৪৮. প্রফেসর ওয়াই ৫: আবার একত্রে [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪৮
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি, ১৯৭৬
এক
জ্ঞান ফিরে পেয়ে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল ডি. কস্টা। গড, ওহ গড! থ্যাঙ্কস, মেনি থ্যাঙ্কস ফর ন্যায় বিচার! পৃথিবীতে আমি মানুষের এত উপকার করিয়াছি যে হেভেনে হামাকে জায়গা না ডিয়া উপায় ছিল না টোমার।
| সুন্দর একটা হলরুমের নরম বিছানায় শুয়ে আছে ডি, কস্টা। বাতাসে অদ্ভুত সুন্দর একটা সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। সুমধুর সঙ্গীতের অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে কোথাও থেকে। অদূরের একটা টেবিলের উপর থরে থরে সাজানো রয়েছে পাকা আপেল, আঙ্গুর, কলা, আনারস, পেঁপে, কালো জাম প্রভৃতি ফলমূল। মাথা উঁচু করে পাশের টেবিলটার উপর দিকে তাকাল সে। জল এসে গেল জিভে তার। চাইনিজ আর ইংলিশ ডিশ সাজানো রয়েছে টেবিলের উপর।
হলরূমের খোলা জানালার ধারে একটা আরাম কেদারায় বসে রয়েছে অপরূপ সুন্দরী এক যুবতী। উঠে বসল ডি. কস্টা। বিড় বিড় করে আপন মনেই বলে উঠল, ননা ডাউট, দিস ইজ হেভেন। দ্যাট বিউটিফুল গার্ল-সুন্দরী নিশ্চয়ই হেভেনের পরী! এই পরিবেশ পৃথিবীর কোঠাও ঠাকিটে পারে না। টারমানে, আমি মারা গিয়াছি হিমালয়ের সেই গুহার ভিটর, এবং টারপর গড় হামাকে এই হেভেনে টুলিয়া
আনিয়াছেন।
ঘাড় ফিরিয়ে পিছনদিকে তাকাল ডি কস্টা। ভুরু কুঁচকে উঠল তার। পাশের বিছানায় শুয়ে রয়েছে মি. সিম্পসন। তার পাশের একটা বেড়ে আর
একজন-আরে! মি, কামাল না? | ‘ওহ গড! রহস্যটা কোঠায়। মি. কামাল কি করিটেছেন আমাডের হেভেনে। ইহা যে স্বর্গ টাহাটে কোন সহে নাই। বাট, কোশ্চেন ইজ, ইহা মুসলমানডের
জান্নাত, না খ্রিস্টানদের হেভেন?”
মি. সিম্পসন নড়েচড়ে উঠলেন। মাথা তুলে দেখলেন তিনি ডিকস্টাকে। এইমাত্র জ্ঞান ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে তার।
কোথায় রয়েছি আমি। ডি. কস্টা হাসল, হেভেনে।
এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মি. সিম্পসন ডি কস্টার দিকে। তারপর মুচকি হেসে উঠে বসলেন বিছানার উপর।
‘হোয়াটস্ দ্য ম্যাটার, মি. সিম্পসন? হাসিলেন যে, হোয়াই!’
কুয়াশা ৪৮
১০১
মি, সিম্পসন সহাস্যে বললেন, ‘জায়গাটা কার, এখানে কিভাবে এলাম তা এখনও বুঝতে না পারলেও একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে এটা হেভেন বা স্বর্গ বা জান্নাত কোনটাই নয়।
হোয়াট! হেভেন নয় বলিটেছেন? হেভেনে ঠাকিয়া হেভেনকে ডিনাই করিটেছেন?
মি. সিম্পসন বললেন, ‘হেভেনকে অস্বীকার করছি না। আমি শুধু বলতে চাইছি এটা হেভেন নয়। হেভেন হলে তুমি এখানে থাকতে না। তুমি মানুষকে এত জ্বালিয়েছ যে হেভেনে তোমার ঠাই হতে পারে না। তোমার ঠাই হবে হেলে অর্থাৎ নরকে। সুতরাং, তুমি যখন এখানে রয়েছ তখন এই জায়গা কোনমতেই হেভেন হতে পারে না।’
টবে কোঠায় রহিয়াছি আমরা? হেলে? নরকে!
হলরূমের সর্বশেষ প্রান্তের বিছানা থেকে ভেসে এল শহীদের কণ্ঠস্বর, ওহে ডি. কস্টা, এটা হেভেনও নয়, হেলও নয়। আমরা কুয়াশার স্পেসক্রাফটে রয়েছি। মাটি থেকে তিন মাইল উঁচু দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আফ্রিকা মহাদেশ সম্ভবত এখন আমাদের নিচে।
বিছানা থেকে নেমে পড়লেন মি. সিম্পসন। তড়াক করে ডি. কস্টাও নামল । মি. সিম্পসনকে পিছনে ফেলে পাটখড়ির মত পা নিয়ে ছুটল সে শহীদের দিকে। কামাল উঠে বসল তার বিছানায়, তার দৃষ্টি দূরের একটি বেডের দিকে। সে বেডে বসে আছে মহুয়া। উজ্জ্বল হাসিতে ভরা মুখ।
কামাল চেঁচিয়ে উঠল, ‘মহুয়াদি! আমি কি স্বপ্ন দেখছি! নিজের গায়ে চিমটি কাটল কামাল, মাগো! ব্যথা তো লাগে!
সবাই ঘিরে ধরল শহীদকে।
কামাল বলল, শহীদ, আমার প্রশ্নের উত্তর দে তুই আগে। এখানে কে উদ্ধার করে আনল আমাদেরকে। তুই?
শহীদ বলল, না। কুয়াশা। আমাদের প্রত্যেকের শরীরে কুয়াশা VNR-5 এর একটা করে কণা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল বহুদিন আগে, জানিস তো? সেই কণা যেখানে থাকে প্রয়োজনে সেইখানে কুয়াশাকে নিয়ে যাবার জন্য কুয়াশা একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছিল। সেই ইণ্ডিকেটর যন্ত্রের সাহায্যে সে আমাদের সবাইকে মুমূর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করেছে। তুই আর ডি. কস্টা অক্সিজেনের অভাবে মরে যাচ্ছিলি । তোরা যে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলি সেই গুহায় প্রবেশ করতে প্রায় এক হাজার টন বরফ গলাতে হয়েছে কুয়াশাকে। আর মি. সিম্পসনকে উদ্ধার করার জন্য বরফ গলাতে হয়েছে আড়াইশো টন। প্রফেসর ওয়াইয়ের রোবটরা আমাকে সুপারম্যানে রূপান্তরিত করছিল, মহুয়ার মুণ্ডু কেটে ফেলে দিয়ে সেই জায়গায় বসাচ্ছিল যান্ত্রিক মুণ্ডু। অপারেশনের কাজ শুরু করে দিয়েছিল রোবটরা। কিন্তু কুয়াশার সময়োচিত হস্তক্ষেপে রোবটরা অচল হয়ে যায়, আমরা বেঁচে যাই। পরে কুয়াশা ভারতমহাসাগরের একটা দ্বীপ থেকে আমাদের দুজনকে উদ্ধার করে।
| শহীদ থামতে সবাই এক সাথে কথা বলে উঠল। কুয়াশার বুদ্ধি, সাহস,
ভলিউম ১৬
১০২
দায়িত্ববোধ এবং মহানুভবতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই।
মি. সিম্পসন বললেন, “সত্যি, প্রতিভা বটে একটা। যতই শত্রুতা থাক তার সাথে আমার, তার মহত্ত্বকে অস্বীকার করতে পারি না আমি।’
কামাল বলল, আমরা এখন তাহলে আফ্রিকার উদ্দেশে যাচ্ছি। শহীদ বলল, হ্যাঁ। রহসপুরীর কথা মনে আছে তো?” সবাই একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, “নিশ্চয়ই মনে আছে।’
শহীদ বলল, ‘সেই রহস্যপুরীতেই যাচ্ছি আমরা। সেখানে কোটি কোটি টাকার গুপ্তধন আছে। আমাদের উদ্দেশ্য সে-সব উদ্ধার করা।
মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, ‘শয়তান প্রফেসর ওয়াই–তার খবর কি?’
সকলের পিছন থেকে অপরূপ সুন্দরী আনতারার রাজকুমারী ওমেনা বলে উঠল, ‘প্রফেসর ওয়াই মারা গেছে।
হোয়াট! মারা গেছে!’ চমকে উঠে সবাই রাজকুমারীর দিকে তাকাল। মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, আপনি কে! আপনাকে তো চিনলাম না, মিস•••?’
রাজকুমারী বলল, “আমি টুইন আর্থ আনতারার রাজকুমারী। কুয়াশা আমাদের গ্রহে গিয়েছিলেন। আমি তার সাথে চলে এসেছি আপনাদের পৃথিবীতে।
‘মাই গড! এসব কি শুনছি আমি শহীদ! কুয়াশা: কুয়াশা মানুষ না অতিমানব! সত্যিই তাহলে শয়তান প্রফেসর ওয়াই তাকে মহাশূন্যের কোন এক গ্রহে পাঠিয়েছিল? কিন্তু তা না হয় হলো, কুয়াশা ফিরল কিভাবে?
শহীদ বলল, সে-সব অনেক বিচিত্র আর দীর্ঘ কাহিনী। পরে শুনবেন।’
কামাল রাজকুমারী ওমেনার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, প্রফেসর ওয়াই মারা গেছে সত্যি! আপনি দেখেছেন তার লাশ?
রাজকুমারী বলল, না লাশ দেখিনি। তবে তার বাড়িতে বোমা ফেলছেন মি. কুয়াশা। এবং বাড়িটা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে আগুনে।’
ভারি একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল ঠিক এমন সময়, শহীদ!’
সবাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। কন্ট্রোল রুমের দরজা পেরিয়ে হলরুমে প্রবেশ করছে দীর্ঘদেহী, কালো আলখেল্লা পরিহিত স্বয়ং কুয়াশা।
দীর্ঘ পদক্ষেপে শহীদের সামনে এসে দাঁড়াল কুয়াশা। হাতে একটা ক্ষুদ্র চারকোণা রেডিওর মত যন্ত্র ধরা রয়েছে। মুখের চেহারায় একটু যেন উদ্বেগের ছাপ।
‘সবাই সুস্থ তো?’ মায়াময় চোখ ঘুরিয়ে সকলের দিকে একবার করে তাকাল কুয়াশা।
সকলের আগে চেঁচিয়ে উঠল ডি. কস্টা, “ওহ্ বস! থ্যাঙ্কস, মেনি থ্যাঙ্কস ফর সেভিং মাই ভ্যালুয়েবল লাইফ! টা, মহাশূন্যের জার্নিটা উপভোগ্য হইয়াছিল টো?
কুয়াশা মৃদু হাসল। বলল, ‘খুবই উপভোগ্য হয়েছিল ফিরতি অভিযানটা। যাবার সময় তো টেরই পাইনি।’
| শহীদ বলল, “কি ব্যাপার, কুয়াশা? ‘তোমাকে যেন চঞ্চল মনে হচ্ছে?
| ‘ঠিকই ধরেছ তুমি, শহীদ! আমরা এখন আফ্রিকার ওপর রয়েছি, বুঝলে । স্পেসক্রাফট দাঁড়িয়ে আছে শূন্যে।
কুয়াশা ৪৮
১০৩।
কেন! রহস্যপুরীর কাছে পৌঁছে গেছি নাকি?
কুয়াশা বলল, “না! রহস্যপুরী আরও একটু দূরে। থামার কারণ কি জানো, আমার এই ইণ্ডিকেটর যন্ত্র বলছে, নিচে আমাদের পরিচিত কোন শুভানুধ্যায়ী রয়েছে।’
‘সেকি!
কুয়াশী বলল, ‘খুবই অবাক ব্যাপার। আফ্রিকার জঙ্গলে আমাদের কে থাকতে পারে? আমি অতি পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সবার রক্তেই শুধু VNR-5 এর কণা প্রবেশ করিয়েছিলাম। সুতরাং নিচের জঙ্গলে আমার ঘনিষ্ঠ কেউই আছে।’
মি. সিম্পসন বললেন, আশ্চর্য লাগছে। কুয়াশা, তোমার যন্ত্রে গোলমাল নেই তো?’
‘অসম্ভব।’
শহীদ বলল, কে হতে পারে বলে মনে করো তুমি?
কুয়াশা বলল, রাসেলের কথা মনে হচ্ছে। কিন্তু রাসেল আফ্রিকার জঙ্গলে আসবে কেন? তাছাড়া ইণ্ডিকেটর যন্ত্রের সিগন্যাল দেখে আমি বুঝতে পারছি। জঙ্গলের মধ্যে যে-ই থাকুক, সে খুব বিপদে আছে।
“কি করতে চাও তুমি?’
কুয়াশা বলল, “কি করতে চাই ঠিক করে ফেলেছি। স্পেসক্রাফট নামিয়ে সন্ধান নিতে হবে। আমি একাই যাব।’
‘আমিও যাব তোমার সাথে।
কুয়াশা বলল, “না, শহীদ। এটা একটা ফাঁদও হতে পারে। সবাইকে রেখে আমরা দুজনই যেতে পারি না। রাত এখন, বিপদের কথা কিছুই বলা যায় না।’
শহীদের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, ফাঁদ? কে ফাঁদ পাততে পারে, কুয়াশা?’
কুয়াশা বলল, আমার শত্রুর কি অভাব আছে, শহীদ? ‘প্রফেসর ওয়াই?’ ‘নট ইমপসিবল!’ কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা ।
পিছন থেকে মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু মিস ওমেনা যে বললেন, তুমি তার বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছ বোমা মেরে?’
| কয়াশা দাঁড়াল না। কন্ট্রোলরুমের দরজার কাছে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাল সে! বলল, বাড়িটা ধ্বংস হয়েছে, বোমার আঘাতে। কিন্তু প্রফেসর ওয়াই মারা গেছে কিনা সেটা আমরা কেউ দেখিনি। কন্ট্রোলরূমে অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশা কথাটা বলে।
কুয়াশা চলে যেতেই প্রফেসর ওয়াই বেঁচে আছে কি মরে গেছে এই নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে গেল মি. সিম্পসন, ডি কস্টা, কামাল এবং মহুয়ার মধ্যে ।
রাজকুমারী ওমেনাও ওদের আলোচনায় যোগ দিল। তার বক্তব্য, ‘বাড়িটা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, নিজের চোখে দেখেছি আমি। তা সত্ত্বেও যদি ওই বাড়ির
১০৪
ভলিউম ১৬
T
‘
কেউ বেঁচে থাকে তাহলে আমি বলব সে মানুষ নয়, আর কিছু।
| তিন মিনিট পর কুয়াশার মহাশূন্যযান আফ্রিকার গভীর অরণ্যে নামল। কুয়াশা বলল, আমি এক ঘণ্টার মধ্যে না ফিরলে মনে করবে বিপদে পড়েছি।
হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের বিচরণ ক্ষেত্রে একা নামল কুয়াশা অ্যালুমিনিয়ামের সিঁড়ি বেয়ে। গাঢ় অন্ধকারে চারদিক ঢাকা। অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশা।
| মহুয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল। কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে যেতেও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সে। দূরে কোথাও ডাকছে একটা বাঘ। হঠাৎ একদল নেকড়ে এক যোগে ডেকে উঠল কাছে পিঠে কোথাও থেকে। শিউরে উঠল মহুয়া।
রাজকুমারী ওমেনা মহুয়ার পিছনে এসে দাঁড়াল। মহুয়াকে টেনে নিল সে কাছে। বলল, আপনার দাদাকে আপনি এখনও বুঝি চিনতে পারেননি? কেন শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছেন নিজেকে? ওঁর ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকুন।
অপর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কামাল, মি. সিম্পসন, ডি. কস্টা। শহীদ কন্ট্রোলরূমে ঢুকেছে কুয়াশা চলে যাবার পর।
হঠাৎ স্পেসক্রাফটের চারদিকে উজ্জ্বল আলোর বন্যা দেখা দিল।
শশারগোল উঠল হলরূমের ভিতর। ডি. কস্টা হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচাচ্ছে বাইরের দিকে তাকিয়ে, মি, সিম্পসন! রাইফেলটা কোঠায় বলুন টো! বাঘ শিকারের সাটা এই চান্সে মিটাইয়া লই। এমোন চান্স লাইফে আর মিলিবে না, ফর গডস সেক! ডেকছেন, কেমন হলুড ডোরাকাটা বাঘটা•••উই মা, হাটি! কট্টোবড় হাটি রে বাপ!
শহীদ হলরূমে ঢুকল। আলো জ্বেলে দিয়েছে সে-ই। জানালার সামনে দাঁড়াল সে। মি. সিম্পসন কোথায় জিজ্ঞেস করতে কামাল বলল, তিনি সম্ভবত কন্ট্রোলরূমে গেছেন। স্পেসক্রাফটের চারদিকে দারুণ খেলা জমে উঠেছে। বুনো জন্তুগুলো ঘুর ঘুর শুরু করছে চারদিকে। উজ্জ্বল আলোয় দেখা যাচ্ছে বাঘ, হাতি, হায়েনা, বুনো মোষও চোখে পড়ল কয়েকটা। | সবাই মেতে উঠল ছেলেমানুষের মত। সবচেয়ে উঁচু গলা ডি. কস্টার, এই ব্যাটা নেকড়ে, হামার ডিকে টাকিয়ে ফেস বাঁকা করিটেছিস কোন্ সাহসে! এক চড় দিয়ে মাঠা ঘুরিয়ে ডেবো…’
সময়টা কেটে গেল দেখতে দেখতে। কন্ট্রোলরূমের বৈশিষ্ট্য দেখার কৌতূহলে মি. সিম্পসন গিয়েছিলেন ভিতরে একবার। খানিক আগে বেরিয়ে এসেছেন তিনি।
শহীদ পায়চারি করছে উত্তেজিত ভাবে। হঠাৎ বলে উঠল ও, ‘একঘন্টা প্রায় হয়ে এসেছে। কুয়াশার দেখা নেই এখনও!
তীক্ষ কণ্ঠে মি. সিম্পসন ডাকলেন হঠাৎ, শহীদ।
থমকে দাঁড়াল শহীদ । মি. সিম্পসন, কামাল, ডি, কস্টা, মহুয়া, রাজকুমারী–সবাই চুপ হয়ে গেছে। ব্যাপার কি! | দ্রুত জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ।
‘তাকিয়ে থাকো। দেখতে পাবে,’ বললেন মি. সিম্পসন
কুয়াশা ৪৮
অপেক্ষা করতে হলো না বেশিক্ষণ। শহীদ দেখতে পেল, এক গাছের আড়াল থেকে আরেক গাছের আড়ালে দ্রুত চলে গেল চারপাঁচজন নিকষ কালো জংলী। হাতে বল্লম, কাঁধে তীর ধনুক, মুখে রঙ, মাথায় পাখির পালক গোজা। কদাকার মুখের চেহারায় হিংস্রতার ছাপ।
ঘিরে ফেলেছে ওরা আমাদেরকে!’ কামাল উত্তেজিত। মিসিম্পসন বললেন, আমি ভয় করছি।’ ‘চুপ করে গেলেন মি. সিম্পসন কথাটা শেষ না করেই।
কামাল জিজ্ঞেস করল, “কি ভয় করছেন? শহীদ বলল, ‘ওরা স্পেসক্রাফটের কোনরকম ক্ষতি করার চেষ্টা করবে কিনা? মি, সিম্পসন বললেন, হ্যাঁ। সেই ভয়ই করছি আমি।’
শহীদ বলল, কন্ট্রোলরূমে যাচ্ছি আমি। দেখি জংলীদেরকে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা। সবাই সাবধান, ওরা তীর ছুঁড়তে পারে। ওদের তীরের ভগায় বিষ মেশানো আছে। চামড়া ছুলেই মৃত্যু!
দ্রুত কন্ট্রোলরূমে গিয়ে ঢুকল শহীদ।
শহীদ যাবার পর দুই মিনিটও কাটল না, জংলীরা অপ্রত্যাশিতভাবে চারদিক থেকে চিৎকার জুড়ে দিল। শুধু তাই নয়, গাছের আড়াল থেকে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এসে যে যেদিকে পারল ছুটল সবাই।
“কি ব্যাপার! অমন পাগলের মত ছুটোছুটি করছে কেন ওরা!
মৌমাছির চাকে ঢিল মারিয়াছে বোধহয়
কামাল গর্জে উঠল, “থামুন আপনি! বুদ্ধিশুদ্ধির মাথা একেবারে খেয়ে বসে আছেন দেখছি।
মি. সিম্পসন বললেন, ‘শহীদ বোধহয় কন্ট্রোলরূম থেকে এমন কিছু করেছে যা দেখে ভয় পেয়েছে ওরা••• |
এমন সময় আবার ফিরে এল শহীদ হলরূমে, কামাল, ব্যাপার কি বল তো? জংলীরা হঠাৎ অমন আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি শুরু করল কেন?
‘তুমি কিছু করোনি তাহলে? ‘না!’ কামাল বলল, ভারি অবাক কাণ্ড তো!’
শহীদ জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জংলীরা গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে। ছুটোছুটির বিরাম নেই তাদের। দিক হারিয়ে ফেলেছে সবাই, কেউ ছুটছে দক্ষিণ দিকে, কেউ ছুটছে উত্তর দিকে। দলবদ্ধভাবে, দল ছাড়া, যে যেভাবে পারছে ছুটছে।
শহীদ হঠাৎ কেঁপে উঠল।
মি. সিম্পসন! কামাল! চেয়ে দেখ, আকাশের দিকে চেয়ে দেখ! সবাই তাকাল শহীদের কথা মত।
কথা ফুটল না কারও মুখে। রাতের কালো আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। গাছপালার উপরের আকাশে যেদিকে তাকাচ্ছে ওরা সেদিকেই দেখতে পাচ্ছে। লালচে একটা আভা।
১০৬
ভলিউম ১৬
‘শহীদ! কামাল শহীদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ‘আগুন!’ মি. সিম্পসন বললেন ঢোঁক গিলে । শহীদ বলল, “সর্বনাশ! বনভূমির চারদিকে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
মি. সিম্পসন বললেন, কিন্তু এই রকম দাবাগ্নির কথা কখনও শুনিনি। চারদিকে একই সময়••• |’
শহীদ সঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘এ নিশ্চয়ই প্রফেসর ওয়াইয়ের কাণ্ড : কুয়াশাকে কৌশলে সে বনভূমিতে নামিয়েছে। এটা তার ফাঁদ!
রাজকুমারী এবং মহুয়া কাছে এসে দাঁড়াল। ‘শহীদ, কি হবে?
রাজকুমারী আশ্বাস দিল মহুয়াকে, “কিছুই নেই ভয়ের! আগুন কোন ক্ষতিই করতে পারবে না আমাদের। স্পেসক্রাফট অপারেট করতে জানি আমি। মি. শহীদও সম্ভবত জানেন। আমরা উঠে যাব ওপরে।
শহীদ বলল, দেরি করে লাভ নেই, ওমেনা, চলো, বনভূমি ছেড়ে শূন্যে উঠে যাবারই ব্যবস্থা করি।’
কন্ট্রোলরূমে গিয়ে ঢুকল ওরা। মি. সিম্পসন একটা চুরুট ধরালেন। রীতিমত চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। মহুয়া কামালের একটা হাত ধরে বলল, দাদার কি হবে?’
কামাল বলল, কুয়াশা বোকা নয়, মহুয়াদি। এটা যে একটা ফাঁদ তা সে আগেই অনুমান করেছিল। সুতরাং নিজেকে রক্ষা করার উপায়ও ঠিক করে রেখেছিল সে মনে মনে। প্রফেসর ওয়াই কোন ক্ষতিই করতে পারবে না তার।
মিনিট পাঁচেক পর হলরুমে ছুটে প্রবেশ করল ওমেনা এবং শহীদ। শুকিয়ে গেছে শহীদের মুখ। ওমেনা হাঁপাচ্ছে ।
‘স্পেসক্রাফট নষ্ট হয়ে গেছে। কামাল, আর একমুহূর্ত দেরি না করে নেমে পড় সবাই! আগুনের বেড়া থেকে গা বাঁচিয়ে যেমন করেই হোক বেরিয়ে যেতে হবে আমাদেরকে।
‘বাট দ্যাটস ইম্পসিবল, মাই বয়! মি. সিম্পসন বলে উঠলেন।
শহীদ স্পেসক্রাফটের দরজা খুলতে খুলতে বলল, ‘সম্ভব কি অসম্ভব সেটা এখন ভেবে লাভ নেই। এছাড়া উপায় নেই এখন।স্পেসক্রাফট সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। ফুয়েল ট্যাঙ্ক শূন্য, ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের সব কানেকশন বিচ্ছিন্ন, রাডারের তার ছেঁড়া, কমপিউটার কন্ট্রোল সম্পূর্ণ নষ্ট। উড়বে না, উড়বে না এটা আর।
মহুয়া বলল, কিন্তু নষ্ট হলো কিভাবে?’
শহীদ কি যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ওমেনা বলে উঠল, ‘আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ এই শত্রুতামূলক কাজটা করেছেন। শুধু তাই নয়, স্পেসক্রাফটে একটা মেয়াদী বোমাও রয়েছে। টাইম বোমা আমাদের কারও সাথেই ছিল। পিন তুলে, কাটা নির্দিষ্ট সময়ের ঘরে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়টা কখন তা আমরা জানতে পারছি না। এই শত্রুতামূলক কাজ যিনি করেছেন একমাত্র তার পক্ষেই তা জানা সম্ভব। বোমাটা যে-কোন মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে।
কুয়াশা ৪৮
১০৭
আমাদের ইণ্ডিকেটর যন্ত্রে বোমাটার অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। সেটাকে খুঁজে বের করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। খুঁজে পাবার আগেই সেটা ফেটে যেতে পারে।
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, হোয়াট! মাই গড়! এসব কি শুনছি! টাইম বোমা! কে••• কে…?
শহীদ বাধা দিয়ে বলল, তা না-ও হতে পারে, মি. সিম্পসন । আমার ধারণা সম্পূর্ণ অন্যরকম। যাক, এ বিষয়ে কথা বলার সময় এটা নয়। চারদিক থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে দাবাগ্নি। স্পেসক্রাফটে আর একমুহূর্ত থাকাও নিরাপদ নয়। এই দুই বিপদের হাত থেকে বাঁচব কি মরব জানি না–কিন্তু চেষ্টা করতে হবে আমাদেরকে!
আর সময় নষ্ট করল না ওরা। সিঁড়ি বেয়ে শহীদের পিছু পিছু বনভূমিতে নামল সবাই।
দুই সাবেক বেলজিয়ান কঙ্গো-বর্তমানে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অভ কঙ্গো। আফ্রিকার গর্ব কঙ্গো। অকুতোভয় শিকারীদের তীর্থভূমি কঙ্গো। কঙ্গোপৃথিবীর সবচেয়ে গহীন অরণ্য। গরিলা, শিম্পাঞ্জী, ওরাংওটাংদের আবাস ভূমি; সিংহ, বাঘ, গণ্ডার, হায়েনা, নেকড়ে আর বুনো হাতির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র; অসভ্য জংলী বর্বর উপজাতিদের জন্মভূমি এই বিশাল অরণ্য।
বনভূমি কোথাও কোথাও এমনই গভীর যে সূর্যের আলো ঘনসন্নিবেশিত গাছপালার শাখা প্রশাখা ও পাতা ভেদ করে নিচে পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে না। এই গভীর বনভূমিতে-কত শত দুর্ধর্ষ শিকারী যে যুগ যুগ ধরে প্রাণ হারিয়েছে তার হিসেব করা সম্ভব নয়।
কঙ্গোর অরণ্যে এখন নিকষ কালো গভীর রাত। হিংস্র, মাংসখেকো জীবজন্তুরা অভিযানে বেরিয়েছে। খাদ্য চাই।
| আহারের তালিকা এক এক পশুর এক এক রকম। বাঘের চাই হরিণ, শিয়ালের বাচ্চা, খরগোস। তবে খিদে যদি প্রচণ্ড হয়ে ওঠে, বুনো মোষের উপরও হামলা চালাতে দ্বিধা করবে না সে। কিংবা যদি চোখে পড়ে এক-আধটা মানুষ, তবে তো কথাই নেই। সিংহের চাই মোষ, বুনো ছাগল, উপাদেয় হরিণের মাংস, এবং মানুষ। হায়েনারও চাই ছাগল, হরিণ, ধাড়ী শিয়াল। মানুষ দেখলে আনন্দে হেসে খুন হবে
সে, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে তার দেহের মাংস।
আট মণ ওজনের অজগর গুহা থেকে বেরিয়ে এঁকেবেঁকে ধীর গতিতে চলেছে। শিকারের সন্ধানে। বড় আকারের হরিণ বা একটা ছাগল হলেই তার চলবে। মানুষকে গিলে খাবার সাধ তার থাকলেও, চলার গতি মন্থর বলে সচরাচর সে মানুষকে বাগে আনতে পারে না।
| রাত নামলেই এই সব শক্তিশালী হিংস্র সরীসৃপ এবং পশুকুল যে যার.আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। পেট পূজার তাগিদে ওত পেতে থাকে ঝোঁপ-ঝাড়ে, অপেক্ষা করতে থাকে শিকারের জন্য।
১০৮
ভলিউম ১৬
রাতের বনভূমি জেগে উঠেছে। দুর্বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে সবল। বাঘের পেটে যাচ্ছে শিয়ালের বাচ্চা, সিংহের পেটে যাচ্ছে বুনো মোষ। অরণ্যের সর্বত্র ভোজ শুরু হয়ে গেছে যেন।
সিংহের গর্জন, বাঘের হাঁক, হায়েনার কর্কশ হাসি, রাত জাগা বিচিত্র সব পাখিদের পাখা ঝাঁপটাবার শব্দ, দুর্বল পশুদের আতাঁরব, চারদিকে নারকীয় কাণ্ড।
| কঙ্গোর এই রাতের অরণ্যের কথা ভাবলেই আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে যায়। মানুষের। আধুনিকতম মারণাস্ত্রে সজ্জিত কোন মানুষও এই অরণ্যে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকার কথা ভাবতে পারে না। কখন কোনদিক থেকে বিপদ আসবে তা পূর্ব মুহূর্তেও জানা সম্ভব নয়। একবার আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এই অঞ্চল থেকে শিকার করে ফিরবার পর তার ভক্তরা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, শুনেছি রাতের বেলায় জঙ্গলের মধ্যে টর্চ হাতে নিয়ে চললে নাকি হিংস্র জন্তু জানোয়াররা কিছু বলে না? টর্চ হাতে চলা নাকি খুবই নিরাপদ?
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “ঠিকই শুনেছেন, তবে সেটা নির্ভর করে টর্চ হাতে কত দ্রুত চলেছেন, তার ওপর।
চারদিক অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারে চোখ জ্বলে পশুকুলের। তারা সব দেখতে পায় ।
দীর্ঘদেহী মানুষটাকে। দেখতে পেল অরণ্যের হিংস্র বাসিন্দারা। কে যায়। কে যায়! কার এত সাহস! কী আনন্দ, কী আনন্দ-একটা মানুষ যায়! একটা শিকার। যায়।
সাড়া পড়ে গেল গভীর অরণ্যে। মানুষ যায়। একটা শিকার যায়।
দীর্ঘ পদক্ষেপে দ্রুত হাঁটছিল কুয়াশা। কালো আলখেল্লা উড়ছে তার। কখনও লাফ দিয়ে ছোট ছোট ঝোঁপঝাড় টপকে, সঁাৎ করে সরে দিক পরিবর্তন করে, কখনও গাছের ঝুরি ধরে ঝুলতে ঝুলতে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলেছে। সে। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তার। মাথা উঁচু করে বীরোচিত ভঙ্গিতে অকুতোভয়ে অগ্রসর হচ্ছে। একদল নেকড়ে পড়ল সামনে। কুয়াশাকে দেখে উল্লসিত হয়ে বিকট কণ্ঠে হাঁক দিয়ে ছুটে এল দলটা, হঠাৎ কি যে হলো, আঁৎকে উঠে দৌড়ে পালাল সবগুলো নেকড়ে দলছাড়া হয়ে নানাদিকে।
| কিছুই যেন ঘটেনি। আগের মতই এগিয়ে চলেছে কুয়াশা। মুখে তার নিজের আবিষ্কৃত একটা মুখোশ। মুখোশের উপরিভাগে একটা টর্চের সামনেটার মত বস্তু আটকানো। একটা টর্চই ওটা। তবে আলো দেখা যায় না। এই টর্চের আলো দেখতে হলে চোখে পরতে হবে বিশেষ একটা চশমা। মুখোশের সাথে ফিট করা, রয়েছে নিজের আবিষ্কৃত চশমার কাঁচ দুটো। ফলে অন্ধকারেও পরিষ্কার সর্ব দেখতে পাচ্ছে কুয়াশা।
কুয়াশা এগোয়। পশুরা সব ছুটে পালায়। একটা জেব্রাকে ধরাশায়ী করে একটা বাঘ সবেমাত্র আহারে মনোযোগ দিয়েছে, হঠাৎ সেখানে দেখা গেল কুয়াশাকে। গর্জে উঠল বাঘ। আহারের সময় বিঘ্ন সৃষ্টি করে, এত সাহস কার? লাফ দিয়ে। কুয়াশার ঘাড়ে পড়তে গিয়েও থমকে গেল বাঘটা। বিকট গর্জনে চারদিকের বনভূমি
কুয়াশা ৪৮
১০৯
কাঁপিয়ে দিয়ে দিশেহারার মত লাফ দিল সে ঠিকই, কিন্তু কুয়াশার উপর নয়। চোখের পলকে কুয়াশার পথ ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল সে.। | চলার গতি বাড়িয়ে দিল কুয়াশা। আফ্রিকার জঙ্গলে তার পরিচিত কোন মানুষ বিপদে পড়েছে। ইণ্ডিকেটর যন্ত্র দেখে ব্যাপারটা টের পেয়েছে সে। মানুষটা যে কে, তা সে জানে না। তবে সুপরিচিত কেউ তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু মাত্র সুপরিচিত ব্যক্তিদের রক্তেই VNR-5 সামান্য পরিমাণে মিশিয়ে দিয়েছিল কুয়াশা । এটা যাদের শরীরের রক্তে থাকবে তারা যেখানেই থাকুক, কুয়াশার ইণ্ডিকেটর যন্ত্রে তাদের অবস্থান ধরা পড়বেই। পাঁচশো মাইলের মধ্যে এই পদ্ধতি কার্যকরী।
জঙ্গলের মাইল আড়াইয়ের মধ্যেই, পশ্চিম দিকে, সেই ব্যক্তি আছে। ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে স্পেসক্রাফটে থাকার সময়।
শহীদ ও মহুয়া, কামাল ও ডি. কস্টা এবং মি. সিম্পসনকে পৃথিবীর বিভিন্ন দুর্গম এলাকা থেকে উদ্ধার কুরে কুয়াশা তার স্পেসক্রাফটে চড়ে উড়ে যাচ্ছিল জঙ্গলের উপর দিয়ে রহস্যপুরীর দিকে।
রহস্যপুরী সত্যিই রহস্যপুরী। ভাবছে কুয়াশা। | এই রহস্যপুরীকে কেন্দ্র করে শতশত কিংবদন্তী প্রচলিত আফ্রিকার বিভিন্ন রাজ্যে। কিন্তু দুর্গম অরণ্যের কোথায় যে আছে রহস্যপুরী তা আজও কেউ জানতে পারেনি। সভ্য জগতের কোন মানুষ রহস্যপুরী দেখে ফিরে যেতে পারেনি।
একমাত্র ব্যতিক্রম আবিদ। ভাগ্যক্রমে আজও বেঁচে আছে সে। কিন্তু আবিদকে বন্দী করে রেখেছে প্রফেসর ওয়াই।
আবিদই সর্বপ্রথম রহস্যপুরী সম্পর্কে বাস্তব তথ্য দিতে সক্ষম হয়। রহস্যপুরী সত্যি আছে। নিজের চোখে দেখেছে সে। আফ্রিকার জঙ্গলে এক যুগেরও বেশি কাল ছিল সে। অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। কিশোর বয়সে ভাগ্যের তাড়া খেয়ে ঢাকা থেকে এই গহীন জঙ্গলে আশ্রয় নেয় আবিদ ও শ্বেতাঙ্গিনী লিজা। গরিলাদের সাথে বসবাস করে তারা। গড়ে তোলে আবিদ বিরাট গরিলাবাহিনী। সে এক দীর্ঘ কাহিনী ।*
| জংলী অসভ্যদের চল্লিশটা উপজাতি প্রতি দশ বছর অন্তর সদলবলে যাত্রা করে সেই রহস্যপুরীর উদ্দেশে। সাথে করে নিয়ে যায় সভ্য জগতের বন্দীদেরকে। রহস্যপুরীতে দেবতাদের বসবাস। দেবতাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য জংলীরা বলি দেয় বন্দীদের ধরে নিয়ে গিয়ে। সাথে করে নিয়ে যায় জংলীরা দশবছর ধরে সংগৃহীত স্বর্ণ, মূল্যবান পাথর এবং রূপা। এই সব মূল্যবান জিনিস তারা দেবতাদের আশীর্বাদ লাভের জন্য রেখে আসে রহস্যপুরীতে। প্রতি বছরই আসে কয়েকটা করে দল ।
জংলীরা এই নিয়ম পালন করে আসছে হাজার বছর ধরে। আজও সেই নিয়ম অটুট। * সেই চমকপ্রদ কাহিনী জানতে হলে পড়ুন কুয়াশা-৪৫
১১০
ভলিউম ১৬
জংলীজাতি ছাড়া সভ্য দুনিয়ার কোন লোক বা দল রহস্যপুরীতে প্রবেশের অনুমতি পায় না। তেমন কেউ যদি রহস্যপুরীতে প্রবেশ করে কখনও, সেইখানেই তার মৃত্যু। আজ পর্যন্ত রহস্যপুরীতে প্রবেশ করে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারেনি কেউ। | ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসী, উগাণ্ডার প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল ইদি আমিন, সউদী আরবের বাদশা সউদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিযাত্রী দল পাঠান। অভিযাত্রীরা সবাই আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত ছিল। কিন্তু অভিযাত্রীদের কেউই রহস্যপুরীর ধারে কাছেও পৌঁছুতে পারেনি।
আবিদ রহস্যপুরীর সঠিক অবস্থানের কথা জানে, এই খবর দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ফিল্ড মার্শাল ইদি আমিন আবিদকে উগাণ্ডার নাগরিকত্ব দান করেন এবং রহস্যপুরীতে অভিযান চালাবার জন্য একটি অভিযাত্রীদলের নেতা হিসেবে তাকে নির্বাচন করেন। কিন্তু আবিদকে কাম্পালা থেকে কিডন্যাপ করে গ্রেট ম্যাজিশিয়ান,
ওরফে প্রফেসর ওয়াই।
| প্রফেসর ওয়াইয়ের উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার। রহস্যপুরীতে হাজার হাজার বছর ধরে যে স্বর্ণের পাহাড় গড়ে উঠেছে তা হস্তগত করতে চায় সে।
স্বর্ণের সেই পাহাড়ের মালিক হতে চায় কুয়াশাও। তাই এই অভিযান।
জঙ্গলের উপর দিয়ে যাচ্ছিল কুয়াশার স্পেসক্রাফট। হঠাৎ ইণ্ডিকেটর যন্ত্রে নজর পড়ে। চমকে ওঠে কুয়াশা। বুঝতে পারে জঙ্গলের ভিতর তার পরিচিত কেউ আছে? মানুষটা যে-ই হোক, সে খুব বিপদে আছে। তার হার্টবিট স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত গতিতে কাজ করছে। স্পেসক্রাফট নামিয়ে ফেলে কুয়াশা। শহীদ, মি, সিম্পসন, কামাল, ডি, কস্টা, মহুয়া এবং আনতারার রাজকুমারী ওমেনাকে স্পেসক্রাফটে রেখে চলে এসেছে কুয়াশা কর্তব্যের খাতিরে। একঘণ্টার মধ্যে ফিরবে, শহীদকে জানিয়ে এসেছে সে। কিন্তু তা বোধহয় সম্ভব নয়। যে লোক এই
জঙ্গলে আছে সে ক্রমশ সরে যাচ্ছে দূরে।
| ইণ্ডিকেটরের রিডিং অনুযায়ী লোকটা আরও মাইল দুয়েক পশ্চিমে আছে। কিন্তু কুয়াশা যতই এগোচ্ছে, লোকটাও তত দূরে সরে যাচ্ছে। খানিক পর পর ঘড়ির সাথে ফিট করা ইণ্ডিকেটর যন্ত্রটা দেখে নিচ্ছে সে। সেই একই অবস্থা। দূরত্ব আগের মতই থাকছে, কমছে না।
ফাঁদ? প্রফেসর ওয়াই তার পরিচিত কাউকে বন্দী করে এই গহীনতম অরণ্যে নিয়ে এসেছে ফাঁদ পাতবার জন্য?
অসম্ভব নয়। বোমা মেরে প্রফেসরের ঢাকার কন্ট্রোলরুম সহ আটতলা উঁচু বাড়িটা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে এসেছে কুয়াশা। এত তাড়াতাড়ি প্রফেসর ভোলেনি সে-কথা নিশ্চয়ই। প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবে সে তাতে আর তাশ্চর্য কি!
*য় করে না কুয়াশা। অবাধ্য প্রফেসর যখন তখন তার ভয়ঙ্কর হিংস্র থাবা
কুয়াশা ৪৮
১১১
মারতে পারে কুয়াশাকে লক্ষ্য করে। কুয়াশা সেজন্যে সদা প্রস্তুত। অবাধ্য প্রফেসরের ভয়ে কর্তব্য পালনে পিছিয়ে যাবার কথা ভাবতেই পারে না সে। ফাঁদই যদি হয়, হোক। দেখা যাক ফাঁদে ফেলে প্রফেসর ওয়াই তার কোন ক্ষতি করতে পারে কিনা!
তবে এমনও তো হতে পারে এই ঘটনার সাথে প্রফেসর ওয়াইয়ের কোন সম্পর্কই নেই। তার পরিচিত লোকটি হয়তো ঘটনাচক্রে এসে পড়েছে কঙ্গোর এই অরণ্যে। বিপদে পড়েছে সে, তাই পালাচ্ছে। কিংবা জংলীদের হাতে বন্দী হয়েছে, জংলীরা তাকে নিয়ে যাচ্ছে ধরে নিজেদের গ্রামের দিকে।
ছোট একটা নালা পড়ল সামনে। দীর্ঘ লাফ দিয়ে নালাটা অতিক্রম করে স্যাৎ করে সরে গেল কুয়াশা। কালো একটা তিনুহাত লম্বা ফ্লাইং স্নেক কুয়াশার মাথার পাশ দিয়ে উড়ে গেল। আর একটু হলে বিষ দাঁত বসিয়ে দিত কুয়াশার কপালে।
ঘড়ি দেখল কুয়াশা। রাত আড়াইটা। হঠাৎ থামল সে। প্রায় একঘণ্টা কেটে গেছে। এই প্রথম দাঁড়াল কুয়াশা ।
রাতের জঙ্গল। চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার। ঝোঁপ-ঝাড় কেঁপে উঠছে। প্রকাণ্ডদেহী বাঘ, নেকড়ে আর হায়েনার দল লাফ দিয়ে সরে যাচ্ছে সামনের চলার পথ থেকে। কোন হিংস্র জন্তুই ‘আক্রমণ করেনি কুয়াশাকে এখনও। কেউ পিছু পিছু আসছেও না।
কুয়াশা জোরে শ্বাস গ্রহণ করল। ভুল হয়নি তার। একটা ঝঝাল টকটক গন্ধ নাকে ঢুকেছে বলেই দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। এ গন্ধ তার চেনা। আফ্রিকার জঙ্গলে এর আগে বহুবার অভিযান চালিয়েছে সে। এ গন্ধ চিনতে ভুল হবার কথা নয়।
অসভ্য জংলীরা বিভিন্ন উপজাতি, গোষ্ঠী, দল এবং উপদলে বিভক্ত। এদের আলাদা আলাদা নামও আছে। জুজু উপজাতির লোকসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের প্রিয় মদ হলো চুচুন। গন্ধটা যে চুচুনের তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কুয়াশা। ডান হাতে শক্ত করে ধরা মিনি লেজারগান। টর্চের মত দেখতে। বাঁ হাতে একটা স্প্রে মেশিন। কিছুক্ষণ পর পর বোতাম টিপে বিষাক্ত গ্যাস স্প্রে করে বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে সে। এই গ্যাস আবিষ্কারক সে নিজেই। বাঘ-ভালুক, সিংহ প্রভৃতি হিংস্র পশুরা এই গ্যাসের গন্ধ। সহ্য করতে পারে না। এর আগেই পরীক্ষা করে সুফল পেয়েছে কুয়াশা। ল্যাবরেটরিতে তিনমাস অক্লান্ত রিসার্চ করার পর এই গ্যাস আবিষ্কার করে সে। নাক দিয়ে এই গ্যাস ফুসফুসে প্রবেশ করার সাথে সাথে তীৰ জালা শুরু হয়ে যায়।
শরীরের ভেতর। আগুন জ্বলে ওঠে যেন পশুদের শরীরের রক্তে মাংসে।
অন্ধকার হলেও দিবালোকের মত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সব কুয়াশা। কোথাও কেউ নেই। কিন্তু চুচুনের গন্ধ তো আর মিথ্যে নয়। নিঃশব্দে। এগোল কুয়াশা।
হঠাৎ গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। বানরের মত গাছের ডালে বসে আছে জংলীটা।
১১২
ভলিউম ১৬
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে কুয়াশা। একজন নয়। অন্তত চারজনকে দেখতে পাচ্ছে সে চারটে গাছের ডালে।
চেহারা ইত্যাদি দেখেই কুয়াশা বুঝল এরা জুজু উপজাতির লোক। গরিলার মত প্রকাণ্ড শরীর। সারা গায়ে এবং মুখে লাল এবং সাদা রঙের লম্বা লম্বা ডোরা। মাথায় সাপের চামড়া জড়ানো। সেই চামড়ায় গোজা ঈগল পাখির পালক। সম্পূর্ণ উলঙ্গ ওরা। কোমরে বেল্টের মত বাঁধ গো-সাপের চামড়া। হাতে তীর-ধনুক। গাছের ডালে গেঁথে রেখেছে বর্শী।
ধনুকে তীর লাগিয়ে তৈরি হয়ে আছে জংলী চারজন । একটু অবাকই হলো কুয়াশা। জংলীদের মুখের চেহারায় ফুটে উঠেছে অধীর উত্তেজনা। অপেক্ষা করছে ওরা। কার জন্য?
কঙ্গোর জঙ্গলে এমন কি জংলীরাও গ্রাম ছেড়ে বেরোয় না রাতে। হিংস্র পশুদের হাতে প্রাণ হারাতে কে চায়। জংলীরাজের জরুরী আদেশ পেলে অবশ্য করার কিছু থাকে না কারও। কিন্তু জংলীরাজ কেনই বা এই রাতে তার প্রজাদের পাঠাবে জঙ্গলে? বিষাক্ত তীর নিয়ে কার জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা! তার জন্যে…কিন্তু সে এই পথে আসছে তা এরা জানল কিভাবে?
হঠাৎ খেয়াল হলো কুয়াশার, সময় নষ্ট হচ্ছে। পকেট থেকে নিঃশব্দে একটা পিস্তল বের করল সে। গাছের ডালে বসা জংলীরা কুয়াশাকে ছাড়িয়ে আরও দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনের গাছের জংলীর দিকে পিস্তল তাক করল কুয়াশা। ট্রিগারে আঙুল চেপে বসল ।
কোন শব্দ হলো না। জংলীটা তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে গেল । চিৎকার করার অবসরও পেল না সে। গাছের উঁচু ডাল থেকে চলে পড়ে গেল সে নিচে। নিঃসাড় হয়ে গেল দেহটা।
একে একে বাকি তিনজনেরও সেই একই অবস্থা হলো। কুয়াশা পিস্তল তুলে আঙুল দিয়ে ট্রিগারে টান মারতে লাগল, একটা করে জংলী জ্ঞান হারাতে লাগল।
দুজন আটকে রইল গাছের ডালেই। বাকি দুজন সশব্দে পড়ল মাটিতে। কুয়াশা অচেতন দেহগুলোর মাঝখান দিয়ে হন হন করে এগিয়ে যেতে শুরু করল আবার।
সব অস্ত্র কুয়াশার নিজের আবিষ্কৃত। খানিক আগে যে পিস্তল ব্যবহার করল সেটিও তাই। কুয়াশা স্বয়ং যেমন অভিনব বুদ্ধির অধিকারী, রহস্যে ভরা তার জীবন, তেমনি তার আবিষ্কৃত অস্ত্রগুলোও রহস্যময় এবং অভিব। দেখতে অস্ত্রটা পিস্তলের মত হলেও, এর ভিতর বুলেট নেই। বুলেটের পরিবর্তে এই পিস্তল থেকে ছুটে যায় ক্ষুদ্র একটা সুচ। সুচের আগায় মাখানো আছে ওষুধ। এই ওষুধ যার রক্তের সাথে মিশবে সে জ্ঞান হারাবে সাথে সাথে । ঘণ্টা দুয়েকের আগে সে জ্ঞান ফেরার আর কোন সম্ভাবনা নেই।
অজ্ঞান জংলীগুলোকে বাঘ ভালুক বা নেকড়ের দল যাতে হজম করে না ফেলে তার ব্যবস্থাও করে গেছে কুয়াশা। স্প্রে করে দিয়েছে সে চারপাশে স্ব আবিষ্কৃত গ্যাস। কয়েকটা ঘণ্টা কেউ এদিকে ঘেঁষতে পারবে না।
কুয়াশা ৪৮
১১৩
| পিস্তলটা পকেটে রেখে দিয়েছে কুয়াশা। হাতে লেজারগান। চলার গতি একটু মন্থর এখন। কপালে চিন্তার রেখা। জংলীদের ব্যাপারটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না সে।
কার নির্দেশে মাত্র চারজন জংলী তার জন্য বিষাক্ত তীর নিয়ে অপেক্ষা করছিল? খুঁত খুঁত করছে মন। প্রফেসর ওয়াইয়ের হাত আছে কি? কিন্তু প্রফেসর এমন কাঁচা কাজ করার চীজ নয়। সে জানে চারজন বা আটজন জংলী তার কোন ক্ষতিই করতে পারবে না।
| সাবধান হয়ে গেছে কুয়াশা। হয়তো ওই চারজন অগ্রবর্তী দলের ক্ষুদ্র অং মাত্র! সামনে বাকি সবাই তৈরি হয়ে আছে।
দাঁড়াল কুয়াশা। পকেট থেকে বের করল ইণ্ডিকেটর যন্ত্রটা। সর্বনাশ। দূরত্ব কমা তো দুরের কথা, আরও বেড়েছে। পরিচিত অথচ নাম-না জানালোকটা দূরে সরে গেছে আরও।
পকেটে ঢুকিয়ে রাখল কুয়াশা যন্ত্রটা। রাত তিনটে। কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল সে। বহু দূর থেকে ভেসে আসছে পশুদের গর্জন।
খটকা লাগল। স্থির দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে কি যেন শোনার চেষ্টা করল সে। পিছনে ফেলে আসা বনভূমির দিক থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত সব ধ্বনি। বাঘের ডাক, সিংহের গর্জন, নেকড়েদের সম্মিলিত কর্কশ ট্রাম্পেট সঙ্গীত। ব্যাপার কি! বনের পশুরা অমন ভয়ার্ত রবে হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি শুরু করেছে কেন?
| চিন্তিত হয়ে উঠল কুয়াশা। কি এমন ঘটতে পারে? পশুদের মধ্যে লড়াই শুরু হলেও এমন হবার কথা নয়। এ যেন বনের সব পশু পাখি একযোগে বিপদে পড়ে আর্ত রবে কাঁপিয়ে তুলছে দূরের বনাঞ্চল।
দাবাগ্নি? হতে পারে। একমাত্র চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়লেই পশুরা এমন অসহায় ভাবে চিৎকার জুড়ে দেয়। এর আগের অভিজ্ঞতা সে-কথাই বলে।
শহীদদের কথা ভেবে চিন্তা হলো কুয়াশার, পরমূহুর্তে প্রবোধ দিল নিজেকে–শহীদ জানে কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হয়। তাছাড়া স্পেসক্রাফট তো আছেই। বনভূমিতে আগুন লাগলে স্পেসক্রাফট নিয়ে উঠে যাবে ওরা শূন্যে।
পা বাড়াল আবার কুয়াশা। ফিরে যাবার কথা ভাবতেও রাজি নয় সে। একজন লোক বিপদে পড়ে আছে, তাকে উদ্ধার করতেই হবে।
আরও আধঘণ্টা অবিরাম হাঁটার পর কুয়াশা থামল। লক্ষণ ভাল নয়। জুজু উপজাতিরা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত দেখা যাচ্ছে। গভীর বনভূমির যতটা দেখা যায়, কেউ কোথাও নেই। কিন্তু সামনে গাছের ডালে ঝুলছে একটা নরকঙ্কাল। কঙ্কালের মাথাটা নিচের দিকে, পা দুটো গাছের ডালের সাথে বাঁধা। বড় অশুভ লক্ষণ। জুজুরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার পর এইভাবে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে নরকঙ্কাল, এটা তাদের একটা প্রাচীন রীতি।
খসখস করে উঠল ডানদিকের ঝোঁপঝাড়! লেজারগান তুলল কুয়াশা। থেমে গেল ঝোঁপটা আর নড়ছে না। শুকনো পাতা মাড়িয়ে কারা যেন এগিয়ে আসছে সামনের দিক থেকে।
১১৪
ভলিউম ১৬
এক মুহূর্ত পর ঝট করে পিছন দিকে তাকাল কুয়াশা। পাতা মাড়িয়ে পিছন থেকেও আসছে কারা যেন।
অথচ কাউকে এখনও দেখতে পাচ্ছে না কুয়াশা। সড়াৎ করে সরে গেল সে। বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে গেল একটা তীর।
মানুষ সমান উঁচু একটা ঝোঁপের ভিতর প্রবেশ করল কুয়াশা। বিপদ ঘিরে ধরেছে তাকে চারদিক থেকে। জুজু উপজাতির অসভ্যরা ফাঁদ পাততে ওস্তাদ। কুয়াশা বুঝতে পারছে ফাঁদের মাঝখানে আটকা পড়ে গেছে সে।
কোথাও কিছু নেই হঠাৎ বনভূমি থর থর করে কেঁপে উঠল ঢাক-ঢোল আর করতাল, জংলীদের বিকট চিৎকার আর উল্লাসধ্বনিতে।
তিন ঝোঁপ-ঝাড় আর গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল জংলীরা। জ্বলে উঠল তাদের হাতে বিশ-পঁচিশটা মশাল। লালচে আলোয় জেগে উঠল যেন বনভূমি। ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে চারদিক থেকে অসভ্যরা। নাচতে নাচতে, বাতাসে এলোপাতাড়ি হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে, বিকট চিৎকারে আনন্দ প্রকাশ করতে করতে ঝোঁপটার দিকে এগিয়ে আসছে সবাই।
মুখোশটা খুলে দ্রুত ভাজ করে পকেটে ভরে ফেলল কুয়াশা। হাতের লেজারগানটার দিকে তাকাল একবার। জংলীরা সংখ্যায় দুই থেকে আড়াইশোের কম হবে না। সকলের হাতেই বর্শা কিংবা তীর-ধনুক। লেজারগানের কাছে ওগুলো কোন অস্ত্রই নয়। কিন্তু কুয়াশার মাথায় তখন অন্য চিন্তা।
নরকঙ্কাল উল্টো করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছে জুজুরা। তারমানে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এরা। যুদ্ধে হয় এরা জিতবে, নয় হারবে। পিছপা হবার উপায় নেই, পালাবার কোন জায়গা নেই। যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালানো মানে রাজার হাতে খুন হওয়া।
হয় এরা কুয়াশাকে মারবে, নয়ত কুয়াশার হাতে খুন হবে। কুয়াশা ভাবছে অন্য কথা। এতগুলো নিরীহ অসভ্যকে হত্যা করতে চাইছে না সে। কে এদেরকে পাঠিয়েছে জানা নেই। যে পাঠিয়েছে তার উদ্দেশ্যও অজানা। রাজা যদি পাঠিয়ে থাকে কিন্তু জুজুদের রাজা তার আগমনের কথা টের পাবে কিভাবে? রাজাকে কি কেউ আগেভাগেই জানিয়েছে তার কথা? কে জানাতে পারে? রহস্যপুরীর উদ্দেশে কঙ্গোর এই বনভূমির উপর দিয়ে স্পেসক্রাফট নিয়ে যে সে উড়ে যাবে একথা একমাত্র প্রফেসর ওয়াইয়ের পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব। সেই কি জুজুদের রাজার সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে প্ররোচিত করেছে জংলীরাজকে এই নির্দেশ দিতে?
প্রফেসর ওয়াই এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে। এটা অনুমান করে নেয়া যায়। কিন্তু অবাধ্য প্রফেসরের ষড়যন্ত্রের শিকার সে হবে না। জুজু উপজাতির অসভ্যরা তাকে ঘিরে ফেলেছে ঠিক, কিন্তু যে-কোন মুহূর্তে সে পারে এই শ’দুয়েক জংলীকে লেজারগানের সাহায্যে বাতাসের সাথে মিশিয়ে দিতে। ওদের রক্ত-মাংস, হাড়
কুয়াশা ৪৮
১১৫
মজ্জা বাষ্প হয়ে এক নিমিষে উড়ে যাবে আকাশের দিকে। দুই বা আড়াইশো,
সংখ্যায় ওরা যতই হোক, একজনেরও চিহ্ন থাকবে না এই বনভূমিতে।
কিন্তু সেটা কি উচিত কাজ হবে?
এরা অসভ্য জংলী হলেও মানুষ তো। প্রফেসর ওয়াইয়ের অসৎ পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে জংলী রাজা তাকে বন্দী বা হত্যা করতে ওদেরকে পাঠিয়েছে। ওরা নির্দোষ। হুকুমের দাস মাত্র। ওদের প্রাণ কেড়ে নেয়া মানবিক কাজ হতে পারে না।
কিন্তু তাছাড়া উপায়ই বা কি? দ্রুত চিন্তা করছিল কুয়াশা। জংলীরা নৃত্যে মেতে উঠেছে। ঘিরে ফেলেছে তারা শত্রুকে। তার আর পালাবার কোন উপায় নেই। তাড়া কিসের, একটু নেচেগেয়ে আনন্দ করে নেয়া যাক না!
লেজারগানটা তুলল কুয়াশা। কিছু গাছপালা ধ্বংস করে দিয়ে দেখা যাক। চোখের সামনে থেকে আকাশে মাথা ঠেকিয়ে দণ্ডায়মান মহীরূহগুলো এক নিমেষে নেই হয়ে গেলে জংলীরা ভয় পাবে নিশ্চয়ই। ভয় পেয়ে পালাতেও পারে।
লেজারগানের বোতামে চাপ দিতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখোমুখি হলো কুয়াশা। ভোজবাজির মত কাণ্ড ঘটে গেল একটা। হাতের লেজারগান ধরে কেউ যেন হেঁচকা টান মারল। সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করতে গিয়েও পারল না কুয়াশা। ছুটে গেল হাত থেকে। তীরবেগে ঝোঁপের ভিতর থেকে ছুটে গেল সেটা। | অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কুয়াশী ঝোঁপের ভিতর থেকে বাইরের দিকে। লেজারগানটা কোন দিকে গেল বুঝতে পারল না সে।
প্রফেসর ওয়াই! জংলীদের সাথে সে-ও তাহলে উপস্থিত এখানে? প্রমাদ গুল কুয়াশা। পকেটে হাত ভরল সে। কিন্তু পরক্ষণে স্থির হয়ে গেল সেই হাত। খালি হাতটা পকেট থেকে বের করে আনল সে। প্রফেসর ওয়াইয়ের কাছে অদ্ভুত একটা চুম্বক দণ্ড আছে। রিসার্চ করে ওয়াকিং স্টিকের মত একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে সে। ভীষণ শক্তিশালী ম্যাগনেটিক পাওয়ার সেই যন্ত্রের। লোহা বা ইস্পাত: জাতীয় যে কোন জিনিসকে পাঁচশ গজ দূর থেকে আকর্ষণ করার শক্তি আছে এই ম্যাগনেটিক স্টিকের। পকেট থেকে অস্ত্র বের করার আর কোন মানে হয় না। সবই হাত থেকে
ছুটে চলে যাবে ম্যাগনেটিক স্টিকের কাছে।
| কিন্তু কোথায় প্রফেসর ওয়াই? দেখা যাচ্ছে না কেন তাকে? লুকিয়ে আছে?
না, অসম্ভব! লুকিয়ে থাকার মত ভীতু তো সে নয়। আর আত্মরক্ষার জন্য লুকিয়ে থাকলেও, মুখ বুজে থাকার স্বভাব তার নয়। এতক্ষণে অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে তোলার কথা তার চারদিক। নিদেন পক্ষে, নাতিদীর্ঘ একটা বক্তৃতা তো দান করতই।
তবে কি প্রফেসর স্বয়ং উপস্থিত নেই। ম্যাগনেটিক স্টিক জংলীদের হাতে তুলে দিয়েছে বুদ্ধি করে?
করার কিছু নেই। অসভ্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব নয়, তা চায়ও না সে। পরবর্তী কর্তব্য স্থির করে ফেলল কুয়াশা। ধরা দেবে সে। বন্দী হবে জংলীদের হাতে। জংলীরা যদি তাকে হত্যা করতে চায় শুধুমাত্র তখনই আত্মরক্ষার জন্য চেষ্টা
ভলিউম ১৬
করবে সে। বন্দী হলে লাভ বই লোকসান নেই। যে-কোন শাওন শ’ হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার মত বুদ্ধি ও সাহস তার আছে। এদা হলে ফোন ওয়াইয়ের কাছে নিশ্চয়ই নিয়ে যাওয়া হবে তাকে। ‘তাই সে 6ায়। পরে মুখোমুখি হলে তার পরবর্তী কর্মসূচী সম্পর্কে কিছু না কিছু জানা যাবে। জানা যাবে তার পরিচিত কোন ব্যক্তিকে সে ধরে নিয়ে এসেছে এই গভীর বনভূমিতে।
জংলীরা ঘিরে ফেলেছে ঝোঁপটা। প্রকাণ্ডদেহী, কুৎসিত দর্শন অসভ্যরা মশাণের লালচে আলোয় অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত-পা নেড়ে অবিরাম নাচছে।
একটা গাছের উপর নজর পড়ল কুয়াশার । একটা জংলী বসে আছে ডালের উপর। তার হাতে তীর নেই, ধনুক নেই। তীর-ধনুক-বর্শার বদলে তার হাতে দেখা যাচ্ছে একটা লম্বা ছড়ি।
ম্যাগনেটিক স্টিক।
ঝোঁপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল কুয়াশা। জংলীরা একযোগে উল্লাসধ্বনিতে ফেটে পড়ল। তীব্র বেগে ছুটে এল কয়েকটা তীর। কুয়াশার মাথার উপর দিয়ে বাতাসে শিস কেটে উড়ে গেল সেগুলো। পঞ্চাশ-ষাটজন অসভ্য বর্শা উঁচিয়ে ঘিরে ফেলল তাকে।
হাসছে কুয়াশার চেয়ে আছে সামনের গাছের উঁচু ডালের দিকে। হঠাৎ ভারি কণ্ঠে কথা বলে উঠল সে, কোচেন।
গাছের ডাল থেকে গরিলা সদৃশ্য জংলীটা গর্জে উঠল, কোচেন?
কুয়াশা হাসছে। বলে উঠল সে আবার, কোচেন, হিরি কিরি নাচা! নাচা, হিরি কিরি। পানচা, তিরি-রুকু সুকু হালাকু। লোচে ভে! লোচে ভে? হিরি কিরি-আশা, হিরি কিরি কুয়াশা। কোচেন!’
‘নাচা! নাচা! নাচা! আশা? কুয়াশা!
বাদুড়ের মত গাছের ডাল থেকে শূন্যে লাফ দিল জংলীদের সর্দার। ঝুপ করে শুকনো পাতার উপর পড়ল সে। ছুটল সাথে সাথে। জংলীরা সবাই নিশ্চুপ। চোখে মুখে বিস্ময় এবং উদ্বেগ! সর্দারকে পথ ছেড়ে দিল তারা। ছুটে এসে কুয়াশার বুকের উপর পড়ল কোচেন। কুয়াশার বিশাল বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে ছেলে মানুষের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। তার হাতে ম্যাগনেটিক স্টিক এবং লেসারগানটা কুয়াশার পায়ের কাছে পড়ে গেল।
কোচেনের গলা দিয়ে একটা মাত্র শব্দ বেরুচ্ছে, নাচা! নাচানাচানাচা!’
অর্থাৎ-বন্ধু। আশা–অর্থাৎ কুয়াশা। কোচেন-জংলী সর্দারের নাম। কুয়াশা, আজ বছর দশেক আগে এই বনভূমিতে একদল শ্বেতাঙ্গ শিকারীর হাত থেকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল কোচেনকে। কুয়াশার প্রতি সেই থেকে কৃতজ্ঞ সে। আজ দশ বছর পর রাজার নির্দেশে যাকে বন্দী করতে এসেছে সে তিনি যে স্বয়ং তার রক্ষাকর্তা তা সে
জানত না।
হাসছে কুয়াশা। কোচেনের ঘামে ভেজা পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
হয়েছে, কোচেন, হয়েছে। কাঁদবার কি হলো? তুমি কি জানতে নাকি যে আমি এই পথে আসছি? মুখ তোলো, কোচেন। তোমার কাছ থেকে অনেক কথা জানবার কুয়াশা ৪৮
১১৭
আছে আমার। হোচেন কেমন আছে। তোমার ছেলে? তোমার বউ, আজি? রাজা অমেনটোট?
| মুখ তুলল কোচেন। প্রকাণ্ড মুখ। কানের সর্বত্র ফুটো, ফুটোয় স্বর্ণের রিঙ ঝুলছে। কপালে চামড়ার পট্টি বাধা, মাথায় ধবধবে সাদা পাখির পালক গোজা । সারা শরীর এবং মুখে লাল-সাদা রঙ মাখানো।
‘সবাই মরে গেছে। রাজা দীর্ঘজীবী হোন,’ কোচেন নিজের ভাষায় কথা বলল।
সে কি! কিভাবে? ‘আজি গেছে রাজার মেয়ের সাথে লড়তে গিয়ে। হোচেন গেছে সিংহের পেটে। এসব কথা থাক, আশা। তোমার কথা বলে। তুমি কোত্থেকে এলে? কোথায় যাচ্ছ? তোমার বিরুদ্ধে আমাদের রাজা কেন এত খেপে গেছে? রাজার হাত থেকে বেঁচে ফিরবে কিভাবে তুমি?
কুয়াশা বলল, “কিছুই তো আমি জানি না। তোমাদের রাজা আমার কথা জানল কিভাবে?
কোচেন যা বলল তার সংক্ষিপ্ত মর্ম এই রকম–গত দুদিন থেকে ওদের রাজা অমেনটোট অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন করেছেন। অবিশ্বাস্য সব যাদু দেখাচ্ছেন তিনি। যাদুকররাও তাজ্জব হয়ে গেছে রাজার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে। কোত্থেকে কে জানে, নানারকম অস্ত্র পেয়েছেন তিনি। এক একটা অস্ত্রের এক এক রকম যাদু। কোন অস্ত্র একশো গজের দূরের মানুষ, গাছ, পশু বা যে-কোন জিনিসের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। যে-কোন জিনিসকে চোখের পলকে গায়েব করে দেবার মত ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রও আছে তার কাছে। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে রাজা অমেনটোট তাদেরকে জানিয়েছে, রহস্যপুরীর দেবতারা তাকে দেখা দিয়েছিল। সেই দেবতারাই দিয়ে গেছে এইসব ভয়ঙ্কর অস্ত্র। দেবতারা রাজাকে বলে গেছেন জঙ্গলের উত্তর দিকের হেলা পর্বতের গুহায় একজন লোককে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যাবে। তাকে ধরে এনে বলি দিতে হবে রহস্যপুরীতে নিয়ে গিয়ে। এরপর দেখা যাবে নদীর তীরে একদল সভ্য মানুষকে। তারাও ঐ লোকটার মত রহসপুরীর পবিত্রতা নষ্ট করে স্বর্ণ এবং দামী দামী পাথর চুরি করার জন্য এই জঙ্গলে এসেছে। তাদেরকেও বন্দী করতে হবে। বলি দিতে হবে রহস্যপুরীর ভিতর, দেবতা রোটেনহেপো হেমনোমান ক্যানক্যান-এর পদমূলে।
সবশেষে আসবে আর একজন লোক। তার কাছে থাকবে ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র । যেমন সে বুদ্ধিমান, তেমনি তার বীরোচিত সাহস। রাজা আসলে কুয়াশার কথাই বলতে চেয়েছে। সেই লোকও নাকি রহস্যপুরীর পবিত্রতা নষ্ট করতে চায়। তাকে রাজা স্বয়ং হত্যা করবেন গ্রামের ভিতর। দেবতাদের নির্দেশ নাকি সেই রকমই।
কুয়াশার প্রশ্নের উত্তরে কোচেন জানাল, ‘না, আশা গত দুদিনের মধ্যে কেন, গত একহপ্তার মধ্যেও কোন সভ্য বা অসভ্য লোক আমাদের গ্রামে আসেনি। তবে, হ্যাঁ, রাজা শিকারে বেরিয়েছিলেন বটে তিনদিন আগে। পথ হারিয়ে ফেলেন রাজা অমেনটোট এবং তার দশজন দেহরক্ষী। পরদিন অবশ্য গ্রামে ফেরেন তাঁরা। গ্রামে
১১৮
ভলিউম ১৬
ফেরার পর থেকেই যাদু দেখাতে শুরু করেন রাজা।
কুয়াশা গম্ভীর, চিন্তিত। কি ভাবছ, ‘আশা?
কুয়াশী বলল, কোচেন, কথাটা বললে তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না। তবু বলছি। আমার অনুমান এটা। অনুমান কখনও মিথ্যে হয় না আমার।
‘তুমি মন খুলে কথা বলো, ‘আশা। কোচেন অধীর হয়ে উঠল। কোচেন, আমার ধারণা রাজা অমেনটোট বিপদে পড়েছেন। “তারমানে!
কুয়াশা বলল, তোমরা এখন যাকে রাজী বলে মনে করছ সে হয়তো তোমাদের রাজা নয়। আমার ধারণা এই লোক প্রফেসর ওয়াই। তাকে তুমি চিনবে
। আমাদের দেশের একজন বিজ্ঞানী সে, ধরে নাও। কিন্তু মাথায় গোলমাল আছে। ভয়ানক লোক। তার উদ্দেশ্য খারাপ হয়তো নয়, কিন্তু সে যা-ই করে মানুষের তাতে মন্দ বই’ভাল হয় না। এই প্রফেসর ওয়াই আমার প্রাণের শত্রু। আমাকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। আমার বিশ্বাস, তোমাদের রাজাকে সে বন্দী করে আটকে রেখেছে কোথাও। রাজার ছদ্মবেশ নিয়ে সে তোমাদের কাছে এসেছে। তোমরা তার বা তার অনুচরদের ছদ্মবেশ ধরতে। পারনি।’
বোবা হয়ে গেল কোচেন। এসব কি শুনছে সে। দলের সকলের উদ্দেশে কোচেন কুয়াশার সন্দেহের কথা বলল। জংলীরা-প্রতিহিংসায় খেপে উঠল। কুয়াশার সন্দেহ সত্য বলেই মনে করে তারা।
কোচেনকে ভারি উৎকণ্ঠিত দেখাল। বলল, রাজা যদি বেঁচে থাকে এই জঙ্গলের কোথাও তাহলে তাকে আমরা ঠিকই খুঁজে বের করব। এই নকল রাজাকে খুন করে খেয়ে ফেলতে খুব একটা সমস্যা হবে না। কিন্তু সন্দেহের উপর নির্ভর করে তো কিছুই করা উচিত নয়, আশা।
কুয়াশা বলল, তা ঠিক। তাছাড়া, এই নকল রাজার বিরুদ্ধে লড়ে সহজে জয়ী হতে পারবে না তোমরা। ওর ক্ষমতা যেমন ভয়ঙ্কর, হৃদয় তেমনি দয়ামায়াহীন পাষাণের মতো। দরকার হলে শয়তানটা তোমাদের গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে যাবে, তোমাদের সবাইকে খুন করে রেখে চলে যাবে। সে ক্ষমতা ওর আছে।’
কোচেন বলল, সেটা আমাদের সমস্যা। কিভাবে এর সমাধান করা যায় পরে ভেবে দেখব। সবচেয়ে আগে চাই প্রমাণ। প্রমাণ পেতে হলে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের আসল রাজাকে। আশা, আমি তোমার কথা ভাবছি।
কুয়াশা হাসল। বলল, ‘দূর পাগল! নিজেকে কিভাবে রক্ষা করতে হয় আমি জানি।’
“জানি তা। কিন্তু, ‘আশা, গ্রামের দিকে যাওয়া চলবে না তোমার।
‘কেন? কুয়াশা ৪৮
১১৯
‘রাজার নির্দেশে তোমাকে বন্দী করার জন্য আমাদের এই দলটাই শুধু আসেনি। আরও দল ওত পেতে আছে জঙ্গলের ভিতর। ওরা আছে জানি, কিন্তু ঠিক কোথায় আছে, কিরকম ফাঁদ পেতে রেখেছে তা জানি না। রাজা একদলের কাজ স্নার একদলকে জানতে দেয়নি।
কিন্তু কোচেন, একটা কথা ভেবে দেখো। আমারই একজন লোককে বন্দী করে রেখেছে নকল রাজা তোমাদের গ্রামে।
কোচেন বলল, হ্যাঁ। ঘণ্টাখানেক আগে এই পথ দিয়েই একজন সভ্য মানুষকে আমাদের লোকেরা হেলা পর্বতের গুহা থেকে বন্দী করে নিয়ে গেছে গ্রামের দিকে।’
ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইল কুয়াশা, ‘লোকটার বর্ণনা দিতে পার?’ | কোচেন বর্ণনা দিল। ভুরু কুঁচকে উঠল কুয়াশার । সে সন্দেহ করেছিল লোকটা রাসেল হবে। প্রফেসর ওয়াই হয়তো ঢাকা থেকে বন্দী করে নিয়ে এসেছে তাকে ফাঁদ পাতার জন্য। কিন্তু, কোচেনের বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে রাসেল নয়, অন্য কেউ।
কুয়াশা বলল, “ঠিক চিনতে পারছি না। তবে সে যে আমারই পরিচিত কেউ তাতে সন্দেহ নেই। কোচেন, তুমি কি বলতে চাও আমি আমার একজন বন্ধু বিপদে আছে জেনেও প্রফেসর ওয়াইয়ের ভয়ে পালিয়ে যাব?’
| নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তোমাকে তাই করতে হবে।
কুয়াশা হেসে উঠল। বলল, আমাকে তুমি এখনও চিনতে পারোনি কোচেন। ফিরে আমি যাই না কখনও কাজ শেষ না করে। বন্ধুকে উদ্ধার করাই এখন আমার
একমাত্র কর্তব্য। মিছে বাধা দিয়ো না আমাকে।
অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে উঠল কোচেন। কি যেন চিন্তা করছে সে। কি ভাবছ?
কোচেন বলল, ‘বেশ। তোমার কথাই থাক। জানি, তোমাকে বললেও তুমি কথা শুনবে না। তবে, একটা অনুরোধ আছে। অনুরোধটা রাখতে হবে, আশা।
‘বলো।’
‘তুমি এখানেই থাকবে অন্তত আধঘন্টা। আমি দল নিয়ে ফিরে যাই। যাবার সময় গাছের গায়ে চিহ্ন রেখে যাব আমি। সেই চিহ্ন দেখে, আধঘণ্টা পর, তুমি এগোতে শুরু করবে। পথে কোথাও ফাঁদ থাকলে আমরা টের পাব। টের পেলে একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। যারা ফাঁদ পেতে আছে তাদেরকে হয় বোঝাব আসল ব্যাপার, কিংবা, তারা যদি বুঝতে না চায়, যুদ্ধ করব।
‘খবরদার, কোচেন। নিজেদের মধ্যে লড়াই করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমি তোমাকে নিষেধ করছি।’
“ঠিক আছে। লড়াই নয়। বোঝাব। যদি তারা না বোঝে? | না বুঝলে নাই বুঝল। তোমরা অপেক্ষা করবে। আধঘণ্টা পরই তো পৌঁছুব আমি। তখন দেখা যাবে কি করা যায়।
‘ঠিক। তবে সেই কথাই রইল। আমরা রওনা হই এখন। তুমি কিন্তু আধঘণ্টার আগে রওনা হবে না।’ ১২০
ভলিউম ১৬
কুয়াশা বলল, আচ্ছা। একটা কথা, কোচেন, ঘন্টাখানেক আগে পিছন থেকে পশুদের চিৎকার ভেসে আসছিল•••?’
আমাদের ওই রাজারই কাণ্ড প্রকাণ্ড একটা উড়োজাহাজ না কি যেন জঙ্গলের মধ্যে নেমেছে। তার ভিতর আছে সভ্য দুনিয়ার লোকজন। তাদেরকে পুড়িয়ে মারার জন্য রাজা একটা দল পাঠিয়েছিল। দলটা বিরাট একটা এলাকার চারদিকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
‘সর্বনাশ! উড়োজাহাজ নয়, কোচেন! ওটা আমারই স্পেসক্রাফট। ওতে আছে আমারই বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়!
কোচেন জানতে চাইল, তারা কি বুদ্ধিমান?’ কুয়াশা বলল, “খুব বুদ্ধিমান।
কোচেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন, যাক, তাহলে কোন চিন্তা নেই। রাজা বলেছিল, তারা যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে আগুনের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবে। তবে, রক্ষা পেলেও, তাদেরকে বিপদের মুখোমুখি হতে হবে আবার। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের লোকের হাতেই বন্দী হবে। বন্দী করে তাদেরকে নিয়ে আসা হবে গ্রামে। গ্রাম থেকে নিয়ে যাওয়া হবে রহস্যপুরীতে। সেখানে তাদেরকে বলি দেয়া হবে।
দ্রুত চিন্তা করছিল কুয়াশা। আগুনের হাত থেকে কিভাবে বাঁচবে শহীদরা? স্পেসক্রাফট যদি ধ্বংস করে দিয়ে থাকে প্রফেসর ওয়াই? | ছটফট করতে লাগল মন। কিন্তু এখন ফিরে যাবারও তো কোন অর্থ হয় না। আগুনের কাজ, আগুন সেরে ফেলেছে এতক্ষণ। ওরা কি সবাই পুড়ে মরেছে?
মনে হয় না। শহীদ, কামাল, মি. সিম্পসন, রাজকুমারী, ডি.কস্টা–একটা না একটা উপায় বের করে নিজেদেরকে নিশ্চয়ই রক্ষা করেছে ওরা।
“কি ভাবছ, আশা?’।
‘কিছু না। কোচেন, আর দেরি নয়। তোমরা রওনা হও। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। নকল রাজার কবল থেকে আমার পরিচিত লোকটাকে উদ্ধার করে ছুটতে হবে স্পেসক্রাফটের কাছে। খোঁজ নিতে হবে আর সব বন্ধু আর আত্মীয়দের।
কোচেন জড়িয়ে ধরল দুই হাতে কুয়াশাকে। কুয়াশার দুই গালে সশব্দে চুমু খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। চোখ দুটো জলে ভরে গেছে তার।
জংলীর দল নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়াল। দ্রুত রওনা হলো তারা গ্রামের দিকে । গ্রাম এখান থেকে আরও আড়াই মাইল দূরে।
মশালের আলো গাছপালার আড়ালে হারিয়ে গেল। মুখোশটা বের করল কুয়াশা। সেটা লাগিয়ে নিল মুখে। লেজারগানটা তুলে নিল সে মাটি থেকে।
আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে তাকে। কিন্তু সময় যে এগোচ্ছে না মোটেই! এক মিনিটকে মনে হচ্ছে একটা যুগ।
অস্থির হয়ে উঠল কুয়াশা। বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
কুয়াশা ৪৮
১২১
চার। গভীর বনভূমির ভিতর দিয়ে প্রায় ছুটে চলেছে কুয়াশা। কোচেন এই পথ দিয়ে যাবার সময় গাছের গায়ে চিহ্ন রেখে গেছে। দিকভ্রান্ত হবার কোন আশঙ্কা নেই। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে কুয়াশা।
আধঘণ্টা পর চিন্তিত দেখাল কুয়াশাকে। গাছের গায়ে আর চিহ্ন নেই। এদিক ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করল সে। সর্বশেষ যে গাছটায় বর্শার ধারাল ফলা দিয়ে কোচেন চিহ্ন এঁকে রেখে গেছে সেটি দেখে একটু ডানদিক ঘেষে এগোবার কথা কুয়াশার। কোচেনের চিহ্ন সেই নির্দেশই দিচ্ছে। কিন্তু ডান দিকে কেন, বাঁ দিকে এবং সামনে এগিয়েও কাছাকাছি গাছগুলোতে কোন রকম চিহ্ন দেখতে পেল না সে।
সন্দেহ নেই বিপদে পড়েছে কোচেন এবং তার দল। কিন্তু সংখ্যায় ওরা অনেক, এমন কি বিপদে পড়ল যে.••! বিপদ দেখলে এখানেই অপেক্ষা করার কথা ওদের। আড়াইশো লোককে কেউ বন্দী করে নিয়ে গেছে–ভাবা যায় না।
অন্ধকারের জন্য এতটুকু অসুবিধে হচ্ছে না কুয়াশার। মুখোশটা পরে নিয়েছে সে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সব। কই, কোথাও নেই কেউ।
বিস্মিত হলো কুয়াশা। কি করা উচিত চিন্তা করল কয়েক মুহূর্ত। হাতের লেজারগানটার দিকে তাকাল একবার। এটা বোধহয় ব্যবহার করার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
| পকেট থেকে ইণ্ডিকেটর যন্ত্রটা বের করল সে। দেখল, দূরত্ব কমেছে। যেই হোক জংলীদের গ্রামেই তার ঘনিষ্ঠ একজনকে ছদ্মবেশী প্রফেসর ওয়াই বন্দী করে রেখেছে। গ্রামটা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় আর।
বড়জোর মাইল দেড়েক হবে। কিন্তু এই দেড় মাইল অতিক্রম করা সম্ভব তো? নাকি তার আগেই প্রফেসর ওয়াইয়ের ফাঁদে ধরা পড়ে যেতে হবে? | প্রফেসর ওয়াই জানে, সে এই পথে যাচ্ছে। ফাঁদ সে ভালভাবেই পেতেছে। কুয়াশার হয়েছে উভয় সংকট। জানে যে সামনে বিপদ, কিন্তু তবু পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। বন্ধুকে চিনতে না পারলেও, বাঁচাতেই হবে তাকে প্রফেসরের কবল থেকে।
সতর্ক পায়ে এগোচ্ছে কুয়াশা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছে চারটা দিক। মন বলছে সামনেই বিপদ।
আরও কিছুদূর যাবার পর থামল কুয়াশী। একটা জংলীর নিঃসাড় দেহ ওর পায়ের কাছে। দেহটার সামনে বসার আগে চারটা দিক ভাল করে দেখে নিল সে। ধীরে ধীরে বসল। গায়ে হাত দিল লেকটার। পাল্স দেখল।
খানিক আগে খুন হয়েছে জংলীটা। শরীর এখনও গরম। একটা মাত্র ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। মাথার খুলি ফুটো করে বেরিয়ে গেছে ক্ষুদ্র আকারের একটা বুলেট ।
আশ্চর্য লাগল কুয়াশার। গুলির শব্দ শোনেনি সে। তারমানে সাইলেন্সর লাগানো রিভলভার দিয়ে কেউ গুলি করেছে। প্রফেসর ওয়াই? সম্ভবত। কিংবা
১২২
ভলিউম ১৬
ম্যাটাবর ম্যাটচেক মন্টোগোমারী। প্রফেসর ওয়াইয়ের ডান হাত।
জংলীর লাশটার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। আর সবাই কোথায়? এগোতে শুরু করল কুয়াশা। আস্তে আস্তে। চারটা দিক দেখতে দেখতে। ওই যে, লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছে জংলীরা। কিন্তু একি!
| থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। শয়তান! বিড় বিড় করে উচ্চারণ করল শব্দগুলো । শয়তান! বড় বেড়ে গেছ তুমি! নিরীহ জংলীগুলোকে তুমি ভ্যানিশিং রে ব্যবহার করে অমানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলেছ! আচ্ছা, দেখাব তোমাকে এর পরিণতি।
আরও কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। লাশের পর লাশ। কারও কোমরের নিচ থেকে নেই। নেই মানে একেবারেই নেই। কেউ যেন নিপুণ ভাবে কেটে নিয়েছে। কারও নেই কোমর থেকে উপরের অংশটা।
, বাতাসে কিসের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে যেন এখনও। সিধে হয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। গভীর, থমথুমে চেহারা। চিনতে পারল গন্ধটা। এদের যন্ত্রণাক্ত চিৎকার কেন শুনতে পায়নি সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। বাতাসে একটা রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করে ছড়িয়ে দিয়েছিল প্রফেসর ওয়াই বা তার সহকারীরা। | ভয়ঙ্কর জিনিস। প্রফেসর তরল পদার্থটার নাম দিয়েছিল জেড স্কয়ার কম্পাউণ্ড। এই কৃত্রিম গ্যাস কারও ফুসফুসে প্রবেশ করা মাত্র তার শরীরের মাংসপেশী অবশ হয়ে যায়। জংলীদেরও তাই হয়েছিল। মাংসপেশী অবশ হয়ে যাবার জন্যই চিৎকার করার সুযোগ হয়নি কারও। | শিউরে উঠল কুয়াশা। কী মর্মান্তিক দৃশ্য। লোকটা একটা বর্ণ মার্ডারার। জন্ম থেকেই খুনী প্রফেসর ওয়াই। | অধিকাংশ লাশই চেনবার উপায় নেই। শরীরের মাঝখান থেকে হয় নিচের অংশ নয়ত উপরের অংশ গায়েব করে দিয়েছে ভ্যানিশিং রে। কোচেনের লাশটা চিনতে পারল কুয়াশা। নিচের অংশটা নেই। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ঘাসের উপর। হাতের বর্শাটা ছাড়েনি কোচেন। সেটা শক্ত হাতে এখনও ধরে রেখেছে।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে কোচেনের লাশের কাছ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল কুয়াশা। সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রফেসর! এর একটা সমাধান না করলেই নয়।
ধীরে ধীরে হাঁটছে কুয়াশা! চোখ কান খোলা তার। হঠাৎ হেসে উঠল প্রফেসর ওয়াই।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!
কেঁপে উঠল উন্মাদ প্রফেসরের অট্টহাসিতে নিস্তব্ধ রাতের গহীনতম অরণ্য। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
লাফ দিয়ে সরে গেল কুয়াশা। একটা প্রকাণ্ড গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল সে। কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হাসির শব্দটা আসছে বাঁ দিক থেকে। তৈরি হলো কুয়াশা। এটাই হয়তো তার এবং প্রফেসর ওয়াইয়ের মধ্যেকার সর্বশেষ যুদ্ধ। দেখে শুনে মনে হচ্ছে প্রফেসর ওয়াই আজ তাকে হত্যা করার চরম সিদ্ধান্তই গ্রহণ কুয়াশা ৪৮
১২৩
করেছে।
ঠিক আছে। দেখা যাক যুদ্ধের ফলাফল কি হয়।
•• হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ•••!
কপালে চিন্তার রেখা ফুটল কুয়াশার। প্রফেসর কি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গেল? এ কেমন হাসি? থামবে না নাকি তার এই বিকট অট্টহাসি?
| সন্দেহটা আরও খানিক পর দৃঢ় হলো কুয়াশার মনে। হাসিটা প্রফেসরের কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সে কি বনভূমিতে সত্যি উপস্থিত? নাকি তার হাসি টেপ করে টেপ রেকর্ডারটা কেউ রেখে গেছে এই জঙ্গলে? | সবত তাই। কথা বলছে না প্রফেসর, শুধু হাসছে । জংলীদেরকে খুন করে কুয়াশাকে বোঝাবার চেষ্টা করছে, বিজয়ী হয়েছে সে। তাই এই অট্টহাসি।
গাছের আড়াল থেকে বেরুল কুয়াশা। অতি সতর্কতার সাথে পা ফেলছে সে। হাসির শব্দটা এখনও শোনা যাচ্ছে একইভাবে। বিরাম নেই, বিরতি নেই। আরও খানিকটা এগিয়ে থামল কুয়াশা। টেপ-রেকর্ডই। হাসিটা ভেসে আসছে গাছের ডালের সাথে বাধা একটা টেপ রেকর্ডার থেকে। গায়ে যেন আগুন ধরে গেল কুয়াশার। অসহ্য। দুকানে হাত চাপা দিয়ে অট্টহাসির কবল থেকে রক্ষা পেতে চাইছে মন। লেজারগানটা উপর দিকে তুলল কুয়াশা। বোতামে চাপ দিতেই ডালের খানিকটা অংশ নিয়ে বাষ্প হয়ে গেল টেপ রেকর্ডারটা।
থামল সেই অট্টহাসি। | এগোল কুয়াশা। পরমুহূর্তে ধরাশায়ী হলো সে। পায়ের নিচের মাটিতে বিছানো ছিল নমনীয় প্লাস্টিকের জাল? জালের উপর শুকনো পাতার বিছানা। তাই ফাঁদটা দেখতে পায়নি সে।
| মাটির উপর পড়লেও, হাতের লেসারগানটা ছাড়েনি কুয়াশা। জালের ভিতর আটকা পড়ে গেছে সে। হাত-পা ছুঁড়ে ছিঁড়তে চেষ্টা করছে কুয়াশা জালটা। পটু পটু করে শব্দ হচ্ছে। সাদা ধোয়া দেখা যাচ্ছে চারপাশে। দমবন্ধ করে ফেলল কুয়াশা। কিন্তু ততক্ষণ যা হবার হয়ে গেছে। বিষাক্ত ধোয়া ফুসফুসে প্রবেশ করেছে। খানিকটা। অবশ হয়ে আসছে কুয়াশার সর্বশরীর। লেজারগান ধরা হাতটা চাপা পড়েছে তার শরীরের নিচে। বের করার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু নড়াতে পারছে না দেহটা।
| মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ল কুয়াশা। | প্লাস্টিকের সুতোর সাথেই জালে ছিল কয়েকটা একই আকৃতির প্লাস্টিকের টিউব। টিউবগুলোর ভিতরে ছিল বিষাক্ত সাদা ধোঁয়ার মত গ্যাস। কুয়াশার হাত
পা ছোঁড়ার ফলে টিউবগুলো ছিঁড়ে গেছে।
কুয়াশা নড়াচড়া করছে না আর। চারদিক থেকে বেরিয়ে এল চল্লিশ পঞ্চাশ জন জুজু উপজাতির অসভ্য জংলী। জালে আবদ্ধ কুয়াশার অচেতন দেহটাকে ঘিরে দাঁড়াল তারা। পাঁচজন জংলী এল সবার শেষে। তাদের সাথে একটা খাঁটিয়া। খাঁটিয়ার উপর তোলা হলো কুয়াশার অচেতন দেহটাকে। দ্রুত অকুস্থল ত্যাগ করল
১২৪
ভলিউম ১৬
জংলীরা খাঁটিয়া কাঁধে তুলে নিয়ে ।
পঁচ স্পেসক্রাফটের কন্ট্রোলরূম থেকে শহীদ এবং রাজকুমারী ওমেনা ছুটে বেরিয়ে এসে ঘোষণা করল, মহাশূন্যযান বিকল হয়ে গেছে। এরপর শহীদ যা বলল তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য হলেও ব্যাপারটা বাস্তব সত্য।
কেউ শত্রুতা করে নষ্ট করে দিয়েছে স্পেসক্রাফট। শহীদ এবং ওমেনার বক্তব্য, ওদের মধ্যেই কেউ কাজটা করেছে।
কে? শহীদ, কামাল, মহুয়া, ডি কস্টা, মি. সিম্পসন, রাজকুমারী–এদের মধ্যে শত্রু কেউ নয়। অথচ এদের মধ্যে থেকেই কেউ কাজটা করেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ।
সকলের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। | কিন্তু এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় তখন নেই। বনভূমির চারদিকে জ্বলছে আগুন। আগুনের মাঝখানে অবস্থান করছে ওরা ছয়জন মানুষ। আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় ছিল স্পেসক্রাফটটা। সেটাও বিকল । তাই বলে চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। চেষ্টা করতে হবে।
এলুমিনিয়ামের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা নিচে। দাবাগ্নি ক্রমশ এগিয়ে আসছে। গাছপালায় আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। চারদিকের আকাশ হয়ে উঠেছে। লাল।
নিচে নেমে পরস্পরের দিকে বোবা দৃষ্টি মেলে তাকাতে লাগল সবাই। কারও মুখে কোন কথা নেই।
নীরবতা ভাঙল কামাল।
‘শহীদ, ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই। সেজন্যে চিন্তা বা ভয় করি না। তুই বলছিস, আমাদের মধ্যে কেউ বিশ্বাসঘাতক আছে, সেই নষ্ট করে দিয়েছে। স্পেসক্রাফট। অমি চাই, সে যেই হোক, এখুনি তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। নিজেদের মধ্যে একটা কেউটে সাপ আছে একথা জানার পর এই দাবাগ্নির কবল থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করার মত উৎসাহও হারিয়ে ফেলেছি আমি। কি লাভ? সেই বিশ্বাসঘাতক সুযোগ পেলে আবারও বেঈমানী করবে। আমরা মরি মরব, তাকে আগে খতম করে তারপর মরব।’
| শহীদ বলল, কামাল, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বিশ্বাসঘাতক একজন আছে সত্যি। কিন্তু তাকে তুই চিনবি কিভাবে? তাকে শাস্তি দেবার একটাই রাস্তা আছে এখন।
কি?
শহীদ বলল, “বিশ্বাসঘাতক আমরা যে-কেউ হতে পারি। এক কাজ কর, আগে আমাকে খুন করে ফেল। তারপর একে একে মহুয়া, মি. সিম্পসন, ডি. কস্টা, ওমেনা। কুয়াশা ৪৮
১২৫
ডি. কস্টা চেঁচিয়ে উঠল, “ফর গডস সেক! হামি কেন খুন হইটে যাইবো! হামি টো বিট্রে করি নাই, আপনাদের খোডার কসম বলিটেছি।’
চুপ করো!’
ধমকে উঠল শহীদ। বলল, ‘সবাইকে মেরে ফেল। তারপর আত্মহত্যা কর নিজে। তাহলেই বেঈমানের শাস্তি হয়েছে বলে ধরে নেয়া যাবে।’
মি. সিম্পসনকে অস্বাভাবিক গম্ভীর দেখাচ্ছে। বারবার তাকাচ্ছেন তিনি রাজকুমারী ওমেনার দিকে। মহুয়া এবং ডি কস্টাও আড়চোখে দেখছে ওমেনাকে।
রাজকুমারীকে কেউই ভাল করে চেনে না। কুয়াশার সাথে অন্য এক গ্রহ থেকে সে পৃথিবীতে এসেছে মাত্র কয়েক দিন আগে।
| শহীদ বলে উঠল, ‘বেঈমানের শাস্তি পরে দেয়া যাবে; কামাল। এখন আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হবে।’
হঠাৎ একদল নেকড়ে জঙ্গলের আড়াল থেকে তীর বেগে ছুটে আসছে দেখা গেল। খিচে দৌড় দিল ডি. কস্টা। মহুয়া লাফ দিয়ে পড়ল শহীদের বুকের উপর।
ঝড়ের রেগে নেকড়ের দল ওদেরকে পাশ কাটিয়ে ডি, কস্টার দুপাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল।
‘ওরা নিজেদের জান বাঁচাতে ছুটোছুটি করছে। ভয় পেয়ো না।
আসলেও তাই। অসভ্য জুংলীরা ছুটছে দিক-বিদিক। কেউ পশ্চিমে যাচ্ছে, কেউ পুবে, কেউ বা উত্তরে, কেউ বা দক্ষিণে। পথ পাচ্ছে না কেউ আগুনের ঘের থেকে বেরোবার । আগুনের বেড় চারদিকে। ক্রমশ সেটা ছোট হয়ে আসছে।
বনের পশু আর জংলীদের আর্ত রবে কানের পর্দা ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হলো। সবাই দিশেহারা। মৃত্যু প্রতি মুহূর্তে কাছাকাছি চলে আসছে।
এর নাম দাবাগ্নি। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। সে সে একটা শব্দ হচ্ছে চারদিক থেকে। আগুনের ডাক। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে দিতে এগিয়ে আসছে চারদিক থেকে সোঁ সোঁ করে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে।
শহীদ চেঁচিয়ে উঠল, কামাল, তুই পুব দিকে যা। দেখ কোন পথ পাওয়া যায় কি না। আমি পশ্চিমে যাই। মি. সিম্পসন আর. ডি. কস্টা এখানেই থাকুন। আমরা। না ফেরা অবধি কোথাও যাবেন না। আগুনের বাইরে বেরুনো সম্ভব নয়, তবু চেষ্টা করে দেখা যাক। কামাল, দেরি করবি না।
ছুটল কামাল পশ্চিম মুখো হয়ে।
শহীদও ছুটল। ওমেনা কি মনে করে পিছু নিল শহীদের। পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শহীদ। কি যেন জিজ্ঞেস করল ওমেনা। শহীদ গম্ভীর নিচু গলায় কিছু বলল তাকে।
| ফিরে এল ওমেনা। অস্বস্তি বোধ করছে সে। মি. মিস্পসন, মহুয়া, ডি, কস্টা–এরা তাকে সন্দেহ করছে।
গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে কামাল এবং শহীদ। ছটফট করছেন মি. সিম্পসন। ডি. কস্টা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেঁপাচ্ছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার
১২৬
ভলিউম ১৬
শরীর। কাঁদছে।
| মহুয়া যেন পাথর হয়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে জঙ্গলের দিকে।
ওদের চারধারে ছুটোছুটি করছে হিংস্র জানোয়ারগুলো। ওদের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না কেউ। যার-যার জান বাঁচাতে অস্থির সবাই।
একদল উলঙ্গ জংলী হঠাৎ বেরিয়ে এল। ভয়ে কাঁপছে তারা। অসহায় ভঙ্গিতে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল সবাই। তারপর শুয়ে পড়ল আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে। দুর্বোধ্য ভাষায় তারা কি সব বলতে লাগল।
. মি. সিম্পসন চেঁচিয়ে উঠলেন, আমাদের সাহায্য চেয়ে কোন লাভ নেই। অামরাই বাঁচার পথ দেখছি না। তোমাদের বাঁচাব কিভাবে? যাও, ভাগো।
জংলীরা মি. সিম্পসনের ভাষা না বুঝলেও তাঁর অগ্নিমূর্তি দেখে বুঝতে পারল–কোন আশা নেই এদের কাছে থেকে সাহায্য পাবার ।
পায়চারি করছেন মি. সিম্পসন। হঠাৎ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ডি. কস্টা। ছুটল সে।
কোথায় যাচ্ছেন!’ মহুয়া সংবিৎ ফিরে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল। ডি. কস্টা মহুয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটা উঁচু গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মি. সিম্পসন ডাকলেন, করছেন কি! আরে শুনুন!’
শুনল না ডি কস্টা। গাছের উপর চড়ছে সে। বেশ খানিকটা উপরে উঠে ডি, কস্টা বলল, ‘হাপনারাও ডেরি করিবেন না, ফর গডস সেক। একটা একটা করিয়া টল গাছ চয়েস করিয়া লিন, উঠিয়া পড়ুন সময় ঠাকিটে।
মি. সিম্পসন ঠোঁট বাঁকা করে হাসলেন, ‘পাগল।
ওমেনা চেঁচিয়ে উঠল, নেমে পড়ুন, মি. ডি. কস্টা। গাছের উপর চড়লে কি বাঁচবেন? আগুন তো গাছেই ধরবে।
‘ঢরিবে, ঠিক! বাট অনেক উঁচুটে ফায়ার নাও পৌঁছাইটে পারে। মিরাকেলি বাঁচিয়াও যাইটে পারি। চান্সটা হাপনারাও নিটে পারেন, যডি বাঁচিটে চান।
বড় দেরি করছে ওরা।
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। আমি বরং উত্তর দিকটা একবার দেখে আসি।’
কেউ আপত্তি প্রকাশ করল না। বিপদ তো একটাই, আগুন। তাছাড়া আর কোন বিপদ এখন নেই। সুতরাং মি. সিম্পসন না থাকলেও ভয়ের কিছু নেই।
দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলেন মি. সিম্পসন।
মহুয়া চেয়ে আছে যে-পথে শহীদ অদৃশ্য হয়ে গেছে বেশ খানিক আগে সেদিকে। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে ছাৎ করে উঠল বুক।
রাজকুমারী ওমেনা নেই। গেল কোথায় সে।
আরও প্রায় সাত মিনিট পর ফিরে এল কামাল। শুকনো মুখ। মহুয়ার পাশে নিঃশব্দে, নত মস্তকে এসে দাঁড়াল সে। হাঁপাচ্ছে হাপরের মত।
কামাল!’ মহুয়া অসহায় কণ্ঠে ডেকে উঠল। কুয়াশা ৪৮
মুখ তুলল না কামাল। কথা বলল না । ‘মি, সিম্পসন কই?’ শহীদের গলা শুনে ওরা দুজনেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। উত্তর দিকটা দেখতে গেছেন তিনি যদি কোন পথ পাওয়া যায় দেখার জন্য। ‘ওমেনা?’
মহুয়া বলল, কি জানি। হঠাৎ দেখি যে পাশে নেই। শহীদ, আমার সন্দেহ, •• |
সন্দেহের কথা থাক। কামাল?
কামাল মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘আগুনের বেড় থেকে বেরোবার কোন পথ নেই, শহীদ। খামকা আমরা চেষ্টা করছি।’
কথা বলল না শহীদ। হঠাৎ ছুটল ও উত্তর দিকে। ‘কোথায় যাচ্ছিস?
থমকে দাঁড়াল শহীদ। ঘুরে দাঁড়াল। বলল, আমার অনুমান কখনও মিথ্যে হয়।, কামাল আমার বিশ্বাস, একটা না একটা পথ আমরা পাবই। পথ আছে। কামাল, ডি কস্টা কোথায়?
মহুয়া উত্তর দিল উঁচু একটা গাছের দিকে আঙুল তুলে। ‘ওখানে কি করছেন আপনি!
ডি. কস্টা চেঁচিয়ে উত্তর দিল গাছটার মগ ডাল থেকে, ‘আমি বাঁচিটে চাই। টাই…।’
‘নেমে আসুন বলছি? ধমকে উঠল শহীদ। তাকাল কামালের দিকে, ওকে যেভাবে পারিস নামিয়ে আন। তোরা তিনজন মিলে স্পেসক্রাফট থেকে একে একে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো নিচে নামা। আমি আসছি খানিকক্ষণের মধ্যে। হয়তো দেরি করে ফেললাম।
কথাগুলো বলেই ছুটল শহীদ। অদৃশ্য হয়ে গেল সে। ধোয়া আর আগুনের আভায় টকটকে লাল হয়ে উঠেছে আকাশ।
ছুটতে ছুটতে থমকে দাঁড়াল শহীদ। কোথায় যাচ্ছে সে? কোন্ দিক গেছেন মি. সিম্পসন, কোন দিক গেছে ওমেনা জানা নেই, খামকা ছুটে লাভ কি?
কপালের ঘাম মুহুল শহীদ। বুকটা উঠছে নামছে ঘনঘন। পাগলের মত তাকাল সে চারদিকে। ওটা কি? এগিয়ে গেল শহীদ। টর্চের আলোয় চকচক করছে লাল স্কার্ফটা। ওমেনার মাথায় ছিল এটা।
আবার ছুটল শহীদ। এদিকেই এসেছে ওমেনা। হয়তো আরও খানিকটা সামনে গেলে তাকে পাওয়া যাবে।
“শহীদ ভাই!
চাপা কণ্ঠের ডাক শুনে থমকে দাঁড়াল শহীদ। বাঁ দিকের প্রকাণ্ড একটা গাছের কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমারী ওমেনা। ১২৮
ভলিউম ১৬
‘এখানে কি করছ তুমি?’ হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল শহীদ। আকাশের চেহারাটা দ্রুত দেখে নিল ও।
শহীদ ভাই, আপনার পায়ের জুতো কোথায়? দুটো পা-ই যে কেটে গেছে। ইস রক্তে ভেসে যাচ্ছে যে।
| ধমকে উঠল শহীদ, যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। কি করছিলে তুমি এখানে? মি. সিম্পসন কোথায়?
‘মি. সিম্পসনের পিছু পিছু তো এসেছি আমি। দূর থেকে দেখলাম তিনি এই খানটায় রয়েছেন। কিন্তু এখানে এসে দেখি নেই। কোথায়, কোন দিকে গেলেন বুঝতেই পারলাম না।’
শহীদ বলল, ‘হু।’ শহীদ চিৎকার করে ডাকল, “মি. সিম্পসন। মি. সিম্পসন! কোন সাড়া নেই মি. সিম্পসনের। তুমি ঠিক দেখেছ মি. সিম্পসনকে এখানে! ‘পরিষ্কার দেখেছি। এই মোটী গাছটার গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। একটা সাপ দেখে ভয়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম আমি। ইয়া বড় একটা অজগর, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে একেবারে আমার পায়ের কাছে চলে এসেছিল। ভয়ে লাফ দিয়ে সরে যাই। মিনিট দুয়েক পর, সাপটা অদৃশ্য হয়ে যেতে, এগিয়ে আসি আমি। কিন্তু তখন আর মি. সিম্পসনকে দেখতে পাইনি।
প্রকাণ্ড গাছটার আপাদমস্তকে চোখ বুলিয়ে নিল শহীদ। এই রকম অশখ গাছ বড় একটা দেখা যায় না। শত বছরের বেশি হবে এর বয়স। কাণ্ডটা অস্বাভাবিক মোটা। পাঁচজন লোক হাতে হাত ধরে দুই হাত দুদিকে প্রসারিত করে গাছটাকে জড়িয়ে ধরলেও বেড় পাবে না।
– ওমেনা হাঁ করে শহীদের কাণ্ড দেখছে। শহীদ গাছটার গায়ে রিভলভারের উল্টো পিঠ দিয়ে টোকা মারছে ঘুরে ঘুরে।
‘ও কি করছেন?
উত্তর দিল না শহীদ। খানিক পর নিরাশ হয়ে ওমেনার পাশে এসে দাঁড়াল ও। তাকিয়ে আছে সেই গাছের দিকেই।
একমুহূর্ত পর আবার পা বাড়াল শহীদ। চুপ করেই রইল ওমেনা। লালচে আলোয় বনভূমি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দ্রুত এগিয়ে আসছে দাবাগ্নি।
‘আমাকে সাহায্য করতে হবে, শহীদ বলল। এগিয়ে গেল ওমেনা, বলুন।
তোমার গায়ে তো খুব জোর। দুটো হাত গাছের গায়ে ঠেকিয়ে রাখো। আমি তোমার হাতের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে লাফ দিয়ে একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়ব। পারবে
তো আমার ভার সহ্য করতে!
খুব পারব। কিন্তু•••।’
যা বলছি করো। ৯-কুয়াশা ৪৮
১২৯
উঠে দাঁড়াল শহীদ ওমেনার দুই হাতের উপর। তারপর লাফ দিয়ে ধরল গাছের একটা ডাল। ঝুলতে ঝুলতে, শরীরটাকে দোলাতে শুরু করল শহীদ। তারপর কায়দা করে পা দুটো তুলে দিল ডালের উপর।
উঠে দাঁড়াল’ শহীদ ডালের উপর। আগুনের লাল আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
ওমেনা নিচে থেকে অবাক হয়ে দেখছে শহীদের কাণ্ড কারখানা।
গাছটা যেমন মোটা তেমনি মোটা তার ডালপালাগুলো । দুটো প্রধান শাখা দুদিকে বেঁকে গেছে মূল কাণ্ড থেকে বেরিয়ে। দুই শাখার ভিত্তিমূলে প্রশস্ত একটা জায়গা। শহীদ সেই প্রশস্ত জায়গাটার কাছে এসে দাঁড়াল। একটা শাখার গায়ে হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল ও। তারপর বসে পড়ল প্রশস্ত জায়গাটার উপর। বড় সুন্দর জায়গা। ইচ্ছা করলে একজন মানুষ স্বচ্ছন্দে শুয়ে বিশ্রাম নিতে বা রাত কাটাতে পারে এখানে।
উবু হয়ে বসে শহীদ প্রশস্ত জায়গাটায় রিভলভারের বাট দিয়ে টোকা মারল। ঢব ঢব–শব্দ শুনে বোঝা গেল ভিতরটা যেন ফঁপা।
উজ্জ্বল হয়ে উঠল শহীদের মুখ।
“কি করছেন আপনি? এদিকে আগুন যে একেবারে কাছে চলে এসেছে চারদিক থেকে।
চেঁচিয়ে উঠল নিচে থেকে ওমেনা। সাঁ সাঁ শব্দে এখন আর কান পাতা যাচ্ছে
জবাব দিল না শহীদ।
শহীদ গাছটার দুই প্রধান শাখার মধ্যবর্তী প্রশস্ত জায়গাটা গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করছে। কিন্তু আশার কোন আলো ফুটছে না তার মুখে। বোঝ; যাচ্ছে জায়গাটা ফাঁকা। বোঝা যাচ্ছে গাছের গা তুলে এখানে অন্য কাঠের গোপন দরজার কবাট ফিট করা হয়েছে। কিন্তু কবাট বা পাটাতন রাবার ব্যবস্থাটা কি জানা যাচ্ছে না। হঠাৎ চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ও, ইউরেকা!
“কি হলো? কি পেলেন?
জবাব দিল না শহীদ। প্রশস্ত জায়গাটায় নয়, একটি প্রধান শাখার গায়ে পাওয়া গেল একটা ইলেকট্রিক সুইচ। সুইচ অর্থাৎ বোতামটার রঙ গাছের রঙের সাথে মিলে গেছে। প্রশস্ত জায়গাটা থেকে একটা সরু ডালে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। তারপর হাত বাড়িয়ে আঙুল দিয়ে চেপে ধরল বোতামটা। মধ্যবর্তী স্থানটা থেকে সরে গেল কাঠের পাটাতন ঝুলে পড়ল সেটা সশব্দে নিচের দিকে।
ভিতরটা অন্ধকার। টর্চের আলো ফেলতেই একটা লোহার সিঁড়ি দেখা গেল। নেমে গেছে নিচের দিকে।
নেমে পড়ল শহীদ গাছের উপর থেকে। ‘এসো, হাঁটতে লাগল শহীদ হনহন করে। “কি দেখলেন! ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠলেন কেন তখন?
১৩০
ভলিউম ১
মি. সিম্পসন বাঁচিয়েছেন আমাদেরকে। ওই গাছটার উপরে গোপন একটা দরজা আছে। গাছের ভিতর দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে একটা। সম্ভবত মাটির নিচে দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে।
“ কিন্তু মি. সিম্পসন••?
মুচকি হাসল শহীদ। বলল, “হয়তো গোপন সুড়ঙ্গটা নিরাপদ কিনা পরীক্ষা করে দেখছেন তিনি।
নিরাপদ বলে মনে করলে তবে বুঝি আমাদেরকে খবর দেবেন।’
শহীদ বলল, ‘খবর দেবার আর দরকার নেই। আমরা নিজেরাই নামব ওই সুড়ঙ্গে।
স্পেসক্রাফটের কাছে ফিরে এসে ওরা দেখল মহুয়া সেই একই জায়গায় পাথরের মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কামাল পায়চারি করছে অধীর উত্তেজনা। দমন করতে না পেরে । এবং স্যানন ডি, কস্টা একটা কোদাল দিয়ে মাটি কাটছে।
ইতিমধ্যেই একটা বড়সড় গর্ত করে ফেলেছে সে। গর্তের চারধারে মাটির পাহাড় জমে গেছে। ডি. কস্টা গর্তের ভিতর দাঁড়িয়ে বিরামহীন, বিশ্রামহীন মাটি
কেটে চলেছে তখনও ।
আগুনের আঁচ লাগছে গায়ে। উড়ে আসছে ছোট ছোট কালো রঙের ছাই-ভস্ম বাতাসের সাথে। মহুয়ার শাড়ি প্রায় কালো হয়ে গেছে ছাই লেগে । কামালের কাপড় চোপড়েরও একই অবস্থা।
ওদেরকে ঘিরে চতুর্দিকে ছুটোছুটি করছে বুনো পশুরা, দিশেহারা ভাবটা আরও বেড়েছে, অবলা পশুদের কাতর ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপছে সারাক্ষণ।
মি. ডি. কস্টা, কি হচ্ছে শুনি?
ঘামে ভেজা মুখ তুলে তাকাল ডি, কস্টা, তারপর গর্তের ভিতরই সিধে হয়ে দাঁড়াল।
‘বিপড়ে পড়িলে মানুষ মানুষকে চিনিক্টে পারে। আপনারা যে ভীটুর ডিম ট্রা জানিটাম না। মাই গড, হোপ ছাড়িয়া ডিয়া ওয়ান অ্যাণ্ড অল বসিয়া আছেন। দিস। ইজ টু ব্যাড। ডেকুন হামাকে ডেকুন। ডেকিয়া অন্টট শিক্ষা লাভ করা উচিট । হামাকে ফলো করিলেও বাঁচিটে পারিবেন। আসুন, মি. শহীড, হামার সাঠে মাটি
কাটিয়ে একটা সুড়ঙ্গ টৈরি করুন••• |
হেসে ফেলল শহীদ। কি যেন বলতে যাচ্ছিল ও, কামাল এগিয়ে এসে ওর একটা হাত চেপে ধরুল শক্ত করে, শহীদ! তুই হাসছিস!
‘হাতটা ছেড়ে দে। ভেঙে ফেলবি নাকি! লজ্জা পেয়ে ছেড়ে দিল কামাল হাতটা। শহীদ বলল, “উত্তেজিত হোসনে। রাস্তা একটা পেয়েছি। ‘হোয়াট।
শহীদের কথাটা শুনেই গর্ত থেকে ক্যাঙ্গারুর মত লাফ দিয়ে উঠে এল ডি, কস্টা।
কুয়াশা ৪৮
১৩১
বলল, শেম শেম! গাধার মত পরিশ্রম করিলাম ফর ননা বেনিফিট? এই ডেকুন, ডুটো হাটেই ফোঁসকা পড়িয়া গিয়াছে।
ঠিকই। ডি. কস্টার দুই হাতেরই চামড়া ফুলে উঠেছে পানি নিয়ে। মহুয়া হঠাৎ বলে উঠল, ‘শহীদ, তুমি ঠাট্টা করছ না তো!’
শহীদ হাসল, ঠাট্টা করার সময় এটা নয়, মহুয়া। চলো সবাই। আর দেরি করা উচিত না।’
| ‘মি. সিম্পসন কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল মহুয়া।
কামাল বলে উঠল, ‘আরে তাইত। মি. সিম্পসন কোথায়?
শহীদ বলল তিনি সুড়ঙ্গে নেমে গেছেন। হয়তো সুড়ঙ্গটা নিরাপদ কিনা পরীক্ষা করে দেখছেন।
হয়তো। হয়তো মানে কি, শহীদ। একটু পরেই জানতে পারবি, কামাল। জিনিসপত্র কাঁধে তুলে নিয়ে দ্রুত রওনা হলো ওরা সেই অশথ গাছটার দিকে।
ছয়
লোহার সিঁড়িটা নেমে গেছে নিচের দিকে। সবার আগে নামল শহীদ। টর্চের আলোয় জায়গাটা দেখে নিল ও। একেবেঁকে চলে গেছে একটা সুড়ঙ্গ পশ্চিম দিকে। সুড়ঙ্গের দুই দিকের দেয়াল পাথরের। মাথার উপর সিলিং এবং মেঝেটাও তাই। ফাঁকা, নির্জন সুড়ঙ্গ।
‘নেমে এসো সবাই।’
কথাটা বলে শহীদ সুড়ঙ্গের দেয়ালে টর্চের আলো ফেলল। ছোট্ট একটা সুইচ বোর্ড দেখা যাচ্ছে। তাতে দুটো সুইচ। কিন্তু সেদিকে হাত বাড়াল শহীদ।
মহুয়া এবং ওমেনা নেমে এল নিচে। তারপর ডি. কস্টা। সবশেষে কামাল।
‘গোপন ডরজাটা বন্ট করিয়া ডিন। টা না হইলে ব্যাটা, আগুন নাক গলাইবে।’ ডি. কস্টা বলে উঠল।
খিলখিল করে হেসে উঠল মহুয়া তার কথা শুনে। নিরাপদ আশ্রয়ে এসে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সে। অবশ্য, সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে মাঝে-মধ্যেই তাকাচ্ছে সে রাজকুমারী ওমেনার দিকে। সাথে সাথে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠছে তার কপালে।
শহীদ ফিসফিস করে কথা বলছে কামালের সাথে।
আলো জ্বালা যায়। ইলেকট্রিসিটি আছে। কিন্তু আলো জ্বালতে চাই না আমি। আমি চাই তোরা আমার বেশ খানিকটা পিছনে থাক। আগে আগে আমি যাব।’
| ‘কিন্তু।
শহীদ বলল, ‘সামনে বিপদ থাকার কথাটা ভাবা দরকার, কামাল। সবাই একসাথে এগোলে শত্রুরা শব্দ পেয়ে সাবধান হয়ে যাবে। আমি তা চাই না? ১৩২
ভলিউম ১৬
| ‘তুই বলতে চাইছিস সুড়ঙ্গের সামনের দিকে শত্রুরা আমাদের জন্য ওত পেতে আছে?
‘ঠিক তা বলতে চাই না। তবে সন্দেহটা আমার সেই রকমই। ‘মি. সিম্পসন•••? শহীদ বলল, “তিনি হয়তো শত্রুদের হাতে ধরা পড়েছেন।
কামাল বলল, “। একটা কথা, শহীদ। তুই কিন্তু একটা কথা আমার কাছ থেকে লুকোচ্ছিস।’
কি কথা?
আমাদের মধ্যেই একজন বেঈমান আছে। তুই জানিস সে কে। কিন্তু তার নাম চেপে রেখেছিস। কেন?’
শহীদ বলল, আমি যাচ্ছি। তোরা দশমিনিট পর রওনা হবি। তোর প্রশ্নের উত্তরে শুধু একটা কথাই বলবার আছে আমার, কামাল। তা হলো, বেঈমান আমাদের মধ্যে যে-ই হোক, তার নাম বলার সময় এখনও আসেনি। সময় হোক, নিজের চোখেই সব দেখবি।’ | রিভলভার এবং টর্চ নিয়ে সুড়ঙ্গ ধরে হাঁটতে শুরু করল শহীদ। কামাল তার গমনপথের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
‘মি. কামাল, ডেরি করিটেছি ফর হোয়াট? বডি অ্যাণ্ড মাইণ্ডের উপর ডিয়া বজ্ঞই টরচার গিয়াছে। চলুন, ডেকা যাক, সামনে ভাল খানাপিনা এবং সফট বিছানার ব্যাবস্টা পাওয়া যায় কিনা!
| কামাল খেঁকিয়ে উঠল, থামুন! এতক্ষণ এই আশ্রয় না পেলে পুড়ে কয়লা হয়ে যেতেন, সে কথা মনে নেই বুঝি? কথায় বলে, বসতে পেলে শুতে চায়-আপনার হয়েছে সেই দশা।
‘ফর নাথিং। হাপনি চটিয়া উঠিটেছেন, মি. কামাল। হামি ইংরাজের, আই মীন, রাজার জাট। আপনারা টো বিপডের সময় হোপলেস হইয়া পড়িয়া চুপচাপ দাঁড়াইয়া ছিলেন। বাট হামি কট্টো কাজ করিলাম। আমি যডি এখন একটু ভাল । খানাপিনা আর নরম একটা বিছানা পাইটে চাই টাহা কি হামার ইললিগ্যাল ডিমাণ্ড বলিয়া আপনি মনে করিটে পারেন?
চুপ করুন! বিরক্তির সাথে বলে উঠল কামাল। কান পেতে কিছু শোনা যায় কিনা দেখছে সে।
ইটস নট ফেয়ার, বিড় বিড় করে বলল ডি. কস্টা। কামাল, কি শোেনার চেষ্টা করছ বলো তো তুমি? মহুয়া কামালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সে প্রশ্নটা করে।
টর্চটা কামালের হাতে। সুড়ঙ্গের যতদূর সম্ভব টর্চের আলো ফেলে সেদিকে তাকিয়ে আছে কামাল। প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য ঘাড় ফিরিয়ে পাশে দাঁড়ানো মহুয়ার দিকে তাকাল সে।
উত্তর দেয়া হলো না কামালের। সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে ভেসে এল রিভলভারের কুয়াশা ৪৮
১৩৩
শব্দ। ঠাস ঠাস করে পর পর দুটো গুলির শব্দ হলো!
মাই গড! ডাকাটের ডল আসিটেছে মনে হয়! মহুয়া কামালের একটা হাত চেপে ধরল, কামাল!
ওমেনা দম বন্ধ করে বলে উঠল, “এখানে দাঁড়িয়ে থাকার আর কোন মানে হয় না। মি. শহীদ হয়তো•••।’
অমঙ্গল আশঙ্কাটা পুরোপুরি উচ্চারণ না করলেও কারও বুঝতে বাকি রইল না কি বলতে চায় সে।
| কামাল বলল, হ্যাঁ। আর দেরি করার মানে হয় না। আমার পিছু পিছু এসো সবাই। খুব সাবধান! কেউ কথা বোলো না। পা টিপে টিপে হাঁটো সবাই, যেন শব্দ না হয়।’ | ‘ইয়েস’ ডম বণ্ড করিবার ডরকার নাই। টবে জোরে নিঃশ্বাস ফেলাটা উচিট হইবে না।
নিঃশব্দে এগোল ওরা ।
এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে সুড়ঙ্গটা। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছে শহীদ। সামনে পিছে আলকাতরার মত কালো অন্ধকার। নিজের শরীরও দেখা যায় না। খানিকটা কবে এগোয় শহীদ, একবার করে থামে। তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে ওর শ্রবণেন্দ্রিয়। কোথাও কোন শব্দ নেই। তবু সন্দেহ ঘোচে না মন থেকে। দাঁড়িয়েই থাকে ও।
একসময় একবার এগোতে শুরু করে শহীদ। টর্চটা ওর হাতেই ধরা। কিন্তু সেটা ভুলেও জ্বালে না। ডান হাতে শক্ত করে ধরা লোডেড রিভলভারটা। যে কোন মুহূর্তে ব্যবহার করার জন্য তৈরি হয়েই আছে ও। ওর মন বলছে, অচিরেই রিভলভারটা ব্যবহার করার দরকার পড়বে।
ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। অক্সিজেনের পরিমাণ কম সুড়ঙ্গের ভিতর। সারা শরীর ভিজে গেছে ঘামে। বেরুবার পথ নিশ্চয়ই আছে ভাবল ও। কিন্তু পথটা বন্ধ কিনা
কে জানে। | এগোতে এগোতে অনেক কথা ভিড় করে আসছে মনে। কুয়াশা কি সত্যি প্রফেসরের ফাঁদে আটকা পড়েছে? কিন্তু সব চিন্তাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে গহীদ নির্মমভাবে। চিন্তা করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন চিন্তা করবার সময় নয়। এখন সমস্যা সমাধানের, সমস্যার জড় উপড়ে ফেলার সময়।
কপালের ঘাম মুছে নিল শহীদ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে। সরিয়ে দিল চুলগুলো কপাল থেকে। সামনের অন্ধকারে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল আবার।
দু’পা এগোতেই হাতে ঠেকল দেয়াল। সর্বনাশ! এ যে শক্ত কাঠের প্রকাণ্ড দরজা।
দরজাটার গায়ে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করে নিরাশ হলো শহীদ। এদিক থেকে দরজা খোলা বা বন্ধ করার কোন ব্যবস্থা নেই। দেয়ালে কোন ইলেকট্রিক সুইচ
১৩৪
ভলিউম ১৬
আছে কিনা দেখার জন্য হাত বাড়াতেই বাঁ দিকটা ফাঁকা ঠেকল। হাত দিয়ে অন্ধের মত হাতড়াতে লাগল ও। আরও একটা দরজা, বোঝা যাচ্ছে। ভরে উঠল বুক আশায়। এ দরজাটা খোলা।
হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল শহীদের সর্বশরীর। একটা পদধ্বনি এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে খোলা দরজাটার ভিতর দিক থেকে।
নিশ্চল গাছের মত অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল শহীদ। এগিয়ে আসছে দ্রুত। পদশব্দ। যেই হোক লোকটা, ভয়ানক ব্যস্ত সে, কিংবা ভয় পেয়েছে কোন কারণে।
পদশব্দ একেবারে কাছে এসে পড়েছে। শহীদ প্রশ্ন করল, “মি. সিম্পসন? কোন জবাব এল না।
পরমুহূর্তে গর্জে উঠল একটা রিভলভার। পরপর দুবার বারুদের গন্ধ এবং ধোয়ায় ভরে উঠল জায়গাটা।
কামাল হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল সে, ‘মি. ডি. কস্টা, ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। বিড় বিড় করে কথা বলছেন কেন শুনি?
কে? তোরা এসেছিস?’ শহীদের গলা শোনা গেল। জ্বলে উঠল কামালের হাতের টর্চ। আঁতকে উঠল ওরা সবাই।
শহীদ দাঁড়িয়ে আছে। একা। ওর সামনে এবং ডান দিকে দুটো দরজা। ডান দিকেরটা বন্ধ। বা দিকের দরজার চৌকাঠের উপর রক্তাক্ত একটা লাশ পড়ে আছে।
‘শহীদ।’ কামাল চেঁচিয়ে উঠল।
‘মাই গড! হামি স্বপ্ন ডেকিটেছি! হামার জাট ভাই মি. সিম্পসন মার্ডার হইয়াছেন–মাই গড! ই, কে, কে টাহাকে হট্টা করিয়াছে, মি. শহীড! জাট ভাইয়ের ব্লাড বৃঠা যাইটে ডিবো না, হামি বডলা লইব।
| ডি, কস্টার দু’চোখে পানি জমে উঠল।
শহীদ কামালের দিকে তাকাল, ‘তোর প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিস এবার, আশা। করি?
‘কিন্তু, শহীদ…মি. সিম্পসন বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন আমাদের সাথে। অসম্ভব।’ | মহুয়াও প্রবলভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, হতেই পারে না! মি. সিম্পসন–অসম্ভব! শহীদ, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? এ কি কাণ্ড
করেছ!’
শহীদ হেসে উঠল। বলল, ‘মাথা আমার ঠিকই আছে, মহুয়া। তবে তোমাদের ধারণাও সেন্ট পারসেন্ট ঠিক। মি. সিম্পসন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না আমাদের সাথে। তিনি তা করেননি। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছিস, কুয়াশী ৪৮
১৩৫
কামাল?
‘বলতে চাইছিস..বলতে চাইছিস, মি. সিম্পসন বিশ্বাসঘাতকতা করেননি..তারমানে…তারমানে, বুঝেছি! শহীদ, তোর কথা বুঝে ফেলেছি আমি।’ চেঁচিয়ে উঠল কামাল।
“কি বুঝেছিস।
শমাল বলে উঠল, ‘তুই বলতে চাইছিস, যে লোককে আমরা দেখছি সে মি. সিম্পসনের মত দেখতে হলেও আসলে তা নয়!
‘হ্যাঁ। মি. সিম্পসমের ছদ্মবেশে এ অন্য লোক। ‘অন্য নোক! কি বলছ তুমি। মহুয়ার গলায় বিস্ময়।
শহীদ বলল, “ছদ্মবেশটা সত্যি খুব নিখুঁত হয়েছিল। বুঝতে পারছ না, কুয়াশা। পর্যন্ত সন্দেহ করতে পারেনি?
অন্য নোক বুঝলাম। কিন্তু কে? এর পরিচয় কি? আর, মি. সিম্পসন-তিনি কোথায়?’
শহীদ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “ওরে বাপ! এক সাথে এতগুলো প্রশ্ন! দাঁড়া একটা একটা করে উত্তর দেবার চেষ্টা করি।’
সবাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শহীদের দিকে। বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকাল শহীদ। বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত হচ্ছে না। খোলা দরজাটা দিয়ে একটু ভিতরে যাই চল। বসে বসে সব কথা বলা যাবে।
লাশটা টপকে ভিতরে ঢুকল ডি. কস্টা, কামাল।
আমি লাশ টপকাব না।’
দেয়ালের দিকে চোখ রেখে প্রতিবাদ করল মহুয়া। শহীদ লাশটা ধরে সরিয়ে দিল এক পাশে। বলল, হয়েছে এবার?
সুড়ঙ্গ ধরে সবাই খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বসল দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।
“মি. সিম্পসনকে প্রফেসর ওয়াই গ্রীনল্যান্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিল তার ম্যাটার ট্রান্সমিট করার মেশিনের মাধ্যমে, একথা আমরা সবাই জানি।
‘জানি।’
শহীদ বলল, “শুধু মি. সিম্পসনকে কেন, আমাদের সবাইকে পৃথিবী এবং পৃথিবীর বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। পৃথিবীর বাইরে পাঠিয়েছিল কুয়াশাকে। প্রফেসর ভেবেছিল কুয়াশা পৃথিবীতে ফেরত আসতে পারবে না আর কোন দিন। কিন্তু কুয়াশা: টুইন আর্থ থেকে বহাল তবিয়তে ফিরে আসল এবং প্রফেসর ওয়াইয়ের ঢাকার কন্ট্রোলরূম বোমা মেরে ধ্বংস করে দিল।
‘এসব কথা তুই নতুন করে বলছিস কেন? সবই তো আমাদের জানা।
‘সব কথা না বললে তোর প্রশ্নের উত্তর ঠিক দেয়া সম্ভব নয়। শোন, যা বলছিলাম। বোমা মেরে কন্ট্রোলরূম কুয়াশা ঠিকই ধ্বংস করে দেয়, কিন্তু প্রফেসর ওয়াই বা তার সহকারীরা ঠিকই বেঁচে যায়। প্রফেসর ওয়াই বোমার হাত থেকে ১৩৬
ভলিউম ১৬
বেঁচে যাবার পর কুয়াশাকে কাবু করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। কুয়াশার স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে ভাল ধারণা আছে তার। সে বুঝতে পারে এরপর কুয়াশা আমাদেরকে উদ্ধার করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে। প্রফেসর ওয়াই মাথা খাঁটিয়ে সাথে পথে একটা বুদ্ধি বের করে। কুয়াশা মি. সিম্পসনকে উদ্ধার করার জন্যে। গ্রীনল্যাভে যাবে তা সে বুঝতে পারে। কিন্তু কুয়াশা গ্রীনল্যাণ্ডে পৌঁছবার আগেই সে মি. সিম্পসনের ছদ্মবেশে একজন সহকারীকে সেখানে পাঠায়। এবং তার সাথে স্বয়ং নিজেও গ্রীনল্যান্ডে গিয়ে উপস্থিত হয়।
“নিশ্চয়ই সে তার ম্যাটার ট্রান্সমিট করার মেশিন ব্যবহার করে?
শহীদ বলল, “তা তো নিশ্চয়ই। মি, সিম্পসনের ছদ্মবেশধারী সহকারীকে গ্রীনল্যাণ্ডে রেখে প্রফেসর ওয়াই আমাদের প্রকৃত মি: সিম্পসনকে বন্দী করে নিয়ে। আসে। আমার বিশ্বাস, মি. সিম্পসন এই বনভুমিতেই প্রফেসরের হাতে বন্দী হয়ে আছেন। এবং সেজন্যেই কুয়াশা তার ইণ্ডিকেটার যন্ত্র দেখে বুঝতে পারে তার পরিচিত জনের মধ্যে কেউ এখানে আছে। এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে প্রফেসর ওয়াই। আমাদের দলে নিজের লোককে তো সে ঢুকিয়ে দিয়েই ছিল, মি. সিম্পসনকে বন্দী করে কুয়াশার জন্যে পেতেছে সে মস্ত একটা ফাঁদ।
| দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মহুয়া জানতে চাইল, ‘দাদা তাহলে সত্যি খুব বিপদে। আছে?
| শহীদ বলল, “বিপদে সে নিশ্চয়ই পড়েছে। তবে চিন্তার কিছু নেই। বিপদের। মোকাবিলা করার মত বুদ্ধি বা শক্তি, কোনটারই অভাব নেই তার। কিন্তু আমাদের উচিত তার খোঁজ খবর সংগ্রহ করা। ‘
কামাল বলল, এই সুড়ঙ্গ থেকে বেরুবার উপায় কি?’
শহীদ বলল, ‘উপায় একটা বের করতেই হবে। সুড়ঙ্গের এদিকটা ক্রমশ ঢালু হয়ে গেছে, লক্ষ্য করেছিস?’
করেছি।’
‘এই পথ ধরে গিয়েছিলাম আমি। বেরুবার কোন উপায় নেই। নদীর সাথে গিয়ে মিশেছে সুড়ঙ্গটা।
‘তাহলে উপায়?’ শহীদ উত্তর না দিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল এদিক ওদিক।
নাক ডাকছে কার? কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?’
চাপা কণ্ঠে হেসে উঠল মহুয়া। বলল, হ্যাঁ। মি, ডি. কস্টা। আমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। “ শহীদ বলল, কামাল, উপায় একটাই, বুঝলি? গ্রেনেডগুলো আনতে ভুলিসনি তো?’
ভুলিনি।’
শহীদ বলল, “দে একটা। গ্রেনেড মেরে ভেঙে ফেলতে হবে বন্ধ দরজাটা। ধাক্কা দিয়ে বা আর কিছু করে কোন লাভ নেই। উড়িয়ে দিতে হবে গ্রেনেড মেরে।’
কামাল জানতে চাইল, দরজার ওপাশেও কি আবার সুড়ঙ্গ আছে বলে মনে করিস? কুয়াশা ৪৮
১৩৭
‘সম্ভবত আছে। কিন্তু এই সুড়ঙ্গের শেষ কোথায়?
শহীদ হাসল, ‘শেষ কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আছে। ব্যস্ত হচ্ছিস কেন, ধৈর্য ধর।’
ভোরবেলা সুড়ঙ্গ থেকে বেরুবার পথ পেয়ে গেল ওরা। সুড়ঙ্গটা যেখানে শেষ সেখানে একটা লোহার সিঁড়ি। দেয়ালের গায়ে একটা সুইচ বোর্ডও দেখা গেল। সাদা সুইচটা আঙুল দিয়ে চেপে ধরতেই কাঠের পাটাতন ঝুলে পড়ল। উপরে দেখা গেল গাছের ডালপালা, মিন আকাশ। | সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখল একটা গাছের উপর দাঁড়িয়ে আছে সবাই ওরা। গাছের উপর থেকেই দেখা যাচ্ছে নদীটাকে। চারদিকে কেউ কোথাও নেই। ঠাণ্ডা শীতল বাতাসে গা জুড়িয়ে গেল ওদের।
গাছের উপর থেকে নেমে পড়ল সবাই। ওমেনা কারও সাহায্য নিল না, বরং সাহায্য করল মহুয়াকে নামতে নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়াল ওরা ।
হোয়াট অ্যাবাউট ব্রেকফাস্ট?’ জিজ্ঞেস করল ডি. কস্টা।
কামাল বলল, “চারদিকটা একবার ভাল করে দেখে আসা দরকার । জংলীদের গ্রাম কাছেপিঠে থাকা বিচিত্র নয়। সেক্ষেত্রে ওদের পেটেই চালান হয়ে যাব সবাই ব্রেকফাস্ট হয়ে।
দাঁত বের করে আপন মনে হাসতে শুরু করল ডি কস্টা। ‘হাসছেন যে বড়?
ডি. কস্টা বলল, হাসিটেছি নাকি? হইটে পারে, একটা কঠা মনে পড়িয়া গেল, টাই।’
“কি কথা আবার মনে পড়ে গেল?’
“গটবার যখন আফ্রিকার এই জঙ্গলে অ্যাডভেঞ্চারে আসিয়াছিলাম, জংলী লেডিসরা হামাকে ডেকিয়া ওয়ান অ্যান্ড অল হামার প্রেমে পড়িয়া হাবুডুবু খাইটে লাগিল ।
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি লুকিয়ে মহুয়া বলল, তারপর?
‘টারপর আর কি করিব বলুন! ওদের টেরোজন, না, সটের জন, ঠিক মনে করিটে পারিটেছি না। বিবাহ করিয়া ফেলিলাম…।
| ‘কামাল, এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কিন্তু উচিত হচ্ছে না।’ শহীদ বলে উঠল ।
| কামাল নদীর দিকে তাকিয়েছিল । বেশ যোত নদীর পানিতে। দুধারেই গভীর জঙ্গল। হঠাৎ কয়েকটা ভেলার দিকে চোখ পড়ল ওর। নদীর তীর ঘেষে ভাসছে, ঢেউয়ের তালে তালে মৃদু দুলছে ভেলাগুলো।
শহীদ।
শহীদ বলল, দেখেছি। ভেলাগুলোই প্রমাণ দিচ্ছে আশেপাশে জংলীদের গ্রাম
১৩৮
ভলিউম ১৬
আছে।’
‘এখন কি করতে চাস তুই? কুয়াশার সন্ধানে যাবি?
শহীদ বলল, “তাই যাওয়া উচিত আমাদের। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কুয়াশা কোথায় আছে সে সম্পর্কে কতটুকু ধারণা করতে পারি আমরা?
কামাল বলল, কেন, কুয়াশা পশ্চিম দিকে গেছে আমবও পশ্চিম দিকে এসেছি।’ | ‘প্রশ্ন হলো, কুয়াশা কতটা দূরত্ব অতিক্রম করেছে। আর আমরা কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছি? আমরা আরও পশ্চিমে যাব, না, পিছু হটব, অর্থাৎ পুবে যাব আবার?
‘সমস্যাই বটে।
শহীদ বলল, আমার যতদূর ধারণা, কুয়াশার চেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলেছি আমরা। সুড়ঙ্গটা মোটেই ছোট নয়, মাইল তিনেক তো লম্বায় হবেই।’
কামাল বলে উঠল, “যাই বলিস শহীদ। এইরকম একটা সুড়ঙ্গ আফ্রিকার জঙ্গলে ভাবাই যায় না। কাদের কীর্তি বল তো এটা?’
শহীদ বলল, ‘বলৈছি তো একবার, আরও অনেক মজার জিনিস দেখতে পাবি। রহসপুরীর কাছাকাছিও তো আসিনি এখনও।
কামাল বলল, ‘রহস্যপুরী সম্ভবত এখান থেকে খুব বেশি দূরেও নয়। বড়জোর মাইল দশেক হবে।
শহীদ বলল, “ভেলায় চড়ে আমরা বরং পূব দিকেই এগোই, বুঝলি? কামাল বলল, তাই চল।
ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে ভেলায় চড়ল ওরা। বৈঠা নেই, বৈঠার কাজ হাত দিয়ে সারতে হচ্ছে।
গান জুড়ে দিয়েছে ডি. কস্টা। পা দুটো ঝুলিয়ে দিয়েছে সে পানিতে। কামাল আর ডি কস্টা একটা ভেলায় চেপেছে। মহুয়া আর ওমেন একটায়। শহীদ একটা ভেলায় একা! সকলের পিছনে ওর ভেলাটা। মহুয়াদেরটা মাঝখানে।
‘চিকা বুম চিকা বুম।
বুম বুম চিকা।
দিস ইজ আফ্রিকা। ঘনঘন মাথা দোলাতে দোলাতে গাইছে ডি. কস্টা।’
‘এই যে, রাজার জাত, অত জোরে গান গাইবেন না। জংলীরা ভাববে ফাঁদে শিয়াল পড়ে চেঁচাছে হেঁড়ে গলায়, এক্ষুণি ছুটে আসবে তীর ধুনক নিয়ে।
| বিদ্যুৎ বেগে ঘাড় ফিরিয়ে “কামালের দিকে তাকাল ডি কস্টা। চমকে উঠল কামাল। ডি, কস্টার চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে গেছে। থর থর করে কাঁপছে।
“কি হলো?
কি যেন বলার চেষ্টা করছে ডি. কস্টা। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তার। অনেক কষ্টে সে উচ্চারণ করল, মি. কামাল! মাই লেগ..মাই লেগ..মাই
কুয়াশা ৪৮
১৩৯
লেগ…!
ঝুপ করে ভেলা থেকে পানিতে পড়ে গেল ডি. কস্টা। পরমুহূর্তে গর্জে উঠল শহীদের হাতের রিভলভার। পরপর দু’বার গুলি করল
শহীদ।
কিন্তু ডি. কস্টাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ভেলা থেকে পড়েই পানির নিচে ডুবে গেছে সে। কামাল কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল, শহীদ ডাইভ দিয়ে পড়ল পানিতে।
দ্রুত সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে শহীদ।
কুমীর! আমি দেখেছি!
মহুয়া চিৎকার করে বলছে কথাটা ওমেনাকে, ‘মি. ডি. কস্টার পা কামড়ে ধরে পানিতে নামিয়ে নিয়ে চলে গেল!
শহীদকেও আর দেখা যাচ্ছে না। ডুব দিয়েছে সে। ঠিক ভেলার কাছেই ভেসে উঠল ডি. কস্টা। ‘মি, কামাল! জলডি! হেলপ মি ফর গডস সেক? দুহাত দিয়ে ধরে ডি কস্টাকে ভেলার উপর তুলল কামাল।
মি. কামাল! প্লীজ মিঠ্যা কঠা বলিবেন না। ডেকুন টো, হামার ডুইটা পা-ই আছে কিনা?
চোখ বন্ধ করে কাঁপছে ডি. কস্টা। | কামাল বলল, সবই তো ঠিক আছে। ডান পায়ে অবশ্য দাঁতের দাগ দেখা যাচ্ছে। ও কিছু না, টিংচার আইডিন লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে।
‘উঁটের ডাগ আছে কিনা জানিটে চাহি নাই। জানিটে চাহিটেছি দুইটা লেগই হামার আছে কিনা!
কামাল হেসে ফেলল, চোখ মেলে দেখলেই তো পারেন।
মহুয়া চিৎকার করে উঠল, কামাল, পানি অমন লাল হয়ে উঠেছে কেন? শহীদ কোথায় সে?•••এখনও উঠছে না কেন?’
| ডি কস্টা চোখ মেলে নিজের পা দুটো দেখে আশ্বস্ত হলো। বলে উঠল, হামি বলিয়া কুমীরের কবল হইটে নিজেকে ছিনাইয়া আনিয়াছি। মি. শহীদ কি টা পারিবেন? আই ডাউড ইট।
শহীদ ভেসে উঠল এমন সময়। ‘গুড।
ডি, কস্টা হাততালি দিয়ে বলে উঠল! ধমকে উঠল শহীদ, কেমন আক্কেল আপনার শুনি? এই নদীতে শয়ে শয়ে কুমীর আছে। আপনি কি মনে করে পা দুটো ডুবিয়ে রেখেছিলেন পানিতে? গুলি করে যদি কুমীরটার মাথা ফুটো করে দিতে না পারতাম তাহলে তো যেতেন খতম হয়ে। | ‘টাই নাকি! কুমীরটাকে গুলি করিয়াছিলেন আপনি! বাট, হামি কিছু জানিটেই পারি নাই,-জেসাস!
১৪০
ভলিউম ১৬
মহুয়া বলে উঠল, ‘তুমি আবার সাঁতার কাটছ কেন? উঠে পড়ো ভেলায়।’
শহীদ হাসল। বলল, একটা ওষুধ ছিটিয়ে দিয়ে তারপর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কুয়াশা দিয়েছিল আমাকে। কুমীর ধারে কাছে ঘেঁষে না, যদি••
মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল শহীদের।
নদীর দুই তীর থেকে অসংখ্য ভেলায় চড়ে প্রায় শ’তিনেক জংলী এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।
নদীর পানিতে গাছপালার ডাল নুয়ে পড়ায় তীর দেখা যায় না। শাখা প্রশাখা এবং পাতাগুলো একটা আড়াল সৃষ্টি করে রেখেছে। সেই আড়ালে লুকিয়ে ছিল জংলীরা ওদের অপেক্ষাতেই।
, কামাল রিভলভার তুলে জংলীদের দিকে তাক করতেই চিৎকার করে উঠল শহীদ।
কামাল! গুলি করিস না!’
পরমুহূর্তে জংলীদের দিক থেকে গর্জে উঠল একটা রাইফেল। কামালের মাথার উপর দিয়ে ছুটে গেল একটা বুলেট ।
‘ওরা বন্দী করবে, শহীদ! ওদের হাতে একবার বন্দী হলে••|
‘জানি, বাঁচার আশা করা বৃথা। কিন্তু বন্দী হলে আরও কিছুক্ষণ তবু হয়তো বাঁচব। কিন্তু ওদেরকে বাধা দিলে যে এখুনি মরতে হবে। তারচেয়ে বন্দী হওয়া ভাল না?
চারদিক থেকে শত শত জংলী ঘিরে ফেলেছে ওদেরকে।
শহীদ বলে উঠল, ভেলা তিনটে দেখেই তখন কেমন যেন খটকা লেগেছিল আমার। কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারিনি। এটা একটা ফাঁদ।
ডি. কস্টা জানতে চাইল, ‘মি. কামাল, সত্যিই কি এই জংলীরা হামাদেরকে ব্রেকফাস্ট করিবে?
আট
আড়াল থেকে শুনলে সন্দেহ হবে একদল জংলীর গায়ে আগুন ধরে গেছে কিংবা দলের ভিতর এক পাল নেকড়ে হামলা চালিয়েছে। চারদিকের আকাশ বাতাস সচকিত হয়ে উঠেছে তাদের একটানা অবিরাম বিকট চিৎকার। উন্মত্ত আবেগে তারা ঘন ঘন মাথা দোলাচ্ছে। দিক-বিদিকে হাত ছুঁড়ছে পা ছুঁড়ছে।
দলটার মাঝখানে একটা খাঁটিয়া। খাঁটিয়াটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে চার পাঁচজন অসভ্য। খাঁটিয়ার উপর কালো আলখাল্লা পরা প্রকাণ্ড একটা দীর্ঘ মানুষের দেহ।
জ্ঞান ফেরেনি এখনও কুয়াশার।
জংলীরা নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। মশালের আলোয় আশপাশের বনভূমি কেমন যেন রহস্যময় এবং ছমছমে হয়ে উঠেছে।
কুয়াশা ৪৮
১৪১
অসভ্যদের দলটা থামল হঠাৎ । টুং-টুং, টুং-টাং । সবাই চুপ হয়ে কান পেতে শুনছে শব্দটা। টুং-টাং, টুং-টাং। হাতির গলায় বাধা ঘণ্টা বাজছে। রাজার হাতি। এসে গেছে রাজার হাতি!
ছুটল সবাই। খানিক দূর গিয়েই তারা দেখতে পেল হাতি দুটোকে। দুই হাতির পিঠে দুই মাহুত। কিন্তু দুই হাতির উপর প্রকাণ্ড হাওদা একটাই।
| রাজা এই হাওদায় চড়ে শিকারে যান। হাতি দুটোকে এমন ভাবেই শিক্ষা দেয়া। হয়েছে যে তারা সমানতালে পা ফেলে, থামতে বললে দুজন একসাথে থামে, বসতে বললে দুজন একসাথে বসে।
, হাতি দুটো প্রায় দুই মানুষ সমান উঁচু। সিঙ্গেল খাটের মত চওড়া এক একটার পিঠ। দুই হাতির দুই পিঠের উপর স্থাপিত হয়েছে কয়েকটা মজবুত পুরু কাঠের তক্তা। তার উপর দাঁড় করানো হয়েছে কাঠের খুঁটি, চারদিকে দেয়াল হিসেবে অনেকগুলো গাছের পাতাকে ব্যবহার করা হয়েছে সুন্দর ভাবে। পাতার উপর পাতা, পাতার পাশে পাতা বসিয়ে পরিশ্রম এবং মেধা খাঁচা করে জংলী রাজের নির্দেশে শিল্পীরা এই হাওদাটা তৈরি করেছে। বড়সড় এবং মজবুত একটা কামরা বলা চলে।
| রাজা তার নিজস্ব এই হাওদা পাঠিয়ে দিয়েছেন বন্দীকে বহন করে নিয়ে যাবার জন্য। রাজার এমন উদ্ভট সিদ্ধান্তের অর্থ কি তা জংলীরা ভেবে দেখে না। রাজার হুকুম শিরোধার্য। রাজা যা করেন ভালর জন্যই করেন।
খাঁটিয়া নামানো হলো মাটিতে। কুয়াশার অচেতন দেহটাকে ধরাধরি করে হাতি দুটোর কাছে বয়ে নিয়ে গেল জংলীরা। অতি কসরতের সাথে চেষ্টা করার পর হাওদার উপর তোলা সম্ভব হলো দেহটাকে। হাওদার দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। বাইরে থেকে। জংলীরা লাফ দিয়ে নেমে পড়ল নিচে।
| আবার এগিয়ে চলল সবাই। সবার আগে দুই হাতি। পিছনে উল্লসিত জংলীরা। আবার শুরু হলো নাচ গান।
ভোরের আলো ফুটে উঠল পুবাকাশে খানিকক্ষণের মধ্যেই। পাখ-পাখালির কলগুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠল বনভূমি।
| জংলীদের নাচগান থেমে গেছে ভোরের আলো ফুটে ওঠার পরপরই। নাচগান করে ওরা ননাি কারণে। শরীরটাকে গরম রাখার জন্যে, ক্লান্তিকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়োজনে নাচে ওরা, হিংস্র পশুদেরকে ভয় দেখানোর জন্য বিকট স্বরে চেঁচিয়ে গান গায়। | হাতির পিছু পিছু জংলীরা দ্রুত হাঁটছে। গ্রাম এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বড় জোর মাইলখানেক আর।
কিন্তু গ্রামে পৌঁছবার আগেই থামতে হলো ওদেরকে। রাজার এক দেহরক্ষী পনেরো বিশজন জংলীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের জন্যে। কি ব্যাপার! না, রাজা নতুন আদেশ পাঠিয়েছেন। বন্দীকে গ্রামে নিয়ে যাবার কোন দরকার নেই। তাকে এই জঙ্গলেই হত্যা করতে হবে।
১৪২
ভলিউম ১৬
হত্যা করতে হবে?
নেচে উঠল অসভ্য জংলীরা! রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠল সবাই। শুরু হলো আবার নাচ এবং গান । দেহরক্ষীর সাথের অসভ্যরা ঢাক-ঢোল বাজাতে শুরু করল। মোষের শিঙে ঢালা হতে থাকল কড়া মদ, চুন।
দেহরক্ষার সাথের জংলীরা বন্দীকে হত্যা করার সব ব্যবস্থা সেরে রেখেছে।
জীবন্ত কবর দেয়া হবে বন্দীকে। রহস্যপুরীর পবিত্রতা নষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে বন্দী এই জঙ্গলে প্রবেশ করেছিল। দেবতার নির্দেশেই তাকে জীবন্ত কবর দেয়া হবে। রাজার উদ্ভট খেয়াল না এটা। দেবতার নির্দেশ। অল্য নির্দেশ।
দেহরক্ষীর নির্দেশে হাতি দুটো বসল। হাওদার দরজা খোলা হলো বাইরে থেকে। দেখা গেল বন্দীর জ্ঞান ফেরেনি এখনও। মুচকি হাসি ফুটল দেহরক্ষীর ঠোঁটে। বন্দী কুয়াশার শরীরে এখনও জড়িয়ে রয়েছে জাল । জ্ঞান ফেরেনি তার, দেখতেই পাচ্ছে সে ।
হাওদার ভিতরে প্রবেশ করল দেহরক্ষী। দরজাটা বন্ধ করে দিল ভিতরে ঢুকে। বন্দীর আলখাল্লার পকেটগুলোয় মূল্যবান অনেক জিনিস আছে। সেগুলো উদ্ধার করা দরকার।
মিনিট পনেরো পর দেহরক্ষী বেরিয়ে এল হাওদা থেকে। হাতির পিঠ থেকে নেমেই সে নির্দেশ দিল, “হিরি মা, কিরি মা। আগডু বাগডু ডুলাডু? উলুট ভুলুট খুট টটরা।’
অর্থাৎ, পরবর্তী কাজে হাত দিতে হয়। শুভ কর্মে দেরি করে লাভ কি? বন্দীকে জীবন্ত কবর দেয়া হোক।’
জংলীরা সোল্লাসে বলে উঠল একযোগে, ‘উলুট ভুলুট খুট টটরা।’
গভীর একটা কূপ খনন করা হয়েছে। হাওদা থেকে কালো আলখেল্লা পরিহিত। অচেতন দেহটাকে নামানো হলো। ধরাধরি করে জংলীরা দেহটাকে নিয়ে গেল কূপের কাছে।
| দেহরক্ষী মন্ত্র আওড়াতে লাগল, উলুন চা বুলুন চা–খচা। হিরি তিরি বামবা। নচা উলুন চা বুলুন চা-খচা। হিরি তিরি বামবা•••
সবশেষে দেহরক্ষী বিকট স্বরে বলে উঠল, ‘খচা! খচা! খচা! উলুন চা! | কৃপটা বেশ গভীর। দুই মানুষ গভীর তো হবেই। অচেতন বন্দীকে ফেলে দিল জংলীরা সেই কুপের ভিতর। সাথে সাথে বিশ পঁচিশজন জংলী কৃপের চারপাশে স্তূপীকৃত মাটি ফেলে ভরে দিতে শুরু করল কৃপটা।
দেখতে দেখতে ভরে গেল কৃপটা। কূপের উপর দাঁড়িয়ে নাচতে লাগল জংলীরা।
দেহরক্ষীকে ঘিরে নাচছে আর একদল জংলী । হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে গেল দেহরক্ষী হাওদার দিকে।
হাওদার ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল দেহরক্ষী। হাতি দুটো মাহুতদ্বয়ের নির্দেশ
কুয়াশা ৪৮
১৪৩
পেয়ে উঠে দাঁড়াল এবার।
| গ্রামের দিকে ফিরে চলল সবাই। হাতির উপর হাওদায় দেহরক্ষী। হাতির পিছন পিছন নৃত্যরত অসভ্য জংলীদল। সবার পিছনে বাদক দল। উন্মত্তের মত ঢাক-ঢোল পেটাচ্ছে তারা।
— —
Leave a Reply