৪৭. প্রফেসর ওয়াই ৪: বিপদের মাঝে [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪৭
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর, ১৯৭৫
মাঝারি আকারের একটি কামরা। কেউ নেই ভিতরে। মানুষ তো নয়ই, এমনকি টিকটিকি, তেলাপোকা, মশা, মাছি, কিংবা কুকুর, বিড়াল, শিয়াল—কোন পোকা মাকড় বা জীব জানোয়ারের টিকিটি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
| কামরাটার মাঝখানে উঁচু একটা টেবিল। টেবিলের উপর জ্বলছে একটা হারিকেন। দেখতে হারিকেনের মত হলেও ওটা জ্বলছে বিশেষ এক ধরনের গ্যাসে। গত তিন বছর ধরে ওই টেবিলের উপরই রয়েছে হারিকেনটা ওই অবস্থায়। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা জ্বলছে একই ভাবে। প্রফেসর ওয়াইয়ের আবিষ্কার এই আজব। হারিকেন। একবার সে ভরে দিয়েছে হারিকেনের ট্যাঙ্ক গ্যাস দিয়ে, ব্যস, চিরকাল জুলতে থাকবে এমনিভাবে। আপনাআপনিই তৈরি হচ্ছে গ্যাস ট্যাঙ্কের ভিতর।
টেবিল এবং টেবিলের উপর ওই হারিকেনটা ছাড়া কামরাটার ভেতর আর কিছুই নেই।
| কামরার চারদিকের দেয়াল ভারি এবং কঠিন পাথর দিয়ে তৈরি। মাথার উপরের শিলিংটাও পাথরের।.অবাক কাণ্ড, কামরাটা জানালা ও দরজাহীন এখান থেকে বেরুবার বা বাইরে থেকে এর ভিতর ঢোকার কোন দৃশ্যমান পথ নেই। এমনকি একটা ভেন্টিলেটারও নেই।
অথচ কামরার ভিতর অক্সিজেনের কোন অভাব নেই’। রহস্যটা অবশ্য প্রফেসর ওয়াই জানে। পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের অন্যতম সে। তার আবিষ্কৃত যুগান্তকারী গ্যাসের সাহায্যে জ্বলছে হারিকেনটা। ওই গ্যাসই পুড়ে আপনা-আপনি তৈরি হচ্ছে
অক্সিজেন।
হঠাৎ একটা শব্দ উঠল কামরাটার ভিতর। কেউ যেন কাঠের টেবিলটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল একটু।
এ কোথায় এলাম!’ একটি নারী কণ্ঠ থেকে বিস্ময়োক্তি বেরিয়ে এল।
মুহূর্ত পূর্বেও এই কামরাটা ছিল নির্জন। এখন দেখা যাচ্ছে কামরার শক্ত কালো, পাথরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ। একজন তার মধ্যে নারী, অন্যজন সূদর্শন সুবেশী বলিষ্ঠ চেহারার পুরুষ।
শাড়ি পরিহিতা সুন্দরী মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াবার সময় ধাক্কা খেয়েছে টেবিলের থে। পুরুষটিও বিমূঢ় নেত্রে কামরার চারদিকটা দেখে নিচ্ছিল। অন্যমনস্কভাবে সে
৫৬
ভলিউম ১৬
বাল, ‘কি জানি, ঠিক বুঝতে পারছি না। দেখে মনে হচ্ছে এটা যেন একটা কারাগর।’ | মেয়েটি বলল, দরজা নেই, জানালা নেই–আমরা এর ভিতর ঢুকলাম কিভাবে?’
পুরুষটি বলল, আমি সে কথা ভাবছি না, মহুয়া। আমি ভাবছি প্রফেসর ওয়াই আমাদেরকে এই রকম একটা সেলে পাঠাল কেন? খেপে গিয়ে সে বলেছি আমাদেরকে তার ম্যাটার ট্রান্সমিট করার যন্ত্রের সাহায্যে ভারত মহাসাগরের একটা দ্বীপে পাঠাবে।
কথাটা বলে শহীদ পায়চারি করতে শুরু করল উত্তেজিত ভাবে।
মহুয়া লেল, “প্রফেসরের ম্যাটার ট্রান্সমিশন যন্ত্র–আমি বিশ্বাস করি না । আমার কি ধারণা জানো?’
“কি?’
মহুয়া বলল, আমরা ঢাকাতেই প্রফেসরের বাড়িতে বন্দী রয়েছি। এটা হয়তো আণ্ডার গ্রাউণ্ডের কোন সেল। প্রফেসরের কাঁচ দিয়ে ঘেরা কেবিনে ঢোকার পর আমরা মারাত্মক কোন গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম। তাই মনে নেই, মনে করতে পারছি না, কিভাবে এখানে এলাম। নিশ্চয়ই কেউ আমাদেরকে এখানে রেখে গেছে।
| পায়চারি থামিয়ে শহীদ টেবিলের হারিকেনটা ওলে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। মুখ তুলে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। বলল, ‘কুয়াশা কিন্তু বিশ্বাস করে ম্যাটার ট্রান্সমিট করার যন্ত্রের কা। তুমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, মনে পড়ে?
‘হ্যাঁ, মনে পড়ে। তাহলে তুমিও বলতে চাইছ… শহীদ বলল, ‘প্রফেসর সত্যি ওই রকম একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। | মহুয়া বলল, রিসিভিং সেট দেখছি না কেন তাহলে? তুমিই তো আমাকে বলেছিলে যেখানে রিসিভিং সেট নেই সেখানে প্রসেসর তার যন্ত্রের সাহায্যে ম্যাটার বা মানুষকে পাঠাতে পারবে না।
শহীদ টেবিলের উপরে হারিকেনটা নামিয়ে রাখল। বলল, এই প্রশ্ন আমার মনেও দেখা দেয়। উত্তরও পেয়ে গেছি। এই হারিকেনটাই হলো প্রফেসর ওয়াইয়ের রিসিভিং সেট । অন্যান্য সেটের চেয়ে একটু অন্য রকম দেখতে এই যা।’
মহুয়া স্বামীর দিকে বোকার মত তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, “তুমি বলতে চাইছ সত্যি প্রফেসর তার ঢাকার আস্তানা থেকে ট্রান্সমিট করে আমাদেরকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে?”
শহীদ বলল, অন্য কোথাও না, আমার ধারণা সে তার কথা মত, আমাদেরকে ভারত মহাসাগরের কোন এক ছোট্ট নির্জন দ্বীপেই পাঠিয়েছে।
কালো হয়ে গেল মহুয়ার মুখটা! বলল, তাহলে তোমার কথা যদি সত্যি হা | শহীদ আমরা আবার দেশে ফিরতে পারব তো?’
শহীদ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রই, মহুয়ার দিকে। বলল, সত্যি কথাই বলা ভাল, মহুয়া। মিথ্যে আশা দিয়ে তোমাকে ঠকাতে চাই না দেশে ফিরতে পারব কিনা
কুয়াশা ৪৭
৫৭
জানি না আমি।
মেয়েরা চিরকাল যে-কোন পরিস্থিতির সাথে দ্রুত নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। মহুয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। শহীদের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে সে জানতে চাইল, প্রফেসরের রোবটরা তোমাকে খাবারের দুটো প্যাকেট দিয়েছিল-কোথায় সেগুলো?
মহুয়ার কাঁধে পানির ফ্লাস্কটা অবশ্য ঠিকই আছে। প্রফেসরের একটা রোবট সুপেয় পানি ভরা এই ফ্লাস্কটা দিয়েছিল ওদেরকে।
| ‘প্যাকেট দুটো আমি পকেটে ভরে রেখেছিলাম প্রফেসরের ম্যাটার ট্রান্সমিশন যন্ত্রের কেবিনের ভিতর ঢুকে।
পকেটে হাত ঢোকাল শহীদ! প্লাস্টিকের দুটো প্যাকেট বের করে টেবিলের উপর রাখল ও।
হঠাৎ নিজের’রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল মহুয়া।
শহীদ, মাত্র দেড় মিনিট হয়েছে–মানে, দেড় মিনিট আগেও আমরা ঢাকায় প্রফেসরের কন্ট্রোল রূমে ছিলাম!
শহীদ বলি, ‘ঠিক তা নয়। প্রফেসরের কেবিনে ঢুকে সময় দেখেছিলাম আমি। এখানে নিজেকে আবিষ্কার করার সাথে সাথে আবার সময় দেখেছি। দেড় মিনিট হলো আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি বটে, কিন্তু পৌঁছতে এক সেকেণ্ডও লাগেনি। আলোর গতিতে আমরা এখানে এসে পৌঁছে গিয়েছি।
মহুয়া টেবিলের কিনারায় বসে পড়ল। বলল, আমার মাথায় তোমার হেঁয়ালি ঢুকছে না, বাপু। কি বলতে চাইছ তুমি? এক নিমেষে এতদূর আসা যায় কোনদিন?
‘আলোর গতিতে মাত্র এক সেকেণ্ডে চলে যাবে তুমি এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। প্রফেসরের আবিষ্কৃত যন্ত্রটা ম্যাটারকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পাঠাতে পারে আলোর গতিতে।
মহুয়া গালে হাত দিয়ে বলল, “তুমি বলতে চাই আমরা টাকা থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে এসেছি?’
শহীদ বলবে, দুই হাজার ছয়শো মাই-হ্যাঁ। | মহুয়া টেবিল থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল! খপ করে একটা হাত ধরে ফেলল সে শহীদের, তার মানে–প্রফেসরের সব কথা সত্যি। কামাল আর ডি কস্টা তাহলে এই মুহূর্তে :
হ্যাঁ। ওরা এখন এভারেস্টের চুড়োয় রয়েছে।
মহুয়ার চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঢোঁক গিলল সে। বলল, আর মি. সিম্পসন গ্রীনল্যাণ্ডে
‘হা।’
আর দাদা, দাদাকে প্রফেসর পাঠাতে চেয়েছিল মহাশূন্যে
শহীদ বলল, কুয়াশা হয়তো মহাশূন্যের কোন গ্রহের উদ্দেশে ছুটছে। কুয়াশা ঠিক নয়, কুয়াশার শরীর লক্ষ-কোটি অণু পরমাণুতে পরিণত হয়ে গেছে। সেই
ভলিউম ১৬
অণুগুলো ছুটছে সীমাহীন মহাশূন্যের পথ ধরে। ডক্টর কূটজের স্পেসক্রাফটের রিসিভিং সেট যেখানে আছে সেখানে গিয়ে অনুগুলো একত্রিত হবে অর্থাৎ কুয়াশা নিজেকে সেখানে আবিষ্কার করবে।’ | কুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মহুয়া। দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল সে শহীদকে। শহীদ গম্ভীর হয়ে উঠল একটু। মহুয়ার মাথায় একটা হাত রেখে সান্তনার সুরে কিছু বলতে গিয়েও ঠোঁট দুটো বন্ধ করে ফেলল ও।
সান্তনা দেবার ভাযা নেই।
খানিক পর ধাতস্থ হয়ে মহুয়া শাড়ির আঁচলে চোখ-মুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘আমরা তো এখনও বেঁচে রয়েছি। কিন্তু ওরা••ওরা হয়তো মরে গেছে এরই মধ্যে ।’
শহীদ বলল, মরেনি। প্রফেসর ওদেরকে কিছু কিছু সাজসরঞ্জাম দিয়েছে, যার ফলে কটা দিন বেঁচে থাকতে পারবে সবাই।
মহুয়া বলল, “তাতেই বা কি! এভারেস্টের চুড়ো থেকে ওরা. কি নামতে পারবে বলে মনে করো? মি. সিম্পসনই বা বরফের দেশে ক’দিন বেঁচে থাকতে পারবেন? আর দাদা•••!
আবার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল মহুয়ার। জীবনে আর হয়তো দাদাকে দেখতে পাবে না সে। অনেক জীবন-মরণ সমস্যায় পড়েছে তারা, কিন্তু প্রত্যেকবারের মত এবার আর দাদা ছুটে আসবে না তাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে।
শয়তান প্রফেসরের শিকার কুয়াশা নিজেও। “কি করছ তুমি?’
শহীদ পিছন ফিরে না তাকিয়েই জবাব দিল, এখান থেকে বেরুবার গোপন পথের হদিস পাবার চেষ্টা করছি।’
শহীদ পাথরের দেয়ালের প্রতি ইঞ্চি জায়গা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে এবং হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করছে।
বেরুবার রাস্তা যদি না থাকে?
মহুয়ার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কাজ করে যেতে লাগল শহীদ। চারদিকের চারটে দেয়াল পরীক্ষা করতে আধ ঘণ্টা সময় নিল ও। নৈরাশ্য ফুটে উঠল ওর চোখে মুখে।
‘কি, পেলে না?’ ব্যর্থ কণ্ঠে জানতে চাইল মহুয়া।
না। মেঝেটা বাকি আছে পরীক্ষা করতে।
মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসল শহীদ। মেঝের দিকে তাকিয়ে ভুরু জোড়া কুঁচতে উঠল ওর। দু’হাত মেঝেতে রেখে ঝুঁকে পড়ল নিচের দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে কিছু যেন দেখছে সে।
এদিকে মহুয়া টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে হতবাক হয়ে গেছে। সুন্দর একটা আধ হাত লম্বা টর্চ দেখা যাচ্ছে ড্রয়ারের ভিতর। ঘাড় ফিরিয়ে মুখটা হাঁ করল কিছু বলার
জন্য। কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই শহীদ কথা বলে উঠল ।
‘মহুয়া, এদিকে এসো। দেখো তো, এগুলো পায়ের ছাপ না?’
কুয়াশা ৪৭
পায়ের ছাপ।
মহুয়া শহীদের পাশে এসে বসল, মেঝের দিকে তাকিয়ে সে দেখল সত্যি পায়ের ছাপই। কাদামাখা পায়ের ছাপ পরিষ্কার ফুটে রয়েছে মেঝের উপর। তবে, ছাপগুলো যেন বাচ্চা ছেলের পায়ের।
শহীদ বলল, খুব ছোট ছোট, না? একটু যেন, লম্বার তুলনায় বেশি চওড়া–তাই মনে হচ্ছে না তোমার?’
মার দিকে তাকাল শহীদ কথাগুলো বলে। প্রশ্ন ফুটে উঠল ওর চোখের দৃষ্টিতে। বলল, তোমার হাতে টর্চ কোত্থেকে এল? * মহুয়া বলল, এটা টর্চ কিনা বুঝতে পারছি না । টর্চের মত দেখতে কিন্তু সুইচ বা বোতাম নেই কেন?’
হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিল শহীদ। সত্যি, সুইচ বা বোতাম জাতীয় কিছু নেই কোখাও শহীদ মুখ তুলে তাকাতে মহুয়া বলে উঠল, ড্রয়ারের ভিতর ছিল।”
জিনিসটার দিকে আবার তাকাল শহীদ। এক মুহূর্ত পর আপন মনেই বলে উঠল ও, আশ্চর্য!
মহুয়া সাগ্রহে জানতে চাইল, কি ব্যাপার?’
শহীদ টর্চের মত দেখতে চকচকে ইস্পাতের জিনিসটা বাড়িয়ে দিল মহুয়ার দিকে। বলল, “পিছন দিকটা ভালমত লক্ষ্য করে দেখো । কিছু দেখতে পাচ্ছ?’
| মহুয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনে। খোঁপা ডেঙে মাথার চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ল পিঠের উপর । প্রায় সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠল সে, একি! কুয়াশা-দাদার নাম খোদাই করা রয়েছে যেকিন্তু•••
শহীদ বলল, “কুয়াশারই কাজ এটা। এখন আমি বুঝতে পারছি। প্রফেসরের কন্ট্রোলরূমের ঠিক কোন জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিল কুয়াশা খেয়াল আছে তোমার? কাঁচের কেবিনটার দরজার কাছ থেকে বড়জোর চার কি পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল
– হ্যাঁ, মনে পড়ছে। কিন্তু দাদার দাঁড়িয়ে থাকার সাথে এই জিনিসের সম্পর্ক
কি
শহীদ বলল, “সম্পর্ক আছে। কুয়াশা জানত প্রফেসর ওয়াই আমাদেরকে পাঠাচ্ছে ভারত মহাসাগরের একটা দ্বীপে। আমরা বিপদে পড়তে পারি এ-কথা ভেবে সে-ই সকলের অগোচরে এই টর্চটা ছুঁড়ে দিয়েছিল কেবিনের ভিতর। কেবিনে ঢোকার পর আমি একটা শব্দ শুনেছিলাম। কিন্তু তখন কোন শব্দের প্রতি মনোযোগ দেবার মত মানসিক অবস্থা আমার বা তোমার ছিল না।’
মহুয়া বলল, এটা তাহলে দাদার আবিষ্কৃত কোন অস্ত্র?
শহীদ বলল, হ্যাঁ। আমাদের জন্যে শেষ মুহূর্তেও মাথা ঘামিয়েছে কুয়াশা। কিন্তু অস্ত্রটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় জানাতে পারেনি। ঠিক আছে, চেষ্টা করলে
জানা তেমন কোন কঠিন কাজ হবে না।
শহীদ টর্চ সাদৃশ জিনিসটা পকেটে ভরে রেখে মেঝের দিকে তাকাল। | ‘কিন্তু, এটা ড্রয়ারে এল কিভাবে?
৬০
ভলিউম ১৬
শহীদ মুখ না তুলেই বল, কেবিনের দেয়ালে লেগে মেঝেতে পড়বার আগেই শূন্যে থাকা অবস্থায় অনুতে পরিণত হয়ে একত্রিত হয়েছে ওটা ওই ড্রয়ারের ভেতর। ওটা যদি আমার পকেটে বা তোমার হাতে থাকত তাহলে আমার পকেটে বা তোমার হাতেই পাওয়া যে ওটাকে এখানে এসে।’
বসে বসেই মেঝের উপর দিয়ে এগোতে লাগল শহীদ। ছোট ছোট পায়ের ছাপগুলো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে, সাতে আর কোন চিহ্ন নেই। মেঝের দিকে আরও নুয়ে পড়ল শহীদ।
‘মহুয়া! ইউরেকা!
শহীদের পাশে দাঁড়িয়ে হাত দুটো পিছনে নিয়ে গিয়ে মু। কালো সাপের মত চুলগুলোকে একত্রিত করে খোঁপার মধ্যে বন্দী করতে চেষ্টা করছিল সাহুহাত দুটো থেমে গেল ওর। ঝুলে পড়া চুলগুলো পিঠের উপর।
“কি পেলে! বেরুবার রাস্তা?’
শহীদ বলল, দেখো, এই জায়গার পাথরটা সামান্য একটু উঁচু হয়ে রয়েছে । এটা সরাতে হবে।’
আশার আলো ফুটে উঠেছিল মহুয়ার চোখে মুখে। কিন্তু পাথরটার দিকে চোখ পড়তেই দল করে নিভে গেল সব আশার আলো ।
অতটুকু মাত্র! ওটা সরালেই বা কি? যদি গর্ত একটা পাওয়াও যায়, বড়জোর খাবার প্যাকেটগুলো একটা একটা করে গলিয়ে দেয়া যাবে। আমরা বেরুবো কোন
পথে? তোমার মাথা গরম হয়ে গেছে। তাই ছোট্ট একটা পাথর উঁচু হয়ে রয়েছে দেখেই।’
শহীদ গায়ে মাখল না মহুয়ার কথা। পাথরটাকে সরাবার চেষ্টা করছে ও। কিন্তু সরানো তো দূরের কথা, নড়াতেও পারছে না পাথরটাকে। মিনিট সাতেক পর ক্ষান্ত হলো ও }
“ এভাবে হবে না। কি মনে করে, পাথরটার উপর ডান হাত রেখে চাপ দিতে লাগল শহীদ। সাথে সাথে শব্দ উঠল ঘর-ঘর-ঘর করে।
শহীদ এবং মহুয়া বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পিছন দিকে। লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল শহীদ। পশ্চিম দিকের দেয়ালটা মাঝখান থেকে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে দু’পাশে সরে যাচ্ছে। উন্মোচিত ফাঁকা জায়গায় দেখা যাচ্ছে একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা উঠে গেছে উপর দিকে।
মহুয়ার একটা হাত ধরল শহীদ। বলল, ‘এটা সেল হলেও জায়গাটা কিন্তু বেশ নিরাপদ।
মহুয়া ঝট করে তাকাল শহীদের দিকে, তুমি বলতে চাইছ এখান থেকে বেরুলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে?
| শহীদ বলল, তোমার কি মনে হয়? বিপদে পড়ার আশঙ্কা না করলে কুয়াশা অস্ত্রটা আমাদের সাথে পাঠাত কি? আমার কাছে রিভলভার আছে তা তো সে জানতই। তার মানে কি দাঁড়ায়? কুয়াশা জানত আমরা এখানে যে বিপদে পড়ব সেই বিপদের মোকাবিলা করার জন্য রিভলভার যথেষ্ট নয়।
কুয়াশা ৪৭
সুড়ঙ্গটার মেঝে, দেয়াল এবং সিলিং পাথরের তৈরি। পেন্সিল টর্চটা ছিল বলে রক্ষে। তা না হলে গাঢ় অন্ধকারে হাতড়ে মরতে হত। মহুয়া খুব বেশি নার্ভাস হয়ে পড়েছে। বিশেষ কিছু বলছে না সে ঠিক, কিন্তু শহীদ তার দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
এর আগে দু’বার বাঁক নিয়েছে ওরা। সামনে আরও একটা বক। বেশ দীর্ঘ সুড়ঙ্গ। মাঝে মধ্যে থেমে কান পেতে কোন শব্দ শোনা যায় কিনা খেয়াল করছে শহীদ। মহুয়া ঠিক ওর পিছনেই রয়েছে। তার ছোঁয়া প্রতি মুহূর্তে পাচ্ছে ও পিঠে। দু’জনের মাঝখানে এতটুকু দূরত্ব রাখতে চায় না মহুয়া।
সুড়ঙ্গের দু’পাশের দেয়ালগুলো কোথাও মসৃণ, কোথাও উঁচু-নিচু। মেঝেটাও পরীক্ষা করেছে শহীদ। বেশ যত্ন করে বড় বড় পাথরের খণ্ড বসানো হয়েছে। প্রাকৃতিক কোন সুড়ঙ্গ নয়। একদল মানুষের কঠোর পরিশ্রমের ফসল এটা।
শহীদের কাধ দুটো আঁকড়ে ধরল মহুয়া পিছন থেকে, শহীদ, আমার বড় ভয় করছে কেন যেন!
সামনে বাক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর শহীদ বলল, “ভয়ের কি আছে? আমি থাকতে তোমার ভয়ের কিছু নেই, মহুয়া। আশপাশে বাঘ, ভালুক, সিংহ বা গরিলার দল বা চোর, ডাকাত, গুণ্ডা, বদমাশ কিছুই তো দেখছি না। প্রফেসর ওয়াই–সেও তো ঢাকায়। কাকে ভয় লাগছে তোমার বলো তো? আমাকে বিশ্বাস করো, মানুষটা আমি কখনও কখনও ভয়ঙ্কর হলেও, তোমার কোন ক্ষতি আমি করব না।
কাজ হলো। সর ভয়, উত্তেজনা শঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে শব্দ করে হেসে ফেলল মহুয়া।
বক পেরুতেই শহীদ দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘মহুয়া, দেখছ?
দরজা। অনেকগুলো। শহীদ, দরকার নেই আর সামনে এগিয়ে চলো ফিরে যাই সেই কামরাটায়।
‘দূর বোকা! ওখানে কতদিন থাকবে শুনি? খাবে কি? তাছাড়া, এত ভয় পেলে চলবে কিভাবে বলো তো? সত্যিকার ভয়ের ব্যাপার ঘটলে দেখছি তুমি হার্টফেলই করবে।
মহুয়া বলল, “সত্যিকার ভয়ের ব্যাপার ঘটলে হার্টফেল করার সুযোগ পাব? তার আগেই সত্যিকার ভয়ের ব্যাপারটা ঘাড় মটকে দেবে না তো?
দরজাগুলোর গায়ে বড় বড় তালা ঝুলছে। ভিতরে কি আছে দেখার কোন উপায় নেই। শহীদ বলল, আমার কিন্তু ভারি কৌতূহল হচ্ছে, মহুয়া।
“কি করতে চাও তুমি?’
পকেট থেকে সেই ইস্পাতের লম্বা টর্চটা বের করল শহীদ। বলল, কুয়াশার এই জিনিসটা এবার ব্যবহার করা দরকার। আমার বিশ্বাস, এটা কুয়াশার আবিষ্কৃত
৬২
ভলিউম ১৬
লেজার গানের ক্ষুদ্র সংস্করণ।
নেড়েচেড়ে দেখতে শুরু করল শহীদ জিনিসটা! ডায়াল দেখা যাচ্ছে পিছনে একটা। জিরোতে সেট করা আছে ডায়ালের একটা কাঁটা। খানিক নাড়াচাড়া করেই টের পেল শহীদ, আলাদা কোন বোতামের ব্যবস্থা নেই–পিছনের এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা সবটাই বোতাম। চাপ দিলে ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। ডায়াল ঘুরিয়ে কাঁটাটা ওয়ানের উপর নিয়ে এল শহীদ।
‘খুলছে তাহলে?’
মহুয়া কাছে সরে এল। ধমকে উঠল শহীদ সাথে সাথে । সরে যাও সামনে থেকে! এটা লেজার গান, ছেলে-খো ব্যাপার নয়। সুইচে আঙুলের ছোঁয়া লাগলেই বেরিয়ে পড়বে অদৃশ্য একটা রে। সেই রে যার ওপর পড়বে সে-ই চোখের পলকে বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে।’
মুখ শুকিয়ে গেল মহুয়ার। শহীদের পিছনে চলে গিয়ে বলল, ‘সুইচ কোথায় পেলে তুমি আবার?
শহীদ বলল, এই দেখো এটাই সুইচ।’ মহুয়া পিছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে শহীদের কার্যকলাপ।
শহীদ ডায়ালের কাটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, রে-এর তরঙ্গের কম বেশি করার জন্যে এই ডায়াল। মহুয়া, চোখ দুটো বন্ধ করো তো।’
চোখ বন্ধ করল মহুয়া। শহীদ মিনি লেজারগানের সামনের দিকটা একটা দরজার তালার দিকে ধরে লেজার গানের পিছনের অংশে একটা আঙুল রেখে মৃদু চাপ দিল।
এক নিমেষে তালাসহ দরজার খানিকটা অংশ যাদুমন্ত্রে অদৃশ্য হয়ে গেল। দরজার গায়ে ধাক্কা দিতেই কবাট দুটো সরে গেল দুদিকে।
কামরার ভিতর বড় বড় কাঠের বাক্স একটার উপর একটা চাপানো রয়েছে। লেজারগানের রেএকটা বাক্সের একটা কোণা গায়েব করে দিয়েছে। বাক্সের ভিতর চকচক করছে ইস্পাতের তৈরি যন্ত্রপাতি।
| বাক্সগুলোয় নানারকম যন্ত্রপাতি, মেশিনের পার্টস এইসব রয়েছে।’
শহীদ গভীর। কথা না বলে পাশের কামরার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও।
দ্বিতীয় কামরায় বাক্স নয়, কাঁচের বড় বড় জার দেখা গেল। জারের ভিতর নানা রঙের, নানা জাতের তরল রাসায়নিক পদার্থ। তৃতীয় কামরার ভিতর কিছুই পাওয়া গেল না। সম্পূর্ণ ফাঁকা। চতুর্থ কামরার ভিতর নানা ধরনের তার। চুলের মত সরু থেকে শুরু করে আঙুলের মত মোটা–সব রকমের তারই রয়েছে।
পাঁচ নমূর কামরার ভিতরই অপেক্ষা করছিল ওরা। ঘর ভর্তি লোক। দাঁড়িয়ে আছে সবাই দরজার দিকে মুখ করে। যেন শহীদ এবং মহুয়ার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে সবাই। দাঁত বের করে হাসছে।
কানের কাছে তীক্ষ্ণবরে আর্তচিৎকার করে উঠল মহুয়া। দুই হাত দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে জড়িয়ে ধরেছে সে শহীদকে। ছাড়াতে পারছে না শহীদ নিজেকে। শত চেষ্টাতে মহুয়াকে থামাতে পারছে না ।
কুয়াশা ৪৭
৬ ৩
=
=
=
চোখ বুজে চিৎকার করেই চলেছে মহুয়া।
কামরার ভিতর লোকগুলো দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। কেউ নড়ছে না কারও গায়ে মাংসের ছিটেফোনেই ওদের। শুকনো, খটখটে ।
| কঙ্কাল পরস্পরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝট করে মুখ তুলে আবার তাকাল শহীদ! মাথাটা যেন ঘুরে উঠল ওর। মহুয়ার চিৎকার, সেই সাথে কাদের যেন সম্মিলিত হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ ধরনের ভয় দেখানোর হাসি•••
লজ্জা পেল শহীদ। ওটা আসলে মনের ভুল । কেউ হাসছে না। মহুয়ার মুখে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার থামিয়ে দিল ও। হাতটা পরমুহূর্তে সরিয়ে নিয়ে হালকা সুরে বলল, “অমন করে কেউ চেঁচায়? ওগুলো তো নিষ্প্রাণ কঙ্কাল, কি করবে ওরা তোমার?
| চোখ খুলতে ভয় হচ্ছে মহুয়ার। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে আছে সে শহীদকে । শহীদের ঘাড়ের মাংসে চেপে বসেছে তার আঙুলের নখগুলো। কাঁপছে গোটা দেহ। ভাঙা গলায় সে বলে উঠল, এখানে আর এক সেকেণ্ডও নয়!’
মৃদু হেসে শহীদ বলল, “বেশ তো, চলো, সামনের দিকে হাঁটি।’
সামনে আর একটা বাক। বাক ঘুরতেই কাঠের উপর লোহার পাত মোড়া। প্রকাণ্ড দরজা দেখতে পেল ওরা। দরজার মাথার উপরে, পাথরের দেয়ালে, ঝুলছে। একটা টিভি ক্যামেরা।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মহুয়া ভয়ে ভয়ে পিছন দিকে বারবার তাকাচ্ছে। দেয়ালে হাত বুলিয়ে কি যেন খুঁজছে শহীদ। মিনিট খানেক পরই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। পাওয়া গেছে একটা বোতাম। বোতামটায় চাপ দিল ও।
নিঃশব্দে খুলে যাচ্ছে মস্ত ভারি দরজাটা। সূর্যের আলোয় ধাধিয়ে গেল ওদের চোখ । উঁচু একটা মাটির টিলা দেখা যাচ্ছে। সুর্যটা তার মাথার উপর । সামনে সবুজ গছিপালা, ঝোঁপঝাড়।
একটানা গুরুগম্ভীর গর্জনের শব্দ আসছে কোথাও থেকে। মহুয়া ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কিসের শব্দ হচ্ছে অমন?
সমুদ্র ডাকছে। মহুয়া, আমরা ভারত মহাসাগরের কোন দ্বীপেই বন্দী রয়েছি। কথাটা বলে দরজা পেরিয়ে বনভূমিতে পা রাখল শহীদ। মহুয়াও ওর পিছু পিছু
বেরিয়ে এল। | এক মুহূর্ত পর একটা শব্দ শুনে ওরা দুজনেই পিছন ফিরে তাকাল। সুড়ঙ্গের দরজাটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।
দরজাটা কোথায়! শহীদ! আমি কি স্বপ্ন দেখছি!
শহীদ বলল, দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে, মহুয়া। ওই যে মস্ত পাথরটা দেখছ, ওটাই দরজা। দরজার গায়ের সাথে পাথরটাকে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমি ভাবছি-দরজা বন্ধ করল কে?
৬৪
ভলিউম ১৬
তিন
1
পরিবেশটা খুবই সুন্দর। গাছে গাছে সবুজ পাতা, ডালে ডালে চেনা-অচেনা হরেক রকম হলুদ, লাল, খয়েরী, কালো রঙের সুন্দর সুন্দর পাখি। সুরেলা কণ্ঠে ডাকাডাকি করছে, দল বেঁধে এক ডাল থেকে আরেক ডালে গিয়ে বসছে। বুনো ফুলের উজ্জ্বল রঙ চোখ ধাধিয়ে দেয়, মন কেড়ে নেয়। রঙিন প্রজাপতিরা উড়ছে ফুলের চারদিকে। শীতল শরীর-জুড়ানো সামুদ্রিক বাতাস, বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে ওরা। ভুলেই গেছে প্রফেসর ওয়াইয়ের কথা।
| হঠাৎ মহুয়া থমকে দাঁড়াল। অবাক কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ছেলে-মানুষের মত, মাগো মা! তুমিও এখানে আছ! এমন করে চেয়ে আছ কেন আমার দিকে? এসো কাছে এসো, বিস্কুট খাবে?’
ঘাড় ফিরিয়ে শহীদ দেখল মহুয়া একটা সাদা খরগোশের সাথে আলাপ জমাবার চেষ্টা করছে। হেসে উঠে বলল, গুড! তোমার নীতির প্রশংসা করি।’
মহুয়া ঝাঝাল কণ্ঠে আক্রমণ করল শহীদকে, দিলে তো ভয় খাইয়ে বেচারীকে। তোমার হেঁড়ে গলা শুনে পালিয়ে গেল।
হেঁড়ে গলা আমার? বলতে পারলে কথাটা তুমি?’
‘পুরুষ মানুষের গলা মেয়েদের তুলনায় হেড়ে নয় তো কি! যাকগে আমার নীতির প্রশংসা করছিলে যেন! কিসের নীতি?
| শহীদ বলল, এই দ্বীপের বাসিন্দাদের সাথে, আই মীন, জীবজন্তু জানোয়ারদের সাথে সহাবস্থানের নীতিই গ্রহণ করতে হবে। বন্ধুত্ব চাই আমরা। একদিন দু’দিনের ব্যাপার তো আর নয়। বাকি জীবনটা আমাদেরকে কাটাতে হবে এখানেই। সুতরাং•••|
| মহুয়া সহাস্যে বলল, ভয় দেখাতে চেষ্টা করছ তুমি? জি না, হুজুর, ভয় আমি আর পাচ্ছি না। বিশ্বাস করো, সভ্য দুনিয়ায় ফিরে যেতে চাই না আর আমি। বড় ভাল লাগছে, এখানকার পরিবেশ। তুমি আর আমি বাকি জীবনটা এখানে কাটিয়ে দেব-মন্দ কি! শহরের কোলাহল, যান্ত্রিক শব্দ, কল-কারখানার দুষিত ধোয়া, চোর ডাকাতের উপদ্রব, যুদ্ধের বিভীষিকা-কিছু নেই এখানে। স্বর্গের চেয়ে কম কিসে এই পরিবেশ?
হাঁটতে হাঁটতে ওরা যতই এগোচ্ছে সমুদ্রের গর্জন ততই কাছে এগিয়ে আসছে। ঝোঁপঝাড়, গাছপালাকে পাশ কাটিয়ে হাত ধরাধরি করে আরও খানিক এগিয়ে বালুকাবেলায় স্পেীচ্ছল ওরা। পায়ের জুতো খুলে আরও এগিয়ে গেল।
লুটিয়ে পড়ছে ওদের পায়ের কাছে ভারত মহাসাগর! সাগরের কুল? কিনারা নেই। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু অথৈ জলরাশি। ঢেউয়ের পর কেউ একটার একটা অবিরাম ছুটে আসছে, বালুকাবেলায় ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়ুই, li৬, আসছে ওদের পায়ের দিকে। ফেনায় ফেনায় সামনের দিকটা সাদা হয়ে *1* গ সম্মোহিত দৃষ্টিতে দেখছে ওরা মহাসাগরের মহিমা।
৫–কুয়াশা ৪৭
শহীদের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে মহুয়া বলল, ‘শহীদ। যাব না, এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যাব না আমরা।’
মুচকি হাসল শহীদ। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের গভীর বনভূমির দিকে চেয়ে রইল ।
কি দেখছ?
শহীদ বলল, এই গভীর জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী নিশ্চয়ই আছে, মহুয়া। আমাদেরকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।
সুপারি আর নারকেল গাছগুলোর মাথার দিকে তাকিয়ে শহীদ আবার কথা বলে উঠল, ডাব খাবে?
মহুয়া সমুদ্রের দিকে চেয়ে আছে। অন্যমনস্কভাবে বলল সে, ‘খাব।’
বনভূমিতে ঢুকে একটা নারকেল গাছের কাছে এসে দাঁড়াল শহীদ। মহুয়াও এসেছে ওর সাথে। বুনো ফুলে অস্তগামী সূর্যের কিরণ পড়েছে। ঘুরে ঘুরে ফুল ছিঁড়ছে মহুয়া। শহীদ গাছে চড়তে শুরু করল। বলল, ‘বুঝলে মহুয়া, ডাব পাড়াই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। ওপরে উঠে দ্বীপের চারদিকটা একবার দেখে নিতে চাই। রাতটা নিরাপদে কাটাবার জন্য একটা ভাল জায়গা পেতে হবে।’
মহুয়া কথা বলছে না কেন? গাছ বেয়ে শহীদ প্রায় সাত-আট হাত উপরে উঠে গেছে। নিচের দিকে তাকাল ও।
ঠিক তখনই চোখ বন্ধ করে চারদিক সচকিত করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করতে শুরু করল মহুয়া।
চিন্তা করার কোন অবকাশই পেল না শহীদ। একটা কদাকার বাইসন মাথা নত করে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে মহুয়ার দিকে। পেশীবহুল প্রকাণ্ডদেহী হিংস্র জন্তুটার ঘাড়টা দেহের তুলনায় মস্ত বড়। ছোট্ট লেজটী উপর দিকে তুলে সগর্জনে ছুটে আসছে। রক্ষে নেই মহুয়ার। এক ধাক্কাতেই তার শরীরের হাড়-পঁজরা গুড়ো করে ফেলবে।
চিন্তা করার কোন অবকাশই পেল না শহীদ। লাফ দিল ও নারকেল গাছের উপর থেকে। মহুয়ার সামনে পড়ল ও। তাল সামলে সিধে হয়ে দাঁড়িয়েই ধাক্কা দিল মহুয়াকে। ছিটকে সাত হাত দূরের একটা ঝোঁপের উপর গিয়ে পড়ল মহুয়া।
ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। স্বয়ং যমদূত এসে গেছে সামনে। লেজারগানটা পকেটেই রয়েছে শহীদের। কিন্তু সেটা বের করার সময় পাওয়া গেল না।
দ্রুত একটু ডান দিকে সরে গেল শহীদ। মহুয়াকে দেখতে না পেয়ে হিংস্র বাইসনটা শুরু গুরু মেঘ ডাকার মত গম্ভীর স্বরে আক্রোশ প্রকাশ করল শহীদের প্রতি। শহীদ ছুটতে শুরু করল। | ছুটছে শহীদ। চেয়ে আছে পিছন দিকে। বাইসনটার দৃষ্টি নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে চাইছে ও। উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে ওর। বাইসনটা বিপুল বেগে ছুটে আসছে পিছু পিছু।
মহুয়াকে বাঁচাবার জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছে শহীদ। বনভূমির উপর দিয়ে ঝোঁপঝাড় টপকে তীরবেগে ছুটছে ও। পিছন পিছন ছুটে আসছে মহাশক্তিশালী খেপা বাইসনটা । গোঁয়ার জন্তুটা নাছোড়বান্দা। কেন রেগে গেছে কে জানে। শহীদকে
৬৬
ভলিউম ১৬
তো না মারতে পারলে যেন শান্তি নেই ওর। শহীদের পিছু পিছু ঝড়ের বেগে ছুটছে সে।
মাত্র আড়াই কি তিন হাত পিছনে চলে এসেছে বাইসনটা। সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলার হুশ হুশ শব্দ পাচ্ছে শহীদ। সামনে একটা নালা দেখল ও। ঢালু হয়ে গেছে জায়গাটা। মাঝখানে পানি জমেছে । তারপর আবার উঁচু হয়ে গেছে মাটি। লাফ দিয়ে নালাটা পেরিয়ে গেল ও। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাবার সময়ও নেই।
গতি একটু শ্লথ হলেই বিপদ। বাইসনের তীক্ষ্ণ শিঙের গুতোয় পটল তুলতে হবে।
| হাঁপিয়ে গেছে শহীদ। ঘামে ভিজে গেছে ট্রাউজার, শার্ট। হঠাৎ ও টের পেল, বাইসনের নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর । কিন্তু ঝোঁপঝাড় ভেঙে ধাওয়া করে আসছে ঠিকই। তবে, পিছিয়ে পড়েছে একটু। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শহীদ। পিছিয়ে পড়ার কারণটা বুঝতে পারল ও। এঁকেবেঁকে ছুটেছে এতক্ষণ ও, সেটাই কারণ।
সামনেই একটা ফাঁকা মত জায়গা। শহীদ হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বাইসনটার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। পারছে না আর। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত ছুটেছে এতক্ষণ। দম ফুরিয়ে এসেছে। এবার দৌড়ে কঁকি দেয়া নয়, ফাঁকি দিতে হবে কৌশলে । | একটা গাছকে ঠিক পিছনে রেখে বাইসনটার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে শহীদ। ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে কদাকার জন্তুটা। এসে পড়েছে। আর এক সেকেণ্ড, গুতো মেরে শহীদের দেহটা রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে পরিণত করবে এবার। গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে চ্যাপটা হয়ে যাবে।
আচমকা বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন শহীদের শরীরে। চোখের পলকে লাফ দিয়ে সরে গেল ও এক পাশে।
শহীদের পেট লক্ষ্য করে মস্ত ঘাড় ফুলিয়ে ছুটে আসছিল বাইসনটা। শেষ মুহূর্তে শহীদ সরে গেল, দিক পরিবর্তনের সময় পেল না জন্তুটা।
“ ইউক্যালিপটাস গাছের মসৃণ কাণ্ডের গায়ে গুতো মারল বাইসনটা। ঝড়ের গতি রুদ্ধ হলো। কেঁপে উঠল সুউচ্চ ইউক্যালিপটাস গাছটা। শুকনো পাতাগুলো খসে পড়ল সেই কম্পনে।
| গাছের কঠিন কাণ্ডের সাথে ধাক্কা খেয়ে বাইসনের মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। গাছের গোড়ায় উল্টে পড়েছে প্রকাণ্ড দেহটা। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। হাপরের মত, ঘন ঘন বুকটা উঠছে আর নামছে শহীদের। সশব্দে হাঁপাচ্ছে ও। পকেট থেকে মিনি লেজারগানটা বের করল ও। লেজারগানের সাথে বেরিয়ে এল রুমালটা।
মারা যাবে জন্তুটা! বড় কষ্ট পাচ্ছে। যন্ত্রণা থেকে ওটাকে দ্রুত মুক্তি দেবার জন্য লেজারগানটা তুলল শহীদ! লেজারগানের অদৃশ্য রে বাইসনটাকে অদৃশ্য করে দিল মুহূর্তে। ক্লান্তিতে ঘাসের ওপর বসে পড়ল ও। শরীরটা যেন জ্বলছে প্রচণ্ড
গরমে। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ও চোখ দুটো বন্ধ করল । কুয়াশা ৪৭
৬৭
মহুয়া একা কি করছে কে জানে। কথাটা মনে হতেই চোখ মেলে তাকাল ও আরে, কি ব্যাপার? ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? কিসের ওপর মাথা রেখে শুয়েছে ও? নড়ছে কেন•••? মাথা তুলে সিধে হয়ে বসল শহীদ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই ছানাবড়া হয়ে উঠল চোখ দুটো সর্বনাশ!
সম্মোহিতের মত চেয়েই রইল শহীদ। নড়াচড়ার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে ও। ঘাসের উপর হলুদ ডোরাকাটা প্রকাণ্ড একটা বাঘ শুয়ে আছে পাশ ফিরে! এতক্ষণ বাঘটার পেটেই মাথা রেখে শুয়েছিল ও। | নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল শহীদ। ডান হাতে শক্ত করে ধরা লেজারগানটা। দাঁড়াল বটে ও, কিন্তু পা বাড়াল না।
বাঘ ওটা, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ কেমন বাঘ? চোখ দুটো অমন গাঢ় নীল কেন? নীল চোখের মাঝখানে সাদা মণি। চেয়ে আছে শহীদের দিকে। যেমন শুয়েছিল তেমনি শুয়ে আছে। এ কেমন বাঘ? মাথাটা দেহের তুলনায় কি একটু ছোট? ঠিক বুঝতে পারছে না শহীদ। হাতের তালু দুটো ঘামছে ওর।
আরও একটা বিদঘুঁটে ব্যাপার চোখে পড়ল শহীদের। বাঘটার গায়ের রঙের সাথে মাথার দিকের রঙের পার্থক্য রয়েছে বেশ একটু। গলা থেকে উপরের অংশটা ডোরাকাটা হলুদ হলেও হলুদ রঙটা এখানে অনেক বেশি গাঢ়। কেউ যেন তুলি দিয়ে। রঙ করে দিয়েছে সযত্নে।
খুঁটিয়ে আরও কয়েক মুহূর্ত দেখার পর একটা ভুল ভাঙল ওর। বাঘটা জেগে নেই। ঘুমুচ্ছে চোখ মেলে। বঘিটার চোখ রয়েছে কিন্তু চোখের পাতা নেই।
অতি সন্তর্পণে পা বাড়াল শহীদ। বুকের ভেতর সারাক্ষণ হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। ভয় যত না পেয়েছে তার চেয়ে বেশি বিমূঢ় হয়ে পড়েছে ও। এ কেমন রহস্য! | কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারছে না শহীদ। নিঃশব্দে বাঘটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল ও, কুঁকে পড়ল নিচের দিকে। যা আছে কপালে, সন্দেহ নিরসনের জন্য বরাজের মাথাটা পরীক্ষা কবে সে। ভয় কি, ডান হাতে তো ধরাই রয়েছে
লেজারগান।
বাঘের মাথায় আঙ্গুল দিয়ে প্রথমে মৃদু একটা টোকা দিল শহীদ। তারপর বেশ জোরে আবার টোকা মারল। প্রথমে আস্তে, তারপর বেশ জোরে। টং, টং, করে শব্দ হলো দুবার।
| ধাতব পদার্থ! বাঘের মাথাটা ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। শহীদের হাত-পা। এ কি ব্যাপার! এ কি রহস্য! কে•••কার কাণ্ড এটা! এই দ্বীপে কারা আছে।
‘আমাকে বিরক্ত করার কোন মানে হয় না। প্লীজ, লেট মি স্লীপ, মাই ফ্রেণ্ড!
আত্মা খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে শহীদের। কে বলল কথাগুলো। বাঘটা? না আর কেউ?
কম্পিত পায়ে সরে যেতে লাগল শহীদ। এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। কিন্তু কথা বলল কে? আশপাশে দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিল শহীদ। কেউ নেই। অন্তত
৬৮
ভলিউম ১৬
কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেমন যেন দিশেহারার মত হয়ে উঠেছে ও, তাই কথাগুলো কোনদিক থেকে ভেসে এল ঠিক বুঝতে পারেনি।
বাঘটার কাছ থেকে বিশ-পঁচিশ গজ দূরে এসে দাঁড়াল শহীদ। বিশ্বাস করতে পারছে না সে ঘটনাটা। ও কি স্বপ্ন দেখেছে খানিক আগে? রাইসনের তাড়া খেয়ে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছিল। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েনি তো? ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেনি তো? | দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল শহীদ। মহুয়া একা কি করছে কে জানে। এ বড় ভয়ঙ্কর দ্বীপে প্রফেসর ওয়াই পাঠিয়েছে ওদেরকে। প্রতি মুহূর্ত চোখ কান খোলা রাখতে হবে। বিপদ যে-কোনদিক থেকে কি রূপ নিয়ে আসবে কেউ তা জানে না।
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল শহীদ। হাঁটতে হাঁটতে ওর মনে হলো, পথ ভুল করেনি তো? মহুয়াকে কোনদিকে রেখে এসেছিল সে?
এমন সময় গোধূলির নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙে দিল একটি শব্দ।
পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। অস্ত গেছে সূর্য। চারদিকে ছায়া-শীতল একটা ভাব। শব্দটা রিভলভারের। গুলির শব্দ শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিল শহীদ হন হন করে হাঁটছে আবার।
| মহুয়াকে রিভলভারটা দেবার সময় শহীদ বলে দিয়েছিল পথ হারিয়ে ফেললে ফাঁকা আওয়াজ করতে। মহুয়া সম্ভবত নিজের অবস্থান ওকে জানাবার জন্যই গুলি
“ কিংবা, হয়তো, বিপদে পড়েছে মহুয়া। কিন্তু অশুভ কোন কথা ভাবতে চায় না শহীদ। এমনিতেই ইতিমধ্যে মাথাটা ভারি হয়ে উঠেছে নানা রকম দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায়।
মহুয়াকে যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানে তাকে পেল না শহীদ। এদিকে সন্ধ্যা নামছে, চারদিক আঁধার হয়ে আসছে দ্রুত। নানা অশুভ কথা মনে পড়তে লাগল। ওর। কোন বিপদে পড়েনি তো মহুয়া? এই দ্বীপে তারা ছাড়াও মানুষ থাকতে পারে। মানুষ হিসেবে তারা কেমন তাও জোর করে কিছু বলা যায় না। গলা ছেড়ে মহুয়ার নাম ধরে ডাকতে গিয়েও ক্ষান্ত হলো শহীদ। যদি মহুয়া সত্যি বিপদে পড়ে থাকে তাহলে তার কাছ থেকে কোন সাড়া তো পাওয়া যাবেই না, বরং শত্রুদেরকে
জানিয়ে দেয়া হবে নিজের অবস্থান।
সমুদ্রের কিনারায় চলে গেল শহীদ। আকাশে মেলা বসছে নক্ষত্রদের, একটা একটা করে ফুটছে তারা। কেন যেন, সমুদ্রের গর্জনের সাথে ওর বুকটা হু হু করে উঠল। হাঁটতে হাঁটতে আবার থামল ও।
আবার গুলির শব্দ। এবার কাছাকাছি থেকেই এসেছে আওয়াজটা। বালুকাবেলা ছেড়ে দ্রুত পা বাড়াল শহীদ। বনভূমির ভিতর প্রবেশ করে খানিকটা এগিয়েই থামল ও। মহুয়ার গলা।
‘আরও বাঁ দিকে এসো। আমি এই বটগাছটার উপর রয়েছি।’ কুয়াশা ৪৭
দ্রুত গাছে এল শহীদ। মহুয়ার বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না ও। প্রকাণ্ড একটা বটগাছ বেছে নিয়েছে মহুয়া। এমন চওড়া একটা ডালে বসে আছে ও যে তাতে অনায়াসে দুজন পাশাপাশি শুয়ে পড়া চলে।
‘তোমার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে••• শহীদ, বাইসনটা•••।’
‘খুব বুদ্ধির কাজ করেছ। মেরে ফেলেছি ওটাকে। শহীদ বলল। কিন্তু যান্ত্রিক মাথাওয়ালা বাঘটা সম্পর্কে কোন কথা বলল না ও।
মহুয়া শহীদের একটা হাত ধরে বলল, “যা ভয় পেয়েছিলাম না। এদিকে শহীদ, এই দ্বীপে বড় রহস্যময় কাণ্ড ঘটছে, জানো? নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন ঘটনা আছে।’
কাণ্ড ঘটছে মানে? ঘটনা আছে-কিসের মধ্যে?
মহুয়া দম বন্ধ করে চাপা উত্তেজনায় বলতে শুরু করল, “এই গাছে চড়ে তোমার খোঁজে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম কি জানো?’
কি?”
মহুয়া বলল, তুমি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ভুল দেখিনি।
“কি দেখেছ বলোই না ছাই?’
‘পাঁচিল। প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু একটা পাঁচিল। ওই দিকে, মানে পুব দিকের কথা বলছি আমি। পঁচিলের ওপারে কি আছে দেখা যায় না এখান থেকে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পাচিলের খানিকটা অংশ দেখেছি আমি। পঁচিলের ওপর কাটাতারের বেড়াও আছে।
হুঁ।’ গম্ভীর হয়ে উঠল শহীদ।
একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছে মহুয়া। এই দ্বীপে তাহলে মানুষ আছে? কারা তারা? পাঁচিল কেন? এই দ্বীপে কি করছে মানুষগুলো? তারা কি ওদেরকে বিরূপ চোখে দেখবে, শত্রু বলে মনে করবে? | চিন্তায় মগ্ন শহীদ। মহুয়ার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারল না ও। সংক্ষেপে বলল-জানি না।
কি হলো তোমার? এমন চুপচাপ হয়ে গেলে যে? কি ভাবছ?’
শহীদ বলল, না, কি আর ভাবব। ভাবছি পাঁচিলটার কথা। ভুল দেখোনি তো, মহুয়া?’
মহুয়া অভিমান ভরে বলে উঠল, আমাকে তুমি কি মনে করো? পরিষ্কার না দেখে তোমাকে এত জোর দিয়ে বলতে পারি?
প্রসঙ্গ বদলাবার ছলে শহীদ বলল, কাল সকালে দেখে আস্ব পাঁচিলটা। বাদ দাও এখন পাচিলের কথা। খিদে পায়নি তোমার?
| না। তোমার?’
শহীদ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল আবার। মহুয়ার কথা ওর কানেই যায়নি। অনেকক্ষণ পর মহুয়ার কথায় ওর ধ্যান ভাঙল। অন্ধকার আর তেমন গাঢ় নেই। চাঁদ উঁকি দিচ্ছে পাতার ফাঁক দিয়ে। জানতে চাইল ও, কিছু বললে, মহুয়া?’
৭০
ভলিউম ১৬
‘হ্যাঁ। কিছু হয়েছে তোমার, শহীদ। বলবে না আমাকে?
জোর করে হাসল শহীদ। সান্তনা দেবার জন্য বলল, “কিছুই হয়নি, পাগলী । ভাবছি অনেক কথা।’
| ‘দাদার কথা ভাবছ বুঝি?
শহীদ বলল, “হ্যাঁ। সে হয়তো মহাশূন্যের কোন অচেনা গ্রহে পৌঁছে গেছে-কিংবা এখনও তার দেহের অণুগুলো আলোক গতিতে ছুটছে মহাশূন্যের পথ ধরে। কি জানো মহুয়া, কুয়াশার জন্যে তেমন দুশ্চিন্তা করি না আমি। আমি জানি, বিপদ যতই ভয়ঙ্কর হোক, সাধ্যের মধ্যে থাকলে কুয়াশা সামলে নেবে। বেচে থাকার যোগ্যতা বা ক্ষমতা কোনটারই তার অভাব নেই। প্রফেসর ওয়াই তাকে যত বড় বিপদের মাঝখানেই ছুঁড়ে দিক, কুয়াশাও তো তার চেয়ে কম না কোন কিছুতে। কুয়াশা হাজার হোক, প্রফেসর ওয়াইয়ের প্রভু তো ছিল এককালে!’
“তাই নাকি? কই, একথা তো কোনদিন দাদা আমাকে বলেনি।
শহীদ বলল, “বলেনি সে কাউকেই। এমনকি সব কথা সে আমাকেও বলেনি। তবে যতটুকু বলেছে তার সাথে কিছু অনুমান যোগ করে আসল কথা বুঝে ফেলেছি আমি। আমার অনুমান মিথ্যে হতে পারে না। প্রফেসর ওয়াই, কুয়াশাকে যমের চেয়েও বেশি ভয় করে। কেন?’
কেন বলো তো?’ | শহীদ হঠাৎ নিজেকে সামলে নিল। বলল, না, থাক, মহুয়া। এসব কথা আলোচনা করা ঠিক হচ্ছে না। কুয়াশা আমাকে বলেছিল, কাউকে যেন এ সম্পর্কে আমি কোন কথা না বলি। মোট কথা, কুয়াশার জন্য আমি খুব একটা দুশ্চিন্তা করছি
। আমি ভাবছি কামালের কথা। ওর সাথে ডি. কস্টা আছে–তার কথা। আর ভাবছি মি. সিম্পসনের কথা। ওদের কপালে যে কি ঘটছে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন। ওদেরকে সাহায্য করার কেউ নেই! কুয়াশার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি হয়তো পারতাম কিন্তু এই দ্বীপ থেকে কবে মুক্তি পাব আদৌ মুক্তি পাব কিনা কে জানে!
| ছোট ভাইয়ের মত কামালকে কত বকেছি, কত আদর করেছি–আর দেখতে পাব না ওকে একথা ভাবলে কান্নায় বুকটা ফেটে যেতে চায়…’ রুদ্ধ হয়ে এল মহুয়ার কণ্ঠস্বর।
চুপ করে রইল ওরা। খানিক পর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল মহুয়া। শহীদ বলল, ‘খাবে এবার খেয়ে নিয়ে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
‘তুমি?
শহীদ বলল, আমি জেগে থাকব। পাহারা দিতে হবে সারারা।
মহুয়া নীরব গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেন, কোন রকম বিপদের আশঙ্কা করছ। নাকি তুমি?
শহীদ বলল, তা ঠিক না। তবে বলাও তো যায় না। অচেনা জায়গা, কি ঘটে ঘটে বলা যায়?
মহুয়া বলল, তাহলে আমিও জেগে থাকব।’ কুয়াশা ৪৭
খাবার প্যাকেটে পাওয়া গেল সুস্বাদু খাদ্য সামগ্রী। সিদ্ধ ডিম, বাটার টোস্ট, জেলী, পনির, মধু, কাজু বাদাম, আপেল এবং ব্র্যাণ্ডিভরা চকোলেট। এদিক থেকে কিছুমাত্র কার্পণ্য করেনি প্রফেসর ওয়াই। খাওয়া শেষ হতে মহুয়া বলল, দ্বিতীয় প্যাকেটটা কাল সকালের জন্য রইল। তারপর!’
তারপর বুনো ফল আর ডাবের পানি। | মিষ্টি সুরে হেসে উঠল মহুয়া বলল, তাই বা মন্দ কি। তবে ভাগ্য ভাল হলে পাচিলের ওপারের মানুষগুলোর সাথে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে••• {‘।
‘পাচিলের ওপারে মানুষ না-ও থাকতে পারে, মহুয়া। মনে নেই, প্রফেসর ওয়াই বলেছিল–জনমানবহীন একটা দ্বীপে পাঠাচ্ছি তোমাদেরকে?
কিন্তু মানুষ না থাকলে পাচিল এল কোথা থেকে? চুপ করে রইল শহীদ। মহুয়া একই প্রশ্ন দ্বিতীয়বার করতে ও শুধু বলল, ‘জানি ।
খানিকক্ষণ থেমে থাকার পর মহুয়া বলল, “মানুষ যদি সত্যি না থাকে তাহলে তো আরও ভাল। কেউ বিরক্ত করবে না আমাদেরকে। দুজনে বেশ আনন্দেই থাকব। জায়গাটা জঙ্গলে ভরা হলেও বাইসন ছাড়া অন্য কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ার নেই, তাই না? রাত তো বেশ হয়েছে, থাকলে এতক্ষণে বাঘের গর্জন আর হায়েনার কুৎসিত হাসিতে কেঁপে উঠত চারদিক, কি বলো?’ | কোন মন্তব্য করল না শহীদ। অনেকক্ষণ কেটে গেল। একটা সিগারেট ধরাল শহীদ। গভীর চিন্তায় মগ্ন? এক সময় মহুয়ার কথা স্মরণ হতে বলে উঠল, “তোমার শাড়ির আঁচলটা দাও দেখি আমাকে। গাছের সাথে বেঁধে রাখি। তা না হলে পড়ে যেতে পারো।’
ঘুম আসছে না যে। জেগে থাকে। যদি ঘুমিয়ে পড়ো, তাই বলছি। শুয়ে পড়ো দেখি।’
আপত্তি করল না মহুয়া। গাছের সাথে মহুয়াকে শাড়িটা দিয়ে বেধে দিল শহীদ। তার পাশে নিজেও চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে চাঁদের অংশ বিশেষ। সেদিকে তাকিয়ে কুয়াশার কথা মনে পড়ল ওর। মহুয়াকে, আসলে সান্তনা দিয়েছে সে। কুয়াশার বেঁচে থাকার সম্ভবনা যে কত ক্ষীণ তা সে ভাল করেই জানে। ড. কূটজের মহাকাশযান যদি বিধ্বস্ত হয়েই থাকে, সে গ্রহে অক্সিজেন থাকবে তার কি নিশ্চয়তা?
একটা রাত জাগা পাখি গাছের উপর দিয়ে তীক্ষ্ণস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। শহীদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মহুয়ার দিকে, ঘুমালে নাকি?’
. একটা হাত খামচে ধরল শহীদের কাঁধের মাংস। চাপা উত্তেজনায় কাঁপছে। মহুয়ার নিচু গলা, শুনছ!
পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে শহীদের মাংসপেশী। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে ও। কারা যেন কথা বলছে।
বলো কি হে। ইউ হ্যাভ সীন উইথ ইওর ওউন আইজ! মোস্ট ইন্টারেস্টিং। তা, কথাবার্তা কিছু হলো তোমার সাথে লোকটার?
ভলিউম ১৬
৭২
দ্বিতীয় কন্ঠস্বরটাও প্রথমটার মত কেমন যেন ঘরঘরে যান্ত্রিক বলে মনে হলো, ঘুমের দরকার ছিল তখন আমার। তাই আলাপ করার কথা ভাবিনি।
প্রথম কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “মন্দ নয়, কি বলো? এরপর দেখা হলে আলাপ করো । খবর দিতে ভুলো না যেন আমাকে। তা, মাস্টারদেরকে জানিয়েছ কথাটা!
না। মাস্টাররা তো আমাদের কথা ভুলেই গেছে। দেখা করারই সুযোগ পাই
দ্বিতীয় কণ্ঠস্বরটা বলল, ‘মিথ্যে বলোনি। মাস্টাররা আর আমাদের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।’
শহীদ নিঃশব্দে উঠে বসল। নিচের বনভূমিতে চাঁদের আলো আর ঘন কালো ছায়া মিলেমিশে একাকার। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। কণ্ঠস্বর দুটের অবস্থান লক্ষ্য করে নির্দিষ্ট একদিকে চেয়ে রইল শহীদ। উঠে বসেছে মহুয়াও। সে-ও তাকিয়ে আছে।
কাউকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। আর কোন শব্দও নেই! অনেক, অনেকক্ষণ কেট গেল। শিরদাঁড়া ব্যথা করতে শুরু করল শহীদের। উশখুশ করছে মহুয়াও।
| ‘শহীদ। বাঘ: চাপা গলায় বলে উঠল মহুয়া। শহীদ চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেল বাঘটাকে। বটগাছটার খানিকটা দূর দিয়ে হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে। একা নয়, আরও একটা বড়সড় জানোয়ার রয়েছে বাঘটার সাথে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করা কঠিন–এমন দৃশ্য কেউ কোনদিন দেখেছে! বাঘটার সাথে, পাশাপাশি
হাঁটছে একটা গরু।
দেখতে দেখতে বাঘ এবং গরুটা অদৃশ্য হয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।
শহীদ। শহীদ যেন অনেক দূর থেকে উত্তর দিল, ‘বলো।’ স্বপ্ন দেখলাম না তো?’ না।’
মহুয়া ঢোঁক গিলল, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার। বাঘ-বাঘের সাথে ওটা কি দেখলাম? মহুয়ার কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর, তা কি করে সম্ভব? বাঘ আর গরু..পাশাপাশি হাঁটছে…মনে হচ্ছে দুজন দুজনের বন্ধু…’
| এখানকার নিয়ম আলাদা। এখানে বাঘ-গরু একঘাটে জল খায়। খুব কড়া শাসন কিনা!’
‘শাসন? কাদের শাসন?
তা তো জানি না!’
মহুয়া বলে উঠল, “ঠাট্টা করছ তুমি! ভয় করছে না তোমার? অবাক লাগছে। না?’
শহীদ মৃদু হাসল, ‘ভয় করছে। অবাকও লাগছে। কিন্তু করার কিছু নেই।’ মহুয়ার প্রশ্নের শেষ নেই, কারা কথা বলছিল বলো তো?’ ‘দেখতে পাইনি।
মহুয়া চিন্তিত, মানুষ তাহলে সত্যি আছে। ওরা কি আমাদেরকে কুয়াশা ৪৭
শহীদ বাকা স্বরে বলল, মানুষ আছে? দেখেছ তুমি স্বচক্ষে?
মহুয়া বিরক্ত হলো, তার মানে? কি বলতে চাইছ তুমি? না দেখলে কি হয়েছে, পরিষ্কার শুনলাম কথাগুলো। বাংলায় কথা বলছিল ওরা, ইংরেজিও জানে…’
শহীদ বলল, হু। অনেক হয়েছে। দয়া করে এবার ঘুমাও। সকাল থেকে কাজে নামতে হবে।’
“কি কাজ? শহীদ সিগারেট ধরাল। ধোয়া ছেড়ে বলল, কাল সকালেই শুনো।’
রাতটা কাটল নিরুপদ্রবে। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙল মহুয়ার, ওমা! আমি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি!
শহীদ নামছে গাছ থেকে নামতে নামতেই জিজ্ঞেস করল, “সমুদ্র স্নান–রাজি! ‘শাড়ি পেটিকোট কই? চান করে পরব কি?
মুচকি হাসল শহীদ। বলল, বাকি জীবনটা এখানে নাকি থাকতে চাও বলেছিলে যে! একটা শাড়ি পেটিকোট কত দিন চলবে? গাছের ছাল বা পাতা দিয়ে তৈরি পোশাকই তো ব্যবহার করতে হবে।’
‘যখন হবে তখন হবে। আমি গোসল করব না। ‘কোরো না। আমি করব । দেখার ইচ্ছা থাকলে এসো।
সমুদ্র স্নান করল শহীদ। বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে রইল মহুয়া। ইচ্ছা হচ্ছিল ওরও ঝাঁপিয়ে পানিতে নামতে। কিন্তু ভিজে কাপড়ে থাকতে হবে সারাদিন ভেবে নিজেকে সামলে রাখল জোর করে।
দ্বিতীয় প্যাকেটের খাবার উদরস্থ করল ওরা। ফ্লাস্কের পানিও শেষ। মহুয়া বলল, চা হলে বড় ভাল হত।
শহীদ হাসল, সবচেয়ে ভাল হত নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারলে, কি বলো?’
শুকিয়ে গেল মহুয়ার মুখটা বাড়ির কথা মনে পড়ে যেতে। বলল, কি যে অবস্থা করছে লেবু আর সন্দেশ বাড়ির, আল্লাই জানে। শহীদ, সত্যি আমরা কি ফিরতে পারব না কোনদিন এখান থেকে?
ইতিমধ্যেই খারাপ লাগতে শুরু করেছে? এখনও তো তেমন অসুবিধের কারণ ঘটেনি। আজ দুপুর থেকেই মজাটা বুঝবে। খেতে হবে বুনো ফল আর ডাবের মিষ্টি পানি। | ‘না-না! শহীদ, আমি বাড়ি ফিরব!’ ঘনঘন মাথা নেড়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল মহুয়া।
* এই রে, এ যে দেখছি কেঁদে ফেলবে? অধৈর্য হয়ো না, দ্বীপের চারদিকটা দেখব আজ ভাল করে। দেরি নয়, পঁচিলটা কোন দিকে দেখেছিলে মনে আছে তো? পুব দিকে, কেমন? হাঁটো তাহলে । ভাগ্য ভাল হলে দেশে ফেরার একটা উপায় পেয়েও যেতে পারি।’
| ‘সত্যি? চলো তাহলে।
৭৪
ভলিউম ১৬
আশায়-আনন্দে খুশি হয়ে উঠল মহুয়া। কিন্তু শহীদ জানে, সেটা অত সহজ নয়। বাড়ি ফেরা তো দূরের কথা, প্রাণ বাঁচানো সম্ভব কি না সে ব্যাপারেও ঘোর সন্দেহ দেখা দিয়েছে ওর মনে।
এখানে আসার পর থেকে যা যা দেখেছে ও সেগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়নি শহীদ। সে জন্যেই ওর মনে অমন ভয় ঢুকেছে।
পাঁচ
পাঁচিলটা খুব বেশি দিনের পুরাতন নয়। প্লাস্টার খসে পড়েনি কোথাও, শ্যাওলাও জমেনি। প্রায় দুই মানুষ সমান উঁচু হবে। মহুয়ার কথাই ঠিক, কাটাতারের বেড়াও রয়েছে। শহীদের সন্দেহ হলো, তারের বেড়াটা ইলেকট্রিফায়েড। চুলেই মৃত্যু ।
‘কি ভাবছ? পঁচিলের ওপর উঠবে নাকি? তা আমি উঠতে দেব না তোমাকে!
মহুয়া শঙ্কিত। শহীদ বলল, ‘পাচিলে উঠব না এখন। উঠব ওই উঁচু গাছটায়। ভিতরটা দেখা দরকার।’
কি দরকার দেখার।
শহীদ বলল, বাহ্! ভিতরে কি আছে, কারা আছে জানতে হবে না? কৌতূহল মেটাব বলেই না এলাম।
মহুয়া বলল, তাহলে আমিও গাছে চড়ব।’
শহীদ সাহায্য করল মহুয়াকে। উঁচু একটা জাম গাছের উপর উঠল ওরা। পাচিলের ওপারেও গাছপালার সমারোহ। কিন্তু পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাকা একটা রাস্তা। গাছপালার ভিতর দিয়ে খানিকদূর গিয়ে বাক নিয়ে আরও ভিতর দিকে চলে গেছে। সবটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। ডান দিকের অনেকদূর ফাঁকা, কোন গাছপালা নেই। গম্ভীর হলো শহীদ। বহুদূর অবধি দেখা যাচ্ছে। ফাঁকা একটা মাঠের পর সাদা ধব ধবে একটা দোতলা বিল্ডিং, বেশ বড়সড়। উপর নিচে কম করেও বিশ-পঁচিশটা কামরা নিশ্চয়ই আছে।
রাস্তায় বা বাড়িটার সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার পাশে লাইট পোস্ট দেখা যাচ্ছে। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ গজ দূরের একটা গাছের দিকে দৃষ্টি পড়তে ভুরু
কুঁচকে উঠল শহীদের। গাছের ডালে বাধা রয়েছে কি ওটা? | চিনতে পারল জিনিসটাকে শহীদ। টিভি ক্যামেরা। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল শহীদ। দ্রুত চিন্তা করছে ও। টিভি ক্যামেরা–তারমানে বাড়ির ভিতর যারা আছে। তারা এই মুহূর্তে টিভিতে দেখতে পাচ্ছে ওদেরকে। | তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দূরের বাড়িটার দিকে চেয়ে রইল শহীদ! কেউ না কেউ বেরুবে
বাড়িটা থেকে, আশা করছে ও।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কাউকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেখল না শহীদ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ও, ভিতরে ঢুকতে হবে। তবে গা ঢাকা দিয়ে। টিভি ক্যামেরার চোখকে ফাঁকি দিয়ে।
‘শহীদ! মাগো! কী ওটা! চেঁচিয়ে উঠল মহুয়া। পড়ে যাচ্ছিল সে, চট করে
কুয়াশা ৪৭
৭৫
ধরে ফেলল শহীদ।
| মহুয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে পাঁচিলের ওপারের অপ্রশস্ত পাকা রাস্তাটার বাকের দিকে তাকাতেই গায়ের রক্ত বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেল শহীদের আতঙ্কের হিমশীতল স্পর্শ উঠে আসছে শরীর বেয়ে উপর দিকে।
রাস্তার বাঁকে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে মূর্তিমান একটা রাক্ষস। দেখতে হুবহু মানুষের মত হলেও আকারে মানুষের চেয়ে তিনগুণ বড়। হাত দুটো প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। মাথাটা সেই তুলনায় প্রকাণ্ড, সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে কামানো, মাথা থেকে। চোখ দুটো যথাস্থানে থাকলেও আকারে এক একটা বড় সাইজের আপেলের মত। চোখমুখের চেহারায় কোন বিশেষ ভাব ফুটে নেই। শুধু চেয়ে আছে ওদের দিকে। ওটার দিকে তাকালে অসমসাহসী যে-কোন মানুষের বুকের রক্ত পানি হয়ে যেতে বাধ্য।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে পকেট থেকে বের করে আনল শহীদ মিনি লেজারগানটা। পিছনের ক্যাপটা খুলতে গিয়ে লক্ষ্য করল, হাত দুটো কাঁপছে। ডায়ালের কাঁটা অ্যাডজাস্ট করে রাক্ষসটার দিকে মারণাস্ত্রটা তুলে ধরতেই মহুয়া চিলের মত ছো
মেরে কেড়ে নিল সেটা।
না? মেরো না ওটাকে, শহীদ। ওটার সাথে নিশ্চয়ই আরও অনেক আছে। ওদেরকে ঘাটাবার দরকার নেই। যেমন আছে তেমনি থাক। চলো, এখান থেকে সরে যাই আমরা। এদিকে আর না এলেই হবে!
তাকিয়ে আছে শহীদ রাক্ষসটার দিকে। | ‘মাগো, কী ভয়ঙ্কর!’ মহুয়া চোখ বন্ধ করে ফেলল। থর থর করে সর্বশরীর কাঁপছে তার।
শহীদের হঠাৎ মনে হলো, রাক্ষসটা হাসছে দাঁত বের করে। ঠিক তাই। হলুদ দাঁত দেখা যাচ্ছে দু’সারি। এক একটা দাঁত এক একটা দিয়াশলাইয়ের বাক্সের সমান। হঠাৎ রাক্ষসটা ঘুরে দাঁড়াল। শিরশির করে উঠল শহীদের গা। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে অতিকায় মানুষটা । এক একটা পদক্ষেপে দু’গজ পেরিয়ে যাচ্ছে অনায়াসে। চলমান পেশীবহুল মাংসের পাহাড়টা অদৃশ্য হয়ে গেল গাছ-পালার। আড়ালে।
একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠল যেন ওরা। পরস্পরের দিকে তাকাল। কারও মুখে কথা ফুটল না।
সারাটা দিন অস্বাভাবিক উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রইল শহীদ। চোখ-কান খোলা রেখে মহুয়াকে নিয়ে ঘুরে বেড়াল দ্বীপটার এদিক ওদিক। পঁচিলের পাশ ঘেঁষে হাঁটল। সমুদ্র থেকে শুরু হয়েছে পাঁচিলটা, শেষও হয়েছে সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে । দ্বীপটার মাঝ বরাবর এই পাঁচিল ।
দুপুরবেলা কলা আর জামরুল খেয়ে ক্ষুধার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে । রাতের জন্যও পেড়ে রেখেছে কিছু। ডাব প্রচুর। কিন্তু নির্ভেজাল পানির স্বাদ কি আর ডাবের পানিতে মেটে? কিন্তু উপায় কি, দুধের সাধ ঘোলেই মেটাতে হচ্ছে।
৭৬
ভলিউম ১৬
খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছে মহুয়া। শহীদ ওকে নানা ভাবে চেষ্টা করেছে সান্ত্বনা দেবার। অভয়দানের সব চেষ্টাই অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে। মহুয়ার আতঙ্ক এবং দুর্ভাবনা, কোনটাই দূর করতে পারেনি ও।
দুপুর গড়িয়ে যাবার পর শহীদ কথাটা পাড়ল । খেপে উঠল মহুয়া। এতটা আশঙ্কা করেনি শহীদ। ও ভেবেছিল মহুয়া ভয় পাবে, আপত্তি করবে ঠিকই কিন্তু মরিয়া হয়ে উঠবে না।
না-না-না-না। আমি তোমাকে কোন মতে যেতে দেব না! আমি বেঁচে থাকতে তুমি ওই পাঁচিলের ওপারে যেতে পারবে না। ওদিকে পা বাড়িয়ে দেখো, আমি আত্মহত্যা করব!
বোঝাতে চেষ্টা করল শহীদ, উত্তেজিত হয়ো না, মহুয়া। আমার যুক্তিটা শোনো। তারপর না হয়…।’
না! তোমার কোন কথাই আমি শুনতে চাই না। আমি জানি, আমার মন বলছে, পাচিলের ওপারে, যাওয়া মানে মৃত্যুর হাতে নিজেকে সপে দেওয়া । জেনেশুনে আমি তোমাকে মরতে যেতে দিতে পারব না।’
কথা বাড়াল না শহীদ। কিন্তু এরপর সন্ধ্যার খানিক আগে, প্রসঙ্গটা আবার তুলল ও। এবার অন্যভাবে বলল, মহুয়া, এই দ্বীপে আমরা নিরাপদ নই, একথা তো বিশ্বাস করো?
‘করি।’
‘পাচিলের ওপারে যারা আছে তাদের উদ্দেশ্য কি, ক্ষমতা কতটুকু কিছুই জানি না আমরা। হয়তো ওরা আমাদেরকে শত্রু বলে মনে করছে না। হয়তো…।’
‘শত্রু বা মিত্র, যাই মনে করুক, আমরা ওদিকে যাব না।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল মহুয়া।
| শহীদ শক্তভাবে বলল, তোমার কথাতে যুক্তি আছে, স্বীকার করি। জেনে শুনে বিপদের মধ্যে পা বাড়ানো বোকামি। কিন্তু, ধরো, ওরা যদি আক্রমণ করে? আমাদেরকে বন্দী করতে আসে?
‘যখন আসবে তখন দেখা যাবে। সহজে পারবে না ওরা আমাদের সাথে। আমাদের হাতে লেজারগান আছে।’
শহীদ বলল, “ঠিক বলেছ। লেজাগান থাকতে ভয় কি আমাদের। কিন্তু আমি ভাবছি এই দ্বীপ থেকে মুক্তি পাবার উপায় কি? জানো, আমার কি ধারণা পাচিলের ওপারেও সমুদ্র আছে, শেষ মাথায়! ও. পিকের সমুদ্রে থাকতে পারে কোন ইয়ট বা জাহাজ। যদি সেই ইয়ট বা জাহাজ দখল করতে পারি তাহলে দেশে ফেরা কোন সমস্যাই নয়। কিন্তু পাচিলের ওপারে না গিয়ে তো আর জাহাজ বা ইয়টের সন্ধান পাব না। লেজারগনি রয়েছে আমাদের কেউ বাধা দিতে এলেই তাকে খতম কমে ফেলতে পারব। তুমি ভেবে দেখো দেখি ভাল করে।
মহুয়ার সেই একই কথা, না। দেশে ফিরতে না পারি, না পরিব; তাছাড়া জাহাজ বা ইয়ট ওদিকে আছে কিনা তাই বা নিশ্চয় করে জানছ কিভাৰে তুমি?
‘থাকতেও তো পারে। কুয়াশা ৪৭
নাও তো থাকতে পারে? শহীদ হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “নাহ! তোমাকে বোঝানো আমার কম্ম নয়।’
সারাটা দিন হাঁটাহাঁটি করার ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ওরা। মানসিক শক্তির অপব্যয়ও কম হয়নি। মহুয়া সেই বটগাছের প্রশস্ত ডালে শুয়ে পড়ল সন্ধ্যার পরই। অনেক অনুরোধেও খাওয়া-দাওয়া করল না সে।
সিগারেটের প্যাকেট থেকে সর্বশেষ সিগারেটটা বের করে ধরাল শহীদ। মনে মনে ভেবে রেখেছে একটা কাজের কথা। কিন্তু কাজটা করা উচিত হবে কি হবে না ঠিক করতে পারছে না সে এখনও।
| ঘুমিয়ে পড়েছে মহুয়া। শাড়ি দিয়ে ডালের সাথে তাকে বেশ মজবুত করে বেঁধেও ফেলেছে শহীদ। কিন্তু মনস্থির করতে পারছে না ও এখনও। উচিত হবে কি মহুয়াকে একা এই গাছের উপর রেখে যাওয়া? যদি কোন বিপদ দেখা দেয়। যদি একটা বাঘ বা সাপ গাছে চড়ে আক্রমণ করে মহুয়াকে? কিংবা হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে যদি পাশে ওকে দেখতে না পেয়ে গাছ থেকে নেমে খুঁজতে চেষ্টা করে?
না, মহুয়াকে একা রেখে যাওয়াটা বোধহয় উচিত হবে না। জানিয়ে যেতে পারলে এক কথা ছিল–কিন্তু জানলে মহুয়া ওকে যেতে দেবে না। অথচ চুপচাপ বসে থাকাও উচিত হচ্ছে না। পাঁচিলের ওপারে কারা আছে, কি করছে তারা, কি করতে চায়–সব জানা দরকার। ওদের সম্পর্কে জানা না জানার উপরই নির্ভর করছে বাঁচা মরার সমাধান, পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণের সূত্র।
রাত বাড়ছে ক্রমশ। সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে দূর থেকে। ঝিঁঝি পোকার ডাক চারদিকে। অস্থিরতা অনুভব করছে শহীদ। কিছু একটা করা দরকার। এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা তার স্বভায় নয়।
শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে উঠল ও। ঝুঁকে পড়ে নক্ষত্র আর চাঁদের আলোয় আলোকিত মহুয়ার মুখটা দেখল। ঘুমাচ্ছে অঘোরে। নিঃশব্দে নড়ে উঠল শহীদ। নামতে শুরু করল গাছের উপর থেকে।
একটি কঠিন কণ্ঠস্বর বাধা দিল শহীদকে। “নেমো না!’ সুড় সুড় করে উঠে এল শহীদ মহুয়ার পাশে, তুমি ঘুমাওনি?” সংক্ষিপ্ত উত্তর মহুয়ার, না।’
রাতটা কেটে গেল। ভোরের দিকে চোখ দুটো আপনা থেকেই বুজে এসেছিল শহীদের। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসা অবস্থাতেই নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়েছিল ও। ঘুম ভাঙল একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। গাছের নিচে সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষসটা এসে দাঁড়িয়েছে। মহুয়া ভয়ে চিৎকার করছে•••
চোখ মেলে মৃদু হাসল শহীদ। পাশেই শুয়ে রয়েছে মহুয়া। ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। একটা প্রজাপতি বসেছে তার এলো চুলে।
কোথায় রাক্ষস? স্বপ্নই। মাথাটা ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকাল শহীদ ছাত করে উঠল বুক। ঠিক গাছের নিচেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
দাত বের করে হাসছে অতিকায় মানুষটা। গাছের কাণ্ডের উপর অস্বাভাবিক
৭৮
ভলিউম ১৬
লম্বা একটা হাত, অপর হাতটা কোমরে। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের ছটা ফুটে রয়েছে। মুখ হাঁ করল হঠাৎ, বিরাট একটা গহ্বরের সৃষ্টি হলো । গুরু গুরু মেঘের ডাকের মত শব্দ বেরিয়ে এল: ‘তোমাদেরকে নিতে এলাম। নেমে পড়ো।
প্যান্টের পকেটে শহীদের ডান হাতটা অতি সন্তর্পণে ঢুকে যাচ্ছে। মিনি লেজারগানটা বের করে আনল ও আলগোছে। ডায়ালের কাটা অ্যাডজাস্ট করাই আছে।
কে তুমি? কে পাঠিয়েছে তোমাকে?’ সাহসে বুক বেঁধে প্রশ্ন করল শহীদ! ‘আমি সুপারম্যান। আমাকে পাঠিয়েছেন ব্রেইনী মাস্টাররা। ‘ব্রেইনী মাস্টার? কারা তারা?
কণ্ঠস্বর তো নয়, যেন বাঁশ ফাটছে, তারা আমার স্রষ্টা। তারা অজেয়, অমর। তাদের মৃত্যু নেই, জরা নেই, শোক নেই, তাপ নেই, দুঃখ নেই, বোধ নেই! আছে। শুধু উচ্চাশা! তারা তোমাদেরকে চান। তোমাদের ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালাবেন।’ | কেঁপে উঠল শহীদের কণ্ঠ, তুমি ফিরে যাও, গিয়ে বলো, আমরা যাব না। আমরা তাদের হুকুমের চাকর নই।’
রাক্ষসটা বিকট শব্দে হেসে উঠল। বলল, তাঁরা চান তোমাকে আমার মত সুপারম্যানে রূপান্তরিত করতে। তাতে তুমিও উপকৃত হবে। ভয় থাকবে না তোমার, ঘৃণা থাকবে না। থাকবে না শোক, তাপ, দুঃখ, সুখ। অমর না হলেও মৃত্যু সহজে ঘায়েল করতে পারবে না তোমাকে। শত শত বছর বাঁচিয়ে রাখবেন রেইনী মাস্টাররা তোমাকে। আর তোমার স্ত্রী মিসেস মহুয়াকে নিয়ে ব্রেইনী মাস্টাররা নতুন ধরনের একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চান। ইতিমধ্যে হিংস্র জন্তুদের ওপর এই এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়েছে–অপারেশন সাকসেসফুল। কিন্তু এবার একজন মানুষের ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালানো হবে। মিসেস মহুয়ার দেহটা ঠিকই থাকবে, শুধু কেটে ফেলে দেয়া হবে গলা থেকে উপরের অংশ অর্থাৎ মুণ্ডুটা। ওই জায়গায় নতুন একটা যান্ত্রিক মুণ্ডু বসানো হবে। এসবই ব্রেইনী মাস্টারদের সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা মোতাবেক ঘটবে।’
| শহীদের চোখ জোড়া কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হাতের তালু ঘামছে। লেজারগানটা হাত থেকে পিছলে পড়ে যাবে মনে করে আরও জোরে মুঠো করে ধরল ও। হাতটা কাঁপছে থরথর করে। ঘাড় না ফিরিয়েও বুঝতে পারল ও মহুয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। খানিক পর পর সশব্দে হাঁপাচ্ছে সে।
“তোমাদের ব্রেইনী মাস্টারদেরকে গিয়ে বলে আমরা যাব না। পাগলদের পাগলামির শিকার হবার চেয়ে আমরা আত্মহত্যা করব!’ মহুয়া চেঁচিয়ে উঠল শহীদের পাশ থেকে।
রাক্ষসটা গম্ভীর হলো, ব্রেইনী মাস্টারদের এ ব্যাপারে কিছু করার নেই। তারা তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছেন।’
কে সে? রাক্ষসটা ভক্তিতে গদগদ হয়ে নামটা উচ্চারণ করল : প্রফেসর ওয়াই।’
শহীদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, “ও, সেই শয়তানটার কারসাজি তাহলে। যাও, তুমি তাকে গিয়ে জানাও আমরা যাব না।’
কুয়াশা ৪৭
৭৯
‘যেতে হবে। আমি তোমাদেরকে নিতে এসেছি।’ রাক্ষসটা অবলীলায় গাছের উপর উঠে আসছে।
শহীদ মিন জোরগানটা তুলে ধরল রাক্ষসটার দিকে। মহুয়া ওর ডান হাতটা চেপে ধরতে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল তার হাতটা ও। রাক্ষসটা উঠে আসছে। পৌঁছে গেছে প্রায়। হাত বাড়ালেই ধরতে পারে সে শহীদকে। লাল বোতামে চাপ দিল শহীদ। এক নিমেছে গাছের মোটা মোটা কয়েকটা ডালাসহ রাক্ষসটা বাষ্প হয়ে
উড়ে গেল উপর দিকে।
দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল মহুয়া।
আধ ঘণ্টা ধরে বোঝাল শহীদ মহুয়াকে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ যাত্রায় রাজি হলো সে। শহীদের যুক্তিগুলো অকাট্য। রাক্ষসটা নিহত হয়েছে জানার পর স্বভাবতই প্রফেসর ওয়াইয়ের সৃষ্ট ব্রেইনী মাস্টাররা পাল্টা প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে। কিন্তু সে সুযোগ তাদেরকে দেয়া উচিত হবে না মোটেই। আচমকা পাচিলের ওপারের শত্রুদেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করে ধ্বংস করতে হবে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে এখন। যারা আগে আক্রমণ করবে জয়ের সম্ভাবনা তাদেরই বেশি। ওদের সাথে লেজারগান রয়েছে, সুতরাং ভয়ের কিছুই নেই।
পাচিলের নিচে পৌঁছুল ওরা। চারদিক নিস্তব্ধ, থমথমে। মাত্র সকাল, সূর্য এখনও মাথার ওপর উঠে আসেনি। শীতল ঠাণ্ডা ছায়ার মধ্যে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ কান পেতে। পাশ থেকে মহুয়া কথা বলে উঠল, ব্রেইনী মাস্টাররাও বুঝি ওই রাক্ষসটার মত দেখতে?
ঠিক বলতে পারছি না। সম্ভবত অন্য রকম চেহারা হবে ওদের।
আরও ভয়ঙ্কর
উত্তর দিল না’শহীদ। কোথাও কোন শব্দ নেই। গাছে চড়ে ভিতরটা একবার দেখে নিলে কেমন হয়? কিন্তু তার দরকারই বা কি। লেজারগান দিয়ে পাচিলের খানিকটা গায়েব করে দিলেই তো হয়।
তাই করল শহীদ। কাটা তারের বেড়াসহ পাঁচিলের খানিকটা অং লেজারগানের অদৃশ্য আলোয় ভস্মে পরিণত হলো। মহুয়ার হাত ধরে পাচিলের ওপারে প্রবেশ করল শহীদ। বনভূমির মধ্যে দিয়ে পা বাড়াল দ্রুত। শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটছে ওরা। মুড়মুড় করে ভাঙছে শুকনো পাতা। চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে শহীদ। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে অপ্রশস্ত পাকা রাস্তা। থমকে দাঁড়াল শহীদ। একটা গাছের উপরের ডালে বাধা রয়েছে একটা টিভি ক্যামেরা। লেজারগান তুলল ও। টিভি ক্যামেরাটাকে ভস্মে পরিণত করে পা বাড়াল আবার।
আচমকা একটা গাছের ডাল থেকে বেরিয়ে এল ••চকচকে ইখতি দিয়ে তৈরি পূরেপিরি মানুষের মত দেখতে একটা রোবট।
শহীদ অবাক হলো না। ব্রেইনী মাস্টাররা রোবট বা যান্ত্রিক মানুষ জাতীয় কিছু হবে তা সে আগেই অনুমান করেছিল ।
আপাদমস্তক সম্পূর্ণ স্টেনলেস স্টীল দিয়ে তৈরি রোবট। পা দুটো ছোট ছোট।
ভলিউম ১৬
bo
লমার তুলনায় চওড়া একটু বেশি। জানালা-দরজাহীন কামরাটার কথা মনে পড়ল শহীদের। নিজেদেরকে ওখানে আবিষ্কার করার পর ছোট ছোট পায়ের চিহ্ন দেখেছিল ওরা।
রোবটটার পা দুটো মোটা পাইপের মত। হাঁটুর জয়েন্টগুলো ভ্রু দিয়ে আঁটা, সাদা দুধের মত প্লাস্টিকের আচ্ছাদন সেখানে। উরু দুটো পুরোপুরি গোলাকার। মোটা ইস্পাতের বেল্ট কোমরটাকে বেড় দিয়ে রেখেছে। নাভির জায়গায় লাল টকটকে একটা বোতাম দেখা যাচ্ছে। বুকটা মসৃণ, চকচকে। কোমরের মোটা বেল্টের ভিতর থেকে বাঁকা রড বেড়িয়ে এসেছে, রড়গুলোর অপর প্রান্ত গিয়ে প্রবেশ করেছে কাঠের ভিতর। গোটা বুকটা রডের জাল দিয়ে ঘেরা। গলার স্থান দখল করেছে কড়ে আঙুলের সমান মোটা তারের প্যাচানো কয়েল। তারের উপর তার জড়ানো, বেশ মোটা গলা।
রোবটের মুখটা চারকোনা। দুপাশে দুটো গর্ত, কিন্তু ঢাকনি নেই। সামনের, দিকটায় মুখের বদলে ইস্পাতের সরু তারের ঝাঁঝরি। নাকের জায়গায় একটা নীল প্লাস্টিকের লম্বা সুইচ। চোখ দুটোর মণি আছে, জবা ফুলের মত লাল, দামী পাথরের মত আলো ছড়াচ্ছে। চোখের পাতা নেই। কপালটা মসৃণ। মাথার মাঝখান থেকে দুটো মোটা তার বেরিয়ে এসে দুদিকে বেঁকে গিয়ে প্রবেশ করেছে। কানের দুটো.গর্তে। গালের দু’পাশে দুটো টর্চ লাইটের মত কাঁচ। কাঁচের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটা থেকে হলুদ, অপরটি থেকে গোলাপী রঙের উজ্জল আলেী। সারাক্ষণ জ্বলছে, নিভছে; জ্বলছে, নিভছে ।
শহীদ লক্ষ্য করল রোবটটার হাতে কোন অস্ত্র নেই। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে উঠল যান্ত্রিক মানুষ, ‘স্বাগতম! আমি যাচ্ছিলাম তোমাদেরকে নিয়ে আসার জন্য। তোমরা নিজেরাই এসেছ দেখছি। গুড়। এসো, আমার পিছু পিছু এসো।
শহীদের হাতে লেজারগানটা প্রস্তুত। অধৈর্য হয়ে উঠেছে মহুয়া। নিচু গলায় বলে উঠল সে, শেষ করছ না কেন এখনও!
শহীদ রোবটটার উদ্দেশ্যে বলল, “নিজেরাই এসেছি আমরা। নিশ্চয়ই অনুমান করে নিয়েছ? তোমাদের সুপারম্যানকে গায়েব করে দিয়েছি আমি।’
কাজটা ভাল করোনি। ও ছিল আমাদের একমাত্র সুপারম্যান। যাক, যা হবার হয়েছে। তোমাকেও আমরা সুপারম্যানে রূপান্তরিত করব। জানো নিশ্চয়ই, সুপারম্যান তৈরি করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটা কি? মানুষের শরীর হচ্ছে সেলের সমষ্টি। গ্রুপ অব সেলকে বলা হয় গ্ল্যাণ্ডস। সব গ্ল্যাণ্ডেরই কাজ হলো রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করা। এই রাসায়নিক পদার্থের কোনটার নাম হরমোন, কোনটার নাম আইয়োডিন। বহুল আলোচিত এইরকম একটি গ্ল্যাণ্ড রয়েছে গলায়। এটার নাম, জানো নিশ্চয়, থাইরয়েড। থাইরয়েড যে কেমিক্যালস তৈরি করে সেটার রঙ ভায়োলেট, সবাই সেটার নাম দিয়েছে আইয়োডিন। থাইরয়েড যদি অস্বাভাবিক বেশি পরিমাণে আইয়োডিন তৈরি করতে শুরু করে তাহলে মানুষ তার স্বাভাবিক আকৃতির চেয়েও অনেক বড় হয়ে উঠবে। থাইরয়েড সাধারণত তা করে না। তা না করুক। আমরা তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছি। থাইরয়েডকে বাতিল করে তার ৬-কুয়াশা ৪৭
জায়গায় আমাদের আবিষ্কৃত একটা গ্ল্যাণ্ড জটিল অপারেশনের মাধ্যমে সংযুক্ত করে দিই। আমাদের থাইরয়েড প্রচুর পরিমাণে আঁইয়োডিন সরবরাহে সক্ষম। ফল সহজেই বোঝা যায় যে মানুষের ওপর এই অপারেশন করা হয় সে দিনে দিনে বড় হতে থাকে। বাড়তে থাকে তার হাত-পা-মাথা-বাড়তে বাড়তে সাধারণ একটা মানুষের চেয়ে তিনগুণ, এমনকি চারগুণ বড় আকার লাভ করে সে। মোস্ট ইন্টারেস্টিং-তাই না? আমরা এই এক্সপেরিমেন্ট তোমার ওপর চালাব। তুমি ভাগ্যবান, মি. শহীদ। কংগ্রাচুলেশনস?’।
শহীদ লেজারগান তুলল। লাল বোতামটার ওপর ওর একটা আঙুল ছোঁয়ানো। কঠিন গলায় কথা বলে উঠল শহীদ, তোমরা শয়তান প্রফেসরের পাগলামির শিকার। তোমরা প্রকৃতির অবদান সৃষ্টির সেরা একটা মানুষকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছ। আমি তোমাদের এলাকায় ঢুকেছি আত্মসমর্পণের জন্যে নয়, তোমাদেরকে ধ্বংস করার জন্যে।
ছুটির ঘণ্টা যেমন দ্রুত তালে বাজে তেমনি দ্রুত ঘন্টাধ্বনি বেরিয়ে আসতে লাগল রোবটটার ভিতর থেকে। অর্থাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে সে। হাসি থামিয়ে সে বলল, “ওই একটা লেজারগান হাতে থাকায় এত বড় বড় কথা বলছ কেমন? কিন্তু ওটার কোনই মূল্য নেই, মি. শহীদ।
| ‘দেখাচ্ছি, মূল্য আছে কি না।
লাল বোতামটায় আঙুলের চাপ দিতে গেল শহীদ। কিন্তু একি! কে যেন ছো মেরে কেড়ে নিল তার হাত থেকে লেজারগানটা। ঘটনাটা এক সেকেণ্ডেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে গেল! বিদ্যুৎবেগে মহুয়ার হাতের দিকে তাকাল শহীদ। কিন্তু মহুয়ার হাত শূন্য, লেজারগানটা নেই তার হাতেও।
‘ওটা আমার হাতে!’ রোবটটা বলে উঠল যান্ত্রিক কণ্ঠে। কাল শহীদ। সবিস্ময়ে দেখল সত্যিই তাই, লেজারগানটা রোবটের বাঁ হাতে রয়েছে।
‘ম্যাগনেটের যাদু! বুঝতে পারছ তো? এবার, মি. শহীদ, সস্ত্রীক এগিয়ে এসো।’
মহুয়া উপস্থিত বুদ্ধি খাটাল এই সময়। শহীদের একটা হাত শক্ত করে ধরে ছুট মারল পিছন দিকে। মহুয়ার সাথে ছুটল শহীদও। বন্দী হওয়া চলবে না, পালাতে হবে এদের আওতা থেকে।
পিছন থেকে তেড়ে আসছে রোবটের দ্রুত তালের ঘণ্টাধ্বনি–অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে সে।
ছুটছে ওরা। ঝোঁপঝাড় টপকে খিচে দৌড়চ্ছে। কিন্তু পিছন থেকে ওদের দু’জনের কাঁধ চেপে ধরল দুটো লোহার মত শক্ত হাত। বাধা পেয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হলো ওরা। শহীদের একটা হাত নিজের ঘাড়ে গিয়ে উঠল। ঠাণ্ডা ধাতব পদার্থের
স্পর্শ অনুভব করল ও। | ঘাড় বাকিয়ে পিছন দিকে তাকাল শহীদ। রোবটটা দাঁড়িয়ে আছে সেই একই জায়গায়। এক পাও এগোয়নি সে। কিন্তু নিজে না এগোলেও বাড়িয়ে দিয়েছে তার হাত দুটো। দুই হাতের কব্জি দুটো স্ত্রীঙ-এর মাথায়, শ্রীঙ দুটো বেরিয়ে এসেছে
৮২
‘ভলিউম ১৬
দুই হাতের দুই পাইপের ভিতর থেকে। লম্বা প্রায় আট থেকে দশ গজ-শহীদ এবং মহুয়ার কাধ পর্যন্ত।
ছয়
ঢাকা ।
তিন বিঘা জমির মাঝখানে সদ্য তৈরি সুউচ্চ হালফ্যাশনের অট্টালিকাটা দাঁড়িয়ে আছে। অট্টালিকার চারপাশে উঁচু পাঁচিল। শহরের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী এমরান চৌধুরী এই অট্টালিকার মালিক। সম্প্রতি তিনি এটি নির্মাণ করেছেন।
অট্টালিকার আটতলায় এমরান চৌধুরী বাস করেন। এলিভেটর ছাড়া উপরে ওঠার আর কোন রাস্তা নেই। এমরান চৌধুরীর কড়া নির্দেশ, একটা পিঁপড়েও যেন এলিভেটরে চড়ে বা দেয়াল বেয়ে আটতলায় উঠতে না পারে।
প্রকাণ্ড একটা হলরূমের একপ্রান্তে একাধিক টেলিভিশনের পর্দার দিকে মুখ করে বসে আছেন এমরান চৌধুরী। ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার দক্ষিণ হস্তস্বরূপ সহচর।
প্রকাণ্ড হলরূমের চারদিকে ছোট বড় নানা আকৃতির মহামূল্যবান জটিল, সূক্ষ্ম, ভারি যন্ত্রের সমাবেশ ঘটেছে। একাধিক কমপিউটর, ওয়্যারলেস সেট, ম্যাটার ট্রান্সমিশন ইকুইপমেন্ট, ট্রান্সমিটার রেডিও, টিভি, রাডার, ইন্টারকম ছাড়াও, এমন সব ভারি ও হালকা যন্ত্রপাতি রয়েছে যেগুলোর সাথে বাইরের দুনিয়ার কোন বিজ্ঞানীর পরিচয় নেই।
| এমরান চৌধুরী ওরফে প্রফেসর ওয়াই এই সব যন্ত্রপাতি ও মেশিনারীর আবিষ্কারক। এটা তার কন্ট্রোলরূম।
রিভলভিং চেয়ারে বসে মুচকি মুচকি হাসছেন প্রফেসর ওয়াই। হাত দুটো ডেস্কের উপর লম্বা করে মেলে দেয়া । ডান হাতের কাছেই একটা বোর্ড। বোর্ডে ডজন দুয়েক নানা রঙের সুইচ। বাঁ হাতে ধরা একটা চুরুট। নীলচে ধোয়া উঠে যাচ্ছে একেবেঁকে সিলিঙের দিকে।
প্রফেসর ওয়াইয়ের ডেস্কের সামনে অনেকগুলো টিভির একটি চালু রয়েছে। প্রফেসর টিভি দেখছেন। ক্ষণে ক্ষণে তার মুখের চেহারা বদলে যাচ্ছে। কখনও অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন, কখনও সকৌতুকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন, কখনও মুচকি হাসি ফুটছে ঠোঁটে।
টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে মাঝারি আকারের একটি কামরা। কামরার মাঝখানে সামান্য ব্যবধান রেখে পাতা রয়েছে দুটো বেড । দুই বেডে শুয়ে আছে দুজন। দুজনেরই হাত-পা লোহার বেডের সাথে বাঁধা। প্রথম বেডে শুয়ে রয়েছে মহুয়া। দ্বিতীয় বেডে শহীদ।
বেডের চারদিকে পাঁচ-ছয়টা রোবট ঘোরাফেরা করছে। ধীরস্থির ভঙ্গিতে এক একজন এক একটা কাজ করছে। কেউ মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে রক্তের নমুনা পরীক্ষা করছে, কেউ শহীদের হার্ট বিটের সংখ্যা জেনে নিচ্ছে বুকের উপর একটা যন্ত্র
কুয়াশা ৪৭
৮৩
চেপে ধরে, কেউ মহুয়ার বেডের পাশের টেবিলে সাজিয়ে রাখছে অপারেশনের জন্যে একান্ত প্রয়োজনীয় ছুরি, কাচি, সুচ এবং নানা রকম ওষুধপত্র ।
বোঝা যাচ্ছে, শহীদ ও মহুয়ার অপারেশন একই সাথে শুরু হবে। তারই প্রস্তুতি চলছে।
| প্রফেসর ওয়াই সাগ্রহে দেখছেন গোটা ব্যাপারটা। মাঝে মধ্যে তিনি সুইচ বোর্ডের বোতামে চাপ দিচ্ছেন। রোবটগুলোকে পরিচালিত করছেন রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে।
‘ম্যাটাবর। | চুরুটে টান দিয়ে ম্যাটাবর ম্যাটবেক মন্টোগোমারী ওরফে মাতবরের দিকে একমুখ নীলচে ধোয়া ত্যাগ করলেন প্রফেসর ওয়াই হুশ করে।
ইয়েস, স্যর!
ম্যাটাবরের জন্ম লণ্ডনে। লেখাপড়া শিখেছে অক্সফোর্ড এবং কেম্বুিজে। প্রফেসর ওয়াইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সে উনিশশো আটষট্টি সালে। বিজ্ঞানের প্রতি নিবেদিত প্রাণ বলে প্রফেসর ওয়াই ম্যাটাবরকে ডান হাতের পদমর্যাদা দিয়ে প্রায় সর্বক্ষণ সাথে থাকার সুযোগ দিয়েছেন।
দেখছ, শখের গোয়েন্দা, আইমীন, টিকটিকি মি. শহীদের অবস্থা। ফ্রম নাউ ইটস এ ম্যাটার অভ টেন মিনিটস ওনলি, মি. টিকটিকির পরিবর্তন শুরু হয়ে যাবে । কয়েক দিনের মধ্যে চারগুণ আকার লাভ করবে সে। তার নাম হবে সুপারম্যান।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! কেঁপে উঠল কন্ট্রোলরূমটা প্রফেসরের অট্টহাসিতে।
| হাসি থামতে আবার কথা বলতে শুরু করলেন প্রফেসর ওয়াই, মি. কুয়াশার পর এই লোকটাকেই আমি একটু ভয় করতাম। আমার ক্ষতি করার কোন ক্ষমতা এর না থাকলেও বড় সাহসী এই টিকটিকি। কাজের ব্যাঘাত ঘটাতে ওস্তাদ। এবার একেও কাবু করে ফেলা যাচ্ছে। সুপারম্যান হওয়ার পর আমূল পরিবর্তন হবে ওর। দুঃখ থাকবে না, ঘৃণা থাকবে না, শোক থাকবে না–এককথায় বোধহীন, অনুভূতিহীন, আবেগহীন এক যন্ত্র হয়ে যাবে ও। নিজের বুদ্ধি বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না ওর ভিতর। আমি যা বলব ও তাই পালন করবে অক্ষরে অক্ষরে। চমৎকার হবে, তাই না?
ইয়েস, স্যর।’
প্রফেসর চুরুটের দিকে তাকালেন ভুরু কুঁচকে। ডেস্ক থেকে লাইটারটা তুলে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করলেন ধীরেসুস্থে, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ওর স্ত্রী, আই মীন, মিসেস খানের ওপর নতুন একটা এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে। নতুন ঠিক নয়, এর আগেও এই এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছি আমি। তবে সেগুলো বাঘ আর গরুর মধ্যেই সীমিত ছিল। এক্সপেরিমেন্ট সবগুলোই সফল হয়েছে। হিংস্র বাঘ গোবেচারা ভাল মানুষে পরিণত হয়েছে। ঘাস দিলে ঘাস খায়, খেতে না দিলেও প্রতিবাদ জানায় না। হিংস্রতা একেবারেই নেই, গর্জন করার অভ্যাস তো ছেড়েছেই, টু শব্দটিও করে না সাধারণতম্যাটাবর, আমি প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম মানুষ নামের কোন প্রাণীকেই রাখব না এই পৃথিবীতে। কিন্তু পরে ভেবে ঠিক
৮৪
ভলিউম ১৬
করেছি, মানুষগুলোকে সম্পূর্ণ বাতিল না করে ওদের মুণ্ডুটা বাতিল করে দেব। নতুন যান্ত্রিক মুণ্ডু বসিয়ে মানুষ জাতটাকে আমি আরও উন্নত, বুদ্ধিমান করে গড়ে তুলব।
এই পৃথিবী হবে যান্ত্রিক মাথাওয়ালী মানুষের রাজ্য।
কিন্তু, স্যার, তা কি সম্ভব?’
হোয়াই নট? সম্ভব নয় কেন? কেউ বাধা দেবে ভাবছ আমার পরিকল্পনায়? নো, ম্যাটাবর, নন! আমাকে বাধা দেবার মত আর কেউ নেই। ছিল একজন, কিন্তু এখন সে কোথায়? বিলিভ মি, আই ডোন্ট নো। তার সৃষ্টিকর্তাই একমাত্র জানে কি দশা তার হয়েছে, কোথায় সে আছে কিংবা আদৌ সে আছে কিনা।
‘স্যার, আপনি কি মি. কুয়াশার কথা বলছেন?’ | ‘সার্টেনলি! সেই পারত আমার কাজে বাধা দিতে। এতবড় দুনিয়ায় একমাত্র তাকেই আমি সত্যিকার অর্থে ভয় করতাম। এখন আর কোন ভয় নেই। মহাশূন্যে পাঠিয়ে দিয়েছি তাকে আমি। এখনও হয়তো তিনি মহাশূন্যের পথ ধরে আলোক গতিতে ছুটে চলেছেন, হয়তো এমনি ভাবেই ছুটতে থাকবে তার দেহের বিচ্ছিন্ন অণুগুলো শত কোটি বছর ধরে। সে যাই হোক, ম্যাটাবর, একটা ব্যাপারে আমি সেন্ট পারসেন্ট শিওর, মি. কুয়াশা বেঁচে থাকুন বা মরে যান, এই পৃথিবীতে আর। কোন দিন ফিরে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না।’
ম্যাটাবরের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে প্রফেসর ওয়াই তাকালেন টেলিভিশনের উজ্জ্বল পর্দার দিকে। চেঁচিয়ে উঠলেন: “আহ্, ম্যাটাবর! লক্ষ্য করোনি, ওদিকে যে
অপারেশনের সব প্রস্তুতি শেষ!’
দ্রুত কয়েকটা সুইচে চাপ দিলেন প্রফেসর।
টিভিতে দেখা যাচ্ছে, একটা রোবট একটা হাইপডারমিক সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহুয়ার সামনে। আর একটা রোবট দাঁড়িয়ে আছে শহীদের বেডের সামনে। তার হাতেও একটা হাইপডারমিক সিরিঞ্জ । সিরিঞ্জের সূচটা প্রবেশ করিয়ে দিল সে শহীদের বাহুতে। হালকা হলুদ রঙের মেডিসিন সিরিঞ্জ থেকে সূচের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করছে শহীদের শরীরে, মিশে যাচ্ছে রক্তের সাথে। ইঞ্জেকশন দেয়া শেষ হতে রোবটটা সরে গেল, তার জায়গা দখল করল আর একটা রোবট। শহীদের চোখমুখে ফুটে উঠেছে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ। হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করছে ও। কিন্তু নাইলনের কর্ড দিয়ে বাঁধা বলে নড়াচড়ার উপায় নেই। দ্বিতীয় রোবটের হাতে ধারাল একটা ছুরি দেখা যাচ্ছে।
| মহুয়ার বাহুতেও ইঞ্জেশন দেয়া হলো। আর একটা রোবট মহুয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতেও ছুরি দেখা যাচ্ছে। ছুরি না বলে এটাকে ছোরা বলাই ভাল। এর সাহায্যে অনায়াসে জবাই করা চলে গরু-ছাগল।
ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে শহীদের শরীর। বুজে আসছে চোখের পাতা দুটো। নিঃশেষ হয়ে আসছে শক্তি।
জ্ঞান হারাল একসময় শহীদ। মহুয়াও চোখ বুজল, স্থির হয়ে গেল তার দেহটা।
প্রফেসর ওয়াইকে পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে। অদ্ভুত একটা উজ্জ্বলতা খেলা করছে’তার মুখের চেহারায়! বিজয়উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, “এইবার!
কুয়াশা ৪৭
দ্রুত কয়েকটা বোতামে চাপ দিলেন আবার।
রোবটগুলো সচল হলো আবার। শহীদের গলার কাছে ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়েছে একটা রোবট। মহুয়ার গলা দ্বিখণ্ডিত করার জন্য দ্বিতীয় রোবটটিও প্রস্তুত। এমন সময় কামরার ভিতর প্রবেশ করল আরও চার-পাঁচজন রোবট। তারা শহীদ এবং ‘হুয়ার চারপাশে বিভক্ত হয়ে দাঁড়াল।
প্রফেসর ওয়াই হাত বাড়ালেন ডেস্কের সুইচবোর্ডের দিকে। লাল কয়েকটা সুইচে চাপ দিতে যাচ্ছেন তিনি।
“ এমনসময় ঝন ঝন শব্দে ভেঙে পড়ল জানালার কাঁচের শার্সি! ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকালেন প্রফেসর ওয়াই। জানালায় পর্দা ঝুলছে। দুলছে সেটা।
‘ম্যাক্টিাবর! কে ওখানে?’
প্রফেসর গর্জে উঠলেন। পরমুহূর্তে পড়পড় করে শব্দ উঠল। কে যেন টেনে ছিঁড়ে ফেলল জানালার ভারি পর্দার কাপড়টা।
জানালার পর্দা ছিঁড়ে যেতেই দেখা গেল অ্যাস্ট্রোনটের পোশাকপরা প্রকাণ্ডদেহী একজন আগন্তুককে। বাদুড়ের ডানার মত দীর্ঘ দুই হাত দুইদিকে মেলে দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল আগন্তুক কন্ট্রোলরূমের মেঝেতে। পা থেকে মাথা অবধি ভারি পোশাকে ঢাকা আগন্তুকের। চেহারা দেখার কোন উপায় নেই। মেঝেতে নেমেই দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড শুরু করে দিল সে। জানালা গলে যেন একটা বস্ত্র প্রবেশ করেছে রূমের ভেতর। প্রবেশ করেই সজোরে ছুঁড়ে দেয়া টেনিসবলের মত দিগ্বিদিক ছুটে যাচ্ছে। আগন্তুক আধমণ ওজনের ঘুসি মেরে চুরমার করে দিল ডেস্কের উপরকার সুইচ বোর্ডটা। বাঁ হাতটা চলে গেল ডেস্কের নিচে। অসংখ্য তার মেঝে ফুড়ে চলে গেছে। নিচের দিকে। সবগুলো তার মুঠোয় ধরে হেঁচকা টান মারল সে, ছিঁড়ে গেল সব। তার। তড়াক করে লাফ দিয়ে ট্রান্সমিটার যন্ত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। সুইচ অফ করল সেটার। এক পা পিছিয়ে এসে লাথি মারল অন করা প্রকাণ্ড এক যন্ত্রের কাঁচের ডায়ালে। সবেগে ছুটে গিয়ে ধাক্কা খেলো সেটা দেয়ালের সাথে। ক্যাঙ্গারুর মত লাফ মেরে কন্ট্রোলরূমের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটোছুটি করতে লাগল আগন্তুক। অফ করল অসংখ্য সুইচ, নামিয়ে ফেলল একাধিক যন্ত্রের হ্যাঁণ্ডেল, ভেঙে চুরমার করে দিল অন করা অনেকগুলো মেশিন। | ঘটনাগুলো ঘটল নূ্যনতম সময়ের মধ্যে। আগন্তুককে বাধা দেবার মত সময়ই পেলেন না প্রফেসর ওয়াই বা তার সহচর ম্যাটাবর।
প্রফেসর ওয়াই রিভলভিং চেয়ার ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াবার সময়টুকুর মধ্যে ঘটে গেছে এতগুলো কাণ্ড। টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে এখনও রোবটগুলোকে। কিন্তু বগুলো রোবট অচল, অনড়, দাঁড়িয়ে আছে–এতটুকু নড়ার ক্ষমতা নেই কারও। ওগুলোকে পরিচালনা করার জন্য যেসব মেশিন কাজ করছিল সেগুলো এখন বিধ্বস্ত জঞ্জালৈ পরিণত হয়েছে।
– আগন্তুক সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাস্কের ভিতর থেকে কথা বলে উঠল সে, “চিনতে পারো, ওয়াই?
ভলিউম ১৬
অবাক বিস্ময় ফুটে উঠল প্রফেসর ওয়াইয়ের দুই চোখে। অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি, ‘মাই গড! ও মাই গড! হাউ ক্যান আই বিলিভ! ইটস কোয়াইট ইমপসিবল বাট মোর টু দ্যান রিয়্যালিটি! ও মাই গড! |
‘আমার পক্ষে সবই সম্ভব, ওয়াই। আশা করি ভবিষ্যতে আমার ব্যাপারে তুমি আরও সাবধান হবে। তোমাকে কঠিন কোন শাস্তি দিলাম না আজ। কিন্তু বাড়াবাড়িটা তোমার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, ওয়াই। সাবধান না হলে ভবিষ্যতে কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। কথাটা মনে রেখো। আজ শুধু ধ্বংস করে দিলাম তোমার এই কন্ট্রোলরূম! চললাম!
আগন্তুক কথাগুলো বলে এক লাফ দিয়ে জানালার উপর উঠে দাঁড়াল।
‘ম্যাটাবর! স্টেনটা! স্টেনটা দাও আমাকে ম্যাটার! প্রফেসর ওয়াই চিৎকার করে উঠলেন।
| আগন্তুক লাফ দিল আবার। আটতলা উঁচু জানালা থেকে অন্ধকার শূন্যে। মিলিয়ে গেল সে। ছুটে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর ওয়াই।
জানালার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে প্রকাণ্ড পিরিচের মত একটা স্পেসক্রাফট, ক্রমশ উপরে উঠে যাচ্ছে সেটা।
বিমূঢ় বিস্ময়ে উপর দিকে চেয়ে রইলেন প্রফেসর। সসারের মত আকৃতিবিশিষ্ট স্পেসক্রাফট প্রায় পাঁচশো গজ উপরে উঠে গিয়ে শূন্যে ভাসছে।
‘সর্বনাশ! ম্যাটার! সর্বনাশ হতে যাচ্ছে। “কি হলো স্যার! পাশে এসে দাঁড়াল ম্যাটাবর।
প্রফেসর ওয়াই কাঁপছেন, ‘ম্যাটাবর। ভ্যানিশিং রে? জলদি দাও! ওহ গড! ওই গড়! দেরি কোরো না, ম্যাটাবর! ভ্যানিশিং রে! ভ্যানিশিং রে।’
কামানের ছুটন্ত গোলার মত কন্ট্রোলরুম থেকে বেরিয়ে গেল ম্যাটাবর।
প্রফেসর ওয়াই জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়ে উপর দিকে তাকিয়ে চেঁচাচ্ছেন অবিরাম, ম্যাটাবর! কোথায় তুমি? এখনও আনতে পারলে না!
মাথার চুল ছিঁড়ছেন প্রফেসর ওয়াই, ম্যাটাবর! সর্বনাশ হয়ে গেল, ম্যাটবির। হলো না শেষ রক্ষা! সব ধ্বংস হয়ে গেল। সব ধ্বংস হয়ে গেল! বড্ড দেরি করে ফেললে তুমি, ম্যাটাবর।
উন্মাদের মত জানালার কাছ থেকে সরে এলেন প্রফেসর ওয়াই! দুই হাত দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছেন। টলছে বিশাল দেহটা। টলতে টলতে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দরজার গায়ে লেখা ‘এলিভেটর!
দরজা খুলে এলিভেটরে ঢুকলেন প্রফেসর ওয়াই। পরমুহূর্তে বোমাটা পড়ল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ কাঁপিয়ে তুলল চারদিকের পাঁচ সাত মাইল এলাকা।
ধোয়া এবং আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করল প্রফেসর ওয়াইয়ের সুউচ্চ অট্টালিকাকে।
আধঘণ্টা পর বাতাসের সাথে ধোয়ারাশি সরে যেতে দেখা গেল প্রফেসর ওয়াইয়ের সুউচ্চ অট্টালিকাটি মিশে গেছে মাটির সাথে। ইট-কাঠ-ইস্পাতের কুয়াশা ৪৭
ভস্মীভূত স্কুপ ছাড়া সেখানে কিছুই নেই আর।
সাত
এভারেস্ট। পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ।
শতবর্ষেরও আগের ঘটনা, তৎকালীন সার্ভে জেনারেল অব ইণ্ডিয়া এর উচ্চতা নির্ণয় করেন এবং প্রমাণ করেন যে এই গিরিশৃঙ্গটিই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ। ভদ্রলোকের নাম ছিল স্যার জর্জ এভারেস্ট। তাঁর সম্মানার্থেই পৃথিবীর এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নামকরণ করা হয় মাউন্ট এভারেস্ট। স্যার জর্জ এভারেস্টের হিসেব অনুয়ায়ী মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ২৯০০২ ফিট।
সাড়ে পাঁচ মাইল উঁচু এই মহাকায় পর্বতের উপরিভাগ বছরের সর্বক্ষণ তুষার আর বরফে ঢাকা থাকে। পর্বতগাত্রের উপর স্তূপীকৃত তুষার ভারি হয়ে উঠলে ধস নামে। সৃষ্টি হয় তুষার নদের। সেই তুষারের নদী সশব্দে নামতে থাকে নিচের দিকে। তিব্বত হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত, তুষার নদ তিব্বতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই তুষার নদের নাম রাঙবক। অনেকসময় এই স্থূপীকৃত তুষার শক্ত বরফে পরিণত হয়। তারপর যখন উত্তাপ পেয়ে এই বরফ গলতে শুরু করে, সৃষ্টি হয় হিমবাহের। কোটি কোটি টন জমাট বরফ উপর থেকে ধেয়ে নামতে শুরু করে নিচে। | হিমালয়ের উপরের দিকে তুষার ঝড় বয়ে চলেছে সারাক্ষণ। অসংখ্য
অভিযাত্রীদল এভারেস্টকে জয় করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। সর্বপ্রথম শেরপা। তেনজিং এবং স্যার এডমণ্ড হিলারী এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করে প্রমাণ করেন মানুষের অসাধ্য কোন কাজ নেই।
* এভারেস্টের উপর দাঁড়িয়ে নিচের পৃথিবীর কিছুই দেখা যায় না। কারণ মেঘের রাজ্য এভারেস্টের অনেক নিচে। তাছাড়া তুষার এবং হিমবাহ থেকে উত্থিত বাষ্প
এবং কুয়াশী ঢেকে রাখে নিচের পৃথিবীকে।
| এভারেস্টের বাতাসে অক্সিজেনের দারুণ অভাব। কিন্তু, কামাল এবং ডি. কস্টার কোন অসুবিধেই হলো না এভারেস্টে পৌঁছে। দুজনেরই পিঠে অক্সিজেন সিলিণ্ডার বাধা রয়েছে, মুখ-মাথা প্লাস্টিকের ফাপা মাস্কে ঢাকা।
ছোট একটা গুহার মধ্যে নিজেদেরকে আবিষ্কার করল ওরা। ধপ করে ডি কস্টা একটা কাঠের বাক্সের উপর বসল। মাস্কের ভিতর থেকেই কথা বলে উঠল সে, ‘প্রফেসর ওয়াই আনড়াইটেডলি রাফ ডিয়াছে। টকেটিভ, পুওর ফেলো! বলে কিনা টোমাডেরকে এভারেস্ট পাঠাইয়া ডিব! যট্টোসবএভারেস্টে গুহা ঠাকিটে পারে? ইহাকে কি এভারেস্ট বলিয়া মনে হইটেছে! যট্টোসব ইডিয়োটিক কঠা-বার্টা! ম্যাটার ট্রান্সমিশন যন্ত্র-রাফ!
গুহার ভিতর কয়েকটা কাঠের মুখ বন্ধ করা বাক্স, পাটের দড়ির গোটাচারেক বাণ্ডিল, শাবল, ইস্পাত্রের রড, চটের ব্যাগ ভর্তি হাতুড়ি, একপোয়া ওজনের বড় বড় পেরেক, ইত্যাদি যন্ত্রপাতি ছাড়াও টুকিটাকি আরও কিছু জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে।
ভলিউম ১৬
৮৮
গুহার মুখের সামনে বড় একটা পাথর। ফলে বাইরেটা ভাল দেখা যাচ্ছে না।
কামাল ফিরে এল গুহায়। এইমাত্র বাইরেটা দেখার জন্য বেরিয়ে গিয়েছিল সে।
ডি. কস্টা, উঠুন! আমরা সত্যিই এভারেস্টে রয়েছি। মাত্র আধঘণ্টা সময় হাতে, অক্সিজেনের অভাবে এবার মারা যাব দম বন্ধ হয়ে! | দেয়ালে হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে ভি. কস্টা মুচকি হাসল । বলল, প্রফেসর ওয়াইয়ের কঠা মাইণ্ড ঠেকে বহিষ্কার করিটে পারিটেছেন না, কেমন? আপনার কমনসেন্স অ্যাণ্ড বুড়ি লাপাত্তা হইয়া গেছে ডেকিটেছি! ফর গডস সেক, নার্ভাস হইবেন না, মি. কামাল! আমি আপনাকে নিশ্চয়টা ডিটেছি, দিস ইজ নট এভারেস্ট।
মাস্কের ভিতর দাঁতে দাঁত চাপল কামাল, ‘মরতে চান বুঝি! বেশ মরুন । আমি চললাম।
কামাল দ্রুত চটের ব্যাগ থেকে বের করে নিল কয়েকটা একপোয়া ওজনের পেরেক, একটা হাতুড়ি। লম্বা পেরেকগুলো পকেটে ভরল সে। তুলে নিল দুটো দড়ির বাণ্ডিল। পিছন দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল সে গুহার বাইরে।
| ডি. কস্টার নড়ার নাম নেই। কামালের গমন পথের দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাতে দোলাতে আপনমনেই বলে উঠল, বেচারা! প্রফেসর ওয়াই ইহার ব্রেনটা
স্পয়েল করিয়া ডিয়াছে- পুওর ফেলো!
কাঠের বাক্সগুলোর দিকে তাকাল সে। বাক্সগুলোর উদ্দেশ্যে বলে উঠল, পেটের ভিটর গোল্ড অর সামথিং লাইক দ্যাট, আছে, টাই না? ওয়েট, স্যার, ওয়েট–আই উইল সি!
উঠে দাঁড়াল ডি, কস্টা। দেয়ালে খাড়া করে রাখা একটা ভারি শাবল তুলে নিয়ে ঘা মারল একটা বাক্সের গায়ে।
বাক্সের উপরকার কাঠ ফেটে গেল। আবার ঘা মারল ডি কস্টা। ভেঙে গেল বাক্সটা।
মাই গড! ইউরেনিয়াম!
আসলেও তাই। বাক্সের ভিতর দেখা গেল বড় বড় ইস্পাতের অনেকগুলো টিউব। টিউবের গায়ে লেখা, ইউরেনিয়াম । | ডি, কস্টা দুই বাহু শূন্যে তুলে লাফাতে শুরু করল, “মি. কামাল! মি. কামাল। আই অ্যাম কিং নাউ! সার্ট রাজার টন! চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটল ডি কস্টা।
গুহার বাইরে বেরিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল ডি, কস্টা। আনন্দের উচ্ছ্বাস একনিমেষে উবে গেল। চারদিকে দিশেহারার মত তাকাল সে। একি দৃশ্য! আকাশ একেবারে মাথার কাছাকাছি নেমে এসেছে। নিচের দিকে দেখা যাচ্ছে ভাসমান মেঘের রাজ্য। যেদিকে দৃষ্টি পড়ছে সেদিকেই মেঘ, মেঘ আর মেঘ। কিন্তু মেঘ নিচে কেন? মেঘ তত মাথার উপর ভেসে বেড়ায়।
কামালের দিকে তাকাল ডি, কস্টা। পাথরের গায়ে পেরেক পুঁতে তার সাথে দড়ির একটা প্রান্ত বেঁধে দিয়েছে সে। দড়িটা ঝুলিয়ে দিয়েছে নিচের দিকে।
কুয়াশা ৪৭
মি. কামাল! আমি কি ড্রিম ডেকিটেছি?’ কামাল ডি, কস্টার কাছে এসে দাঁড়াল, ‘কি, বিশ্বাস হচ্ছে তো এবার।
ডুকরে কেঁদে উঠল ডিকস্টা। কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল সে কামালকে, ‘মি. কামাল! হায়, হায়! এটো উঁচুটে হামি উঠিটে চাই নাই, ফর গডস সেক। অ্যামবিশন হামার ছিল, নো ডাউট, কিন্ট এটো উঁচুটে উঠিটে চাই নাই |
কামাল ধমকে উঠল, কাঁদলে কোন লাভ নেই। প্রতিটি সেকেণ্ড এখন কাজে লাগাতে হবে আমাদের। আধঘন্টা পর ফুরিয়ে যাবে অক্সিজেন। তাড়াতাড়ি করে যত নামতে পারব ততই বাঁচার আশা বাড়বে।’
নামিটে হইবে? মাই গড, এভারেস্ট হইটে নামিব-হাউ? যেখানে উঠি নাই সেখান হইটে নামিব, কি ভাবে।’
কামাল বলল, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? | ডি, কস্টা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কামালকে, নো-নো। বিশ্বাস না করিয়া উপায় ডেকিটেছি না। বাট, নিজের চেষ্টায় উঠি নাই এভারেস্টে, মি. কামাল। বাট নামিটে হইবে নিজের চেষ্টায়। পারিব না, আপন গড, মি পারিব না! পা ফসকাইয়া ভূপটিট হইব, রশি ছিঁড়িয়া ঢুরাশায়ী হইব…’
কিচ্ছু হবে না। আপনার জন্য দেখছি আমাকেও দমবন্ধ হয়ে মরতে হবে। আপনি নাটক করুন, আমি চললাম। নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে পা বাড়াল কামাল কিনারার দিকে।
‘ওয়েট এ মিনিট। গুহার ভিটর ইউরেনিয়াম আছে হামার! প্লীজ, ওয়েট মি. কামাল! হামার ইউরেনিয়াম মিলিয়নস অফ ডলার মূল্য•••।’
কামাল বলল, ইউরেনিয়াম না ছাই! আর থাকলেই বা কি, প্রাণ আগে না ইউরেনিয়াম আগে?
‘টবু, হাটের ঢনকে পায়ে ঠেলিটে নাই। ওয়েট…।’
ঘুরে দাঁড়াল কামাল। কয়েক পা এগিয়ে ডি. কস্টার একটা হাত চেপে ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেল তাকে চুড়ার কিনারায়, নামুন। খুব সাবধানে। রশি ছাড়বেন না ভুলেও। প্রথমে আস্তে আস্তে নামতে শুরু করুন। তারপর যত দ্রুত সম্ভব। মনে থাকে যেন, সাড়ে পাঁচ মাইলের মত নামতে হবে আমাদেরকে।
‘ফাইভ অ্যাণ্ড হাফ মাইলস! প্যান্ট খারাপ করিয়া ফেলিব, বিলিভ মি.!
ফের কথা! কথা বলবেন না। কই, রশি ধরুন!
ডি, কস্টা রশি ধরে ঝুলে পড়ল। কালের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল পরমুহূর্তে।-সর্বনাশ! দড়ি ধরে সবেগে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে ডি. কস্টা। জ্ঞান নেই লোকটার । ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে। কামালও রশি ধরে ঝুলে পড়ল। নামতে নামতে নিচের দিকে তাকিয়ে ছ্যাৎ করে উঠল ওর বুক। ডি, কস্টাকে দেখা যাচ্ছে না। মাত্র কয়েক মুহূর্তে তীরবেগে নামতে নামতে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে
সে।
মিনিট তিনেক অবিরাম নামার পর ড়ি, কস্টাকে দেখতে পেল কামাল। লম্বা হয়ে পড়ে আছে পাথরের উপর। নড়ছে না। রশির শেষ প্রান্তটা এখানে। এরপর
৯০
ভলিউম ১৬
.
।
নামতে হলে নতুন রশি এখান থেকে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিতে হবে।
কামালের শব্দ পেয়ে ডি. কস্টা বলে উঠল, মরি নাই! জাস্ট টায়ার্ড। | রশির দ্বিতীয় বাণ্ডিলটা উপর থেকে নিচের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল কামাল। সেটী অদূরেই পাওয়া গেল। পকেট থেকে পেরেক আর হাতুড়ি বের করে কাজে লেগে গেল সে।
আবার রশি ঝোলানো হলো।
ধাক্কা দিয়ে ধমক মারতে ডি. কস্টা উঠে দাঁড়াল। কি করতে হবে বুঝিয়ে দিল কামাল। প্রথম রশিটা ধরে প্রাণপণ শক্তিতে টানাটানি শুরু করল ওরা। খানিকক্ষণের অক্লান্ত পরিশ্রমে এভারেস্টের চূড়ায় বরফের গায়ে পোতা পেরেকটা বিচ্ছিন্ন হলো। পেরেক সহ রশিটা পড়ল ওদের পায়ের কাছে। দুজনে সেইরশি ধরে উপরে তুলল, আবার ছুঁড়ে দিল নিচের দিকে।
নিচে নেমে আবার কাজে লাগাতে হবে রশিটাকে। চুলকাইটেছে!’
ডি. কস্টার দিকে তাকাল কামাল। রবারের দস্তানা পরা ডান হাতের আঙুল, দিয়ে বাঁ হাতের আঙুল চুলকাচ্ছে ডি, কস্টা। এমন জীবন মরণ সমস্যার মধ্যেও হেসে ফেলল কামাল, আপনার কাণ্ড দেখে এভারেস্টও নড়ে উঠবে হাসি চাপতে না পেরে। রবারের উপরে চুলকালে কি আঙুলের চুলকানির উপশম হবে?’
| ডি, কস্টা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, ‘টাহলে উপায়? বড্ড বেশি চুলকাইটেছে যে! প্লীজ, আপনি ডয়া করিয়া একটু চুলকাইয়া ডিন।
সেই একই তো কথা! সাধারণ একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকছে না আপনার? রবারের উপর রবার দিয়ে চুলকালে কোন ফায়দা নেই। ইস! সময়ই নষ্ট হচ্ছে শুধু। কই, আগে বাড্রন, আবার নামতে হবে। খুব সাবধানে। হাত ফসকালেই।
‘ ডি, কস্টা ঝুলে পড়ল আবার। দেখতে দেখতে রশি ধরে নিচের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। কামালের কথা সে শুনতেই পায়নি।
মেঘের নিচে ওরা। ঝড়ে বাতাসে দুলছে রশি! দুলছে সেই সাথে ওরা দুজন। চারদিকে তুষার, তুষার আর তুষার। হালকা তুষার কণা উপর থেকে তুলোর মত পড়ছে। পিঠের অক্সিজেন সিলিণ্ডার এবং মুখের মাস্ক খোলেনি ওরা।
ভিজে রশি রবারের দস্তানা রা হাত দিয়ে ধরা মুশকিল।
পেচ্ছাব পাইয়াছে, মি. কামাল!
কান দিল না কামাল। এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে রশি ধরে নামছে সে। ডি, কস্টা তার উপরে। ঝড়ো বাতাসে দুলছে রশি। নিচের দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে না, দাঁড়াবার জায়গা আরও কতটা নিচে।
একঘণ্টার বেশি এই ঝড়ের কবলে পড়ে হিমশিম খাচ্ছে ওরা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শরীরের রক্ত জমাট বেঁধে যাবে যেন। কনকন করছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শরীরের জয়েন্টগুলো। অসাড় হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ হাতের আঙুল। অথচ হাত একটু ঢিলে করলেই ভিজে দোদুল্যমান রশি ছুটে যাবে মুঠো থেকে। তার মানে, নির্ঘাৎ মৃত্যু। কুয়াশা ৪৭
‘চাপিটে পারিটে২ি না, মি. কামাল!’ কথাটা বলেই ডি. কস্টা ছেড়ে দিল হাতের রশি। কামাল কিছু টের পাবার আগেই হুড়মুড় করে ওর মাথার উপর এসে পড়ল ডি. কস্টার দেহটা। ফসকে গেল কামালের হাতের রশি।
* শূন্যে ডিগবাজি খাচ্ছে ডি. কস্টা। গোটা দেহটা ডিগবাজি খেতে খেতে তীরবেগে নেমে যাচ্ছে হিমালয়ের উপর থেকে নিচের দিকে। নামছে তো নামছেই, নামছেই, নামছেই••
| কামালেরও সেই একই অবস্থা।
লি, কস্টার হাত দুটো যতদূর সম্ভব প্রসারিত করা, অবলম্বন খুঁজছে সে, ধরতে চাইছে কিছু একটা, ধরে এযাত্রা রক্ষা করতে চাইছে প্রাণটা। কিন্তু শুন্যে নিক্ষিপ্ত চিলের মত নেমেই চলেছে ওর দেহটা নিচের দিকে। পাচ্ছে না সে কোন অবলম্বন,
পাবেও না সে, পাওয়া সম্ভব নয়।
আরও অনেক নিচে পর্বতের গা একটু ফুলে উঠেছে। সেখানে জমেছে শত শত মণ তুষার। ডি, কস্টা আর কামাল পড়ল সেই সুপীকৃত তুষারের উপর।
কিন্তু ভাগ্য বিরূপ হলে যা হয় তাই হলো। তুষারের উপর পড়ল ওরা ঠিকই, নড়েচড়ে, এপাশ ওপাশ করে উঠে দাঁড়াল, একমুখ হাসিতে উজ্জ্বলও হয়ে উঠল ডি, কস্টা, কামালের উদ্দেশ্যে বলল, ‘গড একজন আছেন, বুঝিলেন, ব্রাদার! এ ট্রা লাইফটা সেভ হয়ে গেল। আর একটু হইলে খরচা হইয়া যাইটাম। কিন্তু কটো কুইক নামিয়াছি ডেখিলেন?
কিন্তু ওই পর্যন্তই। সুপীকৃত তুষার নড়ে উঠল। ধস নামল তুষারের । নরম তুষার সবেগে ধসে যাচ্ছে। তলিয়ে গেল ডি কস্টা তুষারের নিচে। একমুহূর্ত পর দ্বিধা বিভক্ত তুষারের গভীর তলদেশে ঢুকে গেল কামলিও।
জ্ঞান ফিরে আসতে চোখ পিটপিট করে তাকাল ডি. কস্টা। এ কোথায় পড়ে রয়েছে। সে? শী শা করে ও কিসের শব্দ? গড! ঝড় বহিটেছে? | সব কথা মনে পড়ে গেল ডি কস্টার। মুচকি হাসল সে। উঠে বসল। ধূসর রঙের পাথরের উপর শুয়ে ছিল সে এতক্ষণ। তুষারের চিহ্ন নেই কোথাও। তবে পাথর ঢাকা পড়ে রয়েছে কোথাও কোথাও সাদা, কঠিন বরফে।
হাজার হোক হামি ইংরাজের জাট! কই মাছের জান। টাই টিকিয়া আছি। বাট, মি. কামাল, যেহেটু ভেটো বাঙালী, টাই অক্কা লাভ করিয়াছেন। গড, প্লীজ, টাহাকে নরকে ঠাই ডিটে মিসটেক, থুড়ি, স্বর্গে ঠাই ডিটে মিসটেক করিবেন না। আমেন।’ | কামালের জন্য প্রার্থনা শেষ করে পা বাড়াল ডি. কস্টা। ভিজে পিচ্ছিল পাথরের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে সতর্ক করল বারবার বিড়বিড় করে, ‘পড়িয়াছ কি মরিয়াছ! অটি সাবটানে প্রসিড অন, মাই ফ্রেণ্ড! নিশ্চয় টুমি মি. কামালের সাঠে ডেকা করিটে নরকে যাইটে চাও না!’
খানিক পর ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে সে বলল, “হামি চাহিলে কি হইবে, মি. কামাল নরকেই যাইবে। স্বর্গ টাহার কপালে নাই।
ভলিউম ১৬
মিনিট পাঁচেক প্রলাপ বকতে বকতে হাঁটার পর একটা গুহা দেখতে পেল ডি. কস্টা। ইউরেকা!’ বলে ভিতরে ঢুকল সে। তারপরই চিৎকার করে উঠল, হাউ স্ট্রেঞ্জ?
মুচকি হেসে গুহার এক কোণ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কামাল বলে উঠল, বেঁচে আছেন তাহলে!’
সেই কোশ্চেন টো হামারও! আমি আপনার জন্য প্রার্থনা করছিলাম কটো! গডকে বলিলাম, বিলিভ মি.••। বাড ডিন। খাবারবার সামথিং ডিন টো। বড় ক্ষিড়ে পাইয়াছে।
| ‘খাবার? খাবার কেথায় পাব?’ কামাল খেঁকিয়ে উঠল। আবার বলল, ‘ভাগ্যটা বড় সাহায্য করছে, বুঝলেন? জ্ঞান ফেরার পর এই গুহায় ঢুকি আমি। কোন অভিযাত্রী দলের ক্যাম্প ছিল এটা। কমুল, শাবল, রশি, অক্সিজেন, মাস্ক–এইসব আছে। কিন্তু খাবার নেই।’
গুহার প্রবেশ পথের দিকে তাকাল ডি. কস্টা। ফিসফিস করে বলল, ‘প্রবেশ পঠটা বণ্ড করিয়া ডিবার কুনো উপায় করিটে পারা যায় না?
চোখ কপালে উঠল কামালের, কেন? গুহার মুখ বন্ধ করতে চাইছেন কেন?
ক্যাম্পটী যাহাড়ের টাহারা যড়ি ফিরিয়া আসে? টাহারা যডি ঘাড় ঢাড়িয়া বাহির করিয়া ডেয় হামাডেরকে এই ডুযোগে।’
| ‘দূর! আপনি দেখছি নোকার হদ্দ। এই ক্যাম্প কি আজকের?. যারা এখানে, ক্যাম্প করেছিল তারা মরে ভূত হয়ে গেছে কবে?
ডি. কস্টা খুশিতে আত্মহারা, ‘টবে টো কঠাই নাই! ভূত হইয়া ঠাকিলে টাহাদের আর কুনো অটিকার নাই এই ক্যাম্পের উপর।
‘রাত নামবে একটু পর, বুঝলেন? ঘুম দিতে হবে। হিমালয়ের এই এলাকায় ঝড়-তুফান বছরের সবসময়ই লেগে থাকে। এই তুমুল ঝড় থামবে সে আশা না করাই ভাল। তবে কমতে পারে, কমলেই বেরিয়ে পড়তে হবে। বুঝতে পারছেন আমার কথা?’
লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার! বাট, মি. কামাল, উহা কিসের শব্দ হইটেছে?
শব্দটা কামাল শুনতে পাচ্ছিল। কান পাতল ও। কিন্তু কান পাতবার দরকার নেই, ক্রমশ বাড়ছে শব্দটা।
দেখতে দেখতে অস্পষ্ট শব্দটা বাড়তে বাড়তে একটানা গর্জনে পরিণত হলো । শুধু শব্দই নয়, সেই সাথে শুরু হলো কম্পন। কাগতে শুরু করল গুহার মেঝে, দেয়াল, ছাদ।
মি. কামাল। হিমালয় ভাঙিয়া যাইটেছে-বিলিভ মি.!’
মুখ শুকিয়ে গেল কামালের। সর্বনাশ! যা সে আশঙ্কা করেছিল মনে মনে, তাই শেষ পর্যন্ত ঘটতে চলেছে। হিমবাহ নামছে উপর থেকে।
শিউরে উঠল কামাল। হিমবাহ নামতে কোনদিন দেখেনি সে। কিন্তু হিমবাহ নামার ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা অজানা নেই তার। কোটি কোটি টন কঠিন বরফ হুড়মুড় করে একবার নামতে শুরু করলে আর রক্ষে নেই। পর্বতের গা ভেঙে, ছোট
কুয়াশা ৪৭
বড় পাথরের খণ্ডকে সাথে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সেই যে হিমবাহের পতন শুরু হয় তার আর থামার লক্ষণ দেখা যায় না। কোন কোন হিমবাহ নাকি মাসাধিককাল শুধু নামতেই থাকে।
খানিক পরই চাক্ষুষ করল ওরা হিমবাহের স্বরূপ। গুহার সামনে দিয়ে নিচের দিকে পড়ছে বরফের টুকরো। প্রথমে অল্প অল্প। তারপর হাজার হাজার বরফের খণ্ড,
আরও পরে বরফের খণ্ড সংখ্যায় এত বেশি পড়তে লাগল যে আলাদা করে দেখার উপায় রইল না একটাকেও। বরফের একটা নদী যেন কেউ উপুড় করে দিয়েছে, সেই নদীর বরফনামছে নিচের দিকে।
. কানে আঙুল দিল কামাল। বিকট গর্জনে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে। ডি. কস্টা হঠাৎ লাফ দিয়ে চলে গেল কামালের পিছনে। আত্মগোপন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে।
অসংখ্য বরফের খণ্ড গুহামুখের সামনে স্তূপীকৃত হচ্ছে। চেয়ে চেয়ে দেখছে কামাল নিজেদের সর্বনাশ। করার কিছুই নেই তাদের। চুপচাপ বসে দেখতে হবে প্রকৃতি কি নির্মমভাবে মৃত্যুফাঁদ তৈরি করছে তাদের জন্য।
দেখতে দেখতে গুহামুখটা বন্ধ হয়ে গেল। বড় অন্ধকার ঠেকিটেছে!
কামাল থমথমে গলায় বলল, এই অন্ধকার থেকে এ জীবনে আর আলোর মাঝখানে যেতে পারবেন বলে মনে হয় না!
মহাপ্রনয়, ঘনিয়ে এসেছে। সহ্য হয় না আর এই একটানা কম্পন আর গর্জন।
কেটে গেছে তিন তিনটে দিন। গত বাহাত্তর ঘণ্টা ধরে সহ্য করছে ওরা এই গাঢ় অন্ধকার, সহ্য করছে, হিমবাহের দুনিয়া কাঁপানো অবিরাম গর্জন, সহ্য করছে
জঠরের তীব্র জালা! তিন দিন–পেটে একটা দানাও পড়েনি ওদের।
মি. কামাল।
জবাব দিল না কামাল। পাগল হয়ে যাবে ও। চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলছে ক্রমশ। ডি. কস্টা এর আগে জ্ঞান হারিয়েছিল একবার। খানিক আগে জ্ঞান ফিরেছে। তার। জ্ঞান সে-ও হারাবে। আর সহ্য করবার শক্তি নেই, দেহ মন পরাজয় মেনে নিতে চাইছে।
‘মি, কামাল।
বলুন। ডি কস্টা হাঁপাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তার। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল কামালের। কিন্তু করার কিছু নেই ওর।
হামাডের মঢ্যে একটা চুক্তি হয়ে যাওয়া ডরকার! ‘চুক্তি? কিসের চুক্তি?’
আস্তে আস্তে কথা বলছে ডি, কস্টা, ‘ক্ষিড়ে একটা নীটিহীন শয়টান, মি. কামাল। এই ক্ষিডের টাড়নায় মানুষ মানুষকেও খাইয়া ফেলিটে পারে?
কামাল চুপ করে রইল। ডি. কস্টা কি পাগল হয়ে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত?
আমরা ভরলোক, টাই না? হামাডের মদ্যে একটা ভরলোকের প্যাক্ট
৯৪
ভলিউম ১৬
হইয়া যাক।
কি প্যাক্ট?
ডি. কস্টা বলল, ‘প্যাক্টের মূল বিষয় হইবে–হ্যামরা পরস্পরকে খাইব না। এগ্রী?
কামাল বলল, “ই।’
ডি. কস্টা হাসল তবু, বাট, এই চুক্তি কার্যকরী ঠাকিবে দুইজন বাঁচিয়া ঠাকা পর্যন্ত। দুইজনের একজন যডি অন্য যে-কোন কারণে মারা যাই টাহা হইলে চুক্তি বাটিল হইয়া যাইবে।
তার মানে?’
ডি. কস্টা বলল, “টারমানে, হামি মরিয়া গেলে হাপনি হামাকে খাইটে পারিবেন এবং আপনি মরিয়া গেলে…ইত্যাদি ইত্যাদি, বুঝিটে পারিটেছেন টো?’
কামাল উত্তর দিতে পারল না। জ্ঞান হারিয়েছে সে।
একা বিড়বিড় করল ডি কস্টা আরও খানিকক্ষণ । শক্তি পাচ্ছে না সে শরীরে। মাথা ঘুরছে। কমূলেও নিষ্কৃতি মিলছে না ঠাণ্ডার হাত থেকে। প্রচণ্ড খিদেতে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে সে••এরপর আর কিছু মনে নেই ডি কস্টার।
আট
চারদিকে ধোয়ায় ধোঁয়ায় একাকার। দশ পনেরো হাতের বেশি দূরের জিনিস দেখা যায় না। কিন্তু ধোয়া বলে মনে হলেও আসলে ওগুলো ধোয়া নয়বাষ্প। বরফ থেকে উঠছে হু হু করে। চারদিক থেকে। আর তার সাথে গাঢ় কুয়াশা। কুয়াশার জাল ভেদ করে সূর্যের আলোও আসতে পারছে না স্বাধীনভাবে।
| আবির্ভুত হবার পর চব্বিশ ঘণ্টারও উপর এই শীতল নরকে কেটে গেছে মি. সিম্পসনের। সূর্য অস্ত যায়নি একবারও, ঠিক যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে
আছে। গ্রীনল্যাণ্ডের দস্তুরই এই।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছেন মি, সিম্পসন। বাঁ পাটা অসাড় হয়ে গেছে। ঘণ্টাখানেক থেকে চিমটি কেটেও সাড়া পাচ্ছেন না এতটুকু। হাড়, মাংস, চর্বি, রক্ত সই পাটা বরফে পরিণত হলেও অবাক হবার কিছু নেই। এমন ঘটনা সচরাচর ঘটেই থাকে এখানে।
উত্তই একটা দুর্গন্ধে বমি এল মি. সিম্পসনের। ব্যাপার কি! সশব্দে থুথু ফেললেন তিনি। ছানাবড়া হয়ে উঠল চোখজোড়া, মাই গড!
নিচের বরফের উপর দুই টুকরো বরফ টক টক শব্দে পড়ল, ড্রপ খেয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে থামল। থুথু মুখ থেকে বেরিয়েই বরফে পরিণত হয়ে গেছে।
গ্রীনল্যাণ্ড । প্রায় এক হাজার মাইল প্রস্থ এবং দুই হাজার মাইল দৈর্ঘ্যের প্রকাণ্ড একটা বরফাচ্ছাদিত ভূখণ্ড। মাটি, পাথর, বালি অতবড় ভূখণ্ডে নেই বললেই চলে। যেদিকে তাকাও বরফ, বরফ আর জমাট বরফ।
সূর্য গ্রীষ্মকালে অস্ত যায় না মাসের পর মাস। আবার শীতকালে মাসের পর কুয়াশা ৪৭
মাস এস্কিমোরা অন্ধকারে থাকে, সূর্য ওঠে না তখন গ্রীনল্যাণ্ডের আকাশে।
বরফের দেয়াল দিয়ে ঘেরা জানালাহীন দরজাহীন গোলাকার একটা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করলেন মি. সিম্পসন। বাইরে বেরুবার জন্য একটা গর্ত দেখতে পান তিনি। বরফের তৈরি ঘর দেখেই রহস্যটা বুঝতে পারেন তিনি। শয়তান প্রফেসর ওয়াই মিথ্যে গর্ব করেনি। সত্যি সে তাকে গ্রীনল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দিয়েছে। | উলের গরম কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা থাকলেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছিলেন মি. সিম্পসন। খাবার দুটো প্যাকেটও দিয়েছিল শয়তান প্রফেসর গরম কাপড়ের পকেটে ভরে। কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে এই বরফের তৈরি ঘরে বসে থাকলে চলবে না। বসে থাকলে রক্ত চলাচলের গতি শ্লথ হয়ে পড়বে, ফলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তার দেহটাকে কঠিন বরফে রূপান্তরিত করে ছাড়বে। শূন্য ডিগ্রীর চেয়ে নিচেই নয় শুধু, এখানকার তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রীর চেয়ে পঞ্চাশ ডিগ্রী নিচেই থাকে সব সময়। প্যাকেটের খাবারও শেষ হয়ে যাবে একবার পেট ভরে খেলে। সুতরাং বেরিয়ে পড়তে হবে এখান থেকে।
| এস্কিমোদের সাহায্য পাবার আশাই একমাত্র সম্বল। সভ্য দুনিয়ায় ফিরে যাবার কথা এই মুহূর্তে ভাবা বাতুলতা। গ্রীনল্যাণ্ডের সাথে নিয়মিত কোন যোগাযোগ নেই সভ্য দুনিয়ার। এই বিশাল ভূখণ্ডে শুধুমাত্র বৃহৎ শক্তিদ্বয়ের একটি কি দুটি রিসার্চ সেন্টার আছে–ব্যস। সেই রিসার্চ সেন্টারে যারা কাজ করে তারাই এখানে.সভ্য দুনিয়ার প্রতিনিধি। তারাই বছরে একবার সভ্য দুনিয়ায় যায় বা সেখান থেকে এখানে আসে।– গ্রীনল্যাণ্ডের আকাশে সূর্য দেখে মি. সিম্পসন বুঝতে পারেন, এখানে এখন গ্রীষ্মকাল।
বরফের তৈরি ঘর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে মি. সিম্পসন আবিষ্কার করেছিলেন একটা পাহাড়ের উপর রয়েছেন তিনি। আধঘণ্টা পর পাহাড় থেকে নেমে তীব্র ঠাণ্ডার দরুন সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা অনুভব করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। হায় কপাল, শেষ পর্যন্ত বরফ হয়ে যাবে তার দেহটা!
মাইলখানেক হাঁটার পর কয়েকটা সীল দেখতে পেলেন মি. সিম্পসন। সীল সম্পর্কে অনেক কথাই মনে পড়ল মি. সিম্পসনের।
বড় অদ্ভুত প্রাণী এই সীল। সীলরা অতি প্রাচীনকালে, ডাঙায় বসবাস করত। কালক্রমে তারা পানিকেই নিজেদের আবাসস্থল হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাদের স্বভাব, প্রকৃতি, দৈহিক বৈশিষ্ট্য এখনও স্থলচর প্রাণীদের মতই রয়ে গেছে। সীলদের ধমনীতে উষ্ণ রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। সীলদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া সম্পন্ন করে ফুসফুস। সীলরা ডিম পাড়ে না, জ্যান্ত বাচ্চা প্রসব করে। পানিতে জীবনযাপন শুরু করার পর অবশ্য কিছু পরিবর্তনও এসেছে ওদের মধ্যে। যেমন পাগুলো রূপান্তরিত হয়ে সাঁতার কাটার সুবিধার জন্যে হাঁসের পায়ের মত হয়েছে। সীলরা একান্নবর্তী পরিবার। প্রত্যেক সীল পরিবারে একজন কর্তা থাকে। তার থাকে একাধিক স্ত্রী এবং অনেক বাচ্চাকাচ্চা। মেয়ে-সীল বাচ্চা প্রসব করে ডাঙায়। বাচ্চারা জন্মেই সাঁতার কাটতে পারে না। ওদের বাবা-মা ওদেরকে সাঁতার শেখায়। মাসখানেকের চেষ্টায়
৯৬
ভলিউম ১৬
বাচ্চারাও বড়দের মত অভিজ্ঞ সাঁতারু হয়ে ওঠে।
সীলরা গান গাইতেও পারে। নিজেদের কণ্ঠকে তারা নানা ছন্দে, নানা সুরে পরিবর্তিত করতে ওস্তাদ।
এই সীলের মাংস এস্কিমোদের প্রধান খাদ্য। সীলের চর্বি ব্যবহার করে তারা আলো জ্বালার জন্য। সীলের চামড়ায় গরম কাপড় তৈরি হয়। এস্কিমোরা সীলের চামড়া দিয়ে নৌকাও তৈরি করে।
গ্রীনল্যাণ্ডের নদীতে সীল ছাড়াও বিরাটাকার সী-এলিফ্যান্ট, সী-লায়ন, সী-কাউ এর দেখা পাওয়া যায়। এস্কিমোরা হার্পণ-এর সাহায্যে এইসব জলচরপ্রাণী শিকার করে বরফমোড়া এই ভূখণ্ডে টিকিয়ে রেখেছে নিজেদের অস্তিত্ব।
| দিক হারিয়ে কঠিন বরফে ঢাকা বিস্তীর্ণ এলাকায় একা তীব্র শীতের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন মি. সিম্পসন। একটা ব্যাপারে এখন আর কোন সংশয় নেই তার মৃত্যু দ্রুত এগিয়ে আসছে, এখান থেকে বেঁচে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। প্রফেসর ওয়াই তাকে এখানে পাঠিয়েছে বিনা উদ্দেশ্যে তা মনে করার কারণ নেই। এই বরফের রাজ্যে তিনি প্রাণ হারাবেন, প্রফেসর ওয়াই তাই চায়। শয়তানটা নিশ্চয়ই তাকে এমন জায়গায় পাঠায়নি যেখানে কারও সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। এস্কিমোরা যেখানে নেই, যেখানে বাস করে না, সেখানেই তাকে পাঠানো হয়েছে।
বিপদ বিকট রূপ ধারণ করতে শুরু করল খানিক পর। দেখতে দেখতে কুয়াশা আরও গাঢ় হয়ে নামে চারদিকে। দুই হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। তারপর শুরু হয় তুষারপাত । সেই সাথে কনকনে বাতাস।
প্রমাদ গুণলেন মি. সিম্পসন। উপায় কি হবে? কোথায় আশ্রয় নেবেন তিনি?
খাবারের প্যাকেটে এক শিশি ব্র্যাণ্ডি ছিল। সেটা পান করে একটু আরাম পেলেন যেন একটু যেন গরম হলো শরীরটা। কিন্তু খানিক পরই আবার শুরু হলো। যন্ত্রণা আর ব্যথা।
কতক্ষণ স্থায়ী ছিল ঝড় হিসেব করেননি মি, সিম্পসন। থেমেছে মাত্র ঘণ্টা দুয়েক আগে। প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা হাত-পা গুটিয়ে পড়েছিলেন তিনি প্রকাণ্ড একটা তিনমানুষ সমান উঁচু বরফখণ্ডের পাশে বাতাসের হাত থেকে রক্ষা করেছে তাকে
এই পাথর।
ঝড় থেমে যাবার পর আবার হালকা হয়ে গেছে কুয়াশা। তুষারপাত বন্ধ হয়েছে। সূর্যের আলো দেখতে পাচ্ছেন তিনি। শীতের প্রকোপ হয়তো কমেছে একটু। যদিও তা টের পাচ্ছেন না মি. সিম্পসন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এখনও ব্যথা করছে। তার শরীরের হাড়গুলো।
দূরে একটা উঁচু মত কিছু দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই হাঁটছেন মি. সিম্পসন । ঘন্টাচারেক পর কালো হয়ে গেল মি. সিম্পসনের মুখ। একি আবহাওয়া এখানকার।
আবার নামছে তুষার। আবার গাঢ় হচ্ছে কুয়াশা। দমকা বাতাসও দেখা দিয়েছে হঠাৎ ।
উঁচু মত জিনিসটা আসলে পাহাড়। মি. সিম্পসন আরও বিশ মিনিট হাঁটার পর উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। এই পাহাড়েই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন নিজেকে আর
৭-কুয়াশা ৪৭
৯৭
কিছু না হোক, পাহাড়ের উপর একটা বরফের তৈরি ঘর তো আছে। ঘরের ভিতর দুটো কাঠের বাক্সও দেখেছিলেন মি. সিম্পসন। সেগুলো খুলে দেখার কথা চিন্তা করেননি তিনি তখন।
সেগুলো খুলে দেখবেন এবার। ভাগ্য ভাল হলে, শুকনো কিছু খাবার, একটা ম্যাপ, কম্বল, ব্র্যান্ডি বা হুইস্কির কটা বোতল। চিন্তার লাগাম টেনে ধরলেন মি. সিম্পসন। বড় বেশি আশা করছেন তিনি।
পাহাড়ে উঠতে গিয়ে প্রকৃত সমস্যার মুখোমুখি হলেন মি: সিম্পসন । পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে ঝড়। পাহাড়ের উপর থেকে সবেগে নেমে আসছে তুষার-বস। কোথায় পা রাখবেন স্থির করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেলেন তিনি। পঞ্চাশ গজের মত উঠলেন অমানুষিক পরিশ্রম করে। পা রাখলেন সামনে অনেক বাছ-বিচার করে। ভাগ্য বিরূপ, স্থূপীকৃত তুষারের উপর পড়ল পা।
তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন তিনি। তুষারের ধস নামল সেই সাথে। তুষারের সাথে গড়াতে গড়াতে একেবারে পাহাড়ের পাদদেশে নেমে এলেন তিনি।
নতুন করে পাহাড়ে চড়বার সংগ্রাম শুরু হলো তার। পুলিসের লোক তিনি, পরাজয় কাকে বলে জানেন না। বিজয়ী হতে তিনি বদ্ধপরিকর।
শেষ পর্যন্ত জিতলেন মি. সিম্পসন। সেই বরফের তৈরি ঘরে ঢুকলেন অবশেষে হামাগুড়ি দিয়ে।
অতিরিক্ত আশা তিনি করেননি। বাক্স দুটো ভেঙে যতটুকু আশা করেছিলেন তার চেয়েও বেশি পেলেন সব জিনিসই।
কিন্তু ঝড়-তুফান ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে. মি. সিম্পসনের ঘরের উপর এবং চারদিকে তুষারের স্তর পঁচিশ গজ মোটা দেয়ালের সৃষ্টি করল।
বরফের নিচে চাপা পড়ে গেলেন মি. সিম্পসন।
নয়।
‘হাঃ! হাঃ! হাঃ!
কেঁপে উঠল প্রফেসর ওয়াইয়ের অট্টহাসিতে প্রশস্ত হলরুমের চার দেয়াল। হাসি থামল। চেহারাটা তার হয়ে উঠল পরক্ষণে বাঘের মত ভয়ঙ্কর হিংস। চোখের দৃষ্টি যেন আগুনের শিখা। বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠলেন প্রফেসর ওয়াই, চিনেছি! ‘তাকে আমি চিনতে ভুল করিনি জর্মন শেখ! কুয়াশা। নিশ্চয়ই এ তারই কাণ্ড!
‘স্যার! কুয়াশা কিভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসবে?’
প্রফেসর ওয়াই সঁতে দাঁত চেপে কড়কড় করে শব্দ তুললেন। সিলিঙের দিকে খ্যাপাদৃষ্টিতে তাকিয়ে কথা বলে উঠলেন। যেন কুয়াশা রয়েছে সেখানে।
“সাবাশ! সাবাশ, মি. কুয়াশা। কংগ্রাচুলেশনস্! সত্যি, আপনি বিশ্বের সেরা বৈজ্ঞানিক! যা কারও পক্ষে সম্ভব নয় আপনি তাই সম্ভব করেছেন। ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি আমি, আপনি আবার ফিরে আসতে পারবেন পৃথিবীতে! ব্রাভো, মি. কুয়াশা,
৯৮
ভলিউম ১৬
ব্রাভো! কিন্তু সাবধান, মি, কুয়াশা, খুব সাবধান! মারাত্মক পরিণতি ঘটতে যাচ্ছে।
নার। খেপে গেছি আমি! কেউ রক্ষা করতে পারবে না এবার আপনাকে আমার হাত থেকে আপনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন আমার বিরুদ্ধে কী সাংঘাতিক স্পর্ধা আপনার প্রস্তুত হোন, মি, কুয়াশা, আপনি আক্রমণের সূচনা করেছেন, আমি পাল্টা আঘাত হানব! হাঃ! হাঃ! হাঃ! হাঃ! ভেবেছিলেন স্পেসক্রাফট থেকে বোমা মেরে আমাকে খতম করে দেবেন? হাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ! হাসি পায়, মি. কুয়াশা, আমার হাসি পায়। প্রফেসর ওয়াইকে খতম করা অত সহজ নয়, মি. কুয়াশা! জর্মন শেখ!’
| ‘ইয়েস, স্যার।’ প্রফেসর ওয়াই অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন সহকারী জর্মন শেখের দিকে, ‘আমাদের এই কন্ট্রোলরূমের অবস্থান কেউ যেন টের না পায়। এই বিল্ডিংয়ের আশপাশে সন্দেহজনক যাকে দেখবে তাকেই ধরে এনে গায়েব করে দেবে ভ্যানিশিং রে দিয়ে–এই আমার হুকুম। এই হুকুম পালনে বিচ্যুতি দেখলে আমি খুন করব তোমাকে।
“ইয়েস, স্যার।’
প্রফেসর কি যেন ভাবলেন মাথা নিচু করে। কয়েক মুহূর্ত পর ঝট করে মাথা তুললেন আবার, আমি জানি মি. কুয়াশা এরপর কি করতে যাচ্ছেন। ভারত মহাসাগরের দ্বীপ থেকে তিনি ইতিমধ্যেই হয়তো উদ্ধার করেছেন মি. টিকটিকি আর তার স্ত্রীকে।’– জর্মন শেখ অবিশ্বাস ভরা গলায় প্রশ্ন করল, কিন্তু, স্যার, মি. কুয়াশা জানলেন কিভাবে ওই দ্বীপের সন্ধান?’
প্রফেসর ওয়াই বললেন, কিভাবে সন্ধান পেয়েছেন তা-ও আমি জানি। মি. কুয়াশা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রত্যেকের শরীরের রক্তে VNR-5 এর একটা করে কণা প্রবেশ করিয়ে রেখেছেন বহুদিন আগেই। একটা ইণ্ডিকেটর যন্ত্রও ফিট করে নিয়েছেন হাতঘড়ির সাথে। VNR-5-এর কণা যার শরীরে থাকবে তার অবস্থান সম্পর্কে এই ইণ্ডিকেটর পরিষ্কার একটা ধারণা দিতে সক্ষম। পাঁচশো মাইল দূর থেকেও কাজ করতে পারে এই ইণ্ডিকেটর যন্ত্র। মহাশূন্য থেকে ফিরে তিনি এই যন্ত্রের সাহায্যে টিকটিকি শহীদ আর মিসেস খানের সন্ধান পান। মি. কুয়াশা আগেই শুনেছিলেন আমি ওদেরকে ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপে পাঠাব। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি খুঁজে বের করবেন বাকি সবাইকে। কামাল আর ডি কস্টা, তারা বোধহয় মারা গেছে এভারেস্টের ওপর থেকে নামতে গিয়ে। মি. সিম্পসন–সে-ও হয়তো এতক্ষণে–জর্মন শেখ, তোমার দক্ষিণ হস্ত ডেভিলকে আনো। ওকে আমার দরকার হবে এখুনি।
ইয়েস, স্যার! জর্মন শেখ পা বাড়াল।
প্রফেসর বললেন, ‘থামো। মি. কুয়াশাকে বন্দী করতে হবে আমাদের। বড় বেশি বেড়ে গেছেন তিনি। আমি জানি পরবর্তী পরিকল্পনা কি তার। সবাইকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন তিনি আগে। তারপর যাবেন আফ্রিকায়। আফ্রিকার রহস্যপুরী থেকে শত শত মণ স্বর্ণ উদ্ধার করার লোভ ত্যাগ করতে পারবেন না তিনি। জর্মন শেখ, ফঁদ পাতো। আমার শত্রুদের কবর রচিত হবে ওই আফ্রিকাতেই। যারা
কুয়াশা ৪৭
৯৯
মরে গেছে তারা বেঁচে গেছে, আর যারা বেঁচে আছে তাদেরকে অসহ্য কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলতে হবে। জর্মন শেখ, ব্যবস্থা করো। তারা সবাই যেন আগুনে পুড়ে মরে, দাবাগ্নি যেন তাদের সবাইকে ভস্ম করে দেয়। আর মি. কুয়াশা-তাকে আমি জীবন্ত চাই। তাঁকে আমি জীবন্ত হাতে পেতে চাই। নিজের হাতে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে তাঁকে আমি খুন করব! উন্মাদের মত দেখাচ্ছে প্রফেসর ওয়াইকে। ঠকঠক করে উত্তেজনায় কাঁপছেন তিনি।
জর্মন শেখ। ‘ইয়েস, স্যার। প্রফেসর বললেন, ‘মি. সিম্পসন গ্রীনল্যাণ্ডে আছে, না?’ ‘ইয়েস, স্যার।
প্রফেসর নির্দেশ দিলেন ডেভিলকে, সঙ্গে করে নিয়ে এসো তাহলে এখুনি। আর শোনো, ফাঁদ কিভাবে পাততে হবে জানাব আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে। যাও!
ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল জর্মন শেখ প্রফেসর ওয়াইয়ের কন্ট্রোলরুম থেকে। পায়চারি শুরু করলেন প্রফেসর ওয়াই। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ। | বিড়বিড় করছেন তিনি, “আমাকে খেপিয়ে ভোলার মজাটা এবার দেখাব? পুড়িয়ে মানব সবাইকে! দাবাগ্নি ঘিরে ধরবে চারপাশ থেকে কোথায় পালাবে বাছাধনেরা? কে এবার বাঁচাবে তোমাদেরকে? কুয়াশা? হাঃ! হাঃ! হাঃ! হাঃ! মি. কুয়াশা তখন নিজের প্রাণ বাঁচাতেই হিমশিম খাবে। উপায় নেই, কোন উপায় নেই। এবার তোমাদের আমার হাত থেকে বাঁচার। নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরি করেছি আমি মনে মনে••
Leave a Reply