৪০. অরণ্য রাজ্য ৩ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৪০
প্রথম প্রকাশ : জুলাই, ১৯৭৩
এক
ঘুরে বসেছে রোম। পায়ের বাঁধন খোলার কথা ভুলে গেছে কিশোর ছেলেটা।
ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে রইল সে কয়েক মুহূর্ত। বিপুল বেগে ঘোড়সওয়ার হাহারা ছুটে আসছে।
রাসেল নেই। চোরাবালি তাকে গ্রাস করেছে।
রোম তাকাল ঘাড় সোজা করে সামনের দিকে। আনন্দে চকচক করে উঠল আবার তার চোখ জোড়া’। বনভূমির দিক থেকে বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসছে কয়েকজন ঘোড়সওয়ার। ঘোড়সওয়ারদের চেহারা পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে না। বালির উপর দিয়ে ছুটে আসছে ঘোড়াগুলো। বালি উড়ছে ঘোড়ার পায়ের সাথে সাথে। বালির মেঘ উঠছে যেন নিচ থেকে উপরের দিকে। দেখতে দেখতে ঘোড়সওয়াররা কাছে এসে পড়ল। লাগাম টেনে ধরে ঘোড়াগুলোকে দাঁড় করাল তারা। এবার চিনতে পারল রোম।
ড, কুয়াশা। রোম আনন্দে চিৎকার করে উঠল। কুয়াশার সাথে চারজন জংলী ঘোড়সওয়ারও এসেছে।
ঘোড়া থামার আগেই লাফ দিয়ে নিচে নেমে রোমের পাশে হাঁটু মুড়ে বসল। কুয়াশা। ছোট ছুরিটা তার হাতেই ছিল। সেটা দিয়ে পায়ের বাঁধন কেটে দিয়ে রোমকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল ও।
| জংলীরা ঘোড়া থেকে নামল। কুয়াশা রোমকে তুলে নিয়ে দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল একটি ঘোড়ার পিঠে। বলল, বনভূমির দিকে চলে যাও। খদার, পিছন ফিরে একবারও তাকাবে না।
রোম ঘোড়ার পাজরে খোঁচা মারল পা দিয়ে। দ্রুত ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা। হাহাদের হাত থেকে বাঁচল এ যাত্রা নোম। কিন্তু মৃত্যুর দিকেই ছুটল
সে।–
| ঘোড়ার জিনের সাথে ঝুলন্ত ব্যাগ থেকে দ্রুত কয়েকটা জিনিস বের করল কুয়াশা। লম্বা এক খণ্ড দড়ি বের করে নিজের বাঁ হাতের সাথে বাধল। দড়ির অপর প্রান্তটা দিল একজন জংলীর হাতে।
চোরাবালির দিকে তাকাল কুয়াশা। তার মত অসম সাহসী বীরের বুকটাও
কেঁপে উঠল। দূর থেকে দেখেছে সে রাসেলের সর্বনাশ। চোরাবালি ছেলেটাকে হজম করে ফেলেছে। হারিয়ে গেছে রাসেল। চিরতরে। ওকে কি আর ফিরিয়ে আনা যাবে না এ পৃথিবীর মুক্ত বাতাসে।
| এরকম অবস্থায় রাসেলকে উদ্ধার করা অসম্ভর জেনেও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না কুয়াশা। তার চোখের সামনে এমন অসহায় ভাবে মারা যাবে ছেলেটা? কোন সাহায্যই সে করতে পারবে না?
| যা হবার হয়ে গেছে। যে গেছে তাকে আর ফিরিয়ে নিয়ে আসার উপায় নেই। কিন্তু শেষ চেষ্টা বলে একটা কথা আছে। কুয়াশার কথা হলো আশা কখনও হারাতে নেই। শেষ চেষ্টা সে করবে।
পকেট থেকে ছোট ছোট দুটো স্বআবিষ্কৃত ৰােমা বের করল কুয়াশা। | জংলীরা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। হাহারা কাছাকাছি এসে পড়েছে। জংলীরা হঠাৎ কুয়াশার ধরিয়ে দেয়া দড়ির প্রান্তটা ছেড়ে লাফ দিয়ে যে যার ঘোড়ায় চেপে বসল। তিনটে ঘোড়ায় চারজন উঠে বসেই ঘোড়াগুলোর পেটে লাথি মারতে শুরু করল।
| বজ্রকণ্ঠে গর্জন করে উঠল কুয়াশা, দাঁড়াও! আমি থাকতে তোমাদের কোন ভয় নেই।’
কিন্তু কে কার কথা শোনে। হাহারা আসছে। ওর জংলীদের পরম শত্রু। চিরকাল হাহারা জংলীদেরকে ধরে ধরে আগুনে পুড়িয়ে খেয়েছে। সেই হাহারা শ’য়ে শ’য়ে ছুটে আসছে। ভয় পাবে না তারা? | বোমা দুটো চোরাবালির দুদিকে ছুঁড়ে মারল কুয়াশা। চোখের পলকে ফট ফটু শব্দে বোমা দুটো ফাটল। কান ফাটানো কোন শব্দ নয়। যেন পটকা ফাটল। পরমুহূর্তে দেখা গেল ক্ষুদ্র বোমা দুটো বিস্ফোরিত হওয়ায় কালো ধোঁয়ায় চারদিক ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। প্রতি সেকেণ্ডে ধোয়া গাঢ় হচ্ছে এবং আশেপাশের বিরাট একটা এলাকা নিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে।
ব্যাগ থেকে চশমাসহ দুটো প্লাস্টিকের মুখোশ বের করল কুয়াশা। অনেক কৌশলে ঘোড়ার মুখে পরিয়ে দিল একটা মুখোশ।
গাঢ় কালো ধোঁয়া কুয়াশা, চোরাবালি এবং কুয়াশার ঘোড়াটাকে ঢেকে ফেলেছে।
মুখোশ পরে নিয়ে দড়ির শেষ প্রান্তটা ঘোড়ার গলার সাথে বাধল কুয়াশা। ঘোড়র গায়ে হাত বুলিয়ে একমুহূর্ত আদর করল ও। বলল, ভয় পাসনে, বাবা । আমি থাকতে তোর কোন ভয় নেই। আমাকে না দেখতে পেলেও এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। দড়িটা নাড়ব আমি, তখন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি। খবরদার, চোরাবালির দিকে পা বাড়াসনে। | অবলা জানোয়ার কি বুঝল কে জানে। নিষ্পলক চোখ মেলে সে কেবল
ভলিউম ১৪
তাকিয়ে রইল কুয়াশার দিকে।
কুয়াশা চোরাবালির দিকে তাকাল। কালো ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। কিন্তু বিশেষ একধরনের চশমা পরে থাকায় কুয়াশা সবই দেখতে পাচ্ছে।
রাসেল যেখানে ডুবে গেছে সেখানকার বালি বেশ একটু জায়গা নিয়ে নেমে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে দম বন্ধ করল কুয়াশা। একটা প্রশ্ন জাগল মনে। ফিরে আসতে পারবে তো সে বালির নিচ থেকে?
লাফ দিয়ে পড়ল কুয়াশা চোরাবালিতে। দশ সেকেণ্ডের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল সে বালির নিচে।
ঘোড়া ছুটিয়ে তীরবেগে প্রায় মাইল খানেক চলে আসার পর কুয়াশার নিষেধসত্ত্বেও রোম কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে পিছন ফিরে তাকাল। বহুদূরে দেখা গেল কুয়াশা এবং জংলী চারজনকে। জংলী চারজন ঘোড়ায় উঠে বসেছে দেখে অবাক হলো নোম। পালিয়ে আসছে নাকি ওরাও। কিন্তু ড. কুয়াশা তো ঘোড়ায় চড়েননি। | খানিকপর আবার পিছন ফিরে তাকাল রোম। জংলীরা সত্যি পালিয়ে আসছে। ড. কুয়াশাকে দেখতে না পেয়ে বিমূঢ় হলো সে। কালো ধোঁয়া দেখে কেঁপে উঠল তার বুক। ড. কুয়াশা নিশ্চয়ই বিপদে পড়েছেন।
জংলীদের সর্দারকে সংবাদ দেয়া দরকার। নাকি সে ড, কুয়াশাকে সাহায্য করার জন্যে ফিরে যাবে?
ফিরে যেতে সাহস পেল না রোম। আরও জোরে ছুটতে শুরু করল ও ঘোড়া নিয়ে। বনভূমির কাছাকাছি চলে এসেছে সে ইতিমধ্যে। | বনভূমিতে প্রবেশ করেই রোম ঘোড়া থামাল। দশ পনেরো জন জংলী গাছের উপর বসে তাকিয়ে আছে মরুভূমির দিকে। গাছ থেকে নেমে এল স্বয়ং সর্দার।
রোম সংক্ষেপে সব কথা জানাল। সর্দার জিজ্ঞেস করল কুয়াশার সঙ্গে যে চারজন গ্রামবাসী ছিল তারা ফিরে আসছে কেন? ভয়ে?
রোম জানাল, ঠিক জানি না। তবে ভয়েই হয়তো।
নির্মম হয়ে উঠল সর্দারের মুখের চেহারা। ব্যাপারটা বুঝতে পারল না বোম। হাহাদেরকে সবাই ভয় করে। ভয় পাওয়াটা অপরাধ নয়। সর্দার স্বয়ং আহাদেরকে যমের চেয়েও বেশি ভয় করে।
সর্দার হঠাৎ জানাল, তুমি ছেলে মানুষ, চলে যাও। এখানে থাকা তোমার উচিৎ নয়।’
সর্দারের চোখমুখ দেখে কেন যেন ভয় লাগল রোমের। কথা না বাড়িয়ে গ্রামের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল সে।
গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে পথে দেখা হলো ফোমের সাথে। ঘোড়া থামিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল রোম, দিদি! ড. কুয়াশা আমাকে বাঁচিয়েছেন, দিদি!
কুয়াশা ৪০
মরেই গিয়েছিলাম…!
‘রোম!’
ছুটে আসছে ঝোঁপ-ঝাড় ডিঙিয়ে ফোম। ওর গায়ে এখনও রাসেলের সেই শার্টটা।
| ঘোড়া থেকে নেমে একটা গাছের সাথে লাগাম বাঁধতে বাঁধতে বোম ভারি গলায় বলে উঠল, তোর জন্যে খুব একটা খারাপ খবর আছে, দিদি!
‘রোম!’ ছুটে আসছে ফোম। রোমের সামনে এসে দাঁড়াল ফোম। হাঁপাচ্ছে সে। আশঙ্কায় দুলছে ওর বুক। “কি হয়েছে, নোম? জোনজা কি…’
, জোনজার কিছু হয়নি। কিন্তু তুই জোনজাকে এখন আর আগের মত ভালবাসিস না দিদি, বাসিস? আমার কাছে মিথ্যে বলে লাভ নেই দিদি, আমি সব বুঝতে পারি।’
| আচ্ছা, আচ্ছা-তুই সব বুঝতে পারিস, বুড়ো দাদা আমার! এখন বল কি হয়েছে।’
রাসেল ভাই আমাকে হাহাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে দিদি। হাহারা আমাকে ধরে নিয়ে পালাচ্ছিল। রাসেল ভাই গুলি করে একজন হাহাকে মেরে ফেলে। তারপর•••।’
রোম আর কথা বলে না। আতঙ্ক ফুটে ওঠে ফোমের দু’চোখে, তারপর? চুপ করে গেলি কেন, রোম? রাসেল ভাই চোরাবালিতে ডুবে গেছে।’
রো-ও-ও-ও-ম!’ আর্তনাদ করে উঠল ফোম। রোমকে দু’বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল ও।
বড় বোনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কেঁদে ফেলল রোম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলল, আমি জানি তো বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলি। রাসেল ভাইয়ের মত ছেলে খুব কম হয়। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি প্রাণ দিয়েছেন-দিদি?”
‘ব।’
চল, গ্রামে যাই। গ্রামের মাঝখানে আরা একটা ইউকেলিপটাস গাছের চারা পুঁতব। আজই। সেই গাছের পাশে একটা বড় শ্বেত পাপর রাখব। তাতে লিখব রাসেল ভাইয়ের কথা…।’
গ্রামের দিক থেকে ভেসে এল ড. মূরকোটের চিৎকার। বঁচাও! বাঁচাও! পরমুহূর্তে শোনা গেল জোনজার বিকট গর্জন।
পাথরের মূর্তির মত ফোম এবং রোম দুজন দুজনের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ।
ভলিউম ১৪
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল।
নোম নিজের কাঁধ থেকে ফোমের হাত নামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘বাবা বিপদে পড়েছেন, ফোম!’
দুটল রোম।
ফোম অনুসরণ করল রোমকে। পিছন থেকে সাবধান করে দিচ্ছে ও, খুব সাবধানে, রোম। জোনজার সাথে আমরা পারব না। ওকে ঘাঁটানো উচিত হবে না মোটেই। দূর থেকে যা করার করতে হবে।’
গ্রামে ঢুকে বিমূঢ় হয়ে পড়ল ওরা।
উঠানের মাঝখানে বারো-তেরোটা শূকর রক্তের নদীতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে ডি. কস্টা। শূকরগুলোর ধড় থেকে মাথাগুলো আলাদা করা হয়েছে। জোনজাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ডি কস্টাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তেরোজন মেয়ে। ডি.কস্টার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রোম। পিছু পিছু চঞ্চল পায়ে এল ফোম।
ব্যাপার কি, মি. ডি কস্টা?’ নোম প্রশ্ন করল। বেপার ইজ ভেরী ভেরী গুড।’
ডি.কস্টা সোৎসাহে বলে চলল, আমার কাজ হামি করিটেছিলাম, আই মীন হামি টেরোটা শূয়োরের বাচ্চাকে কোরবানি ডিটে টৈয়ার হইটেছিলাম। ইন দ্য মীন, টাইম মি. দৈট্য আই মীন, মি. জোনজা ছুটিয়া আসিয়া আমাকে পড়া করিল। ছোরা। ফেলিয়ে ডিয়া হামি পলাইলাম, বাট হামার ওয়াইফরা ঢারিয়া ফেলিল। মি. জোনজা হামার ছোরা টুলিয়া নিয়া শূয়ারের বাচ্চাগুলাকে কোরবানি ডিয়া ডিল…।’
এমন সময় ড. মূরকোটের কণ্ঠস্বর ভেসে এল ল্যাবরেটরির ভিতর থেকে, হেলপ মি! ফর গডস্ শেক, হেলপ্ মি•••।’
হুটল রোম।’ ‘ছোকরা মরিটে চলিল…’
ডি.কস্টা চিৎকার করে উঠল। ফোম হঠাৎ বুঝতে পারল জোনজা তার বাবার ল্যাবরেটরির ভিতরই আছে। হুটল ও রোমকে ধরার জন্যে, রোম, দাঁড়া। রোম শোন! রোম যাসনে•••!’
রোম ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল তার বাবার ল্যাবরেটরির ভিতর। ভিতরে ঢুকে রোম স্তম্ভিত হয়ে পড়ল।
জোনার হাতে প্রকাণ্ড একটা লোহার রড। রড দিয়ে ল্যাবরেটরির যাবতীয় যন্ত্রপাতি এমনকি ট্রান্সমিশন যন্ত্রটাও ভেঙে তছনছ করছে। রোমের বাবা ড, মুরকোট আহত অবস্থায় পড়ে আছেন মেঝেতে। মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে তার।
রোম পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল জোনার উপর।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল জোনজা,।
কুয়াশা ৪০
।
আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ফোম দরজার বাইরে থেকে।
জোনজার সারা গায়ে তাজা রক্ত। চোখ দুটো ধিকি ধিকি জ্বলছে তার। সে চোখের দৃষ্টিতে খুনের নেশা।
হাতের রড ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল জোনজা।
জোনজা! জোনজা আমার দিকে তাকাও।’
কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠল ফোম! ছোট ভাইয়ের অমঙ্গল আশঙ্কায় কাঁপছে ও।
“জোনজা তাকাল ফোমের দিকে। তার চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠল অবিশ্বাস, সন্দেহ আর ঘৃণা।
ঘোঁৎ করে শব্দ করল জোনজা সক্রোধে। দাঁতে দাঁত চাপছে সে। ঘুসি পাকাচ্ছে।
রোম এলোপাতাড়ি ঘুসি মেরে চলেছে জোজার বুকে, পেটে। জোনজা অনড়। তেলাপোকার লাথি খেলে পাথরের মূর্তির যেমন কোন ক্ষতি হয় না, তেমনি রোমের ঘুসি খেয়ে জেনজার কোন ক্ষতি হচ্ছে না।
জোনজা চোখ সরিয়ে নিল ফোমের দিক থেকে। রোমের দিকে তাকাল সে। পরমুহূর্তে চারদিক কেঁপে উঠল তার গর্জনে। ।
নোমকে দুহাত দিয়ে ধরল জোনজা।
ড. মূরকোট উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে কি যেন বলছেন। | ল্যাবরেটরির ভিতর ঢুকছে উন্মাদিনীর মত ফোম। চিৎকার করছে সে, জোনজা, রেমিকে ছেড়ে দাও! জোনজা, আমার দিকে তাকাও…!’
রোমের দুটো ঊরু ধরল জোনজা দুহাত দিয়ে। শূন্যে তুলল সে রোমকে। রোমের মাথা মাটির দিকে। হাঁটু দুটো ভাজ হয়ে গেছে। ছটফট করছে রোম।
ফোম পাগলিনীর মত চিৎকার করছে। ভয়ে অনড় হয়ে গেছে যেন ওর হাত পা। ল্যাবরেটরির ভিতর ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়েছে ও। নড়াচড়ার শক্তি নেই শরীরে আর। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ফোম, জোনজা!’
রোমের দুই ঊরু ধরে দু’দিকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জোনজা ।
ফোমের চোখ জোড়া বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর ছেড়ে। বুঝতে পারছে ও জোনজীর ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য। অবিশ্বাসে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে ওর চোখ জোড়া।
অসহ্য ব্যথায় চিৎকার করছে রোম।
জোনার উপর লাফ দিয়ে পড়ল ফোম। জোনার বিশাল কাঁধে দু’হাতের দশটা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে ঝুলে পড়ল ফোম। | রোমের গলা দিয়ে আর শব্দ বের হচ্ছে না। জোনজা দুই উরু ধরে ফেড়ে ফেলছে তাকে।
রোমের শরীরের হাড় মাংস ত্বক দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
১০
ভলিউম ১৪
সাপের মত মোচড় খাচ্ছে রোমের অসহায় দেহটা। কলকল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে রোমের দুই উরুর সংযোগস্থল ছিঁড়ে যাওয়ায়। ক্রমে দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে কচি দেহটা। :
প্রচণ্ড জোরে দু’দিকে আকর্ষণ করল জোনজা রোমের দুই উরু ধরে ।
বিদঘুঁটে শব্দে দু’ভাগ হয়ে গেল রোমের শরীর। জীবন্ত কিশোরের শরীরটা চোখের পলকে ফেড়ে ফেলল জোনজা।
ঝুপ করে মেঝেতে পড়ল ফোম। জ্ঞান হারিয়েছে ও।
দ্বিখণ্ডিত রোমের শরীরটা দরজার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল জোনজা। দরজার বাইরে উঠানে গিয়ে পড়ল দেহের দুটো ভাগ।
এক পা এগিয়ে ফোমের দিকে ঝুঁকে পড়ল জোনজা। দাঁতে দাঁত চাপল সে। পাঁচ-মণ ওজনের একটা পা তুলে দিল হঠাৎ ফোমের বুকে। তারপর কি মনে করে পা-টা নামিয়ে নিল। নুয়ে পড়ে দুহাত দিয়ে প্রল ফোমের দুই উরু। শূন্যে তুলল ফোমের অজ্ঞান দেহটা।
| রোমকে এভাবেই ধরেছিল জোনজা।
অবলা ঘোড়াটা বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখোশ পরিয়ে দেয়ায় অস্বস্তি হবার কথা। কিন্তু ভাষাহীন জানোয়ারটা ভুলেই গেছে বুঝি মুখোশের কথাটা। তাকিয়ে আছে সে চোরাবালির দিকে। যেখানে খানিক আগে কুয়াশা লাফ দিয়ে পড়েছিল।
কুয়াশা চোরাবালির নিচে তলিয়ে গেছে।
ঘোড়াটার চোখে পলক পড়ছে না। কেমন যেন বিস্মিত, স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
চারদিকে গাঢ় ধোয়া।
চোরাবালির উপর পড়ে আছে শুধু লম্বা দড়িটা। দড়ির একটি প্রান্ত ঘোড়াটার গলার সাথে বাঁধা। অপর প্রান্তটি বাধা আছে কুয়াশার বা হাতের কব্জির সাথে।
দড়িটা ধীরে ধীরে আরও নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। বালির গভীরে চলে যাচ্ছে কুয়াশা। সেই সাথে দড়িটাও যাচ্ছে।
হঠাৎ স্থির হলো দড়িটা।
কথা বলতে না জানলেও অবোধ পশুদের বোধশক্তি আছে বৈকি। দড়িটার স্থির হয়ে যাওয়া লক্ষ করল সে। এদিক ওদিক তাকাল চঞ্চল ভাবে। আনন্দের সংবাদটা জানাবার জন্যে একজনকে দরকার। ধোঁয়ার বাইরে, প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে শ’দুয়েক হাহা পাথরের মূর্তির মত বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। হাহারা বা হাহাদের ঘোড়াগুলো দেয়ার ভিতরের দৃশ্য কিছুই দেখতে না পেলেও কুয়াশার ঘোড়াটা কুয়াশী ৪০
১১*
ধোয়ার ভিতর বাইরের, সব দৃশ্যই দেখতে পাচ্ছে বিশেষ চশমা পরে থাকায়। হাহারা এবং হাহাদের ঘোড়াগুলো যে শত্রুপক্ষ তা বুঝতে পারল ঘোড়াটা। আকাশের দিকে মুখ তুলে চিহি চিহি করে দু’বার ডেকে উঠে আনন্দ প্রকাশ করল
সে। বালিতে পা ঠুকল একবার।
চোরাবালির নিচ থেকে কুয়াশা দড়িটা একবার টানছে তারপর আবার ছেড়ে দিচ্ছে। ঘোড়াটা সকৌতুকে তাকিয়ে রইল দড়িটার দিকে। দড়িটা একবার নড়ে
উঠছে, পরক্ষণে স্থির হয়ে যাচ্ছে। * আর একবার ডেকে উঠল ঘেড়াটা। দড়িটার দিকে তাকিয়ে আর একবার পা
কৈল সে বালিতে। এমন সময় গলায় টান পড়ল ঘোড়াটার।
• একপা এগিয়ে গেল ঘোড়াটা। ঢিলে হলো গলার বাঁধন। আবার টান পড়ল গলার বঁধনে।
গম্ভীর হয়ে উঠল ঘোড়াটা। আবার কি সে সামনে পা বাড়াবে? নাকি পিছিয়ে যাবে?
কিভাবে কি করা উচিত কুয়াশা বলে গেলেও অবোধ জানোয়ারটা তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু কাজের সময় সে কুয়াশার নির্দেশ মতই কাজ করল।
প্রথমবার দড়িতে টান পড়ায় সামনে পা বাড়ালেও এবার ঘোড়াটা সামনে পা বাড়িয়ে পিছিয়ে আসতে শুরু করল।
সর্বশক্তি দিয়ে পিছিয়ে আসছে ঘোড়াটা এক পা এক পা করে। চোরাবালির নিচ থেকে উঠে আসছে দড়িটা।
মিনিট খানেক পর কুয়াশার বাঁ হাতটা উঠে এল চোরাবালির নিচ থেকে। ঘোড়াটা আরও জোরে পিছিয়ে আসতে শুরু করল।
ধীরে ধীরে চোরাবালির নিচে থেকে উঠে এল কুয়াশার মাথা, গলা, বুক।
কুয়াশা ডান হাত দিয়ে ধরে রেখেছে রাসেলের কাধ। রাসেলের বগলের ভিতর হাত দিয়ে গলিয়ে নিজের শরীরের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কুয়াশা তাকে।
চোরাবালির উপর উঠে এল ওরা। ঘোড়াটা ডেকে উঠল আবার চিহি রবে। পিছিয়ে গেল সে আরও কয়েক পা।
চোরাবালির সীমানা পেরিয়ে এপারে পৌঁছেই উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। মাথার বালি ঝেড়ে ফেলে রাসেলকে নিয়ে পড়ল সে।
ঘোড়াটা অভিমানে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এতবড় উপকারটা করল। অথচ এতটুকু আদর পেল না সে লোকটার কাছ থেকে।
রাসেলের পালস্ পরীক্ষা করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কুয়াশার চোখ দুটো। বেঁচে আছে এখনও।
কিন্তু শেষ অবধি বাঁচবে তো? রাসেলের নাক-মুখ থেকে বালি বের করতে শুরু করল দ্রুত। নাক-মুখ পরিষ্কার
ভলিউম ১৪
করা শেষ হলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করার পদ্ধতি অনুসরণ করে ঝাড়া পনেরো মিনিট পরিশ্রম করল কুয়াশা গভীর যত্নের সাথে।
ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করল রাসেল।
মুখ তুলে সোজা ঘোড়াটির দিকে তাকাল কুয়াশা। ঘোড়াটা তাকিয়েছিল ছলছল চোখে এতক্ষণ কুয়াশারই দিকে। কুয়াশা তাকাতেই আস্তে আস্তে মুখ ঘুরিয়ে নিল সে।
হেসে উঠল কুয়াশা ঘোড়ার অভিমান হয়েছে বুঝতে পেরেছে সে। ধোয়া সরে যেতে শুরু করেছে।
ঘোড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। আলতোভাবে হাত রাখল মাথায়। নুয়ে পড়ে চুমু খেল কুয়াশা জানোয়ারটার গালে। ফিসফিস করে তার কানে কানে বলল, তুমি আমার পরম বন্ধুর মত কাজ করে। আমাদের দুজনকে নতুন জীবন দান করেছ বন্ধু।
| আদরে গলে গেল ঘোড়াটা। অভিমান ভুলে বালিতে পা ঠুকল সে। ঘাড়টা সরিয়ে আনল কুয়াশার গায়ের কাছে। কুয়াশার গায়ের সাথে গলা ঘষতে ঘষতে ডেকে উঠল চিহি চিহি রবে।
ধোয়ার বাইরে হাহারা বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। গভীর মনোযোগের সাথে সেদিকে তাকিয়ে রইল কুয়াশা। হাহারা তাজ্জব বনে গেছে।
প্রায় শ’দুয়েক হাহা বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। কারও চোখে পলক পড়ছে না। এতটুকু নড়ছে না তারা। জীবন্ত না যেন ওরা। যেন পাথরের মূর্তি বসানো রয়েছে ঘোড়াগুলোর পিঠে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে পাথরের মূর্তিগুলো ধোয়ার দিকে।
রাসেলকে ধীরে ধীরে তুলে ঘোড়র উপর উপুড় করে শুইয়ে দিল কুয়াশা। ঘোড়ার পিঠে না চড়ে ব্যাগ থেকে বের করল, একটা তিন ফুট লম্বা সরু কাঠের টুকরো।
| টুকরোটার এক দিক চ্যান্টা অন্যদিক গোল। চ্যাষ্টা দিকটা তীক্ষ্ণ। টুকরোটার গোল দিকটা ডান হাতের দু’আঙুল দিয়ে ধরে হাহাদের সবচেয়ে লম্বা লোকটার মাথার একটু নিচে আঘাত করার উদ্দেশে ছুঁড়ে মারল সেটা।
বাতাস কেটে তীর বেগে ছুটে গেল কাঠের টুকরোটা। টুকরোটা কিন্তু সরাসরি লোকটার কপালে গিয়ে আঘাত করল না। বালিতে ড্রপ খেল প্রথমে। ড্রপ খেয়ে আবার উপরে উঠল। দশ গজ দূরে গিয়ে আবার ড্রপ খেল সেটা। উপরের দিকে উঠতে শুরু করল আবার।
লম্বা কাঠের টুকরোটী দু’বার ড্রপ খেয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে আঘাত করল সবচেয়ে লম্বা হাহার কপালে। | লোকটা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল উত্তপ্ত বালিতে মুখ থুবড়ে। প্রচণ্ড কুয়াশা ৪০
১৩
আঘাতে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে তার নিঃশব্দে।
লোকটার কপালে কাঠের টুকরোটা আঘাত করেই নিজেকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেতে খেতে সবেগে ফিরে আসতে শুরু করেছে কুয়াশার দিকে। চোখের পলকে সেটা লুফে নিল কুয়াশা শূন্য থেকে।
বুমেরাং।
অস্ট্রেলিয়ার জংলীদের নিজস্ব অস্ত্র এই বুমেরাং। বড় ভয়ঙ্কর অস্ত্র। নিক্ষেপকারীর কাছে ফিরে আসাই বুমেরাংয়ের বৈশিষ্ট্য। এই বুমেরাং দিয়ে ৪০০ ফুট দূরের মানুষ বা জন্তুকে হত্যা করা যায়। সাধারণত বুমেরাং দু’ধরনের হয়। পিছন দিকে না তাকিয়ে কেবল শব্দ এবং অনুমানের উপর নির্ভর করে ছোঁড়া যায় বুমেরাং। পিছন দিকে নিক্ষেপ করলে বুমেরাং ফিরে আসে না।
পর পর পাঁচবার বুমেরাং ছুঁড়ে মারল কুয়াশা। প্রথম বার বুমেরাং ছুঁড়ে একজন হাহাকে হত্যা করার পিছনে বিশেষ কারণ ছিল কুয়াশার। হাহাদেরকে ভয় দেখানোটাই ছিল তার উদ্দেশ্য। এরপর অপর চারজন হাহাকে বুমেরাং হুঁড়ে-সে কেবল আহত করল। ‘
লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে পিছন ফিরে তাকাল, কুয়াশা। হাহারা পিছিয়ে যাচ্ছে। ভীত হয়ে পড়েছে তারা। ঘোড়া দুটিয়ে দিল কুয়াশা।
ধোয়া ভেদ করে প্রায় একশো গজের মত এগিয়ে এসে আর একবার ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল কুয়াশা। না, হাহারা সত্যি ভয় পেয়েছে। অনুসরণ করছে না তারা। অবাক বিস্ময়ে তারা তাকিয়ে আছে শুধু। | মরুভূমি ছেড়ে জঙ্গলে প্রবেশ করার কয়েক মিনিট পরই হঠাৎ লাগাম টেনে ধরে ঘোড়া দাঁড় করাল কুয়াশা।
উঁচু একটা গাছের মাথায় ঝুলছে একটা জংলীর লাশ। জংলীটার মুণ্ডু নেই। শুধু ধড়টা ঝুলছে। টপটপ করে রক্ত পড়ছে নিচে এখনও।
এদিক ওদিক তাকাল কুয়াশা। নির্জন বনভূমি। কোথাও কোন শব্দ নেই। ব্যাপার কি?
চিন্তিত দেখাল কুয়াশাকে। এ কিসের চিহ্ন? কারা এমন বীভৎস কাণ্ড করল?
ঘোড়া ছুটিয়ে দিল আবার কুয়াশা। গ্রামে না ফেরা অবধি এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না।
কিন্তু পঞ্চাশ গজ দূরত্ব অতিক্রম করার আগেই আবার দাঁড় করাতে বাধ্য হলো কুয়াশা ঘোড়া। আরও একটা লাশ ঝুলছে গাছের উপরে। এটারও সেই একই অবস্থা। ধড়টা ঝুলছে শুধু, মুণ্ডু নেই।
গম্ভীর হয়ে উঠল কুয়াশা। লক্ষণ শুভ নয়। কারা এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড করতে পারে? সামনে কি আরও জংলীর লাশ ঝুলছে? ধড়গুলো ঝুলছে, মুণ্ডুগুলো কোথায়?
তবে কি বনভূমির অন্যান্য জংলী জাতিরা আক্রমণ করে এই এলাকার সব ১৪।
ভলিউম ১৪
জংলীকে হত্যা করে গেছে?
| ঘোড়া ছুটিয়ে দিল আবার কুয়াশা। আরও লাশ দেখল ও। এবার কিন্তু থামল
। কেবল ঝুলন্ত ধড়গুলো গুণতে শুরু করল।
মোট চারটে ধড় দেখল কুয়াশা। আরও খানিক দূরে যাবার পর একটি গাছের গোড়ায় পাশাপাশি সাজানো রয়েছে দেখতে পেল চারটে মুণ্ডু। এখানেও দাঁড়াল না কুয়াশা।
আরও পঁচিশ গজ এগোবার পর ঘোড়ার লাগাম.টেনে ধরল ও। | আশপাশের গাছের উপর জংলীরা দাঁড়িয়ে আছে। সতর্ক হয়ে উঠল কুয়াশা। আক্রান্ত হবার সম্ভবনা উড়িয়ে দিতে পারল না সে।
জংলী সর্দারকে দেখতে পেল কুয়াশা। তর তর করে প্রায় কাঠ বিড়ালীর মত দ্রুত নামছে সে একটা গাছ থেকে। _ গাছ থেকে নেমে সর্দার কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়াল। সর্দারের চোখ মুখ ভয়ানক থমথম করছে লক্ষ করল কুয়াশা।
লাশ কেন গাছের ওপর?’ ইঙ্গিতে ইশারায় প্রশ্ন করল কুয়াশা।
সর্দার বলল, আকুলা আঙকা চাকুলা চিপি হিল-খিল। সোনাকা মোনাকা চানকি-মানকি হিন্দু, তান তানাক্কা বায় বানাক্কা ধা ধা ধা। ইকড়ি মিকড়ি।
অনর্গল বলে চলল সর্দার। কুয়াশা সব কথা বুঝতে না পারলেও কয়েকটা– শব্দের অর্থ ও শিখে নিয়েছিল বলে সর্দারের বক্তব্যের সারমর্ম সে ঠিকই বুঝতে পারল। সর্দারের বক্তব্য হলো এই যে কুয়াশা তাদের দেবতা, দেবতা তাদের চারজন জংলীকে নিয়ে হাহাদের এলাকায় গিয়েছিল, কিন্তু জংলীরা দেবতার আদেশ পালন না করে পালিয়ে আসায় সর্দার তাদেরকে আইন অনুযায়ী চরম শাস্তি দিয়েছে।
কুয়াশা রীতিমত বিরক্ত হলো সর্দারের উপর। সর্দারের বক্তব্য শেষ হতে ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে সে জংলীদের ভাষায় জানাল যে এই হত্যাকাণ্ডে সে বিরূপ হয়েছে। এরপর থকে জংলীদের কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে না। অপরাধ যত বড়ই হোক
কেন। মৃত্যুদণ্ড মানবতা বিরোধী, নির্মম। আজ থেকে এর প্রচলন উঠে গেল। সর্দারেরমতামত কি?
কুয়াশার কথা শুনে আলকাতরার মত কালো হয়ে গেল সর্দারের মুখ। বোবা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে।
অবাক হলে কুয়াশা। ভীষণ মানসিক যন্ত্রণা পাচ্ছে সর্দার বুঝতে পারল কুয়াশা। কিন্তু কারণ কি? মৃত্যুদণ্ড ওঠাতে রাজি নয়? সেক্ষেত্রে এত দূশ্চিন্তার কি আছে? তার মতামত গ্রহণ না করলেই পারে।
ঠোঁট জোড়া কঁপছে সর্দারের। কি যেন বলার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারছে । কুয়াশা লক্ষ করল সর্দারের দু’চোখের কোণে পানি। বিস্ময়ের সীমা রইল না
কুয়াশা ৪০
১৫
তার। অবশেষে সর্দার বলল, ইগলু-হিগলু, আমপা, শিগলু-মিগলু রামপী।
কুয়াশার হুকুম বিনা তর্কে মেনে নিল সর্দার। কুয়াশা লক্ষ করল সর্দারের আশেপাশে উঁড়ানো জংলীদের চোখে মুখে ফুটে উঠল আতঙ্ক এবং বিস্ময়। কারণটা বুঝতে পারল না কুয়াশা। জংলীদের সকলকে নিয়ে গ্রামের দিকে ফেরার নির্দেশ দিয়ে ঘোড়া ছোটাল সে।
গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে কুয়াশা ডি কস্টার আর্তচিৎকার শুনতে পেল।
ডি.কস্টাকে খানিকপর দেখতে পেল কুয়াশা। একেবেঁকে ছুটে আসছে সে তীরবেগে। তাকে ধাওয়া করেছে তার তেরোজন স্ত্রী।
কুয়াশাকে দেখে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল যেন ডি.কস্টা। সামনে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, ঠকঠক করে কাঁপছে সে। হাঁটু দুটো পরস্পরের সাথে বাড়ি খাচ্ছে।
‘জোনজা, স্যার।’ হাঁপাতে হাঁপাতে শব্দ দুটো উচ্চারণ করল ডি কস্টা। | কুয়াশা বলল, শান্ত হোন। জোনজা কোথায়? আপনাকে তো তাড়া করে আসহে আপনার স্ত্রীরা।
• ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল ডি.কস্টা। ঢোক গিলল। বলল, “উহারাও স্যার আমার মটো ভয়ে ডরে কাপিটে কাঁপিটে পালাইয়া আসিটেছে জোনার ভয়ে•••!
| কোথায় সে?’ কুয়াশা জিজ্ঞেস করল।
‘প্রফেসর মূরকোটের ল্যাবরেটরিটে স্যার। রোমকে মারিয়া ফেলিটেছে ডেকিয়া আসিলাম…।’
ঘোড়া ছুটিয়ে দিল কুয়াশা।
গ্রামে ঢুকে একজন জংলীকেও আশপাশে দেখতে পেল না কুয়াশা। উঠানে রক্তাক্ত মৃত শূকরগুলো চোখে পড়ল তার।
ঘোড়া থামাল কুয়াশা মঁসিয়ে মূরকোটের ঘরের পাশে। ঘটার দরজার সামনে একটি দ্বিখণ্ডিত দেহ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দরজার দিকে ছুটল পরমুহূর্তে।
দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কুয়াশা দেখল ফেমিকে শূন্যে তুলে ধরেছে জোনজা, ফোমের মাথাটা মাটির দিকে, জ্ঞান নেই।
জোনজা! বজ্ৰগভীর কণ্ঠে গর্জে উঠল কুয়াশা।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল জোনজা। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে কুয়াশা।
‘ফোমকে ছেড়ে দাও! গম্ভীর গলায় আদেশ কর কুয়াশা।
ঘাড় ফিরিয়ে নিল জানজা। পরমুহূর্তে গর্জে উঠল সে। ঘুরে উঁড়াল কুয়াশার মুখোমুখি। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ক্রোধ বর্ষণ করল সে কুয়াশার উপর।
১৬
ভলিউম ১৪
কুয়াশা স্থির, অচঞ্চল গলায় আবার বলে উঠল, ‘ভাল চাও তত ফোমকে নামিয়ে রাখো মেঝেতে।
হঠাৎ ফোমকে ছুঁড়ে দিল জোনজা কুয়াশার দিকে। তৈরি না থাকলেও বিদ্যৎবেগে দুহাত তুলে শূন্য থেকেই ফোমকে লুফে নিল কুয়াশা। সেই মুহূর্তে কুয়াশাকে লক্ষ্য করে লাফ দিল জোনজা। | লাফ দিয়ে চোখের পলকে একপাশে সরে গেল কুয়াশা। জোনজা তাল সামলাবার জন্যে কয়েক পা এগিয়ে গেল। ল্যাবরেটরির ভিতর থেকে উঠানে বেরিয়ে এসেছে সে।
আস্তে করে ফোমের অচেতন দেহটা নামিয়ে দিল কুয়াশা মাটিতে। জোনজা ঘুরে দাঁড়িয়ে দমাদম ঘুসি মারছে নিজের বুকে।
কুয়াশা সোজা হয়ে দাঁড়াল। বিকট গর্জন করছে ড্রোনজা দুর্বোধ্য স্বরে। এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে সে।
কুয়াশা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। জোনার লাফ দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে
সে।
| তিন হাতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল জেনিজা। লাফ দেবার কোন লক্ষণ নেই তার মধ্যে। গর্জন করছে, দাতে দাঁত পিষছে, বুকে সশব্দে ঘুসি মারছে। সে চাইছে কুয়াশা তাকে আক্রমণ করুক।
হঠাৎ জোনজীর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল কুয়াশার ঘোড়ার উপর শায়িত রাসেলের উপর। গর্জে উঠল সে। পা বাড়াল সেদিকে। ।
লাফ দিয়ে পড়ল কুয়াশা জোনজার সামনে। বাধা পেয়ে সক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল জোনজা।
| কুয়াশার মাথা লক্ষ্য করে ঘুসি চালাল জোনজা। সরে গেল কুয়াশা। সরে যেতে যেতেই ডান হাত দিয়ে জোনার কপালের বা পারে রগে প্রচণ্ড একটা ঘুসি বসিয়ে দিল।
কুয়াশার ঘুসি খেয়ে বহু শক্তিশালী মানুষ তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে এমন ঘটনা ঘটেছে অতীতে অনেক। কিন্তু জোজার চোখ মুখ ব্যথায় কুঁচকে উঠলেও তেমন বিশেষ কোন ক্ষতি তার হয়েছে বলে মনে হলো না। ঘুসি খেয়ে আবার সে লাফ দিল কুয়াশাকে লক্ষ্য করে। কুয়াশা জোনজার হাত হতে মুক্ত থেকে তার বগলের নিচে একটি নার্ভে প্রচণ্ড আঘাত হানল ডান হাতের আঙুলগুলো পাশাপাশি একত্রিত করে।
জেনজার বাঁ হাতের বগলের নিচে অবস্থিত নার্ভটা অকেজো হয়ে গেল আঘাত লাগার ফলে। গোটা বাহুটাই অসাড় হয়ে গেল জোনজার।
তৃতীয়বার লাফ দেবার কোন লক্ষণ জোনজার মধ্যে দেখা গেল না। ভয় ফুটে উঠেছে তার দু চোখে। বাঁ হাতটার দিকে তাকাচ্ছে ঘনঘন।
২-কুয়াশা ৪০
কুয়াশা বিপুল বিক্রমে জোনজার ডান উরুর সংযোগ স্থলে সর্বশক্তি দিয়ে একটা লাথি মারল।
ঝাঁকিয়ে উঠল জোনজা দুর্বোধ্য স্বরে। কিন্তু পরমুহূর্তে মরিয়া হয়ে লাফ দিল সে।
কুয়াশা জেনজার এই আক্রমণের জন্যে তৈরি ছিল না। জৈানজা ডান হাত দিয়ে কুয়াশার দেহটা জড়িয়ে ধরে টেনে আনল নিজের কাছে। গায়ের সাথে কুয়াশাকে চেপে ধরল সে।
| কুয়াশাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবার সাথে সাথে নিজেও পড়ে গেল জোনজা।
কুয়াশা পড়ল আগে। তার উপর পড়ল জোনজা।
একটি মাত্র হাত জোনার কাজের। সেই হাত দিয়েই সে কুয়াশার গলা চেপে ধরল।
গলার উপর কেউ পাঁচমণ ওজনের পাথর চাপিয়ে দিয়েছে বলে মনে হলো কুয়াশার । দুহাত দিয়ে জোনার হাতটা সরাবার চেষ্টা করল সে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে কুয়াশার। অবশ হয়ে আসছে সর্বশরীর। গোটা দেহের উপর জোনজী নিজের দেহের অস্বাভাবিক ভার চাপিয়ে রেখেছে।
জোনজীর হাতের কড়ে আঙুলের নিচে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে সবেগে ধাক্কা দিয়ে সেটাকে ভেঙে দেবার চেষ্টা করল কুয়াশা। কিন্তু আঙুল ভাঙলেও জোনার মধ্যে কোন দুর্বলতা প্রকাশ পেল না।
এবার গলা চেপে ধরল কুয়াশা জোনজার।
দুর্বল হয়ে পড়েছে কুয়াশা। জোনার হাতটা সাড়াশীর মত এঁটে বসেছে গলার চারপাশে। এতটুকু ঢিলে হচ্ছে না। দম ফেলতে পারছে না কুয়াশা।
দুর্বল হাতে ধরেছে জেনজার গলাটা কুয়াশা। অবশ হয়ে আসছে। বিস্ফারিত হয়ে গেছে চোখ জোড়া। একটু একটু করে শক্তি বাড়িয়ে জোনজার গলার চারদিকে চাপ দিচ্ছে সে।
কিন্তু কোনই ফল হচ্ছে না। জোনজীর একটা ব্যাতেই অমানুষিক শক্তি। বড় ভয়ঙ্করভাবে ধরেছে সে কুয়াশার গলা। হাড়ানো অসম্ভব। এভাবে বেশিক্ষণ চলতে পারে না। চোখে সর্ষেফুল দেখছে কুয়াশা। দম ফেলতে পারছে না। মারা যাচ্ছে
সে।
দাঁতে দাঁত চেপে সর্বশক্তি একত্রিত করে ড্রোনজার গলার চারদিকে চাপ দিল কুয়াশা দুহাতের দৃশটা আঙুল দিয়ে।
একটু ঢিল হলো জোনজার হাত।
আশায় ডরে উঠল কুয়াশার বুক। মৃত্যুকে তাহলে জয় করা যাবে! আরও শক্তি দরকার। আরও জোরে চেপে ধরা দরকার।
ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করছে কুয়াশা। ফোঁস ফোঁস শব্দে নিঃশ্বাস ফেলছে সে
. ভলিউম ১৪.
১৮
এখন। জোনজীর হাত ঢিলে হয়ে গেছে গলার চারপাশে।
টেনিস বলের মত বড় বড় চোখ দুটো জোনজার গর্ত থেকে ঠিকরে বেরিয়ে পড়বার উপক্রম হয়েছে। এই সুযোগ। হঠাৎ প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিল কুয়াশা নিচ থেকে।
কুয়াশার ধাক্কায় জোনজা মাটিতে পড়ে গেল। এক মুহূর্ত দেরি না করে কুয়াশা জোনজার বুকে চেপে বসল।
নতুন শক্তিতে চেপে ধরল কুয়াশা জোনআর গলা। পা দুটো ছুঁড়ছে প্রকাণ্ড দৈত্যটা এলোপাতাড়ি ভাবে। সচেতন ভাবে নয় ঠিক, যন্ত্রণা এবং আতঙ্কে মরিয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে প্রাণপণ শক্তিতে চাপ দিয়ে চলেছে কুয়াশা তার চারগুণ বড় শত্রুর গলায়।
ধীরে ধীরে স্থির হয়ে আসছে জোন্জার দেহ। পা দুটো ছুঁড়ছে না সে আর। নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না সে এখন। পা দুটো নড়ছে কিন্তু আস্তে আস্তে।
দেখতে দেখতে নিঃসাড় হয়ে গেল জোনার দেহ। আরও মিনিট খানেক পর ছেড়ে দিল কুয়াশা জোনজার গলা।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। হাঁপরের মত উঠছে আর নামছে আলখাল্লায় ঢাকা তার বিশাল বুকটা।
তিন।
বেলা দশটা থেকে একটা অবধি দম ফেলবার ফুরসত পেল না কুয়াশা। দুজন রোগী এবং একজন রোগীনিকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাবার কথা যে-কোন মানুষের। তারমধ্যে রাসেলের মত রোগী থাকলে তো কথাই নেই, ডাক্তার পালাবার পথ। খুঁজত।
| কুয়াশা কিন্তু স্থির মস্তিষ্কে তিনজনকে সামলাতে লাগল। রাসেলের অবস্থা । সবচেয়ে খারাপ। বাঁচে কি না বাঁচে বলা দুষ্কর। কোরামিন দিয়েছে কুয়াশা ড. মূরকোটকে। জ্ঞান ফিরেছে বৃদ্ধের কিন্তু ঘুমাচ্ছেন। ফোমের জ্ঞান ফিরলেও খানিক পর পরই আবার জ্ঞান হারাচ্ছে সে। জ্ঞান ফিরলে চোখ মেলে তাকায় সে, এদিক ওদিক রোমকে খোঁজে তারপর হঠাৎ রোমের নাম ধরে চিৎকার করেই জ্ঞান হারায়। | অক্সিজেন দিচ্ছে কুয়াশা রাসেলকে। কুয়াশার অধিকাংশ সময় এবং মনোযোগ রাসেল একাই নিয়েছে।
বেলা একটার সময় সফল হলো কুয়শার অক্লান্ত পরিশ্রম। চোখ মেলে তাকাল রাসেল ।
সাফল্যের অনির্বচনীয় হাসি ফুটে উঠল কুয়াশার মুখে।
রাসেল তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। ওর চোখের দৃষ্টির মর্ম বোঝা যাচ্ছে কুয়াশা ৪০
। | নিস্তব্ধতার মধ্যে কেটে গেল কয়েক মিনিট। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করল রাসেল। কয়েক মুহূর্ত পরে আবার চোখ মেলল ও। কুয়াশার চোখে চোখ রেখে
হঠাৎ হাসল। বলল, “এটা স্বর্গ না নরক?’
গভীর মমতায় রাসেলের কপালে একটা হাত রাখল কুয়াশা আলতোভাবে। বলল, তোমার কি মনে হচ্ছে, রাসেল?’।
সেই পরিচিত হাসি ফুটল রাসেলের ঠোঁটে। হাসিটা একটু বাঁকা, মৃদু ব্যঙ্গাত্মক। ও বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি মহৎ পুরুষ, আপনার স্বর্গে যাবারই কথা। আমি অধম, অর্বাচীন, আমার তো নরকেই স্থান পাবার কথা। কিন্তু এযে দেখছি দুজনেই এক জায়গায় রয়েছি। তবে কি এটা স্বর্গ বা নরক কোনটাই
?’
না, কোনটাই নয়। এটা পৃথিবী। কুয়াশার কথা শেষ হতে অবিশ্বাস ফুটে উঠল রাসেলের চেহারায়।
কিন্তু তা কি করে সম্ব? আমি কি চোরাবালির নিচে প্রবেশ করিনি? সেটা কি দুঃস্বপ্ন ছিল বলতে চান? না, দুঃস্বপ্ন হতে পারে না। এখন যা দেখছি সেটাকে স্বপ্ন বলে স্বীকার করতে রাজি আছি আমি•• |” | প্রাণ খুলে হেসে উঠল কুয়াশা দরাজ গলায় হাঃ হাঃ করে। রাসেল কুয়াশার অজ্ঞাতে নিজের উরুতে চিমটি কাটল।
‘উহ্!’ ব্যথায় শব্দ করে উঠল রাসেল। “কি হলো?’ হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।
না স্বপ্ন দেখছি না। চোরাবালিতে ডুবে যাওয়াটা তাহলে দুঃস্বপ্ন ছিল?’
, কোনটাই স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন নয়। চোরাবালিতে ঠিকই ডুবে গিয়েছিলে তুমি, রাসেল। তবে তোমাকে তুলে এনেছি আমি বালির নিচ থেকে। সে ব্যাপারে পরে
সব শুনো। কেমন বোধ করছ এখন?’
‘ভাল। পরে না, এখুনি আপনি সব বলুন আমাকে।’ রাসেল উঠে বসার চেষ্টা করল বিছানার উপর।
দু’হাত দিয়ে আলতোভাবে ধরল রাসেলকে কুয়াশা। বলল, উঠো না, উঠো । তুমি অসুস্থ এখনও, শুয়ে থাকো! সবকথা তোমার পরে শুনলেও চলবে, রাসেল। এখন তোমাকে জরুরী কয়েকটা কথা বলে রাখি।
বেশ বলুন। রাসেল শান্ত ভাবে শুয়েই রইল।
আমি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে হাহাদের এলাকায় যাচ্ছি, রাসেল। ওরা খেপে গেছে আমাদের ওপর। আজ রাতেই ওরা আক্রমণ করবে এই গ্রাম।’
কে বলল?
ভলিউম ১৪
২০.
কেউ বলেনি। এটা আমার ধারণা। ওরা যদি আক্রমণ করে তাহলে কেউ প্রাণে বাঁচবে না। সংখ্যায় ওরা কয়েক হাজার। বনভূমির জংলীদের চেয়ে অনেক
বেশি হিংস্র, অনেক বেশি দুঃসাহসী। তার ওপর ওদের সাথে আছে ডেভিড।
| বনভূমির জংলীদের সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় পনেরো হাজার।’
‘তা ঠিক। কিন্তু পনেরো হাজারকে একত্রিত করা সম্ভর নয়। বনভূমির বিভিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদা ভাবে নিজস্ব গ্রামে বাস করে এরা।
‘চেষ্টা করলে হাহাদের বিরুদ্ধে এই পনেরো হাজারকে একত্রিত করা কঠিন কিছুই নয়। আপনি সে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।’
| কিন্তু তাতে সময় লাগবে।’ | রাসেল স্বীকার করল, তা লাগবে।
কুয়াশা বলল, “অত সময় আমাদের হাতে নেই। আজ রাতে যদি হাহারা এই | গ্রাম আক্রমণ করে তাহলে ডেভিডও হয়তো সঙ্গে থাকবে। এবং আমার লেসার গানের কথা আমি ভুলিনি, রাসেল। ডেভিডের মত শয়তান লোকের হাতে দুই মারাত্মক অস্ত্র থাকার তাৎপর্য যে কি পরিমাণ মারাত্মক তা একমাত্র আমিই বুঝি। হাহাদের এলাকায় যাবার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো লেসার গানটা উদ্ধার করা।’
কিন্তু আপনি একা কি করতে পারবেন ওদের? শেষ পর্যন্ত প্রাণটা হারাবেন না তো বিদেশ বিভূঁইয়ে?’ ‘
| রাসেলের কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল কুয়াশা। হাসি থামতে ও বলল, ‘নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা আমার আছে, রাসেল। যে-কোন বিপদেই
পড়ি না কেন।
তাহলে আর কি, যান। কেউ বাধা দিচ্ছে না আপনাকে।
আবারও হেসে ফেলল কুয়াশা। বলল, তোমাকে সঙ্গে নিয়েই যেতাম আমি, রাসেল। যেতে তো আজ হোক কাল হোক হবেই। গ্রেট ভিক্টোরিয়া মরুভূমির নির্দিষ্ট একটা এলাকার বালিতে ইউরেনিয়াম আছে। সে বালি আরও ভালভাবে পরীক্ষা করতে হবে। সেখানে যেতে হলে হাহাদের এলাকা পেরিয়েই যেতে হবে। ড. মূরকোটের আবিষ্কৃত যান্ত্রিক ঘোড়াটা যদি থাকত তবে হাহাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যেত। কিন্তু সেটাও তো ডেভিডের হাতে। আমি কি ভেবেছি
জানো, রাসেল?”
কি?’
‘আমি হাহাদের পার্বত্য এলাকায় যাব পিছন দিক দিয়ে। প্রায় পঞ্চাশ মাইল ঘোড়ার পিঠে চড়ে পশ্চিম দিকে যাবার পর উত্তর দিকে রওনা হব আমি। আরও পঞ্চাশ মাইলের মত অনুমান পার্বত্য এলাকার পর হাহাদের পার্বত্য এলাকা পড়বে। সঙ্গে দেড় শশা শূকর নিয়ে যাব ভাবছি।
কেন? কুয়াশা ৪০
ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল রাসেল।
রহস্যময় হাসি ফুটল কুয়াশার ঠোঁটে। বলল, “হাহাদেরকে ভেট দেব। পুড়িয়ে খাবে ওরা।’
গম্ভীর হয়ে উঠল রাসেল। বলল, হেঁয়ালি আমি পছন্দ করি না। কিন্তু, আমি হেঁয়ালি করছি না। সত্যি সত্যি শূকরগুলো হাহারা পুড়িয়ে
খাবে।’
রাসেল কোন কথা বলল না।
কুয়াশা নিঃশব্দে আর একবার পরীক্ষা করল রাসেলকে। পরীক্ষা শেষ করে সে বলল, দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। তুমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে। চলি, কেমন?
‘এখুনি রওনা হবেন নাকি?’ ‘হা। দেরি করতে চাই না। হাতে সময় খুব কম।
বেশ, যান।’ বিদায়। ‘বিদায়।
দরজার কাছে গিয়ে রাসেলের গলা শুনে থমকে দাঁড়াল কুয়াশা। অদ্ভুত এক হাসি ফুটল তার ঠোঁটে।
. রাসেল পিছন থেকে বলল, আবার দেখা হবে।’ * ঘাড় ফিরিয়ে রাসেলের দিকে তাকাল কুয়াশা। হাসল। বলল, আবার দেখা হবে।’
বেরিয়ে গেল কুয়াশা।
রাসেলের ঘর থেকে বেরিয়ে ফোমের ঘরে এসে ঢুকল কুয়াশা। ফোমকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে সে। ফোমকে পরীক্ষা করে ড. মূরকোটের বিছানার পাশে
এসে দাঁড়াল।
রক্ত দেয়া হয়েছে ড. মূরকোটকে। কুয়াশা নিজেই দিয়েছে রক্ত। ঘুমাচ্ছেন বৃদ্ধ। অবশেষে উঠানে বেরিয়ে এল কুয়াশা।
সর্দারের কি যেন হয়েছে। হাসি নেই তার মুখে। কথা বলছে না সে বিশেষ কারও সাথে। তার চোখের দৃষ্টি কেমন যেন উদাস এবং ভাবলেশহীন।
কুয়াশা বেরিয়ে আসতেই সামনে এসে উঁড়াল সর্দার। সর্দারের পিছনে গ্রামের প্রায় সব জংলীই জমায়েত হয়েছে। | উঠানের মাঝখানে ডি.কস্টার তেরোজন স্ত্রী গোল হয়ে ঘিরে বসেছে। ডি.কস্টাকে। ডি.কস্টার হাড়ভাঙা পরিশ্রম যাচ্ছে আজ। চারটে শূকরের চামড়া ছাড়িয়েছে সে মাত্র । এখনও নয়টা বাকি। কোনদিকে মন নেই তার। বিড় বিড় করে কার উদ্দেশে যেন সে ইংরেজি বাংলা এবং উর্দুতে মেশানো অদ্ভুত এক ভাষায়
ভলিউম ১৪।
গালাগালি করছে ।
কুয়াশা সর্দারকে জানাল ড. মূরকোট, ফোম এবং রাসেলের অবস্থা এখন ভাল। বিপদের কোন সম্ভাবনা নেই।
• সর্দারের কাছে একশো শূকর চাইল কুয়াশা। দিতে রাজি হলো সর্দার বিনা বাক্যব্যয়ে। কিন্তু কারণ জিজ্ঞেস করল। কুয়াশা বলল, আমি হাহাদের এলাকায় যাব। শূকরগুলো দেব ওদেরকে খেতে। | একশো শূকরের গলায় দড়ি বেঁধে আনা হলো। বাঁধন পরীক্ষা করল কুয়াশা । বিরাট লম্বা এক খণ্ড দড়ি দিয়ে কৌশলে বাধা হয়েছে শূকরগুলোকে। দড়ির একটি প্রান্ত রইল কুয়াশার হাতে। | ঘোড়ায় চড়ল কুয়াশা তার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং ক্ষুদ্র নানারকম অস্ত্রশস্ত্রে ভর্তি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে।
সর্দার অদ্ভুত এক কাণ্ড করল। নিজের হাতের কড়ে আঙুল কেটে কুয়াশার কপালে এক ফোঁটা রক্ত দিয়ে টিপ পরিয়ে দিল সে।
চমকে উঠল কুয়াশা। চিরকালের জন্যে বিদায় নেবার বা দেবার সময় জংলীরা নিজের কড়ে আঙুল কেটে টিপ পরিয়ে দেয়। সর্দার কেন যে তাকে চিরকালের জন্যে বিদায় দিল বা নিল বুঝতে পারল না কুয়াশা। হাহাদের এলাকায় সে যাবে শুনে সর্দার কি ধরে নিয়েছে প্রাণ নিয়ে আর ফিরে আসতে পারবে না?
এ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন না করে কুয়াশা সর্দারকে বলল, আমি চললাম। আমার অনুপস্থিতিতে কোন সমস্যা দেখা দিলে আমার ছোট ভাই রাসেলের সাথে পরামর্শ করো তোমরা। ও তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে।
সর্দার মাথা নাড়ল। কিন্তু মুখ খুলল না। ঘোড়া পা বাড়াল।
শূকরগুলোর গলায় বাঁধা দড়ির প্রান্তটা কুয়াশার হাতে। টান পড়তে জানোয়ারগুলো ঘোড়ার পিছু পিছু ছুটতে শুরু করল।
জংলীদের গ্রাম থেকে বেরিয়ে গেল কুয়াশা। সর্দার এবং গ্রামের সব জংলীরা বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কুয়াশার গমন পথের দিকে।
ধীর গতিতে ছুটল কুয়াশার ঘোড়া। শূকরগুলো সাথে আছে বলে দ্রুত ঘোড়া ছোটাবার উপায় নেই।
. বেলা তিনটের দিকে মোড় নিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে চলল কুয়াশা। আধঘণ্টা পরই বনভূমি হালকা হয়ে এল। বিস্মিত হলো কুয়াশা। কম্পাস বের করে দিক নির্ণয় করে নিল আবার। না, দিক ভুল হয়নি। এত অল্প দুরত্ব অতিক্রম করবার পরই জঙ্গল, শেষ হয় কি করে? আরও মাইলখানেক এগিয়ে গেল কুয়াশা। মাটির সাথে বালি এবং কাকরের আধিক্য। গাছপালা দু’একটা দেখা যাচ্ছে। খানিক পর তাও দেখা গেল
। পিছনে বনভূমিকে ফেলে রেখে বালি, কাকর, ছোট বড় পাথরের উপর দিয়ে কুয়াশা ৪০
ছুটে চলল ঘোড়া।
দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়শ্রেণী। বিকেল চারটের দিকে ছোট দুটো পাহাড়ের মধ্যবর্তী গিরিপথে ঢুকল কুয়াশা।
পনেরো মিনিট পর গিরিপথের শেষ প্রান্তে পৌঁছে কুয়াশা লাগাম টেনে ধরে দাঁড় করাল ঘোড়াকে।
শূকরগুলো হাঁপিয়ে গেছে। চিৎকার করার শক্তি তাদের নেই। বিনকিউলার বের করে চোখে লাগাল কুয়াশা।
দুরে উঁচু-নিচু পাহাড়। শক্তিশালী বিনকিউলার দিয়ে পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে তাজ্জব বনে গেল কুয়াশা।
হাহারা অসভ্য নরখাদক হলেও তারা যে-কোন সভ্য জাতির চেয়ে পরিশ্রমী বুঝতে পারল কুয়াশা। উঁচু-নিচু প্রতিটি পাহাড়ের গায়ে গুহা বানিয়ে বাস করার ব্যবস্থা করেছে তারা। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পাথর কেটে কেটে চওড়া ধাপ তৈরি করেছে। বিশাল সিঁড়ির ধাপ উঠে গেছে পাহাড়ের বহু উঁচু অবধি। সিঁড়ির পাশে চওড়া সমতল রাস্তা তৈরি করেছে তারা। রাস্তার পাশে গুহা মুখ।
হাঁহারা জংলীদের মত কোমরবন্ধনীও পরে না। প্রায় সব হাহাই সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তবে কিছু সংখ্যককে নেকত্রে ছাল পরে থাকতে দেখতে পেল কুয়াশা বিনকিউলার দিয়ে। নেকড়ের ছালগুলো লাল রঙে রঞ্জিত। ওরা সম্ভবত গ্রুপ লীডার।
হাহাদের মেয়েরাও নগ্ন। কোন কোন গুহার ভিতর দৃষ্টি পড়ল কুয়াশার । মেয়েরা বাচ্চাদেরকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে পা মেলে পাথরের উপর বসে। পুরুষরা– বর্শার ফলায় শান দিচ্ছে, নেকড়ের ছাল রং করছে, যুবকদের মাথা কামিয়ে দিচ্ছে । প্রৌঢ়রা। একদল যুবক প্রশস্ত একটা সমতল জায়গায় বর্শা নিক্ষেপ করা শিখছে। প্রকাণ্ড গুহার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে রাশ রাশ ধোয়া। ওখানে পোড়ানো হচ্ছে নেকড়ে, শূকর, ভল্লুক। ছোট একটি পাহাড়ের গুহার ভিতর দৃষ্টি পড়তে চমকে উঠল কুয়াশা ।
গুহা মুখটায় দশ বারোজন হাহা বর্শা হাতে নিয়ে অনড় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। গুহার দিকে মুখ করে বর্শা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা।
পাথরের মূর্তি বলে সন্দেহ হলো কুয়াশার। কিন্তু খানিক পর ভুল ভাঙল তার। মূর্তি নয়, মানুষই। গুহার ভিতর বিদেশী শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ বেশ কয়েকজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। শুয়ে বসে আছে তারা গুহার ভিতর।
ওরা বন্দী, বুঝতে পারল কুয়াশা।
পাহাড়ের উপর থেকে দৃষ্টি নামল কুয়াশার নিচের দিকে। রীতিমত বিস্মিত হলো কুয়াশা। সেই সাথে খুশি হয়ে উঠল সে। পাহাড়ের নিচে দৈত্যাকার তিনটে ট্র্যাক্টর, দুটো ট্রাক, দুটো স্বয়ংক্রিয় ক্রেন, অসংখ্য মোটা পাইপ এবং ভারী আরও কয়েক রকম যন্ত্র ও মেশিন দেখতে পেল কুয়াশা। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগল তার
ভলিউম ১৪
৯
২৪
মনে-এগুলো কোথায় পেল হাহারা?
উত্তরটা অনুমান করে নিল কুয়াশা পরমুহূর্তে। গ্রেট ভিক্টোরিয়া ডেজার্ট সোনা এবং ইউরেনিয়ামে সমৃদ্ধ। দেশী এবং বিদেশী সরকার ইঞ্জিনিয়র দল পাঠিয়ে নানা রকম খনিজ দ্রব্যের সন্ধান পাবার চেষ্টা করেছেন অতীতে। হাহারা সেইসব লোকজনদের বন্দী করে রেখেছে। সেই সাথে রয়ে গেছে ইঞ্জিনিয়রদের যন্ত্রপাতি
এবং মেশিন। | :
কুয়াশা জিনিসগুলো ব্যবহার করতে পারবে ভেবে দারুণ খুশি হয়ে উঠল ।
আরও এগিয়ে যেতে হবে। হাহাদের মধ্যে যাবার পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করল কুয়াশা। দেড়শো গজ সামনে একটি পাহাড়ের উপর তিনজন হাহা বসে আছে পাথরের উপর। তিনজনের হাতেই বর্শা। পাহারা দিচ্ছে ওরা।
হাহাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ওদের এলাকার যত দূর সদ্য ভিতরে ঢুকতে চায় কুয়াশা।
জটিল একটা পথ বেছে নিল কুয়াশা। চড়াই ঠেলে প্রথমে বেশ খানিকটা উঠতে হবে উপর দিকে। তারপর উত্রাই। শূকরগুলোকে নিয়ে ওঠানামা কষ্টকর কিন্তু নিরাপদ।
কুয়াশার ঘোড়া পা বাড়াল।
প্রায় বিশ মিনিট পর সমতল পাথরের উপর লাগাম টেনে পঁাড় করাল কুয়াশা আবার ঘোড়াকে। এবার ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল সে।
মোট তিনটে পাহারাদানরত দলকে পাশ কাটিয়ে, তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনেকটা ভিতরে চলে এসেছে কুয়াশা।
প্রকাণ্ড একটা পাথরের আড়ালে ঘোড়া থেকে নেমে লাগামটা বাধল কুয়াশা ছোট একটা পাথরের সাথে। কাঁধে ব্যাগ এবং হাতে শূকরদের গলায় বাধা দড়ির শেষ প্রান্তটা ধরে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নিঃশব্দে উপরে উঠতে শুরু করল কুয়াশা। উপরে একটা গুহা।
দূর থেকেই কুয়াশা দেখে নিয়েছে গুহার ভিতরে কেউ নেই।
গুহাটা যেন কুয়াশার জন্যেই হাহারা তৈরি করেছে। গুহা মুখটার সামনে, ডানে, বায়ে বড় বড় পাথর। ফলে অন্য কোন দিক থেকে এই গুহার সামনে বা ভিতরের দৃশ্য দেখা যায় না।
পাঁচ মিনিট লাগল কুয়াশার গুহার ভিতর ঢুকতে। প্রকাণ্ড প্রহা! দেখতে অনেকটা বারো নাম্বার ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারের মত। L-এর মত সোজা খানিক দূর
• গিয়ে মোড় নিয়ে চলে গেছে বেশ অনেক দূর অবধি।
অধিকতর নিরাপত্তার জন্যে মোড় নিয়ে আরও ভিতরে চলে গেল কুয়াশা শূকরগুলোকে নিয়ে।
কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে ভিতর থেকে বড় একটা বোতল বের করল কুয়াশী।
কুয়াশী ৪০
| ২৫
বোতলের ভিতর তার নিজের আবিষ্কৃত মেডিসিন । বোতলটা বের করে পাশে রাখল। ব্যাগের ভিতর থেকে এরপর সে বের করল হাইপড়াবমিক সিরিঞ্জ ।
কুয়াশা সিরিঞ্জে ওষুধ ভরতে শুরু করল।
গুহার ভিতর ঢুকে মোড় নিয়ে নিঃশব্দ পায়ে কুয়াশার পাঁচ হাত দূরে এসে দাঁড়াল তিনজন হাহা। তাদের হাতে উদ্যত বর্শা। বর্শার মাথায় লোহার তিনটে করে তীক্ষ্ণধার ফলা। ফলাগুলোর মুখে লাল রঙ লাগানো। ওগুলো শুধু রঙই নয়। লাল বিষাক্ত এক জাতীয় পাহাড়ী গাছের শিকড় থেকে যে মারাত্মক বিষ পাওয়া যায় তা মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে জিনিসিটা। এই বিষ মানুষের রক্তের সাথে মেশামাত্র যে-কোন মানুষ তৎক্ষণাৎ মারা যাবে।
এতোটুকু শব্দ হলো না।
বর্শা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাহা তিনজন। লাল টকটকে তিন জোড়া চোখের দৃষ্টিতে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। একজন হাহা হিংস্র জন্তুর মত মোটা কর্কশ কণ্ঠে উচ্চারণ করল, ‘গগ গগ!
চমকে উঠে মুখ তুলে তাকাল কুয়াশা। খাড়া হয়ে উঠল তার সর্বশরীরের লোম।
হাহারা একযোগে কুয়াশার বুক লক্ষ্য করে বর্শা চালাল বিদ্যুৎগতিতে।
চার
কুয়াশা বিদায় নিয়ে চলে যাবার সময় থেকে পুরো একটা ঘন্টা গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল রাসেল। ওর চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল সর্দারের কর্কশ, উচ্চকিত কণ্ঠস্বরে।
| রাসেল যেখানে শুয়ে রয়েছে সেখান থেকে উঠানটা দেখতে পাবার কথা। রাসেলের ঘরের পর আরও একটা ঘর আছে। সেখানে আছেন ড. মুরকোট এবং ফোম। তারপর উঠান। সর্দার অবিরাম বক্তৃতা দিতে শুরু করেছে। উঠান থেকে ভেসে আসছে তার একার গলা। ..
বিছানার উপর উঠে বসল রাসেল। যতটা দুর্বল সে মনে করেছিল ততটা দুর্বল বলে মনে হলো না এখন নিজেকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল রাসেল।
ঘণ্টাখানেক গভীর ভাবে চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাসেল। বনভূমির সবক’টা জংলীদের সর্দারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে একত্রিত করে হাহাদেরকে আক্রমণ
প্রলে মন্দ হয় না ভেবেছে সে। হাহারা যুগ যুগ ধরে বনভূমির জংলীদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়ে আসছে। এর একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। জংলীরা একত্রিত হয়ে হাহাদের উপর মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে হাহারা পরাজিত হতে বাধ্য। নরখাদক হাহারাদের অস্তিত্ব রাসেলের পক্ষে সহ্য করা অসম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত অবশ্যি আরও একটি কারণে নিতে বাধ্য হয়েছে
ভলিউম ১৪
রাসেল। কুয়াশা গেছে হাহাদের এলাকায়। একা সে সেখানে গিয়ে কি করবে ভেবে কূল পায়নি রাসেল। ও ধরে নিয়েছে কুয়াশা নির্ঘাৎ হাহাদের হাতে নিহত হবে।
কুয়াশার মত প্রতিভাবান একজন স্বদেশবাসী বিজ্ঞানী একদল নরখাদক অসভ্যের হাতে নিহত হবে একথা ভাবতেই পারে না রাসেল। যেমন করে হোক হাহাদেরকে বাধা দিতে হবে। এবং কার্যকরীভারে বাধা দিতে হলে বনভূমির সকল সক্ষম
জংলীদেরকে নিয়ে আক্রমণ করা ছাড়া আর কোন পথ দেখতে পায়নি রাসেল।
উঠানে পা দিয়েই অবাক হয়ে পড়ল রাসেল। উৎসব-টুৎসব চলেছে নাকি জংলীদের?
দাঁড়িয়ে পড়ল রাসেল। বিরাট তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে জংলীদের মধ্যে। ব্যাপারটা পরিষ্কার ভাবে বোঝার জন্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিতে শুরু করল ও।
প্রকাণ্ড উঠানের মাঝখানে বড় আকারের দুটো শ্বেত পাথর দেখা যাচ্ছে। একটি শ্বেত পাথরের উপর বসে আছে জংলীদের সর্দার। তার সারা গায়ে লাল রঙ। রঙ শুকিয়ে চকচক করছে।
সর্দার যে শ্বেত পাথরে বসে আছে তার পাশেই, পাঁচ হাত দূরে আর একটি শ্বেত পাথর। সেটার উপরও কে একজন বসে আছে। যে বসে আছে তাকে চেনার কোনও উপায় নেই। কারণ তার মাথা, কাঁধ, সর্ব শরীর উপর কচি লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
শ্বেত পাথরের পিছনে অনেকগুলো কালো পাথর। গুণল রাসেল।
মোট বাইশটা কালো পাথর পাশাপাশি ফেলা। প্রতিটি পাথরের উপর একজন করে প্রকাশুদেহী লোক।
| এই বাইশজন লোককেও চিনতে পারল না রাসেল। লোকগুলোর বেশভূষা এবং চেহারা দেখে বুঝতে পারল যে ওরাও জংলী। তবে এ গ্রামের জংলী নয়। বাইশজন লোকের বাইশ রকম বেশভূষা। রঙের আধিক্য তাতে বড় বেশি। অন্যান্য জংলী জাতির সূর্দার নাকি ওরা বাইশজন? * কালো এবং শ্বেত পাথরগুলোর কাছ থেকে দশগজ অবধি কোন লোক নেই। দশ গজ জায়গা ছেড়ে দাঁড়িয়েছে জংলীরা। তাদের দাঁড়াবার ভঙ্গিও বড় বিচিত্র।
সাধারণত জংলীদেরকে খালি হাতে দেখা যায় না। কিন্তু রাসেল একজন জংলীর হাতেও কোন রকম অস্ত্র দেখতে পেল না।
অস্ত্রগুলো স্তূপীকৃত হয়ে আছে ফাঁকা দশগজ জায়গার মধ্যে। তাও বর্শা ছাড়া, অন্য কোন প্রকার অস্ত্র দেখা যাচ্ছে না সেখানে।
| জংলীরা ভীড় করে দাঁড়ায় সাধারণত । কিন্তু রাসেল দেখল এরা পাঁচজনের এক একটি দল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটি দলের কাছ থেকে আর একটি দল দাঁড়িয়ে আছে চার পাঁচ হাত দূরে। কোন দলেই কম বেশি দেখল না রাসেল।
কুয়াশা ৪০ |
‘ সর্দার বক্তৃতা দিয়ে চলেছে। হঠাৎ কান পাতল রাসেল। সর্দারের কথা ও বুঝতে না পারলেও কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। যেন বিদায় ভাষণ, দিচ্ছে সর্দার। সুরটা কেমন যেন উদাস। ভাবাবেগে যেন কাঁপছে সর্দারের গলা।
| পা বাড়াল রাসেল। কালো পাথরগুলোর পিছনে নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল ও। কয়েকমুহূর্ত পর পিছন থেকে শোনা গেলঃ রহস্যময় কেস, মি. রাসেল। সমান করিটে পারিবেন বলিয়া হোপ করিবেন না! মাঠা খাটাইটে খাটাইটে ঘামিয়া নাকানি চোবানি খাইটেছি•••। | ঘাড় ফিরিয়ে ঠোঁটে তর্জনী রেখে ডি.কস্টাকে চুপ করার নির্দেশ দিল রাসেল। ডি.কস্টা অসন্তুষ্ট হয়ে চুপ করে গেল।
* খানিক পর বক্তৃতা শেষ করে উঠে দাঁড়াল শ্বেত পাথরের উপর সর্দার। শ্বেত পাথরের উপর থেকে নেমে স্থূপীকৃত বাগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। পাঁচটা বর্শা তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
সানের দলের, পাঁচজন জংলীর হাতে পাঁচটা বর্শা তুলে দিয়ে আবার ফিরে এল সর্দার। এবার তুলে নিল পাঁচটা বর্শা। এভাবে পাঁচটা করে বর্শা তুলে নিয়ে প্রত্যেক দলকে দিয়ে আসতে লাগল সর্দার। প্রায় পনেরো মিনিট লাগল প্রত্যেকটি দলকে বর্শী দিতে। অবশেষে শ্বেত পাথরের উপর এসে বসল সর্দার।
জংলীদের কারও মুখে কোন কথা নেই। এতটুকু শব্দ নেই কোথাও। কেউ নড়ছে না একচুল। সত্যি বড় রহস্যময় মনে হলো গোটা ব্যাপারটা রাসেলের। সর্দার চিৎকার করে বলল, ‘হিচকা-মিচকা তুরুপ তা না, দুমকা লুমকা কীউঠা ছা
।
কেউ নড়ল না। কেউ কোন কথা বলল না। সকলে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে আছে সর্দারের দিকে। সর্দার আস্তে আস্তে লম্বা শ্বেত পাথরের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।
চমকে উঠল নিজের মনে রাসেল। সর্দারের চোখে জল। তার গাল বেয়ে জল পড়ছে শ্বেত পাথরে।
ব্যাপার কি? আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সর্দার।
আকাশের দিকে তাকাল রাসেল সর্দারের দৃষ্টি অনুসরণ করে। নির্মল, মেঘমুক্ত আকাশ। সূর্য গাছপালার আড়ালে চলে গেছে। দুটো শকুনকে শুধু উড়তে দেখল রাসেল মাথার উপর। পাশাপাশি থেকে আকাশে চক্কর মারছে শকুন দুটো।
সর্দারের বজ্রকণ্ঠ শুনে চমক ভাঙল রাসেলের। সর্দার মেঘের মত গর্জন করে বলল, চাগলা আগলা রিমরিম। লাললা শাওলা টিমটিম।
অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড ঘটতে লাগল। : বর্শা হাতে সামনের জংলী দলটা তীরবেগে পা চালাল। ছুটে এল তারা
ভলিউম ১৪
লাফিয়ে লাফিয়ে। শ্বেত পাথরের সামনে এসে মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে বর্শার তীক্ষ্ণধার ফলা সবেগে ঢুকিয়ে দিল তারা সর্দারের বুকে।
পাঁচটা বর্শা সর্দারের বুকের চারদিকে গেথে গেল। হেঁচকা টান দিয়ে একযোগে বর্শা পাঁচটা খুলে নিয়ে পাঁচজনার দলটা ছুটে চলে গেল নিজেদের জায়গায়। কালবিলম্ব না করে ছুটে এল দ্বিতীয় দলটা।
পাঁচটা বর্শার আঘাত খেয়েই ইহলীলা সাঙ্গ হয়ে গেছে জংলী সর্দারের।
পাঁচ
আকাশের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেছে সর্দারের চোখ দুটোর কালো মণি জোড়া।
| রক্তাক্ত শ্বেত পাথরের উপর নিঃসাড় পড়ে আছে তার দেহটা। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম-একের পর এক দল বর্শা উঁচিয়ে ছুটে আসছে ।
দেখতে দেখতে মার্দারের অতবড় দেহটা আর চেনার কোন উপায় রইল না। একদলা মাংসপিণ্ড পর। রয়েছে শ্বেত পাথরের উপর। সেই মাংসপিণ্ডের উদুই বশী গাঁথছে জংলীরা। বর্শার ডগায় আটকে যাচ্ছে মাংসের, হাড়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো। শ্বেত পাথরের উপর থেকে কমছে একটু একটু করে দলা পাকানো মাংসপিণ্ড। প্রায় পঞ্চাশটা দল বর্শার আঘাত হানল একই নিয়মে।
| বর্শাঘাত হানার শেষে দেখা গেল শ্বেত পাথরে সের দুয়েক মাত্র মাংস অবশিষ্ট আছে।
জংলীরা যে-য়ার জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে চারদিকে। কোথাও কেউ এতটুকু নড়ছে না।
আচমকা উপস্থিত শত শত জংলী গান গেয়ে উঠল।
ইচাকা ইচাকা হিচকো সাউনা, তোপরা তোপ কাউলা বাউনা••• | | মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গাইছে জংলীরা সমস্বরে। রাসেল লক্ষ্য করল কালো। বাইশটা পাথরের উপর বসা জংলী সর্দাররা গানের সুরে ঠোঁট নাড়ছে না! লতাপাতা ঢাকা শ্বেত পাথরে বসা অপর লোকটি গাইছে কি না বোঝার উপায় নেই।
| গান থামল খানিক পর।
গান থামার সাথে সাথে লতাপাতায় ঢাকা শ্বেত পাথরের উপর বসা লোকটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। লতাপাতা খসে খসে পড়ল তার গা থেকে।
জংলীরা একযোগে উল্লাসধ্বনি করে উঠল। বর্শাধারী জংলীর প্রথম দলটাকে আবার ছুটে আসতে দেখল রাসেল।
কেঁপে উঠল রাসেলের বুক।
পাঁচজনের দলটা ছুটে এসে শ্বেত পাথরের সামনে দাঁড়াল। বর্শাগুলো তারা কুয়াশা ৪০
শ্বেত পাথরের নিচে ফেলে আবার ছুটে চলে গেল নিজেদের জায়গায়। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং পরবর্তী সব দলের পালা।
রাসেল অনুমান করল দ্বিতীয় শ্বেত পাথরে যে সুঠাম দেহের অধিকারী যুবকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে সে বর্তমানে এই গ্রামের জংলীদের সর্দার। সর্দারকে বরণ করছে জংলীরা।
জংলীরা নতুন সর্দারের পায়ের কাছে বর্শা জমা দিয়ে যে যার জায়গায় ফিরে গেল।
নতুন সর্দার জংলীদের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। প্রতিটি জংলীর উপর দৃষ্টি পড়ছে তার। গর্বে তার বুক ফুলে উঠেছে। চোখেমুখে ফুটে উঠেছে গভীর দায়িত্ব সচেতনতার ভাব। জংলীদের দিক থেকে দৃষ্টি ফেলল সে ঘাড় ফিরিয়ে রাসেলের দিকে। | নতুন সর্দার হাসল রাসেলের চোখে চোখ রেখে। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সে তাকাল জংলীদের দিকে। পরমুহূর্তে বক্তৃতা দিতে রু কবল সে।
মিনিট তিনেক এক নাগাড়ে বক্তৃতা দেবার পর থামল নতুন সর্দার। জংলীরা উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। এতক্ষণ পাঁচজন পাঁচজন করে সুশৃঙ্খল ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। এবার দল ভেঙে গেল।
শ্বেত পাথরের উপর থেকে নিচে নামল নতুন সর্দার। একদল জংলী তার শ্বেত পাথরটা তুলে নিয়ে গিয়ে কালো বাইশটা পাথরের সামনে রাখল।
মৃত সর্দারের শ্বেত পাথরটা সরিয়ে নিয়ে গেল জংলীরা।
নতুন সর্দার অন্যান্য জংলীদের মুখোমুখি বসেছে। একদল যুবক নিয়ে আসছে শূকরের পোড়ানো রান, ভাল্লুকের ঝলসানো সিনা, বন্য মুরগী এবং পাখির রোস্ট। * নতুন সর্দার ঘাড় ফিরিয়ে রাসেলের দিকে তাকিয়ে আবার হাসল। হাত নেড়ে ডাকল সে।
এগিয়ে গেল রাসেল।
পাশে বসতে বলল সর্দার রাসেলকে। শ্বেত পাথরের উপর, নতুন সর্দারের পাশে বসল রাসেল।
সর্দার ঝকঝকে দাঁত বের করে হঠাৎ ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে ইংরেজিতে বলে উঠল, তোমার বান্ধবী কেমন আছে?’
অবাক হলো রাসেল। মাথা নেড়ে ও বলল, ফোম ঘুমাচ্ছে। তুমি ইংরেজি জানো?’ * জানি একটু একটু। ড, মূরকোটের সাথে সাথে থাকতাম কিনা। আমার নাম মোনজা। জোনজা আমার ছোট ভাই ছিল। ওর বন্ধু ছিল ফোম। এখন তুমি ফোমের বন্ধু। ছোট ভাইয়ের বন্ধু ছিল বলে আমাদের নিয়ম অনুযায়ী আমি বড় ভাই হয়ে ফোমের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি না। সে নিয়ম যদি থাকত তাহলে তোমাকে
৩০
ভলিউম ১৪
আমি খুন করতাম-না, খুন করতাম না, খুন করা আজ থেকে আমাদের মধ্যে পাপ বলে মনে করা হবে-তোমাকে তাড়িয়ে দিতাম আমাদের গ্রাম থেকে। তারপর ফোমকে বন্ধু করে নিতাম। কিন্তু নিয়ম তা নয়। তাই ফোমের সাথে আমার বন্ধুত্ব হতে পারে না। তুমিই ওর বন্ধু থাকো। তুমি আমার বন্ধু। রাজি?’
সপ্রতিভ ভাবে এতগুলো কথা মন খুলে বলে আবার সাদা দাঁত বের করে হাসল মোনজা।
রাসেলও হাসল। বলল, তোমাকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমি খুর খুশি। কিন্তু একটু আগে যা ঘটে গেল তার ব্যাখ্যা আমাকে জানাতে পারো, বন্ধু?’.
জানাতে পারি। আমার বাবা অর্থাৎ আমাদের সর্দার আমাকে বলে গেছেন–’ কোন সমস্যা দেখা দিলে তোমার সাথে পরামর্শ করতে।’
| তোমার বাবাকে হত্যা করা হলো কেন?’
মোনজা হাসছে। এতটুকু মলিন দেখাচ্ছে না তাকে। এতটুকু দুঃখিত মনে হচ্ছে ।
বলতে শুরু করল সে, ‘আমাদের জলীদের নিয়ম বড় কড়া, বন্ধু। শোনো তবে। আমাদের মধ্যে যে সব আইন, নিয়মকানুন ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে চালু আছে তা পরিবর্তন বা উঠিয়ে নেয়া খুব কঠিন। কোন আইন বাতিল করার ক্ষমতা কারও নেই একমাত্র সর্দার ছাড়া। তাও সর্দারও পারেন না. আইন বাতিল করতে। যদি করেন তাহলে সর্দারের পদ থেকে পদত্যাগ করে উত্তরাধিকারীর হাতে সর্দারীর দায়িত্ব দিয়ে নিজের প্রাণ স্বইচ্ছায় দান করতে হয়। কিন্তু সর্দাররা নিজেদের প্রাণ হারাতে চান না বলে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত আইন বহাল আছে আমাদের মধ্যে। আইন বাতিল করার মত দুঃসাহসী সর্দার শত বছরে, হাজার বছরেও একজন জন্মগ্রহণ করে কিনা সন্দেহ। আমার বাবা সৎসাহসী। তিনি আপনার ভাই, আমাদের দেবতার নির্দেশ মত, মৃত্যুদণ্ডের আইন বাতিল ঘোষণা করেছেন।
| গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিহত সর্দারের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত করল রাসেল। অনেকক্ষণ আর কোন কথা বলতে পারল না।
খাওয়া-দাওয়া শুরু হলো। :
সর্দারের অপর পাশে এসে অযাচিত ভাবে বসল ডি.কস্টা। জংলী সর্দাররা যা খাচ্ছে সে-ও তা মহা উৎসাহে উদরস্থ করতে লেগে গেছে তৎপরতার সাথে । রাসেল বুনো মুরগীর রোস্ট বেছে নিয়ে আস্তে আস্তে খাচ্ছে।
খেতে খেতে নিমন্ত্রিত অন্যান্য বাইশজন জংলী-সর্দারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল মোনজা। জংলী সর্দাররা মোনজার মাধ্যমে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। একজন, জংলী সর্দার জানতে চাইল জংলীদের মধ্যে কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে রাসেল।
রাসেল উত্তরে বলল, হাহাদেরকে উচিত শাস্তি দিতে।
জংলী সর্দাররা উৎসাহিত হয়ে উঠল। হাহাদের উপর সব সর্দারই খাপ্পা। কোন কুয়াশা ৪০
সর্দার জানাল প্রতি মাসে গড়ে প্রায় পঁচিশজন লোককে ধরে নিয়ে যায় হাহারা গ্রাম থেকে।
হাহাদের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে অনেক গল্প বলল সর্দাররা। রাসেল এক ফাঁকে বলল, “হাহাদেরকে উচিত শাস্তি ইচ্ছা করলে জংলীরাই দিতে পারে। এমন শাস্তি ইচ্ছা করলে জংলীরা হাহাদেরকে দিতে পারে যার ফলে চিরকালের জন্যে হাহারা জংলীদের কথায় উঠবে, বসবে। গোলাম হয়ে থাকবে তারা জংলীদের। জংলীরা এক জোট হলেই তা সম্ব।
একজোট হতে রাজি হয়ে গেল সর্দাররা। তারা চেপে ধরল রাসেলকে একটা উপায় রে করে দেবার জন্যে, যাতে করে হাহাদের হাত থেকে তারা স্থায়ীভাবে রেহাই পেতে পারে।
রাসেল সর্দারদের সাথে গঠনমূলক আলোচনায় রত হলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলল গভীর শলাপরামর্শ।
সর্দাররা রাসেলের পরামর্শ এবং সিদ্ধান্ত সানন্দে গ্রহণ করল।
মোনজা তার জংলীদেরকে প্রস্তুত হতে বলল যুদ্ধযাত্রার জন্যে। অন্যান্য সর্দাররা ঘোড়া ছুটিয়ে যে-যার গ্রামের দিকে চলে গেল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পনেরো বিশ হাজার সশস্ত্র জংলীকে নিয়ে. ওরা বাইশ জনই ফিরে আসবে। তারপর রাসেলের নেতৃত্বে তারা সবাই’ হাহাদেরকে আক্রমণ করার জন্যে রওনা হবে।
বাইশজন সর্দার চলে যাবার পর রাসেল মোনজাকে বলল, “আমাদের এই গ্রামের মেয়েদেরকেও যেতে হবে যুদ্ধে। যুদ্ধ যে তাদেরকে করতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তবে মেয়েরা হলো জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। ওরা সঙ্গে থাকলে যোদ্ধাদের মনোবল বাড়বে, দেখতেও বেশি মনে হবে সংখ্যায়।’
সানন্দে রাজি হলো মোনজা। ঠিক হলো মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা চওড়া, মোটা, ভারী এবং শক্তিশালী মেয়ে ত্রিশ বছর বয়স্কা কালাকুলার অধীনে
মেয়েরা যুদ্ধে যাবে।
কালাকুলা সত্যি দশাসই মেয়ে। প্রকাণ্ড দেহ তার। হাতির মত পা । বড় বড় চোখ। লম্বাও সে খুব। তার মতো মেয়ে জংলীদের মধ্যে আর একজনও নেই। অনেক পুরুষও তার সাথে শক্তি পরীক্ষায় পারে না। ত্রিশ বছর বয়স হলেও জংলীদের কোনও পুরুষ তাকে বিয়ে করতে সাহসী হয়নি। শেষ অবদি ডি. কস্টা তাকে অন্য বারোজন মেয়ের সাথে বিয়ে না করলে চিরকাল কালাকুলা অবিবাহিতাই থেকে যেত।
| ডি.কস্টার তেরোজন নতুন বউদের মধ্যে কলাকুলীওঁ একজন।’
| ডি.কস্টা কথাটা শুনে পাটখড়ির মত পা দুটো নিয়ে ছুটল স্ত্রীকে সুখবরটা দিতে। তার বিবাহিত একজন স্ত্রী গোটা জংলীদের মেয়ে সমাজকে যুদ্ধক্ষেত্রে
পরিচালনা করবে এ কি কম গর্বের কথা!
৩১
ভলিউম ১৪
কালাকুলা তার আর সব সতীনদেরকে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে নেকড়ের কলজে সিদ্ধ খাচ্ছিল। ডি কস্টা ক্যাঙ্গারুর মত লাফাতে লাফাতে ঘরের ভিতর ঢুকে নতুন রপ্ত করা জংলীদের ভাষায় হড়বড় করে সুসংবাদটা প্রচার করে দিল।
স্বামীর কথা শুনে নেকড়ের সিদ্ধ কলজে হাতে উঠে পঁাড়াল কালাকুলী। বুক উঁচু করে পাঁচবার উঠল আর বসল। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার শরীরটা একটু দলাইমলাই করে দাও দেখি।
| ডি.কস্টা বলে উঠল, ব্যায়াম করিয়া কুছ ফায়দা হোবে না, মাই ডিয়ার। যুদ্ধে ফিজিক্যাল শক্তি বিশেষ ডরকার নাই। চলো, টোমাকে আমি রাইফেল চালনা শিখাইয়া ডিই।’
ঘরের কোণ থেকে রাইফেলটা তুলে নিয়ে এসে কালাকুলার একটা হাত ধরে আকর্ষণ করল ডি কস্টা।
রাইফেল দেখে ভয়ে ডি; কস্টার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে সরে গেল কালাকুলা।’
ভয় পাইটেছ কেন•••?
ডি. কস্টা আবার এগিয়ে গেল কালাকুলাকে ধরার জন্যে। কালাকুলা হঠাৎ ধাক্কা মারল ডি কস্টাকে।
ধাক্কা খেয়ে রোগা পটকা ডি কস্টা ছিটকে পড়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল কালাকুলা।’
রাগে চেঁচিয়ে উঠল ডি. কস্টা, ইহার ফল ভাল হইবে না বলিয়া ডিটেছি। হামি টোমাকে ডাইভোর্স করিব, ফর গডস সেক…!’
উঠে বসার চেষ্টা করল ডি, কস্টা। কিন্তু হাঁটুতে ব্যথা লাগায় তা সে পারল । তার অন্যান্য স্ত্রীরা সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসছে দেখে সে চিৎকার করে উঠল, ‘ডুর হইয়া যাও টোমরা আমার সম্মুখ হইটে! বেয়াড়া, আনসিভিলাইজড, ডুষ্ট ওয়াইফ যুট্টো সব। আমার ফোরহেডে এমনও ছিল…
ছয় বিদ্যুৎ খেলে গেল কুয়াশার শরীরে। চোখের পলক পড়তে না পড়তে তিন হাত দূরে সরে গেল সে।
হাহাদের বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। মাত্র দশ সেকেণ্ড সময় পেল কুয়াশা। বিমূঢ় হাহারা নতুন করে তাল সামলে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করার অবসর পেল
। কুয়াশা উঠে দাঁড়িয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনজনের উপর।
একজন শত্রুর বাহুতে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করাবার সাথে সাথে দ্বিতীয় লোকটার তলপেটে সবেগে লাথি মারল সে।
৩-কুয়াশা ৪০
লাথি খেয়ে গুহার দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল লোকটা। ঝুপ করে পড়ল সে মেঝেতে।
তৃতীয় শত্রু বর্শা তুলেছে মাথার উপর। কুয়াশার বুক লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করার আগেই বিদ্যুৎবেগে বর্শাটা ধরে হেঁচকা টান মারল কুয়াশা ।
| তাল হারিয়ে ছুটে এল তৃতীয় শত্রু কুয়াশার দিকে। গায়ের সাথে ধাক্কা লাগার আগেই কুয়াশা ডান হাতের প্রচণ্ড এক ঘুসি বসিয়ে দিল লোকটার কপালের পাশে। এক ঘুসিতেই অসংখ্য শর্ষে ফুল ফুটে উঠল তার চোখের সামনে। ছিটকে পড়ল গুহার দেয়ালের কাছাকাছি। | প্রথম শত্রুর বাহুতে সিরিঞ্জ ছুঁড়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছে কুয়াশা। জ্ঞান হারিয়েছে সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
জ্ঞান হারিয়েছে তিনজনই।
অজ্ঞান প্রথম শত্রুর কপালের পাশে প্রচণ্ড এক ঘুসি মারল কুয়াশা । ইঞ্জেকশন দেয়ায় সাময়িক ভাবে জ্ঞান হারালেও খানিক পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে চেঁচামেচি শুরু করবে সে ওষুধের গুণে। ঘুসি মারার ফলে জ্ঞান ফিরতে দেরি হবে লোকটার।
ব্যাগ থেকে তুলো বের করে তিন অচেতন শত্রুর মুখের ভিতর খানিকটা করে তুলো ভরে দিয়ে কাপড় দিয়ে বাইরে থেকে বেঁধে দিল কুয়াশা। একজন শত্রুর পোশাক খুলে নিল সে। নিজের পোশাক খুলে লাল রঙ করা নেকড়ের ছাল কোমরে পরে নিল দ্রুত! হাহাদের মাথা কামানো। কুয়াশা ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের চওড়া একটা জিনিস বের করল। সেটা মাথায় পরল সে। কে বলবে তার মাথায় চুল আছে। কুয়াশার মাথা এখুনি যেন কেউ কামিয়ে দিয়েছে।
| হাহাদের নিখুঁত ছদ্মবেশ নিতে আরও দশ মিনিট খরচ করল কুয়াশা। ছদ্মবেশ নেয়া শেষ হতে শূকরগুলোর ঊরুতে সিরিঞ্জ কুঁড়ে ইঞ্জেকশন দিতে শুরু করল ও। প্রত্যেকটি শূকরের দেহে ইঞ্জেকশন দেয়া শেষ হতে দেখা গেল শূকরগুলো জ্ঞান হারিয়ে শুয়ে আছে গুহার মেঝেতে।
শূকরগুলোর গলার বাঁধন খুলে দিল কুয়াশা। ব্যাগ থেকে একটা ক্ষুদ্র মিনি ওয়্যারলেস সেট এবং যাবতীয় দরকারী জিনিস সে নেকড়ের ছালের ভিতর, কোমরে গুঁজে নিল। তারপর বেরিয়ে এল সতর্ক চোখে চারদিকে দেখতে দেখতে গুহার বাইরে।
গুহার বাইরে বেরিয়ে কুয়াশা দেখল আশপাশে কেউ নেই। খানিকটা দূরে দূরে গুহা। গুহার ভিতরে বাইরে হাহার যে-যার কাজে ব্যস্ত। কেউ তার দিকে তাকিয়ে নেই।
সূর্য ঢলে পড়েছে। খানিক পরই অদৃশ্য হয়ে যাবে দিগন্ত রেখা অতিক্রম করে।
গুহা থেকে বেরিয়ে উপর দিকে উঠতে লাগল কুয়াশা পাথর কাটা সিঁড়ির ধাপ টপকে টপকে।
গুহার কাছ থেকে প্রায় পঁচিশ গজ উপরে উঠে কুয়াশা অদূরে দেখল একটি
ভলিউম ১৪
৩৪
গুহা। গুহার বাইরে কয়েকজন হায় কি যেন খাচ্ছে। কুয়াশাকে দেখে তারা হাতের খাবার দেখিয়ে কাছে ডাকল।
সামনে যাওয়া কি উচিত হবে? ভাবল কুয়াশা। সামনে গিয়ে দাঁড়ালে যদি তার ছদ্মবেশ ধরে ফেলে? সে যে হাহাদের একজন নয় তা সহজেই বুঝতে পারবে ওরা।
ছদ্মবেশ ধরতে না পারলে ভয়ের কিছু নেই। হাজার হাজার হাহাদের মধ্যে সবাই কি আর সবাইকে চেনে, সকলের চেহারা কি সকলে মনে করে রাখে?
ডাকছে লোকগুলো। না গেলে হয়তো সন্দেহ প্রবে। সিঁড়ি ছেড়ে চওড়া সমতল পথ ধরে সেদিকে পা বাড়াল কুয়াশা।
দৃপা এগোতেই শব্দ এল পিছন থেকে। সতর্ক, সন্দিহান হয়ে উঠল কুয়াশা। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাবার অবসরও পেল না সে।
| একটা বর্শার ফলা কুয়াশার উরুর পিছনে খোঁচা মারল। আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল কুয়াশা। একজন হাহা বর্শা হাতে পিছন পিছন আসছে। নোংরা দাঁত বের করে হাসছে সে। নেকড়ের ছাল কুয়াশার শরীরে ছোট হয়েছে বলে বর্শার খোঁচা মেরে ঠাট্টা করেছে হাহাটা। কুয়াশার পাশে চলে এল সে। সৌভাগ্যক্রমে কোন কথা জিজ্ঞেস করল না লোকটা কুয়াশাকে।
| পাশাপাশি হেঁটে গুহাটার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা দুজন। গুহার সামনে চার পাঁচজন হাহা পাহাড়ী হরিণের কাবাব তৈরি করে খাচ্ছে। ওদের দুজনের দিকে দুটো এক সের ওজনের মাংসের টুকরো তুলে দিল একজন হাহা।
কুয়াশার সাথে যে হাহাটা এসেছিল সে মাংস নিয়ে দাঁড়াল না। খেতে খেতে হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে। কুয়াশাও তাই করল। লোকটাকে অনুসরণ করে চলল সে।
: কিন্তু লোকটা দ্রুত হাঁটছে। কুয়াশা ইচ্ছে করেই আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল মাংস দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে ছিঁড়তে। কান পেতে রইল সে।
ত্রিশ সেকেণ্ড পরই প্রত্যাশিত শব্দ কানে এল কুয়াশার। একপাল শূকর গলা ছেড়ে চিৎকার করছে।
আশপাশের হাহারা অবাক হয়ে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে ঘাড় ফিরিয়ে। তাকাচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়ল কুয়াশা। সে-ও তাকাল শব্দ লক্ষ্য করে।
. এক মুহূর্ত পরই দেখা গেল গুহার ভিতর থেকে একটা দুটো করে শূকর বেরিয়ে আসছে চেঁচাতে চেঁচাতে।
আধ মিনিটের মধ্যে হৈ-চৈ পড়ে গেল হাহাদের মধ্যে 1 জোর গলায় হাসছে কেউ কেউ। কেউ বর্শা নিয়ে ছুটছে শূকর শিকার করার জন্যে। কেউ কেউ একে ওকে জিজ্ঞেস করছে হঠাৎ এতগুলো শূকর কোথা থেকে এল।
প্রশ্নটা নিয়ে হাহারা খুব একটা মাথা ঘামাল না! দলে দলে তারা বর্শা নিয়ে ছুটল শূকর শিকার করবে।
| সুযোগটা হাত ছাড়া করল না কুয়াশা। হাহাদের দেখাদেখি সে-ও তার বর্শা
কুয়াশা ৪০;
উঁচিয়ে শূকর শিকার করতে শুরু করল। মিনিট তিনেক একটা শূকরের পিছনে ছুটে সেটাকে বিদ্ধ করল কুয়াশা ।
অন্যান্যদের দেখাদেখি নিহত শূকরটাকে কাঁধে নিয়ে চওড়া সমতল রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলল কুয়াশা।
• সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের নিচে নামল কুয়াশা। কাঁধে সদ্য শিকার করা শূকর নিয়ে প্রকাণ্ড একটা গুহার ভিতর ঢুকছে সবাই। কুয়াশাও ভিতরে ঢুকল।
| বিরাট বিশাল গুহাটা। | গুহার ভিতরে ধোয়া। চোখ জ্বালা করতে লাগল কুয়াশার অনভ্যাসে। তবু বেরিয়ে এল না সে ভিতর থেকে। চারদিকে লোকজন দেখল ও। একদিকে শূকর, ভালুক, ক্যাঙ্গারু, পাহাড়ী হরিণ, ছাগল জবাই করা হচ্ছে। ছাল ছাড়ানো হচ্ছে আর এক দিকে। হাল ছাড়াবার পর আগুনে ঝলসানো হচ্ছে জানোয়ারগুলোকে। একের পর এক শূকর নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে হাহারা। সকলে খুশিতে ফেটে পড়ছে শূকর দেখে। ভাগ্য আজ হঠাৎ সুপ্রসন্ন। অনেকগুলো শূকর অযাচিত ভাবে মিলে গেছে।
| গুহার বাইরে বেরিয়ে এল কুয়াশা। বাইরের হাহারা প্রায় উৎসব শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। আজ ভুরি-ভোজন হবে।
হাঁটতে হাঁটতে বর্শার ফলা শান দিচ্ছে যেখানে একদল লোক সেখানে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। সেখান থেকে এক মিনিট পর পা বাড়াল সে।
এক জায়গায় প্রায় আশি নব্বই জন হাহা ব্যায়াম করছে-সব জায়গায় একবার করে গেল কুয়াশা হাঁটতে হাঁটতে। যেখানে কিছু লোকের ভীড় দেখল সেখানেই গিয়ে কিছুক্ষণ করে দাঁড়াল।– একটা পুকুরে সাঁতার কাটছে মেয়ে-পুরুষ একত্রে। পুকুরের পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াল কুয়াশা। * সন্ধ্যার পর আরও একটা পুকুর দেখতে পেল কুয়াশা। কিন্তু সেটায় কেউ নামেনি। সেটার পারে গিয়ে দাঁড়াতে কুয়াশা অবাক হয়ে গেল। পানির বদলে পুকুরে রয়েছে অপরিশোধিত তেল।’
কুয়াশা বুঝতে পারল পাথরের নিচে তেলের খনি আছে। এই পুকুর কৃত্রিম পুকুর নয়।
এই তেল প্রচুর পরিমাণে আছে বলেই মশাল জ্বেলে গোটা এলাকাটা লালচে আলোয় আলোকিত করে রাখতে পেরেছে হাহারা।
গোটা এলাকাটা ঘুরে ফিরে দেখতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগল কুয়াশার।
হাহারা যে পাহাড় শ্রেণীর উপর রাত্রি যাপন করে তার সামনের দিকে মরুভূমি। মরুভূমির অপর দিকে, মাইল খানেকেরও কম দূরে, মুখোমুখি আবার পাহাড় শ্রেণী। সেখানে হাহারা রাত্রি যাপন করে না। সেখানে দিনের বেলায় তারা যায় যুদ্ধ-বিদ্যা, শিখতে।
ভলিউম ১৪
–
. | . |
. |
—.
–
গোটা এলাকাটা ঘুরে দেখে কুয়াশা অনুন করল হাজার পাঁচেক লোক সব মিলিয়ে হাহারা।
বন্দীদের গুহার সামনেও গেল একবার কুয়াশা। বন্দীদের কয়েকজনকে দেখে রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সে। | বিশ্ববিখ্যাত ইন্দোনেশিয়ান বিজ্ঞানী সুর্জানা বছরখানেক আগে গ্রেট ভিক্টোরিয়া মরুভূমিতে ক্যানবেরায় একটা সম্মেলনে যোগ দিতে যাবার সময় প্লেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মারা গেছেন বলে শুনেছিল কুয়াশা। বন্দীদের মধ্যে বৃদ্ধ সুর্জানাকেও দেখল সে তার সাথে রয়েছেন ইরাকের কেমিস্ট হাসান আল ইয়াজদি। বয়সে তরুণই বলা চলে ইয়াজদিকে। সুর্জানার সাথে প্লেনে সে-ও ছিল। বন্দীদের আর কাউকে চিনতে পারল না কুয়াশা।
কুয়াশা বন্দীদের গুহার সামনে থাকার সময়ই একদল হাহা ভিতরে ঢুকল। তারা ইয়াজদিকে ধরে বের করে আনল গুহার ভিতর থেকে।
| গুহা থেকে ইয়াজদিকে বের করে হাহারা তাঁকে বেঁধে ফেলল জন্তুর সরু চামড়া দিয়ে। তারপর তাঁকে সিঁড়ির উপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল নিচের দিকে।
কি ভেবে হাহাগুলোকে অনুসরণ করল কুয়াশা। সাত এলাকার সবচেয়ে বড় পাহাড়টার বৈশিষ্ট্য আগেই লক্ষ করেছিল কুয়াশা। পাহাড়ের পাদদেশে প্রকাও একটা গুহামুখ। এই গুহার ভিতর হরদম হাহারা যাচ্ছে আর আসছে। || উলঙ্গ হাহাদের একজনকেও গুহার ভিতর ঢুকতে বা বের হতে দেখেনি কুয়াশা। গুহার ভিতর যারা-ঢুকছে বা বের হচ্ছে তাদের প্রত্যেকের পরনে নেকড়ের হলি ।
| ইয়াজদিকে নিয়ে হাহা কজন সেই পাহাড়টার গুহার দিকেই চলেছে। কুয়াশা পিছু পিছু যেতে অনুমান করল হাহাদের রাজা বা সর্দার হয়তো গুহার ভিতরই থাকে।
| গুহার ভিতর হাহারা প্রবেশ করল ইরাকী কেমিস্ট ইয়াজদিকে নিয়ে। খানিক পর কুয়াশাও প্রবেশ করল। গুহা মুখের ভিতর প্রবেশ করেই ভুল ভাঙল তার।
গুহামুখ বলে যেটাকে ভুল করেছিল কুয়াশা সেটা আসলে প্রকাণ্ড এক সুড়ঙ্গের মুখ। সোজা চলে গেছে সুড়ঙ্গটা বহুদূর অবধি।
সুড়ঙ্গের মেঝে শ্বেত পাথর দিয়ে বাঁধানো।
দেয়ালে দেয়ালে পাথর খুদে তাতে নানারকম রঙ লাগিয়ে আঁকা হয়েছে নানা প্রকার জীব-জানোয়ারের ছবি।
সুড়ঙ্গ পথটা খুবই চওড়া। পথের দু’ধারে পাথরের উঁচু আসন। সেখানে কুয়াশা ৪০
৩৭
হাহারা বসে গল্প করছে। হাসাহাসি করছে।
ইয়াজদিকে নিয়ে হাহারা এগিয়ে চলল।
প্রায় পঞ্চাশ গজ সোজা যাবার পর মোড় নিল হাহারা। কুয়াশাও মোড় নিয়ে ডানদিকের পথ ধরে এগিয়ে চলল। বড় বড় পাথরের পাত্রে একদল হাহা তরল পানীয় নিয়ে যাচ্ছে ভিতর দিকে। লোহার শিকে বিদ্ধ শূকরও বয়ে নিয়ে চলেছে অনেকে। এই মাত্র আগুনের আঁচ থেকে তুলে আনা হয়েছে ওগুলোকে।
মিনিট খানেক পর রাস্তার শেষ মাথায় এসে পৌঁছুল কুয়াশা। সামনে দেখা যাচ্ছে প্রকাও একটা দরজা। দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছে হাহারা বন্দী ইয়াজদিকে নিয়ে।
ভিতরে প্রবেশ করল কুয়াশা।
প্রকাণ্ড একটা গোল সভাগৃহের মত দেখতে জায়গাটা। অনেক উঁচুতে পাথরের ছাদ, গম্বুজওয়ালা মসজিদের ভিতরটা যেরকম দেখতে অনেকটা সেরকম জায়গাটা। আকারে প্রকাণ্ড | প্রায় শ’ পাঁচেক বা তারও বেশি লোক বসে আছে ভিতরে।
হাহারা বসে বসে মাংস এবং মদ খাচ্ছে। সভাগৃহের মাঝখানে ছোট একটা মঞ্চ। সেখানে উলঙ্গ কয়েকজন যুবতী নাচছে। ঢাক ঢোল পেটাচ্ছে একদল হাহা মঞ্চের নিচে।
সভাগৃহের সর্বশেষ প্রান্তে উঁচু আর একটা মঞ্চ। সেই মঞ্চে বসে আছে তিনজন। তিনজনের মধ্যে একজন মেয়ে।
মেয়েটির বয়স খুব কম। বড় জোর উনিশ কি কুড়ি বছরের হবে। তার নিম্নাঙ্গে এবং ঊর্ধ্বাঙ্গে নেকড়ের হাল। লাল এবং নীল রঙে রাঙানো। গর্বিত ভঙ্গিতে সোনা দিয়ে তৈরি উঁচু একটা সিংহাসনে বসে আছে সে। তার ডান পাশে একজন দীর্ঘকায়,
যুবক হাহা।
* কুয়াশা অনুমান করল, যুবকটি হলো হাহাদের রাজা। পাশের মেয়েটি তার স্ত্রী-রানী।
রানীর বাঁ দিকে বসে আছে আর একজন লোক। লোকটার উপর চোখ পড়তে চমকে উঠল কুয়াশা।
লোকটা শ্বেতাঙ্গ। চিনতে এতটুকু অসুবিধে হলো না কুয়াশার ।
পরিষ্কার বুঝতে পারল এখানে থাকা নিরাপদ নয়। কিন্তু বন্দী ইয়াজদিকে নিয়ে হাহারা কি করে না দেখে এখান থেকে বেরিয়ে যাবারও ইচ্ছা করল না তার।
গা-ঢাকা দেবার চেষ্টায় সভাগৃহের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা।
মঞ্চের কাছে উঁচু একটা পাথরের উপর নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে হাসান আল ইয়াজদিকে।
দু জন হাহা ধারাল খাড়া হাতে সঁড়িয়ে আছে তার পাশে। তারা তাকিয়ে, আছে রাজার দিকে। রাজার আদেশ পেলেই ইয়াজদির গলায় খাড়া মেরে মুণ্ডু আর ধড় আলাদা করে ফেলবে।
ভলিউম ১৪
৩৮
নরবলি দেয়ার রেওয়াজ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে হাহাদের মধ্যে। প্রতি রাতে
• একজন করে বিদেশীকে বলি দেয়া হয় রাজার সামনে। ব্যতিক্রম নেই এর।
ডেভিড রাজার কানে কানে কি যেন বলছে লক্ষ করল কুয়াশা। তাকে কি ডেভিড চিনে ফেলেছে?
ডেভিডের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে যুবক রাজা। ডেভিডের কথা শেষ হলো। কথা শেষ করে ডেভিড তাকাল ইয়াজদির দিকে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কুয়াশা । ডেভিড তাকে চিনতে পারেনি। তা যদি চিনত তাহলে রাজার কানেকানে কথা বলার পর সরাসরি কাকাত সে কুয়াশারই দিকে।
রাজা ইঙ্গিতে ডাকল দুজন হাহাকে। তাদের কানে কানে কি যেন বলল সে। •
হাহ দুজন মঞ্চ থেকে নেমে এল। তারা নেমে আসতেই একদল হাহা তাদের দুজনকে ঘিরে ধরল। তারা অন্যান্য হাহাদেরকে কি যেন বলল। বলে উঠে গেল দুজনেই আবার মঞ্চে।
হাহাদের দলটি এবার সরাসরি তাকাল কুয়াশার দিকে। কুয়াশা প্রথম থেকে লক্ষ করছিল গোটা ব্যাপারটা। হাহারা তার দিকে তাকাতেই সে বুঝতে পারল ডেভিড তাকে চিনে ফেলেছে।
হাহারা দ্রুত এগিয়ে আসছে কুয়াশার দিকে।
পালাবার কথা ভাবল কুয়াশা। কিন্তু পালানো যে সম্ভব নয় তা সে বুঝতে পারল। সভাগৃহের সর্বত্র সশস্ত্র হাহারা রয়েছে। কিভাবে, কোন পথে পালাবে সে? তার চেয়ে ধরা পড়ে বন্দী হয়ে দেখা যাক কি ঘটে।
নিজের জায়গায় শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। যেন কিছুই সে জানে না।
দ্রুত হাহাদের একটি দল কুয়াশার কাছে এসে ঘিরে দাঁড়াল। ঘাড় ফিরিয়ে কৃত্রিম বিস্ময়ে প্রত্যেকের দিকে তাকাল কুয়াশা।
হাহাদের একজন দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন দ্রুত বলে উঠল। লোকটার কথার একটা বর্ণও বুঝতে পারল না কুয়াশা। ভাষা বুঝতে না পারলেও উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয় তার। কেউ ওর শরীর স্পর্শ করার আগেই পা বাড়াল ও মঞ্চের দিকে।
দৃঢ় পায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে চলল কুয়াশা। হাহারা চারপাশ থেকে পাহারা । দিয়ে নিয়ে চলল তাকে।
চারটে ধাপ টপকে মঞ্চের ভিতর উঠে রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। সরাসরি রাজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কুয়াশার প্রকাণ্ড পেশীবহুল শরীরের দিকে তাকিয়ে থেকে রাজা ডেভিডের উদ্দেশে নিজস্ব ভাষায় কি যেন বলল।’
ডেভিড কুয়াশার উদ্দেশে বলে উঠল, “আপনি ধরা পড়ে গেছেন, ড, কুয়াশা। তবে আপনার সাহসের প্রশংসা•••।’
কুয়াশা তাকাল ডেভিডের দিকে।
কুয়াশা ৪০
| ৩৯
ডেভিড হাসছে ব্যঙ্গভরে। হাসতে হাসতে সে বলে উঠল, ‘শুনেছিলাম আপনি সাহসী পুরুষ। কিন্তু এতটা ভাবিনি। মৃত্যুকে আপনি বুঝি ভয় পান না?’
কুয়াশা গুরু গম্ভীরভাবে বলল, না, মৃত্যুকে আমি ভয় করি না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি আমার মৃত্যুর কথা ভাবছি না। ভাবছি তোমার মৃত্যুর কথা।
আমার মৃত্যুর কথা!
কথাটা বলে সশব্দে হেসে উঠল ডেভিড। হাসি থামিয়ে সে বলল, আপনি তো বেশ লোক, ড, কুয়াশা! মৃত্যু আপনার অবধারিত জেনেও এমন রসিকতা করতে পারছেন। সত্যি আশ্চর্য ব্যাপার। আসলে এক নম্বরের বোকা আপনি। সাহস দেখিয়ে বাহাদুরী করার লোভে আপনি হাহাদের মধ্যে এসে পড়েছেন বুঝতে পারছি। এদেরকে আপনি চেনেন না। চিনলে এ সাহস আপনার হত না। না চিনলেও একটু পরই চিনতে পারবেন। আফশোস, তখন আর আপনার কিছু করার। থাকবে না। যাকগে, আপনার দুর্ভাগ্যের জন্যে আপনিই দায়ী–আমাদের কিছু করার নেই। তা বুড়ো মূরকোট কেমন আছে? তার সুপারম্যান কি ত্রুটিমুক্ত হয়েছে?’
যুবতী রানী কুয়াশার দিকে সপ্রশংসদৃষ্টিতে তাকিয়ে রাজার উদ্দেশে কি যেন বলছে লক্ষ করল কুয়াশা।
কুয়াশা বলল, “ড, মূরকোটের সুপারম্যান সম্পর্কে তোমার কোন কৌতূহল থাকা উচিত নয়, ডেভিড। ড. মূরকোট একজন বিজ্ঞানী, আর তুমি একজন শয়তান। আমার লেসার গানটা কোথায় রেখেছ?’
লেসার গান?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ডেভিড। | হ্যাঁ। যেটা একজন বিশ্বাসঘাতক তোমার হাতে দিয়েছিল চুরি করে। পালাবার সময় যেটা তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ। ওটা বন্দুক বা রাইফেল নয়, ওটা লেসার গান। আমার নিজের তৈরি । কোথায় রেখেছ?
| ‘আপনার নিজের তৈরি? নিশ্চয়ই ব্যবহার করতে জানেন? আমি তো হাজার চেষ্টা করেও কাজে লাগাতে পারিনি। তা আপনা লেসার গান কি কাজে ব্যবহার হয়, ড, কুয়াশা? কিভাবে ব্যবহার করতে হয়?
| তোমার মত আস্ত একটা গাধার পক্ষে লেসার গানের তাৎপর্য বোঝা সম্ভজ্ব নয়, ডেভিড। ওটা তোমার ব্যবহারের জিনিস নয়। আমার জিনিস ফিরে চাই আমি।’
হাঃ হাঃ করে জঘন্য ভাবে হেসে উঠল ডেভিড। হাসি থামিয়ে সে রাজার দিকে তাকিয়ে কয়েকটি কথা বলল হাহাদের ভাষায়। | রাজা কয়েকজন হাহার প্রতি ইঙ্গিত করল। কুয়াশার দিকে এগিয়ে এল তারা সরু চামড়ার বেল্ট নিয়ে। কুয়াশাকে বাধতে চায় তারা।
রানী কি যেন আবার বলল রাজার উদ্দেশে।
রাজা তাকাল ডেভিডের দিকে। ডেভিডকে কি যেন বলল সে। ডেভিড উত্তরে অনেকগুলো কথা বলল। ডেভিডের কথা শেষ হতে রাজা আবার কি বলল।
ভলিউম ১৪
ডেভিডের মুখ শুকিয়ে গেল কেন যেন। কিন্তু হাহাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় একটা আদেশ দিল সে।
উঁচু পাথরের উপর থেকে নামিয়ে আনা হলো হাসান আল ইয়াজদিকে।
ডেভিড কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে রাজা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। বলি দেয়া হবে আপনাকে। নিজের কোন বক্তব্য থাকলেও রাজাকে জানাতে পারেন।
কুয়াশা হাসান আল ইয়াজদির দিকে তাকাল। মৃদু হাসল সে। ইয়াজদির উদ্দেশে বলল, মিঃ ইয়াজদি, আপনি আমাকে চিনতে না পারলেও আমি আপনাকে চিনেছি। আমার নাম কুয়াশা। বার্লিনে একটা সিম্পোজিয়ামে আপনার সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার দশ বছর আগে। আপনি কি হাহাদের ভাষা বুঝতে এবং বলতে পারেন?’
| অবাক বিস্ময়ে কুয়াশার কথাগুলো গিলছিল হাসান আল ইয়াজদি। কুয়াশার প্রশ্নে মাথা নেড়ে সে বলল, হ্যাঁ, আমি হাহাদের ভাষায় কথা বলতে শিখেছি গত এক বছরে।’.
কুয়াশা কলল, দয়া করে আমার বক্তব্যটুকু রাজাকে আপনি জানিয়ে দিন । ‘রাজাকে বলুন, আমি একজন জাদুকর। মন্ত্র পড়ে; হিসেব কষে আমি অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটাতে পারি। বলে দিতে পারি ভবিষ্যতের অনেক ঘটনা যা বলব তা অবশ্যই ঘটবে।’
বিমূঢ় দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রইল ইরাকী কেমিস্ট। | কুয়াশা বলল, ইতস্তত করবেন না। যা বলছি তা ভেবেই বলছি। আপনি রাজাকে আমার কথাগুলো জানান।’
ইয়াজদি রাজাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে শুরু করল। তার কথা শেষ হতে রাজা একটা প্রশ্ন করল।
ইয়াজদি বলল, ‘রাজা জানতে চাইছেন আপনি আপনার জাদুশক্তি প্রমাণ করতে পারবেন?’
‘পারব।’
কথাটা রাজাকে জানাল ইয়াজদি। রাজা প্রশ্ন করল, বেশ, হাহাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জাদুকর কিছু বলুক শুনি।’
রাজার প্রশ্ন শুনে কুয়াশা বলল “হাহাদের সামনে ভীষণ বিপদ। চারভাগের তিনভাগেরও বেশি হাহা আজ রাতের মধ্যেই মারা যাবে। এবং দু’একদিনের মধ্যেই
ধ্বংস হয়ে যাবে গোটা হাহা জাতি।
ইয়াজদি কথাটা রাজাকে জানাতে ভয় পেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুয়াশার বারংবার অনুরোধে কথাটা জানাতে বাধ্য হলো সে।
কুয়াশার কথা শুনে রেগে লাল হয়ে গেল রাজা। সিংহাসন ত্যাগ করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল সে। চিৎকার করে কি যেন বলল সে।– ইয়াজদি ফিসফিস করে কুয়াশার উদ্দেশে বলল, রাজা আপনার কথা শুনে কুয়াশা ৪০
ভীষণ অপমানিত বোধ করেছে। মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সে আপনার।’
| কুয়াশা বলল, আমাকে মেরে ফেললেও হাহাদের ভবিষ্যৎ বদলাবে না। যা বলেছি তা ঘটবেই।’
একদল হাহা ঝাঁপিয়ে পড়ে বেঁধে ফেলল কুয়াশাকে। বন্দী কুয়াশাকে তারা নিয়ে চলল উঁচু পাথরটার উপর।
পাথরটার উপর দাঁড় করিয়ে খাড়া উঁচু করে ধরল কয়েকজন হাহা কুয়াশার মাথার উপর। রাজার আদেশের অপেক্ষায় তৈরি তারা ।
রাজা এদিকে তাকিয়ে আছে সভাগৃহের দরজার দিকে। দরজা দিয়ে দশ পনেরোজন নেকড়ের ছাল পরা হাহা হাপাতে হাঁপাতে ভিতরে প্রবেশ করছে। দরজার কাছ থেকেই তারা রাজার উদ্দেশে চিৎকার করে কি যেন বলছে।
আট
অসংখ্য মশালের আলোয় সভাগৃহ আলোকিত।
সভাগৃহের কাছ থেকে ভীড় ঠেলে হাহাগুলো শোরগোল তুলে এগিয়ে আসতে লাগল রজার দিকে।
| রানী তার সিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল রাজার পাশে। ডেভিড বসেই। রইল তার সামনে। চোখমুখের চেহারা, তার ভারী, থমথমে হয়ে উঠেছে।
| কি যেন বলল রানী রাজার দিকে তাকিয়ে।
রাজা তাকাল কুয়াশার দিকে।
কুয়াশা লক্ষ করল রানীও তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। ডেভিডের দিকে তাকাল কুয়াশা। দাতে দাঁত চাপছে সে। কার উদ্দেশ্যে কে জানে।
উত্তেজিত হাহাগুলো মঞ্চে উঠে রাজার সামনে এসে দাঁড়াল। এমন সময় সভাগৃহের একধারে গোলযোগ শুরু হলো। রাজা তাকাল সেদিকে।
একদল পান-ভোজনে মত্ত হাহা হঠাৎ ঢলে পড়েছে মেঝেতে। কোন রকম নড়াচড়া করছে না তারা। তাদের পাশে যারা ছিল তারা ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করছে।
রাজার সামনে দাঁড়িয়ে নবাগত হাহারা সমস্বরে কি সব বলে চলেছে।
শুনতে শুনতে অবিশ্বাস ফুটে উঠল রানীর সারা মুখের চেহারায়। গম্ভীর হয়ে উঠল রাজা।
সভাগৃহের আর এক দিকে নতুন করে গোলযোগ শুরু হলো। সেখানেও একদল হাহা পান-ভোজন করতে করতে আচমকা ঢলে পড়েছে।
উপস্থিত হাহারা ঢলে পড়া সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে মারা গেছে তারা। ফলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ভীষণ ভাবে। | রাজা ডেভিডের দিকে তাকাল, কি যেন বলল সে তাকে। ডেভিড মাথা নেড়ে
ভলিউম ১৪
কি যেন বলল দ্রুত।
এমন সময় একজন হাহা ঢুকল সভাগৃহে। হাঁপাতে হাঁপাতে, ছুটতে ছুটতে, মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছে সে।
সভাগৃহের মাঝখানে নতুন করে গোলযোগ শুরু হলো।
নবাগত হাহাটী মঞ্চে উঠে রাজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা এবং ভীত কণ্ঠে কি সব বলতে শুরু করল। তার কথা শেষ হবার আগেই আর একজন দুঃসংবাদবাহক হাহা সভাগৃহের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। তার পিছু পিছু প্রবেশ করল আরও দু’জন।
মঞ্চের উপর নবাগত হাহার সংখ্যা ক্রমশ বাড়তেই লাগল।
সভাগৃহে উপস্থিত হাহারা ছুটোছুটি শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। রাজার উপস্থিতি ভুলে তারা পরস্পরের ঘাড়ে পড়ছে, চিৎকার করছে, হুটে বেরিয়ে যাচ্ছে সভাগৃহ থেকে।
রাজা একজন হাহাকে কি যেন বলল। কুয়াশার কাছাকাছি যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের উদ্দেশে লোকটা নির্দেশ দিল।
লোকগুলো খুলতে শুরু করল কুয়াশার বাঁধন। বাধন খুলে উঁচু পাথরের উপর থেকে নামিয়ে কুয়াশাকে মঞ্চে নিয়ে আসা হলো।
| হাসান আল ইয়াজুদি তখনও মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশার কানের কাছে মুখ সরিয়ে নিয়ে এসে সে অবিশ্বাস ভরা বিমূঢ় কণ্ঠে বলে উঠল, আপনি কি সত্যিই জাদু জানেন, ড. কুয়াশা? আপনার ভবিষ্যৎবাণী যে ইতিমধ্যেই ফলতে শুরু করেছে!
কুয়াশার মুখে কোন কথা ফুটল না। তার দৃষ্টি ভাবলেশহীন নির্বিকার।
রাজা, রানী, ডেভিড, মঞ্চে উপস্থিত নবাগত হাহারা ও সভাগৃহের সচেতন প্রতিটি হাহা তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে।
রাজার চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ। রানীর চোখে অপার বিস্ময়। ডেভিডের চোখে ঘৃণা, ঈর্ষার আগুন। নবাগত এবং সভাগৃহের প্রতিটি হাহার চোখে আতঙ্ক।
রাজা ইয়াজদির দিকে তাকিয়ে কি যেন বলল।
ইয়াজদি কুয়াশার দিকে তাকাল, রাজা বলছেন তার রাজ্যে হঠাৎ অশান্তি শুরু হলো কেন? এর জন্যে কে দায়ী? আপনি?
| ‘অশান্তি তো শুরু হবেই। হাহাদের সামনে মারাত্মক বিপদ এ কথা বলে সাবধান করে দিইনি আমি? এই বিপদ এবং অশান্তির জন্যে দায়ী হাহারা নিজেরাই। তারা অন্যায় করছে অন্যান্য জাতির উপর, তারা একজন বিদেশী শয়তানকে নিজেদের মধ্যে আশ্রয় দিয়েছে এবং তারা ভাল মানুষদেরকে বলি দিচ্ছে।’. | | ইয়াজদি কুয়াশার বক্তব্য রাজাকে জানাল। রাজা তাকাল ডেভিডের দিকে। কি যেন বলল সে। ডেভিড রাগে কাঁপতে কাঁপতে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কি যেন বলল।
রাজা কথা বলল আবার। কুয়াশী ৪০
• ৪৩
ইয়াজদি রাজার প্রশ্ন জানাল কুয়াশাকে, ‘রাজা জিজ্ঞেস করছেন তার প্রজারা দলে দলে মারা যাচ্ছে। প্রতিটি গুহা থেকে সংবাদ আসছে মৃত্যুর। এই সভাগৃহেও মরছে অনেকে। আপনি যখন জাদুকর তখন নিশ্চয়ই হাহাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন?
কুয়াশা জানাল, ‘পারি।’ রাজা প্রস্তাব দিল সমাধান করার।
কুয়াশী বলল, আমার জাদুদণ্ড চুরি করেছে ডেভিড। জাদুদণ্ড ছাড়া প্রমাণ করা সম্ভব নয়। জাদূদণ্ডটা কোথায় রেখেছে ডেভিড বলুক।’
রাজা ডেভিডকে জাদুদণ্ডের কথা জিজ্ঞেস করল। সেটা ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করল ডেভিড।
| রাজা তখন একজন হাহাকে হুকুম করল ডেভিডের গুহা থেকে জাদুদণ্ডটা নিয়ে আসতে। রাজার হুকুম শুনে খেপে গেল ডেভিড । চিৎকার করে অনেকগুলো কথা। বলল সে। তারপর মঞ্চ থেকে নামার জন্যে সামনে পা বাড়াল।
রাজার নির্দেশে কয়েকজন হাহা বাধা দিল ডেভিডকে বাধা পেয়ে মঞ্চ ত্যাগ করার চেষ্টা বাদ দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সে তার আসনে।
নতুন নতুন দুঃসংবাদ নিয়ে সভাগৃহে হাহাদের প্রবেশ করার বিরাম নেই। সভাগৃহেও অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটে চলেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেক হাহা ঢলে পড়ে যাচ্ছে মেঝেতে। পড়ে যাবার সাথে সাথে স্থির, নিঃসাড় হয়ে যাচ্ছে তাদের দেই। সুস্থ লোক সভাগৃহে এখন মুষ্টিমেয়। বেশির ভাগ হাহাই ঢলে পড়েছে।
দুঃসংবাদ নিয়ে আগত ত্রিশ চল্লিশ জন হাহার মধ্যেও পনেরো বিশজন ঢলে পড়েছে মঞ্চে।
ডেভিড বিপদ টের পেয়ে কৌশলের আশ্রয় নেবার চেষ্টা করছে। নরম সুরে রাজার সাথে কথা বলছে সে। কুয়াশা মৃদু হাসল রানীর দিকে তাকিয়ে। পরিবর্তে | মিষ্টি হাসি উপহার দিল রানী।
লেসার গান নিয়ে ফিরে এল একজন হাহা।
রাজা সেটা নিজের হাতে নিয়ে কি যেন বলল। ইয়াজুদি তাকাল কুয়াশার | দিকে, বলল, রাজা বলছেন তার সম্মানিত মেহমান মি. ডেভিডও একজন জাদুকর। আপনি তাকে শয়তান বললেও রাজা তা মেনে নিতে পারছেন না। রাজার কথা হলো দুই জাদুকর আপনি এবং মি. ডেভিড পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় নামুন। প্রতিযোগিতায় যে জিতবে তাকেই বড় জাদুকর হিসেবে স্বীকার করে নেবেন রাজা। যে হারবে তাকে মরতে হবে।’ | কুয়াশা জানাল, আমি রাজার প্রস্তাবে রাজি আছি। ডেভিডকে চ্যালেঞ্জ করছি। আমি। রাজা ওর হাতেই জাদুদণ্ড দিন। মন্ত্র পড়ে জাদুদণ্ডের সাহায্যে ডেভিড আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করুক।’ | ডেভিড কুয়াশার প্রস্তাবে রাজি হলো না। সে বলল, ‘জাদুদণ্ডটা কুয়াশার
ভলিউম ১৪
আমার নয়। আমি আমার জাদুদণ্ড ব্যবহার করতে চাই।’
সে অধিকার ডেভিডকে দিতে রাজি হলো কুয়াশা। ডেভিডের নির্দেশে একজন হাহা একটা রাইফেল নিয়ে এসে দিল তার হাতে । | রাইফেল দেখে কুয়াশা আপত্তি করল। রাজার উদ্দেশে সে বলল, রাইফেল হলো একটা আগ্নেয়াস্ত্র । ওটা কোন জাদুদণ্ড নয়। রাইফেল ব্যবহার করে যে-কোন লোক যে-কোন লোককে খুন করতে পারে, আহত করতে পারে। রাজা, আপনি কি
একটা বর্শাকে জাদুদণ্ড রলেন? একটা বর্শা যদি জাদুদণ্ড না হয় তাহলে একটা রাইফেলও জাদুদণ্ড নয়।
রাজা মাথা দোলাল। কুয়াশার যুক্তি মনঃপুত হয়েছে তার।
ডেভিড বলল, রাইফেল যদি জাদণ্ড না হয় তাহলে রাজার হাতে যেটা রয়েছে সেটাও জাদুদণ্ড নয়। কেননা ওটাও রাইফেলের মত দেখতে। এটার কাজও নিশ্চয়ই রাইফেলের মত।
কুয়াশা বলল, ল, ওটার কাজ রাইফেলের মত নয়।’ ডেভিড জানতে চাইল, তাহলে ওটার কাজ কি রকম?’
কুয়াশা বলল, ‘ওটার কাজ কি তা বললে আমার মন্ত্র গুণ হারিয়ে ফেলবে। জাদুদণ্ডও কাজ করবে না। তবে রাজাকে গোপনে আমি কথাটা জানাতে পারি।’
রাজা কুয়াশাকে নিয়ে মঞ্চের একধারে চলে এল। সঙ্গে এল হাসান-আল ইয়াজদি।
কুয়াশা জানাল, আমার জাদুদণ্ডের দ্বারা আমি ডেভিডকে বাতাসের সাথে মিশিয়ে দিতে পারি। কেউ তাকে দেখতে পাবে না। হঠাৎ সে মিলিয়ে যাবে বাতাসে।’
রাজা মাথা নেড়ে স্বীকার করল, “হ্যাঁ, এটা জাদুর দ্বারাই সম্ভব। রাইফেল বা বর্শা এরকম অত্যাশ্চর্য কাজ করতে পারে না। একমাত্র জাদুদণ্ডের দ্বারাই তা সম্ভব।’
| ওরা আবার পূৰ্ব্বে জায়গায় ফিরে এল।
ডেভিড বলল, ঠিক আৰ্ছে, আমি কুয়াশার জাদুদণ্ড হাতে নেব। দেখি ওটা দিয়ে । আমি কোন জাদু দেখাতে পারি কিনা।’
রাজা ডেভিডকে কুয়াশার লেসার গানটা দিল। ডেভিড কুয়াশার দিকে তুলে ধরল জাদুদণ্ড অর্থাৎ লেসার গান।
কেঁপে উঠল কুয়াশার বুক। ডেভিড কি এতক্ষণ ভান করছিল? খেলা করছিল তার সাথে? সে কি জানে লেসার গান অপারেট করতে? :
| লেসার গান ব্যবহার করতে শেখাটা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। লেসার রশ্মি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা দরকার, জানা দরকার গানের মেকানিজম সম্পর্কে দু’একটি খুঁটিনাটি।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুয়াশা ডেভিডের দিকে।
সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে ডেভিডের দিকে। কুয়াশা ৪০
৪৫
রানী তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। তার চোখে শঙ্কা ফুটে উঠেছে। রাজাও তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। নির্বিকার মুখ তার। কি যে ভাবছে বোঝার উপায় নেই।
ডেভিড লেসার গানের লকটা নাড়াচাড়া করছে। হেসে ফেলল কুয়াশা। ডেভিড যে লেসার গান চালাতে জানে না তা সে ধরে ফেলেছে। লক খোলার আগে ছোট একটা বোতামে চাপ দিয়ে লকের ট্রিগারটাকে গুপ্তস্থান থেকে বাইরে বের করার ব্যবস্থা করতে হবে সবচেয়ে আগে। কুয়াশা বোতামটার নাম দিয়েছে সিক্রেট বাটন। সেটা আবার একটি গর্তের ভিতর লুকানো আছে। গর্তটা সহজে চোখে পড়বার মত জায়গায় নেই।
কুয়াশা বুঝতে পারল ডেভিড সিক্রেট বাটনের অস্তিত্বের কথা জানে না।
রাজাকে কুয়াশা জানাল, ডেভিড আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমি ওর চেয়ে অনেক বড় জাদুকর। মন্ত্র পড়ে জাদু শক্তি আমি নষ্ট করে দিয়েছি।’
ডেভিডের চোখ-মুখ কালো হয়ে গেছে। লেসার গান নিয়ে অকারণে নাড়াচাড়া করছে সে। হঠাৎ ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল কুয়াশার।..
কুয়াশার কোমরের কাছ থেকে যান্ত্রিক ধ্বনি বেরিয়ে আসছে-কির-কির কিরকির, কির-কির কিরকির।
রাজা পিছিয়ে গেল এক পা। ভয় পেয়েছে সে।
কোমর থেকে বের করল কুয়াশা মিনি ওয়্যারলেসটা। কানের কাছে সেটা তুলে ধরে মেসেজ রিসিভ করার জন্যে অতি ক্ষুদ্র একটা বোতাম টিপল সে।
ভেসে এল রাসেলের কণ্ঠস্বর, ‘মি, কুয়াশা?’
বলছি।’ রাসেল বলল, আপনি কি বন্দী হয়েছেন হাহাদের হাতে?’ ‘প্রায় তাই। কিন্তু তুমি কোথা থেকে বলছ?
রাসেল বলল, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমরা আধঘন্টার মধ্যে আক্রমণ করছি হাহাদের এলাকা।’
বলো কি?
“ঠিকই বলছি। আমার সঙ্গে পনেরো বিশ হাজার জংলী রয়েছে। হাহারা সংখ্যায় কত?’
কুয়াশা হেসে বলল, ‘সংখ্যায় ওরা বেশি নয়। বড় জোর ছয়-সাত হাজার।
সাত-হাজার! অসম্ব! আপনি কি ঠাট্টা করছেন?’
কুয়াশা বলল, না, সত্যি কথাই বলছি। তুমি এখানে এলেই সব দেখতে পাবে। সম্ভবত হাহারা তোমাদেরকে বাধাই দেবে না। বিনা যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে নেবে।’
‘এসব কি বলছেন আপনি! আপনার কি মাথা•••।’
ভলিউম ১৪
৪৬
কুয়াশা বলল, মাথা আমার ঠিকই আছে। রাসেল জিজ্ঞেস করল, আপনি কি গুরুতর বিপদে পড়েছেন?
তা পড়েছি। তবে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
চিন্তা করবেন না। ওদেরকে আধঘণ্টা ঠেকিয়ে রাখুন কোন মতে। আমরা আধঘণ্টার মধ্যে আপনাকে উদ্ধার করার আশা করছি।’
‘ হেসে ফেলে কুয়াশা বলল, ঠিক আছে।’
সেট অফ করে সেটা আবার কোমরে গুঁজে রাখল কুয়াশা । রাজা জানতে চাইল, ব্যাপার কি?’
কুয়াশা জানাল, ব্যাপার গুরুতর। জাদুর বদৌলতে আমি আমার ওস্তাদের সাথে কথা বলাম। ওস্তাদ আমাকে জানালেন যে হাহাদের সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ। বনভূমির জংলীরা আজ রাতের মধ্যেই আক্রমণ করবে হাহাদেরকে। সংখ্যায় তারা পনেরো বিশ হাজার।
কালো হয়ে গেল রাজার চোখ-মুখ।
ডেভিডের হাত থেকে লেসার গান নিয়ে নিল রাজা। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে সে বলল, এবার আপনি আপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করুন।’
কুয়াশা লেসার গান হাতে নিয়ে সিক্রেট বাটনের গর্তে আঙুল ঢুকিয়ে চাপ
দিল।
লকের ট্রিগার বেরিয়ে এলো ক্লিক করে একটা শব্দ করে। লেসার গান ধরল কুয়াশা ডেভিডের দিকে।
| ডেভিডের পিছন দিকে কেউ আছে কিনা দেখে নিয়ে রেঞ্জ ঠিক করে নিয়ে ট্রিগারে চাপ দিল কুয়াশী।
| চোখের পলকে অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটে গেল। ডেভিড যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে সে নেই। চোখের পলকে সকলের দৃষ্টির সামনে থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছে সে।
হাত তালির শব্দে সকলের সংবিৎ ফিল। । রানী কুয়াশার প্রশংসা করছে হাত তালি দিয়ে।
রাজা নত হয়ে দাঁড়াল কুয়াশার সামনে। বলল, আপনি অবশ্যই শ্রেষ্ঠ জাদুকর। আপনার প্রাপ্য সম্মান দিতে আমি বাধ্য। এখন থেকে আপনি আমার সম্মানিত মেহমান। আপনি আমাদের মঙ্গলের জন্যে আপনার জাদুশক্তি ব্যবহার••!’
| রাজার কথা শেষ হবার আগেই অকস্মাৎ চারদিক কাঁপিয়ে একযোগে সভাগৃহের বাইরে এবং ভিতরে বেজে উঠল অনেকগুলো ড্রাম।
ড্রামের গুরুগম্ভীর আওয়াজে কান পাতা দায় হয়ে উঠল। রাজা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সভাগৃহে প্রবেশ করছে সশস্ত্র হাহারা। কুয়াশা ৪০,
খানিক পর ড্রামের শব্দ থামল।
সভাগৃহে জড়ো হয়েছে প্রায় হাজার খানেক যোদ্ধা। তারা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে রাজার দিকে।
কিন্তু রাজা তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে।
রাজা বলল, ড্রাম বাজার একটাই অর্থ। শত্রুরা আক্রমণ করতে আসছে জানতে পারলেই কেবল ড্রাম বাজানো হয়। আপনার কথাই ঠিক। জংলীরা সত্যি সত্যি আক্রমণ করতে আসছে।’
কুয়াশা মৃদু হাসল। একটা হাত আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে উপর দিকে তুলে সে । বলল, ভয় নেই। আমি জাদুকর। জংলীদেরকে শান্ত করার ক্ষমতা আমার আছে।’
| আশ্বাস পেয়ে রাজার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলতে শুরু করল, রাতারাতি হাহারা প্রায় অর্ধেকই মারা গেছে। বেঁচে আছে যারা তাদেরও অনেকেই অসুস্থ। এ-রকম মহাবিপদে হাহারা যুদ্ধ করতে পারে না। অথচ আত্মসমর্পণ করারও কোন মানে হয় না। কারণ জংলীরা হাহাদেরকে পেলে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ‘
কুয়াশা বলল, জংলীদেরকে সমূলে ধ্বংস করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি জাদুকর হলেও কারও ক্ষতি করতে পারি না। আমার জাদুশক্তি কেবল ভাল কাজ করার জন্য ব্যবহার করা চলে। রাজা, আপনি যদি রাজি হন তাহলে আমি জংলীদেরকে মন্ত্র দিয়ে বশ করে আপোস করার জন্যে রাজি কাতে পারি।’
কি রকম আপোস?’ সাগ্রহে জানতে চাইল রাজা।
আপনাকে হাহাদের তরফ থেকে কথা দিতে হবে যে ভবিষ্যতে হাহারা জংলীদের ওপর অত্যাচার করতে পারবে না, আক্রমণ করতে পারবে না। জংলীদের সাথে একত্রে বনভূমি, মরুভূমি এবং পার্বত্য এলাকা ভাগাভাগি করে বসবাস করতে হবে। জংলীরা এবং হাহারা পরস্পরকে ভাই বলে মনে করবে। জংলীদের মেয়েদের সাথে হাহাদের ছেলেদের এবং হাহাদের মেয়েদের সাথে জংলীদের ছেলেদের বিয়ে দিতে হবে।’
রানীর সাথে পরামর্শ করল রাজা। রানী মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। কুয়াশার প্রস্তাবে রাজি হলো রাজা।
কুয়াশা বলল, ‘পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে আমি সকল হাহাকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে পারি। কিন্তু তা করার আগে আমার কয়েকটা শর্ত মেনে নিতে হবে।’
রাজা জানতে চাইল, কি শর্ত?’
কুয়াশা বলল, হাহাদের হাতে যে-সব বন্দী আছে তাদেরকে রিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে। হাহাদের মধ্যে যে নিয়ম আছে তা উঠিয়ে নিতে হবে। নরবলি দেয়া। চলবে না। মানুষের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে।’
| রানীর পরামর্শ নিয়ে রাজা কুয়াশার শর্তগুলো বিনা দ্বিধায় মেনে নিল। “ মিনি ওয়্যারলেস বের করে কুয়াশা রাসেলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করল।
ভলিউম ১৪
৪৮
–
=
“কি সংবাদ, মি. কুয়াশা। উত্তেজিত শোনাল রাসেলের গলা। কুয়াশা বলল, ‘খবর ভাল। তোমরা এখন কোথা?
‘আমরা আর মাইল খানেক এগোলেই হাহাদের পাহাড়গুলোর কাছাকাছি পৌঁছে যাব।’
| ‘পাহাড়ের কাছে আর পৌঁছুবার দরকার নেই। তোমরা যেখানে আই সেখানেই থামো। আমি হাহাদের রাজা এবং রানীকে নিয়ে তোমাদের কাছে আসছি।
সে কি!”
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ। যুদ্ধ করে লাভ নেই বুঝিয়েছি আমি রাজাকে। তাতে শুধু রক্তপাতই ঘটবে। আপোস করতে রাজি আছে রাজা।
আপোসের শর্তাবলী জানাল কুয়াশা রাসেলকে। তেইশজন জংলী সর্দারের সাথে পরামর্শ করে কুয়াশাকে জানাল, জংলী সর্দাররা সবাই আপোসে রাজি আছে।’
ওয়্যারলেস সেট যথাস্থানে রেখে কুয়াশা রাজাকে তিনটে তেজি ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে বলল।
পনেরো মিনিট পর কুয়াশা রাজা ও রানীকে নিয়ে সারবন্দীভাবে দণ্ডায়মান জংলীদের সামনে এসে থামল।
আধঘন্টা আলাপ আলোচনার পর তেইশজন সর্দার এবং রাসেল হাহাদের সভাগৃহ অভিমুখে যাত্রা করল।
সভা গৃহ থেকে ঢলে পড়া হাহাদেরকে সরিয়ে অন্যত্র রেখে আসা হলো। সভা.বসল সম্ভগৃহে।, ঝাড়া দুঘন্টা আলাপ আলোচনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে জংলী এবং হাহাদের মধ্যে বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব এবং সম্প্রীতিমূলক চুক্তি সম্পাদিত হলো। তেইশজন সর্দার এবং রাজা যার যার কড়ে আঙুল কেটে রক্ত জমা করল একটি পাত্রে। সেই রক্ত দিয়ে রাজা সর্দারদের কপালে টিপ পরিয়ে দিল। সর্দারদের মধ্যে একজন টিপ পরাল রাজার কপালে।
ঠিক হলো হপ্তাব্যাপী উৎসবের আয়োজন করা হবে। চুক্তি সম্পাদন শেষ হবার র সর্দাররা রাজার সাথে খোশ-গল্পে রত হলো।
কুয়াশার নির্দেশে একদল হাহা বন্দীদেরকে মুক্ত করে সভাগৃহে নিয়ে আসার জন্যে রওনা হলো।
রাসেল কুয়াশার পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, এমন অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড কিভাবে ঘটালেন? একশো শূকরের দশাই বা কি হলো?’
কুয়াশা মৃদু হেসে বলল, ‘একশো শূকরের প্রাণের বিনিময়ে অনেক বড় কাজ হয়েছে। আমার আবিষ্কৃত একটা পয়জন শূকরগুলোর শরীরে প্রবেশ করিয়ে
৪-কুয়াশা ৪০
৪৯
দিয়েছিলাম। কয়েক মিনিটের জন্যে জ্ঞান হারিয়েছিল তারা। কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসে আবার। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও শূকরগুলোর মাংস বিষাক্ত হয়ে যায়। ওই বিষ শূকরগুলোর কোন ক্ষতি করেনি। কিন্তু যারা ওই শূকরের মাংস খেয়েছে তারা সবাই ছয় ঘণ্টার জন্যে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
অদ্ভুত! কিন্তু একশো শূকরের মাংস কি কয়েক হাজার হাহার জন্যে যথেষ্ট? হাহারা কি সবাই খেয়েছে শূকরের মাংস?’
| ‘খায়নি। ব্যাটারা এক একজন যে পরিমাণ মাংস খায় তাতে একশো শূকর তো একশোজন হাহাই খেয়ে শেষ করে ফেলতে পারে।’
তাহলে কি ভাবে হাজার হাজার হাহাকে অজ্ঞান করলেন আপনি? | ‘এক্স-এম টু-থ্রি কম্পাউণ্ড দিয়ে। জিনিসটা ছোট একটা মারবেলের মত দেখতে। ক্ষুদ্র একটা বোতামও আছে ওগুলোর গায়ে। বোতাম টিপে প্রায় প্রতিটি গুহায় একটা করে এক্স-এম-টু-থ্রি কম্পাউণ্ড। বোম ফেলে দিয়েছিলাম আমি। এগুলো কিন্তু ফাটে না। বোতাম টিপার পর থেকে চোখে দেখা যায় না এমন ধরনের বিষাক্ত গ্যাস বের হতে থাকে ভিতর থেকে। এই গ্যাস যার বুকে ঢুকবে সেই-ই ছয় ঘণ্টার জন্যে জ্ঞান হারাবে। এখন বুঝতে পারছ আসল রহস্য?’
সপ্রশংস দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থেকে রাসেল বলে উঠল, জলের মত। এক্স-এম-টু-থ্রি কম্পাউণ্ডও নিশ্চয় আপনার আবিষ্কার?’ |
মৃদু হেসে কুয়াশা বলল, হ্যাঁ।’
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে কুয়াশা বলল, ‘হাহাদের কাছে কি সব যন্ত্র আর মেশিন আছে জানো? ক্রেন, ট্রাক্টর, ট্রাক, ডায়নামো, গভীর নলকূপ বসাবার ভারী যন্ত্রপাতি•••’।
‘বলেন কি! আপনার দারুণ কাজে লাগবে তাহলে ওগুলো, তাই না? ইউরেনিয়াম সংগ্রহকরার জন্যে এগুলোর মধ্যে কাজে লাগবে অনেক জিনিস।
কুয়াশা বলল, লাগবেই তো। এমন সময় রানী তার একজন সহচারীকে নিয়ে হাজির হলো সামনে। মিষ্টি সুরে নিজেদের ভাষায় কি যেন বলল সে। তারপর ইঙ্গিতে বলল, আপনারা আমার সাথে অন্দর মহলে চলুন। আপনাদেরকে আমি নিজের হাতে খাওয়াব।’ ।
রানীর সাথে যেতে যেতে রাসেল সহাস্যে কুয়াশাকে বলল, “খেতে তো যাচ্ছি। কিন্তু শূকরের মাংস চিনব কি ভাবে?’
কুয়াশা বলল, একটু বুদ্ধি খরচ করলেই চিনতে পারবে।’
সে কেমন?’ মৃদু হেসে কুয়াশা বলল, “চিন্তা করে দেখো।
রাসেল চিন্তা করে বলল, বুঝেছি। আপনি যে মাংস খাবেন না আমিও সেটা খাব না। তাহলেই বিষক্রিয়ার হাত থেকে বাঁচব। তাই না?’
তাই,’ কুয়াশা বলল।
Leave a Reply