৪৪. প্রফেসর ওয়াই ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪৪
প্রথম প্রকাশ : আগস্ট, ১৯৭৫
এক
।
রাত বারোটা বাজতে আর মাত্র এক মিনিট বাকি
প্রফেসর ওয়াই নরম কার্পেট বিছানো. বিশাল ডিম্বাকৃতি আণ্ডারগ্রাউণ্ড কন্ট্রোলরূমে পায়চারি করছেন। টিউব লাইটের সাদা আলোয় তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম চিক চিক করছে। ফোলা ফোলা লাল গাল দুটো মাঝে মধ্যে কাঁপছে। আপন মনে বিড় বিড় করছেন তিনি। কখনও আশার আলো ফুটে উঠছে মুখের চেহারায়, কখনও আশঙ্কার কালো মেঘ ছায়া ফেলছে দু’চোখে।
| ঢং, টং, টং•••
রাত বারোটা।
বা বগলের ক্রাচটা ডান হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে রূমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রফেসর ওয়াই। বাঁ পায়ের গোড়ালি নেই তার। গোড়ালিহীন পা’টা আবার বাঁকাও একটু। ক্রাচ ছাড়াও হাঁটতে পারেন তিনি, তবে একটু কষ্ট হয়।
লাল টকটকে চোখ দুটো অঙ্গারের মত জ্বলছে যেন প্রফেসর ওয়াইয়ের। লাল টেলিফোনটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তিনি।
| ‘অপারেশন শুরু হয়েছে!’ বিড় বিড় করে বললেন।
আবার শুরু করলেন পায়চারি। ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে হাত বুলালেন কিছুক্ষণ। মেহেদি রাঙানো পরিপাটি মাথায় চুলে আঙুল চালালেন। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে মুছলেন সাদা রুমাল দিয়ে। হাত দুটো একটু একটু কাঁপছে তার।
কন্ট্রোলরূমের চারদিকের দেয়ালে, সিলিঙের কাছাকাছি, চারটে ইস্পাতের তৈরি হাতির মাথা দেখা যাচ্ছে। অক্সিজেন ঢোকার এবং কার্বনডাই অক্সাইড বেরোবার পথ আসলে ওই হাতির মাথাগুলো। রূমের এক কোনায় পাশাপাশি দাঁড় করানো রয়েছে দুটো টিভি। দুটোই অন করা। এই আণ্ডারগ্রাউণ্ড আস্তানার দুটো প্রবেশ পথের সম্মুখভাগ দেখা যাচ্ছে টিভিদুটির স্ক্রীনে। পশ্চিম দিকের দেয়াল জুড়ে তিনটে ম্যাপ সঁটা দেখা যাচ্ছে। একটি ওয়ার্ল্ড ম্যাপ, দ্বিতীয়টি এশিয়ার ম্যাপ, তৃতীয়টি বাংলাদেশের। পুব দিকে দেয়ালে ঝুলছে দুটো অটোমেটিক কারবাইন, * একটা মেশিনগান। উত্তর দিকে দেয়ালে প্রকাণ্ড ট্রান্সমিটার যন্ত্রটা। পৃথিবীর যে কোন
ভলিউম ১৫
দেশের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে এই যন্ত্রের সাহায্যে।
কন্ট্রোলরূমের মাঝখানে ডিম্বাকৃতি একটি টেবিল। টেবিলের উপর দুটো ফোন, ইন্টারকম, এগারোটা বোতামসহ একটি সুইচবোর্ড, ফাইলপত্র, চকচকে কালো একটা রিভলভার, কলম-পেন্সিল, হাইপডারমিক সিরিঞ্জ, কয়েকটা শিশি প্রভৃতি হরেক রকম জিনিস শোভা পাচ্ছে।
প্রকাণ্ড কন্ট্রোলরূমের কোথাও দরজার চিহ্ন মাত্র নেই। তবে প্রবেশপথ একটা নয়, একাধিক আছে। দেখা না গেলেও প্রফেসর ওয়াই জানেন কোন্ বোতাম টিপলে কোনদিকের দেয়াল ফাঁক হয়ে যাবে। যে কোন মুহূর্তে প্রফেসর ওয়াই ল্যাবরেটরিতে স্টাডিরূমে বা মেকআপ রূমে কিংবা টরচার চেম্বারে উপস্থিত হতে পারেন এখান থেকে। | ক্রাচে ভর দিয়ে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রফেসর ওয়াই। ইন্টারকমের বোতামে চাপ দিয়ে বললেন, ল্যাবরেটরিতে দুটো বানর চাই আমি। সাধন, পেরু থেকে যে পার্সেলটা এসেছে সেটা খোলেনি তো? ওতে ইউরেনিয়াম। আছে-হ্যাঁ, কাজে বাব আমি আজ রাতেই। সেই বেটে লোকটার উচ্চতা মেপেছ সন্ধ্যার পর? বেড়েছে, না?•••দু’ইঞ্চি বাড়ল সাতদিনে••কিন্তু মেডিসিন আর দেয়া যায় না ওকে, মারা যাবে, এদিকে বাড়ছে না আর.••চিন্তার কথা। যাকগে, আস্তানা নম্বর পাঁচ, সতেরো, উনত্রিশ, সাতচল্লিশ-সব জায়গায় খবর পাঠাও, টাকা পাঠায় যেন যত বেশি সম্ব এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভ।
আবার পায়চারি শুরু করলেন প্রফেসর ওয়াই। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। বিড় বিড় করছেন আপন মনে, টাকা দরকার। লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা! মাই গড, কত কাজ পড়ে রয়েছে অসমাপ্ত। প্রজেক্ট ইমিটেশন হার্ট টাকার অভাবে স্থগিত রয়েছে। বেঁটে মানুষকে লম্বা করার পরীক্ষায় প্রায় সফল হয়েছি আমি, টাকার অভাবে আমদানি করা যাচ্ছে না দুষ্প্রাপ্য কেমিক্যাল, ফলে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে, নিখুঁত হচ্ছে না এক্সপেরিমেন্ট। নাহ, এভাবে চলতে পারে না। যেভাবেই হোক টাকা যোগাড় করতে হবে। নিকট মহাশূন্যে স্থিতিশীল শহর নির্মাণের পরিকল্পনাটা কাগজে কলমেই রয়ে যাচ্ছে, টাকা নেই বলে হাত দিতে পারছি না। কাজে! মানুষের ফুসফুস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়েও পিছিয়ে এলাম, টাকা নেই। অথচ আমার দৃঢ় বিশ্বাস ফুসফুসের উন্নতি, এবং পরিবর্তন করতে পারলে মানুষ যেমন ডাঙায় বসবাস করছে তেমনি পানিতেও বসবাস করতে পারবে•• ||
‘ প্রফেসর লাল টেলিফোনটার দিকে তাকালেন। ভুরু কুঁচকে উঠল তাঁর। দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। রিস্টওয়াচ দেখলেন। বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট হয়েছে। খবর আসছে না কেন এখনও? একশো বত্রিশটা ট্রাক-কতক্ষণ লাগবে বর্ডার পেরিয়ে যেতে? দূরত্ব তো মাত্র চার মাইল!
আবার পায়চারি শুরু করলেন প্রফেসর ওয়াই। বিড় বিড় করছেন আবার।
কুয়াশা ৪৪
৫৭
টাকার ব্যবস্থা হবে, হবে। ভয় পাবার কিছু নেই। আজকের অপারেশন সাক্সেসফুল হতে বাধ্য। খামোকা আশঙ্কা করছি। নিজে তদারক করে এসেছি, সব পুরোপুরি নিখুঁত দেখে এসেছি। খবরটা এল বলে, আর দেরি নেই।বেশ ভাল টাকা পাব এই অপারেশনে। প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা ক্যাশ। তার ওপর এক মন সোনা। অভাব মোটামুটি দূর হবে সাময়িক ভাবে।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং•••!
পড়িমরি করে টেবিলের দিকে এগোলেন প্রফেসর। ক্রাচটা পড়ে গেল বগলচ্যুত হয়ে। টেবিলটা ধরে ফেলে কোনমতে তাল সামলালেন তিনি। থরথর করে কাঁপছে হাত। ক্রেডল থেকে তুলে নিলেন তিনি কাঁপা হাতে লাল রিসিভারটা। ‘হ্যালো:শাহীন! •••হোয়াট! • রোড, বুক ফ্রম মিলিটারী? ইমপসিবল! পঁচিশ মাইলের মধ্যে কোন ক্যাম্প থাকার কথা নয়•••বুঝতে পারোনি ওরা কারা? ইডিয়ট!•••মেশিনগান, মর্টার, মাইন ব্যবহার করা হয়েছে-মাই গড!••হোয়াট অ্যাবাউট গোল্ড?•••ওহ জেসাস! ওহ জেসাস!–শাহীন, এসব কি বলছ তুমি! পাবলিক, একজন সাধারণ লোক, তোমাদের দুশো জন সশস্ত্র লোককে পিছু হটিয়ে দিয়েছে•••ট্রাক দখল করে নিয়েছে, সোনা কেড়ে নিয়েছে•••আমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছি? ওহ জেসাস! •••শাহীন, আমি ওদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় চাই। ইয়াহ, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। ওদের কর্তার, ইয়েস! আই ওয়ান্ট টু নো হু ইজ দ্যাট বাস্টার্ড!
রিসিভার নামিয়ে রেখে টেবিলের প্রান্ত ধরে কোনরকমে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখছেন প্রফেসর ওয়াই। ঘামছেন তিনি। কাঁপছেন। উন্মাদের মত দেখাচ্ছে
তাঁকে। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চাইছে চোখের অগ্নিগোলক দুটো।
সব শেষ করে দিয়েছে। হলো না, কাজ হলো না! অভাব আমার ঘুচল না এবারও। ওহ জেসাস! কিন্তু কার এই দুঃসাহস! দেখব, তাকে আমি দেখব! এই পৃথিবীর বাতাস তার জন্যে নিষিদ্ধ করে দেব আমি।’
শাওয়ারে স্নান সেরে সুসজ্জিত হয়ে বেডরূমে ঢুকল শখের গোয়েন্দা শহীদ খান। অপর দরজা দিয়ে একই সাথে ঢুকল মহুয়া। স্বামীর দিকে তাকিয়ে মহুয়া বলল, রেডি?’
মহুয়া মুখোমুখি পঁড়িয়ে শহীদের হাত দুটো ধরে নামিয়ে দিল ওর দু’পাশে, নিজেই টাইয়ের নট ঠিক করে বেঁধে দিতে দিতে বলল, ‘ডাইনিংরূমে যাও তুমি।
আর তুমি?’ মহুয়া বলল, কামাল নামেনি ছাদ থেকে। দেখে আসি কি করছে।’
মুচকি হাসল শহীদ। বলল, কাজ পাচ্ছে না বেচারা। গত একমাসে দেশে বড়
৫৮
ভলিউম ১৫,
রকমের কোন অঘটন ঘটেনি-মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে। বেশি ঘটিয়ো না ওকে।
‘এই সাত সকালে তোমাদের সাথে আমি ঝগড়া করতে চাই না। কিন্তু কথাটা বলেও পারি না। বেশ ভালই তো আছি আমরা সবাই দেশে অঘটন ঘটলে বড় আনন্দ পাও, না? কিরকম মানুষ তোমরা বুঝি না। একমাত্র কামনা তোমাদের কিছু একটা ঘটুক। আশ্চর্য! তবে শকুনের দোয়ায় কি আর গরু মরে।
মহুয়ার কথা কিন্তু শুনতে পাচ্ছে না শহীদ। ইতিমধ্যে সোফায় বসেছে সে। হাতে তুলে নিয়েছে সকালবেলার দৈনিক পত্রিকাটা। গভীর মনোযোগের সাথে, সেটাই পড়ছে সে। | গুলশানের বাড়ি এটা শহীদের। পা টিপে টিপে ছাদে উঠল মহুয়া। দেখল কামাল শক্তিশালী বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে তাকিয়ে আছে পুব দিকে।
অবাক হলো মহুয়া। কামাল গতকাল রাত এগারোটায় ছাদে উঠল বাকি রাতটুকু নক্ষত্র, গ্রহ ইত্যাদি দেখে কাটাবে বলে। শহীদকে এ কাজের শরিক করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে। শহীদ ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসেব-পত্র দেখার কাজে ব্যস্ত ছিল তখন। লাভ লোকসানের হিসেব নিয়ে চীফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট এসেছে।
/ পা টিপে টিপে কামালের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল মহুয়া। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কি দেখছে কামাল অমন গভীর মনোযোগের সাথে। চোখ কপালে উঠল মহুয়ার! ও, এই ব্যাপার! মাইল খানেক দূরে একটি বাড়ির সুইমিং পুল দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয় কেউ স্নান করছে ওখানে–খালি চোখে মহুয়া পরিষ্কার দেখতে না পেলেও
বুঝতে অসুবিধে হলো না, মেয়েরাই সাঁতার কাটছে। | হাত উঁচু করে কামালের কান চেপে ধরল মহুয়া শক্ত করে। * ‘কে–মাগো! মহুয়াদি, ছাড়ো..উঃ! লাগে বলছিঃ••।’
কান ধরে হিড় হিড় করে সিঁড়ির দিকে কামালকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে মহুয়া খিলখিল করে হেসে উঠল, বলল, নত্র, গ্রহ এসব বুঝি আজকাল সুইমিং পুলে
নেমে এসেছে!
ছাড়ো,লাগছে…লোকে কি বলবে দেখলে…।’
লোক কোথায়? ওই মেয়েগুলো, যারা সাঁতার কাটছিল? ওরা যদি দেখে থাকে তাহলে ভাববে আমি তোমার দজ্জাল বউ, কুকর্ম করাতে শাসন করছি।
মহুয়াদি, অপরাধ করেছি, নাফ চাই••• | আসলে ডি. কস্টা…’। তুমি বলতে চাও ডি, কস্টা ব্রেসিয়ার পরে নেমেছে ওই সুইমিং পুলে?’
না, না। সুইমিং পুলে না। আশেপাশেই ঘুর ঘুর করছে। ওকে দেখতে গিয়েই চোখে পড়ে গেল মেয়েগুলো। বিশ্বাস করো, দশ সেকেণ্ডের বেশি দেখিনি ওদের। এবার কানটা ছাড়ো, লক্ষ্মী দিদি। তোমাকে চাইনিজ খাওয়াব। উঃ!
“ঠিক আছে, ছাড়ছি। নিজে ধরো এবার। দশবার উঠবস করে নেমে এসো
কুয়াশা ৪৪
নিচে। আর হ্যাঁ-চাইনিজের কথাটা আবার ভুলে যেয়ো না যেন।
নিচে নেমে সোজা বাথরূমে ঢুকল কামাল। বেরুল দশ মিনিট পর । ড্রইংরূমে ঢুকতেই কানে গেল গভীর কণ্ঠস্বর। কাণ্ড ঘটেছে রে, কামাল।’ | | শহীদ হাতের দৈনিক পত্রিকাটা সামনের নিচু টেবিলে রেখে বলল, বর্ডারে একশো সাতচল্লিশটা ট্রাক ধরা পড়েছে, চাল ভর্তি। বর্ডার পেরিয়ে ওপারে যাচ্ছিল। এক হাজার টনেরও বেশি হবে-পঞ্চাশ লাখ টাকার চেয়েও বেশি মূল্য, বাজারদর, অনুযায়ী।
ধপ করে সোফায় বসল কামাল, বলিস কি?
পড়ে দেখ আরও মজার তথ্য আছে।’
মহুয়া বলে উঠল, সেরেছে। এই সকালবেলা তোমরা মজার তথ্য নিয়ে মেতে উঠবে! বলি ব্রেকফাস্ট কি আমার একার জন্যে তৈরি হয়েছে?
কামাল ততক্ষণ খবরের কাগজে নিমগ্ন। শহীদ চিন্তা করছে চোখ বুজে। ওরা কেউ যেন মহুয়ার কথা শুনতেই পায়নি। এদের সাথে রাগারাগি করে লাভ হবে না বুঝতে পেরে অসহায় দৃষ্টিতে দুজনকে খানিকক্ষণ দেখে নিয়ে দুপদাপ পায়ের শব্দ করে বেরিয়ে গেল মহুয়া।
কামাল বলে উঠল, কী সাংঘাতিক! কে এই এহসান চৌধুরী? ভদ্রলোককে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা উচিত।’
তুই ঠাট্টা করছিস?’
কামালকে সিরিয়াস দেখাচ্ছে, মোটেই না! ভেবে দেখ কী অসাধ্য সাধন | করেছেন ভদ্রলোক। ঢাকায় থাকতে তিনি খবর পান একদল চোরাচালানকারী প্রচুর চাল বর্ডারের ওপারে পাচার করার চেষ্টা করছে। পাচারকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার সময় পাননি তিনি। কিন্তু তাদেরকে অনুসরণ করার সুযোগ পান। ভদ্রলোকের সাথে মাত্র নয়জন সাহায্যকারী ছিল। বর্ডারের এমন এক জায়গা দিয়ে একশো সাতচল্লিশ ট্রাক চাল পাচারের চেষ্টা চলছিল যেখানে কোন সামরিক ঘাটি নেই। জায়গাটা স্বভাবতই বনভূমির গভীরে এবং দুর্গম। কিন্তু পাচারকারীরা রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে পাচারের পথ সুগম করার জন্য। সংখ্যায় তারা ছিল দুইশো লোক। সবাই সশস্ত্র। ওদের কাছ থেকে নানা রকম অস্ত্র এবং বোমা ছিনিয়ে নিয়ে এই এহসান চৌধুরী এবং তার নয়জন সাহায্যকারী বাধা দেয় পাচারের কাজে–ফলে ট্রাক রেখে পাচারকারীরা জান নিয়ে পালায়। শহীদ, তুই যা-ই বলিস, এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। এর মধ্যে, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, রহস্য আছে। কে এই এহসান চৌধুরী? এমন যার সাহস, তাকে দেশের লোক চেনে না কেন? চাল কেনা বেচারই ব্যবসা করে বলছে রিপোর্টার, তাছাড়া আরও ডজনখানেক ব্যবসা আছে ভদ্রলোকের। সবই বুঝলাম। প্রশ্ন হলো, এত দিন নাম শুনিনি কেন তার? আমার কি মনে হয় জানিস, শহীদ?
ভলিউম ১৫
৬০
“কি মনে হয়?
‘এ কাজ কুয়াশার নয় তো? এমন দুঃসাহসিকতাপূর্ণ অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত মনোবল, ক্ষমতা কুয়াশারই একমাত্র আছে বলে জানতাম। এখন দেখছি।’
শহীদ গম্ভীর হলো একটু। বলল, কুয়াশার কাজ বলছিস? কোন্ কাজটা বল তো? পাচার করার কাজটা, না, পাচারকারীদের ধরার কাজটা?’
কামাল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শহীদের দিকে।
শহীদ বলল, ‘প্রথম পাতারই শেষ কলামের সবচেয়ে নিচের খবরটা পড়ে দেখ।’
কামাল খবরের কাগজটা আবার তুলে ধরল সামনে, তারপর শহীদের নির্দেশিত খবরটা পড়তে শুরু করল । ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্বিমঃ কুয়াশার কোলকাতা উপস্থিতি। আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার গোপন এবং বিশ্বস্ত সূত্রে সংবাদ পেয়েছেন বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর দস কুয়াশা বর্তমানে কোলকাতা শহরে অ স্থান করছে। সংবাদ প্রাপ্তির সাথে সাথে প্রাদেশিক সরকার কুয়াশা কর্তৃক সম্ভাব্য ঘটন ঘটবার আশঙ্কা সম্পর্কে আইনরক্ষক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা করে, সরকারের মুখপাত্র এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন দস্য কুয়াশাকে জীবিত বন্দী করতে পারলে বা তার অবস্থানের সঠিক তথ্য দিতে পারলে পুরস্কৃত করা হবে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে।
কামাল নামিয়ে রাখল খবরের কাগজ। ‘কি বুঝলি?’
কামাল বলল, কুয়াশা কোলকাতায়! তারমানে কি এই যে চাল পাচার করার ব্যবস্থাদি সেরে সে আগেভাগে কোলকাতায় চলে গেছে পেমেন্ট নিতে?’
দূর বোকা! কুয়াশাকে তুই এতদিনেও চিনলি না! টাকা তার দরকার, সত্যি কথা। কিন্তু দেশের সম্পদ অন্য দেশে পাচার করে, দেশের চরম ক্ষতি করে কোন কাজ করার লোক সে নয়।’
কামাল বলল, তাহলে? পাচারকারী না হয় কুয়াশা নয় ধরে নিচ্ছি। কিন্তু এই এহসান চৌধুরীটা কে? এত টাকাই বা ইনি পেলেন কোথায়? খবরে দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে ভুখা-নাঙ্গা অসহায় মানুষের জন্যে লঙ্গরখানা খুলেছেন এই এহসান চৌধুরী। তারপর, এই একশো সাতচল্লিশ ট্রাক চাল। তাঁর বিশেষ অনুরোধে সরকার এই চাল যুক্তিসঙ্গত মূল্যে তাঁরই কাছে বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। এহসান চৌধুরী এই চাল কিনে লঙ্গরখানা খুলবে আরও কয়েকটা। ভেবে দেখ, কত লক্ষ টাকার ব্যাপার! বাংলাদেশে এত বড় মহান দাতা আছে–ভাবা যায়? গরীবের বন্ধু হিসেবে আমরা তো চিনি একমাত্র কুয়াশাকে। কুয়াশা ৪৪
‘এহসান চৌধুরী কুয়াশা নয় একথা জোর করে বলা যায় না, কামাল।
শহীদের কথা শুনে কামাল হতবাক।
শহীদ আবার বলল, এমনও তো হতে পারে কাগজের খবরটা মিথ্যে? হয়তো। কুয়াশাই রটিয়েছে। আসলে কোলকাতায় যায়ইনি সে•••’। এসব আমাদের সন্দেহের কথা। বেশি মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আসল কথা কি জানিস, ঘটনা মাত্র। ঘটতে শুরু করেছে। তুই কি মনে করিস পঞ্চাশ লক্ষ টাকা মূল্যের চাল যে পাচার করছিল সে সহজে এই এহসান চৌধুরীকে ছেড়ে দেবে?
মাথা খারাপ। নির্ঘাৎ এহসান চৌধুরীকে খুন করব সে।’
শহীদ বলল, ‘খুন করাটাই তো বড় কথা নয়। খুনোখুনি হয়তো শেষ পর্যন্ত হবে, কিন্তু তার আগে আরও কত কি ঘটতে পারে দেখ নাঃ••।’
আবার সেই খুনোখুনির কথা!’ মহুয়া প্রবেশ করল রূমে তার পিছনে ব্রেকফাস্টের ট্রে হাতে সন্দেশ এবং লেবু।
সন্দেশ ও লেবু দুই ভাই। দুজনেই তোতলা। ও যমজ ভাই। মহুয়া ওদেরকে আবিষ্কার করে একটি গ্রাম্য মেলাতে। বয়স হলো-সতেরো বছর। সন্দেশ সাত মিনিটের বড় লেবুর চেয়ে। বাড়ির কাজকর্ম করে ওরা।
‘ডি ডি-ডি-ডি•••।’ সন্দেশ টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে শহীদের দিকে তাকিয়ে বলতে চেষ্টা করছে কিছু।
বড় ভাই উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে দেখে ছোট ভাই লেবু বলতে চেষ্টা করল, | ‘ক-ক-কস-কস•••।’
কামাল ওদেরকে সাহায্য করল, ডি, কস্টা? সন্দেশ আনন্দে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।’ কামাল জানতে চাইল, ডি, কস্টা কি করেছে?
সন্দেশের মুখের হাসি উবে গেল। রীতিমত করুণ সুরে বলতে চেষ্টা করল সে, ‘ধা-ধা-ধা-ধা•••।’
লেবু যোগ দিল, পা-পা-পা-পা•••।’ শহীদ বিরক্তির সাথে বলল, এযে দেখছি রীতিমত গান ধরছে দুজনে! মহুয়া বলল, “এই! বেরো তোরা। আমি বলছি কি হয়েছে।’
মহুয়া ধমকে উঠতেই সন্দেশ এবং লেবু ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠল। কি করবে ভেবে কূল কিনারা পেল না যেন কিছুক্ষণ। তারপর, দুই ভাই একযোগে পরস্পর পরস্পরের কান ধরে দ্রুত ওঠ-বস করতে শুরু করল। পাঁচ-সাতবার ওঠ-বস করে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল বেডরূম থেকে।
হন মুখে মহুয়া বলল, “গতকাল ডি. কস্টা এসে ওদেরকে রমনা পার্ক দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। কথা ছিল পার্কে বেড়িয়ে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরবে। ওদের
৬২
ভলিউম ১৫
বেতনের টাকা আমার কাছে জমা থাকে। দশটা টাকা চাইল ওরা, দিলাম আমি। রাতে ফিরল দু’জন কাঁদতে কাঁদতে।’
টাকাগুলো ধাপ্পা দিয়ে কেড়ে নিয়ে ডি. কস্টা ওদেরকে।
মহুয়া বলল, হ্যাঁ। ওদেরকে পার্কে বসিয়ে রেখে টিকেট কাটতে যাবার নাম করে গাড়ি নিয়ে চলে যায়, আর ফেরেনি।
শহীদ মহুয়ার দিকে তাকাল, ‘গাড়ি? ‘হ্যাঁ, দাদার সেই কালো মার্সিডিজটা।
শহীদ এবং কামাল পরস্পরের দিকে তাকাল। কালো মার্সিডিজ কুয়াশা আর কাউকে ব্যবহার করতে দেয় না।
কামাল বলল, কুয়াশা তাহলে ঢাকায় নেই।’ শহীদ বলল, আমার সন্দেহ সত্যি হলে কোলকাতাতেও নেই সে।’
কামাল বলল, “ঢাকায় নেই, কোলকাতায় নেই–নিশ্চয়ই সে তাহলে বর্ডারে আছে!
শহীদ বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু যা মনে হয় কুয়াশার বেলায় তা সচরাচর সত্যি হয় না।’
তিন
পনেরো দিন পরের ঘটনা। ও সতেরোই মে। সকালবেলার খবরের কাগজে এহসান চৌধুরীর ছবি উঠল। সেই সাথে খবর ছাপা হলো : আজ দুপুর থেকে এহসান চৌধুরীর বদান্যতায় এবং তত্ত্বাবধানে মেট্রোপলিটান ঢাকার সাতটি এলাকায় সাতটি লঙ্গরখানা খোলা হচ্ছে। প্রতিটি লঙ্গরখানায় এক সীটিঙে নয়শো লোককে খাওয়ানো হবে।
ব্রেকফাস্ট সেরে সবেমাত্র দ্বিতীয় কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়েছে শহীদ, এমন সময় কামালের প্রবেশ, কাগজ দেখেছিস? এহসান চৌধুরীর ছবি ছাপা হয়েছে।’
শহীদ বলল, “ছরি দেখে কিন্তু সন্দেহ দূর হয়ে গেছে আমার। এহসান চৌধুরী কুয়াশা নয়।’
কামাল বসতে বসতে বলল, আমারও তাই মনে হয়েছে। কিন্তু তবু একবার সামনে থেকে নিজের চোখে দেখে আসা দরকার।’
‘এহসান চৌধুরী কুয়াশা নয়। এ ব্যাপারে আমি বাজি রাখতে পারি। তবে লোকটা আমাদের পরিচিত কেউ হতে পারে।’
তারমানে? পরিচিত কেউ-কে রে?’ ‘এখনই নামটা বলব না। আগে শিওর হয়ে নিই।’ ‘শিওর হতে হলে গিয়ে দেখে আসতে হবে। সাভারের লঙ্গরখানার যা?
কুয়াশা ৪৪
যাবার দরকার নেই। আমার বিশ্বাস, খবর পাব এখানে বসেই।’
কামাল বোকার মত তাকিয়ে রইল। বলল, হেঁয়ালি ছাড় তো! কে খবর পাঠাবে ভাবছিস?
ধৈর্য ধরো, বৎস! আমার অনুমান সহজে মিথ্যে প্রমাণিত হয় না…।’ কথা শেষ হলো না শহীদের, ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল ফোনটা। | রিসিভারটা ছোঁ মেরে তুলে নিল কামাল, হ্যালো?’
. অপরপ্রান্ত থেকে মি. সিম্পসনের সুপরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কামাল বলছ?
ইয়েস, মি. সিম্পসন। ‘শহীদ কোথায়?– আমার মুখোমুখি সোফায়। | মি. সিম্পসন বললেন, “আচ্ছা, মি. এহসান চৌধুরী সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি বলো তো?
কামাল বলল, ‘আমাদের দু’জনেরই ধারণা হয়েছিল এহসান চৌধুরী কুয়াশাই। কিন্তু আজকের কাগজে ছবি দেখে সে ধারণা ভুল•••।’ | মি. সিম্পসন বললেন, “আমারও তাই সন্দেহ ছিল। কিন্তু এখানে এসে দেখছি।’
‘আপনি কোত্থেকে বলছেন?
মি. সিম্পসন বললেন, সাভারের লঙ্গরখানা থেকে। মি. এহসান চৌধুরীর সাথে পরিচয় হয়েছে। না, কুয়াশা হতে পারেন না তিনি। বয়স খুবই কম। তবে খুব স্মার্ট। ইউরোপে ছিলেন অনেক দিন। বিদেশে ওর বাবার প্রচুর টাকা আছে। সেই টাকার সামান্য কিছু নিয়ে এসে এখানে ব্যবসা করছেন।
কামাল বলল, লঙ্গরখানায় কোনরকম গোলমালের আশঙ্কা করছেন আপনি, মি. সিম্পসন?’
| ‘পরিস্থিতি এখানে তো খুবই শান্ত। কিন্তু একটা কথা সরাতে পারছি না মন থেকে। এত টাকার চাল যে পাচার করার চেষ্টা করছিল সে কি চুপ করে বসে আছে? অবশ্য প্রচুর সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে প্রতিটি লঙ্গরখানায়। তবে মি. এহসান চৌধুরী নির্ভয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেরাচ্ছেন। বডিগার্ড দিতে চেয়েছি, নেবেন
তিনি।’
কামাল বলল, ‘শুধু টাকা আছে তাই নয়, উদার একটা মনও আছে, সেই সাথে আছে প্রচণ্ড সাহস।’
‘এত সব দোষ বা গুণ আছে দেখেই তো সন্দেহ করেছিলাম এ লোক কুয়াশা হয়ে যায় না। আমি জানতাম, এ সন্দেহ তোমাদের মনেও জাগবে। তাই ফোন করে ভুলটা ভেঙে দিলাম। যাক, এদিকে কিন্তু একটা গুজব ভীষণভাবে ছড়িয়েছে।’
‘পেজব?’ |
ভলিউম ১৫
মি. সিম্পসন বললেন, হ্যাঁ। লঙ্গরখানায় দলে দলে অভুক্ত নারী-পুরুষ-শিশু বুদ্ধ আসতে শুরু করেছে। তারা কি বলছে জানো?
“কি বলছে?’।
তারা বলছে, এহসান চৌধুরীই কুয়াশা। কুয়াশা ছাড়া এমন গরীবের বন্ধু আর কেউ নেই।’
আশ্চর্য!’ মি. সিম্পসন বললেন, ‘আশ্চর্য বলে আশ্চর্য । যাক, এখন ছাড়ি, কামাল। কামাল বলল, ঠিক আছে। একটা কথা, কিছু ঘটলে অবশ্যই জানাবেন। ‘অফকোর্স জানাব।’
সেদিনেরই ঘটনা।
সাভারের লঙ্গরখানা। শয়ে শয়ে অভুক্ত নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ ঘেরা এলাকার ভিতর চাটাইয়ের উপর অধীর অপেক্ষায় বসে আছে। খাদ্য বিতরণকারীরা দৌড়ো দৌড়ি ছুটোছুটি করে বড় বড় গামলায় ভাত, মাংস এবং ডাল নিয়ে আসছে। কিন্তু এখনও পরিবেশন করা হয়নি। ক্ষুধার্ত পশুর মত লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবাই সেদিকে। | এহসান চৌধুরী স্বয়ং তদারক করছেন। লাউডস্পীকারে ঘোষণা করা হচ্ছে দু’একমিনিট পরপরই : অধৈর্য হবেন না। এখুনি পরিবেশনের কাজ শুরু হবে।
পরিবেশনের কাজ শুরু হলো। প্রচুর ভলানটিয়ার নিযুক্ত আছে এ কাজে। ফলে কম বেশি নয়শো লোককে প্রায় একত্রে পরিবেশন করা কঠিন হলো না। খাওয়া যেন সবাই একসাথে শুরু করে একসাথে শেষ করতে পারে তার দিকে বিশেষ নজরও রাখা হয়েছে। কারণ প্রথম ব্যচ উঠে গেলে দ্বিতীয় ব্যাচ বসবে। তারপর তৃতীয় এবং চতুর্থ ব্যাচ।
পরিবেশনের কাজ শুরু হলো। বেশ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলেছে কাজ। এহসান চৌধুরী ঘড়ি দেখলেন। মি. সিম্পসন সারাক্ষণ তার পাশে পাশে আছেন।
‘ নারায়ণগঞ্জের খবরটা পেলাম না এখনও। একবার যেতে চাই।’ এহসান চৌধুরী বললেন।
মি. সিম্পসন বললেন, এখানে আর কোন অসুবিধে হবে না। যেতে পারেন আপনি। তবে আপনি যদি আপত্তি না করেন তাহলে সাথে আমি যেতে পারি? আপনার জীবনের ওপর হামলা আসার আশঙ্কা।
মুচকি হাসলেন এহসান চৌধুরী। বললেন, আপনি অকারণে দুশ্চিন্তা করছেন, মি. সিম্পসন। নিজেকে রক্ষা করার মত যোগ্যতা আমার আছে। তাছাড়া আমার ধারণা, কোন রকম বিপদ ঘটবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আপনাকে আমি
৫–কুয়াশা ৪৪
অহেতুক কষ্ট করতে দেব না। আমি একাই মুভ করব।
গাড়িতে গিয়ে চড়লেন এহসান চৌধুরী। মৃদু হাসলেন মি. সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে। হাত নাড়লেন। বললেন, আবার দেখা হবে। স্টার্ট দেয়া গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে গেল সামনে থেকে।
এই প্রথম একটা সন্দেহ জাগল মি. সিম্পসনের মনে। এহসান চৌধুরী কথা বললেন চিবিয়ে চিবিয়ে। ইউরোপে অনেকদিন থাকার ফলে অনেকে এই রকম চিবিয়ে চিবিয়ে বাংলা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু এহসান চৌধুরীর কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকল, অথচ চিনতে পারা যাচ্ছে না। ভদ্রলোক নিজের প্রকৃত কণ্ঠস্বর গোপন রাখার জন্যে অমন চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন না তো?
চার
শহীদের ড্রয়িংরূম।
ক্যারম খেলছিল কামাল আর মহুয়া। শহীদ একটা বিশাল উপন্যাসের অতলতলে নিমজ্জিত। এমন সময় বেডরূম থেকে শব্দ ভেসে এল, “ক্রিং ক্রিং…।’
ফোন। মহুয়া কথাটা বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ড্রয়িংরূম থেকে। যারা সময় কামালের উদ্দেশ্যে বলল, “গুটি গোনা আছে আমার, চুরি কোরো না!’
| তিন মিনিট পর সম্পূর্ণ অন্য চেহারা নিয়ে প্রায় টলতে টলতে ড্রয়িংরূমে প্রবেশ করল মহুয়া। ভীষণ. অসুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়াল, সে। তারপর পা বাড়াল। ভাঙা গলায় কোনরকমে উচ্চারণ করল, শহীদ…!
‘মহুয়াদি!’ কামাল মুখ তুলে মহুয়ার অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে উঠল।
বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে তড়াক করে সিধে হয়ে দাঁড়াল শহীদ কার্পেটের উপর, কি হলো!’ | দাদা খুন করেছে•••সাভারের লঙ্গরখানায় নয়শো লোক..সবাই মারা গেছে…মি. সিম্পসন কথা বলবেন তোমার সাথে•••।’
‘মহুয়া! ছুটল শহীদ। ছুটল কামাল। কিন্তু ওরা মহুয়ার কাছে গিয়ে পৌঁছুবার আগেই মহুয়া জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল কার্পেটের উপর।
| ‘তুই দেখ ওকে। আমি কথা বলি মি. সিম্পসনের সাথে। | ছুটে বেরিয়ে গেল শহীদ। কামাল মহুয়ার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার, করে ডাকল, সন্দেশ! লেবু!
–
–
–
অকুস্থলে পৌঁছল ওরা বিকেল পাঁচটারও কিছু পরে।
দুটো গ্রামের মধ্যবর্তী মস্ত মাঠের মাঝখানে বেড়া দিয়ে ঘেরা লঙ্গরখানা। ভিড়
৬৬
ভলিউম ১৫
ঠেলে এগোনোই মুশকিল। গাড়ি থামাতে নির্দেশ দিল শহীদ। স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে কামাল বলল, ‘মি. সিম্পসনকে দেখছি না কিন্তু।
‘মি: সিম্পসন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিন মি. ওবায়দুল হককে নিয়ে ব্যস্ত, সম্ভবত। দেখছিস না, ভদ্রলোকের গাড়ি দেখা যাচ্ছে।
‘আরে, তাই তো!’
ভিড় ঠেলে এগোল ওরা। আশপাশের গ্রাম থেকে লোক এসেছে ঘটনার কথা শুনে। মুখেমুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। শুধু আশপাশের গ্রামে নয়, সারা দেশে, সারা পৃথিবীতে ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্ভাগা নয়শো লোকের খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত মৃত্যু সংবাদ।
পুলিস কর্ডন দিয়ে রেখেছে লঙ্গরখানা। কেউ ভিতরে ঢুকতে পারছে না। ভিতরে অবশ্য ভলানটিয়ার এবং তদারককারীরা রয়েছে এখনও। পুলিস তাদের সাথে কথা বলবে বলে কাউকে বেরুবার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। | গেটের কাছে মি. সিম্পসনকে পেল ওরা। তিনি একা নন, তার সাথে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিস মি. ওবায়দুল হক ছাড়াও রয়েছেন উচ্চ পদস্থ পুলিস অফিসার, ডেপুটি কমিশনার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি, প্রখ্যাত ডাক্তার মি. আহাদ খান, মি. জাফরউল্লাহ, মি. শেখ আবদুস সবুর এবং আরও অনেকে। | ওদের দুজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার হলো না কারও। ওঁরা
সবাই শহীদ এবং কামালকে চেনেন।
শহীদ, মাই বয়•••! মি. সিম্পসন এগিয়ে এসে শহীদের কাঁধে হাত রেখে সাথে করে নিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিস মি, ওবায়দুল হকের সামনে। শহীদের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা শক্ত করে ধরলেন মি. ওবায়দুল হক। কিন্তু কোন কথা
বলে একপাশে টেনে নিয়ে গেলেন শহীদকে।
সকলের কাছ থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। মি. ওবায়দুল হক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “চিঠিতে কুয়াশা নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে। সাংবাদিকরা বাইরে দল বেঁধে অপেক্ষা করছে, কিন্তু আমরা এখনও চিঠির কথা ওদেরকে বলিনি।
| মি. সিম্পসন শহীদকে ফোনে আগেই জানিয়েছিলেন কুয়াশা একটা চিঠি লিখে স্বীকার কুরে গেছে যে নয়শো লোককে সে সজ্ঞানে হত্যা করেছে। কারণ হিসেবে সে বলেছে বাংলাদেশে লোকসংখ্যা খুব বেশি বেড়ে গেছে এবং লোকসংখ্যা এত বেশি বলেই দেশের আর্থিক অবস্থা এমন খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। এই সমস্যার একমাত্র সমাধান মানুষকে মেরে ফেলা। প্রচুর মানুষ মেরে ফেলার পর যারা বেঁচে থাকবে তারা বেশ আনন্দেই থাকবে। তাদের কোন অভাব থাকবে না।
এই কথা ভেবেই সে হত্যাযজ্ঞে নেমেছে।
শহীদ বলল, ‘আপাতত চিঠির কথাটা প্রকাশ করা উচিত হবে না। চিঠিটা আমি
কুয়াশা ৪৪
৬৭
পরীক্ষা করে দেখব। তার আগে আমি জানতে চাই, অন্যান্য লঙ্গরখানা থে দুঃসংবাদ এসেছে কিনা।’
‘এখনও আসেনি। তবে আমি নির্দেশ দিয়েছি সব লঙ্গরখানা ইমিডিয়েটলি । করে দিতে। তার আগেই মারা পড়ল কিনা কে জানে!
শহীদ বলল, মি. এহসান চৌধুরী কোথায়?
সে-ই তো কালপ্রিট। আমার বিশ্বাস সে কুয়াশারই অনুচর। নারায়ণগঞ্জে লঙ্গরখানায় যাবার নাম করে এখান থেকে কেটে পড়ে সে চারটের দিকে। ওর খো পেলেই ওকে অ্যারেস্ট করবার হুকুম দিয়েছি।’
শহীদ জানতে চাইল, লাশ গোনা হয়েছে? নয়শো বত্রিশটা লাশ। শহীদ ঢোক গিলল, ফুড পয়জনিং?
হ্যাঁ। তবে এমন একটা বিষ যার সাথে স্থানীয় হোমড়া-চোমড়া ডাক্তারর পরিচিত নন। মৃত্যুর কারণ নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে ওদের মধ্যে। খাবার পরীক্ষা করে কেমিক্যালস পাওয়া গেছে অবশ্য। ডাক্তার আহাদ খান বল! ভিকটিমদের হার্ট রহস্যজনক কোন কারণে সাডেনলি স্টপ হয়ে গেছে।
শহীদ অন্যমনস্ক ভাবে বলল, হু।
এমনি সময়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন মি. সিম্পসন। স্যার! সর্বনাশ হ গেছে! ঢাকার কন্ট্রোলরূম জানাচ্ছে প্রত্যেকটা লঙ্গরখানা থেকেই এসে মৃত্যুসংবাদ। লাশের মোট সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজার!
স্তম্ভিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওরা দুজন সিম্পসনের মুখের দিকে। সংবিত ফি পেয়ে ওবায়দুল হক বললেন, ‘মাই গড! ইমপসি! সবাই মারা গেছে?
সবাই। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সিম্পসন।’
ওবায়দুল হক বললেন, মি. শহীদ, এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্যে দায়ী যে হোক, আমরা চাই অপরাধী ধরা পড়ুক এবং চরম শাস্তি পাক। অপরাধী কে । আগে জানতে হবে আমাদের, তারপর তাকে গ্রেফতারের প্রশ্ন। ব্যক্তিগতভা আমি চাই, এই মস্ত দায়িত্ব আপনি গ্রহণ করুন। অতীতে আপনার মূল্যবান সাহা আমরা পেয়েছি, আশা করি আজকের এই মহা বিপদের দিনেও বঞ্চিত হব না । আ অফিশিয়ালি আপনাকে রিকোয়েস্ট করব! পুলিসবাহিনী আপনাকে সবর সাহায্যের জন্যে তৈরি থাকবে।’
‘ধন্যবাদ, স্যার।’ শহীদকে নিয়ে মি: ওবায়দুল হক ফিরে এলেন সব মাঝখানে।
শহীদ মৃদুস্বরে, অনেকটা আপন মনে বলল, “ঠিক যেন মিলছে না। মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, কি মিলছে না, শহীদ?
না ও কিছু না। আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম। আচ্ছা, মি. সিম্পস
ভলিউম
[শগুলোর কি ব্যবস্থা করা যায় বলুন তো?
প্রখ্যাত ডাক্তার আহাদ খান শহীদের মুখোমুখি হলেন, মি. শহীদ, লাশগুলোর ব্যাপারে আমার একটা বক্তব্য আছে।’
চোখ ফিরিয়ে তাকাল শহীদ ডাক্তার আহাদ খানের দিকে। আমার বিশ্বাস, খাদ্যে এমন একটা রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়েছে যা শরীরের অভ্যন্তরে কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোনরকম ক্ষতি সাধন না করে কেবলমাত্র হার্টকে অচল করে। দিয়েছে। অকস্মাৎ থামিয়ে দিয়েছে ওটাকে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে আশ্চর্য এক ধরনের কেমিক্যাল পাওয়া গেছে। আমার কোন সন্দেহ নেই যে সব লাশের পাকস্থলিতে ওই একই জিনিস পাওয়া যাবে। নিশ্চিত হবার জন্য কোন লাশের পেট কেটে দেখার ঘোর বিরোধী আমি। ‘
শহীদ এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বৃদ্ধ ডাক্তার আহাদের দিকে। ডাক্তার আহাদ আবার বলতে শুরু করলেন, ডাক্তারী শাস্ত্রে এইরকম সমস্যার কথা উল্লেখ নেই। তবু, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কোন মেডিসিন বা ম্যাসেজের সাহায্যে যদি একবার হার্টকে চালু করা যায় তাহলেই বেঁচে যাবে এই নয়শো বত্রিশ জন মানুষ।
নয়শো বত্রিশ নয় ড. আহাদ, খবর এসেছে, মোট লাশের সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজার।’
| অন্যান্য ডাক্তাররা ফিসফিস করে আলোচনা করছে। তারা সবাই একমত হলো, বুড়ো ডাক্তার আহাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তা না হলে ফুড পয়জনিং হয়ে ঘণ্টা দেড়েক আগে মারা গেছে যারা তাদেরকে বাঁচাবার কথা ভাবে কি করে?
ডাক্তার আহাদ কিন্তু বলেই চলেছেন, ‘আমি আমার বিশ্বাস অনুযায়ী একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই। আপনারা আমাকে যদি একটি লাশ দেন, অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারি।, মি. সিম্পসন বললেন, তুমি কি বলো, শহীদ?
শহীদ বলল, ডাক্তার আহাদের যখন চেষ্টা করার ইচ্ছা হয়েছে, তখন আমাদের বাধা দিয়ে লাভ কি?
ডাক্তার আহাদ হাসলেন। বললেন, ‘ধন্যবাদ। আমি এখুনি লাশ নিয়ে চলে যেতে চাই। ব্যবস্থা করে দিন। আর হ্যাঁ, লাশগুলো যেন কঠোর পাহারায় রাখা হয়। নাড়াচাড়া করার দরকার নেই। পোস্ট মর্টেমের জন্যে কোথাও যেন পাঠানো হয়। আমার বিশ্বাস ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমার কাছ থেকে রিপোর্ট পাবেন…’
মি. সিম্পসন ডাক্তার আহাদকে নিয়ে চলে গেলেন। অকুস্থল থেকে বিদায় নিলেন আরও অনেকে। কামালকে ডেকে নিয়ে গিয়ে শহীদ তার কানে কানে কি যেন
বলল।
ছানাবড়ার মত হয়ে উঠল কামালের চোখ দুটো। পরমুহূর্তে পকেটে হাত
কুয়াশা ৪৪
ঢুকিয়ে রিভলভারটা বের করে কামাল দ্রুত কণ্ঠে বলল, কই, কোন্ দিকে গেল? “ হেসে উঠল শহীদ। বলল, ওর নাম শুনেই খেপে গেলি যে? বাধা দিয়ে কোন্ত লাভ হবে? তাছাড়া আমার ধারণা••• মি. সিম্পসন এদিকে আসছেন দেখে চুপ করে গেল শহীদ।
মি. সিম্পসন উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন এগিয়ে আসতে আসতে, শহীদ, আর এক কাণ্ড ঘটেছে।
কামাল লুকিয়ে ফেলল রিভলভারটা। বলল, কি ঘটল আবার? লাশ চুরি হয়েছে একটা। চুরি, ঠিক নয়, ছিনতাই।’
সে কি!
হ্যাঁ। একটা ভ্যানগাড়ি লঙ্গরখানার পশ্চিমদিকে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ থেকে। পুলিসরা ভেবেছিল, কোন ভদ্রলোক নিয়ে এসেছেন ওটা। খানিক আগে হঠাৎ ভ্যান, থেকে পাঁচজন সশস্ত্র লোক বেরিয়ে এসে পাহারাত এগারোজন পুলিসকে বেঁধে ফেলে। বেড়ার পাঁচিল টপকে তারা লঙ্গরখানার ভেতরে ঢুকে একটা লাশ নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
রহস্যময় ব্যাপার!’ কামাল কথাটা বলে তাকাল শহীদের দিকে।
কি যেন চিন্তা করছে শহীদ। মুখ তুলে বলে উঠল হঠাৎ, ইয়েস, ভেরি মিসটিরিয়াস অ্যাণ্ড ইন্টারেস্টিং। * মি. সিম্পসন চেয়ে আছেন শহীদের দিকে, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ভেরি মিসটিরিয়াস অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং, শহীদ?
শহীদ বলল, মি. সিম্পসন, আপনার এখানের কাজ শেষ হলে চলুন, বাড়ি ফিরি। ফেরার পথে বলব।’
কামাল বলল, ‘চিঠিটা দেখা যাক আগে। মি. সিম্পসন পকেটে হাত দিলেন।
শহীদ বলল, কুয়াশার চিঠিটা তো?, থাক। দেখার আর দরকার নেই আমার। নিশ্চয়ই টাইপ করা চিঠি?
হ্যাঁ। ‘এ চিঠি কুয়াশার নয়।’ মি. সিম্পসন স্তম্ভিত। কুয়াশার নয়! বলো কি! তুমি জানলে কি করে?
শহীদ বলল, “চিঠিটার বক্তব্য শুনেছি। শুনেই বুঝেছি ও চিঠি কুয়াশার হতে পারে না। মানুষের জীবন নিয়ে এইভাবে ছিনিমিনি খেলার লোক আর যেই হোক, কুয়াশা নয়। লোকসংখ্যা বেড়ে গেছে বলে লোককে খুন করে কমাতে হবে এই সিদ্ধান্ত হাস্যকর। একমাত্র উন্মাদ কোন লোক এইরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
মি. সিম্পসন বললেন, তোমার ধারণা কুয়াশার ঘাড়ে সব দোষ চাপানোর উদ্দেশ্যে কেউ•••। | ‘হ্যাঁ। আমার তাই ধারণা।
৭০
ভলিউম ১৫
=
F
=
১
– : :
কাকে সন্দেহ করিস তুই, শহীদ?’ জানতে চাইল কামাল।
সন্দেহ আমি কাউকে করি না। তবে চাল পাচার করতে যাচ্ছিল যে লোক তার কথা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না আমাদের। মার খেয়ে মার হজম করার লোক সে না-ও হতে পারে। এহসান চৌধুরীর সুনাম ধ্বংস করার জন্যে সে লোক খাদ্যে মারাত্মক কোন বিষ মিশিয়ে দিয়ে থাকলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।’
মি. সিম্পসন বললেন, না, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু সে লোক দোষটা কুয়াশার ঘাড়ে চাপাতে চাইবে কেন? কুয়াশার সাথে তার কি সম্পর্ক?’
শহীদ গাড়ির দিকে পা বাড়াল। বলল, কুয়াশার সাথে কি সম্পর্ক জানব কি করে? তবে, সে লোক হয়তো চাল পাচার করতে পারেনি কুয়াশা বাধা দেয়াতেই।’
অর্থাৎ! কামাল বলল, অর্থাৎ এহসান চৌধুরী…’
কুয়াশা?’ শহীদ হাসল। বলল, না এহসান চৌধুরী যে কুয়াশা নয় তা তার ছবি দেখেই বুঝতে পেরেছি। তবে এহসান চৌধুরী হয়তো কুয়াশার পরিচিত, কুয়াশা হয়তো চাল পাচার করার কাজে বাধার সৃষ্টি করেছে এহসান চৌধুরীর সাহায্যে। সবই হয়তো করেছে কুয়াশা স্বয়ং, কিন্তু পিছনে থেকে। নিজের পরিচয় গোপন রাখার জন্য এহসান চৌধুরীকে ব্যবহার করেছে সে।’
কামাল বলল, আমি কিন্তু অন্য একটা কথা ভাবছি। চাল যে পাচার করার চেষ্টা করছিল, সে কে? কি তার পরিচয়? প্রতিশোধ বশত এই এতগুলো লোককে খুন করার কথা কল্পনা করতেও ভয় লাগেনি তার?
‘সে লোক নিশ্চয়ই এমন কেউ যে ভয় পায় না। সম্বত উন্মাদ. কোন লোক, শহীদ বলল ।
মি. সিম্পসন. বললেন, সাধারণ কেউ সে নয়। এমন একটা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেছে যার সাথে পরিচয় নেই রসায়নবিদদের। আমার মনে হয় কোন মিস গাইডেড সাইন্টিস্ট..মাই গড। শহীদ, এ লোক•••?’ |
শহীদ গম্ভীর হয়ে বলে উঠল, হ্যাঁ, মি. সিম্পসন, সন্দেহ আমার আপনার আগেই হয়েছে। আমার ধারণা প্রায় একযুগ পর আবার প্রফেসর ওয়াই বাংলাদেশে
• ফিরে এসেছেন।’
• মাই গড!’ লাফিয়ে উঠলেন মি. সিম্পসন। ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেছে তাঁর মুখের চেহারা, তোমার কথা যদি সত্যি হয়, আরাম হারাম হয়ে যাবে জীবন থেকে। জান কবচ করে ছাড়বে শয়তানটা•••।’
শহীদের গাড়িতে উঠে বসল ওরা তিনজন। কামাল স্টার্ট দিল গাড়ি। কি যেন বলতে গিয়ে ক্ষান্ত হলেন মি. সিম্পসন। শহীদ গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছে। ওকে বিরক্ত করা উচিত হবে না।
কুয়াশা ৪৪
মীরপুর ব্রিজ পেরিয়ে এল ওদের গাড়ি।
মি. সিম্পসন বললেন, কামাল, সামনের পেট্রল পাম্পে গাড়ি থামিয়ে। ফোন করব। ডাক্তার আহাদ লাশ নিয়ে গেছেন তা প্রায় একঘণ্টা তো হয়ে গেল।’
শহীদ বা কামাল কেউ কোন কথা বলল না। খানিক পর ট্রেল পাম্পের সামনে গাড়ি থামাল কামাল। মি. সিম্পসন নেমে গেলেন দরজা খুলে।
| মিনিট পাঁচেক পর জুতোর মচমচ শব্দ তুলে দ্রুত ফিরে এসে গাড়িতে উঠলেন মি. সিম্পসন। বললেন, “কি যে ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না।’
| ‘কেন, আবার কি ঘটল?
মি. সিম্পসন বললেন, চোখের মাথা আমরা সবাই খেয়ে বসে আছি, শহীদ, তা না হলে–যাক, কি ঘটেছে শুনবে? ফোন করেছিলাম ডাক্তার আহাদের বাড়িতে। ফোন ধরেছিলেন ডাক্তার স্বয়ং। লাশের কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, গত সাতদিন ধরে তিনি অসুস্থ, বাড়ি থেকে এক সেকেণ্ডের জন্যেও বের হননি। আজকে বের হবেন কিনা ভাবছেন।
শহীদ বলল, “ডাক্তার আহাদ মিথ্যে বলেননি। ‘হোয়াট!
শহীদ বলল, “অকুস্থলে যাকে আমরা দেখলাম, যে লাশ চেয়ে নিয়ে গেল সে আসলে ডাক্তার আহাদ নয়, ডাক্তার আহাদের ছদ্মবেশধারী।’
“কি বলছ তুমি! মি, সিম্পসন বিমূঢ়।
শহীদ শান্তভাবে বলল, “ঠিকই বলছি। লোকটা আসলে কে জানেন, মি, সিম্পসন?’
কে?’ ‘স্বয়ং কুয়াশা।’ মি. সিম্পসন চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মাই গড!
শহীদের গুলশানের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সাদা ফোক্সওয়াগেনটা। গাড়ি থেকে নামার সময় ওরা লক্ষ করল একটা ট্যাক্সি গেটের কাছ থেকে বাঁক নিয়ে ফিরে যাচ্ছে।
তোমার বাড়িতে কেউ এসেছে মনে হচ্ছে, শহীদ,’ মি. সিম্পসন বললেন।
শহীদ বলল, আমার ধারণা সত্যি হলে নির্ঘাৎ এহসান চৌধুরী এসেছে আমার সাথে কথা বলতে।
পাঁচ ড্রয়িংরূমে ঢুকে কিন্তু ওরা কাউকে দেখতে পেল না।
৭২
ভলিউম ১৫
কোথায় তোর এহসান চৌধুরী? কামাল সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকাল শহীদের দিকে। শহীদ বলল, তোরা বস। ভিতরটা দেখে আসি আমি।’
বেডরমে মহুয়াকে পেল শহীদ। শহীদকে দেখে হাসি পেলেও সেটা প্রকাশ করল না মূহুয়া। চোখে মুখে উদ্বেগ ফুটিয়ে তুলে বলল, কি খবর গো?
‘ভাল নয়। দাদী:••!’
সে দায়ী নয়।’ মহুয়া বলল, এদিকে এক কাণ্ড•••।’ ‘কি?’
‘এহসান চৌধুরী, যার ছবি ছাপা হয়েছে আজকের পত্রিকায়, তোমার সাথে দেখা করতে এসেছৈন।’
শহীদ স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইল, ‘কোথায় সে?’
ছাদে। তুমি ছাড়া আর কারও সাথে দেখা করতে রাজি না, ড্রয়িংরূমে বসতে চাইছিলেন না, তাই আমি ছাদে একটা চেয়ার পেতে দিতে বললাম সন্দেশকে।
শহীদ হাসল, হয়েছে, আর অভিনয়ের দরকার নেই। ভাবখানা দেখাচ্ছ, এই এহসান চৌধুরী কে তা জানো না।’
তুমি জানো আসলে কে ও?’
শহীদ বলল, জানব না? এই লাইনে কম দিন তো কাটালাম না। আমি ছবি দেখেই সন্দেহ করেছিলাম। তারপর ঘটনার সাথে ঘটনা মিলিয়ে পরিষ্কার বুঝতে পারি কে এই এহসান চৌধুরী।
সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল শহীদ। ছাদে উঠে শহীদ দেখল চেয়ারে বসে আছে এহসান চৌধুরী। সংবাদপত্রের ছবিতে দেখা চেহারার সাথে পুরোপুরি মিল দেখা যাচ্ছে।
“কি হে, এহসান চৌধুরী! অমন মন খারাপ করে বসে আছো কেন?
চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল এহসান চৌধুরী। বলে উঠল, ‘শহীদ ভাই! কখন এলেন? আমি জানতাম, আপনি ঠিকই চিনে ফেলবেন আমাকে।’
এহসান চৌধুরী উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে।
শহীদ একটু গম্ভীর হলো, সব কথা ব্যাখ্যা করে বলো তো, রাসেল। আমি যা ভেবেছি তার সাথে সব মেলে কিনা দেখি।’
এহসান চৌধুরী আসলে দুঃসাহসী যুবক রাসেল ছাড়া আর কেউ নয়। দ্রুত এবং সংক্ষেপে সব কথা বলল রাসেল।
শহীদ মৃদু হেসে বলল, যা ভেবেছি সব মিলে যাচ্ছে। কুয়াশা প্রফেসর ওয়াইকে চোখে চোখে রাখছিল, সে বাংলাদেশে পা দেবার পর থেকেই। একদল কুয়াশা ৪৪
মওজুতদার বিশ্বাসঘাতক প্রফেসর ওয়াইকে প্রস্তাব দেয় তাদের প্রায় এক হাজার টন। চাল বর্ডারের ওপারে পৌঁছে দেবার, প্রফেসর ওয়াই সাথে সাথে তা গ্রহণ করে–এ খবর কুয়াশা জানতে পারে। প্রফেসর ওয়াইয়ের প্রচুর টাকা দরকার, সে ভেবেছিল চাল বর্ডারের ওপারে নিয়ে গিয়ে প্রস্তাবকারীদের প্রতিনিধিদের হাতে তা তুলে, না। দিয়ে নিজের লোকদের দিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেবে, ঠকাবে প্রস্তাবকারীদের। কুয়াশা ঠিক করে বর্ডারে বাধা দেবে সে। এবং নিজের পরিচয় গোপন রাখার জন্য তোমাকে সে ব্যবহার করে–এই তো?’
। হ্যাঁ।’
শহীদ বলল, ডাক্তার আহাদের ছদ্মবেশে কুয়াশা যে লাশ নিয়ে গেল–কাজ হবে বলে মনে করো?
‘ঠিক জানি না। তবে আশার আলো না দেখলে কুয়াশা যে কোন কাজে হাত দেন না তা তো আপনি জানেন।’
নিচে চলো, রাসেল। মি. সিম্পসন সব শুনতে চাইবেন তোমার মুখ থেকে।
রাসেল আঁতকে উঠল, “অসম্ভব, শহীদ ভাই। মি. সিম্পসন এসব কথা শুনলে ভাববেন আমি কুয়াশার সহকারী, নির্ঘাৎ গ্রেফতার করতে চাইবেন। তাছাড়া কাজও আছে অনেক। এখন সমস্যা হলো ওর চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালাই কি করে•••।’
শহীদ বলল, ‘পালাবার রাস্তা আছে। বাতলে দেব। কিন্তু সত্যিই ওঁর সাথে দেখা করতে চাও না?’
।’ বেশ। তাহলে শোনো…’
শহীদের মুখে সব কথা শুনে মি. সিম্পসন বললেন, সত্যিই তাহলে শয়তান প্রফেসর ওয়াই বাংাদেশে আবার ফিরে এসেছে!’
শহীদ বলল, এখন আর কোন সন্দেহ নেই। | কামাল কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, আমার ধারণা প্রফেসর ওয়াই শুধু প্রতিশোধ নেবার জন্যে সাড়ে ছ’হাজার লোককে হত্যা করেনি। কোন মেডিসিন পরীক্ষা করার ইচ্ছাও তার ছিল। হয়তো কোন এক্সপেরিমেন্ট••|’ :
| শহীদ বলল, আমারও তাই ধারণা । তবে কুয়াশার ওপর দোষ চাপানোও আর এক উদ্দেশ্য। প্রফেসর ওয়াই বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, একথা কুয়াশাও স্বীকার করেছে অতীতে। বিজ্ঞান চর্চার জন্যে উৎসর্গীকৃত প্রাণ, তবে বদ্ধ উন্মাদ, মিসগাইডেড।’ | মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, লাশ হাইজ্যাক নিশ্চয়ই ওই শয়তানের
চেনাদেরই কাণ্ড।’
শহীদ বলল, “ঠিক ধরেছেন। লোকগুলোকে মেরে ফেলেছে এক্সপেরিমেন্ট
.৭৪
ভলিউম ১৫
করতে গিয়ে, এখন তাদেরকে বাঁচাবার জন্যে এক্সপেরিমেন্ট চালাবে। | ক্রিং ক্রিং••• ক্রিং•••। ফোনের শব্দ ভেসে এল। কফির কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে ড্রয়িংরূম থেকে বেরিয়ে গেল কামাল।
মি. সিম্পসন বললেন, “গতবার শয়অন প্রফেসর ওয়াইয়ের টিকি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারিনি আমরা, মনে আছে, শহীদ? একের পর এক খুন, ডাকাতি, লুঠ করে গেছে সে। আমরা অসহায় দর্শকের মত দাঁড়িয়ে পঁড়িয়ে দেখেছি। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, আজ অবধি তার, প্রকৃত চেহারা কেমন দেখিনি আমরা। প্রতিদিন সে নতুন নতুন ছদ্মবেশ নেয়। আজ পর্যন্ত আমরা জানতে পারলাম না শয়তানটার জন্ম স্থান। কোথায়, মাতৃভাষা কি! এমনকি তার নামটা পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারিনি আমরা। কেউ বলে প্রফেসর ইয়াহ্। কেউ বলে প্রফেসর ইয়াঙ্কী, কেউ বলে প্রফেসর যোগী, কেউ বলে প্রফেসর ইয়াকুব-স্ট্রেজ! |
কামাল ফিরে এল ড্রয়িংরূমে, ‘অজ্ঞাত পরিচয়ের ফোন। লঙ্গরখানাগুলো থেকে লাশগুলো সরাতে নিষেধ করল। নিষেধ অমান্য করলে শাস্তি দেয়া হবে–মৃত্যুদণ্ড!
টপ করে বসল কামাল সোফায়। ‘এ নিশ্চয়ই শয়তান প্রফেসর ওয়াইয়ের হুমকি! মি. সিম্পসন মন্তব্য করলেন। কামাল বলল, আমারও তইি বিশ্বাস।’
শহীদ বলল, দুই প্রতিভা নিহত লোকগুলোকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। দেখা যাক কে সফল হয়। কিংবা আদৌ কেউ হয় কিনা। মরা মানুষকে বাঁচানো তো আর ছেলেখেলা কথা নয়!
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ফোন এল। মি. সিম্পসনের ফোন, অফিস থেকে করেছে তার সেক্রেটারি।
ফোনে আলাপ করে মি. সিম্পসন ড্রয়িংরূমে ফিরে এলেন। বললেন, শহীদ, কুয়াশার কোন আড্ডা আছে কিনা জানো শান্তিনগর এলাকায়?’
‘আছে বলে শুনেছি। কেন?’
মি. সিম্পসন বললেন, একটা লাশ পাওয়া গেছে শান্তিনগর এলাকায় । ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গেছে কেউ। বুক চেরা, পেট চেরা লাশ। বাহুতে ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে তার চিহ্নও পাওয়া গেছে। আমার মনে হয় কুয়াশা যে লাশ নিয়ে গেছে সাভার থেকে এটা সেটাই। পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে সে। লোকগুলোকে বাঁচানো সম্ভব নয় বুঝতে পেরে সহকারীদের ফেলে দিতে বলায় সহকারীরা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গেছে..’
কামাল বলল, প্রফেসর ওয়াই যে লাশটা হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে এটা সেই লাশও তো হতে পারে।
কুয়াশা ৪৪
ক্রিং ক্রিং ক্রিং•••|
কামাল সোফা ত্যাগ করতে করতে বলল, “ড্রয়িংরূমের ফোনটা ভাগ্যগুণে আজই খারাপ হয়ে গেল!’
| কামাল অদৃশ্য হয়ে যেতে মি. সিম্পসন বললেন, ‘কে আবার কি খবর দেয় দেখো।’
একটু পরই ফিরে এল কামাল, ডাক্তার আমিনুল ইসলাম তোর সাথে আলাপ করতে ইছেন, শহীদ।
| ডাক্তার আমিনুল ইসলাম! আমার সাথে আলাপ করতে চান কেন?’
কামাল বলল, “তিনি নাকি নিহত সমস্ত লোককে বাঁচাতে পারবেন। যদি কয়েকটা শর্ত পূরণ করা হয়।’
বলিস কি! শহীদ উঠে বঁড়াল। পা বাড়াল বেডরূমের দিকে।
মি, সিম্পসন বললেন, লোকটা নিশ্চয়ই আমিনুল ইসলাম নয়? হয় কুয়াশা, নয় শয়তান প্রফেসর ওয়াই। কি শর্ত পূরণ করতে হবে।’
কামাল বলল, লাশগুলো পৌঁছে দিতে হবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। এবং তিনি যতক্ষণ কাজ করবেন ততক্ষণ আশপাশে যাতে কোনরকম হাঙ্গামা না হয়,
অবাঞ্ছিত লোকের সমাগম না ঘটে তার ব্যবস্থা করতে হবে।’
| শহীদ ফিরল পাঁচ মিনিট পরই। রীতিমত উত্তেজিত ও। বলল, ‘প্রফেসর ওয়াই নয়, কুয়াশাও নয়। ডাক্তার আমিনুল ইসলামই ফোন করেছিলেন। উনি, মি, সিম্পসন। লাশগুলো মেডিক্যাল কলেজে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। আর, গোটা হাসপাতালটা আর্মড ফোর্স মোতায়েন করে ঘিরে রাখতে হবে…’।
| ‘ডাক্তার আমিনুল ইসলাম গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেন? মরা মানুষগুলোকে তিনি বাঁচাতে পারবেন?
বলছেন পারবেন। ওঁর বক্তব্য হচ্ছে–আসলে মানুষগুলো মরেনি। ওদের শরীর অক্ষত এবং পরিপূর্ণ সুস্থ আছে। আশ্চর্য এক ওষুধের প্রভাবে কেবল মাত্র অচল হয়ে গেছে হার্ট। অতি সামান্য প্রাণ স্পন্দন নাকি এখনও রয়েছে। সেই অচল হার্টকে সচল করতে পারলেই তারা আবার বেঁচে উঠবে। ‘
‘অচল হার্টকে সচল করার পদ্ধতি বা মেডিসিন কি তা তিনি জানেন?
শহীদ বলল, একটু পরই জানেন কি জানেন না প্রমাণ হয়ে যাবে। তবে তিনি দাবি করছেন জানেন বলে।
কামাল বলল, কিন্তু কুয়াশা এমন চুপচাপ কেন? আর তরফ থেকে এ ব্যাপারে কোন সাড়া শব্দ না আসাটা কেমন?
শহীদ বলল, দেরি করছি শুধু শুধু আমরা। পচতে শুরু করার আগেই সবগুলো মরা মানুষকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে। পচতে শুরু করলে কোন ওষুধেই বা কোন পদ্ধতিতেই আর কোন কাজ হবে না।’
৭৬
ভলিউম ১৫
মি. সিম্পসন দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, ‘শহীদ, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ডাক্তার: আমিনুল ইসলামের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিয়েছ। মরা মানুষগুলোকে বাঁচানো সম্ভব, তোমার বিশ্বাস?’
শহীদ বলল, ‘স আর অসম্ভবের প্রশ্ন এখন নেই, মি. সিম্পসন । আমার অনুমান কি জানেন? আমিনুল ইসলাম কুয়াশা নয়, তবে কুয়াশার অনুরোধে এই কাজ করছেন তিনি। কুয়াশা, আমার বিশ্বাস, ডাক্তার আমিনুল ইসলামের চোখের সামনে একজন মৃত লোককে বাঁচিয়ে তুলেছে। সে নিজে প্রকাশ্যে কাজ করতে সম্মত নয় বলে মেডিসিন এবং পদ্ধতি কি জানিয়ে দিয়ে মানুষগুলোকে বাঁচাবার দায়িত্ব দিয়েছে ডাক্তার আমিনুল ইসলামের ওপর। আপনি ফোনে ব্যবস্থা করে ফেলুন, তারপর রওনা হওয়া যাক।
মি. সিম্পসনের টেলিফোন করা হয়ে যেতেই গাড়িতে উঠে বসল ওরা। কামাল বসেছে স্টিয়ারিং হইলে। তীরবেগে বেরিয়ে গেল সাদা ফোক্সওয়াগন ফিফটিন হারেড। মি. সিম্পসন তখনও হজম করতে পারেননি শহীদের স্বাগুলো।
গাড়ি তীরবেগে ছুটছে মেডিকেল কলেজের দিকে।
মি. সিম্পসন আপন মনে বলে উঠলেন, ‘মাই গড! মরা মানুষকে জ্যান্ত করে ফেলেছে–এ আবার কি শুনি! মাই গড!
কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ পর আর অবিশ্বাস্য রইল না ব্যাপারটা। শহীদ, কামাল আর মি, সিম্পসনের চোখের সামনে ডাক্তার আমিনুল ইসলাম নিহত: লোকদের একজনকে বাঁচিয়ে তুললেন!
রটে গেল বিস্ময়কর এই খবর সারা পৃথিবীতে। কিন্তু ডাক্তার আমিনুল ইসলাম কারও অভিনন্দন বাণীই গ্রহণ করলেন না। সাংবাদিকরাও ব্যর্থ হলো তার সাথে দেখা করতে। | ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সবগুলো মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হলো। ডাক্তার আমিনুল ইসলাম মেডিসিন সাপ্লাই দিলেন। তাকে সাহায্য করলেন তার বিশজন ডাক্তার বন্ধু।
ডাক্তার আমিনুল ইসলামের দাড়িভর্তি মুখটা সবসময় গম্ভীরই রইল। চশমার ভিতর চোখ দুটো দেখে মনে হলো কি যেন চিন্তা করছেন তিনি। কারও কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন না। সরাসরি কারও দিকে তাকাতে পর্যন্ত ইতস্তত করতে দেখা গেল তাঁকে।
ছয় কয়েকদিন পরের ঘটনা।
কুয়াশা ৪৪
ডিজে রাত। বিরামহীন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামছে তো নামছেই।
টয়েনবি সার্কুলার রেন্ডি প্রায় ডুবু ডুবু, পীচ দেখা যাচ্ছে না। লোক নেই পথে। ল্যাম্পপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। নিচের ভিজে ফুটপাথে আলো পড়ে চকচক করছে। ফুটপাথের পাশে প্রকাণ্ড গারেজের গেটটা খোলা। উঠানের চারদিকে নানারকম যানবাহন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে বৃষ্টিতে। জায়গার অভাবে বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার ওপর।
ল্যাম্পপোস্টের ঠিক নিচে ছোট্ট একটা লাল ফিয়াট দেখা যাচ্ছে। গাড়িটার দরজা খোলা। ডাক্তারের পোশাক পরা একজন প্রৌঢ় দরজা দিয়ে মাথাটা গাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে কি যেন করছেন। তার পিছনে একজন ইউনিফর্ম পরা পুলিস কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে, উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে ডাক্তারের কাজকর্ম। কনস্টেবলের মাথার উপর একটা ছাতা। তার পিছনে রেনকোট পরা স্বাস্থ্যবান একজন লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে একজন মেকানিকের সাথে ।
এমন সময় দুটো হেডলাইট দেখা গেল রাস্তার বাঁকে। একটা গাড়ি আসছে দ্রুতবেগে।
কাছাকাছি আসতে নেকোট পরা লোকটা হাত নাড়ল গাড়িটার উদ্দেশে। সাদা একটা ফোক্সওয়াগেন থেমে দাঁড়াল রেনকোট পরা লোকটার পাশে।
গাড়ির ভিতর থেকে মুখ বের না করেই শহীদ জানতে চাইল, “কি ব্যাপার, মতি?’
মতি এই গ্যারেজের মালিক। এখানে গাড়ি মেরামত করা হয়, গাড়ি ভাড়া দেয়া হয়, যাদের গ্যারেজ নেই তারা রাতের বেলা এখানে গাড়ি রেখে যেতে পারে সামান্য দু’এক টাকার বিনিময়ে। শহীদ এখানেই প্রয়োজনে গাড়ি মেরামত করায়। মতির সাথে দীর্ঘ দিনের পরিচয় ওর। ছেলেটা পরিশ্রমী এবং সৎ। সাধারণ একজন হেলপার থেকে আজ সে এত উঁচুতে উঠেছে শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রম এবং সতোকে মূলধন করে।
ফোক্সওয়াগেনের জানালার সামনে মুখ নামিয়ে নিচু গলায় বলল মতি, লাল ফিয়াটে একটা লাশ পাওয়া গেছে, স্যার। মোড় থেকে একজন কনস্টেবলকে ডেকে এনেছি। সে-ই ফোন করে ডাক্তার সাহেবকে আনিয়েছে। ভয় করছে। খামোকা ঝামেলায় ফেলবে কিনা ভাবছিলাম।’
গাড়ির শব্দ পেয়ে পুলিশ কনস্টেবলটি ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। রেনকোট পরা ঋজু, লম্বা শহীদ খানকে গাড়ি থেকে বেরুতে দেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এল সে। স্যালুট মারল সামনে দাঁড়িয়ে, বলল, আপনি, স্যার!
কি ব্যাপার বলো তো? জ্ঞান হারিয়েছে বুঝি কেউ?
ভলিউম ১৫
৭৮
কনস্টেবল বলল, না, স্যার। সুইসাইড করেছে লোকটা। ডাক্তার সাহেব তো তাই বলছেন। গাড়ির ভিতর শিশি রয়েছে একটা•••।’
“তাই নাকি!’ শহীদ মতির দিকে তাকাল, কে লোকটা? তোমার চেনা কেউ?
না, স্যার। আগে কখনও দেখিনি। কাপড়চোপড় দেখে মনে হয় গরীব মানুষ, বেকার। মরবার জায়গা খুঁজে পায়নি,এই গাড়িতে এসে বিষ খেয়েছে।
শহীদকে ম্লান দেখাল, ‘বেচারা! লাশ কে দেখে প্রথম?’ | মতি যে মেকানিকের সাথে খানিক আগে কথা বলছিল সে শহীদের সামনে এসে দাঁড়াল, আমি, স্যার। হর্ন কাজ করছে না, এই বলে এক ভদ্রলোক গাড়িটা রেখে চলে যান। আমি চেক করার জন্যে দরজা খুলতেই দেখি সীটের ওপর একটা কম্বল। কম্বলের নিচে কিছু একটা বড়সড় আছে বুঝতে পারলেও তখনও সন্দেহ। করিনি…যাকগে, হঠাৎ দেখি কম্বলের বাইরে বেরিয়ে রয়েছে একটা জুতো পরা পা। ভীষণ ভয় পাই আমি। কেউ কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমুচ্ছে কিনা অনুমান করার চেষ্টা করি। দু’বার “এই যে সাহেব”, “এই যে সাহেব” করে ডাকাডাকিও করি। উত্তর
পেয়ে কম্বলটা ধরে টান দেই। মুখের চেহারা দেখেই বুঝতে পারি, বেঁচে নেই–সাথে সাথে চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করতে থাকি সবাইকে••• |
| শহীদ বলল, “ঠিক আছে।’ কথাটা বলে ফিয়াটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও । সরকারী ডাক্তার তার পরীক্ষা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন এতক্ষণে। ঘাড় ফিরিয়ে না । তাকিয়েই বললেন, হ্যালো, মি. শহীদ। রহস্যের গন্ধ ঠিকই পান আপনারা, কেমন? দেখুন, লাশটা দেখুন ভাল করে।
একপাশে সরে দাঁড়ালেন ডাক্তার। শহীদ গাড়ির ভিতর উঁকি মেরে দেখল লোকটা শুয়ে আছে অনেকটা বসার ভঙ্গিতে। দরজার গায়ে হেলান দেয়া, জানালার উপর মাথাটা, হাঁটু দুটো ভাজ করা, কোমরটা সীটের উপর। হাত দুটো বুকের কাছে পড়ে রয়েছে শান্ত ভঙ্গিতে। লোকটার মুখের রঙ ফ্যাকাসে। চোখ দুটো আধবোজা। একটা চোখের মণি নেই। মণির বদলে পাথর অর্থাৎ কৃত্রিম পাথরের মণি বসানো রয়েছে। ওটা ডান চোখ। শহীদের দৃষ্টি এড়াল না, ডান চোখটা একটু ফুলে রয়েছে। পরনে সস্তা খদ্দরের হাওয়াই শার্ট, অনেক জায়গায় ছেঁড়া। খাকী ট্রাউজারটাও ছেঁড়া । | ‘স্ট্রিকলিন!’ ডাক্তার বললেন ওষুধের একটা শূন্য এবং লেবেলহীন শিশি উঁচু করে তুলে ধরে। মি. শহীদ, লাশের মুখে বাঁকা মত একটু হাসির আভাস লক্ষ করছেন? খুবই তাৎপর্যময় ব্যাপার। The Tisus sardonicus, we call it. মাংসপেশীগুলো পিচবোর্ডের মত শক্ত হয়ে গেছে। বেশ কয়েক ঘন্টা আগে মারা গেছে লোকটা। গাড়িটা এখানে এসেছে কখন?
| সন্ধ্যা সাতটারও পরে।’ জানাল মতি, ‘এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক নিয়ে আসেন
কুয়াশা ৪৪
।
গাড়িটা। বললেন, ‘গাড়ির হর্ন কাজ করছে না কেন বুঝতে পারছি না। দেখে ঠিক করে রাখবেন, আমি একসময় এসে নিয়ে যাব। ভদ্রলোক এসে এই কাণ্ড দেখে থতমত খেয়ে যাবেন একেবারে।
শহীদ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল, লোকটার কোন পরিচয় জানা গেছে?
ডাক্তার চিন্তিতভাবে বললেন, ‘পকেটে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা–”দিনের পর দিন না খেয়ে বাঁচা সঙ্ঘ নয়। অথচ আমাকে একটা চাকরি দিতে রাজি না কেউ। বেকারত্বের অভিশাপ সহ্য করতে না পেরে আমি আমার জীবনের সমাপ্তি টানলাম।” না, নাম নেই। পকেটে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি যা দেখে লোকটা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়। | কথাগুলো বলে ডাক্তার গাড়ির দিকে আবার ঝুঁকে পড়লেন। জোরে জোরে শ্বাস নিলেন দুবার। বললেন, আশ্চর্য! গাড়ির ভিতর থেকে কিসের যেন একটা গন্ধ আসছে। স্ট্রিকলিনের নয়।”
মিষ্টি একটা গন্ধ শহীদের নাকেও ঢুকেছে।
ভারি জুতোর শব্দ শোনা গেল। ঘাড় ফেরাতেই শহীদ হ্যাট পরিহিত রেনকোটে আবৃত লম্বা চওড়া মি. সিম্পসনকে এগিয়ে আসতে দেখল। মি. সিম্পসনের পিছনে একজন লোক। লোকটার কালিমাখা পান; শার্ট দেখে বোঝা
গেল, গ্যারেজেরই একজন মেকানিক সে।
শহীদ তুমি?’ শহীদ হাসল, ‘এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। মতি দেখে হাত নেড়ে থামাল।
মি. সিম্পসন বললেন, ঝটিকা সফরে বেরিয়েছিলাম। রমনা থানায় হঠাৎ খবর গেল, একটা গাড়িতে লাশ পাওয়া গেছে। খবর শুনে নিজেই চলে এলাম, ‘
মি. সিম্পসন গাড়ির খোলা দরজার কাছে এসে নুয়ে পড়ে ভিতরটা দেখতে শুরু করলেন। লাশ দেখে গম্ভীর হলেন তিনি। কয়েকটা প্রশ্ন করলেন ডাক্তারকে। লাশের শার্টের পকেট থেকে পাওয়া চিঠিটা নিলেন, পড়লেন। ভুরু কুঁচকে উঠল তার। তাকালেন শহীদের দিকে। বিদঘুঁটে কয়েকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ, শহীদ?”।
মৃদু হেসে ঘাড় কাত করল শহীদ।
মি. সিম্পসন বললেন, বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে হাঁটতে এ লোক এই গাড়িতে এসে ওঠে, তারপর আত্মহত্যা করে–হ্যাঁস্যকর! এখান থেকে থানা–এইটুকু মাত্র রাস্তা হেঁটে এসেছি, অথচ ট্রাউজারের নিচের অংশ কাদায় একাকার হয়ে গেছে। কই, অজ্ঞাত পরিচয় এই লোকের ট্রাউজারে কাদা কই? গোটা ট্রাউজারটাই দেখা যাচ্ছে ভিজে, কিন্তু কাদা নেই এক ফোঁটাও।’
শহীদ বলল, স্ট্রিকলিন ভয়ঙ্কর ধরনের বিষ। স্ট্রিকলিন পয়জনিঙে যে লোক মারা যায় সে রীতিমত যন্ত্রণায় জবাই করা মুরগীর মত লাফালাফি করে, তাই না? কিন্তু লাশটা দেখুন। মরার আগে ছটফট করেছে বলে মনে হয়? রীতিমত যত্ন করে
৮০
ভলিউম ১৫
কম্বল চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল।’
মি. সিম্পসন চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মাই গড! শহীদ তুমি বলতে চাইছ এটা আত্মহত্যা নয়-মার্ডার!
. উত্তর না দিয়ে শহীদ কনস্টেবলের হাত থেকে চার ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে আলো ফেলল লাশের মুখে। তারপর প্রশ্ন করল, মি. সিম্পসন, লাশের ডান কানে কিছু লেগে রয়েছে, দেখতে পাচ্ছেন?’
মি, সিম্পসন আরও নুয়ে পড়লেন, ‘ইয়েস। মনে হচ্ছে সাবান জাতীয় কিছু। শহীদ বলল, সাবানই। শেভিং সোপ।’ সোজা হয়ে দাঁড়াল শহীদ। মুঠো করে ডান হাতটা খুলল। বলল, “দেখুন। |
শহীদের হাতে দু’তিনটে সাদা-কালো চুল দেখা গেল। এগুলো আমি লোকটার শার্টের কলারে পেয়েছি। মি. সিম্পসন, জোরে কয়েকবার শ্বাস নিন তো। একটা গন্ধ পাবেন।’
শ্বাস নিয়ে মি. সিম্পসন বললেন, “ইয়েস, অফকোর্স! কিন্তু গন্ধটা ঠিক চিনতে পারছি না…’
শহীদ বলল, হেয়ার ডাই।’ মি. সিম্পসন চোখ বড় বড় করে বললেন, তার মানে তুমি বলতে চাইছ•••? | শহীদ বলল, আমি বলতে চাইছি ছেঁড়া শার্ট-ট্রাউজার দেখে লোকটাকে কপর্দকহীন মনে হলেও আসল ব্যাপার ঠিক তার উল্টো। চিঠিতে যা লেখা আছে। তাও সত্যি নয়। এ লোক বেকার ছিল না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন বিশিষ্ট ভদ্রলোক ছিলেন ইনি। মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি ছিল ভদ্রলোকের। চশমাটা গাড়িতে নেই কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি চশমা পরতেন ভদ্রলোক। ডান চোখের গহ্বরে কৃত্রিম পাথর বসানো হয়েছে, আমার বিশ্বাস, মাত্র কয়েকঘন্টা আগে। সম্ভবত মারা যাবার পর কেউ তার চোখের মণি বের করে কৃত্রিম পাথরের মণি বসিয়ে দিয়েছে। এবং এই ভদ্রলোক বৃষ্টি মাথায় করে হাঁটতে হাঁটতে গাড়িতে এসে বিষ পান করে আত্মহত্যা করেননি। মৃত অবস্থায় তাঁকে এই গাড়িতে করে এনে রেখে যাওয়া হয়েছে।’
‘মার্ডার, কেমন?’ মি. সিম্পসনের প্রশ্ন। পরমুহূর্তে হাইহিলের শব্দ শোনা গেল।
যুবতী একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনদিকে তাকাল সবাই। মেয়েটি বলে উঠল, ‘ইউ হ্যাভ গট মাই কার ব্যাক দেন!
সাত
মেয়েটা ইউরোপিয়ান। স্কার্টের উপর কোট পরেছে কিন্তু মাথায় টুপি নেই। এগিয়ে আসতে দেখে শহীদ এবং মি. সিম্পসন সরে দাঁড়ালেন একটু। মেয়েটা সোজা
৬-কুয়াশা ৪৪–
৮১
গাড়ির খোল দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। পরমুহূর্তে সাপ দেখার মত চমকে উঠে দুপা পিছিয়ে গেল সে। শহীদ ধরে ফেলল মেয়েটার একটা বাহু।
| ইটইটস্ হরিবল। কে, কেও আমার গাড়ির ভিতর অমন মড়ার মত পড়ে রয়েছে?
থানার ইন্সপেক্টর লম্বা লম্বা পা ফেলে অকুস্থলে হাজির হলেন। মি..সিম্পসনের উদ্দেশ্যে বললেন, “উনি মিস ভেরা শ্লেড। আজ বিকেলে উনি গাড়ি চুরির কথা জানিয়ে যান থানায়। আপনি, স্যার, এখানে আসার জন্যে থানা থেকে বেরুবার পর আমি লক্ষ্য করি মিস ভেরার গাড়ির সাথে এখানে যে গাড়িটায় লাশ পাওয়া গেছে তার নাম্বার মিলে যাচ্ছে। সাথে সাথে আমি মিস ভেরাকে ফোন করে জানাই ব্যাপারটা।’
| মি. সিম্পসন মিস ভেরার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “গাড়িটা আপনার বলে সনাক্ত করছেন?’
‘অবশ্যই এটা আমার গাড়ি! ঢাকা ক্লাবে বসে লাঞ্চ খাচ্ছিলাম দুপুর বেলা। খেয়েদেয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি গাড়ি নেই। প্রথমে ভেবেছিলাম মি. ইসলাম নিয়ে গেছেন গাড়িটা কোন জরুরী কাজে, কিন্তু••• |’
‘মি, ইসলাম কে?’
মিস ভেরা বলল, ওই ভদ্রলোকের সাথেই লাঞ্চ খাচ্ছিলাম আমি। খাওয়ার সময় কেউ ডাকে ভদ্রলোককে। বেশ কিছুক্ষণ বাইরে থাকেন তিনি। তা প্রায় পনেরো বিশ মিনিট তো হবেই। তারপর ফিরে আসেন। আমাকে বলেন, বাকি খাবারের জন্যে.তিনি অপেক্ষা করতে পারবেন না বলে দুঃখিত। বিদায় নিয়ে চলে যান তিনি। আমি আরও অনেকক্ষণ থাকি ক্লাবে। চিঠি লিখি, কফি খাই। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর বাইরে এসে দেখি গাড়ি নেই।’
মি. ইসলাম গাড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন আপনাকে?
।’ মি. সিম্পসন আবার প্রশ্ন করলেন, লাঞ্চ খাবার সময় মি. ইসলাম টেবিল ছেড়ে বাইরে গিয়েছিলেন কেন জানেন?
না। একজন বেয়ারা এসে বলল, এক ভদ্রলোক ডাকছে। মি. ইসলাম সাথে সাথে বেয়ারার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক কেন ডেকেছিলেন, তার পরিচয় কি–পরে আর জিজ্ঞেস করতে সময় পাইনি আমি।
‘গাড়ি চুরি যাবার পর মি. ইসলামের সাথে আপনার আর দেখা হয়নি?
‘দেখা হবার কথাও নয়। আজকের সন্ধ্যার ফ্লাইটে বৈরুত যাবার কথা মি. ইসলামের।
এতক্ষণে মুখ খুলল শহীদ, মি. ইসলামকে এই ভদ্রলোক? সম্পূর্ণ নাম কি?
মিস ভেরা ত্যাগ করল। বলল, ক্লাবেই গত হপ্তায় পরিচয় ভদ্রলোকের সাথে
৮২
ভলিউম ১৫
আমার। সম্পূর্ণ নাম জানার সুযোগ ঘটেনি।
শহীদ সন্তুষ্ট হলো না মিস ভেরার উত্তরে। কিন্তু অসন্তুষ্ট হলেও তা প্রকাশ করল না। প্রশ্ন করল আবার, ‘ভদ্রলোকের চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন?
মুখ ভর্তি দাড়ি, কাঁচা-পাকা। চশমা পরেন। বয়স প্রায় চল্লিশ। শহীদ এবং মি. সিম্পসনের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো। ‘গাড়িটা এখানে কখন আনা হয়?
মতি একজন মেকানিককে সামনে ঠেলে দিল। এই মেকানিকই থানায় খবর দিতে গিয়েছিল খানিক আগে। সে বলল, সোয়া সাতটার দিকে এক ভদ্রলোক গাড়িটা আনলেন। ভদ্রলোকের পরনে ছিল নীল রঙের সুট। খুব বেশি ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেলেন তিনি। যাবার সময় বলে গেলেন রাত সাড়ে দশটার দিকে ফিরবেন তিনি গাড়ি নিতে। ভদ্রলোকের ডানদিকের গালে কাটা দাগ ছিল, বড় বড় চুল মাথায়, চুরুট ছিল হাতে।
‘একা?’ ‘হ্যাঁ।
কিন্তু মতি বলল, ‘না, একা ঠিক নয়। আমি রেস্তোরাঁয় চা খেতে যাচ্ছিলাম তখন। ভদ্রলোকের পিছু পিছু যাই আমি, রেস্তোরাঁটা ওদিকেই। মোড়ের কাছে গিয়ে দেখি আর এক ভদ্রলোকের সাথে মিলিত হলেন তিনি। মোড়ে অপেক্ষা করছিলেন। এই দ্বিতীয় ভদ্রলোক, মনে হলো। বয়স খুব বেশি নয়, বড় জোর ত্রিশ-বত্রিশ হবে। তবে স্বাস্থ্যটা ভাল, বিরাট লম্বা চওড়া। একটু যেন খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। | নিস্তব্ধতা নামল। একটান, একঘেয়ে বৃষ্টিপাতের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। রাত প্রায় এগারোটা বাজতে যাচ্ছে।
শহীদ মিস ভেরার দিকে ফিরল, আপনার গাড়িতে মৃত এই লোকটাকে আপনি চেনেন? আগে কখনও দেখেছেন?
জীবনে দেখিনি। • তবু, ভাল করে লক্ষ্য করুন আর একবার।
শহীদ টর্চের আলো ফেলল গাড়ির ভিতর। মিস ভেরা নুয়ে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখল নিহত লোকটাকে। সোজা হয়ে দাঁড়াল তারপর, বলল, না, দেখিনি।’
মি. সিম্পসন কি যেন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, শহীদ তার পায়ে চাপ দিল জুতাসহ পা তুলে দিয়ে। মি. সিম্পসন ইঙ্গিতটা বুঝে আর কোন প্রশ্ন করলেন না। শহীদ বলল, ‘মিস ভেরাকে অহেতুক কষ্ট দেবার কোন মানে হয় না। মতি, একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করো।’
ট্যাক্সি ডেকে আনা হলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে। মিস ভেরা ট্যাক্সিতে উঠলেন । মি. সিম্পসন বললেন, মিস ভেরা, আগামীকাল সকালে আপনার সাথে দেখা করব ‘আমি।’
কুয়াশা ৪৪
“নিশ্চয়ই। মিস ভেরা উঠে বসল। ছেড়ে দিল ড্রাইভার ট্যাক্সি।
ট্যাক্সি অদৃশ্য হয়ে যেতে মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, পায়ের ওপর ত চাপ দিলে কেন, শহীদ।
শহীদ বলল, মেয়েটা চিনতে পেরেছে গাড়ির ভিতর নিহত ভদ্রলোককে। চেনার ভান করছে যখন তখন জেরা না করে ছেড়ে দেয়াই ভাল।
মি. সিম্পসন হাঁ করে চেয়ে রইলেন শহীদের দিকে।
শহীদ বলল, আমি চললাম। কাল সকালে আলাপ হবে। নিজের গাড়ির দি পা বাড়াল শহীদ।
| মুখের ভিতর বৃষ্টি পড়ছে, তাড়াতাড়ি মুখ বন্ধ করে ফেললেন মি, সিম্প একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি শহীদের গমন পথের দিকে।
পরের দিন সকাল। ব্রেকফাস্ট শেষে শহীদ কামালকে বলল, ‘ডক্টর আমিনুল ইস খুন হয়েছেন।’
| গত মাসখানেক ধরে কামাল শহীদের বাড়িতেই আছে। কফির কাপটা । একটু হলে পড়ে যেত কামালের হাত থেকে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে, হোয়াট!’ | গত রাতের ঘটনা খুলে বলল শহীদ। সবশেষে বলল, অকুস্থল থেকে ত বাড়ি না ফিরে ভক্টর আমিনুল ইসলামের বাড়িতে যাই। ভদ্রলোক বিয়ে করেন একা একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন। ওখানে গিয়ে দেখা পাই ডি কস্টার।
সে কি করছিল ওখানে?
শহীদ বলল, আমি জানতাম কুয়াশার কোন লোককে আশপাশে পাব। কস্টা কি করছিল? ডক্টরের অপেক্ষায় ছিল সে। কুয়াশা ওকে নিযুক্ত করে ডক্টর পাহারা দেবার জন্যে। কুয়াশা আশঙ্কা করেছিল, ডক্টরকে হত্যা করার চেষ্টা । পারে। যাক, ডি, কস্টা গতকাল দুপুর থেকে হারিয়ে ফেলে ডক্টরকে।
ডক্টরের বাড়িতে কি দেখলি?’’
দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখলাম আমার আগেই কেউ তালা খুলে ভি ঢুকেছিল। চেয়ার টেবিল উল্টোপাল্টা করে ছড়ানো চারদিকে। খাটের গদি ছে ড্রয়ারগুলো মেঝেতে পড়ে আছে, বুক কেসের বইগুলোর অবস্থাও তাই–মোট কেউ তন্ন তন্ন করে কিছু একটা খুঁজেছে বুঝতে পারলাম।
কামাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শহীদের দিকে।
শহীদই মুখ খুলল আবার, ‘ডক্টর আমিনুল ইসলামের কাছ থেকে কেউ আশা করেছিল। সেটার খোঁজেই গিয়েছিল তার বাড়িতে। সম্ভবত পায়নি। পা বলেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। ‘
জুতোর শব্দ শুনে কান খাড়া করল কামাল। শহীদ বলল, ‘মি. সিম্প
৮৪
ভলিউম
গলেন।
ড্রয়িংরূমে প্রবেশ করলেন মি. সিম্পসন। দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বললেন, “গুড মর্নিং, বয়েজ। টেলিফোনটা কি…?
কামাল বলল, হ্যাঁ, সেরে গেছে ব্যারাম।
মি. সিম্পসন টেলিফোনের দিকে এগুলেন। কিন্তু রিসিভার ধরতে হাত পাড়াতেই ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল সেটা।
রিসিভার তুললেন মি. সিম্পসন, হ্যালো?’
পাঁচ সেকেণ্ড পর শহীদের দিকে তাকালেন তিনি, ‘তোমার ফোনগণহীদ। মিস ভেরা কথা বলতে চাইছেন তোমার সাথে। তুমি কথা বলে নাও, তারপর আমি বলব।’
শহীদ উঠে গিয়ে মি. সিম্পসনের হাত থেকে রিসিভার নিল। মিনিট তিনেক মিস ভেরার সাথে কথা বলে রিসিভারটা মি, সিম্পসনের হাতে দিল ও। ফিরে এসে বসল। সোফায় আবার। মি. সিম্পসনও দু’মিনিট পর রিসিভার নামিয়ে রেখে শহীদের মুখোমুখি বসলেন একটা সোফায়। জানতে চাইলেন, “কি বলল মিস ভেরা?
| শহীদ সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে একমুখ ধোয়া ছাড়ল চিন্তিতভাবে। বলল, সকালের কাগজে মেয়েটা দেখেছে গতরাতের মার্ডার কেসের তদন্তের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। খুব খুশি হয়েছে, বুঝতে পারলাম। আজ রাতে ডিনার খাওয়াতে চায় আমাকে।
কামাল মন্তব্য করল, সাবধান, শহীদ। মিস ভেরার যে বর্ণনা খানিক আগে তুই আমাকে দিলি তাতে মনে হলো মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী। ফাঁদে পড়ে যাসনি যেন!
মুচকি হাসলেন মি. সিম্পসন।
শহীদ বলল, ‘ফাঁদে পড়তে না জানলে ফাঁদে কাউকে ফেলা যায় না রে।
অর্থাৎ?
ব্যাখ্যা চাস? পরে শুনিস। তা, মি. সিম্পসন, বলুন তো সাংবাদিকরা কিভাবে জানল যে আমি গতরাতের মার্ডার কেসের তদন্তের ভার নিয়েছি?’
মি. সিম্পসন বললেন, কি করে বলব বলো। আমি কারও সামনে টু শব্দটিও করিনি। আমার মনে হয় একাজ তোমাদের সেই মতির। রিপোর্টাররা অকুস্থলে গিয়েছিল তুমি চলে আসার পর, তখন মতিই হয়তো ওদেরকে কথাটা বলে থাকবে।’
শহীদ মুচকি হেসে বলল, না। আসলে ফোন করে রিপোর্টারদেরকে কথাটা আমিই জানাই।’
সে কি! কেন?’
শহীদ বলল, কারণ তো অবশ্যই একটা আছে। পরে শুনিস, কামাল। তার আগে কয়েকটা ঘটনার কথা বলি মি. সিম্পসনকে। তুইও শোন। কুয়াশা ৪৪
bet
সন্দেশ দরজার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল। কামাল বলল, ‘তিঃ তিঃ …’
শহীসগারেটে টান মেরে ধোয়া ছাড়ল সিলিংয়ের দিকে। কি যেন ভাবছে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ রইল ও। তারপর শুরু করল, আজ থেকে চার মাস অ আত্মহত্যা করেন বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা কেমিস্ট মি. সায়িদ, মনে অ তো? মি. সায়িদ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত ছিলেন এবং এমন এ এক্সপেরিমেন্টের কাজে নিযুক্ত ছিলেন যা সফল হলে মানুষের শরীরের যাব দৃষিত পদার্থকে একটি মাত্র ইঞ্জেকশন দিয়ে ঠিক করে দেয়া সম্ভব হত । মি. সা আত্মহত্যা করেন, কারণ আজও অনাবিষ্কৃত। শুধু একটি ব্যাপার জানা গেল যেদিন তিনি আত্মহত্যা করেন সেদিন সকালে তার সাথে একজন রাশিয়ান ভদ্রনে দেখা করতে যান। রাশিয়ান ভদ্রলোককে পরে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। জ গেছে, ভদ্রলোক সামান্য খোঁড়া ছিলেন।
| দম নিয়ে শহীদ আবার শুরু করল, মাস তিনেক আগে শান্তিনগর এলা পাওয়া যায় মেজর জেনারেল মুহম্মদ আলীর বুলেটবিদ্ধ লাশ। মেজর জেনা রিটায়ার করেছিলেন, সবাই জানে, কিন্তু আসলে তিনি সরকারের বিশেষ অনুরে বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রচনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। হত্যাকারীকে আজও গ্রেফতার করা সম্ব হয়নি। বিকেল বেলা মেজর জেনারেল দেখা যায় একটি ক্লাবে। তার সাথে এক ভদ্রলোক ছিলেন। ভদ্রলোকের সন্ধান । পাওয়া যায়নি। তবে যারা ক্লাব থেকে ওদের দুজনকে বেরিয়ে যেতে দেখে তারা বলেছেন মেজর জেনারেলের সঙ্গী ভদ্রলোক হাঁটছিলেন সামান্য খুঁড়িয়ে।’
| ‘মাই গড! দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাথে শব্দ দুটো উচ্চারণ করলেন মি. সিম্পসন।
শহীদ অ্যাশট্রেতে সিগারেট ফেলে দিয়ে নতুন আর একটা ধরাল, বলতে । করল আবার। এরপর ঘটে আরও মর্মান্তিক ঘটনা। বিজ্ঞানী শহীদ মাহ রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ লাইনের ওপর লাফ দিয়ে পড়ে ট্রেন সাথে সাথে তাঁর ওপর দিয়ে চলে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় বিজ্ঞানী শ মাহমুদের সাথে যে লোকটা ছিল সে হাঁটছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এবং এই ধর একটা ঘটনা ঘটে গতরাতেও। যে লোক মতির গ্যারেজে লাল ফিয়াট রেখে যায় মোড়ে গিয়ে মিলিত হয় একজন খোঁড়া লোকের সাথে। মি. সিম্পসন, প্রতিটি ঘ তাৎপর্যপূর্ণ নয়? প্রতিটি ঘটনাতেই আমরা একজন খোঁড়া লোককে পাচ্ছি কিন্তু ঘ ঘটে যাবার পর তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। গতরাতে ডক্টর আমিনুল ইসলাম হয়েছেন। গাড়িটা মতির গ্যারেজে রেখে যায় কে জানেন?
কে?
চেহারার বর্ণনা শুনে আমার ধারণা, প্রফেসর ওয়াইয়ের ডান হাত কুখ মাতবর ছাড়া কেউ নয় সে।’
মি. সিম্পসন বললেন, তারমানে শয়তান প্রফেসর ওয়াই নির্বিঘ্নে একটার ৮৬
ভলিউম
একটা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে–আমরা তার কেশও স্পর্শ করতে পারছি না। একদিন সকালে হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখব–আমি নেই, শয়তান প্রফেসর ওয়াই আমাকে খুন করে ফেলে রেখে গেছে বাড়ির পিছনের নর্দমায়!’
কামাল বলল, কথাটা অস্বীকার করে লাভ নেই, আমরা প্রফেসর ওয়াইয়ের নাগাল পাচ্ছি না। তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারছি না।’
শহীদ গম্ভীরভাবে বলল, তার কাছে আমরা যেতে পারছি না সত্যি। সেক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সে আমাদের কাছে আসে। আমার পরিকল্পনাটা ব্যাখ্যা করি এবারকামাল, দেখ তো তোর সেই তিনকাপ চা হলো কিনা। দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে কথা বলব আমরা।’
সেদিনই সন্ধ্যার খানিক পরের ঘটনা।
পুরানো ঢাকা শহরের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থাইফা। মিস ভেরার অনুরোধে শহীদ এই প্রথম পা ফেলছে এখানে। কেবিন রিজার্ভ করা ছিল আগে থেকেই। নির্দিষ্ট সময়ে এসে শহীদ মিস ভেরাকে পেয়েছে কেবিনে।
খেতে খেতে গল্প করছিল ওরা।
‘তদন্তের কাজ কতদূর এগোল, মি. শহীদ? যেহেতু দুর্ভাগা লোকটার লাশ আমার গাড়িতে পাওয়া গেছে সেহেতু, স্বভাবতই, আমি এই কেসের ফলাফল জানতে উৎসাহী।’
শহীদ হাসল নিঃশব্দে। বলল, কেলটা জটিল। এই হত্যাকাণ্ডের ভিতর প্রচুর রহস্য আছে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি আমি। চমকপ্রদ খবর দিতে পারব, আশা করছি।’
| ‘আমাকে বলবেন না?
আবার হাসল শহীদ, দুঃখিত।
মিস ভেরাও হাসল, আপনারা, আইমিন, প্রাইভেট ডিটেকটিভরা নিজের ওয়াইফকেও বিশ্বাস করেন না। প্রাইভেট ডিটেকটিভদের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা আছে আমার। অনেক বই পড়েছি, এদের কাণ্ডকারখানা সত্যি বিস্ময়কর লাগে আমার কাছে। বইয়ের ডিটেকটিভ আর বাস্তবের ডিটেকটিভ-পার্থক্য নেই! পেটের কথা আদায় করা মুশকিল। যাক, আচ্ছা, ডিটেকটিভরা নাকি কোন ঘটনাকেই ছোট করে। দেখেন না, কোন চরিত্রকেই সন্দেহের উর্ধ্বে বলে মনে করেন না। সত্যি নাকি?’
সত্যি ।’ মিস ভেরা হাসছে, আমাকেও তাহলে সন্দেহ করেন আপনি?” হেসে উঠল শহীদ।
মিস ভেরা ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘নিশ্চয়ই আপনি আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছেন ইতিমধ্যে? আচ্ছা, বলুন তো, কোথায় থাকি আমি? কি কাজ করি? বলতে পারলে মেনে নেব আপনি সত্যি কাজের ডিটেকটিভ, নাম-কা ওয়াস্তে নন।’ কুয়াশা ৪৪
৮৭
শহীদ রিস্টওয়াচ দেখল, “আপনি বিদেশী একটা ব্যাঙ্কে স্টেনোটাইপিস্টের চাকরি করেন। ঢাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করেছেন, ওপর তলায় থাকেন, নিচের তলা দুটো ভাড়া দিয়েছেন। আপনার দেশ সুইডেনে। বাবা নেই, মা আছেন কিন্তু তিনি বিয়ে করেছেন আবার…’
‘ওয়াণ্ডারফুল! সত্যি, আমি স্যাটিসফায়েড। পাস করেছেন আপনি। আবার রিস্টওয়াচ দেখল শহীদ। বারবার সময় দেখেছেন। কোথাও যাবার কথা আছে নাকি?
শহীদ বলল, আমার সহকারী অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। ওকে গতকালকের মার্ডার কেস সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে কয়েক জায়গায় যেতে বলেছিলাম, এতক্ষণে ফিরেছে সে। তথ্য কিছু পেল কিনা জানার ইচ্ছা হচ্ছে ।’
মিস ভেরা বলল, আপনি তো গাড়ি আনেননি।’
। পুরানো শহরে গাড়ি আনি না।’ মিস ভেরা বলল, ‘আপনার মূল্যবান সময়ের অপচয় করতে চাই না। আমন্ত্রণ রক্ষার জন্যে ধন্যবাদ। বাড়ি ফিরবেন কিসে বলুন তো?
ট্যাক্সি নেব।’
মিস ভেরা বলল, ‘ট্যাক্সি নেবেন কেন? আমার গাড়ি রয়েছে, চলুন পৌঁছে দিই আপনাকে। কোথায় থাকেন আপনি?
‘গুলশানে। অনেক দূর।’
মিস ভেরা হাসল, দূর না ছাই। আপনার মত স্বনামধন্য লোকের সঙ্গ পেলে পৃথিবীর শেষ সীমা পর্যন্ত যেতে পারি। এক মিনিট বসুন, আমি ফোন করে জানিয়ে দিই বাড়ি ফিরতে দেরি হবে রাতে। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আমি আমার বান্ধবী
শ্যারনের কাছে যাব। অনেকদিন দেখা নেই। ও গুলশানেই থাকে।’
মিস ভেরা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ফোনে কথা বলে পাঁচ মিনিট পরই কেবিনে ফিরল সে। বলল, চলুন।
মিস ভোর গাড়িতে এসে উঠল ওরা। শহীদ সিগারেট ধরাল। । অনর্গল কথা বলল, সুন্দরী ভেরা। কোন্ রোমাঞ্চোপন্যাসে কোন্ ডিটেকটিভ কি করেছিল, কিভাবে ধরেছিল ক্রিমিন্যালকে- এই সব গল্প।
গাড়ি ছুটছে। পশু হাসপাতাল পেরিয়ে গেল। হাইকোর্টের কাছে এসে মোড় নিল গাড়ি।
‘ব্রেকটা ঠিক মত কাজ করছে না যেন! মিস ভেরা বিরক্তির সাথে কথাটা বলে ব্রেক প্যাডেলে পা দিয়ে চাপ দিল। স্পীড কমছে গাড়ির, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা।
পরমুহূর্তে বাইরে থেকে একজন লোক গাড়ির দরজা খুলে ফেলল এক ঝটকায়।
, ভলিউম ১৫
লোকটা যেন গাড়ি থামার অপেক্ষায় ছিল।
লাইট পোস্টের আলোয় শহীদ দেখল লোকটার হাতে চকচক করছে কালো একটা পিস্তল।
নড়েছ কি মরেছ, শহীদ খান। লক্ষ্মী ছেলের মত বেরিয়ে এসে বাইরে।
শহীদ দেখল গাড়ির চারদিকেই লোক রয়েছে। মিস ভেরা ভীত কণ্ঠে বলে উঠল, “মি. শহীদ-একি ঘটছে…!
| ‘চুপ! একটা কথা বলেছ কি খুন করে ফেলব।’
উপায় নেই, এমনভাবে হাসল একটু শহীদ। বেরিয়ে এল গাড়ির ভিতর থেকে লক্ষ্মী ছেলের মতই।
‘সামনেই একটা নীল টয়োটা দাঁড় করানো রয়েছে। সেদিকে হাঁটতে বলা হলো শহীদকে। নিঃশব্দে টয়োটার দিকে এগোল শহীদ। পিছনে মিস ভেরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, শুনতে পেল ও। | টয়োটায় উঠল শহীদ। পিছু পিছু উঠল মিস ভেরা। স্টার্ট দেয়াই ছিল গাড়িতে। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল। তীরবেগে ছুটল গাড়ি। মোট তিনজন লোক গাড়িতে। শহীদের হাত বেঁধে ফেলা হলো। বাধা হলো ওর চোখ।
মিস ভেরা সারাক্ষণ কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
টয়োটা শহরের বাইরে বেরিয়ে এসেছে বুঝতে অসুবিধে হলো না শহীদের খানিক পর। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ও কিন্তু ট্রাফিকের শব্দ পাচ্ছে না বিশেষ।
| প্রায় ঘন্টা খানেক পর থামল টয়োটা। দরজা খোলার শব্দ শুনল শহীদ। ইতিমধ্যে পা দুটোও বেঁধে ফেলেছে শত্রুপক্ষ। পাঁজাকোলা করে বয়ে নিয়ে যাওয়া, হলো ওকে।
যে লোকটা ওকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে ঘনঘন হাঁপাতে দেখে শহীদ বুঝতে পারল সিঁড়ির ধাপ টপকে উপরে উঠছে লোকটা। একসময় থামল লোকটা। তালা খোলার শব্দ হলো.। খট করে শব্দ হলো সুইচ টিপে আলো জ্বালার। একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হলো ওকে। কেউ ওর হাতের বাঁধন স্পর্শ করল না। তবে খুলে দিল একজন ওর পায়ের বাঁধন। তারপর খোলা হলো ওর চোখের রুমাল ।
উজ্জ্বল আলোয় ধাধিয়ে গেল চোখ। খানিক পর মিট মিট করে চোখ মেলে তাকাল আবার শহীদ।
সামনে একটা নিচু ডেস্ক দেখা যাচ্ছে। ডেস্কের ওধারে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে প্রকাণ্ড চেহারার একজন লোক। ‘,
• প্রফেসর ওয়াইকে চিনতে পারল শহীদ। উন্মাদগ্রস্ত এক প্রতিভা ওর দিকে চেয়ে আছে খ্যাপাদৃষ্টিতে।
কুয়াশা-৪৪
আট চারকোনা বিরাট রূমের দেয়াল ঘেঁষা একটা চেয়ারে বসে আছেন প্রফেসর ওয়াই । নিচু ডেস্কে রীডিং ল্যাম্প জ্বলছে। ল্যাম্পটার সবুজ শেড এমনভাবে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে সব আলো পড়েছে শহীদের দিকে। প্রফেসর ওয়াই বসে আছেন ছায়াতে।
প্রফেসর ওয়াইকে চিনতে পারল শহীদ তার বিরাট বিশাল শরীর দেখে। ছদ্মবেশধারী প্রফেসর ওয়াইয়ের এক চেহারা দ্বিতীয় বার কেউ কোনদিন দেখেনি।
ঘন কাঁচা-পাকা ভুরুর নিচে লাল দুটো চোখ। মাথায় টাক। চোখে চশমা।, লোমশ হাত দুটো ডেস্কের উপর বিছানো। সামনের দিকে ঝুঁকে ক্লিনশেভড় প্রফেসর
ওয়াই নিঃশব্দে দেখছেন শহীদকে। হাতের পাইপ থেকে নীল ধোয়া উঠছে।
পুরো এক মিনিট তিনি নিঃশব্দে চেয়ে রইলেন। তারপর বাজখাই কণ্ঠে বললেন, মেরা খুশনসীব! তুম মেরে মেহমান হো!
পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতে কথা বলতে পারেন প্রফেসর ওয়াই। কোনটা তার মাতৃভাষা আজও কেউ তা জানে না।
শহীদ চুপ করেই রইল। প্রফেসর ওয়াইয়ের পিছনের দেয়ালে একটা দরজা দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্য করতে ভুল করল না ও।
যাদেরকে হত্যা করব তাদের তালিকায় তোমার নাম আছে, তুমি জানো । কিন্তু, মি. টিকটিকি, তোমাকে কিভাবে হত্যা করব তা এখনও ভেবে ঠিক করার সময় পাইনি। কিছু মনে কোরো না, আমি তোমার সাথে মন খুলে খোলাখুলি আলাপ করছি।’
পাইপে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়লেন প্রফেসর ওয়াই। আবার কথা বলে উঠলেন তিনি, যতদূর মনে পড়ে, আগে তুমি কথাবার্তা একটু বেশি পরিমাণে বলতে। আজকাল কম কথা বলো, না, ভয়ে কথা বেরুচ্ছে না?
শহীদ মৃদু হাসল। বলল, আমার ভয় পাবার কোন কারণ ঘটেনি। ভয় পাবেন আপনি। পুলিস আপনাকে অসংখ্য খুনের অপরাধে গ্রেফতার করার জন্য ওয়ারেন্ট নিয়ে ঘুরছে। সুযোগ পেলেই তারা আপনার হাতে হাতকড়া পরাবে। দিন আপনার, শেষ হয়ে এসেছে, প্রফেসর ওয়াই। আপনার পাগলামি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বাস করুন, আপনি ধরা পড়লেন বলে।
| শাট আপ! গর্জে উঠলেন প্রফেসর ওয়াই, তোমার মত ছেলেমানুষের মুখে অমন কথা এর আগেও অনেক শুনেছি আমি। পুলিশ গ্রেফতার করবে আমাকে–ফুহ! জানো, আমার ল্যাবরেটরিতে ভ্যানিশিং রে মউজুদ আছে? কহাজার পুলিস আছে বাংলাদেশে? ভ্যানিশিং রে ব্যবহার করলে দৃশলাখ পুলিসকে আমি বাতাসের সাথে
৯০
ভলিউম ১৫
মিশিয়ে গায়েব করে দিতে পারি মুহূর্তে। বড় বড় কথা বলো আমার সামনে বসে! দেখাব মজা? আমার ড্রিলিং মেশিনটা••• মাথার মাঝখান দিয়ে নামিয়ে দেব ইস্পাতের বিটটা?’
বাঘের মত ফুঁসছেন প্রফেসর ওয়াই।
হঠাৎ শহীদ দেখল ওর চেয়ারের পিছন থেকে একজন লোক এগিয়ে গিয়ে বঁড়লি বাঁ দিকের দেয়ালের কাছে।
নীল স্যুট পরা লোকটার ডান গালে কাটা দাগ। পেশীবহুল শরীর। কদাকার, কুৎসিত চেহারা।
শহীদ বলল, এই লোকই ডক্টর আমিনুল ইসলামকে খুন করে গাড়ির ভেতর ফেলে রেখে আসে। আপনার ডান হাত, মাতবর। তাই না, প্রফেসর?’
| ‘খামোশ! গর্জন করে উঠলেন প্রফেসর, আমাকে প্রশ্ন করার সাহস দেখাচ্ছি! বড় বেশি বেড়ে গেছ তুমি, ছোকরা! আমি বাংলাদেশে থাকতে কাউকে বেশি বাড়াবাড়ি করতে দেব না, স্মরণ রেখো। প্রস্তুত হও, বীর পুরুষ, মৃত্যু ঘটবে তোমার পাঁচ মিনিটের মধ্যে। মাতবর!
জ্বী, হুজুর! ভ্যানিশিং রে! নিয়ে এসো জলদি! “জ্বী, হুজুর! দ্রুত একটা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল কুৎসিতদর্শন মাতবর।
দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি! দাঁতে দাঁত চেপে বললেন প্রফেসর ।
শহীদ বলল, আমাকে খুন করে রেহাই পাবেন না, প্রফেসর ওয়াই। আমাকে কিডন্যাপ করে খুন করাটাই হবে আপনার ধ্বংসের মূল কারণ।’
ডেস্কের উপর থেকে রিভলভারটা তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন প্রফেসর ওয়াই। হঠাৎ গলা ছেড়ে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন।
শিউরে উঠল শহীদ। কী ভয়ঙ্কর হাসি! কেঁপে ওঠে অন্তরাত্মা!
দ্রুত আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল শহীদ রূমের চারদিকে। বড়সড় একটা ডাইনিং টেবিল পুব দিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ফার্নিচার বিশেষ কিছু নেই বললেই চলে। তিনটে দরজা মোট। একটা দরজা প্রফেসর ওয়াইয়ের চেয়ারের ঠিক পিছনে।
গোটা বাড়িটায় বিরাজ করছে কবরের নিস্তব্ধতা। বাইরে থেকে এতটুকু শব্দ আসছে না। সম্বত সাউণ্ড প্রফ রূম এটা। ওয়ালকুকটা শুধু সারাক্ষণ টিকটিক, টিকটিক করছে। সাড়ে দশটা বাজতে আর মাত্র মিনিট দুয়েক বাকি।
| শহীদ কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে প্রফেসর ওয়াই বলে উঠলেন, কান পেতে কোন লাভ হবে না, ছোকরা। সন্ধ্যার পর এখানে কোন শব্দ আসে না। শব্দ শুধু যে আসে না তাই নয়, এখান থেকে কোন শব্দ বাইরে বেরুতেও পারে না। পরীক্ষা করে দেখেছি আমি। গতকালকের কথাই ধরো না। কুয়াশা ৪৪
ডক্টর আমিনুল ইসলাম ‘বাঁচাও” “বাচাও” করে কি কম চিৎকার করল? স্ট্রিকলিন হুইস্কির সাথে পেটে পড়তেই সে কি হাত-পা খেচা তার। স্ট্রিকলিন পেটে পড়লে ভিক্টিম অমন আকাশ ফাটায়-কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। যাক, কোন অসুবিধেই ঘটেনি। বাইরে থেকে শুনতে পায়নি কেউ তার গলা।’ | শহীদ ওয়ালকুক থেকে চোখ নামিয়ে বলল, ‘একজন নিরীহ লোককে হত্যা করে কি লাভ হলো আপনার?
খেপে গেল প্রফেসর ওয়াই, ‘নিরীহ লোক? এই আমিনুল ইসলাম? ঠাট্টা করছ তুমি আমার সাথে?’’
কি তার অপরাধ শুনি?
টাকা সাধলাম, অনুরোধ করলাম, ভিক্ষা চাইলাম-কেন বলল না সে আমাকে বন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষের হার্টকে আবার চালু করার ওষুধটার নাম? গোপন রেখে কি লাভ হল তার? কোন কাজে লাগাতে পারল সে জিনিসটা? ওটা পেলে আমি কি করতে পারতাম তা জানো? মৃত মানুষ পচে যায়, জানো তো? আমি দেশী গাছ গাছড়া দিয়ে এমন একটা কেমিক্যাল তৈরি করেছি যা মাখিয়ে দিলে মৃত মানুষ পচবে
। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী যেমন ছিল জীবিত। অবস্থায় তেমনি থাকবে মরে গেলেও। ধরো, একজন লোক সিদ্ধান্ত নিল সে এখন মরে যাবে স্বেচ্ছায়,কিন্তু এক হাজার কি পাঁচ হাজার বছর পর আবার জীবিত হবে। অবাস্তব কল্পনা বলে মনে হচ্ছে? না-না-না, মোটেই অবাস্তব নয়। লোকটার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ব। হাটকে অকস্মাৎ বন্ধ করে দেবার উপায় আমার জানা
আছে। সাভারের লোকগুলোর হাট কেমন অচল করে দিলাম, দেখলে তো? ইচ্ছা। করলে ওদের দেহ না পচবার ব্যবস্থাও করতে পারতাম আমি। সে যাকগে, যা বলছিলাম–লোকটার হার্ট অচল করে দিয়ে সেই কেমিক্যাল মাখিয়ে দিলাম, ধরে নাও। এক হাজার বা পাঁচ হাজার বছর পর আবার যদি তার হার্ট চালু করা যায়। তাহলেই সে জীবিত হতে পারে আবার । ঠিক তো? তবেই দেখো, ব্যাপারটা অবাস্তব মোটেই নয়। কিন্তু ঘাপলা সৃষ্টি করল ওই আমিনুল ইসলাম। কোনমতেই ওষুধটা তৈরির নিয়ম প্রকাশ করতে রাজি হলো না।’
শহীদ জানতে চাইল, সাভারের লোকগুলোকে হত্যা করার!’
হত্যা? ছোকরা, তুমি দেখছি বোকার হদ্দ। হত্যা আমি করিনি। ওদের হার্ট অচল করে দিয়েছিলাম মাত্র।’
| ‘কিন্তু অচল হার্টকে সচল করার উপায় আপনি জানতেন না। ডক্টর আমিনুল ইসলাম যদি ওদের হার্ট সচল করতে ব্যর্থ হতেন তাহলে ওরা সবাই মারা যেত।
| আমি হাট সচল করার ওষুধ তৈরি করেছিলাম। কিন্তু প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখলাম, কাজ হচ্ছে না। যাক, স্বীকার করি, ঝুঁকিটা নেয়া উচিত হয়নি। তবে কি জানো ছোকরা, এত লোক বেঁচে রয়েছে বলেই তো এত সমস্যা–কিছু মরলে
• ৯২
ভলিউম ১৫
মন্দের চেয়ে ভালই হয়। তবে, কাজটা করেছিলাম আমি রাগে।
‘রাগে?’।
হা! রেগে গেলে আমি কি করি না করি খেয়াল থাকে না। তাই তো বারবার বলি, আমাকে রাগিয়ো না। বিপদ ঘটিয়ে দেব আমাকে রাগালে। এমন বিপদ যা ঘটলে কেউ প্রাণে বাঁচবে না তোমরা•••
একদিকের দরজা খুলে গেল আচমকা। ভিতরে ঢুকল কুৎসিত দর্শন নাতবর। তার হাতে অদ্ভুতদর্শন একটা যন্ত্র। যন্ত্রটা দেখতে দেড় হাত লম্বা টর্চের মত। খুব ভারি নিশ্চয়। মাতবর দুই হাত দিয়ে ধরে নিয়ে এল। মুখের দিকটা বড়সড়, অনেকটা গোলাকার।
দাও ওটা আমাকে, প্রফেসর ওয়াই বললেন, “ছোকরাকে বাতাসে মিলিয়ে দিই।’
মাতবর ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
প্রমাদ গুনল শহী। ঘামছে ও। বুকের ভিতর জমাট বেঁধে গেছে মৃত্যুভয়। দ্রুত ওয়ালকুকের দিকে আর তাকাল ও । দশটা বেজে বত্রিশ মিনিট হয়ে গেছে।
প্রচণ্ড ধাক্কা মারল সারা শরীরে অপ্রত্যাশিত তীক্ষ্ণ ওয়ার্নিং বেলের শব্দ। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শহীদ ডেস্কের উপর রাখা বেলটার দিকে।
প্রফেসর ওয়াই হাত বাড়িয়েছিলেন, মাতবরের হাত থেকে ভ্যানিশিং মেশিনটা নেবার জন্যে, বেলের শব্দ শুনে থমকে গেছেন তিনি।
পরমুহূর্তে ধাক্কা মারল কেউ দরজায়। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল দরজৗ সেই প্রচণ্ড ধাক্কায়।
মি. সিম্পসনের ভারি গলা শোনা গেল সাথে সাথে, হ্যাঁণ্ডস আপ, শয়তান প্রফেসর |
মি. সিম্পসনের কথা শেষ হবার আগেই পিস্তলের শব্দে কানে তালা লাগার অবস্থা হলো। গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করল রূমটাকে।
| শহীদ চেঁচিয়ে উঠল, “মি. সিম্পসন, ডেস্কের পিছন দিকে একটা দরজা আছে। প্রফেসর ওয়াই ওই পথেই পালাচ্ছেন•••।’’
‘ কামাল পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালল। প্রফেসরের পিছনের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ দেখা গেল।
রূমের ভিতরে প্রফেসর ওয়াই নেই। তার ডান হাত মাতবরকেও দেখা গেল
না।
দরজাটা ভেঙে ফেলতে হবে। কামাল এবং মি. সিম্পসন একযোগে দৌড়ে দরজার গায়ে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মারলেন। ভেঙে পড়ল দরজা। দেখা গেল একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে।
কামাল তুমি থাকো এখানে। তোমরা এসো।’ সশস্ত্র কনস্টেবল তিনজনকে কুয়াশা ৪৪
নিয়ে ঝড়ের বেগে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেলেন মি. সিম্পসন ।
শহীদের হাতের বাঁধন খুলে দিল কামাল। ‘এত দেরি করলি কেন তোরা?’
কামাল বলল, আমরা ভেবেছিলাম প্রফেসরের ডান হাত বাঁ হাত কাউকে পাকড়াও করতে পারব। কিন্তু কাউকে পাইনি কোথাও। তুই যে কোন্ রূমে আছিস
তা আবিষ্কার করতেই দেরি হয়ে গেল।
‘মিস ভেরাকেও পাসনি?’ কামাল অবাক হলো।
না।’
শহীদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “হারামজাদী পালিয়েছে! ওকে আমি গতকালই সন্দেহ করেছিলাম।’
কে ও?’।
প্রফেসর ওয়াইয়ের অ্যাডপটেড ডটার। দশ বারো বছর আগে দেখেছি, তখন অনেক ছোট ছিল।– মি. সিম্পসন হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলেন খাকি পর, ‘পালিয়েছে শয়তানটা!’
নয়।
এক হপ্তা পরের কথা।
বিকেল চারটে। শহীদ এবং কামাল ড্রয়িংরুমে বসে আছে। মহুয়া অন্দরমহল থেকে এসে কামালের পাশে বসল।
শহীদ বলল, কই গো, তোমার বান্ধবী মিসেস খান কোথায়? | গোল, ফর্সা হাত তুলে ছোট্ট রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল মহুয়া, তাই তো! চারটে বেজে গেছে। ট্রাফিকের জন্যে লেট হচ্ছে হয়তো। জরুরী দরকার বলল, আসবে তো অবশ্যই।’
কামাল বলল, ‘মহুয়াদি, মিসেস খান তোমার কেমন বান্ধবী বলো তো? একদিনও মহিলাকে দেখলাম না কেউ আমরা?’ ।
মহুয়া বলল, “দেখার কথা নয়, আমার বিয়ের আগেই স্বামীর সাথে নিউইয়র্কে চলে যায় ও। ফিরেছে মাত্র তিন মাস হলো। ঢাকায় এখন থাকবে ও স্থায়ীভাবে। শ্যামলির-ওকে আমি ওর ডাক নাম ধরে ডাকি–শ্যামলির স্বামী গতমাসে ফিরে গেছে আবার নিউইয়র্কে। ওখানে ওদের বিরাট ব্যবসা।
কলিংবেলের শব্দ হলো। উঠে দাঁড়াল মহুয়া, ওই এসেছে শ্যামলি।’
বেরিয়ে গেল মহুয়া ড্রয়িংরূম থেকে। খানিক পরই ফিরল অপরূপ সুন্দরী ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স্কা নাভীর নিচে নীল শাড়ি পরিহিতা বব-কেশী এক
ভলিউম ১৫
মহিলাকে সাথে নিয়ে। শহীদ এবং কামালকে দেখিযে মহুয়া বলল, ‘ওরা দুজন যথাক্রমে আমার স্বামী এবং দেওর। আর, এ শ্যামলি, আমার বান্ধবী। গাছে চড়ে। একবার নদীতে লাফ দিয়ে দুজনেই ডুবে যাচ্ছিলাম।
মহু! থাম।’ শহীদ বলল, বসুন।’
মহুয়া মিসেস খানকে নিয়ে বসল একটা সোফায়। বলল, “পরশুদিন ফোন করে যেতে বলেছিলি, যেতে পারিনি বলে রাগ করিসনি তো? সংসারের ঝামেলায়…।
মিসেস খান বলল, ‘সংসার বৈকি! এখনও বাচ্চাকাচ্চা হয়নি–একে আবার সংসার বলে নাকি?
তোর কটা বাচ্চারে?’ মহুয়া জানতে চাইল। হেসে ফেলল মিসেস খান। একটাও না।’ | কথা বল তোরা । আমি চা দিতে বলি।’
উঠে দাঁড়াল মহুয়া। কাজের কথার সময় মহুয়া শহীদকে বিরক্ত করে না। কখনও।
মিসেস খান শহীদের দিকে তাকাল। বলল, সংক্ষেপে সারব, না, কোন কথা বাদ না দিয়ে সবটাই বলে যাব?’
শহীদ বলল, আমার কোনও ব্যস্ততা নেই। তবে অপ্রয়োজনীয় কথা বাদ দিয়ে বলাই ভাল।
মিসেস খান শুরু করলেন, মহুয়া সম্ভবত আপনাকে জানিয়েছে, আমি মর্তি সংগ্রহ করি। বলতে পারেন, এটা আমার হৰি। সংগ্রহ আমি হরেক রকম জিনিসই। করি। তবে যে কোন ধরনের মূর্তির ওপর বিশেষ দুর্বলতা আছে আমার। নিউইয়র্ক, প্যারিস, লণ্ডন, ভিয়েনা যেখানেই উল্লেখযোগ্য কোন মূর্তি বিক্রির জন্যে আসুক, ডিলারদের কেউ না কেউ আমাকে খবর দেবেই। সন্ত্র হলে ঝট করে চলে যেতাম। প্লেনে করে মৃর্তিটা দেখার জন্যে। পছন্দ হয়ে গেলে কিনতাম, পছন্দ না হলে কিনতাম না।
মিসেস খান দম নিয়ে বলতে লাগল, “ঢাকায় এসেছি মাত্র মাস তিনেক হলো। কিন্তু ইতিমধ্যেই এখানকার এজেন্ট এবং ডিলারদের কাছে আমি বিশেষ পরিচিত। হয়ে উঠেছি। ডিলারদের মধ্যে সবচেয়ে কাজের এবং বিশ্বস্ত বলে মনে করি আমি জনাব তবারক হোসেনকে। গতকাল তবারক হোসেন ফোন করে আমাকে জানায় যে একটি রাশিয়ান আইকন (Ikon)–আইকন বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, ধর্মীয় মূর্তি অর্থাৎ দেবতাদের পবিত্র মূর্তি যা রাশিয়ান চার্চ বা বাসভবনে সযত্নে রাখা হয়–নীলাম হবে রেজিস্টার্ড নীলামকারী মি, কুসর অফিসে। তবারক হোসেন আমাকে জানায় জিনিসটা দেখতে খুবই সুন্দর। নীল আর সবুজ রঙের ম্যাডোনা এবং তার সন্তান । সিলভারের আচ্ছাদনের ওপর ওই দুই রঙের এনামেল। সম্ভবত
কুয়াশা ৪৪
টুয়েল বা থারটিন সেঞ্চুরীর কাজ। তবারক হোসেন জানান, হাজার খানেক টাকার বেশি দাম উঠবে না, আমার হয়ে সে নীলামে যোগ দিতে চায়। কিন্তু নীলামের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পছন্দ করি আমি। তাই অনুষ্ঠানের বেশ খানিক আগে মি. কুন্দুসের অফিসে হাজির হই। আইকনটা ওখানেই প্রথম দেখলাম আমি। দেখেই ওটার প্রেমে পড়ে গেলাম। জিনিসটা ছোটখাট, নয় ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি সম্বত, কিন্তু আকারের তুলনায় বেশ ভারী।
সন্দেশ এবং লেবু দুটো ট্রে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। চা এবং বৈকালিক নাস্তা। কামাল বলল, “আগে খেয়ে নিন, মিসেস খান।
পট থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে মিসেস খান বলতে লাগল, খানিক পর ওখানে এল আমার ডিলার তবারক হোসেন। সে জানাল আইকনটা একজন রাশিয়ান কাউন্টের মিউজিয়মে ছিল। কাউন্টের নামটা ভুলে গেছি আমি। মিউজিয়ম থেকে আইকনটা নাকি চুরি যায় উনিশশো উনিশ সালে। তারপর নানা দেশ ভ্রমণ করে ওটা এসে ঠেকেছে ঢাকায়। যাক, নীলাম অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় আমরা বহু লোক বেলা চারটের পরও বসে রইলাম। শুরু হবার কথা বেলা দুটোয়। অধৈর্য হয়ে বেশির ভাগ লোক চলে গেল। বেলা সাড়ে চারটের সময় আইকনটা নিয়ে আসা হলো। শুরু হলো ডাক। একশো টাকা থেকে শুরু হলো ডাক। আমরা তিন কি চারজন ছিলাম ওটা কেনার জন্যে। এগারোশো টাকা পর্যন্ত উঠে চতুর্থ ব্যক্তি খসে গেলেন? রইলাম বাকি তিনজন। আমি, একজন রোগা পটকা হ্যাট পরা অ্যাংলো। এবং চশমা পরা স্বাস্থ্যবান আর এক লোক। অ্যাংলোটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেইনি আমি। হাবভাব-সুর্ব সদা-সতর্ক ধড়িবাজ লোক বলে মনে হচ্ছিল। একটু পাগলাটে বলেও মনে হয়। মুচকি মুচকি হাসে, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়, পরক্ষণে অশান্ত হয়ে ওঠে, কায়দা করে সিগারেট ধরায়-হাস্যকর। মাথা ঘামাচ্ছিলাম দ্বিতীয় লোকটাকে নিয়ে। লোকটা রঙিন গ্লাসের চশমা পরে ছিল। প্রকাণ্ড শরীর। ডান গালে কাটা দাগ। দেখতে, মানে, চেহারাটা ঠিক কি বলব, লোকটাকে দেখে প্রথম থেকেই ভয় লাগছিল আমার।’
কামাল প্রশ্ন করল, “ঠিক লক্ষ্য করেছেন আপনি, ডান গালে কাটা দাগ ছিল? ছিল। আমি ভুল দেখিনি। শহীদ এবং কামাল দৃষ্টি বিনিময় করল।
মিসেস খান শুরু করল আবার, দ্বিতীয় লোকটা যে সহজে পরাজয় স্বীকার করবে না তাও আমি বুঝতে পারছিলাম। তবারক হোসেনকে পাঠালাম, লোকটার পরিচয় জানার জন্য। তবারক হোসেন ফিরে এসে আমার কানে কানে বলল, লোকটার নাম মহাদেব। পুরো নাম কেউ জানে না। আগে কেউ দেখেনি তাকে।
তারপর?’ ‘অ্যাংলো লোকটাকে আগে গ্রাহ্য না করলে কি হবে, সেও ভাবিয়ে তুলল
ভলিউম ১৫
আমাকে। ইতিমধ্যে আড়াই হাজারে পৌঁছে গেছে ডাক। অ্যাংলো একলাফে তিন হাজারে চলে গেল। মহাদেব বলল, তিন হাজার একশো। বিরক্তি লাগছিল আমার। জেদ কাজ করছিল আমার মধ্যে। তাছাড়া জিনিসটা আমার খুবই ভাল লেগে গেছে। দাম যতই পড়ুক, না কিনে ছাড়ব না। সবাইকে চমকে দেবার জন্য কাণ্ড করলাম একটা, পুরো চার হাজার টাকা অফার করলাম। আমি চার হাজার বলতেই চমকে উঠল মহাদেব ভদ্রলোক। কিন্তু আমাকে চমকে দিল অ্যাংলোটা। সে এক লাফে উঠে গেল পাঁচ হাজারে।’
‘মোস্ট ইন্টারেস্টিং,’ কামাল সিগারেট ধরিয়ে ধোয়া ছাড়ল সিলিংয়ের দিকে।
মহাদেব বলল, ছয় হাজার। অ্যাংলো উত্তর দিল, ‘সাত হাজার। আমি নির্বাক দর্শকের মত ওদের দুজনের কাণ্ড দেখছি তখন। দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। কে কাকে টেক্কা দিতে পারে তারই প্রতিযোগিতা। হঠাৎ চমকে উঠলাম, শুনলাম আংলো বলছে-বাইশ হাজার!’
বাইশ হাজার একটা আইকনের দাম? কামাল চোখ কপালে তুলল।
মিসেস খান বলছেন, তবারক হোসেনকে আবার পাঠালাম। ফিরে এসে ও জানাল, অ্যাংলোর নাম•••’।
শহীদ বলে উঠল, ‘স্যানন ডি কস্টা। মিসেস খান সবিস্ময়ে জানতে চাইল, আপনি জানলেন কিভাবে?’
চেহারার বর্ণনা শুনে। আপনি বলে যান।’ ~
মিসেস খান আবার শুরু করল, আমি দাম হাঁকার সময়ই পেলাম না, ডাক উঠে গেল পঁয়ত্রিশ হাজারে। অ্যাংলোকে বিচলিত দেখলাম। অকশনারকে সে জিজ্ঞেস করল, চেক গ্রহণ করা হবে কিনা। গ্রহণ করা হবে না জানানো হলো তাকে। খানিকক্ষণ ইতস্তত করার পর বিদায় হয়ে গেল সে। রইলাম আমি আর মহাদেব ভদ্রলোক। সত্যি কথা বলতে কি, তখন বিচার বিবেচনা বোধ ছিল না আমার। একটা আইকন অত টাকায় কেনার কোন মানে হয় না। টাকার কথা নয়, টাকা আমার আছে। কিন্তু টাকা থাকলেই যা তা কিনে অপচয় করা উচিত নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, জিনিসটাকে আমি যা তা ভাবতে পারছিলাম না। রীতিমত জাদু করেছিল আমাকে আইকনটা। আমি বললাম, চল্লিশ। মহাদেব ভদ্রলোক খুবই ধীর গলায় বললেন, একচল্লিশ।’
দম নিল মিসেস খান। তারপর শুরু করল, “পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত উঠলেন ভদ্রলোক। আমি একান্ন বললাম । ফোন করবার জন্য অনুমতি চাইলেন তিনি। লক্ষ্য করলাম মহাদেব ভদ্রলোকের পিছু পিছু বেরিয়ে গেল আমাদের তবারক হোসেন।
তারপর!’
মাত্র দু’মিনিট পর ফিরে এসে তবারক হোসেন প্রলাপ বকতে শুরু করল আমার কানের কাছে। রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে দেখলাম তার মুখের চেহারা।
৭-কুয়াশা ৪৪
৯৭
মহাদেব ভদ্রলোক আইকনটা কিনবেন কারণ তিনি একজন রাশিয়ান ভদ্রলোকের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সেই রাশিয়ান ভদ্রলোকের পূর্বপুরুষ নাকি ছিলেন এই আইকনের মালিক, এটা পারিবারিক সম্মানের প্রতীক–সে এক লম্বা ইতিহাস। অর্থাৎ তবারক হোসেন বলতে চাইল আইকনটা মহাদেব ভদ্রলোককেই কিনতে দেয়া হোক। কিন্তু ওর একটা কথাও আমার কানে যাচ্ছিল না। যে জিনিস আমার পছন্দ হয়েছে সে জিনিস আমিই কিনব, দাম যতই পড়ুক। অথচ তবারক হোসেন আমাকে বারবার সেই একই কথা বলছে,-এক হাজার টাকার জিনিস পঞ্চাশ-ষাট হাজার। টাকায় কেউ কেনে না, এর চেয়ে ভাল জিনিস কিনিয়ে দেব আপনাকে আমি, ইত্যাদি। অকশনার টেবিলে হাতুড়ি ঠুকতে আমি তবারক হোসেনকে সরিয়ে দিলাম সামনে থেকে, বললাম, পঞ্চান্ন হাজার। মহাদেব ভদ্রলোক বললেন, মে আই সে ফিফটি সিক্স থাউজ্যাণ্ড? আমি বললাম, সিক্সটি থাউজ্যাও। মাহদেব ভদ্রলোক বললেন, অ্যাণ্ড ফাইভ হান্ড্রেড। অকশনার আমার দিকে তাকাল, বলল, সিক্সটি থাউজেন্ড অ্যান্ড ফাইভ হাডে? ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম। তবারক হোসেন চাপা উত্তেজনায় কাঁপছিল। ইতিমধ্যে উপস্থিত লোকেরা দুভাগে ভাগ হয়ে একদল আমার দিকে, একদল মহাদেব ভদ্রলোকের দিকে দাঁড়িয়েছে। রূমের ভেতর পিন ড্রপ সাইলেন্স। তবারক হোসেন চাপা গলায় আমাকে বলছে, ছেড়ে দিন, মিসেস খান। ও-ই নিয়ে যাক ওটা। আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি এর চেয়ে ভাল আইকন কিনিয়ে দেব। আবার আমি লোকটাকে সরিয়ে দিলাম হাতের ধাক্কায়। মহাদেব ভদ্রলোক সত্তর হাজারে পৌঁছে গেছেন এক লাফে। মাথাটা ঘুরছিল আমার। কি করছি না। করছি খেয়াল ছিল না তখন। ফস করে বলে বসলাম, ওয়ান লাখ!
এক লাখ!’ মিসেস খান হাসলেন। বললেন, ‘আমি এক লাখ বলতেই মহাদেব ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন হলরূম থেকে। আইকনটা আমার হলো।
বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল কামাল।
তিবারক হোসেন এরপর আর কোন কথা বলল না আমার সাথে। আমাকে সেখানে রেখেই বেরিয়ে গেল সে। মাত্র ওইটুকু সময়ে সম্পূর্ণ বদলে গেল লোকটা। যাক, আইকনটা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম আমি।’
তারপর কি ঘটল!
মিসেস খান বলল, আজ সকালে, ঘুম থেকে ওঠার আগেই, তবারক হোসেন বাড়িতে গিয়ে হাজির। ব্যাপার কি? না, ওর এক ক্লায়েন্ট আইকনটা কিনতে চায়, দাম দেবে দেড় লক্ষ টাকা। তবারককে বললাম, ওটা আমি বেচবার জন্য কিনিনি। তা সত্ত্বেও সে জানতে চাইল, কত দাম চাই আমি। বললাম, আইকন আমি বিক্রি করব না। কিন্তু নাছোড়বান্দা লোক এই তবারক হোসেন। আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে সে দাম দিতে চাইল এরপর দু’লক্ষ টাকা, তারপর, তিন লক্ষ। তার বক্তব্য,
৯৮
ভলিউম ১৫,
তার ক্লায়েন্ট নাকি ভীষণ আগ্রহী আইকনটা পাবার জন্য। কারণ আইকনটা এককালে তার পরিবারের সম্পদ ছিল।
আপনি কি বললেন এরপর?
বললাম, যদি আইকনটা তোমার ক্লায়েন্টের পরিবারের সম্পদ ছিল একথা প্রমাণ করতে পারো তাহলে আমি ভেবে দেখব । প্রমাণ করতে না পারলে তিন কেন তিন চারে বারো লক্ষ টাকাতেও এটা আমি বিক্রি করব না।’
শহীদ প্রশ্ন করল, রাশিয়ান ক্লায়েন্টের নাম বলেনি তবারক হোসেন?
‘জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি নাম। কিন্তু তবারক হোসেন বলল, নাম প্রকাশ করা । সম্ভব না। অবশ্য নাম নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আসলে পাইনি আমি। তবারক হোসেন চলে যাবার খানিক পর তার ক্লায়েন্ট স্বয়ং গিয়ে হাজির হলো আমার বাড়িতে।
“তাই নাকি! ‘চাকর এসে খবর দিতে জানিয়ে দিলাম, আমি এখন কাজে ব্যস্ত, দেখা হবে । কিন্তু রাশিয়ান ভদ্রলোক খবর পাঠালেন, তিনি অপেক্ষা করবেন। অগত্যা, দু’একটা কথায় আইকন বিক্রি করব না জানিয়ে দিয়ে আপদ বিদায় করব ভেবে, দেখা করলাম। ভদ্রলোককে দেখে গলা শুকিয়ে গেল আমার। প্রকাণ্ড শরীর। লাল টকটকে সূর্যের মত মুখ। বগলে কাঁচ, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। কথা বললেন আমার সাথে ফ্রেঞ্চ ভাষায়। বললেন, “আমার প্রতিনিধি মহাদেব এক নম্বর বোকা, তাই সে টাকার মায়া করে আইকনটা কেনেনি। যাক, তার এই ভুলের জন্য আমি মাসূল দিতে প্রস্তুত। মিসেস খান, আপনি চার লক্ষ টাকায় আইকনটা আমার কাছে বিক্রি করুন।’ কথাগুলো বলে রাশিয়ান ভদ্রলোক পকেট থেকে ফাউন্টেন পেন এবং ব্যাঙ্কের চেক বই বের করলেন।
আপনি কি বললেন?
সেই একই কথা বললাম, আইকন বিক্রির জন্য কিনিনি। ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, আরও বেশি দাম চান? আমি বললাম, না, দাম বেশি পেলেও বিক্রি করব
। এটা আমি কিনেছি আমার শো-কেসে সাজিয়ে রাখব বলে। কিন্তু কার কথা কে শোনে! ভদ্রলোক বললেন, ঠিক আছে, পুরো পাঁচ লাখই দেব, তবু আইকনটা আপনি আমাকে দিন। | ‘কী সাংঘাতিক!
কামাল ঢোক গিলল, একটা আইকন, পাঁচ লাখ টাকা তার দাম!
মিসেস খান বলল, রীতিমত আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটছিল ভদ্রলোকের সাথে আমার জীবনে অনেক রকম লোকের মুখোমুখি হয়েছি, কিন্তু এমন ব্যক্তিত্ব, এমন চেহারী আর চোখে পড়েনি। যাক, ভদ্রলোকের সাত লক্ষ টাকার প্রস্তাবও যখন আমি অগ্রাহ্য করলাম তখন তিনি সেই ধীর গলাতেই বললেন, “মিসেস খান, আমার হৃদয়
কুয়াশা ৪৪
৯৯
বাঁধা পড়ে গেছে আইকনটার সাথে। আপনার উচিত ওটা আমাকে দিয়ে দেয়া। আমি বললাম, দুঃখিত আমি। কিন্তু আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভদ্রলোক বললেন, ভুল করছেন আপনি। পরে হয়তো আফসোস করবেন এই ভুলের জন্য।’ আমি বললাম, আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল থাকব। দ্য আইকন ইজ নট ফর সেল। মি, শহীদ, এরপর ভদ্রলোক কি করলেন কল্পনা করতে পারেন?
“কি করলেন?’
‘ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। রাগে কাঁপছেন থরথর করে। চোখ দুটো জ্বলছে অঙ্গারের মত। হঠাৎ ক্রাচটা বগল থেকে সরিয়ে এনে উপর দিকে তুললেন, যেন মারবেন আমাকে, তারপর কি মনে করে ঘুরে দাঁড়িয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে গেলেন দরজা দিয়ে। ভয়ে আমি নিষ্প্রাণ পুতুলের মত সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। এরপর••।
দ্রুত জিজ্ঞেস করল শহীদ, আইকনটা বাড়িতে রেখে আসেননি তো মিসেস খান?’
, রেখে আসিনি। আপনাকে দেখাব বলে ওটা সাথে করেই নিয়ে এসেছি।’ কোলের উপর থেকে হ্যাঁণ্ডব্যাগটা তুলে নিয়ে খুলল সেটা মিসেস খান। ভিতর : থেকে খয়েরী রঙের একটা পার্সেল বের করে বাড়িয়ে দিল শহীদের দিকে।
পার্সেলটা নিয়ে আলোর নিচে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। আইকনটা গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করল ও। কয়েকবার হাত উঁচু-নিচু করে জিনিসটার ওজন :
অনুভব করার চেষ্টা করল। | মিসেস খান বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য এত কথা বললাম, মি. শহীদ। বলুন দেখি, আইকনটা পাবার জন্য রাশিয়ান ভদ্রলোক এমন উন্মাদের মত । আচরণ করলেন কেন? জিনিসটা দেখতে সুন্দর, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে সাত লক্ষ টাকা এর দাম হতে পারে না। আমি যে দামে কিনেছি তার একশো ভাগের এক ভাগ দামও এটার জন্য বেশি।’
কিন্তু শহীদ ঘুরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তখন কামালের সাথে।
শহীদ বলছিল, কিন্তু তুই যাই বলিস কামাল, নিশ্চিত হওয়া দরকার আমাদের। ফোন করে ওকে বল, আমি এক্ষুণি একবার ওর সাথে দেখা করতে চাই।’
কামাল টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে শুরু করল! মিসেস, খান ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল। হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘কি ব্যাপার! ওটা তো তুবারক হোসেনের ফোন নাম্বার। |
শহীদ হাত তুলে মিসেস খানকে চুপ করতে বলল।
কামাল রিসিভার মুখে ঠেকিয়ে বলছিল, আমি তবারক হোসেনের সাথে কথা বলতে চাই।’’ ।
পুরো একমিনিট চুপচাপ অপর প্রান্তের বক্তার কথা শুনল কামাল। বিস্ময় ফুটে
১০০
ভলিউম ১৫
উঠল তার চোখেমুখে। রিসিভার নামিয়ে বেখে কামাল শহীদের দিকে তাকাল। বলল, বেলা দুটোর সময় তবারক হোসেনের লাশ পাওয়া গেছে তার অফিসে।
মারা গেছে তবারক হোসেন?’ মিসেস খান বিমূঢ়। ‘গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে সে,’ বলল কামাল।
গম্ভীর শহীদ মাথার চুলে দ্রুত আঙুল চালাতে চালাতে পায়চারি করতে শুরু করল।
| হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে ও বলে উঠল, অসহ্য! এর একটা বিহিত না করলেই নয় আর!’
ড্রয়িংরূমে প্রবেশ করল সন্দেশ। তার ঠিক পিছনে লেবু। সন্দেশ বলল, দা দাদা…’
লেবু ‘দাদামণি শব্দটার অবশিষ্টাংশ উচ্চারণ করার চেষ্টা করল, ম-ম-ম ণি•••
কামাল ধমকে উঠল, “কি বলতে চাস একজন বল।’ লেবু বলল, ‘আ-আ-মরা মা-মার্কেটে যা-যা-•••’ সন্দেশ যোগ করল, যা-যা-যা-যাচ্ছি! দি-দিদি..’ কামাল বলল, “দিদিমণির সাথে মার্কেটে যাচ্ছিস, এই তো?” লেবু এবং সন্দেশ দুজনেই বলল, হ্যাঁ।’
যা, ভাগ।’
মিসেস খান হঠাৎ বলল, কিন্তু আমি যে বিশ্বাসই করতে পারছি না তরারক হোসেন আত্মহত্যা করেছে।
কামাল শহীদের দিকে ফিরে বলল, ‘ফোন ধরেছিলেন মি. সিম্পসন। তিনি জানালেন তবারক হোসেনের অফিসে একটা গোড়ালিহীন পায়ের জুতোর ছাপ পাওয়া গেছে…’
শহীদ বলল, ‘থাক। আর বলতে হবে না।’
দশ মিনিট পাঁচেক পর পায়চারি থামিয়ে শহীদ বলল, “মিসেস খান, আমি আপনার কাছ থেকে এক বা দু’ঘণ্টার জন্য আইকনটা ধার চাইছি। কোন আপত্তি।
‘আপত্তি? আপত্তি কেন থাকবে? আমি রহস্যের মীমাংসার জন্যে এসেছি, মি. শহীদ। | শহীদ কামালের দিকে ফিরল, কামাল, তুই মিসেস খানকে পৌঁছে দিবি। আর, মিসেস খান, কামাল আজকের রাতটা আপনার বাড়িতে থাকবে, অ্যাজ এ গার্ড… |
‘গার্ড? কেন, কিছু ঘটতে পারে বলে ভয় পাচ্ছেন নাকি?”
কুয়াশা ৪৪
১০১
শহীদ বলল, ভয় পাচ্ছি না মানে? মিসেস খান, আইকনটা কেনার পর থেকে আপনি প্রতি মুহূর্তে বিপদের মধ্যে রয়েছেন। যে-কোন মুহূর্তে আপনার জীবনের ওপর হামলা হতে পারে।
মিসেস খান বেশ শব্দ করে হেসে উঠলেন, মি. শহীদ, আপনি আমাকে মিছেমিছি ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন!
মোটেই না। ওই যে, টেলিফোন রয়েছে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে আপনি আপনার বাড়িতে ফোন করে জেনে নিন আপনার অনুপস্থিতিতে সেখানে কিছু ঘটেছে কিনা। | শহীদকে সিরিয়াস দেখে মিসেস খানের মুখের হাসি অদৃশ্য হয়ে গেল। হাত
বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল সে।
ফোনে কথা বলার সময় কালো হয়ে গেল মিসেস খানের মুখের চেহারা। রিসিভার নামিয়ে রাখল সে একটু পরই।
শহীদ প্রশ্ন করল, কি খবর?
মিসেস খান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না। আমার বেডরূমের জিনিসপত্র তছনছ করে দিয়ে গেছে কেউ। স্টাডি রূমের আলমারির কাঁচ। ভেঙে ফেলেছে। ড্রয়িংরূমের শো-কেসও কারা যেন•••
শহীদ বলল, “মিসেস খান, আপনাকে আমি সাবধানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। যে-কোন মুহূর্তে আপনার প্রাণের ওপর হামলা আসতে পারে। আশা করি আমার কথা আর অবিশ্বাস করবেন না।’
মি. শহীদ, কে এই লোক, আমার পিছনে কেন সে…’
কামাল জানালার ধার থেকে আচমকা শসস্ করে শব্দ তুলল ঠোঁটে একটা আঙুল ঠেকিয়ে।
চুপ করে গেল ওর।
কামাল ফিসফিস করে বলল জানালা দিয়ে নিচের দিকে চোখ রেখে, শহীদ, মাতবর বাড়ির দিকে নজর রেখেছে।’
জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল শহীদ। উঁকি দিয়ে দেখল সত্যি একজন লোককে দেখা যাচ্ছে নিচের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকতে। ছদ্মবেশে আছে, কিন্তু লোকটা যে প্রফেসর ওয়াইয়ের ডান হাত কুখ্যাত মাতবর তাতে কোন সন্দেহ নেই। | দাঁড়া, আমি আসছি।’ কথাটা বলে ড্রয়িংরূম থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল শহীদ।
বাড়িটা দুই রাস্তার মোড়ে অবস্থিত এবং শহীদের বেডরূমের জানালা দিয়ে নিচের সাইড রোডটা দেখা যায়। বেডরূমে ঢুকল’ শহীদ। পর্দা সরিয়ে জানালা পথে উঁকি দিয়ে নিচে তাকাতেই ফুটপাথের উপর আর একজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে | দেখল ও। কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর লোকটাকে চিনতে পারল * শহীদ। লোকটা মটরসাইকেল চালাতে ওস্তাদ। নাম, জর্মন শেখ। প্রফেসর
১০২
ভলিউম ১৫
ওয়াইয়ের বাঁ হাত। রাস্তার একধারে প্রকাণ্ড একটা ঝকঝকে মটরসাইকেলও দেখল শহীদ।
রাস্তার শেষ প্রান্তে আর একজন লোককে দেখল শহীদ। রাস্তায় পঁড়িয়ে আপন মনে বাদাম বা ছোলা ভাজা জাতীয় কিছু খাচ্ছে। লোকটার মাথায় অস্বাভাবিক লম্বা একটা হ্যাট। লোকটা যে ডি কস্টা তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। | ‘সাইডরোডেও প্রফেসর ওয়াইয়ের লোক আছে,’ ড্রয়িংরূমে প্রবেশ করে বলল শহীদ। তাকাল মিসেস খানের দিকে, মিসেস খান, আপনি আজ ডিনারটা আমাদের সাথেই খাবেন। আপনার বান্ধবী মার্কেটে গেছে সেই কথা ভেবেই।’
মিসেস খান বলল, কিন্তু আপনি যে বললেন আপনার সহকারী মি. কামাল আহমেদ আমার বাড়িতে থাকবেন আজ রাতে?’।
ফোনের রিসিভার তুলে নিতে নিতে শহীদ বলল, ‘সাইড্ডাের বা মেইনডোর কোন পথেই বাইরে বেরুবার উপায় নেই।
রিসিভার ভুলে ডায়াল করল শহীদ, হ্যালো? আমি মি. আলাজিভটাকরাভস্কির সাথে কথা বলতে চাই।’
। খানিক পর অপর প্রান্তে বাঞ্ছিত ভদ্রলোক এলেন। শহীদ বলল, কেমন আছেন, প্রফেসর আলাজিভটাকরাভস্কি? শহীদ খান বলছি, ইয়েস। হাতে খুব কাজ নাকি? একবার আসুন না আমার বাড়িতে-হা, বিশেষ প্রয়োজন•••তাই নাকি! ওয়াইফের অসুখ? ডাক্তারকে খবর পাঠানো হয়েছে? দুঃখিত•••ঠিক আছে। সেক্ষেত্রে আমাকেই যেতে হবে আপনার কাছে হা, এই ধরুন বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছুব আমি।’
রিসিভার নামিয়ে রাখল শহীদ ক্রেডলে।
কোথায় যাবেন আপনি?’
শহীদ বলল, আপনার আইকনটা একজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে আনি। কামাল, মিসেস খানকে দেখবি তুই! কাজ সেরেই ফিরব আমি। ছাদের ওপর দিয়ে যাচ্ছি।’
মহামূল্যবান আইকনটা নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল শহীদ ড্রয়িংরূম
থেকে।
সন্ধ্যা নেমেছে খানিক আগে।
অন্দর মহলে ঢুকল কামাল মিসেস খানকে ড্রয়িংরূমে বসিয়ে রেখে। একটু পরই ফিরল ও। বলল, কী বিদঘুঁটে ব্যাপার বলুন তো, মহুয়াদি সাথে করে চাকর-বাকর সবাইকে নিয়ে গেছে মার্কেটে। বাইরে থেকে তালা দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে গেছে সাইড্ডাের।
মিসেস খান কথা বলল না, কি যেন ভাবছে। ‘কি ভাবছেন?’
কুয়াশা ৪৪
১০৩.
| বেচারা তবারকের কথা আমি ভুলতে পারছি না। গতকাল তার ওপর বিরক্ত হয়েছিলাম, কিন্তু আসলে লোক হিসেবে খারাপ ছিল না সে। দুঃখ লাগছে বড় ওর
জন্য। কেন সে আত্মহত্যা করল?
কামাল বলল, ‘আত্মহত্যা সে স্বেচ্ছায় করেনি, মিসেস্ব খান। হয় সে খুন হয়েছে, নয়ত, আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে।’
‘আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে মানে!
কেউ যদি আপনার বুকের উপর পিস্তল ধরে বলে এই মুহূর্তে দড়ি ঝুলিয়ে গলায় ফঁস পরীও, আপনি কি করবেন?
‘কিন্তু•••কে তবারককে এ কথা বলল? কেন বলল? কি তার অপরাধ?’
কামাল বলল, ‘আমাদের দৃষ্টিতে হয়তো সে কোন অপরাধ করেনি। কিন্তু প্রফেসর ওয়াইয়ের চোখে সে অপরাধী। আমার ধারণা প্রফেসর ওয়াই তাকে আইকনটা যে ভাবে হোক আপনার কাছ থেকে আদায় করার হুকুম দিয়েছিল। হুকুম পালন হয়নি বলে শাস্তি দিয়েছে।’
কে এই প্রফেসর ওয়াই? লোকটা সম্পর্কে সব কথা বলুন আমাকে, মি. কামাল।
কামাল বলতে শুরু করল প্রফেসর ওয়াই সম্পর্কে।
শুনতে শুনতে অবিশ্বাসের ভাব ফুটে উঠল মিসেস খানের চোখে মুখে। বলল, ‘কি বলছেন এসব আপনি? একজন উন্মাদের ভয়ে সবাই কাহিল হয়ে পড়েছেন? দেশে কি পুলিস নেই? আইন নেই? আপনারা থাকতে..’ ‘
কামালের আর উত্তর দেয়া হলো না। তার মুখ খোলার আগেই ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন।
‘হ্যালো?’ অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল ভারি কণ্ঠস্বর, কামাল নাকি? কামাল চমকে উঠল, কুয়াশা! অপর প্রান্ত থেকে আবার সেই ভারি গলা বলল, শহীদ কোথায়? ‘একটু আগে বিশেষ দরকারে বাইরে গেছে।
অপরপ্রান্ত থেকে ভারি কণ্ঠস্বর বলল, ‘কামাল, শহীদ যখন নেই, তুমিই একবার চলে এসো, আমার মগবাজারের বাগান বাড়িতে। বিশেষ জরুরী একটা আলাপ
আছে।’
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
কামালকে চিন্তিত দেখে মিসেস খান জানতে চাইলেন, কে ফোন করেছিলেন? চিন্তায় পড়ে গেলেন মনে হচ্ছে?
কামাল বলল, হ্যাঁ। বিশেষ একটা জরুরী ব্যাপারে বাইরে যেতে হবে আমাকে এখুনি। ভাবছি, আপনাকে একা রেখে যাওয়া উচিত হবে কিনা। মহুয়াদিও ফিরল না এখনও•••।’
১০৪
। ভলিউম ১৫
হেসে ফেলল মিসেস খান। বলল, ‘একা থাকতে ভয় পাব ভাবছেন? মি. কামাল, আমি আমেরিকায় বহু বছর কাটিয়েছি। একা আমি সমুদ্রে ছিলাম তিন দিন, ভেলার ওপর। আরিজোনা মরুভূমিতে দু’বার পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি.••ভয় বলে কোন জিনিসের সাথে আমি পরিচিত নই। আপনি প্রফেসর ওয়াইয়ের যে গল্প আমাকে শোনালেন তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি, ভয় পাইনি। আপনি নির্দ্বিধায় আমাকে একা রেখে বাইরে যেতে পারেন। বিশ্বাস করুন, আমি এতটুকু ভয় পাব
।’
কামালের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘সত্যি তো? নাকি লজ্জায় স্বীকার করছেন না•••?’
খিলখিল করে হেসে উঠল মিসেস খান। বলল, হাসালেন দেখছি। ভয় পেলে স্বীকার করতে লজ্জা কিসের?’ | কামাল বলল, “তবে আমি যাই। কাজ সেরেই এসে পড়ব। এক কাজ করুন, আমি বেরিয়ে গেলেই দরজাটা বন্ধ করে দিন ভিতর থেকে।
‘ ঠিক আছে।’
দরজা বন্ধ করে দিয়ে কি মনে করে মিসেস খান জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পর্দাটা একটু ফাঁক করে নিচের দিকে তাকাল সে।
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে সেই লোকটা এখনও।
লোকটার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল মিসেস খান। তারপর হঠাৎ দেখল, লোকটা রাস্তা ধরে দ্রুত হাঁটছে।–
দেখতে দেখতে চোখের আড়ালে চলে গেল লোকটা। মিসেস খান বুঝতে পারল লোকটা কামালকে অনুসরণ করতে শুরু করেছে।
জানালার কাছ থেকে ফিরে এসে সোফায় বসল মিসেস খান। মনটাকে কেন যেন স্থির রাখতে পারছে না সে। সকালবেলার ঘটনাটা মনে পড়ছে। প্রকাণ্ডদেহী রাশিয়ান লোকটাই তাহলে প্রফেসর ওয়াই। বাপরে, কী ভয়ঙ্কর চেহারা! চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত কয়লার টুকরো।
. মনে পড়ল, কারা যেন তার বাড়ির জিনিসপত্র তছনছ করে দিয়ে গেছে। আবার কিছু ঘটেনি তো বাড়িতে? মিসেস খান হাত বাড়িয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল।
কি ব্যাপার! শব্দ নেই কেন রিসিভারে!
ক্রেডলে রিসিভার রেখে চিন্তা করতে লাগল মিসেস খান। কখন খারাপ হলো ফোনটা? কলিংবেলের বোতামের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ল তার। মহুয়া কি ফিরেছে? বোতামে চাপ দিল সে।
একি! শব্দ নেই কোন। তারমানে কলিংবেলও কাজ করছে না
পাশের রূমে আর একটা ফোন আছে, মনে পড়ল। দ্রুত পায়ে পাশের রূমে
কুয়াশা ৪৪
১০৫
গেল সে। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল-সর্বনাশ! এটাও ডেড!
ভয়ের একটা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসছে মিসেস খানের। দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরূমে ফিরে এল সে।
পিছন দিকে শব্দ হলো দরজা খোলার। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে গিয়ে ভাবল মিসেস খান, যাক, বাঁচা গেল, মহুয়া ফিরেছে শেষ পর্যন্ত•••
ঘাড় ফিরিয়ে মিসেস খান দেখল দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন প্রকাণ্ডদেহী প্রফেসর ওয়াই।
তীক্ষ্ণ এক চিৎকারের জন্যে মুখ হাঁ করল মিসেস খান।
এগারো
অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটল একটা। হাঁ করে তীক্ষ্ণ চিৎকার করতে যাচ্ছিল মিসেস খান। কিন্তু তিন গজ দূর থেকে গরিলাসদৃশ প্রফেসর ওয়াই বিদ্যুৎবেগে রূমের ভিতর প্রবেশ করলেন। অমন ভারি দেহ নিয়ে চোখের পলকে তিনগজ দূরত্ব অতিক্রম করা এককথায় বিস্ময়কর হলেও পরমুহূর্তে দেখা গেল প্রফেসর ওয়াই মিসেস খানের মুখে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার বের হবার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন।
খ্যাপা দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন প্রফেসর। সরে গেলেন ধীরে ধীরে এক পাশে। | গর্জে উঠলেন ভারি বাজখাই গলায়, মিসেস খান, হুঁশিয়ার! চেঁচালে কোন লাভ হবে।
তোমার। সাবধান করে দিয়েছিলাম তোমাকে, মনে আছে তো? এবার দাও, ছিনিয়ে নিতে এসেছি আমি আইকনটা। সাত লক্ষ টাকা দাম দিতে চেয়েছিলাম, দাওনি। এখন একটা নয়া পয়সাও পাবে না তুমি আমার কাছ থেকে। আইকনটা কোথায়?’
সেটা•••সেটা আমি বাড়িতে রেখে এসেছি!’
বগলের ক্রাচ তুললেন প্রফেসর সবেগে মিসেস খানের মাথার উপর। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘মিথ্যে কথা বলেছ কি গুঁড়িয়ে দেব মাথা! টিকটিকি শহীদ খানের। কাছে নিয়ে এসেছ তুমি আইকনটা। আমার সাথে চালাকি করে কেউ কোন দিন পার পায়নি, মিসেস খান। তোমার বাড়ির এমন কোন জায়গা নেই যেখানে সন্ধান চালানো হয়নি। নেই সেখানে আইকন। আমি শেষবার জানতে চাই কোথায় সেটা?’
মিসেস খান ঠোঁট কামড়ে ধরে কি যেন ভাবছে।
ক্ৰাচটা নামিয়ে নিলেন প্রফেসর। ঝট করে ধরলেন নোমশ হাতে মিসেস খানের একটা হাত, বলবে না? বেশ! তাহলে মৃত্যুর জন্য তৈরি হও…’
প্রফেসর ওয়াই, মিসেস খানের হাতটা ছেড়ে দিন। ব্যথা পাচ্ছেন ভদ্রমহিলা। বিকট শব্দে গর্জে উঠে প্রফেসর ওয়াই সবেগে ঘুরে দাঁড়ালেন রূমের তৃতীয়
১০৬
ভলিউম ১৫
দরজার দিকে। চোখের পলকে বের করে ফেলেছেন পকেট থেকে বিরাটাকার অটোমেটিক রিভলভারটা।
মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও, শহীদ খান? হিংস্র হয়ে উঠেছেন, প্রফেসর ওয়াই।
শহীদ বলল, “কিন্তু আমার হাতের পার্সেলটা ফেলে দিলে ভেঙে যাবে যে…। ‘গুলি কব আমি। তোলো বলছি মাথার ওপর হাত।
মাথার উপর হাত তুলল শহীদ। মিসেস খানের দিকে তাকিয়ে বলল ও, দুঃখিত, মিসেস খান। কামাল যদি এখন থাকত এখানে…’।
• জর্মন শেখ!’ প্রফেসর হাঁক ছাড়লেন। বেডরূম থেকে দুজন লোক বেরিয়ে এল সাথে সাথে। জর্মন শেখ এবং মাতবর।
প্রফেসর ওয়াই শহীদের দিকে তাকালেন। বেশ একটু শান্ত দেখাচ্ছে এখন তাকে, কামাল, না? সে কুয়াশার জুরুরী টেলিফোন পেয়ে বেরিয়ে গেছে আধঘণ্টা আগে, তাই না মিসেস খান?’
কথাটা বলে চেয়ার টেবিল কাঁপিয়ে হাঃ হাঃ করে হাসতে শুরু করলেন প্রফেসর ওয়াই।
. শহীদ মিসেস খানের উদ্দেশ্যে বলছিল, আমি একা, ওরা তিনজন–করার কিছু নেই, মিসেস খান। স্বপ্নেও ভাবিনি এরা এখানে ঢুকতে সাহস পাবে। আগে থেকে জানলে জিনিসটা নিয়ে ঢুকতাম না এখানে•••।
‘জর্মন শেখ, টিকটিকির হাতের প্যাকেটটা আনো!’ প্রফেসর ওয়াই হুকুম করলেন। বিজয়ীর হাসি তার সারা মুখে। জর্মন শেখ প্যাকেটটা শহীদের হাত থেকে
ছোঁ মেরে নিয়ে প্রফেসর ওয়াইয়ের হাতে দিল।
কাগজের মোড়ক খুলে আইকনটা বের করলেন প্রফেসর ওয়াই! নেড়েচেড়ে দেখলেন সেটা খানিকক্ষণ। আবার উজ্জ্বল হাসিতে ভরে উঠল তার মুখ। আইকনটা ওভারকোটের পকেটে ভরে রাখলেন সযত্নে।
শহীদের দিকে তাকালেন প্রফেসর, এক ঢিলে দুই পাখি মারার স্বভাব আমার নয়। এক-একবারে এক-একটা কাজ করি আমি। তোমাকে আছাড় দিয়ে থেঁতলে। মেরে ফেলার সাধ ইচ্ছা করলেই এই মুহূর্তে পূরণ করতে পারি আমি। কি, পারি
? কিন্তু, না, তোমাকে এখন খতম করব না। জানি, আমার কেশ স্পর্শ করার ক্ষমতাও তোমাদের নেই। পারবে না জেনেও অকারণে আমার সাথে লাগতে আসোলজা নেই তোমাদের। এখন ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু ভবিষ্যতে ছাড়ব না, জেনো। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে। তোমরা আমাকে ধরার জন্যে মাঝে মধ্যে এমন তড়াক তড়াক করে লাফাও, এমন ছুটোছুটি দৌড়োদৌড়ি করো–বেশ মজা লাগে দেখতে। তোমরা না থাকলে কোত্থেকে পেতাম এমন মজা? যাক, সময় নেই আমার। কাজ হাসিল হয়েছে, চললাম। ‘ কুয়াশা ৪৪
১০৭
ড্রয়িংরূম থেকে করিডরে বেরিয়ে গেল প্রফেসর ওয়াই। পিছু পিছু বেরিয়ে গেল * তার দুই সহকারী। বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।
| দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই মিসেস খান তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মি, শহীদ আপনি•••আপনি একটা কাপুরুষ! আমি ভেবেছিলাম আপনি সত্যিকার
• পুরুষমানুষ একজন, সাহসী! আমি ধারণাই করিনি এতটুকু বাধা না দিয়ে ভয়ে কঁপতে কাঁপতে আইকনটা আপনি একটা ডাকাতকে দিয়ে দেবেন।’
শহীদ মৃদু মৃদু হাসছিল। বলল, ‘পাঁচ মিনিট সময় দিন আমাকে, মিসেস খান। আমি সব ব্যাখ্যা করব।
কে শুনতে চায় আপনার ব্যাখ্যা? লোকটা আমার আইকন নিয়ে চলে গেল-এর আবার ব্যাখ্যা কি? ব্যাখ্যা শুনে আমার লাভই বা কি হবে?’
শহীদ ড্রয়িংরূম থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। রহস্যময় হাসিটা লেগে আছে তখনও ওর ঠোঁটের কোণে।
খানিক পরেই ফিরে এল ও। বলল, প্রফেসর ওয়াই দলবল নিয়ে কেটে পড়েছেন। এবার সব কথা বলা যায় আপনাকে। তার আগে এক ভদ্রলোকের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার।’ কথাগুলো বলে শহীদ রূমের তৃতীয় দরজার দিকে তাকাল, মি. আলাজিভটাকরাভস্কি!
ছোটখাট একজন রাশিয়ান ভদ্রলোক ড্রয়িংরূমে প্রবেশ করলেন।
শহীদ বলল, “আসুন, প্রফেসর। মিসেস খান, ইনি প্রফেসর আলাজিভটাকাভস্কি। রাশান এমব্যাসীতে চাকরি করেন। আমার বন্ধু।
ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করুল ঝড়ের বেগে কামাল, মিসেস খান, কোন বিপদ ঘটেনি তো?”
মুচকি হেসে শহীদ বলল, কি রে, কেন ডেকেছিল কুয়াশা?’
কামাল চেঁচিয়ে উঠল, বোকা বানিয়েছে প্রফেসর ওয়াই আমাকে। বুঝতেই পারিনি। কুয়াশার সাথে দেখা হয়নি, ডি, কস্টা বলল কুয়াশা ঢাকায় নেই | তা, কি ঘটেছে বল তো এখানে?’
মিসেস খান বুলল, কি আবার ঘটবে! মি. শহীদ কাপুরুষের মত আমার আইকনটা সেই ডাকাতের হাতে তুলে দিয়েছেন।
হোয়াট! প্রফেসর ওয়াই এসেছিল এখানে?’
মিসেস খান বলল, ‘এসেছিল এবং আইকনটা নিয়ে গেছে। মি. শহীদ এতটুকু বাধা দেননি তাকে।
‘শহীদ•••!’ কামাল হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেল। চোখ দুটো কপালে উঠল তার। মিসেস খান অন্যদিকে চেয়ে আছেন।
কামাল বলে উঠল, কে বলল প্রফেসর ওয়াই আইকনটা নিয়ে গেছেন? আমি তো দেখতে পাচ্ছি শহীদের হাতে রয়েছে সেটা।’
ভলিউম ১৫
১০৮
ঝট করে ঘুরে তাকাল মিসেস খান। অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে সে দেখল শহীদ মিটি মিটি হাসছে। ওর হাতে রয়েছে আইকনটা।
একি!’ মিসেস খান ঢোঁক গিলল।
শহীদ প্রফেসর আলাজিভটাকরাভস্কির দিকে ফিরল, প্রফেসর আপনি এবার ব্যাখ্যা করে আইকনটা সম্পর্কে বলুন, প্লীজ।
শহীদের হাত থেকে আইকনটা নিয়ে প্রফেসর আলাজিভটাকরাভস্কি বলতে শুরু করলেন মিসেস খানের দিকে তাকিয়ে, ম্যাডাম, আপনি সত্যি ভাগ্যবতী। রাশিয়ান চার্চের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি আজ আপনার হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিয়েছে। এই আইকনটা সাধারণ আর সব আইকনের মত দেখতে হলেও আসলে ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এটি অন্য সবগুলোর চেয়ে লক্ষকোটি গুণ বেশি মূল্যবান। অত্যন্ত পুরানো এই আইকন। এভানজেলিস্ট স্বয়ং এতে রঙ লাগিয়েছিলেন।
প্রফেসর সিগার ধর বার জন্য বিরতি নিলেন।
মি. শহীদ প্রফেস ওয়াইকে চেনেন। ওঁর সন্দেহ, প্রফেসর ওয়াই ধর্মীয় বা ঐতিহাসিক কারণে আইকনটা হস্তগত করতে চাইছেন না। এর পিছনে অন্য কোন কারণ আছে। আমার কাছে তিনি নিয়ে যান আইকনটা পরীক্ষা করবার জন্য। খুবই সাধারণ আইকন এটা। এটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতটুকু তা বোঝার মত’ জ্ঞান সাধারণ লোকের তো দূরের কথা, আমারই নেই। আমি আইকটা নিয়ে গিয়ে দেখাই ভ্লাদিমির তুখোমভকে। আপনারা সংবাদপত্রে দেখে থাকবেন হয়তো, তুখোমভ বর্তমানে বাংলাদেশে ভ্রমণ করছেন। তিনি আইকনটা পরীক্ষা করে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন।
| প্রফেসর আলাজিভটাকাভস্কি হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আইকনটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে জেনেও আমার বন্ধু মি. শহীদ খান সন্তুষ্ট হতে পারলেন
। অগত্যা আইকনটা আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আবার পরীক্ষা করতে বল্লাম। এবার পরীক্ষা করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম।’
প্রফেসর আলাজিভটাকরাভস্কি আইকনটা উল্টো করে ধরে সবাইকে দেখালেন পিছন দিকটা। দেখা গেল নিচের কাঠের সাথে আটকানো চারটে স্ক। শু চারটে খুলতেই কাঠের ঢাকনিটা আলগা হয়ে গেল। সেটা সরিয়ে ফেললেন প্রফেসর আলাজিভটাকাভস্কি। এরপর দেখা গেল চারটে গভীর গর্তে চারটে টিউব ঢোকানো রয়েছে। একটা টিউবের গায়ে জড়ানো অতি পুরাতন একটুকরো কাগজ।
টিউবগুলো ধাতব পদার্থের। একটা একটা করে খোপ থেকে বের করে। সেগুলো রাখা হলো টেবিলের উপর।
“কি আছে টিউবগুলোয়?
সবাইকে চমকে দিয়ে ঘোষণা করল শহীদ, রেডিয়াম। কারও মুখে কথা ফুটল না। বোকার মত চেয়ে আছে মিসেস খান শহীদের
কুয়াশা ৪৪ |
১০৯
দিকে। কামাল হতভম্ব।
শহীদ বলে উঠল, প্রফেসর টাকাভস্কি চিঠিটা অনুবাদ করে বাংলায় পড়ুন আপনি।’
প্রফেসর পড়তে শুরু করলেনঃ
‘আই, প্রফেসর চেগেরভ, প্রফেসর অব কেমিস্ট্রি ইন দ্য ইউনিভার্সিটি অব মস্কো, বীইং ইন ইমিনেন্ট ডেঞ্জার অভ অ্যারেস্ট বাই দ্য এক্সট্রা অর্ডিনারি কমিশন অব সোভিয়েট গভর্নমেন্ট হ্যাভ কনসিলড ফর সেফ কাস্টডি ইন দ্য রেসেড আইকন অব আওয়ার লেডি অফ স্পেলেনস্ক ফোর গ্রামস অভ রেডিয়াম, প্রপার্টি অভ দ্য মস্কো কেমিক্যাল। ইন্সটিটিউট, হুইচ আই টেক উইথ মি ইন মাই ফ্লাইট টু সেভ ফর সায়েন্স।’
কামাল আঁতকে উঠে বলল, কী সাংঘাতিক! চার গ্রাম রেডিয়াম–মাথা ঘুরছে আমার হিসেব করতে গিয়ে। চলতি বাজারদর অনুযায়ী চার গ্রাম রেডিয়ামের দাম কমপক্ষে আড়াই লক্ষ ব্রিটিশ পাউণ্ড •••। প্রফেসর ওয়াই সাধে কি এর পিছনে ছুটছিলেন।
মিসেস খান ঢোক গিলে জানতে চাইল, কিন্তু প্রফেসর ওয়াই যে আইকনটা নিয়ে গেল?
উত্তর দিলেন প্রফেসর টাকাভস্কি, ম্যাডাম, একটি কথা বোধহয় আপনারা জানেন না। কথাটা হলো এই যে আজও রাশিয়ায় আইকনের কদর আছে। এর পবিত্রতা রক্ষা করি আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের মতই। রাশিয়ার প্রায় সব বাড়িতে এবং গির্জায় একাধিক আইকন পাবেনই আপনি। উন্মাদ প্রফেসর ওয়াই যেটা নিয়ে গেলেন সেটা আসলে আমার বাড়ির আইকন, শহীদ খান ওটা আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিলেন।’
শহীদ বলল, আমি ভেবেছিলাম ওটা আপনার বাড়িতে রেখে আসব গোপনে, মিসেস খান। প্রফেসর ওয়াই আবার আইকনের খোঁজে আপনার বাড়িতে গেলে ওটা পাবে এবং আসল আইকন মনে করে নিয়ে যাবে সাথে করে–এই রকম কল্পনা করেছিলাম আমি। কিন্তু ছাদ থেকে নিচে নেমে ড্রয়িংরূমে ঢুকতে গিয়ে শুনি প্রফেসর ওয়াই কথা বলছেন আপনার সাথে। দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। সুযোগটা হাতছাড়া করতে মন চাইল না•••।’
মিসেস খান বলল, বুঝেছি। মি, টাকরাভস্কির আইকনটা নিয়ে গেছে প্রফেসর ওয়াই। মি, শহীদ, আমি দুঃখিত! অনেক অপ্রীতিকর কথা বলেছি না বুঝে, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
• শহীদ হাসল। বলল, “ওসব কথা ছাড়ুন। আমার অভিনয়টা কেমন হয়েছিল বলুন তো?’
১১০
ভলিউম ১৫
সবাই হেসে উঠল একসাথে।
শহীদ বলল, ‘পাগলা প্রফেসর ওয়াই কিন্তু আইকনটা পরীক্ষা করে ভয়ানক খেপে যাবে। কারণ•••
কারণ?’ :
শহীদ হঠাৎ হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল, নকল আইকনের পিছনটা খুলে আমি এক টুকরো কাগজ পুরে দিয়েছি ভিতরে। তাতে প্রফেসর ওয়াইয়ের উদ্দেশ্যে হাস্যরসাত্মক কথা লেখা আছে দু’একটা।’
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল সবাই। হাসি থামতে কামাল বলল, “আচ্ছা, চিঠির লেখক এই প্রফেসর চেগেরভ কে? লোকটা বিপ্লবের বিরোধী ছিল বোঝা যাচ্ছে।’
| প্রফেসর, টাকরাভস্কি বললেন, ‘প্রফেসর চেগেরভ ছিল তখনকার মস্কোর আতঙ্ক। পণ্ডিত এবং প্রতিভাবান ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকৃতিটা ছিল ক্রিমিন্যালের মত। নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করত সে। শোনা যায়, মানুষকে দীর্ঘজীবী করার এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে বহু নিরীহ লোককে হত্যা করে সে। | মিসেস খান বলল, রেডিয়ামসহ আইকনটা বাংলাদেশে এল কেমন করে?
শহীদ বলল, সে রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে।’
কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা দরজার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল ভিতরে মহুয়া। ফিসফিস করে বলল সে, ‘তোমরা এখানে গল্প করছ এখনও! এদিকে
এসো সবাই, দেখো কি কাণ্ড হচ্ছে।’
কি কাণ্ড হচ্ছে!’ উঠে দাঁড়াল উত্তেজিত কামাল। ‘আস্তে! সবাই পা টিপে টিপে এসো আমার সাথে। খুনোখুনি কাণ্ড••• | সবাই পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল মহুয়ার পিছু পিছু ড্রয়িংরূম থেকে। রয়ে গেলেন শুধু প্রফেসর টাকরাভস্কি। আইকনের নিচের খোলে রেডিয়ামের টিউব চারটে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখছেন তিনি।
পা টিপে টিপে ওরা সবাই কিচেনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল! কিচেনের জানালায় গিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে সবাই দেখল সন্দেশ এবং লেবু সশস্ত্র অবস্থায় শত্রুকে,
পাহারা দিচ্ছে।
রূমের দুটো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সন্দেশ এবং লেবু; সন্দেশের হাতে ধারাল একটা দা, লেবুর হাতে মোটা একটা লোহার রড। কিচেনরূমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে হ্যাট পরা স্যানন ডি কস্টা। বক্তৃতার ভঙ্গিতে কিছু বলছে সে।
লেবু বলে উঠল, টাকা মে-মে-মে••• 1 সন্দেশ বলল, “মেরে বো-বো-বো•••।’ লেবু বলল, বোকা বানিয়ে-য়ে-য়ে•••।’ বানিয়েছিলে আমা-মা-দেরকে••• ‘আজ তো তো–’ লেবু বলল, তোমার রক্ষা নে-নে-নেই!
কুয়াশা ৪৪
ডি, কস্টা বলছে, এগেন অ্যাণ্ড এগেন এক কঠা টোমাডেরকে বলিটে ডাল লাগিটেছে না হামার। টোমাডের বস হামার ফ্রেণ্ড। বসের ফ্রেণ্ডকে টোমরা ইনসাল্ট করিটে পারে৷ না। টাছাড়া, টোমরা হানড্রেড টাইমস্ ট্রাই করিলেও হামার কোন। ক্ষটি করিটে পারিবে না। হামি মি, কুয়াশারও ফ্রেণ্ড। ইচ্ছা করিলেই টোমাডেরকে কারাটের কোপ মারিয়া সেন্সলেস করিয়া ডিটে পারি।’
হোঃ হোঃ শব্দে হেসে উঠল কামাল। শহীদ বলল, এই কাণ্ড দেখবার জন্য ডেকে আনলে তুমি আমাদেরকে?
• মহুয়া হাসতে লাগল।
মিসেস খান বলে উঠল, কে ওই হ্যাঁন্ট পরা লোকটা? গতকাল নীলাম ডাকার সময় ওই তো ছিল আমার দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী।
শহীদ বলল, ‘ওর নাম স্যানন ডি কস্টা। কুয়াশার লোক। কুয়াশা কে? শহীদ বলল, কেন, আপনার বান্ধবী কুয়াশার কথা কখনও বলেনি আপনাকে।
তো!’ মহুয়া বলল, ‘দাদার কথা আমি সচরাচর কাউকে বলি না। কে কি মনে করে। তোর দাদার নাম কুয়াশা?’ মহুয়া বলল, হ্যাঁ।
শহীদ বলল, তার কথা আর একদিন শুনবেন, মিসেস খান। একদিনে বেশি লোকের কথা শুনে হজম করতে পারবেন না।’
ড্রয়িংরূমের দিকে পা বাড়াল শহীদ, মিসেস খান এবং মহুয়া। কামাল ডি, কস্টা নাম সন্দেশ ও লেবুর ঝগড়ার মীমাংসা করে দিতে ব্যস্ত কিচেনে।
ড্রয়িংরূমে ঢুকেই শহীদ আঁতকে উঠল, প্রফেসর টাকরাভস্কি গেলেন কোথায়?’
• রূমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে মিসেস খান কাউকে দেখতে না পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, নেই!’
মহুয়া বলল, এই তো ভদ্রলোককে দেখে গেলাম।
মিসেস খান বলে উঠল, ‘দরজাটা খোলা••মি, শহীদ, আপনার বন্ধু আমার আইকনটা নিয়ে পালিয়ে যাননি তো?
শহীদ হঠাৎ লাফ মারল সোফাগুলোর দিকে।
দেখা গেল সোফার পিছনে প্রফেসর ‘টাকরাভস্কির অজ্ঞান দেহটা পড়ে রয়েছে।
মহুয়া, ডাক্তারকে খবর দাও…’ শহীদ দ্রুত বলল। মহুয়া ফোনের দিকে এগোতে মিসেস খান বলে উঠল, ফোনের লাইন কাটা।
কামালকে ডাকছি আমি।’ মহুয়া ছুটে বেরিয়ে গেল ড্রয়িংরূম থেকে।
ভলিউম ১৫
শহীদ পালস দেখল প্রফেসর ‘টাকরাভস্কির। ভয়ের কোন কারণ নেই। জ্ঞান হারিয়েছেন প্রফেসর ক্লোরোফর্মের প্রভাবে। মিষ্টি গন্ধটা চিনতে ভুল হয়নি
শহীদের।
হঠাৎ টেবিলের উপর নজর পড়ল শহীদের.। আইকনটা কোথায়?
টেবিলে নেই আইকন। টেবিলের উপর ওটা কি, পেপার ওয়েট চাপা দেয়া একটুকরো কাগজ না ।
টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল শহীদ। পেপার ওয়েট সরিয়ে তুলে নিল কাগজের টুকরোটা।
একটা চিঠি! হাতের লেখাটা চিনতে পারল শহীদ প্রথম দর্শনেই।
• চিঠিটা হুবহু এইরকম?
প্রিয় শহীদ,
কুশল জেনো। ডি কস্টা জিনিসের গুরুত্ব বোঝে না তাই আইকনটা গতকাল হাতছাড়া করে সে। যে-কোন মূল্যে ওটা সংগ্রহ করতে বলছিলাম ওকে। যাক, মিসেস খান প্রচুর টাকার মালিক, এইরকম বহু আইকন সে কিনতে পারবে। সে যদি গ্রহণ করতে সম্মত হয় তাহলে আমি একজোড়া আইকন পাঠিয়ে দেব তার বাড়িতে। এটা তার কোন কাজে লাগবে না বলে নিয়ে যাচ্ছি।
ইতি কুয়াশা।
Leave a Reply