৪৬. প্রফেসর ওয়াই ৩: আরেক পৃথিবী [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪৬
প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর, ১৯৭৫
এক
ঢাকা।
প্রফেসর ওয়াইয়ের কন্ট্রোল রূম। খেপে গেছে প্রফেসর ওয়াই। এইমাত্র সে একে একে শহীদ, মহুয়া, মি. সিম্পসন এবং কামাল ও ডি. কস্টাকে তার ম্যাটার ট্রান্সমিট করার যুগান্তকারী মেশিনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দুর্গম জায়গায়।
* শহীদ এবং মহুয়াকে পাঠানো হয়েছে ভারত মহাসাগরের ছোট্ট একটা দ্বীপে। যে দ্বীপে এর আগে কোনদিন কোন মানুষ পৌঁছোয়নি। যে দ্বীপে কোনদিন কোন জাহাজ ভেড়েনি, ভিড়বেও না। ওদের সাথে প্রফেসর ওয়াই দু’প্যাকেট শুকনো খাবার দিয়েছে। যাতে ওরা কয়েকদিন অন্তত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। এটা একধরনের নির্মম রসিকতা প্রফেসর ওয়াইয়ের। সে জানে শহীদ এবং মহুয়া শত চেষ্টা করলেও সেই জনমানবহীন দ্বীপ থেকে মুক্তি পাবে না কোনদিন। মি. সিম্পসনকে গরম পোশাকে সাজিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে সে গ্রীনল্যাণ্ডে। গ্রীনল্যাণ্ড, যেখানে বরফ ছাড়া চোখে পড়ে না কিছুই। শূন্য ডিগ্রীর নিচেই থাকে সদা সর্বদা সেখানে টেম্পারেচারের কাটা। আর কামাল এবং ডি, কস্টাকে পাঠিয়েছে সে হিমালয়ে, সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের একেবারে মাথায়। ওদেরকে অক্সিজেন সিলিণ্ডারে সজ্জিত করে পাঠালেও মাত্র আধঘণ্টা পর ফুরিয়ে যাবে ওদের
অক্সিজেন। মরে যাবে ওরা দম ব হয়ে!
এবারে কুয়াশার পালা। করার কিছু নেই কুয়াশার । প্রফেসর ওয়াইকে সে আর সকলের চেয়ে ভাল করে চেনে। শহীদ, মি. সিম্পসন, ডি কস্টা এবং মহুয়াৰুে সে ধরে এনেছে এখানে এখবর পাবার পরপরই স্ব-আবিষ্কৃত খুদে মারণাস্ত্রগুলো সাথে নিয়ে সোজা চলে এসেছে সে প্রফেসর ওয়াইয়ের কন্ট্রোল রূমে। শহীদদেরকে বাঁচাবার তাগিদেই কাজটা করে সে। কিন্তু কাজটা যে ভুল হয়েছে তা সে বুঝেছে অনেক পরে। লেজার গান, আলট্রাসনিক যন্ত্র, স্মোক বম বা অন্য কোন মারণাস্ত্র ব্যবহার করে প্রফেসর ওয়াইকে ঘায়েল করা সম্ভব নয় একথা কুয়াশার চেয়ে ভালভাবে আর কেউ জানে না। লেজার গান মারাত্মক একটা অস্ত্র। কিন্তু লেজার গান দিয়েও ঘায়েল করা মুশকিল অতিমানব প্রফেসর ওয়াইকে ।
এটা প্রফেসর ওয়াইয়ের নিজস্ব কন্ট্রোল রূম। এখানে প্রফেসর ওয়াই রাজা। এই কন্ট্রোল রূমে কেউ ওর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
অকারণে বাধা দিয়ে লাভ নেই। তাতে নিজের মৃত্যু ডেকে আনাই সার হবে। প্রফেসর পাগল হয়ে গেছে। তার পক্ষে সবই সম্ভব। ম্যাটার ট্রান্সমিট করার যন্ত্রের দিকে পা বাড়াল কুয়াশা। ঘড়ি দেখল। প্রফেসর তাকে মহাশূন্যে পাঠাবে ঘোষণা
করেছে।
কেবিনে ঢুকে দাঁড়াল কুয়াশা। অকস্মাৎ নীল অত্যুজ্জ্বল আলোয় ধাধিয়ে গেল চোখ।
তারপর আর কিছু মনে নেই কুয়াশার।
ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ! চড়ুই পাখিরা এক ডাল থেকে আরেক ডালে গিয়ে বসছে। চুিক চুক, কুহু-কুহু, ক-ক–অনেক রকম পাখির ডাক কানে আসছে কুয়াশার। কলকল পাহাড়ী নদীর ধেয়ে আসার শব্দ আসছে কাছে পিঠে কোথাও থেকে । নিজের দিকে তাকাল কুয়াশা।
| মখমলের মত মসৃণ কালো আলখাল্লায় ঢাকা তার ঋজু বিশাল শরীর। আলখাল্লার গোপন পকেটগুলোয় হাত চলে গেল। আছে, যা যা ছিল সবই আছে।
চারদিকে গভীর অরণ্য। এ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে? প্রফেসর ওয়াইয়ের ম্যাটার ট্রান্সমিট করার কেবিনে প্রবেশ করার পর ডিজইন্টিগ্রেটেড অবস্থায় কতক্ষণ ছিল সে? কয়েক মিনিট, না কয়েক হাজার বছর?
বা হাতটা চোখের সামনে তুলল কুয়াশা। রিস্টওয়াচের কাটায় চোখ রাখল।
রবিবার। হ্যাঁ, রবিবারেই প্রফেসর ওয়াইয়ের কন্ট্রোল রূমে ঢুকেছিল সে। তিন তারিখ-ঠিকই আছে। মাসটাও আগস্ট। রিস্টওয়াচের কাঁটা দেখে হিসেব করল কুয়াশা, ষোলো মিনিট পঞ্চান্ন সেকেণ্ড কেটে গেছে প্রফেসর ওয়াইয়ের কেবিনে ঢোকার পর।
পনেরো সেকেণ্ড হয় এই অপরিচিত জায়গায় এসে পৌঁছেছে সে। মাত্র পনেরো সেকেণ্ড হয়েছে ডিজইন্টিগ্রেটেড অবস্থা থেকে অর্থাৎ গোটা দেহটা বিচ্ছিন্ন হয়ে শত সহ-লক্ষ কোটি অণুতে পরিণত হবার পর আবার এই জায়গায় অণুগুলো একত্রিত হয়েছে এবং তার ফলে তার দেহ পূর্বের আকার আকৃতি ফিরে পেয়েছে।
তার মানে মধ্যবর্তী মোলো মিনিট চল্লিশ সেকেণ্ডের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। ষোলো মিনিট চল্লিশ সেকেণ্ডে কতটা দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব?
ম্যাটারকে অণুতে পরিণত করে আলোর গতিতে যে-কোন দূরত্বে নিক্ষেপ করতে পারে প্রফেসর ওয়াইয়ের ম্যাটার ট্রান্সমিশন যন্ত্র।
ষোলো মিনিট চল্লিশ সেকেণ্ডে আঠারো কোটি ষাট লক্ষ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করেছে সে আলোর গতিতে। দ্রুত হিসেব করে ফেলল কুয়াশা। পরমুহূর্তে তার মনে পড়ল–পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল।
ভুরু কুঁচকে উঠল কুয়াশার। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব যা তার দ্বিগুণ দূরত্ব অতিক্রম করেছে সে।
চঞ্চল দৃষ্টিতে চারদিকে আবার তাকাল কুয়াশা। এ কোথায় তাকে পাঠিয়েছে পাগলটা? পরিচিত সব পাখিদেরকে দেখা যাচ্ছে, আম, জাম, বট-পরিচিত সব গাছ আশেপাশে। তবে কি ধাপ্পা মেরেছিল প্রফেসর ওয়াই? অহেতুক ভয় দেখিয়েছিল?
ভলিউম ১৬
প্রফেসর ওয়াই বলেছিল, আপনাকে আমি ডক্টর কূটজের মহাশূন্যযানে পাঠাব। কূটজের মহাশূন্যযানে আমার রিসিভিং সেট আছে লুকানো। তার মহাশূন্যযানটা কোন গ্রহে আছড়ে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে, যতদূর জানি। আপনি মহাশূন্যের সেই গ্রহে গিয়ে উপস্থিত হবেন। আর কোনদিন ফিরতে পারবেন না এই পৃথিবীতে।
এটা কি তবে পৃথিবী নয়? | অসম্ভব, এটা পৃথিবী না হয়ে যায় না। কিন্তু হিসেব মিলছে না তাতেও। তবে কি প্রফেসর ওয়াই তাকে অণুতে পরিণত করে পৃথিবীর চারদিকে কয়েক বার চক্কর খাইয়ে আবার পৃথিবীরই কোথাও নামিয়ে এনেছে? নাকি সোজা গিয়ে সূর্যের সাথে। ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞাত কারণে ফিরে এসেছে সে পৃথিবীতেই?
কিন্তু আর একটা সম্ভাবনার কথাও উঁকি দিল কুয়াশার মনে। | টুইন আর্থ?
টুইন অর্থের গল্প পৃথিবীতে বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত। এর স্বপক্ষে মজবুত। কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু এর বিরুদ্ধেও আজ অবধি কেউ কোন প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি।
| টুইন আর্থ সম্পর্কে ব্যাখ্যাটা এই রকম ও পৃথিবী থেকে সূর্য যত দূরে, সূর্যের অপর দিকে সূর্য থেকে ঠিক ততদুরে আমাদের পৃথিবীর মতই সমগতিসম্পন্ন কোন গ্রহ থাকা খুবই সম্ভব। যদি থাকে তাহলে সেই গ্রহকে কোনদিনই আমরা দেখতে পাব না। কারণ পথিবী যে গতিতে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, সেই গ্রহটিও একই গতিতে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। অর্থাৎ পৃথিবী আর সেই গ্রহের মাঝখানে প্রকাণ্ড। একটা পাচিলের মত সব সময়ই রয়েছে সূর্য। ফলে সেই গ্রহের বাসিন্দা পৃথিবীকে, পৃথিবীর বাসিন্দা সেই গ্রহকে কোনদিন দেখতে পাচ্ছে না। টুইন আর্থ যদি থাকে তাহলে তাতে প্রাণী আছে এটাও ধরে নেয়া যায়। কারণ টুইন আর্থ যেহেতু সূর্যের কাছ থেকে পৃথিবীর সমান দূরত্বে অবস্থিত এবং তার আকার আকৃতিও পৃথিবীর মত, সেহেতু তার আবহাওয়াও পুরোপুরি পৃথিবীর মতই হবার কথা।
চঞ্চল হয়ে উঠল হঠাৎ কুয়াশা। তীক্ষ্ণ চোখে এদিক ওদিক তাকাল সে। প্রফেসর ওয়াইয়ের রিসিডিং সেট কোথায়? তার কথা মত, ডক্টর কূটজের স্পেসক্রাফটে ছিল রিসিভিং সেটটা। কোথায় সেই স্পেসক্রাফট? | খানিক খোঁজাখুঁজির পরই একটা ঝোঁপের ভিতর পাওয়া গেল রিসিভিং সেট। কিন্তু আবার একটা প্রশ্ন দেখা দিল কুয়াশার মনে। এই রিসিভিং সেট যে ডক্টর
কূটজের মহাশূন্যযানে ছিল তার প্রমাণ কি?
কুয়াশা লক্ষ করল আশপাশে গাছপালা এবং ঝোঁপঝাড়ের পাতা আর শাখা প্রশাখা শুকনো, কেউ যেন আগুন দিয়ে ঝলসে দিয়ে গেছে। পা বাড়াল কুয়াশা। খানিক দূরে যেতেই চোখে পড়ল আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে চারদিকের গাছগুলো।
| আরও পঁচিশ ত্রিশ গজ এগোবার পর থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। আর এগোবার দরকার নেই। পুড়ে কালো হয়ে গেছে চারদিকের বনভূমি। মাঝখানে দুমড়েমুচড়ে কুয়াশা ৪৬
পড়ে রয়েছে একটা ধাতব পদার্থের লম্বা রকেট।
| ডক্টর কূটজের স্পেসক্রাফট ধ্বংস হয়ে গেছে তাহলে। সবচেয়ে আগে যে প্রশ্নটা দেখা দিল কুয়াশার মনে–এটা যদি অন্য কোন গ্রহ বা টুইন আর্থ হয়, তাহলে পৃথিবীতে ফিরবে সে কিভাবে?
চেষ্টা করে মৃদু হাসল কুয়াশা। হয়তো অকারণেই সে দুশ্চিন্তা করছে। হয়তো। ডক্টর কূটজের স্পেসক্রাফট পৃথিবীরই কোন জায়গায় ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রফেসর ওয়াই এ সম্পর্কে হয়তো খবর রাখেনি। এটা হয়তো পৃথিবীরই কোন জায়গা।
ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। বেরুতে হবে এই জঙ্গল থেকে। প্রমাণ চাই, এটা পৃথিবী। কিনা।
| চারদিকে গভীর বনভূমি। কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। কান পাতল কুয়াশা। পাখিদের কলরব আর খরস্রোতা নদীর কুলকুল শব্দ ছাড়া শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না।
কিছু।
“ লম্বা পা ফেলে বনভূমির ভিতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল কুয়াশা। চঞ্চল দৃষ্টিতে গাছপালাগুলো দেখে নিচ্ছে সে। পাতার ফাঁক দিয়ে গলে পড়ছে সূর্য কিরণ, টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে ঘাসের উপরে।
ফাঁকা জায়গায় পৌঁছল কুয়াশা মিনিট সাতেক পর। ছোট একটা উপত্যকার উপর রয়েছে সে। ঢালু হয়ে নেমে গেছে মাটি সমতলভূমির দিকে। দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট একটা গ্রাম। বেড়ার ছোট ছোট ঘর বাড়ি। আরও দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুদীর্ঘ পাঁচিলের মত পাহাড়শ্রেণী। পাহাড়ের উপর মেঘ দেখা যাচ্ছে। মেঘের উপর সূর্য।
| স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল কুয়াশা। মুচকি একটু হাসল আপন মনে । প্রফেসর ওয়াই মিছে ভয় দেখিয়েছিল। পৃথিবীরই কোন জায়গা এটা। মহাশূন্যের কোন অপরিচিত গ্রহ নয়।
আবার হাসল কুয়াশা প্রফেসর ওয়াইয়ের কথা মনে পড়তে। কিন্তু প্রশ্ন হলো–পৃথিবীর এই জায়গাটার নাম কি? এটা কি আফ্রিকা? না, ইউরোপ? এশিয়া হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
| উপত্যকা থেকে সমতলভূমির দিকে নামতে শুরু করল কুয়াশা। দূরের ওই গ্রামটায় পৌঁছুলেই সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। | উপত্যকা জুড়ে গাছপালা। নামার সময় হরিণ এবং খরগোশ দেখল কুয়াশা। মাইল দুয়েক অতিক্রম করার পর গ্রামে ঢুকল সে। দূর থেকেই একটা ব্যাপার লক্ষ করে অবাক হয়েছিল কুয়াশা। গ্রাম যখন, লোকজন না থেকেই পারে না। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না সে। গ্রামের ভিতর ঢুকে রীতিমত বিস্ময় বোধ করল। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এবং ছাড়াছাড়িভাবে বেশ অনেকগুলো বেড়ার ঘর পঁাড়িয়ে আছে। কিন্তু পথে বা বাড়িতে উঠানে কিংবা ঘরগুলোর সামনে প্রাণের সামান্যতম চিহ্ন
পর্যন্ত নেই।
এ কেমন ব্যাপার? একটা তিনচালার দিকে এগোল কুয়াশা। বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে এল ঘরের ভিতর
ভলিউম ১৬
থেকে একটা শিয়াল। কুয়াশাকে ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখল কি দেখল না। তীর বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল বাড়ির পিছন দিকের বাগানে।
একমুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে আবার পা বাড়াল কুয়াশা। একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে তাকে। শিয়ালের মুখে একটা মানুষের প্রায়-মাংসহীন হাত ছিল, লক্ষ করতে ভুল করেনি সে। হাতটা পচে গলে গেছে, তাও দেখে নিয়েছে সে এক পলকের ভিতর।
লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল কুয়াশা। তীৰ দুর্গন্ধে কুঁচকে উঠল নাক। রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরল কুয়াশা।
অস্তগামী সূর্যের শেষ কিরণ ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছে। ঘরটা বেড়ার হলেও ভিতরে দামী আসবাবপত্রের অভাব নেই। একদিকের প্রায় দশহাত দেয়াল জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা অদ্ভুত যন্ত্র। জিনিসটা দেখতে হুবহু টেলিভিশনের মত। পাশেই একটা ছোট্ট টেবিলের উপর ছোট একটা যন্ত্র। ওয়্যারলেস ওটা, অনুমান করল কুয়াশা। সোফা সেট, ফোমের বিছানা, রিফ্রিজারেটর–সবই আছে।
ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে তিনটে কঙ্কাল। দুটো কঙ্কাল শুকনো, খটখটে। অপর কঙ্কালটার হাড়ের সাথে এখনও পচা, গলা কিছু মাংস লেগে রয়েছে। একটা হাত নেই এই কঙ্কালটার।
তীক্ষ্ণ চোখে কঙ্কালগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল কুয়াশা। তার দৃষ্টিশক্তি অসাধারণ বলেই কয়েকটা বিদঘুঁটে ব্যাপার সেই মুহূর্তে নজর পড়ল তার। তিনটে কঙ্কালেরই হাতের আঙুল একটা করে বেশি। অর্থাৎ প্রতিটি হাতের আঙুল পাঁচটা নয় ছয়টা। শুধু তাই নয়, সন্দেহ হতে পাজরগুলোও গুণল সে। মানুষের পাজর মোট বিশটা থাকে। ডান পাশে দশটা বাঁ পাশে দশটা। কিন্তু কঙ্কাল তিনটেরই পাঁজরের সংখ্যা সাধারণ মানুষের তুলনায় দুটো করে বেশি। এগারো দু’গুণে বাইশটা করে পাজর প্রত্যেক কঙ্কালের। | ভুরু কুঁচকে বেরিয়ে এল কুয়াশা ঘরের বাইরে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আলখাল্লার পকেট থেকে রঙিন কাঁচ লাগানো একটা চশমা বের করে জ্বলন্ত লাল সূর্যের দিকে তাকাল সে।
কয়েক মুহূর্ত পর চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে পকেটে রেখে দিল আবার। গ্রামের চারদিকে ঘুরল সে। কেউ নেই। অনেকগুলো ঘরে ঢুকল নাকে রুমাল চাপা দিয়ে। কোন কোন ঘরের ভিতর পাওয়া গেল আরও কঙ্কাল, কোন কোন ঘরে পাওয়া গেল না। কিন্তু সব বাড়িতেই প্রকাণ্ড টেলিভিশন এবং ওয়্যারলেস সেট দেখল কুয়াশা। হিসেব কষার যন্ত্র, শক্তিশালী বিনকিউলার, অত্যাধুনিক টেপ রেকর্ডার, পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র, গোলাকার থার্মোফ্লাস্ক, যান্ত্রিক চেয়ার, রিভলভিং খাট, গ্যাস লাইন, ইলেকট্রিসিটি, ইন্টারকম ইত্যাদি হরেক রকম জিনিস প্রায় সব ঘরেই দেখল কুয়াশা। সবই পৃথিবীর তুলনায় আধুনিক।
খটখটে কঙ্কাল রাস্তার উপরও পড়ে থাকতে দেখল কুয়াশা। গ্রামটা ছোট হলেও রাস্তাগুলো পাকা রাস্তার মোড়ে মোড়ে দুটো করে কল। কৌতূহল জাগল।
কল দুটোর মুখ খুলে দিতেই একটা দিয়ে সাদা ঘন তরল পদার্থ এবং অপরটি
কুয়াশা ৪৬
দিয়ে পানি বেরিয়ে আসতে লাগল মোটা ধারায়। সাদা তরল পদার্থটা হলো দুধ। ঘরগুলোর দেয়াল এবং চাল বেড়া বলে মনে হলেও কুয়াশার চোখে ওগুলো অস্বাভাবিক উজ্জল ঠেকল। পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলো সে। বরমার বেড়া নয়, ওগুলো কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। প্লাস্টিকের ছাদও দেখল কুয়াশা। মজবুত এবং হালকা। গ্রামের পশ্চিম দিকে চারতলা বাড়িও রয়েছে অনেক।
| গ্রামের শেষ সীমায় পৌঁছে কুয়াশা গোলাকার কয়েকটা বড়সড় যন্ত্র দেখতে পেল। ধারে কাছে এখানেও কেউ নেই। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে যন্ত্রগুলো। ছোটখাট মটরগাড়ির মত আকার সেগুলোর, পুরোপুরি গোলাকার। কিন্তু চাকা দুটো করে চারটে নর, ছয়টা করে বারোটা।
এরকম আকৃতির যানবাহন এর আগে দেখেনি কুয়াশা। জিনিসটার বহির্ভাগ ইস্পাতের তৈরি। খুবই মসৃণ। দরজাটা পেটের কাছে। একটা যন্ত্রের দরজা খুলে ভিতরে মাথা গলিয়ে দিল কুয়াশা।
সল্পীডোমিটারের ডায়াল, ফুয়েল ইণ্ডিকেটর, গিয়ার, স্টিয়ারিং হুইল দেখে বুঝতে অসুবিধে হলো না, যন্ত্রটা আসলে এক ধরনের গাড়ি। কিন্তু সামনের দিকের রাস্তা দেখার জন্য উইণ্ডস্ক্রীন বা ওই জাতীয় কিছু নেই ভিতরে। তার বদলে আছে টিভির বড়সড় পর্দা। গাড়ির চারপাশের সবকিছুই দেখা যায় সেই স্ক্রীনে।
নতুন ধরনের এই যন্ত্রের ভিতর উঠে বসল এবার কুয়াশা। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রাখল সে। ফাঁকা রাস্তা। সতর্ক অর্থাৎ টাইট হয়ে বসে স্টার্ট দিল কুয়াশা গাড়িতে। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে।
মৃদু একটা গুঞ্জন ধ্বনি কানে এল।
গিয়ার দিতেই আঁতকে উঠল কুয়াশা। যাদুর মত ক্রিয়াকাণ্ড ঘটতে শুরু করল। এক ধাক্কায় বিশগজ এগিয়ে গেল গাড়িটা। প্রতি সেকেণ্ডে বাড়ছে স্পীড ।
ল্পীডোমিটারের দিকে চোখ পড়তে ‘কুয়াশা দেখল অপরিচিত ভাষায় লেখা অঙ্কের প্রথম ঘরটা মাত্র ছুঁয়েছে কাটা। ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইলের মত বেগে ছুটতে শুরু করেছে গাড়ি প্রাথমিক পর্যায়েই, অনুমান করল কুয়াশা। স্পীডোমিটারের প্রথম অঙ্কটা তাহলে পঞ্চাশ মাইলের সমর্থক, ধরে নেয়া যায়। গুণে দেখল কুয়াশা, এক ইঞ্চি পর পর আট ইঞ্চির মধ্যে আটটা সংখ্যা লেখা। তার মানে চারশো মাইল গতিবেগে চলতে পারে এই গাড়ি। | এটা পৃথিবী নয়, অন্য একটা গ্রহ, সে ব্যাপারে সব সন্দেহের অবসান ঘটছে ধীরে ধীরে। টুইন আর্থের ব্যাপারটা হয়তো দিবালোকের মতই সত্য। এই গ্রহের মানুষ পৃথিবীর মানুষের মতই দেখতে, প্রমাণ এসেছে ইতিমধ্যে তার হাতে। এবং যান্ত্রিক সভ্যতায় এরা পৃথিবীর চেয়ে অনেক অনেক বেশি উন্নত।
এই গাড়িটার কথাই ধরা যাক। তিনশো মাইল স্পীডে ছুটছে এখন। অথচ বিশেষ কোন শব্দ হচ্ছে না, ঝাঁকুনিও লাগছে না। জানালা নেই, দরজাও বন্ধ। এয়ারটাইট বলা চলে। তবে চাকার সাথে অতিরিক্ত যন্ত্র সংযুক্ত করা আছে, অক্সিজেন তৈরি হবার মেশিনটা চালু রাখার জন্য। শুধু তাই নয়, পানিতেও এটা চলতে পারে। তবে পানিতে এর স্পীড অর্ধেকের মত। সামনে ব্যারিকেড বা উঁচু
১০
ভলিউম ১৬
কোন বাধা থাকলে তা টপকে যাবার ক্ষমতাও এই গাড়ির আছে। অর্থাৎ উড়তেও পারে। কিন্তু মাত্র দশ হাত উপরে ওঠার ক্ষমতা এর। এদিকে উড়ন্ত অবস্থায় এর
স্পীড দ্বিগুণ প্রায়। সবকিছু দেখেশুনে অবাক হয়ে গেল কুয়াশা। | এদের যান্ত্রিক সভ্যতা সত্যি বিস্ময়কর। টিভির স্ক্রীনগুলো রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝুলছে। ট্রাফিক কন্ট্রোল করার ব্যবস্থা অত্যাধুনিক। রাস্তা সম্পূর্ণ ফাঁকা এবং নির্জন হলেও মোড়ে মোড়ে ক্যামেরা সিগন্যাল রোড ম্যাপের নিউমিনাস প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ডায়াল দেখে কুয়াশা বুঝতে পারল সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা হয় এখানে এবং এই সব রাস্তায় এক সময় সদাসর্বদা দ্রুতগতিসম্পন্ন যানবাহনের ভীড় লেগে থাকত।
যান্ত্রিক সভ্যতা ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন দিকে এরা যথেষ্ট উন্নতি করেছে বোঝা যাচ্ছে। ছেড়ে আসা গ্রামে এমন অনেক জিনিস দেখেছে কুয়াশা যে-সব জিনিস
পৃথিবীতে নেই বা থাকলেও তা এখানকার মত অত্যাধুনিক নয়। | গাড়ি চালাতে এতটুকু অসুবিধে হচ্ছে না কুয়াশার। একাধিক টেলিভিশনের পর্দায় ফুটে রয়েছে গাড়ির বাইরের চারদিকের দৃশ্য। দ্রুত, ঘণ্টায় তিনশো বিশ মাইল ল্পীডে ছুটছে গাড়িটা। প্রশস্ত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তা। যানবাহন এবং জনমানবহীন, ফাঁকা।
কত কথা ভাবছে কুয়াশা। প্রফেসর ওয়াই, শহীদ, মহুয়া, ডি কস্টা, কামাল এবং মি, সিম্পসন এখন কোথায়? এখনও কি বেঁচে আছে তারা প্রফেসর ওয়াই•••অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেল কুয়াশা। প্রফেসরকে নিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়েছে সে। দৈত্যটাকে ধ্বংস করা যে সম্ভব নয় তা নয়। ইচ্ছে করলে সে পারে, পারে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিতে, টুকরো টুকরো করে বাতিল আবর্জনায় পরিণত করতে। কিন্তু প্রফেসরকে ধ্বংস করার কথা ভাবলেই অন্তরের অন্তস্থলে ব্যথা অনুভব করে সে। প্রফেসরের নীতি, আদর্শ এবং উদ্দেশ্য ক্ষতিকর, বিপজ্জনক। সমর্থন করা যায় না তাকে। কিন্তু সাধারণ আর দশটা মানুষের মস্তিষ্কের সাথে প্রফেসরের মস্তিষ্কের তুলনাই হয় না। যে-কোন সমস্যায়, যে-কোন কাজে, যে কোন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বা সফল হবার মত মেধা এবং বুদ্ধি মজুদ আছে প্রফেসরের ব্রেনে। এমন যান্ত্রিক নির্ভুলতা, নিপুণতা এবং ক্ষমতা কোন মানুষের মধ্যে নেই। এত বড়, এমন অভূতপূর্ব এবং যুগান্তকারী একটা বিস্ময়কে ধ্বংস করা বড় কঠিন। সৃষ্টির সেরা মানুষ, সেই মানব সমাজের হাজার রকম উপকারে, হাজার রকম সমস্যার সমাধানে প্রফেসরের এই অদ্বিতীয় ব্রেনকে কাজে লাগাবার ইচ্ছা বহুদিন ধরে পোষণ করছে কুয়াশা। কিন্তু প্রফেসর বড় বেশি ক্ষমতা পেয়ে গেছে। যার ফলে কুয়াশার আদেশ, নির্দেশ পালন করতে সক্ষত নয় সে।
কিন্তু কুয়াশা এখনও আশা রাখে, একদিন প্রফেসরকে পোষ মানাতে পারবে সে। একদিন প্রফেসরকে দিয়ে নিজের মনমতো কাজ করাতে সক্ষম হবে।
কিস্তু শহীদ এবং মহুয়াদেরকে প্রফেসর কি সত্যি মেরে ফেলেছে ইতিমধ্যে? ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপে পাঠানো হয়েছে শহীদ ও মহুয়াকে। কুয়াশা জানে,
কুয়াশা ৪৬
প্রফেসরের একদল রোবট ভারত মহাসাগরের একটা দ্বীপে পরীক্ষামূলকভাবে শহর গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত। শহীদ ও মহুয়া কি সেই রোবটগুলোর খপ্পরে গিয়ে পড়েছে? তা যদি হয় শিউরে উঠল কুয়াশা। প্রফেসর রোবটগুলোকে তৈরি করেছে। সাধারণ মানুষের মুণ্ডু কেটে ফেলে তার জায়গায় যান্ত্রিক ব্রেনবিশিষ্ট মাথা বসিয়ে দিয়ে। রোবটে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই কি ওদেরকে ভারত মহাসাগরের সেই দ্বীপে পাঠিয়েছে প্রফেসর?
মি. সিম্পসন, ড়ি, কস্টা, কামাল কিন্তু এসব সমস্যা পৃথিবীর সমস্যা। আপাতত থাক। ইচ্ছা থাকলেও এখনই এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় তার পক্ষে। এখনকার সমস্যা, এখানকার সমস্যা•••এই অপরিচিত গ্রহের মানুষ সম্পর্কে।
ফেলে আসা গ্রামটার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল কুয়াশার। বেশ বড়সড় একটা গ্রাম কিন্তু জীবিত নেই কেউ। দেখে মনে হয়, মহামারী লেগেছিল। সেই মহামারীতে শেষ হয়ে গেছে সবাই।
কিন্তু একটা ব্যাপার খুবই রহস্যময় । গ্রামের কোথাও পনেরো ষোলো বছরের কম বয়সের ছেলেমেয়ে একটাও চোখে পড়েনি তার। কোথায় তারা? মহামারীর ভয়ে ছেলেমেয়েদের কি অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল গ্রামবাসীরা?
আর-ওই ঘা। যে লাশগুলোকে কুকুর শিয়ালরা এখনও খেয়ে শেষ করতে পারেনি সেগুলোর ত্বকে গোলাপী রঙের কুৎসিত একরকমের ঘা দেখছে সে, এ রোগের সাথে পরিচয় নেই তার। ছোট ছোট ঘামাচির মত ফুটে রয়েছে ঘা গুলো, ভিতরে পুঁজ, গোলাপী রঙের। খুব ঘন ঘন, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ফুসকুড়ির মত ফোটে, গোড়ার দিকের চামড়া কালচে রঙের। পিচ্ছিল হলুদ রসে ঘায়ের সবটুকু ভেজা ভেজা। এই কুৎসিত ঘা হয়তো মহামারী আকারে দেখা দেয়ায় সবাই মরে গেছে। ভাবল কুয়াশা।
রাস্তার দুপাশে পানীজমি। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষবাস করা হয়। খেতের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দেখা যায় না। তেপান্তরের মত ধু-ধু মাঠের কোথাও জনমানবের ছায়া পর্যন্ত নেই। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে দু’একটা কৃত্রিম তন্তুর তৈরি একচালা, বড় বড় ধান আর গম কাটার যন্ত্র, বীজ বপনের মেশিন, নলকূপ, পাওয়ার পাম্প। কিন্তু সবই স্থির, অচল। প্রাণের সাড়া নেই কোথাও।
| সূর্য নেই তখন আকাশে। কুয়াশা টিভির পর্দায় চোখ রেখে দেখল সন্ধ্যার মানিমা সামনের রাস্তার কোথাও. পরিলক্ষিত হচ্ছে না। লাইটপোস্টগুলো শুভ্র আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে চারদিক। আরও দূরে, চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জার আভাস দেখা যাচ্ছে।
প্রকাণ্ড একটা তোরণ দেখতে পাচ্ছে কুয়াশা। তোরণের মাথায় কি যেন লেখা রয়েছে। আরও কাছাকাছি পৌঁছুতে কুয়াশার দু’চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তোরণের মাথায় অপরিচিত ভাষার পাশাপাশি স্থান লাভ করেছে বাংলা ভাষা। বড় বড় বাংলা। অক্ষরে লেখা রয়েছে :
প্রাদেশিক রাজধানী : বিরাটশহর এলা হীকাণ্ড।
স্বাগতম।
ভলিউম ১৬
আলোকমালায় সজ্জিত আকাশচুমী তোরণটা। তবে আলোর খেলা এবং যাদু আসলে তোরণের ওপারে, শহরের ভিতর।
দূর থেকেই মুগ্ধ হলো কুয়াশা শহরের চেহারা দেখে। এত বড় শহর, নিশ্চয়ই মানুষ না থেকে পারে না, তাদের সাথে কথা বলার সৌভাগ্য হবে তার খানিক পরেই।
| রোমাঞ্চ অনুভব করল কুয়াশা। এদিকে গর্বে ফুলে উঠেছে তার বুক। মাতৃভাষা স্থান পেয়েছে এই গ্রহের ভাষার পাশাপাশি। সত্যি, বড় আনন্দ লাগছে।
| কিন্তু এরা বাংলাভাষা শিখল কিভাবে? ডক্টর কৃটজে বাংলা জানতেন, তবে কি তিনিই শিখিয়েছেন এদেরকে?
| এখানে তিনি বেঁচে আছেন নাকি?
আশায় ভরে উঠল কুয়াশার বুক। ডক্টর কৃটজে বেঁচে থাকলে চিন্তার কিছু নেই। এখান থেকে পৃথিবীতে ফেরা তাহলে অসম্ভব হবে না। দুজনে মিলে একটা মহাকাশযান তৈরি করে ফেলতে কতক্ষণ?
দুই শহরের ভিতর ঢুকে গাড়ি দাঁড় করাল কুয়াশা। টিভির পর্দায় চোখ রেখে গাড়ির চারদিক দেখে নিল সে। রঙচঙে আলোয় চোখ ধাধিয়ে যাবার মত অবস্থা। প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে ফুটপাথ। ফুটপাথের সাথে বড় বড় দোকানপাট। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ।
| রাস্তার দুপাশে মাথা আকাশে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য স্কাইপোর। বিশ, পঁচিশ, চল্লিশ তলা উঁচু এক একটা বিল্ডিং। প্রতিটা বিল্ডিংয়ের গায়ে অসংখ্য নিওন সাইন, কোনটা লাল, কোনটা নীল, কোনটা সবুজ, কোনটা জ্বলছে আর নিভছে ঘনঘন, কোনটা পাক খাচ্ছে, ছুটছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। নিওন সাইনগুলো এক একটা এক এক কোম্পানীর বিজ্ঞাপন, বুঝতে পারল কুয়াশা।
| দোকানপাটগুলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কিন্তু খরিদ্দার নেই একজনও’। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, দোকানের ভিতর সেলস্ম্যানও নেই। নির্জন পড়ে আছে সুসজ্জিত হাজার রকম জিনিসপত্রে ঠাসা দোকানগুলো।
আজ রবিবার, এই গ্রহের মানুষও কি রবিবার দিনটা ছুটির দিন হিসেবে পালন করে? বোঝা যাচ্ছে বাণিজ্যিক এলাকা এটা। কোম্পানীগুলোর অফিস সব বন্ধ। কিন্তু যে শো-রূমগুলো খোলা রয়েছে সেগুলোতে লোক নেই কেন?
নোক হয়তো দরকার হয় না, কুয়াশা তাবল। যার যা দরকার নিয়ে যাবার সময় মূল্য দিয়ে চলে যায়। এই গ্রহের মানুষরা হয়তো পরম্পরকে ঠকাতে জানে
, তারা হয়তো অসং হতে জানে না। | আবার গাড়ি ছাড়ল কুয়াশা। এবার ধীরগতিতে। শহরের আবাসিক এলাকাটা দেখতে হবে। সন্ধান চাই মানুষের।
কুয়াশা ৪৬
মাইল তিনেক অতিক্রম করে আবার গাড়ি থামাল কুয়াশা। গাড়ি থেকে নামল সে। পথে একাধিক করুণ দৃশ্য চোখে পড়েছে তার। দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। কুয়াশার কপালে। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এখানেও আকাশ ছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। রাস্তার এখানে সেখানে স্যুট-কোট পরা লোকজন শুয়ে রয়েছে। কাউকে স্পর্শ না করেই কুয়াশা বুঝতে পেরেছে, ওরা কেউ বেঁচে নেই। লম্বা হয়ে পড়ে আছে লাশ, মৃত মানুষ।
| একতলা দোতলা বাড়িও দেখা যাচ্ছে। কোন বাড়িতে আলো জ্বলছে, কোন বাড়ি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা।
এক পা, দু’পা করে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। সুবেশী একজন লোক উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। চোখ দুটো খাৈলা তার। কিন্তু মণি দুটো স্থির, অচঞ্চল।
মৃতদেহটা স্পর্শ করে দেখার দরকার হলো না। বোঝা যাচ্ছে, মারা গেছে অনেক আগে। লোকটার পরনের কাপড় দামী এবং নতুন। কিন্তু অনেক জায়গায় ছেঁড়া। কুয়াশার মনে হলো জোর করে টেনে ছিঁড়েছে কেউ ট্রাউজার আর শার্ট কয়েক জায়গায়। আবার লোকটার মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। মারা গেলেও লোকটার চোখের দৃষ্টিতে ফুটে রয়েছে ভীষণ আতঙ্ক। মুখের ভাঁজ দেখে বোঝা যাচ্ছে অসহনীয় কষ্ট পেতে পেতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে এই লোক। পা এবং হাত দুটো, মুখ, নাক, কপাল এবং ছেঁড়া কাপড়ের ফাঁক দিয়ে বুক, পেট উরুর যে অংশগুলো দেখা যাচ্ছে–সব গোলাপী রঙের ঘায়ে ঢাকা পড়ে গেছে। কদাকার কুৎসিত।
| দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল কুয়াশা। কান পাতল। কোথাও কোন শব্দ নেই। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ চারদিক। | গা ছমছম করে উঠল কুয়াশার। শহর বটে, কিন্তু ভৌতিক শহর। মহামারী উজাড় করে দিয়েছে শহরটাকে। এগিয়ে আসছে চারদিক থেকে একটা কায়াহীন আতঙ্ক। | একোথায় এসে পড়েছে সে। এখান থেকে মুক্তির উপায় কি! কেউ একজনও কি জীবিত নেই এত বড় শহরে? এই ঘা, নিশ্চয়ই কোন ভয়ঙ্কর ভাইরাস এর জন্য দায়ী। কিন্তু এত উন্নত একটা জাতি, ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল কেন? গ্রামকে গ্রাম, শহরকে শহর উজাড় হয় কি করে?
| ভাইরাস, তা সে যতই ভয়ঙ্কর হোক, তাকে ধ্বংস করার ওষুধ আবিষ্কার করা একেবারেই কি অসম্ভব?
নানান কথা ভাবতে লাগল কুয়াশা। ভাইরাসে আক্রান্ত হলো কিভাবে এরা? এরা কি জীবাণু যুদ্ধের শিকার? এই গ্রহেরই অন্য কোন জাতি এদেরকে ধ্বংস করার জন্য জীবাণু ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে?
গম্ভীর হয়ে উঠল কুয়াশা। এই সাংঘাতিক ঘা-এর জীবাণু বাতাসের সাথে উড়ে বেড়াচ্ছে। শ্বাস গ্রহণের সাথে তার শরীরেও প্রবেশ করছে অচেনা, ভয়ঙ্কর জীবাণু।
ভলিউম ১৬
সে-ও যে-কোন মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারে ভাইরাসে, ঘা ফুটে উঠতে পারে তার শরীরেও।
চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিকে ওদিকে তাকাল কুয়াশা। ল্যাবরেটরি নিশ্চয়ই আছে এত বড় শহরে। কিন্তু কোথায়, কোন দিকে? কে বলে দেবে তাকে?
খুক করে কাশল সে। একবার ভাবল, চেঁচিয়ে ডাকে কাউকে। তার সাড়া পেয়ে কেউ হয়তো আশপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেও পারে। হয়তো মহামারীর ভয়ে সবাই দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে বসে আছে ।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল কুয়াশার দৃষ্টি। দ্রুত এ-বাড়ি, সে-বাড়ি, এ-বিল্ডিং, সে বিল্ডিংয়ের জানালা খুলে যাচ্ছে।
কুয়াশা উপর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। সাত-আটতলা উঁচু অবধি ফ্রাটের জানালা খুলে গেছে। উঁকি মেরে দেখছে তাকে লোকজন। কোন জানালায় একজন, কোন জানালায় দু’জন। তারা সবাই কুয়াশাকেই দেখছে।
রহস্যময় ব্যাপার! জানল কিভাবে এরা কুয়াশা এখানে আছে। মনে পড়ল কুয়াশার, কেশেছিল খানিক আগে সে খুক করে। কাশির শব্দ অত উঁচু অবধি গেল কিভাবে?
তবে কি এখানকার মানুষের শ্রবণশক্তি পৃথিবীর মানুষের তুলনায় বেশি? ইথারের মৃদুম কম্পনও কি এদের কানে আঘাত হানতে সক্ষম?
নিশ্চয়ই তাই। | যেমন দ্রুত খুলে গিয়েছিল তেমনি দ্রুত একে একে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জানালাগুলো। আজব ব্যাপার সন্দেহ নেই। কিন্তু কুয়াশা আশ্চর্য হলো না। এখানকার মানুষ মৃত্যুভয়ে জর্জরিত। মহামারীর প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি এরা। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা সকলের, এই বুঝি ভাইরাস আক্রমণ করল। চোখের সামনে মারা গেছে এদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অপরিচিত গোটা শহরের অসংখ্য নাগরিক বেঁচে আছে মুষ্টিমেয় তারা ক’জন, ফলে যে-যার কামরায় দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে আতঙ্কের প্রহর গুণছে।
দীর্ঘ পদক্ষেপে রাস্তাটা পেরিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের খোলা গেটের দিকে এগিয়ে চলল কুয়াশা। সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। রোগের সাথে আপোস নেই। রোগও কারও সাথে আপোস করে না। চেষ্টা করে দেখতে হবে এই রোগের ওষুধ আবিষ্কার করা যায় কি না। চেষ্টা করতে গেলে চাই ল্যাবরেটরি। ল্যাবরেটরি
পেলে কোন কাজই হবে না।
গেট অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেল কুয়াশা। একি! কে অমন চেঁচাচ্ছে।
থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে তার, টের পাচ্ছে সে। এ ঠিক চিৎকার নয়, আর্তনাদ। অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের তিন কিংবা চারতলার কোন ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে। কোন লোকের গলা দিয়ে এমন ভয়ঙ্কর আর্তচিৎকার বেরুতে পারে, কানে না শুনলে বিশ্বাস করা যায় না। অসহনীয়, সহ্যের অতীত
কুয়াশা ৪৬
কোন ব্যথা বা যন্ত্রণা বা জ্বালায় উন্মাদ হয়ে গেছে যেন লোকটা।
এগিয়ে আসছে ভীতিকর চিৎকারের শব্দ। ‘ঠাস!’ | ভুরু কুঁচকে উঠল কুয়াশার। একি! গুলির শব্দ হলো কেন? থেমে গেছে গুলির শব্দের পরপরই সেই ভীতিকর বিকট আর্তনাদ। খটখট, খট-খট, খট-খট! ভারি জুতো পায়ে দিয়ে কেউ নামছে সিঁড়ি দিয়ে। কুয়াশা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে চেয়ে রয়েছে সিঁড়ির দিকে। এক মুহূর্ত পরই সে দেখল একজন লোককে। প্রকাণ্ড, দশাসই চেহারার নোকটা ধীরস্থির ভঙ্গিতে নামে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। পরনে ট্রাউজার এবং শার্ট। মাথাটা নত।
কুয়াশাকে লোকটা দেখেও দেখল না। পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে কুয়াশা খুক করে কাশল। কিন্তু লোকটা থামল না বা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালও না।
‘ ইতস্তত না করে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে উঠল কুয়াশা, মাফ করবেন, আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।’
লোকটা যেমন হাঁটছিল তেমনি হাঁটতে লাগল । কুয়াশার কথা যেন তার কানে যায়নি। কুয়াশা পিছু নিল লোকটার। আবার বলল, একটু দাঁড়াবেন কি!’
বৃথা চেষ্টা, নোকটা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল না পর্যন্ত। কুয়াশা লোকটার পাশে চলে গেল। পাশাপাশি হাঁটছে সে।
কানে কম শোনেন নাকি? আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না? কাজ হলো না। নোকটা নির্বিকার।
কী আশ্চর্য!
কুয়াশা হাত বাড়াল। লোকটার কাঁধে রাখল সে হাতটা। তারপর চেপে ধরল সেই হাত দিয়ে চওড়া কাধটা। বলল, দাঁড়ান।’
লোকটা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কুয়াশার দিকে। তারপর ডান হাতটা তুলে কুয়াশার হাতটা এক ঝটকায় কাধ থেকে নামিয়ে দিল।
| “কি হবে প্রশ্ন করে? কি জানতে চান? জেনে কি লাভ? বিরক্ত করবেন না, নিজের চরকায় তেল দিন গিয়ে।
| লোকটা শুদ্ধ বাংলায় কথাগুলো বলে আবার হাঁটতে শুরু করল। কুয়াশা নাছোড়বান্দা। হাঁটতে লাগল সে লোকটার সাথে সাথে। জানতে চাইল, আমি আপনাদের এখানকার মানুষ নই। কিছুই জানি না এখানকার অবস্থা সম্পর্কে। তাই কৌতূহল। একটু আগে একজন চিৎকার করছিল–কেন বলুন তো? তারপর গুলির শব্দ হলো-কে কাকে গুলি করল বলতে পারেন?
| ‘পাগল নাকি আপনি? এখানকার অবস্থা জানেন না কথাটার অর্থ কি? আনতারার সব জায়গার অবস্থাই তো এই গুলি আমি করেছি, আমার ভাইকে।’
কেন?’
লোকটা রেগে উঠল, কী জ্বাল! আপনি দেখছি পাগলই! জিজ্ঞেস করছেন, কেন? জানেন না বুঝি! ওর অমন কষ্ট সহ্য করতে পারিনি বলে গুলি করেছি। এবার
১৬
ভলিউম ১৬
.
কেটে পড়ুন। আর একটাও কথা শুনতে চাই না আকি আপনার।
কিছু বলতে যাচ্ছিল কুয়াশা, হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল পঁচিশ গজ দূরের আকাশচুমী একটা বাড়ির পাঁচতলার ব্যালকনিতে। ব্যালকনির রেলিঙের উপর ওঠার চেষ্টা করছে একটি মেয়ে। বাড়িটার উপরতলা থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠের চিৎকার ভেসে আসছে। সেই চিৎকারের শব্দ কানে যেতেই কুয়াশার দৃষ্টি ওদিকে গিয়ে পড়েছে।
আঁতকে উঠল কুয়াশা। মেয়েটা মরতে চায় নাকি! লাফ মারবে বলে মনে হচ্ছে পাঁচতলা থেকে।
ছুটল কুয়াশা। লাফই মেরেছে মেয়েটা। সবেগে নেমে আসছে দেহটা নিচের ফুটপাতে।
কেউ যেন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল কুয়াশাকে। থমকে দাঁড়িয়েছে কুয়াশা । ইন্দ্রিয়গুলো সতর্ক, সাবধান হয়ে উঠল সাথে সাথে । কেউ ধরেনি পিছন থেকে কুয়াশাকে। সে নিজেই দাঁড়িয়ে পড়েছে আচমকা।
‘ আশপাশের বাড়ি থেকে একটা নয়, দুটো নয়, অনেক নারী-পুরুষের বিকট আর্তনাদের শব্দ কুয়াশার কানের পর্দায় আঘাত হানতে শুরু করেছে।
মৃত্যু যন্ত্রণায় অস্থির, সহ্যের অতীত কষ্ট হলেই মানুষ অমন বিকট স্বরে চিৎকার করতে পারে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল কুয়াশার। একি রহস্য!
দুর্জয় মনোবলের অধিকারী কুয়াশাও কেমন যেন আতঙ্কিত হয়ে উঠছে। এ কোথায় পাঠিয়েছে তাকে প্রফেসর ওয়াই। এমন ভৌতিক পরিবেশ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও থাকতে পারে তা কল্পনা করাও কষ্টকর।
| বাড়ছে, চিৎকারগুলো চারদিক থেকে বেড়ে উঠছে। কানে আঙুল দিল কুয়াশা। সহ্য করতে পারছে না সে মানুষের এমন অসহায় আর্তনাদ। তার বিশাল বুক কানায় কানায় ভরে উঠেছে, উথলে পড়ছে, সমবেদনা, সহানুভূতি-কিন্তু কি করবে সে এদের জন্য! কিভাবে কি করলে এদেরকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব?
| দিশেহারা হয়ে পড়ছে কুয়াশা। পৃথিবীতে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি সে কখনও। প্রতিটি বাড়ি থেকে একাধিক নারী-পুরুষ অস্থির যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
দরজা জানালা ঠোকাঠুকির শব্দ হচ্ছে। কুয়াশা দেখল দলে দলে মানুষ বেরিয়ে আসছে রাস্তায়। ভীত-সন্ত্রস্ত সবাই। কেউ কারও সাথে কথা বলছে না, কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না। দ্রুত, চঞ্চল পায়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।
মর্মর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। জীবনে এই প্রথম, সাময়িকভাবে হলেও, উপস্থিত বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে সে।
কাছেই খটাং করে শব্দ হলো একটা। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কুয়াশা। দরজা খুলে বেরিয়ে এল একজন লোক।
| হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল কুয়াশার। চোখের সামনে যা ঘটেছে তা চিরকাল স্মরণ থাকবে তার। মানুষটা লাফাচ্ছে। সবেমাত্র ডাঙায় তোলা শিঙি মাছের মত । চোখে না দেখলে এরকম দৃশ্য কল্পনা করা অসম্ভব। লাফাচ্ছে বলা ঠিক হবে না। ২”কুয়াশা ৪৬
লোকটা আসলে গোলাকার ফুটবলের মত ড্রপ খেতে খেতে রাস্তায় বেরিয়ে এল। চেয়ে আছে কুয়াশা। কিন্তু মানুষটা মেয়ে না পুরুষ বুঝতে পারছে না সে। মানুষটার হাত দুটো কোথায়, পা দুটো কোথায় দেখতে পাচ্ছে না সে। বিদ্যুৎ গতিতে হাত-পা গুটিয়ে দেহটা শুন্যে উঠছে, আবার ড্রপ খাচ্ছে ফুটপাতে, আবার শূন্যে উঠছে–এইভাবে চলেছে, সারাক্ষণ। সেই সাথে কান-ফাটানো চিত্তার বেরিয়ে আসছে মানুষটার গলা দিয়ে। চারদিকের হাজারো নারী-পুরুষের চিৎকারের সাথে সেই চিৎকারটা মিশে যাচ্ছে, চেনা যাচ্ছে না আলাদাভাবে।
চোখের কোণে পানি জমে উঠল কুয়াশার। মৃত্যুও এর চেয়ে ভাল। এই কষ্ট শক্রর জন্যও কেউ কামনা করতে পারে না।
| পা বাড়াল কুয়াশা আলখাল্লার পকেট থেকে বড়সড় একটা হাইপডারমিক সিরিঞ্জ বৈরিয়ে এসেছে তার হাতে। পেশীবহুল দীর্ঘ ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে কুয়াশা বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন মানুষটাকে ধরতে চেষ্টা করল। মুহূর্তের জন্য মানুষটা ধরা পড়ল কুয়াশার হাতে। নিজের শরীরের সাথে তাকে চেপে ধরতে গেল কুয়াশা। কিন্তু ব্যর্থ হলো সে। তড়াক করে লাফিয়ে হাতছাড়া হয়ে গেল মানুষটা।
সম্ভব নয় এভাবে। আবার পা বাড়াল কুয়াশা। এবার বাড়িয়ে দিয়েছে সে মানুষটার দিকে সিরিঞ্জ ধরা বাঁ হাতটা! কাছাকাছি পৌঁছে কুয়াশা সবেগে অস্থির মানুষটার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিল সিরিঞ্জের সুচ। | সিরিঞ্জের সবটুকু ওষুধ প্রবেশ করল মানুষটার দেহে। এক পা পিছিয়ে এল কুয়াশা। এক মিনিট। তারপরই স্থির হয়ে গেল দেহটা।
পুরুষ মানুষই। পরনে কিছু নেই, সম্পূর্ণ উদোম। স্থির, অচঞ্চল হয়ে পড়ে আছে ফুটপাতের উপর হাত-পা ছড়িয়ে। কুয়াশার ব্যথা উপশমকারী ওষুধের প্রভাবে সব ব্যথা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে সে।
লোকটা হাঁপাচ্ছে চোখ বন্ধ করে । পাশে গিয়ে বসল কুয়াশা। সারা শরীরে ঘা দগদগ করছে দেখল সে। কয়েক মুহূর্ত পর মাথাটা ঘুরে উঠল তার।
একী সাংঘাতিক ঘা! কুয়াশার চোখের সামনে ঘা বাড়ছে। ঊরুর ঘা বাড়তে বাড়তে তলপেটের উপর দিয়ে বুকের দিকে এগিয়ে আসছে। মুখ ভর্তি ঘা, মুখ থেকে
ছড়িয়ে পড়ছে গলায়, গলা থেকে কাঁধে, কাঁধ থেকে হাতে।
দেখতে দেখতে সব শরীর ছেয়ে যাচ্ছে, ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, গোলাপী ঘায়ে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে কুয়াশা। আশ্চর্য! কয়েক মিনিটেই সর্বশরীর ছেয়ে গেল লোকটার দগদগে ঘায়ে।
হঠাৎ কুয়াশা সংবিৎ ফিরে পেল। দেখল আর নিঃশ্বাস ফেলছে না, ঘায়ের আক্রমণে নিহত হয়েছে লোকটা।
উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। চারদিকের আর্তচিৎকার বয়ে বেড়াচ্ছে বাতাস। রাস্তায় এখনও মানুষ দেখা যাচ্ছে। দ্রুত, মাথা নিচু করে, পালাচ্ছে ভীত নারী-পুরুষ। | আবার বসল কুয়াশা। মৃত মানুষটার শরীরে একটা সিরিঞ্জের সুচ ঢুকিয়ে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করল সে। চিনতে হবে এই ঘায়ের ভাইরাসকে।
উঠে দাঁড়িয়ে কুয়াশা দেখল দু’জন লোক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সরাসরি প্রশ্ন
১৮
ভলিউম ১৬
করল এবার কুয়াশা, ল্যাবরেটরি কোন্ পথে, বলতে পারেন? আমি নতুন এখানে।
থামল না লোক দুজন। তবে একজন বলল, কোন লাভ নেই।
কিন্তু দ্বিতীয় লোকটা বলে উঠল, সোজা চলে যান, চৌমাথায় গিয়ে ডান দিকে মোড় নেবেন, খানিকদূরে গেলেই হলুদ বিল্ডিংটা চোখে পড়বে। ওটাই।
কিন্তু প্রথম লোকটা বিরক্তির সাথে বলল, দৃর! ওটা না, ওর পাশের বিল্ডিংটা ল্যাবরেটরি।
হবেও বা।’ বলল দ্বিতীয় লোকটা।
কুয়াশা ল্যাবরেটরির সন্ধানে পা বাড়াল। রাস্তার উপর লাশের সংখ্যা বাড়ছে। কয়েক পা এগিয়েই দাঁড়াল কুয়াশা। আর একজন লোক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রচণ্ড ব্যথায় লাফাচ্ছে অস্থিরভাবে।
একশো গজ অতিক্রম করতে দশবার থামতে হলো কুয়াশাকে । দশজন লোককে ব্যথা উপশমকারী ওষুধ দিল সে। কিন্তু ব্যথা থেকে তারা মুক্তি পেলেও তাদের কাউকেই বাঁচাতে পারল না। ঘায়ে ছেয়ে গেল তাদের সকলের দেহ, মারা গেল সবাই সাথে সাথে।
তারপর কুয়াশা হঠাৎ দেখল, ওষুধ নেই আর। সব শেষ হয়ে গেছে। | প্রকাণ্ড থাবা বসিয়েছে মহামারী। একটা উন্নত জাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মেনে নিতে পারছে না কুয়াশা এদের এই পরাজয়! এরা এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি কেন? এরা কি বিজ্ঞানের এই দিকটায় খুব বেশি উন্নতি করতে পারেনি? | সে যাই হোক, কুয়াশা স্বয়ং চেষ্টা করে দেখবে একবার। দেখা যাক সফলতা আসে কিনা!
তিন।
এক পলকে সব আশার আলো দপ করে নিভে গেল। ল্যাবরেটরির সন্ধান ঠিকই পেল কুয়াশা কিন্তু অক্ষত অবস্থায় নয়। ল্যাবরেটরির ভিতরে পড়ে আছে চার পাঁচটা ভাইরাসে আক্রান্ত মৃত মানুষের লাশ। ছোট বড় কাঁচের জার, টিউব মাইক্রোসকোপ সব ভেঙেচুরে একাকার হয়ে পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মেঝেতে নানা রঙের কেমিক্যালসের বন্যা। | ভাইরাসে আক্রান্ত লোকগুলো তীব্র যন্ত্রণায় দাপাদাপি করার সময় ধাক্কা লেগে সর্ব পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে। বেরিয়ে পড়ল কুয়াশা। সময় নষ্ট করা মানে নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনা। যে-কোন মুহূর্তে ঘা ফুটে উঠতে পারে তার শরীরেও। একবার আক্রান্ত হলে আর রক্ষা নেই। আক্রান্ত হবার আগেই এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে হরে।
গাড়িটার কাছে ফিরে এল কুয়াশী। নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ চারদিক। আগের মতই ভৌতিক পরিবেশ ফিরে এসেছে। কিন্তু এখন রাস্তায় লাশের সংখ্যা অগুনতি। কুয়াশা ৪৬
১৯
জীবিত মানুষগুলো এই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে গেছে। কাউকে গাড়ি ব্যবহার করতে দেখেনি সে। তার মানে, মহামারী এই পাড়ায় দেখা দেয়ায় জীবিত মানুষগুলো কাঁছে পিঠের কোন পাড়ায় চলে গেছে।
গাড়ি ছুটছে। অচেনা পথ। গন্তব্য অজ্ঞাত। তবু ফুল স্পীডে ছুটছে কুয়াশার গাড়ি।
মিনিট সাতেক পর আবার থামল কুয়াশা। নতুন শহর এটা। খা খা করছে চারদিক। সবই আছে; নেই কেবল প্রাণ।
আবার ছুটল গাড়ি।
এরপর যে শহরটায় প্রবেশ করল কুয়াশা, সেটা আকারে ছোট হলেও জীবিত মানুষের দেখা পাওয়া গেল রাস্তাঘাটে।
চৌমাথার কাছে গাড়ি থামিয়ে লাফ দিয়ে নামল কুয়াশা। আগুন জ্বলছে একটা তিনতলা বাড়ির নিচতলায়।
গাড়ি থেকে নেমে বোকা বনে গেল কুয়াশা। এ কেমন আচরণ এখানকার মানুষদের? গাড়ি-ঘোড়া সবই চলছে, ফুটপাত দিয়ে। সুবেশী সুদর্শন এবং দীর্ঘদেহী নারী পুরুষ যাচ্ছে আসছে। কিন্তু কেউ দেখেও যেন দেখছে না বাড়িটার দাউ দাউ আগুন। যে যার পথে হাটছে সবাই, কেউ দাঁড়াচ্ছে না একবার, কারও মধ্যে এতটুকু চাঞ্চল্য নেই। বাড়িটার উপরতলা থেকে প্রাণভয়ে অস্থির নারী-পুরুষের চিৎকারও কি কানে ঢুকছে না কারও?
| রাস্তার চৌমাথায় দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল কুয়াশা। আগুন ধরে গেছে বাড়িটায়। আপনারা সবাই দেখেও দেখছেন না কেন? বাড়ির ভিতর আটকা পড়েছে মানুষ, ওরা পুড়ে মরবে, ওদেরকে বাঁচাতে চেষ্টা করি, চলুন!
সবাই যেন একযোগে কুয়াশাকে ব্যঙ্গ করার পরিকল্পনা এঁটেছে। কেউ কান দিল না কুয়াশার কথায়। যেন শুনতেই পায়নি তার কথা।
| লোকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত না হয়ে পারল না কুয়াশা। সবাই ভাবলেশহীন। সহ্য হলো না কুয়াশার, লাফ দিয়ে একদল লোকের সামনে গিয়ে পড়ল সে। খপ করে ধরল সামনে যাকে পেল তার একটা হাত। অন্যান্যরা ফিরেও তাকাল না, পাশ ঘেঁষে চলে গেল যন্ত্রের মত নির্বিকারভাবে।
“কি ব্যাপার? আপনারা বেঁচে আছেন, না, মরে ভূত হয়ে গেছেন? বাড়িটীয় আগুন লেগেছে..
“কি করব?’ লোকটা নিরাসক্ত গলায় কথাটা বলল। | ‘আগুন নেভাবেন। ফায়ার ব্রিগেড়ে খবর দেবেন। কুয়াশা ধমকে উঠে বলল।
লোকটা ছাড়িয়ে নিল হাতটা। বলল, আপনার দেখি মাথা বিগড়ে গেছে। আগুন জ্বালিয়েছে ও বাড়ির মানুষরা নিজেরাই!
কেন? ‘মরবার জন্যে, আবার কেন!
ভলিউম ১৬
‘মরবার জন্যে?
বাঁকা সুরে লোকটা বলল, “জী-হা-মরার জন্যে। ওরা বাঁচতে চায় না। ঘা ফুটবে এই ভয়ে, তাছাড়া..দূর, সরেন, পথ ছেড়ে দিন আমার, আপনি পাগল, আপনার সাথে পাগলামি করতে রাজি নই আমি।’
বাড়িটার দোতলায় ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। বুঝতে পারছে কুয়াশা, কারও কাছ থেকে সাহায্য পাবার কোন আশা নেই। বাড়িটার ভিতর থেকে নারীপুরুষের সম্মিলিত চিৎকার ভেসে আসছে। এই দৃশ্য কোন মানুষের পক্ষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব নয়। দৌড়ুতে শুরু করল কুয়াশা। বাড়িটার গেটের কাছে গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পিছন দিকে সে। কী অবাক কাণ্ড! রাস্তায় এত মানুষ, কেউ এদিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত।
গেট পেরিয়ে সিঁড়িটা দেখতে পেল কুয়াশা। নিচের তলাটা দখল করে নিয়েছে আগুন। কামরাগুলোর ভিতর নৃত্য করছে লেলিহান অগ্নিশিখা। মাংসপোড়ার উৎকট গন্ধে দম বন্ধ হবার উপক্রম। কেউ বেঁচে নেই নিচের তলায়। সিঁড়িতেও ধরেছে। আগুন। তা সত্ত্বেও পা বাড়াল কুয়াশা সেদিকে।
হাই জাম্প দেবার কায়দায় লাফ দিয়ে সিঁড়ির আটটা ধাপ টপকে নবম ধাপে গিয়ে পড়ল কুয়াশা। নয় এবং দশ নম্বর ধাপে আগুন নেই। উপরের পাঁচটী ধাপে আগুন ধরেছে, নিচের সবকটা ধাপেই আগুন। আবার লাফ দিল কুয়াশা। তারপর আবার। দোতলার করিডরে উঠে এল সে লাফ দিয়ে আগুন টপকাতে টপকাতে।
করিডরের দক্ষিণ প্রান্তের একটা বড় হলরূমের ভিতর জ্বলছে আগুন। ভিতর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা কয়েক মুহূর্ত। করিডরে চার-পাঁচজন লোক বসে রয়েছে চেয়ারে। আগুনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই। কারও মধ্যে কোন উদ্বেগ, আতঙ্ক.বা চাঞ্চল্য নেই। আগুনের রক্তিম শিখা যেন ওদেরকে সম্মোহিত করেছে। ইচ্ছে করলে এখনও এরা প্রাণ বাঁচাতে পারে। কিন্তু প্রাণ বাঁচাবার উৎসাহ বা আগ্রহ এদের মধ্যে একেবারেই নেই।
কুয়াশা জ্বলন্ত হলরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ধোয়া এবং আগুনের শিখায় কামরার ভিতরটা ঢাকা পড়ে গেছে। তবে ভিতরে যে জীবন্ত মানুষ আছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। চিৎকার ভেসে আসছে ভিতর থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কুয়াশা পিছন দিকে। লোকগুলো চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছে। কপালে ভাঁজ ফুটে উঠেছে তাদের।
যে-কোন কারণেই হোক, অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাদেরকে।
কুয়াশা লাফ দিয়ে জ্বলন্ত কামরার ভিতর ঢুকল। আগুন এবং ধোয়ার মধ্যে হারিয়ে গেল সে।
কামরাটা বিরাট। কুয়াশা আতঙ্ক অনুভব করছিল। কামরার ভিতর অনেক লোকজন আটকা পড়ে গেছে। কিন্তু মাত্র দুজনকে দেখল সে। একটি যুবতী মেয়ে এবং একজন প্রৌঢ় লোক। দুজনেই ফুটবলের মত কামরার মেঝেতে ড্রপ খাচ্ছে, কুয়াশা ১৬
ভাইরাসে আক্রান্ত তারা। দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য যন্ত্রণায় কাতর নারী এবং পুরুষটির শরীরে আগুন ধরে গেছে। মেঝেতে আর একজনকে দেখল কুয়াশা। ইতিমধ্যেই আগুনের কবলে পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে লোকটা।
| করণীয় কিছুই নেই দেখে করিডরে বেরিয়ে এল কুয়াশা তেমনি বসে আছে লোকগুলো। কুয়াশা তাদের সামনে দাঁড়াল। বলল, আপনারা কি মনে করে বসে আছেন?’
জানি না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও উত্তর দিল একজন, অন্যদিকে তাকিয়ে। ‘আগুন লাগল কিভাবে?’ দ্বিতীয় লোকটা উত্তর দিল, আমি লাগিয়েছি।’
কেন?
এবার চারজনই মুখ তুলে তাকাল কুয়াশার দিকে। একযোগে চারজনই বলে উঠল, এ কেমন প্রশ্ন? পাগল নাকি আপনি?
হাসবে কি রাগবে বুঝতে পারল না কুয়াশা। কিন্তু সময় নষ্ট না করে আবার প্রশ্ন করল সে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। দেরি করলে পুড়ে মরবেন সবাই। চলুন, নিচে নামার চেষ্টা করি।’
| প্রথমজন বলল, ‘নিচে নেমে কি হবে?
কুয়াশা বলল, ‘প্রাণটা রক্ষা পাবে। বেচে থাকবেন। এখানে এভাবে বসে থাকলে পুড়ে মরবেন, বুঝতে পারছেন না?’
তৃতীয় লোকটা তিক্ত হাসল। বলল, “বেঁচে থাকব? ঠাট্টা করছেন, না? সাহস তো কম নয় আপনার! বেঁচে থাকার কোন উপায় আর নেই, এ কথা কে না জানে।
কুয়াশা বলল, আপনাদের বক্তব্য ঠিক বুঝতে পারছি না আমি।’
দরকার নেই বোঝার, নিজের চরকায় তেল দিন গিয়ে।
কুয়াশা শান্ত গলাতেই বলল আবার, দেখুন, আপনাদের সমস্যা আমি বুঝতে পারছি না, কারণ, আমি আপনাদের গ্রহের মানুষ নই। আমি এসেছি পৃথিবী থেকে।
‘পৃথিবী থেকে!
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। এসেই দেখি আপনাদের শহর, গ্রাম মহামারীতে জনশূন্য হয়ে গেছে–যাচ্ছে। কিন্তু••• |
‘পৃথিবী থেকেই আসুন আর যেখান থেকেই আসুন, করার কিছু নেই আপনার। ডক্টর কূটজেই পারলেন না কোন ব্যবস্থা করতে আর আপনি কি করবেন।’
কুয়াশা বলল, ডক্টর কূটজে! কোথায় তিনি?
মারা গেছে। ঘায়ে।
কুয়াশা বলল, ডক্টর কূটজে বুঝি ঘ-এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন?
না। সসেমিরাদের ধ্বংস করার উপায় বের করার চেষ্টা করছিলেন তিনি।
সময় নেই আর। করিডরেও হামলা চালিয়েছে আগুন। সিঁড়িটা সম্পূর্ণ অগ্নিকবলিত। এখন প্রাণ বাঁচাতে হলে দোতলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়তে হবে।
ভলিউম ১৬
দ্রুত বলল কুয়াশা, এই ঘা-এর প্রতিষেধক আমি আবিষ্কার করতে পারব। আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। আপনাদের ল্যাবরেটরি কোথায় দেখিয়ে দিন। আমাকে। বিশ্বাস রাখুন আমার ওপর, আমি আপনাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে চেষ্টা করব। পৃথিবীর একজন বিজ্ঞানী আমি, আমার ওপর আপনারা আস্থা রাখুন..’
‘পাগল! কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এই গ্রহকে, এই গ্রহের মানুষকে রক্ষা করা। স্যাটার্ন-এর অ্যাস্টারয়ড বিরাট বিপুল আকারে বিদ্যুৎবেগে ধেয়ে আসছে, সসেমিরাকে ধাক্কা দিয়ে সাথে নিয়ে চলে যাবে সৌরজগতের বাইরে, সীমাহীন মহাশূন্যে। সসেমিরা না থাকলে আনতারা কক্ষচ্যুত হবে, আকর্ষণের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে•••দুত্তোরী ছাই! পুরানো কথা বলতে আর ভাল্লাগে না। যান, কেটে পড়ুন। পৃথিবীর মানুষ, পৃথিবীতে ফিরে যান। আমরা শেষ হয়ে গেছি, সসেমিরাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। বলা যায় না, ওরা হয়তো বাঁচার একটা রাস্তা পেয়েও যেতে পারে। ওরা বাচলে আপনাদের বিপদ। ওরা পৃথিবীতেই যাবার পরিকল্পনা করছিল। আপনি বরং পৃথিবীতে গিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা জোরদার করার চেষ্টা করুন। আমাদেরকে রক্ষা করার কথা ভুলে যান। আমরা খতম হয়ে গেছি।
কথা না বলে আচমকা কুয়াশা একজন লোককে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল। রেলিঙের কাছে গিয়ে কুয়াশা তাকাল নিচের দিকে। বাড়িটার পিছন দিকের সুইমিং পুলটা দেখা যাচ্ছে। তবে প্রায় বিশ-পঁচিশ হাত দূরে সেটা। কুয়াশা লোকটাকে সজোরে ছুঁড়ে দিল সুইমিং পুলের দিকে।
একে একে বাকি তিনজনকেও নিক্ষেপ করল কুয়াশা একই জায়গায়। নিচের বাগানে নামল কুয়াশা লাফ দিয়ে।
সুইমিং পুল থেকে লোকগুলো সঁতরে উঠে পড়েছে পাকা চত্বরে। চারজনই উঠে পড়েছে ইতিমধ্যেই। ভিজে কাপড়-চোপড় না খুলেই গেটের দিকে হাঁটছে তারা। কুয়াশা পিছন থেকে লোকগুলোর পাশে চলে গেল।
বলল, আপনারা আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। ল্যাবরেটরিটা দেখিয়ে দিন••• |’
এই বাড়িটার ওপর তলায় ছিল ল্যাবরেটরি। আমরা চিকিৎসক। গত তিনমাস ধরে চেষ্টা করেও কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারিনি। আমাদের অপর তিনজন সহকারী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে আজ, তাই আগুন জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়েছে ল্যাবরেটরি। ঘায়ের বীজাণু যাতে ল্যাবরেটরির বাইরে বেরুতে না পারে তার ব্যবস্থা করার জন্যই আগুন লাগাই আমরা। আপনি অপকার করেছেন আমাদেরকে মরতে না দিয়ে। এই শহরে ভাইরাস প্রথমবার আক্রমণ করেছিল মাস দুয়েক আগে। সবাই মারা গেছে তখন। এখন যাদেরকে দেখেছেন তারা সবাই অন্য শহর থেকে পালিয়ে এসেছে।’
কুয়াশা বলল, “অন্য কোন্ শহরে ল্যাবরেটরি পাব বলতে পারেন?
রাজধানীতে যেতে পারেন। অনেক ল্যাবরেটরি পাবেন। কিন্তু লাভ নেই কেনি। আপনি•• | কুয়াশা ৪৬
কুয়াশা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখের সামনে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘটনা ঘটল একটা। পাশের একটা গলি থেকে হলুদ ডোরা কাটা সাত হাত লম্বা হিংস্র একটা বাঘ বিকট গর্জন তুলে চারদিক কাঁপিয়ে একেবারে সামনে এসে পড়ল ওদের। কুয়াশার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল যে চিকিৎসকটি, তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়েছে বাঘটা। লোকটা পড়ে গেছে। বাঘটা লোকটার তলপেটের কাছে কামড়ে ধরেছে, তাকে তুলে নিয়ে ছুটছে তীরবেগে।
এমন অপ্রত্যাশিত দৃশ্য চোখের সামনে ঘটতে দেখে মুহূর্তের জন্য নিষ্ক্রিয় থাকলেও কুয়াশার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল পরমুহূর্তেই। টর্চের মত লম্বা একটা যন্ত্র বেরিয়ে এল পকেট থেকে তার হাতে। লেজার গান । টর্চের মুখটা পলায়নরত বাঘের দিকে ধরে বোতাম টিপল কুয়াশা।
বাঘের পিছনের অর্ধাংশ, রক্ত, মাংস, হাড়সহ বাষ্প হয়ে উড়ে গেল উপর দিকে। আক্রান্ত চিকিৎসক উঠে দাঁড়াল। রক্ত বেরুচ্ছে তার তলপেটের ক্ষতস্থান থেকে। কুয়াশা দেখল এমন ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা লোকটার অপর তিনসঙ্গী বা অসংখ্য পথচারীদের কারও মনেই কোন রকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি। লোকটার সঙ্গী তিনজন হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এগিয়ে গেছে। পথচারীরাও কেউ দাঁড়ায়নি, যে-যার পথে ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে চলছে। সবাই খুব বিমর্ষ, বিষণ্ণ। কারও মুখে হাসি নেই, কারও মধ্যে চাঞ্চল্য নেই, সকলের মধ্যেই প্রাণস্পন্দনের বিকট অভাব দেখা যাচ্ছে।
ডান হাতের কনুইয়ের পিছনদিকটা জালা করে উঠল কুয়াশার । চমকে উঠল সে। হার্টবিট বেড়ে গেল সাথে সাথে। কনুইয়ের পিছন দিকটা চোখ দিয়ে দেখার আগে মনটাকে শক্ত করে নিল। ভাইরাস যদি আক্রমণ করে থাকে•••
না, পিঁপড়ে কামড়েছে। ভাইরাসের আক্রমণ নয়। তবু ব্যস্ত হয়ে পড়ল কুয়াশা। ভাইরাসের আক্রমণ যে-কোন মুহূর্তে আসতে পারে।
গাড়ির কাছে ফিরে এল সে। রাজধানীতে যেতে হবে।
চার
লা ভেনজু। রাজধানী বিরাট শহর। কয়েক লক্ষ অধিবাসী। লা ভেনজুকে যান্ত্রিক শহর বলা চলে। ঘণ্টাখানেক হলো পৌঁছেছে কুয়াশা এখানে। তার হাতের রিস্টওয়াচে এখন রাত সাড়ে এগারোটা।
| রাজধানীতে ভাইরাস আক্রমণ চালিয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। এখনও ভাইরাসে আক্রান্ত কোন মানুষকে দেখেনি কুয়াশা। তবে বিরাট শহর, কোথাও যদি ভাইরাস হামলা চালিয়েও থাকে, তা বোঝার কোন উপায় নেই। | ব্যস্তসমস্ত ভাবটা কিন্তু কোথাও দেখল না কুয়াশী। দোকানপাট খোলা, পথেঘাটে লোকজন রয়েছে, গাড়ি ঘোড়াও ছুটছে–কিন্তু সবই কেমন নির্জীব । কারও সুবিধে-অসুবিধের দিকে কেউ খেয়াল দিচ্ছে না! কেউই যেন নিজের উদ্দেশ্য বা গন্তব্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পোেষণ করে না।
ভলিউম ১৬
কয়েকটা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতে দেখল কুয়াশা। প্রথম দুর্ঘটনাটা ঘটাল একটা বড় আকারের গোলাকার গাড়ি। রাস্তা ছেড়ে সরাসরি ফুটপাতে উঠে গেল, উল্টে পড়ল সাত-আটজন লোকের উপরে। চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেল কয়েকজন মানুষ। তিনজন লোকের নিম্নাঙ্গ চাপা পড়ল । উর্ধ্বাঙ্গ অক্ষত থাকলেও কেউ তাদেরকে সাহায্য করতে এগোল না।
মায়া-মমতা, সহানুভূতি, সমবেদনা–এসব যেন নেই এদের মধ্যে।
এক জায়গায় দলবদ্ধভাবে নেশা করে মাতাল হয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে। একদল নারী-পুরুষ। তাদের কান্নার কারণ কি বোঝা গেল না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এদেরকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করা তো দূরের কথা, কেউ ফিরেও তাকাল।
।
কুয়াশা অসংখ্য লোকের সাথে আলাপ করবার চেষ্টা করল। কাজ হলো না। বাংলা, ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা এরা প্রায় প্রত্যেকেই জানে কিন্তু কোন প্রশ্নেরই। উত্তর দেবার মত আগ্রহ বা ধৈর্য কারও মধ্যেই নেই। কয়েকজনকে জোর করে ধরে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করেও ফল পায়নি কুয়াশা। বেশিরভাগ লোকই একটা কথাই বলে,
ধ্বংস অনিবার্য! খামোকা আলাপ করে কি লাভ হবে।’
ল্যাবরেটরির খোঁজ পেতে অবশ্য বিশেষ অসুবিধে হলো না। শ’খানেক লোককে প্রশ্ন করার পর একজন লোক দেখিয়ে দিল আঙুল দিয়ে-ওদিকে যান, পাবেন। | শেষ পর্যন্ত সন্ধান মিলল ল্যাবরেটরির । সুদৃশ্য দোতলা বিল্ডিং । প্রকাণ্ড গেট । সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত লন। মোজাইক করা সিঁড়ি। পরিষ্কার, ঝকঝক তকতক করছে চারদিক।
| সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠে মুখ তুলে তাকাল কুয়াশা। প্রৌঢ় তিনজন লোক ক্লান্ত শরীরে ধীরে ধীরে নিচে নামছে।
কুয়াশা নিশ্চিত হবার জন্যে প্রশ্ন করল, “এটা ন্যাশনাল সায়েন্স ল্যাবরেটরির একটী শাখা, তাই না?
হ্যাঁ। আপনি•••?
কুয়শা বলল, আমাকে আপনারা চিনবেন না। আমি একটা ব্যাপারে ল্যাবরেটরিটা ব্যবহার করতে চাই। কার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে?
দ্বিতীয় প্রৌঢ় বলল, আপনি বিজ্ঞানী?”
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ।
প্রথম প্রৌঢ় প্রশ্ন করুল, ল্যাবরেটরি ব্যবহার করবেন কি উদ্দেশ্যে? আমরাও বিজ্ঞানী, আমাদেরকে বলতে পারেন।
কুয়াশা বলল, ‘মহামারী আকারে যে ঘা দেখা দিয়েছে তার প্রতিষেধক আবিষ্কার করার চেষ্টা করব আমি।
‘ও, পাগল!’ প্রথম লোকটা তার অপর দুই সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে সবজান্তার মত মাথা নাড়ল। কুয়াশা ৪৬
কুয়াশা বলল, ‘পাগল হলাম কিভাবে? আপনারা এই ঘায়ের বিরুদ্ধে কোন ওষুধ আবিষ্কার করতে পারেননি বলে ধরে নিয়েছেন আর কেউ পারবে না? আপনারা চিকৎসাশাস্ত্রে মাত্র প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের তুলনায় । আমি পৃথিবীর একজন বিজ্ঞানী।
তিনজনই ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইল কুয়াশার দিকে।
আপনারা দয়া করে আমার সাথে আসুন। দেখুন আমি পারি কিনা।
প্রথমজন বলল, আমাদের ক্ষমতানুযায়ী আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। ঘায়ের জীবাণু নিয়ে গত পাঁচমাস ধরে আমরা এমন কোন এক্সপেরিমেন্ট নেই যা যাচাই করিনি। আটাশ জন বিজ্ঞানী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, এই হয়েছে ফল। এই খানিক আগে মারা গেল পাঁচজন। তাই, পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে চলে যাচ্ছি আমরা। সকালে মহামান্য রাজার কাছে রিপোর্ট দেব–আমরা ব্যর্থ!
কুয়াশা বলল, রিপোর্ট আপনারা দেবেন কাল সকালেই, ঠিক। কিন্তু সে রিপোর্ট হবে ব্যর্থতার নয়, সফলতার। আপনারা আসুন আমার সাথে । আপনারা থাকলে আমার কাজ সহজ হবে। আমার সহকারী হিসেবে আপনারা কাজ করবেন।’
শেষ পর্যন্ত রাজি হলো তারা । | সুসজ্জিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা ল্যাবরেটরি । সবরকমের কেমিক্যালস, গাছ গাছড়ার রস, খনিজ পদার্থ, গ্যাস এবং অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি রয়েছে।
হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টের নাম ড. কায়মনো। অপর দুজন তার সহকারী–ড. যোজনা এবং ড. রেকা। ড, কায়মনোর কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে ল্যাবরেটরির সবগুলো দরজা বন্ধ করে দিয়ে তালা লাগিয়ে দিল কুয়াশা। কায়মনো প্রশ্ন করতে কুয়াশা বলল, ‘সফল হওয়া অবধি আমরা কেউ বাইরে বেরুব না। না হই, এখানেই মরব চারজন একসাথে। বাইরে ভাইরাস নিয়ে যেন বেরুতে না পারি সেজন্যেই দরজায় তালা লাগলাম। মনে রাখবেন, আমি যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হই তাহলে আমাকেও বাইরে বেরুতে দেবেন না । | কাজ শুরু করল কুয়াশা। দ্রুত প্রশ্ন করে বড় বড় কাঁচের জার এবং পাত্রে সংরক্ষিত তরল পদার্থের নামগুলো জেনে নিল সে।
টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ধর্মের এবং গুণের কেমিক্যালস নিয়ে পরীক্ষা চালাল কুয়াশা । ভাইরাসে আক্রান্ত একজন লোকের দেহ থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে সিরিঞ্জটা পকেটে রেখে দিয়েছিল কুয়াশা। সিরিঞ্জটা বের করল সে। রক্তের নমুনা কাঁচের টিউবে প্রবেশ করাল। পকেট থেকে বের করল একটা রঙিন শিশি। শিশিটা খুলে বেগুনী রঙের তরল পদার্থ ঢালল একটি পাত্রে। আলখাল্লার বিভিন্ন পকেট থেকে বেরিয়ে এল আরও তিন-চারটে শিশি। পয়জন লেখা শিশিগুলো থেকে প্রয়োজন মাফিক তরল পদার্থ ঢেলে নিয়ে বিভিন্ন কেমিক্যালস-এর সাথে মিকশ্চার করতে লাগল।
ভলিউম ১৬
অবাক চোখে দেখছে প্রৌঢ় তিনজন বিজ্ঞানী কুয়াশার কাজ ।
মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ পরিবেশ। বাইরের রাস্তায় ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের বিকট চিৎকার ঢুকছে না সাউণ্ডপ্রুফ জা ভেদ করে ল্যাবরেটরির ভিতর। মাঝেমধ্যে বিশেষ কোন নির্দিষ্ট যন্ত্র বা কেমিক্যালসের নাম উচ্চারণ করে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে কুয়াশা। তিনজন প্রৌঢ় বিজ্ঞানী শশব্যস্ত হয়ে একযোগে হুকুম পালন করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠছে। | কেটে যাচ্ছে ঘন্টার পর ঘণ্টা রক্তের নমুনার সাথে রয়েছে, ভাইরাস, ঘা-এ কঠিন-প্রাণ জীবাণু। এদেরকে সমূলে ধ্বংস করতে সক্ষম একটা ওষুধ আবিষ্কার করতে হবে। বিভিন্ন বিষাক্ত তরল পদার্থ মিশিয়ে সেই ওষুধ তৈরির একনিষ্ঠ সাধনাতেই মগ্ন কুয়াশা। কাজের প্রতি তার মনোযোগ আর একাগ্রতা দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, নিবেদিত প্রাণ তার । এই কাজেই সে উৎসর্গ করেছে নিজেকে ।
| টিউবের ভিতর রক্তের সাথে ঘা-এর জীবাণু সংখ্যায় লক্ষ কোটি, মাইক্রোসকোপে চোখ লাগিয়ে সেই জীবাণুগুলোকে দেখছে কুয়াশা, দেখছে নতুন করে সবেমাত্র তৈরি ওষুধের প্রভাবে জীবাণুগুলো মরছে কিনা।
মরছে না। গত তিন ঘন্টায় সাতবার পরীক্ষা চালিয়েছে কুয়াশা। সাতবারই এসেছে ব্যর্থতা।
কিন্তু ব্যর্থতা মেনে নিতে রাজি নয় কুয়াশা। তাই তার কাজেরও বিরাম নেই, সন্দেহ নেই, এ বড় শক্ত জীবাণু। কোনভাবেই এদেরকে ধ্বংস করা যাচ্ছে না।
এই কাজে ঝুঁকির পরিমাণও কম নয়। মারাত্মক একটা বিষ প্রয়োগে এই জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করা হয়তো কঠিন কিছু নয়। কিন্তু জীবাণুগুলোকে যে বিষ বা ওষুধ ধ্বংস করবে সেই বিষ বা ওষুধ যাতে মানুষের শরীরে কোনরকম ক্ষতিকর ক্রিয়া করতে না পারে সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। যাতে সাপও মরে লাঠিও না। ভাঙে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
রাত তো শেষ হয়ে এসেছে, ‘হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভাঙল ড, কায়মনো । রেকা হাই তুলল। ধৈর্য এবং উৎসাহ ফুরিয়ে গেছে তার। ক্লান্ত কণ্ঠে সে বলল,, এ অসম্ভব! মি, কুয়াশা, অকারণে খাটছেন। পরাজয় স্বীকার করে নেয়াই ভাল।’
‘শাটআপ! গর্জে উঠল অকস্মাৎ কুয়াশা। অপ্রত্যাশিতভাবে বুদ্র কণ্ঠের ধমক খেয়ে চমকে উঠে দু’পা পিছিয়ে গেল তিনজন।
কুয়াশা এখনও আশাবাদী। নিরাশ হতে জানে না সে। পরাজয় বা ব্যর্থতার সাথে পরিচিত নয় সে। ইচ্ছা থাকলে উপায় হবে না কেন? জীবাণু যখন আছে তখন তাকে ধ্বংস করার ওষুধও আছে। উপাদান রয়েছে, সেগুলো একত্রিত করে তৈরি করতে হবে ওষুধ। কাজে ভুল হয়, হবে। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি করলে চলবে না। আধঘণ্টা পর নতুন করে মাইক্রোসকোপে চোখ রাখল কুয়াশা। ডান হাত দিয়ে টিউবের ভিতর প্রবেশ করাল নতুন একটা মিকশ্চার।
দেড় মিনিট পর উন্মাদের মত উল্লাসে ফেটে পড়ল কুয়াশা।
কুয়াশা ৪৬
পেরেছি! পেরেছি! ভাইরাসগুলো মরে গেছে! মি. কায়মনো, আমি সফল হয়েছি। দেখুন, দেখুন–মাইক্রোসকোপে চোখ লাগিয়ে দেখুন আপনারা?
অধীর উত্তেজনায় কাঁপছে ড, কায়মনো। এগিয়ে গেল সে। কুয়াশার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। চোখ রাখল মাইক্রোসকোপে।
কয়েক মুহূর্ত পর মাথা তুলল ড. কায়মনেনা। মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইল সে কুয়াশার দিকে।
একে একে ড: রেকা এবং ড. যোজনাও দেখল, সত্যি মরে গেছে টিউবের ভাইরাসগুলো।
| ড. কায়মনো কুয়াশার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল, মি. কুয়াশা, আপনি জানেন না, কি বিপদ থেকে আনতারার মানবজাতিকে আপনি রক্ষা করেছেন। সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আপনি। আপনি আমাদের নমস্য। আমি আনতারার জাতীয় সায়েন্স ল্যাবরেটরির অধ্যক্ষ, আমি ব্যবস্থা করব যাতে আপনাকে আনতারার সরকার ‘লা সাফা” অর্থাৎ ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ’–এই উপাধি গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। এর আগে কেউ এই উপাধি পাননি।’
| কিন্তু কুয়াশার কানে এসব কথা ঢুকছে না। এখনও অনেক কাজ বাকি। ধ্বংস হয়েছে ঠিকই টিউবের ভাইরাস, কিন্তু মানুষের শরীরে এই ওষুধ কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
এতক্ষণ নোট বইতে নানারকম আঁকিঝুঁকি এঁকেছে কুয়াশা, অঙ্ক কষেছে, প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে রেখেছে। সেগুলো গভীর মনোযোগের সাথে আবার পড়ছে
সে।
খানিক পর মুখ তুলল কুয়াশা। বলল, আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে চাই। যে ওষুধ আবিষ্কার করেছি সেটা মানুষের শরীরে ইঞ্জেক্ট করার পর কি প্রতিক্রিয়া হয়, শরীরের রক্তের সাথে মিশে যাওয়া জীবাণুদেরকে কি হারে, কত দ্রুত ধ্বংস করতে সক্ষম তা জানতে হবে আমাকে।’
“কি করতে চান তাহলে এখন?’ ড. কায়মনো প্রশ্ন করল। | কুয়াশা ঘোষণা করল, বাইরে ভাইরাসে আক্রান্ত লাশ-এর শরীর থেকে ভাইরাস বের করে আমি আমার নিজের শরীরে গ্রহণ করব। ঘা ফুটবে, স্বভাবতই, আমার শরীরে। তারপর আমি আমার আবিষ্কৃত প্রতিষেধক গ্রহণ করব শরীরে। ফলাফল কি দাঁড়াবে জানা আছে আমার। ভাইরাসগুলো মারা যাবে, ঘা-ও সেরে যাবে সেই সাথে। চলুন, ড. কায়মনো, ভাইরাস নিয়ে আসি আমরা।’
দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ওরা। খানিক পরই ভাইরাস সংগ্রহ করে ফিরে এল ড. কায়মনো এবং কুয়াশা।
ড, যেজিনা বলছিল উ. রেকার উদ্দেশ্যে, কিন্তু যাই বলো, এই ঘায়ের কবল থেকে আমরা সবাই বাচলেও যা মরলেও তাই। কি লাভ বেঁচে থেকে? ক’দিন? বিপদ কি একটা?
কুয়াশা এবং ড. কায়মনো ভিতরে ঢুকতে ড: যোজ চুপ করে গেল।
ভলিউম ১৬
কুয়াশা উ. যোজনার শেষের কথাগুলো শুনেছে। সে বলল, “সমস্যা আপনাদের অনেক, অনুমান করতে পারি আমি। কিন্তু সব সমস্যারই সমাধান আছে। ধীরে ধীরে, একটা একটা করে সব সমস্যারই সমাধান করা যেতে পারে। ধৈর্য হারালে কোন লাভ নেই। সমস্যাকে ভয় করলেও কোন লাভ নেই।
দরজাটায় তালা লাগিয়ে দিন ড. কায়মনো। শরীরে ভাইরাস গ্রহণের আগে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই। ভাইরাস গ্রহণের পরপরই আমি আমার আবিষ্কৃত ওষুধ গ্রহণ করব শরীরে। আমি শয়তান নই, সুতরাং আমার তৈরি প্রতিষেধকে ত্রুটি থাকতেও পারে। যদি কোনরকম ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটে থাকে, তাহলে হয়তো ভাইরাস ধ্বংস হবে না। ফলে ঘা বাড়তে থাকবে, তীব্র যন্ত্রণায় আমি ছটফট করব। স্মরণ রাখবেন, আমার যাই হোক, যত কষ্টই হোক,–কোন অবস্থাতেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে দেবেন না আমাকে। আমি চাইলেও না। দরকার হলে শারীরিক শক্তি ব্যবহার করে আমাকে বাধা দেবেন। আর একটা কথা । আমার তৈরি এই প্রতিষেধকে যদি কোন রকম গোলমাল থাকে তাহলে সামান্য হিসেবের ভুল বা রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমা কমবেশি হবার দরুন বা রাসায়নিক পদার্থগুলো ভেজাল হওয়ার ফলেই গোলমা ঘটে থাকবে। সেক্ষেত্রে সতর্ক ভাবে নতুন করে একই উপাদান মিশিয়ে তৈরি করতে হবে প্রতিষেধক, ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধনের জন্য। এই কাজের দায়িত্ব রইল আপনাদের ওপর। আমি সুস্থির থাকতে যদি না পারি তাহলে আমার বদলে কাজটা আপনারা করবেন। আমার অনুরোধ, আপনারা আমার অবস্থা খারাপ দেখলে বিচলিত হবেন না, এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করবেন না। আমার নোট বুকে প্রতিষেধক তৈরির ফর্মুলাটা রইল। এবার, হ্যাঁ, আমি ভাইরাস গ্রহণ করব। | কুয়াশা সিরিঞ্জটা প্রবেশ করাল নিজের বা বাহুতে। এতটুকু কাঁপছে না তার হাত। কয়েক সিসি ভাইরাস ধীরে ধীরে প্রবেশ করল কুয়াশার শরীরে, মিশে গেল সারা শরীরের রক্তের সাথে। | ড. কায়মনে, ড. যোজনা, ড. রেকাকোটর ছেড়ে তিনজনেরই বেরিয়ে আসতে চাইছে তিনজোড়া চোখ। হাঁ হয়ে গেছে ওদের মুখ বোয়াল মাছের মত।
ড. কায়মনো ঢোঁক গিলল। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ তাঁর। অধীর উত্তেজনায় শরীরের মাংসপেশীগুলো টানটান হয়ে গেছে। | শান্ত কুয়াশা। গভীর ধ্যানে নিমগ্ন যেন সে। সুদর্শন মুখের চেহারায় ফুটে উঠেছে অস্পষ্ট একটু হাসি-হাসি ভাব। কপালে মুক্তোর মত লেগে রয়েছে স্বেদবিন্দু। উজ্জ্বল বৈদ্যতিক আলোয় দাঁড়িয়ে আছে সে। অচঞ্চল।
টেবিল থেকে দ্বিতীয় সিরিঞ্জটা তুলে নিল কুয়াশা। এটাতে রয়েছে তার আবিষ্কৃত ভাইরাসের প্রতিষেধক।
অটুট নিস্তব্ধতা ল্যাবরেটরির ভিতর।
প্রৌঢ় বিজ্ঞানী তিনজন ঝুঁকে পড়েছে কুয়াশার দিকে দৃষ্টি এবং শ্রবণেন্দ্রিয় জাগ্রত। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে তারা। কুয়াশা ৪৬
অপেক্ষার পালা শেষ হলো। কেউ যেন ফুটবলের মত ছুঁড়ে মারল কুয়াশাকে। ঘটনাটা ঘটল চোখের পলকে, এক সেকেণ্ডেরও কম সময়ের মধ্যে। কুয়াশা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে তাকে আর দেখা গেল না। সাত হাত দূরের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলো কুয়াশা। দেয়াল থেকে পড়ল মেঝেতে, মেঝেতে ড্রপ খেয়ে উঠল উপর দিকে, সিলিং-এর প্রায় কাছাকাছি, সেখান থেকে আবার মেঝেতে নামল, ড্রপ খেয়ে তির্যকভাবে, তীরবেগে গিয়ে ধাক্কা খেলো বা দিকে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো স্টীলের র্যাকের সাথে। হুড়মুড় করে র্যাক থেকে পড়ে গেল কাঁচের জার, নানা আকার এবং আকৃতির চিনেমাটির পাত্র, বোতল, শিশি। কাঁচের খণ্ডবিখণ্ড টুকরো, ল্যাবরেটরির মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। তরল পদার্থ ভাসিয়ে দিল চারদিক।
| কুয়াশাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। অবিরাম বিদ্যুৎবেগে লাফাচ্ছে তার দেহটা। হাত-পা কোথায় তার, কি অবস্থায় রয়েছে বোঝার কোন উপায় নেই। দেহটা কুণ্ডলী পাকিয়ে সম্ভবত গোলাকার হয়ে উঠেছে, এর বেশি কিছু অনুমান করারও উপায় নেই।
পাঁচ রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পার্লামেন্ট হাউস। দর্শনীয় স্থান। পৃথিবীর কোথাও এতরড় ভবন নেই, সুতরাং তুলনা দিয়ে এই প্রকাণ্ড ভবনের আকার এবং বৈশিষ্ট্য বোঝানো সম্ভব নয়। পার্লামেন্ট হাউস তিন ভাগে বিভক্ত। অ্যাসেমূলি হল, রাজপ্রাসাদ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাসভবন।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে অ্যাসেম্বলি হল। আসন সংখ্যা আড়াই হাজার। আরামদায়ক গদি আঁটা প্রতিটি আসনের সামনে একটি করে সুদৃশ্য মাঝারি আকারের টেবিল। টেবিলের উপর নানারকম যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে ফোন, ইন্টারকম, ওয়্যারলেস সেট, একাধিক কলিংবেল, হিসেব কষার যন্ত্র, মাইক্রোফোনের মাউথপীস, টেপ রেকর্ডার, মিনি টিভি সেট, হেডফোন ইত্যাদি।
অ্যাসেমূলি হলটা গোলাকার। মঞ্চটা এক প্রান্তে। মঞ্চের সর্বোচ্চ আসনটা সিংহাসন। সিংহাসনে রাজা বসেন। মঞ্চের ডানদিকে বাঁ দিকে দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে রাজা নিজ প্রাসাদে যেতে পারেন, প্রাসাদ থেকে অ্যাসেম্বলি হলে আসতে পারেন।
| রাজার নিচের আসনে বসেন প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্টের পাশেই ভাইস প্রেসিডেন্ট। এর নিচের আসনে বসেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর দুপাশে বসেন মন্ত্রীরা। তাদের নিচে প্রতিমন্ত্রীরা। আড়াইশো প্রদেশের প্রায় আড়াই হাজার। প্রতিনিধি বসেন সাধারণ আসনে, মঞ্চের সামনে।
আনতারা পৃথিবীর মৃতই এককালে শত শত রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। হাজার বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল রাষ্ট্রগুলো। দার্শনিক, পণ্ডিত, নেতৃবর্গ এবং মনীষীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রায় শতবর্ষ আগে আনতারার সকল জাতি মিলিত হয়ে একটি মাত্র রাষ্ট্র গঠন করেছে। সেই রাষ্ট্রের নাম, গ্রহের নামানুসারে, আনতারা।
৩০
ভলিউম ১৬
আনতারায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। রাজা আছেন কিন্তু তিনি শাসক নন। তিনি ন্যায় বিচার এবং অভিভাবকত্বের প্রতীক হিসেবে ক্ষমতায় আসীন। জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী, প্রতিনিধি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট। জনতার রায়ই এখানে চুড়ান্ত।
পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছে বর্তমানে। এখানকার অবস্থাও আনতারার অন্যান্য জায়গার মত। অনিয়ম, নৈরাশ্য, উদ্যমহীনতা বিরাজ করছে চারদিকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীরা কেউ উপস্থিত নেই অ্যাসেম্বলি হলে। বিশেষ ক্ষমতা বলে মহামান্য রাজাই এখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। অধিবেশনের সভাপতিও তিনি।
| প্রতিনিধিদের অনেক আসন শূন্য। বড় জোর হাজার খানেক প্রতিনিধি যার যার নির্দিষ্ট আসনে বসে আছে। বেশিরভাগই ঘুমাচ্ছে তারা, কেউ কেউ বই পড়ছে। অধিবেশনের কাজ চলছে ঢিমে তালে, বিশৃঙ্খলভাবে। কেউই বিশেষ মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছে না বা দেখছে না। সবাই ভীষণ বিমর্য, বিষণ্ণ।
| মহামান্য রাজা স্বয়ং আধবোজা চোখে বসে আছেন সিংহাসনে হেলান দিয়ে। তার সামনের গালিচা পাতা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তথ্য দফতরের সেক্রেটারি। তার হাতে ধরা কাগজ দেখা যাচ্ছে। কাগজে লিপিবদ্ধ রিপোর্ট পড়ছে সেঃ
‘গত চব্বিশ ঘণ্টায় তথ্য দফতর মাত্র পঁচাত্তরটি প্রদেশ থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করতে পেরেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, পঁচাত্তরটি প্রদেশে গত চব্বিশ ঘণ্টায় ঘায়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তিন লাখ তিয়াত্তর হাজার নয়শো এগারো জন। বিষুদা প্রদেশের বারোটা গ্রাম, একটা শহর, যামদানী প্রদেশের চারটে গ্রাম, দুটো শহর, মালাকা প্রদেশের এগারোটা গ্রাম ছয়টা শহর সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে গেছে ঘা-এর আক্রমণে। এই রোগের কবলে অর্ধেকেরও বেশি মারা গেছে, যে-সব শহরে এবং গ্রামে সেগুলোর নাম•••
প্রায় দশ মিনিট ধরে পড়ল সেক্রেটারি তার রিপোর্ট। রিপোর্ট পড়া শেষ করে বিনাবাক্যব্যয়ে নেমে গেল সে মঞ্চ থেকে। অপেক্ষারতদের আসন থেকে মঞ্চে উঠে এল আরেক দফতরের আর এক সেক্রেটারি। তার রিপোর্টে দেখা গেল গত চব্বিশ ঘণ্টায় গোটা দেশে আত্মহত্যা করেছে আশি হাজার লোক এটা আনুমানিক সংখ্যা, প্রকৃত সংখ্যা নাকি এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হতে পারে।
“ এরপর একদল বিজ্ঞানী উঠল মঞ্চে। তারা তাদের রিপোর্টে জানালসসেমিরা। থেকে সসেমরা আকুল আবেদন জানিয়ে বেতার সঙ্কেত পাঠাচ্ছে তাদেরকে বাঁচাবার জন্য। সলেমরা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করছে বারবার। এবং তারা বন্দী সতেরোজন বিজ্ঞানীকে মুক্তি দিতে আগ্রহী বলে জানাচ্ছে ।
সসেমিরা হলো আনতারার একমাত্র উপগ্রহ, পৃথিবীর যেমন চাঁদ। কিন্তু পৃথিবীর চাদে প্রাণের অস্তিত্ব না থাকলেও আনতারার সসেমিরায় সসেম নামের অস্বাভাবিক কুয়াশা ৪৬
৩১
মেধাবী এবং প্রতিভাবান একটী জাতি বাস করে।
| বিজ্ঞানীদের রিপোর্টের শেষটা এরকম শনির বলয় দ্রুত ছুটে আসছে সসেমিরার দিকে । আমাদের হিসেব অনুযায়ী আগামীকাল বিকেলে সসেমিরাকে নিয়ে অসীম মহাশূন্যের পথে সৌরজগতের আকর্ষণ অগ্রাহ্য করে শনির এই বিচ্ছিন্ন বলয় ছুটে যাবে। ফলে আনতারা কক্ষচ্যুত হবে সাথে সাথে।
আইন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী মঞ্চে উপস্থিত হলো এরপর। তার সাথে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে নির্বাচিত তিনজন প্রতিনিধি। একজন প্রতিনিধি একটা প্রস্তাব পাঠ করল।
| প্রস্তাবটি এরকম : প্রমাণ পাওয়া গেছে ঘায়ে আক্রান্ত কোন কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে অস্বাভাবিক বিলমূ ঘটছে। ঘায়ে আক্রান্ত ব্যক্তির তীব্র, অসহনীয় যন্ত্রণা সম্পর্কে আমরা অবগত। দেখা গেছে কোন কোন ব্যক্তি ঘণ্টাধিক কালেরও বেশি সময় যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। এই অস্বাভাবিক কষ্ট সহ্য করা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। ঘ একবার আক্রমণ করলে মৃত্যু অনিবার্য । একথা আমরা জানি। মৃত্যু যার অবধারিত সে যদি অকারণে কষ্ট ভোগ করতে থাকে তাহলে তার কষ্ট দূর করার উপায় বের করার চেষ্টা করা দরকার আমাদের, আমি তাই মনে করি। আমি প্রস্তাব করছি, ঘায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কষ্টের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ঘা তার শরীরে দেখা দেয়া মাত্র তাকে দ্রুত এবং সহজপ্রাপ্য যেকোন অস্ত্রের সাহায্যে মেরে ফেলার। এতে করে আক্রান্ত ব্যক্তির উপকার করাই হবে।
মৌখিক ভোট গ্রহণ করা হলো। বেশ কিছু প্রতিনিধি, যারা ঘুমায়নি, হাত তুলে প্রস্তাবের স্বপক্ষে মতামত জানাল। আইন মন্ত্রণালয়ের অফিসার লিখিত প্রস্তাবটা নিয়ে রাজার সামনে গেল।
রাজা অলস ভঙ্গিতে বসে ছিলেন। ধীরেসুস্থে সোজা হয়ে বসলেন তিনি। তারপর কলম তুলে নিয়ে সই করলেন কাগজের উপর।
পাশ হয়ে গেল আইন।
এরপর বিভিন্ন দফতরের অফিসাররা অস্তিত্বহীন-প্রায় প্রশাসনের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলল তাদের রিপোর্টে। এদিকে, আচমকা, বিকট চিৎকার উঠল। প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে।
| পাশাপাশি দুজন প্রতিনিধি আক্রান্ত হয়েছে ঘায়ে। গোলাপী ঘা ফুটে উঠেছে তাদের শরীরে, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের সর্বত্র। দুজনই যন্ত্রণায় জ্ঞানশূন্য হয়ে দিকবিদিক লাফাচ্ছে। পরপর গুলির শব্দ হলো কয়েকটা।
স্থির হয়ে গেল, ঘায়ে আক্রান্ত প্রতিনিধি দুজন। একদল লোক ক্লান্ত পায়ে অকুস্থলের দিকে রওনা হলো। তারা ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে চলে গেল লাশ দুটো।
এরপরই অ্যাসেম্বলি হলে প্রবেশ করল চারজন বিজ্ঞানী। তারা চারজনই সোজা, মঞ্চে উঠল, উঠে রাজার সামনে দাঁড়াল।
বিজ্ঞানীদের নেতা বিরাট বপু দুলিয়ে শুরু করল ভাষণ। তার হাতে কোন কাগজপত্র নেই। রীতিমত উত্তেজিত সে। কাঁপা গলায় বলে চলেছে একটাই কথা।
ভলিউম ১৬
৩২
‘মহামান্য রাজা, প্রতিনিধি ভাইয়েরা, আমরা অবশেষে ভয়ঙ্কর গোলাপী ঘায়ের– প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছি••বিশ্বাস করুন আপনারা, বিশ্বাস করুন মহামান্য রাজা, আমরা অবশেষে ভয়ঙ্কর গোলাপী ঘায়ের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পেরেছি। আপনারা প্রমাণ চান, প্রমাণ দেখাব। আশ্চর্য, কেউ শুনছেন না কেন আমার কথা! মহামান্য রাজা, বিশ্বাস করুন•••।’
| বস্তুতঃপক্ষে কেউই শুনছিল না বিজ্ঞানীদলের নেতার কথা। রাজা তখন ব্যস্ত অন্য কাজে। রাজপরিবারের বার্তাবাহক উপস্থিত হয়েছে মথে। রাজার পাশে দণ্ডায়মান দেহরক্ষীদের প্রধানের সাথে কথা বলছে সে।
| খানিক পর প্রধান দেহরক্ষী রাজার উদ্দেশে সবিনয়ে বলল, “মহামান্য, দুঃসংবাদ। সংবাদ এসেছে মহামান্য রাজকুমারী ওমেনা আক্রান্ত হয়েছেন ঘায়ে । কিন্তু রাজকুমারীর আবিষ্কৃত যন্ত্রণা উপশমকারী ওষুধের গুণে তিনি সুস্থির আছেন,
তবে ঘা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে।
রাজা বললেন, ‘আমি আদেশ দিচ্ছি, রাজকুমারীকে মেরে ফেলা হোক!’
না।’
বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানাল রাজার আদেশের বিরুদ্ধে একটি গুরুগম্ভীর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
এই প্রথম সজাগ হলো উপস্থিত সকলে। যারা ঘুমোচ্ছিল তাদের ঘুম ভেঙে গেল। যারা বই পড়ছিল তাদের হাত থেকে খসে পড়ে গেল বই। রাজার চোখ কপালে উঠল। কার এত বড় বুকের পাটা! তার আদেশের বিরুদ্ধে কথা বলে
প্রতিবাদ জানিয়েছে মঞ্চে উপস্থিত চারজন বিজ্ঞানীর সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি। পরনে তার শার্ট, ট্রাউজার, কোট নয়। একটা কালো চাদরে শরীর ঢাকা তার, পা থেকে গলা অবধি। দীর্ঘদেহী, সুদর্শন এই ব্রিজ্ঞানী দৃঢ় পদক্ষেপে রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রাজা ভুরু কুঁচকে দেখছেন বিজ্ঞানীকে।
| বিরাট হল ঘরের কোথাও কোন শব্দ নেই। সবাই তাকিয়ে আছে তরুণ বিজ্ঞানীর দিকে অবাক চোখে।
| রাজার দেহরক্ষীরা সতর্ক হয়ে উঠেছে। প্রস্তুত তারা যে-কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য।
তরুণ বিজ্ঞানীর চোখ দুটো অদ্ভুত সুন্দর। মায়াময়, যাদুকরী, দৃষ্টি তার দুই চোখে।
রাজা গর্জে উঠলেন আচমকা, কে হে তুমি। আমার কথার ওপর কথা বলো? জানো, আমি বর্তমানে আনতারার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী? আমার মুখের কথাই আইন! আমি হুকুম দিচ্ছি, রাজকুমারীকে মেরে ফেলা হবে। | প্রতিনিধিদের তরফ থেকে আওয়াজ উঠল, “মহামান্য রাজার কথাই ঠিক। তিনিই বর্তমানে দেশের শাসক। তার কথাই আইন।
‘থামুন আপনারা সবাই,’ ধমকে উঠল তরুণ বিজ্ঞানী। তারপর সে রাজার দিকে ফিরল, বলল, “মহামান্য, আপনি ভুল করছেন। আনতারার কোন অধিবাসী এখন থেকে আর ঘায়ে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে না । আমি গোলাপী ঘায়ের ৩কুয়াশা ৪৬
T
প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছি। যেমন দ্রুত এই ঘা বাড়তে থাকে প্রতিষেধক শরীরে প্রবেশ করালে তেমনি দ্রুত এই ঘা শরীর থেকে মুছে যায়, অদৃশ্য হয়ে যায়। আপনি প্রমাণ চাইলে•••
এমন সময় মঞ্চের একপাশের একটা দরজা সশব্দে খুলে গেল। অপূর্ব সুন্দরী চব্বিশ পঁচিশ বছরের একটি যুবতী মেয়ে চঞ্চল পদক্ষেপে মঞ্চে, রাজার পাশে এসে দাঁড়াল।
যুবতীর দিকে চেয়ে আছে সবাই। এমন রূপ বড় একটা দেখা যায় না। যুবতীর গাল বেয়ে নামছে নোনা জল।
| রাজার উদ্দেশ্যে যুবতী বলে উঠল, “বাবা! আর পারছি না। আপনি আমাকে মারার আদেশ দিন। আমার তৈরি ওষুধ খেয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্ত ছিলাম এতক্ষণ। কিন্তু ওষুধের প্রভাব কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বাবা, বড় কষ্ট হচ্ছে আমার•••এই
দেখুন, ঘা কিভাবে বাড়ছে।
রাজকুমারী তার বুকের কাপড় ফড় ফড় করে ছিঁড়ে ফেলল।
রাজকুমারীর বুক-পেট জুড়ে গোলাপী ঘা দগদগ করছে। ক্রমশ বেড়ে চলেছে সেই ঘা ।
রাজা চোখ বন্ধ করলেন। রুদ্ধকণ্ঠে নির্দেশ দিলেন তিনি, ‘প্রধান দেহরক্ষী! রাজকুমারীকে গুলি করো!’
কেউ কাউকে গুলি কোরো না।’ তরুণ বিজ্ঞানী প্রধান দেহরক্ষীর চোখে চোখ রেখে বলে উঠল মধুর, মিষ্টি স্বরে।
প্রধান দেহরক্ষীর হাত চলে গিয়েছিল হোলস্টার রাখা আগ্নেয়াস্ত্রের উপর। হঠাৎ সেই হাত ঝুলে পড়ল তার দেহের পাশে, যেন অবশ হয়ে গেছে আচমকা হাতটা ।
মহা হইচই শুরু করেছে প্রতিনিধিদের দল। আসন ছেড়ে হাত-পা ছুঁড়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছে কেউ কেউ। তরুণ বিজ্ঞানীর ধৃষ্টতা দেখে সবাই বিক্ষুব্ধ!
তরুণ বিজ্ঞানী, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল প্রতিনিধিদের দিকে। দুই হাত থামতে বলার ভঙ্গিতে শূন্যে তুলে রাখল সে। তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল, থামো! যে যেখানে আছে সেখানে দাঁড়াও! এক পা-ও নোড়ো না কেউ! সাবধান! কথা বোলো না কেউ।
যাদুর মত কাজ হলো । সবাই থমকে দাঁড়াল। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।
অটুট নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে চারদিকে। কারও নিঃশাস পতনের শব্দও শোনা, যাচ্ছে না।
সম্মোহিত নেত্রে সবাই চেয়ে আছে তরুণ বিজ্ঞানীর মায়াময় দুটি চোখের দিকে। কারও সাধ্য নেই সেই চোখের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার।
| রহস্যময় এক টুকরো হাসি ফুটল যেন তরুণ বিজ্ঞানীর মুখে। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল সে। রাজকুমারী মুগ্ধ চোখে দেখছে। ভুলে গেছে সে তার যন্ত্রণার কথা। মনে নেই তার, মৃত্যু আর মাত্র কয়েক মুহুত পরই তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে ইহজগত থেকে।
রাজকুমারী! আমার কাছে এসো তুমি!’ তরুণ বিজ্ঞানীর মধুর কণ্ঠস্বর।
৩৪
ভলিউম ১৬
সম্মোহিতা রাজকুমারী এক পা দুপা করে এগিয়ে এল।বিজ্ঞানীর মুখোমুখি হলো। তরুণ বিজ্ঞানী হাত বাড়াল বিশালদেহী দলনেতার দিকে। পকেট থেকে বের করল নেতা একটি হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ ।
| তরুণ বিজ্ঞানী সিরিঞ্জটা নিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরে ওষুধের পরিমাণটা, দেখল। তারপর আলতোভাবে ধরল রাজকুমারীর একটা বাহু। সিরিঞ্জের নিডলটা প্রবেশ করিয়ে দিল সে রাজকুমারীর বাহুতে।
ইঞ্জেকশন দেয়া শেষ হলো। অপেক্ষার পালা। নিজের হাতের রিস্টওয়াচের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ বিজ্ঞানী।
এক, দুই করে কেটে যাচ্ছে মিনিট। কারও মুখে কোন কথা নেই, কারও চোখে পলক নেই।
ঠিক সাত মিনিট পর তরুণ বিজ্ঞানী কথা বলে উঠল। রাজকুমারী, তোমার শরীরে ঘা বলে কোন জিনিস নেই। কিছু যদি মনে করো, সকলের সামনেই একবার সরাও তো বুকের কাপড়। দেখুক সবাই, দেখো তুমিও, দেখুন, মহামান্য রাজা।’
রাজকুমারী কাপড় সরিয়ে নিজের বুক দেখল। আনন্দে, উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল সে, বাবা। বাবা! আমি ভাল হয়ে গেছি। নেই, সত্যি ঘা নেই! ওহ, বাবা!
H
ছয়
বিপদ!
বিপদ এগিয়ে আসছে দেখে বিজ্ঞানীদলের নেতা এবং অপর দুই সহকারী ভয়ে মঞ্চ থেকে লাফ মেরে ছুটল।
তরুণ বিজ্ঞানী কিন্তু নড়েনি মঞ্চ থেকে। হাসছে সে ভরাট গলায়। ছুটে আসছে উন্মাদের মত মঞ্চের দিকে শত শত, হাজার হাজার প্রতিনিধি।
‘আমাকে দিন! আমাকে দিন। আমাকে দিন।’ সমস্বরে সবাই চেঁচাচ্ছে। ভাইরাস আক্রমণ করার আগেই সবাই প্রতিষেধক নিয়ে মৃত্যু-ভয় থেকে নিষ্কৃতি
চায়।
রাজা স্বয়ং দিশেহারা হয়ে উঠলেন। কি যে হলো তাঁর, সিংহাসন থেকে লাফ মেরে পড়লেন তিনি তরুণ বিজ্ঞানীর সামনে।
‘আমাকে! আমাকে। ঘা ফুটছে–জলদি ইঞ্জেকশন দাও আমাকে।
সত্যিই তাই।. তরুণ বিজ্ঞানী দেখল, রাজার হাতে ঘা ফুটছে। দ্রুত হাতের সিরিঞ্জটা রাজার বাহুতে প্রবেশ করাল সে। অবশিষ্ট প্রতিষেধক রাজার দেহে প্রবেশ করিয়ে সুচটা বের করে নিল। রাজা ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নিজের হাতের ঘায়ের দিকে। বাড়ছে ঘা। ক্রমশ বাড়ছে।
কই! কমছে না কেন! জ্বালা বেড়ে যাচ্ছে যে…’
তরুণ বিজ্ঞানী তখন কথা বলছে ধস্তাধস্তিরত প্রতিনিধিদের উদ্দেশে, ‘আপনারা মঞ্চে উঠবেন না । দয়া করে আমার কথা শুনুন। মঞ্চে উঠলে কোন লাভ হবে না ।
কুয়াশা ৪৬
আমার কাছে ওষুধ নেই। ওষুধ আছে. ল্যাবরেটরিতে।
সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুনছে তরুণ বিজ্ঞানীর কথা।
আপনারা অধীর হবেন না। মনে রাখতে হবে, গোটা দেশ আজ বিপদের মধ্যে। আপনাদের ভয় পাবার কিছু নেই। আমি যে ওষুধ আবিষ্কার করেছি তা সহজেই যে কোন বিজ্ঞানী ফর্মুলা দেখে তৈরি করতে পারবেন। আপনারা ড. কারমনোর সাথে এখুনি ল্যাবরেটরিতে চলে যান। ড. কায়মনো, আপনি মঞ্চে উঠে আসুন। উঃ যোজন এবং উ. রেকা, আপনারাও আসুন।
মঞ্চে উঠে এল বিজ্ঞানী দলের নেতা ড. কায়মনো এবং তার দুই সহকারী।
তরুণ বিজ্ঞানী কুয়াশা বলল, “আপনারা আমার কর্মুলা প্রেসে ছাপতে দিন এই মুহূর্তে। হাজার হাজার কপি ছড়িয়ে দিন, বিলি করার ব্যবস্থা করুন দেশের সর্বত্র। সাধারণ কেমিস্টরাও এই ফর্মুলা দেখে ওষুধ তৈরি করতে পারবেন। রেডিও, টি: ডির মাধ্যমে ফর্মুলা প্রচার শুরু করুন। মনে রাখবেন, যত তাড়াতাড়ি এই প্রতিষেধকের কথা মানুষ, জানবে তত কম মারা যাবে মানুষ। আপনারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আপনারা সবাই মিলিতভাবে চেষ্টা করুন বিজ্ঞানী এবং ডাক্তারদেরকে একত্রিত করার, তাদেরকে কাজে লাগাবার।
রাজা বলে উঠলেন আচমকা, সেরে গেছে! ঘা সেরে গেছে আমারও। কুয়াশা বলল, “মহামান্য, আপনি পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে নির্দেশ দিন।
প্রতিনিধিদের উদ্দেশে রাজা বললেন, ‘আমরা সবাই এই তরুণ অজ্ঞাত পরিচয় বিজ্ঞানীর কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের জীবনের ভয়ঙ্কর বিপদের অন্তত একটি বিপদ থেকে এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী আমাদেরকে রক্ষা করেছে। এখন আমাদের কর্তব্য এই বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত ওষুধ ব্যাপক হারে তৈরি করা এবং সব নাগরিকের জন্য সহজপ্রাপ্য করে তোলা। আপনারা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, যার যার এলাকায় ফিরে গিয়ে ফর্মুলা অনুযায়ী ওষুধ তৈরি করে জনসাধারণের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা। করুন। আমি জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করছি অনির্দিষ্টকালের জন্য।
প্রতিনিধিরা বিদায় নিল। প্রকৃতপক্ষে ড. কায়মনোর নেতৃত্বে সবাই ছুটল ল্যাবরেটরির দিকে।
রাজা তরুণ বিজ্ঞানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি আমার অতিথি, বিজ্ঞানী। তোমার সম্পর্কে আমি সব কথা জানতে চাই। ভাল কথা, এসো পরিচয় করিয়ে দিই। এ আমার মেয়ে, রাজকুমারী ওমেনা। ওমেনাও একজন বিজ্ঞানী।
হাত বাড়াল কুয়াশা। করমর্দন করল রাজকুমারীর সাথে। রাজকুমারীর মুগ্ধ দৃষ্টি সারাক্ষণ কুয়াশার মুখের উপর বিছিয়ে রয়েছে।
এসো সবাই বসি পাশের কামরায়।’
মঞ্চ থেকে পার্শ্ববর্তী দরজা পেরিয়ে একটি সুসজ্জিত কামরায় প্রবেশ করল কুয়াশা রাজার পিছু পিছু।
নরম সোফায় বসল কুয়াশা রাজা এবং রাজকুমারীর মুখোমুখি। রাজা দেহরক্ষীদের নির্দেশ দিলেন, ‘ঠাণ্ডা পানীয় দাও আমাদেরকে।
ভলিউম ১৬
ঠাণ্ডা পানীয় পান করে রাজা প্রশ্ন করলেন, এবার তোমার পরিচয় দাও, বিজ্ঞানী। কে তুমি? নাম কি তোমার? কোথায় থাকো তুমি? চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমন
পাণ্ডিত্য কিভাবে অর্জন করেছ–সব বলো আমাকে।
কুয়াশা হাসতে হাসতে বলল, আমার ধারণা একটি কথাতেই আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি আমি। মহামান্য, আমি আপনাদের আনতারার মানুষ নই । আমি পথিবীর বাসিন্দা। আমার নাম কুয়াশা।’
কিন্তু রাজা চমকালেন না এতটুকু, আশ্চর্যও দেখাল না তাকে। বললেন, “আমি সেই রকমই ধারণা করেছিলাম।’
রাজার কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হলো কুয়াশা। জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে উঠেছেন আপনি, মহামান্য।
রাজা বললেন, হ্যাঁ। তার কারণও আছে। আনতারাকে ধ্বংসের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না–সেই কথা ভেবেই।
কুয়াশা বলল, ধ্বংসের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না মানে?
রাজা বললেন, “তুমি পৃথিবীর মানুষ, ডক্টর কৃটজেও পৃথিবীর মানুষ ছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত তার কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। যাক যা বলছিলাম। ওমেনা,
তুমিই বরং মি, কুয়াশাকে বলো আমাদের বিপদগুলোর কথা। | রাজকুমারী বলল, “সব কথা আপনি যদি জানতে চান তাহলে প্রথম থেকেই বলা ভাল।’
কুয়াশা পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে আরাম করে বসল, বলল, তাই বলো।
রাজকুমারী ওমেনা শুরু করল, আমাদের এই গ্রহের নাম আনতারা। আনতারার আকার এবং আকৃতি হুবহু পৃথিবীর মত। পৃথিবী যে গতিতে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে আনতারাও, সেই একই গতিতে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সূর্যের একদিকে পৃথিবী অপরদিকে আনতারা। আনতারা এবং পৃথিবীর মাঝখানে সারাক্ষণ বিশাল পাচিলের মত অবস্থান করছে সূর্য। ফলে পৃথিবীবাসী আনতারা সম্পর্কে,
আনতারাবাসী পৃথিবী সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি এতদিন।
কুয়াশা বলল, জানতে না পারলেও এই রকম একটা গ্রহের অস্তিত্ব থাকতে, পারে বলে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকে ধারণা পোষণ করতেন। আমরা এই কল্পিত গ্রহের নামও দিয়েছিলাম-টুইন আর্থ।
রাজকুমারী বলল, “আমরা পৃথিবী সম্পর্কে সর্ব প্রথম জানতে পারি মাস ছয়েক আগে। আপনাদের পৃথিবী থেকে এক বৃদ্ধ বিজ্ঞানী তার মহাকাশযান নিয়ে আমাদের এই গ্রহে এসে পড়েন। বিজ্ঞানীর নাম ডক্টর কৃটজে। অবতরণের সময় ডক্টর কৃটজের মহাশূন্যযান বিধ্বস্ত হয়। যাক, ডক্টর কূটজেই সর্বপ্রথম পৃথিবী এবং পৃথিবীর সভ্য মানবজাতি সম্পর্কে আমাদেরকে জানান। কিন্তু এসব অনেক পরের কথা। আমি আগের কথায় ফিরে যাই।
দম নিয়ে রাজকুমারী আবার বলতে শুরু করল, পৃথিবীর মত আনতারারও একটি উপগ্রহ আছে। এই উপগ্রহের নাম সসেমিরা। সসেমিরায় অদ্ভুত এক ধরনের প্রাণী বাস করে। এরা যেমন দয়ামায়া আবেগ বর্জিত তেমনি অকৃতজ্ঞ,
কুয়াশা ৪৬
৩৭
বিশ্বাসঘাতক। দেখতে এরা অক্টোপাশের মত। চলে মাকড়সার মত। গত পনেরো বছর আগেও এরা ছিল বুনো জন্তু-জানোয়ার। কিন্তু এরা নিকৃষ্ট প্রাণী হলেও একটা কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। ভয়ঙ্কর ধারাল এদের ব্রেন। যে-কোন জিনিস একবার দেখলে, জিনিসটার নাড়ি নক্ষত্র সম্পর্কে বিশদ এবং নিখুঁত ধারণা পেয়ে যায়। জ্ঞান অর্জনের এমন অস্বাভাবিক ক্ষমতা সৃষ্টির আর কোন প্রাণীর মধ্যে সম্ভবত নেই। যে-কোন ভাষা মাত্র আধঘণ্টার চেষ্টায় শিখে ফেলতে পারে এরা। ওদের ব্রেনটা অত্যাধুনিক কমপিউটারের চেয়েও হাজারগুণ উন্নত। জ্ঞানকে ওরা খাদ্য বলে মনে করে। জ্ঞানের পিপাসাও ওদের ভয়ঙ্কর। জন্তু-জানোয়ারের মত দিন কাটাচ্ছিল ওরা, কিন্তু আমাদের সংস্পর্শে আসার মাত্র দুই মাসের মধ্যে আমাদের জ্ঞান ওরা হজম করে ফেলে।
‘কুয়াশা প্রশ্ন করল, তোমাদের সংস্পর্শে ওরা এল কিভাবে?
রাজকুমারী বলল, আজ থেকে পনেরো বছর আগে আমরা একটা রকেট নিয়ে সসেমিরায় প্রাণী আছে কিনা দেখতে যাই। প্রাণী আছে জানার পর পরবর্তী এক বছর ধরে আমরা ওখানে কয়েকটা দালান তৈরি করি। মহাশূন্যের অপরাপর গ্রহ সম্পর্কে গবেষণা এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য আমরা ওখানে একটা রিসার্চ সেন্টার স্থাপন করি। আমাদের সতেরোজন বিজ্ঞানী কাজ করছিলেন ওখানে। মাত্র দুইমাসের মধ্যে সসেমরা আমাদের বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে যাবতীয় জ্ঞান পার করে হজম করে ফেলে। এবং বন্দী করে আমাদের বিজ্ঞানীদের। সে আজ পনেরো বছর আগের কথা। এরপর বন্দী বিজ্ঞানীদের সাহায্যে এবং নিজেদের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে ওরা দ্রুত। সেই বছরই ওরা রকেট. যোগে আমাদের আবহাওয়া মণ্ডলে বিষাক্ত একটা গ্যাস ছড়িয়ে দেয়। যার ফলে আনতারার প্রতিটি প্রাণী সম্ভানোৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
কুয়াশা সোজা হয়ে বসল, বুঝেছি এতক্ষণে! তাই তোমাদের এখানে পনেরো ষোলো বছরের কম বয়েসী ছেলে-মেয়ে একটাও দেখতে পাইনি। তার মানে রোগে, শোকে, জরায়, দুর্ঘটনায় আনতারাবাসীরা স্বাভাবিক হারে মরছে ঠিকই কিন্তু নতুন মানুষ জন্মাচ্ছে না। কি সাংঘাতিক! এর প্রতিকার না করলে যে তোমরা শেষ হয়ে যাবে একদিন! আনতারায় কোন প্রাণীই থাকবে না ভবিষ্যতে।
রাজকুমারী বলল, “সসিমরা চায়ও তাই। আগেই বলেছি, ওদের ব্রেন কল্পনার বাইরে ক্ষমতা রাখে। এবং ওদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যও ভয়ঙ্কর। নিজেদের অস্বাভাবিক ক্ষমতা সম্পর্কে ওরা সচেতন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মনে করে ওরা নিজেদেরকে। ওরা ঘোষণা করেছে সসেম জাতি ছাড়া মহাশূন্যের কোথাও কোন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকবে না । আনতারাকে জনশূন্য গ্রহে পরিণত করার জন্য ওরা বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দিয়েছে। এরপর ওরা যাবে পৃথিবীতে।
কুয়াশা আঁৎকে উঠল, সে কি!
রাজকুমারী বলল, “পৃথিবীতে যাবার কারণও আছে। পৃথিবীর মানুষের অর্জিত জ্ঞান হজম করার উদ্দেশ্য তো আছেই, তাছাড়া অন্যান্য কারণও আছে। সসেমিরা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে দ্রুত, আগামী একশো বছরের মধ্যেই সম্ভবত হিমশীতল হয়ে যাবে
ভলিউম ১৬
৩৮
সসেমিরা। সসেমরা তাই অন্য গ্রহে চলে যেতে চায়। যাবার সব রকম প্রস্তুতি শেষ করেছিল ওরা। তৈরি করেছিল মস্ত একটা মহাশূন্যযান। সংখ্যায় ওরা মাত্র আড়াই লাখ। একটি মাত্র মহাশূন্যযানে করে ওদের রওনা হবার কথা ছিল পৃথিবীর উদ্দেশে। তার আগে ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে ওরা। এমন একটা কাণ্ড, যার ফলে সসেমিরা অদৃশ্য হয়ে যাবে, আনতারা কক্ষচ্যুত হবে•••
কি করেছে ওরা?’
‘রকেটযোগে পারমাণবিক বোমা পাঠিয়ে ভেঙে দিয়েছে ওরা স্যার্টান-এর অ্যাসটারয়েড। শনির বলয়টা এমন কায়দায় ভেঙে দিয়েছে ওরা যে সেই বিচ্ছিন্ন মহাকাশ বলয় দ্রুত বেগে ছুটে আসছে সসেমিরার দিকে। আমাদের হিসেব অনুযায়ী। আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় সেই অগ্রসরমান বলয় সসেমিরাকে আঘাত হানবে। সসেমিরাকে সাথে নিয়ে সেটা ক্রমশ দুরে সরে যাবে, সৌরজগৎ পেরিয়ে, মহাশূন্যের সীমাহীন রাজ্যে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যাবে সেটা। এর ফলে আনতারা স্বভাবতই, কক্ষচ্যুত হবে।
| আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। চঞ্চল, উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে, ‘কী বলছ তুমি, রাজকুমারী! এসব যদি সত্যি হয় তাহলে••আনতারা কক্ষচ্যুত হলে গোটা সৌরজগতের প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। পৃথিবীও রক্ষা পাবে না। শেষ পর্যন্ত। তুমি ঠিক জানো সসেরা পৃথিবীর উদ্দেশে রওনা হচ্ছে?”
| ‘পৃথিবীতে যাবারই উদ্দেশ্য ছিল ওদের। কিন্তু এখন ওরাও আটকা পড়ে গেছে। ধ্বংস ওদের অনিবার্য। একটি মাত্র মহাশূন্যযান তৈরি করেছিল ওরা। ডক্টর কৃটজে সেটা রকেট মেরে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
সব কথা ব্যাখ্যা করে বলো আমাকে, রাজকুমারী।’
রাজকুমারী বলল, ডক্টর কূটজে মাস ছয়েক আগে আমাদের এই গ্রহে আসেন, একথা তো আগেই বলেছি। তিনি আমাদের সমস্যাগুলো জানার পর বলেন সব সমস্যার সমাধান করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে মহাশূন্যযান সংক্রান্ত গবেষণায় তিনি কিছু অবদান রাখতে পারেন। আমরা তাকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিই। তিনি আমাদের একদল বিজ্ঞানীকে সাথে নিয়ে একটা মহাপরিকল্পনায় হাত দেন। মোট বারোটা রকেট তৈরি করেন তিনি। একটি মাত্র রকেট নিক্ষেপ করা হয়। সেই রকেট সসেমদের মহাশূন্যযানকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে সসেমিরা থেকে
অন্য কোথাও যাবার আর কোন উপায় নেই ওদের।
ডক্টর কূটজে বারোটা রকেট তৈরি করেছিলেন কেন?
রাজকুমারী বলল, ডক্টর কৃটজের পরিকল্পনা ছিল পারমাণবিক বোমার আঘাতে শনির ধাবমান বলয়কে প্রতিরোধ করা। বলয়টাকে বাধা দিতে হলে সসেমিরা থেকে অপারেশন করা দরকার। তাই সসেমদেরকে কাবু করার জন্য তিনি প্রথমে বোমার আঘাতে ওদের মহাকাশযান ধ্বংস করে দেন। পরিকল্পনার দ্বিতীয় কাজ ছিল সসেমিরায় একটা রকেট স্টেশন স্থাপন করা। স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা রকেট স্টেশন তৈরিও করা হয়। কিন্তু তার আগেই ডক্টর কূটজে মারা যান।
কাশা জানতে চাইল, ঘায়ের ভাইরাস সসেমরা কেন ছড়িয়ে দিল আনতারার “কয়াশা ২.৬
আবহাওয়ায়?’
রাজকুমারী বলল, সসেমরা ডক্টর কূটজে সম্পর্কে সব কথা জেনে ফেলেছিল। ওদের উন্নতমানের বেতার যন্ত্র এমনই যাদুকরী যে তার মাধ্যমে আনতারার কোথায় কি ঘটছে, কি আলাপ হচ্ছে, সব পরিষ্কার শুনতে পায় ওরা। ডক্টর কৃটজের পরিকল্পনার কথাও জানতে পারে ওরা। ফলে ওরা দাবি জানায়-কৃটজেকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। তা না হলে বিষাক্ত ঘায়ের ভাইরাস ছড়িয়ে দেবে ওরা
আমাদের আনতারার আবহাওয়া মণ্ডলৈ। আমরা রাজি হইনি ডক্টর কুটজেকে ওদের হাতে তুলে দিতে। ফলে ওরা ভাইরাস পাঠায়। ভাইরাস পাঠিয়েছে এই খবর শুনে ডক্টর কূটজে তাড়াহুড়ো করে পারমাণবিক বোমাসহ একটা রকেট পাঠান। সসেমিরায়। এটা ছিল প্রতিশোধ। ওদের রকেট ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু ডক্টর কৃটজে ভাইরাসে আক্রান্ত হন কদিন পরই। মারা যান তিনি। ফলে মহাপরিকল্পনার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বেশির ভাগ বিজ্ঞানী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন তাদের যোগ্যতাও ডক্টর কৃটজের মত না। ডক্টর কৃটজের
অসমাপ্ত কাজ শেষ করার মত দক্ষতা আমাদের বিজ্ঞানীদের নেই।’
কুয়াশা পায়চারি করছিল। হঠাৎ থামল সে। বলল, “বিপদ বড় ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। গোটা সৌরজগৎই ধ্বংস হয়ে যাবে, যদি শনির বলয় সসেমিরাকে ধাক্কা দিয়ে সাথে করে নিয়ে চলে যায়। রাজকুমারী, এ আমি মেনে নিতে পারছি না। পৃথিবী এবং আনতারার মানুষের এই সভ্যতা, কোটি কোটি নিরীহ মানুষের প্রাণ ধ্বংস হয়ে যাবে একটা উগ্র, হিংস্র, অন্যায়ের পূজারী, শয়তান উপাসক নিকৃষ্ট মানবেতর জাতির ষড়যন্ত্রে-এ অসম্ভব!
কুয়াশা রাজার দিকে তাকাল, মহামান্য আপনি অনুমতি দিন! আমি ডক্টর কুটজের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্যে শেষ চেষ্টা করতে চাই।
রাজা বললেন, অনুমতির জন্য ভেব না, কুয়াশা। কিন্তু সময় কোথায় আর? শনির বলয়কে ঠেকানো সম্ভবও নয় যে।’
কুয়াশা বলল, “অসম্ভব বলে কোনো জিনিস নেই। সবই সম্ভব, যদি চেষ্টা করা হয়। জানি না কতদূর কি করতে পারব আমি। তবে চেষ্টা করে দেখতে চাই একবার। আমাকে আপনাদের রকেট ষ্টেশনে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। যে কজন বিজ্ঞানী বেঁচে আছেন তাদেরকে একত্রিত করুন। তারা যেন আমাকে সাহায্য করেন, এই নির্দেশ দিন তাদেরকে। আমি পরিকল্পনার অগ্রগতি, সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাই।’
| রাজকুমারী বলল, আপনি আমার সাথেই চলুন। বিজ্ঞানীরা কোথায় আছেন আমি জানি। যাবার পথে ওঁদেরকে তুলে নেব গাড়িতে।
রাজা উঠে দাঁড়ালেন। কুয়াশার কাঁধে একটা হাত রেখে তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘তোমার প্রশংসা করার ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। প্রার্থনা করি, তুমি আমাদের রক্ষাকর্তা হতে পারো যেন।
৪০
ভলিউম ১৬
সাত
আণ্ডারগ্রাউণ্ড রকেট স্টেশন। রুদ্ধদ্বার কন্ট্রোলরূম।
| কুয়াশা একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে আছে। সামনের প্রকাণ্ড টেবিলের উপর বিছানো রয়েছে কমপিউটারের মাধ্যমে নিরূপিত সাঙ্কেতিক ডাটা, ম্যাপ, ইনফরমেশন। এক পাশে রয়েছে মহাশূন্য যানগুলোর ব্লুপ্রিন্ট। টেকনিক্যাল ইনফরমেশন অর্থাৎ রকেটগুলোর স্পীড, ক্যাপাসিটি, ল্যাণ্ডিং সিস্টেম, কাউন্ট ডাউন প্রসেস, ফুয়েল ক্যাপাসিটি, ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ এবং বিস্তারিত তথ্য ছাপার অক্ষরে লেখা রয়েছে একাধিক চার্টে।
কমপিউটর, ক্যালকুলেটর মেশিন রয়েছে কুয়াশার বাঁ দিকে। গভীর মনোযোগের সাথে সবকিছু পরীক্ষা করছে কুয়াশা। রাজকুমারী এবং বারোজন বিজ্ঞানী কুয়াশার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রয়েছে। কুয়াশা যখন যা চাইছে তাই বাড়িয়ে। দিচ্ছে তারা।
দ্রুত কমপিউটরের সুইচ টিপছে কুয়াশা, বোতাম টিপছে, হিসেব করছে ক্যালকুলেটর মেশিনে। ধীরে ধীরে পরিষ্কার ধারণা পাচ্ছে সে গোটা পরিকল্পনা সম্পর্কে।
প্রায় দু’ঘণ্টা পর মুখ তুলল কুয়াশা। হতাশার রেখা তার চোখেমুখে।
‘একি কাণ্ড আপনাদের। বারোটা রকেট তৈরি করা হয়েছে অথচ কোনোটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আপনারা যে-সব কাগজ পত্র দিয়েছেন আমাকে সেগুলোতে রকেট পরিচালনা করার বিষয়ে কোনো ডাটা, ইনফরমেশনই নেই। একি পাগলামি।
রাজকুমারী বলল, “ডক্টর কৃটজে য়েমন নির্দেশ দিয়েছিলেন আমাদের টেকনিশিয়ানরা সেই রকমভাবে তৈরি করেছিল রকেটগুলো।
কুয়াশা বলে উঠল, ডক্টর কূটজে তো আর পাগল ছিলেন না। নিশ্চয়ই তিনি রকেটগুলো মহাশূন্যে পাঠাবার জন্যই তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন, তাই না? কিন্তু আমার কাছে যে-সব টেকনিক্যাল ডাটা রয়েছে তাতে রকেটগুলো পরিচালনা
করার ব্যাপারে কোনো পদ্ধতির উল্লেখ নেই। এমন হতে পারে না।’
সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। কারও মুখে কোন কথা নেই।
কুয়াশা বলল, “নিশ্চয়ই ডক্টর কূটজে কোন ব্যবস্থা করেছিলেন। রকেটগুলো মহাশূন্যে পাঠাতে হলে ওগুলোকে চালু করতে হবে না?
রাজকুমারী বলল, ‘নিশ্চয়ই হবে।’ কুয়াশা ধমকে উঠল, সেক্ষেত্রে কোথাও তার উল্লেখ নেই কেন?
সবাই চুপ। এই প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। | কুয়াশা অধৈর্য স্বরে বলল, আমার ধারণা ডক্টর কূটজে রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে রকেটগুলোর পরিচালনা করার কথা ভেবেছিলেন। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আলাদা একটা কন্ট্রোলরূম থাকবে। কিন্তু আপনারা এমন কিছু আমাকে দেননি যার ফলে সেই কন্ট্রোলরূমের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারি আমি।
কুয়াশা ৪৬
কেউ কথা বলছে না।
কুয়াশা তাকাল রাজকুমারীর দিকে। তুমি বলেছিলে ডক্টর কূটজে সসেমিরায় স্থাপনের জন্য একটা রকেট লঞ্চিং স্টেশন তৈরি করেছিলেন। কোথায় সেটা? সেটা কি স্বয়ংক্রিয় একটা স্টেশন? স্টেশনটা কি মুভেবল? সেটার টেকনিক্যাল ডাটা, চার্ট ব্লুপ্রিন্ট–কোথায় সব?
* প্রৌঢ় একজন বিজ্ঞানী বলল, রকেট স্টেশনটা অন্যান্য বারোটা রকেটের মত একটা রকেট। সেটার কাগজপত্র ডক্টর কৃটজে তার নিজের কাছে রাখতেন।
কুয়াশা বলল, ওগুলোই দরকার আমার। আমার বিশ্বাস ওই রকেট স্টেশনেই আছে একটা কন্ট্রোলরূম। সেই কন্ট্রোলরূম থেকেই এই বারোটা রকেটকে পরিচালনা করার ব্যবস্থা করেছিলেন ডক্টর কূটজে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। রাজকুমারী, রকেট স্টেশন সম্পর্কে যাবতীয় কাগজপত্র চাই আমি।’
রাজকুমারী বিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ডক্টর কূটজে কাগজপত্রগুলো কোথায় রেখেছেন এ বিষয়ে এক-এক জনের এক-এক রকম ধারণা।
| যাক, পনেরো মিনিটের জন্যে সম্ভাব্য স্থানে সন্ধান চালাবার জন্য রাজকুমারী ছাড়া সবাই বেরিয়ে গেল।
| কুয়াশা হাসিমুখে বলল, তোমরা এমন একটা উন্নত জাতি অথচ কয়েকটা সামান্য বিপদের মধ্যে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছ। তোমাদের বিজ্ঞানীরাই ডক্টর কূটজের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে পারত। পারেনি মনোযোগের অভাবে, স্থিরতার অভাবে। আসল জিনিসটার খোঁজ না করে এরা বারোটা রকেট কিভাবে পরিচালনা করতে হবে সেই সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে ডক্টর কূটজে মারা যাবার পর। ডক্টর কূটজে যে রকেটগুলো পরিচালনার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করে গেছেন সে খবরই এরা রাখে না।
‘আপনি নিশ্চিত?’
“নিশ্চয়ই। ডক্টর কৃটজেকে আমি চিনতাম। তিনি আগের কাজ কখনও পরে করতেন না। রকেটগুলো তৈরি করেছেন অথচ সেগুলো পরিচালনার ব্যবস্থা। করেননিএমন হতেই পারে না।’
| রাজকুমারী বলল, আপনি আমাদের বিজ্ঞানীদের দোষ দিতে পারেন না। যেখানে জীবনের ধ্বংস অনিবার্য সেখানে মনোযোগ দিয়ে সুস্থিরভাবে কাজ করা সম্ভব নয়।
জীবনের ধ্বংস অনিবার্য বলছ কেন? তোমাদের কোনো সমস্যাই তো খুব ভয়ঙ্কর নয়। ভাইরাস-এর ফলে ঘা দেখা দিয়েছিল–চেষ্টা করলে তার প্রতিষেধক আবিষ্কার করা সম্ভব হত তোমাদের দ্বারাও।
রাজকুমারী বলল, “আমাদের বিজ্ঞানীরা কেমিক্যালস এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে তেমন উন্নত নয় যে, | কুয়াশা বলল, তবু প্রাণ উৎসর্গ করে চেষ্টা করলে সফলতা আসত। দ্বিতীয় বিপদ, সন্তানোৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছ তোমরা, শেষ হয়ে যাচ্ছ গোটা জাতি ধীরে ধীরে। এটা আসলে কোন সমস্যাই নয়। যে বিষাক্ত গ্যাস সন্তানোৎপাদনের
32
ভলিউম ১৬
ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে সেই গ্যাসের প্রভাব থেকে মুক্তি পাবার জন্য চাই মেডিসিন । চব্বিশঘণ্টার চেষ্টাতেই সেই মেডিসিন আবিষ্কার করতে পারি আমি।’
| রাজকুমারী বলল, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আবার আনতারার মেয়েরা সন্তান ধারণ করতে পারবে?
কেন পারবে না? বিজ্ঞান কি এই সামান্য সমস্যার সমাধান দেবার মত উন্নতি লাভ করেনি?
সত্যি বলছেন? আমি..আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না।’ | কুয়াশা হাসল। বলল, “দাঁড়াও, আগে শনির বলয়টাকে ঠেকাবার ব্যবস্থা করি। এ কাজে যদি সফল হই তাহলে তোমাদের চুনোপুটি বাকি সমস্যাগুলোরও সমাধান করে দিয়ে যাব।
রাজকুমারী বলল, “কিন্তু আপনার ঋণ আমরা শোধ দেব কিভাবে?’
কুয়াশা বলল, তোমরা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের তুলনায় অনেক বিষয়ে অনেক পিছিয়ে আছ ঠিক, কিন্তু অনেক বিষয়ে তোমরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছ। আনতারা এবং পৃথিবীর মানুষের বুদ্ধি যদি একত্রিত হয় তাহলে কল্পনার চেয়েও বেশি উন্নতি করতে পারবে উভয় গ্রহই। সভ্যতার চরম বিকাশ ঘটবে তাহলে। তোমাদের ব্রেন সত্যি আমাদের ব্রেনের চেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী। যেমন, ডক্টর কটজে তিনটে ভাষা জানতেন। অল্প সময়ের মধ্যে তোমরা প্রায় সবাই তিনটে ভাষাই রপ্ত করে নিয়েছ। এটা একটা অস্বাভাবিক গুণ।
রাজকুমারী বলল, “ঠিকই বলেছেন। যে কোন ভাষা আমরা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে শিখে নিতে পারি।
কুয়াশা বলল, তোমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, অল্পতেই হাল ছেড়ে দাও তোমরা। আর, তোমাদের ব্রেনকে তোমরা ঠিক মত কাজে লাগাতে সচেষ্ট নও।’
রাজকুমারী বলল, “ভাল কথা, আপনি পৃথিবী থেকে এলেন কিভাবে? আপনার স্পেস-ক্র্যাফট কোথায়?
| ‘আমাদের বিজ্ঞান কত উন্নত তার প্রমাণ চাও? দেখো, পৃথিবী থেকে আমি আঠারো কোটি ষাট লক্ষ মাইল অতিক্রম করে তোমাদের এই গ্রহে এসেছি। সূর্য ভেদ করে সূর্যের ভিতর দিয়ে এসেছি আমি। কিন্তু মজা কি জানো, কোন রকেট বা মহাকাশযান নিয়ে আসিনি।
“তাহলে?
‘পৃথিবীতে এক পাগল বিজ্ঞানী আছে। তার নাম প্রফেসর ওয়াই। এর সম্পর্কে সব কথা পরে বলব তোমাকে। এই পাগলা এমন একটা ট্রান্সমিটার যন্ত্র তৈরি করেছে যার দ্বারা বস্তু বা মানুষকে ট্রান্সমিট করা যায়। অর্থাৎ রেডিও বা টেলিভিশনের মত একটা ব্যাপার। রেডিও শব্দ ট্রান্সমিট করে, টেলিভিশন ছবি ট্রান্সমিট করে, কিন্তু এই পাগলার ট্রান্সমিটার যন্ত্র ম্যাটার ট্রান্সমিট করতে পারে। কোনও কারণে পাগলা প্রফেসর ওয়াই আমার ওপর রেগে গিয়ে পৃথিবী থেকে আমাকে তোমাদের এই গ্রহে পাঠিয়ে দিয়েছে। তার ধারণা আমি কোনদিন পথিবীতে ফিরে যেতে পারব না। কুয়াশা ৪৬
৪৩
‘ভাগ্যিস আপনাকে পাঠিয়েছিল! আপনি না এলে আমরা নির্ঘাৎ ধ্বংস হয়ে যেতাম।
কুয়াশা বলল, ধ্বংস শুধু তোমরা হতে না, আমরাও হতাম। কিন্তু, কথা হলো, ধ্বংস আমরা হব না সে-কথাও তো বলা যায় না এখনও জোর করে। শনির বলকে প্রতিরোধ করা যদি অসম্ভব হয়?
রাজকুমারী বলল, “আশার কথা বলুন আপনি। নিরাশার মধ্যে ডুবে ছিলাম আমরা, তলিয়ে যাচ্ছিলাম গোটা জাতি। আপনি আমাদেরকে আশার আলো দেখিয়েছেন। এখন আর নিরাশার কথা শুনতে চাই না। আমরা আবার বাঁচতে চাই। আপনি আমাদেরকে বাঁচাবার চেষ্টা করুন।
কুয়াশা হাসল। বলল, ‘চেষ্টা তো অবশ্যই করব। কিন্তু সফলতা আসবে কিনা কে জানে।’
তিনজন বিজ্ঞানী প্রবেশ করল কন্ট্রোলরূমে ছুটতে ছুটতে। কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাপরের মত হাঁপাচ্ছে তারা।
কুয়াশা কোন প্রশ্ন করল না। একজনের হাতে নানা সাইজের নানা ধরনের কাগজপত্র দেখল সে। হাত বাড়িয়ে সেগুলো নিয়ে একটা একটা করে বিছিয়ে নিল টেবিলের উপর।
আবার কাজে নিমগ্ন হয়ে পড়ল কুয়াশা।
প্রায় এক ঘণ্টা পর আচমকা টেবিল থেকে মুখ তুলে কুয়াশা ভরাট কণ্ঠে হোঃ হোঃ করে হাসতে শুরু করল।
রাজকুমারী এবং বিজ্ঞানীরা হতবাক। কি ব্যাপার! কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ এমন পাগলের মত হাসি কেন? এত বড় বিজ্ঞানী কি শেষ পর্যন্ত উন্মাদ হয়ে গেল?
কুয়াশা হাসি থামিয়ে বলল, আমাকে সবাই পাগল ভাবছেন, তাই না? কিন্তু। পাগল আমি নই, পাগল আপনারা!’
রাজকুমারী বলে উঠল, ‘কেন?’
কুয়াশা বলল, কেন? আবার সেই ভরাট গলায় উচ্চকণ্ঠে হাসতে শুরু করল কুয়াশা। * খানিক পর থামল তার হাসি। বলল, “ডক্টর কূটজে কোন কাজই অবশিষ্ট রেখে যাননি। মারা যাবার আগে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। রকেট স্টেশনটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। ওটাকে শুধু সসেমিরায় নিয়ে যেতে হবে। ওই রকেট স্টেশনের ভিতরই আছে কন্ট্রোলরূম। সেই কন্ট্রোলরূম থেকে পরিচালনা করা যাবে এখানকার বারোটা রকেটকে। কাজ বাকি আছে শুধু একটাই।’
‘কি সেটা?’ সমস্বরে জানতে চাইল সবাই।
বারোটা রকেটের জন্য তৈরি করা আছে বারোটা পারমাণবিক বোমা। সেই বোমাগুলো বারোটা রকেটের ভিতর নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দিতে হবে। মাত্র কয়েক ঘন্টার কাজ।
“কিন্তু সসেমিয় রকেট-স্টেশন নিয়ে যাবে কে! সসেমরা বশ্য চব্বিশ ঘণ্টা
৪৪
ভলিউম ১৬
বিরামহীনভাবে আমাদের সাহায্য চাইছে ওদেরকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু বড় বিশ্বাসঘাতক ওরা। যে যাবে তাকেই ওরা বন্দী করে রাখবে। শুধু তাই না, রকেট। স্টেশনটাও দখল করে নেবে ওরা।
কুয়াশা বলল, ওরা যদি সত্যি বিপদে পড়ে থাকে তাহলে এখান থেকে যে রকেট-স্টেশন নিয়ে যাবে তার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। কেউ যাক বা না যাক, সসেমিরায় আমি যাব। ওদের সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি, দেখতে চাই স্বচক্ষে। তাছাড়া যেতে এমনিতেও হবে। ওখান থেকেই কেবল শনির বলয়াকে প্রতিরোধের চেষ্টা করা সম্ভব।
রাজকুমারী কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কুয়াশা বাধা দিয়ে বলল, কোন কথা নয়। আমি এখন থেকে ঠিক চারঘন্টা পর রওনা হব সসেমিরার উদ্দেশে। রাজাকে এ ব্যাপারে তুমি সব জানাবার ব্যবস্থা করো। বারোটা রকেট নিক্ষেপ মঞ্চেই আছে, সুতরাং কাজ তেমন বাকি নেই। শুধু বোমাগুলো ওঠাতে হবে রকেটের ভিতর। এ কাজটা আমি তোমাদের সকলের সাহায্যে এই চারঘণ্টার মধ্যেই সেরে ফেলতে পারব।’
রাজকুমারী বলল, “সসেমদেরকে আপনি চেনেন না। ওরা আমাদের সতেরো জন বিজ্ঞানীকে পনেরো বছর ধরে বন্দী করে রেখেছে। আপনাকেও•••।
কুয়াশা বলল, “সতেরো জন বিজ্ঞানীকে আমি মুক্ত করে আনব। ওদেরকে আমি চিনি না, সত্যি কথা। চিনি না বলেই তো চিনতে চাই। আর আমাকে বন্দী করবে, বলছ? সম্ভব নয়। আমাকে বন্দী করে রাখার মত শক্তি কারও নেই।
আট
পরদিন বেলা দুটোর সময় সসেমিরায় রকেট-স্টেশন নামল কুয়াশাকে নিয়ে। বেতার সঙ্কেত পাঠিয়ে সসেমদেরকে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল কুয়াশার অভিযানের কথা। রকেট অবতরণের স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছিল সেই সময়।
সসেমিরার আবহাওয়া মণ্ডলে প্রবেশ করার পূর্ব মুহূর্তে রকেটের গতি শ্লথ করে ঘণ্টায় মাত্র তিনশো মাইলে নামিয়ে আনল কুয়াশা। খানিক পর গতি আরও কমাল।
প্রকাণ্ড মাঠে সসেম সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং সেনাবাহিনীর তিন প্রধানকে নিয়ে উপস্থিত রয়েছে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। বড়সড় একটা মঞ্চের সামনে নামল কুয়াশার রকেট। “ সসেমবাসীরা আটটা হাত-পা সহযোগে তালি দিয়ে স্বাগত জানাল কুয়াশাকে। আরও কয়েক মিনিট পর কেবিনের জানালা খুলে নিচের দিকে তাকাল কুয়াশা। কুয়াশাকে দেখে সেনাবাহিনীর তিন প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী স্যালুট করল সম্মান দেখিয়ে।
রাজকুমারী বলে উঠল পাশ থেকে, ‘ভক্তিতে একেবারে গদগদ ভাব দেখাচ্ছে ওরা। লক্ষণ ভাল নয়। নিশ্চয়ই কোন কুমতলব এটেছে।’
রাজকুমারীকে এই বিপদসঙ্কুল অভিযানে নিয়ে আসতে চায়নি কুয়াশা। কিন্তু
কুয়াশা ৪৬
৪৫
এমন জেদ ধরল যে শেষপর্যন্ত কুয়াশা সাথে আনতে বাধ্য হয়েছে।
কন্ট্রোলরূমে যাও তুমি। দরজা খুলে দিয়ে বোম টিপে নামিয়ে দাও এলুমিনিয়ামের সিঁড়ি। ওদের প্রতিনিধিরা উঠে আসুক ওপরে।’
কেবিন থেকে কন্ট্রোলরূমে গিয়ে প্রবেশ করল রাজকুমারী। | কুয়াশা অনেক নিচের সসেমদের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। একেবারে মাকড়সার মত দেখতে সসেমরা। আটটা পা। পাগুলোই হাতের কাজ করে। দেহটা শসার মত, একপ্রান্তে ফুটবলের মত বড়সড়, খয়েরী রঙের মাথা। মাথার একপাশে দুটো হলুদ মণিবিশিষ্ট চোখ। পাগুলো কালো এবং বড় বড়, খাড়া খাড়া লোম গজিয়ে রয়েছে। দূর থেকে দেখে কুয়াশার মনে হলো ওদের শসার মত শরীরগুলো ভিজে ভিজে, পিচ্ছিল তরল পদার্থের প্রলেপ দেয়া। লেজ আছে, তবে মাত্র আধ হাতের মত লমা। কারও পরনেই কাপড়-চোপড়ের কোন বালাই নেই।
সসেমদের চেহারা দেখে গা ঘিন ঘিন করে উঠল কুয়াশার। সত্যি কথা বলতে কি, চেহারার দিক থেকে সসেমরা আসলেই কুৎসিত। | নেমে গেছে স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে আট পা বিশিষ্ট চারটে
সসেম।
খানিকপর জানালার কাছ থেকে সরে এল কুয়াশা। কন্ট্রোলরূমে গিয়ে একটা। চেয়ারে বসল সে দরজার দিকে মুখ করে। একমিনিট পরই রাজকুমারী দরজার কাছ থেকে ঘোষণা করল, ওরা এসেছেন।
কন্ট্রোলরূমে প্রবেশ করল চারটে বিরাটাকার মাকড়সা। কুয়াশার মুখোমুখি পাশাপাশি দাঁড়াল তারা। ডান দিক থেকে সব চেয়ে বড় মাকড়সাটা বলে উঠল পরিষ্কার বাংলায় অনেকটা যান্ত্রিক স্বরে, আমি সসেমিরার প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য পৃথিবীবাসী মি. কুয়াশা, আপনি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আপনি মানবজাতির গর্ব। আপনি আমাদেরকে অবধারিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে এসেছেন বলে আমরা আনন্দিত এবং উল্লসিত।
| কুয়াশা বলল, ‘ধন্যবাদ।’
মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রী বলল, এবার আমি পরিচয় করিয়ে দিই আমাদের তিন বাহিনীর প্রধানের সাথে। ইনি আমাদের স্থল বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কোরোলা কেংখাব, ইনি আমাদের নৌবাহিনীর প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল নামা লাম্পা চোক এবং ইনি আমাদের বিমান বাহিনীর প্রধান, এয়ার ভাইস মার্শাল চেগা
ডেগা বুম! মহামান্য পৃথিবীবাসী কুয়াশা, এবার আপনি আপনার কাজ শুরু করুন। স্যাটার্ন-এর বলয় এখন থেকে দুঘণ্টা চল্লিশ মিনিট তিরিশ সেকেণ্ড পর আঘাত হানবে সসেমিরায়। সুতরাং দেরি করা উচিত হবে না।’
| কুয়াশা বলল কিন্তু আগে আমাদের শর্ত পূরণ করুন আপনারা। আনহারার বন্দী বিজ্ঞানীদেরকে মুক্তি দিন। তাদের সবাইকে আগে পাঠান এই রকেটে। তা না হলে আমি কাজে হাত দেব না।
মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রী সাথে সাথে উত্তরে বলল, “কিন্তু কী বিজ্ঞানীদেরকে এই মুহূর্তে একত্রিত করে এখানে নিয়ে আসা কোনমতেই সম্ভব নয়। তারা বিভিন্ন
ভলিউম ১৬
প্রজেক্টে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছেন। অন্তত বারো ঘণ্টা সময় দিতে হবে। বারো ঘণ্টা পর সবাইকে আপনি এই রকেটে বহাল তবিয়তে পাবেন। আমার কথা
অবিশ্বাস করবেন না। এখন ভেবে দেখুন কি করবেন। মনে রাখবেন, শনির বলয় সসেমিরাকে ধ্বংস করলে আপনারা বা আনতারাবাসীরাও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।’
কুয়াশা বলল, ‘বিপদ কেটে যাবার পর যদি আপনারা কথা না রাখেন? প্রধানমন্ত্রী বলল, “আমাদেরকে বিশ্বাস করা ছাড়া কোন উপায় নেই আপনার।
কুয়াশা একমুহূর্ত ভেবে বলল, ঠিক আছে। তাই। কিন্তু একটা কথা বলে রাখি। আপনারা যদি কোনরকম বেইমানী করেন তাহলে তার ফল ভাল হবে না।
মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রী বলল, আমরা বেঁচে থাকতে চাই। ইন্টেলিজেন্স এবং নলেজ হজম করতে চাই। বেইমানী কাকে বলে জানি না। ভাল কথা, শনির বলয়কে প্রতিরোধ করবেন আপনি কি উপায়ে?
কুয়াশা বলল, “নিজের চোখেই দেখুন কিভাবে কি করি আমি।
কুয়াশা দেখল মাকড়সারা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠিক তার নিচে হলদেটে তরল পদার্থ পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। সসেমদের দেহ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। হলদেটে, আঠাল পদার্থ। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা।
রাডার এবং ট্রান্সমিশন সেটের সামনে গিয়ে বসল কুয়াশা। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের সামনে একটা হেডফোন পড়ে রয়েছে। ওয়্যারলেস সেটের। বোতাম টিপে রাডারে চোখ রাখল কুয়াশা।
আট পায়ে থপথপ, থপথপ করে এগিয়ে এসে সসেমরা পঁাড়াল কুয়াশার পাশে।
রাডারের পর্দায় ফুটে উঠল ছোট্ট একটা কালো বিন্দু।
কুয়াশা বলল, দেখছেন তো? ওই কালো বিন্দুটাই হলো শনির বিচ্ছিন্ন, অগ্রসরমান বলয়। ওটা আপনাদের সসেমিরার চেয়েও কয়েক শতগুণ বড়। ঘণ্টায় আশি হাজার মাইল বেগে ছুটে আসছে।
মাকড়সাদের বিমানবাহিনীর প্রধান চেগা ডেগা বুম বলে উঠল, “জানি আমরা।’ ধমকে উঠল কুয়াশা, সাবধান, কথা বলবেন না। যা বলব শুনবেন শুধু।
প্রধানমন্ত্রী বলল, “ঠিক আছে।
কুয়াশা আর একটা বোতাম টিপে দ্বিতীয় রাডারে চোখ রাখল। দ্বিতীয় রাডারের পর্দায় ফুটে উঠল টিভির মত ছবি। বারোটা রকেট মঞ্চে পাশাপাশি পঁড়িয়ে রয়েছে।
কুয়াশা বলল, ‘আনতারার দৃশ্য এটা। রকেটগুলো দেখছেন তো? ওগুলো প্রত্যেকটি পারমাণবিক বোমা দিয়ে সজ্জিত। এই রকেটগুলোই শনির অগ্রসরমান বলয়ে গিয়ে আঘাত হানবে। পারমাণবিক বোমার আঘাতে শনির বলয় শুধু গতিহীন হয়ে পড়বে যে তা নয়, যে পথে যেখান থেকে ওটা আসছে সেই পথে, সেখানেই ফিরে যাবে ওটা!
কুয়াশা ৪৬
৪৭
‘গুড। গুড।’ প্রধানমন্ত্রী এবং তিনবাহিনীর প্রধান একযোগে বলে উঠল।
কুয়াশা বলল, গুড় তো ইংরেজি শব্দ। আপনারা পৃথিবীর ভাষা শিখলেন কি ভাবে?”
মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রী যান্ত্রিক স্বরে বলল, ‘পৃথিবীর দুই শত পঁচাত্তরটিরও বেশি ভাষা আমরা সবাই জানি। আমাদের বেতার যন্ত্র পৃথিবীর সব শব্দ গ্রহণ করতে সক্ষম। আমরা আপনাদের কথাবার্তা শুনে শুনে ভাষাগুলো শিখে ফেলেছি।
অবাক হয়ে চেয়ে রইল কুয়াশা। ‘কাজ করুন। প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দিল কাজের কথা। ইমেন্ট প্যানেলের যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করল কুয়াশা। ট্রামিটার যন্ত্রের বোতাম টিপল খট খট করে কয়েক ডজন। হাতল ঘোরাল, হুইলের মত গোলাকার দেখতে একটা ইস্পাতের চাকা বেরিয়ে এল একটা ফোকর থেকে, সেটা ঘুরিয়ে দিল বন বন করে। কুয়াশার দৃষ্টি রাডারের দ্বিতীয় পর্দার দিকে। সেদিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই লম্বা লাল একটা হ্যাঁণ্ডেল ধরে নিচের দিকে টানল। হ্যাঁণ্ডেলটা নিচের দিকে নুয়ে পড়তেই রাডারের পর্দায় দেখা গেল–বারোটা রকেট এক যোগে মঞ্চ ত্যাগ করে আকাশে উড়ল।
কুয়াশা কথা বলে উঠল, ‘মাত্র পনেরো মিনিট…’
পনেরো মিনিট তেইশ সেকেণ্ডের মাথায় রকেটগুলো আঘাত হানবে শনির ওই, বলয়ে।’
কুয়াশার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বাকি অংশটা পূরণ করল প্রধানমন্ত্রী। কুয়াশা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, আপনি জানলেন কি ভাবে?
‘হিসেব কষে। রকেটগুলোর গতিবেগ সম্পর্কে জানি আমরা, জানি শনির বলয় কি গতিতে ছুটে আসছে-সুতরাং রকেট এবং শনির বলয় ঠিক কখন পরস্পরের সাথে মিলিত হবে তা জানা কি আর এমন কঠিন।
কুয়াশা মনে মনে ভাবল, কী সাংঘাতিক! অঙ্কে এরা কমপিউটারের চেয়েও দক্ষ দেখা যাচ্ছে।
সকলের দৃষ্টি এক নম্বর রাডারের পর্দার দিকে।
ঠিক পনেরো মিনিট তেইশ সেকেণ্ড পর ঘটল ঘটনা। দেখা গেল শনির অগ্রসরমান বলয় প্রচণ্ড ভাবে কেঁপে উঠল পারমাণবিক বোমার আঘাতে। ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে চারদিক। রাডারের পর্দা এক সময় অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর ধোয়া সরে গেল ধীরে ধীরে।
| দেখা গেল শনির বলয় ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করেছে। ফিরে যাচ্ছে স্বস্থানে। ছোট্ট কালো বিন্দুটা একচুল একচুল করে সরে যাচ্ছে রাডারের পর্দার উপর দিকে।
কুয়াশা বলল, ‘সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।
হ্যাঁ। আমাদের সমস্যার সমাধান হলো মাত্র। কিন্তু আপনাদের? আপনার?
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে গিয়েও পারল না কুয়াশা। তিন আটে চব্বিশটা পা তাকে জড়িয়ে ধরল দুপাশ থেকে।
৪৮
ভলিউম ১৬
r
+
তিন বাহিনীর প্রধান তাদের চব্বিশটা পা দিয়ে কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরেছে। নিজেকে ছাড়াবার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছে কুয়াশা। | হাঃ হাঃ করে হাসছে প্রধানমন্ত্রী। সে তার আট পা দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে রাজকুমারী ওমেনাকে।
| হাসি থামিয়ে মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রী বলল, ‘ওহে, মি, কুয়াশা, লম্ফঝম্ফ দেবার চেষ্টা করে লাভ নেই। তুমি আমাদের বন্দী হয়ে বেশ মজাতেই থাকবে সসেমিরায়, যা চাও পাবে। বদলে কাজ করতে হবে আমাদের কথা মত।
স্থির হলো কুয়াশা । এদের চব্বিশটা লোহার মত পায়ের বাধন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় বুঝতে পারছে সে। মাকড়সাদের উদ্দেশ্যে সে কঠিন কণ্ঠে বলে উঠল, এই বিশ্বাসঘাতকতার সাজা তোমাদেরকে পেতে হবে!’
| মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রী বলল, বেইমানী বিশ্বাসঘাতকতা—- এইসব শব্দের প্রকৃত অর্থ আমাদের ক্লাছে অন্য রকম। আমরা নলেজ চাই, ইন্টেলিজেন্স চাই! তোমার কাছ থেকে চাইলে তুমি দেবে না। তাই আদায় করার জন্য তোমাকে বন্দী করে রাখব, বাধ্য করব আমাদের কথা মত কাজ করতে। আমাদের উন্নতির স্ত্রন্যে এটা না করে উপায় নেই। আমাদের সভ্যতার বিকাশ ঘটাবার স্বার্থে আমরা এটা করতে বাধ্য। এরমধ্যে অন্যায় তো কিছু দেখি না।
বিমান বাহিনী প্রধান চেগা ডেগা বুম বলল, “আমরা সসেমিরা থেকে পৃথিবীতে যাব। ডক্টর কূটজে আমাদের রকেট ধ্বংস করে দিয়েছে। উক্টর কুয়াশা, তুমি, আমাদেরকে রকেট তৈরির ব্যাপারে সাহায্য করবে। আমরা পৃথিবীতে যাব। তোমাদের নলেজ এবং ইন্টেলিজেন্স আমরা খেয়ে ফেলব, হজম করে নেব। তারপর পৃথিবীতে ছড়িয়ে দের বিষাক্ত গ্যাস। পৃথিবীর মানুষ সেই গ্যাসের প্রভাবে শেষ হয়ে যাবে। তারপর ওখান থেকে আমরা যাব অন্য এক গ্রহে। সেখানেও আমরা বেশি দিন থাকব না। মহাশূন্যে শত শত গ্রহে কোটি কোটি প্রাণী রয়েছে। আমরা তাদের জ্ঞান হজম করব এবং তাদেরকে খতম করে দেব। এইভাবে আমরা সীমাহীন মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াব, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করব।’
কুয়াশা মনে মনে আঁৎকে উঠলেও প্রকাশ্যে বলল, “স্বপ্ন দেখছ তোমরা। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমাদের। ব্রেন তোমাদের যতই শক্তিশালী হোক, তোমরা নীতিহীন, আদর্শহীন। শুধু এই কারণেই তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রী বলল, ‘নীতিহীন বা আদর্শহীন হলেই কোন জাতি ধ্বস হতে পারে না। যে জাতির যত বেশি বুদ্ধি, সেই জাতি তত বেশি দিন টিকে থাকবে। তোমরা বা আনতারাবাসীরা বুদ্ধিহীন। তোমরা তাই ধ্বংস হয়ে যাবে।’
কুয়াশা বলল, “সময় আসুক, প্রমাণ পাবে তোমরা, ধ্বংস করা হয়।
মাকড়সার প্রধানমন্ত্রী বলল, বড় বেশি চাড়াং চাড়াং কথা বলছ তুমি। আমাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে সাতদিন বন্দী থাকবে তুমি। আহার-টাহার দেয়া হবে
। ওখানে বন্দী বিজ্ঞানীরা সবাই আছে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখো। টরচারের প্রকৃতি কি রকম ভয়ঙ্কর আমাদের। আমরা রসায়ন শাস্ত্রে খুব বেশি উন্নত।
৪-কুয়াশা ৪৬
একটা ইঞ্জেকশন আবিষ্কার করেছি আমরা, সেটা দিলে তোমার শরীরের ভিতর আগুন জ্বলবে, সত্যি সত্যি আগুন জ্বলবে না, কিন্তু মনে হবে আগুন জ্বলছে, পুড়ে যাচ্ছে ভিতরের হাড়, মাংস, চর্বি–সব। সাতদিন পরও যদি তুমি আমাদের কথা মত কাজ করতে রাজি না হও তাহলে ওই ইঞ্জেকশন দেয়া হবে তোমাকে।’
নয়
রাত বাড়ছে ক্রমশ।
সেলের বাইরে মাকড়সাদের সশস্ত্র সেন্ট্রিরা পাহারা দিচ্ছে। | হাত-পা বাঁধা কুয়াশার। কিন্তু রাজকুমারীকে বাধেনি ওরা। দুটো সেলের মাঝখানে কোন দেয়াল নেই। দেয়ালের বদলে মোটা মোটা লোহার রডের প্রতিবন্ধকতা । ওদিকের সেলে ঘুমাচ্ছে আনতারার সতেরোজন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। তারা কেউই কুয়াশা বা রাজকুমারী সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি এখনও।
| অটোমেটিক কারবাইনের মত দেখতে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে দু’জন মাকড়সা সেলের বাইরের মেঝেতে বসে আছে।
কুয়াশাকে নড়াচড়া করতে দেখলেই খেঁকিয়ে উঠছে তারা।
মাকড়সার প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়ে গেছে কুয়াশা কোনরকম চালাকি করার চেষ্টা করলেই গুলি করে জখম করতে।
রাত বাড়ছে। ফিসফিস করে কথা বলছে কুয়াশা। রাজকুমারী গভীর মনোযোগের সাথে শুনছে তার কথা।
কুয়াশা বলছে, “অকারণে ভয় পাচ্ছ তুমি, ওমেনা। এমন মুষড়ে পড়লে চলে নাকি। তুমি দেখো, এরা আমাদেরকে বন্দী করে রাখতে পারবে না। মুক্তির উপায় কি তা আমার জানা আছে। কিন্তু তোমার সাহায্য দরকার হবে। আমার জুতোর ভিতর লুকানো আছে ছোট্ট একটা পেন্সিল। ওটাই আসলে দরকার। ওটা হাতে পেলে আমরা এখান থেকে মুক্ত তো হবই, আনতারাতেও ফিরে যেতে পারব!
‘দূর: আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একটা পেন্সিল দিয়ে এদের সাথে লড়বেন আপনি?’
কুয়াশা হেসে ফেলল, “বিশ্বাস করো, ওই পেন্সিলটা দিয়েই আমি লড়ব। সে লড়াইয়ে জিতবও আমি। তুমি শুধু আমার পিছনদিকে গিয়ে শুয়ে পড়ো। ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে আস্তে আস্তে খোলার চেষ্টা করো হাতের বাধন। খুলতে আমিও পারি পাঁচ মিনিটের মধ্যে। কিন্তু মাকড়সা ব্যাটারা যে নড়তে দেখলেই গুলি করবে। লক্ষ্মী, রাজকুমারী, যা বলছি ঠিক তাই করো এবার। কোন ভয় নেই তোমার। এতটুকু দুশ্চিন্তা কোরো না।
| রাজকুমারী কুয়াশার পিছনে গিয়ে শুয়ে পড়ল। খানিক পরই স্থির হয়ে গেল তার হাত-পা, যেন ঘুমিয়ে পড়েছে অঘোরে। | তিন মিনিটে কুয়াশার হাত বাঁধনমুক্ত হলো। আগেই সে ডান পা দিয়ে বা পায়ের জুতোটা খুলে ফেলেছিল। হাত দুটো মুক্ত হতেই জুতোর ভেতর থেকে
ভলিউম ১৬
পেন্সিলের মত লম্বা একটা জিনিস বের করে ফেলল।
সশস্ত্র মাকড়সারা অটোমেটিক কারবাইন তুলল কুয়াশার দিকে। পেন্সিলটা লম্বা করে ধরল কুয়াশা। ক্ষুদ্রাকৃতি একটা বোতাম রয়েছে পেন্সিলটার মাঝখানে। সেটায় চাপ দিল।
মাকড়সাদুটোর কারবাইনের ইস্পাতের ব্যারেলসহ হাতলের বেশির ভাগ অংশ চোখের পলকে বাষ্প হয়ে উঠে গেল বাতাসে।
অবাক বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল রাজকুমারী, মাই গড! একি ভোজবাজী!’ কুয়াশা তখন ব্যস্ত সেলের লোহার রডগুলোকে বাষ্পে পরিণত করতে।
‘রাজকুমারী, তুমি তোমাদের বিজ্ঞানীদেরকে ঘুম থেকে ওঠাও। সংক্ষেপে ওদেরকে জানাও, আমরা ওদেরকে মুক্ত করে আনতারায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। তাড়াতাড়ি করো!
পাশের সেলে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিল রাজকুমারী।
সেলের বাইরে ভয়ানক দুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে। দলে দলে মাকড়সারা দুটে আসছে কুয়াশার সেলের দিকে। প্রত্যেকের হাতে অটোমেটিক কারবাইন।
কিন্তু সেলের ধারে কাছে ঘেঁষতে পারছে না কেউ। কুয়াশার মিনি জোর গানের যাদুকরী কারসাজিতে মাকড়সাদের হাতের অস্ত্র, কারও দুটো পা, কারও দেহের শেষ ভাগের আধ হাত লেজ বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে।
যন্ত্রণাকাতর অতিকায় মাকড়সারা বিকট স্বরে চেঁচাচ্ছে।
মাকড়সারা পিছু হটে গেল। সেলের বাইরে একটা মাকড়সাকেও দেখা যাচ্ছে। না আর।
রাজকুমারী কুয়াশার পাশে এসে দাঁড়াল হাঁপাতে হাঁপাতে। তার পিছনে সতেরোজন বিজ্ঞানী।
সবাইকে বুঝিয়ে বলেছি। এখন কি…আমরা কি পারব এখান থেকে পালাতে? কুয়াশা বলল, আমার পিছু পিছু এসো তোমরা।’ সেল থেকে বেরিয়ে পড়ল কুয়াশা। পিছনে রাজকুমারী এবং বিজ্ঞানীর দল।
সেলের বাইরে বড়সড় একটা চত্বর। সেই চত্বরে বিদ্যুৎ বেগে এসে পড়ল একটা গোলাকার ছয় চাকাওয়ালা গাড়ি। গাড়িটা থামার আগেই কুয়াশা গাড়িটার দিকে তুলে ধরল লম্বালমি ভাবে হাতের পেন্সিলটা ।
গাড়ি থেকে নামল প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। উন্মাদের মত কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছে, সে কুয়াশার দিকে।
সাবধান! আর একপাও এগোবে না। গর্জে উঠল কুয়াশা।
থমকে দাঁড়াল মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রী। কাঁদাদ কণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘হে মহামান্য পৃথিবীবাসী মি. কুয়াশা, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। দয়া করে আপনি এইবার আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমরা আপনার প্রতি অন্যায় করেছি, তার জন্য যে শাস্তি দেবেন সেই শাস্তি মাথা পেতে নেব। কিন্তু নতুন এই বিপদ থেকে আপনি দয়া করে আমাদেরকে রক্ষা করুন।’
কুয়াশা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘নতুন বিপদ?
কুয়াশা ৪৬
‘ভাইরাস! কেমন করে জানি না ল্যাবরেটরি থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বাইরে। সসেমরা দলে দলে আক্রান্ত হচ্ছে ভয়ঙ্কর গোলাপী ঘায়ে। মারা যাচ্ছে শয়ে শয়ে। প্রতি মুহূর্তে মারা যাচ্ছে শয়ে শয়ে। এভাবে মরতে থাকলে আমরা আড়াই লক্ষ সসেম দু’দিনেই ধ্বংস হয়ে যাব।’
| কুয়াশা হাসল। বলল, ‘নিজেদের ফঁদে নিজেরাই পড়েছ তোমরা।’
প্রধানমন্ত্রী বলল, আনতারা থেকে আপনি যখন সুস্থ শরীরে এখানে এসেছেন তখন নিশ্চয়ই আপনি এই ঘায়ের প্রতিষেধক কি জানেন। আপনিই আনতারাবাসীদেরকে রক্ষা করেছেন এই ঘা থেকে। পৃথিবীবাসী মহামান্য মি. কুয়াশা, ক্ষমা করুন আপনি আমাদেরকে।
কুয়াশা বলল, “ঠিক আছে। চলুন রকেটে। প্রতিষেধক আছে বটে রকেটে তবে পরিমাণ খুব বেশি নয়। সব সসেমকে বাঁচানো যাবে না, হয়তো অর্ধেক সসেমকে বাঁচানো যাবে।’
“তাই বাঁচান! দোহাই আপনার। তাই বাঁচান।’
ওদের রকেটে ওরা ফিরে এল সতেরোজন বিজ্ঞানীকে সাথে নিয়ে। সিঁড়ি বেয়ে মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রীও উঠল।
কন্ট্রোলরূমে ঢুকে প্রধানমন্ত্রী কুয়াশাকে বলল, কোথায় আপনার ঘায়ের প্রতিষেধক?’
কুয়াশা রাজকুমারীর উদ্দেশ্যে বলল, ওমেনা, আমাদের বিজ্ঞানীদের ইঞ্জেকশন দেবার ব্যবস্থা করো তুমি। ওদেরকে ইঞ্জেকশন দেয়া হয়ে গেলে আমাকে জানাও, কতটা ওষুধ অবশিষ্ট থাকে।
মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রী বলল, “কিন্তু আপনি যে বললেন••?” কুয়াশা বলল, “রাজকুমারী, সিঁড়ি তুলে নিয়েছ? কেবিনের দরজা বন্ধ করেছ? “হ্যাঁ।
কুয়াশা বলল, “আমি রকেট নিয়ে মহাশূন্যে উঠছি, সসেমিরা ত্যাগ করছি। এই মাকড়সাটাকে তোমরা সবাই মিলে বেঁধে ফেলো। আর এখান থেকে সরিয়ে স্টোররূমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দাও। কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে বুন্ধুটা।
| রাজকুমারী এবং কয়েকজন বিজ্ঞানী এগিয়ে গেল মাকড়সাদের প্রধানমন্ত্রীর
দিকে।
কুয়াশা বলল, তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি কেন জানো? তোমার বিচার একটু অন্যভাবে হওয়া দরকার, তাই। আর সব সসেমদের বিচার হয়ে গেছে, শাস্তি হিসেবে তারা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে, দুদিনের মধ্যেই সবাই মারা যাবে। এর
চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে?
ভলিউম ১৬
দশ জাতীয় উদ্যানে নামল রকেট।
লক্ষ লক্ষ মানুষ অধীর উত্তেজনায় অপেক্ষা করছে। তাদের নব জীবনদাতা পথিবীবাসী মহামানব কুয়াশা সসেম জাতিকে ধ্বংস করে দিয়ে ফিরে আসছে আনতারায়।
চারদিকে সে কি উল্লাস! সে কি আনন্দ ধ্বনি।
সিঁড়ি বেয়ে নামছে, কুয়াশা। তার পিছনে রাজকুমারী। রাজকুমারীর পিছে সতেরোজন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। পনেরো বছর পর বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের গ্রহে ফিরে এসেছে তারা।
লক্ষ লক্ষ জনতা হাত নেড়ে, বাতাসে টুপি উড়িয়ে লাফাতে লাফাতে আনন্দ প্রকাশ করছে।
মঞ্চের উপর রাজা এবং নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীরা অপেক্ষা করছেন।
কুয়াশা উঠে এল মঞ্চে। রাজা প্রথমে, তারপর প্রধানমন্ত্রী, তারপর মন্ত্রীরা মাল্যভূষিত করল কুয়াশাকে।
| প্রধানমন্ত্রী লাউডস্পীকারের মাউথপীসের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। অবশেষে তিনি আনতারার সর্বশ্রেষ্ঠ উপাধি”সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব দান করে কুয়াশাকে সম্মানিত করার প্রস্তাব দিলেন। জনতা দুই হাত তুলে সোল্লাসে সমর্থন– জানাল।
প্রধানমন্ত্রী মূল্যবান পাথর খচিত স্বর্ণের কণ্ঠহার পরিয়ে দিল কুয়াশার গলায়। আনুষ্ঠানিক ভাবে কুয়াশাকে আনতারার নাগরিকত্ব দান করা হলো।
অনুষ্ঠান শেষে কুয়াশা রাজার উদ্দেশে বলল, আপনাদের আর একটি মাত্র সমস্যা আছে। সন্তানোৎপাদন ক্ষমতা ফিরে পেলেই আপনারা, বিপদমুক্ত হতে পারেন। সসেমিরা থেকে ফেরার পথে আমি গবেষণা করে এই রোগের ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছি। ওষুধ তৈরির ফুর্মুলাটা রাজকুমারীর কাছে আছে। মহামান্য রাজা, মি. প্রেসিডেন্ট এবং আনতারার বন্ধু এবং ভাইয়েরা,~~এবার আমাকে বিদায় দিন। পৃথিবীতে আমি অনেক কাজ ফেলে এসেছি। আমার আত্মীয় বন্ধু, এবং লাখো! লাখো দুঃখী, গরীব ভাইয়েরা বিপদের মুখে পড়ে আছে। তাদের জন্যে আমার হৃদয় বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। আমি এখনি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় চাই।’
রাজা বললেন, “তা হয় না। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করেছি, আপনাকে আনতারায় স্থায়ীভাবে থেকে যাবার প্রস্তাব দেব। মি. কুয়াশা, আপনি আমাদের কাছ থেকে সম্মান, ভালবাসা, আরাম, ক্ষমতা–সব পাবেন। আনতারা যদি আপনার মত গুণী, প্রতিভাবান বিজ্ঞানী পায় তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই উন্নতির চরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারবে। আপনাকে আমরা হারাতে চাই
।
কুয়াশা গম্ভীর মুখে বলল, তার মানে? আপনারা কি আমাকে আনতারায় বন্দী
কুয়াশা ৪৬
করে রাখতে চান?
রাজা হাসলেন, “মি. কুয়াশা, ভুল বুঝো না আমাদেরকে। আনতারাবাসী চাইছে তুমি তাদের সাথে থাকো।
কুয়াশা বলল, সেটা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে আমার অনেক কাজ। পৃথিবীবাসীর কথা ভুলে আমি এখানে থেকে যাব-এও কি সম্ভব? আপনারা পাগলামি করছেন। আমাকে বিদায় নিতে দিন।’
প্রধানমন্ত্রী বলল, তা হয় না। তার মানে আমি বন্দী?
প্রধানমন্ত্রী বলল, “দুঃখের সাথে জানাচ্ছি,-হ্যাঁ। আপনার মত বিস্ময়কর প্রতিভাকে আমরা পেয়েও হারাতে রাজি নই।
গভীর রাত। কোথাও কেউ জেগে নেই।
বন্দী কুয়াশা হাসছে আপনমনে। কিন্তু তার এ হাসি দুঃখের হাসি। উপকার করার কি ফল! গোটা জাতটাকে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার বিনিময়ে বরণ করতে হলো বন্দী।
রাজ প্রাসাদেরই একটা আরামদায়ক কামরায় বন্দী করে রাখা হয়েছে কুয়াশাকে। কেড়ে নেয়া হয়েছে ওর কাপড়চোড়, জুতো, অস্ত্রশস্ত্র।
মুক্তির উপায় কি?
ভাবছে আর ভাবছে কুয়াশা। কামরার চারদিকে পাথরের দেয়াল। একটি মাত্র দরজা, তাও বাইরে থেকে বন্ধ। বাইরে সশস্ত্র সেন্ট্রি পাহারা দিচ্ছে, তাদের বুট জুতোর শব্দ পাচ্ছে সে।
বড় অকৃতজ্ঞ এরা।
আবার হাসল কুয়াশা। শেষ পর্যন্ত তিক্ত একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। মুক্তি সে ঠিকই পাবে, আজ হোক, কাল হোক। কিন্তু এদের সম্পর্কে খারাপ একটা ধারণা থেকে যাবে তার মধ্যে।
হঠাৎ কুয়াশার খেয়াল হলো বুট জুতোর শব্দ হচ্ছে না কামরার বাইরে। ব্যাপার কি?
পরমুহূর্তে সশব্দে খুলে গেল দরজা। ‘রাজকুমারী, তুমি!
রাজকুমারী ত্রস্ত পদক্ষেপে কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতে কুয়াশার সেই পেন্সিলটা।
‘মিনি লেসারগান-ওটা কেন তোমার হাতে! রাজকুমারী কুয়াশার হাত পায়ের বাধন খুলে দিতে দিতে বলল, কথা বলো। । তোমার কাপড়চোড় সব এনেছি। তাড়াতাড়ি সর পরে নাও। পালাতে দেরি করলে ধরা পড়ে যাব।’
কোথায় পালাব! ‘পৃথিবীতে ফিরবে না! তাড়াতাড়ি করো, পরে নাও কাপড়চোপড়! ধরা পড়ে
ভলিউম ১৬
যাব.যে!
তুমি…’ রাজকুমারী বলল, “হ্যাঁ। আমিও যাব তোমার সাথে । তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছি আমি। শুধু তোমার সাথে যেতে পারব এই আশায় সাতজন সেন্ট্রিকে লেজার গান দিয়ে শেষ করে এখান অবধি পৌঁছেছি। প্লীজ! অমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকো না। এখুনি কেউ হয়তো এসে পড়বে।
| রাজকুমারীর প্রদর্শিত পথ দিয়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এল কুয়াশা পাঁচ মিনিটের ভেতর।
জাতীয় উদ্যানের দিকে ছুটল রাজকুমারীর গাড়ি।
কুয়াশা বলল, ওমেনা, ভেবে দেখো ভাল করে এখনও! একবার গেলো আর হয়তো ফিরতেই পারবে না।”
ভেবে দেখেছি বৈকি! ফিরতে চাই না বলেই তো যাচ্ছি।
কুয়াশা বলল, “কিন্তু কেন? আত্মীয়-স্বজন, বাবা, দেশ-সব ছেড়ে কেন যেতে চাইছ তুমি?’
‘ভালবাসি, তাই। ভালবাসার চেয়ে বড় কিছু আছে? বলো? কুয়াশা শুধু হাসল। উত্তর দিল না।
Leave a Reply