৪৫. প্রফেসর ওয়াই ২ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪৫
প্রথম প্রকাশঃ নভেম্বর, ১৯৭৫
এক বহুদূর থেকে আসছে শব্দটা। দ্রিম-দ্রিম, ডুম-ডাম-দ্রাম-মি-দ্রিম, ডুম ডাম–দ্রাম দ্রিম দ্রিম••। কান পাতলে মনে হয় দূরে কোথাও মেঘ ডাকছে। উপর দিকে বৃথাই তাকাল আবিদ। ঘন সন্নিবেশিত মহীরুহের শাখাপ্রশাখা আর পাতায় ঢাকা পড়ে গেছে আকাশ। সূর্য কিরণ এখানে প্রবেশের অনুমতি পায় না। প্রবেশ নিষেধ এখানে বহিরাগতদের। সে বহিরাগত যেই হোক-মানুষ বা পশু, জংলী ভূত বা হিংস্র সিংহ–এখানে একবার পথ ভুলেও যদি কেউ প্রবেশ করে তবে তার আর রক্ষে নেই। আবিদের গরিলাবাহিনী নির্দেশ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর উপর। শেষ শত্ৰুটির হাত পা বিচ্ছিন্ন করে হৃৎপিণ্ড বের করে আনবে বুকের ভিতর থেকে, তবে শান্ত হবে তারা।
বিচিত্র এই দেশ। অদ্ভুত এখানকার পরিবেশ। আবিদ এই মহাদেশের ইংরেজি নামের ছয়টি অক্ষরের ছয়টি অর্থ আবিষ্কার করেছে। A দিয়ে আতঙ্ক, F দিয়ে ফঁদ, R দিয়ে রক্ত, I দিয়ে ইতর, C দিয়ে কালো এবং সর্বশেষ অক্ষর A দিয়ে হয় অগম্য, অন্ধকার, অশনি, অমঙ্গল, আশ্চর্য••। “ সত্যি, আতঙ্কের দেশ আফ্রিকা। প্রতি পদে এখানে ফাঁদ। প্রতি মুহূর্তে এই গহীন দুর্গম অরণ্যে ঝরছে লাল তাজা রক্ত। সভ্য দুনিয়ার চোখে এখানকার কালো অসভ্যরা ইতর প্রাণী ছাড়া আর কিছু নয়। আফ্রিকার অভ্যন্তরে প্রবেশ সহজ কথা নয়। অন্ধকারে অমঙ্গল আছে ওত পেতে, এতটুকু আভাস না দিয়ে ঘাড়ে পড়বে লাফ দিয়ে। সিংহ যদি তোমায় দেখে, বাঘ যদি তোমায় পায়, অসভ্যদের মধ্যে যদি তুমি গিয়ে পড়ো5ধরে নিতে পারো তুমি নেই, মারা গেছ!
থমথমে হয়ে ওঠে আবিদের মুখ। শব্দটা এতক্ষণে পরিচিত মনে হচ্ছে তার। জংলীদের কাফেলা! প্রতি বছরের মত এবছরও তাহলে জংলীরা আসছে। | রহস্যপুরীতে প্রতি বছর যাচ্ছে একটা করে জংলীদের কাফেলা।. হাজার, দুহাজার জংলী ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল বাজাতে বাজাতে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে রহস্যপুরীর দিকে প্রতি বছরই যায়। রহস্যপুরীতে আবিদও গেছে দু’বার। না, ভিতরে ঢোকেনি সে। ভিতরে ঢুকলে বেঁচে ফিরে আসতে হত না
ভলিউম ১৫
১১৪
তাকে। জংলীরা যায়, ফিরেও আসে। কিন্তু সভ্য মানুষরা গেলে ফেরে না । | কি আছে দক্ষিণ-পশ্চিমের এই রহস্যপুরীতে তা আজও জানতে পারেনি আবিদ। জংলীরা দলবদ্ধ ভাবে যায়। সাথে থাকে বন্দিনী নারী, খাঁচার ভিতর বাঘ, ভালুক, হরিণ, বুনো ছাগল, ঘোড়া, মোষ, শূকর। প্রায় প্রত্যেক জংলীর সাথে থাকে সের-দু’সের করে হলুদ ধাতব পদার্থ–স্বর্ণ। গোল গোল সোনার ভারি অলঙ্কার | ৬ংলীদের পায়ে গলায় শোভা পায়। এইসব অসভ্যরা বহু দূরের কোন গহীন জঙ্গলে থাকে। বিভিন্ন উপায়ে বছর বছর ধরে তারা যত স্বর্ণ সংগ্রহ করে, তার প্রায় সবটুকু নিয়ে আসে রহস্যপুরীর জন্য। কিন্তু ফেরার সময় ফেরে তারা শূন্য হাতে।
মাইল তিরিশেক হবে এখান থেকে রহস্যপুরী। জংলীদের একটা কাফেলাকে অনুসরণ করে প্রথমবার গিয়েছিল আবিদ। সাথে ছিল লিজা এবং গরিলাবাহিনী।
গহীন জঙ্গলের পর একটা মস্ত মাঠ। মাঠে নামেনি ওরা। জঙ্গলের ভিতর থেকে ওরা দেখে মাঠের অপর প্রান্তে শত-সহস্র মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। উলঙ্গ। সবাই গা ঘষাঘষি করে, লাইনবন্দী হয়ে।
মাঝখানের তিনজন মানুষ পাহাড়ের মত এক-একজন। আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তাদের মাথা। হাতের আঙুলগুলোই প্রকাণ্ডদেহী এক একটা গরিলার মত। মাথাগুলো প্রকাণ্ড এক একটা পাহাড়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এই তিনজন মানুষের দুপাশেও দাঁড়িয়ে আছে বহু মানুষ। ক্রমশ ছোট হতে হতে সাধারণ মানুষের মত আকার-আকৃতি পেয়েছে মানুষগুলো। দু’প্রান্তে, যতদূর দৃষ্টি যায়, দাঁড়িয়ে আছে তারা গায়ে গা ঠেকিয়ে।
উঁচু পাঁচিলের মত দেখায় দূর থেকে।
মানুষগুলো যে জ্যান্ত নয়, ওগুলো যে পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে তা বুঝতে বেশ একটু সময় লাগে আবিদের। দেখতে হুবহু জ্যান্ত মানুষের মতই। মাঝখানের তিনজন মানুষের চোখ কি দিয়ে তৈরি কে জানে। সব সময় লাল আলো বেরিয়ে
আসছে সেই চোখগুলো থেকে।
জংলীরা সেই তিন প্রকাণ্ড মূর্তির সামনে গিয়ে নতজানু হয়। এমন সময় ভারি বজ্রকণ্ঠে মন্ত্ৰপড়ার মত শব্দ হয় কোথা থেকে যেন । মধ্যস্থানের প্রকাণ্ড তিন মূর্তির তিন দুগুণে ছয়টি পা। একজোড়া পায়ের কাছ থেকে অপর জোড়ার দূরত্ব পঞ্চাশ হাতের মত। মধ্যবর্তী জায়গায় একটি করে প্রকাণ্ড গেট। দুটো গেটই এরপর খুলে যায়। জংলীরা প্রবেশ করে রহস্যপুরীতে ।
অপেক্ষা করতে থাকে আবিদ। জংলীরা প্রবেশের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেছে। বিশাল লোহার গেট। ক্রমে রাত নামে। রাতটা ওখানেই থেকে যায় আবিদরা । সকাল হয়। জংলীদের দেখা নেই। নেই কোন সাড়াশব্দ। তারপর ঠিক দুপুরে গেট খুলে যায় রহস্যপুরীর। আনন্দে উন্মাদের মত দেখায় জংলীদেরকে। পাগলের মত মাথা নাড়তে নাড়তে, হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে রহস্যপুরী থেকে বেরিয়ে আসে কুয়াশা ৪৫,
১১৪
–
—–
–
–
–
–
–
——-
–
–
“–
‘
–
তারা। আবিদ গাছের উঁচু ডালে বসে লক্ষ্য করে জংলীদের সাথে সেই বন্দিনী নারীরা নেই, নেই খাঁচার বাঘ, ভালুক, ঘোড়া, হরিণ। নেই সেই মণ মণ স্বর্ণালঙ্কার।
তবে জংলীরা রহস্যপুরীতে ঢোকে কালো শরীর নিয়ে, ফেরে লাল শরীর নিয়ে। সর্ব অঙ্গে তাজা লাল রক্ত মেখে বেরিয়ে আসে তারা। চলে যায় জঙ্গল পরে নিজেদের পথে। সেই পথ সুদীর্ঘ। সেই পথের শেষ কোথায় জানা নেই আবিদের।
এরপর আর একবার আর একটা কাফেলাকে অনুসরণ করে জঙ্গলের শেষ সীমানা পর্যন্ত এসেছিল আবিদ। দ্বিতীয়বারের এই অভিযানে সে অনুসরণ করেছিল। সভ্য জগতের শ্বেতাঙ্গদের একটা কাফেলাকে।
‘ সভ্য মানুষদের এই কাফেলায় ছিল মাত্র চার জন লোক। রহস্যপুরী কোন দিকে উঃ তারা জানত না। কিন্তু তাদের হাবভাব, আচার আচরণ দেখে আবিদ বুঝতে পেরেছিল তারা রহস্যপুরীর সন্ধান পাবার জন্যেই এই দুর্গম অরণ্যে প্রবেশ করেছে। কোন্ দিক যাবে তা তারা স্থির করতে পারত না, লেগে যেত তর্ক বিতর্ক নিজেদের মধ্যে। | অবশেষে শ্বেতাঙ্গরা রহস্যপুরীতে ঢুকেছিল ঠিকই। কিন্তু তারা আর বেরিয়ে আসেনি ডিতর থেকে।
কি এর রহস্য? কি আছে রহস্যপুরীতে। জংলীরা কেন যায়? জংলীরা গিয়ে। ফিরে আসতে পারে, সভ্য মানুষরা কেন ফিরতে পারে না? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর পায়নি আবিদ গত পনেরো বছর ধরে চেষ্টা করেও।
চারদিকে তাকাল আবিদ। গেল কোথায় লিজা? রফিকী আর বেগমের সাথে এই তো খেলছিল। যাক, ভালই হয়েছে। ওদেরকে লুকিয়ে জংলীদের কাফেলাকে। চুপিসারে দেখে আসা যাবে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে আবিদ।
ক্রমে ঢাক-ঢোলের শব্দ বাড়ছে। বুকের ভিতর অদ্ভুত একটা আশার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে জংলীদের কাফেলার আগমন টের পেলে। ক্ষীণ একটা ইচ্ছা ধিকি ধিকি জ্বলে মনে। দেশে ফেরার সুযোগ কি কখনও আসবে না তার?
মানুষ বলতে সে আর লিজা। আজ পনেরো বছর ধরে আর কোন মানুষের সাথে কথা বলেনি তারা, মুখোমুখি দাঁড়াবার সুযোগ পায়নি। সভ্য দুনিয়ার লোকদের কাফেলাটিকে দেখে দুর্দমনীয় ইচ্ছা হয়েছে ছুটে গিয়ে ওদের সাথে মিলিত হবার। কিন্তু নানা কারণে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সে ক্ষান্ত করেছে। রহস্যপুরীর দিকে যে
কাফেলাগুলো এদিক দিয়ে যায়, তারা সভ্যই হোক বা অসড্যই হোক, লোকগুলোর চেহারা দেখেই খুনী, শত্রুভাবাপন্ন বলে মনে হয় তার। তাদের কাছে ছুটে গেলে তারা যদি তাকে গ্রহণ না করে? যদি হত্যা করে নির্মমভাবে? অসভ্যদের কাছে তো যাবার কথা চিন্তাই করতে পারে না সে। দেখামাত্র বিষাক্ত তীর মেরে হত্যা করবে তারা।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এইরকম অনেক কথা ভাবছিল আবিদ।
ভলিউম ১৫
১১৬
মনে পড়ছিল দেশের কথা, বাবার কথা। ঢাকা শহর এখন কেমন হয়েছে কে জানে। বাবা কি বেঁচে আছেন আজও। সেন্ট্রাল জেল থেকে বাবা কি মুক্তি পেয়েছিলেন? আইয়ুব খানের নামটা ভোলেনি আবিদ। লোকটা কি এখনও তার দেশের মানুষকে শোষণ করছে, শাসন করছে?
আর সোহরাব?
সোহরাব কি সমুদ্রেই তলিয়ে গেছে? নাকি তার মত সে-ও ভাসতে ভাসতে কোথাও গিয়ে উঠেছিল বেঁচে আছে আজও?
| একে একে মনে পড়ে যায় সব কথা, পনেরো বছর আগের কথা। রাজনীতি করতেন আশরাফ উদ্দিন এডভোকেট। ঢাকায় তার নিজের বাড়ি ছিল। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখের সংসার। দুই ছেলে আবিদ এবং সোহরাব। আর একটি পাখি। বাজপাখি। শিকারী বাজপাখি। এডভোকেট আশরাফ সাহেবের এই এক হবি ছিল, শিকারী বাজপাখি পোষা। বাজপাখিটার নামও ছিল শিকারী।
| আবিদ পড়ত ক্লাস এইটে, সোহরাব টুতে। সেটা উনিশশো ঊনষাট সাল। এডভোকেট আশরাফ সাহেবকে গ্রেফতার করা হলো রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে। বিচার
• ছাড়াই তাকে নিক্ষিপ্ত করা হলো কারাগারে অনির্দিষ্টকালের জন্য। শুধু তাই নয়, অত্যাচারী সরকার বাজেয়াপ্ত করল তাদের ব্যাঙ্কের টাকা এবং একমাত্র সম্পত্তি ঢাকার বাড়িটা ।
| বাড়ি ছেড়ে ওদের মা ওদেরকে নিয়ে পথে নামলেন। শান্তিবাগে ভাড়া নিলেন ছোট্ট একটি ঘর। শুরু করলেন টিউশনি। ছেলে দুটোকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন তিনি।
কিন্তু ভাগ্য বিমুখ হলে যা হবার তাই হলো। মা হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে মারা গেলেন।
| দুই ভাই অসহায় অবস্থায় পথে নামল। সাথে কিছুই নেই। আসবাবপত্র যা ছিল সব বাড়িওয়ালা ভাড়া বাকি থাকায় রেখে দিল। আবিদ আর সোহরাব রাস্তায় নামল বাজপাখি শিকারীকে নিয়ে।
| দুনিয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ দুই ভাই শহরের পথে বেরিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু আবিদ বয়সে বড়, তার বুদ্ধি সোহরাবের চেয়ে বেশি। দুদিন পথে পথে
কাটিয়ে, উপোস থেকে হঠাৎ সে একটা রাস্তা বের করে ফেলে জীবিকা অর্জনের।
শিকারীকে কাজে লাগায় আবিদ। পল্টন ময়দানে গিয়ে বহু লোকের সামনে সে শিকারীকে ছেড়ে দেয়। মাথার উপর আকাশে হয়তো উড়ছে একটা কবুতর। তীরের মত উড়ে গিয়ে কবুতরটিকে ধরে নেমে এল শিকারী।
প্রথম প্রথম কবুতরগুলোকে মেরে ফেলত শিকারী। কিন্তু আবিদ শিকারীকে শিক্ষা দিতে লাগল। আবিদের কথা বুঝতে শিখল শিকারী। তারপর থেকে সে না
মেরে কবুতর ধরে আনত জ্যান্ত।
কুয়াশা ৪৫
,
১১৭
–
–
আহত কবুতর বিক্রি করে বেশ দু’পয়সা আয় হত ওদের। আবার খেলা দেখার আনন্দও পেত দর্শকরা। ফলে তারাও দু’চার আনা বকশিশ দিত ওদের দুই ভাইকে।
রোজ রোজ একই জায়গায় খেলা দেখালে তা জমে না। কথাটা বুঝতে পেরে শহরের বাইরে যেতে শুরু করল ওরা। তারপর একদিন উঠে বসল ট্রেনে।
এবার অন্য শহর।
চট্টগ্রামে পৌঁছে সেই কবুতর শিকারের খেলা দেখিয়েই দিন কাটতে লাগল ওদের। লালদিঘীর মাঠে একদিন খেলা দেখাচ্ছিল ওরা। দর্শকদের মধ্যে ছিল এক ইংরেজ সাহেব। ওদের খেলা দেখে চমৎকৃত হন ভদ্রলোক। ওদের সাথে আলাপ করেন। জানতে চান ওদের বাবার নাম, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি।
সমস্ত কথা সবিস্তারে বলে আবিদ সেই সাহেবকে।
এই সাহেব ছিলেন একটি জাহাজের ডাক্তার। প্রায়ই তিনি আবিদের খেলা দেখতে আসতেন। সোহরাবের তখন ভয়ানক অসুখ। ডিকেনসন সাহেব ওদেরকে একদিন নিয়ে যান পোর্টে। জাহাজে চড়ে আবিদ প্রথমে খুব ভয় পে..ছল। সোহরাবের চিকিৎসার জন্য ডিকেনসন সাহেব ওদের দুজনকেই জাহাজে আশ্রয় দেন। সাহেবের দয়ায় জাহাজেই আশ্রয় পেল ওরা দুই ভাই। কিছু দিনের মধ্যেই সেরে গেল সোহরাবের অসুখ। বেশ সুস্থ হয়ে উঠল সে। ডিকেনসন সাহেব কিছু রঙিন বই দিয়েছিলেন আবিদকে। আবিদ সেগুলো দেখে সময় কাটাত। অবসর সময়ে চিন্তা করার চেষ্টা করত সে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। সোহরাব কিছুই ভাবত না। মাত্র ছয় বছর বয়স তখন তার।
লিজার তখন সাত কি আট বছর বয়স। ডাক্তারের মেয়ে লিজা।
জাহাজে রয়ে গেল ওরা দুই ভাই। তারপর, একদিন ভেঁপু বাজল, পাড়ি জমাল। সমুদ্রে প্রকাণ্ড সেই দ্বীপের মত আলোক মালায় সজ্জিত জাহাজ।
রূপকথার রাজকুমার বলে মনে হয়েছিল নিজেকে আবিদের। সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে যাচ্ছে যেন তারা দুই ভাই, সাথে ভিন দেশের রাজা এবং রাজকন্যা।
| রূপকথার রাজকুমার বাণিজ্যে রওনা হবার পর যা ঘটে আবিদের ভাগ্যেও ঠিক তাই ঘটল। জাহাজটার নাম ছিল ম্যাজেস্টিক। ম্যাজেস্টিকের পরবর্তী গন্তব্য। ছিল সিলোন। কিন্তু সিলোনে নোঙর করার আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ মারা গেলেন ডিকেনসন সাহেব।
লিজা এতিম হলো। ওর মা আগেই, ক্যালিফোর্নিয়ায়, মারা গিয়েছিল।
দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটা ঘটল ভয়ঙ্কর। এরকম ঘটনা রূপকথার রাজকুমারের ভাগ্যেই ঘটে। মাদাগাস্কারের দিকে ছুটছিল জাহাজ। ভারত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তের সবচেয়ে বড় দ্বীপ এই মাদাগাস্কার। কিন্তু মাদাগাস্কারে পৌঁছবার দুদিন আগে ঝড় উঠল।
১১৮
ভলিউম ১৫
–
*
সে প্রচণ্ড ঝড়। সমুদ্রের সেই বিকট গর্জন আজও ভোলেনি আবিদ। জাহাজ এই ডোবে ডোবে অবস্থা।..
‘ চব্বিশ ঘন্টা ঝড়ের সাথে, পাহাড় প্রমাণ লক্ষ কোটি রাক্ষুসে ঢেউয়ের সাথে সংগ্রাম করে টিকে রইল ম্যাজেস্টিক। ঝড় থামল। ক্যাপটেন বললেন, মাদাগাস্কার পেরিয়ে আমরা অন্যদিকে চলে গেছি। জাহাজ ঘোরাতে হবে।
| ঘুরল জাহাজ। কিন্তু হঠাৎ আবার বিপদ ঘটল। জাহাজ ফুটো হয়ে গেছে।
ফুটো মেরামত করার সংগ্রাম চলল এবার। কিন্তু ব্যর্থ হলো সে সংগ্রাম । হাহাকার পড়ে গেল এদের মধ্যে। কান্নার রোল উঠল যাত্রীদের মধ্যে।
ক্যাপটেন স্বয়ং : লিজা এবং আবিদকে নামিয়ে দিলেন একটা লাইফবয়ে। সোহরাবকে নামানো হলো আর একটা লাইফবয়ে।
ম্যাজেস্টিক তখন ডুবছে। বাজপাখিটা ছিল দুটো লাইফবয়ের মাঝখানে, আকাশে।
সমুদ্রে ভাসতে লাগল ওরা। সন্ধ্যার পর রাত্রি নামল। কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছে লিজা। লিজাকে জড়িয়ে ধরে আবিদ বসে আছে। সমুদ্রের গর্জনে কানে তালা লাগার অবস্থা। সারারাত জেগে রইল সে। সকাল হলো এক সময়। দিনের আলোয় চারদিকে কোথাও সোহরাবের লাইফবয়ের চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পেল না। জ্বর এল আবিদের। লিজা জ্ঞান হারিয়েছিল রাত্রেই। সে-ও অজ্ঞান হয়ে পড়ল। লাইফবয় সেদিনই সন্ধ্যায় ভিড়ল তীরে।
জ্ঞান ফিরতে আবিদ দেখল সে শুয়ে আছে জেলেদের কুঁড়ে ঘরে।
এরপর নাটকীয় ঘটনা ঘটতে থাকে একটার পর একটা। জেলেরা আবিদ এবং লিজাকে কুড়িয়ে পায় বালুকাবেলায়। তারাই ওদেরকে বিক্রি করে দেয় দার-এস সালামের এক শেখের কাছে।
শেখের বাড়িটা ছিল সুউচ্চ একটা দুর্গ বিশেষ। সেখানে বন্দীর মত জীবনযাপন করতে থাকে ওরা। শেখের কড়া নির্দেশ ছিল লিজাকে যেন কোনমতে বাইরে বেরুতে দেয়া না হয়। তবে আবিদ যখন খুশি বেরুতে পারত, ঢুকতে পারত। মাস তিনেক ওখানে কাটাবার পর কৌশলে শেখের খপ্পর থেকে লিজাকে উদ্ধার করে সে। ছেলেদের প্যান্টশার্ট পরিয়ে শেখের দুর্গ থেকে লিজাকে বাইরে বের করে আনে সে। সোজা চলে যায় সেখান থেকে রেল স্টেশনে।
ট্রেনে উঠে বসে ওরা। অজ্ঞাত দেশ, দুর্বোধ্য ভাষা, গন্তব্যের ঠিকানা জানা নেই–তবু চনেছে ওরা। ইতিমধ্যে এক লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল আবিদের। সেই লোক লোভ দেখিয়ে বলেছিল, টাবোরা শহরে একবার পৌঁছুতে পারলে হয়, যে কেউ বড় লোক হয়ে যাবে। লোকটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারত। সেই লোকের কথা শুনেই ট্রেনে ওঠে আবিদ লিজাকে নিয়ে।
দার-এস-সালাম থেকে টাবোরা পাঁচশো মাইল প্রায়। কিন্তু একশো মাইল
কুয়াশা ৪৫
১১৯
পেরোবার আগেই নেমে পড়ল ওরা।
| এরপরের দিনগুলো ঘটনাবহুল। কাজ করল আবিদ আর লিজা কয়েকটা খনিতে। পালিয়ে গেল এক শহর থেকে আর এক শহরে, শ্রমিকদের সর্দারের অত্যাচার সহ্য করে কোন খনিতেই কিতে পারল না ওরা।, নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে খেয়ে না খেয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গিয়ে পড়তে লাগল ওরা। কখনও ট্রাকে, কখনও ট্রেনে করে বহু দূরের কোন শহরে চলে যেত। সেখানে ঘুরে বেড়াত যাযাবরদের মত। তারপর আবার কোন গুণ্ডা বা ডাকাতদলের হাতে পড়ে । বিক্রি হয়ে যেত কোন আমিরের কাছে।
কিন্তু পালাবার চেষ্টা করে কোন বারই ব্যর্থ হয়নি আবিদ ও লিজা। যেখানে, যার অধীনেই থাকুক, ঠিকই ওরা আবার পালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ওরা পৌঁছুল মোয়ানজায়। এখানেও একটা খনিতে কাজ পেল ওরা। কেউ জানল না লিজা ছেলে
মেয়ে।
একদিন সকালে উঠে ওরা দেখল শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে গেছে। সে এক খুনোখুনি কাণ্ড। ভয়ে পালাল ওরা। ছুটতে ছুটতে শহরের কাছাকাছি এসে ধরা পড়ল কয়েকজন লোকের হাতে।
একদল লোক একটা তিন চাকাওয়ালা গাড়ি নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। আবিদ এবং লিজাকে দাঁড় করাল তারা। লোকগুলো
• সংখ্যায় ছিল আটজন। গাড়িতে তাদের ব্যাগ বাক্স ছিল। প্রত্যেকের চেহারার মধ্যে
কেমন একটা বেপরোয়া ভাব ফুটে ছিল। লোকগুলো যে সুবিধের নয় তা আবিদ বুঝতে পেরেছিল। এর আগে অনেক খারাপ লোকের হাতে পড়ছিল ওরা কিন্তু এরা যে সে-সব লোকের চেয়েও ভয়ংকর প্রকৃতির তা বুঝতে কষ্ট হয়নি তার।
আবিদকে দাঁড় করিয়ে রাখল তারা। লিজাকে হুকুম করল তিন চাকাওয়ালা গাড়ির গা পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে ফেলার। লিজা ভয়ে ভয়ে কাজে হাত দিল। লোকগুলো ব্যাগ খুলে বের করল খেজুর আর বাদাম। আবিদ আর লিজাকেও দিল খেতে। খাওয়া শেষ হতে লোকগুলো আবিদকে দূরের একটা কৃয়া থেকে এক বালতি পানি নিয়ে আসার হুকুম করল।
পানি নিয়ে এল আবিদ।
লোকগুলো গাড়িতে চড়ল। আবিদ ও লিজাকেও তুলে নিল ওরা গাড়িতে। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
সারারাত দুটল গাড়ি। সকাল হতে গাড়ি থামল। গাড়ি থেকে নেমে আবিদ আর লিজা দেখল গভীর জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করছে গাড়ি। সামনে আর রাস্তা নেই। | লোকগুলো ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমোবার আগে তারা আবিদ আর লিজার মাথার চুল ধরে নাড়া দিয়ে ভয় দেখাল আকার ইঙ্গিতে–এখান থেকে পালাবার কোন
১২০।
ভলিউম ১৫
উপায় নেই। পালাবার চেষ্টা করলেই হিংস্র জীব-জন্তুর হাতে প্রাণ হারাতে হবে।
এরপর গহীন বনভূমির ভিতর দিয়ে দিনের পর দিন হাঁটতে হয় ওদেরকে। সেই আর্টজনের দলটি আসলে রহস্যপুরীর সন্ধানে যাচ্ছিল গহীন অরণ্যের ভিতর দিয়ে। আবিদ এবং লিজাকে তারা সাথে নিয়েছিল কাজকর্ম করবার জন্য। ওরা দুজন রান্নাবান্না করত, কাঠ কেটে আনত, লোকগুলোর হাত-পা টিপে দিত। কাপড় ধুয়ে দিত।
অরণ্যের প্রাণীদের তরফ থেকে আক্রমণ আসত প্রায় রোজই। আধুনিক যন্ত্রপাতি সাথে থাকলেও আটজনের মধ্যে তিনজনই নিহত হলো এক হপ্তার মধ্যে। বাকি পাঁচজন আক্রান্ত হলো একদিন হঠাৎ একদল জংলীদের দ্বারা।
তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। প্রাণের ভয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটল আবিদ ও লিজা।
কতক্ষণ ধরে দৌড়েছিল খেয়াল নেই আবিদের। হঠাৎ সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় এবং জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফেরার পর সে দেখে পাশেই শুয়ে আছে লিজা। ঘুমাচ্ছে অঘোরে। এবং ওদের দুজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ডদেহী অসংখ্য গরিলা।
বাজপাখিটা বসেছিল একটা গাছের ডালে। আবিদ জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে, বসতেই সে চিৎকার করে ডেকে উঠে মাথার উপর উড়তে লাগল ঘুরে ঘুরে।
আবিদকে উঠে বসতে দেখেই প্রকাণ্ড একটা গরিলা নিজের বুকে চাপড় মেরে ঢোল পেটার মত বিকট শব্দ তুলে এগিয়ে আসতে লাগল। ভয়ে কেঁদে ফেলল।
আবিদ।
কিন্তু পরমুহূর্তে ঘটল অদ্ভুত একটা কাণ্ড। সেই প্রকাণ্ড আক্রমণোদ্যত গরিলাটা যখন আবিদের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে তখন তিন চারটে সম-আকৃতির গরিলা অকস্মাৎ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বিকট গর্জন তুলে এগিয়ে এল।
আক্রমণোদ্যত গরিলাটাকে তারা বাধা দিল। লেগে গেল ওদের মধ্যে কোন্দল। শেষ পর্যন্ত হিংস্র গরিলাটা পিছিয়ে গেল।
অধিকাংশ গরিলা আবিদ এবং লিজাকে সুদৃষ্টিতে দেখায় কোন বিপদই ঘটল না ওদের। ক্রমে গরিলাদের বাচ্চারা ওদের কাছে আসতে লাগল, ওদের নিয়ে খেলা করতে চেষ্টা করতে লাগল। দিন কাটতে লাগল, গরিলারা নিজেদের মধ্যে আবিদ এবং লিজার উপস্থিতি মেনে নিল। গরিলাদের হাবভাব গলার স্বর ইত্যাদি নকল করতে শুরু করল ওরা। কেটে গেল মাসের পর মাস বছরের পর বছর। আবিদ এবং লিজা হয়ে উঠল গরিলাদের একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় মানুষ-বন্ধু।
আবিদ হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। খিকখিক করে হাসছে চারদিক থেকে শ’দেড়েক গরিলা। ঘিরে ফেলেছে ওকে তারা । লিজার উপর রাগ হলো আবিদের। ঢাক-ঢোলের শব্দ
কুয়াশা ৪৫
১২১
.
…
.
‘
শুনে আগেই সে গরিলা বাহিনীকে নিয়ে এগিয়ে এসেছে এতদূর। রফিকী ফিক ফিক করে হাসছে আবিদের গার্য দেখে। ‘
জংলীদের উপর গরিলারা বিশেষভাবে খেপা বলে আবিদ পারত পক্ষে চায় না এদেরকে মুখোমুখি হতে দিতে। জংলীদের প্রতি বিদ্বেষের’কারণ হলো জংলীদের ঢাক-ঢোল পেটাবার শব্দটা গরিলাদের বুক চাপড়াবার শব্দের মতই। ঢাক-ঢোলের শব্দ হলেই ওরা ধরে নেয় জংলীরা যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছে।
| লিজাকে চারদিকে খুঁজল আবিদ। নেই সে। রফিকীর বউও নেই আশপাশে কোথাও। রফিকীর দিকে তাকাল আবিদ, জানতে চাইল, লিজা কোথায়? তোমার বেগম কোথায়?’
রফিকী দুই হাত সামনে বাড়িয়ে সাঁতার কাটার ভঙ্গি করে বোঝাল তারা নদীতে স্নান করতে গেছে।, জংলীরা আসছে। আমার পিছু পিছু ওদেরকে দেখার জন্য যেতে পারো তোমরা । কিন্তু কোন শব্দ করতে পারবে না। রাজি?’
| রফিকী মাথা কাত করল। রাজি সে। রফিকী রাজি হলেই সবাই রাজি। রফিকীর পিঠের লোম উঠে গেছে। রূপোর মত চকচকে তার পিঠ। এটা বয়সের চিহ্ন। অধিকাংশ গরিলার পিঠ তাদের সর্বাঙ্গের মতই লোমে আবৃত। যাদের পিঠ রূপের মত কচকে তারাই শুধু সর্দার হবার উপযুক্ত। রফিকী সর্দার।
পা বাড়াল আবিদ।
প্রিম-দ্রিম, ডুম-ডাম-দ্রাম–দ্রিম, ডুম-ডাম-দ্রাম–দ্রিম-দ্রিম, ডুম-ডাম। সেই সাথে জংলীদের উল্লসিত দুর্বোধ্য আকাশ ফাটানো চিৎকার, সেই সাথে খাঁচায় বন্দী বাঘের গর্জন চারদিকের বনজঙ্গল কাঁপিয়ে তুলছে।
গরিলা বাহিনী আবিদের পিছু পিছু এগোচ্ছে। সবাই উত্তেজিত, সকলের দৃষ্টি তার দিকে। তার একটা ইঙ্গিতের অপেক্ষায় থাকে ওরা। ইঙ্গিত পেলেই বুকে ‘চাপড় মারতে মারতে বিপুল বিক্রমে গাছপালা ভেঙে ছুটবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে
জংলীদের ঘাড়ে।
থমকে দাঁড়াল আবিদ। পিছন দিকে হাত নাড়ল। ইঙ্গিত পেয়ে যে যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে পড়ল গরিলারা।
জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে মালকানী পাহাড়ের গিরিপথ। সামনে প্রশস্ত সমতলভূমি। শ পাঁচেক বা তারও কিছু বেশি জংলী ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে সমতলভূমি পেরিয়ে উত্তর পশ্চিম দিকের জঙ্গলের ভিতর ঢুকছে। সেই একই দৃশ্য। খাঁচায় বন্দী বাঘ, ভালুক, ঘোড়া, শ্বেতাঙ্গ বন্দিনী। ভারি স্বর্ণের অলঙ্কার গলায়, গায়ে।
জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল জংলীরা। কিন্তু নড়ল না আবিদ। গরিলারা নিজেদের মধ্যে খেলা শুরু করে দিয়েছে। লাফালাফি করছে তারা। বাচ্চা গরিলারা গাছের
=
==
১২২
ভলিউম ১৫
ডাল ধরে দোল খাচ্ছে! মড় মড় শব্দ হচ্ছে ডালপালা ভাঙার। আবিদ হঠাৎ গর্জে
উঠল, চুপ করো সবাই।
| বনভূমির আড়ালে চলে গেছে জংলীরা। সেই সাথে বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ঢাক ঢোল পেটানো । কান পেতেও কোন শব্দ পাচ্ছে না আবিদ। ব্যাপার কি?
এরকম তো এর আগে কখনও হয়নি।
মালকানী গিরিপথের দিকে চোখ পড়তেই তীক্ষ্ণ হলো আবিদের দৃষ্টি। বিশ পঁচিশজন লোককে দেখা যাচ্ছে, বেরিয়ে আসছে তারা গিরিপথের ভিতর থেকে সমতল ভূমিতে।
বিপদ ঘটতে যাচ্ছে, কপাল মন্দ ওদের। জংলীদের হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যাবার কারণ বুঝতে পারল আবিদ। ওরা জানতে পেরেছে সভ্য জগতের বিশ পঁচিশজনের, একটা দল ওদেরকে অনুসরণ করে আসছে। জঙ্গলে প্রবেশ করে গা ঢাকা দিয়ে। লুকিয়ে পড়েছে সবাই। ওত পেতে আছে। সভ্য দুনিয়ার এই লোভী লোকগুলো রহস্যপুরীর সন্ধান জানতে এসেছে। কিন্তু রহস্যপূরী পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না তারা। সমতলভূমি পেরিয়ে জঙ্গলে প্রবেশের সাথে সাথে জংলীরা এদের জান কবচ করবে।
গরিলারাও এতক্ষণে টের পেয়েছে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
সন্ধানী দৃষ্টিতে দূরের ওই লোকগুলোকে দেখতে লাগল আবিদ। অনেকটা দূরে ওরা, ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। তবে দলটা যে সভ্য জগতের মানুষের তাতে কোন সন্দেহ নেই। সবাই রঙচঙে পোশাক পরে আছে। প্রায় প্রত্যেকের হাতে আধুনিক মারণাস্ত্র। তবে দলে শ্বেতাঙ্গ কেউ নেই।
হঠাৎ মাথার উপর তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে চমকে উঠল আবিদ। তার শিকারী তীর বেগে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে।
পিছন দিকে তাকাল আবিদ। বেগম এসে দাঁড়িয়েছে রফিকীর গাশে। তার পাশে বাঘের চামড়া দিয়ে তৈরি সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে সিক্ত শরীরে পঁড়িয়ে আছে পরীর মত সুন্দরী যুবতী লিজা। লিজার দুচোখে বিস্ময়। আবিদ তাকাতে সে বলল, ‘শিকারী আমার কাঁধে ছিল। কি দেখে অমন চিৎকার করে উড়ে গেল বুঝতে পারলাম
।’
পাতার ফাঁক দিয়ে আবার সামনের দিকে তাকাল আবিদ। বিশ-পঁচিশজনের দাটা সমতলভূমির মাঝামাঝি জায়গায় চলে এসেছে। দলটার মাথার উপর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচাচ্ছে শিকারী, চক্কর দিচ্ছে দলটাকে কেন্দ্র করে আকাশে। গোটা দলটা উত্তেজিত। জংলীদের ঢাকঢোলের শব্দ হচ্ছে না দেখে একটা সন্দেহ জেগেছে তাদের মনে। সতর্ক পায়ে এগোচ্ছে তারা। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই মারণাস্ত্র রয়েছে। সবাই প্রস্তুত।
এরপর ঘটল সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা। আবিদের শিকারী দলটার একজন
কুয়াশা ৪৫
১২৩
লোকের কাছে গিয়ে বসল হঠাৎ। |
বুকের ভিতর কেমন যেন একটা ছটফটানি ভাব দেখা দিল আবিদের। কি যেন স্মরণ করার চেষ্টা করছে সে, কি যেন চিন্তা করার চেষ্টা করছে।
বিশ-পঁচিশজনের দলটা জঙ্গলে প্রবেশের আগেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে জংলীরা খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল বিষাক্ত তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে ।
আবিদ বিকট কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, রফিকী! সাবাড় করো জংলীদের।
চোখের পলকে দ্রুত ঘটতে লাগল একের পর এক ঘটনা। ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুঁড়তে লাগল জংলীরা। সভ্যদের প্রত্যেকের হাতের আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে উঠল। আহতদের আর্তনাদে কেঁপে উঠল চারদিকের বনভূমি। জংলীরা-প্রথম আক্রমণ করায় সভ্য লোকদের বেশ কয়েকজন প্রথমেই বিষাক্ত তীরবিদ্ধ হয়ে ধরাশায়ী হয়েছে । মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তারা। এদিকে জংলীরা মরছে দলে দলে। বুলেটবিদ্ধ হয়ে একসাথে লুটিয়ে পড়ছে চার-পাঁচজন করে জংলী।
কিন্তু জংলীরা সংখ্যায় পঞ্চাশ গুণ বেশি। তাদের লক্ষ্যও অব্যর্থ। ভয়ে বা আত্মরক্ষার্থে পিছিয়ে আসার বান্দা তারা নয়। মরছে একের পর এক, কিন্তু তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই। সভ্য লোকদের প্রায় সবাই তীরবিদ্ধ হলো দেখতে দেখতে। তারপর, জংলীরা হঠাৎ মেঘের মত ডাক শুনে ঘাড় ফেরাতেই দেখতে পেল গরিলা বাহিনীকে।
মৃত্যু ভয়ে যে যেদিক পারল ছুটল। কিন্তু গরিলাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ নয়। জংলীদের ধরে গরিলারা ফেলে দিল ধাক্কা দিয়ে মাটিতে, তারপর পা তুলে দিয়ে দাঁড়াল বুকের উপর। মটু মটু করে ভাঙতে লাগল জংলীদের পাজরগুলো।
সমতলভূমির মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছুল আবিদ।
আহত এবং নিহত বিশ-পঁচিশজনের দলটার মাথার উপর চক্কর মারছে আর চেঁচাচ্ছে তখন শিকারী ।
‘, আহতদের একজন লোক একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে আবিদের দিকে। আবিদও দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না। পাশে এসে দাঁড়াল লিজা। | চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসছে আবিদের। গাল বেয়ে সেই জলের ধারা টপ টপ করে পড়ছে আহত লোকটার গায়ে।
* কাঁদছে নিঃশব্দে আহত লোকটাও। লিজাও হঠাৎ কান্না ভারাক্রান্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল, সোহরাব।’
আবিদ ঝাঁপিয়ে পড়ল ছোট ভাইয়ের বুকের উপর।
১২৪
ভলিউম ১৫
রফিকীকে পাওয়া গেল না কোথাও। বেগম কাঁধে করে নিয়ে এল সোহরাবকে জঙ্গলের ভিতর । আবিদের কুঁড়েঘরে শোয়ানো হলো তাকে। মাথার কাছে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বাজপাখি। কুঁড়েঘরের সামনে আহত আরও চারজনকে এনে রাখল । তাদের মধ্যে এক ঘণ্টার মধ্যে মারা গেল দু’জন।
রফিকী ফিরল ঘণ্টা দুয়েক পর। আবিদের হাতে সে তুলে দিল নীল রঙের কয়েকটা গাছের পাতা। হাতের উপর হাত ঠকে সে দেখাল পাতাগুলো কেটে থেঁতলে সোহরাবের ক্ষতস্থানে লাগাতে হবে, খাওয়াতে হবে এই নীল পাতার রস।
| আহত অপর লোক দুজনের চিকিৎসার ভার নিল লিজা। আবিদ ছোট ভাইয়ের পাশ থেকে উঠল না মুহূর্তের জন্যও।
গরিলারা লিজার নর্দেশে জংলীদের যাবতীয় জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে এল আবিদের কুঁড়েঘরের ভিতর। খাঁচাগুলো রাখা হলো বাইরে।
রফিকীর ওষুধের গুণে বেঁচে গেল সোহরাব এবং তার দলের অপর দুজন। সোহরাব একে একে বলতে লাগল দুই ভাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর তার ভাগ্যে কি
কি ঘটেছে।
উগাণ্ডায় বসবাস করছে সোহরাব। বিয়ে করেছে সে। কাম্পালায় তার বেশ ডাল ব্যবসা আছে। ব্যাঙ্কে জমেছে প্রচুর টাকা। পথের ফকীর থেকে সোহরাব আজ অনেক টাকার মানুষ। প্রচণ্ড খেটেছে সে। অনেক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজেকে। কিন্তু শেষ রক্ষা বুঝি হলো না। | উগাণ্ডার একনায়ক শাসক জেনারেল ইদি আমিন বিশেষ আইনবলে এশিয়াবাসীদেরকে উগাণ্ডা ত্যাগ করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশ পেয়ে স্বভাবতই মন ভেঙে যায় সোহরাবের। এত কষ্টের ফসল, ব্যবসা, টাকা, ঘর-বাড়ি ফেলে চলে যেতে হবে ভাবতে কারই বা ভাল লাগে। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা তদ্বির করে সে দেখা করে ইদি আমিনের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি এক মহিলার সাথে।
ইদি আমিনের প্রাইভেট সেক্রেটারি সোহরাবের প্রার্থনা শুনে তিনদিন পর উত্তর দেয়, সোহরাব যদি সাবেক বেলজিয়ান কঙ্গো অর্থাৎ বর্তমানের ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গোর গভীর অরণ্যে অবস্থিত হাজার হাজার বছরের সঞ্চিত গুপ্তধন সম্পর্কে যে গুজব শোনা যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে আনতে পারে অর্থাৎ গুজবের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে বাস্তবভিত্তিক রিপোর্ট দিতে পারে তাহলে তার সয়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে না এবং উগাণ্ডার নাগরিক হিসেবে তাকে গ্রহণ করা হবে।
কঙ্গোর গভীর অরণ্যে গুপ্তধন সঞ্চিত আছে এরকম একটা গুজব প্রচলিত ছিল।
কুয়াশা ৪৫
১২৫
কিন্তু কেউই এর হদিস আজ অবধি পায়নি। যারাই এর সন্ধানে এসেছে তারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে, দেশে ফিরতে পারেনি। রহস্যপুরীর ধারে কাছে কেউ পৌঁছুতে পেরেছে বলে দাবি করেনি কেউ।
আবিদ বলল, “গুপ্তধন কোথায় আছে তা আমি জানি। গুপ্তধন আছে যে শুধু তাই নয়, তা প্রতি বছরই বাড়ছে। রহস্যপুরী নাম দিয়েছি সেই জায়গার। কিন্তু, সোহরাব, সেখানে গিয়ে কেউ কোনদিন ফিরতে পারে না।’
সোহরাব বলল, ইথিওপিয়ার ম্রাট হাইলে সেলাসী কয়েক বছর আগে একটা, দল পাঠিয়েছিলেন। তারা প্রায় বিশ মণ সোনা উদ্ধার করে নিয়ে যায় তোমার এই রহস্যপুরী থেকে । এ ঘটনার কথা জেনারেল ইদি আমিন জানতে পেরেই গুপ্তধন পাবার লোডে আমার নেতৃত্বে একটা দল পাঠিয়েছেন।
আবিদ বলল, ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসীর পাঠানো সেই দল বিশ মণ সোনা রহস্যপুরী থেকে উদ্ধার করেনি, সোহরাব। সভ্যজগতের কেউ কোন দিন রহস্যপুরীতে প্রবেশ করে বেরুতে পারেনি আজ পর্যন্ত। এ বা জংলীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল সম্ভবত ওই সোনা। জংলীরা, কেন জানি, প্রতি বছর দল বেঁধে মণ মণ সোনা নিয়ে আসে রহস্যপুরীতে। সেই সোনা রহস্যপুরীতে রেখে ফিরে যায় ওরা।’
কী আশ্চর্য! রহস্যপুরীতে কারা থাকে, কাদেরকে সোনা দিয়ে যায় জংলীরা! | আবিদ বলল, জানি না। রহস্যপুরীতে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসা কোন সভ্য মানুষের পক্ষে সম্ভঘ নয়। সোহরাব, দেশের খবর কিছু জানিস?
কথাটা বলে আবিদ হেসে উঠল হঠাৎ, তারপর আবার বলল, দেশের কথা তুই জানবি কিভাবে। ছয় বছর বয়সে তোকে নিয়ে বেরিয়েছি। বাবার কথা, দেশের কথা তোর মনে থাকার কথা নয়। সোহরাব, আমাদের বাবা বেঁচে আছেন। আমাদের দেশ, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।’
সেকি! বাবা বেঁচে আছেন! তুমি এসব খবর এই গভীর জঙ্গলে থেকে সংগ্রহ করলে কিভাবে।’
শোনো হবে। আমি এই জঙ্গলে আসার পর থেকে মাঝে মাঝেই আমাদের শিকারী হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যেত। পঁচিশ-ত্রিশ দিন দেখা পাওয়া যেত না তার। আসলে কোথায় যেত সে জানিস? যেত আমাদের দেশে।
‘সেকি!’
আবিদ বলল, হ্যাঁ। যে কোন কারণেই হোক, বাবা শিকারীকে লক্ষ্য করেননি অনেক দিন অবধি। কিন্তু মাস চারেক আগে শিকারী আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। ফেরে প্রায় পনেরো দিন পর। দেশেই গিয়েছিল সে। সাথে করে নিয়ে এসেছে–কি নিয়ে এসেছে জানিস?’
‘কি?’ •
১২৬
ভলিউম ১৫
‘চিঠি। বাবার নিজের হাতে লেখা চিঠি। দাঁড়া, দেখাচ্ছি।
কথাটা বলে আবিদ ঘরের এক কোনায় রাখা একটা লেদার ব্যাগের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ব্যাগটা খুলে একটা তামার মাদুলী বের করে আনল সে। মাদুলীর একদিকের মুখ মোম দিয়ে বন্ধ করা। মোমটুকু লম্বা নখ দিয়ে খুঁটে বের করে ভিতর থেকে ভাঁজ করা ছোট একটা কাগজের টুকরো বের করল আবিদ।
ভঁজ খুলে আবিদ চিঠিটা পড়তে শুরু করল।
| আমার দুই সোনা মানিক আবিদ আর সোহরাব, বাবারা, তোমরা বেঁচে আছ কিনা, বেঁচে থাকলেও কোথায় আছ কিছুই জানি না। তোমাদেরকে হারিয়ে আমি নিদারুণ দুশ্চিন্তা এবং শোকে কাতর হয়ে দিন কাটাচ্ছি। | তোমরা যখন হারিয়ে যাও তখন তোমাদের সাথে আমার পোষা পাখি শিকারীও হারিয়ে যায়। গত বছর খানেক হলো, আমি শিকারীকে মাঝে মধ্যে কোথা থেকে জানি না উড়ে আসতে দেখি। ওকে দেখে আমার বুকে আশার আলো জ্বলে ওঠে, মনে হয় তোমরাও বেঁচে আছ। তাই শিকারীর গলায় একটা মাদুলীর সাথে এই চিঠি লিখছি। তোমরা যদি বেঁচে থাকো তাহলে এই চিঠির উত্তর দিও। আমার দোয়া রইল তোমাদের প্রতি।
তোমাদের বাবা,
আশরাফ উদ্দিন চিঠিটা পড়া শেষ করে আবিদ বলল, ‘শিকারীকে এর পর আর পাঠাইনি। ভেবেছিলাম এবার পাঠাব। কিন্তু তাও আর দরকার হবে না।
সোহরাব বলল, এখন কি করতে চাও তুমি? আবিদ বলল, যেমন করে থোক দেশে ফেরার চেষ্টা করব, সোহরাব।’
দেশে তো অবশ্যই ফিরব। কিন্তু•••।’
আবিদ বলল, তুই কি আশঙ্কা করছিস বুঝতে পারছি। গুপ্তধনের সঠিক অবস্থান। জেনারেল ইদি আমিনকে জানাতে হবে। শুধু জানালেই চলবে না, জানাবার পর সেই গুপ্তধন উদ্ধার করে তুলে দিতে হবে তার হাতে। তা না হলে তোর সয় সম্পত্তি যাবে সব।
‘শুধু তাই নয়, প্রাণ নিয়ে উগাণ্ডা থেকে পালাবারও উপায় থাকবে না আমার। জেনারেল রগচটা মানুষ। কখন কি করে, কখন কি সিদ্ধান্ত নেয় তার ঠিক নেই। সারা পৃথিবীর লোক জানে ইদি আমিন যেমন পাগলাটে তেমনি নিষ্ঠুর।
আবিদ বলল, হু! অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর সোহরাব বলল, আমার যা হবার হবে। তুমি দেশে
কুয়াশা ৪৫
১২৭
| ফিরে যাও।
| ‘তা হয় না। তোকে এমন বিপদে ফেলে আমি দেশে যাব কেমন করে রে, বোকা? ঠিক আছে, উপায় পেয়ে গেছি। উগাণ্ডায় চল আগে। রহস্যপুরীর হদিস দেব জেনারেলকে। জেনারেল গুপ্তধন উদ্ধার করতে পাঠাতে চাইলে রাজি হব আমি উদ্ধার অভিযানে আসতে। কিন্তু শর্ত দেব তোদেরকে উগাণ্ডা ত্যাগের অনুমতি দিতে হবে। ব্যবসার শুড উইল বিক্রির টাকা, ব্যাঙ্কের টাকা, বাড়ি বিক্রির টাকা সব
দেশে নিয়ে যাবার অনুমতিও দিতে হবে সেই সাথে।
“কিন্তু•••।
আবিদ বলল, আমার বিপদের কথা ভাবছিস? আমি বিপদে পড়ব না। এই এলাকাতেই তো যত বিপদ, তাই না? এখানকার বিপদকে আমি পরোয়া করি না। রফিকীর দল আমাকে সাহায্য করবে। এদেরকে নিয়েই আমি রহস্যপুরীতে ঢুকব। | সাথে থাকবে ইদি আমিনের সামরিক বাহিনীর বিরাট একটা দল। সব ঠিক করে
ফেলব, দেখিস তুই। তিন ঢাকা।
মিল কারাক রোডের উপর দুর্ঘটনা ঘটেছে এইমাত্র। প্রকাণ্ড একটা ড্যান ছোট্ট একটা অস্টিনকে পিছন থেকে ধাক্কা মেরেছে। ভ্যানের ড্রাইভার পাটখড়ির মত রোগা হ্যাট পরা লোকটা শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষেছিল ঠিকই কিন্তু কাজ হয়নি তাতে। অস্টিনকে বাঁচাতে পারেনি সে। পঞ্চাশ মাইল স্পীডে দুটন্ত ভ্যানের ধাক্কায় অস্টিনটা ফ্রী কি খাওয়া ফুটবলের মত প্রায় উড়ে গিয়ে পড়েছে মাঠের উপর। অস্টিনের ড্রাইভারের ভাগ্য অস্বাভাবিক ভাল বলতে হবে। কারণ ধাক্কা লাগলেও পুরোপুরি অক্ষত আছে সে। গাড়ির পিছনটা অবশ্য তুবড়ে গেছে। অকস্মাৎ ডান ব্রেক কমায় কাঠের কয়েকটি বাক্স ছিটকে পড়ে গেছে রাস্তার উপর।
ভেঙে গেছে একটা বাক্স। ডাঙা বাক্স থেকে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য তেলাপোকা।
মহা হৈ-চৈ পড়ে গেছে চারপাশের লোকজনের মধ্যে। দোষ কার? সবাই একবাক্যে বলছে দোষ অস্টিনের। অস্টিনের ড্রাইভার হঠাৎ ব্রেক কষে মাঝ রাস্তায় পঁড়িয়ে পড়েছিল। যদিও দু’একজন লোক বলছে, ভ্যানের ড্রাইভারই বা কেমন লোক? শহরের ভিতর এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল কেন সে? তবে অ্যাক্সিডেন্টে তেমন ক্ষতি কারোরই হয়নি, তাই কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। এদিকে ভ্যানের পিছনে, ছোটখাট একটা ভিড় জমে গেছে। ভ্যানের ড্রাইভার নিচে নেমে কাঠের বাক্সগুলো তুলছে। ভাঙা বাক্সের ভিতর থেকে তেলাপোকারা বের হয়ে পালাচ্ছে এদিক। সেদিক, লোকটা এক হাতে মাথার হ্যাট ঠিক করতে করতে দৌড়াদৌড়ি ছুটোছুটি
১২৮
ভলিউম ১৫
করে সেগুলোকে ধরে বাক্সে ভরার চেষ্টা করছে। দর্শকরা এদিকে হেসে গড়িয়ে পড়ছে একজন আরেকজনের গায়ের উপর।
এমন দৃশ্য দেখা যায় না সচরাচর।
খেপে উঠেছে হ্যাটপরা ভ্যানের ড্রাইভার। তেলাপোকাদের সাথে পারছে না সে ।
“ফিফটি ঠাউজেন্ট তেলচোট্টা সাপ্লাই ডিটে হইবে-এডিকে ব্যাটারা পলাতক হইটে চায়।’
বলাই বাহুল্য, ভ্যানের ড্রাইভার স্বয়ং স্যানন ডি কস্টা। “কি হবে এই তেলাপোকা দিয়ে?’ একজন পথিক হাসি থামিয়ে জানতে চাইল।
শাটআপ, মিস্টার! কি হইবে টা ডিয়া হাপনার কি ডরকার? | ডি কস্টা কথাটা বলে ভাঙা বাক্সটা ভ্যানের পিছন দিকে তুলে ফেলল। মাথার হ্যাটটা বাক্সের উপর রাখল সে। যাতে তেলাপোকারা আর বেরুতে না পারে। ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল সে।
কে একজন বলল, “পুলিস আসছে। | পাশেই থানা পুলিস আসছে এতক্ষণে। ডি. কস্টা বলে উঠল, কোন প্রফিট হইবে না। পকেট এমটি।
ড্যান স্টার্ট দেয়াই ছিল, চলতে শুরু করল এবার। কিন্তু অস্টিনের ড্রাইভার স্যুট পরা ভদ্রলোক রাস্তার মাঝখানে পথ রোধ করে দাঁড়াল। চিৎকার করছে সে, ‘পালিয়ে যেতে দেব ভেবেছ? আমার গাড়ির পিছনটা তুবড়ে গেছে, আমি কেস করব। ডাল যদি চাও, থামো, গাড়ি মেরামতের টাকা দিয়ে যাও!
| ডি. কস্টা গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিচে নামল। লোকটা সামনে এসে দাঁড়াতে অতি আপনজনের মত অপ্রত্যাশিতভাবে ডি. কস্টা তাকে দুই বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করে বুকের সাথে চেপে ধরল।
“আরে! ছাড়ো বলছি, তোমার হাড় বিধছে গায়ে–কী মুশকিল। পাগল নাকিরে বাবা। স্যুট পরা লোকটা চেঁচিয়ে বলতে লাগল।
ডি.কস্টার কাণ্ড দেখে হোঃ হোঃ করে হাসছে দর্শকরা। লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল ডি. কস্টা। মিটিমিটি হাসছে সে। জানতে চাইল মিষ্টি গলায়, হাউ মাচ? কট টাকা লাগিবে মিস্টার আপনার খেলনা গাড়ি মেরামট করিটে?
দুশো টাকার এক পয়সাও কম না। “ডিচ্ছি ডিচ্ছি।’
কথাটা বলে আবার ভ্যানে উঠে পড়ল ডি. কস্টা। পকেট থেকে বের করল ম্যানিব্যাগ, উল্টেপাল্টে দেখল সেটা। বিড় বিড় করে বলল, বেশ দামী জিনিস ডেকা যাইটেছে অণ্ডরমহলে রসকষ কিছু ঠাকিলেও ঠাকিটে পারে।’
৯”কুয়াশা ৪৫
১২৯
ম্যানিব্যাগ খুলে ডি. কস্টা দেখল দশ টাকার অনেকগুলো নোট দেখা যাচ্ছে। দ্রুত বিশটা নোট শুনে নিচে দাঁড়ানো লোকটার দিকে বাড়িয়ে ধরল সে, বলল, এই নিন, মিস্টার। হাপনার টাকা, আইমীন, হাপনার প্রাপ্য হাপনাকে ডিলাম।
লোকটা টাকাটা নিতেই ভ্যান ছেড়ে দিল ডি, কস্টা। স্যুট পরা লোকটা। জানতেও পারল না তার পকেটের ম্যানিব্যাগ কখন কিভাবে ডি, কস্টার পকেটে গেল, বুঝতেও পারল না যে টাকাগুলো ডি কস্টা তাকে দিল সেগুলো আসলে তারই টাকা।
ভ্যান ছুটছে। ডি, কস্টা মাথা দোলাতে দোলাতে গান গাইছে আপন মনে:
মাই নেম ইজ স্যানন। লাইক এ বিগ ক্যানন আই অ্যাম এ হিরো। অল অফ দেম আর জিরো লা লা লা লা লা লা বা বা বাদা, বা বা বাম্বা
মাই নেম ইজ•••••। এ-রাস্তা সে-রাস্তা ঘুরে ডি, কপ্টার ভ্যান গিয়ে দাঁড়াল সেগুনবাগিচার একটা, একতলা বাড়ির গেটের সামনে। স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামল সে। গেটের গায়ে নেমপ্লেট রয়েছেঃ এডভোকেট আশরাফ উদ্দীন।
খোলা গেট পেরিয়ে হন হন করে উঠন দিয়ে বারান্দায় গিয়ে উঠল ডিকস্টা। এডভোকেট আশরাফ সাহেব দৈনিক পত্রিকা পড়ছিলেন বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে। সহাস্যে তিনি অভ্যর্থনা জানালেন ডি, কস্টাকে। বললেন, “আসুন, মি. ডি.; কস্টা। বসুন।
| মুখোমুখি একটা কাঠের চেয়ারে বসল ডি, কস্টা। পকেট থেকে বের করল, চুরুটের প্যাকেট। ধরাল একটা। নীল ধোয়া ছাড়ল উপর দিকে। তারপর জানতে চাইল, ইজ দেয়ার এনি নিউজ অফ ইওর সান, অর অফ দ্যাট এক্সট্রা অর্ডিনারী গুড বার্ড-দ্য শিকারী?
আশরাফ সাহেব বিষণ্ণ হাসলেন, না, নতুন কোন খবর নেই, মি. ডি. কস্টা। আমার শিকারীর অপেক্ষাতেই তো রোজ সারাক্ষণ এই বারান্দায় বসে থাকি আর আকাশ দেখি। কিন্তু কই, আর তো তার দেখা নেই। আমার কি সন্দেহ জানেন? সন্দেহ হয় শিকারী হয়তো মারা গেছে। কিংবা আমার ছেলেরা হয়তো কোন বিপদে পড়েছে, হয়তো-থাক। রাতদিন কত অশুভ কথা মনে হয়। ওদেরকে আর এজীবনে দেখতে পাব বলে আমার বিশ্বাস হয় না।’
নো-নো-নো-ননা। দ্যাট ইজ ইমপসিবল! আপনার শিকারী নিশ্চয়ই ফিরিয়া যাইটে পারিয়াছে। আর হাপনার ছেলে? টাহাকে হামি আনিয়া ডিব। বিলিভ মি,
১৩০
ভলিউম ১৫
হাপনি চিন্টা করিবেন না। মি, আশরাফ, আপনি আপনার ছেলেডেরকে রিটার্ন পাইবেন। হামি মি. স্যানন ডি. কস্টা, টাহাড়েরকে উড়ঢ়ার করিয়া আনিব।
| শিকারী কয়েক মাস পর পর হঠাৎ করে কোথাও থেকে আসে এ খবর আশরাফ সাহেবই দেশের খবরের কাগজগুলোর রিপোর্টারদেরকে জানিয়েছিলেন। প্রায় সব কাগজেই এই আশ্চর্য খবরটা ছাপা হয়েছিল। ফলে দেশবাসী জানে এই আশ্চর্য ঘটনার কথা।
এদিকে আশরাফ সাহেব ঘোষণা করে দেশের গোয়েন্দাদেরকে জানিয়েছিলেন যে কেউ যদি তার দুই সন্তানের সন্ধান দিতে পারেন তাহলে তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। কিংবা, কেউ যদি প্রমাণ দিয়ে জানাতে পারে শিকারী কয়েক মাস পর পর কোত্থেকে আসে তাহলে তাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।
• এই পুরস্কারের কথা শুনেই ডি কস্টা ঘন ঘন আসা যাওয়া করতে শুরু করে এ বাড়িতে। মাঝে-মধ্যেই সে আসে, চা-পানির সদ্ব্যবহার করে এবং ফেরার সময় দু’চার টাকা গাড়ি ভাড়া চেয়ে নেয় আশরাফ সাহেবের কাছ থেকে। এবং বলা বাহুল্য, সে টাকায় বাংলা মদ কিনে খায়।
‘মি, আশরাফ, প্রাইজের টেন ঠাউজেন্ট কি বড্ড কম। টাকার অ্যামাউন্টটা আরও বাড়াইয়া ডিন••।’
একজন পিয়নকে গেট পেরিয়ে হন হন করে এগিয়ে আসতে দেখে চুপ হয়ে গেল ডি..কস্টা। পিয়নটা উঠন থেকে বারান্দায় উঠল লাফ দিয়ে। বলল, স্যার, আপনার টেলিগ্রাম। উগাণ্ডা থেকে এসেছে।’
উগাণ্ডা থেকে টেলিগ্রাম!’
আশরাফ সাহেব অবাক হলেন। পিয়ন উত্তেজিত, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, বলে উঠল, “জি, হ্যাঁ। উগাণ্ডা থেকেই এসেছে। আপনার নামই তো আশরাফ সাহেব? জানি, জানি। আপনার দুই ছেলেই বেঁচে আছে, স্যার। তারা, তাদের একজন•••।’ | ছোঁ মেরে টেলিগ্রামটা কেড়ে নিল ডি, কস্টা পিয়নের হাত থেকে। দ্রুত পড়ল সে টেলিগ্রামটা। সত্যি উগাণ্ডা থেকেই এসেছে টেলিগ্রামটা। পাঠিয়েছে আশরাফ সাহেবের বড় ছেলে আবিদ।
আবিদের বক্তব্য বাংলা করলে এই রকম অর্থ দাঁড়ায়:
: “বাবা, | তোমার দোয়ায় আমরা নিরাপদে কঙ্গোর গহীন জঙ্গল থেকে উগাণ্ডার রাজধানী কাম্পালায় পৌঁছেছি। কঙ্গোর জঙ্গলেই দেখা হয় আমার সাথে সোহরাবের-হ্যাঁ, আমরা তোমার দুই ছেলেই বেঁচে আছি। আগামী রবিবার দিন সোহরাব প্লেনে উঠবে ওর স্ত্রীকে নিয়ে। আমি জেনারেল ইদি আমিনের অনুরোধে আর একবার যাব কঙ্গোয় ।
কুয়াশা ৪৫
ফিরব কাজ শেষ করে। হয়তো কিছু দিন দেরি হবে, আমার জন্য দুশ্চিন্তা কোরো না। দেশে একদিন না একদিন ফিরবই।”
টেলিগ্রামটা, পড়া শেষ করে ডি কস্টা বৃদ্ধ আশরাফ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেলো দুগালে।
আনন্দে জল বেরিয়ে আসছে আশরাফ সাহেবের দুচোখ বেয়ে। ডি, কস্টা চেঁচিয়ে উঠল, “ফর গড় সেক, ইউ আর এ লাকী ফাদার। ডিন আর, একটা সিগারেট ডিন।’
‘খবরটা তাহলে পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দিতে হয়, কি বলেন?’ রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বললেন আশরাফ সাহেব।
| ডি, কস্টা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, নো চিন্টা ডু ফুর্টি, মি. আশরাফ। হামি ঠাকিটে হাপনার ভরসা নাই, থুড়ি, হামি ঠাকিতে হাপনার কোন চিন্টা নাই। সব কাজ হামি করিয়া ডিব। ডিন, টাকা ডিন, সুইট মিট খাইব।’
। মিষ্টি খাবার টাকার জন্য হাত পেতে দিল ডি কস্টা। চার উগাণ্ডার রাজধানী কাম্পালা।
জেনারেল ইদি আমিনের প্রাসাদোপম অট্টালিকা। লোহার প্রকাণ্ড গেটের সামনে গিজ গিজ করছে সশস্ত্র মিলিটারি পুলিস। গেট খুলে গেল। দ্রুত বেজে উঠল সাইরেন।গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এল হুডখোলা দুটো মিলিটারি জীপ। জীপের উপর দাঁড়িয়ে আছে অটোমেটিক কারবাইন হাতে চারজন করে সশস্ত্র সৈনিক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাদের চোখে।
জীপ দুটোর পিছনে নীল রঙের একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ। গাড়িটার বুলেটপ্রুফ জানালার কাঁচ উঠানো। পিছনের সীটে বসে আছে নীল রঙের স্যুট পরে আবিদ এবং সোহরাব। সামনের সীটে, ড্রাইভারের পাশে একজন মিলিটারি পুলিস। তার হাতে স্টেনগান দেখা যাচ্ছে।
রাজধানীর ফাইভ স্টার হোটেল দ্যা মিরাকল-এর ভিতর ঢুকল জীপ দুটো। পিছু পিছু মার্সিডিজ।
| জীপের সশস্ত্র লোকগুলো লাফ দিয়ে নামল নিচে। হোটেলের লাউঞ্জ থেকে দ্রুত নেমে এল আরও চারজন সশস্ত্র লোক। মার্সিডিজের দরজা খোলা হলো।
ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবিদ নামল নিচে।
আবিদের দুপাশে দাঁড়াল সশস্ত্র গার্ড। সিঁড়ি বেয়ে লাউঞ্জে উঠল আবিদ। সাথে মিলিটারি পুলিস। লিফটের দিকে এগোচ্ছে ওরা।
ইতিমধ্যে মার্সিডিজ বেরিয়ে গেল সোহরাবকে নিয়ে হোটেল কম্পাউণ্ড ত্যাগ করে। নিজের বাড়ির উদ্দেশে চলেছে সোহরাব। রীতিমত চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।
১৩২।
ভলিউম ১৫
আজ রবিবার। আর একঘন্টার মধ্যে প্লেনে চড়বে সোহরাব স্ত্রীকে j•া। বাড়িটা উগাণ্ডা সরকার কিনে নিয়েছে ভালো দামে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ট্রান্সফার করে পাঠিয়ে দিয়েছে সে বাংলাদেশের ব্যাঙ্কে। ব্যবসার গুডউইলও বিক্রি হয়ে গেছে। সবই খুশির খবর।
জেনারেল ইদি আমিন দু’মণ সোনা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন প্রথম দিন। আবিদের সব শর্তই মেনে নিয়েছিলেন তিনি। ঠিক হয়েছে বিরাট একটা অভিযাত্রী দল নিয়ে আবিদ কঙ্গোর গহীন জঙ্গলে যাবে। উদ্ধার করে আনবে রহস্যপুরীর সমস্ত গুপ্তধন। আবিদ পুরস্কার স্বরূপ পাবে উদ্ধারকৃত স্বর্ণের শতকরা একভাগ।
সবই খুশির খবর। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে একটা। বিপদের ঘন কালো মেঘ কোত্থেকে যে উড়ে এল মাথার উপর!
কে এই লোক, যার নাম গ্রেট ম্যাজিশিয়ান? জেনারেল ইদি আমিনের মত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী লৌহমানবও ভয় পায় এই গ্রেট ম্যাজিশিয়ানকে। ভয় পেয়েছেন বলেই তিনি আজ সাবধানে থাকার অনুরোধ করেছেন আবিদকে। আবিদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র মিলিটারি নিয়োগ করেছেন হোটেলে, হোটেলের বাইরে।
গ্রেট ম্যাজিশিয়ানের লেখা চিঠিটা পড়ে ভয় পেয়েছে আবিদও। চিঠিটা ইদি আমিনের প্রাইভেট সেক্রেটারির নামে এসেছে। চিঠির বক্তব্য হলো : আবিদকে এঁকে দিতে হবে কঙ্গোর গভীর জঙ্গলে অবস্থিত রহস্যপুরীর নকশা। এটা গ্রেট ম্যাজিশিয়ানের আদেশ। এই আদেশ অমান্য করলে নির্মমভাবে হত্যা করা হবে আবিদকে।
সোহরাব নতুন বিপদ দেখা দেয়ায় দেশে ফিরে যেতে রাজি হয়নি এত তাড়াতাড়ি। কিন্তু আবিদ বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছে তাকে। তার বক্তব্য ও বিপদ যদি আসেই, একজনের উপর আসুক।
হোটেল মিরাকলের ফিফথ ফ্লোরের ছয়শো এগারো নম্বর রূমের বাইরে সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টার জন্যে। জেনারেল ইদি আমিন কড়া নির্দেশ দিয়েছেন–আবিদের কোনরকম শারীরিক ক্ষতি ঘটলে কারও রক্ষা থাকবে না।
কিন্তু স্বয়ং ইদি আমিনই গ্রেট ম্যাজিশিয়ানের চিঠি পেয়ে আতঙ্ক বোধ করছেন। তার ভাষায় : এই গ্রেট ম্যাজিশিয়ান পারে না এমন কাজ নেই। দিনে দুপুরে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে একা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছে সে একাধিকবার। সাত তলা বিল্ডিং থেকে লাফ মেরে রাস্তায় পড়েছে সে, কিছুই হয়নি তার, দিব্যি হাঁটতে হাঁটতে মিশে গেছে ভিড়ের মধ্যে। আবার তাকে দেখা গেছে ক’দিন পরেই রাজধানীতে। কোন কোটিপতির বাড়িতে সে হানা দিয়েছে খালি হাতে, কেড়ে নিয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ
কুয়াশা ৪৫
১৩৩
“
টাকা। জাদু জানে লোকটা। আজ পর্যন্ত কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে লোকটাকে জীবিত বা মৃত ধরে দেবার জন্য। ধরা তো দূরের কথা, কাছে পর্যন্ত ঘেষতে পারেনি কেউ। বড় ভয়ঙ্কর ক্ষমতা লোকটার। যা বলে তা পালন করে অক্ষরে অক্ষরে।
উভয় সংকট একেই বলে!
নরম কার্পেট বিছানো রূমের মেঝেতে উত্তেজিত আবে পায়চারি করতে করতে বিড় বিড় করে কথাটা বলল আবিদ। সত্যি, বিপদ, অজগর সাপের মত পেঁচিয়ে ধরতে চাইছে তাকে। জেনারেল ইদি আমিন জানিয়ে দিয়েছেন, গ্রেট ম্যাজিশিয়ানকে সে যদি রহস্যপুরীর নকশা এঁকে দেয় তাহলে চরম শাস্তি পেতে হবে তাকে মৃত্যুদণ্ড।
এদিকে গ্রেট ম্যাজিশিয়ান রহস্যপুরীর পথের সন্ধান না পেলে হুমকি দিয়েছে হত্যা করবে তাকে।
ভাবছিল আবিদ। কে এই গ্রেট ম্যাজিশিয়ান? সত্যিই কি তার ক্ষমতা জাদুকরদের মত? অনেক গল্প শুনেছে সে এই ক’দিনে। সব কি সত্যি?
গ্রেট ম্যাজিশিয়ান যে-ই হোক, ক্ষমতা তার যতই থাক, রহস্যপুরীর নকশা সে কাউকে দেবে না। জেনারেল ইদি আমিনের নির্দেশে রহস্যপুরীর স্বর্ণ উদ্ধার করতে রওনা সে হবে ঠিকই, কিন্তু উদ্ধার করার চেষ্টা সেখানে গিয়ে করবে কিনা তা এখনও ঠিক করেনি। কঙ্গোর গহীন অরণ্যে যেতে তাকে হবেই।
| লিজা রয়েছে সেখানে। তাকে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছে আবিদ। গরিলাদের বুক ফাটা আকুলকান্না দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল আবিদ রওনা হবার দিন। তার কোন কথাই তারা শুনছিল না। বুকে চাপড় মেরে গগনবিদারী শব্দে বনজঙ্গল কাঁপিয়ে তারা বিলাপ করছিল দুর্বোধ্য ভাষায়, চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল কালো লোমশ বুক।
শেষ পর্যন্ত লিজাই প্রস্তাবটা দেয়, আমি থেকে যাই। আবার তো তুমি আসবে। তখন যাব? এরা আমাদের জীবন রক্ষা করেছে–এদেরকে কাদিয়ে গেলে অমঙ্গল হবে।’
| লিজা থাকবে জানতে পেরে রফিকীর দল কান্না থামায় শেষ পর্যন্ত। ..
লিজাকে নিয়ে আসার জন্য যেতেই হবে তাকে। এবং সেখানে যেতে হলে জেনারেল ইদি আমিনের সহযোগিতা একান্ত দরকার। কিন্তু তার মানে এই নয় রহস্যপুরীতে প্রবেশ করে গুপ্তধন উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে জেনারেল ইদি আমিনের জন্য। রহস্যপুরীতে যত বড় মিলিটারি ফোর্সই পাঠানো হোক, আবিদের বিশ্বাস, সেখান থেকে ফেরা কারও পক্ষে কোনদিনই সম্ভব হবে না।
| শিকারী বসে আছে জানালার উপর। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে।
১৩৪
ভলিউম ১৫
শিকারীকে আদর করল অন্যমনস্কভাবে। নিচের দিকে তাকাল একবার। হঠাৎ তী হয়ে উঠল তার দৃষ্টি।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে হোটেলের পিছনের অংশটা দেখা যাচ্ছে। ফুলের বাগান পিছন দিকটায়।অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল আবিদ।
ঠাণ্ডা বরফের মত হয়ে গেল তার শরীর আতঙ্কে।
বাগানে দুজন মিলিটারি পুলিস হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। দুজনের বুকই ভেসে যাচ্ছে লাল রক্তে।
ঢোক গিলল আবিদ। খানিক আগে লোক দুজনকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছে ও। ইতিমধ্যে খুন করল কে ওদেরকে?
গ্রেট ম্যাজিশিয়ান?
ভয়ে হাত-পা সেঁধিয়ে যেতে চাইছে পেটের ভিতর । আসছে, আসছে গ্রেট ম্যাজিশিয়ান! মন বলছে তার। সাবধান, আবিদ? যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলো, সময় নেই হাতে, তোমার প্রাণ কেড়ে নিতে আসছে আজরাইল।
দ্রুত চিন্তা করতে লাগল আবিদ।
• হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল মাথায়। মরতে তাকে হবেই, বুঝতে আর অসুবিধে হচ্ছে
তার। মরার আগে রহস্যপুরীর সঠিক নকশা এঁকে রেখে যাওয়া দরকার। একমাত্র সেই জানে ঠিক কোথায় অবস্থিত এই রহস্যপুরী।
• তড়াক করে লাফিয়ে জানালাটা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল ‘আবিদ। দ্রুত বন্ধ করল বাকি দুটো জানালা। তারপর বাথরূমে যাবার এবং করিডরে বেরুবার দরজা দুটোয়। তালা লাগাল। টেবিলের ড্রয়ার খুলে কাগজ কলম বের করল আবিদ দ্রুত। কলম | দিয়ে আঁকতে লাগল অত্যন্ত মনোযোগের সাথে একটা ম্যাপ। ‘ প্রায় পনেরো মিনিট ধরে নকশাটা আঁকল আবিদ। নিখুঁত হয়েছে, কোন সন্দেহ
নেই। এই নকশা যার হাতে পড়বে সে-ই পৌঁছুতে পারবে রহস্যপুরীতে।
| একটা জানালা খুলে দিয়ে নকশাটা ভাঁজ করতে শুরু করল আবিদ। দুর্ভাঁজ, চারভঁজ তারপর আট ভাঁজ করল কাগজের টুকরোটাকে। সুতো দিয়ে বাঁধল সেটা। সুতোর ফাঁদ তৈরি করে সেটা গলিয়ে দিল শিকারীর গলায়।
| উজ্জ্বল হয়ে উঠল আবিদের মুখ।
‘দেশে ফিরে যাবি তুই। বাবার কাছে।
শিকারীর উদ্দেশে কথাটা বলে হঠাৎ কান খাড়া করল আবিদ। ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে এল শিরদাঁড়া বেয়ে নিচের দিকে।
খুট খাট শব্দ হচ্ছে ঠিক তার পিছনে। আস্তে আস্তে ঘাড় ফেরাল আবিদ পিছন দিকে।
হাঁ হয়ে গেল অবিদের মুখ। একি স্বপ্ন দেখছে সে? কে ওই লোক বসে রয়েছে চেয়ারে তার দিকে পিছন ফিরে? কুয়াশী ৪৫
১৩৫
‘আমি এসেছি এইমাত্র। আমি কে তা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ? কেন এসেছি। তাও জানো, তাই না?
আবিদের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। কোত্থেকে এল এই লোক? দরজায় ভিতর থেকে তালা দেয়া। জানালাগুলো সব বন্ধ একটি ছাড়া। খোলা জানালার গ্রিলও যেমন ছিল তেমনি আছে। আগে থেকে এই রূমে লুকিয়েও ছিল না। সশস্ত্র মিলিটারি পুলিসরা তার সামনে সার্চ করেছে রূমটা। তাহলে–সত্যি কি লোকটা জাদু জানে?
এতক্ষণে ঘাড় ফিরিয়ে আবিদের দিকে তাকাল গ্রেট ম্যাজিশিয়ান, কথা বলছ না যে? নকশাটা আঁকো।
হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠল আবিদ। মরতে তাকে হবেই বুঝতে পারল সে। মনে মনে প্রস্তুতও হয়ে গেল সেই মুহূর্তে। ব্যস, সব ভয় দূর হয়ে গেল মন থেকে। বলল, নকশা? সে তো একে ফেলেছি আমি।
চেয়ার ছেড়ে উত্তেজিত ভাবে উঠে পঁড়াল গ্রেট ম্যাজিশিয়ান, কোথায়! দেখি! ‘এতই সহজ? দেখি বললেই দেখাব ভেবেছেন?
তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল গ্রেট ম্যাজিশিয়ান, বড় সাহসের সাথে কথা বলছ দেখি, ছোকরা! নকশাটা কি ইতিমধ্যে পাচার করে দিয়েছ?
আবিদ বলল, না! নকশাটা এখনও এই ঘরের ভিতরই আছে। তবে যে-কোন মুহূর্তে বেরিয়ে যাবে এ ঘর থেকে। মোট কথা নকশাটা আপনার হাতে পড়ছে না।’
“ দ্রুত রূমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল গ্রেট ম্যাজিশিয়ান। শিকারীর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ হলো তার। পা বাড়াল সে দ্রুত জানালার দিকে।
‘শিকারী, উড়ে যা!
আবিদের কথা শেষ হওয়ামাত্র শিকারী জানালা গলে বেরিয়ে গেল ফুড়ুৎ করে।
হাঃ হাঃ হা করে হেসে উঠল গ্রেট ম্যাজিশিয়ান। বিকট কণ্ঠে হাসতেই থাকল সে। সারা শরীরে ভয়ের কাটা দেখা দিল আবিদের। হাসি থামিয়ে সুদর্শন গ্রেট ম্যাজিশিয়ান বলে উঠল, নকশা চলে গেল বাংলাদেশে, কেমন? তুমি এত বড় বোকা ভাবিনি। গাধার মত হলো না কি কাজটা? নকশা না হয় পাঠালে, কিন্তু নিজের ব্যবস্থা কি করলে তুমি?
| আবিদ বলে উঠল, আমি মরতে প্রস্তুত।’
‘দূর, গাধা। মারব কেন তোমাকে? তুমি মরলে তো সবই ফুরিয়ে যাবে। নকশার জনক তুমি। একটা এঁকেছ, আরেকটা আঁকতে কতক্ষণ লাগবে?
আঁকব না, কেউ আমাকে দিয়ে আর একটা নকশাও আঁকাতে পারবে না।’
আমি পারব। টরচার মেশিনের ভিতর তোমাকে ঢুকিয়ে দিলেই তুমি বাপ বাপ করে একে দেবে। শুধু রহস্যপুরীর নকশাই নয়, আমি চাইলে তুমি তোমার বাপের, সারা দুনিয়ার, স্বর্গের, নরকের নকশাও আঁকতে রাজি হবে। চলো।
কোথাও যাব না আমি।
১৩৬
ভলিউম ১৫
পা বাড়াল গ্রেট ম্যাজিশিয়ান, তুমি যেতে চাইবে না সে তো আমি জানি। জোর করে নিয়ে যাব তোমাকে। এখনও কি তুমি আমার ক্ষমতার প্রমাণ পাওনি? বন্ধ ঘরের ভিতর বাতাসের সাথে ঢুকতে পারলাম–দেখলে তো নিজের চোখেই। এখনও বুঝতে পারছ না আমার ক্ষমতা কতটুকু? ‘ দরজায় ঘনঘন করাঘাত পড়ছে।
দরজাটা খুলে দাও, আবিদ। দেখা যাক, তোমার গার্ডরা তোমাকে রক্ষা করতে পারে কি না। ভয় নেই, কিছু বলব না আমি, দরজা খোলো। তোমাকে
একটা চান্স দিচ্ছি আমি।’
| পা বাড়াল আবিদ। দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে রূমের ভিতর ঢুকল চার পাঁচজন স্টেনগানধারী সেন্ট্রি।
এই লোকটাই গ্রেট ম্যাজিশিয়ান•• ||
আবিদের কথা শেষ হবার আগেই গর্জে উঠল একযোগে চারটি স্টেনগান। সেইসাথে গগনবিদারী কণ্ঠে হাসির শব্দ উঠল রূমের ভিতর-হাঃ হাঃ হাঃ হা।
স্টেনগানের শব্দ থামল। থামল গ্রেট ম্যাজিশিয়ানের হাসির শব্দ। সে বলল, “কি হলো, আবিদ মিয়া, চান্স পেয়েও কাজ হলো না, তাই না? তোমার কপাল খারাপ! এবার দেখো, আমার রিভলভার কি সুন্দর কাজ দেখায়।
ধীরে ধীরে পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করে সেন্ট্রি চারজনের দিকে তুলল গ্রেট ম্যাজিশিয়ান।
| সেন্ট্রিরা ভীত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে গ্রেট ম্যাজিশিয়ানের দিকে। লোকটা মানুষ ভূত? একটা বুলেটও বিদ্ধ হয়নি শরীরে–এ কেমন অবিশ্বাস্য কাণ্ড!
রিভলভার গর্জে উঠল পরপর চারবার।
লুটিয়ে পড়ল চারজন সেন্ট্রি। লোহার মত শক্ত হাতে আবিদের একটা হাত ধরল গ্রেট ম্যাজিশিয়ান, চলো, মিয়া! তুম মেরা মেহমান! পাঁচ ঢাকা।
প্রখ্যাত শখের গোয়েন্দা শহীদ খানের গুলশানের বাড়ি। রাত আড়াইটা।
দোতলার সবগুলো ঘরের আলো নিভে গেছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন লীনার কামরায় লীনা। মহুয়ার বেডরূমে একা ঘুমাচ্ছে মহুয়া। শহীদ সেখানে নেই। | সন্দেশ এবং লেবু কিচেনের পাশের ঘরে শুয়ে আছে। দুইজনের নাক ডাকছে
দুই স্কেলে।
আলো জ্বলছে ড্রয়িংরূমে।
ফস্ করে দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরাল শহীদ। কিন্তু ভূতের গল্পের বইয়ের কুয়াশা ৪৫
১৩৭
• পাতা থেকে দৃষ্টি সরাল না। বইয়ের শেষ পরিচ্ছেদ এটা। দারুণ ইন্টারেস্টিং। সময়ের হিসেব ভুলে পড়ে চলেছে সে তুমুল বেগে।
| ফরফররু••!
চমকে উঠল শহীদ। মুখ তুলে তাকাল। হাসি পেল ওর। ভূতের গল্প পড়লে একটু শব্দ হলেই মানুষ চমকে ওঠে! শব্দটা তেলাপোকার। জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে দুটো তেলাপোকা।
আবার বইয়ের পাতায় চোখ রাখল শহীদ। ফরু••••ফরু••
ঘরের চারদিকে উড়ছে তেলাপোকাগুলো। বিরক্তির সাথে আবার মুখ তুলল শহীদ। ভুরু কুঁচকে উঠল ওর। আরে, এ যে অনেক তেলাপোকা।
ফররফররু••
দ্বিতীয় জানালার দিকে তাকাল শহীদ। কী আশ্চর্য! দুই জানালা দিয়েই যে তেলাপোকা ঢুকছে। তিন এবং চার নম্বর জানালার দিকেও স্বভাবতই তাকাল ঘাড় ফিরিয়ে ও।
সিগারেটটা পড়ে গেল ঠোঁট থেকে কার্পেটের উপর। সর্বনাশ! একি বিদঘুঁটে কাণ্ড! এত তেলাপোকা আসছে কোত্থেকে? ভৌতিক কাণ্ড নাকি!
রূমের চারদিকে ফরফর করে উড়ে বেড়াচ্ছে ডজন তিনেক তেলাপোকা। দেখতে দেখতে ভরে যাচ্ছে ঘর। আরও ঢুকছে। হাঁটতে হাঁটতে, উড়তে উড়তে দলে দলে, শয়ে শয়ে তেলাপোকারা আসছে রূমের ভিতর।
হঠাৎ লেবুর চিৎকার ভেসে এল অন্দরমহল থেকে, ইইই। পরমুহূর্তে শোনা গেল সন্দেশের গলা, দুদু••দুর।’ লেবু এবং সন্দেশ এরপর একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, ইঁদুর! ইঁদুর!
ব্যস্ত হয়ে উঠল শহীদ। তেলাপোকারা বসছে ওর কাঁধে, ঘাড়ে, মাথায়। পা বেয়ে উঠছে গায়ে। উড়তে উড়তে ধাক্কা খাচ্ছে ওর শরীরে। বিচ্ছিরী আঠা লেপটে যাচ্ছে ওর শরীরে।
লীনা চেঁচাচ্ছে না? হ্যাঁ, লীনার গলা। ভাবী! ভাবী! তেলাপোকা আসছে কোত্থেকে হাজারে হাজারে!
মহুয়ার আতঙ্কিত কষ্ঠস্বর ভেসে এল বেডরূম থেকে, ‘শহীদ! শুনছ তুমি? বাঁচাও বাঁচাও! শয়ে শয়ে ইঁদুর ঢুকছে ঘরের তিত, মাগো।
শোরগোল উঠল রাত দুপুরে বাড়ির সর্বত্র। হুলস্থুল কাণ্ড। বিপদের গুরুত্ব টের পেলেও হাসি দমন করতে পারল ন শহীদ। আপন মনে খানিক হাসল সে। তেলাপোকা, ইঁদুর-ব্যাপার কি? কী ধবনের উপদ্রব এসব? কেউ যেন রসিকতা। করার ইচ্ছা নিয়ে পাঠাচ্ছে।
নিভে গেল শহীদের মুখের হাসি। জানালা দিয়ে পিল পিল করে ঢুকছে ছোট
ভলিউম ১৫
ছোট লাল পিঁপড়ে। পানি যেমন গড়িয়ে পড়ে তেমনি সাদা হোয়াইট ওয়াশ করা দেয়াল বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে হাজার হাজার লাখ-লাখপিঁপড়ে।
তুমি কোথায়? শহীদ!
মহুয়া চেঁচাচ্ছে। সেই সাথে ভেসে আসছে পাশের ঘরগুলো থেকে চেয়ার টেবিল উল্টে পড়ার শব্দ।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল শহীদ সোফা ছেড়ে। ক্রেডল থেকে তুলে নিল রিসিভারটা। অতি পরিচিত নাম্বারে ডায়াল করল দ্রুত। তারপর বলল, কামাল! উই আর ইন ডেঞ্জার। এক্ষুণি চলে আয় বাড়িতে।
কামালকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই রিসিভার নামিয়ে রাখল শহীদ। দরজা খুলে ফেলল ও। সাথে সাথে পিছিয়ে এল দু’পা। নেংটি ইঁদুর গণ্ডা চার-পাঁচ লাফাতে লাফাতে করিডর থেকে ঢুকে পড়ল ড্রয়িংরূমের ভিতর।
রসিকতা, কোন সন্দেহ নেই, ভাবল শহীদ। কিন্তু রসহীন রসিকতা, স্বীকার করতেই হবে। করিডর ধরে ছুটল ও।
বেডরূমের দরজা খোলাই ছিল। ভিতরে ঢুকে শহীদ দেখল মহুয়া দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের উপর। মেঝেতে ছুটোছুটি করছে নেংটি ইঁদুরগুলো। ফররু•••ফররু••• করে উড়ছে চারদিকে তেলাপোকার দল।
লাফ দিয়ে পড়ল মহুয়া। তাল সামলাতে না পারলে পড়ে যেত ওরা দুজনেই কার্পেটের উপর। শূন্য থেকেই মহুয়াকে ধরে ফেলল শহীদ।
তারস্বরে চিৎকার করছে মহুয়া। আঁকড়ে ধরেছে শহীদকে দুই হাত দিয়ে। শহীদ ধমকে উঠল, থামোঅমন চেঁচালে লাভ হবে কিছু?
শহীদ কিন্তু আর হাসছে না। রীতিমত গভীর দেখাচ্ছে ওকে।
‘লীনা চেঁচাচ্ছে!’ বলে উঠা মহুয়া হাঁপাতে হাঁপাতে। শহীদ মহুয়াকে তুলে দিল আবার টেবিলের উপর। আসছি বলে বেরিয়ে গেল ও রূম থেকে।
করিডরে বেরিয়ে শহীদ দেখল ঝাড়ু হাতে তেলাপোকা মারতে মারতে লেবু আর সন্দেশ ছুটে আসছে।
‘দা-দা-দা-দাদা–’ ‘ম-ম-মণি!’
শহীদ বলল, “ছাদে গিয়ে ওঠ সবাই তোরা। লীনা দরজা খুলে তীর বেগে ছুটে আসছে শহীদের দিকে। “থাম, থাম। পড়ে যাবি যে।
শহীদ লীনাকে ধরে ফেলল। হাঁপাচ্ছে লীনা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘পিঁপড়েও•••!’।
মহুয়াকে নিয়ে এল শহীদ। করিডরেও তেলাপোকা উড়ছে, ইঁদুর ছুটোছুটি–ছে। পিঁপড়ে অবশ্য নেই। সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে ওরা।
কুয়াশা ৪৫
১৩৯
কয়েকটা ধাপ টপকে থমকে দাঁড়াল শহীদ।
মাগো!
চেঁচিয়ে উঠল গালে হাত চাপা দিয়ে মহুয়া। দু’চোখে তার আতঙ্ক। লীনা জড়িয়ে ধরল মহুয়াকে, ভাবী-বাড়ি ছেড়ে পালাই চলো।’’
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে লাখ লাখ পিঁপড়ে।
পিছিয়ে এল শহীদ। বলল, ‘মহুয়া, সাহস হারিয়ো না। তোমরা সবাই নিচে নেমে গ্যারেজের দিকে ছোটো। গাড়িটা বের করা হয়তো সম্ভব এখনও। কামালের বাড়িতে চলে যাও সবাই। যাও, দেরি কোরো না।
ছুটল সবাই করিডর ধরে সিঁড়ির দিকে। ‘
দ্রুত ফিরে এল শহীদ ড্রয়িংরূমে। কার্পেটের উপর পিঁপড়ের সমুদ্র তৈরি হয়ে গেছে। লাফ মেরে একটা সোফায় উঠল ও। ক্রেল থেকে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে ডায়াল করল নিকটবর্তী দমকল বাহিনীর অফিসে।
| ড্রয়িংরূম থেকে বেরিয়ে ছুটল শহীদ। নিচে নেমে বেরিয়ে এল বাড়ির সামনের উঠনে। সাঁ করে বেরিয়ে গেল খোলা গেট দিয়ে ওর ফোক্সওয়াগেনটা।
তিন মিনিট পর সেই খোলা গেট দিয়েই ঢুকল একটা মোটর সাইকেল। স্টার্ট বন্ধ করে দ্রুত নামল কামাল। উঠনে শহীদের পাশে এসে দাঁড়াল সে, কি ব্যাপার? মহুয়াদি ওদেরকে নিয়ে গেল কোথায় এত রাতে?’.
‘পালাল, তোর ওখানে। কামাল অবাক, পালাল মানে? হেঁয়ালি করছিল রাত দুপুরে?
শহীদ বলল, “আমাদের ওপরতলা শত্রু কবলিত। পিঁপড়ে বাহিনী, কয়েক ব্রিগেড তেলাপোকা, দশ কিংবা পনেরো ব্যাটালিয়ান ইঁদুর একযোগে আক্রমণ করছে। বিশ্বাস না হয়, আয় আমার সাথে। নিজের চোখেই দেখবি। | সিঁড়ির উদ্দেশে পা বাড়াল শহীদ। কামাল অনুসরণ করল তাকে। দোতলার: আলোকিত করিডরে পা দিয়েই আঁতকে উঠল কামাল, একি কাণ্ড!
* করিডরে পিঁপড়েদের ডোজনপর্ব শুরু হয়েছে। আহত এবং নিহত তেলাপোকাদের উপর চড়াও হয়েছে পিঁপড়ে বাহিনী। হাজারে হাজারে দলবদ্ধ ভাবে তারা তেলাপোকাদের পা কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে চলেছে নানাদিকে । মেঝেতে, দেয়ালে এই একই দৃশ্য। অবশ্য মাথার উপর ফ•••ফর করে উড়ে বেড়াচ্ছে এখনও অসংখ্য তেলাপোকা।
নিচ থেকে ঢং ঢং শব্দ ভেসে এল। দমকলবাহিনীর গাড়ি এল। আবার নিয়ে নেমে এল শহীদ এবং কামাল। দমকল অফিসারকে সমস্যাটা বুঝিয়ে দিতে যা দেরি, কর্মীবাহিনী নিয়ে তিনি কাজে নেমে পড়লেন। পানির পাইপ সিঁড়ি দিয়ে তুলতে শুরু করল কর্মীরা দোতলায়।
কামাল হেলান দিয়ে দাঁড়াল তার মটরসাইকেলে। শহীদ ধীরে-সুস্থে পায়চারি
ভলিউম ১৫
১৪
করছে।
এই বিদঘুঁটে ঘটনার তাৎপর্য কি তাহলে? শহীদ দাঁড়াল। বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
চিন্তিত দেখাচ্ছে ওদের দুজনকে। খানিক পর শহীদ বলল, “খুবই রহস্যময় ব্যাপার। দু’চারজন মানুষের পক্ষে এত ইঁদুর, এত তেলাপোকা, এত পিঁপড়ে নিয়ে এসে বাড়ির দোতলায় ছেড়ে দেয়া সম্ভব নয়। বিশ-পঁচিশজন মানুষের পক্ষেও সম্ভব কিনা সন্দেহ। আমি তো জেগেই ছিলাম। ছাদে বা সিঁড়িতে কেউ এলে শব্দ পেতাম।’
কামাল বলল, ‘ভৌতিক ব্যাপার দেখছি!
দমকলবাহিনী সফলতার সাথে দোতলা থেকে শত্রুর বংশ বিংস করে দিয়ে চলে গেছে ভোর পাঁচটায়।
মহুয়ারা ফিরে এসেছে সাড়ে ছয়টায়। ব্রেকফাস্ট সেরে কামাল এবং শহীদ ড্রয়িংরুমে বসে আছে। দুজনেই চিন্তামগ্ন।
এমন সময় ঝড়ো কাকের মত চেহারা নিয়ে ড্রয়িংরূমে প্রবেশ করলেন মি. সিম্পসন। বললেন, হ্যালো, শহীদ। চিন্তিত মনে হচ্ছে তোমাদেরকে?
‘আপনি কোত্থেকে খবর পেলেন,’ জানতে চাইল কামাল।
ধপ করে একটা সোফায় বসলেন মি. সিম্পসন। বললেন, “কিসের খবর? আমি এলাম উর্বশী গ্রাম থেকে। সারারাত ছুটোছুটি করেছি গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি।
কেন?’
কুয়াশা উর্বশী গ্রামের গরীব মানুষদের সাহায্য দেবে রাতের বেলা গোপনসূত্রে এই খবর পেয়ে দলবল নিয়ে গিয়েছিলাম।’
সাহায্য দিয়েছে কুয়াশা?”
হ্যাঁ। দুশো করে টাকা, একমণ করে চাল পেয়েছে প্রতিটি পরিবার। কিন্তু। কোথাও তার বা তার দলের টিকিটিও দেখতে পেলাম না। যেখানে যাই, শুনি এইমাত্র সাহায্য দিয়ে সে অমুক দিকে চলে গেছে। আবার ছুটি। কিন্তু ছোটাছুটিই সার, কাজ হলো না। তা কিসের খবরের কথা বললে তুমি, কামাল?’।
শহীদ সবিস্তারে গতরাতের ঘটনা বলল। এ ঠিক সেই ডি. কস্টার কাজ।
মানে? ডি. কস্টাকে সন্দেহ হচ্ছে কেন আপনার?’ | মি. সিম্পসন বললেন, চার-পাঁচদিন আগে একটা ভ্যান নিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম আমি তাকে। অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল তার ভ্যান। ভ্যানে ছিল অনেকগুলো কাঠের বাক্স। একটা বাক্স পড়ে গিয়েছিল রাস্তার উপর। সেটা থেকে বেরিয়ে আসছিল অসংখ্য তেলাপোকা।
কুয়াশা ৪৫
১৪১
“কি সাংঘাতিক! ডি. কস্টা বড্ড বেড়ে গেছে দেখছি!’ কামাল খেপে উঠল।
শহীদ বলল, মাথা গরম করিসনে। ডি.কস্টার সাহস বা বুদ্ধি অতটা নেই, কামাল।
| কামাল বলল, “ডি. কস্টা তাহলে তেলাপোকার বাক্স নিয়ে।
| শহীদ বলল, আমার বিশ্বাস, ডি, কস্টাকে জেরা করলে কিছু তথ্য সে দিতে পারবে। তার বেশি তার কাছ থেকে আশা করা বৃথা। আমার আরও কি বিশ্বাস জানিস? কিছু তথ্য আমরা পাৰ ছাদ থেকে। আমি লক্ষ্য করেছি ইঁদুর, তেলাপোকা এবং পিঁপড়েগুলো নেমে এসেছে দেয়াল বা সিঁড়ি বেয়ে ছাদ থেকেই।’
| এতক্ষণ বলিসনি কেন! চল তাহলে, ছাদটা পরীক্ষা করে আসি।’ | সাগ্রহে উঠে দাঁড়ালেন কামালের সাথে মি. সিম্পসনও, চলো তো দেখা যাক।
এমন সময় ফোন বেজে উঠল। রিসিভার কানে তুলল শহীদ। এক মুহূর্ত পর সে রিসিভারটা এগিয়ে ধরল মি. সিম্পসনের দিকে, আপনার ফোন। আপনি এখানে আছেন কিনা জানতে চাইছে ইন্সপেক্টর জেনারেল অভ পুলিসের সেক্রেটারি। | রিসিভার কানে ঠেকিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মি. সিম্পন্ন।
সিগারেট ধরাল শহীদ।
শহীদ, দুঃখিত। তোমাদের সাথে ছাদে যেতে পারছি না আমি। ইন্সপেক্টর জেনারেল এই মুহূর্তে দেখা করতে বললেন আমাকে। জেনারেল ইদি আমিনের একটা মেসেজ এসেছে প্রেসিডেন্টের কাছে। সেই মেসেজ সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি আলাপ করতে চান।
জেনারেল ইদি আমিনের মেসেজ?’
ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল শহীদ। তারপর বলল, এডভোকেট আশরাফ, উদ্দীনের দুই ছেলের এক ছেলে-কি যেন নাম-হ্যাঁ, সোহরাবের না গতকাল প্লেনে চড়ার কথা?
মি. সিম্পসন বললেন, হ্যাঁ। আজ দুপুরে ল্যাণ্ড করার কথা সেই প্লেন ঢাকা এয়ারপোর্টে। বেলা একটায়।
ঘড়ি দেখল শহীদ। দশটা বাজে।
কামাল বলল, সোহরাবের আগেই এল জেনারেল ইদি আমিনের মেসেজ। মেসেজটা কি পলিটিক্যাল, না, আবিদ সোহরাব দুই ভাই সংক্রান্ত?
মি. সিম্পসন বললেন, সে কথা জানাবার জন্যই ডাকা হয়েছে আমাকে। চলি, শহীদ। খবর দেব সুযোগ হলেই।’
ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন মি. সিম্পসন দ্রুত। ও কামাল বলল, চল, শহীদ, ছাদে যাই।’ | শহীদ চিন্তিতভাবে বলল, চল।’ ১৪২
ভলিউম ১৫
–
–
–
–
–
ছাদে উঠে এল ওরা। সিঁড়ির শেষ পাপ দুটোর উপরে একটা কাঠের মাচা আছে অনেক দিন থেকে। সেই মাচায় টুকিটাকি ব্যবহারের অযোগ্য বহু জিনিস ফেলে রাখা হয়েছে। ছাদে গিয়েও কি মনে করে ফিরে এসে সিঁড়ির উপরের সেই মাচায় উঠল শহীদ। কামাল ছাদে গিয়ে চারদিক দেখে নিল ভাল করে। তার পর প্রকাণ্ড ছাদটার এক প্রান্ত থেকে হাঁটতে শুরু করল। পরিষ্কার ছাদ। কোথাও কিছু নেই। কৃথা খোঁজাখুঁজি। পুরো ছাদটা চক্কর মেরে সিঁড়ির কাছে ফিরে এল সে।
শহীদ তখন মাচা থেকে নামছে। কামাল বলে উঠল, ‘কিছুই তো নেই রে.••।’
শহীদের হাতে অদ্ভুত ধরনের একটা যন্ত্রের মত জিনিস দেখে মাঝপথে থেমে গেল কামাল।
“কি রে ওটা?
জিনিসটা অনেকটা ছোট আকারের ছাতা বা টেবিল ল্যাম্পের শেডের মত দেখতে। ধাতব পদার্থের তৈরি মূল্যবান কোন যন্ত্র। চকচক করছে গা। দেখলেই বোঝা যায় জিনিসটা ভারী। আটটা ইস্পাতের সরু শিক বেরিয়ে এসেছে বাইরে যন্ত্রটার ভিতর থেকে। যন্ত্রটার গায়ে হাঁটছে বেশ কয়েকটা পিঁপড়ে।
‘এটা পেলাম মাচার উপর। একটা চটের ভেঁড়া বস্তার ভেতর কেউ লুকিয়ে রেখেছিল।
কামাল বলল, হ্যাঁ। কিন্তু ওটা কি? এল কোত্থেকে?
কি, কোত্থেকে এল তা কি এই মুহূর্তে বলা সম্ভব? তবে শক্র বাহিনী অর্থাৎ ইঁদুর, পিঁপড়ে, তেলাপোকার আগমনের সাথে এই যন্ত্রের কোন না কোন সম্পর্ক থাকতে পারে।’
বলিস কি! কিন্তু শহীদ আর কোন কথা বলল না। ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে।
নেমে এসে বসল ওরা ড্রয়িংরূমে। খানিক পরই মি, সিম্পসনের ফোন এল। তিনি বললেন, শহীদ, বিপদ দেখা দিয়েছে। জেনারেল ইদি আমিনের মেসেজ সম্পর্কে আমরা তোমার সাথে এখুনি আলোচনায় বসতে চাই। তুমি এখুনি চলে এসো ইন্সপেক্টর জেনারেলের অফিসে। আর শোনো, তোমার বাড়িতে ইঁদুর পিঁপড়ের উপদ্রবের কথা শুনে আমার কেন যেন সন্দেহ হয়েছিল এ কাজ সেই শয়তান প্রফেসর ওয়াই-এর ছাড়া আর কারও না। কিন্তু এখানে এসে জেনারেল ইদি আমিনের মেসেজ পড়েভুল ভেঙে গেছে আমার। উপদ্রবের কারণ শয়তান প্রফেসর ওয়াই নয়। কারণ সে এই মুহূর্তে উগাণ্ডার রাজধানী কাম্পালায় তেলেসমাতি কাণ্ডকারখানা করে বেড়াচ্ছে। সব কথা তোমার জানা দরকার। চলে এসো এখুনি।
রিসিভার নামিয়ে রাখল শহীদ। সব কথা কামালকে জানাল ও। কামাল বলল,
কুয়াশা ৪৫
১৪৩
‘আমার সন্দেহ ডি কস্টা অনেক কথা জানে এই পোকা-মাকড় পাঠাবার ব্যাপারে। হয়তো তারই কীর্তি এসব। শহীদ, যন্ত্রটা আমাকে দে। আমি ডি. কস্টার হোটেলে একবার যাই ওটা নিয়ে।’
বাড়ি থেকে বেরুল ওরা। দুজন রওনা হলো দু’দিকে।
‘এত টাকা তুমি পেলে কোথায় মি. ডি কস্টা?
‘ফের টুমি? গর্জে উঠল ডি. কস্টা।
সরি। এত টাকা কোথায় পেলেন আপনি? দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করল মান্নান। | ডি. কস্টা টাকা ভর্তি ব্রিফকেসটা কাত করতে করতে বলল, “বিজনেস করিয়া আর্ন করিয়াছি।
কি বিজনেস?
‘সেটা আমার বিজনেস সিক্রেট! কাহাকেও বলিটে পারি না। ওসব কঠা ঠাক, ডোস্ট। এসো, ড্রিঙ্ক করি। বিলাতী মাল আছে। ওয়েট, বের করিটেছি।’
ওয়াল ক্যাবিনেট খুলে দুটো গ্লাস এবং একটি জনিওয়াকারের বোতল বের করে আনল ডি. কস্টা। নিচু টেবিলের উপর গ্লাস দুটো রাখল।ছিপি মুক্ত করে বোতল থেকে মদ ঢালল অতি যত্ন সহকারে।
‘পান করো, মি. মান্নান। এমোন চান্স আর কোঠাও পাইবে না।
এমন সময় দরজার গায়ে টোকা পড়ল।
ডি. কস্টাকে হোটেলে থাকার নির্দেশ দিয়েছে কুয়াশা বেশ কিছুদিন হলো। মি. সিম্পসন এবং তার বাহিনী নতুন করে পূর্ণ উদ্যম নিয়ে আবার কুয়াশার পিছনে লাগায় কুয়াশা এই ব্যবস্থা নিয়েছে। ডি, কস্টা বা তার অন্য সব সহকারীকে অনুসরণ করে মি. সিম্পসন যাতে তার কোন আস্তানার সন্ধান পাবার চেষ্টা না করেন তার জন্যই এই ব্যবস্থা। কুয়াশা তার সহকারীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে টেলিফোন বা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে।
কে? হু ইজ দেয়ার?” বাইরে থেকে কামালের গলা ভেসে এল, “দরজাটা খোলো, ডিকস্টা।’
ডি, কস্টা একটু গম্ভীর হলো। বিড় বিড় করে বলল, আপড আসিয়াছে। মি. মান্নান, দরজাটা খুলিয়া ডাও, ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড!
দরজা খুলে দিল মান্নান। কামালকে দেখে ডি, কস্টা আনন্দে আত্মহারা হবার ভান করল। সহাস্যে বলল, হোয়াট এ লাকী পারসন আই অ্যাম! নিজের গুডলাক ডেখিয়া নিজেরই হিংসা হইটেছে। তা মহারথীর কি হেটু আগমন? আসুন, সীট ডাউন, মি. কামাল, অ্যাসিস্ট্যান্ট অব দা গ্রেট ডিটেকটিভ মি. শহীদ খান•••।
কামাল বলল, “থামো, ডি. কস্টা। তোমার বোয়াল মাছের মুখটা বন্ধ করো একবার।
১৪৪
ভলিউম ১৫
কামাল বসল একটা চেয়ারে।
ইনসালটিং কঠা বলবেন না, মি. কামাল। হামার মাউথ বোয়াল মাছের মটো নয়। ডি. কস্টা গঞ্জর।
কামাল বলল, আচ্ছা, আচ্ছা। কাজের কথায় এসে দেখি। কোথায় যাচ্ছিলে সেদিন ভ্যানে তেলাপোকার বাক্স নিয়ে? অস্বীকার কোরো না ডি কস্টা। তাতে ফল ভাল হবে না। আমি সব জানি।
| কামাল হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রাখল পায়ের কাছে।
‘অস্বীকার করিব কোন দুঃখে? পিপড়া, আরশুলা লইয়া হামি বিজনেস করি। ইডুর লইয়া হামি বিজনেস করি। সাপ, পয়জনাল স্নেক লইয়া হামি বিজনেস করি। অস্বীকার করিবার কি ঠাকিটে পারে, মি. কামাল?
কামাল বলল, ব্যবসা করো? কোত্থেকে সংগ্রহ করো ওসব? কে কেনে, মানে, কার কাছে বিক্রি করো তুমি?
– ‘টা বলিটে রাজি নই। বিজনেস সিক্রেট।
ডি. কস্টার কথা শেষ হবার সাথে সাথে উপর থেকে থপ থপ শব্দে দুটো কুচকুচে কালো সাপ পড়ল মেঝেতে।
মাই গড! চেঁচিয়ে উঠল ডি. কস্টা। ভয়ে কেঁপে উঠল কামাল। মান্নান দুর্বোধ্য স্বরে কি যেন বলল, তারপর চেয়ার উল্টে লাফ দিল বিছানার দিকে।
কামাল উঠে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে চেয়ার ছেড়ে। সাপ দুটো কেউটে, দেখেই বুঝেছে সে। এঁকে বেঁকে সরসর করে খাটের নিচে গিয়ে ঢুকছে।
চোখের পলকে ঘটল আর এক কাণ্ড।
আর্তনাদ করে উঠল ডি. কস্টা। বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ফিরিয়ে কামাল তার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
ডি. কস্টার কোলের উপর পড়েছে উপর থেকে আর একটা সাপ! ফণা তুলে ধরেছে সাপটা ডি. কস্টার মুখের সামনে।
হাঁ করে বিকট স্বরে চেঁচাচ্ছে ডি, কস্টা।
মদের বোতলটা হাতে নিয়ে সাপটাকে আঘাত করার জন্য সেটা উপর দিকে তুলল কামাল। কিন্তু তার আগেই যা হবার হয়ে গেল।
ছোবল মারল কেউটে ডি. কস্টার ডান দিকের গালে। ক্ষতস্থান থেকে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছে।
বোতল দিয়ে আঘাত করল কামাল। সাপটা ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে। এঁকে বেঁকে দ্রুত সোফার নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল সেটা।
| চোখ বুজে চেঁচাচ্ছিল ডি. কস্টা। চোখ খুলে সাপ নেই দেখে কাঁপতে কাঁপতে সিধে হয়ে দাঁড়াল সে। দিশেহারার মত কোনদিকে যাবে ঠিক করতে পারছে না। তার ধাক্কায় উল্টে পড়ল গ্লাস সহ টেবিলটা। ১০-কুয়াশা ৪৫
১৪৫
আতঙ্কিত দৃষ্টিতে কামাল এবং মান্নান চেয়ে আছে। কেউটের কামড় খেয়েছে ডি, কস্টা । মৃত্যু অনিবার্য। কেউটের কামড় খেয়ে কেউ বাঁচেনি আজ পর্যন্ত।
‘মি. কামাল! হামাকে ঢরুন। হামাকে বাইরে নিয়ে চলুন–প্লীজ! প্রমিজ । করিটেছি সব কঠা স্বীকার করিব।
মান্নান বলল, কামাল ভাই, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ওকে এখুনি।’ হাসপাটালে? কেন, হাসপাটালে যাইটে হইবে কেন? আপনাকে সাপে কামড়েছে।’ আই নো, আই নো। বাট বিষ নাই! নো পয়জন! কামাল অবাক হয়ে বলল, “বিষ নেই মানে? তুমি জানলে কিভাবে?’ | ডি কস্টা করুণ, মিনতিভরা গলায় বলল, “সব কঠা বলিব। ডয়া করিয়া আপনি হামাকে এই রূম হইটে••।’
ভীড় জমে গিয়েছিল রূমের বাইরে। কামাল সকলকে সাবধান করে দিয়ে বলল, কেউ থাকবেন না আশেপাশে! ঘরের ভিতর তিনটে বিষাক্ত সাপ আছে।’
কেটে পড়ল সবাই। ঘর থেকে বাইরে এসে ডি, কস্টা নামল মান্নানের কাঁধ থেকে। ছুটে এল হোটেলের ম্যানেজার খবর পেয়ে। সংক্ষেপে সব ঘটনা শোনার : পর সেকেণ্ড ফ্লোরের একটা রূম খুলে দিলেন তিনি। যাবার সময় বলে গেলেন, সাপ ধরার জন্য ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন।
বেয়ারা এল ডি. কস্টার জন্য ব্র্যাণ্ডি নিয়ে। গ্লাসটা এক নিশ্বাসে শেষ করল সে। কামাল বলল, আমার হাতে সময় নেই। যা বলবার বলো তাড়াতাড়ি। কোত্থেকে এল তোমার ঘরে সাপগুলো?’
কোঠা হটে আসিয়াছে টা বলিটে পারি না। টবে, এই সাপগুলোই যে আমি গত পরশুদিন সাপ্লাই ডিয়াছি টাহাটে কোন সহে নাই।
| সাপ্লাই দিয়েছ? কাকে?
ডি, কস্টা বলল, ঠম থেকে স্টার্ট করি। এক ভদ্রলোক আমাকে অড সব জিনিস সাপ্লাই ডিবার প্রস্তাব ডেয়। টেলাপোকা, ইডুর, সাপ, পিপড়া এইসব। সেই লোকের নাম জানি না হামি। ঠিকানাও জানিনা। ভ্যানটা সেই লোকেরই। হামি টাহাকে এক এক ডিন এক এক আইটেম সহ ভ্যানটা ডিয়া আসি রমনা পার্কের পিছনের রোডে। সে আমাকে টাকা ডিয়া ভ্যান লইয়া চলিয়া যায়, সম্ভবট টু হেল।
লোকটার চেহারার বর্ণনা দাও। ‘গাট্টাগোট্টা, মেজাজ খাট্টা, গালে দাগ, কপাল কাটা•••।’
বয়স?” ‘থাটি-ফোরটি।’
কতদিন থেকে এই সাপ্লাইয়ের কাজ করছ তুমি?
ডি. কস্টা বলল, ‘ডশ-পনেরো ডিন।
১৪৬
ভলিউম ১৫
কামাল, একটু চিন্তা করল। তারপর জানতে চাইল, তোমার ঘরে সাপগুলো এল কেমন করে?
ডি. কস্টা চোখ বড় বড় করে ঢোক গিলল, সেটাই টো ভেরি আশ্চর্যের কঠা । কিছুই বুঝিটে পারিটেছি না!’
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে জেরা করল ডি. কস্টাকে কামাল। কিন্তু কোন নতুন তথ্যই সে যোগ করতে পারল না। | কামাল যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, এমন সময় হোটেলের ম্যানেজার ঢুকল রূমের ভিতর। তার হাতে আটটা মরা পাখি। পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে কামাল বুঝতে পারল, ওগুলো বাজপাখি।
কোথায় পেলেন এগুলো?’
ম্যানেজার বলল, “মি. স্যানন ডি, কস্টার রূমের মেঝেতে পড়ে রয়েছে দেখলাম। সাপগুলোকে মেরে ফেলার পর আমি ঘরে গিয়ে সব ঠিক আছে কিনা দেখছিলাম। এমন সময় উপর দিক থেকে ঝপ ঝপ করে পড়ল এই মরা পাখিগুলো । ভৌতিক কাণ্ড, সাহেব।’
দেখি, দেখি! আপনার ডান হাতের একটা পাখির গলায় কি ঝুলছে ওটা? কাগজ না? সুতো দিয়ে বাধা কাগজই তো মনে হচ্ছে।’
ম্যানেজারও এতক্ষণে দেখতে পেয়েছে জিনিসটা, “আরেহা, তাই তো!’
সুতো ছিঁড়ে কাগজের টুকরোটা কামালের হাতে দিল ম্যানেজার। ভাঁজ করা কাগজের টুকরো একটা। ভাঁজ খুলতেই কামাল দেখল কয়েকটা লাইন লেখা রয়েছে: শখের টিকটিকি শহীদ খান, সাবধান! গোয়েন্দাগিরি ছাড়ো!’
হাতের লেখাটা চিনতে পারল কামাল। অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে | লেখার দিকে।
“শিকারীকে তোমরা পাবে না। বাংলাদেশের গোটা পশ্চিমাঞ্চল আমার রাডারের আওতায় এনেছি আমি। কোন বাজপাখি আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে পারবে না। প্রতিটি পাখিকেই আমি ধরব। আজ যে-কটা ধরা পড়েছে সে কটা তোমার কাছে পাঠালাম।” ।
| ডি. কস্টার সাথে আরও দশ মিনিট ধরে কথা বলে শহীদের বাড়িতে চলে এল কামাল। এসে শুনল শহীদ তখনও ফিরে আসেনি।
শহীদ ফিরল বেলা আড়াইটার সময়। সবিস্তারে সব ঘটনা বলল কামাল। কিন্তু শহীদকোনমন্তব্য করা থেকে বিরত রইল।
কামাল জিজ্ঞেস করল, তোর খবর কি? কি লিখেছে জেনারেল ইদি আমিন, মেসেজে?’..
শহীদ বলল, কাম্পালায় অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। রবিবার দিন অর্থাৎ গতকাল যথাসময়ে সোহরাব প্লেনে চড়ে। প্লেন টেক অফ করার খানিক পরই গ্রেট
কুয়াশা ৪৫
১৪৭
ম্যাজিশিয়ান নামে এক ভয়ঙ্কর লোক আবিদকে বন্দী করে নিয়ে যায় তার হোটেল থেকে।’
কারণ?
কারণ আবিদ কঙ্গোর দুর্গম জঙ্গলের কোথাও নাকি হাজার হাজার মণ সোনা অর্থাৎ গুপ্তধন দেখে এসেছে। কঙ্গোর গভীর জঙ্গলের কোথাও যে, বিশাল এক গুপ্তধনের ভাণ্ডার জমা হয়ে আছে তা অনেকেই জানে, যেমন আমিও জানি। কিন্তু গুপ্তধনের সঠিক অবস্থান কারও জানা নেই। একমাত্র আফ্রিকার অসভ্য আদিবাসীরা নাকি সেই গুপ্তধনের ঠিকানা জানে। সভ্য জগতের মানুষদের মধ্যে জানে একমাত্র আবিদ। আবিদকে গ্রেট ম্যাজিশিয়ান তাই বন্দী করে নিয়ে গেছে। কিন্তু বন্দী হবার আগে আবিদ একটা কাজের মত কাজ করেছে অবশ্য।
“কি কাজ?’
‘শিকারী, বাজপাখিটার কথা মনে আছে তো? আবিদ একটা নকশা এঁকে বাজপাখিটার গলায় বেঁধে দিয়েছে।’
| ‘অদ্ভুত। তারপর? ‘ জেনারেল ইদি আমিন মেসেজে বলতে চাইছেন যে আবিদ বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করলেও সে উগাণ্ডার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। সেই হিসেবে নকশাটা উগাণ্ডা সরকারের সম্পত্তি। জেনারেলের বিশ্বাস শিকারী বাংলাদেশের উদ্দেশে উড়ে আসছে। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছেন, পাখিটার নিরাপত্তা বিধানের জন্য এক পাখিটার কাছ থেকে নকশাটা উদ্ধার করে উগাণ্ডা সরকারের হাতে তুলে দেয়ার জন্য।’
গ্রেট ম্যাজিশিয়ান লোকটা কে?’
শহীদকে অস্বাভাবিক গম্ভীর দেখাল। বলল, কে আবার, আমাদের প্রফেসর ওয়াই স্বয়ং, গ্রেট ম্যাজিশিয়ান হিসেবে পরিচিত উগাণ্ডায়।’
কামাল বলল, “ডি, কস্টার ঘরে বাজপাখিদের সাথে যে চিঠিটা পাওয়া গেছে সেটা দেখে তোর মনে হচ্ছে না হাতের লেখাটা প্রফেসর ওয়াই-এর?
মনে হবে কেন? হলপ করে বলতে পারি প্রফেসর ওয়াই-এর হাতের লেখা এটা।’
তার মানে সে এখন ঢাকায়?’ শহীদ চিন্তিত ভাবে বলল, হ্যাঁ।’ কামাল জানতে চাইল, সোহরাব পৌঁছেছে?
‘হ্যাঁ। স্ত্রী দুই ছেলেকে নিয়ে বেলা একটার সময় পৌঁছেছে সে। আমি মি. সিম্পসনের সাথে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে। ওখান থেকে ওদের সাথে এডভোকেট
আশরাফ সাহেবের বাড়িতে যাই। সোহরাবের সাথে দীর্ঘ আলাপ করেছি।’
ইন্সপেক্টর জেনারেল কি বললেন?
১৪৮
ভলিউম ১৫
কেসটা নিতে বললেন আমাকে। নিয়ে দু। কিন্তু এখন দেখছি ভুল করেছি নিয়ে।
কেন, ভুল করেছিস মনে হচ্ছে কেন?
শহীদ বলল, ‘দর্শক হওয়া ছাড়া আমাদের করার কিছু আছে কি? প্রফেসর ওয়াই-এর রাডার প্রতি সেকেণ্ড লক্ষ রাখছে পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে কোনও বাজপাখি দেশের সীমানা অতিক্রম করছে কিনা। বাজপাখি দেখলেই সে ভ্যানিসিং রে না। কসমিক রে ব্যবহার করে হয় পাখিটাকে খুন করবে নয়ত গায়েব করে দেবে। বাতাসের সাথে। কি করতে পারব আমরা?’
কামাল জানতে চাইল, আবিদকে বন্দী করেছে বলছিস। সেক্ষেত্রে আবিদের সাহায্যেই তো সে গুপ্তধনের সন্ধান পেতে পারে। নকশার পিছনে উঠে পড়ে লেগেছে কেন আবার?
আমার মনে হয় প্রফেসর ওয়াই আসলে ভয় করছে কুয়াশাকে। কুয়াশার হাতে যদি নকশাটা পড়ে তাহলে সে-ও গুপ্তধন উদ্ধার করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করবে। প্রফেসর ওয়াই তা চায় না। কুয়াশাকে সে রীতিমত ভয় করে।
কামাল খানিক পর জানতে চাইল, কিন্তু ইঁদুর, তেলাপোকা, পিঁপড়ে–এসবের কি অর্থ?
স্রেফ আমাদের বিরক্ত করার জন্য প্রফেসর ওয়াইয়ের রসিকতা ওগুলো। তাছাড়া কিছু নয়। জানিসই তো, লোকটা আসলে বদ্ধ উন্মাদ।’
‘কিন্তু এগুলো আসছে কিভাবে? ডি. কস্টার ঘরের ছাদে ফুটো নেই, গর্ত নেই, ফাটল নেই অথচ উপর দিক থেকে পড়ল সাপগুলো•••
শহীদ বলল, “সিঁড়ির মাচা থেকে যে যন্ত্রটা পেয়েছি ওটা এক ধরনের রিসিভিং সেটই, এখন আমি এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। এর বেশি জানি না আমি।’
আশ্চর্য! শহীদ বলল, তারচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানিস?’
কি?
গতকাল রাতেও দেখা গেছে গ্রেট ম্যাজিশিয়ান ওরফে প্রফেসর ওয়াইকে কাম্পালায়। এদিকে আজ সকালে তাকে দেখা গেছে ঢাকায়।
ঢাকায় দেখা গেছে। শহীদ বলল, হ্যাঁ। কুয়াশার কাছে গিয়েছিল সে।’ ‘তুই জানলি কি করে?
“মি. সিম্পসনকে ফোন করেছিল কুয়াশা । আমি ছিলাম তখন মি. সিম্পসনের সাথে।
কুয়াশা ফোন করেছিল মি. সিম্পসনকে! কেন, কেন?’ প্রফেসর ওয়াই-এর বিরুদ্ধে না লাগার জন্য মি. সিম্পসনকে উপদেশ দেবার
কুয়াশা ৪৫
১৪৯
জন্য। প্রফেসর ওয়াই, কুয়াশাকে জানিয়ে দিয়েছে কুয়াশা, মি. সিম্পসন বা আর যে কেউ তার বিরুদ্ধে লাগলে চরম শাস্তি দেবে সে।
কামাল বলল, হু। তাহলে আমাদের পরবর্তী কর্তব্য কি এখন?
শিকারীর জন্য অপেক্ষা করা। শিকারী যদি পৌঁছায় তাহলে তার গলা থেকে নকশাটা উদ্ধার করা। নকশাটা যাতে প্রফেসর ওয়াই বা কুয়াশা না পায় তার ব্যবস্থা করা।
কামাল মুখ বাঁকা করে বলল, কঠিন, কঠিন কাজ। শহীদ বলল, ‘ঠিক বলেছিস। তিনটেই সত্যি বড় কঠিন কাজ। কামাল জানতে চাইল, ‘শিকারী কবে বাংলাদেশে ঢুকবে বলে আশা করছিস?” “শহীদ বলল, “হিসেব করে দেখেছি আমি। আমার হিসেব যদি ভুল না হয় এবং শিকারী যদি রাতের বেলাও ওড়ার কাজে বিরতি না দেয় তাহলে পরশু দিন সকালের দিকে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করবে সে।
‘এখন তাহলে অপেক্ষার পালা?’ শহীদ বলল, হ্যাঁ। অপেক্ষার পালা।
ছয় পরের দিনটা কাটল ঘটনাবিহীন ভাবে।
• ভিতর ভিতর সবাই ভীষণ উত্তেজিত। সত্যিই কি শিকারী আসবে? প্রফেসর ওয়াই-এর রাডারের পর্দাকে কি শিকারী ফাঁকি দিতে পারবে?
* সকাল থেকে শহীদ, কামাল, মি. সিম্পসন এডভোকেট আশরাফ সাহেবের বাড়িতে বসে আছে। হিসেব অনুযায়ী আজই আসার কথা শিকারীর।
* ছটফট করছেন মি. সিম্পসন। ঘনঘন তাকাচ্ছেন আকাশের দিকে। উঠনের আম গাছটার দিক থেকে কামাল তো মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি ফেরাচ্ছে না।
বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে সবাই ওরা। আশরাফ সাহেব আছেন ওদের সাথে। সোহরাবও আছে। সোহরাবের আফ্রিকান স্ত্রী আসমা লেমন খানিক পরপরই গরম চা দিয়ে যাচ্ছে।
দশ মিনিট পরপরই ফোন আসছে মি. সিম্পসনের। টেবিলের উপর এনে রেখেছে ফোনটা সোহরাব।
ফোনে খবর পাচ্ছে মি. সিম্পসন কন্ট্রোল রূম থেকে।
ভারত সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে কোন বাজপাখিকেই যেন গুলি করে হত্যা করা না হয় তার ব্যবস্থা করবার জন্যে।
গতরাতে মেটিওরলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের হাই অফিশিয়ালদের সাথে শিকারীকে ডাইভার্ট করার কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা সে ব্যাপারে দীর্ঘ আলাপ করেছেন মি. সিম্পসন। কিন্তু কেউ কোন পরামর্শ দিতে পারেননি। ১৫০
ভলিউম ১৫
প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা করছে, সবাই প্রফেসর ওয়াই-এর কাছ থেকে খবর আসবে–শিকারীকে পেয়েছি আমি।
* শহীদ গৰ্ভর। কোন কথাই বলছে না সে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বন্ধ হয়ে গেল সকলের মুখের কথা। সবাই চেয়ে আছে আকাশের দিকে।
| মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ। কিন্তু কোথায় শিকারী? একটা চিল বা শকুনেরও চিহ্ন নেই আকাশের কোথাও?
প্রফেসর ওয়াইও শিকারীকে ধরতে পারেননি, বোঝা যাচ্ছে। শিকারীকে ঘায়েল করতে পারলে সগর্বে তিনি তা ঘোষণা করতেন।
তাহলে? আসছে না কেন শিকারী? তবে কি পথ ভুল করেছে পাখিটা? কিংবা মারা গেছে পথে কোথাও?
কিছুই অসম্বনয়। বিকেল থেকে সন্ধ্যা নামল।
সকলের চেহারায় ফুটে উঠেছে নৈরাশ্যের ঘোর কৃষ্ণছায়া। ক্রমশ নামল রাত্রির অন্ধকার।
এল না শিকারী।
এদিকে সকাল বেলাই আলোচনা হয়ে গেছে শিকারী আবিদের তৈরি নকশা যদি নিয়ে আসে তাহলে সেটার মালিক হবে কে? আশরাফ সাহেব জানিয়ে দিয়েছেন নকশার উপর তার কোন লোভ নেই। নকশা বাংলাদেশ সরকারকে দান করবেন তিনি। তবে সরকার যদি তাকে পুরস্কার দিতে চান তাহলে তা তিনি গ্রহণ করবেন।
নতুন করে হিসেব কষতে বসল কামাল।
‘শিকারী হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্রাম নেবে ঠিক করেছে এক বা দুদিন কোথাও। ইতস্তুত করতে করতে বলল সোহরাব।
মি. সিম্পসন জোর দিয়ে বলে উঠলেন, ‘খুবই সদ্য সেটা।
আশরাফ সাহেব বললেন, রাস্তা তো আর কম নয়। কয়েক হাজার মাইল। চাট্টিখানি কথা নয়।
কামাল বলল, আগামীকাল নিশ্চয় পৌঁছে যাবে শিকারী। কিন্তু পরদিনও অপেক্ষা করাই সার হলো । এল না শিকারী। এদিকে প্রফেসর ওয়াইও নীরব। অর্থাৎ শিকারী তাকেও ফাঁকি দিয়েছে।
নির্দিষ্ট দিনের পর কেটে গেল আরও দুটো দিন। তবু শিকারীর দেখা নেই। কিন্তু মি. সিম্পসন হাল ছাড়বার পাত্র নন। এখনও তিনি আশা করেন শিকারী
আসবে।
আশা করে শহীদও।
মি, সিম্পসন পলিস পাহারা বসিয়েছেন আশরাফ সাহেবের বাড়ির চারদিকে। কুয়াশা ৪৫
১৫১
তার বিশ্বাস প্রফেসর ওয়াই শিকারীর কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। শিকারী সরাসরি উড়ে আসবে আশরাফ সাহেবের আম গাছের উপর।
কেটে গেল আরও একটা দিন।
ধৈর্যের পরীক্ষা চলেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আশরাফ সাহেবের বারান্দায় সবাই বসে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে। কামাল বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে সারাদিন আকাশে খোঁজে শিকারীকে। পশ্চিম দিকের আকাশ থেকে তার দৃষ্টি সরে না। | সোহরাব উগাণ্ডার গল্প বলে। সবাই শোনে। আসমা লেমন চা আনে, মাঝে মধ্যে বসে ওদের সাথে, জেনারেল ইদি আমিনের পাগলামির বর্ণনা দেয় নানা ঘটনার উল্লেখ করে। জেনারেল কি রকম নিষ্ঠুর, কি রকম রগচটা, কি রকম গোঁয়ার তার গল্প শোনায় একটার পর একটা।
অন্যমনস্কভাবে সবাই শোনে। শোনার ফাঁকে ফাঁকে মুখ তুলে দেখে নেয় আকাশটা!
কিন্তু কোথায় শিকারী?
কেটে যায় আরও একটা দিন।
পরদিনও আবার চলে ধৈর্যের কঠোর পরীক্ষা। আবার বসেছে আজ ওরা আশরাফ সাহেবের বারান্দায়। চেয়ার টেবিল পেতে। শহীদ এবং মি. সিম্পসন মুখোমুখি। শহীদের পাশে কামাল। মি. সিম্পসনের পাশে সোহরাব। সোহরাবের পাশে ডি, কস্টা। ডি. কস্টাও ক’দিন থেকে আসছে নিয়মিত। ডি. কস্টার পাশে আশরাফ চৌধুরী।
| বাড়ির ভিতর, উঠনে, একটা লম্বা বেঞ্চের উপর বসে আছে পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র পুলিস। বাড়ির গেটের বাইরেও সশস্ত্র পুলিস আছে। পিছনেও পাহারার ব্যবস্থা। করেছেন মি. সিম্পসন। রাস্তায় আছে পুলিশ বিভাগের ডিটেকটিভরা, সিডিল ড্রেসে।
| আসমা লেমন গল্প বলছিল। জেনারেল ইদি আমিন সামান্য কারণে একজনের উপর চটে গিয়ে নির্মমভাবে তার কি চরম ক্ষতি করেছিল সে কথা বর্ণনা করছিল সে।
এমন সময়, যেন টিকেট না কেটেই লটারিতে প্রাইজ পাওয়া গেল, শিকারী উড়ে এসে বসল আশরাফ সাহেবের কাঁধে।
* চোখের পলকে ঘটে গেল কয়েকটা ঘটনা।
শহীদ সবচেয়ে আগে চেয়ার ছেড়ে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েই পকেট থেকে লোডেড রিভলভার বের করল। সাবধানের মার নেই। মি. সিম্পসন হুইসেল বের করে ফুঁ দিলেন দীর্ঘক্ষণ। ছুটে আসতে লাগল সশস্ত্র পুলিসরা।
কর্ডন! কর্ডন! কর্ডন করো বারান্দাটাকে!’ দাতে দাঁত চেপে উত্তেজনা মন করতে করতে নির্দেশ দিলেন. মি. সিম্পসন। সোহরা গিয়ে দাঁড়াল তার বাবার পাশে। শিকারীর গায়ে আলতোভাবে হাত দিল সে।
১৫২
ভলিউম ১৫
লাল টকটকে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে শিকারী। হাঁপাচ্ছে সে। ছোট্ট বুকটা উঠছে, নামছে–উঠছে নামছে।
| মি, সিম্পসন সোহরাবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। শিকারীর গলা থেকে সুতো দিয়ে বাঁধা ভাঁজ করা কাগজটা খুলে নিয়ে সাথে সাথেই প্যান্টের পকেটে ভরে ফেললেন তিনি। তাকালেন শহীদের দিকে, শহীদ, নকশাটার নিরাপত্তা বিধানের জন্যে এখন আমাদের কি করা উচিত মনে করো তুমি?
শহীদ বলল, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরে পড়া উচিত। হেডকোয়ার্টারে চলুন।’
বাড়ি ভরে গেছে সশস্ত্র পুলিসে।
মি. সিম্পসন বারান্দা থেকে নামলেন। তার সাথে শহীদ, পাশাপাশি। পিছন পিছন কামাল, ডি, কস্টা।
গোটা দলটাকে ঘিরে রেখে গেটের দিকে এগিয়ে চলেছে সশস্ত্র পুলিসের দল।
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পুলিস বিভাগের দুটো মাইক্রোবাস। দুটো জীপও দেখা যাচ্ছে। মাইক্রোবাসের কাছাকাছি গিয়ে কামাল কটমট করে তাকাল ডি, কস্টার দিকে। ঢোক গিলল ডি. কস্টা। কেন যেন অপ্রতিভ দেখাল তাকে। কামাল বলল, ‘আমাদের সাথে যাবার মতলব আছে নাকি?
টা নয়, টা নয়,’ বলে সরে গেল ডি কস্টা। দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল সে রাস্তার বাঁকে।
মি. সিম্পসন, শহীদ, কামাল উঠল একটি মাইক্রোবাসে। সামনের মাইক্রোবাসটায় উঠল কিছু সশস্ত্র পুলিস। সামনে রইল একটা জীপও।
পিছনে রইল আর একটা জীপ। সবগুলো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করল একযোগে।
মি. সিম্পসন পাশে বসা শহীদের হাতের রিভলভারটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “রিভলভারটা পকেটে ভরে রাখতে পারো শহীদ। ওটার বোধ হয় আর দরকার নেই।’
শহীদ বলল, নকশাটা নিরাপদ জায়গায় না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি, মি. সিম্পসন। ‘
কামাল বসেছে শহীদের পাশে। মি. সিম্পসন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, শহীদ। মাথাটা ঘুরছে আমার…’
কথা শেষ হলো না তার। মাথাটা কাত হয়ে গেল একপাশে। শহীদ পিছন দিকে তাকাবার জন্য ঘাড় ফেরাতে গিয়ে মিষ্টি একটা গন্ধ পেল। পিছন দিকে ঘাড় ফেরানো হলো না ওর। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে-ও।
কামাল আগেই জ্ঞান হারিয়েছে।
কুয়াশা ৪৫
মাইক্রোবাস যেমন ছুটছিল তেমনি ছুটছে। ড্রাইভার শুধু খানিক পর নাক থেকে রুমাল সরিয়ে পিছন ফিরে তাকাল।
সবাই যেন ঘুমুচ্ছে অঘোরে। মুচকি হাসি ফুটে উঠল মাইক্রোবাসের ড্রাইভারের ঠোঁটে। সাত
জ্ঞান ফেরার পর শহীদ দেখল প্রকাণ্ড একটা হলঘরের একধারে একটা চেয়ারের উপর বসে আছে ও। হাত পা বাধা নয়। মি. সিম্পসন, কামাল, বসে রয়েছে পাশের দুটো চেয়ারে। সকলের জ্ঞান ফিরে এসেছে এইমাত্র।
| হলরুমের চারদিকে তাকিয়ে তাজ্জব হয়ে গেল ওরা। এটাকে হলরূম না বলে বিজ্ঞানাগার বা কন্ট্রোলরূম বলাই ভাল। অদ্ভুত দর্শন ছোট বড় যন্ত্রপাতি চারদিকে দেখা যাচ্ছে।’
| ঘরের ঠিক মাঝখানে,কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটা কেবিন। তার পাশেই দু’মানুষ সমান উঁচু একটা ট্রান্সমিটার। ট্রান্সমিটারটার পাশে তিনফুট উঁচু ইস্পাতের তৈরি মানুষের আকার আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আটটা যন্ত্র।
রোবট! কামাল চাপা কণ্ঠে বলল।
হলের একধারে একটা টেবিলে অসংখ্য সুইচ ছাড়াও রয়েছে, টিভির দেয়াল জোড়া স্ক্রিন। প্রফেসর ওয়াই বসে আছেন টেবিলের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এক চেয়ারে।
জ্ঞান ফিরেছে তাহলে? কেউ কোন কথা বলল না।
আপনাদের পাশে খালি চেয়ার রয়েছে আর কয়েকটা। দেখতে পাচ্ছেন?’ সবাই তাকাল, শহীদ ছাড়া। খালি চেয়ারগুলো আগেই লক্ষ করেছে ও।
প্রফেসর ওয়াই টেবিলের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, আমি চাই না ওই খালি চেয়ারগুলো পূরণ করার জন্য মিসেস শহীদ বা, কুয়াশাকে এখানে আনতে। কিন্তু আপনারা যদি আমাকে বাধ্য করেন তাহলে আমি নিরুপায়। দেখুন, কতটা ভদ্রলোক আমি–সুযোগ পেয়েও আমি আপনাদের ক্ষতি করিনি। আমি চাই, মি. সিম্পসন, নকশাটা নিজের হাতে পকেট থেকে বের করে আমাকে দেবেন।’
মি. সিম্পসন বললেন, নকশা আমি দেব না। এটা তোমার জিনিস নয়, শয়তান প্রফেসর!’।
প্রফেসর ওয়াই টেবিলের অসংখ্য সুইচের মধ্যে থেকে একটা সুইচে আঙুল দিয়ে চাপ দিলেন। | মি. সিম্পসন মাই গড!’ বলে চিৎকার করে উঠে এক ঝটকায় মাথার হ্যাটটা
ফেলে দিলেন মেঝেতে।
১৫৪
ভলিউম ১৫
আগুন জ্বলছে হাটে। দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সেটা।
প্রফেসর ওয়াই বলল, এরপর যদি ভদ্রভাবে কথা না বলেন তাহলে অপনার মাথার চুল, ভুরু আর চোখের পাপড়িতে আগুন ধরিয়ে দেব। নকশাটা বের করুন এবার, মি. সিম্পসন।’
মি. সিম্পসন শহীদের দিকে তাকাল।
শহীদ কঠিন কণ্ঠে বলে উঠল, পরাজয় মেনে নেয়া উচিত আপনার, প্রফেসর ওয়াই। আপনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, শিকারীকে আমাদের হাতে আসতে দেবেন না। হেরে গেছেন আপনি। আপনার উচিত পরাজয় মেনে নেয়া । কাপুরুষের মত নিজের আস্তানায় বন্দী করে নিয়ে এসে এই নাটক করার কোন মানে হয় না। এতে
প্রমাণিত হচ্ছে আপনি আদর্শহীন, শঠ, কাপুরুষ!’, •
‘থামো, ছোকরা!’ গর্জে উঠলেন প্রফেসর ওয়াই, লেকচার এখানে আমি দেব, তুমি না। আমি নকশাটা চাই। এই নকশার জন্য আমি পারি না এমন কোন কাজ নেই। যুদ্ধে পরাজয় বলে কোন জিনিস নেই। একভাবে পারিনি, অন্য ভাবে পারতে হবে–এই আমি বুঝি। মি, সিম্পসন, এই শেষ বার বলছি, নকশাটা পকেট থেকে বের করে মেঝেতে ফেলে দিন।’ | মি. সিম্পসন রাগে কাঁপতে কাঁপতে পকেটে হাত দিলেন। দিয়েই স্থির হয়ে গেলেন তিনি। বিস্ফারিত হয়ে গেছে দুই চোখ। কিন্তু…নকশাটা গেল কোথায়? আমার পকেটেই ছিল শহীদ, নেই কেন?’
কথাগুলো বলেই সবিস্ময়ে তাকালেন মি. সিম্পসন শহীদের দিকে।
প্রফেসর ওয়াই গর্জে উঠল, কৌশল, কেমন? কৌশল খাটবে না, মি. সিম্পসন।
প্রফেসর ওয়াই আর একটা বোম টিপল। ট্রান্সমিটারের পাশে যে আটটা রোবট দাঁড়িয়ে ছিল সেগুলোর মধ্যে থেকে একটা রোবট খট খট করে শব্দ তুলে এগিয়ে যেতে শুরু করল মি. সিম্পসনের দিকে।
* মি. সিম্পসনের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল রোবটটা পুরোপুরি একজন মানুষের মতই। সার্চ করছে রোবটের ইস্পাত নির্মিত দুটো হাত মি: সিম্পসনকে।
: প্রফেসর ওয়াই বলল, “মি. সিম্পসনের কাছে নেই নকশাটা। নাম্বার ওয়ান ডল, তুমি একে একে সকলের পকেট সার্চ করো। | একে একে সকলের পকেট $ করতে শুরু করল নাম্বার ওয়ান ডল। কিন্তু শেষ
পর্যন্ত নকশাটা-পাওয়া গেল না কারও কাছেই। | কামাল বলে উঠল, কী আশ্চর্য! গেল কোথায় সেটা!’ | বজ্রকণ্ঠে কথা বলে উঠল প্রফেসর ওয়াই, কোন কথা শুনব না আমি। নকশা চাই, এই মুহূর্তে চাই। নাম্বার এইট ডল, বাইরে গিয়ে জর্মন শেখকে বলো, শহীদ খানের বাড়িতে যাকে পাওয়া যাবে তাকেই যেন ধরে অনাি হয়। ওকে তিন নম্বর
কুয়াশা ৪৫
১৫৫
ট্রান্সমিশন, কেবিন ব্যবহার করতে বলো!
শহীদ বলল, ‘পাগল আর বলে কাকে? নকশা পাবেন না বলে আমার বাড়ির মানুষদের উপর এত রাগ দেখাবার কারণ কি?’
তুমিই যত নষ্টের মূলে, প্রফেসর ওয়াই বলল।
কামাল তাকাল শহীদের দিকে। শহীদ ফিসফিস করে বলল, “ডি. কস্টাকে সন্দেহ হয় আমার। নকশাটা ওর কাছেই আছে সম্ভবত। মাইক্রোবাসে ওঠার সময় মি. সিম্পসনের পকেট থেকে নকশাটা চুরি করেছে ও।’
‘সেকি! ফিসফিস করে জানতে চাইল কামাল। “ঠিক বুঝতে পারছি না।’
আচমকা হোঃ হোঙ করে হেসে উঠল প্রফেসর ওয়াই। হাসি থামতে বলল, বোকার দল! ভেবেছে ফিসফিস করে কথা বললে শুনতে পাব না? হাঃ হাঃ হাঃ হা! আমার কানে যেসব শব্দ ধরা পড়ে তা তোমরা জীবনে কোনদিন শুনতে পাবে না। স্পেশালভাবে তৈরি এই কান। ডি, কস্টাকে কোথায় পাওয়া যাবে জানি আমি। ডল নাম্বার থ্রী, ডি. কস্টাকে এখানে বন্দী করে আনো। সাত নম্বর কেবিন ব্যবহার করো
তুমি। ।
তিন নম্বর ডল কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
• পাঁচ মিনিট কাটল না। ডি কস্টাকে বন্দী করে নিয়ে এল তিন নম্বর রোবট। প্রফেসর ওয়াই হাঁক ছাড়ল, নকশাটা তোমার কাছে?
ডি, কস্টা ঘন ঘন ঢোক গিলল। বলল, “হ্যাঁ, নকশাটা আমার কাছেই ছিল। কিন্টু এখন সেটা আমার আওটার বাইরে, প্রফেসর ওয়াই।
প্রফেসর ওয়াই গর্জে উঠল, আওতার বাইরে? তার মানে? ‘মাড়লিটা গিলিয়া ফেলিয়াছি। পেটের ভিতর সেটা এখন। চেষ্টা করেও হাসি থামাতে পারল না কামাল।
প্রফেসর ওয়াই বলল বজ্রকণ্ঠে, পেটের ভিতর কি বুকের ভিতর তা আমি শুনতে চাই না। নকশা আমি চাই। এই মুহূর্তে! বের করো, ডি, কস্টা।
“কি বের করিব কিভাবে?
তা আমি জানি না। গিলে ফেলার সময় ভাবনি কিভাবে বের করবে?’
ডি, কস্টা বলল, বের হবে। টবে একটা কি ডেড়টা ডিন ডিটে হবে, প্রফেসর।’ •
“অত ধৈর্য আমার নেই! নকশা তুমি এই মুহূর্তে দেবে কি না, বলো। ‘ উঠে দাঁড়াল প্রফেসর ওয়াই। রাগে কাঁপছে সে।
অসহায় দেখাল ডি, কস্টাকে। সাহস সঞ্চয়ের জন্য সে তাকাল কামালের দিকে। কামাল মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল।
আমাকে তোমরা পেয়েছ কি তাই ভাবি! গিলে ফেলেছ! কোন কথা শুনব না ১৫৬
ভলিউম ১৫
আমি-নকশা দাও! হয় নকশা দেবে নয়ত•••নয়ত ঠিক আছে। ব্যবস্থা করছি আমি। তোমাদেরকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় জানা আছে আমার! দাঁড়াও! তোমার বস মি, কুয়াশাকে আমি বলেছিলাম, সে যেন সবাইকে নিষেধ করে দেয় আমার। পিছনে লাগতে। শোনেনি সে আমার কথা। তোমরাও শোনোনি! বেশ, দেখো আমি কি করতে পারি।’
• প্রফেসর ওয়াই রাগে কাঁপতে কাঁপতে আবার বসল চেয়ারে। সুইচ টিপল আবার একটা। বলল, “ডল নাম্বার সেডেন! যাও তুমি! কেবিনে ঢোকো। কুয়াশাকে গিয়ে বলবে, আমি প্রফেসর ওয়াই, তাকে ডেকেছি। দেখি সে আসে কিনা। যদি সে আসতে না চায় তাহলে জানিয়ে দেবে মি. সিম্পসন, শহীদ খান, কামাল আহমেদ, ডি. কস্টা, মিসেস মহুয়া–সবাইকে আজই নিজের হাতে খুন করব আমি।’
| সাত নম্বর রোবটটা কাঁচ দিয়ে ঘেরা কেবিনের ভিতর ঢুকল। প্রফেসর ওয়াই একটা সুইচ টিপল আবার।
তীব্র নীল আলোয় ঝলসে গেল ওদের সকলের চোখ। চোখ বন্ধ করে ফেলল সকলে। খানিক পর চোখ খুলে ওরা দেখল কেবিনের ভিতরটা ফাঁকা, রোবটটা নেই সেখানে!
| প্রফেসর ওয়াই জিজ্ঞেস করল, খুব আশ্চর্য লাগছে, না? কেবিনের ভিতর থেকে গেল কোথায় রোবটটা? শুনবে, এর রহস্য শুনবে? মাথা খারাপ হয়ে যাবে শুনলে, হ্যাঁ, এমনই অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করেছি আমি। রেডিও টেলিভিশন কি জিনিস জানো তো? নির্দিষ্ট স্টেশন থেকে ছবি বা শব্দ ট্রান্সমিট করা হলেই আমরা আমাদের রিসিভিং সেটের মাধ্যমে অর্থাৎ রেডিও বা টেলিভিশনের মাধ্যমে তা শুনতে পাই বা দেখতে পাই। আলোর গতিতে শব্দটা আসে বা ছবিটা আসে। কিন্তু আমি কি আবিষ্কার করেছি জানো? ছবি নয়, কথা নয়, আমি আবিষ্কার করেছি। বস্তু ট্রান্সমিট করার পদ্ধতি। ওই কেবিনে যে-কোন জিনিসকে ঢুকিয়ে দিয়ে ডিজইন্টিগ্রেট করে দিই আমি, অর্থাৎ বস্তুকে ডেঙে অণু-পরমাণুতে পরিণত করি। বিভিন্ন জায়গায় আমি রেখে দিয়েছি রিসিডিং সেট। যেখানে পাঠাতে চাই, বোতাম টেপার সাথে সাথেই অণুগুলো সেখানে গিয়ে জোড়া লাগে, আবার একত্রিত হয়,
অর্থাৎ বস্তু তার হুবহু নিজস্ব আকার ফিরে পায়। কি, বিস্ময়কর আবিষ্কার না?’
এমন সময় কন্ট্রোলরূমে এসে ঢুকল মহুয়া। পিছনে একটা রোবট। | ‘খালি চেয়ারটায় বসো,’ প্রফেসর ওয়াই নির্দেশ দিল। তারপর আবার বলল, “মিসেস মহুয়া, আপনার প্রতিও আমার কঠিন অভিযোগ আছে। আমার পিছনে লাগা থেকে আপনার স্বামীকে আপনি ক্ষান্ত করতে পারেননি। এর শাস্তি পেতে হবে আজ আপনাকে।
চোখ মিট মিট করল মহুয়া। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, কী ব্যাপার! হঠাৎ কোথায় এসে পড়লাম।
কুয়াশা ৪৫
মহুয়াকে খালি চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করল কামাল। বিস্ফারিত চোখে প্রফেসর ওয়াই-এর দিকে চেয়ে আছে মহুয়া। যন্ত্রচালিতের মত বসল সে একটা চেয়ারে।
প্রফেসর ওয়াই বলতে শুরু করল আবার, ভেবে দেখুন এবার, কতবড় বিজ্ঞানী আমি। আপনার ভাইয়ের চেয়ে কোন অংশে কম নই।’
| মি. সিম্পসন বললেন, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না। বস্তু কখনও ট্রান্সমিট করা যায় না।’
• হোয়াট! কি বললে! আমি মিথ্যে কথা বলছি?
“নিশ্চয়ই, মিথ্যে কথা বলছ। হয়তো কোন ম্যা জক দেখিয়ে আমাদেরকে বোকা বানাতে চেষ্টা করবে, বলবে প্রমাণ দেখালাম। পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়! তুমি তো একটা আস্ত পাগল, তোমার কথায় বিশ্বাস করলে
আমি পাগল?
• প্রফেসর ওয়াই আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘যতবড় মুখ নয় ততবড় কথা! ঠিক আছে, ঠিক আর! প্রমাণ চাও, না? বেশ, বেশ! প্রমাণ আমি দেখাব। মি. সিম্পসন, হঠাৎ যদি চোখের পলকে তুমি নিজেকে আবিষ্কার করে গ্রীনল্যান্ডের বরফের উপর, যেখানে শূন্য ডিগ্রীরও অনেক নিচে টেম্পারেচার কেমন হয় বলো তো?’
রাখো তোমার বড় বড় কথা! ওসব গল্প আমি অনেক শুনেছি।’
বেশ। প্রমাণ দেখাব তোমাকে। অবশ্যই দেখাব। তোমাকে একা কেন, প্রমাণ সবাইকেই দেখাব। আসতে দাও কুয়াশাকে, তাকে দেখার প্রমাণ। তোমাদের সবাইকে আমি ছড়িয়ে দেব পথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। নকশাটা তোমার পেটে, তাই না। ডি, কস্টা? বেশ, বেশ। তোমাকে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জায়গা এভারেস্টের শৃঙ্গে পাঠাব। একা নয়, একা নয় তোমার দোসর থাকবে-ফুলবাবুর মত এই যে সাজগোজ করে রয়েছে কি যেন নাম–হ্যাঁ, মনে পড়েছে, কামাল মিয়া। ওর সাথেই পাঠাব তোমাকে। ডল নাম্বার ওয়ান, ওদের দুজনকে অক্সিজেন পাইপ দিয়ে সাজিয়ে দাও। যাতে বিশ কি পঁচিশ মিনিট বেঁচে থাকতে পারে এভারেস্টে গিয়ে। সাবধান, বেশি অক্সিজেন যেন না থাকে সিলিণ্ডারে। ডি. কস্টা আর কামাল, কেমন হবে বলো তো ব্যাপারটা? রহস্যপুরী ওখান থেকে মাত্র কয়েক হাজার মাইল দূরে। তবে, দুঃখের কথা এভারেস্ট থেকে নামার সুযোগ তোমরা পাবে না। তার আগেই অকা পাবে। মানুষ এভারেস্টে চড়তে গিয়ে প্রাণ দেয়। তোমরা সেখান থেকে নামার জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ দেবে। মরে গিয়েও অমর হয়ে থাকবে। •••এবার মি. সিম্পসন,•••ওহে ডল নাম্বার টু, এক কাজ করো, মি. সিম্পসনকে বেশ গরম কাপড় চোপড় পরিয়ে দাও ভাল করে। মি. সিম্পসন, আপনার এখন মাত্র দু এক মিনিট একটু গরম লাগবে। তাতে বিচলিত না হওয়াই উচিত আপনার। কারণ এই গরম কাপড় পরিয়ে দিচ্ছি বলে খানিক পরই আপনি আমাকে শত-কোটি প্রণাম
১৮
ভলিউম ১৫
জানাবেন। কারণটা কি জানেন? খানিক পরই আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন বরফের রাজ্য, গ্রীনল্যাণ্ডে। ওখানে আপনি বড়জোর এক কি দুঘণ্টা বেঁচে থাকবেন। তারপর ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে যাবেন। শক্ত, পাথরের মত। আর শহীদ, তোমাকে আর তোমার স্ত্রীকে পাঠাব ভারত মহাসাগরের এক রহস্যময় দ্বীপে। যেখানে-কেউ কোনদিন পৌঁছায়নি, কেউ কোনদিন পৌঁছাবে না। কোন জাহাজ সেখানে কোনদিন ভেড়ে না। ওখানে মহুয়ার জন্য অপেক্ষা করছে আমার কিছু লোক। মহুয়াকে পেলে ওরা বড়ই আনন্দিত হবে। ‘
| এমন সময় কালো আলখাল্লায় আপাদমস্তক ঢাকা দীর্ঘদেহী ঋজু এক পুরুষ প্রবেশ করল হলরূমে। প্রফেসর ওয়াইয়ের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে, থাকার পর সে বলে উঠল ভারি গলায়, আমাকে কোথায় পাঠাবে, ওয়াই?’
চমকে উঠল প্রফেসর ওয়াই। ঘাড় ফিরিয়ে কালো আলখাল্লা পরিহিত কুয়াশাকে দেখে সে চেঁচিয়ে উঠল, কে! মি. কুয়াশা! আপনি এসেছেন! সার্থক হলো আমার জন্ম! আপনাকে আমার কন্ট্রোলরূমে পাব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। চমৎকার। আমার রোবটকে পাঠিয়েছিলাম আপনাকে বন্দী করে আনতে! সে বুঝি আপনাকে পায়নি? স্বেচ্ছায় এসেছেন দেখছি–গুড! ভেরী গুড। মি, কুয়াশা, আপনাকেও পাঠাব!
সে কথাই তো জানতে চাইছি। কোথায় পাঠাবে আমাকে?
‘আপনাকে পাঠাব মহাশূন্যে। প্রফেসর কুটজে যেখানে আছে আপনিও সেখানে থাকবেন। প্রফেসর কুটজের স্পেস ক্রাফটে রিসিভিং সেট লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম আমি। তার স্পেসক্রাফট নষ্ট হয়ে গেছে মহাশূন্যে, কোন এক গ্রহের উপর আছড়ে পড়ে, যতদূর জানি। আপনিও সেখানে যাবেন। কোনদিন ফিরতে পারবেন না এই দুনিয়ায়। অনেক ভাবে অনেকবার অনুরোধ করেছি আপনাকে। আমার কাজে বাধার সৃষ্টি করবেন না। শোনেননি। এর শাস্তি আজ আপনাকে পেতে হবে, মি. কুয়াশা। স্বীকার করি, আমি আপনার কাছে ঋণী। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনারা যেমন আপনাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ঋণী আমি তেমনি••থাক, কথা ঝড়িয়ে লাভ নেই। আপনাদের অত্যাচার আমি অনেক সহ্য করেছি। আর নয়। এই পৃথিবীর মানুষকে আমি ভালবাসি। এদের জন্য কিছু কাজের। মত কাজ করতে চাই আমি। কিন্তু আপনারা থাকতে তা আর সম্ভব নয়, বুঝতে পারছি। ডল নাম্বার মোর, ফাইড। গরম কাপড় তো পরানো হয়ে গেছে? মি. সিম্পসনকে কেবিনে ঢোকাও!
মি. সিম্পসন ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বললেন, ঢোকাতে হবে না, আমি নিজেই ঢুকছি। আবারও বলছি আমি তোমার ম্যাটার ট্রান্সমিট করার কথা বিশ্বাস করি না।
‘মি. কুয়াশা, শুনলেন? বোকা লোকটার কথা শুনলেন?’
কুয়াশা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘বড় বেশি বেড়ে গেছ তুমি, ওয়াই। কুয়াশা ৪৫
১৫৯
একটা কথা মনে রেখো, ইচ্ছা করলেই এই মুহূর্তে আমি তোমার ইতি ঘটাতে পারি।’
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন প্রফেসর ওয়াই। বললেন, ‘পারতেন, স্বীকার করি। কিন্তু এখন আর পারবেন না। এখন আপনি আমার হাতে বন্দী। আপনার কোন ক্ষমতা নেই এখান থেকে বেরিয়ে যাবার! কথাটা আপনিও জানেন। আমার ইতি ঘটাবার ক্ষমতা আপনার ছিল খানিক আগে পর্যন্ত সেজন্যে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম আমি। সব ভয় দূর হয়ে গেছে আমার এখন। আপনাকে আজ পেয়েছি আমার কন্ট্রোলরূমে। কেউ বাধা দিতে পারবে না এখন আমার কাজে। আমি আপনাকে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেব। আপনি অনেক বড় বিজ্ঞানী, দেখব ফিরে আসতে পারেন কিনা আবার এই সুন্দর পৃথিবীতে। | ‘মি. সিম্পসন কঁচ ঘেরা কেবিনে ঢুকেছেন। প্রফেসর ওয়াই সুইচ টিপতেই আবার সেই চোখ ঝলসানো আলো দেখা গেল। পরমুহূর্তে দেখা গেল মি. সিম্পসন নেই কেবিনের ভিতর।
দাদা! এসব কি সত্যি! চিৎকার করে জানতে চাইল মহুয়া।
কুয়াশা গম্ভীর। মৃদু কণ্ঠে শুধু বলল, এই মুহূর্তে আমি তোদের কারও কোন কাজে লাগতে পারব না রে, মহুয়া। তবে চিন্তা করিসনে, বোন। তোর দাদা যদি বেঁচে থাকে তবে তোরাও বেঁচে থাকবি!’
সাবাস! সাবাস! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর মতই কথা বলছেন আপনি মি. কুয়াশা,’ প্রফেসর ওয়াই বলে উঠলেন।
মহুয়া আবার শুনতে চাইল, মি. সিম্পসন কি সত্যিই…? কুয়াশা সংক্ষেপে শুধু বলল, হ্যাঁ। এতক্ষণে পৌঁছে গেছেন। প্রফেসর ওয়াই বলল, ‘এবার শহীদ আর মিসেস।’
শহীদ মহুয়ার হাত ধরে দৃঢ় পদক্ষেপে কেবিনের দিকে এগোল। এছাড়া উপায় মেই। মৃত্যুর চেয়ে এ-ও ভাল।
ঝলসে উঠল আলো। অদৃশ্য হয়েছে। এরপর কামাল আর ডি কস্টা ঢুকল কেবিনে। সবশেষে ঢুকল কুয়াশা।
সুইচে আঙুলের চাপ দিল প্রফেসর ওয়াই। নীল আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল।
দেখা গেল কেবিনে কুয়াশা নেই।
প্রফেসর ওয়াই হাফ ছেড়ে বলল, বাঁচা গেল! সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কেউ ওরা বেঁচে ফিরবে না আর এই বাংলাদেশে। আমি এখন একা। যা খুশি তাই করব এবার। কেউ নেই আমাকে বাধা দেবার! নো ওয়ান।
গলার স্বর পরিবর্তন করে হাঁক ছাড়ল, ডল নাম্বার এইট! কফি খাওয়াও দেখি এক কাপ।
Leave a Reply