আসছে। ড্রাইভারের ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল সে। সোজা ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে গাড়ি ট্রাকটাকে লক্ষ্য করে।
গুলি করে এই সময় দ্বিতীয় দরজার তালা ভেঙে ফেলল কুয়াশা। রাজকুমারী ওমেনা সেই দরজা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছুটন্ত গাড়ি থেকে।
গাড়ির ড্রাইভার লাফ মারল ট্রাকের সাথে গাড়ির ধাক্কা লাগার ঠিক এক। সেকেণ্ড আগে।
চোখের পলকে,ভয়ঙ্কর একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। টয়োটা গাড়িটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে কিম্ভুতকিমাকার আকার ধারণ করল। ট্রাকটা টয়োটাকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেল ডানদিকের একটি পাঁচিলের দিকে, সেখানে চেপে ধরুল সে টয়োটাকে পঁচিলের সাথে।
টয়োটা ভেঙেচুরে একাকার। ওটার ভিতরে কেউ থাকলে তার পক্ষে বেঁচে যাওয়া অনূভব। হাড়, মাংস, রক্ত-সব একত্রিত হয়ে মণ্ড হয়ে যাবার কথা।
কিন্তু কুয়াশা ছিল না টয়োটায়। ড্রাইভার যখন গাড়ির বাইরে লাফিয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময়ই কুয়াশাও গোয়েদার অচেতন দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে লাফ দেয় রাস্তায়।
| সংঘর্ষের শব্দ তখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। রাস্তার উপর দিয়ে সবেগে ছুটে গেল একটা ট্যাক্সি। ট্যাক্সির ব্যাক সীটে বসে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটি যুবতী। এই মেয়েটিই খানিক আগে দাঁড়িয়েছিল এয়ারপোর্টের সামনের রাস্তায়।
চার
ছুটন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় লাফিয়ে ভারসাম্য রক্ষার জন্য কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে সিধে হয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। গোয়েন্দাকে তখনও সে কাঁধের উপর ধরে রেখেছে এক
সিধেয়েদাহ সাথে লোকে লোদিকে কুয়াশা দ্রুত
দুর্ঘটনাটা ঘটার সাথে সাথে লোকে লোকারণ্য রাস্তার চারদিক থেকে শশারগোল শুরু হয়ে গেল। সবাই ছুটে আসছে এদিকে। কুয়াশা দ্রুত তাকাল,
কুয়াশা ৫১
১০১
এদিক ওদিক। একটা ট্যাক্সি থামল সজোরে ব্রেক কষে তিন-চার গজ দূরে। ডাইভার জানালা দিয়ে মুখ বের করে আর সকলের মত দেখার চেষ্টা করছে দুর্ঘটনার ফলে ক’জন লোক মরেছে বা আহত হয়েছে। হঠাৎ সে চমকে উঠে পিছনের দিকে তাকাল। ট্যাক্সির দরজা খুলে কে যেন ভিতরে উঠছে।
কুয়াশা ট্যাক্সিতে উঠে বসেছে। ড্রাইভার তাকাতেই বলল, ক্যান্টনমেন্ট। জলদি!
কুয়াশার কণ্ঠস্বরে এমনই একটা জরুরী তাগাদার ভাব ছিল যে ড্রাইভার কোন বাক্যব্যয় না করেই ছেড়ে দিল ট্যাক্সি।
কুয়াশা গোয়েন্দা প্রবরকে পাশের সীটে বসিয়ে দিয়েছে। এইমাত্র বাকশক্তি ফিরে পেয়েছে সে, কেউ আপনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল।
জবাব দিল না কুয়াশা।
আপনার সহকারী যুবকটা গেল কোথায়?’ গোয়েন্দাকে উদ্বিগ্ন দেখাল।
মৃদু হাসল কুয়াশা। বলল, ওর জন্য চিন্তা করবেন না । নিজেকে রক্ষা করার। যোগ্যতা ওর আমাদের চেয়ে কম নয়।
কিন্তু ব্যাপারটা কিভাবে ঘটল বলুন তো? গ্যাসের কোন রকম গন্ধ পাইনি আমরা। কি এমন হলো যার ফলে অমন জ্ঞানহারা হয়ে পড়েছিলাম?’..
কুয়াশা বলল, জিনিসটা যাই হোক, সাথে সাথে প্রভাবিত করে না কাউকে। সেজন্যেই বেঁচে গেছি আমরা এ যাত্রা।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারির সাথে কথা বলার সময়ও ঘটনাটা সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা দিল না কুয়াশা।
সেক্রেটারি বললেন, আমি আশা করেছিলাম ঢাকায় আপনার উপস্থিতি সম্পর্কে কেউ জানতে পারবে না। ঢাকায় আপনি পদার্পণ করার সাথে সাথে চেষ্টা করা হলো আপনাকে হত্যা করার তার মানে, শত্রুরা আপনার গতিবিধি সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখছে। এই ঘটনার ফলে প্রমাণ হয়ে গেল শত্রুপক্ষ শুধু বুদ্ধিমানই নয়, মহাশক্তিশালী। তাদের সংগঠন খুবই মজবুত।
কুয়াশা বলল, “ঠিক। বিরাট একটা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হবে আমাদেরকে।
সেক্রেটারির মুখ গম্ভীর থমথমে হরে উঠল, নানারকম গুজব ছড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে গুজবগুলো একেবারে মিথ্যে নয়।’
কুয়াশা কথা না বলে তার যাদুকরি চোখের দৃষ্টি ফেলাল সেক্রেটারির দিকে।
সেক্রেটারি বলতে শুরু করলেন, ‘অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য সব গুজব। এইসব গুজবের সাথে আমাদের সেনাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সম্পর্ক কতটুকু তা আমি জানি না। কিন্তু একের পর এক এমন সব ঘটনা ঘটছে যে দেখেশুনে মনে হচ্ছে সম্পর্ক নিশ্চয়ই একটা কিছু আছে।
বলে যান।’ আমরা শুনতে পাচ্ছি, এমন একটা যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে যার বিরুদ্ধে কোন
১০২
ভলিউম ১৭
ব্যবস্থাই নাকি টিকতে পারবে না। কে এর আবিষ্কারক, কাদের দখলে এটা আছে তা জানা যাচ্ছে না। এই ভয়ঙ্কর অস্ত্রের ক্ষমতা নাকি কল্পনারও অতীত। আমাদের গোটা সেনাবাহিনী এবং নাগরিক প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারে কয়েক মিনিটের মধ্যে।
কুয়াশাকে শান্ত দেখাচ্ছে।
বলল, আর্মি প্রুভিং গ্রাউণ্ডে যে হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে তা দেখে আর কোন সন্দেহ থাকে না যে ওই ধরনের কোন অস্ত্র সত্যিই আবিষ্কার হয়েছে।’
সেক্রেটারি ঢোক গিলে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু অস্ত্রটা কি বা কি রকম তা আমরা জানি না। আমাদের সেনারা কিভাবে মারা গেছে তারও সন্তোষজনক কোন ব্যাখ্যা নেই। তারা সবাই নিহত হয়েছে, এইটুকুই শুধু জানি। আমাদের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ কাজ করছে ঠিক, কিন্তু আমরা আসলে আপনার ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করছি। রহস্যময় এবং মহাশক্তিশালী অপরাধীদের সাথে বহুবার বিশ্বের বহু স্থানে আপনি বিবাদ করেছেন এবং বিজয়ীও হয়েছেন। তাই এই বিপদে আমরা আপনার সাহায্য কামনা করছি। আপনাকে আমাদের তরফ থেকে সব রকম সহযোগিতা দেয়া হবে। সবরকম স্বাধীনতা পাবেন আপনি। আপনার নিজস্ব পদ্ধতিতে আপনি কাজ করবেন। আমরা শুধু জানতে চাই–অস্ত্রটা কি, কি তার বৈশিষ্ট্য, কেন সেই অস্ত্র আমাদের যোয়ানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলো এবং এই অস্ত্র কার দখলে আছে।
সংক্ষেপে কুয়াশা জানান, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
সেক্রেটারি বললেন, বিপদের গুরুত্ব আপনাকে বুঝিয়ে বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন গোটা জাতি কল্পনাতীত একটা সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। দেশ এবং জাতিকে রক্ষা করতে হবে আপনার। আমার মনে হয়, অতীতে আপনি যে সব শত্রুর মুখোমুখি হয়েছেন বর্তমান শত্রুপক্ষ তাদের সকলের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি ধূর্ত এবং নির্মম।’
কুয়াশা মৃদু একটু হাসল শুধু।
‘গুপ্তচররা চারদিকে সক্রিয়। বিদেশী গুপ্তচরদের কথা বলছি আমি। তারা কার হয়ে, কোন উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মাটিতে কাজ করছে তা আমরা জানি না। এর আগে মহামূল্যবান গোপন কাগজপত্র চুরি গেছে। আমরা বর্তমানে যে শত্রুর সাথে মোকাবিলা করতে যাচ্ছি সে কাজ এদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে কিনা জানি না•••।’
সেক্রেটারি মাঝপথে থামলেন। দরজা খুলে গেল সশব্দে। চেম্বারে প্রবেশ করল সরকারী গোয়েন্দা। এই লোকই এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আসার সময় কুয়াশার সাথে ছিল। উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। প্রায় চিৎকার করে ঘোষণা করল সে, টয়োটার নকল ড্রাইভারকে পাওয়া গেছে। দুর্ঘটনা ঘটার জায়গা থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে একটা পার্কের ভিতর তার মৃতদেহ আবিষ্কার করেছে পুলিস। পিস্তলের বুলেট হার্ট ভেদ করে গেছে। বুলেটটাও পাওয়া গেছে। বুলেটের মাপ দেখে বোঝা
—
।
• • •
–
—
–
—
—
কুয়াশা ৫১
১০৩
যাচ্ছে একটা .৪৫ অটোমেটিক ব্যবহার করা হয়েছে। মৃতদেহের কাছে একটি রুমাল পাওয়া গেছে, তাতে সুতো দিয়ে ইংরেজি S অক্ষরটি লেখা আছে। কারও নামের আদ্যাক্ষর, সম্ভবত।’ | কুয়াশার চোখ দুটো জুলজুল করছে। শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল সে, নিহত ড্রাইভারের কব্জিতে বড় আকারের ঘড়িটা কি পাওয়া গেছে? * হাঁ হয়ে চেয়ে রইল গোয়েন্দা কুয়াশার দিকে। তারপর বলল, ঘড়ি? কই, না। তো!’
সেক্রেটারি বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, ৪৫ পিস্তল ব্যবহার করে খুন করা হয়েছে আবার। তবে কি দুটো ঘটনার সাথে কোন যোগাযোগ আছে?
কুয়াশা মুখ তুলে তাকাল। সেই প্রশ্নবোধক, যাদুকরী দৃষ্টি তার চোখে।
সেক্রেটারি দ্রুত বলতে শুরু করলেন, নকল ড্রাইভারকে .৪৫ ক্যালিবারের বুলেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে শুনে আর এক হত্যাকাণ্ডের কথা মনে পড়ে গেল। একজন আইনবিদ মোখলেসুর রহমান, গতকাল খুন হয়েছেন তার অফিসে। তাকেও খুন করা হয়েছে ৪৫ কোল্ট অটোমেটিক দিয়ে। প্রভিং গ্রাউণ্ডের মর্মান্তিক ঘটনার খবর কাগজে ছাপা হয়, পর্যবেক্ষকরা নীল, লাল আগুনের ফুলকির মত আলোক বিন্দু দেখতে পান এ খবরও পরিবেশিত হয় এবং এই খবর পড়ে আইনবিদ মোখলেসুর রহমানের সহকারী ফোন করে। সহকারী উকিল জানায় যে মোখলেসুর রহমানও নাকি অন্য এক ধরনের অদ্ভুত আলো দেখতে পেয়েছিলেন। তার ধারণা প্রুভিং গ্রাউণ্ডের ঘটনার সাথে তার বসের হত্যা রহস্যের যোগাযোগ থাকতে পারে।’
কুয়াশা কোন কথা বলল না।
কিন্তু গোয়েন্দা প্রবর উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, আমাদের গাড়িতেও দেখা গেছে নীল, লাল আগুনের ফুলকির মত আলোক বিন্দু।
কুয়াশা উঠে দাঁড়াল।
দশ মিনিট পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বাইরে বেরিয়ে এল সে। ছদ্মবেশ ত্যাগ করেছে সে। শত্রুপক্ষ তার পরিচয় জেনে ফেলেছে, ছদ্মবেশ নেবার আর কোন মানে হয় না।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা গাড়ি নিয়ে হোটেলের উদ্দেশে রওনা হলো কুয়াশা।
অনেক পিছনে একটা লাল গাড়ি। খুব সাবধানে অনুসরণ করছে কুয়াশার গাড়িকে।
লাল গাড়িতে আরোহী মাত্র দু’জন। একজন প্রায় ছয়ফুট লম্বা। তার পোশাক আশাক খুবই দামী। অপরজনকে বেটেই বলা চলে। তার পরনেও দামী কাপড়, চোপড়।
কথা বলছিল সে-ই, বড় চিন্তার কথা, দেওজী। লোকে বলে কুয়াশা নাকি মানুষ না, যাদুকর। সেই যাদুকর লেগেছে আমাদের বিরুদ্ধে।
দেওজীর চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠল, ‘সান্তারাম, তুমি একটা ভীতুর ডিম।
১০৪
ভলিউম ১৭
আমাদের আসল পরিচয় জানা এত সহজ নয়। কুয়াশার কথা যদি বলে, আমি মনে করি, যাদুকর না ছাই! শয়তানটাকে ঘায়েল করা কোন সমস্যাই নয়, সময় সাপেক্ষ ব্যাপার মাত্র। সত্যি বটে শয়তানটাকে খতম করে দেবার জন্যে যাকে নিয়োগ করেছিলাম সে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তাতে কি! যে ব্যর্থ হয়েছে তাকে তো চরম শাস্তি দিয়েছিই, শয়তানটাকেও রেহাই দেব না। সব কাজই হবে, ধীরে ধীরে। হোটেলে কি কাণ্ড ঘটেছে ভাবো একবার। শয়তানটার সবগুলো চেলাকে সাবাড় করে দেয়া হয়েছে।’
ঠিক সেই সময় কুয়াশার গাড়ি প্রথম শ্রেণীর এক হোটেলের সামনে থামল। | পিছনের লাল গাড়িটা থামল না। হোটেলের সামনে দিয়ে সবেগে চলে গেল সেটা দেওজী এবং সান্তারামকে নিয়ে।
রিসেপশনে মুহূর্তের জন্যও থামল না কুয়াশা। কালো আলখেল্লা পরিহিত সুদীর্ঘ দেহের অধিকারী কুয়াশাকে দেখে রিসেপশনের কর্মচারীরা দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
লবিতে ঢুকল কুয়াশা। বেশ ভিড় লবিতে। সবাই সুদর্শন আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে রইল মন্ত্রমুগ্ধের মত। থেমে গেল সব কোলাহল। দৃঢ়, দীর্ঘ পদক্ষেপে এলিভেটরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কুয়াশা। লবির এক কোণায় বসে রয়েছে বেঁটে একজন লোক, খবরের কাগজ পড়ার ভান করছে সে।
কুয়াশা লোকটাকে দেখে থাকলেও তার মধ্যে কোন রকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ। করা গেল না।
কুয়াশা এলিভেটরে চড়ার পরপরই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বেঁটে লোকটা খবরের কাগজ গুটিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। লম্বা লম্বা পা ফেলে, প্রায় ছুটেই বেরিয়ে গেল সে লবি থেকে। লোকটার পালিয়ে যাবার কারণ, কুয়াশার পিছন পিছন দু’জন বলিষ্ঠদেহী লোককে লবিতে ঢুকতে দেখেছে সে। এরা সরকারী:গোয়েন্দা। কুয়াশার উপর দৃষ্টি রাখার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিযুক্ত করা হয়েছে।
“ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি কোন রকম ঝুঁকি’নিতে চান না। কুয়াশার নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য সবরকম ব্যবস্থা করতে চান তিনি। এ ব্যাপারে কুয়াশাকে কিছু জানানো হয়নি। তবে কুয়াশা সম্ভবত সবই জানতে পেরেছে।
এদিকে এলিভেটর থেকে বেরিয়ে পাঁচ তলার নির্জন করিডর ধরে এগিয়ে চলেছে কুয়াশা। তিন কামরা বিশিষ্ট একটা স্যুইট টেলিফোনে গতরাতেই রিজার্ভ করেছিল সে এই হোটেলে। সকলের উপস্থিত হবার কথা এই স্যুইটেই। সুইটের নাম্বারটাও জানা আছে কুয়াশার।
একশো একষট্টি নাম্বার সুইট। স্যুইটের কাছাকাছি এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। জোরে শ্বাস গ্রহণ করল সে। কপালে ফুটে উঠল চিন্তার রেখা। পরমুহূর্তে লাফ দিয়ে একশো একষট্টি নাম্বার- সুইটের দরজার সামনে চলে গেল সে। নব ঘুরিয়ে বুঝল, তালা বন্ধ ভিতর থেকে।
মুহূর্তের জন্যও থামল না কুয়াশা। দরজায় তালা দেয়া বুঝতে পারার সাথে সাথে কাধ ঠেকাল দরজার গায়ে, তারপর সর্বশক্তি দিয়ে চাপ দিতে লাগল.••L.
কুয়াশা ৫১
১০৫
মড়মড় করে ভেঙে গেল কবাট।
রূমের ভিতর নিঃসাড়, মৃতবৎ কয়েকটা দেহ কার্পেটের উপর বিশৃংখলভাবে পড়ে রয়েছে দেখা গেল। মৃদু একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে তখনও রূমের বাতাসে। এই দুর্গন্ধ পেয়েই করিডরে থমকে দাঁড়িয়েছিল কুয়াশা।
রূমের ভিতর ঢুকে একমুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। ক্যামেরার মত রূমের সব কিছু দেখে নিচ্ছে তার চোখ দুটো।
| ডি, কস্টা এবং কামালকে দেখা যাচ্ছে বাথরুমের দরজার কাছে চিৎ হয়ে পড়ে থাকতে। ডি কস্টার পরনে শুধু অন্তর্বাস। স্নান সেরে বাথরুম থেকে বের হওয়া মাত্র আক্রান্ত হয়েছে সে, বোঝা যায়।
রূমের মাঝখানে পড়ে আছে রাজকুমারী ওমেনা। মি. সিম্পসনকে দেখা যাচ্ছে। একটি জানালার সামনে। শহীদকে দেখা যাচ্ছে দরজার কাছে। রাসেল অপর একটি জানালার কাছে। সবাই ধরাশায়ী। প্রাণের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না কারও মধ্যে।
| আলখেল্লার পকেট থেকে একটা ক্যাপসুল বের করে মুখে পুরল কুয়াশা। ক্যাপসুলটা তার নিজেরই আবিষ্কার। যে খাবে এই ক্যাপসুল তার আর অক্সিজেন দরকার হবে না। শ্বাস গ্রহণ না করেও থাকা সম্ভব কমপক্ষে আধঘণ্টা। দুর্গন্ধ পেয়েই কুয়াশা বুঝেছে, রূমের বাতাস বিষাক্ত হয়ে গেছে–সম্ভবত মারাত্মক কোন গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে ঘরের ভিতর।
টেবিলের উপরকার কাঁচের জাগটা সবচেয়ে আগে পরীক্ষা করল কুয়াশা। পানিতে বিষ মিশিয়ে দেয়া বিচিত্র কিছু নয়। তবে পানিতে বিষ থাকলেও–ছয়জন একসাথে বিষাক্ত পানি খেয়েছে এমন হতে পারে না। | পরমুহূর্তে অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল কুয়াশা। লাফ মেরে সে একটা রাইটিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে টেবিলটা। জানালা গলে সূর্য কিরণ পড়ছে টেবিলের মাঝখানে। টেবিলের উপর বেশ কয়েকটা ব্লটিং পেপার দেখা যাচ্ছে। দ্রুত সবগুলো ব্লটিং পেপার একত্রিত করে হাতে তুলে নিল সে। তারপর প্রায় ছুটে গিয়ে ঢুকল বাথরুমের ভিতর। একটু পরই বাথরূমের ভিতর থেকে কল থেকে পানি পড়ার শব্দ ভেসে এল।
. প্রায় সাথে সাথে রূমের ভিতর ফিরে এল কুয়াশা। শহীদের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল সবচেয়ে আগে। শ্বাস-প্রশ্বাস নেই। তুলে নিল শহীদের একটি হাত। পালস্ দেখল। আছে। যদিও খুবই ক্ষীণ, সামান্য আভাস পাওয়া যাচ্ছে বিটের। আর আধ মিনিটের মধ্যে যদি কিছু করা না যায়, মৃত্যু ঘটবে ওর।
জীবনে এই প্রথম বিচলিত হতে দেখা গেল কুয়াশাকে। স্থির, বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে শহীদের মুখের দিকে। কিন্তু সে মাত্র মুহূর্তের জন্য। একমুহূর্ত পরই তৎপর হয়ে উঠল সে।
কুয়াশাকে বলা হয় গ্রেটেস্ট সাইন্টিস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড। বছরে একবার করে
১০৬
ভলিউম ১৭
কয়েক মাসের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যায় সে, একথা সবাই জানে। কিন্তু কেউ জানে
সেই কয়েকমাস কোথায় যায় কুয়াশা। আসলে সেই কয়েকমাস ল্যাবরেটরির ভিতর নিজেকে ব্যস্ত রাখে সে, গবেষণা করে একা একা।
চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেছে কুয়াশা। সেই অগাধ জ্ঞান এই মুহূর্তে চরম পরীক্ষার সম্মুখীন। তার সহকারী, বন্ধু এবং প্রিয়পাত্ররা মরে যাচ্ছে এদের বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব এখন তার কাঁধে।
এরা সবাই গ্যাসে আক্রান্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে কুয়াশা নিশ্চিত হয়েছে ব্লটিং পেপারগুলো থেকে মৃদু হালকা ধোয়া উঠতে দেখে। ধোয়া উঠছিল ঠিক, কিন্তু তা এমনই পাতলা যে অন্য কেউ হলে তার চোখেই পড়ত না ব্যাপারটা। বিষাক্ত পাউডার ব্লটিং পেপারগুলোয় ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল কেউ। সূর্য কিরণের তাপে সেই পাউডার গ্যাসে রূপান্তরিত হচ্ছিল।
ব্লটিং পেপারগুলোকে পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে গ্যাসের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে কুয়াশা।
দরকার হলো এখন অক্সিজেন ট্যাংক। কিন্তু তা হাতের কাছে পাওয়া অসম্ভব। পকেট থেকে ক্যাপসুলগুলো বের করল কুয়াশা। প্রত্যেকের মুখের ভিতর একটা করে ক্যাপসুল ঢুকিয়ে দিল সে। হার্টের কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি কারও। ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি শরীর।
একটু আশার আলো আছে ওইখানেই। আলখেল্লার পকেট থেকে একটা বাক্স বের করল কুয়াশা। ছোট বাক্সটা খুলে ফেলতেই দেখা গেল সিরিঞ্জ আর অ্যাল। | লাঙস-এর পেশী সম্পূর্ণ অবশ হয়ে আছে। ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ বন্ধ। রয়েছে সকলের।
প্রত্যেকের শরীরে ইঞ্জেকশন দিল কুয়াশা। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। অবস্থা সেই একই রকম। কেউ নড়ছে না।
এমন সময় শোনা গেল নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস পড়ছে। ক্রমশ জোর হচ্ছে, দীর্ঘ হচ্ছে সেই শব্দ। দেখা গেল, সকলেরই বুক উঠছে নামছে•••1.
সকলের চেয়ে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও সকলের আগে চোখ মেলল ডি. কস্টা।
| ‘মাই গড। বস, হাপনি! উঠে বসল ডি, কস্টা। কুয়াশা সানন্দে হাসল।
বাটরূমে ছিলাম, সাডেনলি টুপ-ঢাপ সাউণ্ড শুনিটে পাইলাম! ছুটিয়া আসিয়া ডেকিলাম অল অ্যাণ্ড এভরি ওয়ান টলিটে টলিটে পড়িয়া যাইটেছে! টাহার পর-মাই গড-হামিও পড়িয়া গেলাম!’.
| শহীদ উঠে বসল এরপর। মি. সিম্পসন, রাজকুমারী ওমেনা ও কামাল প্রায় একই সাথে চোখ মেলল। রাসেলও উঠে বসল ধীরে ধীরে।
মুচকি হেসে শহীদ বলল, মরেই গিয়েছিলাম, কি বলো, কুয়াশা? তুমি সময় মত এসে পড়েছিলে, তাই এযাত্রা বাঁচলাম। আমার বিশ্বাস হোটেলের সেই বেযেটাকে নিশ্চয়ই এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
কুয়াশা ৫১
১০৭
।
হোটেলের বেলবয়? তোমার কথা ঠিক…’ মি. সিম্পসন বললেন।
শহীদ বলল, আমরা জ্ঞান হারাবার কয়েক মিনিট আগে ডি কস্টা দরজা খুলে দিয়েছিল একজনবেলবয়কে, মনে নেই?
হা-হা…’
শহীদ বলল, আমার ধারণা আমরা বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়েছিলাম। এবং সেই গ্যাস আমদানি করেছিল বেলবয়টা।’
কামাল গর্জে উঠল, এখুনি আমি খোঁজ নিচ্ছি। ব্যাটাকে যদি পাই।’
কৈ মাছের মত লাফাতে শুরু করল ডি কস্টা, প্লিজ, মি, কামাল। ব্যাটাকে হাপনি আমার উপর ছাড়িয়া ডিন! হামি উহাকে হাঁড়ি কাবাব বানাইয়া খাইব…’.
শহীদ কুয়াশার দিকে তাকাল।
কুয়াশা বলল, রাসেল এবং মি. ডি. কস্টাকে খুলনায় যেতে হবে। জরুরী। একটা প্লেন চার্টার করে চলে যান আপনার, মি. ডি. কস্টা। আমি একটা তালিকা। দিচ্ছি, ল্যাবরেটরি থেকে জিনিসগুলো নিয়ে আসতে হবে।
আমার কি কাজ, কুয়াশা?’ জানতে চাইল রাজকুমারী।
তুমি যাবে কামালের সাথে। পুলিসের কাছ থেকে সম্ভাব্য সাহায্য নিয়ে। তোমরা নিজেরা খোঁজ নেবে আইনবিদ মোখলেসুর রহমানের অতীত জীবন, অভ্যাস-অনভ্যাস এবং বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে। এবং আপনি, মি. সিম্পসন, ফিরে যান নিজের চেম্বারে। সর্বশেষ ঘটনার খবর আমি চাই আপনার কাছ থেকে।’
| শহীদের দিকে তাকাল কুয়াশা এরপর। বলল, আমরা একসাথে বেরুব। একটা ক্যামেরা কিনতে হবে আমাদেরকে। তারপর আমরা যাব মোখলেসুর রহমানের অফিসে। সে নাকি নিহত হবার আগে অদ্ভুত ধরনের আলোকরশ্মি : দেখেছিল-চলো, তদন্ত করে আসি। কিন্তু, তার আগে, এলো, আমরা বর্তমান। বিপদ সম্পর্কে একটা ধারণা পাবার চেষ্টা করি।
আলোচনা শুরু হলো ওদের।’
হোটেল থেকে বেরিয়ে এল সবার আগে কুয়াশা। সরকারী গোয়েন্দাদ্বয় খানিকটা পিছন থেকে তাকে অনুসরণ করতে শুরু করল। কুয়াশা তাদেরকে দেখেও দেখল
না।
‘রাস্তার বিপরীত দিকের ফুটপাথে অপেক্ষা করছিল সেই বেঁটে লোকটা। সে হোটেলের লবিতে বসে খবরের কাগজ পড়ার ভান করছিল খানিকক্ষণ আগে। লোকটাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। এমন সময় হোটেল থেকে বেরিয়ে এল শহীদ, কামাল, রাসেল, ডি কস্টা, মি. সিম্পসন ও রাজকুমারী। হাঁ হয়ে গেল বেঁটে, লোকটার মুখ। দুঃসপ্ন দেখছে কিনা সন্দেহ হলো তার। চোখ রগড়ে নিল । কয়েকবার। ভাল করে তাকাল তারপর। পরমুহর্তে ঢোক গিলে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, অসম্ভব! এ হতেই পারে না! মরা মানুষ বেচে উঠল কিভাবে?
পরমুহূর্তে সে তার বড় আকারের হাতঘড়ির দম দেবার চাবিটা ঘোরাতে শুরু করল দ্রুত।
১০৮
ভলিউম ১৭
রাসেল ও ডি.কস্টা একটা ট্যাক্সিতে উঠল। ট্যাক্সি ছুটে চলল এয়ারপোর্টের দিকে। মি. সিম্পসন, রাজকুমারী ও কামাল উঠল মি. সিম্পসনের গাড়িতে । থানা হেডকোয়ার্টারের দিকে ছুটল গাড়ি।
বেঁটে লোকটা তার হাতঘড়ির চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে একটা খালি ট্যাক্সিতে চড়ল। রাসেল ও ডি. কস্টা যে ট্যাক্সিতে চড়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হয়েছে
সেই ট্যাক্সিকে অনুসরণ করতে শুরু করল তার ট্যাক্সি।
রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছিল কুয়াশা। শহীদ তার সাথে গিয়ে উপস্থিত হলো। দুজনে ঢুকল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। পনেরো মিনিট পর বেরিয়ে এল ওরা। দেখা গেল শহীদের হাতে বড়সড় একটা প্যাকেট। প্যাকেটের ভিতর সদ্য কেনা একটা ক্যামেরা।
টাক্সি নিয়ে পৌঁছুল ওরা নিহত মোখলেসুর রহমানের অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে। }
এলিভেটরে চড়ে সাততলায় পৌঁছল দুজন। করিডরে কেউ নেই।
দরজাটা বন্ধ বলেই মনে হলো। কিন্তু কুয়াশার হাতের মৃদু ধাক্কাতেই সেটা খুলে গেল। দরজা খোলাই ছিল।
“ দু’জন দু’জমের দিকে তাকাল ওরা। রূমের ভিতর আগে ঢুকল কুয়াশা। পিছন পিছন শহীদ। শহীদ ভিতরে পা রেখেই লক্ষ্য করল একটি দেয়াল আলমারির দরজার
কবাট দুটো সামান্য একটু ফাঁক হয়ে রয়েছে।
| রূমের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাগজপত্র। বোঝা যায়, কেউ সার্চ করেছে অফিসরুম। কোন কিছুর খোঁজে জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে বিশৃংখলার চরম করে রেখেছে। একটা টেবিলের কাগজপত্র সব কার্পেটের উপর ফেলে দেয়া হয়েছে, দুটো চেয়ার পড়ে আছে উল্টে।
দেয়াল আলমারিটা কুয়াশা লক্ষ্য করেছে কিনা বোঝা গেল না।
উঁচু গলায় কথা বলে উঠল কুয়াশা, বুঝলে শহীদ এখানে এসে কোন লাভই হলো না আমাদের।’
কুয়াশার হত ইতিমধ্যেই চলে গেছে আলখেল্লার পকেটে।
ওদের কাছ থেকে কমপক্ষে বারো ফুট দূরে দেয়াল আলমারিটা। কেউ যদি ওটার ভিতর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে লুকিয়ে থাকে, ওরা ব্যবধানটুকু অতিক্রম করার আগেই সে গুলি করে থামিয়ে দিতে পারবে ওদেরকে।
কুয়াশা শহীদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। চোখ মটকাল সে শহীদের দিকে তাকিয়ে, দেয়াল আলমারির দিকে পিছন ফিরে, পকেট থেকে ছোট্ট একটা মার্বেলের মত জিনিস বের করে নিজের মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে মারল পিছন দিকে।
সাদা মার্বেলটা গিয়ে পড়ল ঠিক আলমারির সামনে। পরমুহূর্তে নিকষ কালো ধোয়ায় ঢাকা পড়ে গেল আলমারিটা। সেই সাথেই কুয়াশা লাফ দিয়ে চলে গেল আলমারির পাশে। একটা হাত আলমারির ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে হিড়হিড় করে টেনে বের করে আনল একজনকে।
চিৎকার করে উঠল মেয়েটা।
কুয়াশা ৫১
১০৯
শহীদ তাড়াতাড়ি খুলে দিল রূমের সব কটা জানালা যাতে ধোয়ারাশি বেরিয়ে যেতে পারে।
মেয়েটার একটা হাত চেপে ধরে আছে কুয়াশা। ব্যথায় এবং ভয়ে এখনও চিৎকার করছে যুবতী।
পাঁচ চিৎকার করছিল মেয়েটা।
“থামো!’ ধমকে উঠল কুয়াশা। আশ্চর্য, এক কথায় চুপ করল মেয়েটা।
কে তুমি? অফিসটার হাল এমন করছ কেন?’ মেয়েটা ঢোক গিলল পরপর কয়েকবার।
চুপ করে থাকলে কোন লাভ হবে না। কথা বলো।
আমার নাম সাইদা শরমিন। আমি একজন সাংবাদিক। আমি..আমি শুধু দেখছিলাম••• দেখছিলাম ••• |
| কি দেখছিলে?’ শান্ত ভাবে জানতে চাইল কুয়াশা।
‘ফিচার লেখার মালমশলা কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখছিলাম…’ কুয়াশা হঠাৎ জানতে চাইল, ‘তোমার রুমালটা কোথায় দেখি?” | টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে খুলে ফেলল কুয়াশা। নানারকম কসমেটিক্স এবং কিছু টাকা রয়েছে ভিতরে! কোন রুমাল নেই।
কুয়াশা বলল, মোখলেসুর রহমান খুন হয়েছে তার অফিসে কেন এসেছ তুমি? তোমার নামের প্রথম অক্ষর লেখা রুমালটা পাওয়া গেছে আর একজন নিহত লোকের সাথে। পুলিস সেই রুমালের মালিককে খুঁজছে।
মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে। কুয়াশার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না সে। বলে উঠল, ‘আমি’লোকটাকে পড়ে যেতে দেখি, তারপর দৌড়ে যাই তাকে সাহায্য করার জন্যে, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি সে মারা গেছে, তারপর আমি দৌড়ে চলে যাই।’
শহীদ বলে উঠল, ‘সত্যি কথা বলবে বলে মনে হয় না। কুয়াশা, পুলিসকে ডেকে তাদের হাতেই তুলে দাওঁ বরং।’ : পুলিস ডাকার কোন ইচ্ছা শহীদের নেই। স্রেফ মেয়েটাকে ভয় দেখাবার জন্যেই কথাটা বলা।
‘পুলিসের কাছেও আমি মুখ খুলব না। মি. কুয়াশা, আপনি হয়তো বুঝবেন–কথা বলার মত অবস্থায় নেই আমি।’
কুয়াশা বলল, হ। আচ্ছা, মোখলেসুর রহমানকে চিনতে তুমি? “চিনতাম। কিন্তু তার মৃত্যু সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু জানি না।’ এমন সময় পাশের রূম থেকে টেলিফোনের শব্দ ভেসে এল। শহীদের দিকে তাকাল কুয়াশা। মেয়েটা বলে উঠল, মি. সিম্পসনের ফোন, মি. কুয়াশা।
ভলিউম ১৭
১১০
‘তুমি জানলে কিভাবে? এর আগেও ফোন করেছিলেন মি. সিম্পসন?’
মেয়েটা বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আপনাদের সাথে কথা বলছি ভালো আমাকে মেরে ফেলবে ওরা।
কারা?
মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেল। বলল, না, আর একটা কথাও বলতে রাজি নই আমি।’
কুয়াশা বলল, এয়ারপোর্টে কেন গিয়েছিলে? অ্যাক্সিডেন্টের সময়ও তোমাকে আমি দেখেছি, ট্যাক্সি করে ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলে।
| ফোনের বেল বেজেই চলেছে। কুয়াশা শহীদের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে একটা ইঙ্গিত করে চলে গেল পাশের রূমে।
শহীদ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, কারা তোমাকে মেরে ফেলবে, শরমিন?’
| মেয়েটা চুপ করে রইল। শহীদ পকেটে হাত দিল। এমন সময় মেয়েটা দরজার দিকে ছুটল সবেগে।
মুচকি হাসল শহীদ। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল ও। মেয়েটিকে ধরার কোন চেষ্টাই করল না।
পাশের রূম থেকে কোন শব্দ আসছে না। ধীর পায়ে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে শহীদ দেখল কুয়াশা রূমের ভিতর নেই। রূমের অপর দরজাটা খোলা রয়েছে,
বেরিয়ে গেছে সে।
ফোন করেছিলেন মি. সিম্পসন।
কুয়াশা রিসিভার তুলতেই তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, প্রায় চিৎকার করে বললেন তিনি, ‘হ্যালো! কুয়াশা?
বলছি।’ | ‘সিম্পসন। ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে বলছি। ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটে গেছে এখানে। এখুনি তুমি এয়ারপোর্টে চলে এসো। একটা প্লেন ক্র্যাশ করেছে। রাসেল, ডি. কস্টা কেউ বেঁচে নেই।’
মুহূর্তের মধ্যে পাথর হয়ে গেল যেন কুয়াশা। দ্রুত কাজ করছে তার ব্রেন। রাসেল এবং ডি. কস্টা মারা গেছে। অ্যাক্সিডেন্ট ঘটল কিভাবে? নাকি মড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে ওরা? শহীদকে কথাটা জানানো উচিত হবে না এখনই। নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল সে।
ট্যাক্সি থেকে এয়ারপোর্টের সামনে নামতেই মি. সিম্পস ছুটত ছুটতে কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার সাথে আর এক ভদ্রলোক রয়েছেন।
‘আমি জয়নাল আবেদীন, এয়ারপোর্ট ম্যানেজার••।’ | কুয়াশা যেন ভদ্রলোকের কথা শুনতে পায়নি, লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। সে। কুয়াশার পাশে থাকার জন্য মি. সিম্পসন ও এয়ারপোর্ট ম্যানেজারকে দৌড় শুরু করতে হলো।
কুয়াশা ৫১
১১১
কিভাবে ঘটল ঘটনাটা?
উত্তর দিল না এয়ারপোর্ট ম্যানেজার। অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল একটি জীপ। সকলে গিয়ে উঠল সেটায়। মি. সিম্পসন স্টার্ট দিয়ে তীর বেগে ছুটিয়ে দিলেন সেটাকে।
| টারমাকের শেষ মাথায় গিয়ে থামল জীপ। নামার আগেই কুয়াশা ছোটখাটো একটা ভিড় দেখতে পেল। পুলিস কর্ডন করে রেখেছে জায়গাটা। অ্যাম্বুলেন্স দেখা যাচ্ছে একটা। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িও রয়েছে দুটো। ধ্বংসপ্রাপ্ত এরোপ্লেনটাকে দেখা যাচ্ছে অদূরে। আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়েছে।
* কয়েক পা এগোতেই দেখা গেল ডি কস্টা ও রাসেলকে। ডি. কস্টার রোগা পাতলা দেহটা দুমড়ে মুচড়ে একেবারে এতটুকু হয়ে গেছে। রাসেলের দেহটা লম্বা হয়ে পড়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে, তার মাথায় বড় একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে। আরও একটা লাশ দেখা যাচ্ছে। দেহটা পুড়ে গেছে সম্পূর্ণ।
| ‘চার্টারড প্লেনের ব্যবস্থা করতে আমরা ঘন্টাখানেক সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার সহকারীরা বললেন, অত দেরি করা সম্ভব নয়। তাই তাড়াহুড়ো করে একটা ব্যবস্থা করে দিই। কিন্তু প্লেনের ইঞ্জিনে কোন গোলমাল ছিল না। কাল রাতে মেকানিকরা চেক করে কোন খুঁত পায়নি। আমাদের পাইলটের সাথে মি. রাসেলও ছিলেন সম্ভবত কন্ট্রোল কেবিনে।’
কুয়াশা শুনছে এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের কথা।
প্লেনটা স্টার্ট নিয়ে টারমাক ধরে ছোেট্টার পরপরই আমরা লক্ষ্য করি কোথাও কোন গোলমাল হয়েছে। প্লেনটা দিশে হারিয়ে ফেলেছিল। ব্যাপারটা কেন ঘটছে। বুঝতে পারছিলাম না। যাক, কয়েক মুহূর্ত পরই বেশ সুন্দর ভাবেই ছুটতে শুরু করে। তারপর রানওয়ে থেকে শুন্যে উঠে যায়। পঞ্চাশ,ফিটও ওপরে ওঠেনি, এমন সময় হঠাৎ দেখলাম প্লেনটা ঘুড়ির মত গোত্তা খেয়ে নিচের দিকে নামছে, নাকটা মাটির দিকে ঝুলে পড়েছে তখনই। ইঞ্জিনের শব্দটা শুনতে পাচ্ছিলাম-বারবার থেমে যাচ্ছিল, বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ইঞ্জিন, তারপর একেবারেই থেমে গেল। কিছুই বুঝতে পারলাম না•••।’
‘অস্বাভাবিক কিছুই কি চোখে পড়েনি আপনাদের?
মাথা নেড়ে না’ বললেন এয়ারপোর্ট ম্যানেজার, তারপরই বলে উঠলেন, না, আমি নিজে ঠিক কিছু দেখিনি। তবে আমাদের একজন মেকানিক একটা কথা বলছিল বটে। বিশেষ গুরুত্ব দিইনি তার কথায়। সে বলছিল, সে নাকি প্লেনের ইঞ্জিনের নিচে আগুনের ফুলকির মত বিন্দু বিন্দুনীল লাল আলো দেখতে পেয়েছে। হয়তো কিছুই না, ভুল দেখেছে।’
কোন মন্তব্য করল না কুয়াশা। রাসেল এবং ডি. কন্টার নিঃসাড় দৈহ দুটোর কাছে হাঁটু মুড়ে বসল সে।
মি. সিম্পসন মৃদু গলায় বলে উঠলেন। আশা নেই, কুয়াশা। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। পালস্ নেই। নিঃশ্বাস পড়ছে না•••।’
মি. সিম্পসন ফোন করে কোন দুর্ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন, সেই সংবাদ পেয়ে
১১২
ভলিউম ১৭
কুয়াশা চলে গেছে এটা অনুমান করে নিতে বেগ পেতে হলো না শহীদকে। প্যাকেট থেকে বের করল ও ক্যামেরাটা। কুয়াশার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিল সময় নষ্ট না করে।
বিশ মিনিটের মধ্যেই জটিল কাজটা শেষ করল শহীদ। সিগারেট ধরিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করল, মোখলেসুর রহমান অদ্ভুত আলো কোথায় দেখতে পেয়েছিলেন। জানালার দিকে দৃষ্টি পড়ল ওর। সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিচে রাস্তা। রাস্তার ওপারে উঁচু উঁচু বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের মাথার উপরে আকাশ। কিন্তু আলো
কোথায়?
আলোক সঙ্কেত সেই সময় নিক্ষিপ্ত হলেও শহীদের তা দেখতে পাবার কথা নয়। রঙিন চশমা ছাড়া সে আলো কেউ দেখতে পায় না।
রাস্তার বিপরীত দিকের বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলার একটি রূম থেকে দেওজী ও সান্তারাম জানালা পথে সেই মুহূর্তে দেখছিল শহীদকে।
নিজেদের মধ্যে সরস আলোচনা চলছিল।
আহা, বেচারী। দুঃখ হচ্ছে প্রখ্যাত ডিটেকটিভের জন্যে। আর পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই কি ঘটতে চলেছে জানে না বেচারা।
সান্তারাম বলে উঠল, শয়তান কুয়াশার চেলাগুলোকে একে একে সাবাড় করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু স্বয়ং শয়তানটাকে যতক্ষণ টুকরো টুকরো করে ডালকুত্তাকে দিয়ে খাওয়াতে না পারছি ততক্ষণ স্বস্তি পাচ্ছি না, যাই বলো•••!’
ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো। তুমি কি মনে করো আমাকে? আমরি প্ল্যানটা বলিনি তোমাকে? আগে শয়তানটার ডান হাত বা হাতগুলোকে ভেঙে দিয়ে দুর্বল করে নিই, তারপর.••।’
সান্তারাম বলল, ‘প্ল্যানটা ডাল। যাক, এদিকের ঝামেলা মিটে যাবে ধীরে ধীরে। আমি ভাবছি মি. খালেবাল আইয়ার কথা। কোথায় ডুব মারল সে? চুক্তিটা ফাইনাল করার সময় এসে গেছে, তুমি কি মনে করো?’
আরও একটু ধৈর্য ধরো। হাতের অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ না করলে চুক্তির অনেক শর্ত আমাদের প্রতিকূলে যাবে।’
দেওজী কাংকারিয়া টেবিলের দেরাজ খুলে তার নোমশ হাতটা ঢুকিয়ে দিল ভিতরে।
এদিকে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কোনরকম আলোকবিন্দু বা আলোক সঙ্কেতের দেখা না পেয়ে হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল শহীদ। | দরজা খুলে করিডরে পা রাখতেই ওর মাখা বরাবর নেমে এল ভারি একটা লোহার রড।
বিদ্যুৎবেগে বসে পড়ল শহীদ। একই সাথে মাথার উপর হাত তুলে লোহার রডটা ধরে ফেলেছেও। আক্রমণকারীর পা ধরে টান মারল সজোরে, পড়ে গেল লোকটা। লোকটার হাত ধরে সিধে হয়ে দাঁড়াল শহীদ পা দিয়ে সজোরে লাথি মেরে দেহটাকে উপুড় করে দিয়ে মোচড় দিল হাতে। তারপর লাথি মারল বগলের কাছে। মন্টু করে শব্দ উঠল, ভেঙে গেল হাতটা।
কুয়াশা ৫১
আক্রমণকারীরা সংখ্যায় পাঁচজন। বাকি চারজন এতক্ষণ দর্শক ছিল। এবার তারা দুদিক থেকে এগিয়ে এল। শত্রুরা এগিয়ে আসার আগে শহীদই এগিয়ে গেল তাদের দু’জনের দিকে।
আড়াইমণ ওজনের একটা ঘুসি মারল শহীদ সামনের লোকটার তলপেটে, ছিটকে গিয়ে পড়ল সে করিডরের দেয়ালের গায়ে। বাঁ পাশ থেকে লাফিয়ে আরও দু’জন ইতিমধ্যে চলে এসেছে শহীদের কাছে। একজন দুই বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে, অপরজন মুখে, পেটে, বুকে এলোপাতাড়ি ঘুসি চালাতে লাগল। সেই ফাকৈ ডান দিকেরঅপর লোকটা মেঝে থেকে তুলে নিল লোহার ভারি রডটা।
হাত এবং পা চালান শহীদ। কনুইয়ের গুতো খেয়ে একজন লোক আর্তচিৎকার করে উঠে ছেড়ে দিল শহীদকে। অন্ধ আক্রোশে যে লোকটা ঘুসি মারছিল তার তলপেটে লাথি মারতেই সে ছিটকে গিয়ে পড়ল পাঁচ হাত দূরে। বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়াল শহীদ তৃতীয় শত্রুর মুখোমুখি।
কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো পর্যন্তই, সবেগে ওর মাথার উপর যে লোহার রডটা নেমে আসছিল সেটাকে ঠেকাতে পারল না ও।
মাথায় আঘাত লাগার সাথে সাথে টলে উঠল দেহটা। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল ও। | শত্রুরা দ্রুত কেটে পড়ল একজন একজন করে। আহত লোকগুলোই চলে গেল সবার আগে। একজন লোক পকেট থেকে মদের বোতল বের করে শহীদের চোখেমুখে ছিটিয়ে দিল খানিকটা। তারপর দুজন মিলে ধরাধরি করে নিয়ে চলল শহীদকে।
রাস্তার লোকেরা দেখল ওদেরকে। শত্রুপক্ষের একজন যেচে পড়েই শহীদকে দেখিয়ে বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি একটা দোকানের কর্মচারীকে বলল, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেছে, আমাদেরই বন্ধু মানুষ।
ছয়। জ্ঞান ফিরে পেয়ে শহীদ অনুভব করল ওর মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাধা। হাসি পেল ওর। শত্রুরা কি মনে করে ওর ক্ষতের চিকিৎসা করেছে বোঝা মুশকিল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে উঠল ও।
এ কেমন কামরা? চারদিকে ইস্পাতের দেয়াল, মেঝে এবং ছাদও ইস্পাতের। ছোট্ট একটা ভেন্টিলেটার দেখা যাচ্ছে, মাথা গলবে না শত চেষ্টাতেও। কামরার ভিতরটা আলোকিত। সিলিংয়ের আড়ালে অদৃশ্য বালব আছে।
কামরাটার কোন দরজা দেখা যাচ্ছে না। জিনিসপত্র বলতে একটি স্টীলের শক্ত চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই চেয়ারে বসে আছে শহীদ। চেয়ারের সাথে নাইলন কর্ড দিয়ে মজবুত করে বেঁধে রাখা হয়েছে ওকে।
মাথায় কোন ব্যথা নেই। তবে ডান হাতটা একটু ব্যথা ব্যথা করছে।
১১
ভলিউম ১৭
ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে ওকে, বুঝতে পারল ও। পেইন-রিলিভার জাতীয় ইঞ্জেকশন, যার ফলে মাথার ব্যথাটা নেই।
য্যার ঘ্যার ঘ্যার ঘ্যার:••
শব্দ শুনে সামনে দেয়ালের দিকে তাকাল শহীদ। ইস্পাতের দেয়াল মাঝখান থেকে দুফাঁক হয়ে যাচ্ছে।
| থামল শব্দটা। ফাঁক হয়ে যাওয়া দেয়ালের ওপার থেকে কামরার ভিতর ঢুক। দুজন লোক।
দেওজী কাংকারিয়া এবং সান্তারাম উল্কা।
কি হে টিকটিকি, কেমন বোধ করছ? শখের গোয়েন্দাগিরি করার সাধ মিটেছে তো?’
দাতে দাঁত চাপল শহীদ। কথা বলল না।
সান্তারাম উল্কা বলে উঠল, কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না । কুত্তাটাকে কষ্ট দিয়ে মারব বলে এতক্ষণ অপেক্ষা করেছি। জ্ঞান ফিরে এসেছে, এবার শুরু করা যাক কাজটা…’। | হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে একটু সরে গিয়ে দাঁড়াল সান্তারাম উল্কা । একান্ত মনোযোগের সাথে কি যেন অনুভব করার চেষ্টা করছে সে।
দেওজী কাংকারিয়াও নিঃশব্দে চেয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে, সে-ও যেন কিছু শোনার বা দেখার বা অনুভব করার চেষ্টা করছে। অথচ কোথাও কোন শব্দ নেই, কোথাও কোন আলোক সঙ্কেতও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে, দুজনেই যেন কোন মেসেজ রিসিভ করছে-মাধ্যমটা অজ্ঞাত।
| দেওজী কাংকারিয়া অস্ফুটে বলে উঠল, ‘রাসেল•••এবং কুয়াশার সহকারী ডি. কস্টা•••বেঁচে গেছে!•••অ্যাম্বুলেন্স••• সার্জেন•••অক্সিজেন লাঙস আবার কাজ করছে’ ডি. কস্টা•••রাসেল দুজনেই গুরুতর রকম আহত হয়েছে কিন্তু কুয়াশা যথাসময়ে পৌঁছেছে তার চিকিৎসায় তারা মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছে এযাত্রা•••||
| সান্তারাম উল্কা চিৎকার করে উঠল, ‘কোন কাজেই সফল হতে পারছি না আমরা। ওরা দুজন বাঁচবে একথা ভাবাই যায় না–অথচ বেঁচে গেছে!’
দেওজী কংকারিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “শয়তান কুয়াশা দেখছি সত্যিই জাদু জানে!’
জাদু জানুক আর মন্ত্র জানুক, আমাদের সাথে চালাকি করে রেহাই পাবে না সে। ওরা দুজন বেঁচে গেছে ঠিক, কিন্তু আমাদের মুঠোয় অন্তত একজন তত রয়েছে। দেওজী, দেরি করে লাভ কি, খতম করে দিই টিকটিকিটাকে।
দেওজী বলল, ব্যস্ত হয়ো না, সান্তারাম। একটু বুদ্ধি খরচ করে কথা বলো, বুঝলে? এখনই শখের গোয়েন্দাকে হত্যা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। জিম্মি হিসেবে ওকে আমাদের দরকার হতে পারে।’
কামরা থেকে বেরিয়ে গেল দেওজী আর সান্তারাম। ইস্পাতের দেওয়াল দুদিক থেকে সরে এসে জোড়া লেগে গেল আবার।
t
কুয়াশা ৫১
১১৫
চেয়ারের সাথে হাত এবং পা বাঁধা শহীদের। বাঁধনগুলো খোলার জন্য চেষ্টা করতে শুরু করল সে আবার। এর আগেই হাতের বাধন মুক্ত করার জন্য হাত দুটো মোচড়াচ্ছিল ও। সান্তারাম এবং দেওজী এসে পড়ায় কাজটায় বাধা পড়েছিল। ইতিমধ্যে বাধন ঢিলে করে ফেলেছিল ও।
মিনিট পাঁচেক পর হাতের বাঁধন খুলে গেল। হাতের সাহায্যে পায়ের বাঁধন খুলতে সময় লাগল মাত্র দুই মিনিট।
কক্ষটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল শহীদ। এখান থেকে পালানো সম্ভব নয়, কথাটা অচিরেই বুঝল ও। এদিকে তাকে এখন না হলেও পরে হত্যা করা হবে। উপায় একটা বের করতেই হবে। জুতোর হিলের ফাপা কুরী থেকে ছোট্ট একটা পেন্সিল বের করল ও। ভেন্টিলেটরের নিচে নিয়ে গেল স্টীলের চেয়ারটাকে। চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে পেন্সিলটা ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে বের করে দিল অর্ধেকটা। তারপর পেন্সিলের, গায়ের বোতামটায় আঙুলের চাপ দিল। বেশ কিছুক্ষণ একইভাবে বোতামটা টিপল ও।
ডি. কস্টা এবং রাসেলের সাথে হাসপাতালে প্রায় ঘণ্টাখানেক রইল কুয়াশা। সে নিজে রাসেল এবং ডি. কস্টার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে। হাউজ ফিজিশিয়ান ধরেই নিয়েছিলেন ওরা বাঁচবে না। নিঃশ্বাস পড়ছে না, পাস প্রায় নেই–মরেই তো গেছে। কিন্তু কুয়াশা বুঝিয়ে দিয়ে বলল, নাঙল প্যারালাইজড হয়ে গেছে, তা আবার সচল হয়ে উঠবে। ওরা নিঃশ্বাস ফেলছে না বা শ্বাস নিচ্ছে না দেখেও ঘাবড়াবার কিছু নেই। অক্সিজেনের অভাব হয়নি এতটুকু। কারণ, ওরা অক্সিজেন ক্যাপসুল খেয়েছিল বিপদটা টের পেয়েই।
রাসেলের ডান হাতটা জখম হয়েছে। অপারেশন করার দরকার হলো না অবশ্য। তবে মাথায় অপারেশন করতেই হলো। তার মাথার ‘আঘাতটা বেশ গভীর। অপারেশন করল স্বয়ং কুয়াশা। সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা ডি. কস্টার ব্যাপারটা। প্রথমে দেখে কুয়াশার মনে হয়েছিল তার হাড়-পাজর একটাও অটুট নেই। কিন্তু পরীক্ষা করার পর দেখা গেল একটা রিব ভেঙেছে মাত্র তার, কোথাও আর কোন মারাত্মক আঘাত সে পায়নি।
দুজনেই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করল। নিজের তৈরি কিছু ওষুধ খেতে দিল ওদেরকে কুয়াশা। ইঞ্জেকশন পুশ করল একাধিক। ব্যথা বেদনার কোর্ন অনুভূতিই রইল না ওদের মধ্যে।
“ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে দুজনেই উঠে বসল বেডের উপর। তাজা, উৎফুল্ল দেখাচ্ছে দুজনকে।
রাসেল বলল, “আশ্চর্য ধরনের আলোর বিন্দ, অনেকটা সরষেফুলের মত দেখতে, তবে নীল এবং লাল রঙের, দেখতে পেয়েছিলাম আমরা। সাথে সাথে অক্সিজেন ক্যাপসুল খেয়ে ফেলি। কিন্তু তবু দম বন্ধ হয়ে এল আমাদের। তারপর প্লেনের ইঞ্জিন থেমে গেল•এরপরের ঘটনা মনে নেই।
| ডি কস্টা হাতের মুঠি পাকিয়ে ঘুসি মারার ভঙ্গি করে বলে উঠল, মি. কুয়াশা,
১১৬
ভলিউম ১৭
হামাডেরকে দ্যাট বেলবয় কুণ্ডু বানাইয়াছে। প্লেনের কাছাকাছি একটি লোককে হামি ডেকিয়াছিলাম। টখন ডাউট করি নাই। বাট এখন মনে হইটেছে সে লোকটা আর কেহই নহে, হোটেলে যে বেলবয়টা হামাডেরকে, মার্ডার করিটে চাহিয়াছিল এ ব্যাটা সেই।’
কুয়াশা ফিরে এল হোটেলে। কামাল আর রাজকুমারীর হোটেলে ফিরে রিপোর্ট করার কথা।
স্যুইটে ঢুকে দরজা বন্ধ করার প্রায় সাথে সাথেই টেলিফোনের বেল ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল কুয়াশা। তারপর পা বাড়িয়ে এগিয়ে গেল। রিসিভারটা তুলে কানে লাগাল সে। কিন্তু এ কেমন ব্যাপার। অপর প্রান্ত থেকে কেউ কথা বলছে না। কারণটা কি? লাইন যে কেটে দেয়া হয়েছে তাও
নয়।
রিসিভারটা-কান থেকে সরাল না কুয়াশা। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর খটাং করে শব্দ হলো একটা লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সেই সাথে। এতক্ষণে কেউ রিসিভার নামিয়ে রাখল অপর প্রান্তে।
ব্যাপারটা কি? পাশেব কামরায় চলে এল সে।
একমুহূর্ত চিন্তা করে একটা বোম টিপে পাশের কামরা থেকে হোটেলের টেলিফোন অপারেটরের সাথে কথা বলল কুয়াশা।
শান্তভাবে অপেক্ষা করছিল কুয়াশা, এমনসময় দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল কামাল ও রাজকুমারী। নিঃশব্দে চেয়ে রইল ওরা কুয়াশার দিকে। রাসেল ও ডি. কস্টার কথা রাস্তাতেই শুনেছে ওরা। অশুভ সংবাদ ছড়াতে বেশি সময় লাগে না, শহরে– লোক ইতিমধ্যেই প্লেনক্র্যাশের খবর জেনে ফেলেছে।
দুজনকেই ভারি উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে। কুয়াশা হাসল। রাজকুমারীর মুখ থেকে সব দুশ্চিন্তার ছাপ মুছে গেল।
কামাল জিজ্ঞেস করল, কি খবর, কুয়াশা?’ ‘ভাল।’ রাজকুমারী জানতে চাইল, বাঁচবে নিশ্চয়ই ওরা, কুয়াশা?’ |
না বাঁচার তো কোন কারণ ঘটেনি। যাক, তোমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে পেরেছ?’।
রাজকুমারী বলল, “বিশেষ কিছু না।
কামাল ব্যাখ্যা করে বলল, মোখলেসুর রহমান খুব নাম করা আইনবিদ ছিলেন। বেশ ভাল টাকা রোজগার করছিলেন। অবিবাহিত। বন্ধু-বান্ধব সবাই
বুদ্ধিজীবী। কোন শত্রু ছিল না, ঝগড়া বিবাদ করেননি কখনও কারও সাথে•••।’
রাজকুমারী বলল, একটা মাত্র অদ্ভুত ব্যাপার জানা গেছে। তার সহকারী উকিল আমাদেরকে বলল।
কুয়াশা ৫১
১১৭
রাজকুমারী থেমে গেল। টেলিফোন বাজছে।
কামাল হাত বাড়াল রিসিভার ধরার জন্য। আশ্চর্য একটা কাণ্ড করে বসল কুয়াশা। প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল সে কামালকে। বলে উঠল, ছুয়ো না!’ | কথাটা বলেই পাশের কামরায় গিয়ে ঢুকল কুয়াশা। পাশের কামরাতেও টেলিফোন আছে। | ফোন করেছে হোটেলের টেলিফোন অপারেটর। তার কাছ থেকে একটা তথ্য নিয়ে ফিরে এল কুয়াশা ড্রয়িংরূমে।
বলল, হোটেল থেকে বেরিয়ে ডান দিকে যাবে তোমরা। পঞ্চাশ গজের মত যাবার পর একটা ড্রাগ স্টোর দেখতে পাবে। সেখান থেকে একজন লোক তিন মিনিট আগে ফোন করছিল। লোকটাকে ধরে জেরা করবে। কুইক!’
কামাল চাপা গলায় বলে উঠল, ‘এতক্ষণে অ্যাকশন শুরু হলো তাহলে। ছুটল ওরা। তিন মিনিট পর আবার টেলিফোনের বেল বেজে উঠল।
কুয়শাি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে একটা চামড়ার ব্যাগ থেকে নাইলনের সুতো বের করল। ড্রয়িংরূমের টেলিফোনের রিসিভারটা ক্রেডল থেকে না তুলেই সেটাকে সুতো দিয়ে বাধল। তারপর সুতো ছাড়তে ছাড়তে পাশের বেডরূমে গিয়ে চুল সে।
বেডরূম ও ড্রয়িংরূমের মধ্যবর্তী দরজাটা ভিড়িয়ে দিল সামান্য একটা ফাঁক রইল মাত্র, যাতে ড্রয়িংরূমটা দেখা যায়।
টেলিফোনের বেল বেজেই চলেছে।
সুতোর একটা প্রান্ত কুয়াশার হাতে। সেটা ধরে টান মারল সে। ড্রয়িংরূমের টেলিফোনের রিসিভার ক্রাডল থেকে পড়ে গেল টেবিলের উপর। সেই সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল সুউচ্চ হোটেল ভবন। ড্রয়িংরূমের আসবাবপত্র ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সব। বিস্ফোরণের সময় ড্রয়িংরূমের ভিতর কেউ যদি থাকত, নির্ঘাৎ মরতে হত তাকে।
ইতিমধ্যে কামাল নেপালী ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে এবং রাজকুমারী বাঙালী যুবকের ছদ্মবেশে হোটেল থেকে বেরিয়ে দ্রুত হেঁটে ড্রাগ স্টোরটা খুঁজে বের করে ফেলেছে। দোকানের ভিতর ঢুকবে কি ঢুকবে না ভাবছিল ওরা, এমন সময় একজন গাট্টাগোট্টা চেহারার লোককে বেরিয়ে আসতে দেখল ওরা। লোকটার হাতে অস্বাভাবিক বড় আকারের একটা হাতঘড়ি রয়েছে।’
| এই লোকই!’ কামাল বলল।
কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ওকে ধরে জেরা করে কি লাভ। তারচেয়ে চলো, ফলো করি। ওদের আস্তানাটা হয়তো চেনার সুযোগ পেয়ে যাব।’
কিন্তু কুয়াশা যে বলল•••।’ | রাজকুমারী হাসল, ‘আমার পদ্ধতি সম্পর্কে জানে কুয়াশা। নিজের বুদ্ধি মত কাজ করার স্বাধীনতা সে আমাকে দিয়েছে।
১১৮
ভলিউম ১৭
সাত সিগারেটের গন্ধেই কুয়াশা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের অনুপস্থিতে সুইটের ভিতর কেউ ঢুকেছিল। সস্তাদরের সিগারেট, গন্ধটা তখনও ভাসছিল ড্রয়িংরূমের বাতাসে। তারপর এল ফোন। ফোন এল কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে কেউ কথা বলল না।
অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারী কুয়াশা, ব্যাপারটা অনুমান করে নিতে বেগ পেতে হলো না তাকে।
শত্রুপক্ষের লোকটা ভীষণ ধূর্ত, সন্দেহ নেই। বোমাটা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল সে টেবিলের নিচে। সেই টেবিলের উপরই ছিল টেলিফোনটা। সরু তার টেলিফোন বক্সের বেল এবং বোমার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করছিল। প্রথম টেলিফোন কল এল, কুয়াশা রিসিভার তুলল, সেই সাথে ইলেকট্রিকাল সার্কিট সেট হয়ে গেল বোমায়। দ্বিতীয় ফোন কলের পর রিসিভার ভোলা মাত্র সার্কিটটা ভেঙে যাবার কথা, সেই সাথে ঘটবার কথা বিস্ফোরণ।
শত্রুপক্ষের কেউ না কেউ অপেক্ষা করছিল কামাল ও রাজকুমারী কখন। ড্রয়িংরুমে ঢোকে তা দেখার জন্য। তিনজনকে বোমার সাহায্যে হত্যা করারই পরিকল্পনা ছিল শত্রুপক্ষের। কিন্তু কুয়াশা যে কামাল এবং রাজকুমারীকে বাইরে। পাঠিয়ে দেবে তা তারা ভাবতে পারেনি। তারা এ-ও ভাবতে পারেনি যে কুয়াশা তাদের গোপন ষড়যন্ত্র উদঘাটন করে এভাবে আত্মরক্ষা করবে।
হোটেল কর্মচারীরা এবং ম্যানেজার ছুটে এল। ছুটে এল ভীত-সন্ত্রস্ত বোর্ডাররা। কুয়াশা ঝাড়া তিন মিনিট ধরে ব্যাখ্যা করে বোঝাল যে বোমাটা ফাটাবার ব্যবস্থা করেছিল একজন শত্রু, তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাকে এবং তার বন্ধুদের হত্যা করা।
হোটেল ম্যানেজার ব্যাখ্যাটা শুনলেন। কুয়াশার নির্দেশে অপর একটি সুইটের ব্যবস্থাও করলেন। কিন্তু বিস্ফোরণটা শত্রুপক্ষের কাণ্ড একথা তিনি যেন মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি শুনেছিলেন বিজ্ঞানী কুয়াশা নানাধরনের মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে থাকে।
রহস্যটা উদঘাটনের জন্য উঠে পড়ে লাগল পুলিস। কুয়াশা তাদের উপরেই ছেড়ে দিল দায়িত্বটা। হোটেল ম্যানেজার অবশ্য নিজের ধারণার কথা উচ্চারণ করল না। কারণ কুয়াশা তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ মোটা অঙ্কের একটা চেক দিয়ে দিয়েছে তখুনি।
শহীদ ফিরছে না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল কুয়াশা। শত্রুপক্ষ শহীদের ফেরার জন্য অপেক্ষা না করেই বোমা ফাটিয়েছে। তার মানে, শহীদের জন্য তারা ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ইতিমধ্যে অনুমান করল কুয়াশা।
দ্রুত ফোন করল কুয়াশা কয়েক জায়গায়। ঢাকা পুলিশ বাহিনী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। মি. সিম্পসন স্বয়ং শহীদের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন।
কুয়াশা ৫১
১১৯
আধঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট এল। মোখলেসুর রহমানের অফিস বিল্ডিংয়ের কাছের এক দোকানের কর্মচারী জানিয়েছে, কিছু সময় আগে দুজন লোক একজন মাতালকে ধরাধরি করে নিয়ে গেছে।
মাতালটা যে শহীদ, বুঝতে পারল কুয়াশা।
বড় একটা দেয়াল-আলমারি খুলে ঘোট ঘোট ট্যাবলেট, ক্যাপসুল এবং বেশ কয়েকটা শিশি বের করল কুয়াশা। আলখেল্লার বিভিন্ন পকেটে ভরল সেগুলো পকেট থেকে কিছু ট্যাবলেট, যন্ত্রপাতি, শিশি বের করে রেখে দিল আলমারির তাকে। জরুরী পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য এই সব যন্ত্রপাতি এবং ওষুধপত্র সম্ভাব্য বিপদের ধরন-ধারণ অনুমান করে বিশেষ বিশেষ ওষুধ-পত্র এবং যন্ত্রপাতি সাথে রাখে সে।
আলমারি বন্ধ করে পিছন ফিরতে গিয়েই ভুরু কুঁচকে কান পাতল কুয়াশা কোথাও কোন শব্দ নেই। কিন্তু কুয়াশার কান অসাধারণ। সাধারণ একজন লোক যে শব্দ শুনতে পায় না কুয়াশা সে শব্দ অনায়াসে শুনতে পায়। বেডরূমের সাথেই হলরূম। প্রায় নিঃশব্দে হলরূমের দরজা খুলেছে কেউ।
কিন্তু কুয়াশাকে দেখে মনে হলো না সে ব্যাপারটা জানতে পেরেছে আলখেল্লার পকেট থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল তার। পা বাড়াল অপর একটি দরজার দিকে, যেন ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে সে। তার হাতে ছোট্ট একটা কাঁচের বল দেখা যাচ্ছে।
হলরূমে যাবার দরজাটা ভোলাই রয়েছে। বেডরূম থেকে করিডরে বেরুবার দরজার কাছে গিয়ে বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে মারল কুয়াশা কাঁচের বলটা হলরুমের দিকে।
হলরূমের মাঝখানে গিয়ে পড়ল ওটা। দুপ করে শব্দ উঠল ফাটার। সাদা। ধোয়ায় ভরে গেল হলরুম। একজন লোকের আঁৎকে ওঠার শব্দ পাওয়া গেল পরমুহূর্তে শব্দ হলো–ধুপ! কেউ যেন পড়ে গেল হলরুমের মেঝেতে।
দম বন্ধ করে হলরুমে প্রবেশ করল কুয়াশা। সাদা ধোয়ার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে মেঝেতে একজন প্রায় প্রৌঢ় নোক লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। জ্ঞান হারিয়েছে সে বিষাক্ত গ্যাসে। লোকটাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে এল কুয়াশা। শুইয়ে দিল একটা বিছানায়। তারপর হলরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এসে বসল
একটি চেয়ারে।
| টেবিলের উপর থেকে চুরুটের প্যাকেট টেনে নিয়ে সুদীর্ঘ, সুগন্ধী একটা চুরুট ধরাল কুয়াশা। একমুখ নীলচে ধোয়া ছেড়ে চেয়ে রইল সে অচেতন লোকটার দিকে। বেশ লম্বা দেহের অধিকারী। পোশাক আশাক দেখে শিক্ষিত এবং ভদ্র মনে হয়। কয়েক মিনিট পরই চোখ পিট পিট করে তাকাল লোকটা। কথা বলে উঠল সহজ, সরল ভঙ্গিতে, আপনি সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন–সেজন্যে আপনাকে দোষ দেয়া যায় না, মি. কুয়াশা। কিন্তু আমি নিতান্ত নিরীহ একজন মানুষ।’
১২০
ভলিউম ১৭
কুয়াশা কথা বলল না।
লোকটা সুন্দর কথা বলতে জানে। ভঙ্গিটা মার্জিত। আবার বলল, আমি বরং সব কথা খুলেই বলি।’
কুয়াশা মৃদু হাসল। বলল, বলুন।
আমার নাম শফিকুল কবীর। প্রফেসর। কেমিস্ট্রি পড়াই।
শফিকুল কবীর বিছানার উপর উঠে বসল। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে আনল কালো রঙের বড়সড় একটা পাইপ। পাইপের সামনের অংশটা, যেখানে টোবাকো ভরা হয়, সেটা একটা কফি কাপের মত বড়সড়।
আবার কথা বলতে শুরু করল সে, কাগজে আমাদের সেনাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পড়েছি আমি। তারপর শুনলাম, আপনি এই রহস্যময় কেস সমাধান করার দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনাকে একটা তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারব আমি। সেজন্যেই এসেছি।’
বলে যান, শান্ত গলায় বলল কুয়াশা।
আচমকা নিচু হয়ে গেল শফিকুল কবীরের কণ্ঠস্বর। প্রায় চাপা কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল সে, “এই হত্যাকাণ্ড এবং যাবতীয় রহস্যের পিছনে একজন লোক দায়ী। তাকে আমি চিনি। তার নাম সাইদ চৌধুরী। ভয়ঙ্কর লোক•••।
‘তার মেয়ে বা বোন আছে কেউ সাইদা শরমিন নামে? | মেয়ে। দেখা হয়েছে আপনার সাথে তার? ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছেন তার নাম? জানেন, ওই মেয়েটাও বাপের মত একনম্বরের শয়তান•••
| কুয়াশা বাধা দিয়ে বলে উঠল, সাইদ চৌধুরী সম্পর্কে বলুন।
শফিকুল কবীর পকেট থেকে বের করল তামাকের কৌটো। কৌটো খুলে তামাক ভরতে শুরু করল সে পাইপে। হাত দুটো কাঁপছে মৃদু মৃদু।
সাইদ চৌধুরী একটা ম্যানিয়াক। কিন্তু সায়েন্টিফিক ম্যানিয়াক। কেমিস্ট্রিতে জিনিয়াস সে। বৈজ্ঞানিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আলোচনার জন্যে প্রায়ই সে আমার কাছে আসত। কিছুদিন আগে, কথায় কথায় সে আমাকে জানায় যে সর্বকালের বিস্ময়কর একটা যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার করেছে। সে আরও বলে তার ধারণা। বাংলাদেশ সরকার তাকে এই অস্ত্রের জন্য ন্যায্য দাম দিতে সম্মত হবেন না। কারণ অস্ত্রটার মূল্য হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। ন্যায্য দাম যে দেবে তার কাছেই অস্ত্রটা বিক্রি করতে প্রস্তুত আছে সে আমাকে জানায়।’
শফিকল কবীর থামল। দাঁত দিয়ে পাইপটা চেপে ধরল। চোখ দুটো কি এক প্রত্যাশায় চকচক করে উঠল তার।
‘আমি তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছি, কাজটা ভাল হবে না। বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেয়া উচিত তার আবিষ্কৃত অস্ত্রটা। কিন্তু ভয়ানক চটে যায় সে আমার কথা শুনে, গালাগাল করে অকথ্য ভাষায়। তারপর..তারপর সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। প্রুভিং গ্রাউণ্ডের মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটার পর আমি তার খোঁজ নেবার চেষ্টা করি। খবর পাই, চট্টগ্রামের দিকে নাকি আছে। সে। ভাবলাম, কথাগুলো আপনাকে জানানো দরকার।
কুয়াশা ৫১
১২১
থামল শফিকুল কবীর। কুয়াশা উঠল চেয়ার ছেড়ে। পরমুহূর্তে, প্রায় সাথে সাথে, বসে পড়ল আবার।
বিন্দু বিন্দু লাল, নীল আলো বেডরূমের সর্বত্র ভেসে বেড়াতে শুরু করেছে। কুয়াশার শরীরেও লাগছে, কিন্তু পুড়ছে না কিছু।
কুয়াশার শরীরটা মোচড় খেতে শুরু করল।
শরীরটা শক্ত পাথরের মত হয়ে গেছে শফিকুল কবীরের। দম বন্ধ করে আছে সে। দাঁত দিয়ে সজোরে কামড়ে ধরেছে সে তার পাইপটা।
কুয়াশার হাত দুটো নিজের গলার কাছে উঠে গেল। যেন নিজের গলাটা চেপে ধরতে চাইছে সে।
তুমি তুমি। কথা শেষ করতে পারল না কুয়াশা। স্থির হয়ে গেল তার দেহ। তারপর চেয়ার থেকে সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল নিঃসাড় দেহটা।
ভীষণ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল শফিকুল কবীরকে। দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠল সে। তাড়াহুড়ো করে নামল বিছানা থেকে। ছুটে চলে এল কুয়াশার নিঃসাড় দেহের কাছে। এক হাত দিয়ে পাল্স্ দেখল। অপর হাতটা নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস আছে কিনা বুঝবার চেষ্টা করল।
| মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল শফিকুল কবীরের মুখ। কুয়াশার আলখেল্লা খুলে ফেলল, টান মেরে ছিঁড়ে ফেলল ভিতরের শার্ট এবং গেঞ্জি । তারপর ব্যস্ত হাতে নিজের কাজ গুছিয়ে নিয়ে কয়েক মিনিট পরই বেরিয়ে পড়ল রূম ছেড়ে বাইরে।
কুয়াশার নিঃসাড় দেহটা পড়ে রইল মেঝেতে তেমনিভাবে। দেওজী কাংকারিয়া খবরের কাগজ পড়ছিল। বড় বড় হেডিং-এর প্রধান খবরটা এই রকম:
কুয়াশার সহকারীরা রহস্যময় মৃত্যুর মুখোমুখি।
| অল্পের জন্য প্রাণ রক্ষা এয়ারপোের্ট মেকানিকের চোখে ধরা পড়েছে।
রহস্যময় আলোক বিন্দু দ্বিতীয় প্রধান খবরের হেডিংও বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছে:
গোটা দেশ আতঙ্কিত দূর থেকে লাঙস্ প্যারালাইজিং মেশিন ব্যবহার
করা হয়েছে– যোয়ানদের হত্যাকাণ্ড রহস্য সম্পর্কে
বিশেষজ্ঞদের ধারণা। প্রথম খবরটায় বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, প্লেন ক্র্যাশের ঘটনাটা। কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা শত্রুদের বিরুদ্ধে কঠোরতম হুঁশিয়ারী উচ্চারণ
১২২
ভলিউম ১৭
করেছেন। একজন পদস্থ সরকারী কর্মচারী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন–এসব বাংলাদেশের শত্রুদের ষড়যন্ত্র, নাশকতামূলক পরিকল্পনার অঙ্গ।
খবরটা পড়তে পড়তে মুচকি হাসল দেওজী কাংকারিয়া।
দ্বিতীয় খবরের উপসংহারে বলা হয়েছে কুয়াশা আর্মি ইন্টেলিজেন্স এবং সরকারী গোয়েন্দা বিভাগের সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। আশা করা যায় অচিরেই সে এই রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারবে।
| কচু করবে।’
মুখ ভেংচে বলে উঠল দেওজী, দাঁড়াও না বাছাধনেরা, দেখাচ্ছি মজা। যখন শুনবে যে স্বয়ং তোমাদের কুয়াশাই খতম হয়ে গেছে।’
হঠাৎ সান্তারাম উল্কার দিকে তাকিয়েই থেমে গেল দেওজী। কি যেন অনুভব করার চেষ্টা করছে সান্তারাম।
দেখা গেল, দেওজীও একই সাথে কি যেন অনুভব করার চেষ্টা করছে।
শয়তান কুয়াশা•••আবার মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছে।’
মনে হচ্ছে, কোথাও থেকে মেসেজ পাচ্ছে দেওজী এবং সান্তারাম। কিন্তু কোথা থেকে পাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। “ দেওজী বলে উঠল, বোমা ঠিকই ফেটেছিল••• কিন্তু কিভাবে কে জানে। কুয়াশা:•• বেঁচে•••যায় তার কোন ক্ষতিই হয়নি তার••দু’জন সহকারী
অনুসরণ করছে•••উপায়••• কি•••জানান•••।’
কী সাংঘাতিক।
দেওজী তাকাল খ্যাপা দৃষ্টিতে সান্তারামের দিকে, আশ্চর্য ঘটনা। এতগুলো লোককে নাগালাম, কেউ তারা পারল না কুয়াশাকে খতম করতে! ওদেরকে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।’
সান্তারাম বলল, ‘এদিকে আমাদের চুক্তিটা এখনও ফাইনাল হলো না।’ দেওজী চুরুট ধরিয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় টেলিফোন বেজে
উঠল।
রিসিভার তুলে কথা বলতে শুরু করল দেওজী। চোখ দুটো অবিশ্বাসে বড় বড় হয়ে উঠল তার।
রিসিভার নামিয়ে রাখল সে খানিক পর। সান্তারামের দিকে ফিরে দাঁড়াল বিদ্যুৎবেগে। বলল, নতুন বিপদ দেখছি! একজন অজ্ঞাত লোক ফোন করেছিল। সে দাবি করছে সে নাকি হোটেলে ছিল। আমাদের বোমায় কুয়াশা মারা যায়নি, কিন্তু অন্যভাবে নাকি মারা গেছে সে।’
| ‘হোয়াট! দ্যাটস ইম্পসিবল! কুয়াশাকে আমরা ছাড়া আর কে মারতে পারে!
নার্ভাস দেখাচ্ছে দেওজী কাংকারিয়াকে, আমার ধারণা অন্যরকম। কেউ বা কোন দল আমাদের সম্পর্কে অনেক বেশি জেনে ফেলেছে। তারা সম্ভবত আমাদের কাছ থেকে অস্ত্রটা ব্ল্যাকমেইল করে হাতাতে চায়। মোট কথা, বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। আমি। যা করার দ্রুত করতে হবে আমাদের। পরবর্তী অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করা আছে তো, সান্তারাম?’
কুয়াশা ৫১
১২৩
সব ঠিক আছে। ওটার পরই আমরা হাত-পা ঝেড়েমুছে কেটে পড়তে পারব। কিন্তু এদিকে যে আমাদের লোককে কুয়াশার দু’জন সহকারী অনুসরণ করে আসছে, তার কি হবে? বরং আমিই যাই, ঝামেলা চিরকালের জন্য চুকিয়ে দিয়ে আসি। ..
সান্তারাম টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ড্রয়ার খুলে ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিল সে ভিতরে।
এবার ড্রয়ারের ভিতর অনেকক্ষণ রইল হাতটা।
রাজকুমারী বা কামাল জানতে পারল না ওদের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে। অ্যাশ কালারের একটি ফোক্সওয়াগনকে ট্যাক্সি নিয়ে অনুসরণ করছে ওরা। ড্রাগ স্টোর থেকে বেরিয়ে শত্রুপক্ষের লোকটা সোজা গিয়ে চড়ে ফোক্সওয়াগেনে। তার হাবভাব বা গাড়ি চালাবার ভঙ্গি দেখে মনে হয় ওদেরকে সে সন্দেহ করেনি।
দ্রুত শহরের বাইরে চলে গেল ফোক্সওয়াগেন। রাস্তার দু’পাশে জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ট্যাক্সি ফোক্সওয়াগেনের পিছু পিছু ছুটছে। ডান দিকে বাক নিল একসময় ফোক্সওয়াগেন। আঁকাবাঁকা পথ। গাড়ির গতি এতটুকু কমল না। সোজা দুইশো গজের মত গিয়ে আবার বাঁক নিল। বাকের মাথায় ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড, প্রাইভেট রোড।’
| ‘ট্যাক্সি থেকে নামল রাজকুমারী এবং কামাল ওই বাকের কাছেই। ফোক্সওয়াগেনটা ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ভাড়া ঢুকিয়ে দিয়ে রাজকুমারী ড্রাইভারকে বলল, তুমি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করো এখানে। বখশিশ পাবে।’
‘ঠিক আছে, মেম সাহেব।’
প্রাইভেট রোডটা বেশ প্রশস্ত এবং ইট বিছানো। সোজা খানিকদূর চলে গেছে, শেষ মাথায় দেখা যাচ্ছে একটা গেট। গেটটা বন্ধ। বাড়িটা কোন ধনী এবং সৌখিন লোকের বাগান বাড়ি বলে মনে হয়। বাড়িটার চারদিকে ঝোঁপ-ঝাড়, উঁচু উঁচু গাছপালা।
| গেটের দিকে নোজা না এগিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বাড়িটাকে ঘিরে পিছন দিকে পৌঁছুল ওরা। কোথাও কেউ নেই।
| পঁচিল টপকাল ওরা। বাড়ির পিছন দিকটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার মত। গাছপালা আর ঝোঁপ-ঝাড় চারদিকে। উঁচু বারান্দায় উঠে ওরা দেখল একটি দরজা খোলা রয়েছে।
পাহারায় কেউ নেই দেখে বেশ একটু অবাকই হলো ওরা।
কামাল নিচু গলায় বলে উঠল, ‘বিপদের কোন সম্ভাবনা নেই মনে করে সাবধানতা অবলম্বন করার কথা ভাবেইনি ব্যাটারা।’
ছোট্ট একটা কামরার ভিতর প্রবেশ করল রাজকুমারী। পিছন পিছন কামাল। কেউ নেই কামরায়। আশপাশের কামরাতেও সম্ভবত কেউ নেই। কোনদিক থেকে কোন শব্দ আসছে না।
১২৪
ভলিউম ১৭
‘ওরা কথা বলছে।’
তার মানো কামাল অবাক হলো।
রাজকুমারী বলল, তুমি শুনতে পাচ্ছ না, তোমার গুনতে পাবার কথাও নয় কিন্তু আমি পাচ্ছি। বাড়ির সামনের দিকের কোথাও লোক আছে। কি বলছে বুঝতে পারছি না, তবে বলছে শুনতে পাচ্ছি। হয়তো টেলিফোনে কথা বলছে কেউ।
একটার পর একটা খালি কামরা পেরিয়ে বাড়ির সামনের দিকে এগোতে লাগল ওরা।
সর্বশেষ কামরার ভিতর ঢুকে ওরা দেখল একজন লোককে। টেলিফোন ক্রেডলে রেখে দিচ্ছে তখন সে।
রাজকুমারী কামরার ভিতর ঢুকে পড়ল নিঃশব্দ পায়ে। ওর সাথে কামালও। কথা বলল আগে কামালই, মাথার ওপর হাত তুলে ঘুরে দাঁড়াও, বাছাধন!
ঠিক সেই সময় কামরার চারটে দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল একদল ভয়ঙ্কর চেহারার লোক।
উৎকট উল্লাসে তারা গলা ছেড়ে হাসছে।
গর্জে উঠল কামাল বাঘের মত। পরমুহূর্তে উল্কার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে শক্রদলের উপর।
রাজকুমারীকে অস্বাভাবিক শান্ত দেখাচ্ছে। দ্রুত কাজ করেছে তার মাথা। সংখ্যায় দশ বারোজন হবে শক্ররা। এদের সবাইকে একই সময়ে কাবু করার মত অস্ত্র তার কাছে আছে। পৃথিবীর নয়, অন্য এক গ্রহের মানুষ সে। সে গ্রহের জ্ঞান বিজ্ঞান পৃথিবীর তুলনায় অনেক দিক থেকে অনেক বেশি উন্নত। দেখতে হুবহু পৃথিবীর মানুষের মত হলেও আনতারার মানুষের শরীরে অনেক রহস্যময় রাসায়নিক পদার্থ আছে যার ফলে সেখানকার মানুষ অনেক বেশি বুদ্ধিমান, অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী। রাজকুমারী ওমেনার শরীর থেকে সাবসোনিক র্যাডিয়েশন বের। হয়। জিনিসটা একধরনের অদৃশ্য বিদ্যুতের মত। এই বিদ্যুতের প্রভাব রাজকুমারীর । দেহের চারদিকে দু’আড়াই হাত পর্যন্ত কার্যকরী। এর সমানার মধ্যে এলেই প্রচণ্ড শক খায় লোকে এবং সাথে সাথে প্যারালাইজড হয়ে যায় সে। অন্তত আধঘন্টার জন্য হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অচল।
কিন্তু সাবলোকি র্যাডিয়েশন ইচ্ছা করলেই ব্যবহার করা যায় না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একবার মাত্র এই অস্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব। সাবনোনিক র্যাডিয়েশন শরীরের চারদিকে ছড়াবার আগে দরকার হয় গভীর মনোনিবেশ, আত্মসম্মোহন।
কিন্তু সে সময় কোথায়!
রাজকুমারী কাঠবিড়ালির মত লাফ দিয়ে একটা টেবিলের উপর উঠে দাঁড়াল। কামরার দৃশ্যটা, কে কোথায় আছে, ভাল করে দেখে নিল পলকের মধ্যে। তারপর লাফ দি তিনজন যামার্কা শত্রুকে লক্ষ্য করে।
লাফ দেবার আস্তে সাথে রাজকুমারীর মাথার হ্যাটটা খুলে পড়ে গেল। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল দেখা গেল তার। শত্রুরা সবাই বিস্মিত। মুহূর্তের জন্য তারা বিমূঢ়
কুয়াশা ৫১
১২৫
হয়ে পড়ল। রাজকুমারী সদ্ব্যবহার করল সেই সুযোগের।
রাজকুমারীর হাত ও পায়ের ধাক্কা খেয়ে তিনজনই পড়ে গেল মেঝেতে। একজনের মাথা সজোরে ঠুকে গেল দেয়ালের সাথে। অপর দুজন সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। দেখা গেল তাঁদের দু’জনের হাতেই রিভলভার রয়েছে।
দাঁত বের করে হিংস্র হাসিতে ফেটে পড়ল নোক দু’জন। দু’জন দুদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে এক পা এক পা করে রাজকুমারীর দিকে। | এদিকে কামাল প্রথম আক্রমণ করায় দু’জন শত্রুকে কাবু করে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরেছে আরও কয়েকজন। কামালের লাথি এবং ঘুসি খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে দুজন। সামনের আরও দুজনকে আক্রমণ করতে যাবার আগেই সে আক্রান্ত হয়েছে পিছন থেকে।
মেঝেতে শুইয়ে ফেলল সবাই মিলে তাকে। একজন চেপে বসল তার বুকে। লোকটার হাতে একটা ধারাল ছোরা।
‘ধড়টা আলাদা করে দিই গলায় ছোরা চালিয়ে, কি বলিস?
কামালের বুকে বসে দৈত্যাকার চেহারার লোকটা কাটা ঠোঁটজোড়া কান পর্যন্ত লম্বা করে হাসছে।
নিজেকে মুক্ত করার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছে কামাল। কিন্তু হাত দুটো আর পা দুটো তার চেপে ধরে রেখেছে কয়েকজন লোক। আর একজন কুৎসিত ভাষায় গালাগালি দিতে দিতে কামালের পেটের উপর উঠে দাঁড়াল। পেটের উপর দাঁড়িয়ে লাফাতে লাগল সে।
শালার পেট ফাটিয়ে দেব!
রাজকুমারীর দিকে দুদিক থেকে দুজন রিভলভার হাতে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ বিদ্যুৎবেগে লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল সে। সেই সাথে তার ডান হাতটা নড়ে উঠল। কামালের পেটের উপর যে লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছিল তার নাকে গিয়ে লাগল ওমেনার ডান হাতের ঘুসি।
ভেঙে গেল নাকটা। নাক চেপে ধরে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে শুরু করল সে। টলতে টলতে নামল মেঝেতে। হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছে।
রাজকুমারীর এতসব লক্ষ করার সময় নেই। ঘুসি মেরে নাক ভেঙে দিয়েই পা ছালাল ও। কামালের বুকে বসা নোকটা পাঁজরে সবুট লাথি খেয়ে ফুটবলের মত শূন্য দিয়ে উড়ে গিয়ে ধাক্কা খেল দেয়ালের সাথে। সেখান থেকে পড়ল মেঝেতে।
“ লাফ দিয়ে সরে গেল শত্রুরা। রাজকুমারীকে ঘিরে ফেলেছে তারা চারদিক থেকে। প্রায় একই সময়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল কামাল।
শত্রুদের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠল, হুশিয়ার!
রাজকুমারী এবং কামাল মুহূর্ত মাত্র দ্বিধা না করে যার যার সামনের শত্রুকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
. আত্মরক্ষার পন্থ খুঁজছে শত্রুরা। কয়েকজন ভয়াল প্রকৃতির গুণ্ডা ভয় পেয়ে গেছে রাজকুমারীর বেপরোয়া লড়াই দেখে। সবাই চেষ্টা করছে তার আওতা
১২৬
ভলিউম ১৭
থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে। গুলি করতে পারছে না তারা দুটো কারণে। এক, গুলি করলে নিজেদের নোক মারা পড়তে পারে। দুই, রাজকুমারী এবং কামালকে হত্যা করার নির্দেশ এখনও পায়নি তারা।
হিংস, খুনী পশুগুলো চিৎকার করছে অবিরাম।
ঝাঁপিয়ে পড় শালারা সবাই একসাথে! ‘ছি। একটা মেয়েমানুষ এমন নাকানিচোবানি খাওয়াবে শেষ পর্যন্ত।
রাজকুমারীর শরীরটা বিদ্যুতের মত ছুটোছুটি করছে কামরার চারদিকে। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই ঘুসি মেরে, লাথি মেরে আক্রমণ করছে। কিন্তু শত্রুরা কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিটি আক্রমণ। কামরার ভিতর প্রাণপণে দৌড়োদৌড়ি করছে সরাই।
তারপর সবাই একসাথে হঠাৎ রুখে দাঁড়াল।
এই বিপদটার জন্য তৈরি ছিল না ওরা। শত্রুদের ছুটোছুটি দিখে মনে হচ্ছিল ভয়েই অমন করছে তারা। রাজকুমারী বা কামাল কেউই বুঝতে পারেনি, ওদেরকে কাবু করার এটা একটা কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
কামরার সবগুলো শত্ৰু গর্জে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের উপর। চারদিক থেকে ঘুসি এবং লাথি পড়ছে। একজন দুই লোমশ হাত দিয়ে চেপে ধরেছে রাজকুমারীর গল। আর একজন তার লম্বা চুল ধরে ঝুলে পড়েছে পিছন দিকে।
কামালের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে শত্রুরা ইতিমধ্যে। এলোপাতাড়ি ঘুসি খাচ্ছে সে নাকে মুখে।
জ্ঞান হারাল কামাল আগে।
রাজকুমারীর শক্তি তখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। শত্রুরা সবাই মিলেও তাকে কাবু করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল।
এমনি সময়ে লোহার রড দিয়ে ওমেনার মাথার মাঝখানে বাড়ি মারা হলো। রাজকুমারী ওমেনা পরাজয় স্বীকার করল অবশেষে।
অচেতন হয়ে পড়ল সে।
আট লাল নীল আলোক বিন্দু দেখেই বিপদ টের পেয়ে গিয়েছিল কুয়াশা। দম বন্ধ করে থাকলে বিপদ স্পর্শ করতে পারবে না বুঝতে পেরেছিল সে। নিজস্ব পদ্ধতিতে নিয়মিত ব্যায়াম করে বলে সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশিক্ষণ নিঃশ্বাস না ফেলে থাকতে পারে সে।
| শফিকুল কবীর চলে যাবার কিছু পরই উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে তাজা বাতাস গ্রহণ করল। তারপর হাত দিল আলখেল্লার গোপন পকেটে। পকেট পরীক্ষা করে দেখে সে বুঝতে পারল শফিকুল কবীর কি কি জিনিস নিয়ে গেছে।
তখুনি হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এসে ট্যাক্সি নিল সে। শফিকুল কবীর যখন
কুয়াশা ৫১
১২৭
তার বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছিল তখন কুয়াশা। একটা ইস্পাতের মার্বেলের মত দেখতে ব্যাটারিযুক্ত রেডিও ডিরেকশন ফাইণ্ডার তার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল চুপিসারে। জিনিসটা অবিরাম শব্দহীন সঙ্কেত ট্রান্সমিট করতে পারে। সেই সঙ্কেত ধরা পড়ে কুয়াশার হাতঘড়ির মত দেখতে রিসিভিং সেটে। | বাংলাদেশ বিমানের মতিঝিল অফিসের সামনে পৌঁছুল ট্যাক্সি। সাথে সাথে নয়, কিছুক্ষণ পর ট্যাক্সি থেকে নামল কুয়াশা। ছদ্মবেশ নিয়েছে সে এতক্ষণ ধরে। এখন আর তাকে চেনার কোন উপায়ই নেই। ময়লা পোশাক পরা ভবঘুরে যুবকের মত দেখাচ্ছে তাকে। মাথার চুল বিশৃংখল, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কাঁধের সাহিত্যিক ব্যাগটা ছেঁড়া।
কুয়াশা শফিকুল কবীরকে দেখতে পেল টিকেট কাউন্টারের সামনে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। কুয়াশাকে চিনতে পারল না শফিকুল কবীর। কুয়াশা দেখল, শফিকুল কবীর চট্টগ্রামে যাবার জন্য একটা টিকেট কিনল। একঘণ্টা পর ছাড়বে প্লেন। ভাগ্য ভাল, কুয়াশাও একটা ওই একই ফ্লাইটের টিকেট পেয়ে গেল। আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ, তাই কয়েকজন প্যাসেঞ্জার বুকিং ক্যানসেল করেছে।
কুয়াশাকে অনুসরণ করে দুজন সরকারী গোয়েন্দা অফিসে ঢুকেছিল। কুয়াশা তাদের দিকে এগিয়ে গেল। | কাছে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। কথা বলল নিচু স্বরে। পকেট থেকে বের করে দিল সদ্য কেনা টিকেটটা। সেই টিকেট নিয়ে ছুটল একজন গোয়েন্দা এয়ারপোর্টের দিকে।
| এক ঘণ্টা পরই চট্টগ্রামের উদ্দেশে আকাশে ডানা মেলে রওনা হলো প্লেন। অন্যান্য যাত্রিদের সাথে শফিকুল কবীর ও একজন সরকারী গোয়েন্দাও রয়েছে সেই প্লেনে।
হোটেলে কুয়াশার উপর আক্রমণ হয়েছে এ খবর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পৌঁছুবার সাথে সাথে অতিরিক্ত সাবধানতার জন্য সেক্রেটারি আরও চারজন সরকারী গোয়েন্দাকে পাঠিয়ে দিলেন কুয়াশার নিবাপত্তার দিকে শোন দৃষ্টি রাখার জন্য । চারজন গোয়েন্দা কুয়াশাকে আবিষ্কার করল, মোখলেসুর রহমানের অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে। কুয়াশা বিল্ডিংয়ের ভিতর প্রবেশ করছে তখন।
সাততলায় উঠে মোখলেসুর রহমানের অফিসে ঢুকল সে নিঃশব্দে। অফিস রূমটা পরীক্ষা করে দেখতে চায় সে।
টেবিলের উপর তখনও পড়ে রয়েছে বড় আকারের একটা রাইটিং প্যাড। প্যাডের উপরের কাগজটা না ছুঁয়ে ঝুঁকে পড়ে কিছুক্ষণ ধরে দেখল কুয়াশা। পকেট থেকে বের করল একটা কৌটা। কৌটার পাউডার কাগজটার উপর ছড়িয়ে দিল। তারপর ছেড়ে দিল সিলিং ফ্যানটা।
বাতাসে উড়ে গেল পাউডার। কিন্তু কাগজটাব’গা যেখানে যেখানে ছড়ে বা গর্ত হয়ে গেছে সেখানে লেগেই রইল পাউডার।
মাখলেসুর রহমান নিহত হবার কয়েক মুহূর্ত পূর্বে এই টেবিলে বসে কাজ
১২৮
ভালউম ১৭
করেছেন। বড় বড় অক্ষর লিখেছেন তিনি লম্বা লম্বা লাইনে সাজিয়ে। বাতাসে উড়ে যাবার পর অবশিষ্ট পাউডার দেখে কয়েকটা লাইন পড়তে সক্ষম হলো কুয়াশা।
লাইনগুলো এই রকম:
QPWDZ BRHYZ BBOPD WICGH WGBUF OXPUM WBEIE CHAUK EBROS LTGJP RINDU LYLMF QETYM FINDP BDTCZ VPTOD
BMSSS এর নিচে দুটি শব্দ: “Death today.”
আরও কিছু অক্ষর এবং শব্দ পাওয়া গেল। কুয়াশা বুঝতে পারুল Death এবং today শব্দ দুটোকে মোখলেসুর রহমান সাইফার কোড-এর কী ওয়ার্ড হিসেবে ধরে নিয়ে মেসেজটার অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। টাইপ দেখে সন্দেহ রইল
। এটা জটিল Beuford সাইফার কোড। তবে কী-ওয়ার্ড জানা থাকলে সহজই বটে অর্থ বের করা। না জানা থাকলে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে।
. মোখলেসুর রহমান ‘Death’ শব্দটিকে কী ওয়ার্ড ধরে নিয়েছিল। তাই, সে প্রথমে লেখে Death, তারপর শুরু করে ইংরেজি বর্ণমালার বাকি অক্ষরগুলো লিখে সাজাতে। এভাবে ছাব্বিশটি অক্ষরের চতুষ্কোণ একটি ছক তৈরি করে সে।
ছকটি এই রকম:
DEATIIBCFGIJKLMNOPQRSUVWXYZ EATHIBCFGIJKLMNOPQRSUVWXYZD ATHBCFGIJKLMNOPQRSUVWXYZDE THIBCFGIJKLMNOPQRSUVWXYZDEA HIBCFGIJKLMNOPQRSUVWXYZDEAT BCFGIJKLMNOPORSUVWXYZDEATH CFGL KLMNOPQRSUVWXYZDEATIIB FGIJKLMNOPORSUVWXYZDEATHIBC GIJKLMNOPQRSUVWXYZDEATHBCF IJKLMNOPQRSUVWXYZDI:ATHBCFG JKLMNOPORSUVWXYZDEATHBCFGI KLMNOPQRSUVWXYZDEATHBCEGU LMNOPQRSUVWXYZDEATHBCFGUK MNOPQRSUVWXYZDEATHBCFGLKL NOPQRSUVWXYZDEATHBCFGIJKLM OPORSUVWXYZDEATHBCFGIJKLMN PORSUVWXYZDEATHBCFGIJKLMNO QRSUVWXYZDEATHBCFGIJKLMNOP
· RSUVWXYZDEATHBCFGHJKLMNOPO
৯-কুয়াশা ৫১
১২৯
SUVWXYZDEATHBCFGIJKLMNOPQR UVWXYZDEATHBCFGIJKLMNOPORS VWXYZDEATHBCFGIJKLMNOPQRSU WXYZDCATHBCFGIJKLMNOPQRSUV XYZDEATHBCFGIJKLMNOPORSUVW YZDEATHBCFGLIKLMNOPQRSUVWX
ZDEATHBCFGIJKLMNOPORSUVWXY দ্বিতীয় শব্দ “to day” মেসেজের কী ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপটা সহজ। মেসেজের উপর এইভাবে সাজানো হয়েছে:
TODAY TODAY
TODAY TODAY OPWCZ BRHYZ
BBOPD WICGH TODAY TODAY TODAY TODAY WPBUT QXPUM WBBIE CHAUK TODAY TODAY TODAY TODAY EBROS LTGIP
RINDU LYLME TODAY TODAY
TODAY TODAY ONTYM FINDP
BDTc2. VPTQD TODAY BMSSS
কোড বর্ণমালার সবচেয়ে উপরের সারির T অক্ষরটি খুঁজে নিয়ে কুয়াশা নিচের দিকে নামতে লাগল যতক্ষণ না সে ‘Q’ অক্ষরটিকে পেল, তারপর সেই লাইনের
সর্বশেষ অক্ষরটি দেখল।
এরপর সবচেয়ে উপরের সারির ‘0’ অক্ষরটি খুঁজে নিয়ে কুয়াশা নেমে এল নিচের দিকে সোজা যতক্ষণ না ‘P’ অক্ষরটিকে পেল, তারপর সেই লাইনের
সর্বশেষ অক্ষরটি দেখল।
দ্রুত কাজ করে চলল কুয়াশী। মেসেজটা উদ্ধার করতে খুব বেশি সময় লাগল না তার।
মেসেজটার বিশৃংখল চেহারা পঁড়াল এই রকম:
‘Newde athweapona succe ssbri ngpro spect loarm yprov inggr oundw illki illwo hundr edile reto day,’
সাজাবার পর অর্থ দাঁড়াল:
‘New death weapon a success bring prospect to ariny proving ground will kill two hundred there to day.
অশুদ্ধ ইংরেজি বাক্যটির বাংলা করলে এইরকম দাঁড়ায় মূল অর্থ:
নতুন মৃত্যুবাণ সফল হয়েছে। আমি প্রুভিং গ্রাউণ্ডে সম্ভাব্য ক্রেতাকে নিয়ে এসো। সেখানে দুইশত মানুষ মরবে আজ।
এবং সত্যি সত্যি তাই ঘটেছে। শত্রুদের ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা সফল হয়েছে।
১৩০
ভলিউম ১৭
একশো তেরানব্বই জন জোয়ান নিহত হয়েছে প্রুভিং গ্রাউণ্ডে।
প্রাইভেট অফিস ছেড়ে পাশের রুমে চলে এল কুয়াশা। শহীদ এই রূমে ফিট করে রেখে গেছে ক্যামেরাটা। কিন্তু কোথায় তা কুয়াশা জানে না।
| খুঁজে বের করতে দেরি হলো না কুয়াশার। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, প্রাইভেট অফিস রূমটাকে ডার্করূমে রূপান্তরিত করতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। ওয়াশ বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করতে লাগল কুয়াশা।
আলোর সামনে ফিরে এসে দাঁড়াল সে খানিক পরই। তার হাতে দেখা যাচ্ছে ডেভেলভড় মোশন-পিকচার ফিল্ম রোল। শহীদের লুকানো ক্যামেরা থেকে এই রোলটা পেয়েছে কুয়াশা।
ফিল্মটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করেছে কুয়াশা, এমন সময় নিচ থেকে ভেসে এল পিস্তলের শব্দ।
কুয়াশাকে অনুসরণ করে কয়েকজন লোক বিল্ডিংয়ের নিচ তলা অবধি এসেছিল। বিল্ডিংয়ের ভিতর প্রবেশ করেনি তারা। কিন্তু কুয়াশা বিল্ডিং থেকে বের হতে দেরি করছে দেখে তারা অধৈর্য হয়ে উঠল।
বিল্ডিংয়ের ভিতর প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিল তারা। বিল্ডিংয়ের পিছন দিক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল তারা। গোয়েন্দারা তাদেরকে দেখে চ্যালেঞ্জ করে, সাথে সাথে গুলিবর্ষণ শুরু করে শত্রুপক্ষ।
একজন গোয়েন্দা আহত হয়ে পড়ে যেতে বাকি তিনজন শেল্টার নিয়ে শুরু করল গুলিবর্ষণ।
সিঁড়ির ধাপে লুকোবার জায়গা নেই। শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য। খণ্ডযুদ্ধটা গোয়েন্দাদের অনুকূলেই যাচ্ছিল, এমন সময় রাস্তা থেকে বিল্ডিংয়ের ভিতর প্রবেশ করল তিনজন মামার্কা লোক। প্রত্যেকের হাতে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তেই ঢুকল তারা।
তাদের একজনের হাতে একটা স্টেনগান। অবিরাম গর্জাচ্ছে সেটা। আঁক ঝাক তপ্ত সীসার বুলেট বৃষ্টির মত ছুটে আসছে মুষলধারে।
গোয়েন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। মৃত্যু যে অবধারিত বুঝতে বাকি রইল না তাদের। ডানদিকে সরে যেতে শুরু করল তারা, ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়তে লাগল।
স্টেনগানধারী শত্ৰু গোয়েন্দাদেরকে ঠেকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে নিচেই রয়ে গেল। বাকিরা সবাই সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে শুরু করল। কুয়াশাকে গুলি করে মেরে ফেলার জন্যই এসেছে তারা।
সিঁড়ির মাথায় হঠাৎ দেখা গেল কুয়াশাকে।
শত্রুপক্ষ যেন প্রস্তুতই ছিল। কুয়াশাকে দেখার সাথে সাথে গর্জে উঠল তাদের হাতের পিস্তল।
চার পাঁচটা বুলেট ছুটে গিয়ে লাগল কুয়াশার বুকে। পরিষ্কার শব্দ হলো বুলেট
কুয়াশা ৫১
১৩১
বিদ্ধ হবার।
কিন্তু কুয়াশা সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল সিঁড়ির মাথায়। চার-পাঁচটা বুলেট বুকে গ্রহণ করেও তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শত্ৰুদলের অনুচরেরা বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াল। এমন সময় বেরিয়ে এল পকেট থেকে কুয়াশার ডান হাত। অদ্ভুত দর্শন একটা রিভলভার দেখা গেল তার হাতে। সেটা তুলেই গুলি করল সে।
চারজন শত্রু লুটিয়ে পড়ল সিঁড়ির উপর। একসাথে ছয়টা করে সিঁড়ির ধাপ টপকে নিচে নেমে গেল কুয়াশা। সিঁড়ির উপর ধরাশায়ী নিঃসাড় শত্রুদের দিকে ভুলেও তাকাল না সে। নিচে নেমে দেখল স্টেনগানধারী লোকটা হাঃ হাঃ করে হাসছে। তার সামনে মাথার উপর দুই হাত তুলে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে
সহকারী গোয়েন্দারা।
গুলি করল কুয়াশা। লুটিয়ে পড়ল স্টেনগানধারী।
লোকটার দেহ হাতির মতই বিশাল। প্যান্ট এবং কোট পরা লোকটার কব্জিতে বিরাট একটা রিস্টওয়াচ দেখা যাচ্ছে।
গোয়েন্দারা নতুন জীবন ফিরে পেয়ে আবেগে, কৃতজ্ঞতায় বোবা হয়ে গেছে যেন। কুয়াশা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, “শত্রুরা কেউই মরেনি। ওদেরকে অজ্ঞান করা হয়েছে।’
পকেট থেকে সিরিঞ্জ বের করে একজন গোয়েন্দার হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে আবার সে বলল, “প্রত্যেককে ইঞ্জেকশন দিন। জ্ঞান ফিরে আসবে। তার আগে ওদেরকে সার্চ করুন এবং বেঁধে ফেলুন দড়ি দিয়ে।, শত্ৰুদলের তিনজনকে চিনতে পারা গেল। পুলিসের খাতায় এরা কুখ্যাত গুণ্ডা হিসেবে চিহ্নিত। তাদের একজনের জ্ঞান ফিরল সবার আগে।
কুয়াশাকে দেখে ভয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল সে। বলতে লাগল, হুজুর পীর-পয়গম্বর! আপনাকে খুন করতে হবে তা আমাকে জানায়নি কেউ••• |’
কে তোমাকে নিয়োগ করেছে? নাম বলো তার। সরকারী গোয়েন্দা প্রশ্ন করল কঠিন স্বরে।
ওই যে, ওর নাম তৈয়ব•••।’
স্টেনগান নিয়ে যে লোকটা গুলি চালিয়েছিল তার দিকে আঙুল তুলল লোকটা।
সরকারী গোয়েন্দা বলল, ওকে আমরা চিনি না, মি.কুয়াশা:••!
ঘাড় ফিরিয়ে সরকারী গোয়েন্দা বোকা বনে গেল। কোথায় কুয়াশা? সকলের অজ্ঞাতে অদৃশ্য হয়ে গেছে সে।
আশ্চর্য! বাতাসের সাথে মিশে গায়েব হয়ে গেলেন নাকি?’
আরে! তৈয়ব লোকটার হাতের রিস্টওয়াচটা নেই–গেল কোথায় সেটা? আর কোট,-সেটাও যে দেখছি নেই।’
যে গোয়েন্দা কুয়াশাকে প্রথম থেকে অনুসরণ করছিল সে বলে উঠল, কি আবার হবে! মি. কুয়াশাই সম্ভবত প্রয়োজন মনে করে নিয়ে গেছেন।
শহীদ ক্যামেরাটা মোখলেসুর রহমানের অফিস রূমের এমন এক জায়গায় স্থাপন
১৩২
ভলিউম’১৭
করেছিল যেখান থেকে বিপরীত দিকের বিল্ডিংয়ের সবকিছু দেখা সম্ভব। মোখলেসুর রহমান এমন কিছু দেখেছিল যা রহস্যময়, যা তার মৃত্যুর জন্য দায়ী–এ কথা প্রথম থেকেই বোঝা গিয়েছিল। সে কথা মনে রেখেই ক্যামেরাটা স্থাপন করেছিল ও। সেনসিটিভ ফিল্মে স্বভাবতই অতি ক্ষুদ্র জিনিসও ধরা পড়বার কথা, যা মানুষ চোখ দিয়ে দেখতে পায় না।
ধরা পড়েওছিল। ফিল্মে কুয়াশা একটা মেসেজ পেয়েছে। মেসেজটা শত্রুপক্ষের নয়। শহীদের। ইস্পাতের কারাকক্ষে বন্দী হবার পর ভেন্টিলেটরের উপর হাত তুলে পেন্সিলের বোম টিপে অত্যুজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মি নিক্ষেপ করে শহীদ।
সেই আলোক রশ্মির ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। কুয়াশা শহীদের মেসেজ পায়, বুঝতে পারে শহীদকে কোথায় বন্দী করে রাখা হয়েছে।
শহীদকে মুক্ত করতে হবে। পুলিসের সাহায্য চাইলেই পাওয়া যায়। কিন্তু কুয়াশা নিজের পদ্ধতিতে কাজ করতে ভালবাসে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় সে। গোয়েন্দাদের অজ্ঞাতে বিল্ডিংয়ের পিছন দিকে চলে যায়। | গা ঢাকা দিয়ে বিল্ডিংয়ের সামনের দিকে চলে আসে, তারপর প্রবেশ করে রাস্তার বিপরীত দিকের বিল্ডিংয়ে। শহীদ এই বিল্ডিংয়েই বন্দী হয়ে আছে।
নয়। মস্ত পাকা উঠানটা খা খা করছে। কিন্তু উঠানের দিকে না গিয়ে বাগানের গাছপালার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে নিঃশব্দ পায়ে হাঁটতে লাগল কুয়াশা। বিল্ডিংটার ছাদে একজন লোক বিনকিউলার হাতে নিয়ে বসে আছে, লক্ষ্য করেছে সে। মোখলেসুর রহমানের অফিস বিল্ডিংয়ে খানিক আগে যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। গেছে, তার ফলাফল দেখার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠেছে লোকটা, ফলে কুয়াশাকে সে লক্ষই করেনি।
বিল্ডিংয়ের পিছন দিকে চলে এল কয়াশা। আটতলা থেকে নেমে এসেছে বিল্ডিংয়ের গা বেয়ে কালো মোটা পানির পাইপ। গাছে চড়ার ভঙ্গিতে সেই মোটা পাঁনির পাইপ বেয়ে অবলীলায় উঠে যেতে লাগল কুয়াশা।
ছয়তলায় উঠে কুয়াশা একবার তাকাল নিচের দিকে। সন্দেহ হয়েছে তার।
সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হলো। বাগানের ভিতর দেখা গেল একজন লোককে। লোকটা একটা পিস্তল হাতে চঞ্চল ভাবে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে, যেন খুঁজছে। কাউকে।
কুয়াশার অনুপ্রবেশ প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
লোকটাকে কিছুক্ষণ লক্ষ করল কুয়াশা। হন্যে হয়ে খুঁজছে সে। কিন্তু ভুলেও তাকাচ্ছে না উপর দিকে ।
আবার উঠতে শুরু করল কুয়াশা। নিচের দিকে আর তাকানই না। আটতলার ছাদে উঠে পড়ল সে।
কুয়াশা ৫১
১৩৩
ছাদের সামনের দিকে বসে আছে একজন লোক। কুয়াশার দিকে পিছন ফিরে বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে সে।
কুয়াশা দৃঢ় অথচ নিঃশব্দ পায়ে তার ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটার পাশেই রয়েছে একটি টেলিস্কোপ ফিট করা অটোমেটিক রাইফেল এবং একটি পিস্তল।
মুচকি হেসে কুয়াশা একটা হাত বাড়িয়ে দিল লোকটার ঘাড়ের দিকে। লোহার মত হাত দিয়ে লোকটার ঘাড় চেপে ধরল সে।
| লোকটা তীব্র যন্ত্রণায় গোঙাতে শুরু করল।
শক্ত, পাথরের মত হয়ে গেল লোকটার শরীর। নড়াচড়ার শক্তি বলতে এক বিন্দুও নেই তার। সম্পূর্ণ জড় পদার্থের মত দশা হয়েছে তার।
শান্তভাবে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল কুয়াশা। বোকার মত প্রতিটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে লাগল লোকটা।
| প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জেনে নিয়ে কুয়াশা ঘাড়ের নার্ভ সেন্টারে আঙুলের চাপ বৃদ্ধি করল একটু। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল লোকটা।
সিঁড়ি বেয়ে সাততলায় নেমে এল কুয়াশা।
ফাঁকা করিডর। দু’পাশে দরজা। নিঃশব্দ পায়ে একটার পর একটা দরজার পাশ দিয়ে সামনের বাকের দিকে এগোচ্ছে সে।
সর্বশেষ দরজাটা পেরোল কুয়াশা। সাথে সাথে নিঃশব্দে খুলে গেল দরজার কবাট দুটো। বেরিয়ে এল একটা পিস্তল ধরা লোমশ কালো হাত। কুয়াশার বিশাল পিঠটা মাত্র এক হাত দূরে পিস্তলের নলের কাছ থেকে।
| গর্জে উঠল পিস্তলটা।
কিন্তু কুয়াশা বসে পড়েছে তারও আগে। বিদ্যুৎবেগে ঘুরিয়ে নিয়েছে নিজের দেহটাকে, হাত উঁচু করে বাঘের মত থাবা মেরে ধরে ফেলেছে লোমশ পিস্তল ধরা হাতটা।
ভয়ে চিৎকার করছে লোকটা। কুয়াশা উঠে দাঁড়াল। টেনে বের করে আনন লোকটাকে করিডরে। কাঁপতে কাঁপতে মাথার উপর অপর হাতটা তুলে ধরল লোকটা। :
ছেড়ে দিল কুয়াশা তাকে। লোকটার দুচোখে বিস্ময় ফুঠে উঠল। ডান হাত তুলে প্রচণ্ড একটা ঘুসি মারল কুয়াশা লোকটার কানের নিচে। এক ঘুসিতেই জ্ঞান। হারাল সে, ছিটকে পড়ে গেল দূরে।
বাঁক নিল কুয়াশা। শান্ত দেখাচ্ছে তাকে। মহীরূহের মত প্রকাণ্ড শরীরটা দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
শত্রুপক্ষ তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। কিন্তু সে জন্যে চিন্তিত বলে মনে হলো না তাকে।
শহীদের জন্যই চিন্তিত সে। ওকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে এসেছে সে। করিডরের শেষ মাথায় একটি দরজা। দরজাটা খোলা। ফাঁদ নাকি?
১৩৪
ভলিউম ১৭
সামনে দাঁড়িয়ে কুয়াশা দেখল ভিতরের কামরাটা সম্পূর্ণ ইস্পাত দিয়ে তৈরি। ভিতরে প্রবেশ করল সে। কেউ নেই। আসবাবপত্র বলতে একটি স্টীলের চেয়ার ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কামরার আর কোন দরজা নেই। তবে বিপরীত দিকের দেয়ালটা দু’ফাঁক দেখা যাচ্ছে। গোপন পথ।
ফাঁক করে রাখা হয়েছে কেন দেয়ালটা? নিচের দিকে সিঁড়ি নেমে গেছে।
হঠাৎ শহীদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল কুয়াশা। কঠিন কণ্ঠে কাকে যেন কি বলছে ও। দেয়ালের ফাঁকের কাছে, সিঁড়ির মাথায় গিয়ে দাঁড়াল সে। শহীদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় কি যায় না। ভেসে আসছে নিচের দিক থেকেই।
শয়তান দেওজী! তোমার দিন ফুরিয়েছে! ভেবেছ আমাকে বন্দী করে দুনিয়া জয় করে ফেলেছ!’,
দেওজী কাংকারিয়ার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, বন্দী হয়েও এত তেজ টিকটিকি মহাশয়ের-ভারি তাজ্জবের কথা! কুয়াশার ভরসায় লাফিয়েন না, টিকটিকি মহাশয়! সে-ও বন্দী হলো বলে।’
| বিড়ালের মত নিঃশব্দে লাফ দিল কুয়াশা। দুই লাফে আঠারোটা সিঁড়ির ধাপ টপকে একটা করিডরে নামল।
থমকে দাঁড়াল সে। করিডর, দু’পাশের দেয়াল, দেয়ালের গায়ের দরজাগুলো–সব চকচকে ইস্পাতের তৈরি।
খটাশ করে কান ফাটানো শব্দ হলো। চমকে ঘাড় ফিরাল কুয়াশা। সিঁড়ির সামনে একটা ইস্পাতের দেয়াল নেমে এসেছে সিলিংয়ের কাছ থেকে। সিঁড়িটা গায়েব হয়ে গেছে যেন পলকের মধ্যে।
খটাশ! আবার সেই একই শব্দ।
পিছন দিকের করিডরে আর একটা দেয়াল দেখা যাচ্ছে। আবার সেই শব্দ হলো।
এবার সামনে দেখা গেল নতুন একটা দেয়াল। ইস্পাতের দেয়ালের ভিতর বন্দী করে ফেলা হয়েছে কুয়াশাকে।
হাঃ হাঃ হাঃ হা…!’ কর্কশ কণ্ঠের অট্টহাসি ভেসে আসছে অস্পষ্টভাবে কোথাও থেকে ।
জীবনে এই প্রথম মুহূর্তের জন্যে হলেও বিমূঢ় হয়ে পড়ল কুয়াশা। করিডর ধরে এখানে এসে বন্দী হবার আগেই সে লক্ষ্য করেছে লুকিয়ে রাখা থার্মাইট বোমাগুলো। মৃত্যুকে সে ভয় করে না। তার ভয় শহীদের জন্য।
শহীদ মারা যাবে একথা কুয়াশা ভাবতেই পারে না। কিন্তু এসব কথা ভাববার সময় তখন নেই কুয়াশার।
ইস্পাতের দেয়ালের একেবারে উপরের দিকে, সিলিংয়ের কাছে, ভেন্টিলেটার দেখা যাচ্ছে। পকেট থেকে ছোট্ট একটা পেন্সিল বের করে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল সে। তারপর হাঁটু মুড়ে বসবার উপক্রম করল। কিন্তু বসল না কুয়াশা। হাটু ভাজ করে দেহটাকে একটু নিচু করে লাফ দিল উপরের দিকে। এক হাত দিয়ে ধরল ভেন্টিলেটারের ইস্পাতের রড। ঝুলে রইল সেই অবস্থায়। ঝুলতে ঝুলতে দাঁত
কুয়াশা ৫১
১৩৫
থেকে পেন্সিলটা নিল অপর হাতে। পেন্সিলটা মুখের সামনে ধরে কথা বলতে শুরু করল কুয়াশা।
মোখলেসুর রহমানের অফিস বিল্ডিংয়ে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে, নিহত হয়েছে একজন গোয়েন্দা এবং বন্দী হয়েছে শত্রুপক্ষের কয়েকজন অনুচর–এ খবর পেয়ে ঝড়ের বেগে জীপ চালিয়ে অকুস্থলে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন মি. সিম্পসন।
বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে পুলিশ অফিসারদের গাড়ির ভিড়। মি. সিম্পসন জীপ থেকে নেমেই প্রথম জানতে চাইলেন, কুয়াশা কোথায়?’
কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারল না।
এমনসময় বিপরীত দিকে বিল্ডিংয়ের কোথাও থেকে ভেসে এল কুয়াশার কণ্ঠস্বর।
কুয়াশা পেন্সিলের মত দেখতে মিনি মাইক্রোফোনে কথা বলছে, আমি কুয়াশা বলছি। দু’জন বেপরোয়া ক্রিমিনাল এই বিল্ডিং ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করছে। প্রতিটি প্রবেশ পথের দিকে নজর রাখা হোক দূর থেকে। আমি আবার বলছি•••দূর থেকে। তারা যেন পালাতে না পারে। এবং কোন অবস্থাতেই কেউ এই বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করবেন না, বা কাউকে প্রবেশ করতে দেবেন না। আমি আবার বলছি, কোন অবস্থাতেই এই বিল্ডিংয়ের ভিতর কেউ প্রবেশ করবেন না বা কাউকে প্রবেশ করতে দেবেন না।
এদিকে দেওর্জী কাংকারিয়া এবং সান্তারাম উল্কা মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্যুটকেসে ভরে গোপন সুড়ঙ্গপথ ধরে ছুটে চলেছে দ্রুত।
খানিক দূর যাবার পর ছোট্ট একটা এলিভেটরে চড়ল তারা। এলিভেটর তাদেরকে নামিয়ে দিল নিচের তলায়। তারপর আবার সুড়ঙ্গ পথ।
| প্রায় আড়াইশো গজ দীর্ঘ সুড়ঙ্গপথ। অন্য এলাকার একটি বাড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে পথটা। পথের শেষ মাথায় একটি দরজা। দরজার পাশের দেয়ালে একটি সুইচ বোর্ড।
সুইচ বোর্ডে লাল একটি বোতাম।
দেওজী কাংকারিয়া হাঃ হাঃ হাঃ হা করে বিকট উল্লাসে হাসতে হাসতে সেই লাল বোতামটায় চাপ দিল আঙুলের।
ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কুয়াশা।’
সত্যিই বুঝি তাই! গোটা বিল্ডিংটা কেঁপে উঠল থর থর করে। যেন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। সেই সাথে ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়ার মত বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হলো। মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল বিশাল অগ্নিশিখা।
বিল্ডিংয়ের ছয়তলায় আগুন ধরে গেছে। অস্বাভাবিক দ্রুতবেগে সেই আগুন গ্রাস করছে গোটা বাড়িটাকে।
Leave a Reply