৪১. ভৌতিক বন [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪১
প্রথম প্রকাশঃ জুলাই, ১৯৭৩
এক শাড়ি কাপড়ের হাটের জন্যে সোনাডাঙ্গা বিখ্যাত। হপ্তায় একদিন হাট। লাখ লাখ টাকার বেচাকেনা। এই হাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সোনাডাঙ্গা শহরটা।
| সোনাডাঙ্গার ইতিহাস যারা জানে তারা সোনাডাঙ্গায় হাট করতে এলেও মনের ভিতর খুঁতখুঁতে একটা ভয় নিয়েই আসে। সারাটা দিন হাটের মধ্যে কাটিয়ে, সন্ধ্যা নামার আগেই ট্রেন ধরে যে-যার গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয়। ভাল হোটেল আছে। হোটেলের খাওয়াদাওয়া ভাল। ব্যবসায়ীরা একদিন আগে পৌঁছুতে পারলে সেরা মালগুলো হাটের দিন সকালে কিনে ফেলতে পারে। কিন্তু তা বড় কেউ করে
। যেদিন হাট সেদিনই সোনাডাঙ্গায় পৌঁছয় সবাই। একদিন আগে এসে সোনাডাঙ্গায় রাত কাটাবার মত দুঃসাহস কারও নেই।
সোনাডাঙ্গার চারদিকে বনভূমি। বন কেটে প্রকাণ্ড এক গ্রাম গড়ে উঠেছিল। শোনা যায়, এই গ্রামের সৃষ্টি হয় ঠগীদের একটি অনুতপ্ত দলের লোকজনদের চেষ্টায়। কিন্তু সোনাডাঙ্গার গ্রামের বর্তমান অধিবাসীরা নিজেদেরকে ঠগীদের উত্তর-পুরুষ বলে স্বীকার করে না। তাদের ধারণা তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন চর এলাকার লোক। চর ডুবে যেতে শত শত হাজার হাজার মেয়ে-পুরুষ এই জঙ্গলে এসে আশ্রয় নেয় এবং ঠগীদের সাথে-বছরের পর বছর ধরে সংগ্রাম করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে। চাষাবাদই সোনাডাঙ্গার অধিবাসীর প্রধান পেশা।
তাঁতের সংখ্যাও প্রচুর।
গ্রাম এখন আর বলা চলে না সোনাডাঙ্গাকে। বিদ্যুৎ, দুরালাপনী, মোটর গাড়ি, সাইকেল-রিকশা, ট্যাক্সি, ট্রেন–সবই আছে। আছে একটা হাসপাতাল, কয়েকটি ব্যাঙ্ক; একটি উচ্চ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পোস্ট অফিস। সরকারী কলেজ চালু হবার সব ব্যবস্থাও প্রায় পাকা হতে চলেছে।
সোনাডাঙ্গায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যাও বর্তমানে প্রচুর। ডাক্তার আছেন তিন। জ।
মাধবপুর প্রায় বিশ মাইল দূরে সোনাডাঙ্গা থেকে। বড় শহর। নিউ মার্কেট আছে। আছে সিনেমা হল।
নটার ট্রেনটা শেষ ট্রেন। ট্রেন থেকে নেমে যে-যার বাড়ির ভিতর ঢোকে। তারপর সারারাত আর কোন সাড়া পাওয়া যায় না সোনাডাঙ্গার মানুষদের। কুয়াশী ৪১
আজও সেখানকার মানুষরা রাতের বেলা ঘর থেকে বের হতে আতঙ্ক অনুভব করে।
কেউ কেউ বলে সোনাডাঙ্গার চারপাশে যে গভীর জঙ্গল তার ভিত্বর এখনও শত শত হাজার হাজার ঠগী লুকিয়ে আছে।
‘ আবার কেউ কেউ বলে যে-না ঠগীরা কবে মরে ভূত হয়ে গেছে। ঠগীদের বদ আত্মারা নাকি রাতের বেলায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গ্রামের ভিতর চলে আসে। ওৎ পেতে থাকে তারা বাড়িগুলোর আনাচে-কানাচে, ঘরের দরজা জানালার পাশে। কেউ বের হলেই ঘাড় মটকে তার রক্ত চুষে খাবে। জঙ্গলের ভিতর যে প্রাচীন মন্দিরটা আছে সেখানে নাকি তারা নরবলি দিত।
এসব কথা কেবলই গল্প কথা। বুড়োবুড়ীরাই বলে থাকে। আজ অবদি ঠগীরা বা ঠগীদের আত্মারা কারও ঘাড় মটকায়নি।
কিন্তু রাত নামার পর সোনাডাঙ্গার ছেলেমেয়ে এমনকি যুবক-যুবতীদেরও গা ছমছম করে। ঘরের বাইরে বড় একটা তারা বের হয় না ।
. গ্রামটা বেশ বড়।
পাশাপাশি তিনটে ব্যাঙ্ক। বাঙলা ব্যাঙ্কটা অপর দুই ব্যাঙ্কের মাঝখানে। ব্যাঙ্কের সামনেই বাজার। প্রকাণ্ড বাজার। সকাল থেকে সন্ধে অবদি গমগম করে। পাকা দোকানের সংখ্যাই একশো। আরও অনেক রকম দোকান। প্রায় সব জিনিসই পাওয়া যায়। গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় দু’হাজার। মাধবপুর সোনাডাঙ্গার চেয়ে বড় শহর হলেও সব জিনিস সেখানে পাওয়া যায় না। সেখান থেকেও লোক আসে সোনাডাঙ্গার বাজারে। বাজার এবং হাট একই জায়গায় বসে না।
আজ মঙ্গলবার।
মি, হায়দার ঠিক ন’টার সময় বাড়ি থেকে বের হন ব্যাঙ্কের উদ্দেশে। কিন্তু আজ প্রায় দু’ঘন্টা আগে বাড়ি থেকে বের হলেন তিনি। সঙ্গে চাকর ছেলেটাকে নিলেন। বাজার করে পাঠাবেন।
| মিসেস হায়দার জানেন স্বামীর আজ তাড়াতাড়ি ব্যাঙ্কে যাবার কারণটা ।
বাঙলা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মি, হায়দার। আট-দশ বছর হয়ে গেছে চাকরি করছেন। ক্লার্ক হয়ে ঢুকেছিলেন। আজ তিন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। সোনাডাঙ্গার বাজারে কয়েকটা দোকানও আছে তার। নিজে চালান না। লোক দিয়ে চালান দুটো। বাকিগুলো ভাড়া দিয়েছেন। ছোটখাট সাপ্লাইয়ের কাজ করেও ভাল পয়সা রোজগার করেন তিনি। রীতিমত বড় লোকই বলা যায় তাঁকে। ইচ্ছা করলে চাকরি না করলেও পারেন। কিন্তু চাকরিটাকে তিনি ভালবেসে ফেলেছেন একরকম, তাই ছাড়ার কথা কোনদিন ভাবেননি।
মিসেস হায়দারও অশিক্ষিতা নন। কলেজে পড়তে পড়তে হঠাৎ লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে বিয়ে করেছেন মি, হায়দারকে।
দোতলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্বামীর গমন পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ৫২
ভলিউম ১৪
থাকতে থাকতে চিন্তিত হয়ে উঠলেন মিসেস হায়দার। বুকের মাঝখানে একটা ভয় ক্রমশ দানা বেঁধে উঠছে তাঁর।
দুশ্চিন্তায়, ভয়ে এবং পাপবোধে জর্জরিতা মিসেস হায়দার প্রায় টলতে টলতে বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলেন। চাকরাণীটাকে ডেকে বললেন, “আজ আমি কিছু খাব না। শরীরটা খারাপ। তোর সাহেবের জন্যে বেঁধে দুপুরবেলা ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দিস।’
“কি হয়েছে বিবি সাব’। | হঠাৎ কোনদিন যা হয় না তাই হলো। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে মিসেস হায়দার চিৎকার করে উঠলেন, দূর ই আমার সামনে থেকে! কথার ওপর কথা! ব্যাখ্যা চাইছে আবার, আজই তোকে বিদায় করে দেব!’ |
হাঁ করে তাকিয়ে রইল চাকরাণীটা তার বিবি সাহেবার দিকে। এ কেমন হলো? এমন তো কখনও করেন না বিবি সাহেব!
নানা কথা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেল চাকরাণীটা কামরা থেকে। মিসেস হায়দার নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি।
দুই ব্যাঙ্কের ভিতর ঢুকেই মি. হায়দার ডাকলেন, লতিফ।
দারোয়ান লতিফ গেটের বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকল।
শরীফ সাহেব, মোশাররফ, জিয়া সাহেব। লতিফ বলল, ওনারা এসেছেন, স্যার। পিছনের উঠানে আছেন সবাই। তোমার ভাই?’ লতিফের বদলে আজ ব্যাঙ্কের দারোয়ানি করবে লতিফের ভাই’ মোতাল্লিব।
সে তো আসবে আটটায়, সার।’ মি. হায়দার চশমা খুলে রুমাল দিয়ে কাঁচ দুটো মুছতে মুছতে বললেন, “কিছু জানে না তো সে?’
, স্যার! কিছুই বলিনি ওকে। আটটার সময় আমার সাথে দেখা করতে বলেছি শুধু। এসে আমাকে পাবে না। করিম সাহেব. থাকবেন। তিনিই ওকে বলবেন আজকের দিনটা দারোয়ানি করতে।’
পুরানো নোট ঢাকায় যাবে আজ। সতেরো লক্ষ টাকা সব মিলিয়ে। একশো, দশ, পাঁচ, এক-সব রকমের নোট মিলিয়ে সতেরো লাখ টাকা। এতগুলো টাকার ব্যাপার, সুতরাং গোপনীয়তাও রক্ষা করা দরকার।
মি, হায়দার আবার সব বিষয়েই একটু অতিরিক্ত সাবধানী। কুয়াশা ৪১
মি. শরীফ বাঙলা ব্যাঙ্কের একাউন্টেন্ট। তার ওপর মি. হায়দারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু তবু তিনি বন্ধুকেও আগে থেকে বলেননি যে আজ ঢাকায় টাকা পাঠানো হবে।
বাজার করতে আসার পথে লতিফের বাড়ি হয়ে এসেছিলেন মি. হায়দার। লতিফকে ঘুম থেকে তুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সকলের বাড়িতে। সবাইকে আধ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাঙ্কে পৌঁছুবার নির্দেশ দিয়েছিলেন লতিফের মাধ্যমে।
সবাই চেনে মি. হায়দারকে। মি. শরীফ, ক্লার্ক মোশাররফ, ক্যাশিয়ার জিয়া সবাই জানে কারণ জিজ্ঞেস করা বৃথা । লতিফকে তারা কোন প্রশ্ন করেওনি। খবর পেয়েই ছুটে চলে এসেছে ব্যাঙ্কে।
তবে এদের মধ্যে একজন মোটেই আশ্চর্য হয়নি। তার কারণ সে জানত আজ ঢাকায় টাকা যাবে। জানত সে কয়েক দিন আগে থেকেই।
মি. হায়দার বললেন, তোমার ভাই এলে আমিও তাকে বলতে পারব। তোমাদের সাথে আমি যাচ্ছি না।’
কোথায় যাব স্যার, আমরা?’ | সুযোগ পেয়ে এই কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না লতিফ। একটু যেন তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন মি. হায়দার লতিফের দিকে। তারপর কি মনে করে মিটি মিটি হাসতে লাগলেন। বললেন, কোথাও তো নিশ্চয়ই যাবে। তাড়াতাড়ি করে দেখি। গেট বন্ধ করে পিছন দিকে এসো।’
লতিফ গেট বন্ধ করার জন্যে এগিয়ে গেল।
মি. হায়দার অফিসরূমের ব্যাক ডোর ঠেলে বেরিয়ে এলেন পিছনের বারান্দায়। বারান্দা থেকেই দেখলেন মি, শ্রীফ, মোশাররফ, জিয়া-তিনজন বসে রয়েছে তিনটে চেয়ারে।
শীতের সকাল। রোদে বসে কথাবার্তা বলছে ওরা। মি, হায়দারকে দেখে মি. শরীফ ছাড়া সবাই উঠে দাঁড়াল। বারান্দা থেকে উঠানে নেমে মি. হায়দার বললেন, বসুন, আপনারা বসুন।’
ক্লার্ক মোশাররফ বয়সে তরুণ। নতুন এসেছে চাকরিতে। বিনয়ের অবতার ছেলেটি। মি. হায়দার একটু বিরূপ এবং সন্দেহের চোখেই তাকে দেখেন। তার ধারণা এত বিনয় ভাল নয়। হয় সে হীনমন্যতায় ভুগছে নয়ত বিনয়টা তার কৃত্রিম।-সেক্ষেত্রে ছেলেটি অতি চালাক।
. জিয়া সাহেব-মি. হায়দারের ধারণা সৎ লোক। একটা পয়সার এদিক ওদিক হয়নি তার হাত থেকে আজ অবদি। চাকরিও করছেন প্রায় আট বছর ধরে। প্রায় মি. হায়দার এবং মি, শরীফের সময় থেকে। ওরা দুজনেও আজ আট বছর ধরে চাকরি
করছেন বাঙলা ব্যাঙ্কে।
| মোশাররফ প্রচুর বিনয়ের হাসির সাথে নরম ভারী ডালের মত নুয়ে পড়তে পড়তে এক’পা সরে গিয়ে মৃদু স্বরে বলল, সে কি হয়, স্যার! আপনি বসুন। আমি ৫৪।
ভলিউম ১৪
দাঁড়িয়ে থাকি।’
মি, শরীফ বললেন, “কি ব্যাপার, হায়দার? মি, শরীফের গলায় একটু যেন বিরক্তির সুর।
হেসে ফেললেন মি. হায়দার। শরীফ যে বিরক্ত হয়েছে তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। হাসতে হাসতেই বললেন, আজ ঢাকায় টাকা পাঠাতে হবে। তাই ডেকে পাঠিয়েছি তোমাদেরকে।
এর আগেও ঢাকায় টাকা পাঠাবার সময় এমনি হঠাৎ পরিকল্পনা করে বসেছেন মি. হায়দার। কিন্তু সাত-সকালে সকলকে, ডেকে আগে কখনও একথা বলেননি তিনি।
মি. শরীফ অধিকতর বিরক্তির সুরে বললেন, এর কোন মানে হয়, বলো তো? কালকেই তো খবরটা জানাতে পারতে তুমি?
কেমন যেন অপ্রতিভ হয়ে তাকিয়ে রইলেন মি. হায়দার। কি বলবেন তিনি উত্তরে? বলবেন, তোমাদেরকে আমি বিশ্বাস করি না তাই খবরটা আগে থেকে জানাইনি? তা বলা সঙ্ নয়।
, তাছাড়া সত্যিসত্যি তিনি কাউকে অবিশ্বাস করেন না। কেন যে তিনি টাকা পাঠাবার সময় এরকম অস্বাভাবিক গোপনীয়তা পালন করেন তা তিনি নিজেই ভাল করে জানেন না। হয়তো স্বভাব। হয়তো অহেতুক ভয়। হয়তো তিনি কোন রকম ঝুঁকি নিতে একেবারেই পছন্দ করেন না।
কিন্তু মি, শরীফ যে আজ এত বেশি বিরক্ত হবে তা ভাবেননি মি. হায়দার। অপ্রতিভ হাসিটা মুছে ফেললেন তিনি জোর করে মুখ থেকে। বললেন, ‘অফিশিয়াল ব্যাপারগুলো কেমন বোঝো তো, শরীফ? তাছাড়া আমি নিজেই ঠিক করতে পারছিলাম না কবে পাঠানো যায় টাকাগুলো। আজ সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি সূর্য ওঠেনি। ভাবলাম কাজটা সেরে ফেলাই যাক।
• ভাল কথা, যেমন বুঝেছ ভালই বুঝেছ । ক’টার ট্রেনে যাবে টাকা? এখনও কেউ আমরা নাস্তা করিনি।
মি, হায়দার পিছন ফিরে তাকালেন। লতিফ পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। | লতিফ, হোটেলে গিয়ে নাস্তার অর্ডার দিয়ে এসো তো। কিন্তু ট্রেন যে ন’টায়।’
মি. শরীফ উঠে দাঁড়ালেন নটায় ট্রেন শুনে। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঢাকায় ট্রেন পৌঁছবে সাড়ে এগারোটার সময়। এখন নাস্তা করার সময়ও নেই। দরকার নেই নাস্তার। টাকার ট্রাঙ্ক বের করে ভ্যানে চড়াতে হবে, স্টেশনে যেতে হবে-সময় কই অত? আটটা তো প্রায় বাজেই।
মি. হায়দার বললেন, স্টেশনে গিয়ে নাস্তা করলেই চলে।
‘তাই করব।’ ‘কুয়াশা ৪১
শান্ত হয়ে গেছেন মি. শরীফ। কাজটা যখন হতে যাচ্ছে, যোক নির্বিঘ্নে, ভাবটা এই রকম।
লতিফ বলল, ‘স্যার, আপনি তো আবার বাইরের চা খান না।’ | মি. শরীফ তাকালেন লতিফের দিকে। ঠিকই বলেছে লতিফ। মি, শরীফ প্রচুর চা পান করেন। কিন্তু হোটেলের চা খান না।
তোমার স্টোভটা নিয়ে নাও ভ্যানে। চার পাতা, দুধ কিনে নাও। ট্রেনেই তৈরি করে খাওয়া যাবে। এক প্যাকেট বিস্কুটও নিয়ো।’
গ্যারেজ থেকে মিনি ভ্যানটা বের করে উঠানে আনা হলো। ট্রাঙ্কগুলো বের করা হলো। মোট পাঁচটা ট্রাঙ্ক। সতেরো লাখ টাকা ভিতরে।
সাড়ে আটটার ভিতর রওনা হয়ে গেল মিনি ভ্যানটা বাঙলা ব্যাঙ্কের উঠান থেকে সতেরো লাখ টাকা নিয়ে স্টেশনের দিকে।
| সাথে গেল মি. শরীফ, জিয়া সাহেব, মোশাররফ এবং লতিফ।
স্টেশনে থাকবে সাদা পোশাক পরা দুজন পুলিস অফিসার। কিন্তু তাদের কথা এঁরা কেউ জানেন না। জানেন শুধু মি. হায়দার। তিনিই ফোন করে গতকাল পুলিশের ব্যবস্থা করেছেন।
তিন..
.
সোনাডাঙ্গা থেকে প্রথম ট্রেনটা ছাড়ে সকাল সাড়ে সাতটায়। প্রচণ্ড ভীড় হয় সেটায়। সোনাডাঙ্গার বহু লোক ঢাকা, মাধবপুর, কৈলাসনগর, ধুপখোলায় চাকরি করে। ডেইলী প্যাসেঞ্জার প্রচুর। প্রথম ট্রেনেই সবাই যায়। দ্বিতীয় ট্রেনটা ন’টায়। ভীড় হয় না বললেই চলে। | কিন্তু মিনি ভ্যান থেকে স্টেশনের ভিতরে নেমে চক্ষুস্থির সকলের। স্টেশনে ঢোকা মুশকিল। ভীষণ ভীড়। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে রীতিমত ।
ছোট্ট স্টেশন। পঞ্চাশ জন লোক জমা হলেই দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যায় । তারমধ্যে এত ভীড়। মি. শরীফ কেমন যেন হতচকিত হয়ে পড়েছেন। লতিফ কি মনে করে ভীড়ের মধ্যে মিশে গেল একবার। দু’মিনিট পরই ফিরে এল সে।
“কি ব্যাপার?’ গাড়ির ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন মি. শরীফ।
লতিফ হাসছে। চোখে মুখে কৌতূহল, শ্রদ্ধার ভাব তার। | হাসতে হাসতেই সে বলল, “সেই ছেলেটা, স্যার। ডানপিটে সেই ছেলেটাকে লোকেরা পৌঁছে দিতে এসেছে। সাব্বাস ছেলে বটে। এ কদিন সারাটা গ্রামকে…।’
মোশাররফ বিনয়ের অবতার তাতে কোনও সন্দেহ নেই। লতিফের চেয়ে বয়সে সে ছোট বলেই হোক কি অন্য কোন কারণেই হোক, কথা বলে অতি সমীহ ভাবে। সে জিজ্ঞেস করল, “কিছু যদি মনে করো, লতিফ ভাই, তাহলে আমি
ভলিউম ১৪
৫৬ •
একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করি।’
“কি কথা?’
লতিফও মোশাররফের এত বিনয় সহ্য করতে পারে না। ‘তুমি তাই যে ছেলেটির কথা বলছ তার নাম কি? কে সে?
লতিফ বলে উঠল, ‘আপনি সাহেব আশ্চর্য মানুষ। এই কদিন গ্রামে ছিলেন না? সারা গ্রামের লোক চেনে, নাম জানে তার, আর আপনি বলছেন।’
লতিফ মুখ ফিরিয়ে নিল। মমাশাররফ এবার বলল, তুমি বুঝি, ভাই, মি. রাসেল আহমেদের কথা বলছ? “হ্যাঁ।’
মমাশাররফ বিনয়ের সাথে হাসল। বলল, “কিছু যদি মনে করো, ভাই, তাহলে বলি, দোষটা আমার না। তুমি বললে সেই ছেলেটা। মি. রাসেল আহমেদকে “ছেলে” বলা উচিত হয় না, ভাই। তিনি আমার বন্ধু। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি, ভক্তি করি। বাংলাদেশের বীর সন্তান তিনি…।
মাঝপথে বাধা দিল লতিফ। বলল, আপনি সাহেব বড় বেশি কথা বলেন। ওর বন্ধু হলেন আপনি কিভাবে শুনি?’
তোমার তো দোষ নেই, ভাই,’ বলল মোশাররফ, তুমি তো দেখনি। একদিন। পথে বীর সন্তান মি. রাসেল আহমেদের সাথে আমার কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে বাজারে যাবার পথটার হদিস জানতে চেয়েছিলেন। দু’একটা অন্যান্য কথাও আমাদের মধ্যে হয়েছিল। সেই থেকে আমি তাকে বন্ধু বলে…।’
মি. শরীফ ওদের কথা ছিলেন না। অস্বাভাবিক চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। শেষ অবধি কি ভেবে গাড়ি থেকে নেমে স্টেশন মাস্টারের কামরার দিকে পা বাড়ালেন তিনি।
| গত কয়েকদিনে সোনাডাঙ্গা গ্রামটাকে তোলপাড় করেই ছেড়েছে বটে রাসেল। সোনাডাঙ্গার আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সবাই রাসেলকে দেখেছে। সবাই রাসেলকে চিনেছে। অথচ সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই বড় মজার। রাসেল সোনাডাঙ্গায় পা ফেলতে না ফেলতে কিভাবে যেন রটে গেল যে সে হরিণ শিকার করতে এসেছে। ব্যস। অমনি সোনাডাঙ্গার সব লোক খেপে উঠল। কথাটা যে-ই শুনল সে-ই শত্রুতে পরিণত হলো রাসেলের।
কলেজ ছুটি হবার পর রাসেল বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল। অন্যান্য ছেলের কদিন থেকেই যে-যার দেশের বাড়িতে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। ওদের ব্যস্ততা দেখে মনটা খারাপ হতে শুরু করে রাসেলের। ঘরের ছেলের ছুটির মধ্য ঘরে ফিরে যাবে। সে যাবে কোথায়? | ঢাকার ছেলে রাসেল। ঘর-বাড়িও আছে। কিন্তু ঘরে মানুষ নেই। মা-বোন ছিল ওর জীবনের সব। তারাই নেই। গত মুক্তিযুদ্ধে নিহত হয়েছে তারা।
কুয়াশা ৪১
৫৭
কলেজ খোলা থাকলে লেখাপড়া, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা নিয়ে থাকে। সময় কেটে | সুন্দর। কিন্তু কলেজ বন্ধ হলেই কেমন যেন ছটফট করে বুকটা। | অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবরা ব্যাপারটা লক্ষ না করলেও জামান লক্ষ করেছিল রাসেলের বিষণ্ণতা। ছুটির আগের দিন রাসেলের বাড়িতে এসে জামান বলছিল, কি রে, এত কি ভাবছিস? একি রাইফেল।’
অপ্রতিভ হয়ে হেসেছিল রাসেল। বলেছিল, ‘ভাবছি ছুটির ক’দিন কোথায় কিভাবে কাটাব। ভাবছি সুন্দরবনে যাই। কিন্তু সঙ্গী কোথায় পাই বল তো?
সুন্দরবনে যাবি!’ জামানের চোখ জোড়া ছানাবড়া হয়ে ওঠে, ‘কেন?’
মৃদু স্বরে উত্তর দিয়েছিল রাসেল, পশুপাখি শিকার করা আজকাল নিষেধ। কিন্তু দেখা তো নিষেধের আওতায় পড়ে না। রয়েলবেঙ্গল টাইগার দেখতে যাব।’
আর কোনও কথা বলেনি জামান কয়েক মুহূর্ত। চেনে সে ভাল করে রাসেলকে। যা ভাবছে তা সম্ভব করে তুলবেই সে। কেউ যদি সঙ্গী হতে না চায় তাহলে একাই হয়তো বেরিয়ে পড়বে। না, কোনমতেই জামান রাসেলকে একা ছেড়ে দেবে না।
রাইফেল পরিষ্কার করতে লাগল রাসেল। * আমাকে নিয়ে যাবি?’
হেসেই বলেছিল জামান। জামানের কথা শুনে হেসে উঠেছিল রাসেল। বলেছিল, “তুই যে যেতে চেয়েছিস এটাই যথেষ্ট। নারে, তোর দ্বারা হবে না । ভীতুর ডিম তুই। টিকটিকি দেখেই ভয় পাস । আমি আমার মত একজনকে খুঁজছি।’
সে তুই পাবি না।’
জামান রাসেলের কথা মেনে নিয়ে বলে, সবাই আমারই মত, বুঝলি। প্রাণ হারাতে হতে পারে এমন কোন কাজে ক’জন ছেলে পা বাড়ায়। যাকগে, তোর সাথে তো আমার যাওয়া চলবে না। আমার সাথে তুই যেতে পারবি কিনা ভেবে দেখ দেখি।’
. চকিতে কেন যেন মুখটা লাল হয়ে ওঠে রাসেলের। হাত দুটো স্থির হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকায় ও। জামানের কথা পরিষ্কার বুঝতে পেরেও আবার প্রশ্ন করে ও, কি কললি?’
‘ঋতু তো তোর প্রশংসায় পাগল । আমাদের বাড়ির প্রতিটি মানুষ তোর, চেহারা স্বভাব সব মুখস্থ করে ফেলেছে। ঋতুর পাবলিসিটি! যাবি আমার সাথে?
যেতে মন চায় রাসেলের! ভাবে ঋতু তাহলে তাকে ভুলতে পারেনি।
জামানের ছোট বোন ঋতু। ঢাকায় এসেছিল প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে। জামানের বোন, রাসেল ঋতুকে নিজের বোনের মত মনে করেছিল। ওদের কোনও আত্মীয়-স্বজন না থাকায় জামান হোটেলেই রাখতে চেয়েছিল ঋতুকে। কিন্তু
৫৮
ভলিউম ১৪
আপত্তি করেছিল রাসেল। ঋতুকে তখনও রাসেল দেখেনি। তখনও সে ঢাকায় আসেনি। জামানকে রাসেল বলেছিল, ‘তোর হোস্টেলের রূমে কয়েকটা দিন না হয় আমি থাকব। তুই তোর বোনকে নিয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে থাক।’
| রাজি হয়নি জামান। কিন্তু ধমক দিয়ে রাসেল বলেছিল, ‘পাগল না মাথা খারাপ তোর! হোটেলে কোন মেয়ে একা থাকে? খোঁজ খবর রাখিস কিছু শহরের? বহু লোক ঘুর ঘুর করছে সব জায়গায়। এই তো সেদিন•••।’
এই এক গুণ রাসেলের। ক্রিমিনোলজি সম্পর্কে মোটা মোটা বই পড়বে সময় পেলেই। আর দেশের কোথায় কি অঘটন ঘটছে তার নিখুঁত হিসেব রাখবে।
ঢাকায় কোথায় ডাকাতি হলো, কোথায় কে খুন হলো–সব জানা চাই ওর।
জামান ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই বলছিস হোটেলে ঋতুকে রাখা নিরাপদ নয়?
‘হ্যাঁ, আমি বলছি।
তবে ভাই তোর বাড়িতে•••।’
সব রকমই ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু জামানের অনুরোধে রাসেল ছিল বাড়িতে। ক’দিনের জন্যে আর.হোস্টেলে গিয়ে ওঠেনি।
. মোলো কি সতেরো বছর বয়স ঋতুর। কলমি লতার মত বেড়ে উঠেছে সবে। খিলখিল করে হাসে। প্রচুর কথা বলে। ভীষণ অভিমানি। কোন কারণে অভিমান হলে, তা বোঝাও যাবে না। কথা বলবে, হাসবে, কিন্তু অল্প অল্প। কোন অভিযোগ জানাবে না, মুখ ভার করে থাকবে না। শুধু শান্ত হয়ে থাকবে। তখনই বুঝতে হবে। সে অভিমান করেছে।
পনেরো দিন ছিল ঋতু। এই পনেরো দিনেই ঋতু মনে মনে ভালবেসে ফেলেছিল রাসেলকে।
জামান খানিক পর জিজ্ঞেস করে, “হরিণ তো আমাদের ওদিকের জঙ্গলেই পাওয়া যায় শুনেছি। দেখে আসবি।’
তাই নাকি!’
রাসেল বলল, তবে প্রথমেই সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গলের মুখোমুখি হবার দরকার নেই। আগে হরিণ দেখেই আসি। তোদের সোনাডাঙ্গাতেই যাই চল!’
কিন্তু সোনাডাঙ্গায় পৌঁছে হরিণ দেখা মাথায় উঠল। ঋতু অবশ্য হ্যাঁ না কিছুই বলল না। চুপ করেই রইল সে। এটা তার আর এক মূর্তি। ঋতু ছাড়া ওদের বাড়ির বাকি সবাই ঘোর আপত্তি জানালেন। জামানের বাবা বললেন, কি দরকার বাবা ওই অভিশপ্ত জঙ্গলে ঢুকে। তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছ যখন, তখন আমাদেরই ছেলে। আমরা কি নিজের ছেলেকে জেনে শুনে অমন ভয়ের জায়গায় যেতে দিতে পারি?’
_ সব ঘটনাই মনোযোগ দিয়ে শুনল রাসেল। ঠগীদের কথা, ঠগীদের বদ আত্মার কুয়াশা ৪১
কথা রঙ মাখিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীরাই কয়েকজন এসে শুনিয়ে গেল রাসেলকে। সবচেয়ে বেশি ভয় দেখাল তারা প্রাচীন মন্দিরের কথা তুলে। জঙ্গলের ভিতরের ওই অভিশপ্ত মন্দিরে নাকি ভূত-পেত্নীরা থাকে। * সব শুনে চুপ করেই রইল রাসেল দু’দিন। তৃতীয় দিন রাসেল সকলকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে তারা বছরের পর বছর ধরে যা শুনে আসছে তা স্রেফ বাজে কথা। কিংবদন্তী মাত্র। এই অমূলক আতঙ্কে ভোগার কোনও দরকার নেই। সে যাবে জঙ্গলের ভিতর। মন্দিরের ভিতরও ঢুকবে সে। কিছুই তার হবে না । অক্ষত শরীরে ফিরে আসতে পারবে আবার। | আর কেউ না চিনলেও জামান চেনে তার বন্ধুকে। বাধা দিল না সে। বাড়ির সবাইকেও বাধা দিতে নিষেধ করে দিল।
খবরটা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না। গ্রামের সর্বত্র হৈ-হৈ পড়ে গেল। প্রবীণ লোকেরা জামানদের বাড়িতে ঘন ঘন আসতে লাগলেন। বুঝতে পারছিল রাসেল, গ্রামের প্রবীণরা একজোট হয়ে রাসেলের বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নেবার চেষ্টা করছে । তারা গ্রামের নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলল। জঙ্গলে যদি রাসেল যায় তাহলে গ্রামের উপর বিপদ নেমে আসবে এই ছিল তাদের যুক্তি। প্রবীণরা বেশির ভাগই অশিক্ষিত । যুক্তির কথা শুনতে তারা রাজি নন। বুঝতে বাকি রইল না রাসেলের যে এদের অনুমতি নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
| দেরি করাও যায় না। ‘বুড়োরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নোটিস জারি করে বসলে জঙ্গলে পা দেয়া আর সম্ভব নাও হতে পারে। সব বুঝতে পেরে মনে মনে প্রস্তুত হলো রাসেল।
রাইফেল সে সঙ্গে করে নিয়েই এসেছিল। পরদিন ভোরে ব্যাগে প্রচুর খাবার এবং পানি নিয়ে জঙ্গলের উদ্দেশে পা বাড়াল সে। তখনও সূর্য ওঠেনি। তখনও গ্রামবাসীরা কেউ জাগেনি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ঋতুই পেল রাসেলের চিঠি। জঙ্গলে যাচ্ছে, ফিরতে দু’একদিন দেরি হতে পারে-একথা জানিয়ে চিঠি লিখে রেখে গেছে রাসেল জামানের উদ্দেশে।
চিঠির কথা রটে গেল সারা গ্রামে। সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল উত্তেজনা। সবার মনে ভয়কি হয় কি হয়! সবার মুখে এক কথা-ছেলেটা তো বড় দুঃসাহসী!
কেটে গেল একটা দিন। | ফিরে এল না রাসেল। উত্তেজনাও বাড়ল সেই সাথে। সারাদিন সারারাত ঘরে বাইরে হাটে মাঠে ঘাটে সেই একই আলোচনা।
দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার পরও যখন রাসেল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল না তখন সবাই একবাক্যে মেনে নিল যে-ছেলেটা মারা পড়েছে।
কেমন যেন শোকাভিভূত হয়ে পড়ল সোনাডাঙ্গার মানুষরা। রাসেলের প্রতি
৬০
ভলিউম ১৪
ভাল মনোভাব কারুরই ছিল না। কিন্তু ছেলেটি মারা গেছে মনে হতেই দুঃখ পেল
সবাই।
কিন্তু তৃতীয় দিন ঘটল আসল ঘটনাটা।
চার, বনভূমিতে প্রবেশ করে রাসেল নিজের অজ্ঞাতেই বেশ একটু সতর্ক হয়ে উঠল।
| সোনাডাঙ্গার লোকেদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় এই বনভূমিতে মানুষের পদক্ষেপ পড়েনি কোনদিন। সন্দেহ ছিল এ ব্যাপারে রাসেলের। সন্দেহ নিরসন করাই ওর জঙ্গলে ঢোকার প্রধান কারণ। তাছাড়া প্রাচীন মন্দির সম্পর্কে কৌতূহলটাও কম নয়।
আধঘন্টাটাক ধীর পায়ে হাঁটার পর বেশ একটু নিরাশই হলো রাসেল। বড় বড় গাছপালার সংখ্যা গুণে শেষ করা যায় না। ঝোঁপঝাড় খুব ঘন এবং লম্বা হয়ে আছে। * সূর্য উঠল। অথচ সূর্যের আলো গাছের শাখা-প্রশাখা এবং ডালের বাধা পেরিয়ে
নিচে নামল না।
যে জঙ্গলে মানুষ প্রবেশ করে সেখানে পায়ে হাঁটার সরু পথ থাকার কথা। তেমন কোন পথ চোখে পড়ল না। একই পথে ঘনঘন জন্তু জানোয়ার চলাচল করলেও সরু পথের সৃষ্টি হয়। তেমন কোন পথও চোখে পড়ল না রাসেলের।
সত্যিই কি এই জঙ্গলে মানুষ প্রবেশ করে না?
জীবিত প্রাণ বলতে প্রচুর সংখ্যক পাখি ছাড়া কোথাও কিছু নেই। শালিক, ঘুঘু, চড়ুই, টিয়া, কোকিল, ময়না, দোয়েল-হরেক রকম পাখি দেখতে দেখতে হাঁটতে রাসেল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল ও। একমনে কি যেন ভাবল। তারপর পানি ভর্তি ফ্লাস্ক ব্যাগ এবং রাইফেলটা নামিয়ে বসে পড়ল ঘাসের উপর। মাটিতে কান ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ কি যেন এনল রাসেল।
মিনিট দুয়েক পর সোজা হয়ে বসল রাসেল। চকচক করছে ওর দুই চোখ। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। “ আপন মনেই বিড় বিড় করে বলে উঠল রাসেল, মানুষ তাহলে আছে জঙ্গলে।’,
আবিষ্কারের আনন্দে শিস দিয়ে উঠল, রাসেল। আবার কাঁধে রাইফেল ও মালপত্র তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
আগের চেয়ে বেশি সতর্ক হয়ে উঠেছে এবার রাসেল। মাটিতে কান পেতে পরিষ্কার শব্দ শুনেছে ও। একদল লোক বহুদূরে গাছ কাটছে-এতে কোনও সন্দেহ
নেই।
সোনাডাঙ্গা থেকেই দেখা যায় প্রাচীন মন্দিরের উঁচু চুড়া। সেদিকেই এগিয়ে কুয়াশী ৪১
৬১
যাচ্ছিল রাসেল। কিন্তু এবার সে দিক পরিবর্তন করল। উত্তর-পূব বরাবর দ্রুত
এগিয়ে চলল ও। | হঠাৎ একটা ঝোঁপের ভিতর শব্দ হতেই রাসেল থমকে দাঁড়িয়ে রাইফেল তাক করল।
পরমুহূর্তে দেখা গেল একটি খরগোশ। ঝোঁপের ভিতর থেকে বেরিয়ে ছুটছে সাদা খরগোশটা। তার পিছন পিছন বেরিয়ে এল আরও একটা। পেছনেরটা। রাসেলকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল। বড় বড় দুই চোখ মেলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল খরগোশটা রাসেলের দিকে। জীবিত বলে চেনা গেল না। এতটুকু নড়ছে না প্রাণীটা। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। প্রথম খরগোশটা অদৃশ্য হয়ে গেছে আরেক ঝোঁপের ভিতর। দ্বিতীয়টি রাসেলের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে দাঁড়িয়েই আছে। | কি দেখছিস রে মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করল রাসেল। অমনি বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন মেয়ে খরর্দেশটার শরীরে। ছুটে পালিয়ে গেল টা ।
রাসেল এদিক-ওদিক তাকাল ভাল করে। তারপর আর পা বাড়াল।
যতই এগিয়ে যেতে লাগল রাসেল ততই পরিষ্কার হতে লাগল গাছ কাটার শব্দ। বেলা সাড়ে দশটার দিকে রাসেল দাঁড়াল।
পায়ে চলা সরু পথ সামনে।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল রাসেল পথটা। জন্তু-জানোয়ারের চলার পথ যে এটা নয় তা ও বুঝতে পারল সহজেই। বেশ চওড়া পথ। মানুষজন যাওয়া-আসা করায় এই পথের সৃষ্টি।
| রোমাঞ্চ অনুভব করল রাসেল। সোনাডাঙ্গার লোকেরা যখন শুনবে যে মানুষজন নিয়মিত জঙ্গলে যায় তখন কি বলবে তারা?
কিন্তু কারা আসে জঙ্গলে? তারা কি সোনাডাঙ্গারই মানুষ? নাকি তারা জঙ্গলেই থাকে? ঠগীদের উত্তর-পুরুষরা তবে কি এখনও আছে এই জঙ্গলে?
হাসি পেল রাসেলের। অবাস্তব চিন্তা করা শোভা পায় না তার পক্ষে। ঠগীরা কয়েক যুগ আগে মরে ভূত হয়ে গেছে।
মিনিট পনেরো সেই পথ দিয়ে হাঁটার পর থমকে দাঁড়াল রাসেল। চিন্তার অতীত একটা দৃশ্য দেখে রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে পড়ল ও।
| পায়ে হাঁটার মেঠো পথটা ভাগ হয়ে গেছে দুই দিকে। একটা চলে গেছে বা দিকে, অপরটি ডান দিকে। ডান দিকের পথ ধরে কয়েক পা যেতেই রাসেল দেখল প্রকাণ্ড একটা জায়গা!
| ফাঁকা জায়গাটা এককালে জঙ্গলেরই অংশ ছিল। জঙ্গলের গাছ কেটে সাফ করে ফেলা হয়েছে। এখনও কাটী গাছের মোটা ছোট ছোট কাণ্ডগুলো দেখা যাচ্ছে। প্রায় আধমাইল লম্বা হবে জায়গাটা। একেবারে শেষ প্রান্তে দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো লোককে। খালি গায়ে কুড়াল দিয়ে গাছ কাটছে তারা। একজন দুজন নয়, সংখ্যায়
৬২
ভলিউম ১৪
তারা প্রায় একশো সোয়াশো জন হবে।
কাঠ কাটছে, ওরা কাঠুরে। কিন্তু কেন যেন সন্দিহান হয়ে উঠল মনটা রাসেলের। ঝট করে একটা গাছের আড়ালে সরে গেল ও, যেন ওকে দেখে না ফেলে। আড়াল থেকে দূরবর্তী লোকগুলোর কাঠ কাটা দেখতে দেখতে অনেক প্রশ্ন জাগল ওর মনে।
কারা এরা? গাছ কেটে কোথায় নিয়ে যায়? কোন্ পথ দিয়ে যাওয়া আসা করে?
সোনাডাঙ্গার লোকেরা কেন বলে যে এই জঙ্গলে মানুষ প্রবেশ করে না? কে তাদেরকে ধোকা দিয়ে রেখেছে এতদিন? এতগুলো লোক কাঠ কাটছে, কোথা থেকে এসেছে এরা? কে নিযুক্ত করেছে এদেরকে? সরকারী অনুমতি নিয়ে, না বেআইনি ভাবে কাঠ কাটছে এরা?
নিশ্চয়ই এরা গোপনে কাঠ কাটছে। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ রইল না রাসেলের, মনে। তারমানে ওরা চায় এই গাছ কাটার কথা যেন কেউ না জানে। হঠাৎ যদি ওরা জানতে পারে যে রাসেল ওদের গাছ কাটা দেখে ফেলেছে-তাহলে?
তাহলে হয়তো ওরা রাসেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। হয়তো খুনই করে ফেলবে এই জঙ্গলে। কেইবা জানবে যে রাসেল খুন হয়েছে? সবাই বলাবলি করবে ঠগীদের আত্মা বা মন্দিরের ভূতেরা মেরে ফেলেছে ছেলেটাকে।
অপেক্ষা করাই স্থির করল রাসেল। গাছ কাটা শেষ করে কোথায় যায়। লোকগুলো দেখা দরকার। সব না দেখে এই জঙ্গল থেকে বের হবে না ও।
| হাতের রাইফেল মাটিতে নামিয়ে রাখল রাসেল। চওড়া একটা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। | ফ্লাস্ক এবং ব্যাগ নামিয়ে একটি মাঝারি আকারের ঝোঁপের দিকে পিছন ফিরে বসে পড়ল রাসেল। পরমুহূর্তে কেঁপে উঠল সজোরে পিছনের ঝোঁপটা।
চোখের পলক পড়তে না পড়তে সবেগে উঠে গঁড়াল রাসেল মাটি থেকে রাইফেলটা তুলে নিয়ে।
লক্ষ্যস্থির করে ট্রিগারে চাপ দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। প্রাণপণে ছুটছে লোকটা। রাসেলের পিছনের ঝোঁপের আড়ালেই ছিল লোকটা।
ঢোলা প্যান্ট লোকটার পরনে। মাথায় সাহেবী টুপি। রোগা লম্বা লোকটা দ্রুত ছুটছে।
চিনতে পেরেই গুলি করল না রাসেল। লোকটাকে পিছন থেকে দেখেও চিনতে কোন অসুবিধে হয়নি রাসেলের।
কিন্তু ডি. কস্টা অদৃশ্য হয়ে যেতেই জটিল একটি প্রশ্নের উদয় হলো রাসেলের মনে।
কুয়াশার অনুচর ডি. কস্টা এই বনভূমিতে কেন এসেছে? তবে কি কুয়াশাও কুয়াশা ৪১
আছে এই জঙ্গলে? তবে কি কুয়াশাই গাছ কাটাচ্ছে?
কোন প্রশ্নেরই কোনও সদুত্তর পেল না রাসেল। ভাবতে ভাবতে দুপুর হলো। গাছের আড়াল থেকে রাসেল এবার আরও একটি অদ্ভুত জিনিস দেখল।
দুপুরের খাবার খাচ্ছে কাঠুরেরা। সারি সারি বসেছে সবাই। বেশ কয়েকজন লোক তাদেরকে পরিবেশন করছে।
খুব সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু ব্যবস্থাটার মধ্যে অতিরিক্ত কি যেন আছে। একদল কাঠুরেকে কি এমন বসিয়ে সুশৃংখল ভাবে খাবার খেতে দেয়া হয়? :
এ থেকেই রাসেলের মনে হলো লোকগুলো কোন সুসংগঠিত দলের লোক। এদের একজন নেতা আছে, কর্তা আছে, তার নির্দেশেই এরা চলে।
সন্ধ্যা নামার প্রায় আধঘণ্টা আগে গাছ কাটা শেষ করল লোকগুলো। | কাটা গাছগুলো সেখানেই পড়ে রইল। লোকগুলো গায়ে জামা চড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগল।
সাবধানে লুকিয়ে রইল রাসেল।
লোকগুলো যত এগিয়ে আসছে বিস্ময় ততই বেড়ে যাচ্ছে রাসেলের। পরিশ্রমী লোকেরা স্বাস্থ্যবান হয় তা ঠিক। কিন্তু এই লোকগুলোকে দেখে রাসেলের মনে হলো এরা এক একজন ডাকাত। ডাকাতের মতই চেহারা প্রত্যেকের। ছোট ছোট করে ছাঁটা মাথার চুল, ইয়া চওড়া বুক, চোখে কঠোর দৃষ্টি।
সামনে এসে পড়েছে লোকগুলো। রাসেল ভাল করে দেখতে লাগল আড়াল থেকে। সব লোকই যে ডাকাতদের মত তা নয়। নিরীহ, ক্ষীণদেহী লোকও রয়েছে বেশ কয়েকজন।
চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল লোকগুলো পায়ে হাঁটা চওড়া পথ দিয়ে।
লোকগুলো অদৃশ্য হয়ে যাবার পর রাসেল গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে পা চালাল।
| লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তাদের কথাবার্তার শব্দ কানে আসছে গুঞ্জনের মত। সেই শব্দ লক্ষ্য করেই অনুসরণ করে চলল রাসেল।
পায়ে চলা পথ ধরে প্রায় পনেরো মিনিট হাঁটার পর দাঁড়িয়ে পড়ল রাসেল।
সামনে প্রাচীন মন্দির। গাছের আড়াল থেকে রাসেল দেখল ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে লোকগুলো ঢুকছে মন্দিরের ভিতর।
দেখতে দেখতে মন্দিরের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল সবাই।
এসবের রহস্য কি বুঝতে পারল না রাসেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ফিরে যাবে ও সোনাডাঙ্গায়?
সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না রাসেলের। নিশ্চয়ই আগামীকালও লোকগুলো যাবে গাছ কাটতে। সেই সুযোগে রাসেল মন্দিরে ঢুকবে। দেখবে কি করে
৬৪
ভলিউম ১৪
লোকগুলো ওখানে। রাতটা কোন উঁচু গাছে কাটিয়ে দেবে স্থির করল রাসেল। পরদিন সকালে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল লোকগুলো আবার। কুঠার হাতে নিয়ে চলে গেল সবাই গাছ কাটতে।
| বেশ খানিক পর মন্দিরের দিকে পা বাড়াল রাসেল।
দাঁত বের করে হাসছে প্রাচীন মন্দিরের হঁট বের হওয়া, গা। প্রায় শ’খানেক ধাপ সিঁড়ির। এককালে মসৃণ ছিল, এখন ভেঙেচুরে এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে।
প্রকাণ্ড প্রবেশ পথের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সারা শরীরে খেলে গেল অজানা একটি ভয়। কেঁপে উঠল রাসেল।
চারদিকে কেউ নেই। মন্দিরের ভিতর কালীমূর্তির দুই চোখের দিকে তাকিয়ে। রইল রাসেল নিস্পলক দৃষ্টিতে।
সংবিৎ ফেরার পর রাসেল লক্ষ্য করল কালীমূর্তির সামনেই পড়ে রয়েছে কয়েক টুকরো ছেঁড়া কাগজ, সিগারেটের খালি প্যাকেট, গাছের পাতা, ছাৈট একটা গাছের ডাল ইত্যাদি। পরিষ্কার করা হয় না জায়গাটা। তার মানে পূজা করে না কেউ এখানে।
কালীমূর্তির দিকে আর একবার তাকাল রাসেল। কেমন যেন ভয় ভয় করছে। ভিতরে আর কোন দরজা নেই। অথচ লোকগুলো এই কামরায় ঢুকেছিল। নিশ্চয়ই গোপন পথ আছে এখান থেকে অন্য কোথাও যাবার।
| সতর্ক পায়ে কালীমূর্তির পিছনে গিয়ে দাঁড়াল রাসেল। ছোট একটা জানালা। দেখা যাচ্ছে। জানালার গায়ে ধাক্কা দিল রাসেল।; খুলে গেল কপাট দুটো। জানালার মত দেখতে হলেও গরাদ নেই। তারমানে এটা দরজা। একটা কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে।
| ব্যাগ থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল রাসেল।
কাজটা কি ভাল করছ, রাসেল? নিজেকেই জিজ্ঞেস করল ও। হাসল আপন মনে। সামনে একটা বাক দেখে নিঃশব্দে পা ফেলে নামল কয়েকটা ধাপ। সোজা নেমে গেছে সিঁড়িটা বাক নিয়ে।
সোজা নেমে এল রাসেল প্রকাণ্ড এক আলোকিত উঠানে। বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা দেখে মনে মনে খুব অবাক হলো না রাসেল। আগে থেকেই ও অনুমান করেছিল ব্যাপারটা।
এখানে যারা থাকে তারা বেশ পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে নিয়েছে।
উঠানটা ফাঁকা। উঁচু বারান্দা দেখা যাচ্ছে চারপাশে। দরজা দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা। একটি ছাড়া সব দরজাই বন্ধ। •
| ফিরে যাওয়া উচিত। মনে মনে ভাবল রাসেল। এটা হয়তো ডাকাতদের আচ্ছা। বহু লোককে ধরে নিয়ে এসে জোর করে কাজ আদায় করে এরা, কাঠ
৫-কুয়াশা ৪১ :
কাটায়। নিজেরা হয়তো রাতে বের হয় আশপাশের গ্রামে ডাকাতি করার জন্যে।
নিশ্চয়ই এই পাতালপুরীতে ডাকাতদের লোক আছে। রাসেলকে দেখলে ছাড়বে না তারা। ‘
দরজাটার পাশে এসে দাঁড়াল রাসেল। উঁকি মেরে দেখল কেউ নেই কামরায়। কামরার অপর দিকে আরও একটি দরজা। সেটাও খোলা। কামরার ভিতর প্রবেশ করবে কিনা ভাবছিল রাসেল এমন সময় কয়েকজন লোকের গলা শোনা গেল। সেই সাথে ভারি জুতোর পদশব্দ।
চমকে উঠল রাসেল। মন্দিরের বাইরে থেকে গুপ্ত পথে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে কয়েকজন লোক। এদিক ওদিক তাকাল রাসেল। লুবাকার জায়গা কই? চিন্তার সময় নেই।
অথচ কোথায় লুকানো যায় ভেবে পাচ্ছে না রাসেল। এগিয়ে আসছে শব্দ।
নিঃশব্দে কামরার ভিতর প্রবেশ করল রাসেল। মাঝারি আকারের একটি চৌকি খোলা কামরার একধারে।
রাইফেল, ফ্লাস্ক ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে চৌকির নিচে নিঃশব্দে রাখল রাসেল। নিজেও ঢুকে পড়ল চৌকির নিচে।
‘পরমুহূর্তেই কামরার ভিতর প্রবেশ করল তিনজন লোক। | তিন জোড়া পা দেখতে পেল শুধু রাসেল। একজনের পরণে দামী কাপড়ের প্যান্ট। অন্য দুজন লুঙ্গি পরিহিত। তিনজনের একজন চিৎকার করে কার যেন নাম ধরে ডাকল। পাশের কামরা থেকেই সুম্বত সাড়া এলঃ আসছি, হুজুর!
পাশের কামরা থেকে একজন লুঙ্গি পরিহিত লোক এল।
• আগন্তুক তিনজনের একজন বলে উঠল, ‘সালাম আর জহুরকে গিয়ে খবর দাও। দলবল নিয়ে ওরা যেন কয়েকভাগে ভাগ হয়ে যায়। সোনাডাঙ্গা থেকে এক ছোকরা জঙ্গলে ঢুকেছে গতকাল। এখনও সে ফিরে যায়নি। জহুরকে বলবে ছোকরাকে দেখামাত্র যেন খতম করে দেয়া হয়। এটা আমার কঠোর নির্দেশ।
যাও।
চতুর্থ লোকটি দ্রুত বেরিয়ে যায় কামরা থেকে। | নিজের মৃত্যুদণ্ড শুনে ঘেমে উঠল রাসেল। চৌকির নিচে চুপচাপ পড়ে রইল
ও।
‘আমরা কি করব, হুজুর?’ …।
তোমরা থাকে। এখানে। সতর্কভাবে থাকবে। বলা যায় না, ছোকরা হয়তো এখানেও ঢুকে পড়তে পারে। আমি চললাম। রাতে আসব।’ প্যান্ট পরিহিত লোকটা বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
ভলিউম ১৪
কামরার ভিতর একটা বেঞ্চিতে অপর লোক দুজন বসল। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল তারা ।
লোক দুজনার কথাবার্তা শুনে রাসেল পরিষ্কার বুঝতে পারল এরা আসলে ডাকাত দলই।
পালানো দরকার। পালাবার উপায় বের করার জন্যে ভাবতে লাগল রাসেল। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরই দ্বিতীয় দরজা দিয়ে কামরায় প্রবেশ করল চারজন লোক।
চিন্তিত হয়ে পড়ল রাসেল।
লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে আরও শঙ্কিত হয়ে উঠল ও। মন্দিরের বাইরে পাহারা দেবার জন্যে চারজনকে পাঠানো হলো। পাতালপুরীতে তারপরও নয়জন ডাকাত।
ধরা পড়ে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত?
গভীরভাবে ভাবতে লাগল রাসেল। রাগে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে। করছে তার। নিজের ভুলের জন্যেই এই বিপদে পড়েছে সে।
সকাল থেকে দুপুর হলো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, তারপর হলো সন্ধ্যা। সেই চৌকির নিচে থেকে বের হবার কোন সুযোগই পেল না রাসেল।
কামরার ভিতর, উঠানে এবং মন্দিরের আশপাশে ডাকাত দলের লোকেরা সদাসর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ডাকাতদের কথাবার্তা শুনে সব খব্বই পাচ্ছে রাসেল। অসহায়ভাবে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন পথ নেই। পানির পিপাসাটা’বেশি কষ্ট দিচ্ছে খিদের চেয়ে। কিন্তু সাহস করে ফ্লাস্ক খুলতে পারছে না রাসেল। সামান্য এতটুকু শব্দ হলেই ধরা পড়ে যেতে হবে। সেই ভয়ে পানি এবং খাবার থাকা সত্ত্বেও নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে ও।
রাত নামতে দেরি হলো না বিশেষ। আবার সেই রহস্যময় প্যান্ট পরিহিত লোকটি এল। সবাই তাকে হুজুর হুজুর করে।
জহুর, মজিদ, ফেলু সর্দার ইত্যাদি কয়েকজনকে নিয়ে গোপন আলোচনার জন্যে অন্য কামরায় চলে গেল প্যান্ট পরা লোকটি।
গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। চৌকির উপর শুয়েছে দু’জন। মন্দিরের বাইরে পাহারায় আছে আটজন। উঠানে দুজন।
উঠানে পাহারা বসানো হয়েছে অন্য কারণে। ডাকাতরা যাদেরকে ধরে নিয়ে এসে কাজ করায় তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্যেই এই ব্যবস্থা। গভীর রাতে পানি এবং রুটি খেল রাসেল নিঃশব্দে।
| সেই রহস্যময় লোকটি রাতেই চলে গিয়েছিল। পরদিন সকালে সে আবার এল।
কথাবার্তা শুনে রাসেল এবার খুশি হলো। কুয়াশা ৪১
রাসেল মারা গেছে-এটাই শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করে নিল ডাকাত দলের হুজুর। কেননা গোটা জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি।
সেদিন গাছ কাটতে গেল অধিকাংশ লোক। পাতালপুরীতে রইল হয় সাতজনের মত। ওদের কথাবার্তায় বোঝা গেল মন্দিরের প্রবেশ পথে আর কোন পাহারাদারও নেই।
বেলা এগারোটার সময় সুযোগ পেল একটা রাসেল। কামরায় কেউ নেই। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ও চৌকির নিচ থেকে।
মন্দিরের বাইরে নিরাপদেই বের হয়ে এল রাসেল। চারদিকে কেউ নেই। জঙ্গলে প্রবেশ করে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। পাঁচ
| “
।
তৃতীয় দিন রাসেল হাসিমুখে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ফিরে এল গ্রামে। | গ্রামে যেন আনন্দের বান ডাকল। রীতিমত উৎসব শুরু হয়ে গেল রাসেলকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি বাড়ির ছেলে-মেয়ে-যুবক-যুবতী-বুড়ো-বুড়ি দেখতে এল রাসেলকে। সবাইকে রাসেল জানাল যে সে পথ হারিয়ে ফেলেছিল বনভূমিতে।
একজন মানুষও সে এই তিনদিন দেখেনি।
বুড়ো-বুড়িরা তাদের মত পরিবর্তন করলেন। তাদের অধিকাংশই বললেন, সে কি আজকের কথা। ভূত-পেত্নীদেরও তো মরণ আছে। মন্দিরের ভূতগুলো সব মরে গেছে।’
রাসেল সবাইকে জানিয়ে দিল যে সে মন্দির কোথায় খুঁজেই পায়নি জঙ্গলে।
জামান ঢাকায় চলে গেছে ক’দিন আগেই। গতকাল ওর চিঠি এসেছে। ঋতু কলেজে ভর্তি হবে। ভর্তি করার সব ব্যবস্থা শেষ করেই চিঠি লিখেছে সে।
জঙ্গলে যা দেখেছে রাসেল তারপর আর ঢাকায় ফিরে যাওয়া যায় না। একটা উপযুক্ত ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু স্থানীয় পুলিসকে কিছু জানাতে চায় না রাসেল।
রাসরি মি. সিম্পসনের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করবে ও।
জামানের মা-বাবা রাসেলকে ছাড়তে চান না। তাদের একই কথা, দুটি তো তোমার এখনও আছে, বাবা। একদিন আগে গেলেই তো চলে।’
গ্রামের যুবকরাও ছাড়তে চায় না রাসেলকে। মাথার মণি করে রেখেছে তারা রাসেলকে। কিন্তু জামানের চিঠি পেয়ে রাসেল যেন মুক্তি পেল। কেমন যেন একঘেয়ে লাগছিল। বৈচিত্র্য যা ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে যুবকদেরকে কয়েকবার নিয়ে গেছে সে জঙ্গলের ভিতর।
জামানের চিঠি পেয়ে জামানের বাবা-মাও আর আপত্তি করার সুযোগ পেলেন
৬৮
ভলিউম ১৪
। রাসেলকে আবার আসতে বলে বিদায় দিলেন তারা। বিদায় দিল গ্রামবাসীরা। যুবকের দল রাসেল এবং ঋতুর সাথে চলল স্টেশন অবদি পৌঁছে দিতে।
স্টেশনে সকলের কাছে বিদায় চেয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠল রাসেল।
রাসেল ভাই, আবার আসবেন!’ রাসেল ভাই, আমাদেরকে ভুলবেন না! রাসেল ভাই, চিঠি দেবেন!
চারদিক থেকে এইসব কথা। হাসিমুখে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটা কথার উত্তর দিচ্ছিল রাসেল। হঠাৎ একদিকে চোখ পড়তেই হাসি মুছে গেল তার মুখ থেকে।
লম্বা একটা লোক দ্রুতপায়ে স্টেশনে এসে ঢুকল। আড়চোখে একবার দূর থেকেই দেখে নিল সে যেন রাসেলকে। তারপর দ্রুত ভিড়ের ভিতর দিয়ে ট্রেনের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল সোজা কারও দিকে না তাকিয়ে। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি লোকটার। ঋজু দেহ। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। লম্বা লম্বা পা ফেলে ট্রেনের একটি কামরার সামনে এসে দাঁড়াল সে। কোটের হাতা সরিয়ে হাতঘড়িতে সময় দেখল। তারপর উঠে পড়ল ট্রেনে।
রাসেলের কামরা থেকে পাঁচটা কামরার পরের কামরাটায় চড়ল লোকটা। চিনতে ভুল করেনি রাসেল লোকটাকে। যদিও লোকটা ছদ্মবেশ নিয়ে আছে।
লোকটা যে কুয়াশা তা দেখেই বুঝতে পেরেছে রাসেল। ডি, কস্টার কথা ভোলেনি সে। জঙ্গলে দেখেছে তাকে ও।
কুয়াশাও সোনাডাঙ্গায়! কেন? প্রশ্নটা মনের ভিতর গেঁথে রইল রাসেলের।
বুঝলেন মি. শরীফ, ছেলেটা আমাদের সকলের মনে একটা দাগ কেটে রেখে যাচ্ছে।’
স্টেশন মাস্টার মি, হক দ্রুত মি, শরীফের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, বড় বেপরোয়া, যাই বলুন!
মি. শরীফ গম্ভীর ভাবে শুধু বললেন, হু।’
স্টেশন মাস্টার মি, হক মি, শরীফের গাভীর্য খেয়াল করলেন। যে কাজটা করে যাচ্ছে তা কিন্তু মোটেই সামান্য নয়, মি. শরীফ। সোনাডাঙ্গার গোটা চেহারাই; পাল্টে যাবে, দেখবেন! ভয়ে কেউ ঢুকতই না জঙ্গলে। এখন তো বাচ্চারাও ভয় পাচ্ছে না। কাঠ-ধরুন কাঠের কথাই বলি, গরীব লোকেরা গাছ কেটে কাঠ বিক্রি করেই খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে। প্রচুর হরিণও নাকি আছে। এ বছরই খবর পেয়ে বিদেশী ট্যুরিস্টরা পৌঁছে যাবে। হোটেলগুলো জমজমাট ব্যবসা চালাবে। সত্যি কথা বলতে কি…’
সামনেই দেখা যাচ্ছে মিনি ভ্যানটাকে। মি. হক পিছন ফিরে তাকালেন। পিছন কুয়াশী ৪১
৬৯
পিছন চারজন কুলি আসছে।
ভ্যান থেকে কালো ট্রাঙ্কগুলো বের করে ওঠানো হলো ট্রেনে। শেষ বগিটায় তোলা হলো সবগুলো। মি. শরীফ, জিয়া সাহেব, মোশাররফ এবং লতিফ উঠল।
ট্রেন ছাড়ার এক মিনিট আগে ওদের বগিতে উঠল নতুন,দুজন ভদ্রলোক। ওরা সবাই ভদ্রলোক দুজনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। স্বাস্থ্যবান দুজনই। তবে চোর ছাচর বা ডাকাত বলে মনে হলো না। শিক্ষিত লোক বলেই মনে হলো। তবে সোনাডাঙ্গার লোক নয়।
মোশাররফ তাদের সাথে আলাপ জমাবার চেষ্টা করল। প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রলোক দুজন জানাল যে তারা সোনাডাঙ্গায় এসেছিল এক আত্মীয়ের বাড়িতে সকালের ট্রেনে, এখন ফিরে যাচ্ছে মাধবপুর।
| আর কেউ বুঝতে না পারলেও মি, শরীফ এবং জিয়া সাহেব ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। ভদ্রলোক দুজন পুলিসের লোক। সাদা পোশাক পরে রয়েছে এই যা। সাবধানতার জন্যে মি. হায়দার এই ব্যবস্থা করেছেন কাউকে কিছু না জানিয়ে।
মি, শরীফ এবং জিয়া সাহেব মনে মনে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও পরস্পরকে তারা কেউ কিছু বললেন না।
মি, শরীফ দাঁড়িয়ে ছিলেন খোলা দরজার সামনে। ট্রেন ছাড়ল। লতিফ গেছে বাথরূমে।
ভদ্রলোক দুজন বসে আছে একটি বেঞ্চে পাশাপাশি। খবরের কাগজ পড়ছে দুজন ভাগাভাগি করে। মোশাররফ তাদেরই পাশে। সে-ও পাশে বসে কাগজ
পড়ার চেষ্টা করছে ঝুঁকে পড়ে।
* জিয়া সাহেব অপর এক বেঞ্চিতে ওদের মুখোমুখি বসে। তৃতীয় বেঞ্চিটায় চার পাতা, গুঁড়ো দুধের প্যাকেট, কাপ ইত্যাদি নিয়ে একটি ঝোলা। মি. শরীফ দরজার কাছ থেকে সরে এসে বেঞ্চটায় বসলেন।
টাকাভর্তি ট্রাঙ্কগুলো পাশাপাশি রাখা হয়েছে বেঞ্চের নিচে।
পরবর্তী স্টেশন মাধবপুর । তারপর বিশ মাইল দূরে ধুমনগর ।
মাধবপুর এবং ধুমনগরের মাঝখানে ছোট্ট একটা স্টেশন আছে বটে। কিন্তু আজকাল সেখানে ট্রেন থামে না। স্টেশনটা ভেঙেচুরে দিয়েছিল খান সেনারা। এখনও মেরামত করা হয়নি। তাছাড়া এই স্টেশনে লোকসমাগম নিতান্ত কম হয় বলে কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয়।
মি, শরীফ বেশ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন কেন কে জানে। লতিফ বাথরুম থেকে বেরুবার পর তিনি বললেন, চা করো তো।
কথা বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন।
৭০
ভালউম ১৪
স্টোভ ধরিয়ে চা তৈরি করতে শুরু করল লতিফ।
পিছনের বগিটায় গার্ড আছেন। গার্ড ভদ্রলোক বুড়ো। খবরের কাগজ পড়ছেন। মি, শরীফের সামনের বগিটায় পাঁচজন লোক উঠেছে। পাঁচজন শক্ত সামর্থ চেহারার লোক। একটা বেঞ্চিতে বসে চাপা স্বরে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে তারা । ঘনঘন ঘড়ি দেখছে একজন। আর একজন:দুমিনিট পরপরই খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখে নিচ্ছে।
পাঁচজনেরই চোখে মুখে উত্তেজনা। এই পাঁচজন যে বগিটায় রয়েছে তার পাশের বগিটায় রয়েছে কুয়াশা। কুয়াশা ছাড়া আর কেউ ওঠেনি এই বগিতে। আরও পাঁচটা বগির পরের বগিটায় রাসেল এবং ঋতু। ওরা পাশাপাশি বসেছে।
আপনি কি সব সময় সকলের অমতে কাজ করতে ভালবাসেন, রাসেল ভাই?’ হঠাৎ প্রশ্ন করল ঋতু।
হঠাৎ এ কথা?’ একটু অবাকই হলো রাসেল।
ঋতু জবাব দিল না। রাসেলই আবার বলল, ‘সকলের অমতে মন্দিরে গিয়েছিলাম বলে ও-কথা বলছ? কিন্তু তুমি তো বাধা দাওনি আমাকে।
‘বাধা দিলে আপনি শুনতেন?’ একটু যেন গম্ভীর হলো ঋতু। চুপ করে রইল রাসেল।
চুপচাপ বয়ে চলেছে সময়। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ঋতু। কেন যেন দুই চোখে জুল ভরে উঠেছে তার। কত কথা বলার জন্যে ছটফট করছে মন। কিন্তু বলতে পারছে না সে লজ্জায়।
ট্রেনের গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। সামনে স্টেশন।
দুমিনিট পরই ছেড়ে দিল ট্রেন। কয়েকটি কামরায় আরোহী উঠল দুই কি তিনজন। নামল চারজন।
চায়ের কাপ সামনে ধরে লতিফ ডাক দেয়ায় মি. শরীফের চিন্তাজাল ছিঁড়ে গেল।
লতিফ বলল, চা নিন, স্যার। লতিফের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে বেঞ্চে ফিরে এসে বসলেন মি, শরীফ।
লতিফ সবাইকে এক কাপ করে চা দিল। সাদা পোশাক পরা অপরিচিত লোক দুজনকেও দিল সে চা। সবাই খাবে আর ওরা বাকি থাকবে তা কেমন যেন খারাপ দেখায়। তাছাড়া মি. শরীফও ইঙ্গিতে চা দিতে বললেন ওদেরকে।
সামনে ধুমনগর। অনেক দূর। মাঝখানে পড়বে আমড়া গ্রাম। আমড়াগ্রাম স্টেশনে ট্রেন থামবে না। কুয়াশা ৪১
সুন্দর হয়েছে চা’টা। মি, শরীফ ভুরু কুঁচকে বললেন, কিন্তু এত তেতো কেন? চিনি দাও তো লতিফ।
হ্যাঁ। বড় তেতো,’ বললেন জিয়া সাহেব। | মোশাররফ বলল, ‘চিনি এদিকেও দিয়ে তো, ভাই লতিফ। কিছু মনে কোরো।
ভাই, চা-র পাতা বড় বেশি দিয়ে ফেলেছ তুমি।
• দু’এক ঢোক করে চা খেয়ে সবাই মন্তব্য করছে। লতিফ নিজেও স্বীকার করল অভিযোগটা। | চিনির পেয়ালাটা মি. শরীফের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, বড় বেশি তেততা, ঠিকই বলেছেন, স্যার। কিন্তু…’
জড়িয়ে এল লতিফের কণ্ঠস্বর। টলছে সে।
সবাই লক্ষ্য করছিল লতিফকে। মোশাররফ লতিফকে ধরার জন্যে উঠে দাঁড়াল। প্রায় একই সময় উঠে দাঁড়ালেন মি, শরীফ।
লতিফের দিকে দুজনই হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু লতিফকে ধরে পড়ে যাওয়া থেকে সামলাতে গিয়ে নিজেকে সামলানোই দায় হয়ে পড়ল মোশাররফের।
‘একি••! কথা শেষ হলো না তার। টলতে টলতে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল সে।
প্রায় একই সময় পড়ে গেলেন মি. শরীফ। মি. শরীফের পাশেই পড়ে গেল লতিফ।
তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠল দুই অপরিচিত ভদ্রলোক। কিন্তু তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই টলতে টলতে পড়ে গেল।
জিয়া সাহেব বেঞ্চি ছেড়ে ওঠেননি বা ওঠবার চেষ্টা করেননি।
তিনি আর সকলের মতই জ্ঞান হারিয়েছেন, বেঞ্চের উপর ঘাড় গুঁজে পড়ে আছেন তিনি।
ট্রেনের এই বিশেষ কামরাটির ভিতর নেমে এল, নিস্তব্ধতা। হয়জন আরোহীই একযোগে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল । আর তাদের সাথে রইল সতেরো লাখ টাকা।
কিন্তু টাকাগুলো বেশিক্ষণ রইল না সেখানে।
ছয় মি. শরীফদের সামনের বগিটায় ছিল পাঁচজন শক্তিশালী আরোহী। মাধবপুর স্টেশন ছেড়ে ট্রেন মাইল দুয়েক এগোবার পরই তারা নিজেদের বগি থেকে পিছনের বগিটায় যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেল।
চলন্ত ট্রেনের এক কামরা থেকে অপর কামরায় যাওয়া দুঃসাধ্য কিছু নয়। ট্রেন ছুটছে। লাইনের দুই পাশে ঘন জঙ্গল। লোকজনের চিহ্ন নেই কোথাও।
৭২
ভলিউম ১৪
দরজা, জানালা ধরে নিজেদের বগি থেকে পিছনের বগিতে চলে এল পাঁচজন লোক।
জ্ঞানহীন আরোহীদের দিকে এক পলক তাকিয়েই নিজেদের কাজে মন দিল তারা।
ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে ফেলে, যে-যার কোটের পকেট থেকে হলুদ কাপড়ের ব্যাগ বের করল তারা।
টাকার ব্যাণ্ডিলগুলো দশটা ব্যাগে ভরে ফেলতে সময় লাগল তাদের তিন মিনিট।
টাকা ব্যাগে ভরেই পাঁচজন ছুটে গেল খোল দরজার দিকে।
দুজন তাকাল বাইরের দিকে। দুজনের উপর বাকি তিনজন প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল ।
‘এসে গেছে আমড়াগ্রাম স্টেশন। সামনের দুজনার একজন চাপা অথচ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল। * দরজার কাছ থেকে সরে এল তিনজন।
ট্রেন এখানে থামবে না । না থামলেও গতি সামান্য শ্লথ হলো।
দরজার সামনে দাঁড়ানো লোক দুজন লাফ দিয়ে নেমে পড়ল আমড়াগ্রাম। স্টেশনের পাকা চত্বরে। ট্রেনের সাথে সাথে বেশ খানিকটা দৌড়ে গেল, তারা । চমৎকার ভাবে তাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা।
ইতিমধ্যে টাকাভর্তি হলুদ ব্যাগগুলো স্টেশনের প্লাটফর্মে পড়তে শুরু করছে। চলন্ত ট্রেন থেকে টাকাভর্তি দশটা ব্যাপ পড়ল আমড়াগ্রাম স্টেশনে।
মাধবপুর স্টেশন থেকে গাড়ি ছাড়ার পর, চলন্ত অবস্থায়, রাসেলদের কামরায় উঠেছিল গাড়ির গার্ড কাম-চেকার।
ওদের টিকেট চেক করে চুপচাপ বসেছিল সে আলাদা একটা বেঞ্চে। আমড়াগ্রাম স্টেশন পেরিয়ে যাব যাব করছে যখন ট্রেন তখন সে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে গিয়ে দঁাড়াল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চোখ পড়তেই সে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, আশ্চর্য তো!’
: জানালার ধারেই বসেছিল রাসেল । বাইরের দিকে গলা বাড়িয়ে দিয়ে সে জানতে চাইল, কি হয়েছে?
রাসেল দেখল দুজন লোক হলুদ কয়েকটা ব্যাগ কুড়িয়ে নিচ্ছে। ট্রেন থেকে আরও দুটো ব্যাগ পড়ল প্ল্যাটফর্মে সেগুলোও তুলে নিল তারা। | গার্ড বলল, আমড়াগ্রাম স্টেশন আবার নতুন করে চালু হলো কবে থেকে! ভারি আশ্চর্য লাগছে। আমরা জানি না অথচ…’
দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল গার্ডকে! | ‘ওগুলো পোস্ট অফিসের মাল। ব্যাগগুলো দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।’
কুয়াশা ৪১
৭৩
‘ঠিকই বলেছেন।– সায় দিল গার্ড। বলল, হয়তো স্পেশাল ডেলিভারি ছিল কিন্তু আমরা জানব তা কেমন করে হয়•••।’
সাবধানের মার নেই। চেন টেনে গাড়ি দাঁড় করাতে পারেন। |
স্টেশন থেকে বেশ অনেকটা দূরে চলে এসেছে গাড়ি। গার্ড কি যেন ভাবল। তারপর বলল, থাক। ধুমনগরে তো থামবেই। তখনই জানা যাবে।’
ধুমনগরে ট্রেন থামার পর তাড়াতাড়ি করে নেমে পড়ল গার্ড ।
| যে কামরাটা থেকে হলুদ রঙের ব্যাগগুলো ফেলা হয়েছে আমড়াগ্রাম স্টেশনে। সেটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে।
পরমুহূর্তে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল গার্ড কামরার উপর। তারপরই চিৎকার শোনা গেল তার, পুলিস! পুলিস!
|
সাত কামরাটার সামনে ভীড় জমে উঠল গার্ড তখনও চেঁচাচ্ছে, ডাকাতি হয়ে গেছে। মরে গেছে কয়েকজন মানুষ! পুলিসকে খবর দিন!
তখনও জ্ঞান ফেরেনি মি, শরীফ বা অন্যান্যদের। হৈ-চৈ শুনে রাসেল ঋতুকে বসিয়ে রেখে নেমে এল। ।
ভীড় ঠেলে মি, শরীফদের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গার্ডকে সে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কি?’
‘ডাকাতি হয়ে গেছে, সাহেব! কেবিনের ভিতর পাঁচজন লোক মরে পড়ে আছে।’
কই দেখি! লাফ দিয়ে কেবিনের ভিতর ঢুকল রাসেল। | মি, শরীফ এবং অন্যান্যরা শুয়ে আছেন কেবিনের মেঝেতে। কারও কোন সাড়া শব্দ নেই। মি, শরীফের একটা হাত তুলে নিয়ে পরীক্ষা করল রাসেল। | একে একে সকলেরই পালস দেখল রাসেল। বেঁচে আছে সবাই। মরেনি
কেউ।
এমন সময় স্টেশন মাস্টার কেবিনে ঢুকলেন। রাসেল গার্ডের উদ্দেশ্যে বলল, আপনি এক বালতি পানির ব্যবস্থা করুন দেখি তাড়াতাড়ি!’
| পানির ব্যবস্থা করতে হলো না। জ্ঞান ফিরে এল মি, শরীফের।
চোখ মেলে তাকিয়ে রইলেন মি. শরীফ বোকার মত কয়েক সেকেণ্ড। তারপর আচমকা উঠে বসলেন। এদিক ওদিক তাকালেন। দেখলেন সবগুলো ট্রাঙ্কের ডালা খোলা এবং ভিতরে কিছুই নেই।
, ভলিউম ১৪
৭৪
তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন মি. শরীফ। কঁপা গলায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘পুলিসে খবর দিন। ও মাইগড! সতেরো লক্ষ টাকা! ডাকাতি•••ও মাইগড! |
আবার পড়ে যাচ্ছিলেন মি. শরীফ। গার্ড এবং স্টেশন মাস্টার তাকে ধরে ফেলল।
সতেরো লাখ টাকা ডাকাতি হয়েছে। কথাটা বুঝতে অসুবিধে হলো না রাসেলের। অমনি ওর মনে পড়ে গেল আমড়াগ্রাম স্টেশনে ফেলা হলুদ রঙের ব্যাগগুলোর কথা।
একলাফে কেবিন থেকে নেমে ভীড় ঠেলে নিজেদের কেবিনের জানালার সামনে এসে দাঁড়াল রাসেল।
“কি হয়েছে রাসেল ভাই…’ ‘ঋতু, কিছু মনে কোরো না তুমি।
বাধা দিয়ে রাসেল দ্রুত বলে চলল, ‘ঢাকায় তুমি এই ট্রেনেই চলে যাও একা, কেমন? আমি•••আমাকে একবার আমড়াগ্রাম স্টেশনে যেতে হচ্ছে। কিছু মনে কোরো না।’
ছুটল রাসেল। রাসেল ভাই!
বিস্মিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল ঋতু। কিন্তু রাসেল তখন অনেকটা দূরে চলে গেছে। শেষ চেষ্টা করল ঋতু। চিৎকার করে বলল সে, রাসেল ভাই!
কিন্তু রাসেল থামল না। চলে গেল ও ঋতুকে ফেলে।
ছুটতে ছুটতে মি. শরীফদের দুটো কেবিনের পরের কেবিনটায় এসে উঠল রাসেল।
যা ভেবেছিল ও তাই। কুয়াশা নেই কেবিনে। অথচ কুয়াশাকে এই কেবিনেই উঠতে দেখেছিল রাসেল।
| কুয়াশাকে কেবিনে না দেখে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রাসেল।
স্টেশনে লোক খুব বেশি নয়। প্রতিটি লোকের উপর একবার করে দৃষ্টি ফেলে নিরাশ হলো রাসেল।
স্টেশনের কোথাও নেই কুয়াশা ।
একমুহূর্ত কি যেন ভাবল রাসেল। তারপর লাফ দিয়ে নামল ট্রেন থেকে। নেমেই ছুটতে শুরু করল।
ছুটতে ছুটতে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াল রাসেল। | চারদিকে লোকজন খুব কম। ধু-ধু করছে ধান খেত। সামনে দুটো সাইকেল রিকশা এবং একটি বেবী টেক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেবী ট্যাক্সির ড্রাইভার উৎসুকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে রাসেলেরই দিকে।
‘কোথায় যাবেন, সাব?’ চোখাচোখি হতেই জিজ্ঞেস করল ড্রাইভার।
কুয়াশা ৪১
৭৫
‘আমড়াগ্রাম স্টেশনে কতক্ষণে পৌঁছুতে পারবে?’ সরাসরি প্রশ্ন করল রাসেল।
নড়েচড়ে উঠল ড্রাইভার। একগাল হাসল সে। বলল, দশ মিনিটে যামু গা, সাব। আহেন না!’
আর কথা না বলে বেবীতে গিয়ে চড়ল রাসেল।
‘আমড়াগ্রাম ইস্টিশনে কি কাম, সাব? আব্বাসের ট্যাক্সি কইরা তিনজন লোক এই মাত্তর গেল দেখলাম।
বাধা দিয়ে রাসেল বলল, “তাই নাকি? লোকগুলো দেখতে কেমন?
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ড্রাইভার রাসেলের দিকে। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে সে। চওড়া মেটো পথ। কিন্তু সমান, এবড়োখেবড়ো নয়। তুমুল বেগে ছুটছে বেবী।
আপনে সাব ভদ্দরলোক। আপনারে কইতে পারি লোকগুলারে তেমন সুবিধার মনে অইল না। আব্বাসের ট্যাক্সিতে চইড়াই দশ টাকার দুই খান নোট বাইর কইরা একজন কইল-জলদি লয়া চল, ব্যাটা, বিশ টাকা পাবি! লোকগুলা সব দেখতে গুণ্ডাপাণ্ডাগে রহম।
“ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো তুমি।
আমড়াগ্রাম স্টেশনে দুজন লোককে হলুদ রঙের ব্যাগ কুড়াতে দেখেছিল, রাসেল। আরও তিনজন গেছে বেবী ট্যাক্সিতে। মোট পাঁচজন। দু’একজন আরও হয়তো আছে।
অস্ত্র বলতে পকেটে ছোট একটা ছুরি। রাইফেলটার কথা ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি। নিজেকে তিরস্কার করল রাসেল। ঋতুর কাছে রয়ে গেছে রাইফেলটা। কথা বলার সময় চেয়ে নিলে কাজ হত।
পথের দুই ধারে ফাঁকা মাঠ। কখনও ঝোঁপঝাড়। কখনও ধানখেত। পিছন ফিরে তাকাল রাসেল।
দেখা যায় না কিছু। ধুলোর পাহাড় শুধু।
মিনিট তিনেক পরই আমড়াগ্রামে ঢুকল বেবী ট্যাক্সি। আঁকাবাঁকা পথ। ঘর বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে অসংখ্য মোড় নিয়ে আমড়াগ্রাম স্টেশন অবধি।
ঘর বাড়ির সামনে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে। জোরে গাড়ি চালানো অসম্ভ এবং ভয়ানক বিপদজনক।
কিন্তু ড্রাইভার দক্ষতার সাথে ঝড়ের বেগে ছুটিয়ে নিয়ে চলল বেবী ট্যাক্সিকে। সর্বক্ষণ হর্ন বাজাচ্ছে সে।
মিনিটখানেক পরই ধান খেত পড়ল পথের দুই পাশে। ‘ওইযে, সাব, ইস্টিশন দেহা যায়।’
সামনের দিকে তাকিয়ে ভাঙাচোরা স্টেশনটা দেখতে পেল রাসেল। স্টেশনের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিরাশই হলো ও। কোথাও কোন লোকজন নেই। কোথাও কোন গাড়িঘোড়ার চিহ্ন নেই। সব খা খা করছে।
৭৬
ভলিউম ১৪
তোমার আব্বাসের বেবী ট্যাক্সি কোথায়, দেখছি না যে?’ হেসে ফেলল ডাইভার।
বলল, কোয়েন না, সাব! হের নাম আব্বাস। বিশ ট্যাহা কামাইছে–দেহেন গা, মদ খায়া টুলতাহে এরি মধ্যে•••!’
স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়াল বেবী। লাফ দিয়ে নামল রাসেল। কাউন্টারের পাশ দিয়ে লোহার খোলা গেট দিয়ে একটা শেডের ভিতর গিয়ে ঢুকল ও।
কেউ নেই শেডের ভিতর। কিন্তু কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করল রাসেল।
বেবী ট্যাক্সির ড্রাইভারকে টাকা দেয়নি রাসেল। ইচ্ছা করেই। টাকা পেলেই ভেগে যেতে পারে। সেটা চায় না সে। একজন লোক অন্তত কাছাকাছি থাকুক।
আট শেডের ভিতর জায়গা বলতে অবশিষ্ট নেই এতটুকু। ভাঙা কাঠের চেয়ার, লম্বা লম্বা কাঠ, চটের ব্যাগ, কাগজের স্তূপ চারদিকে। একদিকে দাঁড় করানো রয়েছে অনেকগুলো ড্রাম।
ড্রামগুলোর মাঝখান দিয়ে সরু পথ। পথটা শেষ হয়েছে একটা বন্ধ দরজার কাছে। দরজাটার দিকে একদৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল রাসেল।
শব্দটা আসহে ওদিক থেকেই।
কে যেন কাতরাচ্ছে ব্যথায়।
মেঝের দিকে তাকাল রাসেল। চোখকান সতর্ক হয়ে উঠল ওর। ধুলোর উপর পায়ের ছাপ। সেই সাথে টাটকা রক্ত, ফোঁটা ফোঁটা।,,
এক পা এক পা করে খালি ড্রামগুলো দুই পাশে রেখে দরজাটার দিকে এগিয়ে চলল রাসেল।
দরজার গায়ে কোন তালা নেই। ভিতর থেকে সম্ভবত বন্ধ। বন্ধ না-ও হতে পারে। হয়তো কবাট দুটো শুধু ভেজানো আছে।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাসেল। পকেট থেকে আগেই বের করেছে ও হোট ছুরিটা।
মৃদু ঠেলা দিল দরজার বাটে। সাথে সাথে খুলে গেল দরজা।
ছোট একটা কামরা। কামরার ভিতর দুজন লোক চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। একজন নড়ছে চড়ছে না। মারা গেছে সম্ভবত। বুকের কোট, শার্ট রক্তে ভেজা। অপর জনের বুকের কাছটায়ও রক্ত দেখা যাচ্ছে। নড়ছে না সে বিশেষ। কিন্তু মাঝে মধ্যে গোঙাচ্ছে। মৃত্যুপথের যাত্রী সে-ও বুঝতে পারল রাসেল। কুয়াশা ৪১
৭৭
G
পা বাড়াল রাসেল। কিন্তু পরমুহূর্তে কি মনে করে বাঁ দিকে তাকাল একবার।
বাঁ দিকে তাকিয়েই রাসেল দেখল লোহার একটা রড নেমে আসছে তার মাথার উপর।
ড্রামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকটা। ছুরিটা ফেলে দিল রাসেল হাত থেকে।
আক্রমণকারীর রডটা সবেগে নেমে এল রাসেলের কাঁধ বরাবর। রাসেল ধরে ফেলল ডান হাত দিয়ে রডটা। পরমুহূর্তে বা হাতের আঙুলগুলো পাশাপাশি রেখে লোকটার গলায় প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করল ও।
দুই হাত মাথার উপর তুলে সবেগে পিছন দিকে ছিটকে পড়ল লোকটা। পড়ল গিয়ে দুটো ড্রামের গায়ে। উল্টে পড়ল ড্রাম দুটো। স্থির হয়ে গেল আক্রমণকারীর দেহটা।
সেদিকে পা বাড়াতে গেল রাসেল। ঠিক তখুনি আবার আক্রান্ত হলো ও। ডান পাশের ড্রামগুলোর আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুই জোড়া হাত। রাসেল টেরই পেল না। দুই জোড়া হাত জড়িয়ে ধরল রাসেলের পা দুটো।
ঘুরে দাঁড়াবার আগেই পড়ে গেল রাসেল। পড়ার সাথে সাথে কপালের পাশে এসে লাগল একটা প্রচণ্ড ঘূসি।
ঘুসি খেয়েও লাথি চালাল রাসেল। লাগল না সেটা। দ্বিতীয় একটা ঘুসি লাগল রাসেলের নাক বরাবর। তারপর আবার একটা ঘুসি সেই একই জায়গায়।
মাথাটা ঠুকে গেল রাসেলের পাকা মেঝের সাথে।
ঢামের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল লোক দুজন। কামরার ভিতর তাকাল না তারা একবারও। ভিতর থেকে আহত লোকটার আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
| যে লোকটার গলায় মেরেছিল রাসেল সেই লোকটার অজ্ঞান দেহটা তুলে নিল লোক দুজনের একজন। শেড ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল তারা।
বেবী-ট্রাক্সির ড্রাইভার রাসেলের জন্যে অপেক্ষা করছিল।
লোক দুজন অজ্ঞান দেহটা নিয়ে শেড থেকে বেরিয়ে আসতেই হাঁ হয়ে গেল ড্রাইভারের মুখ। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল তার। বুকটা চিব ঢিব করতে শুরু করল।
লোক দুজন একটু থমকে দাঁড়াল। ড্রাইভারের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে একমুহূর্ত তাকাল তারা। তারপর একজন অপর জনকে বলল, দেরি করলে লাভ কি, চল ভেগে যাই!
‘কিন্তু টাকার কি হবে!’ অপরজন চাপা গলায় যেন আর্তনাদ করে উঠল।
টাকা কি আর এখানে আছে! বড় কড়া ওস্তাদ লেগেছে আমাদের পিছু। সালাম, পটলা–দুজনকে মেরে রেখে গেছে দেখলি তো! চল চল, এখন জান
ভলিউম ১৪
৭৮
বাঁচানো ফরজ।
সিঁড়ি ক’টা বেয়ে নেমে ডান পাশ দিয়ে স্টেশনের দেয়াল ধরে খানিকদূর গিয়েই মোড় নিল ওরা।
| হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বেবী ট্যাক্সির ড্রইভার। কিন্তু ভয় এখনও দূর হয়নি তার। ওদিকে কোথায় গেল লোক দুজন? রেললাইন টপকে জঙ্গল পেরিয়ে ধুমপাড়ার দিকে যাবে নাকি?
নাকি কাঁধের দেহটা আড়ালে রেখে ফিরে আসবে? কথাটা মনে হতেই আবার আতঙ্কে অবশ হয়ে গেল ড্রাইভারের হাত-পা। : পালানো দরকার, বুঝতে পারছে ড্রাইভার। লোক দুজন ফিরে এলে আর রক্ষা নেই। কিন্তু পালাতে যেন মন সরছে না। যে সাহেবকে সে খানিক আগে নিয়ে এসেছে সে কোথায়, কি হালে আছে তা জানা দরকার।
সাহেবটাকে মেরে ফেলল নাকি লোক দুজন?
এমন সময় শোনা গেল একটি গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ।
দেয়ালের আড়াল থেকে কালো রঙের একটা ফোক্সওয়াগন গাড়ি বেরিয়ে এল।
বেবী-ট্যাক্সির দিকে না এসে সোজা দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করল গাড়িটা। ফাঁকা মেটো পথ দিয়ে ঝড়ের বেগে পালিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা।
সত্যি সত্যি নিরাপদ বোধ করল এবার ড্রাইভার। যাক, বাঁচা গেল। গাড়ি করে চলে গেল লোকগুলো।
হঠাৎ তার মনে পড়ল সাহেবের কথা। বেবী ট্যাক্সি থেমে নেমে পা বাড়াল সে এবার সিঁড়ি কটার দিকে।
অকারণেই কেঁপে উঠল ড্রাইভারের বুকটা। এইমাত্র সাহেবকে নিয়ে এসেছে সে। কি দেখবে সে এখন কে জানে।
নয়
জ্ঞান ফিরে আসতে রাসেল দেখল ড্রাইভার তার মুখের উপর ঝুঁকে বসে আছে। নাক জ্বালা করছে ভীষণ। হাতটা স্বভাবতই নাকে ঠেকল। হাত নামাতেই লাল তাজা রক্ত দেখতে পেল সে।
উঠে বসতে গেল রাসেল। ‘উইঠেন না, সাব!’ ড্রাইভার আপত্তি প্রকাশ করল। ধরল সে দুই হাত দিয়ে রাসেলকে।
উঠে বসল রাসেল। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকের রক্ত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল ও, লোক তিনজন পালিয়েছে না?
কুয়াশা ৪১
‘হ, সাব। কালো একটা গাড়ি আছিল ইস্টিশনের ডাইন পাশে…’
নম্বরটা দেখেছ তুমি?’
দেখছিলাম, সাব। কিন্তু টাকা ক, না, খ কইতে পারি না। নাম্বারগুলা মনে আছে, তবে শেষেরটা মনে নাই। তিন, দুই, পাঁচ•••!
খুশি হয়ে উঠল রাসেল। ‘ওতেই খুঁজে পাওয়া যাবে। কালো রঙের তাই না?
হ, সাব। ভোক্সোওয়াগান।’ | জিজ্ঞেস করল রাসেল, কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম আমি বলো তো? ‘মিনিট দশেক অইব, সাব।’ ঘড়ি দেখল রাসেল। বলল, দেখো তো, পুলিসের গাড়ি আসছে কিনা। কথা শেষ হবার সাথে সাথে শোনা গেল জীপের শব্দ।
এদিক ওদিক তাকিয়ে ছোট ছুরিটা খুঁজতে লাগল রাসেল। পাওয়া গেল সেটা অল্প দূরেই।
ছুরিটা পকেটে নিয়ে পা বাড়াল রাসেল। দরজা পেরিয়ে কামরার ভিতর ঢুকে লাশ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল ও।
এই লোক দুটোকেই রাসেল ট্রেন থেকে দেখেছিল হলুদ ব্যাগগুলো কুড়াতে।
দুজনার ক্ষত স্থানই পরীক্ষা করল রাসেল। বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে লোক দুজন। যে গুলি করেছে তার লক্ষ্য অব্যর্থ। ঝানু লোক সন্দেহ নেই রিভলভার বা পিস্তল যাই হোক চালাতে চালাতে হাত পেকেছে। দুজনারই হৃৎপিণ্ড ভেদ করে গেছে বুলেট!
কুয়াশার মুখটা আর একবার ভেসে উঠল রাসেলের চোখের সামনে। ভারী জুতোর শব্দ এগিয়ে আসছে। | কামরার চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রাসেল দ্রুত। । খালি কামরা। হলুদ ব্যাগ তো দূরের কথা, কিছুই নেই।
‘লোকগুলো যাবার সময় কিছু নিয়ে গেছে? কয়েকটা হলুদ ব্যাগ?’ জানতে চাইল রাসেল।
, সাব। কিছু নিয়া যাইতে দেহি নাই।’ আপনারা কে? জুতোর শব্দ এসে থামল খোলা দরজার সামনে কয়েক জোড়া।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রাসেল। ড্রাইভার লোকটা দ্রুত সরে গেল এক কোণে। পুলিস দেখে ভয় পেয়েছে সে।
ইউনিফর্ম দেখে রাসেল বুঝতে পারল প্রশ্নকারী একজন পুলিস ইন্সপেক্টর। ইন্সপেক্টরের হাতে একটি রিভলভার।
পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াল রাসেল। মৃদু হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। বলল, আমি
৮০
ভলিউম ১৪
একজন ছাত্র। রাসেল আহমেদ। আমার সঙ্গে ও একজন বেবী ট্যাক্সির ড্রাইভার।’
কি করছেন আপনারা এখানে?’ ধমক দিয়েই প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর, লাশ দুটো কার? কে খুন করেছে?
উত্তেজিত হবেন না, ইন্সপেক্টর,’ বলল রাসেল শান্ত গলায়। আমিও জানতে চাই কে খুন করেছে এই লোক দুটোকে। কিন্তু আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে সময় দরকার। আপনি এখানের করণীয় যাবতীয় কাজ করে নিন। আপনার সাথে আমি থানায় যাব। সেখানেই শুনবেন সব কথা।
ইন্সপেক্টর রাসেলের আপাদমস্তক লক্ষ করল বারকয়েক। কি যেন বলতে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে কি মনে করে। তারপর পিছন দিকে তাকিয়ে বলল, নজর রেখো, হাবিব।
জ্বী, স্যার!’ ইন্সপেক্টরের নির্দেশ শুনে নিঃশব্দে হাসল রাসেল। কিন্তু কোন মন্তব্য করল না।
কামরার ভিতর ঢুকলেন ইন্সপেক্টর। পিছু পিছু ঢুকল একজন কনস্টেবল। কনস্টেবলের পিছনে ধুমনগর স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। সবশেষে ঢুকল ট্রেনের গার্ড ।
গার্ড রাসেলকে দেখেই অবাক গলায় বলল, “আরে, আপনি, এখানে!
মৃদু হেসে রাসেল বলল, আপনাদের আগেই পৌঁছেছি। কিন্তু ফল হয়নি। নাকে মুখে ঘুসি খাওয়াই সার।’
| ‘চেনেন নাকি ওকে?’
‘ঠিক চিনি না। তবে উনি ওই ট্রেনেই ছিলেন। একই কেবিনে ছিলাম আমরা। এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে হলুদ রঙের ব্যাগগুলো যখন ট্রেন থেকে পড়ছিল তখন তা আমরা দুজনই দেখেছি। ওনার সাথে এক মহিলাও ছিলেন।
সব কথা শোনার প্রয়োজন বোধ না করায় কামরা থেকে বেরিয়ে রক্তের ফোঁটা অনুসরণ করে এগিয়ে চলল রাসেল। | ইন্সপেক্টর চোখের ইশারায় নির্দেশ করলেন। কামরার বাইরে দাঁড়ানো রাইফেলধারী কনস্টেবলটি পাঁচ-সাত হাত দূর থেকে অনুসরণ করে চলল রাসেলকে।
রক্তের ফোঁটা এঁকে বেঁকে চলে গেছে শেডের শেষ মাথায়। সেখানে বড় একটা গেট। গেটটা খোেলাই।
গেট অতিক্রম করে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল রাসেল। কনস্টেবলটিও সাত আট হাত পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
প্ল্যাটফর্মের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় পাশাপাশি চাপ চাপ রক্ত দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গেল রাসেল। রক্তের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে আশপাশের পাকা মেঝের দিকে তীক্ষ্ণচোখে তাকাল ও। জুতোর দাগ দেখা যাচ্ছে ধুলোয়।
৬-কুয়াশা ৪১
নিহত লোক দুজনার পায়ে পুরানো জুতো দেখেছে রাসেল। সেগুলোর ছাপ চেনা গেল। আরও তিন জোড়া জুতোর দাগ দেখল ও। আগের গুলোর মতই। কিন্তু এসব ছাড়াও আর এর্ক জোড়া জুতোর দাগ চোখে পড়ল ওর। | তুলনামূলকভাবে অন্যান্য জুতোর তুলনায় এই জুতোর ছাপ দেখে বোঝা যায় জুতো জোড়া আকারে বড়। জুতোর নিচেটায় লম্বা লম্বা খাঁজ কাটা ছিল, সেইরকমই ছাপ পড়েছে।
প্ল্যাটফর্মের চারপাশে আর কোথাও কিছু নেই। ফিরে এল রাসেল সেই কামরায়।
থানায় নিজস্ব আসনে বসে ইন্সপেক্টর আজমল খান রাসেলের সব কথা শুনে মোটেও খুশি হতে পারলেন না। বললেন, সবই বুঝলাম। কিন্তু আপনাকে ও আপনার ড্রাইভার জলিলকে আমরা পেয়েছি দুটো লাশের সাথে। লোক দুজনকে যে আপনি। বা আপনারা খুন করেননি তার প্রমাণ কি? তাছাড়া এই সব ভয়ঙ্কর ডাকাতির ব্যাপারে আল্লার মত অল্পবয়স্ক একজন ছাত্র এত বেশি আগ্রহী কেন?’–
| মৃদু হাসিটুকু এতক্ষণ পর মুছে গেল মুখ থেকে রাসেলের। শান্ত গলাতেই প্রশ্ন করল ও, মাফ করবেন। পাল্টা প্রশ্ন আছে আমার। আপনারাই বা এত বেশি। আগ্রহী কেন ডাকাতি, খুন, চুরি, রাহাজানি ইত্যাদি সম্পর্কে।
হাঁ হয়ে গেল ইন্সপেক্টর আজমল খানের মুখ। ছোকরা বলে কি? মাথা খারাপ নাকি?
রেগেমেগে তিনি বললেন, আপনি কি ঠাট্টা করছেন আমার সাথে? জানেন না আমরা সরকারী চাকুরে? অন্যায়, অপরাধ, জুলুম রোধ করার জন্যে•••?’
বাধা দিল রাসেল। বলল, অন্যায়, অপরাধ জুলুম ইত্যাদি রোধ করবার জন্যে আপনারা সরকারের টাকা নেন, মানে বেতন নেন। আমি নিই না। আপনার সাথে এই পার্থক্য আমার। আমিও অন্যায়, অপরাধ, জুলুম রোধ করতে চাই। এর বিরুদ্ধে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমারও তো দায়িত্ব, কর্তব্য বোধ, মনুষ্যত্ব ইত্যাদি আছে। যাকগে, আপনি বরং স্পেশাল পুলিস অফিসার মি. সিম্পসনকে ফোন করুন ঢাকায়। আমার সম্পর্কে তিনি সব জানাবেন আপনাকে। আর শুনুন, বলবেন, কুয়াশাকে ওই বিশেষ ট্রেনে দেখা গেছে। সোনাডাঙা থেকে উঠেছিল সে। কিন্তু ধূমনগরে ট্রেন যখন পৌঁছোয় তখন আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রাসেনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ইন্সপেক্টর আজমল খান।
ছেলেটি কে?’ এই একটিই প্রশ্ন আজমল খানের।
শহীদের খোঁজখবর নেবার জন্যে রাসেল প্রায়ই যায় একবার করে শহীদের ৮২
ভলিউম ১৪
বাড়িতে। | শহীদ খান বর্তমানে একাকী বাড়ির ভিতরই দিন কাটায়। প্লাস্টিক সার্জারীর পর বিলেত থেকে দেশে ফিরে বই-পত্র এবং ঘুম নিয়েই আছে সে। বাইরে মোটেই বের হয় না। দেখাসাক্ষতিও করে না সকলের সাথে। রাসেল যায়, মি. সিম্পসন মাঝেমধ্যে যান এবং দু’একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কারও সাথে সে দেখা করে না। । ছেড়ে দিয়েছে শহীদ গোয়েন্দাগিরি। মুক্তিযুদ্ধে সব গেছে তার স্ত্রী মহুয়া, বোন লীনা, প্রাণের চেয়ে কম প্রিয় নয় গফুর, বাল্যবন্ধু কামাল-কেউ বাঁচেনি। | সব হারিয়ে পাথর হয়ে গেছে যেন শহীদ। হাসে না সে। কথা বলে খুব কম। রাজ্যের বই নিয়ে পড়ে থাকে বাড়ির ভিতর। দুনিয়ার কোন খবরই রাখে না।
শহীদের বাড়িতেই মি. সিম্পসনের সাথে পরিচয় রাসেলের। শহীদই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সম্ভবত আড়ালে মি. সিম্পসনের কাছে রাসেলের প্রশংসাও করেছিল শহীদ।
মি. সিম্পসন দেখা হলেই নানান ধরনের ক্রাইম সম্পর্কে আলোচনা করতে চান রাসেলের সাথে।
ফোনে খানিকক্ষণ কথা বলার পরই ইন্সপেক্টর আজমল খান রিসিভারটা রাসেলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত এবং মিষ্টি স্বরে বললেন, মি. সিম্পসন আপনার সাথে কথা বলতে চনি, মি. রাসেল।
রিসিভার কানে ঠেকাল রাসেল। অপরপ্রান্ত থেকে মি. সিম্পসনের গলা শোনা গেল, কেমন আছ, রাসেল?’
‘ভালই, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল রাসেল।
কুয়াশাকে দেখেছ তুমি? ‘হ্যাঁ।’
মি. সিম্পসন জানালেন, ‘ইন্সপেক্টর আজমলকে বলে দিয়েছি। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করবেন না তিনি। এবং সব ব্যাপারে তোমার পরামর্শ নেবেন। আমি, বিকেলেই পৌঁছে যাব। তোমার কি মনে হয়, রাসেল? কুয়াশা এই খুন আর ডাকাতির সাথে জড়িত?’
‘প্রমাণ না পেলে বলি কি করে?
তা ঠিক। ঠিক আছে দেখা হলে কথা হবে। হাড়ছি।’ ফোন ছেড়ে দিল রাসেল।
অফিসরুমে প্রবেশ করলেন ক্রমান্বয়ে মি. হায়দার, মি. শরীফ, জিয়া সাহেব, মোশাররফ, লতিফ এবং সাদা পোশাক পরা দুজন পুলিস ইন্সপেক্টর। •
ইন্সপেক্টর আজমল খান রাসেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, যা জানবার আপনিই জেনে নিন, মি. রাসেল। তারপর আমি।’ কুয়াশা ৪১
চেয়ার দেয়া হলো। বসলেন সবাই। মি. হায়দার ডায়েরী লেখালেন একটা। ফোনে খবর পেয়ে বাংলা ব্যাঙ্ক থেকে ছুটে এসেছেন মি, হায়দার। ইন্সপেক্টর আজমল খান প্রশ্ন করতে মি, হায়দার এবং মি. শরীফ দুজনই জানালেন যে তাঁরা। কাউকে বিশেষভাবে সন্দেহ করেন না। | ডায়েরী লেখা শেষ হবার পরে রাসেল মি. শরীফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনারা অজ্ঞান হলেন কিভাবে?’
‘চা পান করছিলাম আমরা। দু’এক চুমুক পান করার পরই আমরা জ্ঞান হারাই।’ বিষণ্ণ ভাবে উত্তর দিলেন মি. শরীফ।
চা কোথা থেকে এল?’
লতিফ ঢোঁক গিলল পরপর কয়েকবার। তারপর বলল, ‘স্টোভ ছিল আমাদের সাথে, স্যার। আমিই তৈরি করি চা। চা’র পাতা, দুধ, চিনি সব সঙ্গে নিয়েছিলাম আমি।’
রাসেল বলল, ‘কোন রকম বিষ মেশানো ছিল চায়ে। হয়তো চিনিতেও ছিল। কিংবা চার পাতা বা দুধেও থাকতে পারে। যাকগে। গোটা ব্যাপারটা এমর্ন ভাবে ঘটেছে যে স্বভাবতই মনে হয় ডাকাতরা আগে থেকে সব জানত।
| তার মানে? আপনি কি বলতে চান?’
প্রশ্নটা মি, হায়দারের।
রাসেল বলল, আমি বলতে চাই বাংলা ব্যাঙ্কের কোন কর্মচারী ডাকাতদেরকে সরকম তথ্য আগে থেকেই সরবরাহ করেছিল। তা না হলে এমন নিখুঁত ভাবে তারা টাকা নিয়ে চম্পট দিতে পারত না।’
কিন্তু তা অস!’
প্রায় চিৎকার করে উঠলেন ম, হায়দার, একমাত্র আমি ছাড়া আজ সকালের আগে আর কেউ জানত না যে ব্যাঙ্ক থেকে আজ টাকা ঢাকায় যাচ্ছে। কোন ট্রেনে যাচ্ছে তা জানা তো একেবারেই অসম্ব। আমার কর্মচারীদের কোন ভূমিকা এই ডাকাতির সাথে থাকতে পারে না। তারা যখন আমার মুখ থেকে খবরটা পায় তখন থেকে আমার চোখের আড়ালে এদের একজনও কোথাও যায়নি। সোজা স্টেশনে আসে তারা। তারপর ট্রেনে ওঠে। ডাকাতি যে আমার কর্মচারীরা করেনি তাতে সন্দেহ নেই। অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে এদের সবাইকে। এদের সাথে দুজন পুলিস কর্মচারীও ছিলেন। তারাও জ্ঞান হারিয়েছিলেন। আমার কর্মচারীরা ভাড়াটে লোক মারফত এই ডাকাতির ব্যবস্থা করেছে বলে আপনারা সন্দেহ করে থাকলেও তা যুক্তিতে টেকে না। ভাড়াটে লোকদেরকে খবর পাঠাল তারা কখন? সকালে তারা নিজেরাই কথাটা জানতে পারে। তারপর তাদের সুযোগ ছিল না ভাড়াটে ডাকাতদেরকে খবর পাঠাবার।
৮৪
ভলিউম ১৪
রাসেল হেসে ফেলল। বলল, এমনও তো হতে পারে যে আপনি যখন। এদেরকে খবরটা দেন তার আগেই এদের কেউ খবরটা জেনে ফেলেছিল?
| ‘অসম্ভব!’ জোর দিয়ে বললেন মি. হায়দার। আমি কাউকেই এ খবর জানাইনি।
ভাল করে ভেবে দেখুন। অজিকে ঢাকায় টাকা যাবে একথা আপনি কাউকে বলেননি?’
। বলিনি।’ ভেবে না দেখেই মি. হায়দার জোরের সাথে বললেন। | রাসেল বলল, বেশ। আপনাদেরকে প্রশ্ন করে বিশেষ কিছু জানা যাবে বলে মনে হয় না। আমার আর কোন প্রশ্ন নেই। তবে পরে হয়তো আপনাদের সাথে আমি দেখা করব।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রাসেল। ‘চললেন, মি. রাসেল?’ ইন্সপেক্টর আজমল খান জানতে চাইলেন।
হ্যাঁ। মি, সিম্পসন বিকেলে আসবেন। ওঁকে বলবেন আমি সোনাডাঙ্গার জামানদের বাড়িতে আছি।’ কথাগুলো বলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল রাসেল।
‘ও কে?’ জিজ্ঞেস করলেন মি. হায়দার। ‘কিছু যদি মনে করেন তাহলে প্রশ্নের উত্তরটা আমি দেব কি, স্যার? বিনয়ে নুয়ে পড়ে জানতে চাইল মোশাররফ। ইন্সপেক্টর আজমল খান মি. হায়দারের প্রশ্নের উত্তরে কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন। । মি. শরীফ বললেন, ছেলেটার নাম রাসেল। ও-ই তো জঙ্গলে গিয়েছিল? | জ্বী, স্যার, উত্তর দিল লতিফ।
মি. হায়দার ইন্সপেক্টরের দিকে তখনও তাকিয়ে আছেন। ইন্সপেক্টরকে উত্তর দিতে না দেখে আবার তিনি প্রশ্ন করলেন, “আমাদের ব্যাপারে, থানা পুলিসের ব্যাপারে ওর কি ভূমিকা, ইন্সপেক্টর সাহেব?’
রাসেলের উপর মি, হায়দার বিরক্ত হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে।
ইন্সপেক্টর কি বলবেন ভেবে না পেয়ে বলে ফেললেন, ‘ও, মানে, মি, রাসেল একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ।’
মি. হায়দার এবং মি, শরীফ ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কারও মুখে কোন কথা ফুটল না।
বিকেল বেলা সোনাডাঙ্গায় এলেন মি. সিম্পসন। নিজেই দেখা করলেন তিনি রাসেলের সাথে। অনেক আলাপ হলো দুজনে।
মি. সিম্পসন কুয়াশার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। রাসেল কুয়াশাকে দেখেছে একথা প্রকাশ করলেও ডাকাতি এবং খুনের ব্যাপারে কুয়াশাকে সে জড়াল না। কুয়াশা ৪১
৮৫
সবশেষে রাসেল বলল, কুয়াশার একটা ভূমিকা এ ব্যাপারে অবশ্যই আছে। তবে প্রমাণ না পেয়ে তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না, আমি, মি. সিম্পসন।’
রাসেল চায়নি, কিন্তু স্বইচ্ছায় একটি রিভলভার রাসেলের টেবিলে রেখে গেলেন মি. সিম্পসন। বললেন, ‘বড় ভয়ঙ্কর লোক এরা রাসেল । আত্মরক্ষার জন্যেও তোমার অস্ত্র দরকার। বিশেষ করে এখুনি তুমি ঢাকায় ফিরছ না যখন।
এই রহস্যের সমাধান না হওয়া অবধি তো থাকবই,’ হেসে ফেলে বলল ব্রাসেল।
‘আমিও তাই চাই, রাসেল। কুয়াশাকে গ্রেফতার করার জন্যে তোমার সাহায্যেরও আমার দরকার।’
উত্তর দিল না রাসেল। মৃদু হাসল শুধু। রাত নামল।
সোনাডাঙ্গার স্টার হোটেলের সামনে ঘুর ঘুর করতে দেখা গেল কয়েকজন লোককে। লোকগুলোকে বিশেষ ভাবে কেউ লক্ষ না করলেও একজন হোটেলের ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে।
রাত ন’টার দিকে দুজন লোক ম্যানেজারের কামরায় ঢুকে পড়ল।
লোক দুজন গুণ্ডা পাণ্ডাদের মতই দেখতে। একজন একটু বেঁটে। কিন্তু লোহার মত শক্ত তার মাংসপেশী। অনজিন খুব লম্বা। সে একাই পাঁচ-সাতজন লোককে সামলাতে পারে।
‘কি চাই?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল প্রৌঢ় ম্যানেজার।
নতুন একজন বোর্ডার এসেছে আপনার হোটেলে। তার রূম নাম্বারটা দিন।’ কেন? এবার ধমকে উঠল বেটে, যা বললাম তাই করুন। কৈফিয়ৎ দিতে পারব না।’
লম্বা লোকটা পকেট থেকে বের করল, একটা পিস্তল। সেটা ম্যানেজারকে ইঙ্গিতে দেখাল।
ম্যানেজার ঢোক গিলে বলল, “দোতলার সাত নাম্বার রূম…।’ লোক দুজন বেরিয়ে গেল।
ম্যানেজারের কামরার বাইরে অপেক্ষা করছিল আরও চারজন লোক। মোট ছয়জন লোক সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। কিন্তু দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মাত্র
দুজন।
দরজায় নক করতে খুলে গেল প্রায় সাথে সাথে।
লম্বা, রোগা একটি লোক পিট পিট করে তাকাল ওদের দিকে দরজা খুলে দিয়ে। ঢোলা প্যান্ট পরনে। মাথায় হ্যাট।
| বেঁটে লম্বার দিকে তাকাল। বলল, এ আবার কে রে?’ লম্বা সে কথার উত্তর না । দিয়ে বলল, ‘এ রূমে কুয়াশা থাকে?
• ভলিউম ১৪
ইয়েস। আমি তার ফ্রেণ্ড, স্যানন ডি কস্টা। আপনারা কি চান? ‘শুধু দরজাটা খোলা রাখো।’ বেঁটে কথাটা বলেই সিঁড়ির দিকে ফিরে চলল।
সিঁড়ির উপর অপেক্ষা করছিল চারজন লোক। তাদের মধ্যে একজন লোক মুখোশ পরিহিত। বেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সসম্মানে বলল, হুজুর, কুয়াশার রূম পেয়েছি। চলুন। | মুখোশ পরিহিত হুজুরকে সাথে নিয়ে ওরা সবাই এবার সাত নাম্বার রূমের সামনে এসে দাঁড়াল। | ডি কস্টা ইতিমধ্যে তর্ক জুড়ে দিয়েছে। তাকে ধরে রেখেছে লম্বা। চেঁচামেচি শুনে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল কুয়াশা। মোটা চুরুট কুয়াশার মুখে। চোখেমুখে ব্ৰিক্তির চিহ্ন। ভারি গম্ভীর গলায় সে বলে উঠল, কিসের এত হৈ চৈ?’ | মুখোশ পরিহিত রহস্যময় লোকটি বলে উঠল, ‘আপনিই তো কুয়াশী? আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
‘এই রকম সং সেজে এসেছেন কেন? কি লাভ? আপনাকে তো পরিষ্কার চিনতে পারছি আমি।
মুখোশ পরিহিত লোকটি বলল, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন?’ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল কুয়াশা। মুখোশ পরিহিত বলল, যাকগে, আপনার সাথে আমি..’
কোন কথা নেই আপনার সাথে আমার।’
কুয়াশা মুখোশ পরিহিতের অনুচর লম্বার দিকে তাকিয়ে বলল, “এক ঘুসিতে তোদের সব কজনের হাড় ভেঙে দিতে পারি তা জানিস! ছেড়ে দে আমার লোককে।’
লম্বা ঢোক গিলল। ছেড়ে দিল সে ডি কস্টার হাত।
ডি.কস্টা সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করে বলল, “উহাডেরকে সমুচিট শাস্টি ডিয়া ডিব নাকি, মি. কুয়াশা?’
কুয়াশা কিছু বলবার আগেই মুখোশ পরিহিত কুয়াশার উদ্দেশে বলে উঠল, দেখুন, আপনি মারাত্মক ভুল করছেন। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নেই। যা হবার হয়ে গেছে। আসুন মিটমাট করে ফেলি। কোথায় সরিয়েছেন টাকাগুলো? আমরা বরং সমান অর্ধেক ভাগে ভাগ করে নিই আসুন•••।
ভালয় ভালয় পালান,’ ধমকে উঠল কুয়াশা, তা না হলে পস্তাতে হবে, যান।’ কুয়াশার কথা শেষ হতেই ডি.কস্টা দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা। ঠিক আছে, দেখে নেব আমি। আমার নামও•••!’
যথাসময়ে নিজেকে সামলে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল মুখোশ পরিহিত । না, কুয়াশা ৪১
৮৭
কেউ নেই আশপাশে।
এদিকে কুয়াশা ড্রয়িংরূম থেকে বেডরূমে ঢোকার সাথে সাথে পাঁচজন লোক পাঁচ দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল আচমকা ।
| প্রচণ্ড আঘাত লাগল মাথায়। ঘুরে গেল কুয়াশার মাথা।
“কি হলো, মি. কুয়াশা?’ পাশের রূম থেকে শিস দেয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করল ডি কস্টা।
কুয়াশা প্রচণ্ড একটা লাথি চালাল সামনের দিকে। কিন্তু লাগল না লাথি। চোখ দুটো খুলতে পারছে না সে মাথার অসহ্য ব্যথায়। আচমকা নড়ে উঠল তার বিশাল দেহটা আবার।
যেন কেঁপে উঠল প্রকাণ্ড এক বটবৃক্ষ। আবার আঘাত করেছে শত্ৰু মাথায়। জ্ঞান হারাল কুয়াশা মাথায় লোহার রডের ঘা পেয়ে।
ডি কস্টা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে জড়ো করছিল টেবিলে। পিছনে পদশব্দ হতে সে বলল, লোকগুলোকে কেমন জব্দ করে ভেগিয়ে ছিলাম, টাই না?’
পিছন থেকে লোহার রডের ঘা খেয়ে জব্দ হয়ে গেল ডি.কস্টা।
পরদিন সকালে আমড়াগ্রাম থানায় গিয়ে রাসেল জানতে পারল লতিফ সম্পর্কে নানা খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে যে তার অতীত জীবনে কোনরকম কালো দাগ নেই। চিরকালই সে সৎ প্রকৃতির লোক। চোর-ডাকাতদের সাথে তার কোন যোগাযোগ
কোন দিনই ছিল না।
লতিফ চা তৈরি করেছিল বলে পুলিসের নজর তার উপরই পড়েছে সবার আগে।
ইন্সপেক্টরকে রাসেল জিজ্ঞেস করল, মি, হায়দার এবং মি, শরীফ সম্পর্কে কিছু জানা গেছে?
| ‘খোঁজ নেয়া হচ্ছে। বিকেলের মধ্যেই হয়তো খবর পাব।’
মি. সিম্পসন গতকাল ফিরে গেছেন ঢাকায়। আজ সকালেই আবার আসবেন। তিনি।
থানা থেকে বেরিয়ে সোনাডাঙ্গায় ফিরে এল রাসেল।
বাংলা ব্যাঙ্কের সামনে এসে দাঁড়াল রাসেল। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে লতিফ রাইফেল হাতে । তাকে দেখে এগিয়ে গেল রাসেল।
পদশব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল লতিফ। রাসেলকে দেখে মুখ শুকিয়ে গেল তার। জোর করে একটু হেসে সে জানতে চাইল, কেমন আছেন, স্যার?
‘ভালই আছি। আমাকে দেখে খুব ভয় পেয়েছ, না?’ থতমত খেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল লতিফ রাসেলের দিকে।
ভলিউম ১৪
আশ্বাস দিয়ে হাসল, রাসেল। বলল, ভয় নেই, লতিফ। সত্যি কথা বলো, কোন ভয় নেই তোমার।’’
‘স্যার, বিশ্বাস করুন, খোদার কসম বলছি, চায়ের সাথে আমি কিছুই মেশাইনি।’
বেশ। বিশ্বাস করলাম তোমার কথা । কে মেশাতে পারে বলে মনে হয় তোর? কাউকে সন্দেহ করো? ৩
ব্যাপারটার কোন কিছুই বুঝতে পারছি না, স্যার। চা, দুধ, চিনি-সব কিনেছি। আমি ওই যে, ওই দোকানটা থেকে। ওগুলো প্যাকেটের ভিতর ছিল চিনিটুকু ছাড়া। এক মুহূর্তের জন্যেও কাছ ছাড়া করিনি আমি ব্যাগটা। একটা ব্যাগের ভিতরই ছিল ওগুলো।’
লতিফ অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইল রাসেলের দিকে।
রাসেলকে একটু চিন্তিত মনে হলো। একমুহূর্ত পর ও বলল, “ঠিক আছে। এ ব্যাপারে পরে আরও কথা হবে তোমার সাথে। আচ্ছা ব্যাঙ্কের কার কার গাড়ি আছে, লতিফ?’।
‘মি. শরীফের গাড়ি আছে। মি. হায়দারেরও আছে। মি. হায়দার শ্বশুরের কাছ থেকে পেয়েছেন গাড়িটা।’
সোনাডাঙ্গায় কালো গাড়ি আছে কারও?’ | হ্যাঁ স্যার। কালো গাড়িটাই মিসেস হায়দারের।
“ঠিক আছে। তুমি তোমার কাজ করো। আবার দেখা করব একদিন।
পা বাড়াল রাসেল। ব্যাঙ্কের ভিতর থেকে গভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, লতিফ।
চিনতে পারল রাসেল গলাটা। মি. হায়দারের গলা। রাসেলের সাথে কি কি কথা হলো সে সম্পর্কে জানতে চাইবেন হয়তো তিনি।
আঙুল বাড়িয়ে চার পাতা, দুধ এবং চিনির দোকানটা দেখিয়ে দিয়েছিল লতিফ। বাজারের পয়লা দোকান ওটা। আগে শুধু গুঁড়ো চায়ের পাতা বিক্রি হত। এখন দুধ চিনিও পাওয়া যায়।
বাজারে ভিড় খুব কম। বেলা কম হয়নি। দোকানটার সামনে এসে দাঁড়াল রাসেল।
দোকানের ভিতর দুই কি তিনজন মাত্র খরিদ্দার। তাদের মধ্যে একজন মহিলা। মহিলা অপূর্ব সুন্দরী। কিন্তু চোখমুখ ম্লান, বিষণ্ণ।
দোকানের মালিকের সাথে কথা বলছিলেন মহিলা। দোকানের মালিক বুড়ো। একটাও দাঁত নেই তাঁর।
মহিলাকে দোকানের মালিক বলছিলেন, দেশে আর টেকা যাবে না, মিসেস হায়দার। সরকারের কত বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল দেখুন দেখি! একটা দুটো টাকা নয়-সতেরো লাখ, বাপরে! কুয়াশা ৪১
৮৯
মহিলা ম্লান মুখে বললেন, ‘জিনিসগুলো পাঠিয়ে দিতে ভুলবেন না। বিকেলে চা হবে না তাহলে।
ছোকরাটা এলেই পাঠিয়ে দেব, মিসেস হায়দার।
মালিক বুড়ো তাকালেন রাসেলের দিকে। মিসেস হায়দার দোকান ছেড়ে নিচে নামলেন।
| ‘এই যে, ভাবী, কেমন আছেন?’
এক ভদ্রলোক মিসেস হায়দারকে দেখে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল ওরা দুজন দোকানের বাইরে।
মালিক ভদ্রলোক রাসেলকে দেখেই চিনলেন। হাসলেন তিনি। বললেন, কেমন। আছ, বাবা? শুনেছিলাম ঢাকায় চলে গেছ.. {‘।
যাওয়া হলো না।’ রাসেল বলল, ওই মহিলা মি. হায়দারের স্ত্রী, তাই না, কাকা?’
হ্যাঁ, বাবা । ডাকাতির কথা শুনেই বুঝি? রাসেল বলল, হ্যাঁ। শুধু শুনিনি, দেখেছিও। পুলিসকে অনুসন্ধানের কাজে সাহায্যও করছি আমি।
সে তো ভাল কথা!
কেমন যেন কালো হয়ে গেল বুড়োর চোখমুখ। রাসেল বলল, যে-চা খেয়ে মি. শরীফা জ্ঞান হারিয়েছিলেন সেই, চা, চিনি এবং দুধ;এই দোকান থেকেই কিনেছিল লতিফ। কথাটা সত্যি, কাকা?’
‘কিনেছিল…কিন্তু বাবা, আমি বুড়ো মানুষ, সাতকুলে কেউ নেই আমার, তুমি কি মনে করো এই ডাকাতির সাথে আমি জড়িত•••?
‘তা হয়তো নয়,’ বলল রাসেল, হয়তো এখান থেকে কিনে নিয়ে যাবার পর কোন একসময় ওষুধ মেশানো হয়েছিল।’
বুড়ো বললেন, লতিফ ব্যাঙ্কের জন্যে চা, দুধ সবসময় আমার দোকান থেকেই নেয়। কিন্তু চিনি ছাড়া সবই প্যাকেট করা থাকে। চিনিতেও কিছু মেশানো ছিল বলে মনে করি না, বাবা। অন্তত আমার এখানে কিছু মেশানো হয়নি।’
‘মিসেস হায়দার এই দোকানে ছিলেন লতিফ যখন জিনিসগুলো কেনে?’
ছিলেন। কিন্তু মিসেস হায়দার রোজ অমন কয়েকবারই আসেন।’ “ঠিক আছে। চলি, কাকা।
মালিক বুড়োর সাথে কথা বললেও রাসেলের মনোযোগ ছিল মিসেস হায়দারের দিকে। যে ভদ্রলোকের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তিনি সে ভদ্রলোক বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। উল্টো পথে পা বাড়ালেন মিসেস হায়দার। বাজারের ভিতর ঢুকছেন তিনি। খানিকটা দূর থেকে অনুসরণ করল রাসেল মিসেস হায়দারকে।
ভলিউম ১৪
মিনিট দশেক মিসেস হায়দারের পিছন পিছন ঘুরে বেশ একটু অবাকই হলো রাসেল। মহিলা কিনছেন না কিছুই। শুধু এক দোকান থেকে আর এক দোকানে। যাচ্ছেন। জিনিসপত্র দেখছেন, নাড়াচাড়া করছেন, দাম করছেন, কিন্তু না কিনে বেরিয়ে আসছেন। | রীতিমত বিরক্ত বোধ করল রাসেল। কিন্তু মনটাও কেমন খুঁত খুঁত করতে লাগল। আরও সামনে থেকে নজর রাখা দরকার বুঝতে পারল সে।
| মিসেস হায়দারের সাথে এবার রাসেল একটি মনিহারী দোকানে ঢুকল। দোকানদার খবরের কাগজ পড়ছিল। মিসেস হায়দারের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল
সে। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। রাসেল বলল, টুথপেস্ট দিন তো।’
টুথপেস্ট কিনেও দোকান থেকে রে হলো না রাসেল। এটা সেটা দেখতে লাগল। দাম জিজ্ঞেস করতে লাগল। যদিও ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ রয়েছে মিসেস হায়দারের উপর।
| ধরা পড়ে গেলেন মিসেস হায়দার। রাসেলের তীক্ষ্ণ দুই চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেন না তিনি। দোকানের নানা জিনিস নাড়াচাড়া করতে করতে একটা কাঠ পেন্সিল আর একটা বল পয়েন্ট পেন ভরে নিলেন তিনি ভ্যানিটি ব্যাগে এদিক-ওদিক তাকিয়ে।
অবিশ্বাস্য ঘটনা। চুরি করছেন মিসেস হায়দার! দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন ‘ তিনি দ্রুত। খানিক পর রাসেলও বের হলো।
আরও দশ মিনিট কাটল। মিসেস হায়দার এই দশ মিনিটের মধ্যে দুই দোকান থেকে আরও চুরি করলেন একটি লেডিস রুমাল এবং একটি নেইল কাটার।
গোটা বাজারটা একবার চক্কর দিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন মিসেস হায়দার।
দুপুরের খানিক আগে বাড়ি ফিরে এল রাসেল। ওর রূমে মি. সিম্পসন এসে বসে আছেন। ‘
মি. সিম্পসন রাসেলকে দেখে বললেন, ‘আমড়াগ্রাম স্টেশনের আশপাশে দুটো গাড়ির চাকার ছাপ পাওয়া গেছে। একটি ফোক্সওয়াগেনের, আর একটি মরিসের। কালো গাড়িটা পাওয়া গেছে কৈলাশপুরের এক জঙ্গলের ধারে। আমাদের সন্দেহ ওই গাড়ি করেই ডাকাতরা টাকা নিয়ে ভেগেছে।
রাসেল বলল, না। কালো গাড়িটা করে ডাকাতরা টাকা নিয়ে যায়নি। মরিস করেই নিয়ে গেছে। এবং কালো ফোক্সওয়াগেনটা কার জানেন?
‘কার?
বাংলা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মি. হায়দারের স্ত্রীর। মি, সিম্পসন বললেন, ‘বলো কি, রাসেল।
রাসেল বলল, কিন্তু এতে প্রমাণ হয় না যে মি. হায়দার ডাকাতির সাথে সংশ্লিষ্ট।’ কুয়াশা ৪১
“আচ্ছা, রাসেল, ডাকাতি না হয় হলো। কিন্তু লাশ দুটো কাদের? নিজেদের মধ্যে ডাকাতরা মারামারি করে।
| হেসে ফেলল রাসেল। বলল, মনে হয় না । ডাকাতি যারা করেছে তারা টাকা রাখতে পারেনি। সে টাকাও ডাকাতি হয়ে গেছে। ডাকাতদেরকে বোকা বানিয়ে, তাদের দুজন লোককে খুন করে আর কেউ টাকা নিয়ে ভেগেছে, মি, সিম্পসন।’
‘গুড! তোমার ধারণার সাথে আমি একমত। কিন্তু তথ্য প্রমাণ দেখে আমার কি মনে হয় জানো? মি. হায়দার এ ব্যাপারে কতটুকু জড়িত জানা না গেলেও মিসেস হায়দার যে এই রহস্যের অনেক কিছুই জানেন তা পরিষ্কার। ভাবছি মহিলাকে
গ্রফতার করব কিনা।’
উঠে দাঁড়ালেন মি, সিম্পসন। রাসেল বলল, মরিসটার খোঁজ করুন। ডাকাতদের ওপর যে টেক্কা মেরেছে সে : মরিসে করেই এসেছিল। গাড়িটা পাওয়া গেলে অনেকটা কাজ হবে।’
বিকেলের দিকে থানায় একবার এসো না।’ | আসব।’
বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মি, সিম্পসন। দুপুরের পরপরই বাড়ি থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের দিকে রওয়ানা হলো রাসেল।
কুয়াশার জ্ঞান ফিরল পরদিন বেলা বারোটার দিকে। চোখ মেলে কিছু দেখতে না পেয়ে ও বুঝতে পারল জায়গাটা অন্ধকার। এখন কি রাত? উঠে বসার চেষ্টা করল
সে।
সব কথা মনে পড়ে গেল। হাত-পা বেঁধে রেখেছে। কেউ কি আছে এখানে? কাশল কুয়াশা শব্দ করে। কেউ সাড়া দিল না।
হাত-পায়ের বাঁধন পরীক্ষা করে কুয়াশা বুঝল বেশ শক্ত করেই বাধা হয়েছে। চেষ্টা চালাল সে বাধন ঢিল করার।
মাথাটা এখনও ব্যথা করছে। সারা শরীরে কেমন যেন একটা অবসাদ। ইঞ্জেকশন দিয়েছে কেউ টের পেল কুয়াশা। ঘুমিয়ে ছিল সে ওষুধের প্রভাবে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল সে? ডি কস্টা কোথায়? মিসেস হায়দারের কথাও মনে পড়ল সেই সাথে । বেচারীকে হয়তো পুলিস নাজেহাল করছে। তাকে আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যেই কুয়াশা রয়ে গেছে সোনাডাঙ্গায়। তা না হলে চলে যেত সে।
বাধন খুলে ফেলল কুয়াশা দশ মিনিটেই। সাধারণ একটি কামরা। দরজাটা মজবুত। কিন্তু ভাঙা খুবই সহজ।
বাইরে লোক আছে। কিন্তু সময় নষ্ট করল না কুয়াশা। ভেঙে ফেলল সে কাঁধের এক প্রচণ্ড ধাক্কায়।
ভলিউম ১৪
উঠানে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। বারান্দায় বেরিয়ে এল কুয়াশা।
দুজন লোক পাশের দরজা দিয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এল। শব্দ শুনেছে তারা। লাফ দিয়ে লোক দুজনার দিকে এগিয়ে গেল কুয়াশা। দুজনকে দুই ঘুসিতে ভূপাতিত করল কুয়াশা।
সিঁড়িটা দেখা যাচ্ছে। সিঁড়ির দিকে লম্বা পা ফেলল সে।
জঙ্গলের পথ ধরে হন হন করে এগিয়ে চলেছে কুয়াশা । আচমকা রিভলভার হাতে পথ রোধ করে দাঁড়াল মুখোশপরা রহস্যময় সেই লোকটা।
বনভূমি সচকিত করে দিয়ে প্রাণখুলে হেসে উঠল মুখোশধারী। কুয়াশা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
কোথায় পালাবে, বাছাধন?’ মুখোশ পরিহিত বলে উঠল, ‘পালাবার কোন উপায় নেই। এবার বলো কোথায় রেখেছ আমার টাকা?
‘তোমার টাকা?’ হেসে ফেলে বলল কুয়াশা।
“নিশ্চয়ই আমার। ডাকাতি করেছে আমার লোক, আমার নির্দেশে। সে টাকা আমারই। নয় তো•••।’
তোমার লোকের ওপর ডাকাতি করেছি আমি,’ কুয়াশা বলল, সুতরাং সে টাকা আমার। তোমার যুক্তিই মেনে নিচ্ছি আমি-টাকা যার কাছে থাকে তার…।’
খেপে গেল মুখোশধারী।
দাতে দাঁত চাপল সে। কট কট করে শব্দ হলো। বলল, ‘চালাকি করার চেষ্টা কোরো না, কুয়াশা। আমাকে তুমি চেনো না। টাকা দেবে কিনা বলো। তা না হলে মরতে হবে তোমাকে। এক মিনিট সময় দিচ্ছি। উত্তর না পেলে গুলি করব।’
রাসেল এই মাত্র এদিকে এসে পৌঁছেছে। আড়ালে আত্মগোপন করে সব কথাই শুনছে সে।
রাসেলের হাতেও রিভলভার। মুখোশ পরিহিত লোকটার কথা শেষ হতেই দুজনার মধ্যবর্তী একটি গাছের আড়াল থেকে রিভলভার ফেলে দেবার নির্দেশ দিল সে মুখোশধারীকে। কাজ হতেই বেরিয়ে এল ও, দুজনকেই হাতে নাতে ধরেছি।’
কঠোর স্বরে বলল রাসেল, ‘পালাবার চেষ্টা করবেন না কেউ, সাবধান! কুয়াশী পিছিয়ে যাচ্ছে। রাসেল তাকাল মুখোশ পরিহিতের দিকে। পিছিয়ে যাচ্ছে সে-ও। ‘সাবধান!’
কুয়াশার দিকে রিভলভার তাক করে বলল রাসেল। কুয়াশা পঁড়িয়ে পড়ল। ঝট করে তাকাল রাসেল মুখোশ পরিহিতের দিকে। সে তখনও পিছিয়ে যাচ্ছে। গুলি করার জন্যে রিভলভার তুলল রাসেল এবার। বলল, আর এক পা পিছিয়েই কি গুলি কুয়াশা ৪১
৯৩
করব•••!’
দাঁড়িয়ে পড়ল মুখোশধারী। রাসেল তাকাল কুয়াশার দিকে। দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। রাসেল আবার তাকাল মুখোশধারীর দিকে। পিছিয়ে যাচ্ছে সে আবার। রাসেল আবার রিভলভার তাক করল।
পঁড়িয়ে পড়ল মুখোশধারী। কিন্তু এরপর আর রাসেল কুয়াশার দিকে তাকাবার সময় পেল না।
মাত্র পাঁচ হাত দূরে ছিল কুয়াশা। আচমকা প্রচণ্ড এক লাফ মেরে রাসেলের প্রায় ঘাড়ের উপর এসে পড়ল সে। সেই সাথে ভীষণ এক ঘুসি খেল রাসেল কানের নিচে।
ঘুসি খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল রাসেল। তারপর আর ওর মনে নেই কিছু।
জ্ঞান ফেরার পর রাসেল দেখল বিকেল হয়ে গেছে। আশেপাশে কুয়াশা বা মুখোশধারী সেই লোকটিকেউ নেই।
বাড়ির পথ ধরল রাসেল।
বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার খানিক পর মি, হায়দারের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাসেল। কলিংবেল টিপতে চাকর ছেলেটা দরজা খুলে কোন প্রশ্ন না শুনেই
জানিয়ে দিল, সাহেব বাড়ি নেই।
‘তোমার বিবি সাহেব আছেন? আমি তার সাথে দেখা করতে চাই।
ড্রয়িংরুমে বসাল চাকরটা রাসেলকে। সুন্দর, সুসজ্জিত বসার ঘর। সোফা সেট আছে। টি.ভি.ও আছে। খানিক পর মিসেস হায়দার পর্দা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন, কাকে চাই?
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রাসেল। চাকর ছেলেটা মিসেস হায়দারের সাথে ফিরে এসেছে আবার।
মৃদু হেসে রাসেল বলল, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। প্রাইভেট কথা। ধরুন, আপনার বাজারে যাবার কারণ সম্পর্কে আমি কিছু জানতে চাই।’
সভয়ে তাকিয়ে রইলেন মিসেস হায়দার রাসেলের দিকে। দেখতে দেখতে দুই চোখ ভরে উঠল তার পানিতে। কোনমতে তিনি চাকর ছেলেটার উদ্দেশে বললেন, মন্টু, তুই ভিতরে যা।’
মন্টু চলে গেল। রাসেল বলল, বসুন আপনি।
মিসেস হায়দার নড়লেন না। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে তিনি শুধু বললেন, আপনিও তাহলে জানেন!
ভলিউম ১৪
నరి
| L
‘া। ব্যাপারটা কি? ক্লিপটোম্যানিয়া?
ক্লিপটোম্যানিয়া এক প্রকার রোগ। টাকা পয়সার কোন অভাব না থাকলেও অল্প দামের ছোটখাট জিনিস চুরি করা এই রোগের লক্ষণ। এই প্রকৃতির রোগীরা কোনমতেই এই কুকর্ম থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না।
হ্যাঁ,’ বললেন মিসেস হায়দার, দয়া করে আমার স্বামীকে এ ব্যাপারে কিছু জানাবেন না। আমি আপনাকে টাকা যদি চান, দেব।’ | ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মিসেস হায়দার। তার চোখেমুখে ফুটে উঠল মিনতির চিহ্ন।
. রাসেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল মিসেস হায়দারকে, লজ্জায়, অনুশোচনায় মাথা নিচু করে তিনি বললেন, ‘অনেকদিনের বদভ্যাস এটা আমার। চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এই রোগ সারতে দেরি হয়।’
কে চিকিৎসা করছেন আপনার?
ডা. ওমর আবদুল্লা। ঢাকার ধানমণ্ডিতে তার চেম্বার। হপ্তায় একদিন যাই তার কাছে আমি।’
রাসেল বলল, কিন্তু আপনার কাছে এসেছি আমি অন্য কারণে। ব্যাঙ্কের টাকা ডাকাতি করার কাজে আপনার কালো গাড়িটা ব্যবহার করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কি কলবার আছে আপনার।
অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন মিসেস হায়দার। তারপর বলে উঠলেন, ‘আমার গাড়ি! অস! গ্যারেজে আমার গাড়ি পড়ে আছে গত দু’মাস থেকে অচল অবস্থায়!
রাসেল বলল, আপনার কথা ঠিক নয়। গাড়িটা কৈলাসপুরে পেয়েছে পুলিস।
ভুল করছেন আপনি!’ |
মিসেস হায়দার জোর দিয়ে বললেন, “আসুন আপনি আমার সাথে। গ্যারেজেই দেখবেন রয়েছে গাড়িটা।’ |
কিন্তু গ্যারেজ খোলার পর দেখা গেল গাড়ি নেই।
দশ। বৈঠকখানায় ফিরে এসে রাসেল কঠোরস্বরেই বলল, “মিসেস হায়দার, ‘আপনি ভুল করছেন! মিথ্যে কথা বলে।
মিসেস হায়দার বলে উঠলেন, কিন্তু আমি এসব্বে কিছুই জানি না!
আপনি জানেন! | প্রায় ধমকে উঠল রাসেল। ধমক খেয়ে ভেঙে পড়লেন মহিলা। গাল বেয়ে টপ কুয়াশা ৪১
‘৯৫
টপ করে দুই ফোঁটা পানি পড়ল মেঝেতে। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, বেশ, শুনুন। যা জানি বলব। কিন্তু ডাকাতির ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানি না আমি। চুরি করার এই বদ অভ্যাসের জন্যে আমাকে ব্ল্যাকমেল করছে একজন লোক •• |’
কে সে? ‘জানি না। পিয়ন একদিন একটা চিঠি দিয়ে গেল। চিঠির সাথে কয়েকটা ফটো। আমি যখন বিভিন্ন জিনিস চুরি করছি তখনই তোলা হয়েছে ছবিগুলো । চিঠিতে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে আমার স্বামীর কাছে ফটোগুলো পাঠানো হবে বলে হুমকি দেয় পত্রলেখক।
| কোথা থেকে এসেছিল চিঠিটা?’ |
‘ঢাকা থেকে। ঠিকানা ছিল না। টাকা পাঠাবার ঠিকানা ছিল। পোস্ট অফিস বক্স নং এক হাজার পাঁচশো পাঁচ।’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর মিসেস হায়দার বললেন, ‘আজ অবধি বিশ হাজার টাকা গেছে আমার। পাঁচ হাজার করে চারবার দিয়েছি। কিন্তু শেষ যে চিঠিটা পেয়েছিলাম তাতে টাকার দাবি করা হয়নি। সে চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়েছিল ব্যাঙ্ক থেকে কবে, কোন ট্রেনে সতেরো লাখ টাকা ঢাকায় যাবে।’
‘উত্তর দিতে ইতস্তত করছেন মিসেস হায়দার। রাসেল বলল, “মিথ্যে বলবেন ।’
‘দিয়েছিলাম।’
প্রায় কেঁদে ফেললেন মিসেস হায়দার। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘আমার স্বামীর কাছ থেকে কৌশলে সব তথ্য জেনে নিয়েছিলাম। পরে ভেবেছিলাম সব কথা
জানিয়ে দিই স্বামীকে। কিন্তু সাহস পাইনি।’
রাসেল সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবল মাথা নিচু করে। তারপর বলল, আর একটা প্রশ্ন। তথ্যগুলো পত্ৰলেখককে ছাড়া আর কাউকে জানিয়েছিলেন কি আপনি?
ফেরার পথে বাংলা ব্যাঙ্কের সামনে দিয়ে আসার সময় লতিফের সাথে দেখা করল রাসেল।
একথা-সেকথার পর রাসেল জিজ্ঞেস করল, ‘যে ব্যাগটায় চার পাতা, দুধ, চিনি ছিল সেটা একবারও কাছ ছাড়া করোনি তুমি ট্রেনে, লতিফ?’
না…হ্যাঁ, একবার মাত্র, স্যার! আরে, ভুলে গিয়েছিলাম আমি! বাথরূমে ঢুকেছিলাম একবার। ট্রেন তখন ছাড়েনি। বাথরূমে থাকতে থাকতেই ট্রেন ছেড়ে দেয়। আট-দশ মিনিট পর বেরিয়ে আসি আমি বাথরূম থেকে। ব্যাগটা যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানেই ছিল।
৯৬
ভলিউম ১৪
আর সবাই কে কোথায় বসেছিল?
‘মি, শরীফ বসেছিলেন ব্যাগের পাশে। আমি বাথরূম থেকে বেরুবার পর সেখান থেকে উঠে তিনি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ান।’
ঠিক মনে আছে তোমার?
জ্বী, সার।’ | রাসেল কি যেন ভাবল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘মি. শরীফ ব্যাঙ্কের ভিতর
আছেন? ওঁকে গিয়ে বলো আমি দেখা করতে চাই।’
মি. শরীফ ছুটি নিয়েছেন, স্যার। যেদিন ডাকাতি হলো তারপর দিন থেকে তিনি তো ব্যাঙ্কে আসেন না।
| লতিফের কাছ থেকে মি. শরীফের বাড়ি কোন দিকে জেনে নিয়ে পা বাড়াল। রাসেল।
মি, শরীফের বাড়িটা পাড়ার সবচেয়ে বড় বাড়ি। তিনতলা । অনেকগুলো কামরা। পাড়ার শেষ প্রান্তে মি. শরীফের ছাতা তৈরি করার কারখানা আছে একটা। হাতার ব্যবসা করেই পয়সা করেছেন তিনি।
| কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে দিল যুবতী এক চাকরানী। মি. শরীফ অবিবাহিত তা রাসেল জানত। যুবতী চাকরানী দেখে মনে মনে একটু হাসল ও।
• ড্রয়িংরূমে নিয়ে গিয়ে বসাল চাকরানী রাসেলকে। সুন্দর রুচির পরিচয় পাওয়া যয়ি ড্রয়িংরূমের আসবাবপত্রের দিকে তাকালে।
দেয়ালে বড় বড় তৈলচিত্র শোভা পাচ্ছে। ফ্রেমে বাঁধানো কয়েকটা ফটোও বুলিছে। একটি ছবির দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল রাসেল।
অনেক দিনের পুরানো ফুটোটা। মিসেস হায়দার এবং মি. শরীফ পাশাপাশি বসে আছেন একটা ভোলা, মাঠে। ওদের দুজনেরই হাতে ব্যাডমিন্টন র্যাকেট। দুজনই হাসছে।
ফটোটার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল রাসেল। শরীফ কখন রূমে ঢুকেছেন খেয়াল করেনি ও। ‘ | কি দেখছেন?
চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রাসেল। মৃদু হাসল ও। বলল, আপনাকে দু’একটা প্রশ্ন করব, মি. শরীফ।
সিগারেট ধরিয়ে সোফায় বসলেন মি. শরীফ। বললেন, ‘কতদূর এগোলেন কেসটার ব্যাপারে, মি. রাসেল?
‘সামান্য। জানা গেছে ডাকাতিতে যে গাড়ি দুটো ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে একটি গাড়ির মালিক মিসেস হায়দার। মহিলার সাথে তো ভাল পরিচয় আছে। আপনার?’। | সুফিয়া? নিশ্চয়ই। ও আমার ঘনিষ্ট বান্ধবী ছিল স্টুডেন্ট লাইফে। আমরা ৭-কুয়াশা ৪১
৯৭
একসাথে পড়তাম। এমন কি, আপনাকে বলতে আর আপত্তি কি, আমাদের বিয়ে হবার কথাবার্তাও চলছিল। কিন্তু যাকগে সে-সব কথা। আপনি বলছেন ওর গাড়ি ডাকাতিতে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বাস করা কঠিন।’
বিস্ময় ফুটে উঠল মি. শরীফের চোখমুখে।
অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা সত্যি।’ ‘ভারি আশ্চর্য বলতে হয় তাহলে! ডাকাত গুণ্ডা এদের সাথে কিসের সম্পর্ক সুফিয়ার? বিশ্বাস হয় না আজকাল সে এত নিচে নেমে গেছে। অভাব কি তার? হায়দার ভাল টাকা রোজগার করে। চাকরি ছাড়াও পাটের ব্যবসা আছে তার, পার্টনারশিপ বিজনেস…!’
রাসেল বাধা দিয়ে বলল, আচ্ছা, মিসেস হায়দারের সাথে আপনার বিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়নি কেন?’
‘খুব সহজ কারণেই হয়নি, বললেন মি. শরীফ, হায়দারও আমার বন্ধু। আমিই সুফিয়ার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিই। আমার চেয়ে হায়দারকেই সুফিয়ার ভাল লাগে।’
সেদিন সন্ধ্যার পর ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাবার পর লতিফ ফোন করল বিশেষ এক নাম্বারে।
অপ্রপ্রান্ত থেকে ভারি গলা ভেসে এল, “হ্যালো?’ লতিফ বলল, আমি লতিফ বলছি, স্যার। কি ব্যাপার লতিফ?’ লতিফ বলল, “স্যরি•••।’ ইতস্তত করতে লাগল লতিফ।
অপরপ্রান্ত থেকে ভারি কণ্ঠস্বর বলল, কি ব্যাপার, লতিফ? কি হয়েছে? কি বলতে চাও তুমি?
লতিফ ঢোঁক গিলছে ঘন ঘন। কয়েক সেকেণ্ড কেটে গেল।
স্যার।’ বলো।’ লতিফ আবার ঢোক গিলল। তারপর বলে ফেলল, স্যার, আমি জানি। অপরপ্রান্ত থেকে কোন উত্তর এল না তখুনি। কেটে গেল আবার কয়েকটা উত্তেজনাপূর্ণ সেকেণ্ড। লতিফ আবার বলল, আমাকে সামান্য ভাগ দেবেন না, স্যার?
অপরপ্রান্ত থেকে এবার উত্তর ভেসে এল, ‘দেব, লতিফ। কিন্তু সাবধান! কেউ যেন আর না জানে একথা। তুমি বটতলার ফাঁকা রাস্তায় পঁড়িয়ে থাকবে রাত
৯৮
ভলিউম ১৪
বারোটার পর। আমি যাব। কত টাকা চাও, লতিফ।
‘আপনি দয়া করে যা দেবেন স্যার…’
এক লাখ?
তার বেশি হজম করতে পারব না, স্যার, আমি…’’ “ঠিক আছে। রাত বারোটায়। বটতলার ফাঁকা রাস্তায়। কেমন? রিসিভার রেখে কপালের ঘাম মুছল লতিফ জামার আস্তীন দিয়ে।
রাত বারোটা।
জায়গাটার নাম বটতলা। প্রকাণ্ড কয়েকটা বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে। সেজন্যেই জায়গাটার নাম বটতলা। গ্রামের শেষ প্রান্ত এই বটতলা। চারদিকে আর কিছু নেই। ধু-ধু করছে খোলা মাঠ। মাঠের মাঝখান দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে বড় বড় বটগাছ।
চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা গাড়ির দুটো হেড লাইট। দ্রুত এগিয়ে আসছে গাড়িটা মাঠের মাঝখানের ইট বিছানো রাস্তা ধরে। রাস্তার একধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। লোকটা লতিফ।
গাড়িটা এগিয়ে আসছে। হেড লাইটের উজ্জ্বল আলো পড়ছে লতিফের সারা গায়ে। চোখ মেলে তাকাতে পারছে না সে ভাল করে।
এক পা পিছিয়ে এল লতিফ রাস্তা থেকে। গাড়ির স্পীড যেন বেড়ে গেল হঠাৎ। সতর্ক হয়ে উঠল লতিফ। একটা হাত তুলে গাড়িটাকে থামার ইঙ্গিত দিল সে।
এসে পড়েছে গাড়িটা।
হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল লতিফ। গাড়ির চালক যে গাড়ি থামাবে না তা সে হঠাৎ বুঝতে পারুল। দ্রুত পিছিয়ে এল লতিফ কয়েক পা ।
কিন্তু গাড়িটাও লতিফের দিকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটতে শুরু করল লতিফ।
ফঁকা মাঠের মধ্যে চলে এসেছে গাড়িটা। ফাঁকা মাঠের উপর দিয়েই প্রাণপণে ছুটছে লতিফ। কিন্তু যন্ত্রের সাথে দৌড়ে সে পারবে কেন! ..
ক্রমশ দূরত্ব কমে আসছে। এঁকেবেঁকে ছুটছে লতিফ। এঁকেবেঁকেই ছুটে আসছে যন্ত্রদানব লতিফের পিছু
পিছু।
বটগাছগুলোর আড়াল থেকে কখন যেন বেরিয়ে এসেছে দুটো মটর সাইকেল। ঝড়ের বেগে মটর সাইকেল দুটো ছুটছে মটর গাড়িটাকে লক্ষ্য করে।
লতিফ পিছন ফিরে দেখল গাড়িটা আর মাত্র দশ পনেরো হাত পিছনে রয়েছে। আতঙ্কে অবশ হয়ে আসতে চাইছে তার সর্ব শরীর। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে সে। কুয়াশা ৪১
এমন সময় গুলির শব্দ হলো। পরমুহূর্তে ছিটকে পড়ে গেল লতিফ মাঠের মাঝখানে | | ঝড়ের বেগে পাশ দিয়ে ছুটে গেল মটর গাড়িটা। এঁকেবেঁকে যাচ্ছে গাড়িটা। ঝাঁকুনি খাচ্ছে ভীষণ।’
মটর সাইকেল দুটো মটর গাড়ির দশ হাতের মধ্যে চলে এসেছে । সামনের মটর সাইকেল থেকে আবার গুলি করা হলো।
মটর গাড়ির পিছনের চাকায় লাগল গুলি। সশব্দে বাতাস বেরিয়ে আসছে চাকা ফুটো হয়ে যাওয়ায়।
ফাঁকা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা।.. পরমুহূর্তে গাড়িটার দুই পাশে গিয়ে দাঁড়াল দুটি মটর সাইকেল।
দু’জন মটর সাইকেল চালকের মধ্যে একজন রাসেল। রাসেলের গলাই শোনা গেল।
মটর গাড়ির চালককে উদ্দেশ্য করে কঠিন কণ্ঠ রাসেল বলে উঠল, ‘ভাল মানুষের মত বেরিয়ে আসুন, মি. শরীফ।
‘কোন রকম চালাকীর চেষ্টা করবেন না!’ গাড়ির অপর পাশের জানালার ধারে দাঁড়ানো দ্বিতীয় মটর সাইকেলের চালক মি. সিম্পসন বলে উঠলেন। ‘ খুলে গেল গাড়ির দরজা। বেরিয়ে এলেন মি. শরীফ। ম্লান, ঠাণ্ডা গলায় তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি বোকামি করে ধরা পড়ে গেছি। কিন্তু আপনাদের কোন লাভ হবে না আমাকে ধরে। টাকাগুলো আপনারা পাবেন না।’
আধখানা একটি ইটের সাথে টক্কর লেগে হুমড়ি খেয়ে ছিটকে পড়েছিল লতিফ।
হাঁটুতে ব্যথা লেগেছে তার। মি. শরীফের গাড়ি করে তাকে প্রথমেই পৌঁছে দিল রাসেল বাড়িতে।
এগারো মি, সিম্পসন প্রচুর প্রশংসা করলেন রাসেলের।
| কৃতিত্ব প্রকৃতপক্ষে একা রাসেলেই।
মি. শরীফ প্রতিহিংসাবশত ডাকাতির সাথে মিসেস হায়দারকে জড়াতে চেয়েছেন এ সন্দেহ সহজ কারণেই হয়েছিল ওর। ।
মিসেস হায়দারের গাড়ি চুরি করে ডাকাতদেরকে মি. শরীফ সরবরাহ করতে পারেন-এরকম একটা সন্দেহের ভিত্তিতেই রাসেল লতিফকে দিয়ে ফোন করায়।
লতিফের ফোন পেয়ে সব কথা স্বীকার করে ফেলেন মি. শরীফ।
থানায় নিয়ে আসার পর মি. শরীফ আবার সবকথা স্বীকার করলেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল তার সতেরো লাখ টাকা হস্তগত করা। এই কাজে পুলিসের সন্দেহ যাতে মি, হায়দার এবং তার স্ত্রীর প্রতি পড়ে সেজন্যে গাড়িটা চুরি করে ভাড়াটে
১০০
ভলিউম ১৪
ডাকাতদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। মি. শরীফ স্বীকার করলেন-তিনিই গত, বছরখানেক ধরে মিসেস হায়দারকে ব্ল্যাকমেল করে আসছিলেন।
কিন্তু সতেরো লাখ টাকা মি. শরীফ পাননি। ভাড়াটে ডাকাতদের সাথে আধাআধি ভাগে টাকা ভাগ করার কথা ছিল তার। আমড়াগ্রাম স্টেশনে কি ঘটনা ঘটেছে সে সম্পর্কে মি, শরীফ কিছুই জানেন না। যে দুজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে তারা তার ভাড়া করা ছয়জন ডাকাতদের মধ্যে দুজন। বাকি চারজন পালিয়েছে। মি, শরীফের ধারণা তারা চারজনই টাকা নিয়ে ভেগেছে নিজেদের দুই সঙ্গীকে খুন করে।
মি, শরীফকে চালান করে দেয়া হলো ধুমনগর থানায় সেই রাতেই। মি, সিম্পসন বললেন, ‘ওই চারজন ডাকাতই তাহলে টাকা নিয়ে পালিয়েছে।’
দ্বিমত প্রকাশ করল রাসেল, ‘অসম্ভব! বেবী ট্যাক্সির ড্রাইভার যা দেখেছে তা মিথ্যা হতে পারে না। টাকা তারা নিয়ে যায়নি। টাকা নিয়েছে অন্য কেউ। যে দুজন মারা গেছে তারা স্টেশনেই ছিল বা চলন্ত ট্রেন থেকে তারা আমড়াগ্রাম স্টেশনে লাফিয়ে নেমেছিল। অপর তিনজন ছিল ট্রেনেই। তারা ধুমনগরেই নামে। নেমে একটি বেবী ট্যাক্সি করে আসে আমড়াগ্রাম স্টেশনে।
‘ ছয়জন বলছিলে? বাকি একজন?’ | রাসেল বলল, “সে আমড়াগ্রাম স্টেশনের পাশেই ছিল কালো ফোক্সওয়াগন গাড়ি নিয়ে। যাকগে, বেবী ট্যাক্সি করে লোক তিনজন রওনা হবার পাঁচ মিনিট পরই আমি রওনা হই। আমি আসার আগে, এমুন কি লোক তিনজন এসে পৌঁছুবার আগেই এমন একটি ঘটনা ঘটেছে যে ঘটনার কথা আমরা কেউ জানি না। যে লোক। দুজন হলুদ ব্যাগ কুড়িয়ে নিচ্ছিল প্ল্যাটফর্ম থেকে, তাদের দুজনকে কেউ খুন করে টাকা নিয়ে ভেগেছে। এই হলো আমার ধারণা।
কিন্তু কে সেই লোক?’
রাসেল অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘জানি না কে সেই লোক। তবে জানতে আমি পারব।’
| রাসেলের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মি. সিম্পসন বললেন, কুয়াশা। কি সেই লোক হতে পারে না, রাসেল?’
• রাসেলের উত্তর দেয়া হলো না । বেজে উঠল ফোন। ইন্সপেক্টর আজমল খান রিসিভার তুললেন। এক মুহূর্ত পর রিসিভারটা বাড়িয়ে ধরলেন তিনি রাসেলের দিকে, বললেন, “এক মহিলা আপনাকে চাইছেন।’ ‘ কে ফোন করল তাকে?
ভাবতে ভাবতে রিসিভার কানে ঠেকাল রাসেল। বলল, হ্যালো, আমি রাসেল আহমেদ বলছি।’
মিনিট খানেক একমনে চুপচাপ অপর প্রান্তের কথাগুলো শুনল রাসেল। অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে উঠল রাসেলের মুখের চেহারা। ধন্যবাদ বলে রিসিভার
কুয়াশা ৪১
১০১
ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও । বলল, ‘ঢাকায় যেতে হবে, মি. সিম্পসন । গাড়ির ব্যবস্থা করুন। সতেরো লাখ টাকা উদ্ধার করা সম্ব হলেও হতে পারে।
সেদিনই ভোর ছটায় ঢাকায় ফিরল ওরা।
স্নান, আহার, বিশ্রাম করার পর বেলা সাড়ে দশটায় মি. সিম্পসনকে ছাড়াই র সেল ধানমণ্ডিতে এল।
সতেরো নাম্বার রোডের পঁচিশ বাই পঁচিশ নাম্বার বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল রাসেল।
বিরাট গেট বাড়িটার। ঝকঝকে পিতলের অক্ষরে লেখা রয়েছে-ডক্টর ওমর আবদুল্লা।
নামের নিচে লেখা-সাইকিয়াট্রিস্ট।
একজন দারোয়ান গেট খুলে দিয়ে বলল, কাকে চান, হুজুর? ডাক্তার সাহেব তো নেই।’
‘নেই মানে? কখন•••।’
হপ্তায় দু’দিন চেম্বারে বসেন তিনি। সোমবার আর শনিবার। রাসেল জানতে চাইল, ওঁর বাড়ি কোথায়? ‘বাড়ি? বাড়ি তো চিনি না, হুজুর। আমি এই চেম্বার পাহারা দিই।’
পাড়া-প্রতিবেশীদেরকে জিজ্ঞেস করেও ডা. ওমর আবদুল্লার বাড়ির কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।
আগামী পরশু শনিবার। রাসেল চিন্তিত ভাবে ফিরে এল মি, সিম্পসনের অফিসে। | চা পান করতে করতে রাসেল বলল, “মিসেস হায়দারকে একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্যাঙ্কের টাকা ঢাকায় যাবে একথা ব্ল্যাকমেলার পত্রলেখক ছাড়া আর কাউকে তিনি বলেছিলেন কিনা। উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন না। কিন্তু তখন কথাটা মনে কি পড়েনি মহিলার। গতরাতে হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় আমাকে ফোন করেছিলেন। কথাটা তিনি তার মানসিক রোগের চিকিৎসক ডা. ওমর আবদুল্লাকে। বলেছিলেন। ভদ্রলোক সাইকিয়াট্রিস্ট।’
মি. সিম্পসন গম্ভীর মুখে বললেন, ডা. ওমর আবদুল্লা? সাইকিয়াট্রিস্ট?’
গভীরভাবে চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন তিনি। | রাসেল বলল, দুদিন দেরি হয়ে ভালই হলো। মিসেস হায়দারকে কাজে লাগানো যাবে।’
“কিভাবে?’ জানতে চাইলেন মি. সিম্পসন।
বলছি।’ বলতে শুরু করল রাসেল।
শনিবার। রাত আটটা বাজে।
১০২
ভলিউম ১৪
ধানমণ্ডি সতেরো নাম্বার রোডের দুই মাথায় দুটো পুলিস ভ্যান এসে থামল।
পঁচিশ বাই পঁচিশ নাম্বার বাড়ির পেছনের সরু মেথর-প্যাসেজে পজিশন নিল প্রায় পনেরো জন রাইফেলধারী পুলিস। সবশেষে বাড়িটার সামনে একটা জীপ এসে দাঁড়াল।
জীপ থেকে নামলেন মি. সিম্পসন। এবং তার সাথে পাঁচজন পুলিস ইন্সপেক্টর। জীপ থেকে নেমে মি, সিম্পসন হাতঘড়ি দেখলেন। আটটা বেজে দশ। পাঁচজন? ইন্সপেক্টরের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, ‘আধঘণ্টার মধ্যে রাসেল সাহেব ফিরে না। এলে ভিতরে ঢুকব আমরা।
ডা, ওমর আবদুল্লার ওয়েটিং রূমে মাত্র তিনজন মানুষ। একজন মহিলা। দুজন পুরুষ। পুরুষদের মধ্যে একজন রাসেল। অপরজনকে রাসেল চেনে না। মহিলাটিও রাসেলের অপরিচিতা।
মিসেস হায়দার চেম্বারে ঢুকেছেন পনেরো মিনিট আগে। তিনি বের হলেই রাসেলের ডাক পড়বে ভিতরে। কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছে ও আগেই।
আরও তিন মিনিট পর বের হলেন মিসেস হায়দার। রাসেলের সাথে চোখাচোখি হতে মৃদু মাথা নাড়লেন তিনি। তারপর বেরিয়ে গেলেন ওয়েটিং রূম থেকে।
ডা. ওমর আবদুল্লার সেক্রেটারি বসেছিলেন একটি চেয়ারে । তাকালেন তিনি। রাসেলের দিকে। বললেন, এবার আপনি যান, মি, জামান।
ছদ্মনাম ব্যবহার ইচ্ছা করেই করেছে এখানে রাসেল। চেম্বারের দিকে পা বাড়াল রাসেল। খোল দরজার পর সরু প্যাসেজ। প্যাসেজ ধরে সোজা এগিয়ে চলল রাসেল।
প্যাসেজের শেষ মাথায় মোটা সেগুন কাঠের পালিশ করা দরজা। ছোট ছোট প্লাস্টিকের অক্ষরে লেখা-চেম্বার।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই খুলে গেল দরজাটা। ভারি পর্দা সামনে।
পকেটের রিভলভার বাইরে থেকে স্পর্শ করে ভারি পর্দা সরিয়ে গট গট করে এগিয়ে গেল রাসেল।
প্রকাণ্ড এক সেক্রেটারিয়েট টেবিল চেম্বারের এক কোণায়।
টেবিলের উপর কাগজপত্র, নানা রকম ছোটখাট যন্ত্র, অ্যাশট্রে, সিগারেটের প্যাকেট এবং একটি কালো মলাটের খাতা। টেবিলের ওধারে রিভলভিং চেয়ারে বসে রয়েছেন ডা. ওমর আবদুল্লা।
বয়স্ক লোক ডাক্তার। প্রায় ষাটের মত বয়স। গালের মাংসে অনেকগুলো ভাঁজ পড়েছে। দাড়ি আছে, সযত্নে সমান করে কাটা। কাঁচা পাকা এক জোড়া গোঁফ। মুখটা প্রকাণ্ড। কাঁচা পাকা একরাশ চুল মাথায়। চোখে রিমলেস চশমা। দাঁতগুলো মুক্তোর মত ঝকঝক করছে। মৃদু হেসে রাসেলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বসো।’ কুয়াশা ৪১
১০৩
বসল রাসেল একটা চেয়ার টেনে। সূর্ব শরীর টান টান হয়ে আছে ওর। মনটা দমে গেছে নিরাশায়। এ লোক যে কুয়াশা নয় তা সে পরিষ্কার বুঝতে পারল।
‘আপনিই ডা, ওমর?’ প্রশ্নটা ইচ্ছা করেই করল রাসেল। হাসলেন ডাক্তার। বললেন, সন্দেহ হয়?’ | ‘আপনি আমাকে চেনেন?’ সরাসরি প্রশ্ন করল রাসেল।
‘এ প্রশ্ন কেন?’ ডা. ওমর হাসছেন।
‘পরিচয় না থাকলে কেউ “বসুন” না বলে বসো বলে না।’ রাসেল বলল, অবশ্য আপনি বয়স্ক মানুষ। কিন্তু সত্যিই কি আপনি বয়স্ক মানুষ?
এবার উচ্চকণ্ঠে হেসে ফেললেন ডা. ওমর। । | এক মুহূর্ত দেরি হলো না রাসেলের এবার কুয়াশার উচ্চহাসি চিনতে। এরকম হাসি একজনকেই হাসতে দেখেছে রাসেল। কুয়াশা ছাড়া এমন ভারি, ভরাট গলায় আর কে হাসতে পারে?
. কেমন আছো রাসেল?’ জিজ্ঞেস করল ডা, আবদুল্লা ওরফে কুয়াশা। মি. সিম্পসনকে আবার নিয়ে এসেছ কেন সাথে করে?’
রাসেল বাঁকা একটু হাসল। বলল, ভেবেছিলেন চোরের ওপর বাটপারি করে চুপচাপ সতেরো লাখ টাকা হজম করে ফেলবেন। কিন্তু তা সম্ভব নয়, মি. কুয়াশা।’
হাসছে কুয়াশা। হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করল, “সতেরো লাখ টাকা চুরি করি আর বাটপারি করি-প্রমাণ করতে পারবে?
কেন করেছেন এমন জঘন্য কাজ আপনি?
রাগে কেঁপে উঠতে চাইছে রাসেলের সর্বশরীর, ‘শুধু টাকা নয়। আপনি দুজন লোককেও খুন করেছেন।’
কুয়াশা হাসছে। রাসেল, থামতে সে বলে উঠল, ‘কেন করেছি জানতে চাও, তাই না? শোনো। দেশে পাঁচটা হাসপাতাল আছে আমার। বিনা পয়সায় গরীব মানুষদের চিকিৎসা হয় সেখানে। দুটো কলেজ আছে। ছাত্রদের বেতন নেয়া হয় না বললেই চলে। বীরাঙ্গনাদের জন্যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছি তিনটে। গবেষণাগারে পাঁচশো লোককে চাকরি দিতে হয়েছে। পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও সেখানে কাজ করছেন। তাদের থাকা খাওয়ার খরচ আছে। খরচের আরও তালিকা তোমাকে দিতে পারি। এত টাকা আসবে কোত্থেকে? কে আমাকে দেবে? ডাকাতি না করে
আমার উপায় কি?
এক মুহূর্ত থামল কুয়াশা। তারপর আবার বলতে শুরু করল, আমড়াগ্রাম স্টেশনে যে লোক দুজনকে মেরেছি তাদের জন্যে কোন অনুশোচনা নেই আমার। ইচ্ছা করলে ওদেরকে না খুন করেও টাকাগুলো আনতে পারতাম। কিন্তু ওদেরকে।
খুন করার জন্যে আমি গত এক বছর ধরে খুজছিলাম। কেন জানো? দখলদার পাক বাহিনীর আমলে ওরা দুজনই ছিল আলবদর বাহিনীর জল্লাদ। প্রায় পঞ্চাশজন লোককে ওরা ছোরা দিয়ে জবাই করেছে।’
১০৪
ভলিউম ১৪
কিন্তু আইন বলে একটা জিনিস আছে সব দেশেই।’ রাসেল বলল, ‘ওদেরকে আপনি খুন করবার কে? আর ডাকাতি করার স্বপক্ষে যা বলছেন তা স্রেফ আপনার গোয়ার্তুমি ছাড়া আর কিছুই নয়। কে বলেছে হাসপাতাল চালাতে স্কুল-কলেজ চালাতে, গবেষণা করতে?’
কুয়াশা বলল, কেউ বলেনি। আমার ইচ্ছে হয়, তাই চালাই। আইনের কথা ক; তুমি ছেলেমানুষ হলেও নিশ্চয়ই জানো যে সব কিছুই নির্ভর করে শক্তি, বুদ্ধি এবং ইচ্ছার ওপর। আমার শক্তি বৃদ্ধি যে কোন লোকের চেয়ে বেশি। তাই আমার ইচ্ছা মত আমি যা খুশি তাই করে বেড়াই। আইনের প্রতি আমার করুণা হয়। যে
আইন মানুষকে কষ্ট দেয়, অপরাধীকে মুক্তি দেয়।’ | বাধা দিল রাসেল, আপনার নিজস্ব মতামত শুনতে চাই না আমি, মি, কুয়াশা। আমি জানতে চাই সতেরো লাখ টাকা কোথায় রেখেছেন?’
কুয়াশা রাসেলের এই ছেলেমানুষি প্রশ্ন শুনে হেসে উঠল। বলল, টাকা আমার গোপন আস্তানায় আছে। খরচ হয়ে গেছে লাখ পাঁচেক। কিন্তু সে টাকা ফেরত। দিতে পারব না, ভাই।’
| ফেরত আপনি দেবেন না তা জানি,’ বলল রাসেল, জোর করে ফেরত নেব বলেই এসেছি। খুনের আসামী আপনি…।’
* ‘মিথ্যা কথা।’ বলল কুয়াশা, ‘ধোপে টিকবে না তোমাদের অভিযোগ। তোমরা আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ দেখাতে পারবে না।’
একটু থেমে কুয়াশা বলল, যে গাড়ি করে আমি টাকা নিয়ে এসেছি সে গাড়ির প্রতিটি পার্টস ছড়িয়ে পড়েছে আলাদা আলাদা একটা একটা করে সারা বাংলাদেশে। বডিটাও নেই। গলিয়ে ফেলেছি । যে জুতো জোড়া পায়ে ছিল, যে দস্তানা জৈাড়া হাতে ছিল, যে রিভলভারটা দিয়ে গুলি করেছিলাম–সব নষ্ট করে ফেলেছি। এই পৃথিবীতে সে-সবের কোন হদিস পাওয়া যাবে না। কেউ দেখেছে আমাকে টাকা নিতে? গুলি করতে?’ | কথা বলতে বলতে রাসেলের পিছন দিককার উঁচু দেয়ালের দিকে বারবার তাকাচ্ছিল কুয়াশা। হঠাৎ সে বলে উঠল, মি, সিম্পসন দলবল নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকছেন, রাসেল।
পিছন দিকে তাকাল রাসেল। একটি হাত বাকাল পকেটের ভিতর। উঁচু দেয়ালে পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে চারটে টি. ভির পর্দা। বাড়ির চারদিকের ছবি ফুটে উঠেছে টি, ভি,র পর্দাগুলোয়। পকেট থেকে রিভলভার বের করে ফেলেছে রাসেল কুয়াশার অগোচরে।
টেবিলের উপর রিভলভারসহ হাতটা তুলে রাসেল বলল, হ্যাঁ। সব প্রমাণ আপনি নষ্ট করে ফেলেছেন। কিন্তু তবু একটি প্রমাণ এখনও আমাদের হাতে আছে। আপনার টেবিলের উপরই লুকানো আছে একটি টেপরেকর্ড । আপনার সব কথা টেপ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। মাথার উপর হাত তুলুন, মি. কুয়াশী। তা না হলে
কুয়াশী ৪১
১০৫
আমিও গুলি করব।’
দ্রুত টেবিলের উপর চোখ বুলিয়ে নিল কুয়াশা। হাসি মুছে গেছে তার মুখ থেকে।
‘দেরি করছেন আপনি, মি. কুয়াশা। গুলি করব আমি।’ কঠোর কণ্ঠে বলে উঠল রাসেল।
কুয়াশা তাকাল রাসেলের চোখ জোড়ার দিকে। সন্দেহ রইল না কুয়াশার মনে। এ ছেলে হাসতে হাসতে গুলি করতে পারে।
ধীরে ধীরে হাত তুলল কুয়াশা মাথার উপর। টেবিলের ওপর দৃষ্টি পড়ল ওর। কালো মলাটের মোটা খাতাটার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
নড়ছে কুয়াশার ডান পা-টা। টের পাচ্ছে না রাসেল।
টেবিলের পায়ায় একটি বোতাম। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বোমটায় চাপ দিল কুয়াশা।
চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল রাসেল চেয়ারসহ।
ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেছে রাসেল। ও যে চেয়ারটায় বসেছিল সেই চেয়ারটাও নেই। চেয়ারটার জায়গায় দেখা যাচ্ছে গভীর এক গর্ত।
টেবিলের উপরকার কলিংবেলটা টিপে ধরল কুয়াশা। তাকাল টি, ভি, পর্দাগুলোর দিকে।
কয়েক সেকেণ্ড পর চেম্বারে প্রবেশ করল সেক্রেটারি । | ‘গুপ্ত পথে নেমে যাও সাদেক। টেবিলের ওপর থেকে কালো খাতাটা নাও সাথে। জলদি।’
উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। বেরিয়ে গেল সাদেক চেম্বার থেকে দ্বিতীয় দরজা দিয়ে। টেবিলের সামনে বসে পড়ে কুয়াশা ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে ঝটপট খুলে ফেলল কয়েকটা, বোতাম । সেগুলো পকেটে ফেলে বেরিয়ে গেল সে চেম্বার থেকে।
রাসেল যে গর্তের ভিত চেয়ারসহ অদৃশ্য হয়ে গেছে সেখানে আবার শোভা পাচ্ছে চেয়ারটা। কিন্তু এখন সে চেয়ারে রাসেল নেই।
মি. সিম্পসন এক মিনিট পরই প্রবেশ করলেন চেম্বারে। টি, ভি, সেটগুলো তখনও অন করা রয়েছে।
ঘণ্টা দুয়েক তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন মি. সিম্পসন। কিন্তু সতেরো নাম্বার রোডের পঁচিশ বাই পঁচিশ নাম্বার বাড়িটায় একটি প্রাণীরও সন্ধান পাওয়া গেল না।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য ঠেকল মি. সিম্পসনের কাছে। কিন্তু তিনি যে ব্যর্থ হয়েছেন একথা মেনে না নেয়ার আর কোন উপায় রইল ।
Leave a Reply