৪৩. স্বর্ণ চালান ২ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪৩
প্রথম প্রকাশ: মার্চ, ১৯৭৪
এক
সেদিনই বিকেলে আজমল রব্বানী শরীফ চাকলাদারের সাথে দেখা করার জন্যে বাইরে বের হবার কথা ভাবছিল। এমন সময় বেজে উঠল বাড়ির গেটের কলিংবেল। রবালি দরজা খুলে দিয়ে দেখল সুবেশী সুদর্শন স্বাস্থ্যবান একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। রাস্তার পাশে একটা ঝকঝকে নতুন গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বুবালি বুঝল ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে এসেছেন। সবিনয়ে জিজ্ঞেস করল সে, কাকে চান, হুজুর?’
ভদ্রলোক অর্থাৎ সত্যান্বেষী শহীদ খান মুচকি হেসে বলল, চাই তোমাদের বিবি সাহেবাকে। বাড়িতে আছেন কি তিনি?” | রবালি কি বলবে ভেবে পেল না। আজ অবধি শোনেনি সে কেউ তার বিবি সাহেবার সাথে সরাসরি দেখা করতে চেয়েছে। অনেক ভেবে সে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল, ‘সাহেব বাড়িতেই আছেন। আমি কি সাহেবকে ডেকে দেব? বিবি সাহেবা আপনার সাথে দেখা করবেন কিনা।
শহীদ বলল, তোমার সাহেবকে ডেকে দিতে হবে না। আমাকে ড্রয়িংরূমে নিয়ে গিয়ে বসও আগে। তারপর তোমার সাহেবকে গিয়ে খবর দাও। তোমার সাহেবকে গিয়ে বলবে ডিটেকটিভ শহীদ খান এসেছেন। জরুরী দরকার। তার সাথে আলাপ করার চেয়ে তার স্ত্রীর সাথেই আলাপ করার দরকার আমার।’
দারোয়ান বালি বলল, “আসুন, হজুর।’
ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসাল বালি শহীদ খানকে। রবালি চলে যাবার পর ড্রয়িংরূমটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে। বাড়ির মালিকের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ আছে বোঝা যায় দামী দামী আসবাবপত্রের আধিক্য দেখে। কিন্তু টাকা থাকলেও রুচিবোধের নিতান্তই অভাব। দেয়ালে লটকানো রয়েছে এমন সব মেয়ের ছবিসহ ক্যালেণ্ডার যা কোন ভদ্রলোকের ড্রয়িংরূমে সম্পূর্ণ বেমানান। ছবির মেয়েগুলোর পরনে প্রায় কিছু নেই বললেই চলে। তাদের চোখ মুখে ফুটে উঠেছে অশ্লীল ইঙ্গিত।
থমথমে মুখে ড্রয়িংরূমে ঢুকল আজমল রব্বানী। শহীদের দিকে কটমট করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর সে বসল একটা সোফায় । বলল, আপনার পরিচয়?’
শহীদ মৃদু হেসে বলল, প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান। আর কোন পরিচয় দরকার আছে? দরকার থাকলে বলি।’
“কি চান আপনি?
শহীদ বলল, আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে চাই। মিজান চৌধুরী এবং তার ছেলে উজান চৌধুরীর নিখোঁজ হবার কেসটা আমি নিয়েছি। মিসেস ডলির সাথে সে ব্যাপারেই কথা বলব।’
‘ওদের নিখোঁজ হওয়ার সাথে আমার ওয়াইফের সম্পর্ক কি? ব্যাখ্যা দাবি করল.আজমল রব্বানী।
শহীদ বলল, “সম্পর্ক আছে। কিন্তু সব কথা আপনাকে বলা যাবে না।’ | ‘আমার ওয়াইফের কথা আমাকে বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে আমি তো আপনাকে তার সাথে দেখা করার অনুমতি দিতে পারি না! সে আমার ওয়াইফ, কার সাথে দেখা করবে আর কার সাথে দেখা করবে না তা আমার ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে।’ |
| না, আপনার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। আপনার স্ত্রীর আচরণ তা প্রমাণ করে না। আপনি কি জোর করে বলতে পারেন তিনি আপনার অনুমতি ছাড়া কোন লোকের সাথে দেখা করেন না?’
রাগে লাল হয়ে উঠেছে আজমল রব্বানীর গাল, ‘এসব কথার মানে কি জানতে চাই আমি!
শহীদ হেসে উঠল, “দেখুন, কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরিয়ে পড়বে। তারচেয়ে, তর্ক না করে আপনার স্ত্রীকে একবার পাঠিয়ে দিন। অবশ্য আপনি যদি তার সাথে আমাকে দেখা করতে না দেন তাহলে জোর করে কিছু লাভ হবে না। সেক্ষেত্রে কাজটা আপনাদের জন্যে ক্ষতিকরই হবে। বিশ্বাস করুন, আপনার স্ত্রীর উপকার করারই ইচ্ছা আমার। কিন্তু আপনি যদি গোয়ার্তুমি করেন তাহলে আমার কিছু করার নেই। একটা কথা বলে রাখি, আপনার স্ত্রী যদি আমার সব প্রশ্নের উত্তর
দেন তাহলে আজই তাকে গ্রেফতার করবে পুলিস। পুলিসকে এ ব্যাপারে একমাত্র আমিই পারি ঠেকাতে, যুক্তি দিয়ে। এবার দয়া করে তাকে ডেকে দিন। কিংবা তার কাছে আমাকে নিয়ে চলুন। হ্যাঁ, সেটাই ভাল। আমরা নিরিবিলিতে কথা
বলতে চাই।’ | আজমল রব্বানীর চোখমুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। কিন্তু শহীদের প্রতিটি কথা সে বিশ্বাস করেছে। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, আসুন আমার সাথে, মি. শহীদ খান।
অন্দর মহলে ঢুকল শহীদ আজমল রব্বানীর পিছু পিছু। ড্রয়িংরূম থেকে বেরিয়ে সরু একটা প্যাসেজ। প্যাসেজের দু’পাশে কয়েকটা রূম। একটি রূম থেকে বেরিয়ে এল একজন যুবক। আজমল রব্বানীর পিছনে শহীদকে দেখে যুবকটি থতমত খেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিল। পিছন থেকে শহীদ আজমল রব্বানীকে জিজ্ঞেস করল, আপনার
ভলিউম ১৫
ছেলে বুঝি?
হ্যাঁ। আকরম রব্বানী।’
আকরম নিঃশব্দে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল ওরা। আকরম নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শহীদের দিকে। | ডলির রূমটা প্যাসেজের শেষ মাথায়। আজমল রব্বানী দরজায় টোকা দিতে ভিতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। কিন্তু আধ মিনিট পরই খুলে গেল দরজা।
‘ শহীদ দেখল মিসেস ডলির বয়স অত্যন্ত অল্প। বড়জোর তেইশ কি চব্বিশ। আজমল রব্বানীর বয়সের অর্ধেকের চেয়েও দু’এক বছর কম হবে। মাত্র আট মাস। হলো বিয়ে করেছে আজমল রব্বানী ডলিকে। ডলি নয়, ওর নাম ছিল ঝুমা বাঈ।
ডলিকে বিয়ে করার ইতিহাসটাও বড় অদ্ভুত।
ডলি অবাক হয়ে তাকাল শহীদের দিকে। তারপর স্বামীর দিকে ফিরে বলল, “কি ব্যাপার বলো তো?’
আজমল রব্বানী পরিচয় দিল শহীদের। মুখ শুকিয়ে গেল ডলির চোখের নিমেষে। ঢোক গিলল সে। বলল, “কিন্তু মিজান চৌধুরী বা তার ছেলেকে আমি চিনিই না! ওদের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এ ব্যাপারে আমাকে জড়াবার কি কারণ থাকতে পারে?
শহীদ মৃদু হাসল। বলল, মিজান চৌধুরীকে আপনি না চিনলেও নওশের আবদুল্লাকে আপনি চেনেন। মিজান চৌধুরী ও তার ছেলের নিখোঁজ হওয়ার সাথে। নওশের আবদুন্নার সম্পর্ক আছে। সুতরাং আপনাকে প্রশ্ন করে নওশের আবদুল্লা সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করব।
আতঙ্কে নীল হয়ে গেল ডলির মুখের চেহারা ।
নওশের আবদুল্লা! তার সাথে তোমার কি সম্পর্ক, ডলি?’ অবিশ্বাস ভরা গলায় জানতে চাইল আজমল রব্বানী।
ডলি কি বলবে ভেবে পেল না, আমি তো কিছুই…মানে, কিছুই বুঝতে পারছি …।’
নওশের আবদুল্লাকে আপনি চেনেন?’ শহীদ এবার আজমল, রব্বানীকে প্রশ্ন করল ।
‘আমি? না, মানে না, চিনি না। তবে নাম শুনেছি যেন•••।’
শহীদ হেসে ফেলল, ঠিক আছে। আপনি এবার যান। আপনার স্ত্রীর সাথে একা কথা বলতে চাই আমি।
কি মনে করে বিনা বাক্যব্যয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল আজমল রব্বানী।
ডলি পথ করে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল, রূমের ভিতর ঢুকল শহীদ। প্রথমেই লক্ষ্য করল ও রূমের ভিতর একটা সিঙ্গেল খাট। তারমানে ডলি একা শোয় এখানে। ওর স্বামী আলাদা কামরায় থাকে। আসবাবপত্রের অভাব নেই রূমের কুয়াশা ৪৩
ভিতর। ডলি বসল খাটের উপর পা ঝুলিয়ে। একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, বসুন।’
বসল শহীদ। তাকাল ডলির দিকে। বলল, নাচের অভ্যাস কি একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন?’
মাথা নিচু করে উত্তর দিল ডলি, হ্যাঁ।’ | বাঈজী পাড়ার মেয়ে ডলি। নাচ তার রক্তের সাথে মিশে আছে। আজমল রব্বানী ওর নাচ দেখেই মজে ছিল। ডলির সৎ মা’কে নগদ দেড় লাখ টাকা দিয়ে বিয়ে করার অনুমতি নিতে হয়েছিল তাকে।
ডলি মুখ তুলে তাকাল। চাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল, আপনি জানলেন কিভাবে আমার সাথে নওশেরের পরিচয় আছে? নওশের বলেছে আপনাকে?
| শহীদ বলল, নওশের বলেনি। তাকে আমি খুঁজছি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। খুঁজে। যেভাবেই কথাটা জেনে থাকি, কথাটা কি সত্যি নয়? শুধু পরিচয় নয়, নওশেরকে আপনি ভালবাসতেন। আজমল সাহেবের সাথে আপনার বিয়ে হয়েছে ঠিক, কিন্তু আপনি নওশেরকে এখনও ভালবাসেন। নওশেরও আপনাকে ভালবাসে। সব কথাই আমি জেনেছি। প্রতি রবিবারে আপনি নওশেরের সাথে দেখা করতে যান তাও আমি জানি। অস্বীকার করবেন?
অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডলি। কথা সরল না তার মুখে। নওশের কোথায়, মিসেস ডলি?’ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল শহীদ।
বোকার মত তাকিয়ে আছে ডলি। শহীদ আবার বলল, নওশেরের বন্ধুরা খুব চিন্তিত, তা জানেন? কেন বলুন তো? গতকাল থেকে তার কোন খোঁজ নেই। ঢাকা শহরে কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। আপনি জানেন কোথায় সে আছে। কোথায় আছে সে?’
‘আমি জানি না, বিশ্বাস করুন•••!
শহীদ কঠোর স্বরে বলল, “মিথ্যে কথা বলবেন না, মিসেস ডলি। বিশ্বাস করুন, আমি জানি না••• | কবে শেষ দেখা হয়েছিল ওর সাথে আপনার?
‘পরশুদিন সকালে। গতকালুও তাকে আমি দেখেছি। তবে কথা হয়নি। এ বাড়িতে এসেছিল সে।’
‘পরশুদিন সকালে কোথায় দেখা হয়েছিল আপনাদের?
তার বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি। কেন? তার সাথে কি আলাপ হয়েছিল আপনার? মাথা নিচু করে ফেলল ডলি।
শহীদ ছাড়ল না। হঠাৎ প্রশ্ন করল ও, একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিন, মিসেস ডলি। আপনি কি নওশেরকে এখনও ভালবাসেন?’
ডলি উত্তর দিল না। কি যেন বলতে গিয়েও বলল না সে।
ভলিউম ১৫
আপনি কি তার মঙ্গল চান? ঝট করে মাথা তুলল ডলি।
শহীদ বলল, আমার ধারণা নওশের ভয়ঙ্কর কোন বিপদে পড়েছে। তাকে যদি আপনি বিপদ থেকে উদ্ধার করতে চান তাহলে সব কথা খুলে বলুন। আমার কাছে কোন কথা গোপন রাখবেন না। যদি রাখেন তাহলে নওশেরের এমন ক্ষতি হবে যা। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।’
| ডলি চুপ করে রইল। শহীদ আবার বলল, আমি জানি নওশের কুখ্যাত একজন। অপরাধী। বহু ধনী লোকের ব্যক্তিগত দুর্বলতার সুযোগ নেয় সে। বহু লোককে সে ব্ল্যাকমেল করে। নওশের ব্ল্যাকমেল করে এমন ক’জন লোককে আপনি চেনেন, মিসেস ডলি?”
ডলি এবারও মুখ খুলল না। শহীদ বলল, আপনি কি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন না?
উত্তর না দিয়ে ডলি জানতে চাইল, আপনি কি মনে করেন নওশের, খুন হয়েছে?’
‘ঠিক জানি না। তবে খুন হলেও আশ্চর্য হব না। তাকে খুন করার লোকের অভাব হবার কথা নয়।’
ডলি হঠাৎ বলে ফেলল, আমার ধারণা তাকে দু’জন লোক খুন করতে পারে। কিন্তু একজন নিজেই খুন হয়েছে। আর একজন•••।’
‘একজন খুন হয়েছে মানে? আপনি কি কুচবিহারীর কথা বলছেন?’
ডলি ইতস্তত করতে লাগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বীকার করল, হ্যাঁ। নওশের কুচবিহারীকেও ব্ল্যাকমেল করত। কারণ কুচবিহারীর দুর্বলতা ছিল আমার ওপর। প্রায়ই সে গোপনে আমার কাছে আসত। খবরটা নওশের জেনে ফেলে।
জেনে ফেলে, না, আপনিই তাকে জানিয়ে দেন? চুপ করে রইল ডলি।
কুচবিহারীর কাছ থেকে কত টাকা করে নিত নওশের?
হপ্তায় একহাজার টাকা। আপনি কি মনে করেন কুচবিহারীকে নওশের খুন করেছে?
জানি না। নওশেরের সাথে গতপরশু সকালে কি কথা হয়েছিল আপনার বলুন আগে।’
| ডলি কি যেন ভাবছে। খানিক পর সে বলল, “সব কথাই যখন আপনি জেনেছেন, তখন আর বাকি দু’একটা কথা চেপে রেখে কোন লাভ নেই। যা সর্বনাশ হবার তা তো আমার হয়েছে। একূল ওকূল কোন কূলই আর রক্ষা করতে পারব
আমি। প্রথম থেকেই বলি আপনাকে। বলুন।’ শহীদ সিগারেট ধরাল।
কুয়াশী ৪৩
• ডলি বলতে শুরু করল, আজমল আমার স্বামী হলেও তাকে আমি একদিনের জন্যেও মনে প্রাণে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমার নাচ দেখতে গিয়ে ও মুগ্ধ হয়। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল আমাকে, কিন্তু তার প্রস্তাব ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দিই আমি। কিন্তু আমার মতামতের তোয়াক্কা না করে আমার শত্রু সৎ-মায়ের সাথে ষড়যন্ত্র করে জোর করে বিয়ে করে ও আমাকে।
‘আচ্ছা!’ | ডলি বল চলে, নওশেরকে আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। একই বাঈজী পাড়ায় বাড়ি আমাদের। ওর মা মালেকা বাঈ আমাকে খুব ভালবাসত। ওদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল আমার নওশের আমাকে খুব ভালবাসত, আমিও নওশেরকে ভালবাসতাম; কিন্তু আমার জীবনের চরম বিপদের সময় নওশের ঢাকায় ছিল না। আমার সৎ-মা ষড়যন্ত্র করে নওশেরকে টাকার লোভ দেখিয়ে একটা কাজ দিয়ে ঢাকার বাইরে সরিয়ে দেয়। নওশের এ সম্পর্কে কিছুই জানত না। এক হপ্তা পর যখন সে ঢাকায় ফিরল তখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি তখন আজমল সাহেবের স্ত্রী।
তারপর?’
নওশের চেয়েছিল আজমল সাহেবকে খুন করতে। কিন্তু আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে ক্ষান্ত করি। তার প্রতি আমার দুর্বলতা তখনও ছিল, এখনও আছে। হ্যাঁ, প্রতি রবিবারে আমি তার কাছে যাই।’
‘গত পরও দিন সকালে | বলছি। গত পরশু দিন সকালে আমি নওশেরের সাথে দেখা করি সম্পূর্ণ অন্য এক কারণে। তার আগের দিন রাতে আমি এক ষড়যন্ত্রের কথা শুনে ফেলি।’
‘ষড়যন্ত্র? কার বিরুদ্ধে কার ষড়যন্ত্র?
কুচবিহারীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে আমার স্বামী এবং তার বন্ধু শরীফ চাকলাদার। নিজের কানে ওদের ষড়যন্ত্রের কথা শুনে পরদিন সকালে আমি নওশেরকে কথাটা বলি। নওশের খুব খুশি হয়। ওকে খুশি করার জন্যে সব সময় চেষ্টা করি আমি। নওশের আমাকে জানায় যে কুচবিহারীও তাকে প্রস্তাব দিয়েছে
• আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদারকে খুন করার জন্যে। ভাল পয়সা কামানো যাবে দুই দলকে খেলিয়ে।’
‘ওরা পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্র করেছিল কেন?’
ব্যবসা নিয়ে গোলমাল। কুচবিহারী নাকি এদের দুজনকে ঠকাচ্ছিল। তারপর?’
নওশের আমাকে বলে যে সে ওদের কাউকেই খুন করবে না। তবে খুন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দু’দলের কাছ থেকেই মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করবে। গতকাল এসেছিল সে এ-বাড়িতে। আমার সাথে দেখা করেনি। দেখা করেছিল আমার স্বামী
ভলিউম ১৫
১০
এবং শরীফ চাকলাদারের সাথে। ওরাও নওশেরকে প্রস্তাব দেয় কুচবিহারীকে খুন করার জন্যে।
“কি ভয়ঙ্কর। তারপর কি হলো? আচ্ছা, খানিক আগে আপনি বলেছেন, দুজন লোক নওশেরকে খুন করতে পারে। একজন কুচবিহারী, সে নিজেই তো খুন হয়েছে। আর একজন কে? তার পরিচয় তো দিলেন না?
ডলি খোলা জানালাটার দিকে তাকাল। তারপর শহীদের দিকে চোখ ফেলে নিচু গলায় বলল, তাকেও নওশের ব্ল্যাকমেল করে। গতকাল নওশেরকে সে অনুসরণ করেছিল। নওশেরকে সাবধান করে দেয়ার কোনও সুযোগ আমার ছিল
। আমার ধারণা সে-ই নওশেরের কোন ক্ষতি করেছে। তা না হলে নওশের গেল কোথায়? নওশেরকে যদি খুন•••।’
নাম কি তার? কে সে?’ তার নাম•••।’
অকস্মাৎ শহীদের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। বিদ্যুদ্বেগে লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডলির একটা হাত ধরে সবেগে টান মারল।
পরমুহূর্তে কান ফাটানো শব্দ হলো গুলির।
শহীদের আকর্ষণে ডলি পড়ে গেছে মেঝেতে। শহীদ তার দিকে ফিরে না তাকিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল রূম থেকে। প্যাসেজ ধরে ঝড়ের বেগে ছুটল ও। দু’বার মোড় ঘুরে উলির রূমের পিছনের জানালার নিচে, বাগানে এসে দাঁড়াল ও। কেউ নেই বাগানে।
অথচ বাগানে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে গুলি করেছে আততায়ী। বাড়ির ভিতর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে আজমল রব্বানীর। ছুটে আসছে সে। খানিক পরই আজমল রব্বানী বাগানে এসে হাজির হলো। শহীদকে দেখে প্রশ্ন করল, “কি ব্যাপার, মি. শহীদ! কাকে গুলি করলেন?
আকরম তার বাবার পিছন পিছন বাগানে এল।
শহীদ বলল, ‘গুলি আমি করিনি। জানালা দিয়ে কেউ আপনার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে গুলি করেছে।’
‘মিথ্যে কথা!’ চিৎকার করে উঠল আজমল রব্বানী।
পাশ থেকে তার ছেলে আকরম গম্ভীর গলায় বলে উঠল, ‘না বাবা, মি. শহীদ সত্যি কথাই বলছেন। আমি আর ওপরের রূমের জানালা দিয়ে দেখলাম বাগান থেকে একজন লোক ছুটতে ছুটতে পঁচিলের দিকে চলে যাচ্ছে। পাঁচিল টপকে রাস্তায় নামতে দেখেছি তাকে আমি। ঠিক ওখানটায়•••।’
| কথা না বলে আকরমের দেখানো পাচিলের অংশটা পরীক্ষা করার জন্যে পা বাড়াল শহীদ।
পঁচিল পরীক্ষা করতে করতে অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে উঠল শহীদের মুখের
কুয়াশা ৪৩
১১
চেহারা। কিন্তু আকরমকে সে কোনও প্রশ্ন করল না। পাঁচিলের অপর দিকে রাস্তা। পাঁচিলের উপর উঠে শহীদ দেখল একজন বুড়ো ফকির আল্লাহু আল্লাহ করছে। দুলে দুলে। * পাচিল থেকে নেমে গেট পেরিয়ে বাড়ির বাইরে এসে বুড়ো ফকিরটার সামনে, দাঁড়াল শহীদ। ওর ঠোঁটে মুচকি একটু হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। বুড়োকে প্রশ্ন করল ও, এই যে, ফকির বাবা, এখান দিয়ে কাউকে ছুটে পালাতে দেখেছ নাকি?’
বুড়ো ঠোঁট টিপে হাসল। বলল, আমি অন্ধ ফকির, আমি কি দেখতে পাই? কাউকে দেখিনি, বাবা।’
শব্দও শোনোনি? কালা তো আর নও।’ না, তা-ও শুনিনি।’
শহীদ দেখল রাস্তার অপর পারের একটি বাড়ির সামনে পাঁচিলে চুনকামের কাজ করছে একজন শ্রমিক। বাড়িটায় লোকজন নেই। আবার মুচকি হাসল ও। কিন্তু আর কাউকে কোন প্রশ্ন না করে বাড়ির ভিতর ঢুকল আবার।
আপনার কি পিস্তল আছে, আজমল সাহেব?’ ড্রয়িংরূমে পা দিয়েই জানতে চাইল শহীদ।
‘আছে। কেন?’ ‘আমাকে একবার দেখাতে পারেন পিস্তলটা?’ নিশ্চয়ই দেখাতে পারি।’ উঠে দাঁড়াল আজমল রব্বানী।
খানিক পরই ফিরে এল সে শুকনো মুখে। বলল, “মি. শহীদ, আমার পিস্তলটা আয়রন সেফে নেই! কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে ওটা।’
খানিক পর আবার ডলির কামরায় ঢুকল শহীদ। আবার ও প্রশ্ন করল, নওশেরকে কে অনুসরণ করেছিল বলুন তো?’
বলব না।’ সরাসরি জানিয়ে দিল ডলি। অবাক হলো শহীদ, বলবেন না? কেন? আপনি নিজেই তো•••।’
ভেবেছিলাম বলব । কিন্তু এখন ঠিক করেছি বলব না। প্রাণের ওপর আমার খুব মায়া, শহীদ সাহেব। আমি মরতে চাই না এত তাড়াতাড়ি।
শহীদ বলল, তারমানে আপনি ভয় পেয়েছেন। একটু আগে যে লোকটা গুলি করেছে তাকে আপনি চিনতে পেরেছেন। এই লোকটাই নওশেরকে অনুসরণ, করেছিল, তাই না?’ | ডলি কাঁপা গলায় বলে উঠল, কোন প্রশ্ন করবেন না আমাকে, শহীদ সাহেব। আর কোন প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।’
বাড়ি ফিরে শহীদ দেখল ড্রয়িংরূমে মি. সিম্পসন এবং কামাল বসে আছে। লীনা
ভলিউম ১৫ ১২
ওদের দুজনের সামনে চা নাস্তার ট্রে নামিয়ে রাখছে। মহুয়াকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কামাল মুচকি মুচকি হাসছে কেন জানি। শহীদকে দেখে মুছে গেল তার মুখের হাসি, কোথায় গিয়েছিলি রে?
* মৃদু হেসে শহীদ বসল কামাল এবং মি. সিম্পসনের মুখোমুখি, তোর মহুয়াদি বলেনি ডা. মিজান চৌধুরীর স্ত্রী আজ সকালে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন?’
কই, না তো!’ মহুয়াদি বসতে বলে ছুটে চলে গেল নতুন কেনা শাড়ি এনে দেখাবে বলে।
‘এখনও আসছে না, প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল। তা কেন এসেছিলেন রে ভদ্রমহিলা?
শহীদ বলল, কেন আবার, তার নিখোঁজ স্বামী এবং ছেলেকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপাতে। মিসেস মিজান আবার তোর মহুয়াদির এক বান্ধবীর খালা। সেই সম্পর্কের ত্র ধরে আমার কাছে এসেছেন। ফিরিয়ে দিতে পারলাম
।’
কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াল শহীদ, বস তোরা। কাপড় ছেড়ে আসি।’
শহীদ অন্দরমহলে চলে যাবার খানিক পরই মহুয়া ঢুকল। খানিক আগে মহুয়াকে যে শাড়ি পরে থাকতে দেখেছিল কামাল, মহুয়া সেই শাড়ি পরেই এসেছে, তার হাতেও কিছু নেই। কামাল অবাক হয়ে বলে উঠল, কি হলো মহুয়াদি, শাড়ি কই তোমার? অমন চঞ্চল হয়ে ছুটে গেলে…!’
মহুয়া মুচকি মুচকি হাসছে। বলল, দেখোনি নতুন শাড়ি? ওমা, এ কি কথা? আমি না হয় কিছু মনে নাই করলাম, কিন্তু যে শাড়িটা দেখিয়ে গেল সে কি ভাববে বলো তো!’
কামাল মহুয়ার কথা এতটুকু বুঝতে পারল না। লীনা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে মহুয়ার কথা শুনে। মাথা নিচু করে কোনরকমে পালিয়ে বাচল সে ওদের সামনে। থেকে। | কামাল বলল, হেঁয়ালি রাখো, মহুয়াদি। তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি
।’ | মি. সিম্পসন উপভোগ করছিলেন ব্যাপারটা। বললেন, আমি কিন্তু নতুন
শাড়িটা দেখেছি।
মহুয়া হতাশভাবে বলল, না, তোমার চোখ থাকতেও তুমি অন্ধ, ভাই। জলজ্যান্ত একটা নুষ, সে আবার তোমার ইয়ে, নতুন শাড়ি পরে এল, এসে আবার চলেও গেল অথচ তুমি লক্ষ্য করলে না? ছি ছি ছি! কি ভাববে বলো তো মেয়েটা? যাই, কান্না থামাবার চেষ্টা করি। বেচারী নিশ্চয়ই বিছানায় পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মনের দুঃখে•••!
কুয়াশা ৪৩
কামাল এতক্ষণে বুঝতে পারল। লজ্জা পেল ও। সত্যি, বড় ভুল হয়ে গেছে। লীনা যে একটা নতুন শাড়ি পরে এসেছিল তা সে লক্ষ্য করলেও মনোযোগ দেয়নি। ওর মনোযোগ ছিল লীনার মুখের দিকে। আজ বড় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে লীনাকে।
‘মহুয়াদি! দাঁড়াও, শোনো আমার কথা, যেয়ো না।
কামালের কথা শেষ হবার আগেই ড্রয়িংরূমে ঢুকল শহীদ। বলল, কি রে, অমন চেঁচাচ্ছিস কেন?
মহুয়া কামালের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ঘাড় ফিরিয়ে নিল। চলে গেল সে। শহীদের উদ্দেশে কামাল নিচু গলায় বলল, না, কিচ্ছু না।’
মি. সিম্পসন বললেন, ইতিমধ্যে কিছু জানতে পেরেছ, শহীদ?’
শহীদ বলল, “অনেক কথা জানা গেছে। কিন্তু মিজান চৌধুরী বা তার ছেলের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।
| ‘কি জানতে পেরেছিস তাহলে?’ জানতে চাইল কামাল।
শহীদ বলল, মিসেস চৌধুরী আমাকে এসে বললেন হজ সকাল থেকে সাত আটজন লোক আলাদা আলাদা ভাবে তার স্বামীর খোঁজে বাড়িতে আসে। লোকগুলো নাকি সাধারণ ভদ্রলোক নয়। চেহারাগুলো যেন কেমন। কথাটা শুনে ওদের বাড়িতে গেলাম। ঘন্টাখানেক বসে থাকার পর আবার একজন মিজান। চৌধুরীর খোঁজে এল। দেখা করলাম তার সাথে। দেখেই চিনলাম। কুখ্যাত গুণ্ডা। আমাকে দেখেই পালাচ্ছিল–চেনে কিনা। ভয় করে যমের মত। ব্যাটাকে পাকড়াও, করলাম। ভয় দেখাতেই গড় গড় করে বলে দিল বহু কথা। মিজান চৌধুরী বেশ কিছুদিন ধরে মেলামেশা করছে চোর-ডাকাত-গুণ্ডা-অপরাধীদের সাথে। ওদেরও তো চিকিৎসার দরকার হয়। রোজই তো দু’চারজন গুলি খাচ্ছে। মিজান চৌধুরী ওদের চিকিৎসা করেন মোটা টাকার বিনিময়ে। যাকগে, কথায় কথায় জানলাম নওশের আবদুল্লা নামে কুখ্যাত একজন ব্ল্যাকমেলার গতকাল থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। খুঁটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করতে বেরিয়ে গেল নওশের আবদুন্নার সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে আজমল রব্বানীর যুবতী স্ত্রী ডলির। গেলাম ডলির কাছে। অনেক কথা
জানা গেল। কিন্তু আসল কথাটা জানার আগেই কে যেন গুলি করল ডলিকে লক্ষ্য করে। গুলিটা ওর গায়ে লাগেনি, কিন্তু ভয়ে জবান বন্ধ হয়ে গেল ডলির। প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না আর।
বলিস কি! চিনতে পেরেছিস?” | ‘ঠিক চিনতে পারিনি। তবে অনুমান করতে পেরেছি সে কে হতে পারে। যাকগে, সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানিস?’।
কি?
কুয়াশার একজন অনুচরকে দেখলাম। মান্নান। ছদ্মবেশ নিয়ে আজমল রব্বানীর বাড়ির সামনে ভিক্ষা করছে। রাসেলকেও দেখলাম। রাসেলও সম্বত নজর রাখছে।
ভলিউম ১৫
১৪
লোকটার উপর।
মি সিম্পসন বললেন, “কেমন জটিল হয়ে উঠছে সবটা ব্যাপার, কামাল। আজমল রব্বানীর বাড়ির ওপর নজর রাখছে কুয়াশা। কারণ কি?
কামাল বলে উঠল, কারণ নিশ্চয়ই একটা আছে।’ শহীদ বলল, তোরা কতদূর এগিয়েছিস, কামাল। কুচবিহারীর খুনী কে?’
স্নান গলায় কামাল বলল, সকালে মি. সিম্পসনের সাথে গল্প করতে গিয়ে জড়িয়ে গেছি আমি। হাবুডুবু খাচ্ছি এখন, শহীদ। এসেছি তোর বুদ্ধি নিতে। একটা উপায় বাতলে দে। কেসটা বড়ই জটিল মনে হচ্ছে।
শহীদ মুচকি হাসল। বলল, কেসটা আমার কাছেও কম জটিল মনে হচ্ছে না। এখনও সময় হয়নি কিছু বলার। সময় হলে বলব। ততক্ষণ আমাদের আলাদা ভাবে কাজ করাই ভাল মনে করছি। ভাল কথা, কুচবিহারীর পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট কি হলো, কামাল?’
‘গুলি করে খুন করা হয়েছে তাকে। তারপর ছোরা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে তার মুখের চেহারা। এটা একটা রহস্য, তাই না?’.
চিন্তিত দেখাল কামালকে।
শহীদ বলল, কোন রহস্যই স্থায়ী রহস্য হয়ে থাকতে পারে না। যথাসময়ে সব রহস্যের মীমাংসা হবে। ধৈর্য ধরে কাজ করে যা।’
. পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাগজে মোেড় একটা বুলেটের খোল বের করল শহীদ। সেটা মি. সিম্পসনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল আবার, এটা আজমল রব্বানীর বাড়িতে ডলিকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল। পরীক্ষা করে দেখবেন। সম্বত •৩২ এটা। কুচবিহারীকে যে পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছে এটাও সেই পিস্তল থেকে ছোঁড়া হয়ে থাকতে পারে। অবশ্য কথার কথা বলছি, কোন তথ্য পাইনি এখনও। একই পিস্তল থেকে যদি গুলি দুটো ছোঁড়া হয়ে থাকে তাহলে অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে কেসটা।’
কামালের দিকে ফিরল শহীদ, ভাল কথা, একটা ব্যাপার তোকে বলা হয়নি, কামাল। আজমল রব্বানীর পিস্তলটা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা নাকি চুরি গেছে। অন্তত সেকথাই জানানো হয়েছে আমাকে।
দুই জমে উঠেছে আজমল রব্বানীর জলসাঘরে বাঈজীদের নাচ। নূপুরের ঝুমঝুম শব্দ, তবলার আওয়াজ আর, সোমরস ভরা পানপাত্রের টুংটাং ধ্বনি, তার সাথে ফিরোজা। বাঈয়ের মিষ্টি সুরেলা হাসি-সব মিলিয়ে বড় ভাল লাগছে পরিবেশটা আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদারের।
| ‘বেশি খাবেন না আজ! মনে আছে তো, একজন মেহমান আসছেন কুয়াশী ৪৩
খানিকক্ষণের মধ্যে? | ঢুলুঢুলু চোখে কথাটা বলল আজমল রব্বানী। ঢক ঢক করে আধগ্লাস বিলিতি মদ গিলল সে। শরীফ চাকলাদার পকেট থেকে একশো টাকার একটি নোট বের করে ছুঁড়ে দিল ফিরোজা বাঈয়ের দিকে। তারপর তাকাল পাশে বসা যুবতীটির দিকে। বলল, ঢালো, আরও ঢালো!’
শরীফ চাকলাদারের ভাবভঙ্গি দেখে যাই মনে হোক, মদ সে তুলনামূলকভাবে কমই খাচ্ছে। সম্মানীয় মেহমানের কথা সে ভোলেনি। সোমনাথন আগাট থাপার সাথে আজ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবার কথা। বার্মার কোটিপতি আগাট থাপা। সহজ ব্যাপার নয়।
যুবতীটি সোমরস ভরা গ্লাসটা বাড়িয়ে দিতে শরীফ চাকলাদার সেটা ধরল। কিন্তু গ্লাসে চুমুক না দিয়ে আজমল রব্বানীর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বলল, একটা কথা বেমালুম ভুলে গেছেন দেখছি।
আজমল রব্বানীর হাসি নিভে গেল, তারমানে? কিসের কথা বলছেন আপনি?
শরীফ চাকলাদারকে গভীর দেখাল। নিচু গলায় সে শুধু একটি নাম উচ্চারণ করল, নওশের।’
নওশের আবদুল্লা? দূর-দূর, মরা মানুষের কথা মনে রেখে কি লাভ!’
কথাগুলো বলে হাসল আজমল রব্বানী। ফিরোজা বাঈয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল।
শরীফ চাকলাদার কিন্তু প্রসঙ্গটা চাপা পড়তে দিল না। বলল, নওশের মরে গেছে কে বলল আপনাকে? আপনি তার লাশ দেখেছেন? তাছাড়া তাকে খুন করলই বা কে বলুন তো?’ | ‘দূর, আপনি বড় বেরসিক। একটা খুনীর কথা আলাপ করার আর সময় পেলেন
? আরে, নওশের আবদুন্নাকে খুন করার লোকের অভাব হয় নাকি? ওদেরকে খুন করার হাজার হাজার লোক আছে। খুন-খারাবী করে বেড়ায় যারা তারা নিজেরাও খুন হয়। আর লাশ দেখার কথা বলছেন? লাশ দেখার কি দরকার? এমনিতেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাটা খতম হয়ে গেছে। বেঁচে থাকলে ভেবেছেন রেহাই দিত আমাদেরকে? পাওনা আড়াই লাখ টাকা টাকরায় আঙুল দিয়ে আদায় করে নিয়ে যেত । একহপ্তা কেটে গেল অথচ••• |
এমন সময় পাশের কামরা থেকে ভেসে এল ফোনের শব্দ। আজমল রব্বানী, এবং শরীফ চাকলাদার পরস্পরের দিকে তাকাল অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে।
উঠে দাঁড়াল আজমল রব্বানী। বেরিয়ে গেল সে জলসাঘর থেকে। শরীফ চাকলাদার তার পানপাত্র তুলল ঠোঁটের কাছে।
পাঁচ মিনিট পরই আজমল রব্বানী জলসাঘরে ফিরে এল বিশাল দেহী এক বার্মীজ ব্যবসায়ীকে সঙ্গে নিয়ে। শরীফ চাকলাদার তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসেছিল,
১৬
ভলিউম ১৫
ব্যস্ত-সমস্ত ভাবে উঠে দাঁড়াল সেঁ, বলল, “আসুন, আসুন মি. থাপ।’
লম্বা চওড়া বার্মীজ ব্যবসায়ী আগাট থাপা সহাস্যে জলসাঘরে পা দিয়েই হাত বাড়িয়ে দিল। শরীফ চাকলাদার করমর্দন করল। আগাট থাপার হাতে কালো একটা অ্যাটাচী কেস। সেটা বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নিয়ে ভারি গলায় বলল, ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তা বলার সময় নাচ-গান-ফুর্তি আমি পছন্দ করি না।’
আজমল রব্বানী সাথে সাথে বলে উঠল, আলব! আলব! চলুন, মি. থাপা, আমরা পাশের কামরায় গিয়ে বসি।
পাশের কামরায় এসে বসল ওরা তিনজন। আগাট থাপা পকেট থেকে দামী সিগার বের করে অফার করল। তিনজন তিনটে চুরুট ধরাল। সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। কামরার ভিতর। আগাট থাপা ঊরুর উপর কালো অ্যাটাচী কেসটা রেখে সহাস্যে বলল, কুচবিহারীজীর সাথে বিশদ আলোচনা হয়েছিল আমার। কিন্তু আপনারা বলছেন তিনি নাকি আমার সম্পর্কে কোন কথা আপনাদেরকে বলেননি। এ কেমন কথা? আপনারাও এ ব্যবসায় অংশীদার। আপনাদেরকে না জানাবার কারণ কি? ভদ্রলোক মারা গেছেন, মরা মানুষকে অভিযুক্ত করা উচিত নয়।’
শরীফ চাকলাদার বলে উঠল, যে মরে গেছে তার কথা না তোলাই ভাল।’
সায় দিয়ে মাথা নাড়ল আগাট থাপা। বলল, ঠিক। নতুন করে আলোচনা করব আমরা। ফোনে আমরা যে আলোচনা করেছি তাতে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে। আপনারা যে জেনুইন পার্টি তা আমি জেনেছি। আমিও যে জেনুইন। পাটি কুচবিহারীজী জানলেও আপনারা জানেন না। আপনাদেরকে আমি কিছু। উপহার দিতে চাই। উপহারগুলো দেখে আপনারা বুঝতে পারবেন’ আমি কি।
কথাগুলো বলে আগাট থাপা তার অ্যাটাচী কে খুলে ভিতর থেকে সোনার দুটো ভারি চাকা বের করল। সেদুটো টেবিলের ওপর রেখে আবার অ্যাটাচী কেসের ভিতর হাত ভরল সে।
একে একে অ্যাটাচী কেস থেকে বের হলো গোটা কয়েক যন্ত্রপাতি, সেলোফিন পেপারে মোড়া আফিম, কোকেন, দু’টুকরো ডায়মণ্ড, অন্যান্য দামী পাথর এক টুকরো করে, সোনার নিব কয়েকটা, এক কৌটা কৃত্রিম রেডিয়াম, শিশিতে ভরা কয়েক প্রকার প্রাপ্য রাসায়নিক দ্রব্য, এক কৌটা খাঁটি জাফরান, দামী আতর, বিদেশে প্রস্তুত সেন্ট, আমদানি করা পশমের দু’গজের একটা টুকরো, উলের একটা বল প্রভৃতি আরও বহুরকম জিনিস। বেরোচ্ছে তো বেরোচ্ছেই।
আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদার গভীর মনোযোগর সাথে প্রতিটি জিনিস পরীক্ষা করতে করতে পরস্পরের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে থেকে থেকে।
| আগাট থাপা বলল, এগুলো আপনাদেরকে আমি দিলাম উপহার হিসেবে। এই সামান্য পরিমাণ উপহার দেয়া আমার স্বভাব নয়। কিন্তু সঙ্গে করে বেশি কিছু আমি ২-কুয়াশা ৪৩
আনিনি। যা এনেছিলাম তা-ও কুচবিহারীজীকে দিয়েছিলাম। এগুলো পড়ে ছিল অ্যাটাচী কেসে। ভাল করে সব পরীক্ষা করে নিন। এগুলোই আমার নমুনা। আপনাদের সাথে যদি ব্যবস্যা হয় তাহলে প্রচুর পরিমাণে এইসব জিনিসই পাঠাব আমি।’
লোভে চকচক করছে আজমল রব্বানীর চোখ দুটো। আনন্দে আটখানা সে, কথা বলতেই পারছে না। শরীফ চাকলাদার সহাস্যে বলে উঠল, আপনি যে জেনুইন পাটি তাতে আর আমাদের মনে কেন সন্দেহ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা আপনার জিনিসপত্রের নমুনা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছি। এদেশে এসবের প্রচণ্ড চাহিদা আছে । মাল পৌঁছুতে যা দেরি, সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যাবে।’ | ‘খুব ভাল কথা। এবার আপনারা বলুন, এইসব জিনিসের বদলে আপনারা কি কি পাঠাতে পারবেন।’
‘আপনি কি ধরনের জিনিস চান?
‘চাল চাই। চাল, ডাল, পাট, সরিষার তৈল, ডিম, বিদেশী বেবী ফুড, নিউজপ্রিন্ট, চা…।’
পাবেন,’ বলে উঠল আজমল রব্বানী।
আগার্ট থাপা বলল, আর একটা কথা। যে-কোন জিনিস যে-কোন পরিমাণ চান, পাবেন। কিন্তু লোকজনের বড় অভাব আমার। লোকজনের ব্যবস্থা করতে হবে আপনাদেরকে। আপনাদেরই লোক আমার কাছ থেকে মাল নিয়ে আসবে। আবার আপনাদের লোকই এখান থেকে আপনাদের মাল নিয়ে বর্ডারের ওপারে দিয়ে আসবে। বর্ডারের ওপারে অবশ্য আমার লোক থাকবে। হিন্দুস্থান বা বার্মা
যে-কোন দেশে মাল পাঠাতে পারেন। দু’দেশেই ব্যবসা আছে আমার।’
‘আপনার লোকজনের কি এতই অভাব?’.
খুবই অভাব। বিশ্বস্ত লোক পাওয়া বড় কঠিন। আপনারা লোকের ব্যবস্থা করবেন ঠিক, কিন্তু যাবতীয় খরচ বহন করব আমিই।’
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাতে কোনও অসুবিধে হবে না।’
প্রকাণ্ড মুখটা হাসিতে ভরে তুলে আগাট থাপা বলল, আলাপের তাহলে আর বাকি রইল কি? ও, হ্যাঁ, আপনারা মাল আনা-নেয়ার ব্যাপারে কি রকম সতর্কতা অবলম্বন করেন? ভারী মালগুলো তো বর্ডার ক্রস করে আসবে ট্রাকে, নিয়মিত ব্যবস্থার অধীনে। মাসিক টাকা দিতে হয় বিভিন্ন বাহিনীর বিভিন্ন অফিসারকে। কিন্তু হালকা এবং অল্প পরিমাণের জিনিসগুলো, যেমন সোনা, রেডিয়াম…!
শরীফ চাকলাদার হাসতে লাগল ।
আজমল রব্বানী বলল, সে ব্যাপারে আপনি কিছু ভাববেন না, মি, থাপা। হালকা মাল আনা-নেয়ার ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞ ।
‘তাই নাকি?
১৮
ভলিউম ১৫
আজমল রব্বানী বলল, আজই তো ৬ মে রাত বারোটার ফ্লাইটে মন আসছে আমাদের। মাল নিয়ে আসছে সাতজন লোক। তাদের সাথে ব্যাগ অ্যাণ্ড ব্যাগেজ থাকবে । কিন্তু আপনি মাল খুঁজে পাবেন না। মাল আনার ব্যাপারে আমরা, অভিনব একটা উপায় বের করেছি। লোকগুলোকে সার্চ করে দেখতে পারেন । পাবেন না মালের হদিস। অথচ তাদের সাথেই আসছে চোদ্দ পাউণ্ড সোনা।’
আগাট থাপাকে সন্তুষ্ট দেখাল। বলল, ব্যস, ব্যস। আর বলতে হবে না। তাহলে সব ব্যাপারেই আলোচনা হয়ে গেল। খুটিনাটি কয়েকটা ব্যাপার আলোচনা পরে করলেও চলবে । আজকের মত তাহলে আমাকে বিদায় দিন?’
| ‘সে কি! এখুনি উঠবেন? আপনাকে আমরা খাতির করারই সুযোগ পেলাম না••• |
বাধা দিয়ে আগাট থাপা বলল, “খাতির করার ব্যবস্থা আর একদিন করবেন, শরীফ সাহেব। এখন তো আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। যখন খুশি ডাকবেন।
ভালকথা, কোথায় উঠেছেন আপনি?’
আগাট থাপা হাসল। বলল, ‘উঠেছিলাম তো কন্টিনেন্টালে। তবে প্রতিদিনই হোটেল বদলাচ্ছি। কারও নজরে পড়তে চাই না, বোঝেনই তো। এক হোটেলে আমি একদিনের বেশি থাকি না। আজ আছি ইন্টারন্যাশনালে। আগামীকাল সকালে কোন হোটেলে উঠব এখনও ঠিক করিনি।’
– তাহলে আপনার সাথে যোগাযোগ করার উপায়?’ জানতে চাইল শরীফ চাকলাদার। উঠে দাঁড়িয়েছে সে।
আগাট থাপা বলল, আমিই সময় মত যোগাযোগ করব, শরীফ সাহের। চিন্তা করবেন না।’
উঠে দাঁড়াল আগাট থাপা। আজমল রব্বানী পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল তাকে।
;
একই দিনের ঘটনা।
ঘড়িতে কাটায় কাঁটায় রাত বারোটা বাজে। ঢাকার আকাশে ভারি মেঘের ঘনঘটা। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যে-কোন মুহূর্তে নামতে পারে বৃষ্টি। থমথম করছে চারদিক। | ঢাকা এয়ারপোর্ট। লাউঞ্জে লোকজন নেই বললেই চলে। আজ রাতের শেয় বিমানটা এইমাত্র ল্যাণ্ড করেছে রানওয়েতে। আট-দশজন লোক লাউঞ্জে অপেক্ষা করছে যাত্রীদের মধ্যে নিজেদের লোককে রিসিভ করার জন্যে। তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে রেইনকোট পরা শরীফ চাকলাদারকেও। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে সে।
ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান এইমাত্র ল্যাণ্ড করেছে। যাত্রীরা নামছে সিঁড়ি বেয়ে। দেশী-বিদেশী বহু যাত্রী । কাস্টমস অফিসাররা, ব্যাগ অ্যাণ্ড ব্যাগ
কুয়াশী ৪৩
১৯
–
–
চেক করে ছেড়ে দিচ্ছে যাত্রীদেরকে। যাত্রীরা দ্রুত হাঁটছে লাউঞ্জের দিকে। মাথার উপর ভারি মেঘ। বৃষ্টি এল বলে। | লাউঞ্জের ভিতর হঠাৎ ঢুকতে দেখা গেল হ্যাট পরিহিত একজন রোগা-পটকা লোককে। হ্যাটটা বিশেষ ভঙ্গিতে মাথায় দেয়ায় লোকটার মুখের বেশির ভাগই ঢাকা পড়ে গেছে। প্রকাণ্ড পাইপ তার ঠোঁটে। কুল কুল করে ধোয়া বের হচ্ছে পাইপ থেকে। ঢোলা কালো প্যান্টের সাথে লোকটা নীল একটা শার্ট পরেছে। তার বাঁ হাতে একটা ছড়ি। | লাউঞ্জে ঢুকে লোকটা উপস্থিত লোকজনদেরকে ভাল করে দেখে নিল। সবশেষে তার চোখ গিয়ে পড়ল জানালার সামনে দণ্ডায়মান শরীফ চাকলাদারের দিকে। মুচকি হাসল সে। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আপন মনে হাতের ছড়িটা খেলাচ্ছলে ঘোরাতে ঘোরাতে লাউঞ্জের একদিক থেকে আর একদিক অবধি পায়চারি করতে লাগল।
যাত্রী অনেকেই লাউঞ্জে ঢুকল, অনেকেই ঢুকল না। শরীফ চাকলাদার একসময় জানালার কাছ থেকে সরে এল। লাউঞ্জের প্রবেশ পথের দিকে পা বাড়াল সে। প্রবেশ পথের কাছে সে গিয়ে পৌঁছবার আগেই দেখা গেল সাতজন বিভিন্ন পোশাক পরা বিভিন্ন চেহারার লোক একসাথে লাউঞ্জে ঢুকছে। লোকগুলো কাকে যেন খুঁজছে। শরীফ চাকলাদার তাদের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। * এমন সময় দেখা গেল সেই হ্যাট পরা পাইপধারী রোগা-পটকা লোকটাকে। লোকটা শরীফ চাকলাদারের পথরোধ করে দাঁড়াল। বিরক্ত হয়ে শরীফ চাকলাদার থমকে দাঁড়াল। রোগা-পটকা লোকটি মধুর ভঙ্গিতে, হাসল, বলল, এই যে, মিস্টার। হামাকে চিনিটে পারিটেছেন? * শরীফ চাকলাদারের বিরক্তি চরমে উঠল। কি জ্বালা! বলে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে উদ্যত হলো সে। কিন্তু ডি, কস্টা তার ছড়িটা বাড়িয়ে দিল যথাসময়ে।
ছড়ির সাথে পা জড়িয়ে গেল শরীফ চাকলাদারের। চোখের পলকে আছাড় খেয়ে পড়ল সে লাউঞ্জের পাকা মেঝেতে। বাবারে, গেছি!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল শরীফ চাকলাদার।
‘ভেরি সরি! ভেরি-সরি! কোঠায় চোট পাইলেন, জেন্টেলম্যান?’
কথাগুলো বলতে বলতে হাঁটুমুড়ে বসল ডি. কস্টা চাকলাদারের ভূপাতিত দেহের পাশে। হাঁটুতে এবং কনুইয়ে প্রচণ্ড ব্যথা পাওয়া সত্ত্বেও দাঁতে দাঁত চেপে অশ্লীল একটা খিস্তি দিতে উদ্যত হলো শরীফ চাকলাদার। কিন্তু ডি কস্টা এক গাল । হেসে বলে উঠল, “ঠাক, মিস্টার, ঠাক। কষ্ট করিয়া লাভ নাই টোমার, কঠা যা বলিটে চান টাহা বাড়িটে গিয়া বলিবেন। গুড বাই…!’
কথাগুলো বলতে বলতে ডি. কস্টা তার ছড়ির আগাটা চেপে ধরল শরীফ
ভলিউম ১৫
চাকলাদারের পায়ের বুড়ো আঙুলে। ছড়ির আশায় অতি ক্ষুদ্র যে সূচটা ছিল সেটা বুড়ো আঙুলের মাংসে ঢুকে গেল। ছড়িটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল ডি. কস্টা। অসহায় ভঙ্গিতে বলে উঠল সে, কান্ট হে। আপাতত ভঙ্রলোকটি সেন্স হারাইয়াছেন!’
লাউঞ্জে যে সাতজন লোক একটু আগে প্রবেশ করেছিল তারা তাদের পরিচিত লোককে দেখতে না পেয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে দু’একটা কথা বলে ঘুরে দাঁড়াল লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়াবার সাথে সাথে তারা কালো আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘকায় এক পুরুষের মুখোমুখি হলো।
‘আপনারা কুচবিহারীর খোঁজ করছেন, তাই না?
ভরাট গলায় কালো আলখাল্লা পরিহিত পুরুষ প্রশ্ন করল। লোকগুলো তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল তারা। আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘকায় পুরুষ অভয় দিয়ে হাসল, বলল, আমি কুচবিহারীজীরই লোক। আপনারা আমার সাথে চলুন। | সাতজনের একজন তার পাশের সঙ্গীর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত চাপা গলায় বলে উঠল, আমি হলপ করে বলতে পারি এ লোক স্বয়ং কুয়াশা!’ অপর একজন দীর্ঘকায় কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কথা আমরা বুঝতে পারছি
। কে আপনি?”
কুয়াশা হাসল শব্দ করে। বলল, “ঠাট্টা করবেন না। আপনারা আমার সব কথাই জলের মত পরিষ্কার বুঝতে পারছেন।
‘আমরা আপনাকে চিনি না। সূতরাং আপনার সাথে আমরা যাচ্ছি না।’
কুয়াশার হাসি এতটুকু ম্লান হলো না। সে শুধু ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে বলল, কলিম, ব্যবস্থা করো।– চোখের পলকে কুয়াশার দুপাশে এসে দাঁড়াল চারজন লোক। তাদের মধ্যে। একজন কলিম। বাকি তিনজনও কুয়াশার ভক্ত অনুচর। চারজনের হাতেই অস্বাভাবিক লম্বা নলওয়ালা পিস্তল। প্রত্যেকের মুখে মুখোশ।
লোক সাতজন অবস্থা বেগতিক দেখে পিছিয়ে গেল। পিছন থেকে শোনা গেল ডি, কস্টার খটমটে ভাষা, ‘এভরি ওয়ান হেডের উপর হ্যাঁণ্ড টুলুন। টা না হইলে হামি গোলি চালায়গা!’’
দেখা গেল ডি কস্টাও মুখোশ পরে নিয়েছে কোন্ ফাঁকে। লাউঞ্জে যে দশ পনেরোজন লোক ছিল তাদের মধ্যে ছয় জনই ডি কস্টার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারাও মুখোশ ব্যবহার করছে। মুখোশগুলো রাবারের হলেও চোখের জায়গায় স্বচ্ছ কাঁচ লাগানো।
কাণ্ড দেখে এক মহিলা হঠাৎ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠেই জ্ঞান হারালেন। ডি. কস্টা সেদিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকাল।
কুয়াশা ৪৩
কুয়াশাকে দেখা যাচ্ছে না। লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে গেছে সে। কলিম তার পিস্তল উঁচিয়ে লোক সাতজনকে নির্দেশ দিল, ‘এবার কথা শুনবেন তো?’
এমন সময় কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা পুলিসকে দেখা গেল লাউঞ্জের প্রবেশ পথে। ডি কস্টা ইউনিফর্ম দেখা মাত্র গা ঢাকা দেবার জন্যে মাথা নিচু করে বসে। পড়ার উপক্রম করছিল! এমন সময় গর্জে উঠল কলিমের হাতে অস্বাভাবিক লম্বা। ব্যারেলের পিস্তল।
ডি, কস্টার হাতের পিস্তলও গর্জে উঠল! গর্জে উঠল পর পর আরও ক’জনের হাতের পিস্তল। চোখের পলকে কালো ধোঁয়া ঢেকে ফেলল লাউঞ্জের সবাইকে।
| ঘন কালো ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। খানিকক্ষণ কিছু কিছু শব্দ শোনা গেল। একটু পর সব স্থির হয়ে গেল। আরও খানিক পর লাউঞ্জের বাইরে ভিড় জমতে শুরু করল। এয়ারপোর্টের কর্মচারীরা ছুটোছুটি করতে লাগল। ফোন করা হলো ফায়ার ব্রিগেডে।
দমকল বাহিনীর গাড়ি পৌঁছুবার আগেই প্রচণ্ড বাতাস এসে হামলা করল। লাউঞ্জের ভিতর থেকে সব কালো ধোয়া উড়ে যেতে নোকজন ভিতরে ঢুকল। কলিম, ডি কস্টা, কুয়াশার অন্যান্য অনুচর বা সেই সাতজন লোককে লাউঞ্জের ভিতর দেখা গেল না। শরীফ চাকলাদার, অন্য চার-পাঁচজন ভদ্রলোক, একজন, মহিলা এবং ইউনিফর্ম পরা দু’জন পুলিসকে দেখা গেল, প্রাণহীন লাশের মত লাউঞ্জের মেঝেতে পড়ে আছে। | ডাক্তার ডাকার জন্যে ছুটল নোক, আধঘণ্টা পর ডাক্তার এসে অজ্ঞান। সবগুলো লোককে পরীক্ষা করে চিন্তিত ভাবে মাথা নেড়ে বলল, “বিষাক্ত গ্যাস শ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করায় জ্ঞান হারিয়েছে এরা সবাই। তবে ভয়ের কিছু নেই। সবাই জ্ঞান ফিরে পাবে।
তিন
জলসাঘরে এখন আর নাচ-গান হচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে না নূপুরের ধ্বনি। দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ উঠছে আজমল রব্বানীর নাক দিয়ে। খালি পায়ে প্রশস্ত মেঝের উপর সবেগে পায়চারি করছে সে। শরীফ চাকলাদার গম্ভীর মুখে বসে আছে একটি চেয়ারে। বিধ্বস্ত, পরাজিত দেখাচ্ছে তাকেও ।
‘আমি এ কথা বিশ্বাস করতে রাজি নই!’ চাপা গলায় গর্জে উঠল আজমল রব্বানী।.
শরীফ চাকলাদার কর্কশ গলায় বলল, আপনি তাহলে কি বিশ্বাস করেন?
‘আমার বিশ্বাস এ-কাজ সেই বার্মীজের! আগাট থাপাই নোক লাগিয়ে আমাদের সাতজন লোককে হাইজ্যাক করেছে। নওশের আবদুল্লা ওদের আসার ২২
ভলিউম ১৫
খবর জানতেই পারে না। আমরা দুজন ছাড়া খবরটা জানত কুচবিহারী। সে নেই, তার প্রশ্ন ওঠে না। আর একজনকে জানানো হয়েছে, সে হলো আগাট থাপা। আমি হলপ করে বলতে পারি এ-কাজ থাপা করিয়েছে!
তারমানে থাপা জেনুইন পার্টি না?’ আজমল রব্বানী বলল, “এখন তাই প্রমাণ হচ্ছে। লোকটা এক নম্বরের চিট। শরীফ চাকলাদার বলল, থাপাকে আপনিই কথাটা জানিয়েছিলেন?
মাথার চুল টানতে টানতে আজমল রব্বানী বলল, তখন কি আর জানতাম!’
এদিকে ডলির কামরায় টেলিফোন বাজছে। গভীর রাত, প্রায় দুটো বাজে। ঘুম ভেঙে গেল ডলির। কাঁচা ঘুম ভেঙে যেতে খুব বিরক্ত হলো সে। ফোন বেজেই চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ বিছানা ছেড়ে উঠল না ডলি! কিন্তু হঠাৎ নওশের আবদুল্লার কথা মনে পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসল সে। গায়ের শাড়ি ব্লাউজ, ঠিকঠাক না করেই উন্মাদিনীর মত খাট থেকে নেমে এলোচুলে ছুটল কামরার এক কোণে একটা টেবিলের ওপর রাখা টেলিফোনের দিকে।
ক্রেডল থেকে রিসিভারটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে দম বন্ধ করে, ডলি বলল, হ্যালো?’
| ‘ঘুমাচ্ছিলে বুঝি, ডলি? কেমন আছ? চিনতে পারছ তো আমাকে?
অশরীরী আতঙ্কে ঠাণ্ডা হিম হয়ে গেল ডলির সর্বশরীর এক মুহূর্তে। কাঁপা গলা দিয়ে একটা মাত্র শব্দ বের হলো, কে!’
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! ভয় পেলে নাকি, ডলি? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! আরে, ভয় পাবার কিছু নেই। আমি ভালই আছি। তোমার খবর কি?’
গলা শুকিয়ে তক্তা হয়ে গেছে ডলির। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে? এ কি করে সম্ব!
“কি হলো, ডলি? কথা বলছ না যে? ডলি কোন রকমে প্রশ্ন করে, কোথা থেকে বলছ তুমি? অপরপ্রান্ত থেকে আবার জোরাল হাসির শব্দ ভেসে আসে।
ডলি ভয়ে ভয়ে আবছা অন্ধকারে ঢাকা রূমের চারদিকে তাকায়। ইচ্ছা হয়। রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দেয়। কিন্তু সে শক্তিও নেই তার। হাত-পা অবশ হয়ে গেছে ভয়ে।
‘ভয় পেয়ো না, ডলি। শীঘ্রি তোমার সাথে দেখা হবে। পথের কাঁটাগুলো দূর করার জন্যে আপাতত গা ঢাকা দিয়েছি, বুঝলে। পথের কাঁটা দূর হোক, তখন আর তোমার আমার মিলনে কোনও বাধা থাকবে না। তুমিই হবে আমার রাণী, আমার দেবী। তোমাকে আমি কতটুকু ভালবাসি তা তো তোমার অজানা নয়! তোমার কুয়াশা ৪৩
উপযুক্ত আসন এতদিন দিতে পারিনি বলে মনে আমার শান্তি ছিল না। তবে, আর দেরি নেই। খুব শীঘ্রিই তোমাকে আমি নিজের করে নেব, হৃদয়াসনে বসাব সসম্মানে।’
কোথায় আছো তুমি?’
• ডলিকে থামিয়ে দিয়ে অপরপ্রান্ত থেকে রহস্যময় লোকটি বলে চলে নিজের কথা, তোমাকে নিয়ে আমি অন্য কোন দেশে চলে যাব, ডলি। কেউ থাকবে না। সেখানে, শুধু তুমি আর আমি। টাকা পয়সার কোন অভাব নেই আমার, পায়ের ওপর পা দিয়ে সারাটা জীবন বসে বসে খাব আর ফুর্তি করব। আমাদের সুখে, আমাদের আনন্দে কেউ বাধা দিতে যাবে না। জীবনটা হবে বড় মধুর। কিন্তু সেই মধুর দিনের স্বাদ পেতে হলে বুদ্ধি খরচ করে অনেকগুলো কাজ করতে হবে আমাকে। সে ব্যাপারে তুমি ভেব না। সবই করতে পারব আমি। তুমি শুধু কয়েকটা ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে। পারবে তো, ডলি?’.
ডলি ইতিমধ্যে খানিকটা সামলে নিয়েছে নিজেকে। সে বলল, তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি…!’
| অপরপ্রান্ত থেকে বলল লোকটা, মন দিয়ে শোনো, ডলি। বুঝিয়ে বলছি। আজমল রব্বানী আর শরীফ চাকলাদার, এরা দুজন হলো আমার আর তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমাদের সুখী ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় দুটো কাটা। এই কাটা দুটোকে উপড়ে ফেলতে হবে, ডলি।’
| কিন্তু••!
বাধা দিয়ে অপরপ্রান্ত থেকে বলল, ভয় পেলে চলবে না, ডলি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে অটুট মনোবল নিয়ে কাজটা করতে হবে। সব কাজ আমিই করছি, এ কাজটাও আমিই করতাম। কিন্তু এ কাজটা আপাতত আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ওদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ রয়েছে তোমার। কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না। সন্দেহ করলেই বা কি.••।’
“কি করতে হবে আমাকে…?’ আতঙ্কে কাঁপছে ডলি।
‘ওদের দুজনকে খুন করতে হবে। কাজটা খুবই সহজ। জলসাঘরে রোজ সন্ধ্যায় নাচ-গানের আসর বসে ওদের। দেয়াল-আলমারিতে থাকে মদের বোতল। সবগুলো বোতলে মিশিয়ে রাখো বিষ। ব্যস, এরপর তোমার দায়িত্ব শেষ। কাজটা খুব সহজ, করলেই করা হয়। ওরা মদ খেলেই মারা যাবে। কিন্তু তাতে তোমার কোন ভয় নেই। ওরা মারা গেছে একথা জানার পরই তুমি পালিয়ে আসবে বাড়ি। ছেড়ে। আমি তোমাকে।
কিন্তু আমি তা পারব না…’ ডলি কঁপা গলায় বলে উঠল।
‘ও-কথা বলতে নেই, ডলি। তোমার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। পারব না। কালে চলবে কেন, বলো? তুমি কি চাও না আমরা সুখী হই? আমাদের জীবনটা
ভলিউম ১৫
২৪
আনন্দের হোক? পরস্পরের সাথে আমরা চিরকালের জন্যে মিলিত হই?
কিন্তু আমি দুর্বল একটা মেয়ে•••!’ নিজেকে দুর্বল মনে কোরো না, ডলি।”
ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি কি পারব•••আচ্ছা, ভেবে দেখার জন্যে সময় দাও আমাকে:••।
“ঠিক আছে। দুদিন ভেবে দেখো তুমি। আমি আবার ফোন করব। কোনও চিন্তা কোরো না। আমি ভালই আছি। ছাড়ছি, প্রিয়তমা, কেমন?’
‘ছাড়ো। অস্ফুটে কথাটা বলে ডেলে নামিয়ে রাখল ডলি রিসিভারটা।
ভোর চারটের সময় মিস্টার সিম্পসনের কাছ থেকে ফোন পেল কামাল। ..
থানায় মিসেস মিজান চৌধুরী ফোন করে জানিয়েছেন ঘণ্টাখানেক আগে ডা. মিজান চৌধুরীর চেম্বারে চুরি হয়েছে। চোর চুরি করে পালিয়ে যাবার সময় কোন কিছুর সাথে ধাক্কা খায়, উল্টে পড়ে ছোট একটা টেবিল, ফলে শিশি-বোতল ভেঙে যায়। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বাড়ির সকলের। মিসেস মিজান চৌধুরী এবং তার মেয়ে উজালা চেম্বারে ঢুকে দেখে চোরের রাস্তার দিকের দরজা খোলা। চোর ওই পথেই এসেছিল। শিশি-বোতল ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে যাবার পর বাড়ির চাকর বাকর চোর চোর করে চিৎকার করে ওঠে। ঠিক তখুনি বাইরে একটা গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ শোনা যায়। মিসেস মিজান সন্দেহ করছেন চোর কোন সাধারণ লোক নয়। গাড়ি নিয়ে যে চুরি করতে আসে সে নিশ্চয়ই অসাধারণ চোর। মিসেস মিজানের আরও সন্দেহ যে এই চুরির সাথে তার স্বামী এবং ছেলের নিখোঁজ হওয়ার কোন সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। তবে চেম্বার থেকে কি চুরি হয়েছে তা তিনি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছেন না।
ফোন পাবার দশ মিনিটের মধ্যে একজন ক্যামেরাম্যান ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট এবং একজন পুলিস ইন্সপেক্টরকে মিজান চৌধুরীর বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। ইন্সপেক্টর মিসেস মিজান চৌধুরীর বক্তব্য লিখে নিয়েছেন। মিসেস মিজান তাকে জানিয়েছেন, খুব সম্ভং চেম্বার থেকে চুরি হয়ে গেছে দুটি জিনিস। ক্লোরোফর্ম ইঞ্জেকশন এবং তরল সায়ানায়েড পয়জন। দুটোই মারাত্মক জিনিস।
পরদিন সকালে একটি লোমহর্ষক ঘটনার খবর শুনে শিউরে উঠল সকলে। কোন কোন সংবাদ পত্রের দ্বিতীয় সংস্করণে খবরটা বড় বড় হেডিংয়ে ছাপা হলো। বাংলাদেশ বেতারের সকাল সাতটার খবরে প্রচার করা হলো ঘটনাটী। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল খবরটা শহরে, বন্দরে, গঞ্জে, গ্রামে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল নাগরিকেরা। হোটেল, রেস্তোরাঁয়, অফিসে, দোকানে, রাস্তাঘাটে, ড্রয়িংরূমে এবং রান্নাঘরে ছেলে-মেয়ে-বৃদ্ধ-যুবক সবাই খবরটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল।
কুয়াশা ৪৩
এমনিতেই দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি বিপর্যয়ের চরমে পৌঁছেছে। গুম, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, ডাকাতি, হাইজ্যাক, ঘুষ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সব ঘটনাকে ম্লান করে দিয়েছে গতকালের ঘটনা।
সকাল পাঁচটায় টহলদানরত পুলিসের চোখে পড়ে প্রথমে। স্টেডিয়ামের প্রকাণ্ড গেটের কাছে দুজন কনস্টেবল দাঁড়িয়েছিল। খানিক আগে তারা সেখানে এসে দাঁড়ায়। তাদের ডিউটি শেষ হতে দেরি ছিল না। গল্প-গুজব করছিল তারা। তখনও সকাল হয়নি পুরোপুরি। দিনের আলো ক্রমশ ফুটে উঠছিল। সেই আবছা অন্ধকারেই তাদের দৃষ্টি পড়ে আউটার স্টেডিয়ামের প্রকাণ্ড সবুজ মাঠের মাঝখানে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে কয়েকজন লোক।
দূর থেকে শায়িত লোকগুলোকে দেখে প্রথমে কোন সন্দেহ হয়নি তাদের। কিন্তু দিনের আলো আরও উজ্জ্বল হতে তারা দেখে লোকগুলো এমনভাবে হাত-পা
ছড়িয়ে শুয়ে আছে যে দূর থেকে তা বেশ একটু অদ্ভুত দেখাচ্ছে। নিজের মধ্যে এ ব্যাপারে খানিকক্ষণ আলাপ করার পর কনস্টেবল দুজন ঠিক করে কাছাকাছি গিয়ে লোকগুলোকে দেখা দরকার। পা বাড়ায় তারা মাঠের দিকে।
তারা যতই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ততই তাদের মনে সন্দেহ এবং শঙ্কা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। একেবারে কাছাকাছি না পৌঁছেই তারা বুঝতে পারে লোকগুলো নড়াচড়া করছে না। স্বাভাবিক মানুষ যেভাবে শুয়ে থাকে বা ঘুমিয়ে থাকে লোকগুলো সেভাবে শুয়ে বা ঘুমিয়ে নেই। কেউ চিৎ হয়ে শুয়েছে, কিন্তু তার একদিকের গাল ঠেকে আছে ঘাসের সাথে। নাকের ভিতর ঢুকেছে একটা ঘাসের ডগা। কেউ শুয়ে আছে যতদূর সম্ভব হাত পা ছড়িয়ে। কনস্টেবল দুজন
কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই জমাট রক্তের সমুদ্র দেখতে পেল।
দূর থেকে এই জমাট রক্তকেই মনে হয়েছিল শুকনো ঘাস।
কাছে গিয়ে দাঁড়াতে তারা অবিশ্বাস ভরা চোখ মেলে যা দেখল তা বিভীষিকাময়, লোমহর্ষক। মোট সাতজন লোকের মৃতদেহ পড়ে আছে বিশৃংখলভাবে ঘাসের উপর। সাতজনেরই পরনে প্যান্ট। কিন্তু কারও গায়ে শার্ট বা গেঞ্জি নেই।
প্রত্যেককেই খুন করা হয়েছে পেট কেটে। সাতজন লোকেরই পেট চেরা। কারও কারও নাড়িভুড়ি বেরিয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। মাছিরা এসেছে দলবেঁধে।
অকুস্থল থেকে অফিসে পৌঁছুলেন মি. সিম্পসন কামালকে নিয়ে সকাল সাতটায় । লাশকাটা ঘরে পাঠিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়ে এসেছেন তিনি সাতটা মৃতদেহকে। ফেরার পথে একটাও কথা বলেনি কামাল। অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে উঠেছে সে।
কামালকে নিয়ে নিজের চেম্বারে ঢুকলেন মি. সিম্পসন। বসল ওরা। মি. সিম্পসন বললেন, কী সাংঘাতিক! শেষ পর্যন্ত কুয়াশা এমন জঘন্য খুন
ভলিউম ১৫
খারাবীতে মেতে উঠল! এতটা জঘন্য চরিত্রের লোক বলে আগে কখনও তাকে মনে হয়নি আমার। কুয়াশা যে এত নীচে নেমে যেতে পারে তা আমি ভাবতেই পারিনি।’
কামাল ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরাল।
মি. সিম্পসন আবার কথা বলে উঠলেন, ‘গতরাতে কনস্টেবল দুজন কুয়াশার অনুচরদেরকে ঠিকই চিনতে পেরেছিল তাদের ভুল হয়নি!’।
কামাল থমথমে গলায় বলল, ‘ভুল হবার প্রশ্নই ওঠে না। ডি কস্টাকে আর কলিমকে তো ওরা চিনেছেই। এয়ারপোর্টের বাইরে আরও দুজন কনস্টেবল ছিল। তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। তারা দেখেছে স্বয়ং কুয়াশাকে। সাতজন লোককে কুয়াশার অনুচররা কাঁধে করে একটা মাইক্রোবাসে তোলে। কুয়াশা নিজে মাইক্রোবাস চালিয়ে কেটে পড়ে ওখান খেকে।
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, “এই লাশগুলি যে সেই সাতজনেরই তাও তো কনস্টেবল দুজন সনাক্ত করল। না, সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। | পকেট থেকে একটা রুমাল বের করল কামাল। রুমালের ভিতর থেকে বের হলো একটা ঘড়ি। মি. সিম্পসনের দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, দেখুন তো,
এটা চিনতে পারেন কিনা।’
মি. সিম্পসন ঘড়িটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলেন। অদ্ভুত ডায়াল ঘড়িটার। পুরো একবছরের ক্যালেণ্ডার, কম্পাস, সেকেণ্ডকে ভাগ করে সময় নির্ধারণের কাটা। ইত্যাদি সহ তিনটে হালকা রঙে তৈরি ডায়ালটা। চাবি দিতে হয় না। পানিতে আটচল্লিশ ঘণ্টা ফেলে রাখলেও ঘড়ির কোন ক্ষতি হবে না। শক প্রুফ।
কোথায় পেলে এটা তুমি? এ তো কুয়াশার। তার নিজের তৈরি।
হ্যাঁ, তার নিজের তৈরি। কোথায় পেয়েছি জানেন? লাশগুলোর নিচে চাপা পড়ে ছিল।
মি. সিম্পসন চিৎকার করে উঠলেন, ‘মাই গড! যাওবা একটু সন্দেহ ছিল তাও আর রইল না। এ কাজ কুয়াশা, নো ডাউট! কামাল, এখন আমাদের করণীয় কাজ কি?
· কামাল বলল, অবশ্যই গ্রেফতার করতে হবে কুয়াশাকে। কিন্তু তার আগে আমি শহীদের সাথে পরামর্শ করতে চাই। সব কথা ওরও জানা দরকার। কুয়াশাকে তাড়াহুড়ো করে গ্রেফতার করতে চাই না আমি। আঁটঘাট বেঁধে আগে তার বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো সংগ্রহ করতে চাই। তারপর গ্রেফতার। গ্রেফতার করে প্রমাণের অভাবে আবার তাকে ছেড়ে দিতে হলে লজ্জার সীমা-পরিসীমা থাকবে না।’
মি. সিম্পসন খুশি হয়ে উঠলেন, “আমিও ভাই চাই, কামাল। শহীদের সাথে পরামর্শ করবে ভাল কথা। কিন্তু সুযোগ পেলে রাসেলের সাথেও পরামর্শ করতে পারো এ ব্যাপারে। ছেলেটা বুদ্ধিমান।’
* ২৭
কুয়াশা ৪৩
গত কয়েকদিন থেকেই ছায়ার মত লেগে আছে লোকটা আকামের পিছনে। জীবনে এর আগে এ ধরনের সমস্যায় পড়েনি সে। গত কয়েকদিনে লোকটা তার জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে। ধাড়ি থেকে বের হলেই পিছু নিচ্ছে লোকটা। অনেকভাবে : অনেকবার লোকটার চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা করেছে আকরম। রিকশা ছেড়ে ট্যাক্সি.নিয়েছে, ট্যাক্সি ছেড়ে বাসে উঠেছে, বাস থেকে নেমে ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে পায়ে হেঁটে বহুদূর চলে গেছে-কিন্তু কোন লাভ হয়নি। লোকটা ঠিকই।
অনুসরণ করে এসেছে তাকে পিছু পিছু। | গতকাল সারাদিন লোকটাকে ফাঁকি দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে রাত বারোটারও পরে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল আকরম। উপরের কামরা থেকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে লোকটাকে সে, এরপর দেখতে পায়নি। তা সত্ত্বেও আধঘণ্টা অপেক্ষা করে সে। আধঘণ্টা পর আবার সে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।
. অত রাত হলেও বাইরে বের হবার বিশেষ দরকার ছিল আকরমের। পুরানো ঢাকা শহরের একটা বাড়িতে যাওয়া দরকার তার। কয়েকদিন আগেই যাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু অনুসরণকারী লোকটার জ্বালায় সে যেতে পারেনি। আকরম সে বাড়িতে যেতে চায় সকলের অগোচরে।
কদিন বাড়িটায় যেতে পারেনি বলে খুবই দূশ্চিন্তায় ছিল আকরম। দেরি হলে সে-বাড়ির লোক তার সাথে দেখা করার জন্যে আসতে পারে। কেউ তার সাথে সে-বাড়ি থেকে দেখা করতে আসুক তা আকরম কোনমতেই চায় না।
গতকাল অত রাতে সে-বাড়িতে যাবার জন্যেই বেরিয়েছিল আকরম। কিন্তু যাওয়া তার হয়নি। বাদ সেধেছিল সেই অনুসরণকারী লোকটাই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকদূর যাবার পর পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেয়েছিল, সে লোকটাকে।
অগত্যা আবার বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল আকরম। ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে সে। লোকটাকে চেনবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি সে। আগে কোনদিন লোকটাকে দেখেছে বলে মনে হয় না। আকরম প্রথমে ভেবেছিল লোকটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান হবে। কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করার পর সে বুঝতে পেরেছে । লোকটা ডিটেকটিভ শহীদ খান নয়। অন্য কেউ।
, অন্য কে হতে পারে?
• হাঁটতে হাঁটতে আবার পিছন ফিরে তাকাল আকরম। রাস্তার অপর দিকের ফুটপাথ ধরে ঠিকই হেঁটে আসছে লোকটা।
* পুলিসের লোক নয় তো? কিন্তু পুলিসের নোক তাকে অনুসরণ করবে কেন? পুলিসের কাছে তার বিরুদ্ধে কি রেকর্ড আছে?
হাঁটতে হাঁটতে সুলতাদের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে আকরম। মনে মনে
ভলিউম ১৫
সে ঠিক করল সুলতার সাথে দেখা করে ফিরুবে সে। মুলতার সাথে কদিন ধরেই আলাপ হচ্ছে। কিন্তু পরিষ্কার করে কিছু বলছে না সে। আজ সুলতার কাছ থেকে কথা আদায় করতে হবে। রাতে সে ঘুমুতে পারে না সুলতার জন্যে। মেয়েটা সুন্দরী, বাবা টাকাও রেখে গেছে যথেষ্ট। সুন্দরী নারী এবং টাকা দুটোর উপরই লোভ তার। দেরি করলে কি থেকে কি হয়ে যায় তার ঠিক নেই। যা করার তা তাড়াতাড়ি করাই ভাল। সুলতাকে আজ বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করতে বলবে আকরম। কোন রকম ওজর-আপত্তি শুনবে না সে। দরকার হলে জোর খাটাতে হবে। সুলতার বাবা নেই, সুতরাং ভয়েরও কিছু নেই। তবে সুলতার কাকা নাকি আসছে, টেলিগ্রাম করেছে মাদ্রাজ থেকে। লোকটা কেমন কে জানে। মুসলমান ছেলের সাথে ভাইঝির বিয়ে দিতে না-ও চাইতে পারে। বিয়েটা যদি সে এসে পড়ার আগেই সেরে ফেলা যেত তবেই সবদিক দিয়ে ভাল হত। কিন্তু তা কি সম্ব? সুলতা কি মত দেরে? মত দেবে না কেন, ভাবল আকরম, চেষ্টা করে দেখাই যাক
। দরকার হলে জোর করে বিয়ে করতে হবে।
আকরম বাড়ির কলিংবেল টিপতে দরজা খুলে দিল হনুমানজী ।
তোমার দিদিমণি বাড়িতে আছে?’ ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে জানতে চাইল আকরম।–
আছেন। ওপরের কামরায় আছেন। যান,’ হনুমানজী দরজা বন্ধ করতে করতে বলল।
• সিঁড়ি বেয়ে সোজা তিন তলায় উঠে গেল আকরম। সুলতার কামরার দরজায় টোকা দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে সে ভাবল, ‘এত বড় বাড়িটার মালিক হবে দুদিন পর সে। ব্যাঙ্কে সুলতার নামে জমা আছে বারো লাখ টাকা। সে টাকারও মালিক হবে সে।
‘কে? সুলতার গলা ভেসে এ কামরার ভিতর থেকে। ‘আমি। চিনতে পারছ?’ সহাস্যে বলল আকরম।
সব দুশ্চিন্তার কথা আপাতত ভুলে গেছে সে। সুলতা নিঃশব্দে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে দিয়ে পিছন ফিরে কয়েক পা হেঁটে বসল সে একটা সোফায়। আকরম কামরার ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্যত হলো।
সুলতা বলে উঠল, ‘ও কি হচ্ছে?’
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল আকরম। রহস্যময় হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। বলল, “ক্ষতি কি, কেউ তো দেখছে না। * সুলতা কঠিন হলো, কেউ দেখুক আর নাই দেখুক, দরজা বন্ধ করার দরকার নেই।’
দরজার কাছ থেকে না সরেই আকরম বলল, তুমি বড় সেকেলে, সুলতা। মনের মানুষের সাথে দরজা বন্ধ করে গল্প-গুজব করার মধ্যে একটা আনন্দ আছে,
কুয়াশা ৪৩ ।
রোমাঞ্চ আছে, তা কি তুমি বোঝো না?’
সুলতা আবার কঠিন সুরেই বলল, ‘ভেবেচিন্তে কথা বলতে শেখো, আকরম। নিজের অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যেয়ো না।’ | হাসি উবে গেল আরমের মুখ থেকে। দরজাটা সে বন্ধ না করেই সুলতার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। চোখমুখ বিকৃত, কুৎসিত হয়ে উঠেছে তার চেহারা । চিবিয়ে, চিবিয়ে সে উচ্চারণ করুল, তারমানে? কি বলতে চাও তুমি?’
সুলতা বলল, যা বলতে চাই তা তুমি ভাল করেই বুঝেছ। কিন্তু, এখন ওসব কথা থাক। কেন এসেছ এত রাতে?’
কেন, বিরক্ত হয়েছ নাকি এসেছি বলে? আর কারও জন্যে অপেক্ষা করছিলে
বুঝি?
‘অসহ্য!’ অস্ফুটে বলে উঠল সুলতা। কথাটা শুনতে পায়নি আকরম। দ্রুত জিজ্ঞেস করল সে, “কি বললে?’
সুলতা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার শরীর ভাল নয়, আকরম। কেন। এসেছ বলবার ইচ্ছা থাকলে বলো।
কেন এসেছি তা তুমি জানো না? ভাল কথা, তোমার কাকা কাঞ্চন বিহারী এসেছেন?’
সুলতা শান্ত গলায় বলল, না, কাকা আগামীকাল আসবেন।’
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল আকরম, এক মুখ ধোয়া ছেড়ে বলল, এসেছি তোমার সাথে আমার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করতে।’
‘কি!’ সুলতা স্তম্ভিত হয়ে গেল আরমের দুঃসাহস দেখে।
কি হলো, চমকে উঠলে যে?’
সুলতা বলে উঠল, বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছ তুমি, আকরম। বাবা নেই বলে তুমি দেখছি রীতিমত অতিষ্ট করে তুলছ আমাকে। আমাকে বিয়ে করার কথা ভাবো কি করে তুমি?’
তারমানে আমাকে তুমি বিয়ে করবে না?’
সুলতা বলল, এ তো নতুন কথা নয়, আকরম । তোমাকে তো আমি বিয়ে করার কথা কল্পনাই করতে পারি না। তোমাকে কেন, আমি একজনকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারি না, পারবও না!
, সেই একজন তো উজান চৌধুরী। তারমানে তুমি মরা মানুষকে বিয়ে করার জন্যে অপেক্ষা করছ?
আকরম? গর্জে উঠল সুলতা বাঘিনীর মত। উঠে দাঁড়াল সে সোফা ছেড়ে। ‘ওরে বাপরে! এত তেজ? ‘তা মন্দ কি বলেছি আমি? আজ আট-দশ দিন ধরে
ভলিউম ১৫
যে নিখোঁজ সে কি আর বেঁচে আছে বলে আশা করো? তোমার মত বোকা আমি•••।’
চুপ করো, আকরম! উজান মারা যায়নি, আমার মন বলছে বেঁচে আছে। সে•••!’ করুণ মিনতি ফুটে উঠল সুলতার কণ্ঠে। | হাঃ হাঃ করে হাসল খানিকক্ষণ আকরম। তারপর বলল, মেয়েরা সম্ভবত মিথ্যে আশার পিছনে ছুটতে ভালবাসে। যাকগে! আচ্ছা, উজান চৌধুরী যদি সত্যি মারা যায় তাহলে কি করবে তুমি? বিয়ে করবে তো আমাকে?
জানি না! ওসব কথা আমাকে বোলো না তুমি। তুমি. তুমি যাও•••!
জানি না বললে চলবে না। আজ আমি তোমার কথা আদায় না করে যাব না। বলো, উজান চৌধুরীর খোঁজ পাওয়া না গেলে বা তার মৃত্যু-সংবাদ পেলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
“আচ্ছা, আচ্ছা, তাই হবে। এবার তুমি যাও, তোমার দুটি পায়ে পড়ি…!
হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল আকরম সুলতার কামরা থেকে। সফল হয়েছে। সে, কথা দিয়েছে সুলতা।
বাইরে বেরিয়ে রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে আকরম দেখল রাত এগারোটা বেজে গেছে। পুরানো শহরের বাড়িটায় তার যাওয়া দরকার। এদিক-ওদিক তাকাল সে। লোকটাকে দেখতে না পেয়ে খুশি হলো। বিরক্ত হয়ে চলে গেছে লোকটা, অনুমান করল। রিকশা কিংবা বেবী ট্যাক্সি দরকার আরমের। কিন্তু কোনরকম যানবাহন নেই আশেপাশে। মোড়ের দিকে পা বাড়াল সে। ওদিকে গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যাবে, নিশ্চয়ই।
মোড়ে এসে গাড়ি পেল ঠিকই আকম। কিন্তু গাড়ি পেলে হবে কি, এখানে । সেই অনুসরণকারী নাছোড়বান্দা লোকটাকে দেখতে পেল দাঁড়িয়ে থাকতে। রাগে সর্বশরীর জুলতে লাগল তার। নিষ্ফল আক্রোশে লোকটার দিকে বেশ খানিকক্ষণ ‘কিয়ে রইল সে। লোকটা অদুরে একটি বেবী ট্যাক্সির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে প্যান্ট-শার্ট। স্বাস্থ্যটা খুবই ভাল। অভিজাত পরিবারের লোক বলেই মনে হলো আরমের। তার দিকেই তাকিয়ে আছে। লোকটার উদ্দেশ্য কি বুঝে উঠতে পারছে না সে।
বেবী ট্যাক্সি ভাড়া করল আকরম । বেবী ট্যাক্সিতে চড়ে তাকাতেই সে দেখল লোকটাও তার পাশের বেবী ট্যাক্সিতে উঠল ।
পুরানো শহরের নির্দিষ্ট বাড়িতে আর যাবার ইচ্ছা নেই আকরমের। অর্থাৎ উপায় নেই। ঠিক করল সে তাদের ধানমণ্ডির বাড়িতেই ফিরে যাবে।
বাড়ির কাছে বেবী ট্যাক্সি থেকে নামতেই আট-নয় বছরের একটা ছেলেকে বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল আকরম । সে যা
‘য়াশা ৪৩
আশঙ্কা করেছিল তাই ঘটেছে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল সে। হ্যাঁ, আসছে পিছন পিছন আর একটা বেবী ট্যাক্সি।
| গাড়ি থেকে নেমেই আট-দশ বছরের ছেলেটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল আকরম। পকেট থেকে দশ টাকার দুটো নোট বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে সে দ্রুত চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কোন কথা বলবি না! সোজা বাড়ি ফিরে য!’
, বেবী ট্যাক্সির কাছে ফিরে এসে ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে দিল আকরম! আড়চোখে তাকিয়ে দেখল দ্বিতীয় বেবী ট্যাক্সিটা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
| টাকা নিয়ে ছোট ছেলেটা দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ছেলেটাকে বেবী ট্যাক্সির রহস্যময় আরোহী কিছু জিজ্ঞেস করে কিনা দেখার ইচ্ছা হলেও গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করল না আকরম। কারণ তাতে অনুসরণকারী লোকটা সন্দেহ করতে পারে ছোট ছেলেটার সাথে তার কোন সম্পর্ক আছে।
বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল আকরম। গেট খুলে অপেক্ষা করছিল রবালি।
চার রবালিকে আকরম জিজ্ঞেস করল, “আব্বা কোথায় রে?
| রবালি ইতস্তত করছে দেখে ধমকে উঠল আকরম, কি হলো, উত্তর দিচ্ছিস না কেন?’ |
ভয় পেয়ে রবালি বলল, সাহেব মানে, সাহেব জলসা ঘরে।’ “থাক, আর বলতে হবে না! বুঝেছি।’
এগিয়ে যায় আকরম। করিডরে উঠে হঠাৎ পঁড়িয়ে পড়ে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় রবালির দিকে, আমার খাবার দিয়েছিস?
‘জী, ছোট সাহেব। আপনার কামরাতে রেখে এসেছি।’ “ঠিক আছে। তোকে আর দরকার হবে না আমার।’
রবালি চলে যায়। করিডর ধরে এগোতে থাকে আকরম । তার সৎ-মা, ডলির কামরার পাশ ঘেঁষে যাবার সময় আবার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সে। দম বন্ধ করে, কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে আকরম। ডলির রূমে ডলি কথা বলছে।
| কার সাথে কথা বলছে এত রাতে ডলি? প্রচণ্ড কৌতূহলে পেয়ে বসে আকরমকে। সে জানে তার বাবা ডলির কামরায় শোয় না আজ প্রায় মাস ছয়েক। | ডলির কামরায় বড় একটা আসেও না সে। তবে•••?
কার সাথে কথা বলতে পারে ডলি।
৩২. ‘
ভলিউম ১৫
গভীর মনোযোগের সাথে শোনার চেষ্টা করে আকরম। খানিক পরই সে বুঝতে পারে ডলির কামরায় কেউ নেই, ডলি কথা বলছে ফোনে। কার সাথে কথা বলছে
ডলি?
| ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আকরম ডলির দরজার গায়ে কান ঠেকিয়ে। বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে তার। সে বুঝতে পারে ডলি কার সাথে কথা বলছে। বুঝতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে যায় আকরম। অবিশ্বাস্য-ব্যাপার, কিন্তু নিজের কানে শোনা কথা অবিশ্বাস করে কিভাবে সে?
একসময় ডলি রিসিভার নামিয়ে রাখে। স্তম্ভিত, বিমূঢ়, দিশেহারা আকরম নিঃশব্দে পা বাড়ায় নিজের কামরার দিকে।
| নিজের কামরায় ফিরে এসেও স্থির হতে পারে না আকরম। মাথাটা বন বন। করে ঘুরতে থাকে তার। টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে ঢাকা দেয়া খাবারদাবার। কিন্তু খিদের কথা ভুলে গেছে সে। উত্তেজিত ভাবে ঘূণ্টাখানেক মেঝেতে পায়চারি করার পর আকরম ঠিক করল ডলির সাথে কথা বলবে সে। যে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে তার মনে, তার সঠিক একটা ব্যাখ্যা দরকার । হুমকি দিয়ে হলেও ডলির মুখ সে খোলাবে।
নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে আসে আরম। এক পা পা করে এগোয় ডলির কামরার দিকে।
কোথাও কোন শব্দ নেই। রাত গভীর। ডলির কামরার সামনে পৌঁছে হতভম্ব হয়ে পড়ে আকরম। ডলির কামরার দরজা খোলা, হা-হা করছে পান্না দুটো। কামরার ভিতর অন্ধকার। অন্ধকার কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আকরম নিঃশব্দে। ভিতর থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। খুক করে কাশে আকরম। আশ্চর্য হয় সে। কেন যেন একটু ভয়ও লাগে। আবার একবার খুক করে কাশে। কিন্তু অন্ধকার কামরার ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ আসে না। নিঃশব্দে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আকরম।
| পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটা কাঠি জ্বালে আকরম। পা বাড়িয়ে কামরার ভিতর ঢোকে সে। দরজার পাশেই সুইচবোর্ড। হাত বাড়িয়ে সুইচ অন করে ইলেকট্রিক আলো জ্বালে, তাকায় কামরার চারদিকে। খালি পড়ে আছে কামরা, ডলি নেই ভিতরে। গেল কোথায় ডলি?
কামরার ভিতর চিন্তিত ভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আকরম। এক মিনিট, দু’মিনিট। কিন্তু ডলি ফেরে না। গেল কোথায়? বাবার সাথে কথা বলতে যায়নি তো? হতে পারে! চঞ্চল হয়ে ওঠে মনে মনে আকরম। ডলি বাবার সাথে নিশ্চয়ই খানিক আগে ফোনে কথা বলার ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেছে। আলোচনাটা শোনা দরকার। প্রচণ্ড কৌতূহল পেয়ে বসেছে তাকে।
আকরম ডলির কামরা থেকে বেরিয়ে আসে। নিঃশব্দে পায়ে হাঁটতে থাকে সে
৩ কুয়াশা ৪৩
তার বাবার বেডরূমের উদ্দেশে।
আকরম তার বাবার বেডরুমের কাছাকাছি এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় বেডরূমের দরজাটা দূর থেকেই সে খোলা দেখতে পায়। ভিতরে আলো জ্বলছে। দ্রুত পদশব্দ শোনা যায়। একটা চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ হয়। পরমুহূর্তে দেখা গেল ডলিকে। উন্মাদিনীর মত বেরিয়ে এল ডলি বেডরূম থেকে। ‘আকরম কি মনে করে করিডরের একটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করে। ডলি ছুটে আসছে। আশ্চর্য হয় আকরম ডলির মুখের ভাব দেখে। রীতিমত আতঙ্কিত মনে হয় ডলিকে তার । ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে পালাচ্ছে সে। যেন কেউ তাড়া করেছে তাকে।
| থামের পাশ ঘেঁষে ছুটে চলে যায় ডলি। আকরম পাথরের মূর্তির মত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে আরও কিছুক্ষণ। ব্যাপারটা কি বুঝতে পারেনি সে। রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে উঠছে তার কাছে। তার বাবার বেডরূমের দরজা খোলাই রয়েছে।
আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে বেডরূমের দরজার দিকে পা টিপে টিপে এগোতে থাকে আকরম। আস্তে আস্তে খোলা দরজার সামনে এসে উঁকি দিয়ে ভিতরে তাকায় সে।
কামরার ভিতর তার বাবাকে দেখতে পায় না আকরম। কেউ নেই কামরার ভিতর। অবাক হয় আকরম। বাবা কি তাহলে এখনও তার জলসা ঘরে?
জলসা ঘরে বাবার উপস্থিতিতে এর আগে কখনও যায়নি আকরম। কিন্তু এই মুহূর্তে যাবে সিদ্ধান্ত নিল সে। ডলির মুখটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। আতঙ্কিত একটা মুখ। ডলি এমন কিছু দেখেছে বা শুনেছে যার ফলে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সে। তার ভয় পাবার কারণটা জানতে চায় আকরম।
রেড়রূমে ঢুকে আকরম দেখতে পায় জলসা ঘরে যাবার সিঁড়ি মুখের সামনে যে আলমারিটা থাকে, সেটা সরানো হয়েছে আগেই।
সিঁড়ি বেয়ে অত্যন্ত সাবধানে নামতে থাকে আকরম। ডলি এই মাত্র উঠে গেছে জলসা ঘর থেকে। বাবা নিশ্চয়ই জেগে আছেন। হয়তো মাতাল অবস্থায় আরও মদ গিলছেন। মুচকি হাসল আকরম। বাবা যত বুড়ো হচ্ছেন ততই ভোগী হয়ে
উঠছেন। পা টিপে টিপে নামতে থাকে আকরম। বাবা যেন টের না পান।
সিঁড়ি থেকে নেমে করিডরে পা দেয় আকরম। করিডরের শেষ মাথার দিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে সে। জলসা ঘরের দরজাটা খোলাই দেখা যাচ্ছে। চোখ-কান সতর্ক রেখে এগোতে থাকে আকরম। বাবার সাথে আর কেউ থাকতে পারে, ভাবে আকরম। কিন্তু জলসা ঘরের কাছাকাছি পৌঁছেও কারও সাড়া শব্দ না পেয়ে অবাক হতে শুরু করে সে। কান পেতে এতটুকু শব্দও শুনতে পায় না। সে। ছুঁয়ে দেয় তাকে একটা অশরীরী ভয়ের স্রোত হঠাৎ । গা ছমছম করে ওঠে। তার চোখের সামনে ফুটে ওঠে বক্সনগরের জঙ্গলের প্রাচীন মন্দিরের ছবি। ভয়ে
৩৪
ভলিউম ১৫
গলা শুকিয়ে যায় তার। | জলসাঘরের খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় আকরম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। না, কোন শব্দ নেই। জলসা ঘরের ভিতরটা দেখার জন্যে উঁকি দেয় আকরম।
আজমল রব্বানী শুয়ে আছেন। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছেন তিনি। তার পাশে দাঁড় করানো রয়েছে একটা সাদা পেট মোটা’মদের বোতল।
সন্তর্পণে জলসাঘরের ভিতরে পা দেয় আকরম। বাবা কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে শুয়ে রয়েছেন। মুখটা অন্যদিকে ফেরানো।
বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আকরম । তখুনি সে দেখতে পায় বাবার চোখ দুটো।
আজমল রব্বানীর চোখ দুটো খোলা। স্থির হয়ে আছে চোখ দুটো। এতটুকু নড়ছে না। মরা মানুষের চোখ যেমন হয়ে থাকে।
পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে আকরম। কোন সন্দেহ নেই তার যে ডলি তার বাবাকে খুন করেছে।
মাথা ঠাণ্ডা রাখা এই পরিস্থিতিতে খুব কঠিন হলেও আকরম সবরকম পরিস্থিতির সাথে পরিচিত বলেই মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরবর্তী কর্তব্য স্থির করে ফেলল। পুলিস ডলিকে গ্রেফতার করবে তাতে তার কোনও সন্দেহ নেই। আর সে চায়ও তাই। ডলিকে পুলিস গ্রেফতার করলে তার অনেক লাভ। | দৃঢ় মন নিয়ে স্থির, অচঞ্চল পায়ে জলসাঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল সে তার বাবার বেডরূমে। সেখান থেকে সরাসরি ঢুকল নিজের কামরায়। এতটুকু সময় নষ্ট না করে ফোনের ডায়াল ঘোরাতে লাগল সে। কানেকশন পাবার পর সে জিজ্ঞেস করল, এটা কি পুলিস স্টেশন?’
হ্যাঁ। ও. সি. বলছি।’
আকরম বলল, আমি আজমল রব্বানীর ছেলে আকরম রব্বানী ধানমণ্ডির আঠারো নম্বর রোডের পাঁচ বাই তিন থেকে বলছি। এ-বাড়িতে একজন খুন হয়েছে। তাড়াতাড়ি পুলিস পাঠান। খুনী এখনও আছে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে।
‘কি বললেন? খুন? খুনী এখনও আছে কাছাকাছি? কী সাংঘাতিক! দাঁড়ান, দাঁড়ান, ঠিকানাটা আর একবার বলুন দেখি••• |’
ঠিকানাটা আবার জানিয়ে দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল আকরম। কিন্তু থানায় ফোন করেই নিশ্চিন্ত হতে পারল না সে। ডলি খুন যখন করেছে তখন নিজেকে বাঁচাবার জন্যে পালাবার চেষ্টাও করতে পারে বলে মনে হলো তার। কথাটা মনে দৈয় হওয়া মাত্র নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে এল সে। আটকানো দরকার ডাইনীটাকে। তা না হলে পালাবে। সন্তর্পণে এগিয়ে চলল আকরম। কুয়াশা ৪৩
ডলির রূমের কাছাকাছি এসে দরজাটা খোলা দেখে বেশ একটু অবাকই হলো আকরম। এখনও দরজা খোলা কেন?
কামরাটা আলোকিত। আকরম বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল কামরার সামনে। কেউ নেই কামরার ভিতর। ডলি পালিয়েছে ইতিমধ্যেই।
দশ মিনিট পর প্রথমে থানা থেকে একজন ইন্সপেক্টর দুজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলো। মি. সিম্পসন এবং কামাল এল আরও দশ মিনিট পর।
ইন্সপেক্টর আকরম এবং রবালির জবানবন্দি নিল। জলসা ঘরে গিয়ে লাশ দেখল মি. সিম্পসন এবং কামাল। কামাল মদের বোতলটা রুমালে জড়িয়ে পকেটে ভরল। অবশিষ্ট মদ পাঠানো হবে সি. আই. ডি. ডিপার্টমেন্টের ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্যে।
এক ফাঁকে কামাল মি. সিম্পসনকে জানাল, ডলি কোথায় গেছে তা হয়তো খোঁজ করলে আমার পক্ষে জানা সম্ব।
কোথায় খোঁজ করতে চাও তাকে?’
কামাল বলল, শহীদ আমাকে বলেছিল ডলির প্রাক্তন প্রেমিক নওশের আবদুল্লার এক বন্ধুর বাড়ি আছে কুখ্যাত একটি পাড়ায়। সেখানেই নাকি মাঝে মধ্যে ডলি যায়। নওশের আবদুল্লার বন্ধুটাও একজন কেউকেটা, গুণ্ডাদের সর্দার আর কি। আমার মনে হয় ডলি সেখানে গেছে গা-ঢাকা দেবার জন্যে। |
‘চলো তাহলে, গিয়ে দেখা যাক।’ ।
কামাল বলল, “আমি একাই যাই। আপনি বরং লাশ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। দেখবেন, সকালে যেন রিপোর্টটা পাওয়া যায়।”
কিন্তু কুখ্যাত পাড়ায় একজন গুণ্ডার সর্দারের বাড়িতে তুমি একা•••।’ | বাধা দিয়ে কামাল বলল, না, একেবারে একা যাব না। খানা থেকে কযেকজন; আর্মড পুলিসকে তুলে নেব যাবার সময়।’
| মি. সিম্পসন বললেন, হ্যাঁ। তাই করে। আমি বলে দিচ্ছি ফোনে।
পাঁচ : রাত গম্ভীর হয়েছে। সারা শহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। | কিন্তু ঘুম নেই বাঈজীদের পাড়ায়। বাঈজীরা জেগে আছে। রোজই জেগে থাকে তারা সারা রাত। শুধু জেগেই থাকে না, রাত জেগে এরা বিলাসী ধনী সন্তানদের মন ভোলাবার জন্যে নাচে।
বাঈজী পাড়ায় সাধারণত ধনী লোকেরাই আসে। আসে যারা নিশাচর, যারা, অসামাজিক গোপন ভোগবিলাসের দাস। বিকৃত রুচির লোকেরই সমাগম ঘটে এখানে। মাতাল, লম্পট, ব্ল্যাকমেইলার, কালোবাজারী, চোরাচালানকারী,
ভলিউম ১
৩৬
মজুতদার, কালো টাকার কারবারী, গুণ্ডাদের সর্দার, ধনীলোকের বখে যাওয়া সন্তান প্রভৃতিদের একচেটিয়া কী এই বাঈজী পাড়া।
রাত যত গভীরই হোক এ পাড়ার অলিতে গলিতে মাতালের দেখা পাওয়া যাবে। শোনা যাবে আশপাশের বাড়ি থেকে আসা নূপুরের ধ্বনি, তবলার আওয়াজ, মেয়েলি গলার গান এবং রহস্যময় খিলখিল হাসি।
এই পাড়ারই একটি গলি থেকে মাতাল অবস্থায় টলতে টলতে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল একজন প্যান্ট-শার্ট পরা সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান লোককে। এই লোকটাই গত কয়েকদিন ধরে ছায়ার মত অনুসরণ করে আসছে আকরমকে।
লোকটা টলতে টলতে গলি থেকে বেরিয়ে আবছা অন্ধকারে ঢাকা অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তায় বেরিয়েই মুখোমুখি পড়ল কামালের।
কামাল গলিটার ভিতরই ঢুকতে যাচ্ছিল। মাতাল লোকটাকে দেখে চমকে উঠল সে! অবাক চোখে মাতালের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর চাপা গলায় সে বলে উঠল, ‘এ কি রে, শহীদ! তুই এখানে? এত রাতে তুই।
মাতাল লোকটি অর্থাৎ ছদ্মবেশধারী শহীদ খান তেমনি চাপা গলায় উত্তর দিল, ‘প্রশ্নটা তো আমিও তোকে করতে পারি। এতরাতে তুই এখানে কেন?
কামাল নিচু গলায় বলল, “আমি ডলির খোঁজে এসেছি। খানিক আগে আজমল রব্বানী খুন হয়েছেন। আরমের ধারণা তার বাবাকে খুন করেছে ডলি। ডলিকে বাড়িতে পাইনি। সে নাকি পালিয়ে এসেছে। তাই খোঁজ করতে এসেছিঃ•• ||
শহীদ এখন আর টলছে না। মাতালের অভিনয় করার আপাতত দরকার নেই। দ্রুত রাস্তার এদিক-ওদিক দেখে নিল ওঁ। দূরে দু’চারজন লোককে মাতলামি করতে দেখা যাচ্ছে। কাছেপিঠে কেউ নেই। এদিকটা বেশ অন্ধকারও। কামালের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল শহীদ, বলল, তুই ডলিকে খুঁজছিস আর আমি ডলিকে অনুসরণ করে এখানে এসেছি।’
‘ডলিকে অনুসরণ করে এখানে এসেছিস? কোত্থেকে? ডলি তাহলে এ পাড়ায় আছে? কোথায়, কোন্ বাড়িতে বল দেখি?’
আজমল রব্বানীর বাড়ি থেকে অনুসরণ করে আসছি আমি। শোন, নওশের আবদুল্লার বন্ধুর বাড়িটা এই গলির ভিতর। ডলি ওখানেই আছে। নওশেরের বন্ধুকে একটা কাগজের টুকরো দিয়েছে ডলি, দেখেছি আমি। কাগজের টুকরোটায় কি লেখা আছে তা আমার দেখার সুযোগ হয়নি। তুই কি ডলিকে গ্রেফতার করতে চাস?
কামাল বলল, হ্যাঁ, সঙ্ হলে••।’ ‘কিন্তু একা পারবি না। নওশেরের বন্ধু হরমুজ বেগ ভয়ঙ্কর লোক।
‘আমার সঙ্গে আটজন আর্মড পুলিস আছে। পাড়ার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি তাদেরকে••।’
বিদ্বেগে ধাক্কা দিল শহীদ কামালকে। তিনহাত দূরে গিয়ে পড়ল কামাল
কুয়াশা ৪৩
৩৭
আচমকা শহীদের ধাক্কা খেয়ে। পরমুহূর্তে দেখা গেল অন্ধকার গলি থেকে ওদের দুজনের দিকে লাফিয়ে পড়েছে প্রকাণ্ড এক দৈত্য। লোকটার হাতে চকচকে একটা ছোরা।
সময়মত সরে গিয়েছিল বলে রক্ষা। লোকটা তাল সামলাবার আগেই শহীদ পাশ থেকে প্রচণ্ড লাথি চালাল। বিশালদেহী আক্রমণকারীর পাজরে গিয়ে লাগল সবুট লাথি। মট করে ভেঙে গেল একটা পাজরের হাড়। | কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপই করল না আক্রমণকারী। বিপুল-বিক্রমে ছোরা উঁচিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। শহীদ চোখের পলকে সরে গেল এক পাশে। এবারও আঘাত হানতে ব্যর্থ হলো শত্রু। শহীদ এবার প্রাণপণ শক্তিতে ঘুসি চালাল।
. শত্রুর কপালের পাশে গিয়ে লাগল ঘুসি। শহীদের হাতের আঙুলগুলো যেন ঢুকে যেতে চাইল শত্রুর কপালের হাড় ভেদ করে ভিতরে। ককিয়ে উঠল লোকটা। কিন্তু পরাজয় স্বীকার করল না সে। সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার ছোরা চালাল। কিন্তু শহীদ প্রস্তুত হয়েই ছিল। বিদ্বেগে বসে পড়েই দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল
ও শত্রুর হাঁটু দুটো। তারপর আকর্ষণ করল নিজের দিকে হাঁটু দুটোকে! তাল হারিয়ে ফেলল শত্রু। এক সেকেণ্ড পরই শত্রুকে ছেড়ে দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসা অবস্থাতেই আবার ঘুসি চালাল শহীদ। | তলপেটে ঘুসি খেয়ে ককিয়ে উঠল আবার শত্রু। উঠে দাঁড়িয়েই লাথি চালাল শহীদ। পিছন দিকে পড়ে যাচ্ছে লোকটা। কিন্তু পিছন থেকে পিঠেকামালের লাথি খেয়ে আবার সামনের দিকে ঝুঁকল ভারী দেহটা।
সশব্দে রাস্তার উপর পড়ল শত্রুর দেহ। কালবিলম্ব না করে শহীদ এবং কামাল অচেতন দেহটাকে ধরাধরি করে অন্ধকার গলির ভিতর নিয়ে গেল। গলির এক পাশে দেয়াল ঘেষে দেহটা নামিয়ে রেখে সিধে হয়ে দাঁড়াল ওরা।
তুই সময় মত আমাকে সরিয়ে না দিলে••!’
কামালকে বাধা দিয়ে শহীদ নিচু গলায় বলে উঠল, এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা উচিত হবে না। লোকটাকে চিনতে পারছিস? এই-ই নওশের আবদুল্লার বন্ধু হুরমুজ বেগ। এর সাঙ্গপাঙ্গরা টের পেলে আর রক্ষে নেই।
কামাল জিজ্ঞেস করল, তুই কি করতে বলিস?’ শহীদ বলল, ডলিকে যদি গ্রেফতার করতে চাস তবে আর দেরি করিস না।
কথাটা বলেই হুরমুজ বেগের পাশে বসল শহীদ। লোকটার পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ ও বলে উঠল, পেয়েছি।’
কি পেয়েছিস রে? অবাক হয়ে জানতে চাইল কামাল। দেখা গেল শহীদের হাতে একটা চিরকুট। ‘কি ওটা?’ শহীদ বল, ডলি এই কাগজের টুকরোটাই দিয়েছিল হুরমুজ বেগকে।
ভলিউম ১৫
“কি লেখা আছে ওতে?
আবছা অন্ধকারে পড়বার কোন উপায় নেই। পকেট থেকে সিগারেট এবং দেশলাই বের করল শহীদ, সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইয়ের কাঠির আলোয় চিরকুটের লেখাটা পড়ে শহীদ গম্ভীর গলায় বলল, এ যে দেখছি বক্সনগরের একটি মন্দিরে যাবার পথের নির্দেশ লেখা রয়েছে।
মন্দিরের সাথে কি সম্পর্ক ডলির?’
শহীদ বলল, ‘কোন না কোন সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে। ওই মন্দিরেই হয়তো পাওয়া যাবে এই কেসের সকল সমাধান। বলা যায় না, ওখানেই হয়তো আত্মগোপন করে আছে নওশের আবদুন্না কোন কারণে।
তুই কি যাবি? ‘যাব না মানে? পারলে এখুনি রওনা হতাম। কিন্তু রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পৌঁছুতে সেই সকালই হয়ে যাবে। তারচেয়ে সকালেই রওনা হব।’
| সেই ভাল। আমি তোর সাথে যেতে পারব না হয়তো। অনেক কাজ বাকি থাকবে। ডলিকে গ্রেফতার করার পর ওর কাছ থেকে কথা আদায় করতে হবে।
শহীদ জিজ্ঞেস করল, “তোর কি আমার সাহায্য দরকার?’
হাসল কামাল। বলল, আটজন আর্মড কনস্টেবল আছে আমার সঙ্গে। তোর সাহায্য লাগবে না। তুই তো সকালবেলাই মন্দিরের খোঁজে ছুটবি। বাড়ি গিয়ে বরং বিশ্রাম নে। তুই ফিরে খবর দিস, দেখা করব।’
শহীদ বলল, যদি ফিরি তবে খবর দেব।’ যদি ফিরি মানে?
শহীদ হাসল। বলল, বলা যায় না, মন্দিরে হয়তো আমার জন্যে মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে।’
গম্ভীর গলায় কামাল বলল, অলক্ষুণে কথা বলিস না, শহীদ।
বক্সনগর। কাঁচা রাস্তার শেষ মাথায় থামো।
সামনে জঙ্গল। শিমুল গাছগুলোকে ডানপাশে রেখে এগোও। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর পাবে সরু একটা পায়ে হাঁটা পথ।
এই পথ ধরে এগিয়ে চলো। সামনেই পড়বে এক প্রাচীন মন্দির। | ডলির হাতের লেখা ভাল। চিরকুটে উপরের কথাগুলো লেখা। পাকা রাস্তার শেষ মাথায় এসে চিরকুটটায় আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল শহীদ। ‘
সকাল দশটায় জঙ্গলে ঢুকল শহীদ। শিমুল গাছের কথা লেখা আছে চিরকুটে। কিন্তু সমস্যায় পড়লশহীদ। একটা শিমুল গাছও চোখে পড়ল না ওর। অযথা সময় নষ্ট না করে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল ও। খানিকদূর যাবার পর দেখা পাওয়া গেল শিমুল গাছের। ডানদিকে গাছগুলোকে রেখে সরু একটা পথ ধরে দ্রুত এগিয়ে কুয়াশা ৪৩
চলল শহীদ। প্রায় সাত মিনিট হাঁটার পর জঙ্গলের মাঝখানে থমকে দাঁড়াল সে। অদূরে, সামনে, দেখা যাচ্ছে মন্দিটা।
* সতর্ক চোখে মন্দিরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল শহীদ। প্রাণের কোন চিহ্ন বাইরে থেকে দেখতে পেল না ও। সাবধানী পায়ে মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। দোতলার বারান্দার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। | এই প্রাচীন মন্দিরে কি কেউ বাস করে? নিজেকেই প্রশ্নটা করল শহীদ। হোলস্টার থেকে রিভলভারটা বের করল ও। অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি মেলে ঢুকল মন্দিরের ভিতর। | উঠন পেরিয়ে মন্দিরের উঁচু বারান্দায় উঠল, শহীদ। বারান্দায় উঠে খোলা দরজাটার দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল।
সন্তর্পণে খোলা দরজা পথে উঁকি দিয়ে তাকাতেই কালীমূর্তি দেখতে পেল শহীদ। মেঝেতে শুকনো রক্ত দৃষ্টি এড়াল না ওর। কালীমূর্তির পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে একটা বড় ছোরা। ছোরার ফালাতেও রক্ত। কিন্তু সে রক্তও শুকিয়ে গেছে। বেশ কয়েকদিন আগে রক্তের সংস্পর্শে এসেছে ছোরাটা তা বুঝতে পারল শহীদ। পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকল ও।
ছোরাটা মেঝে থেকে তুলে রুমালে জড়িয়ে নিল শহীদ। কালীমূর্তির পিছনটা দেখল ও। কেউ নেই, কিছু নেই। খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল এবার শহীদ।
কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে উঠতে চাইলেও তা সম্ভ হলো না। কাঁচ ক্যাচ শব্দ করে নড়বড়ে সিঁড়িটা প্রবল অভিযোগ প্রকাশ করতে লাগল।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল শহীদ।
উপরে তিনটে কামরা। প্রথম কামরাটার সামনে থমকে দাঁড়াল শহীদ। কামরাটার কড়ায় নতুন তালা ঝুলছে। শহীদ দেখল তিনটে কামরার দরজাতেই, নতুন তালা। | প্রথম কামরার দরজার গায়ে কান পেতে কিছু শোনা যায় কিনা পরীক্ষা করল শহীদ। উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখ। ভিতর থেকে অস্ফুট কাতরধ্বনি ভেসে আসছে। কে যেন নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে কোন বিপদের লক্ষণ দেখতে পেল না শহীদ। রিভলভারের বাঁট দিয়ে সজোরে তালার উপর ঘা মারল ও।
কয়েকবার আঘাত করতে পচা কাঠের শরীরে ঢোকানো লোহার একটা মরচে ধরা কড়া ভেঙে গেল।
আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে দরজার পাল্লা দুটো ফাঁক করল শহীদ। ভ্যাপসা গরম। বাতাস নাকেমুখে এসে লাগল। কামরার ভিতর আবছা অন্ধকার। ভিতরে পা দিল ।
ভলিউম ১৫
৪০
শহীদ।
| কামরার মেঝেতে প্রৌঢ় একজন লোক প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে আছে। লোকটার হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। শহীদ লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চোখ মেলে শহীদের দিকেই তাকিয়ে আছে লোকটা।.
শহীদ মৃদু হাসল। বলল, আর কোন ভয় নেই, মি. মিজান চৌধুরী। পাপের শাস্তি আপনি পেয়েছেন। আপনার ছেলে উজান চৌধুরী কোথায়?
ছয়। বেলা একটার সময় শহীদের ফোন পেল কামাল।
‘বড় চিন্তায় ছিলাম রে। তা মন্দিরে গিয়ে কি, পেলি, শহীদ? | শহীদের হাসির শব্দ ভেসে এল। ও বলল, মূল্যবান তথ্য পেয়েছি। পরে শুনিস। তুই বরং একজন লোক পাঠিয়ে দে আমার বাড়িতে। একটা ছোরা, একটা সিগারেট কেস পাঠাব, ওগুলোতে হাতের ছাপ পাওয়া যায় কিনা, পরীক্ষা করার জন্যে।
কামাল বলল, তা পাঠাচ্ছি। কিন্তু তোকে যেন খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে। কি করছিস রে?
বেড়াতে বেরিয়েছি,’ বলল শহীদ কৌতুক ভরে। ‘এমন সময়? কোথায় বেড়াচ্ছিস? ফোন করছিস কোত্থেকে?”
শহীদ হাসতে হাসতে জানাল, পরে শুনিস। আর একটা কাজ করতে হবে। তোকে |
বল।’
‘আজ বিকেলে মি. সিম্পসনের চেম্বারে বর্তমান কেসে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে নিমন্ত্রণ করে একত্রিত করবি। পারবি তো?”
‘তা পারব। ব্যাপার কি রে, শহীদ? মনে হচ্ছে তুই কেসটার সমাধান করে ফেলেছিস!’ | শহীদ বলল, “সমাধান আমাকে করতে হবে না। তুই-ই পারবি। আমি শুধু তোকে দু’একটা তথ্য দেব। ভাল কথা, কুচবিহারীর লাশে যে বুলেট পাওয়া গিয়েছিল সেটা যে পিস্তল থেকে ছোঁড়া হয়েছিল সেই পিস্তল থেকেই ডলির উদ্দেশে গুলি করা হয়েছিল কিনা বলতে পারিস না? খোল এবং বুলেট দুটোই তো তোর কাছে আছে। পরীক্ষা করিসনি? | কামাল বলল, ‘কেন, তোকে বলিনি? ভুলে গিয়েছিলাম, শহীদ। পরীক্ষার রিপোর্ট বলছে দুটো গুলি যে একই পিস্তল থেকে ছোঁড়া হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ
নেই। এদিকে আরও মজার কাণ্ড হয়েছে তা জানিস?
কুয়াশা ৪৩
“কি কাণ্ড?
‘মিজান চৌধুরীর চেম্বার থেকে ক্লোরোফর্ম এবং সায়ানায়েড বিষ চুরি হয়েছে তা তো জানিস?
‘হ্যাঁ।’’ | চেম্বারে চোরের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।
কার সাথে মিলছে?
কামাল বলল, হাতের ছাপটা যে কার ঠিক বুঝতে পারছি না। দাগী, অপরাধীদের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়েছে, মিলছে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, আজমল রব্বানী যে মদের বোতল থেকে মদ খেয়ে নিহত হয়েছেন সেই বোতলেও এই চোরের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। এখন দেখছি ডলি আজমল রব্বানীকে খুন করেনি। ডলি নিজেই অস্বীকার করছে। বলছে, সে জলসাঘরে গিয়ে দেখে তার স্বামী মরে পড়ে আছে। আমার বদ্ধমূল ধারণা ক্লোরোফর্ম এবং সায়ানায়েড যে চুরি করেছে সে-ই খুন করেছে সেই সাতজন লোককে এবং আজমল রব্বানীকে। আমার একথা বলার কারণ এই যে সাতজন লোকের পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট বলছে ওদেরকে ক্লোরোফর্ম ইঞ্জেকশন দিয়ে আগে অজ্ঞান করা হয় তারপর ছোরা চালিয়ে চেরা হয়, প্রত্যেকের পেট। আজমল রব্বানীর বোতলের মদে পাওয়া গেছে প্রচুর পরিমাণে সায়ানায়েড বিষ ।.
কাকে সন্দেহ করিস তাহলে তুই? তোদের তো ধারণা কুয়াশা সাতজন লোককে খুন করেছে।’
কামাল বলল, কুয়াশা আজমল রব্বানীকেও খুন করেছে হয়তো। মোটিভ?’। কামাল বলল, সেটাই বুঝতে পারছি না।’
কেন, কুয়াশার হাতের ছাপ তো আছে। মিলিয়ে দেখ। দেখেছি। মিলছে না।’
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল শহীদ। হাসি থামিয়ে ও বলল, ‘পরস্পরবিরোধী কথা বলছিস কেন? একবার বলছিস ক্লোরোফর্ম এবং সায়ানায়েড যে চুরি করেছে। সেই-ই সাতজন লোক এবং আজমল রব্বানীকে খুন করেছে এবং সে লোক কুয়াশা ছাড়া আর কেউ নয়; আবার বলছিস কুয়াশার হাতের ছাপের সাথে চোরের অর্থাৎ খুনীর হাতের ছাপ মিলছে না। তোর কথা অনুযায়ী প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে চোর এবং খুনী এক লোক এবং সে আর যে-ই হোক, কুয়াশা নয়।’
| কামাল বলল, সত্যি কথা বলতে কি, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এ ব্যাপারে তোর সাহায্য ছাড়া আমি অচল। | ‘শহীদ বলল, খানিকক্ষণের মধ্যে বাড়ি ফিরছি আমি। লোক পাঠিয়ে দে তুই। পরে আলোচনা করব। বিকেল পাঁচটায় সবাইকে মি, সিম্পসনের চেম্বারে জড়ো
ভলিউম ১৫
৪২
করবি, আমি আসব। কয়েকটা চেয়ার বেশি রাখিস। নতুন মুখ দেখতে পাবি।’
কোথা থেকে ফোন করছিস রে তুই? সুলতাদের বাড়ি থেকে।’ কামাল অবাক হলো, ওখানে কি?
শহীদ বলল, বাহু, সুলতা একা আছে, তাকে দেখতে আসতে নেই? আজ থেকে অবশ্যি বেচারা মেয়েটাকে একা থাকতে হবে না। ওর কাকা কাঞ্চন বিহারী আজ সকাল আটটায় মাদ্রাজ থেকে ঢাকায় এসেছেন। ভদ্রলোক বেজায় মুষড়ে পড়েছেন ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে। গুম মেরে গেছেন। হাজার হোক, এক মায়ের পেটের ভাই তো!’
কামাল বলল, কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করব বল তো?
শহীদ বলল, ‘সবাইকে। শরীফ চাকলাদার, সুলতা, আকরম। সুলতার কাকা কাঞ্চন বিহারীকেও নিমন্ত্রণ করিস। তার ছোট ভাই খুন হয়েছে সুতরাং এই কেসের সমাধানের ব্যাপারে সে-ও নিশ্চয়ই আগ্রহী হবে। আর ডলি তো পুলিসের হেফাজতেই আছে। ওকেও আনাৰি। খোঁজ পেলে কুয়াশাকে খবর দিল। রাসেলকেও ডাকিস। আমার ধারণা কিছু তথ্য সে-ও দিতে পারবে।
কুয়াশা আসবে?’
শহীদ বলল, নিমন্ত্রণ পেলে আসবে না কেন? দোষী হলে হয়তো আসবে না, কিন্তু নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার এটাই তো তার সুযোগ।
বিকেল পাঁচটায় মি. সিম্পসনের চেম্বারে একে একে জমায়েত হলো সবাই। সবাই এসেছে, আসেনি কেবল শরীফ চাকলাদার। আসেনি, কিন্তু ফোন করে সে জানিয়েছে বিশেষ একটা কাজে আটকা পড়ে গেছে বলে তার আসতে ঘন্টা খানেক দেরি হবে।
কামাল অস্থির হয়ে উঠল শহীদের অপেক্ষায়। পাঁচটা বেজে গেছে, অথচ শহীদ এখনও আসছে না কেন? * আকরম তাকিয়ে আছে কামালের দিকে তাকিয়ে আছে ডলি এবং সুলতাও। কাঞ্চনবিহারী এসেছে। এক মনে চুপচাপ চুরুট খাচ্ছে সে। কোন দিকে মনোযোগ নেই।
আকরম বলে উঠল, কি ব্যাপার, মি. কামাল? আমাদেরকে এভাবে বসিয়ে রাখার মানে কি…?
কামাল ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, আপনাদের সবাইকে ডাকা হয়েছে। বর্তমান কেসটা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে। কিন্তু এই কেস নিয়ে যারা মাথা ঘামাচ্ছেন তাদের অনেকেই হাজির হননি এখনও। কেসের সাথে যারা জড়িত তাদের মধ্যে শরীফ চাকলাদার সাহেবও আসতে পারেননি। তিনি পরে আসবেন,
কুয়াশা ৪৩
৪৩
জানিয়েছেন। ঠিক আছে, আমরা এখুনি আলোচনা শুরু করতে পারি।
কামাল মি. সিম্পসনের দিকে তাকাল। মি. সিম্পসন মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিলেন। পাশাপাশি চেয়ারে বসেছে ওরা। ওদের পাশে আরও কয়েকটা চেয়ার খালি পড়ে রয়েছে। ওদের সামনে মস্ত একটা টেবিল। ওদের মুখোমুখি বসেছে। আকরম, কাঞ্চনবিহারী, সুলতা এবং ডলি।
কুয়াশাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে রাসেলকেও। তারা এখনও এসে পৌঁছায়নি।
| কামাল শুরু করল, বর্তমান কেসটা প্রথমে যেমন সরল মনে করা হয়েছিল পরে ঠিক তেমনি জটিল হয়ে ওঠে তা আপনারা সকলেই জানেন। প্রথমে খুন হলেন মি. কুচবিহারী । তারপর সাতজন অজ্ঞাত পরিচয় লোকের লাশ পাওয়া গেল। সবশেষে নিহত হলেন মি. আজমল রব্বানী। এদিকে প্রথম থেকেই নিখোঁজ হয়েছেন ডা. মিজান চৌধুরী এবং তাঁর ছেলে উজান চৌধুরী।
কামাল দম নেবার জন্যে থেমে একে একে সকলের দিকে তাকাল। তারপর শুরু করল আবার, আপনারা সকলেই নিহত মি. কুচবিহারী বা মি. আজমল রব্বানীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কিন্তু দুনিয়া বড় জঘন্য স্থান, এখানে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে খুন করে। অর্থাৎ আপনারা কেউই সন্দেহের বাইরে নন। যারা খুন হয়েছেন তাদেরকে খুন করার পিছনে আপনাদের অনেকেরই উপযুক্ত মোটিভ থাকা সম্ব। সুতরাং আমি আপনাদের প্রত্যেককেই কয়েকটা করে প্রশ্ন করব। আশা করি আমার প্রশ্নের সত্য উত্তর দেবেন সবাই।
কামাল এবার তাকাল আরমের দিকে। বলল, “মি. আকরম, আমি সবার আগে আপনাকেই প্রশ্ন করতে চাই।’
গম্ভীর গলায় আকরম বলল, বলুন।’
আপনার বাবা মি. আজমল রব্বানীর একটা পিস্তল ছিল। সেটা নাকি ক’দিন আগে চুরি যায়। আপনি জানেন পিস্তলটা কে চুরি করেছে?
।’
কামাল বলল, যে পিস্তল দিয়ে মি. কুচবিহারীকে খুন করা হয়েছে সেই পিস্তল দিয়েই গুলি করা হয়েছে শহীদ খান ও মিসেস ডলিকে। তার মানে যে পিস্তলটা চুরি করেছে সে-ই খুন করেছে মি. কুচবিহারীকে এবং সে-ই গুলি করেছিল শহীদ খানকে লক্ষ্য করে। মি: আকরম, আপনি জানেন শহীদ খানকে কে গুলি করেছিল?
‘না। তবে আমি একজনকে ছুটে পালাতে দেখেছিলাম গুলির শব্দের পর পরই:..!’
‘মিথ্যে কথা!
শোনা গেল শহীদের কণ্ঠস্বর। একটা তিন-চার বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে অফিসরুমের ভিতর প্রবেশ করল শহীদ। চমকে উঠে সকলে তাকাল ওর দিকে। হাঁ
৪৪
ভলিউম ১৫
হয়ে গেছে কামালের মুখ শহীদের কোলে একটি শিশুকে দেখে।
| আকরম কি যেন বলার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল শহীদের কোলের তিন-চার বছরের শিশুটি। বাচ্চাটা আকরমের দিকে তাকিয়ে দুহাত বাড়িয়ে পরিষ্কার গলায় বলে উঠল, ‘আব্বা! আব্বা!’ শহীদ বাচ্চাটিকে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই সে ছুটে গিয়ে তার বাবা আরমের হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরল।
| সুলতা সবিস্ময়ে বলে উঠল, তার মানে?’
শহীদ মৃদু হাসল। বলল, মিস সুলতা, ধৈর্য ধরুন। সবই জানতে পারবেন। হ্যাঁ, এই বাচ্চাটি মি. আকরমেরই ঔরসজাত। তিনি বিবাহিত। কিন্তু বিয়ের কথাটা তিনি এতদিন চেপে রেখেছেন এই যা। কারণ তার এই বিয়ের কথা জানতে পারলে তার বাবা তাকে ত্যাজ্যপুত্র করতেন এবং আপনাকে তার বিয়ে করার শখ বা লোভ মিটত না। সে যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি এবার। মি. আজমল রব্বানীর বাড়িতে মিসেস ডলির সাথে আমি যখন কথা বলছিলাম তখন আমাকে লক্ষ্য করে জানালা দিয়ে গুলি করা হয়। সাথে সাথে বাইরে বেরিয়ে আসি আমি। মি. আকরম আমাকে জানান যে পাঁচিল টপকে একজন লোককে তিনি পালাতে দেখেছেন। কিন্তু পাচিল পরীক্ষা করে এবং কুয়াশার একজন অনুচর মান্নানকে প্রশ্ন করে আমি জানতে পারি যে পাঁচিল টপকে বাড়ি থেকে কেউ পালায়নি। তার মানে মি. আকরম মিথ্যে কথা বলেছিলেন আমাকে। আমি জানতে চাই, কেন আপনি মিথ্যে কথা বলেছিলেন, মি. আকম?’
| আকরম হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শহীদের দিকে।
কামাল বলে উঠল, “আপনি মুখ না খুললেও ক্ষতি নেই, মি. আকরম। সত্য কখনও চাপা থাকে না একথা আপনার জানা না থাকলেও আমাদের জানা আছে। আপনি মিথ্যে কথা বলেছিলেন, তার কারণ আপনার বাবার পিস্তলটা চুরি করেছিলেন আপনিই। আপনিই খুন করেন মি. কুচবিহারীকে এবং আপনিই গুলি করেন শহীদ খানকে•••!
কুচবিহারীকে আমি খুন করেছি? চমৎকার! তাকে খুন করার পেছনে আমার স্বার্থ কি? মোটিভ কি? | কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিল, শহীদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, না, আপনি মি. কুচবিহারীকে খুন করেননি। কিন্তু আপনি নওশের আবদুন্নাকে খুন করেছেন। ‘অস্বীকার করেন?
“নিশ্চয়ই অস্বীকার করি! তাকে কেন খুন করতে যাব আমি? কে নওশের আবদুল্লা? তাকে আমি চিনিই না•••।’
বাজে কথা বললে ফল ভাল হবে না, মি. আকরম। নওশের আবদুল্লাকে আপনার ভালভাবেই চেনার কথা। সে ছিল একজন কুখ্যাত ব্ল্যাকমেইলার। আমার । কুয়াশা ৪৩
৪৫
ধারণা সে আপনাকেও ব্ল্যাকমেইল করত•••।’
মিথ্যে কন্যা!
চিৎকার করে উঠল আকরম। ডলি প্রমুহূর্তে তার চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে সমান রবে চিৎকার করে বলে উঠল, মিথ্যে নয়, সত্যি কথা। নওশের তোমাকেও ব্ল্যাকমেইল করত। তুমি বিবাহিত, তোমার দুটো ছেলেমেয়ে আছে একথা প্রচার করে দেবার ভয় দেখায় সে। তুমি তার মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করে মাসে মাসে পাঁচশো করে টাকা দেবার প্রতিজ্ঞা করো। আমি শহীদ সাহেবের সাথে যখন কথা বলছিলাম, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তখন তুমি আমাদের কথা শুনছিলে। তার আগে একটা কথা বলে নিই। এই ঘটনার আগের দিন নওশের আমাদের বাড়িতে যায়। নওশের যখন তোমার বাবার সাথে আলোচনা শেষ করে চলে যাচ্ছিল তখন তুমি তাকে অনুসরণ করো। তোমার এই অনুসরণের কথাটাই পরদিন শহীদ সাহেবকে আমি বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বলা আর হলো না, তার আগেই তুমি গুলি করো শহীদ সাহেবকে লক্ষ্য করে। তোমাকে আমি দেখেছিলাম। কিন্তু ভয়ে তোমার নাম আমি পুলিসকে বা শহীদ সাহেবকে বলিনি। এখন সব কথা বলতে আমার কোন বাধা নেই। কারণ তুমি আমার আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
ডলি থামতেই কামাল প্রশ্ন করে, মি, আকরম তাহলে নওশেরকে খুন করেছেন। কিন্তু তার লাশ কোথায় রেখেছেন?
উত্তর দিল শহীদ, তার লাশ বিকৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে পুলিস। আমরা সবাই যে লাশকে মি, কুচবিহারীর লাশ বলে মনে করেছিলাম সেটা আসলে মি. কুচবিহারীর লাশ নয়। সেটা নওশের আবদুল্লার লাশ।’
সকলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল শহীদের দিকে। মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, ‘এ তুমি কি বলছ, শহীদ? কামাল বলল, “মি. কুচবিহারী তাহলে কোথায়?
শহীদ তাকাল কাঞ্চনবিহারীর দিকে। বলল, “মি, কুচবিহারী এই অফিস রূমেই উপস্থিত আছেন।
হোয়াট! চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন ।
এমন সময় অফিস রূমে ঢুকল একজন সুবেশী প্রৌঢ়। তার পিছন পিছন ঢুকল এক সুদর্শন তরুণ। তরুণের দিকে তাকিয়ে সুলতা আনন্দে আবেগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘উজান। উজান তুমি?
কান্নায় গলা বুজে গেল সুলতার।
শহীদ সুবেশী, প্রৌঢ়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আসুন, মি. মিজান চৌধুরী, আসুন।’
| মিজান চৌধুরী কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল কাঞ্চনবিহারীর দিকে। কাঞ্চনবিহারী
৪৬
ভলিউম ১৫
তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ভয়ে কাঁপছে সে।
মিজান চৌধুরী বলে উঠল, তোমার পাল্লায় পড়ে জীবনে অনেক পাপ করেছি। আমি প্রায় নরকে পৌঁছে গিয়েছিলাম। শেষ অবধি তোমার হাতেই খুন হতে হত। আমাকে। ভাগ্য নেহাত ভাল, সময় মত মি. শহীদ আমাকে উদ্ধার করেছেন। ওঁর ঋণ জীবনে আমি শোধ করতে পারব না। কুচবিহারী সাহেব, নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করো।’
| সুলতা চিৎকার করে উঠল, আপনাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! ইনি আমার কাকা কাঞ্চনবিহারী•••। | শহীদ বলল, না। ইনি আপনার কাকা নন, ইনি আপনার পিতা মি. কুচবিহারী। প্লাস্টিক সার্জারী করে নিজের চেহারা পাল্টে ফেলেছেন। সে এক বিরাট ইতিহাস। সংক্ষেপে বলছি।’
দম নিয়ে আবার শুরু করল শহীদ, মি. কুচবিহারী, মি. আজমল রব্বানী এবং মি. শরীফ চাকলাদার, এই তিনজন একটা অবৈধ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। চোরাচালানের ব্যবসা। অ্যাকটিভ পার্টনার ছিলেন কুচবিহারী। বাকি দুজন অংশীদার হলেও ব্যবসার রহস্য জানার কোন সুযোগ পেত না। ওরা দুজন সন্দেহ করে যে মি. কুচবিহারী তাদেরকে ঠকাচ্ছে। ফলে ওরা ঠিক করে মি. কুচবিহারীকে খুন করতে হবে। কিন্তু ওদের ষড়যন্ত্রের কথা শুনে ফেলে ডলি। ডলি খবরটা দেয় নওশেরকে। নওশের দেয় মি, কুচবিহারীকে। ফলে কুচবিহারী ঠিক করেন তিনিই আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদারকে খুন করবেন। এটুকু আমরা তথ্য এবং অনুমানের ওপর নির্ভর করে বলতে পারি। বাকিটা শোনা যাক স্বয়ং মি. কুচবিহারীর নিজের মুখে। নিন, মি: কুচবিহারী, শুরু করুন।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল কুচবিহারী। মুখ তুলে শহীদের দিকে তাকিয়ে সে কলতে লাগল, হ্যাঁ, আমি পাপ করেছি। টাকার লোভ আমাকে উন্মাদ করে দিয়েছিল। তাই প্রচুর টাকা থাকা সত্ত্বেও চোরাচালানে নামি আমি। পাপ করেছি, তার উপযুক্ত শাস্তি আমাকে দিন। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে।’
বলুন।
‘আমার পাপের শাস্তি যেন আমাকেই দেয়া হয়। আমার মেয়ে সুলতা ফুলের মত নিষ্পাপ, পবিত্র। ওর যেন কোন ক্ষতি না হয়••• ||
‘ওর কোন ক্ষতি যাতে না হয় তা আমরা দেখব, সরকার দেখবে।
কুচবিহারী বলল, তাহলে আমি শুরু করি । শরীফ চাকলাদার এবং আজমল রব্বানী আমাকে খুন করবে একথা জানার আগেই আমি ওদেরকে খুন করার প্রস্তাব। দিই নওশেরকে। কিন্তু নওশের পরদিন আমাকে বলে যে ওরাও নাকি আমাকে খুন। করতে চায়, সে জানতে পেরেছে। যে টাকায় ওদেরকে খুন করতে রাজি হয়েছিল নওশের, তার চেয়ে বেশি টাকা দাবি করে সে। বেশি টাকা দিতেও রাজি হই
কুয়াশী ৪৩
আমি। কিন্তু পরে ফোনে নওশের আমাকে জানায় যে আজমল এবং শরীফ নাকি তাকে একই পরিমাণ টাকা দিতে চেয়েছে আমাকে খুন করার জন্যে। আমি নওশেরের চালাকি বুঝতে পারি। ওকে আমি ফোনে বলি যে ওরা যে পরিমাণ টাকা। দেবে বলেছে আমি তারচেয়েও বেশি টাকা দেব। সে যেন বিকেল চারটেয়। বক্সনগরের মন্দিরে হাজির থাকে, আমি টাকা নিয়ে যাব। আমি কিন্তু মনে মনে তখন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি নওশেরকে খুন করার। মন্দিরে যাবার জন্যে বাড়ি থেকে বেরুবার সময় শুনলাম আমার মেয়ে সুলতা ফোনে কথা বলছে উজান চৌধুরীর সাথে। উজান চৌধুরী আমাদের বাড়িতে আসছে একথা বুঝতে পেরে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আমি উজান চৌধুরীর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি বাড়ির পিছনের সিঁড়ির আড়ালে। কয়েক মিনিট পরই উজান চৌধুরী আসে। আমি পিছন থেকে তার মাথায় লোহার রড মেরে অজ্ঞান করে ফেলি। অজ্ঞান দেহটা সকলের অগোচরে আমার গাড়ির পিছনের বনেট তুলে লুকিয়ে রাখি। পরিকল্পনা অনুযায়ী এরপর আমি ফোন করি মিজান চৌধুরীকে।’ | দম নেবার জন্যে থামে কুচবিহারী।
তারপর আবার সে শুরু করে, মিজান চৌধুরী আমাকে সাহায্য করতেন। খুলেই বলি। মূলত ভারত থেকে সোনা আমদানি করাই ছিল আমার পেশা । সোনা নিয়ে আসত একদল লোক পেটের ভিতর করে। মিজান চৌধুরী ডাক্তার। তিনি পেট কেটে সোনা বের করে আবার সেলাই করে দিতেন পেট। এর জন্যে ভাল টাকা দিতাম। এই পেট কাটা এবং সেলাইয়ের কাজ এত বক্সনগরের মন্দিরে। সুতরাং মিজান সাহেবকে ফোন করে মন্দিরে যাবার কথা বলতে তিনি আপত্তি না করে রাজি হয়ে যান। আমরা মন্দিরে যাই। কিন্তু মন্দিরে গিয়ে আমি দেখি নওশের আবদুল্লাকে
কে খুন করে রেখে গেছে।’
তারপর?
কুচবিহারী বলে, ‘তখনও আজমল এবং শরীফকে খুন করার পরিকল্পনা আছে আমার। নওশেরের লাশ দেখে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। নওশেরের লাশের মুখটা আমি ছোরা দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করলাম, যাতে কেউ চিনতে না পারে। আমার কাপড় চোপড়, আঙটি, ঘড়ি পরালাম নওশেরের গায়ে, কব্জিতে, আঙুলে। তারপর লাশটা ফেলে দিয়ে এলাম রমনা পার্কের পাশে। এদিকে উজানকে বন্ধ করে রাখলাম একটা কামরায়। তার একটা আঙুল আগেই কেটে নিয়েছিলাম। সেটা মিজান সাহেবকে দেখিয়ে বললাম প্লাস্টিক সার্জারী করে আমার চেহারা বদলে দিতে হবে। তা না হলে তার ছেলেকে খুন করব আমি। এর পরের ঘটনা তো সবই জানা আপনাদের।’
শহীদ বলল, “নিজের চেহারা বদলে ফেলার পিছনে আপনার উদ্দেশ্য কি ছিল? কাঞ্চনবিহারী ওরফে কুচবিহারী বলল, ‘উদ্দেশ্য ছিল আজমল রব্বানী এবং
ভলিউম ১৫
শরীফ চাকলাদারকে খুন করা। কুচবিহারী মরে গেছে জানলে ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে উঠত। সেই সুযোগে ওদেরকে আমি খুন করতাম কৌশলে। কেউ আমাকে সন্দেহ করতে পারত না। ওদেরকে খুন করার জন্যে আমি ভলিকে কয়েকবার ফোনও করি।’
কামাল বলল, শহীদ, তুই যে সিগারেট কেস আর ছোরা পাঠিয়েছিলি আজ দুপুরে সে দুটোর ছবি তুলে হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। দুটো ছাপ একই লোকের হাতের।’
শহীদ বলল, সিগারেট কেসটা আমি নিয়ে গিয়েছিলাম আজ দুপুরে সুলতাদের বাড়িতে। কাঞ্চনবিহারীকে সিগারেট অফার করি। কেসটা সে, ধরে। আমার উদ্দেশ্যই ছিল ওর হাতের ছাপ সংগ্রহ করা। এর আগে মি. মিজান চৌধুরীর কাছ থেকে সবকথা শুনি আমি। আর ছোরাটা পেয়েছি মন্দির থেকে। ছোরা এবং সিগারেট কেসের হাতের ছাপ একই লোকের অর্থাৎ কাঞ্চনবিহারীর হওয়ায় একথা, প্রমাণ হয়ে গেল যে কুচবিহারী এবং কাঞ্চনবিহারী একই লোক। এ-কথা যদি তিনি অস্বীকারও করতেন তাতেও কোন ক্ষতি হত না। আমরাই প্রমাণ করতে পারতাম।
কামাল হঠাৎ বলে উঠল, ‘একটা ব্যাপারে একদম কথা বলছিস না তুই, শহীদ। আজমল রব্বানীর খুনী কে? কে খুন করেছে সাতজন অজ্ঞাত পরিচয় লোককে?’
মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, সাতজন লোককে অবশ্যই খুন করেছে কুয়াশা।’
। কুয়াশা ওদেরকে খুন করেননি। তার সাক্ষী আমি, সকলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল বক্তার দিকে। দেখা গেল হাসতে হাসতে সুদর্শন তরুণ রাসেল ঢুকছে
অফিসরূমে।
‘এসো, রাসেল।’ কামাল হাসিমুখে কাছে ডাকল। কামাল এবং শহীদের মাঝখানের চেয়ারে গিয়ে বসল রাসেল। বলল, কুয়াশার পিছনে আমি ছায়ার মত লেগে ছিলাম। আমি জানি কুয়াশা ওদেরকে খুন করেননি।
কিন্তু, রাসেল, মাইবয়, কুয়াশার নিজের তৈরি ঘড়ি পাওয়া গেছে লাশগুলোর সাথে, তা কি তুমি জানো?’
ঘড়ি পাওয়া গেছে লাশের সাথে মি. কুয়াশার?’ চিন্তিত দেখাল একটু রাসেলকে। কিন্তু এক মুহূর্ত পরই উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখমুখ। বলল, কিন্তু এই ঘড়ি পাবার একটা ব্যাখ্যা আছে। ওঁর ঘড়ি পাওয়া গেছে মানে এই নয় যে ওদেরকে কুয়াশা খুন করেছেন।’
শহীদ বলল, সব খুলে বলো, রাসেল।
রাসেল বলল, ‘প্রথম থেকেই তাহলে শুরু করি। মি. কুচবিহারী যে চোরাচালানের কাজে লিপ্ত একথা মি. কুয়াশা সন্দেহ করছিলেন বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। মি. কুচবিহারীর পিছনে লোক লাগান তিনি। নিজেও চোরাচালানের
৪-কুয়াশা ৪৩
৪৯
ব্যবসার সাথে জড়িত এই পরিচয় দিয়ে তিনি নিজেও মি. কুচবিহারীর সাথে দেখা করেন। কুয়াশার উদ্দেশ্য ছিল মি. কুচবিহারী কোন্ পথে, কোন পদ্ধতিতে চোরাচালান করেন তা অবগত হওয়া। কিন্তু হঠাৎ মি. কুচবিহারী নিহত হন। এরপর কুয়াশা মি, আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদারের সাথে দেখা করেন। এখানেও তিনি নিজের পরিচয় দেন একজন চোরাচালানী হিসেবে। ওদের দুজনকে বেশ কয়েক রকম মূল্যবান জিনিস উপহার দেন তিনি। তার মধ্যে কুয়াশার আবিষ্কৃত দুটো ঘড়িও ছিল। যাই হোক, মি. আজমল রব্বানী এবং মি. শরীফ চাকলাদার কুয়াশাকে একজন সমব্যবসায়ী হিসেবে বিশ্বাস করেন এবং তাকে বলেন যে মে মাসের ছয় তারিখে ঢাকা এয়ারপোর্টে রাত বারোটায় সোনা নিয়ে সাতজন লোক আসছে, কিন্তু সার্চ করেও সোনাগুলো তাদের কাছ থেকে বের করা যাবে না, এমনই বিশেষ কৌশলে নিখুঁত পদ্ধতিতে মাল আনা-নেয়ার দায়িত্ব সম্পন্ন করেন তারা। নির্দিষ্ট সময়ে কুয়াশা ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সাতজন লোককে হাইজ্যাক করেন, লোকগুলোকে সার্চ করার জন্যে। হাইজ্যাক করে কুয়াশা লোকগুলোকে তার আজিমপুরের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যান। সেখানে লোকগুলোকে সার্চ করেন কুয়াশা। অনায়াসেই তিনি জানতে পারেন যে লোকগুলোর পেটের ভিতর সোনা। আছে। যা জানার জেনে নিয়ে তিনি ছেড়ে দেন ওদেরকে। আমার সামনে দিয়ে লোকলো কুয়াশার ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে যায়।’
তাহলে লোকগুলোকে খুন করল কে? মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন।
রাসেল কামালের দিকে ফিরে বলল, মি. মিজান চৌধুরীর চেম্বারে চুরি হয়েছে, শুনেছি। শুনেছি হাতের ছাপও পাওয়া গেছে। এদিকে মি. আজমল রব্বানীর মদের বোতলেও পাওয়া গেছে হাতের ছাপ। আমি জানতে চাই দুটো হাতের ছাপ কি একই লোকের?’
হা,’ বলল কামাল। । পকেট থেকে একটা রুমালে জড়ানো কাঁচের গ্লাস বের করল রাসেল। বলল, এই গ্লাসে একজন লোকের হাতের ছাপ আছে। এর সাথে যদি মদের বোতল এবং মি. মিজান চৌধুরীর চেম্বারে পাওয়া হাতের ছাপের মিল হয় তাহলে আমি বলে দিতে পারব কে মি. মিজান চৌধুরীর চেম্বার থেকে চুরি করেছে, কে মি. আজমল রব্বানীকে খুন করেছে এবং কে সাতজন লোককে হত্যা করেছে।’ | বোতলটা রাসেলের কাছ থেকে নিয়ে একজন ইন্সপেক্টরকে দিয়ে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দিলেন মি. সিম্পসন।
শহীদ জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি গ্লাসটা কোত্থেকে নিয়ে এলে বলো তো?
রাসেল বলল, “ঢাকা এয়ারপোর্টের রিফ্রেশমেন্ট রূমে বসে কুয়াশা এবং এক ভদ্রলোক নাস্তা পানি খাচ্ছেন দেখে এসেছি। কুয়াশার সঙ্গী ভদ্রলোক যে গ্লাসে পানি খেলেন সেই গ্লাসটা সংগ্রহ করলাম ওয়েটারকে দশ টাকা ঘুষ দিয়ে। ভদ্রলোকের
৫০
ভলিউম ১৫
৫াতের ছাপ কামাল ভাইয়ের প্রয়োজনে লাগতে পারে মনে করেই এ কাজ করেছি, আমি। কাজটা করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। তা না হলে আরও তাড়াতাড়ি আসতে পারতাম। যাক, এবার আমাকে যেতে হয়।’
কোথায় যাবে আবার তুমি?’ জানতে চাইলেন মি. সিম্পসন। রাসেল বলল, কেমন যেন খুঁত খুঁত করছে মনটা। কুয়াশা ভদ্রলোককে নিয়ে কিা এয়ারপোর্টে বসে আছেন। কেন? নিশ্চয়ই এর পিছনে কোন কারণ আছে। কারণটা জানা দরকার।’
শহীদ বলল, “আজও কি মাল আসছে চোরাচালান হয়ে?
এবার কথা বলে উঠল কুচবিহারী, আজ এগারো তারিখ না? হ্যাঁ, আজও মাল আসবে। কিন্তু মাল আসার কথা আর কারও তো জানার কথা নয়।’’
আপনার ব্যবসার অংশীদাররা অত বোকা নয়, মি. কুচবিহারী। আপনি না জানলে কি হবে, তারা সব খবরই জানত। আপনি যে তাদেরকে ঠকাচ্ছেন তার প্রমাণ পেয়েই তারা আপনাকে খুন করার ষড়যন্ত্র করেছিল।
শহীদ কথাগুলো বলে তাকাল রাসেলের দিকে, শুনলে তো, আজও মাল আসছে।’
রাসেল কুচবিহারীর দিকে তাকাল, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না?’
হেসে উঠল শহীদ। বলল, তোমার না চেনারই কথা। ওঁর নাম মি. কুচবিহারী।
কিন্তু••• শহীদ বলল, প্লাস্টিক সার্জারী করে চেহারা বদলে ফেলেছেন। রাসেল কুচবিহারীকে প্রশ্ন করল, ‘ক’টার সময় মাল আসছে?
সন্ধ্যা সাতটায়। পঞ্চাশ পাউণ্ড সোনা আসছে দুটো কাঠের বাক্সে। কোড ওয়ার্ড ডেলিভারী।’ …
ঘড়ি দেখল শহীদ, কামাল, মি. সিম্পসন এবং রাসেল একযোগে।
কথা বলে উঠল রাসেল, সময় খুব কম। এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না। মাত্র পনেরো মিনিট বাকি সাতটা বাজতে।
মি. সিম্পসন উঠে দাঁড়ালেন, ‘পৌঁছুতেই হবে, রাসেল। কুয়াশার উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পেরেছি। সোনাগুলো সে চায়। কিন্তু আমরা তার আশা পূরণ হতে দেব না। চলো, রাসেল।
এমন সময় ল্যাবরেটরি থেকে ফিরে এল ইন্সপেক্টর। সে জানাল, ‘তিনটে হাতের ছাপই এক লোকের।
রাসেল বলল, তাহলে প্রমাণ হয়ে গেল যে মি. মিজান চৌধুরীর চেম্বার থেকে বিস চুরি করেছিল শরীফ চাকলাদার। সে-ই খুন করেছে সাতজন সোনা বহনকারী, লোককে। মি. আজমল রব্বানীর মৃত্যুর জন্যেও দায়ী সে-ই।’
নিয়াশা ৪৩
৫১
কামাল বলল, তোমরা সবাই যাও। আমি একটু পরে আসছি।
মি. সিম্পসন বললেন, ‘আকরমকে গ্রেফতার করো, ইন্সপেক্টর। গ্রেফতার ক মি, কুচবিহারীকেও। ডলিকেও গ্রেফতার করো। ব্ল্যাকমেলিং করার জন্যে নও, আবদুল্লাকে সাহায্য করত ও। মিস সুলতা, আপনি যেতে পারেন।’
শহীদ তাকাল মিজান চৌধুরীর দিকে।
মি. সিম্পসন বলেই চলেছেন, মি: মিজান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ আর ওকেও গ্রেফতার করো, ইন্সপেক্টর। অফিসরূমের দু দিকের কোণ থে কনস্টেবলরা এগিয়ে এল হাতকড়া নিয়ে ইন্সপেক্টরের ইঙ্গিতে।
রাসেল বলে উঠল, আর দেরি করলে কুয়াশাকে বাধা দেয়া সম্ভ হবে না, সিম্পসন।’
মি. সিম্পসন উঠে দাঁড়ালেন। শহীদ বলল, চলো।
এয়ারপোর্টের গেটের সামনে এসে থামল মি. সিম্পসনের জীপ।
রাসেল বলল, আপনারা জীপেই বসে থাকুন। আমি রিফ্রেশমেন্ট রূমে যাচি দেখে আসি ওরা কি করছে।
মি. সিম্পসন বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরো। দেরি কোরো না।’
রাসেল বলল, ওদের দুজনের কাউকে দেখামাত্র আটকাবেন। তাড়াতাি ফিরে আসব আমি।’
চলে গেল রাসেল। ওরা জীপে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।
এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের প্রকাণ্ড গেট দিয়ে লোকজন যাচ্ছে আসছে। কড়া । রেখেছেন মি. সিম্পসন গেটের দিকে। ইউরোপিয়ান, আমেরিকান নিগ্রো, ভারত নেপালী, ইরাকী, বার্মীজ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতের লোক বেরিয়ে আসছে ভি থেকে। ট্যাক্সি নিয়ে যে যার গন্তব্যস্থানের দিকে ছুটছে।
অস্থির হয়ে উঠল শহীদ। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে ও। রাসেল গেছে । নেরো মিনিট হয়ে গেল। এখনও ফিরছে না কেন সে?
এদিকে রাসেল রিফ্রেশমেন্ট রূমে ঢুকে দেখে ভয়ানক গণ্ডগোল। সং ল্যাভেটরির দরজার সামনে লোকজনের ভিড়। সবাই উত্তেজিত। ভিড় ঠে ল্যাভেটরির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাসেল। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল যে আধঘণ্টা আগে দুই ভদ্রলোক ল্যাভেটরিতে ঢুকেছেন। অনেে দেখেছেন ঢুকতে। কিন্তু এখনও তারা বের হচ্ছেন না। দরজা ভিতর থেকে ক এত ডাকাডাকি, চেঁচামেচি হচ্ছে অথচ ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। রহস্য কাণ্ড তাতে আর সন্দেহ কি! ৫২
ভলিউম
কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করে দরজা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল রাসেল। সকলের মিলিত চেষ্টায় ভেঙে ফেলা হলো দরজা।
ল্যাভেটরির মেঝেতে দেখা গেল শরীফ চাকলাদারের দেহ। দেহটার পাশে বসে পরীক্ষা করল রাসেল। মরেনি, জ্ঞান হারিয়েছে মাত্র। বুঝতে বাকি রইল না। রাসেলের এ-কাজ কুয়াশার।
জানালার গ্রিল খুলে অন্য পথে ল্যাভেটরি থেকে পালিয়েছে কুয়াশা। রাসেল শঙ্কিত হয়ে উঠল। ইতিমধ্যে কুয়াশা হয়তো সোনা নিয়ে কেটেও পড়েছে।
ভিড় কমাবার অনুরোধ করে রাসেল উপস্থিত লোকজনদেরকে বলল, ‘অজ্ঞান এই ভদ্রলোককে আমি চিনি। পুলিস একে খুঁজছে। গেটের বাইরে।
শহীদ, মি, সিম্পসন এবং কামালকে দেখা গেল এগিয়ে আসতে।
কামাল পুলিশ বাহিনী নিয়েই এসেছে। ফলে ভিড় সরাতে দেরি হলো না। রাসেলের কাছ থেকে সব কথা শুনে মি. সিম্পসন এবং কামাল গোটা এয়ারপোের্ট বিন্ডিংটা প্রায় অবরোধ করে ফেলল। শরীফ চাকলাদারের অত্তন দেহটা পাঠিয়ে দেয়া হলো পুলিস ভ্যানে।
আধঘণ্টা ধরে খোঁজাখুঁজির পরও কুয়াশার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। সে । যেন মিলিয়ে গেছে বাতাসের সাথে।
রাসেল হতাশ গলায় বলল, ভেগেছেন তিনি!
কিন্তু সোনাগুলো সে পানে কিভাবে? যারা নিয়ে এসেছে তারা কি এতই বোকা যে কুয়াশা চাইলেই তাকে দিয়ে দেবে?’
রাসেল বলল, কুয়াশা নিশ্চয়ই শরীফ চাকলাদারের কাছ থেকে কোড ওয়ার্ড জেনে নিয়েছিলেন। কথা বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা।
রাসেল বলল, আশ্চর্য! কুয়াশা সকলের চোখে ধুলো দিয়ে কোন দিক দিয়ে পালালেন বলুন তো? আচ্ছা, আমি আপনাদেরকে রেখে ভিতরে ঢুকলাম যখন তারপর গেট দিয়ে কুয়াশা বেরিয়ে যাননি তো?
| শহীদ বলল, না।
মি. সিম্পসন বললেন, ‘গেটের দিকে আমি নজর রেখেছিলাম। দেশী লোক খুব মই দেখেছি। যারা বেরিয়ে গেছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বিদেশী।
রাসেল বলল, “মি. কুয়াশা কিন্তু বিদেশীদের ছদ্মবেশ নিয়েই আছেন। তারমানে!’
রাসেল বলল, কেন, আপনারা জানেন না? কুয়াশা ক’দিন থেকেই বার্মীজদের পোশাক পরে আছেন। মি. কুচবিহারী, মি. আজমল রব্বানী এবং শরীফ, চাকলাদারকে বার্মীজ হেসেবেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠলেন মি. সিম্পসন।
কুয়াশা ৪৩ |
রাসেল তাকিয়ে রইল।
মি. সিম্পসন বললেন, ‘একজন লম্বা-চওড়া বার্মীজকে আমি গেট দিয়ে বেি আসতে দেখেছিলাম। লোকটার হাতে দুটো রঙের বাক্স ছিল।’
রাসেল বলে উঠল, “তিনিই কুয়াশা! কী সাংঘাতিক, আপনাদের চো সামনে দিয়ে চলে গেলেন, অথচ•••।’
শহীদ বলল, “ছি ছি ছি! এতটা অমনোযোগী হওয়া আমাদের উচিত হয়নি।’ | থানায় জ্ঞান ফিরে এল শরীফ চাকলাদারের। আজমল রব্বানীকে খুন ক কথা স্বীকার করল সে। স্বীকার করল সাতজন লোককে খুন করার কথাও। সাত লোককে খুন করার কারণ হিসেবে সে যা বলল তাতে তার নিষ্ঠুর, দয়ামায়া প্রকৃতির পরিচয়ই ফুটে ওঠে।
, কুয়াশা লোকগুলোকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়েছিল, পরে তাদেরকে ছে দেয়। ছাড়া পেয়ে লোকগুলো রব্বানীর বাড়িতে যায়। লোকগুলো জানায় যে ৫ কুচবিহারীকে না পেয়ে তাদের কাছে এসেছে। কারণ ওরা জানে কুচবিহা বিজনেস-পার্টনার তারা। কুয়াশা লোকগুলোকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ছেড়ে দে। শরীফ চাকলাদার সন্দেহ করেছিল এই ছেড়ে দেয়ার পিছনে নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র আর হাইজ্যাকার সাতজন লোককে নিজের দলের হয়ে কাজ করাতে রাজি ২ ফেলেছে, ভবিষ্যতে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে সন্দেহে সে খুন । সবাইকে। এ ব্যাপারে তার সাথে একমত হয়নি আজমল রব্বানী। সাত লোকের পেট থেকে উদ্ধার করা সোনার ভাগ দিতে হবে আজমল রব্বানীকে কথা ভাবতেই খারাপ লাগছিল তার। আরও একটা ভয় তার ছিল। সাত লোককে খুন করার ব্যাপারে আজমল রব্বানী ভবিষ্যতে তাকে ব্ল্যাকমেইল কর পারে। এই দুই কারণে সে তাকে খুন করে। আজমল রব্বানীর জলসাঘ আলমারিতে রাখা মদের বোতলে বিষ মিশিয়ে রেখে এসেছিল সে।
শরীফ চাকলাদারকে প্রশ্ন করে আরও জানা গেল যে ভারত থেকে আজ স সাতটায় যে মোন এসেছে তা তরল এবং রঙিন। কাঠের বাক্সের ভিতর দু রঙের টিনে থাকবে এই তরলীকৃত সোনা।
| রাত দশটায় একজন লোক দেখা করতে এল মি. সিম্পসনের সাথে। লো একটা চিঠি নিয়ে এসেছে। চিঠিটা কুয়াশা পাঠিয়েছে।
সে লিখেছেঃ
মি. সিম্পসন, পত্র বাহকের হাতে দুটো টিন পাঠালাম। এ দুটো টিন শরীফ চাকলাদারের লোক ভারত থেকে আজকের সন্ধ্যা সাতটার ফ্লাইটে নিয়ে এসেছে। ভিতরে তরল সোনা ছিল। বের করে নিয়েছি আমি। খালি টিন দুটো পাঠালাম টিনের গায়ে যে তরল সোনা এখনও এক-আধটু লেগে আছে তা পরীক্ষা করার জন্যে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন কি কি রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে সোনাকে তরল।
ভলিউম
অবস্থায় রাখা যায়। | সোনা বের করে নিয়েছি বলে রাগ করবেন না। উদ্ধারের চেষ্টাও করবেন না দয়া করে। ধানমণ্ডির পাশে যে বস্তিগুলো আছে সেখানে বাস করে কিছু সম্বলহীন, নির্যাতিত মানব সন্তান। ওদের দুঃখ সহ্য করা যায়
। ওদেরকে অল্প-স্বল্প সাহায্য করার চেষ্টা করি সুযোগ পেলেই। আজও সুযোগ পেয়েই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি। মোট সোনার মূল্য হিসেব করে যে টাকা হয় সেই পরিমাণ টাকা ওদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছি। আজ ওরা সারারাত ঘুমাবে না। আনন্দে। আগামীকাল ওরা পেট ভরে খেতে পাবে। রোগে ভুগছে যারা তারা ওষুধ কিনবে। যারা প্রায় উলঙ্গ থাকে তারা কাপড় চোপড় কিনবে। আশা করি ওদের ওপর জুলুম করবেন না। ওরা দোষী নয়। সব দোষ আমার। পারলে আমাকে ধরার চেষ্টা করুন। হাতে নাতে।
আমাকে ধরার চেষ্টা যে আপনি এবার পুরোদমে করবেন সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখছি। এই চিঠিটা আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের কথা চিন্তা করবেন
। কারণ আর কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যাবে লেখাগুলো। সাদা হয়ে যাবে পাতাটা। শীঘ্রি শেষ অংশটুকু পড়ে হাত থেকে ফেলে দিন কাগজটা। একটু পরেই আগুন ধরে যাবে এতে।
আরও একটা কথা বলে শেষ করব আমার বক্তব্য। যে সাতজন। লোকের লাশ পাওয়া গিয়েছে তাদেরকে আমি খুন করেছি বলে আপনার বিশ্বাস, কিন্তু তা সত্যি নয়। ওদেরকে হাইজ্যাক করি আমি তা ঠিক। কিন্তু ছেড়ে দিই। কেন জানেন? কারণ ওদের সাথে কথা বলে, ওদেরকে বুঝিয়ে উপদেশ দিয়ে সৎ পথে ফেরত আনার কোন উপায় নেই। ছেড়ে দিয়েছিলাম, নিজেদের পাপের ফল নিজেরাই ভোগ করুক গিয়ে–এই মনে করে। জানতাম ধরা ওদের পড়তেই হবে, শান্তিও নিতে হবে মাথা পেতে। কিন্তু বজ্রপাতের মতই বড় দ্রুত ঘটে গেল শাস্তিটা। বড় নির্মম। আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি শরীফ চাকলাদার ওদেরকে এভাবে খুন করে। ফেলবে।
যাই হোক, আজ এখানেই শেষ করছি।
শুভেচ্ছান্তে-কুয়াশা।’ চিঠিটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই লক্ষ করলেন মি. সিম্পসন মিলিয়ে যাচ্ছে লেখাগুলো। অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছেন তিনি কাগজটার দিকে। এমনি সময় দপ করে আগুন ধরে গেল কাগজটায়।
খসে পড়ে গেল কাগজটা তার হাত থেকে।
Leave a Reply