৪৯. প্রফেসর ওয়াই ৬: রহস্যপুরী [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪৯
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ১৯৭৬ এক দরজা বন্ধ করে হাওদার ভিতরে বসে পরবর্তী কর্তব্যের কথা ভাবছে কুয়াশা। নির্মম হয়ে উঠেছে সে। প্রফেসর ওয়াইয়ের অমানবিক অত্যাচার ছাড়িয়ে গেছে তার সহ্যের সীমা।
জর্মন শেখকে দেখেই চিনে ফেলেছিল কুয়াশা। লোকটা জাত খুনী। প্রফেসর ওয়াইয়ের প্রভাবে সে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
| জ্ঞান ফেরে কুয়াশার হাওদার ভিতর।
চোখ মেলে সে দেখে এখনও তার শরীরে জড়িয়ে রয়েছে জাল। শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে কুয়াশা। ভারি আশ্চর্য লাগে তার, হাত-পা বাঁধা নেই কেন তার? প্রফেসর ওয়াই কি জংলীদেরকে তার হাত-পা বাধার হুকুম দিতে ভুলে গিয়েছিল?
| ভুলে যায়নি। ইচ্ছা করেই সে নির্দেশ দেয়নি প্রফেসর। যে গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে সে জ্ঞান হারায় সেটা ছিল খুবই মারাত্মক। প্রফেসর ভেবেছিল জ্ঞান ফিরতে কমপক্ষে কয়েক ঘন্টা সময় লাগবে।
কিন্তু প্রফেসর মারাত্মক ভুল করেছে। সাধারণ মানুষের চেয়ে কুয়াশার স্বাস্থ্য অনেক ভাল। জ্ঞান হারালেও গ্যাসের প্রভাব থেকে মুক্তি পায় সে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই।
জাল ছিঁড়ে নিজেকে মুক্ত করতে কোন অসুবিধেই হয়নি কুয়াশার। জাল ছিঁড়ে নিজেকে মুক্ত করার পরই কুয়াশা টের পায় হাতি দুটো দাঁড়িয়ে পড়েছে।
* দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় সে। রাজার দেহরক্ষী হিসেবে পরিচয়দানকারী জর্মন শেখকে চিনতে ভুল হয়নি কুয়াশার। জর্মন শেখের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে কুয়াশা দ্রুত চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করে।
গায়ে জাল চাপিয়ে নিয়ে হাওদার ভিতর আবার শুয়ে পড়ে সে। নিঃসাড় পড়ে থাকে, যেন এখনও তার জ্ঞান ফেরেনি। খানিকপরই জর্মন শেখ হাওদার ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
| কুয়াশার ডান হাতটা ছিল দেহের আড়ালে লুকানো। সেই হাতে ধরা ছিল একটা পিল।
জর্মন শেখ দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতেই হাতটা বের করে পিস্তলের ট্রিগারে চাপ দেয় কুয়াশা।
বিষ মাখানো সরু সঁচ বুলেটের বেগে বিদ্ধ হয় জর্মন শেখের শরীরে। সাথে সাথে জ্ঞান হারায় সে। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় কুয়াশা।
অচেতন পতনোন্মুখ দেহটা ধরে ফেলে সে। তারপর ধীরে ধীরে নিঃশব্দে শুইয়ে দেয় কাঠের মেঝেতে।
দ্রুত জর্মন শেখের পোশাক খুলে নেয় কুয়াশা। জর্মন শেখ অসভ্য জংলীর ছদ্মবেশে ছিল। এবার কুয়াশা সেই ছদ্মবেশ ধারণ করে।
নিজের কাপড়চোপড় জর্মন শেখকে পরিয়ে দেয় কুয়াশা। আলখেল্লা দিয়ে ঢেকে দেয় তার মুখ আর মাথা । তারপর বেরিয়ে আসে হাওদা থেকে।
জংলীরা তার ছদ্মবেশ ধরতে পারেনি। কিন্তু প্রফেসর ওয়াই? তার চোখ কি ফাঁকি দেয়া সম্ভব হবে?
গ্রামের দিকে চলেছে ওরা। প্রফেসর ওয়াইকে এখানে পাওয়া যাবে, কুয়াশা জানে। ওর অনুমান, জংলীদের রাজাকে বন্দী করে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেছে প্রফেসর ওয়াই। কিংবা রাজাকে হয়তো সে হত্যাই করেছে, রাজার ছদ্মবেশ নিয়ে জংলীদের রাজা বনে গেছে সে।
হাওদার ভিতর বসে অনেক কথা চিন্তা করছিল কুয়াশা। প্রফেসরের চোখে ধুলো দিতে পারবে তো সে?
মনে পড়ছিল বারবার শহীদের কথা। ওরা এখন কোথায়? স্পেসক্রাফটে চড়ে দাবাগ্নি থেকে আত্মরক্ষা করতে না পারার তো কথা নয়। কিন্তু যদি প্রফেসর ওয়াই কোনভাবে নষ্ট করে দিয়ে থাকে সেটা?
গ্রামে গিয়ে কি দেখতে পাবে সেটাও চিন্তার বিষয়। যাকে উদ্ধার করার জন্য স্পেসক্রাফট ছেড়ে চলে এসেছে সে, তার পরিচয় এখনও জানা হয়নি। অবশ্য পরিচিতদের মধ্যেই কেউ হবে।
এরপর রহস্যপুরীর চিন্তা। প্রফেসর ওয়াই সবাইকে হত্যা করে রহস্যপুরীর কোটি কোটি টাকার ধন-সম্পদ লুঠ করতে চায়।
কিন্তু তা হতে দেবে না সে। কুয়াশা বেঁচে থাকতে প্রফেসর ওয়াই হস্তগত করতে পারবে না রহস্যপুরীর সাত রাজার ঐশ্বর্য। মনে মনে রহস্যপুরীতে অভিযান
পরিচালনার জন্যে পরিকল্পনা করতে লাগল কুয়াশা ।
এদিকটা জঙ্গল তেমন গভীর নয়। হাতি দুটোর গতি বেড়ে গেছে। গলায় বাধা ঘণ্টা দুটো ঘন ঘন বাজছে, টুং-টাং, টুং-টাং। হাতিদ্বয়ের পিঠের হাওদা থেকে
বেরিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় কুয়াশা।
চেনবার কোন উপায় নেই কুয়াশাকে। ছদ্মবেশটা নিখুঁত হয়েছে। জংলী রাজা অমেনটোটের প্রধান দেহরক্ষী সে।
গ্রামটা দেখা গেল খানিক পরই।
হাতি দুটোর পিছু পিছু নৃত্যগীতরত উলঙ্গ প্রায় অসভ্য জংলীরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। অভিযান সফল হয়েছে তাদের। দেবতার শত্রুকে রাজা বন্দী করে হত্যার । নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাজটা নিখুঁত ভাবে সেরেছে তারা। দেবতার শত্রুকে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফিরে যাচ্ছে গ্রামে।
| হাওদার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছে কুয়াশা। প্রফেসর ওয়াই খবর। শুনে নিশ্চিন্ত হবে। একমাত্র তাকেই সে পরম এবং প্রবল পরাক্রমশালী শত্রু বলে
ভলিউম ১৭
মনে করে। | হাসছিল কুয়াশা সেই কথা ভেবেই। তার মৃত্যু সংবাদ সে নিজেই শোনাবে প্রফেসরকে। প্রফেসর আনন্দে আহ্লাদে আটখানা হবে, অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে তুলবে চারদিক। | কিন্তু, যদি সে কুয়াশার ছদ্মবেশ ধরে ফেলে? যদি সে সন্দেহ করে এ লোক জর্মন শেখ নয়?
গ্রামটা প্রকাণ্ড। নারকেল আর সুপারি গাছ দিয়ে ঘেরা বিরাট এলাকাটা। গ্রামের মাঝখানে পাঁচ মানুষ সমান উঁচু দোতলা। ওটাই রাজার বাসভবন। বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি। রাজপ্রাসাদের সম্মুখভাগটা খোলামেলা। রেলিং দিয়ে ঘেরা উঁচু খোলামেলা ওই জায়গাটাতেই বসে রাজা শাসনকার্য পরিচালনা করেন। | গ্রামের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে জংলী যোদ্ধারা। বর্শার মুখ আকাশের দিকে তুলে রাজার হাতি দুটোকে অভ্যর্থনা জানায় তারা। সরে দাঁড়ায় সসম্মানে একপাশে।
| হাতিদ্বয় প্রবেশ করল গ্রামের ভিতর। | গ্রামের চারদিকে উলঙ্গ জংলীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজার হাতি দুটোকে দেখে সবাই ছুটে এল। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কিশোর-কিশোরী, ছেলে-মেয়ে সবাই উলঙ্গ প্রায়! প্রকৃতির সাথে প্রতিমুহূর্তে কঠোর সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় এদেরকে। সভ্যতার আলো এবং সুযোগ সুবিধে থেকে এরা সর্বতোভাবে বঞ্চিত। অরণ্যের নানারকম পশুর মাংস পুড়িয়ে খেয়ে জীবন ধারণ করে এরা। এদের মধ্যে নেই কোন ভদ্রতা জ্ঞান, নেই শিক্ষা। দলে দলে কোন্দল, উপজাতিতে উপজাতিতে ঝগড়া-লড়াই লেগেই আছে। প্রাণের কোনই মূল্য নেই এদের কাছে। সবল দুর্বলকে সুযোগ পেলেই, কারণে বা অকারণে, হত্যা করে।
সভ্য জগতের মানুষ এদের উপর অত্যাচার কম করেনি। এরাও কম যায় না। সভ্য দুনিয়ার মানুষ দেখলেই এদের জিভে জল এসে যায়। আফ্রিকার অনেক অসভ্য জংলী এই বিংশ শতাব্দীতেও মানুষের মাংস খায়।
গ্রামের চারদিকে ছোট ছোট বাঁশের ঘর। জংলীদের এই উপজাতিটা অন্যান্যদের তুলনায় বেশ একটু এগিয়ে গেছে। মাংস পোড়া এরা এখনও খায়, সভ্য দুনিয়ার মানুষ পেলে এদের জিভে আজও পানি আসে, কিন্তু এরা মোটামুটি একটা সমাজ তৈরি করে নিয়েছে, যে সমাজে রাজা আছে, সর্দার আছে, আছে যোদ্ধা, শিকারী । এরা ঘর তৈরি করে বাস করে। গ্রামটাও এদের নিজেদের তৈরি।
| গ্রামের মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা মাঠ। মাঠের এক প্রান্তে রাজার বাসভবন! মাঠের চারদিকে পদ্মাসনে বসে আছে হাজার কয়েক জংলী। সবাই উত্তেজিত এবং চঞ্চল। কিন্তু রাজার নির্দেশে কেউ নড়ছে না, কারও মুখে কোন কথা নেই।
রাজা নেমে এসেছেন মাঠের মাঝখানে। সেখানে কয়েকটা মোটা খুঁটির সাথে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে কয়েকজন লোককে। তাদের মধ্যে দুজন নারীকেও দেখা যাচ্ছে।
মাঠের ভিতর প্রবেশ করল হাতিদ্বয়। রাজা অমেনটোট অট্টহাসিতে ফেটে কুয়াশা ৪৯
পড়লেন।
| জংলীরা অবাক বিস্ময়ে দেখছে রাজাকে। রাজা অমেনটোট চিরকাল গভীর এবং মিতবাক স্বভাবের। কিন্তু গত কদিন থেকে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তার মধ্যে। যখন তখন হাসছেন তিনি। দেবতারা নাকি তাঁর কাছে
এসেছিল। তারা জানিয়ে গেছে রহস্যপুরীর পবিত্রতা নষ্ট করার জন্য সভ্য দুনিয়ার কিছু লোক আসছে এই জঙ্গলের পথ ধরে। তাদেরকে বন্দী করে হত্যা করতে হবে।
| এসব কথা তারা শুনেছে খোদ রাজার মুখে। রাজা ভবিষ্যত্বাণী করে বলেছেন, অমুক স্থানে শত্রু আছে, দেবতারা আমাকে জানিয়ে গেছে। তোমরা যাও, শত্রুদেরকে ধরে নিয়ে এসো। শত্রুদেরকে বন্দী করার জন্য একের পর এক দল পাঠিয়েছেন রাজা। দলগুলোর সাথে দিয়েছেন দেবতার প্রদত্ত অলৌকিক নানা রকম । অত্র। জংলীরা দলবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট স্থানে গেছে। ওৎ পেতে, ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করেছে তারা। অবশেষে, রাজার ভবিষ্যত্বাণীই সত্য হয়েছে। শত্রুদেরকে দেখা গেছে এগিয়ে আসতে। জংলীরা তাদেরকে বন্দী করে ধরে নিয়ে এসেছে গ্রামে। | হাতির পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নামল কুয়াশা। তার মুখে বিজয়ের হাসি।
অট্টহাসি থামল রাজা আমেনটোটের। মাঠের চারদিকে বসে আছে জংলীরা। তাদের সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে রাজা বললেন, জংলীরা অনেক দূরে, ওরা আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না। নিজেদের ভাষাতেই কথা বলি আমরা, কি বলো জর্মন শেখ!’
স্বস্তিতে ভরে উঠল কুয়াশার বুক। প্রফেসর ওয়াই-ই রাজা অমেনটোটের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে। যাক, প্রফেসর ওয়াইয়ের ছদ্মবেশ সে ধরতে পারলেও তার ছদ্মবেশ প্রফেসর ওয়াই এখনও ধরতে পারেনি।
ইয়েস, স্যার!’
প্রফেসরের কথায় সায় দিয়ে মোটা খুঁটির সাথে শক্ত করে বাঁধা বন্দীদের দিকে তাকাল কুয়াশা। শহীদ, কামাল, ডি. কস্টা, মহুয়া, ওমেনা এবং মি. সিম্পসন–সবাইকে বন্দী করে এনেছে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু আর একজন কোথায়? যার জন্যে এত বিপদের মধ্যে দিয়ে এখন পর্যন্ত এসেছে সে তার ছায়াও তো দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
জর্মন শেখ! তোমার অ্যাসাইনমেন্ট সফল তো?’ কুয়াশা নকল রাজার দিকে তাকাল, ইয়েস, স্যার।
মি. কুয়াশা খতম?’
‘খতম, স্যার। কৃপের ভেতর তার অচেতন দেহটা নামিয়ে আমরা মাটি ফেলে কৃপটা চাপা দিয়ে দিয়েছি। সে কেন, তার আত্মাও ওখান থেকে বেরুতে পারবে না আর।
| বিদ্যুতবেগে বন্দীদের দিকে তাকাল প্রফেসর ওয়াই, মি, টিকটিকি, শুনলে তো? তোমাদের রক্ষাকর্তাকে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে! এবার? বিশ্বাস হয়? | শহীদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, ‘বোকার স্বর্গে বাস করছেন আপনি,
ভলিউম ১৭
প্রফেসর। কুয়াশা এত সহজে মরতে পারে না। কারও কথা শুনে আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই।’
কুয়াশা হঠাৎ চোখ টিপে ইঙ্গিত করল শহীদের উদ্দেশ্যে। কথা শেষ না করে থেমে গেল সে।
কুয়াশা বলে উঠল, “কেউ যদি বিশ্বাস না করে তাহলে আমাদের করার কিছুই নেই, স্যার। তাছাড়া বন্দীদেরকে বিশ্বাস করাবার চেষ্টাই বা আমরা করছি কেন? ওদের সময়ও তো ঘনিয়ে এসেছে?
| “থ্যাঙ্ক ইয়, জর্মন। কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছ আমাকে। ইয়েস, ওদেরকে মরতে হবে। কোন রকম ঝুঁকি আমি আর নিতে চাই না। মন একটু নরম করে এর আগে দেখেছি আমি। এদেরকে কয়েক হাজার বার ক্ষমা করেছি আমি। তা দেখে ওরা ধরে নিয়েছে আমি দুর্বল। আর নয়। এবার আমি আমার ল্যাবরেটরিতে ফিরে যেতে চাই। কাজ করতে চাই এই পৃথিবীটাকে যান্ত্রিক মানুষের পৃথিবী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। এই কাজের জন্য চাই কোটি কোটি, শত সহস্র কোটি টাকা। টাকার ব্যবস্থা হবে। আমার হিসেব অনুযায়ী রহসপুরী থেকেই পাওয়া যাবে এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ। মুক্তো এবং ডায়মণ্ডের মূল্যও পাঁচশো কোটি টাকার কম হবে না। রহস্যপুরীর ধন উদ্ধার করার পর আমি লুঠ করব আমেরিকার ফোর্ট নক্স সহ সবগুলো বড় বড় ব্যাঙ্ক। বছর দুয়েক এক মনে কাজ করার জন্য যথেষ্ট টাকা পাওয়া যাবে সব মিলিয়ে। টাকাগুলো সংগ্রহ করা শেষ হলেই আমি ল্যাবরেটরিতে ঢুকব। কিন্তু এরা বেঁচে থাকলে আমাকে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে দেবে না, এক একটা খুদে হারকিউলিস এরা। পালের গোদা বড় হারকিউলিসকে জ্যান্ত কবর দিয়েছি। এদেরকেও হত্যা করব। কিন্তু তার আগে হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিতে চাই। জর্মন শেখ!
ইয়েস, স্যার।’
‘টিকটিকি শহীদ কি বলছে জানো? বলছে, আমি যাকে মি. সিম্পসনের ছদ্মবেশে গ্রীনল্যাণ্ডে পাঠিয়েছিলাম–আমি ডেভিলের কথা বলছি, তোমার বন্ধু। ওকে গ্রীনল্যাণ্ডে পাঠিয়েছিলাম মি. সিম্পসনের ছদ্মবেশে, বলেছিলাম তোমাকে কথাটা?’
ইয়েস, স্যার।’
মি, টিকটিকি বলছে ডেভিল নাকি ধরা পড়ে যায় এই জঙ্গলে স্পেসক্রাফট নামবার পর। পেসক্রাফটটা নষ্ট করে দেবার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম ডেভিলকে। নষ্ট সে ঠিকই করে। কিন্তু শহীদ তাকে সন্দেহ করে এবং পরে তার ছদ্মবেশ ধরে ফেলে।’
মাই গড! তারপর, স্যার!’
প্রফেসর দাতে দাঁত চেপে বলল, ‘মি, টিকটিকি নাকি ডেভিলকে হত্যা করেছে।
‘হোয়াট! দ্রুত চিন্তা করছিল কুয়াশা। গ্রীনল্যাণ্ড থেকে সে যাকে উদ্ধার করে তিনি
কুয়াশা ৪৯
তাহলে মি. সিম্পসন নন! একটু চিন্তা করতেই রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রফেসর ওয়াই মি. সিম্পসনকে গ্রীনল্যাণ্ড থেকে বন্দী করে নিয়ে আসে এই জঙ্গলে, তার বদলে গ্রীনল্যাণ্ডে রেখে আসে নকল মি. সিম্পসনকে অর্থাৎ ডেভিলকে।
মি. সিম্পসন এই জঙ্গলে বন্দী ছিলেন বলেই তার ইণ্ডিকেটর যন্ত্রে ধরা পড়েছিল ব্যাপারটা।
প্রফেসর ওয়াই বলে উঠলেন, জর্মন, বন্ধুর জন্য দুঃখ কোরো না। তার হত্যাকারীকে দেখতে পাচ্ছ তুমি তোমার সামনেই। এদেরকেই হত্যা করে
প্রতিশোধ নেবে তুমি। তাহলেই বন্ধুর প্রতি কর্তব্য পালন করা হবে।’
| চমকে উঠল কুয়াশা। প্রফেসর ওয়াই কি তার ছদ্মবেশ ধরে ফেলেছে? শহীদ, মহুয়া, মি. সিম্পসন, ডি. কস্টা, ওমেনা–এদেরকে খুন করতে হবে নিজের হাতে? প্রফেসর কি পরীক্ষা করতে চাইছে তাকে?
ইয়েস, স্যার।’ গম্ভীর হয়ে সায় দিল কুয়াশা।
তবে এখনই নয়। হাতের কাজগুলো শেষ করা দরকার আগে। হেলা পর্বতের পশ্চিমের গুহায় আমার ম্যাটার ট্রান্সমিট করার মেশিন আছে, মনে আছে তো? ওখানে বন্দী করে রেখেছি আবিদকে। তাকে দরকার হবে আমাদের। রহস্যপুরীর পথ চেনে সে। তাকে তুমি গিয়ে নিয়ে এসো। সন্ধ্যার আগেই ফেরা চাই। রাতে উৎসব হবে জংলীদের। তুমি আর জংলীরা এই হারকিউলিদেরকে বর্শার আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করবে।’
কুয়াশা হাঁফ ছাড়ল। প্রফেসর ওয়াই তাকে পরীক্ষা করছে না। এখনও সন্দেহ করেনি সে কিছু।
‘দেরি করা উচিত হবে না, জর্মন শেখ। তুমি যাত্রা করো। সাবধান, আবিদ যেন পালাতে না পারে।
কুয়াশা হাসল। বলল, আমার হাত ফসকে কুয়াশাই পালাতে পারেনি, আর এ তো কুয়াশার তুলনায় একটা মাছির চেয়েও ছোট। আপনি ভাববেন না, স্যার। সন্ধ্যার আগেই আবিদকে নিয়ে ফিরে আসব।’
‘আসার সময় খুব সাবধানে আসবে। আবিদ এই এলাকায় অনেকদিন ছিল। গরিলারা ওকে চেনে। গরিলারা যেন ওকে দেখতে না পায়।
ইয়েস, স্যার।
যাও তুমি। সন্ধ্যার আগেই ফিরো। সন্ধ্যার পরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা হবে।’
শহীদের দিকে আবার চোখ টিপে ইঙ্গিত করল কুয়াশা। তারপর ঘুরে দাঁড়াল।
দীর্ঘ পদক্ষেপে বেরিয়ে এল কুয়াশা জংলীদের গ্রাম থেকে।
গ্রামের ভেতর বিকট উল্লাসে ফেটে পড়ছে হাজার হাজার অসভ্য জংলী। রাজা অমেনটোট ঘোষণা করেছেন, বন্দীদেরকে আজ রাতে বর্ষার খোঁচা মেরে মেরে হত্যা করা হবে।
উৎসব চলবে আজ সারাটা দিন এবং সারাটা রাত। বন্দীদের মাংস আজ
১০
ভলিউম ১৭
আগুনে ঝলসে আহার করা হবে।
জংলীরা আনন্দে আত্মহারা। তাদের গগনবিদারী চিৎকারে চারদিক কেঁপে কেঁপে উঠছে–জয় হোক রাজার! জয় হোক রাজা অমেনটোটের।
রাজা অমেনটোটকে উদ্ধার করতে হবে। বনভূমির উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে
যেতে যেতে ভাবছে কুয়াশা। রাজাকে না দেখলে জংলীদের ভুল ভাঙবে না।
কিন্তু হাতে সময় বড় কম। পশ্চিমের হেলা পর্বত কি এখানে। সেখানে না গেলেও নয়। আবিদকে মুক্ত করা দরকার। আবিদের গরিলা বাহিনী কোন কাজে আসে কিনা দেখতে হবে।
এদিকে সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে জংলীদের গ্রামে। কোনক্রমেই দেরি করা চলবে না।
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল কুয়াশা। তার উপর নির্ভর করছে শহীদ, মহুয়া এবং অন্যান্যদের প্রাণ।
হাতির পিঠে চড়ে রওনা হবার কথা ভেবেছিল কুয়াশা। কিন্তু গভীর জঙ্গলে হাতি দ্রুত এগোতে পারে না। হাতির সাহায্য নিলে সময় নষ্ট হবে ভেবে কুয়াশা পা দুটোর উপর ভরসা করেই রওনা হয়েছে হেলা পর্বতের উদ্দেশে।
হেলা পর্বত অচেনা নয় কুয়াশার। পশ্চিমের হেলা পর্বতে সে কখনও না গেলেও তার কাছে যে মাপ আছে তাতে হেলা পর্বতের নিশানা রয়েছে। কিন্তু পর্বতের ওহাটা খুঁজে বের করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে।
কোন একটা গুহার ভিতরেই আছে প্রফেসর ওয়াইয়ের আস্তানা। ম্যাটার ট্রান্সমিট করার মেশিন এবং আবিদ আছে সেই আস্তানায়।
পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিক দেখে নিচ্ছে সে। মাথার উপর চলে এসেছে আফ্রিকার কুদ্ধ সূর্য। ট্রাউজারের পকেট থেকে বিনকিউলার বের করল সে। চোখে তুলল সেটা। পাহাড়ের প্রতি ইঞ্চি জায়গা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে
সে।
অদ্ভুত একটা কাণ্ড দেখতে পেল কুয়াশা। পাহাড়ের প্রায় একশো গজ ওপরে হঠাৎ দেখা গেল দুটো গরিলাকে। পলকের জন্য দেখল কুয়াশা। গরিলা দুটো ছুটছে। পরক্ষণে পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা।
| সেদিকে আরও খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল কুয়াশা। ব্যাপার কি! পাহাড়ী গরিলা তো সহজে ভয় পাবার মত পশু নয়। এরা যেমন হিংস্র তেমনি অসমসাহসী। মানুষ, | বাঘ, সিংহ-কাউকেই এরা পরোয়া করে না।
হঠাৎ আরও একটা ব্যাপার দেখতে পেল কুয়াশা। ঠিক যে জায়গায় গরিলা দুটোকে দেখা গিয়েছিল সেই জায়গাতেই আবার দেখা গেল একটা বুনো হাতিকে। শুড় তুলে ঝড়ের বেগে ছুটছে হাতিটা!
কুয়াশা ৪৯
পাহাড়ের উপর হাতি! অবিশ্বাস্য ব্যাপার। নিশ্চয়ই পাহাড়ের গায়ে পেঁচানো রাস্তা আছে। তা না হলে হাতি উঠল কি ভাবে অত উঁচুতে।
ঘটনা দুটো অবহেলার বিষয় নয়। কুয়াশা স্থির করুল পাহাড়ের চারদিকটা দেখতে হবে। পথ একটা আছেই। নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে সেটা।
কিন্তু পথ থাকলে তা বিনকিউলারে ধরা না পড়বার কারণ কি? পথের পাশে কি পাথরের দেয়াল বা সুপ সৃষ্টি করে রেখেছে কেউ, যাতে নিচ থেকে পথের
অস্তিত্ব টের পাওয়া না যায়?
অসম্ভব নয়।
ক্ষীণ একটা আশা জেগে উঠল কুয়াশার বুকে। প্রফেসরের কীর্তি হতে পারে এটা। হয়তো সে তার আস্তানায় যাতায়াত করার সুবিধার্থে একটা রাস্তা তৈরি করে রেখেছে। এই আস্তানা হয়তো বহুকাল আগেই গড়ে তুলেছে সে। | অল্পক্ষণ পরই কুয়াশার অনুমান সত্য প্রমাণিত হলো। যা ভেবেছিল সে, ঠিক । তাই। পাহাড়ের পাদমূল থেকে পাহাড়কে পেচিয়ে পেঁচিয়ে প্রায় সমতল একটা রাস্তা ক্রমশ উঠে গেছে ওপর দিকে। পথের একধারে ছোট বড় পাথরের স্তূপ। দূর
থেকে মনেই হয় না, পাথরগুলো কেউ বিশেষভাবে জড়ো করে রেখেছে।
খুব বেশি দূর উঠতে হলো না কুয়াশাকে। পাহাড়টাকে বার তিনেক ঘুরে দুশো গজের মত উপরে উঠে থমকে দাঁড়াতে হলো তাকে।
একটা গুহামুখ দেখা যাচ্ছে। ভিতরটা অন্ধকার। সোজা চলে গেছে পাহাড়ের অভ্যন্তরে।
লেসারগানটা বের করল কুয়াশা। এই গুহার ভিতর প্রফেসরের আস্তানা নাও থাকতে পারে। পাহাড়ী গরিলারা সাধারণত দখল করে রাখে এই ধরনের
গুহাগুলোকে।
টর্চ বের করে জালাল সে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ভিতর দিকে। এঁকেবেঁকে অনেক দূর চলে গেছে সুড়ঙ্গের মত। টর্চের আলোয় হঠাৎ দেখা গেল একটা দরজা।
লোহার দরজার গায়ে কোন তালা নেই। গুহার দেয়ালে টর্চের আলো ফেলল সে। সুইচবোর্ড থাকার কথা। আছে, দেখতে পেল কুয়াশা। দুটো সুইচে আঙুল দিয়ে দুটোই চেপে ধরুল কুয়াশা। •
উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল গুহার ভিতরটা। একই সাথে লোহার প্রকাণ্ড দরজাটা ঘড় ঘড় শব্দে সরে গেল দুদিকে।
ভিতরটাও আলোকিত। প্রশস্ত একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। কেউ কোথাও নেই। পাথরের মোটা মোটা পিলার সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। চারদিকের দেয়ালে চারটে সুড়ঙ্গ পথ, চারদিকে চলে গেছে চারটে সুড়ঙ্গ। ** নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। এটা প্রফেসর ওয়াইয়ের সৃষ্টি বলে বিশ্বাস হয়
। প্রকৃতিই পাহাড়ের অভ্যন্তরে এই রকম একটা হলরুম তৈরি করে রেখেছে। তবে সুড়ঙ্গ মুখের পাথর দেখে বোঝা যায়, মসৃণ করা হয়েছে ওগুলো। সুড়ঙ্গগুলো ১২
ভলিউম
–
.
.
হয়তো প্রফেসর লোক দিয়ে বা মেশিন দিয়ে তৈরি করেছে।
আবিদ।
কুয়াশার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে। চারদিক থেকে ভেসে আসছে সেই একই শব্দ–আবিদ! আবিদ! আবিদ! আবিদ।
গা ছমছম করে ওঠে।,
ধীরে ধীরে থামল প্রতিধ্বনি। আবিদের কোন সাড়া নেই। আবার সশব্দে নামটা ধরে ডাকল কুয়াশা!
| দ্বিতীয়বার প্রতিধ্বনি থামতে ডান পাশের সুড়ঙ্গের দিক থেকে ভেসে এল আবিদের কণ্ঠস্বর, কে ডাকে আমাকে! কে ডাকে আমাকে কে ডাকে আমাকে! কে ডাকে আমাকে! কে ডাকে••!
আবিদ সাড়া দিয়েছে! সাড়া দিয়েছে সে একবারই। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে চারদিক থেকে। ‘
দ্রুত এগিয়ে গেল কুয়াশী। সুড়ঙ্গ ধরে হন হন করে হেঁটে খানিক দূর গিয়ে দাঁড়াল সে। সামনে একটা দরজা। দরজার গায়ে গোল একটা গর্ত। গর্তটা দেখেই কুয়াশা বুঝল অক্সিজেন প্রবেশের পথ এটা।
আবিদ! দরজা খোলার উপায় কি?’ হাত গলিয়ে দিন গর্তে। কিন্তু কিন্তু কে আপনি?’ কুয়াশা বলল, তুমি হয়তো আমাকে চিনবে না। আমার নাম কুয়াশা।
কুয়াশা! আপনি কুয়াশা! কুখ্যাত দস্যু আপনি! আমার ভাইয়ের মুখে শুনে ছিলাম আপনার দুষ্কর্মের কথা! আপনি কেন এখানে এসেছেন? কি চান? কিছুই নেই
আমার কাছে। আমাকে হত্যা করে আপনি
কুয়াশা গভীর! দাঁড়িয়ে আছে সে পাথরের মূর্তির মত। হঠাৎ সে বলে উঠল ভারি কণ্ঠে, তুমি ভুল শোনোনি, আবিদ! সত্যি আমি ডাকাত! আমি শোষকদের ধন-সম্পদ কেড়ে নিই, তাদেরকে প্রয়োজনে হতাও করি। কিন্তু তুমি আর কিছু শোনোনি? শোনোনি আমি গরীবের পরম বন্ধু! শোনোনি, আমি অসহায় মানুষের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে যাই? শোনোনি, শোষক অত্যাচারীদের ধন-সম্পদ কেড়ে নিয়ে কাদের মধ্যে সেসব বিলিয়ে দিই?’
আবিদের গলা কাঁপছে, না, শুনিনি! শুনলেও বিশ্বাস করতাম না। দস কখনও গরীবের বন্ধু হতে পারে না।’
‘এ তোমার ভুল ধারণা, আবিদ। তুমি জানো না। তুমি বিপদে পড়েছ, তাই এসেছি আমি। আমি জানি প্রফেসর ওয়াই তোমাকে বন্দী করে রেখেছে। আমি জানি, তোমার কাছে একটা কানা কড়িও নেই। তবু কেন এসেছি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এসেছি তুমি বিপদে আছ বলে। এসেছি তোমাকে মুক্ত করব বলে। | আমি বিশ্বাস করি না। আপনি দস্যু! আপনি আমাকে মুক্ত করতে এসেছেন ঠিক, কিন্তু তাতে আপনার স্বার্থ আহে। আপনি রহস্যপুরীর সন্ধান পেতে চান। রহস্যপুরীর সন্ধান একমাত্র আমিই জানি। তাই আপনি আমার কাছে এসেছেন। রহস্যপুরীর পথ চিনে নিয়ে আপনি আমাকে খুন করবেন।
কুয়াশা ৪৯
কুয়াশা বলল, না। রহস্যপুরীর পথ আমিও চিনি, আবিদ। আজ নয় বহুকাল আগেই রহস্যপুরীর নকশা আমার হাতে এসেছে। বিশ্বাস করছ না, কেমন? তবে শোনো, রহস্যপুরীর বর্ণনা দিই।’
রহস্যপুরী বাইরে থেকে দেখতে কেমন তা বর্ণনা করতে লাগল কুয়াশা। বর্ণনা শেষ করে জানতে চাইল সে, কি, মিলেছে?’
আবিদের গলায় বিস্ময়, আশ্চর্য! আপনি তাহলে।
কুয়াশা বল, হ্যাঁ রহস্যপুরী কোথায় অবস্থিত, কোন পথ ধরে গেলে তার দেখা পাওয়া যাবে তা আমি জানি। আফ্রিকার জঙ্গলে বহু জংলী রাজা আমার বন্ধু। তাদের কাছ থেকেই রহস্যপুরী সম্পর্কে জানতে পারি আমি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রহস্যপুরীতে এতদিন অভিযান চালাইনি। তার কারণ জংলীরা বিশ্বাস করে তাদের দেবতারা রহস্যপুরীতে বাস করেন। ওখানে গেলে রহস্যপুরীর পবিত্রতা নষ্ট হবে ভেবে জংলীরা কোন অ-জংলীকে যেতে দিতে চায় না। বন্ধুদের মনে দুঃখ দিতে চাইনি বলে তখন রহস্যপুরীতে যাইনি আমি। কিন্তু এখনকার অবস্থা অন্য রকম। প্রফেসর ওয়াইকে বাধা দেবার জন্য হলেও রহস্যপুরীতে অভিযান চালাতে হবে। যাক, আবিদ, দরজাটা খোলার উপায়টি বলো এবার।’
আবিদের কথামত কুয়াশা গর্তের ভিতর হাত গলিয়ে দিয়ে একটা বোম স্পর্শ করল। চাপ দিতেই দরজাটা খুলে যেতে লাগল ধীরে ধীরে।
দরজা পেরিয়ে একটা কাঁচ দিয়ে ঘেরা কেবিনের ভিতর প্রবেশ করল কুয়াশা। আবিদ বসে আছে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারের উপর। হাত-পা চেয়ারের সাথে বাধা তার।
কুয়াশার দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইল আবিদ। এ লোক দ্যু হয় কি করে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে সে। এমন রাজকীয় চেহারা, এমন সুপুরুষ কখনও ডাকাত হতে পারে না।
দ্রুত আবিদের বন্ধন মুক্ত করে দিল কুয়াশা।
বলল, আবিদ, তোমাকে একটা খুব জরুরী কাজ করতে হবে।’ সাগ্রহে জানতে চাইল আবিদ, বলুন।
কুয়াশা বলল, তুমি আমার সম্পর্কে যতটা জানো, আমি কিন্তু তোমার সম্পর্কে তার চেয়েও অনেক বেশি জানি। তুমি যে নকশাটা শিকারী অর্থাৎ বাজপাখির গলায় বেঁধে পাঠিয়েছিলে ঢাকায় তার কথাও আমি জানি। সেই নক্শাও আমার কাছেই আছে। নশাটা তোমাদের ঢাকার বাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে প্রফেসর ওয়াই। আমার পরিচিত একজন ডিটেকটিভ মি. শহীদ, তার সহকারী মি. কামাল, স্পেশাল ব্রাঞ্চের গোয়েন্দা অফিসার মি. সিম্পসন, আমার। সহকারী ডি. কস্টা–এরা সবাই প্রফেসরকে বাধা দেবার চেষ্টা করে। ফলে প্রফেসর এদেরকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে। এরা সবাই এখন এই কঙ্গোর গভীর জঙ্গলে প্রফেসরের হাতে বন্দী। প্রফেসর ওয়াই জংলীদের রাজা অমেনটোটের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে। জংলীরা তার ছদ্মবেশ ধরতে পারেনি। ওদের প্রকৃত রাজার কোন সন্ধান এখনও আমি পাইনি।’
ভলিউম ১৭
দাদা, আপনাকে আমি দাদা বলে ডাকার অনুমতি পাব কি? ‘অধিকারের প্রশ্ন নয়, ভাই। তুমি আমাকে যে কোন নামে ডাকতে পারো।’
আবিদ বলল, ‘একজন জংলীকে প্রফেসর ওয়াই বন্দী করে নিয়ে এসেছিল তিন দিন আগে। আমার সন্দেহ হচ্ছে, সেই হয়তো জংলীদের রাজা•••।’
সেই! প্রফেসর তাকে কি হত্যা•••?’
তা তো বলতে পারি না, দাদা। তবে এখান থেকে জংলীর অচেতন দেহটা কাঁধে করে নিয়ে বেরিয়ে যায় সে!
“আচ্ছা আবিদ, পাহাড়ের আরও উপরে কি কোন গুহাটুহা আছে?
সম্ভবত আছে। আমার সন্দেহ প্রফেসর মাল পত্তর রাখার জন্য একটা গুহাকে ব্যবহার করে। এখান থেকে অনেক যন্ত্রপাতি নিয়ে গেছে সে।
| কুয়াশা বলল, ঠিক আছে। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। কিন্তু হাতে সময় বড় কম, আবিদ। শহীদ, কামালএদেরকে প্রফেসর হত্যা করবে সন্ধ্যার পর। সন্ধ্যার আগেই আমাকে পৌঁছতে হবে জংলীদের গ্রামে। অবশ্য আমি না ফেরা অবধি প্রফেসর অপেক্ষা করতেও পারে। তবু, ঝুঁকি নেয়াটা উচিত হবে না। এদিকে জংলীদের রাজা অমেনটোটের ভাগ্য সম্পর্কে বাস্তব তথ্য চাই আমি। সে যদি বেঁচে থাকে তাহলে তাকে উদ্ধার করতে হবে। জংলীরা তাদের রাজাকে দেখে সব বুঝতে পারবে। খসে পড়বে প্রফেসর ওয়াইয়ের মুখোশ। ঠিক সেই সময়ই আঘাত হানতে চাই প্রফেসর এবং তার দলবলের ওপর।’
‘আপনি অনুমতি দিলে আমি একটা কথা বলি, দাদা,’সবিনয়ে বলল আবিদ। ‘তুমি বোধহয় তোমার গরিলাবাহিনীর কথা বলতে চাইছ?’
আবিদের মুখের চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠল, ‘দাদা, আপনি আমার মনের কথা বললেন কিভাবে!’
কুয়াশা হাসল। বলল, তোমার গরিলাবাহিনীর কথাও জানি আমি, আবিদ। তোমার সাহায্য দরকার হবে। কথাটা আগেই ভেবেছিলাম। তুমি এক কাজ করো। তোমার গরিলাবাহিনী নিয়ে তুমি জংলীদের গ্রামের দিকে রওনা হও। সন্ধ্যার ‘আগে পৌঁছতে পারবে তো!’
| ‘পারব, দাদা।
বেশ শোনো, গ্রামের ভিতর ঢুকে না ভুলেও। গ্রামের চারদিকে গরিলাদের শুকিয়ে রাখবে। আমি চেষ্টা করব সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে পৌঁছুতে। আমি পৌঁছে অবস্থা দেখে ব্যবস্থা করব।’
তাই হবে, দাদা।’
আরও খানিকক্ষণ আলোচনা করল ওরা, কুয়াশা জংলীদের গ্রামের অবস্থান জানিয়ে দিল আবিদকে। আকিদের হাতে তুলে দিল একটা পিস্তল। বিপদের-সায়ী হিসেবে।
গুহা থেকে বেরিয়ে এল দুজন। আবিদ বিদায় নিয়ে নামতে শুরু করল পাহাড়ি থেকে। কুয়াশা প্রফেসরের দ্বিতীয় গুহার সন্ধানে উঠতে শুরু করল আরও উপরে।
মাশী ৪৯
১৫
তিন
পেঁচানো পথ ধরে পনেরো মিনিট ওঠার পর কুয়াশা থমকে দাঁড়াল। সামনে এগোনো সম্ভব নয় আর। কালো লোমশ পাহাড়ী গরিলারা পথের উপর বসে আছে। একটা নয়, পাঁচ সাতটা। পথের বাকেও দেখা যাচ্ছে আরও কটাকে। তারা ছুটোছুটি করছে। একবার ছুটে চলে যাচ্ছে পথের বাকে, আড়ালে, পরমুহূর্তে পিছিয়ে আসছে সবেগে। দেখে মনে হচ্ছে, গরিলারা কাউকে তাড়া করে এগিয়ে যাচ্ছে, পরমুহূর্তে প্রতিপক্ষের তাড়া খেয়ে পিছু ছুটে আসছে।
হাতে লেসারগান থাকলেও সেটা ব্যবহার করার কথা ভাবল না কুয়াশা। গরিলার ব্যাপারে তার বিশেষ দুর্বলতা আছে।
কুয়াশাকে দেখে ক্লান্ত পাহাড়ী গরিলারা উঠে দাঁড়াল। প্রমাদ গুনল কুয়াশা। ঢাকের শব্দ উঠল, কেঁপে উঠল সেই শব্দে চারদিক। পাহাড়ী গরিলা ভীষণ হিংস্র, মানুষ দেখলেই তারা ক্রোধে অন্ধ হয়ে দুই হাত দিয়ে বিশাল বুক চাপড়াতে শুরু করে। বুক চাপড়াবার শব্দটাই ঢাক পেটাবার শব্দের মত শোনা যায়। এ তাদের যুদ্ধের আহ্বান।
লেসারগান তুলে বোতামে চাপ দিল কুয়াশা। পথের মাঝখানে গভীর একটা গর্তের সৃষ্টি হলো পরমুহূর্তে। কুয়াশার উদ্দেশ্য গরিলাদেরকে ভয় দেখানো।
লাফ দিয়ে গর্ত টপকে এগিয়ে আসছে পাহাড়ের মত প্রকাণ্ডদেহী গরিলারা। কুয়াশার উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ভয় পায়নি তারা।
সাদা কোদালের মত ধারাল বড় বড় দাঁত বের করে এগিয়ে আসছে তারা। সর্বনাশ! হাতের আওতায় পেলে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে ওরা তাকে।
| দ্রুত চিন্তা করছিল কুয়াশা। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার কোন পথ খুঁজে পেল না সে। স্থাণুর মত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা।
এমন সময় একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটল। রাস্তার বাঁকের দিক থেকে হঠাৎ ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে দেখা গেল অসংখ্য গরিলাকে।
বিমূঢ় হয়ে পড়ল কুয়াশা। এ কি কাণ্ড! এত গরিলা এখানে আছে! কিন্তু এমন উন্মাদের মত ছুটে আসছে কেন এরা।, কুয়াশাকে আক্রমণোদ্যত চার-পাঁচটা গরিলা থমকে দাঁড়াল। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল তারা। পরমুহূর্তে তাদের মধ্যেও একটা পরিবর্তন দেখা দিল। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে তারাও ছুটল পাগলের মত।
পথ ছেড়ে দিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ল কুয়াশা। এতক্ষণে বুঝতে পারল সে, গরিলাদের ভয় পাবার কারণ। | তাড়া করে আসছে বুনো হাতির দল। গরিলারা ভয়ে ছুটছে যে যেদিকে
পারছে।
ঘটনাটা অতি অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে গেল। কুয়াশার পাশ দিয়ে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটা ভয়াল আকৃতির পাহাড়ী গরিলা ঝড়ের বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল পিছনের বাঁকা পথের আড়ালে। কুয়াশাকে তারা দেখেও দেল না।
ভলিউম ১৭
বুনো হাতির দল এসে পড়েছে কাছে। আকাশের দিকে শুড় তুলে গগনবিদারী কণ্ঠে ডাক ছাড়ছে তারা। সংখ্যায় এরা পঁচিশ-ত্রিশটার কম হবে না।
পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াল কুয়াশা। এতটুকু নড়ছে না সে। গরিলারা পালিয়েছে, জান বেচেছে। কিন্তু বুনো হাতিরা এসে পড়েছে একেবারে কাছে। এদের হাত থেকে বাঁচার উপায় কি?
দশ বারোটা হাতি কুয়াশার পাশ দিয়ে চলে গেল। গরিলাদের দেখা না গেলেও, তাড়া করে পাহাড়ের একেবারে নিচে নামিয়ে দিতে চাইছে বোধহয়।
অন্যান্য হাতিরা ফিরে গেছে, যেদিক থেকে তাড়া করে এসেছিল সেদিকে। কুয়াশা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, দুদিকের রাস্তাই ফাঁকা। দ্রুত সিদ্ধান্ত
নিল সে।
এগিয়ে গিয়ে দেখতে হবে রহস্যটা কি। বুনো হাতিরা পাহাড়ে চড়ে করছেটা কি? রাজা অমেনটোট••• ||
আশার একটা আলো দেখতে পাচ্ছে কুয়াশা। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল সে সামনের দিকে।
| রাজা অমেনটোটের সাথে বহু বছর আগে পরিচয় হয়েছিল কুয়াশার। রাজা অমেনটোট তখন রাজা হয়নি। সে ছিল রাজকুমার। যুবক অমেনটোটের বড় প্রিয় ছিল বনভূমির বুনো হাতিরা। শিকার করতে বেরিয়ে সে কখনও হাতি বধ করত
। কথাটা আজও মনে আছে কুয়াশার। সেজন্যেই একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু•••|
মন্দ দিকটাও চিন্তা করল কুয়াশা। হয়তো রাজা অমেনটোটকে প্রফেসর ওয়াই হত্যা করেছে এই পাহাড়ে ধরে নিয়ে এসে। রাজার মৃতদেহ পড়ে আছে হয়তো সামনে কোথাও। সেই মৃতদেহ পাহারা দিচ্ছে বুনো হাতিরা। প্রভুর মৃতদেহ আগলে রেখেছে তারা, ধারে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না পাহাড়ী গরিলাদের ।
হঠাৎ সংবিৎ ফিরল কুয়াশার। বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল সে। লেসারগানটা তুলল উপর দিকে। কিন্তু তখন বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে!
| টেরই পায়নি কুয়াশা। মনেই ছিল না দশ বারোটা হাতি গরিলাদের তাড়া করে নিয়ে গেছে, কিন্তু ফিরে আসেনি। গভীরভাবে চিন্তা করছিল বলে শব্দও পায়নি
সে। বুনো হাতির দল ঝড়ের বেগে এসে পড়ল তার গায়ের কাছে।
ধাক্কা খেয়ে শক্ত পাথরের উপর গড়িয়ে পড়ল কুয়াশা। হাতের লেসারগান ছিটকে পড়ে গেল দশ হাত দূরে।
উন্মত্ত একটা হাতি বিশ মণ দেহের ওজনসহ একটা পা কুয়াশার বুকের উপর তুলে দিচ্ছে। সবেগে দেহটাকে গড়িয়ে দিল কুয়াশা। একটার থেকে রক্ষা পেলেও, আরও তিনটে তখন শুড় উঁচু করে ছুটে আসছে তাকে লক্ষ্য করে।
হাঁপাচ্ছে কুয়াশা। বুনো উন্মত্ত হাতির দলের মাঝখানে পড়ে গেছে সে। এরকম বিপদে পড়লে বাঁচার আশা করা বৃথা।
বিদ্যুৎ খেলে গেল কুয়াশার দেহে। চোখের পলকে উঠে দাঁড়াল সে। সঁাৎ করে সরে গেল প্রথমে ডান দিকে, তারপর বাঁ দিকে, তারপর আবার ডান দিকে। ২-কুয়াশা ৪৯
১৭
*– |
–
–
–
·
=
=
=
• তাকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসছে হাতিরা একে একে। কতক্ষণ এভাবে টিকে থাকা সম্ভব? দম ফেলারও সময় পাচ্ছে না কুয়াশী। লেসারগানটা পড়ে রয়েছে হাত দশেক দূরে। সেটা কুড়িয়ে নেবার চেষ্টা করা তো দূরের কথা, সেদিকে তাকাবার কথাও মনে নেই কুয়াশার। তাকাতে গেলেই সময় নষ্ট। তাকাতে গেলেই হাতির পায়ের নিচে পড়ে চিড়ে-চ্যাপটা হয়ে যেতে হবে।
ঘেমে গেছে কুয়াশা। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বিপদের চরম রূপ প্রত্যক্ষ করছে সে এবার। হাতিগুলো এবার দুদিক থেকে দুই দলে ভাগ হয়ে ছুটে আসছে । সরে যাবার উপায় নেই কোনদিকে।
হিংস্র দানবের মত লাগছে বুনো হাতিগুলোকে। পাহাড়ও থরথর করে কাঁপছে যেন তাদের পদভারে।
প্রাণ রক্ষার শেষ চেষ্টা করল কুয়াশা। হাতিগুলো কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রাণপণ শক্তিতে শূন্যে লাফ মারল সে।
| কুয়াশাকে পরমুহর্তে দেখা গেল একটা হাতির পিঠে চড়ে বসে থাকতে।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। হাতিটা নিষ্কৃতি দিল না তাকে। শুড় উঁচু করে গগনবিদারী কণ্ঠে ডেকে উঠল সে। তারপর গুড় দিয়ে কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরে পিঠ থেকে নামিয়ে আনল।
ছুটছে হাতির দল।
দলের আগে আগে ছুটছে যে হাতিটা তার গুড়ের বাঁধনে বন্দী কুয়াশা। হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে সে।
কিন্তু হাতির শুড় যাকে একবার জড়িয়ে ধরে তার আর রক্ষা নেই। হাতির হাতেই এখন কুয়াশার জীবন মরণ নির্ভর করছে।
সামনেই পথের বাঁক। সেদিকেই ছুটছে হাতির দল। বাঁক ঘুরে গতি মন্থর করল তারা। আরও কয়েক গজ এগোবার পর দাঁড়িয়ে পড়ল।
কুয়াশার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শুড় তার বুক আর পিঠের উপর চেপে বসছে। পাজরের হাড়ে ব্যথা লাগছে বড়। ব্যথায় বিকৃত হয়ে উঠেছে কুয়াশার মুখ। ভেঙে যাবে, এবার মটমট করে ভেঙে যাবে পাজরের হাড়গুলো।
| হঠাৎ একটু ঢিলে হলো শুড়ের পঁাচ। বুক ভরে শ্বাস নিল কুয়াশা। হাতিটা নামিয়ে দিল তাকৈ পথের উপর। এগিয়ে এল এক পা। হাতিটার সামনের প্রকাণ্ড ডান পা-টা মুখের উপর দেখতে পাচ্ছে কুয়াশা। নেমে আসছে পা-টা।
| সরে যেতে চেষ্টা করল কুয়াশা। পারল না। ঘিরে দাঁড়িয়েছে সবকটা প্রকাণ্ডদেহী দানব। সরে যাবে কোথায় সে?
নেমে আসছে কুয়াশার মুখের উপর বিশ মণ ওজন বিশিষ্ট দানবের পা-টা।
আর এক মুহূর্ত। তারপরেই পাথরের সাথে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে রক্ত, মাংস, হাড়, মগজ সহ কুয়াশার মুখ।
এমন সময় কে যেন চিৎকার করে উঠল, রোল! অমেনটোট টেটা-রোল! রোন! রোল! অমেনটোট টেটা•••!
ভলিউম ১৭
চার
অকস্মাৎ কালো ধোয়ায় জায়গাটা অন্ধকার হয়ে গেল। দুই কি তিন সেকেণ্ড সময় পেয়েছিল কুয়াশা। এই অল্প সময়ের মধ্যে পকেট থেকে স্বআবিষ্কৃত, একটা গ্যাস বোমা বের করে ফাটিয়ে দিয়েছে সে।
হাতিরা অবশ্য আগেই সরে গেছে তার কাছ থেকে।
তখনও সেই কর্কশ কণ্ঠস্বর থেকে চিৎকার ভেসে আসছিল: অমেনটোট টেটা! রোল! কিরিক দুরুম! ‘আশা,-নাচা! নাচা! অমেনটোট টেটা! রোল! রোল!
আশা-নাচা! নাচা!
বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে নয়, পুরানো বন্ধু জংলীদের রাজা অমেনটোট-এর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কুয়াশার মুখ। তাকে শেষ মুহূর্তে চিনতে পেরেছে রাজা অমেনটোট। তার নির্দেশেই হাতিগুলো সরে গেছে।
কুয়াশা অবশ্য অমেনটোটের কণ্ঠস্বর শোনার আগেই ফাটিয়ে দিয়েছিল গ্যাস বোমা।
রাজা অমেনটোট ধোয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে কুয়াশাকে। আর কোন ভয় নেই।
| ধোয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কুয়াশা। মুখোশটা খুলে সামনের দিকে
কাল সে।
প্রকাণ্ড একটা গুহা দেখা যাচ্ছে। পথ শেষ হয়ে গেছে গুহার কাছে গিয়ে।
কিন্তু কোথায় রাজা অমেনটোট! কুয়াশার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল গুহামুখের কাছ থেকে অনেক উপরে।
পথের উপর থেকে প্রায় পাঁচ মানুন সমান উঁচুতে একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে রাজা অমেনটোট। পাথরের সাথে তার হাত-পা আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা শক্ত
•ইলনের কর্ড দিয়ে।
| বুনো হাতি এবং পাহাড়ী গরিলাদের লড়াইয়ের কারণ কি বুঝতে পারল ‘:তক্ষণে কুয়াশা। গরিলারা রাজা অমেনটোটকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছিল, বাধা
দচ্ছিল রাজার গুণমুগ্ধ বুনো হাতির দল।
রাজা আমেনটোট হাসছে। চিৎকার করছে সে: আশা! আশা! দেবতা পাঠিয়েছে তোমাকে! মরেই তো যাচ্ছিলাম, এমন সময় তুমি এলে! বন্ধু তোমার * আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব। বন্ধু, তোমার অতীতের ঋণ পরিশোধ করতে রিনি। আজকের ঋণও পরিশোধ করতে পারব না। আশা, তুমি মহান! ‘আশা, শি নমস্য!
“থামো, থামো! অত প্রশংসা কোরো না আমার। প্রাণ তো বাঁচালে তুমিই আমার। আর এক মুহূর্ত দেরি হলে তোমার ভক্তবৃন্দ দিত আমাকে খতম করে।
রাজা অমেনটোট হাসতে লাগল, একটুও বদলাওনি তুমি, আশা। আগের ই বিনয়ী আছ দেখছি।
কথা পরে হবে। দাঁড়াও তোমাকে আগে নামিয়ে আনি।
*[ ৪৯
পাহাড়ের গায়ে পা দিয়ে উপর দিকে উঠতে লাগল কুয়াশা ।
রাস্তার দু’ধারে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে বুনো হাতির দল। কুয়াশার দিকে তাকাচ্ছেও না তারা, যেন লজ্জায় মিশে যেতে চাইছে মাটির সাথে ।
রাজাকে বন্ধনমুক্ত করে নামিয়ে আনল কুয়াশা।
তোমার এই দশা হলো কি করে।’
রাজা বলল, সে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। আশা, ঘটনাটা বললে তুমি বিশ্বাস করবে না।’
কুয়াশা হেসে ফেলল। বলল, “বিশ্বাস করব না মানে? জানো, যা যা ঘটেছে তা আমিই বলে দিতে পারি তোমাকে?
সে কি! তা কেমন করে সম্ভব? তুমি সে ঘটনা জানবে কোত্থেকে! কুয়াশা বলল, সব কথা চলতে চলতে বলব। চলো, যাত্রা শুরু করি।’ চলো।’
লেসারগানটা খুঁজতে হলো না। অদূরেই পড়েছিল সেটা। তুলে নিল কুয়াশা। হাতির পিঠে চড়ল ওরা। দুটো হাতি ওদের দুজনকে পিঠে নিয়ে দ্রুত বেগে নামতে লাগল পাহাড়ী পথ ধরে।
কুয়াশা বলে চলেছে, শিকারে বেরিয়েছিলে তুমি, তাই না! শিকার করতে করতে পথ হারিয়ে ফেলেছিলে তোমরা। এমন সময় একটা সভ্য জগতের লোক তার দলবল নিয়ে তোমাকে আক্রমণ করে এবং বন্দী করে এখানে নিয়ে আসে। সে তোমার ছদ্মবেশ ধারণ করে।
রাজা অমেনটোট বলে উঠল, ‘আশ্চর্য! সবই তুমি জানো দেখছি। কিন্তু আরও ‘ব্যাপার আছে। পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি একা নই, আমার দেহরক্ষীরাও ছিল
আমার সাথে। পথ হারাতাম না। জঙ্গলে হঠাৎ একটা মানুষের অট্টহাসির শব্দ পাই। আমরা। হাসি লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে থাকি আমরা। কিন্তু যতই এগুই, হাসির শব্দের উৎস খুঁজে পাই না। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা হয়ে গেল। এমন সময় হঠাৎ একটা ভৌতিক কাণ্ড ঘটল। আমার চোখের সামনে থেকে আমার দশজন দেহরক্ষী বাতাসের সাথে কর্পূরের মত উবে গেল। বোকা বনে গেলাম আমি। ঠিক তখন
একটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন সভ্য জগতের লোক। তার সাথে। আরও কয়েকজন ছিল। তারাই আমাকে বন্দী করে নিয়ে আসে এখানে।’
তোমার দেহরক্ষীরা কেউ বেঁচে নেই, অমেনটোট। যে লোকটা তোমাকে বন্দী করে সে লোকটা আমাদের দেশেরই একজন ভয়ঙ্কর অপরাধী। তার নাম প্রফেসর ওয়াই। লোকটার খুব বুদ্ধি। তার কাছে এমন একটা অস্ত্র আছে যা দিয়ে যে কোন মানুষ বা জিনিসকে বাতাসের সাথে মিশিয়ে দেয়া যায়। অস্ত্রটার নাম ভ্যানিশিং রে! যাক, সেই প্রফেসর ওয়াই এখন কোথায় জানো?
কোথায়?
তোমার গ্রামে। তোমার ছদ্মবেশ নিয়ে আছে সে। তোমার প্রজারা তার। ছদ্মবেশ টের পায়নি। তারা তাকেই রাজা বলে মনে করছে।
কী বলছ তুমি, আশা।
—।-।
ভলিউম ১৭
ঠিকই বলছি। শুধু তাই নয়, প্রফেসর ওয়াই আমার বন্ধুবান্ধবদেরকে বন্দী করে রেখেছে গ্রামে। আজ রাতে তাদেরকে সে হত্যা করবে। অমেনটোট, তোমার হাতিদেরকে আরও জোরে ছুটতে বলো।’
রাজার আদেশ পেয়ে হাতিরা ছুটতে শুরু করল দ্রুততর লয়ে।
সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিমাকাশে। দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠছে কুয়াশার কপালে । সন্ধ্যার আগে কি তারা পৌঁছতে পারবে গ্রামে।
কিন্তু এসব কেন করছে লোকটা? সে কি রাজা হতে চায় আমার প্রজাদের?
কুয়াশা বলল, না সে রহস্যপুরীর ধন-সম্পদ লুঠ করার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে। আমরা এসেছি তাকে বাধা দেবার জন্যে। তাই আমাদেরকে হত্যা করার জন্য তোমার প্রজাদেরকে বোকা বানিয়ে তাদের সাহায্য নিচ্ছে সে।’
রাজা অমেনটোট গম্ভীর হয়ে উঠল। অনেকক্ষণ পর প্রশ্ন করল, লোকটার ক্ষমতার কাছে আমরা টিকতে পারব কি, আশা?’
কুয়াশা বলল, আমার ক্ষমতা ওর চেয়ে অনেক বেশি, অমেনটোট! তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ভাবছি, সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছতে পারব কিনা গ্রামে।
‘অসম্ভব! গ্রামে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে যাবে আমাদের। আমাকে উদ্ধার করতে এসে ভুল করেছ, আশা। দেখা যাচ্ছে আমাকে উদ্ধার করার বদলে তুমি তোমার বন্ধুবান্ধবকে হারাতে যাচ্ছ।
সন্ধ্যার আগে না থোক, সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে জংলীদের গ্রামে পৌঁছবার একটা উপায় জানা আছে কুয়াশার। সামনে গভীর জঙ্গল। হাতি দ্রুতবেগে ছুটতে পারবে না । | নামতে হবে হাতির পিঠ থেকে। নেমে ছুটতে হবে। হাঁটলে চলবে না, প্রাণপণ শক্তিতে দৌড়ুতে হবে। তাহলেই কেবল সম্ভব সময় মত জংলীদের গ্রামে পৌঁছুননা। | কিন্তু রাজা কি পারবে দৌডুতে এই ক্লান্ত, অভুক্ত শরীর নিয়ে? পাঁচ গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করল হাতি। গতি হলো মন্থর। ঝোঁপঝাড়, ঘনসন্নিবেশিত গাছপালার শাখা প্রশাখা চার পথে বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দিল। হাতিদেরকে ঘনঘন দিক পরিবর্তন করতে হচ্ছে। সময় নষ্ট হচ্ছে প্রচুর, কিন্তু অগ্রগতি হচ্ছে। নামমাত্র।
এভাবে সম্ভব নয়।’ ব্যস্ত হয়ে উঠল কুয়াশা। উপায় কি, ‘আশা!’ রাজা অমেনটোটও উৎকণ্ঠিত। ‘এক কাজ করা যাক। কিন্তু তোমার দুর্বল, অভুক্ত শরীর”তুমি কি পারবে! হাসল জংলীরাজ অমেনটোট।
বন্ধুর উপকার হলে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে রাজা অমেনটোট।
কুয়াশা বলল, ‘হাতির পিঠ থেকে নেমে পড়ি এসো। সূর্য এখনও অস্ত যায়নি। কুয়াশা ৪৯
দুজনে দৌড় দিই। মাইল দশেক পথ বড়জোর। সন্ধ্যার সময় ঠিক পৌঁছে যাব।’
চমৎকার! এমন সহজ একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এল না কেন তাই বুঝতে পারছি না। দেরি নয়, আশা। নামা যাক। কিন্তু, বন্ধু, একটা শর্ত আছে।’
কি শর্ত?
তুমি আমাকে পিছনে ফেলে রেখে এগিয়ে যেতে পারবে না। তোমার সাথে। দৌড়ে আমি পারব না। গতবার, সে আজ দশ বছর আগের কথা, পারিনি তোমার সাথে…।
বুনো হাতিদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদায় করল রাজা। তারা বিদায় নেবার পর দৌড়তে শুরু করল ওরা দুজন। কুয়াশা ব কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ঝড়ের বেগে দূটে চলেছে সে। রাজা অমেনটোটও কম যায় না। একবারও পিছিয়ে পড়েনি সে। Uর গায়ে যেন বিদ্যুতের শক্তি খেলা করছে।
সূর্য অস্ত গেছে। তবে আকাশ এখনও উজ্জ্বল। গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা।
| হাঁপাচ্ছে দু’জনেই। ঘামে ভিজে গেছে রাজা অমেনটোটের সর্ব শরীর। কুয়াশার পোশাকও ভিজে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল এক সাথে দুই বন্ধু। সামনে একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য। পরস্পরের দিকে গম্ভীর মুখে তাকাল ওরা।
‘গরিলা! তারমানে তোমার সেই লোক, কি যেন নাম, আবিদ–আবিদের ভক্ত গরিলারা•••!’ | কুয়াশা কথা বলল না। কপালের লম্বা চুল সরিয়ে গরিলার রক্তাক্ত দেহটার দিকে চেয়ে রইল সে। তারপর হঠাৎ আবার প্রাণপণে দৌড়ুতে শুরু করল।
পিছু নিল রাজা অমেনটোট। প্রতি মুহূর্তে বুকের ভয়টা ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। একটা নয়, সামনে ওরা আরও অসংখ্য গরিলার মৃতদেহ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখল। শুধু গরিলা নয়, পড়ে আছে অনেক জংলীর লাশও।
উন্মাদের মত চিৎকার করে উঠল রাজা অমেনটোট, ‘আশাএ কী সর্বনাশা কাণ্ড! আমার প্রজাদের কারও দেহ অর্ধেকটা নেই, কারও পা দুটো নেই, কারও মাথাটা নেই–এসব আমি কি দেখছি?’
কথা বলবার মত মানসিক অবস্থা নেই কুয়াশার। তীর বেগে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করল সে।
ফাঁকা, জনশূন্য গ্রাম।
থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ছোট ছোট ঘরগুলো। গ্রামের ভিতর অনেক লাশ। জীবিত একজন মানুষকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
অধিকাংশ জংলীই গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে।
আবার ছুটল কুয়াশা। গ্রামের মাঝখানে চলে এল সে। এখনও জ্বলছে রাজা অমেনটোটের দোতলা বাসভবন। মাঠের মাঝখানে শত শত জংলীর লাশ।
২২
ভলিউম ১৭
ভ্যানিশিং রে কারও মাথা, কারও কোমরের নিচের অংশ গায়েব করে দিয়েছে। | পাগলের মত মাঠের মাঝখানে ঘুরছে কুয়াশা। শহীদ, মহুয়া, কামাল, মি. সিম্পসন, ডি, কস্টা এবং আবিদ-একজনের লাশও কি পাওয়া যাবে না! গোটা মাঠের প্রায় সবগুলো লাশ দেখে ফেলল কুয়াশা। নেই!
| তবে কি প্রফেসর ওয়াই জংলীদেরকে হত্যা করে পালাবার সময় ওদেরকে বন্দী করে নিয়ে গেছে?
পাথরের মূর্তির মত মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। তার চারদিকে লাশ। চোখ দুটো ভিজে গেল তার।
. আশা! কাঁদছে রাজা অমেনটোট। কুয়াশার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে। ধীরে ধীরে তাকাল কুয়াশা। দেখল রাজার পাশে এক জংলী যুবক দাঁড়িয়ে আছে। থরথর করে কাঁপছে যুবকটি। চোখের মণি দুটো কোটর ছেড়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার।
‘আমার প্রজাদের বেশির ভাগই পালিয়েছে গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে। এই ছেলেটা ফিরে এসেছে আমাদেরকে দেখে। এ বলছে, তোমার বন্ধু-বান্ধবদেরকে শয়তান
ওয়াই বন্দী করে নিয়ে গেছে•••।
কুয়াশা কথা বলল না’।
জংলী যুবক ঠকঠক করে কাঁপছে এখনও আতঙ্কে। হঠাৎ সে কাঁপা গলায় কথা বলতে শুরু করল।
জংলী যুবকের কথা শুনে প্রকৃত ঘটনাটা জানতে পারল ওরা।
আবিদ সন্ধ্যার অনেক আগেই পৌঁছেছিল গরিলাবাহিনী নিয়ে গ্রামে ঢোকেনি সে। গ্রামের চারদিকের জঙ্গলে লুকিয়েছিল সে এবং তার গরিলাবাহিনী। কিন্তু প্রফেসর ওয়াইয়ের সহচরদের কেউ সম্ভবত ব্যাপারটা টের পেয়ে প্রফেসরকে জানায়। প্রফেসর জংলীদেরকে নির্দেশ দেয় গরিলাবাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য।
এর আগেই আবিদ একটা কাজ করে ফেলে। জঙ্গলে গরিলাদেরকে রেখে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করে জংলীদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করে সে যে বর্তমান রাজা আসল রাজা নয়, নকল রাজা। অধিকাংশ জংলী বিশ্বাস করে তার কথা। ফলে ওরা প্রফেসরের আদেশ পালন করতে রাজি হয় না।
জংলীরা বিদ্রোহী হয়ে উঠছে দেখে প্রফেসর ওয়াই খেপে যায়। খেপে গিয়ে সে তার ভ্যানিশিং রে ব্যবহার করে পাঁচজন জংলীকে গায়েব করে দেয়। জংলীদেরকে নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দেবার উদ্দেশ্যে এই কাজ করে সে।
জংলীরা প্রফেসরের কাণ্ড দেখে আরও খেপে যায়। প্রফেসরকে তারা যাদুকর বলে ধরে নেয়। এবং একজোট হয়ে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়।
প্রফেসর তখন একাই নেমে আসে তার বাসভবন থেকে। তার হাতে ছিল ভ্যানিশিং রে নিক্ষেপক যন্ত্র। সামনে যাকে পায় তাকেই হত্যা করে শয়তানটা। কিন্তু শহীদদেরকে এবং আবিদকে হত্যা করেনি সে। সব ধ্বংস করে দিয়ে যাবার সময় তাদেরকে নিয়ে গেছে। নিয়ে গেছে বোঝা বইবার কাজ করাবার জন্য। এক
কুয়াশা ৪৯
একজনের মাথায় দুই থেকে চারমণ ওজনের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেছে সবাইকে।
| ‘আশা! বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই আমার আর!’ হাহাকার করে উঠল রাজা। অমেনটোট। কি নিয়ে, কাদেরকে নিয়ে বাঁচব? প্রজারা ছিল আমার নিজের সন্তানদের চেয়েও প্রিয়। তারা করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেছে–আমি তাহলে কেন বাঁচি!’
| রাজা অমেনটোট কথা শেষ করে অবিশ্বাস্য একটা কাণ্ড করে বসল। জংলী যুবক দাঁড়িয়েছিল তার মুখোমুখি। যুবকের হাতে ছিল একটা বর্শা। সেই বর্শা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে বিদ্যুৎবেগে নিজের বুকে বসিয়ে দিন রাজা অমেনটোট।
ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে বাধা দেবার সময়ও পেল না কুয়াশা। পড়ে যাচ্ছে রাজা অমেনটোট।
কুয়াশা লাফ দিয়ে চলে এসেছে রাজার পাশে। এক হাত দিয়ে পতনোন্মুখ দেহটা ধরে ফেলল সে। অপর হাত দিয়ে বর্শাটা ধরে হেঁচকা টান মেরে বুকের ভেতর থেকে বের করে আনল ধারাল ইস্পাতের ব্লেডটা।
কলকল শব্দে ঝরনার পানির মত সবেগে রক্ত বেরিয়ে আসছে রাজা অমেনটোটের বুকের গর্ত থেকে।
নীল হয়ে গেছে রাজার মুখ। বর্শার আগায় বিষ মাখানো ছিল।
কুয়াশার চোখে চোখ রেখে একটু যেন হাসন রাজা। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল একবার। কি যেন বলতে চাইছে সে।
বলা আর হলো না। রাজা অমেনটোটের প্রকাণ্ড শরীরটা একবার মাত্র কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল।
জংলী যুবক জবাই করা মুরগীর মত মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পেল না কুয়াশা।
ছয় মহুয়ার চিবুক ধরে প্রফেসর ওয়াই ঘন ঘন মাথা দোলাতে লাগল। তার গলায় ফুটে উঠল মায়া-মমতা এবং সহানুভূতি, আহা! কী সুন্দর মুখ একটা! বাছার কী কষ্ট, দেখলে চোখ ফেটে পানি আসে। কি আর করবে বলো, সবই তোমার ভাগ্য!
মহুয়ার দুচোখ দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে আগুন। লোকটার স্পর্ধা দেখে বাকরুদ্ধ : হয়ে গেছে তার। মাথার উপর দেড় মণ ওজনের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শয়তানটা
রসিকতা করছে।
প্রফেসর ওয়াই এরপর রাজকুমারী ওমেনার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
‘ম্যাটাবর! অকস্মাৎ হাঁক ছাড়ল প্রফেসর। ম্যাটাবর ম্যাটচেক মন্টোগামারী সকলের পিছন থেকে ছুটে এল।
তোমার আক্কেল হবে কবে শুনি! এই মেয়েটার স্বাস্থ্য দেখেছ? কুস্তিতে তোমাকে চিৎপটাং করে দিতে বড় জোর দেড় মিনিট লাগবে এর। এত কম বোঝা
২৪
ভলিউম ১৭
কেন এর মাথায়? দাও, আরও মণখানেক চাপিয়ে দাও এক্ষুণি।
ইয়েস, স্যার।’
নাইন করে দাঁড় করিয়েছে প্রফেসর ওয়াই সবাইকে। সকলের মাথাতেই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বোঝা। প্রত্যেকের একটা হাত শরীরের সাথে বাঁধা নাইলনের শক্ত কর্ড দিয়ে। অপর হাতটি মুক্ত। মাথার বোঝা যাতে না পড়ে যায় সেজন্যে ওই মুক্ত হাতটা ব্যবহার করছে সবাই।
রাতের তাবু গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। রহস্যপুরীর দিকে যাত্রা শুরু হবে এবার। সকলকে দাঁড় করিয়ে পরীক্ষা করছে প্রফেসর ওয়াই। তার হাতে ভ্যানিশিং রে নিক্ষেপক যন্ত্র দেখা যাচ্ছে। তার সহকারীরা সংখ্যায় পনেরোজন। সবাই জংলীদের ছদ্মবেশ নিয়ে মিশে গিয়েছিল জংলীদের সাথে।
লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ, কামাল, মি. সিম্পসন, ডি, কস্টা, আবিদ, আবিদের বান্ধবী লিজা, ওমেনা এবং মহুয়া। লাইনের সামনে এবং পিছনে প্রফুেলরের সহকারীরা পিস্তল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । দুজনের কাছে দুটো অটোমেটিক কারবাইনও দেখা যাচ্ছে।
গত রাতে ওদেরকে খেতে দিয়েছিল প্রফেসর ওয়াই শুধু নারকেলের শাস আর ডাবের পানি। আজ সকালে ভিজে কাঁচা ছোলা।
| প্রফেসর ওমেনার সামনে থেকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল লিজার সামনে।
বাই! গরিলাবাহিনীর নেত্রী, হাউ ডু ইউ ডু? তোমার গরিলাবাহিনীর খবর কি? বুঝেছি, বুঝেছি, স্বর্গে গিয়ে লড়াই করছে তারা, তাই না! হাঃ হাঃ হাঃ..।
“ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল প্রফেসর ওয়াই। হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল সে। আবিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ‘হ্যালো সিপাহসালার! প্রধান সেনাপতি, খবর কি?’
কথা নেই বার্তা নেই, প্রফেসর প্রচণ্ড একটা ঘুসি বসিয়ে দিল আলিদের নাকে।
ঝরঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল আবিদের নাক দিয়ে। মাথায় আড়াইমণ ওজনের ভারি সুটকেসসহ মাটিতে ছিটকে পড়ল সে।
স্ট্যাণ্ড অপ!’ ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল আবিদ।
‘স্যুটকেসটা কে তুলবে, মাথায়! তোমার তো কেউ চাকর নেই এখানে-তোলো কাছি!’
| শার্টের আস্তিন দিয়ে নাকের রক্ত মুছে নুয়ে পড়ল আবিদ। অতি কষ্টে তুলে নিল সে সুটকেসটা মাথার ওপর। প্রফেসর ওয়াই এরপর ডি কস্টার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ডি. কস্টা বিনাৰাক্যব্যয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। গর্জে উঠল প্রফেসর ওয়াই, ড্রামা, ইজ ইট নট! শাস্তি এড়াবার কৌশল, না?
কান্না থেমে গেল ডি কস্টার। দ্রুত কথা বলে উঠল সে, “ওহ্ নো, মি. ওয়াই! হামি রোডন করিটেছি হামার বস মি, কুয়াশার অকাল পরলোকগমনে!
গম্ভীর হয়ে উঠল প্রফেসরের মুখের চেহারা, তোমার বস্ মরেননি এখনও।
কুয়াশা ৪৯
আমার চোখে ধুলো দিয়ে বেঁচে আছেন তিনি এখনও। আমার হাতে মরতে তাকে হবেই।’
ডি. কস্টা চেঁচিয়ে উঠল, ‘মি, কুয়াশা পরলোকগমন করেন নাই! ইটস এ গুড নিউজ, ফর গডস সেক! মি. ওয়াই, সাবান! হামার বস্ না মরিয়া ঠাকিলে হাপনাকে সে মারিবার ব্যবস্টা অফকোর্স করিবে। | ‘থু! এক মুখ থু থু ছুঁড়ে দিল প্রফেসর ডি. কস্টার মুখে। এগিয়ে গেল সে সামনের দিকে।
ডি. কস্টা বলে উঠল বিস্মিত কণ্ঠে, কী আশ্চর্য! থুথুর স্বাড ট্রেলের মটো লাগিটেছে কেন? পেট্রল ছারা পরিচালিট নাকি…?’
মি. সিম্পসনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রফেসর ওয়াই। মি. সিম্পসনের চোখমুখ কঠোর, অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। প্রফেসর ওয়াইয়ের দিকে তাকাবার প্রবৃত্তি নেই তাঁর।
প্রফেসর ওয়াই মি. সিম্পসনের গালের লাল মাংসে চিমটি কাটল। তীব্র জ্বালায় মুখ বিকৃত হয়ে উঠল মি. সিম্পসনের।
‘সরি! আমি মনে করেছিলাম পাথরের মূর্তি।’
কামালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল এবার প্রফেসর ওয়াই। কামাল সরাসরি চেয়ে আছে প্রফেসর ওয়াইয়ের দিকে।
‘সাবাস! তেজ একটুও কমেনি দেখছি! চিনি, চিনি, খুদে হারকিউলিসদের ভাল করেই চিনি আমি। মরে না যাওয়া পর্যন্ত দমবে না তোমরা। চিন্তা কোরো না, মরার ব্যবস্থা করব আমি তোমাদের। রহস্যপুরীতে পৌঁছতে দাও, দেখবে মজাটা।
সবশেষে শহীদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল প্রফেসর ওয়াই। শহীদ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, কুয়াশা! এসে গেছে কুয়াশা!’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল প্রফেসর ওয়াই। হাতের ভ্যানিশিং রে নিক্ষেপ করার যন্ত্রটা উঁচু করে ধরে বনবন করে ঘুরতে শুরু করল সে, কোথায়! কোথায়! কোথায় মি. কুয়াশা!’
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল শহীদ। প্রফেসর ওয়াই তাকাল ওর দিকে।
হাসি থামিয়ে শহীদ বলল, প্রফেসর ওয়াই, কুয়াশাকে আপনি যমের চেয়েও বেশি ভয় পান তা প্রমাণ হয়ে গেল। সাবধান প্রফেসর ওয়াই, কুয়াশা কিন্তু। আশেপাশেই আছে। আমাদের দিকে আড়াল থেকে নজর রেখেছে সে। সময় এবং সুযোগ হলেই সে আক্রমণ করবে আপনাকে! ধ্বংস করে দেবে।’
‘ম্যাটাবর!’ প্রফেসর গর্জে উঠল।
ইয়েস, স্যার! মি. টিকটিকির মাথায় আরও চাপাও এক মা!’ ইয়েস, স্যার!’
ভলিউম ১৭
সাত রাত। বনভূমি জেগে উঠেছে নানারকম পশুদের বিচিত্র হাঁক ডাকে। তাঁবুর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে নেকড়ের দল। দূর থেকে ভেসে আসছে সিংহের গর্জন।
হাত পা বাঁধা অবস্থায় তাবুর ভেতর পড়ে আছে সবাই। ঘুম নেই কারও চোখে। তাবুর বাইরে ম্যটাবর পাহারা দিচ্ছে ভ্যানিশিং রে নিক্ষেপক যন্ত্র নিয়ে। ভয়ঙ্কর অস্ত্রটা হাতে পেয়ে হত্যার নেশায় মেতে উঠেছে সে। কাছে পিঠে কোন পর সাড়া পেলেই যন্ত্রের ট্রিগার টেনে ধরছে সে।
পশুদের কাতর ধ্বনিতে কেঁপে উঠছে চারদিক।
আকাশ পাতাল ভাবছে শহীদ। সারাটা দিন আশা করেছে ও কুয়াশার কাছ থেকে সাহায্য পাবার। আসেনি সাহায্য। কুয়াশার ছায়াও দেখতে পায়নি ওরা কেউ। চিন্তার কথা। গতকাল সন্ধ্যায় জংলীদের গ্রামে ফেরার কথা কুয়াশার। গ্রামে ফিরে জংলী আর গরিলাদের লাশ দেখে সবই অনুমান করে নেবে সে। স্বভাবতই
ওদেরকে সাহায্য করার জন্য গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে সে।
প্রফেসর ওয়াই অবশ্য একটা চালাকি খাঁটিয়েছে গ্রাম ছাড়ার সময়। গ্রাম থেকে রহস্যপুরী উত্তর দিকে। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে দক্ষিণ দিকে রওনা হলো সে। উদ্দেশ্যটা অর্থপূর্ণ। কুয়াশা গ্রামে ফিরে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে প্রফেসর কোন্ দিকে গেছে। জংলী যদি কেউ বেঁচে থাকে সে জবাব দেবে, দক্ষিণে গেছে। স্বভাবতই কুয়াশা। প্রফেসরের হাত থেকে ওদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ দিকে ছুটবে। কিন্তু। দক্ষিণ দিকে গেলে সে পাবে না ওদেরকে।
গ্রাম থেকে বেরিয়ে প্রফেসর ওদেরকে নিয়ে দক্ষিণ দিকে রওনা হলেও খানিক পর সে দিক পরিবর্তন করে। আসলে রহস্যপুরীর দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকেই এগোচ্ছে ওরা। | শহীদ ভাবছে, কুয়াশা কি প্রফেসরের চালাকিটা ধরতে পারেনি? সে কি দক্ষিণ দিকেই রওনা হয়েছে তাদের সন্ধানে?
‘ঘুমালে নাকি, শহীদ? রাত কত হলে অনুমান করতে পারো?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করেন মি. সিম্পসন।
না। ঘুম কি আসে। রাত সাড়ে তিনটে-চারটের কম নয় এখন।’ | অনেকক্ষণ থেকে প্রফেসর ওয়াইয়ের সাড়া পাচ্ছি না। গেল কোথায় বলো তো? ম্যাটার ছাড়া আর সকলেরও কোন পাত্তা নেই।’
শহীদ বলল, কথাটা আমিও ভাবছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েনি তো?’ | মি. সিম্পসন বললেন, মনে হয় না। লোকটা নিশাচর। রাতের বেলা ঘুমায় । অন্যান্য সবাই তো আর ঘুমিয়ে পড়তে পারে না। আমাদেরকে ভয় করে যখন।
মহুয়া বলে উঠল, শহীদ। শহীদ পাশ থেকে বলে উঠল, “কি হলো?’ ভয়ে কাঁপছে মহুয়ার গলা, কে যেন আমার হাতে হাত দিয়ে।
কুয়াশা ৪৯
চুপ! কেউ নয়, আমি তোমার হাতের বাঁধন খুলছি! চাপা কণ্ঠে মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, কী বললে!
চুপ করুন। বাইরে ম্যাটার দাঁড়িয়ে আছে। শব্দ পেলেই আলো নিয়ে ঢুকবে।
শহীদের কথা শেষ হতেই তাঁবুর ভেতর ঢুকল ম্যাটাবর। তার হাতে জ্বলন্ত একটা মশাল, হচ্ছেটা কি? প্রফেসর চলে যেতেই পাখা গজিয়েছে বুঝি?’
শহীদ উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিল সময় মত। ওর হাত দুটো শরীরের নিচে লুকানো। ধড়াস ধড়াস করছে বুক। এর আগে দুবার তাবুতে ঢুকে সকলের হাত পায়ের বাধন পরীক্ষা করে দেখে গেছে ম্যাটাবর। এবারও যদি দেখতে শুরু করে•••|
| ‘মি. টিকটিকি, তুমি অমন কুণ্ডলী পাকিয়ে ছোট হয়ে শুয়ে আছ কেন? মতলব খানা কি তোমার!’
কারও মুখে কোন কথা নেই। দম বন্ধ করে নিঃসাড় পড়ে আছে শহীদ। মহুয়াও নিঃশ্বাস ফেলছে না। মি. সিম্পসন ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। উত্তেজনা সহ্য করতে পারছেন না তিনি।
কামাল দ্রুত চিন্তা করছিল ম্যাটাবরের মনোযোগ অন্য দিকে কিভাবে সরিয়ে– দেয়া যায়। কথা বলে উঠল সে, প্রফেসর ওয়াই এই রাতে জঙ্গলে বেরিয়েছে? নির্ঘাৎ বাঘের পেটে যাবে সে।
‘পাগল! প্রফেসর ওয়াই ইতিমধ্যে ঢাকায় পৌঁছে গেছেন।’
আঁ! কি বললে!’
ম্যাটাবর বলে উঠল, “ঠিকই বলছি। ম্যাটার ট্রান্সমিট করার মেশিন ব্যবহার করেছেন তিনি।
‘জঙ্গলের ভেতরও ম্যাটার ট্রান্সমিট করার মেশিন আছে নাকি?
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল ম্যাটাবর, তাও জানো না! শুনে রাখো তাহলে, ট্রান্সমিট করার স্টেশন একটা নয়, একাধিক আছে এই আফ্রিকায়।
আশ্চর্য!’ বাইরে ডেকে উঠল নেকড়ের পাল।
যাচ্ছি আমি। কেউ কথা বলবে না, সাবধান! কোন রকম চালাকি করতে দেখলে খুন করতে বলে গেছেন প্রফেসর ওয়াই। তার আদেশ সানন্দে পালন করব আমি। কথাটা মনে থাকে যেন।’
তাবুর ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল ম্যাটাবর।
তাঁবুর ভেতর ওরা সবাই চুপচাপ। কারও মুখে কোন কথা নেই। নিঃশব্দে। কাজ করে যাচ্ছে শহীদ। কামালও বন্ধন মুক্ত হয়ে কাজ শুরু করল। মি. সিম্পসনকে বন্ধন মুক্ত করল সে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাই বন্ধন মুক্ত হলো।
‘এখন নয়! আরও পরে। ভোরের আলো না ফুটলে তাঁবু ছেড়ে বেরুনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
ভলিউম ১৭
ফিসফিস করে বলল শহীদ সকলের উদ্দেশ্যে।
কামাল বলে উঠল শহীদের কানে মুখ ঠেকিয়ে, কিন্তু ভোর হবার আগেই যদি প্রফেসর ওয়াই এসে পড়ে?
আসবে বলে মনে হয় না। যদি এসেই পড়ে।’
শেষ হলো না শহীদের কথা, বাইরে থেকে ভেসে এল ম্যাটাবর ম্যাটচেকের তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার।
পরমুহূর্তে একটা ধস্তাধস্তির শব্দ পেল ওরা। আক্রোশে গর্জে উঠল একটা বাঘ ভাবুর দরজার কাছ থেকে।
তিড়াক করে উঠে দাঁড়াল শহীদ অন্ধকারেই। বাঘটার ছুটে পালাবার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে পায়ের শব্দ। সেই সাথেই দূরে সরে যাচ্ছে ম্যাটাবরের তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার।
দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল আবার চারদিক। ম্যাটাবরের গলা আর শোনা যাচ্ছে না। দূর থেকে কেবল ভেসে আসছে একটা হায়েনার কর্কশ হাসির শব্দ। এবং আরও দূর থেকে ভেসে আসছে, শোনা যায় কি যায় না, একটা সিংহের গর্জন।
ঝিঁঝি পোকার ডাক চারদিক মাতিয়ে রেখেছে।
শহীদ নীরবতা ভাঙল, ‘প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নেয়া যাক এবার।’ | ডি, কস্টা হঠাৎ সশব্দে দম ছেড়ে বলে উঠল, ‘ফর গডস সেক, কঠা বলিটে না পারিয়া হামার পেট ফুলিয়া ডবল সাইজ হইয়াছে!’
কামাল বলল, শহীদ, ভ্যানিশিং-রের যন্ত্রটা চাই আমাদের।’ ‘কিন্তু সেটা পাবি কোথায়! বাঘটা ম্যাটাবরকেই নিয়ে চলে গেছে…। ‘পড়ে থাকতেও তো পারে আশপাশে। ‘খুঁজে দেখা যাবেখন যাবার সময়। | ভোরের আলো ফুটতে কাঁধে ব্যাগ-ঝোলা ঝুলিয়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল ওরা।
অনেক খুঁজেও আশপাশে কিন্তু যন্ত্রটা পাওয়া গেল না।
আট
রাগে সর্বশরীর জ্বালা করছে। কার উপর রাগ তা জানে না সে। প্রফেসর ওয়াই বোকা বানিয়েছে তাকে। গ্রামের যুবকটিকে জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছিল। যুবকটি অবশ্য সঠিক উত্তরই দিয়েছিল।
দক্ষিণ দিকে অন্ধের মত ছুটেছিল কুয়াশা গ্রাম থেকে বেরিয়ে। প্রফেসর ওয়াইকে বন্দী এবং দলবল নিয়ে ওদিকেই যেতে দেখা গেছে। প্রফেসর যে চালাকি করে গেছে তা সে বুঝতেই পারেনি।
বুঝতে যখন পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দিক পরিবর্তন করে আবার উত্তর দিকে হাঁটতে হয়েছে তাকে। পথে অনেকবার অনেক জায়গায় থামতে হয়েছে তাকে। শহীদদের সন্ধানে গাছের মগডালে চড়ে দেখে নিয়েছে চারদিক। কুয়াশা ৪৯
• • •
•
•.
কিন্তু প্রফেসর বা তার বন্দীদের কোন চিহ্নই দেখতে পায়নি সে কোথাও।
অনেক ভেবে চিন্তে কুয়াশা সিদ্ধান্ত নেয়, সরাসরি রহস্যপুরীর দিকেই যাবে সে। প্রফেসর হয়তো রহস্যপুরীতে পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যে। অকারণে দেরি করার চীজ সে নয়। শহীদরা যদি প্রফেসরের হাত থেকে পালিয়ে গিয়ে থাকে ভাল। পালাতে যদি না পেরে থাকে তাহলে বিপদের কথা ।
রহস্যপুরীতে পৌঁছে প্রফেসর ওদেরকে নিঃসন্দেহে হত্যা করবে। সাত পাঁচ ভেবে সরাসরি রহস্যপুরীতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় কুয়াশা।
মাথার উপর জলন্ত সূর্য, ঠিক দুপুর বেলা গভীর বনভূমি থেকে ফাঁকা জায়গায় পৌঁছুল কুয়াশা।
সামনে প্রকাণ্ড তেপান্তরের মত মাঠ। মাঠের সর্বশেষ প্রান্তে আফ্রিকার আশ্চর্যতম নিষিদ্ধ দর্শনীয় বস্তু।
পাথরের পাহাড়ের মত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তিনটে মূর্তি। আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে মূর্তি তিনটের মাথা । তিন মর্তির দুই পাশে লাইন দিয়ে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরও অসংখ্য মূর্তি। ক্রমশ ছোট হয়ে গেছে মূর্তিগুলো। তবে কোন মূর্তির উচ্চতাই সাত ফুটের কম নয়।
এই হলো রহস্যপুরী। রহস্যপুরী যে সত্যি রহস্যপুরী তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
মূর্তিগুলো প্রকৃতপক্ষে রহস্যপুরীর পঁচিলের কাজ করছে। মাঝখানের তিনটে মূর্তির মধ্যবর্তী জায়গাটা সম্ভবত প্রবেশ পথ। বন্ধ সেটা।
* খা-খা করছে নির্জন মাঠ। রহস্যপুরীর আশপাশেও জনমনিম্যির চিহ্নমাত্র নেই। ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল কুয়াশা। দেরি করার কোন মানে হয় না। জঙ্গল থেকে মাঠে পা রাখল সে। এগিয়ে চলল রহস্যপুরীর দিকে।
কিংবদন্তীর রহস্যপুরী মিথ্যে নয়। শত শত বছর ধরে সভ্য দুনিয়ার মানুষ। শুনেছে এই রহস্যপুরী সম্পর্কে হাজার রকম গল্প। কেউ এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত, কেউ করত না। যে বিশ্বাস করত সে-ও অনুমানের উপর ভরসা করে বিশ্বাস করত। রহস্যপুরী নিজের চোখে দেখেছে এই দাবি আবিদ ছাড়া আর কেউ কোন দিন করেনি।
অসংখ্য জংলী উপজাতি এই রহস্যপুরীতে দশ বছর অন্তর অন্তর একবার করে, আসে। সাথে করে তারা নিয়ে আসে দশ বছর ধরে সঞ্চিত এবং সংগৃহীত স্বর্ণ, মূল্যবান পাথর। রহস্যপুরীর দেবতাদের কাছে লক্ষ লক্ষ টাকার ধনসম্পদ রেখে যায় তারা। ধরে নিয়ে আসে সভ্য দুনিয়ার বন্দীদেরকে। রহস্যপুরীতে বন্দীদেরকে বলি দেয় তারা। বলি না পেলে নাকি দেবতারা অসন্তুষ্ট হন। শুধু মানুষ না জংলীরা এখানে বলি দেয় বাঘ, সিংহ, নেকড়ে ও অন্যান্য পশুদেরকেও।
শত শত বছর ধরে চলেছে এই নিয়ম।
কিন্তু শিক্ষিত, যুক্তিবাদী মন মেনে নিতে চায় না রহস্যপুরী সম্পর্কে অনেক। বিষয়। দেবতারা কি সত্যিই বসবাস করে রহস্যপুরীতে। বিশ্বাস করা কঠিন। দেবতারা তো স্বর্গের বাসিন্দা, তারা পৃথিবীতে বসবাস করবে কেন?
ভলিউম ১৭
কুয়াশার ধারণা, শত শত বছর আগে এই এলাকায় কোন উন্নত জাতির অভ্যুদয় ঘটেছিল। তারা ছিল সভ্য একটা জাতি। এই রহস্যপুরী তাদেরই সৃষ্টি। সেই সভ্য জাতির রাজা বা বাদশা হয়তো এই রহস্যপুরীতে বাস করতেন। সময়ের অমোঘ বিধানে আজ সেই রাজা বা বাদশাও নেই, নেই সেই উন্নত জাতিরও কোন অস্তিত্ব। কিন্তু আজও মাথা উঁচু করে আছে রহস্যপুরী। জংলী অসভ্যরা এই রহস্যপুরী আবিষ্কার করে কয়েক হাজার বছর আগে। তারা ধরে নেয় রহস্যপুরী দেবতাদের সৃষ্টি, দেবতারা এখানে বাস করে।
তারপর থেকেই সম্ভবত নরবলি এবং ধন-সম্পদ উপঢৌকন দিয়ে দেবতাদেরকে সন্তুষ্ট করার নিয়ম চালু হয়। আবার এমনও হতে পারে–সভ্য দুনিয়ার কোন শিকারী বা অভিযাত্রীদল আফ্রিকার এই এলাকায় কয়েক শত বছর আগে এসে দেখতে পেয়েছিল রহস্যপুরীকে।
| রহস্যপুরী দেখে তারা স্বভাবতই মুগ্ধ হয়। ভিতরে প্রবেশ করে মানুষজন না দেখে তারা এখানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা হয়তো শ্বেতাঙ্গ। জংলীরা তাদেরকে দেখে দেবতা বলে মনে করে।
হতে পারে আরও অনেক কিছু। কিন্তু জংলীদের ধারণাগুলো বাস্তব বা সত্য বলে মেনে নেয়া যায় না।
মধ্যবর্তী তিন মূর্তির পাদদেশে এসে দাঁড়াল কুয়াশা। সত্যি, বড় বিস্ময়কর সৃষ্টি। হাজার হাজার বছর আগে কারা নির্মাণ করেছিল এই মূর্তিগুলো ভাবতে আশ্চর্য লাগে।
তিন মূর্তির মাঝখানে দুটো প্রকাণ্ড প্রবেশ পথ। চমকে এক পা পিছিয়ে এল চয়াশা। যান্ত্রিক শব্দ হচ্ছে একটা।
খুলে যাচ্ছে একটা প্রবেশ পথ। প্রকাণ্ড কাঠের কপাট দুটো দু’ফাঁক হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
চিন্তার রেখা ফুটল কুয়াশার কপালে। নিশ্চয়ই কেউ বা কোন একদল মানুষ এর উপর নজর রেখেছে। প্রবেশ পথ হঠাৎ আপনা আপনি উন্মুক্ত হতে পারে না। কেউ চাইছে সে রহস্যপুরীর ভিতরে প্রবেশ করুক। প্রবেশ পথ খুলে যাবার পিছনে নিশ্চয়ই কারও হাত আছে।
একমুহূর্ত চিন্তা করল কুয়াশা। প্রবেশ করবে, না, করবে না?
পা বাড়াল কুয়াশা। বিপদ ঘটবে, টের পাচ্ছে সে। রহস্যপুরীর ভিতর প্রতি পদে বিপদ ওৎ পেতে আছে। মন বলছে কথাটা। মনের কথা কখনও মিথ্যে হয় না। কিন্তু বিপদের ভয়ে পিছিয়ে যাবার মত মানুষও তো সে নয়।
প্রকাণ্ড গেট অতিক্রম করে রহস্যপুরীর বিশাল পাকা উঠানে গিয়ে দাঁড়াল
•য়াশা। শব্দ শুনে সবেগে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল সে।
গেটটা ধীরে ধীরে খুলে গিয়েছিল। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাতেই কুয়াশা দেখল সেটা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে নয়, এক নিমেষে বন্ধ হয়ে গেছে সেটা।
রহস্যপুরীর ভিতর আটকা পড়ে গেছে সে, বুঝতে কোন অসুবিধে হলো না
•য়াশা ৪৯
কুয়াশার।
নয় উঠানটা মস্ত বড়। এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত উঁচু প্রাচীর ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
প্রাচীরের গায়ে অনেকগুলো লোহার দরজা। দীর্ঘ পদক্ষেপে সেদিকে এগোল কুয়াশা। দুটো হাতই তার শূন্য। লেনারগানটা পকেটেই ভরে রেখেছে।
কুয়াশা উঠানের মাঝখান বরাবর পৌঁছুতেই প্রাচীরের গায়ের অনেকগুলো দরজার মধ্যে থেকে একটি দরজা খুলে গেল।
| মুচকি হাসল কুয়াশা। প্রতি মুহূর্তে নজর রাখা হচ্ছে তার উপর। অদৃশ্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা যে পথে তাকে যেতে দিতে চায় সেই পথের দরজা খুলে দিচ্ছে আগে ভাগে। কুয়াশা যাতে অন্য কোন দরজা ভেঙে অন্য কোন পথে না যেতে চায় তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
ঠিক আছে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছানো যায়।
উন্মুক্ত দরজা অতিক্রম করে প্রশস্ত একটা করিডরে পা রাখল কুয়াশা। মেঝে, সিলিং এবং দেয়ালগুলো মসৃণ পাথরের। ঝক ঝক তক তক করছে চারদিক। যেন
এই মাত্র কেউ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখে গেছে।
করিডরের সিলিংয়ের উপর টিউব লাইট জ্বলছে। দিনের মত উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত সামনেটা। করিডরের দুই পাশে সেগুনকাঠের নতুন পালিশ করা দরজা। কয়েকটা দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে দেখল কুয়াশী।
সবগুলো দরজাই ভিতর থেকে বন্ধ। কেউ সাড়া দিল না ভিতর থেকে, কোন দরজা খুলেও গেল না।
| হঠাৎ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ছে কুয়াশা। কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। কোথাও কোন শব্দ নেই। নেই কোন জনমনিষ্যির সাড়া-শব্দ।
সশব্দে খুলে গেল আচমকা ডান দিকের একটা দরজা। কে খুলল? ভিতরে কেউ আছে নাকি, খোলা দরজা টপকে ভিতরে ঢুকল কুয়াশা। কেউ নেই। কোন মানুষের ছায়া কায়া কিছুই নেই।
দরজাটা পরীক্ষা করল কুয়াশা। স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিচালিত দরজা। নিশ্চয় সবগুলোই তাই।
সরু একটা প্যাসেজে চলে এসেছে কুয়াশা। প্যাসেজের একপাশে মসৃণ। পাথরের দেয়াল, আর এক পাশে দুই হাত অন্তর অন্তর একটা করে কাঠের দরজা।
প্যাসেজের শেষ মাথায় একটা সিঁড়ি। নেমে গেছে নিচের দিকে। পাথরের ধাপগুলো টপকাতে টপকাতে গুনতে শুরু করল কুয়াশা। একশো, একশো এক, একশো দুই•• |
একশো আটাশটা ধাপ। সিঁড়ি থেকে নামল কুয়াশা একটা হলরুমের ভিতর।
রূমের ভিতরের দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। নিজের চোখ দুটোকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এত আধুনিক মারণাস্ত্র কোত্থেকে এল
৩২
ভলিউম ১৭
এখানে? হেভী মেশিনগান, স্টেনগান, দেড় ইঞ্চি মর্টার, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান, গ্রেনেডের বাক্স, রাইফেল, বাজুকা, পিস্তল–সর্বনাশ। এসব এখানে কেন? কারা আনিয়েছে এগুলো?
| প্রফেসর ওয়াই?
সশব্দে খুলে গেল হলরূমের একটা দরজা। সেদিকে পা বাড়াল কুয়াশা। চেহারাটা থমথমে হয়ে উঠেছে। কপালে দুশ্চিন্তার রেখা।
খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কুয়াশা, বিস্ময়ে মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে তার। দরজার ওপারে এবার প্যাসেজ বা করিডর নয়, একটা এলিভেটর।
এলিভেটরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল আপনা আপনি। উপর দিকে সবেগে উঠে যাচ্ছে যান্ত্রিক কেবিনটা।
অস্ত্রগুলোর কথা ভাবছিল কুয়াশা। অস্ত্রগুলো তাকে দেখাবার জন্য নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অস্ত্রগুলো দেখাবার কারণ কি? ভয় দেখানো?
এলিভেটর থামতে দরজা খুলে গেল। নেমেই আরেক বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে হলো কুয়াশাকে। | সামনেই মস্ত একটা ফাঁকা জায়গা। অস্বাভাবিক লম্বা ধাপ বিশিষ্ট একটা সিঁড়ি উঠে গেছে উপর দিকে।
| সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উপরে উঠল কুয়াশা। প্রকাণ্ড একটা লাউঞ্জের মত উপরের জায়গাটা। লাউঞ্জের মাঝখানে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা প্রকাণ্ড কৃয়া। কূয়া এললে জিনিসটার বিরাটত্ব ঠিক বোঝানো যাবে না। এটা এমন একটা কৃয়া যে এর গোলাকার পাঁচিলে বসে অন্তত দুশো লোক বালতি ফেলে পানি তুলতে পারবে।
পাচিলটা প্রায় দুই মানুষ সমান উঁচু। কূয়ার আরও অনেক উপরে সিলিংয়ের সাথে গায়ে প্রায় গা ঠেকিয়ে ঝুলছে একটা মস্ত ইস্পাতের ঢাকনি। লোহার ভারি শিকল দিয়ে বাঁধা ঢাকনিটা। সিলিংয়ের কাছাকাছি লোহার চেনের সাথে বাঁধা
অবস্থায় ঝুলতে দেখল কুয়াশা কয়েকটা লোহার মইকে।
| কৃপের ওদিকে সবচেয়ে বিস্ময়কর দ্রষ্টব্য বস্তু বসে আছে। ব্রেঞ্জের প্রকা একটা মূর্তি হাঁটু মুড়ে বসে আছে। মূর্তিটার মাথা সিলিং ছুঁই ছুঁই করছে। মূর্তিটার এক একটা আঙুল কুয়াশার এক একটা বাহুর সমান। মূর্তিটার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল কুয়াশা।
| মুগ্ধ হয়ে গেল সে। অপূর্ব সৃষ্টি। মূর্তি বলে মনেই হয় না। চোখ দুটোর মণি নীল। নীলকান্ত মণি হওয়াও বিচিত্র নয়। উন্নত নাসা। প্রশস্ত কপাল। মাথা ভর্তি আঁকড়া চুল। মুখটা ভয়ঙ্কর সজীব। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কুয়াশার মনে হলো, এই বুঝি মাথা নেড়ে কথা বলে উঠবে, বা হাসিটা আরও বিস্তৃত হয়ে উঠবে মূর্তিটার।
শব্দ হলো পিছন দিকে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কুয়াশা। একটা দরজা। এই মাত্র খুলে গেছে সেটা।
* একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগল আবার। প্যাসেজ থেকে করিডর, ৩–কুয়াশা ৪৯
করিডর থেকে প্যাসেজ। শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ল কুয়াশা। একটার পর একটা দরজা সশব্দে খুলে যাচ্ছে। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ভিতরে ঢুকতে হচ্ছে তাকে। না চুকে করবেটা কি সে? ‘ ফাঁদ নয়তো এটা? এভাবেই যদি চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন•••।
ওই যে, আবার শব্দ হলো। আবার খুলে গেল একটা দরজা। এই শেষ, মনে মনে ভাবল কুয়াশা। এরপর যত দরজাই খুলুক, ঢুকবে না সে। অন্যান্য দরজা দিয়ে নিজের খুশিমত ঘুরে বেড়াতে চায় সে। দরজা যদি বন্ধ থাকে তাহলে লেসারগান ব্যবহার করবে।
খোলা দরজাটা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই বন্ধ হয়ে গেল সেটা।
প্রকাণ্ড একটা গোলাকার কামরায় পা রেখেছে কুয়াশা। চোখ ঝলসে গেল তার স্বর্ণের স্তূপ দেখে।
রহস্যপুরীর স্বর্ণ ভাণ্ডারে প্রবেশ করেছে সে। উপর দিকে তাকাল কুয়াশা। চারদিকের দেয়াল পাথরের নয়, ইস্পাত দিয়ে মোড়া। সিলিং নৈই। উপরটা ফাঁকা। তবে আরও উপরে দেখা যাচ্ছে সেই ঝুলন্ত মস্ত ঢাকনাটাকে।
| ব্রোঞ্জ মূর্তির পাদদেশে খানিক আগে যে প্রকাণ্ড কৃয়াটা দেখেছিল সে, এই জায়গা সেই কূয়ারই তলদেশ। চারদিকে অনেকগুলো দরজা দেখা যাচ্ছে। সবকটাই বন্ধ।
স্বর্ণের স্তূপের আড়াল থেকে আচমকা দশ বারো জন লোক উঠে দাঁড়াল। প্রত্যেকের হাতে পিস্তল বা রিভভার।
প্রফেসর ওয়াইয়ের হাতটা শূন্য। হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল সে।
বলে উঠল, মি. কুয়াশা! কেমন আছেন? আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যেই এখনও অপেক্ষা করছি আমি এখানে!
দশ প্রফেসরের সহচররা ঘিরে ফেলেছে কুয়াশাকে। তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল সে, অবস্থা সুবিধের নয়। প্রত্যেকের চোখে খুনের নেশা। তার জন্যই অপেক্ষা করছিল এরা, তাকে হত্যা করারই ষড়যন্ত্র করেছে।
‘মি, কুয়াশা, হাত দুটো মাথার উপর তুলুন!’
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। মাথার উপর হাত তোলার কোন লক্ষণ দেখা গেল না তার মধ্যে। প্রফেসরের দশাসই চেহারার সহকারীরা এগিয়ে এসে কুয়াশার | গা ঘেষে দাঁড়াল। হাতের রিভলবার এবং পিস্তলের নলগুলো কুয়াশার বুকে, পিঠে,
পাজরে ঠেকিয়ে রেখেছে তারা।
কুয়াশা গভীর। তার চোখমুখের চেহারা দেখে মনে হয় না এতটুকু ভয় পেয়েছে সে। ভারি গলায় কথা বলে উঠল সে।
রহস্যপুরীতে ঢুকেছ তা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু বেরিয়ে যেতে পারবে ততা, ওয়াই?
ভলিউম ১৭
৩৪
শূন্যে লাফিয়ে উঠে গগনবিদারী অট্টহাসিতে গোলাকার জায়গাটাকে কাঁপিয়ে তুলল প্রফেসর ওয়াই। অনেকক্ষণ পর হাসি থামল তার। বলল, মি, কুয়াশা এখও আপনি প্রফেসর ওয়াইকে চিনতে পারেননি? প্রকৃতপক্ষে আমাকে চিনবার, আমার ক্ষমতা, প্রতিভা, যোগ্যতা–এই সব গুণের মূল্যায়ন করার চেষ্টা আপনি কোনদিনই করেননি। আমি যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রেন, আমি যে সারা বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী একথা আপনি আজও স্বীকার করলেন না। ভুল করেছেন, মি. কুয়াশা। আমার পর আপনাকেই সেরা বিজ্ঞানী বলে মনে করতাম। মনে করতাম বুদ্ধিমানদের মধ্যে আমার পরেই আপনার স্থান। তাই আপনাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, একবার নয় অসংখ্যবার, আমার সাথে একযোগে বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য কাজ করতে। কিন্তু আপনি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।’
• কুয়াশা বলে উঠল, “তোমার ব্রেন আছে স্বীকার করি। কিন্তু তুমি মিস গাইডেড। তোমার মধ্যে দয়ামায়া, মমতা, সহানুভূতি, মানবতা~এতটুকুও নেই। তুমি নীতিহীন। তোমাকে আমি ঘৃণা করি, ওয়াই। শুধু তাই নয়, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, তোমাকে আমি সমূলে ধ্বংস করে দেব।’
প্রফেসরের দুচোখে কৌতুক ফুটে উঠল, ‘আমাকে? ধ্বংস করে দেবেন? আপনি? হাঃ হাঃ হাঃ হা!’
“থামো!’ গর্জে উঠল এতক্ষণে কুয়াশা। প্রফেসরের অট্টহাসি থেমে গেল।
বজ্রকণ্ঠে কুয়াশা বলে উঠল, বারবার তোমাকে আমি নানা কারণে এর আগে ক্ষমা করেছি, ওয়াই। প্রত্যেকবার ভেবেছি, এরপর হয়তো তোমার পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু মিথ্যে আশা। তুমি দিনে দিনে নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছ। নির্মম ভাবে, অকারণে হত্যা করছ নিরীহ মানুষকে।
করছি! আরও করব! কারও যদি ক্ষমতা থাকে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করুক। দেখব! কার কত বুকের পাটা।
প্রফেসর খেপে উঠছে আস্তে আস্তে। চোখ দুটো দিয়ে আগুনের শিখা বেরিয়ে আসছে যেন। দ্রুত উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলে চলেছে সে।
কার কি ক্ষতি করেছি আমি? আমি একজন বিজ্ঞানী, আমার কি নিজের খুশি মত যে কোন বিষয়ের ওপর রিসার্চ করার অধিকার নেই? রিসার্চ করতে গেলে, বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য কাজ করতে গেলে দুএকজন লোককে প্রাণ হারাতে হয়। সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তির স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। যা বলছিলাম, আমাকে কেউ নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে দিতে চায় না। উপায় কি আমার বেপরোয়া না হয়ে কোটি কোটি টাকার দরকার আমার। চাইলে পাব কারও কাছ থেকে? দেবে কেউ? দেবে তো না-ই, আবার ডাকাতি করে লুঠ করে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করলে বাধা দিতেও আসবে। এটা বুঝি ন্যায়? এটা বুঝি সঙ্গত?’
কুয়াশা হেসে উঠল। বলল, প্রফেসর, তোমার মাথায় কোন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। মাথায় ভাল করে নিয়মিতু তেল টেল ঢাল তো?
কুয়াশা ৪৯
ঠাট্টা করছেন? হাঃ হাঃ হাঃ! প্রফেসর ওয়াইয়ের সাথে ঠাট্টা করার স্পর্ধা অবশ্য শুধু আপনারই আছে, স্বীকার করতে আমি বাধ্য। তবে, সেই স্পর্ধারও সমাপ্তি ঘটবে, মি. কুয়াশা। আপনার সাথে সাথে মৃত্যু ঘটবে ওই স্পর্ধার। এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে পারি না, বুঝতেই পারছেন। আপনি সত্যি ভয়ঙ্কর
প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। নিজের হাতে হত্যা করতে চাইনি আমি। কাক কাকের মাংস। খায় না। নিজের হাতে হত্যা করতে চাইনি বলেই আপনাকে ডিজইন্টিগ্রেট করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সীমাহীন মহাশূন্যে। মাই গড! ওহ জেসাস! আপনি মহাশূন্য থেকেও বহাল তবিয়তে ফিরে এসেছেন। ভেবেছিলাম এই পৃথিবীতে আর কোনদিন ফেরা ভব হবে না আপনার পক্ষে। ভুল করেছিলাম। যাক, একই ভুল দ্বিতীয়বার করতে চাই না আমি। কাক কাকের মাংসও খায় প্রয়োজনে, তা এখন প্রমাণ হবে। মি, কুয়াশা, আপনাকে এই স্বর্ণস্তূপের পাশে হত্যা করতে যাচ্ছি আমি। সত্যি, মি, কুয়াশা, আমি দুঃখিত। আশা করি আপনি আমার সমস্যাটা হৃদয়ঙ্গম করবেন। এ ছাড়া আমার সামনে দ্বিতীয় কোন পন্ত খোলা নেই, বিশ্বাস করুন।’
পাশে দাঁড়ানো একজন সহচরের হাত থেকে একটা পিস্তল ছো মেরে কেড়ে নিল প্রফেসর ওয়াই।
আমাকে হত্যা করবে? ভাল কথা, করো। কিন্তু আমাকে হত্যা করলেই তো শুধু হবে না, ধনসম্পদ নিয়ে এখান থেকে কেটে পড়ার ব্যবস্থা করে রেখেছ তো? কেউ যদি বাধা দেয়?
বাধা দেবে? কে? কার এত সাহস আমাকে বাধা দেবে?’ সদম্ভে জানতে চাইল প্রফেসর ওয়াই। | কুয়াশা হাসল। বলল, “যে বা যারা তোমাকে এই রহস্যপুরীতে ঢুকতে দিয়েছে সে বা তারাই বাধা দেবে ওয়াই। এই সহজ কথাটা ঢোকেনি তোমার মাথায়? তুমি না বিজ্ঞানী? নিজেকে না সেরা বিজ্ঞানী বলে দাবি করো? বলো তো, রহস্যপুরীর দরজাগুলো একটার পর একটা কে খুলে দিয়েছে তোমাকে?’
কে খুলে দিয়েছে?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল প্রফেসর। বিমূঢ় দেখাচ্ছে তাকে। কুয়াশা বলল, ‘প্রশ্ন আমি করেছি। উত্তর তুমি দেবে।
কে খুলেছে দরজা তা তো আমি জানি না।’
সশব্দে হেসে উঠল কুয়াশা, বাহ! চমৎকার। কিন্তু উত্তরটা গণ্ডমূর্খের মত হয়ে গেল না, ওয়াই! শোনো তবে, আসল ব্যাপারটা কি। এই রহস্যপুরীতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী একটা দল আছে।
‘দল আছে? কই, কোথায়? কি করছে তারা?’
কুয়াশা বলল, ‘অস্থির হয়ো না। সব কথা শোনো আগে যেখানেই তারা থাকুক, সহজে আমরা তাদের অবস্থান জানতে পারব না। তবে এই রহস্যপুরীর ভিতরেই যে তারা আছে তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। তাদেরকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না ঠিক, কিন্তু তারা সর্বক্ষণ, এমনকি এই মুহূর্তেও আমাদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে। হয়তো, আমাদের কথাও শুনতে পাচ্ছে তারা।
ভলিউম ১৭
প্রফেসর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। বলল, আপনি বলতে চাইছেন টিভি ক্যামেরার সাহায্যে লোকগুলো আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছে!
হ্যাঁ। এতক্ষণে বুঝেছ। তারা টিভিতে দেখতে পাচ্ছে আমাদেরকে। স্বয়ংক্রিয় দরজাগুলো বিদ্যুতের সাহায্যে পরিচালিত, লক্ষ করেছ নিশ্চয়! টিভিতে আমাদের অবস্থান দেখে নিয়ে নির্দিষ্ট একটার পর একটা বোম টিপে একটার পর একটা দরজা মেলে দিয়েছে আমাদের সামনে। তার কারণ কি, ওয়াই? বলতে পারো?
তার কারণ? কি হতে পারে তার কারণ?’ প্রফেসর চিন্তা করার চেষ্টা করছে কারণটা।
কুয়াশা বলল, তার কারণ লোকগুলো চাইছিল আমরা এই স্বর্ণ ভাণ্ডারে প্রবেশ করি।’
তা চাইবার কারণ?’ কারণটাও বলে দিতে হবে? স্বভাবতই আমাদেরকে বন্দী করতে চায়। তার মানে আমরা এই গোল জায়গাটায় বন্দী এখন?
কুয়াশা গম্ভীর হয়ে উঠল, হ্যাঁ, তাই। শুধু তাই নয়, আমাদেরকে তারা হত্যা করার জন্যেই বন্দী করেছে।’
‘এসব কি বলছেন আপনি?
প্রফেসর ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘অসম্ভব। সব মিথ্যে, সব বাজে কথা! আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না। আপনি নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য অহেতুক আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু, মি. কুয়াশা আপনার আশা পূর্ণ হবার নয়। আয়ু শেষ হয়ে গেছে আপনার। আমার করার কিছু নেই।’
প্রফেসর ওয়াই হাতের পিস্তলটা তুলে ধরল। পিস্তলের নলটা ঠেকিয়ে দিল সে কুয়াশার বিশাল বুকের মাঝখানে। ট্রিগারে চেপে বসছে তার আঙুল।
হঠাৎ হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল কুয়াশা। ‘হোয়াট!’
গলা ছেড়ে উদাত্ত কণ্ঠে হেসেই চলেছে কুয়াশা। প্রফেসরকে বিমূঢ় দেখাচ্ছে, চেয়ে আছে সে কুয়াশার দিকে।
হাসি থামল কুয়াশার। বলে উঠল সে, হাসছিলাম কেন জানো, ওয়াই?
কেন?’ প্রফেসর অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে উঠল। ‘হাসছি তোমার কাণ্ড দেখে। আমার বুকে পিস্তল ঠেকিয়েছিলে ঠিকই, কিন্তু তোমার হাতটা কাঁপছিল থরথর করে। আসলে, নিজের হাতে আমাকে গুলি করার সাহস তোমার নেই। হাজার হোক•••
কুয়াশার শরীরে অকস্মাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ডান হাতটা ইলেকট্রিক পাখার মত শুন্যে ঘুরতে শুরু করল তার। চারদিকে ঘিরে দাঁড়ানো প্রফেসরের সহচরদের নাকে মুখে তার হাতের বাড়ি লাগল প্রচণ্ডভাবে। ছিটকে পড়ে গেল সবাই। বাঁ হাত দিয়ে প্রফেসরের হাতের পিস্তলটা কেড়ে নিল সে। পরমুহূর্তে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল তাকে।
কুয়াশা ৪৯
৩৭
কেউ নড়েছ কি মরেছ?’ গর্জে উঠল কুয়াশা, হাতের অস্ত্র ফেলে দাও সবাই!
দু’পা ফাঁক করে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। প্রফেসরের সহচররা সবিস্ময়ে চেয়ে আছে তার দিকে। কি থেকে চোখের পলকে কি হয়ে গেল তখনও তা বুঝতে পারছে না যেন তারা।, প্রফেসর ওয়াই কুয়াশার ধাক্কা খেয়ে স্তূপীকৃত স্বর্ণের উপর গিয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে সে।
কোথায় গুলি করতে হবে আমি জানি। সুতরাং কোন চালাকি করার চেষ্টা কোরো না! সাবধান!
হঠাৎ সশব্দে খুলে গেল একটা দরজা। গোলাকার স্বর্ণ ভাণ্ডারে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করল শহীদ।
চমৎকার ধনসম্পদ, সেই সাথে শয়তান ওয়াই-শাবাশ কুয়াশা! এতদিনে তুমি একটা মনের মত কাজ করেছ।’ কথা বলে উঠলেন শহীদের পিছন থেকে মি. । সিম্পসন।
| কুয়াশা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, শহীদ, দরজাটা সবাই মিলে ধরে রাখো। ওটা যেন কোন মতে বন্ধ হয়ে না যায়!’
ভিতরে ঢুকে পড়েছে শহীদ তখন। ওর পিছনে বাকি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল ওদের পিছনের দরজাটা।
“কি ব্যাপার?’ জানতে চাইল শহীদ।
কুয়াশা কি যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু মুখ খোলার অবসর পেল না সে। যান্ত্রিক একটা শব্দ কানে ঢুকল সকলের।
সবাই মুখ তুলে তাকাল উপর দিকে। প্রকাণ্ড লোহার ঝুলন্ত ঢাকনিটা নেমে আসছে নিচের দিকে। ঘর ঘর করে একটানা আওয়াজ হচ্ছে।
উপরকার ফাঁকটা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক টন ওজনের ঢাকনিটা ঢেকে দিয়েছে স্বর্ণ ভাণ্ডারের মুখ।
কুয়াশা বলে উঠল, ‘আমরা বন্দী এখানে।
শহীদ কি যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় গোপন লাউডস্পীকার থেকে একটা জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে: ‘রহস্যপুরীর পবিত্রতা নষ্ট করে যারা তাদেরকে দেবতারা ক্ষমা করতে জানেন না। তোমরা দেবতাদের অনুমতি না নিয়ে রহস্যপুরীতে অনুপ্রবেশ করেছ। তোমাদের একমাত্র প্রাপ্য শাস্তি মৃত্যু। দেবতা রোটেনহেপো হেমনোসনি ক্যানক্যান-এর পাদমূলে আগামীকাল সকালে তোমাদের সবাইকে বলি দেয়া হবে।’
‘ঘোড়ার ডিম হবে! থর থর করে কাঁপছে প্রফেসর ওয়াই প্রচণ্ড রাগে। চিৎকার করে উঠল সে হঠাৎ। | লাউডস্পীকার থেকে সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর উচ্চারণ করে চলেছে তখনওঃ দেবতাদের আজ্ঞাবহ দাস আমরা। তোমাদের ব্যাপারে আমাদের করার কিছুই নেই। আজকের মত বিদায়!
৩৮
ভলিউম ১৭
প্রফেসর ওয়াই উপর দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে উঠল, দাঁড়াও, আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও!
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।
কান খুলে শুনে রাখো, তোমাদেরদেবতার কান মলে দেব আমি।’ হেসে ফেলল কুয়াশা। বলল, ‘আহ! থামো!’
কুয়াশার দিকে চিন্তিতভাবে তাকাল প্রফেসর ওয়াই! ভারি মুসিবতে পড়লাম দেখা যাচ্ছে। মি. কুয়াশা, এখন উপায়! আমার ভ্যানিশিং রে যন্ত্রটাও ম্যাটাবরের সাথে গায়েব হয়ে গেছে করিটা কি! একটা উপায় বের করুন তো দেখি। আসুন সবাই মিলে একটা পরামর্শ করা যাক।’.
কুয়াশী বলল, তোমার হলো কি? এমনভাবে কথা বলছ শুনে মনে হচ্ছে। সকলের সাথে তোমার পরম বন্ধুত্বের সম্পর্ক!
শত্রুতা আসলে বন্ধুত্বেরই পূর্ব শর্ত অথবা শত্রুতা বন্ধুত্বেরই নামান্তর মাত্র। পরস্পরের শত্রু আমরা এতক্ষণ ছিলাম ঠিক, কিন্তু সে তো নিজেদের মধ্যে। তৃতীয় একটা পক্ষ যখন আমাদের ক্ষতি করতে চাইছে তখন শত্রুতা ভুলে যাওয়া উচিত আমাদের•••।’
.হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল কুয়াশা।
শহীদ বলল, প্রফেসর, মাখা ঠিক আছে তো? ভয়ে আধমরা হয়ে গেছেন দেখছি!’
খেপে গেল প্রফেসর। চিৎকার করে উঠল সে, হোয়াট! কি বললে টিকটিকি তুমি! আমি ভয় পেয়েছি! হাঃ হাঃ হাঃ হা।’ হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল প্রফেসর ওয়াই।
শহীদ লক্ষ করছিল কুয়াশাকে। লেসারগানটি বের করে ফেলেছে সে পকেট থেকে। একটা দরজার দিকে তাক করে ধরেছে সেটা।
উন্মাদের মতই হেসে চলেছে প্রফেসর ওয়াই। চমকে উঠল কুয়াশা।
সর্বনাশ! শহীদ!’। “কি হলো? লেসারগান নষ্ট হয়ে গেছে।
কুয়াশা তাকাল শহীদের দিকে। দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে তার প্রশস্ত কপালে। হ্যাঁ, নষ্ট হয়ে গেছে।
লেসারগানটা ছুঁড়ে ফেলে দিল কুয়াশা। ‘এখুন উপায়!
জানি না। আমরা সাংঘাতিক হিংস্র এবং খুনী লোকদের হাতে বন্দী হয়েছি, শহীদ। এদের হাত থেকে বাঁচব কিনা জানি না।’
প্রফেসর ওয়াইয়ের থামার কোন লক্ষণ নেই। সেই গগনবিদারী কণ্ঠে হাঃ হাঃ হাঃ হা করে উন্মাদের মত হেসেই চলেছে সে।
Leave a Reply