৪২. স্বর্ণ চালান ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪২
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪
এক
পীচঢালা সরল রাস্তাটা সোজা রূপালী গ্রামের দিকে চলে গেছে। রূপালী গ্রামের পরই ক্যান্টনমেন্ট। কিন্তু সেদিকে অর্থাৎ রূপালী গ্রামের দিকে না গিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিল সাদা রঙের হাল মডেলের টয়োটা করোলা।
পীচঢালা রাস্তার দুপাশে কলোনি। কলোনি এলাকা শেষ হবার পর একপাশে খোলা মাঠ, অপর পাশে পাশাপাশি কয়েকটা বড় ফ্যাক্টরী-কারখানার উঁচু প্রাচীর। টয়োটা করোলা ছুটে চলেছে ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল বেগে।
পনেরো মিনিট পর বক্সনগরে পৌঁছল গাড়িটা। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ঘরে ফেরার পালা এখন পাখিদের। গাছে গাছে জমায়েত হয়েছে বেশিরভাগ, কিচিরমিচির শুরু– করেছে। টয়োটা করোলা এগিয়ে চলেছে এবার মেঠো পথ ধরে। দু’পাশের ঝোঁপ ঝাড়, ছোট-বড় গাছ। আরও খানিক আগে দু’পাশের জঙ্গল বেশ ঘন। রাস্তা উঁচুনিচু। কোথাও নেমে গেছে ঢালু হয়ে, আবার ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে। ছোটখাট মাটির ঢিবিও অনেকগুলো। ঢিবিগুলোর পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে পথ। এখান থেকে পথ ক্রমশ সরু হয়ে গেছে।
| ব্রেক কষে গাড়ি থামাল কুচবিহারী । অভ্যাসবশত রিয়ার ভিউমিররে একবার ‘তাকাল। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। তারপর গাড়ির স্টার্ট বন্ধ না করেই গাড়ি
থেকে নামল। পিছন দিকে তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।
মিনিট দুয়েক পিছন দিকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হলো কুচবিহারী। কেউ তাকে অনুসরণ করে আসেনি এখানে। নিশ্চিন্ত হয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসল সে।
রাস্তা থেকে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পঁচিশ তিরিশ গজ দূরে গিয়ে আবার ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাল সে। এবার স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে নিচে নেমে গাড়ি লক করে পায়ে হেঁটে-মেঠো পথে ফিরে এল।
পঞ্চাশোত্তীর্ণ কুচবিহারীর গায়ের রঙ ঠিক কালো না, অনেকটা জ্যোতিহীন, লাবণ্যহীন ছাইয়ের মত। প্রকাণ্ড মাথা। ছোট ছোট হাত। প্রকাণ্ড শরীর । দেখে মনেই হয় না টাকার একজন বিরাট ধনী লোক সে। পরনে প্যান্ট-শার্ট। খুব একটা দামী কাপড় কোনকালেই পরে না সে। কৃপণ হিসেবে তার বদনাম আছে।
মেঠো পথ ধরে কুচবিহারী এবার পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চলল। খানিকদূর যাবার পর পথটা শেষ হলো। পথের শেষে আরও ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সুরু কুয়াশা ৪২
১০৭
একটা পথের চিহ্ন সোজা চলে গেছে বহুদূর।
হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে কুচবিহারী চলার গতি দ্রুত করল। মিনিট পাঁচেক দ্রুত তালে হাঁটার পর ডান দিকে মোড় নিয়ে আর একটা সরু পথের চিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চলল।
| সূর্য অস্ত গেছে। কিন্তু এখনও সন্ধ্যার কালিমা চারদিকে ঘড়িয়ে পড়েনি। দিনের শেষ আলোটুকু থাকতে থাকতেই একটা অতি প্রাচীন দোতলা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়া।
কবে, কতযুগ আগে কে এই গভীর জঙ্গলে মন্দিরটি তৈরি করেছিল তা আজ। আর কেউ বলতে পারে না। খুব কম লোকই জানে এই মন্দিরের কথা। বক্সনগরের এই গভীর ঘন জঙ্গলে যে প্রাচীন একটা মন্দির আছে তা অনেকে কল্পনাই করতে পারে না। বক্সনগরের আশপাশের গ্রামের মানুষরা মন্দিরটা সম্পর্কে জানলেও ভয়ে তারা দিনের বেলাও এদিকে আসে না।
মন্দিরটা দেখলে ভয় লাগারই কথা। এককালে বেশ সৌন্দর্য ছিল এই মন্দিরের। কিন্তু বড় এবং ছোট তিনটে মিনারই ধসে পড়েছে। মন্দিরের দেয়ালের চুনবালি-সুরকি খসে গেছে, প্রাচীন কালের ছোট আকারের লাল লাল ইটগুলো যেন দাঁত বের করে ভেঙচাচ্ছে । মন্দিরের ভিতরে এবং বাইরে মানুষ সমান উঁচু ঝোঁপঝাড় আগাছা এবং ঘাস জন্মেছে। দেয়ালে, পাঁচিলে শ্যাওলা জন্মেছে। বড় গম্বুজটার ভাঙা অংশের গা ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে একটা বট গাছ। মন্দিরটার দিকে তাকালে গা ছমছম করে ওঠে। প্রকাণ্ড একটা গেট ছিল ভিতরে। কিন্তু হাহা করছে গেটটা । কাঠের ভারী পাল্লা দুটো পোকায় খেয়ে ফেলেছিল, তারপর বাতাসে খসে পড়ে পচে গেছে।
মন্দিরের উঠান পেরিয়ে উঁচু বারান্দা। বারান্দার উপর উঠেই একটা দরজা। দরজা টপকে ভিতরে পা দেবার মত দুঃসাহস খুব কম লোকেরই হবে। দোরগোড়া থেকেই দেখা যায় কালীমূর্তিটা। প্রকাণ্ড একটা লাল জিভ বের করে মা কালী বড় বড় চোখ বের করে সরাসরি দরজার দিকেই তাকিয়ে আছেন। দোরগোড়ায় গিয়ে যে দাঁড়াবে তার সাথেই চোখাচোখি হবে কালীমূর্তির’।
| কালীমূর্তির পায়ের সামনে পড়ে আছে একটা প্রকাণ্ড ভোজালি। সে ধার নেই ভোজালিটায়, মরচে ধরেছে বহুকাল আগেই। মেঝের কালচে রঙ দেখে বোঝা যায়, রক্তের স্রোত বয়ে যেত এককালে এখানে। নরবলি হত ধুম-ধামের সাথেই। | কুচবিহারী দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে কালীমূর্তির দুই চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ একইভাবে তাকিয়ে থাকার পর দু’হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে কপালে তুলল সে। চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করে কিছু বলল খানিকক্ষণ । তারপর সরে গেল দরজার সামনে থেকে।
বারান্দা ধরে সিঁড়ির দিকে এগোল কুচবিহারী। কাঠের সিঁড়ি। কাঠে পোকা ধরেছে, ধুলো জমেছে। কুচবিহারী ভারী শরীরটা নিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে.
১০৮
ভলিউম ১৪
উপরের বারান্দায় উঠে এল। | দোতলায় তিনটে মাত্র কামরা। দুটো কামরা খোলা হয় না। দরজা লাগানো বড় বড় তালায় মরচে ধরেছে। শেষ কামরাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুচবিহারী । এই কামরার দরজায় নতুন একটা তালা ঝুলছে। পকেট থেকে চাবি বের করে তালাটা খুলল কুচবিহারী।
, কামরাটা যে এমন সুন্দরভাবে সুসজ্জিত তা বাইরে থেকে কল্পনাও করা যায়
। ম্প্রিঙের খাট, সেগুন কাঠের আলমারি, টেবিল, চেয়ার, আলনা, ড্রেসিং টেবিল প্রভৃতি কামরার ভিতর রয়েছে। রয়েছে একটা ফোন। বহু টাকা খরচ করে কারও মনে কোন রকম সন্দেহ জাগার কোন সুযোগ না দিয়ে কয়েক বছর আগে এই মন্দিরে ফোন নিয়েছিল সে। ইলেকট্রিসিটিও আনিয়েছিল সে-সময়। কিন্তু ইলেকট্রিক আলো জ্বালে না কুচবিহারী। কারও মনে কোন সন্দেহ সৃষ্টি হোক তা সে চায় না। ইলেকট্রিক আলো বহু দূর থেকে দেখা যায় তা সে জানে। :
জানালা তিনটে খুলে দিয়ে টেবিলের সামনে এসে দঁাড়াল কুচবিহারী । পকেট থেকে বের করল একটা রূপের কৌটা, সিগারেট কেস, একশো টাকা নোটর একটা বাণ্ডিল, এবং দেশলাই।
সন্ধ্যা নেমেছে। কামরার ভিতর অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। দুটো হ্যারিকেন জ্বালাল কুচবিহারী। ড্রয়ার থেকে একটা পাঁচ ব্যাটারি টর্চ বের করে রাখল টেবিলের উপর। তারপর একটা হ্যারিকেন নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
বারান্দায় এসে জঙ্গলের দিকে এক দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। বারান্দার একটা ইটের থামের সাথে হ্যারিকেনটা ঝুলিয়ে দিয়ে কামরার ভিতর ফিরে
এসে গায়ের শার্টটা খুলে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসল আস্তে আস্তে।
খানিক পর রূপোর কৌটা খুলে দুখিলি পান গালে পুরল কুচবিহারী। পান খেতে খেতে, হাত ঘড়িটার দিকে তাকাল সে। সাতটা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই। টাকার বাণ্ডিলটা তুলে রবারের বাঁধনটা খুলে নোটগুলো ধীরে সুস্থে গুণতে লাগল সে এবার।
একশো টাকার মোট চল্লিশটা নোট। চার হাজার টাকা। পান চিবাতে চিবাতে কান খাড়া করে কিছু যেন শোনার চেষ্টা করল কুচবিহারী । ভুল হয়নি তার। কাঠের সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছে। কেউ উঠে আসছে উপরে।
| চেয়ার ত্যাগ করে কামরা থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এল কুচবিহারী। সিডি টপকে বারান্দায় পা দিল একজন লম্বা-চওড়া লোক। হ্যারিকেনের স্বল্প আলোয় দেখা গেল নবাগত লোকটার পরনে লুঙ্গি এবং শার্ট। কুচবিহারীর মতই স্বাস্থ্য তার।
কুচবিহারী লোকটাকে দেখে থাম থেকে হ্যারিকেনটা নামাতে নামাতে বিরক্তির সুরে বলল, আধঘণ্টা দেরি করলে যে, নওশের?’
দাঁত বের করে হাসল নওশের। শব্দ হলো না। হাসলেও তার দু’চোখে সন্দেহের ছায়া পড়েছে। কুচবিহারীর সামনে এসে দাঁড়াল সে। আড়চোখে দেখে কুয়াশা ৪২
১০৯
নিল খোলা দরজা পথে কামরার ভিতরটা।
, এমন সময় আজ ডাকলেন কেন, বিহারী সাহেব?’ নওশের আবদুল্লার গলায়, অভিযোগ।
| দরকার আছে। এসো কামরার ভেতর।
কুচবিহারী হ্যারিকেন নিয়ে কামরার ভিতর ঢুকল। পিছু পিছু দোরগোড়া অবধি এল নওশের। ভিতরে ঢুকতে ইতস্তত করছে সে। তীক্ষ্ণ চোখে কামরার ভিতরটা দেখে নিল সে। কুচবিহারী ছাড়া কামরার ভিতর আর কাউকে দেখতে না পেলেও সন্দেহ দূর হলো না তার। সতর্ক এবং সন্দিহান মন নিয়ে ভিতরে ঢুকল সে।
বসো।’ বসল নওশের একটা কাঠের চেয়ারে ।
‘জায়গাটা ভাল নয়। রাত ছাড়া কি কাজটা হত না? তাছাড়া কি এমন দরকার পড়ল আপনার? | ‘ভয় লাগছে নাকি?’ কথাটা বলে হাঃ হাঃ করে হাসল কুচবিহারী। নওশের আবদুল্লাহর চোখে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। হাসি থামিয়ে কুচবিহারী বলল, হাসছি বড় দুঃখে, বুঝলে নওশের! তোমার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে এমন অসময়ে এখানে তোমাকে ডেকেছি বলে তুমি রীতিমত ভয় পেয়েছ। অথচ ভয় পাবার কথা তোমাকে আমার। আমাকে তুমি ভয় পাবে কেন?’
কর্কশ শোনাল নওশেরের গলা, কে বলল আপনাকে ভয় লাগছে আমার? ওসব বাজে কথা বাদ দিন। আপনি খুব ভাল করেই জানেন দুনিয়ার কাউকে আমি ভয় করি । একথা জানেন বলেই মাসে মাসে চার হাজার করে টাকা দিচ্ছেন আমাকে।’
গভীর এবং বিকৃত হয়ে উঠল কুচবিহারীর মুখ। কিন্তু কোন কথা বলল না সে। চুপ করে বসে রইল নওশেরের দিকে তাকিয়ে। নওশেরও তাকিয়ে আছে তার দিকে।
গভীর ভাবেই কুচবিহারী বলে উঠল, “মাসে চার হাজার টাকা আমার কাছে কিছুই নয়, নওশের। একথাও তুমি জানো।’
তা জানি। তা জানি বলেই চার হাজারের কম দাবি করিনি আমি।’ রূপোর কৌটা থেকে পান ব্বে করতে করতে কুচবিহারী বলল, তোমার টাকা টেবিলের ওপর রয়েছে। পকেটে ভরো। তারপরে আলাপ করব।’
দ্রুত টাকার বাণ্ডিলটা শার্টের সাইড পকেটে ভরে ফেলে নওশের আবদুল্লাহ জানতে চাইল, কিসের আলাপ?
‘বিশেষ একটা আলাপ আছে তোমার সাথে আমার, নওশের। প্রত্যেক মাসের দু’ তারিখে বেলা বারোটার সময় তোমাকে টাকা দেবার জন্যে এখানে আসি আমি। আজ কেন এই সময় এসেছি জানো? ওই আলাপটা করব বলে।’ |
আবার সন্দেহ দেখা দিল নওশেরের চোখে। দ্রুত কামরার চারদিকে আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। দরজার দিকে মুখ করে বসেছে সে ইচ্ছা করেই। ১১০
ভলিউম ১৪
দরজার বাইরে বারান্দাটা অন্ধকারে ঢাকা। সেদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে বলে উঠল, “কি আলাপ? | কুচবিহারী গালে পান পুরে চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞেস করল, ‘খুন খারাবিতে তুমি
অভিজ্ঞ কিনা জানতে চাই আমি, নওশের। | চমকে উঠে বারান্দার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নওশের তাকাল কুচবিহারীর দিকে, তার মানে? কি বলতে চান আপনি, বিহারী সাহেব?’
‘বলতে চাই খুন-টুন করেছ কখনও আগে? নাকি শুধু ব্ল্যাকমেইল করেই জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছ?’,
কেন?’ কি কেন?’ ‘এসব কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন আমাকে আজ?”
দরকার আছে বলেই করছি।’
নওশের ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চাপা গলায় বলল, “দরকারু হলে খুন করতে পারি আমিও। টাকা পয়সার ব্যাপারে গোলমাল করলে আপনাকেও করব।’
না, না-আমাকে নয়! দ্রুত বলে উঠল কুচবিহারী, আমাকে নয়! আমিই খুন করাব। দেখিয়ে দেব কাদেরকে সারাতে হবে। তুমি পারবে কিনা তাই জানতে চাইছি। নওশের তাকিয়ে থাকে কুচবিহারীর দিকে। জবাব দেয় না।
| আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। তবু জিজ্ঞেস করে নিলাম। কুচবিহারী নওশেরের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে।
এতক্ষণ পর একটু যেন স্বস্তি পায় নওশের। পকেট থেকে সিগারেট বের করে প্রায় সে, ‘খুলে বলুন, বিহারী সাহেব।
‘পারবে? রাজি তাহলে?
আগে শুনি।’ •
কুচবিহারীও সিগারেট ধরায়। একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে। টিকটিকিটার খোঁজে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কুচবিহারী বলে, আমার দুই বন্ধু আছে। তারা আমার একটা ব্যবসার অংশীদারও বটে। ওরা আজকাল আমাকে একদম বিশ্বাস করে না। ফলে নানারকম বিপদের আশঙ্কা করছি আমি। বড় দুশ্চিন্তায় আছি, নওশের। এ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হবার একটাই উপায়। ওদেরকে সরিয়ে ফেললেই সব মিটে যায়, মুক্ত হই দুশ্চিন্তা থেকে। কাজটা তোমাকে করতেই হয়। বদলে অবশ্যি আমি তোমাকে সন্তুষ্ট করব। কত টাকা চাও বলো।’
বন্ধুদের পরিচয় দিন। সিগারেটে টান দিয়ে কথাটা বলে নওশের।
‘একজনের নাম আজমল রব্বানী। একে তুমি চিনলেও চিনতে পারো। ডলির স্বামী। ডলির সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক আছে একথা যখন তুমি জানতে পেরেছ তখন নিশ্চয়ই ডলির স্বামীর পরিচয় তোমার অজানা নেই। আর একজনের নাম কুয়াশা ৪২
১১
শরীফ চাকলাদার। এর বউ-ছেলেমেয়ে নেই। বলো এবার, কত টাকা?’,
দুই।
বড় বড় চোখ মেলে তাকাল কুচবিহারী, দুই? দুই হাজার খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে না, নওশের?’
হাজার নয়-লাখ! দুই লাখ। বেশি মনে করলে বেশি। আমার ধারণা দু’জন মানুষের প্রাণের দাম দু’কোটির চেয়েও বেশি। নামমাত্র টাকা চেয়েছি আমি, বিহারী সাহেব। এর কমে পারব না।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। দু’লাখই দেব। কিন্তু কাজটা হতে হবে নিখুঁত। কোনমতে যেন বেঁচে না যায় ওরা। এমন একটা উপায় বের করবে তুমি যাতে ব্যর্থ
হও। পয়লা সুযোগেই যেন খতম হয়ে যায় দুজনেই। আর খুব সাবধানে কাজটা করতে হবে তোমাকে। পুলিস ব্যাটারা শিকারী কুকুরের মত। তোমাকে ধরতে পারলে আমিও ফেঁসে যাব…।’
| অর্ধেক টাকা অ্যাডভান্স করতে হবে আমাকে। বাকি অর্ধেক কাজ শেষ হলে দেবেন। টাকার প্রথম অংশ, অর্থাৎ একলাখ টাকা আমাকে যেদিন দেবেন সেদিন থেকে এক হপ্তার মধ্যে আমি কাজ শেষ করব। আর পুলিস-ফুলিসের ব্যাপারে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। ধরা পড়লে আমার ফাঁসি হবে। আপনার গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না।’
কুচবিহারী বলল, “বেশ, এক লাখ টাকা তোমাকে আমি আগামী কাল দেব। .. বিকেলে, চারটের সময়, এখানে এসো তুমি। আর একটা কথা।
নওশের কথা না বলে তাকিয়ে রইল।
ডলির ব্যাপারে তুমি আর আমাকে এভাবে টানা-হেঁচড়া কোরো না।’
নওশের মাথা নেড়ে আপত্তি করতে যাচ্ছিল। কিন্তু কুচবিহারী বলে উঠল আবার, আগে শোনো। তোমাকে আমি এককালীন এক লাখ দিয়ে দেব। তাহলে হবে তো?’
নওশেরকে চিন্তা করতে দেখা গেল। | কুচবিহারী বলে উঠল, এক হপ্তা পর তুমি যখন ওদেরকে খতম করার দরুন বাকি একলাখ টাকা নিতে আসবে তখনই আরও একলাখ দিয়ে দেব আমি তোমাকে কি বলো?’
| বেশ। তাই হবে। চুটিয়ে প্রেম করে যাবেন, কেউ বাধা দেবে না-তার জন্যে এক লাখ আর বন্ধুদেরকে খুন করার জন্যে দু’লাখ। দাঁত বের করে হাসল নওশের কথাটা বলে।
|
–
।
দুই একই দিন সন্ধ্যায় ধানমণ্ডির রব্বানী ভিলার পাতালপুরীর জলসাগরে জমে উঠেছে নাচ আর গান।
ভলিউম ১৪
।
..
প্লাসে গ্লাসে রঙিন মদ ঢালা হচ্ছে : টুলু ঢুলু চোখে আজমল রপঃ এবং চাকলাদার বাঈজীদের কুৎসিত অঙ্গ ভঙ্গির না দেখতে দেখতে কখনও হল বাহবা চিৎকার জুড়ে গড়িয়ে পড়ছে তাকিয়ার উপর, কখনও পকেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে ছুঁড়ে দিচ্ছে বাঈজীদের দিকে ।
বাকা চোখে রহস্যময় ইঙ্গিত ফুটিয়ে নোটগুলো তুলে নিয়ে নর্তকীরা নত হয়ে সালাম জানাচ্ছে।
আজমল রব্বানী মাঝে মাঝেই মদের নেশায় হাত নেড়ে গলা ফাটিয়ে দেশ করছেন, নাচো, আরও নাচো।’
চারজন নর্তকী নাচছে ।
দুজন বাঈজী বসে আছে আজমল রপানা এবং শরীফ চাকলাদারের দু’পাশে ওদের গ্লাস শূন্য হবার আগেই কানায় কানায় সোমরস দিয়ে ভরে দিচ্ছে যুবতী মেয়ে।
দুটো।
or
A
।
+
|
:
নর্তকীদের পরনে কাপড়-চোপড় নিতান্তই কম। প্রায় উলঙ্গই বলা যায় চার যুবতাকে।
আজমল রব্বানীর বাড়ির এই জলসাঘরে বাইরের কোন লোকের প্রদেশ নিষেধ। তার বেডরূমের আলমারির পিছনে গুপ্ত একটা সিঁড়ি আছে। সেই!ি বেয়ে নিচে নামলে একটা করিডরে পৌঁছানো যায়। করিডরের মে মাথায় এই জলসাঘর। রোজ সন্ধ্যার পর আজমল রব্বানীর, এই জলসাগরে বাসদের আগ ঘটে। শোনা যায় নূপুরের ধ্বনি; তবলার আওয়াজ, খিল খিল হানি রি টুংটাং, এবং মদের গ্লাস ভাঙার ঝন ঝন শব্দ।
| শরীফ চাকলাদারও আগে এই জলসাঘরে প্রবেশ করার অধিকার পে: না : ৫ জলসাঘরের একমাত্র রাজা ছিল আজমল রানা স্বয়ং : কারে সে কল
। একাই সে মদ খেত, বাঈজীদের নাচ দেখত: ক + ইদin; } চাকলাদারের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সে। দুজন এখন দৃক পরিZর : : শরীফ চাকলাদারের সাহায্য তার দরকার। কুচবিহারার বিদ্ধে ব্যবস্থা হতে হলে শরীফ চাকলাদারকে হাত করতে হবে। তাই তাকে এই জলসাঘর আজকাল নিয়ে আসে সে।
| রোজই সন্ধ্যার পর জলসাঘর সরগরম হয়ে ওঠে। অমল রব্বানী বিশ্বাস করে, জীবনটাকে চুটিয়ে উপভোগ করাটাই বড় কথা; এক:: সে মনে প্রাণে বিশ: করে বলেই প্রখ্যাত বাঈজী ঝুমা বাঈকে সে মাস আষ্টেক আগে বিয়ে করেছে। অথচ বিয়ে করার বয়স তার নেই। তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা গেছে আজ পশি বছর আগে। বাহান্ন বছর বয়স, বাড়িতে ছাব্বিশ বছরের যুবক ছেলে, অথচ এক, বাঈজীকে বিয়ে করতে দ্বিধা বোধ করেনি সে। ঝুমা বাঈ এখন ডলি নামে পরিচিত। আজমল রব্বানী নতুন নাম দিয়েছে তার।
| বাঈজী ঝুমা বাঈকে বিয়ে করেও যদি ভদ্র এবং সুন্দর জীবন-যাপন কৰ কুয়াশা ৪২
TT L
[!
আজমল রব্বানী তবু একটা কথা ছিল। ঝুমা বাঈকে বিয়ে করে মাস খানেক সব ভূলে ছিল সে। কিন্তু মাস খানেক কাটার পরই আবার যা তাই। আবার জলসাঘরে ফিরে এল সে। আবার শুরু হলো মদ খাওয়া, বাঈজী নাচানো ।
মদের নেশায় চুর হয়ে নাচ দেখছে ওরা। বাঈজীরা হাসছে। দ্রুত তালে নাচছে তারা। শরীফ চাকলাদার তার পাশে বসা যুবতীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল এক সময়। আজমল রব্বানীর পাশে বসা মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠল শরীফ চাকলাদারের কাণ্ড দৈখে। আজমল রব্বানী তাকাল মেয়েটার দিকে। মেয়েটার গাল টিপে দিয়ে জড়িত কণ্ঠে সে বলে উঠল, কি সুন্দরী, মদ ঢালছ না কেন?’
মেয়েটা গ্লাস ভর্তি করে দিল। গ্লাসটা আজমল রব্বানী মুখের কাছে তুলতেই পাশের কামরা থেকে ভেসে এল বেলের শব্দ, ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
আজমল রব্বানীর অবস্থা জাতে মাতাল তালে ঠিক-এর মত। ফোনের বেল ঠিকই শুনতে পেল সে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে শরীফ চাকলাদারের দিকে।
মেয়েটা কাতুকুতু দিচ্ছে পেটে আর শরীফ চাকলাদার বেদম হাসাছে। বিক্রির রেখা। ফুটল আজমল রব্বানীর কপালে। উঠে দাঁড়াল টলতে টলতে। পাশ থেকে মেয়েটা বলে উঠল, ‘কি হলো, হুজুর!
চুপ রও!’ ধমকে উঠল আজমল রব্বানী। চুপসে গেল মেয়েটা। আজমল রব্বানী টলতে টলতে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
তিন মিনিট পরই ফিরে এল আজমল রব্বানী পাশের কামরা থেকে। জলসাঘরে পা দিয়েই স্পষ্ট গলায় সে আদেশ করল, নাচ থামাও।
সাথে সাথে স্থির হলো বাঈজীদের পা। নাচ থামল, তবলা থামল, নূপুরের শব্দ থামল । কেবল শোনা যেতে লাগল:শরীফ চাকলাদারের বেদম হাসি।
“থামুন!’ বজ্রকণ্ঠে বলে উঠল আজমল রব্বানী। হাসতে হাসতে চাকলাদার তাকাল আজমল রব্বানীর দিকে। তার অগ্নিমূর্তি দেখে মেয়েটার কোল থেকে মাথা তুলে সিরে হায়ে বসার চেষ্টা করল সে। মিলিয়ে গেছে মুখের হাসি।
| আজমল রব্বানী এগিয়ে এল, তোমরা যাও। ফিরোজা বাঈ, ড্রইংরূমে একজন লোক বসে ভ্ৰাছে । তাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে যেয়ো।’
| বিনা বাক্যব্যয়ে বাজার এবং বেলচি জলসাঘর ত্যাগ করে বেরিয়ে গেল। শরীফ চাকলাদারের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাসল আজমল রব্বানী। বলল, কি, শরীফ সাহেব, আউট হয়ে গেছেন নাকি?’
‘ন । ব্যাপার কি বলুন দেখি? হঠাৎ অমন চণ্ডমূর্তি ধরেছিলেন কেন?’
আজিম রব্বানীর নেশা ভেঙে গেছে পুরোপুরি; খানিক আগে বেহেড মাতাল হিল সে তা বোঝাই যাচ্ছে না; মোটা গদীর ওপর বিছানো সাদা ধবধবে চাদরের উপর বসে দু’হাত দিয়ে মাথার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে সে বলল, ‘ওপার থেকে আমাদে ইনফর্মার এসেছে!’
১১৪
ভলিউম ১৪
যাদুমন্ত্রের মত কাজ হলো: কথাটায়। টুটে গেল শরীফ চাকলাদারের নেশা। সিধে হয়ে বসল সে। বলল, তাই নাকি?’
অপেক্ষা করছিল ওরা ক’দিন থেকেই। সীমান্তের ওপার থেকে একজন লোক আসার কথা। লোকটা দূত হিসেবে কাজ করে কুচবিহারীর। গোপনে আমদানি হয়। যেসব জিনিস সে-সব জিনিসের পরিমাণ, সে-সব জিনিস কবে, কিভাবে পৌঁছুবে তা আগে ভাগে জানিয়ে যায় কুচবিহারীকে এই লোক। এই লোকটাকে টাকা দিয়ে আজমল রব্বানী এবং রীফ চাকলাদার বশ করেছে। কুচবিহারীকে যে তথ্য লোকটা
জানাবে তা এদেরকেও জানাবে, জানাবে কুচবিহারীকে জানাবার আগেই।
‘এবার সত্যি সত্যি কুচবিহারীর হারামীপনা প্রমাণ হবে,’ বলল চাকলাদার।
আজমল রব্বানী কথা বলল না। দরজা দিয়ে জলসাঘরে প্রবেশ করল একজন অবাঙালী লোক।
আসুন, আসুন! খবর কি, নানকানীজী?’
নানকানী বচকমল হাড্ডিসার দেহটা নিয়ে দ্রুত মেঝেতে পাতা বিছানার কিনারায় এসে দাঁড়াল। তারপর দুই হাত একত্রিত করে বুক অবধি তুলে একটু নত হয়ে নমস্কার করল। বলল, ‘খবর বহুত ভাল আছে, রাব্বানী আওর চাকলাদার সাব।’
বসো বসো! চাকলাদার, নানকানীকে “তুমি”-ই বলো।’
নানকানী বিছানার কিনারায় বসল। ঢোলা সালোয়ার এবং কোর্তায় রোগা পটকা দেহটা: ঢাকা তার। ট্রের ওপর রাখা মদের বোতল এবং গ্লাসের দিকে চোখ পড়তে আনন্দে চকচক করে উঠল তার চোখ দুটো, মুঝে ভি পিনৈকা শওখ…!
‘আলবৎ, আল!’
আজমল রব্বানী গ্লাসে মদ ঢেলে দিল। প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিল নানকানী মদ ভর্তি গ্লাসটা। চুমুক দিয়ে নয়, ঢক ঢক করে পানীয় জল পান করার মত বিলিতি মদ গিলল সে। মদের গ্লাসটা শূন্য করে সশব্দে পর পর কয়েকটা ঢেকুর তুলে কোর্তার
পকেট থেকে একটা আপেল বের করল সে।
আজমল রব্বানী ছোঁ মেরে একরকম কেড়েই নিল নানকানীর হাত থেকে রাঙা আপেলটা।.
নানকানী দাঁত বের করে খিক খিক করে হাসতে লাগল।
আজমল রব্বানীর কোনদিকে খেয়াল নেই। সে চোখের সামনে আপেলটা তুলে ধরে গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করছে। আপেলটার দিকে ঝুঁকে পড়েছে শরীফ চাকলাদারও। নানকানী ওদের দুজনের উদগ্র আগ্রহ দেখে খিকখিক করে হাসতে হাসতে পকেট থেকে আধ-খাওয়া আর একটা আপেল বের করে তাতে কামড় বসিয়ে দিল।
পেয়েছি! ছুরি চাই।’ আজমল রব্বানী পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছোট একটা ছুরি বের প্রল। কুয়াশা ৪২
১১৫
| আজমল রানার হাতে আপেলটা আপাত দৃষ্টিতে অক্ষত বলে মনে হলেও ট্রাসলে কিন্তু আপেলটার খানিকটা জায়গা চারকোনা করে কাটা। চারকোনা করে কেটে টুকরোটা বিচ্ছিন্ন করে আপেলের ভিতর তথ্য সম্বলিত সেলোফিন ব্যাগ ঢুকিয়ে দিয়ে আবার চারকোনা অংশটুকু যথাস্থানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আপেলটা এমন নিখুঁত ভাবে কাটা হয়েছে এবং পরে এমন নিপুণভাবে যথাস্থানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে
যে গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা না করলে ধরে কার সাধ্য!
কাটুব তো, নানকানীজী?’
“জ্বী-হাঁ, জ্বী-হাঁ । আমার কাছে আরও ফল আছে। কুচবিহারী মোশায়কে নতুন ফল দেব।’
ছুরি দিয়ে আপেলটা কাটল আজমল রব্বানী । দেখা গেল একটা সেলোফিন পেপারে মোড়া সোনালী কাগজ। সেলোফিন কাগজটার ভিতর থেকে বের করা হলো সোনালী কাগজটা। | সোনালী কাগজটা ভাঁজ করা। আট ভাঁজ করা কাগজটার ভাজ খুলতে দেখা গেল কয়েকটা ছবি আঁকা রয়েছে। সোনালী কাগজের ওপর ছোট ছোট সাতটা হনুমানের ছবি। লাল। প্রতিটি হনুমানের নাভির জায়গায় সোনালী ফোঁটা একটা করে ফোঁটাগুলোর মাঝখানে লেখা, দুই পাউণ্ড!
| সাতটা হনুমানের মাথার উপর লেখা রয়েছেঃ 6th May +1)haka Airport + MIDNIGIIT (ODE: WORD: KANGAROO.
সাতটা হনুমানের নিচে দুটো কাঠের বাক্স পাশাপাশি আঁকা। বাক্স দুটোর গায়ের ওপর লেখা : 11th May + blaika Airport + 7 .M. (()Dl; WORD: DI:LIVI:KY NET 50 Pounds.
• শরীফ চাকলাদার পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে সোনালী কাগজের ছবি এবং লেখাগুলো হুবহু নকল করে নিয়েছে ইতিমধ্যে। আজমল রব্বানী দাঁত বের করে হাসতে হাসতে পকেট থেকে বের করল একশো টাকার দশখানা নোট। নানকানী বচকমূলের চোখ জোড়া চকচক করে উঠল। প্রায় ছোঁ মেরেই আজমল রব্বানীর হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে কোর্তার ভিতরের পকেটে ভরল সে।
‘আমরা খুব খুশি হয়েছি, বচকমল,’ নিজের আঁকা এবং লেখা হাতের কাগজটা আজমল রব্বানীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল শরীফ চাকলাদার।
আজমল রব্বানী সোনালী কাগজটা ভরল সেলোফিন পেপারের মোড়কে। সেটা নানকানী বচকমলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে জানতে চাইল, কুচবিহারী মশায়কে কখন এটা দিচ্ছেন আপনি?’
ঘণ্টাখানেক পর । ঠিক?
‘আলবৎ ঠিক।’
১১৬
ভলিউম ১৪
আজমল রব্বানী উঠে দাঁড়াল শরীফ চাকলাদারের দেয়া কাগজটা হাতে নি, তাহলে আপনাকে আর দেরি করিয়ে দেব না।’
| উঠে দাঁড়াল নানকানী।
শরীফ চাকলাদার বসেই রইল । বিদায় দেবার জন্যে নানকানীকে নিয়ে। জলসাঘর থেকে বেরিয়ে গেল আজমল রব্বানী।
দু’ঘণ্টা পর দেখা গেল জলসাঘরের পাশের কামরায় দুটো চেয়ারে বসে নার সিগারেট টানছে আজমল রব্বানী, এবং শরীফ চাকলাদার। ওদের সামনে একটা
টেবিল। টেবিলের উপর একটা ফোন। | নানকানী বচকমল বিদায় নেবার পর থেকে এই কামরায় টেলিফোন সামনে নিয়ে বসে আছে ওরা। একটার পর একটা সিগারেট পোড়াচ্ছে চুপচাপ। অ্যাশট্র ভরে গেছে সিগারেটের টুকরোয়। ধোয়ায় আচ্ছন্ন কামরার ভিতরটা। মাঝে মাঝে দুজনেই তাকাচ্ছে ফোনটার দিকে। ওরা আশা করছে ফোনটা যে-কোন মুহূর্তে বেজে উঠবে।
কুচবিহারী ভকতরাম ওপারের দূত মারফত খবরাদি পাবার সাথে সাথেই ফোন করে থাকে আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদারকে। শরীফ চাকলাদারকে বাড়িতে ফোন করে পাবে না কুচবিহারী। কারণ সে আজমল রব্বানীর সাথেই রয়েছে। আগে কুচবিহারী অবশ্য আজমল রব্বানীকেই ফোন করবে। তাই সব সময় করে। কারণ তিন জনের মিলিত ব্যবসার শতকরা পঞ্চাশ ভাগ পুঁজি কুচবিহারার, শতকরা তিরিশ ভাগ আজমল রব্বানীর এবং কুড়ি ভাগ শরীফ চাকলাদারের। ব্যবসাটা পুরোপুরি দেখাশোনা করে কুচবিহারী । এরা দু’জন শুধু লাভের ভাগ নিয়েই সন্তুষ্ট। লাভের পরিমাণও হিসেব করে নির্ধারণ করে কুচবিহারী । সে যে হিসেব দেয়। সেই হিসেবই মেনে নিতে হয় এদেরকে। এতদিন তাই মেনে নিয়েছে এরা। কিন্তু। ইদানীং আর মেনে নিতে চাইছে না। ইতিমধ্যে লাভের পরিমাণ কত তা নিয়ে তুমুল ঝগড়া-ঝাটি হয়ে গেছে কুচবিহারীর সাথে এদের। রীতিমত জানের ভয় দেখিয়েছে শরীফ চাকলাদার কুচবিহারীকে। পুঁজি তার সবচেয়ে কম হলেও আপত্তি, অভিযোগ সবচেয়ে তারই বেশি।
, আড়াই ঘণ্টা পর ফোনের বেল বাজল। আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদার দুজনেই হাত বাড়াল। রিসিভারের দিকে। ছোঁ মেরে তুলে নিল আজম রব্বানী রিসিভারটা ক্রেডল থেকে।
অপর প্রান্ত থেকে কুচবিহারীর গম্ভীর গলা ভেসে এল, হ্যালো?’
আজমল রব্বানী বলল, আমি রব্বানী বলছি। কি খবর, বিহারী সাহেব? এমন অসময়ে কি দরকার পড়ল?’
কুচবিহারী বলল, নমস্কার, রব্বানী সাহেব। সুখবর আছে।’ গম্ভীর গলায় বলল আজমল রব্বানী, বলুন।’ ‘খবর এসেছে ওপার থেকে। মাল আসছে।
কুয়াশা ৪২
১১৭
“কি মাল।’ সোনা।’
আজমল রব্বানী আড়চোখে তাকাল শরীফ চাকলাদারের দিকে, শরীফ চাকলাদার চোখ টিপে মাথা নাড়ল।
আজমল রব্বানী কুচবিহারীকে প্রশ্ন করল, ‘কি পরিমাণ? ‘সাত পাউণ্ড,’ বলল কুচবিহারী।
সাত পাউণ্ড মাত্র?’
ক্রোধ চেপে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল আজমল রব্বানী। শরীফ চাকলাদার দাঁতে দাঁত চাপল। কুচবিহারী বলল, পরে আসছে আরও পঁচিশ পাউণ্ড।’
চুপ করে রইল আজমল রব্বানী। কুচবিহারী যে মিথ্যক তা সে সন্দেহ করলেও এত সহজ সরল ভাবে এমন ডাহা মিথ্যে কথা বলে দেখে সর্ব শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গেল তার প্রতিহিংসায়।
কবে আসছে মাল?’ ‘পরে জানা যাবে,’ উত্তর দিল কুচবিহারী । আজমল রব্বানী বলল, “ঠিক আছে, দেখা হবে পরে।
নমস্কার। ফোন ছেড়ে দিল কুচবিহারী।
ক্রেডল রিসিভার নামিয়ে রেখে আজমল রব্বানী চোখ মুখ ভয়াবহ রকম বিকৃত করে দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল, ‘কুত্তার বাচ্চা, এক নম্বর বেঈমান! মরণ ঘনিয়েছে শালার।’
শরীফ চাকলাদার কিছু বলল না। কিন্তু সে তাকিয়ে আছে আজমল রব্বানীর দিকে। কি যেন ভাবছে সে। আজমল রব্বানী তাকাল তার দিকে, কিছু বলুন! আমাদেরকে বেঈমানটা এভাবে ঠকাবে আর আমরা সব জেনে শুনে চুপ করে থাকব?’
শরীফ চাকলাদার এতটুকু উত্তেজিত হয়নি। হেসে উঠল সে হঠাৎ। বলল, নতুন করে আমার বলবার কিছু নেই, রব্বানী সাহেব। একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে আমাদেরকে। তা হলো, কুচবিহারীর বিরুদ্ধে আমরা আইনের আশ্রয় নিতে পারি না। আমরা তিনজন যে কারবার একত্রে করছি তা অবৈধ, বেআইনী। এই তিনজনের একজন যদি বেঈমানী করে তাহলে তার বিচার বাকি দুজনকেই করতে হবে। এবং অপরাধ ছোট বা বড় যাই হোক, শাস্তি হতে হবে মৃত্যু। জানেন তো, চোরা না শোনে ধর্মের কথা। কুচবিহারীকে অনুরোধ উপরোধ বা ভয়ডর দেখালে কোনও লাভ হবে না।’
‘আপনি বলতে চান ওকে খুন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই? ‘া, আমি তাই বলতে চাই।’
ভয় দেখালেও এর থেকে কুচবিহারী সাবধান হবে না?
ভলিউম ১৪
১১৮
শরীফ চাকলাদার আবার হাসল। বলল, ‘কুচবিহারীকে আমরা যদি বলি যে আপনি চুরি করছেন, আমাদেরকে ঠকাচ্ছেন, এরপর থেকে সে-চেষ্টা করবেন না, করলে খুন করে ফেলব-তাহলে কুচবিহারী কি করবে জানেন?’
“কি করবে?’
কুচবিহারী আমাদের দুজনকেই খুন করে ফেলবে। এ আমার স্থির বিশ্বাস। ইতিমধ্যেই সে হয়তো আমাদেরকে খুন করার জন্যে লোক লাগিয়েছে। ব্যবসার অন্যান্য ব্যাপারে তো তর্ক-বিতর্ক হচ্ছেই। আমরা যে ওর বেঈমানী ধরে ফেলেছি তা হয়তো ও টের পেয়েছে। সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।’
| আজমল রব্বানী গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে তাকাল সে, চাপা কণ্ঠে বলল, ‘বেশ, তাই করা হোক। ব্যাটাকে সরিয়ে দেয়া যাক দুনিয়া থেকে।’
কামরার জানালাগুলো খোলা। পর্দা ঝুলছে। একটা জানালার পর্দা একটু যেন নড়ে উঠল। সেদিকে তাকাল রব্বানী। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। ইচ্ছা হলো। বাইরে বেরিয়ে বা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভাল করে করিডরটা দেখে আসে, কিন্তু শরীফ চাকলাদার তখনই কথা বলে উঠল বলে আজমল রব্বানীর আর যাওয়া হলো না। খানিক পর সে ভুলেই গেল ব্যাপারটা।
| এদিকে জানালার পর্দা সামান্য একটু সরিয়ে একটা যুবতী তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে, শুনছে ওদের প্রতিটি কথা। | শরীফ চাকলাদার বলল, খুব কৌশলে এবং পরিকল্পিতভাবে খুন করতে হবে। কুচবিহারীকে। পুলিশ যেন বুঝতে না পারে কুচবিহারীকে কেউ খুন করেছে।’
কিন্তু খুনটা করবে কে?’
কেন, আমরা?’ আমরা, মানে•••আমরা কি পারব?’
‘পারব না মানে? না পারলে চলবে কেন? আপনি কি টাকা দিয়ে খুনী ভাড়া করে কুচবিহারীকে খুন করতে চান?
সেটাই কি ভাল হত না?’
‘মোটেই না। খুনী যদি পরে ধরা পড়ে? পুলিসের কাছে নির্ঘাৎ আমাদের নাম বলে দেবে।’ ।
আজমল রব্বানীকে এবার সত্যি সত্যি চিন্তিত দেখাল।
তবে তেমন বিশ্বস্ত লোক যদি পাই তাহলে আলাদা কথা। কাজটা নিজের হাতে করা খুব একটা সহজ নয়। ঝক্কি-ঝামেলা-ঝুঁকি সবই আছে। তেমন উপযুক্ত লোক পেলে তাকে দিয়েই করানো যাবে। কিন্তু সে রকম লোক পাচ্ছি কোথায়, বলুন? ধরে নিন শালাকে আমরাই খুন করব।’
কবে নাগাদ••?’ ‘দিন তারিখ এখুনি ঠিক করার দরকার নেই। কিভাবে খুন করা হবে সেটা
কুয়াশা ৪২
১১৯
t-
.
.
… হবে : তারপর দিন তারিখের প্রশ্ন :
হাল রই…’।
বড় বেশি ভয় ধরা পড়ার । গুলির শব্দ চাপা দেবেন কিভাবে আপনি? তবে গোলার বাইরে যদি হয় তবে গুলি করা চলে। মোট কথা এ ব্যাপারে আপনাকে-আমাকে দুজনকেই প্রচুর ভাবনা চিন্তা করতে হবে। ভেবে চিন্তে তৈরি করতে হবে একটা নিখুঁত পরিকল্পনা।’
গ্রজমল রব্বানী বলল, কিন্তু বেশি সময় নষ্ট করা আমাদের উচিত নয়। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন শালা আমাদেরকে ঠকাবে। এই যে আগামী কদিন পর মাল আসছে, শালা অর্ধেকই গাপ করে দিতে যাচ্ছে।’
শরাফ চাকলাদার বলল, এ মাল এসে পৌঁছুবার আগেই খুন করব আমরা
সম্ভব?’ চেষ্টা করলে সবই সম্ভব।’ উঠে সঁড়াল ওরা।
জানালার সামনে থেকে যুবতী সরে গেল দ্রুত। ওরা কেউ জানতেই পারল না ওদের যড়যন্ত্রের কথা কেউ শুনে ফেলেছে।
তিন কুচবিহারীর অত্যাধুনিক অট্টালিকাটি অভিজাত ধনী লোকদের এলাকা গুলশান মডেল টাউনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। তিনতলা বিল্ডিংটা দেখতে ছোটখাট হলেও চারপাশের বাগান এবং বুজ ঘাসে ঢাকা ফাঁকা জায়গাটুকু নিয়ে বাড়িটাকে প্রকাণ্ডই বলা চলে। অতবড় বাড়ি, কিন্তু লোক সে তুলনায় খুবই কম। কুচবিহারী, তার মেয়ে সুলতা এবং দুজন চাকর-চাকরানী ছাড়া আর কেউ নেই। সুলতার মা মারা গেছে আজ পনেরো বছর হলো। তখন ওরা বার্মায় থাকত! বার্মা থেকে ওরা বাংলাদেশে এসেছে মাত্র দু’বছর আগে।
কুচবিহ্বরীর ব্যবসা এটা নয় । মৌলবী বাজারে তার গুঁড়ো মশলার ফ্যাক্টরী আছে। চকে আছে পাইকারী দরে মনিহারী দ্রব্য বিক্রির দোকান। জিঞ্জিরায় আছে গোটা চারেক ভেজাল কারখানা। চাল-ডাল-নুন-তেল-আলু-পেঁয়াজ প্রভৃতি কেনা-বেচার ব্যবসাটাই সবেচেয়ে প্রিয় কুচবিহারীর। খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসাই আসল ব্যবসা, তার মতে । মানুষ আর কিছু কিনুক বা না কিনুক, খাবার জিনিস তাকে কিনতেই হবে। যাই হোক, কুচবিহারীর আরও নানার রকম ব্যবসা আছে। তার মধ্যে অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমেই সে সবচেয়ে বেশি মুনাফা লোটে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কুচবিহারী গতরাতে নওশেরের সাথে তার যে কথাবার্তা হয়েছিল সে-সম্পর্কে ভাবছিল । কেমন যেন খুঁতখুঁত করছে তার মন।
ভলিউম ১৪
১২০
নওশেরকে বিশ্বাস করা কি তার উচিত হয়েছে: যে লোক তার একটা দুর্বলতার সন্ধান পাবার পর থেকে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে আসছে আজ বহর খানেক ধরে, তাকে কি বিশ্বাস করা ভাল। ‘ চিন্তা করতে করতে বেশ একটু ভীত হয়ে উঠল কুচবিহারী। নওশেরের পক্ষে সবই সম্ব মনে হলো তার। হয়তো টাকার লোভে সে রব্বানী এবং চাকলাদারকে খুন ঠিকই করবে কিন্তু তারপর আবার সে তার কাছে এসে টাকা চাইবে। টাকা না দিতে চাইলে ভয় দেখাবে সে যে রব্বানী এবং চাকলাদারকে খুন করার জন্যে তাকে টাকা দিয়েছে তা প্রকাশ করে দেবার। তাতে অবশ্যি নওশেরের নিজের বিপদও কম নয়। কিন্তু সে যে রকম চালু এবং বেপরোয়া লোক তাতে নিজেকে রক্ষা করার একটা ব্যবস্থা ঠিকই বের করবে সে।
| মেজাজটা তেতো হয়ে গেল কুচবিহারীর। রাগের এবং ঝোঁকের মাথায় কাজটা করা ঠিক হয়নি। আরও ভাবনা-চিন্তা করার দরকার ছিল। রব্বানী এবং চাকলাদারকে খুন করতে হবে তা ঠিক। ওরা দুজন, তাকে আর বিশ্বাস করছে না।
যে কারবার একসাথে তারা করে তাতে একবার সন্দেহের বীজ ঢুকলে সর্বনাশ অনিবার্য। প্রশ্ন হচ্ছে, কার সর্বনাশ?
কুচবিহারী নিজের সর্বনাশ চায় না। চায় না বলেই সে খুন করতে বদ্ধ পরিকর ওদের দুজনকে। কিন্তু খুনের দায়িত্ব নওশেরকে দেয়াটা যে বোকামি হয়ে গেছে তা সে বেশ বুঝতে পারল। পেশাদার কোন খুনীকে একাজে নিযুক্ত করা উচিত ছিল তার। ভাত ছড়ালে যেমন কাকের অভাব হয় না তেমনি টাকা খরচ করলে খুনীরও অভাব হয় না। এক ঢিলে দু’ পাখি ঘায়েল করা যেত। নওশেরকেও খুন করা যেত, রব্বানী আর চাকলাদারকেও খুন করা যেত।
দরজায় টোকা পড়তে বিছানা ছেড়ে উঠল কুচবিহারী। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল মাত্র আটটা বেজেছে। এত সকালে কেন ডাকাডাকি তাকে? কেউ এল নাকি?’
কে?’ বিরক্তির সুরে জানতে চাইল কুচবিহারী । সুলতার গলা ভেসে এল বাইরে থেকে, বাবা, আমি সুলতা।’ শান্ত হলো কুচবিহারী, বলল, কেন, মা?’ দরজা ল দিল কুচবিহারী।
তোমার সাথে একজন লোক দেখা করতে এসেছেন, বাবা।’
কুচবিহারী মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সুলতা যে কোন ব্যাপারে অসন্তুষ্ট তা সে বুঝতে পারল। আজমল রব্বানী বা শরীফ চাকলাদারকে সুলতা যে ভাল চোখে দেখে না তা-ও সে জানে। সুলতা তাকে বহুবার পরিষ্কার ভাষায় বলেছে, বাবা, ওদের সাথে কিসের ব্যবসা করো তুমি? ওদেরকে ভাল লোক বলে মনে হয় না। আমার। কুচবিহারী মেয়ের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে এতদিন।
কে এসেছে, মা? রব্বানী সাহেব?’
। আগে কখনও দেখিনি। নাম বলল নওশের আবদুল্লাহ। লোকটা কে,
কুয়াশা ৪২
১২১
বাবা? চেহারাটা ভয়ঙ্কর।’
কুচবিহারীর মুখে কথা নেই। নওশেরের সাহস দেখে স্তম্ভিত সে। এ বাড়িতে না আসার জন্যে কুচবিহারী তাকে একশোবার নিষেধ করে রেখেছে। তবু কোন সাহসে এসেছে সে?
“কি হলো, বাবা? কে ওই লোক? তুমি অমন করে কি ভাবছ হঠাৎ?’
সুলতা অবাক হয়ে গেছে বাবার হঠাৎ পরিবর্তনে। ‘ও কিছু নয়, মা । তুমি তোমার কামরায় যাও। তা নওশেরকে বসিয়েছ তো?’
হনুমানজী বসিয়েছে ড্রয়িংরূমে। কিন্তু লোকটা কে তা তো বললে না, বাবা?’
কুচবিহারী জোর করে হাসল, বলল, কত রকম লোকের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয় মা ব্যবসার খাতিরে, তা আর কি বলব। ওর পরিচয় জেনে তুমি কি করবে বলো? যাকগে, কলেজে যাচ্ছ তো ঠিক মত?’ | ‘সে কি, বাবা! তোমাকে, গতকাল বললাম না কলেজে গোলমাল হয়েছে, কলেজ বন্ধ..!’
হেসে ফেলল কুচবিহারী, ‘ভুলে গেছি, মা। কলেজে গোলমাল, না? তবে যেয়ো না। কিন্তু কলেজ বন্ধ বলে পড়াশুনায় যেন ঢিলে দিয়ো না•••।’ বলতে বলতে কুচবিহারী পা বাড়াল বাথরূমের দিকে। | মুখ হাত ধুয়ে ড্রয়িংরূমে এসে ঢুকল কুচবিহারী। নওশের আবদুল্লা একটা সোফায় বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের ধোয়া ছাড়ছে সে ঠোঁট দুটো গোল করে উপরের দিকে। ধোয়ার রিঙ ছুটে যাচ্ছে সিলিংয়ের দিকে। কুচবিহারী ভিতরে ঢুকতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে, কথা না বলে একটু শুধু হাসল।
চোখমুখ অস্বাভাবিক গভীর কুচবিহারীর। নওশেরের সামনে এসে দাঁড়াল সে, বসল না। বলল, নওশের?’ | নওশের আবার তাকাল। কুচবিহারীর গাম্ভীর্য দেখেও না দেখার ভান করে হাসল আবার। বলল, বসুন, বিহাৰী সাহেব। খারাপ খবর আছে।
নওশের, মনে নেই এ বাড়িতে আসতে মানা করেছিলাম তোমাকে?’
দাঁত বের করে হাসল নওশের। বলল, ও, তাই বুঝি রেগে গেছেন? কিন্তু মানা করলেও থাকতে পারলাম না, বিহারী সাহেব । হাজার হোক, আপনার সাথে সম্পর্ক আমার আগের চেয়েও গম্ভীর হয়েছে। আপনার বিপদের খবর পেয়ে চুপ করে বসে থাকি কি করে বলুন? খবরটা শোনা মাত্র পড়িমড়ি করে ছুটে এসেছি। তা দাঁড়িয়ে কেন, বসুন, বিহারী সাহেব।’
বসল কুচবিহারী, কেন এসেছ তুমি এই সক্কালবেলা?’
শান্ত হোন, বিহারী সাহেব। কিছু একটা বলব বলেই এসেছি। কিন্তু তার আগে মাথা ঠাণ্ডা করুন। এখন আপনার বিপদের সময়। মাথা গরম করলে বিপদ ‘ থেকে মুক্তি পাবেন না। ব্যস্ত হবেন না। বলছি। তার আগে বলুন, আমাদের কথা
১২২
ভলিউম ১৪
কেউ শুনছে না তো?’
একদৃষ্টিতে কুচবিহারী তাকিয়ে আছে নওশেরের দিকে, চোখ না সরিয়েই সে বলল, না। কি বলবে বলো। কেউ নিছে না তোমার কথা। | তবে বলি। বলার আগে একটা কথা জেনে রাখুন। যে খবরটা আপনাকে বলব তা আমি কোত্থেকে, কিভাবে জেনেছি তা জিজ্ঞেস করবেন না। জিজ্ঞেস করলে আমার কাছ থেকে উত্তর পাবেন না।’
বকবক কোরো না, নওশের । তোমার বকবকানি শোনার মত সময় আমার নেই…’
কুচবিহারীকে থামিয়ে দিয়ে নওশের হেসে উঠল, বলল, ‘বেশ, নুন। আপনার বন্ধুরা একটা ষড়যন্ত্র করেছে। সে ষড়যন্ত্রের কথা, দুর্ভাগ্যবশত, আমি জানতে পেরেছি।’
| ‘আবোল তাবোল বোকো না, নওশের।’
সাবধান করে দিয়ে বিরক্তির সাথে বলল আবার কুচবিহারী, যা বলবে পরিষ্কার করে বলো । কাদের কথা বলছ? কে ষড়যন্ত্র করেছে? কার বিরুদ্ধে?’।
| ষড়যন্ত্রটা করেছে আপনার দুই বন্ধু। আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদার। কার বিরুদ্ধে? বুঝতে পারছেন না কার বিরুদ্ধে?’ কুচবিহারীর দু’চোখে বিরক্তির চিহ্ন। অধৈর্য হয়ে উঠেছে সে।
| নওশ্নে আবার বলল, আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে তারা। আপনি যেমন তাদেরকে খুন করতে চান তারাও তেমনি•• |
‘আস্তে•••!’ চাপা কণ্ঠে গর্জে উঠল কুচবিহারী।
হাঃ হাঃ করে হঠাৎ হেসে উঠল নওশের। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কুচবিহারী তাকিয়ে রইল। নওশের হাসি থামিয়ে আর একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আগেই আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করে নিয়েছি আমাদের কথা কেউ শুনছে কিনা•••।’
দেয়ালেরও কান আছে, নওশের। যা বলবে আস্তে আস্তে বলো। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে ওরা একথা কে বলল তোমাকে?’
‘এ প্রশ্ন করবেন না। কি ভাবে জেনেছি, কে বলেছে তা আপনাকে বলব না। ওরা ষড়যন্ত্র করেছে আপনাকে খুন করার।
| ‘অসম্ভ! তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না।’
কুচবিহারীর কথা শেষ হতেই সোফা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল নওশের, আমি জানতাম এ কথাই বলবেন আপনি। যাকগে, আমার কর্তব্য আমি করে গেলাম। পরে আমাকে দুষবেন না যেন।
উঠে দাঁড়ালে যে?’
কাজ আছে আমার। আপনি যা বিশ্বাসই করেন না, সে ব্যাপারে কি আর আলাপ চলে?’
“আচ্ছা, বসো। ধরা যাক, ওরা আমাকে খুন করতেই চায়। কিন্তু তাতে ক্ষতি
কুয়াশা ৪২
১২৩
কি? তোমার সাথে আমার চুক্তি তো হয়েই গেছে। ওদেরকে তুমি খুন করতে রাজি নও এখন?’ |
রাজি নই কে বলল? টাকা পেলে নওশের সব করতে পারে।
তবে? ওরা আমাকে খুন করার ষড়যন্ত্র করেছে একথা শুনে আমার ভয় পাবার কি আছে?’
নেই? ধরুন, আমি ওদেরকে খুন করার আগেই ওরা যদি আপনাকে খুন করে বসে?’
তার মানে!’ কুচবিহারীর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল । নওশের আরাম করে বসল আবার।
আপনাকে আমি কথা দিয়েছি এক হপ্তার মধ্যে ওদেরকে খুন করব। মনে আছে তো কথাটা? ধরুন, তার আগেই যদি ওরা..’।
‘না, একহপ্তা অনেক দিন। তার আগেই, মানে, আজকালকের মধ্যে তুমি ওদেরকে শেষ করে ফেলো।’
শেষ করে ফেলো বললেই তো আর শেক্স করা যায় না, বিহারী সাহেব। নিজের নাক বাঁচিয়ে খুব সাবধানে কাজটা করতে হবে। কাজটা করে ধরা পড়ে গেলে ফাঁসি হবে আমার। সুতরাং ভেবেচিন্তে একটা নিখুঁত উপায় বের করতে হবে আগে, সেজন্যে সময় লাগবেই। এক হপ্তার মধ্যে কথা দিয়েছি, তারও বেশি সময় লাগার কথা। দু’একদিনের মধ্যে তো একেবারেই অসম্ব।’
‘তাহলে? ওরা যদি তার আগেই…।’
নওশেরকে গম্ভীর দেখাল, হ্যাঁ, সেটাই আসল প্রশ্ন। তার আগেই যদি ওরা আপনাকে খুন করার চেষ্টা করে?’
| তুমি জানো না কবে কিভাবে ওরা আমাকে…’
নওশের বলল, না, তা জানি না । তা জানলে তো এত সমস্যার সৃষ্টি হত না। তবে যতটুকু জেনেছি তাতে মনে হচ্ছে দু’ একদিনের মধ্যেই চেষ্টা করবে ওরা।
অধৈর্য গলায় কুচবিহারী বলে উঠল, তুমি কি ওদেরকে আজকালকের মধ্যেই শেষ করে ফেলতে পারো না? আরও বেশি টাকা দিলে?…’
| কত টাকা?’ চকচক করে উঠল নওশেরের চোখ দুটো,লোভে।
• ‘পঞ্চাশ হাজার।
ভেবে দেখি।’ ভাবতে লাগল নওশের।
কুচবিহারী উঠে দাঁড়াল। মেঝেতে কার্পেট বিছানো। কার্পেটের উপর পায়চারি করতে শুরু করল সে। একসময় নওশেরের সামনে দাঁড়াল সে, বলল, ভেবে দেখার এর মধ্যে কিছু নেই, নওশের। তুমিই বহুবার বলেছ টাকা পেলে তোমার পক্ষে সবই করা সম্ভব। এক হপ্তার মধ্যে ওদেরকে তোমার খুন করার কথা, তার জায়গায় আগামীকালই তোমাকে কাজটা করতে বলছি। এ জন্যে পঞ্চাশ হাজার বেশি দেব তোমাকে।’
মুখ তুলে নওশের বলল, “ঠিক আছে। আপনার কথা মতই কাজ হবে। আগামী
১২৪
ভলিউম ১৪
কাল রাত বারোটার মধ্যে ওদেরকে খতম করব আমি । টাকা?’
কুচবিহারী বলল, সোয়া লাখ, না? কালকে যেমন কথা হয়েছিল, চারটের সময় মন্দিরে যেয়ো। আমি টাকা নিয়ে অপেক্ষা করব তোমার জন্যে।
বেশ। বাকি সোয়া লাখ আর মাসিক বরাদ্দের বদলে এককালীন এক লাখ, মোট সোয়া দুই লাখ টাকা আগামী পরশুদিন পাচ্ছি তো?’
“নিশ্চয়ই পাচ্ছ। পরশু দিন বিকেল পাঁচটায় মন্দিরে টাকা নিয়ে যাব আমি।’ শিস দিয়ে উঠে দাঁড়াল নওশের আবদুল্লা ।
‘
|
চার আধঘণ্টা পর নওশের আবদুল্লাকে দেখা গেল আজমল রব্বানীর ধানমণ্ডিস্থ বাড়ির। বৈঠক খানায় ।
ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে আজমল রব্বানী। নওশের আবদুল্লা হাসছে।
শরীফ চাকলাদার খানিক আগে মাত্র পৌঁছেছে আজমল রব্বানীর ফোন পেয়ে। বিমৃঢ় দেখাচ্ছে তাকে। আজমল রব্বানী এইমাত্র সব কথা বলেছে তাকে।
নিস্তব্ধতা ভাঙল শরীফ চাকলাদারই, কিন্তু আপনার স্বার্থ কি? কুচবিহারী আপনাকে টাকা দেবে বলেছে আমাদের দুজনকে খুন করার জন্যে । আমাদেরকে খুন করে তার কাছ থেকে টাকা নেয়াটাই আপনার স্বার্থ তা না করে আপনি আমাদের কাছে এসেছেন কি মনে করে?’
নওশের আবদুল্লাকে এতটুকু অপ্রতিভ দেখাল না। আগের মতই হাসছে সে। রীফ চাকলাদারের প্রশ্নের উত্তরে সে বলে উঠল, আগেই তো বললাম, অকারণে কাউকে আমি খুন করি না। টাকা পেলেই খুন করা আমার স্বভাব নয়। যাকে খুন করব সে খুন হবার মত কোন অন্যায় অপরাধ করেছে কিনা তা জানা দরকার আমার। আমি পেশাদার খুনী হলেও নিরীহ লোককে খুন করা আমার পেশা নয় । আপনাদের অপরাধ কি এ প্রশ্ন আমি কুচবিহারী সাহেবকে করেছিলাম। কিন্তু তিনি উত্তর দেননি। তাই আপনাদের কাছে এসেছি।’
আমাদের কাছ থেকে কি আশা করো তুমি?
নওশের আবদুল্লা বলল, কিছু আশা করি না। শুধু জানতে চাই কুচবিহারী সাহেব কেন আপনাদেরকে খুন করতে চান? আপনাদের সাথে তার বিরোধটা কোথায়?’
আজমল রব্বানী বলে উঠল, কুচবিহারীর সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। আমরা তিনজন একটা ব্যবসার অংশীদার। ব্যবসাটা কুচবিহারীই দেখা শোনা করে। কিছুদিন থেকে আমরা বুঝতে পারছি সে আমাদেরকে ভীষণ ঠকাচ্ছে। ফলে মনে মনে আমরা খেপে আছি। আমরা যে খেপে আছি তা কুচবিহারী সঙ্কত বুঝতে
কুয়াশা ৪২
১২৫
পেরেছে। হয়তো সেজন্যেই আমাদেরকে খুন করতে চায়।’
নওশের ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলে উঠল, ‘ঠিক বলেছেন। সেজন্যেই সে খুন করতে চায় আপনাদেরকে।’
শরীফ চাকলাদার একটা সিগারেট ধরাল।
নওশের আবদুল্লা বলল, ‘এখন দেখছি কুচবিহারী নিজের অপরাধ ঢাকার জন্যে আপনাদেরকে খুন করতে চাইছে। অথচ আমি ভেবেছিলাম অন্য রকম।’
আপনি কি ভেবেছিলেন?’ জানতে চাইল শরীফ চাকলাদার সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। ফলে অনেকটা শান্ত বোধ করছে সে।
নওশের আবদুল্লাও পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল, “আমি ভেবেছিলাম আপনাদের দ্বারা মারাত্মক কোন ক্ষতি হচ্ছে কুচবিহারীর, তাই সে বাধ্য হয়ে আপনাদেরকে খুন করতে চাইছে। এখন দেখছি তা নয়। আসলে একটা অপরাধ ঢাকার জন্যে আর একটা অপরাধ করতে চাইছে সে। না, তার কথা মত কাজ করা আমার পক্ষে সদ্য নয়। অকারণে কোন নিরীহ লোককে আজ পর্যন্ত খুন করিনি আমি, করবও না কোনদিন।
তার মানে কুচবিহারীর প্রস্তাব আপনি প্রত্যাখান করবেন?’ জানতে চাইল আজমল রব্বানী।
নওশের গম্ভীর গলায় বলল, “নিশ্চয়। আমি যখন জেনেছি যে আপনারা নিরপরাধ তখন কি আর আপনাদেরকে খুন করা আমার পক্ষে সম্ব?’
শরীফ চাকলাদার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, বলল, আপনি বেশ বুদ্ধিমান লোক, নওশের আবদুল্লী। কুচবিহারী যে লোক ভাল নয় তা নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পারছেন?’
| হ্যাঁ। লোকটা সত্যিই ভাল নয়। কিন্তু আপনাদের সাথে দেখা না করলে আমি তা জানতেই পারতাম না। হয়তো তার কথায় আপনাদেরকে আমি খুন করে ফেলতাম। এক হাতে তুড়ি দিয়েই ঘটে যেত ব্যাপারটা।
শরীফ চাকলাদার এবং আজমল রব্বানীর বুক কেঁপে উঠল ভয়ে।
শরীফ চাকলাদার রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ঢোক গিলল, তারপর বলল, কুচবিহারী সম্পর্কে আপনিও আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন, নওশের আবদুল্লা। আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে সে এমন একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র করতে পারে তা কল্পনাই করা যায় না। অথচ কথাটা সত্যি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে।’
শরীফ চাকলাদার মাঝপথে থেমে আজমল রব্বানীর দিকে তাকাল। আজমল রব্বানী মৃদু মাথা নাড়ল। শরীফ চাকলাদার নীরব ইঙ্গিত পেয়ে আবার বলতে শুরু করল, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আপনি যদি তার কথা মত কাজ না করেন তাহলে সে আর একজন লোককে লাগাবে। অর্থাৎ আমাদেরকে খুন করার চেষ্টা করবেই।
১২৬
ভলিউম ১৪
নওশের আবদুল্লাকে চিন্তিত দেখাল। বলল, আমিও সে কথাই ভাবছি।
তাহলে তো বিপদের কথা…।’
আজমল রব্বানীর কথার মাঝখানে শরীফ চাকলাদার বলে উঠল, “ভাবতে গেলে সত্যি বিপদের কথাই বটে। কিন্তু এই বিপদ থেকে নওশের আবদুল্লা আমাদেরকে মুক্ত রাখতে পারেন।’
নওশের আবদুল্লা সিগারেটের ধোঁয়া উপর দিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইল, তার মানে?’
‘তা মানে আমাদের কথা মত কাজ করুন।’
কি কাজ?’ নওশেরকে অবাক হতে দেখা গেল । যেন কিছুই বুঝতে পারছে না।’
কুচবিহারী লোক ভাল নয়। আমাদের মত নিরীহ লোককে সে খুন করতে চায়। সুতরাং ওর শাস্তি পাওয়া দরকার। নওশের আবদুল্লা, আপনি কুচবিহারীকে খুন করুন। যত টাকা লাগে আমরা দেব।’
| আজমল রব্বানী চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, “চমৎকার! এটাই একমাত্র রাস্তা। শরীফ সাহেব, সত্যি আপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না।’
শরীফ চাকলাদার তাকিয়ে আছে নওশেরের দিকে।
ভেবে দেখার কি আছে এর মধ্যে? কুচবিহারীকে খুন করতে না চাওয়ার কোন কারণ নেই আপনার। সে যে নিরীহ বা নিরপরাধ নয় তা আপনিই প্রমাণ করেছেন। টাকা পয়সার কথা ভাবছেন? টাকার কথা…।’
শরীফ চাকলাদারের কথার মাঝখানে আজমল রব্বানী বলল, টাকার কথা ভাবতে হবে না। আমাদের দুজনকে খুন করার জন্যে কুচবিহারী আড়াই লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল, তাই না? ঠিক আছে, আমরাও আড়াই লাখ টাকা দেব। সুবিধেটুকু আপনারই, আড়াই লাখ টাকা পাবেন অথচ খুন করতে হবে একজনকে, দুজনকে নয়।
| নওশের আবদুল্লা হঠাৎ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল। আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদার নওশেরের এমন অট্টহাসির কারণ বুঝতে না পেরে বোকার মত তাকিয়ে রইল তার দিকে।
হাসি থামতে নওশের আবদুল্লা বলল, আপনাদের প্রস্তাবটা সত্যি লোভনীয়।’ রাজি তাহলে আপনি?’ শরীফ চাকলাদার সাগ্রহে জানতে চাইল। করমর্দনের জন্যে নওশের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “রাজি!
একগাদা টাকার বাণ্ডিল নিয়ে নিজের কামরায় বসে বসে হিসেব কষছিল কুচবিহারী। হিসেব শেষ করে অ্যাটাচী কেসে টাকার বাণ্ডিলগুলো ভরে ফেলল সে। এমন সময় ফোন এল ।
ফোন করেছে নওশের আবদুল্লা। রিসিভার কানে তুলে কুচবিহারী বলল, ‘কাকে
কুয়াশা ৪২
১২৭
চাই।’
‘।
‘আমি নওশের আবদুল্লা। আপনার সাথে জরুরী একটা আলাপ করার দরকার হয়েছে হঠাৎ, বিহারী সাহেব।’
বিকেল চারটের সময় মন্দিরে এসো । কলবার ওখই বোলো।’
নওশের আবদুল্লা বলল, না, তার আগেই কথাবার্তা হওয়া দরকার আমাদের মধ্যে। ব্যাপারটা খুবই জরুরী।
, কুচবিহারীর চোখমুখ ক্রমশ অস্বাভাবিক গম্ভার হয়ে উঠছে নিজের ভুল টের পাচ্ছে সে! নওশের আবদুল্লাকে মাথায় তুলে ফেলেই সে ।
কি কথা? কি এমন কথা বলতে চাও যা দু’তিন দণ্টা পর বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? তোমার উদ্দেশ্য ঠিক বুঝতে পারছি না। এমন ঘন ঘন বিরক্ত করলে।’
নওশের আবদুল্লা অপর প্রান্ত থেকে মৃদু শব্দ করে হাসল, বলল, ফোন সে কথা বলা যাবে না। আপনি যদি অনুমতি দেন তো আমি মাপার বাড়িতে এখুনি একবার।’
চাপা গলায় দাঁতে দাঁত চেপে কুচবিহারী বলল, না : আমার এ-বাড়িতে তুমি এসো না।’
তাহলে কথাটা বলব কোথায়?’ মন্দিরে চারটের সময় যেয়ো । তখনই শুনব।’
নওশের আবদুল্লা বলল, আপনি ঠিক বুঝতে পারল না আসল ব্যাপারটা। যাকগে, আপনার কথাই থাকুক । তবে একটা কথা জানিয়ে দিই। আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন তো?’।
গম্ভীর গলা কুচবিহারীর, ‘পাচ্ছি! কি বলবে বলো তাড়াতাড়ি।’
মন্দিরে চারটের সময়ই দেখা হবে। সোয়া লাখ টাকা নিয়ে যাবার কথা আপনার মনে আছে তো? ও টাকায় হবে না, আরও বেশি টাকা নিয়ে যাবেন।
• কুচবিহারীর চোখ মুখ ক্রোধে বিকৃত হয়ে উঠল। চাপা গলায় প্রায় গর্জন করে উঠল সে, নওশের! এ তোমার কি ধরনের শয়তানি! আবার বেশি টাকার দাবি…
| অপরপ্রান্ত থেকে নওশের আবদুল্লী শান্ত গলায় বলে উঠল, ‘এ ব্যাপারে। আমাকে দায়ী করে লাভ নেই, বিহারী সাহেব । আপনার বন্ধুরা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল।’
‘আঁ! তার মানে আজমল আর চাকলাদার…!’
‘জী হ্যাঁ। আপনি যে প্রস্তাব দিয়েছেন ওরাও আমাকে সেই একই প্রস্তাব দিয়েছে। আপনি দু’জনের জন্যে যে টাকা দিতে চেয়েছেন ওরা একজনের জন্যে সেই পরিমাণ টাকা দিতে চেয়েছেন। এখন আপনিই বলুন, আমি কি করি? যে কাজের জন্যে আপনি এবং আপনার বন্ধুরা আলাদা আলাদা প্রস্তাব আমাকে দিয়েছেন সে কাজ করা আমার পেশা। যে পার্টি আমাকে বেশি টাকা দেবে আমি
১২৮
ভলিউম ১৪
তার স্বার্থেই কাজ করি। এখন আপনিই বলুন•••।’
| কুচবিহারী বলল, নওশের, ভগবানের দোহাই, এবার তুমি থামো!’
নওশের চুপ করে গেছে। চুপ করে আছে কথাটা বলে কুচবিহারীও। দ্রুত চিন্তা করছে সে। কপালে ফুটে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বেশ অনেকক্ষণ পর আবার সে কথা বলল, “কত দাবি এবার তোমার?’
| ‘নিয়মানুযায়ী পাঁচ লাখই চাওয়া উচিত। কিন্তু আপনি আমার পুরানো খদ্দের । চার লাখ দিলেই চলবে।
“ঠিক আছে। বিকেল চারটেয় মন্দিরে টাকা নিয়ে যাব আমি।’
এতটুকু ইতস্তত না করেই কুচবিহারী টাকা দিতে রাজি হয়ে গেল। .. কিন্তু সন্দেহ হলো নওশেরের। কুচবিহারী দেড় লাখ টাকা বেশি দিতে রাজি হয়ে গেল এক কথায়!
চার লাখ টাকার অর্ধেক দু’লাখ। দু’লাখ টাকাই নিয়ে যাচ্ছেন তো বিকেলে?’ | ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ। দু’লাখই নিয়ে যাব।’ বিবক্ত হয়ে জানাল কুচবিহারী । এবং খটাশ করে নামিয়ে রাখল রিসিভার।
পাঁচ
এটোটা নির্ভয় হইবেন না, মিস্টার ফর গড় সেক, মিস্টার অথার, ওনলি টেরো টাকা সেভেন্টি পয়সা! প্লীজ!’
| যার উদ্দেশ্যে ডি, কস্টা এত কাকুতি-মিনতি ভরে কথা বলছে, সে লোকটার মন গলল বলে মনে হলো না। ডি. কস্টার মিস্টার অথার লোকটা দেখতে লম্বা চওড়া । পরনে আদ্দির পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীর উপর একটা কালো সার্জের ওয়েস্ট-কোট। কড়া ইস্তিরি দেয়া ধবধবে সাদা পাজামা ।মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে। টিকালো নাক, তীক্ষ্ণ চেহারা। লোকটার হাতে একটা জ্বলন্ত চুরুট, বেশ অনেকখানি ছাই জমেছে সেটার মাথায়। উদাস দৃষ্টি মেলে আকাশের নক্ষত্ররাজির দিকে চেয়েছিল লোকটা .ডি, কস্টার কথা শেষ হতে ধীরে ধীরে চোখ নামাল। বলল, কি বলছিলে, ডি, কস্টা?’
চটে গিয়ে ডি, কস্টা মনে মনে বলল, ‘রাইটার হয়ে ব্যাটা মাঠা কিনিয়া নিয়াছে! হামার সহিট ফোরটোয়েন্টিগিরি! দুই বটসর বোকা বানাইয়া রাখিয়াছি, এইবার টোমার টাকাও ঢংস করিব! সর্বণ্ট করিয়া ছাড়িব, নইলে টোমার লেখা বৎ হইবে না।
কিন্তু প্রকাশ্যে ডি. কস্টা বিনয়ের অবতার। বলল, ‘মিস্টার অথার, প্লীজ হেল্প মি! আই অ্যাম ইন গ্রেট ডেঞ্জার।
কেন, কি হয়েছে তোমার?’ ‘আমাশয় হইয়াছে। ডারুণ আমাশয়। ৯-কুয়াশা ৪২
‘১২৯
‘এই কথা বলেই না পরশু-দিন টাকা নিলে আমার কাছ থেকে?’
সে টাকা খটম হইয়া গিয়াছে।’ তারমানে ডাক্তারের কাছে যাওনি সেদিন?
‘ও নো, মাই ডিয়ার অথার। নেটিভ ডক্টরডের হামি রিলাই করিটে পারে না। হামি নিজেই মেডিসিন কিনিয়া খাইয়াছি।’
কি ওষুধ খেয়েছ?’ ‘জাস্ট ওয়ান বটল,বেংগলী ওয়াইন।’ ‘বাহ, বেশ করেছ। সারেনি তাতে?’
ও নো, আরও বাড়িয়াছে। নাউ আই নিড অ্যানাডার বটল…’ ‘আমার কাজ আছে, ডি. কস্টা। একটা মীটিং আছে, বেরোতে হবে এখুনি।
সে মীটিং আজ হইবে না।’
অবাক হয়ে গেল লোকটা, সে কথা তুমি জানলে কি করে? কোথায় মীটিং হবার কথা তুমি জানো?’– “নিশ্চয়। আপনি ভুলিয়া গিয়াছেন, আমি একজন ওয়ার্লড ফেমাস প্রাইভেট ডিটেকটিভ।’
‘কোথায় মীটিং বলো দেখি?
প্রেসক্লাব। সন্যা সাটটায়।’ ‘আশ্চর্য! তুমি জানলে কি করে? মীটিং হবে না আজ?
মাথা নাড়ল ডি, কস্টা, সবজান্তার হাসি হেসে বলল, লুক, মিস্টার অথার, আপনার ফাইভ টাকা রিকশা ভাড়া বাঁচাইয়া ডিলাম-সেই সাঠে যাটায়াটের কষ্ট সেভ করিয়া ছিলাম। ডিন, টেরো টাকা সেভেন্টি পয়সা ওনলি । হাত পাতল ডি. কস্টা। | ডি. কস্টার এই অকাট্য যুক্তি গায়ে মাখল না লোকটা। উঠে দাঁড়াল চেয়ার
ছেড়ে। বলল, “দশটা পয়সা দিতে পারি।’ । বিস্ফারিত হয়ে গেল ডি. কস্টার চোখ। ‘হোয়াট! আমি আপনার ফাইভ টাকা,
সেভ করিয়া ডিলাম…’
না হে! গেলে আমি বাসে যেতাম! এখান থেকে প্রেসক্লাবের ভাড়া পঁচিশ পয়সা। এই পঁচিশটা পয়সা তোমাকে দিতে পারতাম, কিন্তু, মীটিং হোক বা না । হোক বেরোতেই হচ্ছে আমাকে। মীটিং হচ্ছে না জানতে পারায় নেমে পড়ব আমি, গুলিস্তানেই। এখান থেকে গুলিস্তানের ভাড়া উনিশ পয়সা। কাজেই ছয় পয়সার উপকার করেছ তুমি আমার। আর কষ্ট বেচেছে চার পয়সার। মোট দশ পয়সা। নেবে?’
ডি, কস্টাকে রক্তশূন্য মুখে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পা বাড়াল ‘মিস্টার অথার’ লোকটা। সংবিৎ ফিরে পেয়ে পিছু নিল ডি. কস্টা। মাছির মত ভ্যানর ভ্যানর শুরু করল লোকটার কানের কাছে। কিন্তু বিরক্ত হয়ে যে কিছু টাকা,
১৩)
ভলিউম ১৪
ঝেড়ে দিয়ে খালাস পাবে এমন কোন লক্ষণ দেখা গেল না লোকটার মধ্যে। নির্বিকার। এবার প্রশংসায় তুষ্ট করার চেষ্টা করল ডি. কস্টা লোকটাকে, ভাল একটা গল্পের প্লট দেয়ার লোভ দেখাল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেষ পর্যন্ত পূর্ণ । আত্মসমর্পণ করল সে। খপ করে ধরল লোকটার পাঞ্জাবীর আস্তিন।
‘প্লীজ, মিস্টার রাইটার! প্লীজ, হেল্প মি। নইলে মারা যাইব। হামি ডাই করিলে হাপনি যার হইবেন।’
কি রকম?’ এ রকম একটা স্ট্রং ক্যারেক্টারের হিরো কোঠায় পাইবেন? তুমি আমার বইয়ের হিরো নাকি?’ লোকটার চক্ষু চড়কগাছ। বাহ্, এমন একটা খবর তো জানা ছিল না? কুয়াশা, শহীদ, কামাল, এরা বুঝি সব তোমার পার্শ্ব-চরিত্র?
কামালের কঠা বাড় ডিন-হি ইজ ডেড, শহীদ-ইভ্যালিড়, বাকি ঠাকিল কুয়াশা। টাহাকে হিরো বলিটে পারেন, কিম্বা টাহার ফ্রেণ্ড হিসাবে হামাকেও বলিটে পারেন। বাট কঠা সেটা নয়, ওনলি ঠারটিন টাকা সেভেন্টি পাইসা…’।
| ‘মদ খাওয়ার জন্যে একটি পয়সাও দের না আমি তোমাকে! চলি। দেখা হবে আবার।’
হন হন করে হাঁটতে শুরু করল লোকটা। লাভ নেই জেনে দাঁড়িয়ে পড়ল ডি, কস্টা। কটমট করে তাকিয়ে রইল সে লোকটার গমন পথের দিকে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, অল-রাইট! হামার নাম স্যানন, ডি, কস্টা। টোমার রাইটিং হামি বাহির করিটেছি। ফটুর করিয়া ছাড়িয়া ডিব টোমাকে।’
ক্রমে ক্রমে লোকটার বুক পকেটে রাখা মানি ব্যাগটা ভেসে উঠল ডি, কস্টার মানস-চক্ষে। মুচকি হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোণে। অতি সন্তর্পণে অনুসরণ শুরু করল সে।
প্রেসক্লাবের দিকে না গিয়ে গুলিস্তান বিল্ডিং এর সামনেই লোকটাকে নামতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ডি কস্টা। যাক, বেমালুম মিথ্যে কথাটা গিলেছে তাহলে ব্যাটা। নইলে অন্য ফিকির বের করতে হত ওকে প্রেসক্লাবে যাওয়া থেকে বিরত করতে। লম্বা পা ফেলে হেঁটে চলেছে লোকটা। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের এই ভিড়ভাড়াক্কিার মধ্যে কোন অসুবিধেই হবে না ওর মানি ব্যাগটা বের করে নিতে। দ্রুত পা চালাল ডি. কস্টা।
কাছাকাছি গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো ডি, কস্টাকে। ফুটপাথের একটা বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে লোকটা, বই ঘটছে। নাহ, পছন্দ হলো না, আবার হাঁটতে শুরু করেছে। এক মিনিটের মধ্যেই লোকটার একেবারে পিঠের কাছে চলে এল ডি কস্টা। আর পনেরো সেকেণ্ডের মধ্যেই কাজ হাসিল হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ সামনে কি যেন দেখে থমকে দাঁড়াল লোকটা। থমকে দাঁড়াল ডি. কস্টাও। হাত বাড়াতে গিয়েছিল, সামলে নিয়ে ছোট একটা লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল
কুয়াশা ৪২
১৩১
কয়েক পা । সামনের দিকে চেয়েই চক্ষুস্থির হয়ে গেল ওর । যেন ভূত দেখছে সে। বুকে একটা ক্রস চিহ্ন এঁকে আরেক লাফে গিয়ে দাঁড়াল সে লাইট পোস্টের আড়ালে।
রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ডি, কস্টার হাঁড়ির তলার মুত ফর্সা মুখটা ।
বিড় বিড় করে আপন মনে বলছে সে। মাই গড! ও মাই গড! এটো পরিশ্রম করিয়া ডুই বটসর যাহা টেকাইয়া রাখিয়াছি সব ভেস্টে গেল আজ! আর রাখা গেল।
! ও ক্রিস্ট! সকালে উঠিয়া আয়নায় নিজের মুখটা কেন ডেখিলাম!’
উঁকি দিল ডি. কস্টা লাইট পোস্টের আড়াল থেকে। পর মুহূর্তেই মুখটা আড়ালে টেনে নিল আবার। বিড়বিড় করে বলল, “গড, সেভ মাই সোউল! আর কোন পঠ নাই। নিজের এটোবড় সর্বনাশ হামি দেখিটে স্মরিব না।’
চোখ বন্ধ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ডি. কস্টা লাইট পোস্টের আড়ালে।
ঠিক সাত হাত তফাতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে ডি কস্টার ‘মিস্টার অথার লোকটা। তার চার হাত তফাতে এদিকে মুখ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে আর
একজন লোক।
দ্বিতীয় লোকটা কামাল। | .
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছে ওরা। হঠাৎ আচমকা কামাল লোকটাকে লক্ষ্য করে এবং লোকটা কামালকে লক্ষ্য করে লাফ দিল বিদ্যুৎবেগে। চোখের পলকে দেখা গেল দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে দুহাতে।
বুকে বুক ঠেকিয়ে পরস্পরকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ রাখল ওরা ঝাড়া ষাট সেকেণ্ড। তারপর খানিক দূরে সরে চেয়ে রইল পরস্পরের মুখের দিকে ঝাড়া তিরিশ সেকেণ্ড। দুই জোড়া চোখে অবিশ্বাস। আবার জড়িয়ে ধরল দুজন দুজনকে। পনেরো সেকেণ্ড।
প্রথমে মুখ খুলল কামালই। আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তুমি-তুমি-তুমি বেঁচে আছ! অথচ আমি জানি, আমূরা সবাই জানি মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছ•••
লোকটা কামালকে ছেড়ে দিলেও কামালের একটা হাত ছাড়েনি। শক্ত করে চেপে ধরে আছে হাতটা, যেন ছেড়ে দিলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে কামাল। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, কি আশ্চর্য, কামাল! আমিও তো শুনেছি তুমি-তোমরা,
মানে, তুমি, মহুয়াদি, নীনা সবাই মারা গেছ মুক্তি যুদ্ধে..’।
| ‘অদ্ভুত ব্যাপার! আজ সকালেও তোমার সম্পর্কে কথা হচ্ছিল মহুয়াদির সাথে..’
. কামালের দুই কাঁধে হাত রাখল লোকটা। সত্যিই অদ্ভুত! তোমাকে আবার জীবিত দেখতে পাচ্ছি এটা যেন আমার কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছে না। গত বছরও মুজিবনগরে গিয়ে তোমাকে স্মৃতিস্তম্ভে ফুলের মালা দিয়ে মোনাজাত করে এসেছি।’
কামাল বলল, কিন্তু এমন ব্যাপার ঘটল কি করে বলো তো? তুমি জানো
১৩২
ভলিউম ১৪
আমরা মারা গেছি, আমরা জানি তুমি মারা গেছ•••এই যে অসম্ভব-••আচ্ছা, আমরা মারা গেছি এ খবর তোমাকে দিল কে?’ | আমি মারা গেছি, এ খবরটাই বা তোমরা কার কাছে পেলে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল লোকটা।
কামাল বলল, কেন, ডি, কস্টা দিয়েছে খবরটা। স্বাধীনতার পর ঢাকায় ফিরে এলাম, খবর পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো ডি, কস্টা। কাদবার কারণ জিজ্ঞেস করায় আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগল সে। অনেক করে বোঝাবার পর থামল শেষ পর্যন্ত। এবং তোমার মৃত্যু সংবাদ দিল।, লোকটা উত্তেজিত হয়ে আরও শক্ত করে ধরল কামালের কাঁধ। কী
সাংঘাতিক! কী সাংঘাতিক! ডি, কস্টা ঠিক একই ভাবে কাঁদতে কাঁদতে আমার বাড়িতেও গিয়েছিল। অনেক চেষ্টায় ওকে থামাই। বহু কষ্টে কান্নার ফাঁকে ফাঁকে ওর কাছ থেকে জানা গেল মুক্তিযুদ্ধের সময় ওর চোখের সামনে মারা গেছ তুমি, মহুয়াদি আর লীনা। ভয়ানক ভাবে আহত হয়ে যদিও শহীদ বেঁচে গেছে, প্রিয়জনের মৃত্যুতে পাথর হয়ে গেছে সে। কারও সাথে দেখা করে না। এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে পঁচিশটা টাকা ধার চাইল ব্যাটা। দিয়েছিলাম।’
| বলো কি! আমার কাছ থেকে নিয়েছে পঞ্চাশ টাকা।’ কামাল স্তম্ভিত। স্তম্ভিত লোকটাও।
অনেকক্ষণ পর কামাল বলল, কিন্তু দোস্ত, ডি. কস্টার এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কি বলো তো?’ |
সে কথাই তো ভাববার চেষ্টা করছি।’
কামাল বলল, লোকটা হারামীর হাড়। স্রেফ ঠাট্টা করে মজা পাবার জন্যে এই কাণ্ড করেছে। ঠিক আছে ব্যাটাকে পেয়ে নিই একবার সামনে। এমন শিক্ষা দেব
যে…’
‘কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগছে যে গত দু’বছরের বেশি আমরা ঢাকায় আছি অথচ তোমার সাথে বা তোমাদের কারও সাথে আমার দেখাই হলো
!’ | হবে কি করে? প্রায় পৌনে দু’বছর বিদেশে কাটিয়ে এলাম তো আমরা । ফিরেছি সাতদিন হলো। শহীদ অবশ্য ফিরেছে প্রায় তিন মাস আগে। ওর সাথে
কোথাও দেখা হয়নি তোমার?’
উঁহু! যাইনি আমি। ডি. কস্টা বলেছিল কারও সাথে দেখা করে না ও আর। শোকে, দুঃখে পাথর হয়ে গেছে।’
কামাল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সঁতে দাঁত চেপে বলল, “ডি. কস্টার মরণ ঘনিয়েছে। একবার সামনে পেয়ে নিই, তারপর ওর একদিন কি আমার একদিন।’ |
লোকটা বলল, ‘ইস, কী ভয়ানক লোক! ঠিক আছে; এর শাস্তি ওর পাওনা কুয়াশা ৪২
১৩৩
রইল। কিভাবে ওকে শায়েস্তা করতে হয় তা জানা আছে আমার! আমি লোকটাকে হাতে মারব না, মারব কলমে। ওর সম্পর্কে এমন কথা লিখব যে রাস্তায় বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে বাছা ধনের।’
* ‘স্টপ ইট! আই সে, স্টপ ইট!’ আচমকা ডি. কস্টার গলা শোনা গেল।
লাইট পোস্টের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়াল উত্তেজিত ডি, কস্টা। হাত নেড়ে রীতিমত হুমকি দেবার ভঙ্গিতে বলল, হামাকে হাপনারা চিনটে পারেন নাই! হামার নাম স্যানন ডি কস্টা। মি. কুয়াশা ইজ মাই বেস্ট ফ্রেণ্ড! হামি কাহাকেও কুছ পরোয়া করি না।’
‘এই যে, রাসকেল! গর্জে উঠল কামাল। ততোধিক উচ্চ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ডি কস্টা, ইউ শাট আপ! কিছু বলি ডেখিয়া আপনারা হামাকে লইয়া ছিনিমিনি খেলিটে স্টার্ট করিয়া ডিয়াছেন। আই ওয়ার্ন ইউ! সাবটান করিয়া ডিটেছি, হামার নামে যদি কখনও আজেবাজে কঠা লিখেন টা হইলে হামি উকিলের নোটিস ডিব…।’
কামালের বন্ধু লোকটা এবার কথা বলে উঠল, ‘চেঁচিয়ো না, আস্তে কথা বলো। দোষ করেছ আবার গলা ফাটিয়ে যা তা বক-লজ্জা করে না তোমার? জবাব দাও, কেন তুমি আমাদের কাছে মিথ্যে কথা বলেছিলে।’
আপনার লেখা বন্ড করিটে। ওনলি টু স্টপ ইউ মিস্টার অথার। আপনি আপনার পূস্টকের মনে যে ভাবে দেখাইয়াছেন হামি কি সে রকম লোক? আপনি এমন সব কঠা লিখেন যে রাস্তায় বাহির হইটে পারি না। এভরি পূস্টকে আপনি আমার সম্পর্কে এমন সব বাজে কঠা লেখেন যে লজ্জায় হামি কারও কাছে মুখ ডেখাইটে পারি না। হাপনারা বাংলাডেশের লিবারেশনের জন্যে ওয়ার করিটে গেলেন। বহু লোক মরিল, বহুট লোক নিখোঁজ হইল। কিন্তু হাপনারা ঠিকই ঠাকিলেন। অ্যাট দ্যাট টাইম হামার মাঠায় বুডঢ়ি আসিল। আশা করিলাম ডেখা না হইলে স্টপ হইবে স্যানন সিরিজ। টাইম লস না করিয়া হামি মি. কামালের সাঠে ডেখা করিয়া আপনার ডেথ-নিউজ ডিলাম এবং••• | লেট দ্যাট গো, ডিন, পঁচটা টাকা ডিন।’
কামাল এবং কামালের লেখক বন্ধু দুজনেই অবাক হয়ে একযোগে বলে উঠল, কিসের টাকা?’
উকিলের নোটিস ডিব, তার ফি বাবড় পাঁচ টাকা । কোনরকমে হাসি সংবরণ করল ওরা। কামাল বলল, কচু দেব। যাও, ভাগো। .. ঠিক হ্যায়। টাকা না ডিবেন নাই ডিবেন। বাট, রিমেম্বার ইট, মিস্টার রাইটার, এরপর যড়ি কোন বুকে হামার সম্পর্কে খারাপ কোন কঠা লিখিবেন টো মহা মুশকিল বাঢ়াইয়া ডিব। কেস করিব হামি, রিমেম্বার ইট!’
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল কামালের বন্ধুর। সে ডি. কস্টাকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কেন আমাদের দুজনকেই এমন খবর দিয়েছিলে তা তো বুঝলাম, কিন্তু
১৩৪
ভলিউম ১৪
একবারও কি তুমি ভাবনি যে আমাদের সাথে রাস্তা ঘাটে কখনও দেখা হয়ে যেতে পারে?’
| ম্লান কণ্ঠে ডি, কল্টা বলল, ‘গত টিন মাস যাবট কি কঠোর পরিশ্রম যে করিয়াছি, টাহা আর কি বলিব। সড়া সর্বডা চেষ্টা করিয়াছি যাহাটে পরস্পরের সহিট মোলাকাত না হয়।’
| বুঝেছি! কামাল বলল, প্রায়ই তুমি নানা কারণ দেখিয়ে নানা অজুহাত তুলে, বিপদের কথা বলে শহীদকে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় টেনে নিয়ে গেছ…।’
| ‘ইয়েস, টা করিয়াছি। কারণ ওই রাস্তা ধরিয়া গেলে মিস্টার রাইটারের সাঠে ডেখা হইয়া যাইটে পারিট।’
হঠাৎ প্রশ্ন করল কামালের বন্ধু, কামাল, তোমাদের আজ প্রেসক্লাবের মীটিং
• এ যাওয়ার কথা ছিল?’
‘া, ছিল। ওখানেই তো যাচ্ছিলাম। শহীদ নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে এতক্ষণে। মাথা নাড়ল লোকটা। বোঝা গেল এবার।’
হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল ডি, কস্টা, লেট দ্যাট গো, এবার কাজের কঠা হোক। পাঁচটা টাকা ডিবেন কি ডিবেন না? ওনলি দুটো রাস্তা খোলা আছে হপিনাড়ের সামনে। হয় রাজি হয়ে যান যে হামার নামে খারাপ কিছু লিখবেন না, নয়ট পাঁচটা টাকা ডিন, উকিলের নোটিস ডিব আমি…।’
কামালের বন্ধু জানতে চাইল, আমার পিছু পিছু আসছিলে কেন শুনি?’ পিক-পকেট খুড়ি, ওসব টো ছাড়িয়া ডিয়াছি, ইউ নো।’
বাজে কথা। তুমি মদ খাবার জন্যে টাকা চেয়েছিলে । দিইনি বলে আমার পকেট মারার জন্যে পিছু পিছু আসছিলে তাই না?’
কামাল বলে উঠল, এ-কথাটা পরবর্তী বইয়ে লিখতে ভুলো না।
ডি.কস্টা আতঙ্কিত, হোয়াট!’
• কামালের বন্ধু বলল, এ কথা তো লিখতেই হবে। যা সত্যি তা লেখা আমার কর্তব্য।
ডি. কস্টা কামাল এবং কামালের বন্ধুর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ সে দুই হাত জোড় করে কাঁদো কাদো গলায় বলে উঠল, ‘ফরগিভ মি, মিস্টার অথার! ডোহাই আপনার, হামার প্রেস্টিজ আর পাংচার করিবেন না । আপনার জন্যে হামি রাস্তায় বাহির হইটে পারি না! হামার মান সম্মান, নাম-ঢাম সব ডুবিয়া যাইটেছে। প্লীজ, ফর গড সেক, হামাকে মাফ করিয়া ডিন। ডেকুন, হামি পকেট-পিকিং ছাড়িয়া ডিয়াছি। আমি মড় খাওয়া ছাড়িয়া ডিয়াছি। টবু যদি হাপনি•• |
মদ খাওয়া ছাড়োনি। মিথ্যে কথা বলাও…’ | বিলিভ মি, সব ছাড়িয়া ডিব। প্লীজ, আমাকে ওনলি একটা চান্স ডিয়া ডেকুন। হামাকে ভাল হইটে হেলপ্ করুন•• | কুয়াশা ৪২
১৩৫
কামাল বলল, সত্যি তুমি মদ খাওয়া আর মিথ্যে কথা বলা ছেড়ে দেবে? ‘আপন গড়, ছাড়িয়া ডিব। ওয়ার্ড অফ অনার! কামালের বন্ধু বলল, “বেশ। তোমার সম্পর্কে যা সত্যি নয় তা আর লিখব ।’
“থ্যাঙ্কু! থ্যাঙ্কু!’
করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল ডি. কস্টা একগাল হেসে। করমর্দনের শেষে হাত পাতল সে ওদের দুজনের সামনে। বিনীতভাবে বলল, এই উপলক্ষ্যে, ফর ডা ‘লাস্ট টাইম, আমাকে এক বোটল বেঙ্গলি ওয়াইন পান করিবার অনুমটি ডিন। মড়
না, আজ এ মেডিসিন। ইউ নো।
কামাল এবং কামালের বন্ধু পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল ।
হাত বাড়িয়েই রেখেছে ডি কস্টা, ডিন, টেরো টাকা সেভেনটি পয়সা পকেট হইটে বাহির করুন। একজনের নিকট হইটে নিলে বড় বেশি টর্চার হইয়া যায়, ভুইজনে ভাগাভাগি করিয়া ডিন। এক-একজনের ভাগে পড়িবে সিক্স টাকা এইট্টি ফাইভ পয়সা ওনলি। ডিন।
ছয়। পরদিন এক চিমটি নস্যি নাকে ফেলে স্ট্যাণ্ড থেকে টুপিটা তুলে মাথায় পরে বেরিয়ে এল ডি কস্টা আস্তানার বাইরে। গ্যারেজ থেকে ছোট অস্টিনটা নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। কুয়াশা ওকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে কুচবিহারীর বাড়ির ওপর নজর রাখতে। আধমাইলের মধ্যেই কুচবিহারীর প্রকাণ্ড বাড়ি। মুখোমুখি রাস্তার ওপারের বাড়িটা আণ্ডার কনস্ট্রাকশন। কুচবিহারীর বাড়ির প্রাচীর প্রায় দু’মানুষ সমান উঁচু। বাইরে থেকে ভিতরের কিছু দেখার উপায় নেই। কিন্তু বিপরীত বাড়িটা একতলা। ছাদে ওঠার সিঁড়ি এখনও তৈরি হয়নি। বাড়িটার নির্মাণ কাজ আপাতত স্থগিত আছে। কারণ সিমেন্টের দাম কালোবাজারে একশো টাকা, তাও পাওয়া যায় না। ডি, কস্টা তার ছোট অস্টিনটা নিয়ে এই আপাতত পরিত্যক্ত বাড়ির ভিতর ঢুকল বেলা আড়াইটার সময়।
| বাড়িটার উঠানে গাড়ি রেখে একটা কামরার ভিতর ঢুকল ডি, কস্টা। গত চার পাঁচ দিন ধরে দুপুরের পর থেকে এই কামরায় বসে বসে রাস্তার অপর পারে কুচবিহারীর বাড়ির ওপর নজর রাখছে সে কুশায়ার নির্দেশে। কুচবিহারীর গতিবিধির উপর নজর রাখাই তার প্রধান কর্তব্য। কুচবিহারীর সাথে যারা দেখা করতে আসে তাদের চেহারা মনে রাখারও নির্দেশ আছে।
বেলা ঠিক তিনটের সময় একটা ফোর্ড গাড়ি কুচবিহারীর বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়াল।
জানালা দিয়ে গাড়িটাকে দেখেই রীতিমত চঞ্চল হয়ে উঠল ডি. কস্টা। কারণ
১৩৬
ভলিউম ১৪
আছে। এই গাড়িটাকে গত তিন দিন থেকে রোজ বেলা তিনটের সময় কুচবিহারীর বাড়িতে ঢুকতে দেখছে সে। গাড়িটার ড্রাইভিং সীটে বসে আছে বিশালদেহী এক বার্মীজ।
হর্ন শুনে কুচবিহারীর দারোয়ান খুলে দিল দরজা। গাড়িটা গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকতে দারোয়ান বন্ধ করে দিল দরজা। ডি, কস্টার চোখের আড়ালে পড়ে গেল গাড়িটা।
এদিকে গাড়ি বারান্দায় গিয়ে থামল ফোর্ড। বার্মীজ লোকটা ধীরেসুস্থে নামল গাড়ি থেকে। দারোয়ান বিনয়ের সাথে বলল, “আসুন, হুজুর!’ |
দারোয়ানের পিছু পিছু চলল বার্মীজ দৈত্য। লোকটার বেশভূষা, মুখাবয়ব, হাঁটার এবং তাকাবার ভাবভঙ্গি দেখে সন্দেহ থাকে না যে ব্যক্তিত্ব, মান-সম্মান এবং অর্থ সবই তার বিপুল পরিমাণে আছে। চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই দামী চুরুটের সুগন্ধে।
| দারোয়ানের পিছু পিছু চুরুটের নীল ধোয়া উড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল রাশভারী বার্মীজ লোকটা বাড়ির ভিতর। তার ফোর্ড দাঁড়িয়ে রইল গাড়ি বারান্দায়।
উঠানে বা গাড়ি বারান্দার আশপাশে কেউ এখন নেই। গাড়িটার পিছনের বনেটটা আস্তে আস্তে ভিতর থেকে কেউ তুলছে উপর দিকে। খানিক পরই দেখা গেল.বনেটটা বেশ খানিকটা উঠে পড়েছে, ভিতর থেকে মাথা বের করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে একটি যুবক। যুবকটি রাসেল ভিন্ন আর কেউ নয় । রাসেল বার্মীজ লোকটাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছে রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা।
• আস্তে আস্তে গাড়ির পিছনের গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল রাসেল।
| এদিকে ডি কস্টা অস্থির হয়ে উঠেছে। বার্মীজ লোকটার পরিচয় জানা দরকার। জানা দরকার কুচবিহারীর কাছে রোজ বেলা তিনটের সময় কেন সে আসে। কি সম্পর্ক তার কুচবিহারীর সাথে। কুচবিহারীর সাথে লোকটা কি বিষয়ে আলাপ করে তা শোনার কৌতূহল হচ্ছে তার। কিন্তু কুয়াশার নির্দেশ সে যেন কুচবিহারীর বাড়ির ভিতর প্রবেশ না করে। ডি. কস্টা সিদ্ধান্ত নিল আজ সে বার্মীজ লোকটাকে অনুসরণ করবে ।
কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবার পর মুহূর্তেই দেখা গেল কু বিহারীর বাড়ির গেট খুলে যাচ্ছে। গেটটা খোলা হতেই হুস্ করে ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ফোর্ড গাড়িটা। ডি, কস্টা কামরা থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িটার দিকে ছুটল। ফোর্ড ততক্ষণ সবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তার শেষ মাথায় মোড় নিয়ে। আজ এত তাড়াতাড়ি যে বার্মীজ লোকটা চলে যাবে তা ডি কস্টা ভাবতেই পারেনি। অনুসরণ করার সাধ বুঝি অপূর্ণই থেকে যায়। কিন্তু সহজে হাল ছাড়বার বান্দা নয় সে। গাড়িতে উঠে স্টাট দিল দ্রুত। হুস করে বেরিয়ে এল অস্টিন রাস্তায়। রাস্তার বাঁ দিক থেকে একটা ওপেল রেকর্ড আসছিল, সবেগে ডি. কস্টার অস্টিন ওপেলের হেডলাইটের পাশে, একেবারে কিনারায় গিয়ে ধাক্কা মারল। প্রচণ্ড শব্দ হলো। কিন্তু ব্রেক কষে গাড়ি
কুয়াশা ৪২
১৩৭
থামাবার কথা চিন্তাও করল না ডি কস্টা। দুটো গাড়িরই শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে ওপেল। চালক গাড়ি থেকে নামতে নামতে গালাগালি দিচ্ছে অদৃশ্যমান অস্টিনের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু পিছন ফিরে একবার তাকালও না ডি, কস্টা।
| মোড় নিতে গিয়ে আবার দুর্ঘটনা বাধিয়ে বসল ডি কস্টা’। মোড়ের মাথায় লাল সিগন্যাল দেখেও গাড়ি থামায়নি সে। সামনে রাস্তার ঠিক মাঝখানে, একটা রিকশা দেখে সেটাকে কাটাতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু রিকশার সামনের চাকার সাথে অস্টিনের মৃদু ছোঁয়া লেগে গেল। ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল স্পীডে ধাবিত অস্টিনের ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ল রিকশাটা। রিকশার দুই আরোহী রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খেলেও একমুহূর্ত পরই খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা দাড়ি নেড়ে খিস্তি শুরু করল । ডি, কস্টা ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখে মৃদু একটু হাসল শুধু।
মিনিট পাঁচেক ধরে রাস্তার পথিক, গাড়ির চালক, ট্রাফিক পুলিসদেরকে নাস্তানাবুদ করে ডি. কস্টা শেষ পর্যন্ত দেখা পেল বামজি লোকটার ফোর্ডের। কিন্তু তখনও সেটা বহুদূরে। ডি. কস্টা গাড়ির পীড বাড়িয়ে দিল আরও। পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন, তারপর ষাটের ঘরে গিয়ে কাঁপতে লাগল স্পীড মিটারের কাঁটা। কাঁপছে ডি. কস্টার দুটো হাতও. সবচেয়ে বেশি কাঁপছে তার বুক।
রাস্তায় যানবাহনের অভাব নেই। যে-কোন মুহূর্তে আত্মঘাতি একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে। ষাট মাইল স্পীডে ধাবিত গাড়ির সাথে মুখোমুখি কোন বাস বা ট্রাকের যদি সংঘর্ষ হয়••• আর ভাবতে পারল না ডি কস্টা। হঠাৎ হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল তার। জীবনে এত জোরে গাড়ি চালায়নি সে। মাথায় শয়তান ভর করেছিল বুঝি তাই স্পীড বাড়াতে বাড়াতে ষাটে পৌঁছে গেছে। গাড়ির দুপাশের বাড়ি-ঘর-দোকান-পাট তীরবেগে ছুটে যাচ্ছে পিছনে।
| ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল ডি, কস্টা। | স্পীড কমাবার সাহসও নেই এখন তার। কয়েক সেকেণ্ড পর আবার চোখ মেলল সে। দেখল সামনেই বার্মীজ লোকটার ফোর্ড। ব্রেক করার কথা মনে হলো । এমন সময় টিং করে মিষ্টি একটা বেল বেজে উঠল।
চোখের পলকে ফোর্ডকে পাশ কাটিয়ে গেল অস্টিন। ডি কস্টার হঠাৎ মনে পড়ল ফোর্ডকে অনুসরণ করার কথা তার। কিন্তু এখন যা অবস্থা তাতে ফোর্ডই তাকে অনুসরণ করছে বলা যায়।
স্পীড কমাল এবার ডি. কস্টা। পকেট থেকে বের করল ক্ষুদ্র আকারের একটি মিনি ওয়্যারলেস সেট। সুইচ অন করতেই ভেসে এল বেতারে পরিষ্কার বাংলা কথাঃ আমাকে অনুসরণ করে কোন লাভ নেই, মি. সানন ডি কস্টা! |
খুবই পরিচিত, কণ্ঠস্বর। সুইচ অফ করে দিতে দিতে ব্রেক কষল ডি. কস্টা গাড়ির। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে।
গাড়িটা থামছে। ফোর্ড পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল এবার।
: ভলিউম ১৪ ১৩৮
কলেজ বন্ধ সুলতার। সেজন্যে পড়াশোনাতেও মন বসছে না তার। খেয়েদেয়ে ঘুমাবার জন্যে হয়েছিল সে। তন্দ্রা মত এসেছিল। কিন্তু আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায় সে একটা স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে দেখল উজান তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সুপুরুষ, সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান উজান। স্বভাবসুলভ মৃদু হাসিটি লেগেই আছে মুখে। চশমাটার কাঁচ ভেদ করে দেখা যাচ্ছে শান্ত সরল দুটো চোখ।
. উজান চৌধুরীকে স্বপ্নে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসল সুলতা খাটের উপর। হঠাৎ উজানকে স্বপ্নে দেখল কেন সে? জেগে জেগে উজানকে কল্পনা করা; কল্পনায় দেখা সে তো অন্য ব্যাপার। রোজই ওকে কল্পনায় দেখে সুলতা। কিন্তু স্বপ্নের ভিতর আজ এই প্রথম দেখল সে। .. | চঞ্চল হয়ে উঠল সুলতার মন। কি করছে এখন উজান? ওরও তো ভার্সিটি বন্ধ। নিশ্চয়ই বাড়িতে আছে। ফোন করে দেখলে কেমন হয়?
পা টিপে টিপে নিচে নেমে এল সুলতা তিনতলা থেকে। ড্রয়িংরূমে কেউ নেই দেখে-ফোনের সামনে দাঁড়াল সে।
| ডায়াল করতেই পাওয়া গেল উজানকে। সূলতার গলা চিনতে পেরেই সে বলে উঠল, ‘কি আশ্চর্য! আমিও যে তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। কেমন আছো, সুলতা? কি করছিলে?’ ।
সুলতা সকৌতুকে বলল, তুমিও কি আমার মত স্বপ্ন দেখে ফোন করতে যাচ্ছিলে আমাকে?
তার মানে?’
সুলতা বলল, তোমাকে স্বপ্নে দেখে স্থির থাকতে পারছিলাম না । যাকগে, কি, করছ?
কিছু না। পড়াতেও মন বসছে না । ভাবছিলাম…’।
সুলতা চাপা গলায় বলল, চলে এসো না আমাদের বাড়িতে! সাবধানে। বাবা যেন টের না পান। পিছনের দরজা দিয়ে সোজা লোহার সিঁড়ি বেয়ে চলে এসো সেদিনের মত । আমি আমার কামরায় আছি। দরজা ভেজানো থাকবে। টোকা দেবার দরকার নেই। সোজা ঢুকে পড়বে। আসছ তো?’
আসব?, ধরা পড়ে যাব না তো?’ সুলতা বলল, “কেন, ধরা পড়বে কেন? বাবা বাড়ির পিছন দিকে ভুলেও যান
।
চাকর বাকররা?’
‘ওরাও যায় না ওদিকে। ওরা দেখলে ক্ষতিও নেই তেমন। আমার কথায় ওঠে বসে ওরা। মানা করলে বাবাকে জানাবে না। দশ মিনিট সময় দিলাম, চলে এসো। আমের আচার খাওয়াব।’
কুয়াশা ৪২
১৩৯
ঠিক আছে। আসছি। কিন্তু, সুলতা, তোমার আচারের লোভে যাচ্ছি বটে-তবে, কেন যেন বড় ভয় করছে আজ।
| তোমার সব কিছুতেই শুধু ভয়। এত ভয় করলে চলবে কি করে বলো তো? বাবাকে প্রস্তাব দেবার সময়ও যদি বলো যে ভয় করছে তাহলে আমাদের বিয়েই হবে না। সুতরাং ভয়টাকে তাড়াতে চেষ্টা করো।
ঠিক হ্যায়, ভয়ের নিকুচি করেগা আভি সে!’ বলে উঠল উজান রসিকতা করে। খিল খিল করে হেসে উঠেই থেমে গেল সুলতা। চকিতে দরজার দিকে তাকাল। ছিঃ, ছিঃ, একি করল সে! বাবা হয়তো শুনে ফেলেছেন তার হাসি। শুনে থাকলে কি। ভাবছেন ভগবান জানেন।
ঠিক দশ মিনিট পরই সুলতাদের বাড়ির পিছনের দরজায় দেখা গেল উজান চৌধুরীকে। দরজা খোলাই ছিল। সুলতা ফোন করে উপরে উঠে যাবার আগে
রজাটা খুলে দিয়ে গিয়েছিল ।
তিন তলায় নিজের রূমের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সুলতা দেখল উজান বাড়ির ভিতর ঢুকছে। মুখ তুলে উপর দিকে তাকাতেই সুলতাকে দেখতে পেল উজান। মৃদু মৃদু হাসছে সুলতা। মনে একটু সাহস পেল উজান। কেন যেন বড় ভয় করছে আজ তার। ছোট বাগানটা পেরিয়ে উঁচু বারান্দায় উঠল উজান। বারান্দার শেষ মাথায় লোহার সিঁড়ি। সূলতা এখন দেখতে পাচ্ছে না আর উজানকে।
জানালার কাছ থেকে সরে এসে সুলতা ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়াল। কেন যেন তারও বুকটা কাঁপছে আজ মৃদু মৃদু। উজান ধরা পড়ে যাবে না তো? বাবা জানতে পারলে লজ্জার সীমা-পরিসীমা থাকবে না। মুখ দেখাবে কি করে সে বাবাকে?
| ভুরু কুঁচকে ওঠে সুলতার। ব্যাপার কি? সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে কতক্ষণ লাগে? করছে কি উজান? চুপচাপ আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সুলতা। বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে তার। আরও দু মিনিট কেটে যায়। চঞ্চল হয়ে ওঠে সুলতা। সন্তর্পণে দরজাটা খুলে বারান্দার দিকে তাকায়। কেউ নেই। তিন তলায় ওঠেনি উজান। আশ্চর্য! করছে কি উজান নিচে এখনও? হঠাৎ কথাটা মনে হলো, উজান ধরা পড়ে যায়নি তো বাবার হাতে? ভয়ে শুকিয়ে গেল সুলতার মুখ । সর্বনাশ! নিশ্চয়ই উজান ধরা পড়েছে।
সুলতার ইচ্ছা হলো এক ছুটে নিচে গিয়ে উজানকে উদ্ধার করে সে বাবার কাছ থেকে। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে সে বলবে, বাবা, উজানকে দোষ দিয়ো না। ওর কোন দোষ নেই। দোষ আমার! শাস্তি দেবার আমাকে দাও!-কিন্তু ইচ্ছা হলেও, সুলতার পা উঠল না। দরজা ভিজিয়ে দিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল সে আবার। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। বাবা হয়তো এখুনি ডেকে পাঠাবে তাকে, অনুমান করল সে। জিজ্ঞেস করবে উজান কেন তার কাছে চুপি চুপি আসে। কি
ভলিউম ১৪
১৪o
উত্তর দেবে সে?
কিন্তু সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ আসছে না সুলতাকে ডাকতে। উজানও আসছে না। নিচে থেকে চিৎকারের শব্দ শোনা যাবে আশা করে কান পেতেও ব্যর্থ হলো সুলতা। বাবা নিশ্চয়ই গাল মন্দ করেছেন উজানকে। কিন্তু বাবার গলা উপর অবধি আসছে না ।
রূমের ভিতর একা ছটফট করতে লাগল সুলতা। একবার দরজা খুলে বারান্দা। দেখছে সে, আর একবার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাড়ির পেছনের বাগানটার দিকে তাকাচ্ছে। উজান উপরেও উঠে আসেনি। বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেও দেখেনি তাকে। সুলতা। কেটে গেল দেখতে দেখতে পনেরো-বিশ মিনিট। এমন সময় বাড়ির সামনের দিক থেকে ভেসে এল গাড়ির হর্নের শব্দ ।
নিজের রূম থেকে বেরিয়ে বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির অপর দিকে এসে সুলতা দেখল হনুমানজী বাড়ির গেট খুলে দিচ্ছে। গেট খোলা হতে বাড়ির ভিতর ঢুকল একটা গাড়ি। গাড়িটা দেখে সুলতার বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়ল। চেনা
গাড়ি। উজানের বাবার।
উজানের বাবা কেন এসেছেন এসময়? সুলতা পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল বারান্দার রেলিং ধরে। তবে কি বাবা উজানকে ধরার পর ফোন করে ওর বাবাকে খবর দিয়ে আনালেন? গাড়ি বারান্দার দিকে চলে গেল সাদা ফোক্সওয়াগেন। দেখতে পাচ্ছে না এখন আর সুলতা।
* মিনিট দুয়েক পরই সুলতা দেখল ওদের টয়োটা গাড়িটা গেট পেরিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির ভিতর কে কে রয়েছে দেখতে পেল না সুলতা। হনুমানজী বন্ধ করে দিল।
গেট।
আস্তে আস্তে নিচে নামল সুলতা। হলরূমে দেখা হলো হনুমানজীর সাথে! সুলতার প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল, মিজান চৌধুরী এবং সুলতার বাবা এইমাত্র গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। উজান সম্পর্কিত কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারল না সে। উজানকে সে দেখেইনি বাড়িতে।
সুলতা নিজে খোঁজ করল উজানের। কিন্তু কোন রূমেই সে পেল না উজানকে। অথচ হনুমানজী ভগবানের নামে শপথ করে বারবার বলতে লাগল কুচবিহারী এবং মিজান চৌধুরী ছাড়া গাড়িতে আর কেউ চড়েনি।
সুলতা ঘটনার রহস্যটা কোনমতেই আবিষ্কার করতে পারল না। উজানকে সে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে কিন্তু বেরিয়ে যেতে দেখেনি। তবে কি উজান সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে? | : উজান সামনের গেট দিয়ে, তার অগোচরে, চলে গেছে ধরে নিল সুলতা। কিন্তু মনটা তার সর্বক্ষণ খুঁত খুঁত করতে লাগল।
গাড়ি চালাচ্ছে কুচবিহারী স্বয়ং। পাশে বসে আছে ডা. মিজান। চেহারায় তার ফুটে
কুয়াশা ৪২
১৪১
উঠেছে দুশ্চিন্তার ছাপ। বারবার কুচবিহারীর মুখের দিকে তাকাচ্ছে সে, তার মুখের ভাব দেখে মনের খবর পাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কুচবিহারীর অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখ দেখে কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না সে। খানিক পর আবার সে প্রশ্ন করল, ব্যাপারটা কি খুলেই বলুন না, বিহারী সাহেব। দিনের বেলা মন্দিরে যাচ্ছেন, কই, আগে তো কোনদিন দিনের বেলা:;•!’
ঘনঘন হাতঘড়ি দেখছে কুচবিহারী । গাড়ি চালাতে চালাতে সামনের দিকে তাকিয়ে ভারী, থমথমে গলায় সে বলল, “সব বলব, ডাক্তার। ব্যস্ত হবেন না। বিশেষ দরকার পড়েছে বলেই আপনাকে আজ দিনের বেলা মন্দিরে নিয়ে যাচ্ছি। তবে, ভয় পাবেন না। আপনার ভয়ের কিছু নেই।’
নিষেধ করলে কি হবে, ডা. মিজান ইতিমধ্যেই ভয়ে কাবু হয়ে পড়েছে। ‘পুলিস টের পেয়ে গেছে নাকি…?”
কুচবিহারী ডা. মিজানের কথা যেন শুনতেই পায়নি। যেমন গাড়ি চালাচ্ছিল তেমনি চালাতে লাগল সে। : বক্সনগরে পৌঁছে রাস্তার শেষ মাথায় টয়োটা দাঁড় করাল কুচবিহারী ।
অভ্যাসবশত ভিউ মিররে তাকাল একবার। তারপর তাকাল ডা. মিজানের দিকে।
ঢোক গিলল ডা. মিজান, কিছু বলবেন এবার?’
কুচবিহারী বলল, হ্যাঁ। মন দিয়ে শুনুন। যে-কাজ আমি করতে যাচ্ছি তাতে আপনার কোন বিপদের ভয় নেই। কিন্তু কাজটা করতে হলে আপনার সাহায্য আমার একান্ত দরকার।’
“কি করতে চান আপনি, বিহারী সাহেব?’ ভা, মিজানের গায় আতঙ্ক।
ঘাবড়াবেন না। বলছি তো, আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। যা করব তার সব দায়িত্ব আমার। আপনি শুধু আমাকে একটি ব্যাপারে সাহায্য করবেন।
| কি ব্যাপারে…’
কুচবিহারী বলল, সে-কথা পরে জানাব। আপনি সাহায্য করতে রাজি কিনা বলুন?
ডা. মিজান তাকিয়ে রইল কুচবিহারীর দিকে। খানিক পর সে বলল, “জীবনে অনেক পাপ করেছি, বিহারী সাহেব। পাপের বোঝা আমি আর বাড়াতে চাই না। আমাকে আপনি মুক্তি দিন। এ কথা বহুদিন থেকেই বলছি আমি…।’ ‘ মুক্তি দেব। কিন্তু তার আগে একটি কাজ করতে হবে আপনাকে। এটাই
শেষ। আর আপনাকে কোনদিন ডাকব না।
| ডা. মিজানকে ইতস্তত করতে দেখা গেল।
কুচবিহারী বিরক্ত হয়ে উঠল, কি হলো, চুপ করে আছেন যে? রাজি? ডা. মিজান বলল, কাজটা কি না জানলে
সে কথা এখন বলা যাবে না।’
তাহলে যখন কলবেন তখনই আমি জানাব আপনাকে সাহায্য করতে পারব কিনা, বেশ জোরের সাথেই বলল ডাক্তার।
১৪২
ভলিউম ১৪
কুচবিহারীর ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল। পরমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল সেটা। শার্টের পকেট থেকে কাগজে মোড়া ছোট্ট একটা প্যাকেট রে করল সে। প্যাকেটটা খুলতেই আশ্চর্য একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ল।
ভীত-বিহ্বল দৃষ্টিতে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইল ডা. মিজান, ‘একি! কার আঙুল এটা!
কুচবিহারী হাসছে, “দেখুন না, কার-আঙুল আপনার তো চিনতে না পারার কথা নয়। আঙুলটার গায়ে এই আংটিটা আপনারই। তুলে নিয়ে দেখুন, চিনতে পারবেন।’
| আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আঙুলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখ মুখ বিকৃত হয়ে উঠল ডা. মিজানের, বেসুরো গলায় সে বলে উঠল, উজানের…!’
. ভয় নেই, মিজান সাহেব। ছেলে আপনার বেঁচেই আছে। একটা আঙুল কেটে নিলে কি আর কেউ মরে? যাকগে, শেষ পর্যন্ত তাহলে আঙুলটা চিনতে পেরেছেন। ভাল, খুব ভাল। তা, এবার বলুন রাজি তো? আমাকে সাহায্য করছেন নিশ্চয়ই?’
দিশেহারা হয়ে পড়েছে ডা. মিজান। ছেলের জন্যে আতঙ্কে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার সর্বশরীর, বিহারী সাহেব, দোহাই আপনার, কোথায় রেখেছেন আমার উজানকে বলুন!– ধমকে উঠল কুচবিহারী, নাটক করবেন না, ডাক্তার। নাটুকেপনা আমি পছন্দ করি না। বারবার বলছি, আমাকে সাহায্য করবেন কিনা বলুন। আমার কথা মত কাজ করলে আপনার বা আপনার ছেলের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু আমার কথা
শুনলে ছেলের মুখ এ জীবনে আর দেখতে পাবেন না। আপনার ছেলে বেঁচেই আছে। কিন্তু এরপর বেঁচে থাকবে কি থাকবে না তা নির্ভর করে আপনার সিদ্ধান্তের উপর।’
‘আমি রাজি, বিহারী সাহেব, আমি আপনার কথা মত কাজ করব। কিন্তু আমার ছেলের যেন••।’
ডা. মিজান শেষ দিকের কথাগুলো বলতে পারল না, কান্না এসে তার গলা,রুদ্ধ করে দিল। | চাপা গলায় হুঁ হুঁ করে হেসে উঠল কুচবিহারী। হাসি থামতে সে বলল, মেয়ে মানুষের মত করবেন না, ডাক্তার সাহেব। ভয়ের কিছু নেই আপনাদের। শুনুন, কয়েকটা কথা বলে নিই। মন্দিরে একজন লোক আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।’
কে! শঙ্কিত চোখে তাকাল ডা. মিজান।
কুচবিহারীর দু’চোখে ফুটে উঠল প্রতিহিংসার আগুন। সে বলল, আপনি তাকে চিনবেন না। চিনবার দরকারও নেই। যা বলছিলাম। আপনি এই গাড়িতে অপেক্ষা করুন। আমি একা যাব মন্দিরে। ঠিক পনেরো মিনিট পর আপনি এখান থেকে মন্দিরের দিকে পা বাড়াবেন। তার আগে নয়। বুঝতে পারছেন আমার কথা?’
ডা. মিজান চৌধুরী মাথা নেড়ে বলল, “পারছি। কিন্তু কে অপেক্ষা করছে…?’
–
কুয়াশা ৪২
১৪৩
সে কথা জেনে আপনার কোন লাভ নেই। আর একটা কথা। আমি চলে গেলে পালাবার কথা ভাববেন না ভুলেও। পালিয়ে গেলে নিজের সর্বনাশ নিজে করবেন। জানেন তো, আমাদের ব্যবসার কাজে আপনিও সাহায্য করেছেন এতদিন। পুলিসকে যদি আমার কথা বলেন তাহলে আমিও আপনার কথা বলব। ফেঁসে যাবেন। কমপক্ষে চোদ্দ বছরের জেল হবে আপনার•••।’
না না! আমি পালাব না!’
কুচবিহারী বলল, না পালালেই ভাল। পালালে ছেলেটাকেও চিরকালের জন্যে হারাবেন। আচ্ছা চলি। ঠিকু পনেরো মিনিট পর রওনা দেবেন এখান থেকে। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল কুচবিহারী। তার হাতে একটা অ্যাটাচী কেস।
মন্দিরের সামনে এসে হাতঘড়ির কাঁটা দেখে কুচবিহারী একটু চিন্তিত হলো। চারটে বেজে দশ মিনিট হয়ে গেছে। দশ মিনিট দেরিই হয়েছে তার পৌঁছুতে। কিন্তু নওশের আবদুল্লা এখনও পৌঁছায়নি কেন বুঝতে পারল না সে।
| নওশের আবদুল্লা পৌঁছুলে দোতলার বারান্দায় দেখা যেত তাকে। কিন্তু দোতলার বারান্দায় কেউ নেই। নওশেরের আবার হলো কি? ব্যাটা টের পেয়ে গেছে নাকি তার মনের কথা? তাই আসেনি?
| মন্দিরে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাল কুচবিহারী। না, কোথাও নেই নওশের। উঠান পেরিয়ে বারান্দায় উঠল সে। একটা কালো বিড়াল হঠাৎ লাফ দিয়ে নেমে গেল বারান্দা থেকে। চমকে উঠল কুচবিহারী। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বিড়ালটা একটা ঝোঁপের ভিতর গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকিয়ে আছে তারই দিকে। কেন যেন গা টা ছমছম করতে লাগল কুচবিহারীর। নওশের কি লুকিয়ে আছে কোথাও? ‘ ধীর পায়ে খোলা দরজাটার দিকে এগিয়ে যায় কুচবিহারী । কেন যেন পা উঠতে চাইছে না ।
খোলা দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে কালী মূর্তিটা। পরমুহূর্তে কুচবিহারী সাপ দেখার মত লাফিয়ে পিছিয়ে আসে সবেগে।
| কালীমূর্তির পায়ের সামনে পড়ে রয়েছে নওশের আবদুল্লা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে কামরার মেঝে। নওশের তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। তার চোখ দুটো স্থির হয়ে গেছে চিরকালের জন্যে। মেঝের রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। বেশ খানিক আগেই খুন হয়েছে নওশের আবদুল্লা।
আট
হনুমানজীর কাছ থেকে কথাগুলো শুনে সুলতা, ধরে নিল যে উজান সামনের গেট দিয়ে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল বলে সে ক’মিনিট পরই ফোন করল উজানদের বাড়িতে। উজানের বোন উজালা ফোন ধরল। সুলতার সাড়া পেয়েই রসিকতা করল সে, কেমন আছেন, ভাবী?’
১৪৪
ভলিউম ১৪
উজানের সাথে সুলতার মন দেয়া-নেয়ার ঘটনাটা জানে উজালা প্রথম থেকেই। সকলের অগোচরে উজালা সূলতাকে ভাবা’ বলেই ডাকে ঠাট্টা করে। সুলতা লজ্জায় মরে যায়। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও উজালাকে সে শাসন করতে। পারেনি।
অন্য দিন হলে সুলতা কৃত্রিম গাম্ভীর্য দেখিয়ে উজানাকে শাসন করার চেষ্টা, করত। কিন্তু আজ সে শুকনো গলায় জানতে চাইল, উজালা, তোমার দাদা কি বাড়িতে?’
‘দাদা বাড়িতে? অবাক কণ্ঠে আবার বলল উজালা, অনেকক্ষণ হলো দাদা। আপনাদের বাড়িতে গেছেন। অনেক আগেই তো পৌঁছে যাবার কথা!
সূলতা কি বলবে ভেবে পেল না।
ব্যাপার কি, ভাবী? ঝগড়া করে চলে এসেছে বুঝি দাদা?’ উজালার গলায়, উৎকণ্ঠা।
সুলতা কি ভেবে মিথ্যে কথাই বলল, আরে না । তোমার দাদা আসেননি বলেই তোমাকে ফোন করছি। বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বলই অনেকক্ষণ আগে, গেল কোথায়?
| খানিকক্ষণ আলাপ করে উজান বাসায় ফিরলে সাথে সাথেই যেন ফোন করে সে নির্দেশ দিয়ে ফোন ছেড়ে দিল সুলতা। সোজা উপরের কামরায় উঠে গেল সে। গোটা ব্যাপারটা ভাবতে লাগল নতুন করে আবার ।
সন্ধ্যার সময় ফোন এল। ফোন করেছে উজালা । সূলতা জানতে পারল উজান বাড়ি ফেরেনি। উজালার প্রশ্নের উত্তরে সূলতা জানাল তাদের বাড়িতেও উজান। আসেনি। দুজনেই বেশ চিন্তিত হয়ে উঠল। সুলতার দুশ্চিন্তা অবশ্য খুবই বেশি।
| ক্রমে রাত হলো। রাত গম্ভীর হলো। হনুমানজী খবর দিল সুলতাকে কুচবিহারী বাড়ি ফেরেননি তখনও। বাবার জন্যেও দুশ্চিন্তার সূচনা হলো সুলতার মনে। রাত বারোটার সময় সে আবার ফোন করল উজানদের বাড়িতে। উজালা জানাল তার দাদা উজান এবং বাবা এখনও বাড়ি ফিরছেন না বলে তার আম্মা ভীষণ চিন্তিত হয়ে উঠেছেন। সুলতা বলল, আমরাও খুবই চিন্তিত। তোমার দাদা বাড়ি ফেরা মাত্র আমাকে যেন ফোন করে। আমি অপেক্ষা করে থাকব।’
কিন্তু সারারাত কেটে গেল। ফোন এল না।
কুচবিহারীও বাড়ি ফেরেননি।
সকালে আবার ফোন করল সুলতা। উজালা জানাল তার বাবা, দাদা কেউই গতরাতে বাড়ি ফেরেননি। ইতিমধ্যে তারা থানায়, হাসপাতালে খোঁজ খবর নিয়েছে। কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। | সকাল ন’টায় সুলতা ফোন কল আজমল রব্বানীর বাড়িতে। কুচবিহারী বাড়ি ফেরেনি শুনে আজমল রব্বানী ভারি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “এ কি বলছ, মা তুমি! তোমার বাবা তো রাতে বাইরে থাকার মত মানুষ নন। নিশ্চয়ই কোন বিপদে ১০-কুয়াশা ৪২
১৪৫
পড়েছেন তিনি। তুমি চিন্তা কোরো না, মা। আমি এখুনি আসছি।
পনেরো মিনিটের মধ্যে আজমল রব্বানী তার যুবক ছেলে আকরমকে নিয়ে সুলতাদের বাড়িতে এসে পৌঁছল। সুলতার চোখে পানি । আজমল রব্বানী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠল, দেখো দেখি আমার পাগলী মা’র কাণ্ড! আরে, মানুষের বিপদ-আপদ কি ঘটে না? এত অল্পে মুষড়ে পড়লে চলবে কেন, মা? বিহারী সাহেব ছোট ছেলে নন যে হারিয়ে যাবেন। হয় তিনি কোন জরুরী কাজে আটকা পড়ে গেছেন, নয়তো ছোটখাটো কোন বিপদে পড়েছেন। খবর পেতে কতক্ষণই বা লাগবে? দাঁড়াও, আগে থানায় খবরটা পৌঁছে দিই। আকরম।
. আকরম সুলতার দিকে তাকিয়ে বসেছিল একটা সোফায়। বাবার দিকে তাকিয়ে বসেই রইল সে। আজমল রব্বানী তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘পুতুলের মত বসে আছ যে? সূলতার মন খারাপ, বুঝতে পারছ না? যাও, ওকে নিয়ে ওপরের ঘরে গিয়ে একটু সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করো।
আজমল রব্বানী তাকাল এবার সুলতার দিকে, গলার স্বর কোমল করে বলল, যাও মা, আকমলের সাথে গল্প করোগে। দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই, আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমার বাবার খবর পেয়ে যাব। তেমন যদি কিছু আল্লা না করুন, না ঘটে থাকে। তাহলে আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি নিজেই ফিরে আসবেন••• |’
সুলতা বলল, “বাবা গতকাল সাড়ে তিনটের দিকে বেরিয়েছেন। সঙ্গে বাবার একজন বন্ধুও ছিলেন।’
আজমল রব্বানী বলল, ‘বন্ধু?
সুলতা, বলল, হ্যাঁ। ডা. মিজান চৌধুরী। মিজান সাহেব নিজের গাড়ি নিয়েই এসেছিলেন। কিন্তু বাবার গাড়ি নিয়ে ওঁরা দুজন বেরিয়ে যান। মিজান সাহেবের গাড়িটা আমাদের বাড়িতেই রয়ে গেছে।
আজমল রব্বানী জানতে চাইল, তা মিজান সাহেবের বাড়ির ফোন।
সুলতা’ বলল, “ফোন করেছিলাম আমি। মিজান সাহেবও গতরাতে বাড়ি ফেরেননি। তাঁর ছেলে উজান চৌধুরীও ফেরেননি বাড়িতে।’
চিন্তিত দেখাল আজমল রব্বানীকে।
আকরম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুলতার দিকে। হঠাৎ সে বলে উঠল, সূলতা, চলো আমরা উপরে যাই।’
সুলতা তাকাল আরমের দিকে। কেন যেন গা-টা জ্বালা করে উঠল তার। আকরমকে দুচোখে দেখতে পারে না সুলতা। চেহারা দেখেই কেন যেন সুলতার মনে হয় আরমের চরিত্র ভাল না, প্রয়োজন হলে অনেক নিচে নামতে পারে এ লোক।
যাও, মা, সুলতা। তোমরা গল্প-গুজব করোগে। আমি একবার থানা থেকে ঘুরে আসি।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল সুলতা। হলরুমের দিকে পা বাড়াল সে। আকরম সানন্দে অনুসরণ করল সুলতাকে। পিছন থেকে নিজের ছেলে এবং সুলতার দিকে
১৪৬
ভলিউম ১৪
তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল আজমল রব্বানী। সি. আই. ডি. ডিপার্টমেন্টের সুপারিনটেনডেন্ট মি. সিম্পসন তাঁর চেম্বারে আলাপ করছিলেন দেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কামালের সাথে। এমন সময় ফোন এল থানা থেকে।
মি. সিম্পসনের বিশেষ নির্দেশ অনুযায়ী থানা কর্তৃপক্ষ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কেস সম্পর্কে তাঁকে অবহিত রাখে ইদানীং। থানায় কোন কেস এলেই মি, সিম্পসনকে ফোনে তা জানানো হয়। ফোনে কথা শেষ করে মি. সিম্পসন বললেন, এর আগে দু’জনের নিখোঁজ সংবাদ পেয়েছি। এখন আবার কোটিপতি ব্যবসায়ী মি. কুচবিহারীকে পাওয়া যাচ্ছে না, খবর পেলাম। কি যে শুরু হলো দেশটায়। নিজেই একবার যাই, দেখি দুটো ঘটনার সাথে কোন সম্পর্ক আছে কিনা। যাবে নাকি হে?’
আমি?’ হ্যাঁ । চলো না । কাজ আছে নাকি?’
, কাজ নেই। তবে গেলেই তো ফেঁসে যাব। সাহায্য করতে বলবেন।’
হেসে ফেললেন মি. সিম্পসন, আমাকে সাহায্য করতে চাও বলেই সময় বিশেষে তোমাদের সাহায্য চাই। কই, আর কারও কাছ থেকে তো চাই না? শহীদ আর তুমি ছাড়া কি আর কেউ নেই বাংলাদেশে? আছে। কিন্তু তোমাদের উপর আমার আস্থা আছে।
কামাল বলল, বেশ চলুন। তবে একটা শর্ত আছে। কি শর্ত আবার?’ কামাল বলল, জেরা-জিজ্ঞাসাবাদ যা করবার আমিই করব।’ তার মানে প্রথম থেকেই কেসটা নিজের হাতে তুলে নিতে চাও?’
কামাল বলল, হ্যাঁ। কারণ আমি বুঝতে পারছি এ কেসটা জটিল হতে বাধ্য। কোটিপতিরা হঠাৎ নিখোঁজ হয় না। যখন হয় তখন তার পিছনে অনেক রহস্য অনেক জটিলতা থাকে।’
মি. সিম্পসন বললেন, বেশ তো। তাই হবে। চলো।’ উঠে দাঁড়াল ওঁরা।
সুলতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় কামাল বুঝতে পারল মেয়েটা সব কথা খুলে বলছে না। তার বলার এমন কোন একটা বিষয় আছে যা বলতে চায় সে। অথচ ‘ দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে বলে ফেলতে পারছে না।
আজমল রব্বানী এবং আকরমের দিকে তাকিয়ে কামাল বলল,পনারা গদি কিছু মনে না করেন তাহলে কিছুক্ষণের জন্যে পাশের কামরায় গিয়ে বসতে অনুরোধ
করি।’
আজমল রব্বানী:সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল বটে কিন্তু চোখে-মুখে অসন্তোষ ফুটে উঠল। সে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেও তার ছেলে আকরম যেমন ভুরু কুচকে বসে ছিল তেমনি বসেই রইল সোফায়। মি. সিম্পসন তার দিকে প্রশ্নবোধক কুয়াশা ৪২,
১৪৭
দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
কামাল রীতিমত বিরক্ত বোধ করছে। ছোকরা তার কথা শুনতে পায়নি নাকি? | আকরম তাকিয়ে আছে সুলতার দিকে ।
খুক করে কাশল কামাল।
কিন্তু, আকরম সুলতার মুখের দিক থেকে চোখ সরাল না। সুলতা অস্বস্তি বোধ করছে বোঝা গেল।
কামাল চুপ করে থাকতে পারল না আর, আপনাকেও আমি পাশের কামরায় যেতে বলেছি, মি, আকরম।’
| কামালের দিকে তাকাল আকরম। রীতিমত বিরক্ত হয়েছে সে বোঝা গেল । বলল, দেখুন, আপনি ভুল করছেন। সুলতাকে আপনি আমার সামনেই যে-কোন প্রশ্ন করতে পারেন । ওর সাথে আমার অন্য রকম সম্পর্ক।’
কামালের ভুরু কুঁচকে উঠল, “অন্য রকম সম্পর্ক মানে?’
আকরম তাকাল সুলতার দিকে। সুলতা অস্বস্তি বোধ করছে। বেশ বিরক্ত হয়েছে সে। কিন্তু আকরম সুলতার বিরক্তির তোয়াক্কা না করে সগর্বে বলল, সুলতা আমার ভাবী-স্ত্রী। ওর সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হয়ে আছে•••।’
আকরম! এসব কি বলছ তুমি?’ বিস্মিত গলায় বলে উঠল সুলতা।
কামাল একবার সুলতা একবার আকরর দিকে তাকাল। তারপর বলল, মি, আকরম, আপনাদের মধ্যে ভবিষ্যতে কি সম্পর্ক হবে সে ব্যাপারে আমি আগ্রহী নই। আপনাকে একবার পাশের কামরায় যেতে হবে।’
বিরক্ত আকরম উঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
সূলতা পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্যে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, ‘ওদেরকে সরিয়ে দিলেন কেন বলুন তো? কি জিজ্ঞেস করবেন আমাকে?
কামাল বলল, “জিজ্ঞেস কিছু করব না। আমার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে যে আপনি আমাদেরকে একটা কথা বলতে চান, অথচ বলতে পারছেন না।’
সুলতা তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। খানিকক্ষণ পর সে একটু হাসল। বলল, আপনার অনুমান শক্তি অসাধারণ । সত্যি, একটা কথা বলব কি বলব না ভেবে পাচ্ছি না।’
| ‘কোনও কথা চেপে রাখা উচিত নয়,’ বললেন মি, সিম্পসন । | সুলতা বলল, কথাটা বলার আগে ছোট একটা ভূমিকা করে নিতে হয়। ডাক্তার মিজান চৌধুরী আমার বাবার বন্ধু:•• |’
কামাল বলল, “তাই নাকি! আচ্ছা সুলতা দেবী, আপনি নিশ্চয়ই জানেন মি. মিজান চৌধুরী এবং তার একমাত্র ছেলে মি. উজান চৌধুরীও গত রাতে বাড়ি ফিরে যাননি। মিসেস মিজান চৌধুরী আজ সকালে থানায় খবর দিয়েছেন।’
সুলতা বলল, “জানি। ভা, মিজান চৌধুরীর ছেলে উজান চৌধুরীর সাথে আমার পরিচয় আছে। শুধু যে পরিচয়ই আছে তা নয়, ওর সাথে•••!’ ঠিক কিভাবে কথাটা বলবে ভেবে পেল না সুলতা।
১৪৮
ভলিউম ১৪
মি. সিম্পসন হেসে ফেললেন। বললেন, ‘বুঝেছি! লজ্জা কি, মিস সুলতা। বলে যান।
সুলতা মৃদু হেসে বলল, “গতকাল দুপুরে ওকে ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম, আমাদের বাড়িতে এসো। এর আগেও ও এসেছে আমাদের বাড়িতে। কিন্তু গোপনে। বাবা জানতেন না। বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে আসত ও। গতকালও চুপি চুপি এই পথ দিয়ে ওকে আসতে বলেছিলাম।’
এসেছিলেন তিনি?’।
সুলতা বলল, এসেছিলেন। ওপরের রূম থেকে ওকে আমি বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেখি।’
চুপ করে রইল এরপর সুলতা।
কামাল কলল, তারপর? | সুলতা ম্লান মুখে বলল, তারপর ওকে আর দেখিনি। ওপরে ওঠেনি ও। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বাবার হাতে ধরা পড়ে গেছে উজান। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এভাবে অনেক সময় কেটে যায়। বিশ-পঁচিশ মিনিট পর বাড়ির সামনের গেট দিয়ে উজানের বাবাকে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে দেখি আমি। আরও বেশি ভয় পেয়ে যাই। এর পাঁচ-সাত মিনিট পরই আমার বাবা এবং উজানের বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ওরা চলে যাবার পর নিচে নেমে আমাদের বাড়ির দারোয়ান হনুমানজীকে জিজ্ঞেস করতে সে জানায় গাড়ি করে আমার বাবা এবং উজানের বাবা বাইরে গেছেন। উজানকে গাড়িতে উঠতে দেখেনি সে। এমনকি বাড়িতেও দেখেনি
সে তাকে।
খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সুলতা আবার বলল, ‘ব্যাপারটা বড় রহস্যময় ঠেকছে আমার কাছে। বাড়ির পিছন দিক দিয়ে ঢুকে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে সোজা আমার রূমে ঢোকার কথা উজানের। অথচ ওপরে ওঠেইনি সে। বাবার হাতে ধরা, পড়লেও হনুমানজী জানতে পারত। বাবা নিশ্চয়ই তাকে জেরা করতেন। অন্তত উজানের গলা শুনতে পেত হনুমানজী।
মি. সিম্পসন বললেন, “হয়তো আপনার বাবা মি. উজানকে তিরস্কার করেছিলেন। হয়তো অপমানিত হয়ে তিনি সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। আপনি দেখেননি…।’ ‘ তাই যদি হয় তাহলে উজানকে ফোন করে পাইনি কেন? বাড়ি ফিরে যায়নি কেন সে?’
• কামাল বলল, “ঠিক। অপমানিত হয়ে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল কোথায় সে? আপনার কি ধারণা, মিস সুলতা? মি. উজান কি আদৌ এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন?’
তার মানে?’ সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সুলতা।
আর একটু পরিষ্কার করে বলল কামাল, বাড়িটা একবার ভাল করে সার্চ করা
কুয়াশা ৪২
১৪৯
দরকার।’
সুলতা ম্লান গলায় জানাল, ‘সব জায়গায় খোঁজ করেছি আমি। সন্দেহটা আমার মনেও জেগেছিল। বাবা এমনিতে শান্তশিষ্ট মানুষ। কিন্তু রেগে গেলে অন্ধ হয়ে যান। তিনি।
ড্রয়িংরুমে বসে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ বেজে উঠল ফোনটা। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে নিল কামাল।
থানা থেকে ফোন এসেছে। কথা শেষ করে মি. সিম্পসনের দিকে ফিরে কামাল কলল, রমনা পার্কের ভিতর একটা লাশ পাওয়া গেছে। থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। বস্তায় ভরা অবস্থায় পাওয়া গেছে লাশটা। ক্ষতবিক্ষত, চেনবার কোন উপায় নেই।’
বাবা!’ চাপা গলায় উচ্চারণ করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সুলতা। কামাল বলল, মুষড়ে পড়বেন না, মিস সুলতা। না দেখ আগেই ধরে নেবেন লাশটা আপনার বাবার। যে-কোন লোকের লাশ হতে পারে। উজান চৌধুরী বা তার ছেলেও নিখোঁজ এখন অবধি, কথাটা ভুলবেন না।’
মি, সিম্পসন উঠে দাঁড়ালেন।
পাশের কামরা থেকে এসে হাজির হলো আজমল রব্বানী। আপনাদের কথা কি শেষ হয়েছে, মি, কামাল আহমেদ?’
কামাল বলল, হয়েছে। তবে আপনাকে এবং সুলতাকে একবার যেতে হবে থানায়। একটা লাশ পাওয়া গেছে।
সেকি!”সুলতা কাঁদছে।
এমন সময় শরীফ চাকলাদার প্রবেশ করল ড্রয়িংরূমে, কুচবিহারীজীর এখনও কোন খবর পাওয়া যায়নি নাকি?’
মি. সিম্পসন এবং কামাল প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। আজমল রব্বানী শরীফ চাকলাদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ইনিও আমাদের একজন বন্ধু।
মি. সিম্পসন বললেন, মিস সুলতা, উঠুন। “ আজমল রব্বানী বলে উঠল, ‘সুলতা আবার থানায় যাবে কেন? আমরাই তা…।’
| মি. সিম্পসন বললেন, না। ওকেও যেতে হবে। কামাল, চলো।’
আজমল রব্বানী আর কথা বাড়াল ।
|
-।
থানায় এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হলো।
লাশটা যে কুচবিহারীর তা চেনবার কোন উপায় নেই। খুনীর, প্রাণে যে দয়ামায়ার ছিটে ফোঁটাও নেই একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়। লাশের চোখ, নাক, ঠোঁট, গাল, কপাল, চিবুক, ভুরু কিছুই চেনবার উপায় নেই। ছোরা দিয়ে হাজারবার ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে মুখটা। কিন্তু লাশটা যে কুচবিহারীর তাতে কারও সন্দেহ রইল না। লাশটা দেখেই বাবা বলে আর্তচিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাল সুলতা। জ্ঞান ফিরল দশ-পনেরো মিনিট পর। লাশটা সে চিনতে পেরেছে। এ তার
.৫০
ভলিউম ১৪
বাবারই লাশ।
আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদারও একবাক্যে জানাল এ লাশ তাদের বন্ধু কুচবিহারীরই। তার পরনের কাপড় চেনা গেল। চেনা গেল পায়ের জুতো। লাশের কব্জিতে ঘড়ি এবং আঙুলে আংটিও নিঃসন্দেহে কুচবিহারীর।
ময়না তদন্তের জন্যে লাশকাটা ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হলো লাশ। সুলতাকে নিয়ে
• বিদায় নিল আজমল রব্বানী এবং শরীফ চাকলাদার। বেলা, এগারোটা বাজে তখন । তখনও মিজান চৌধুরী এবং তার ছেলে উজানের কোন সন্ধান করতে পারেনি পুলিস।
ওরা বিদায় নিয়ে চলে যেতে মি. সিম্পসন বললেন, “কি রকম বুঝছ, কামাল?”
কেসটা প্রথমে যত সহজ বলে মনে করেছিলাম তত সহজ নয়। আজমল রব্বানী আর তার ছেলে আকরমকে বেশ জটিল চরিত্রের লোক বলেই মনে হলো । ভাবছি, শহীদের সাথে দেখা করব একবার। ওকে ছাড়া চলবে না।’
| এদিকে সুলতাদের বাড়িতে এসে আজমল রবানী সান্তনা দেবার চেষ্টা করছেন সুলতাকে। সুলতা তার কামরায় উঠে এসেছে । বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে সে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আজমল রব্বানী।
| রূমের ভিতর দুটো চেয়ারে বসে আছে শরীফ ‘চাকলাদার এবং আকরম। আকরমকে অস্বাভাবিক চিন্তিত দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝেই গভীর চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে
সে।
| আজমল রব্বানী সুলতাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, কেঁদো না, মা। দুনিয়ায় কেউ চিরকাল বেঁচে থাকে না। কারও মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে হয়, কারও হয় অস্বাভাবিক ভাবে। তোমার বাবাকে কেউ খুন করেছে। কিন্তু তাই বলে একথা ভেবো না যে খুনীকে আমরা ছেড়ে দেব। আমরা বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না! খুনী ধরা পড়বেই, মা । ধরাও পড়বে, তার উপযুক্ত শাস্তিও হবে। তবে তাতে লাভ-ক্ষতি কোনটাই নেই, যিনি গেলেন তিনি কি আর ফিরে আসবেন?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আজমল রব্বানী। তারপর নতুন করে বলতে লাগল, যা ঘটে গেছে তা নিয়ে হা-হুঁতাশ করলে চলে না, মা । শক্ত হও। নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করো। তোমার বাবার বয়স হয়েছিল, দুদিন আগে বা পরে তাকে যেতেই হত। কিন্তু তোমার সামনে পড়ে রয়েছে গোটা জীবনটাই। তোমার কি হবে সেটাই এখন চিন্তার কথা। তবে সে চিন্তা আমার, তোমার নয়, মা। তোমার ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব এখন আমার কাঁধেই পড়েছে। ভেবেছিলাম তোমার সাথে আকরমের বিয়েটা সেরে ফেলব আগামী মাসেই কিন্তু কে জানত এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যাবে। যাকগে, শুভ কাজ সুদিনেই হবে। সময় তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না। মাস চার-পাঁচ কাটুক, তোমাদের দুজনকে ঘর-সংসার গড়ে দিয়ে দায়িত্ব মুক্ত হব। আমারও তো সময় হলো…।’
সুলতাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা হলেও তার কানে আজমল রব্বানীর একটা
কুয়াশী ৪২
? ১৫১
কথাও ঢুকছে না। বাবার শোকে পাগলিনী সে।
কিন্তু বাবার কথাগুলো শুনতে বড় ভাল লাগছে আকরমের। মিটিমিটি হাসছে সে আপন মনে। সে অবশ্য মাঝে-মধ্যে এখনও কি যেন গভীর ভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করছে। দুপুরের দিকে সুলতা একটু শান্ত হলো। আজমল রব্বানী প্রস্তাব দিল সুলতাকে তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকার জন্যে। সুলতা রাজি হলো না। সংক্ষেপে
সে জানাল, বাড়ি ছেড়ে এখন অন্য কোথাও থাকতে পারব না আমি, কাকা।’
আজমল রব্বানী বলল, তা ঠিকই বলেছ, মা! তবে তাই থাকো। কিন্তু তোমাকে একা ফেলে রেখে যাই বা কি করে। আকরমকে রেখে যাচ্ছি। ও,তোমার দেখাশোনা করবে।’
সে ব্যবস্থাই হলো। সুলতা অবশ্য আপত্তি তুলেছিল মৃদু। কিন্তু তার আপত্তি কানে তোলেনি ওরা। আকরম খুব খুশিই হলো ।
ফেরার পথে গাড়িতে আলাপ হলো। শরীফ চাকলাদার এই প্রথম মুখ খুলল অনেকক্ষণ পর, নওশেরের এই কাণ্ডের কারণ বোঝা যাচ্ছে না।’
কিসের কারণ বোঝা যাচ্ছে না? তার কথা সেরেখেছে। খুন হয়নি কুচবিহারী?’ আজমল রব্বানী বলল কথাটা।
শরীফ চাকলাদার বলল, আমি সে কথা বলিনি। কুচবিহারীর লাশ তো নিজেদের চোখেই দেখলাম। কথা রেখেছে নওশের। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা ।
কুচবিহারীর মুখের চেহারা অমন বিকৃত করার কারণ কি তার?’
আজমল রব্বানী বিরক্তির সাথে পাল্টা প্রশ্ন করল, “কি কারণ? এর পিছনে কারর্ণের খোঁজ করার কোন মানে হয়? সবাই কি এক রকম, সবাই কি একই পদ্ধতিতে খুন করে? হয়তো নওশের খুন করার পর লাশের মুখ বিকৃত করে মজা।
পায়…’
শরীফ চাকলাদার বাধা দিয়ে বলল, আরও একটা ব্যাপার আছে।’ ‘কি?’
গতকাল রাতের প্রথম দিকে বা বিকেলে খুন হয়েছে কুচবিহারী। পুলিসের তাই ধারণা। অথচ নওশের আমাদের সাথে এখনও দেখা করছে না কেন? কি করছে সে? গতরাতেই কি দেখা করা উচিত ছিল না তার আমাদের সাথে? টাকার কথা কি সে ভুলে গেছে? আড়াই লাখ টাকা পাবে সে আমাদের কাছ থেকে।
. ই। খুব চিন্তার কথাই দেখছি। তা আপনার কি ধারণী, নওশেরের দেখা না করার কারণ কি হতে পারে?
শরীফ চাকলাদার চিন্তিত ভাবে কাল, কারণটা বুঝতে পারছি না বলেই তো ভাল ঠেকছে না ব্যাপারটা। কেন যেন মনে হচ্ছে, আমাদের সামনেও ওত পেতে আছে ভয়ঙ্কর বিপদ। রব্বানী সাহেব, খুব সাবধানে থাকবেন।
কথাগুলো বলে আপন মনে হাসল শরীফ চাকলাদার। বড় রহস্যময় সে হাসি। আজমল রব্বানী চিন্তিত মনে গাড়ি চালাচ্ছিল সামনের দিকে তাকিয়ে। তাই হাসিটা দেখতে পেল না সে।
Leave a Reply