৩৯. অরণ্য রাজ্য ২ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৩৯
প্রথম প্রকাশঃ জুলাই, ১৯৭৩
এক
বৃদ্ধ মঁসিয়ে মূরকোট থরথর করে কাঁপছেন। ঠোঁট জোড়া নড়ছে তাঁর। কি যেন ফিসফিস করে বলার চেষ্টা করছেন তিনি। কুয়াশার মাত্র দু’হাত সামনে প্রকাণ্ড দৈত্য
জোনজ। কুয়াশার চেয়ে কমপক্ষে তিনগুণ বড় দেহ।
জোনার বিকট অট্টহাসিতে চারদিক প্রকম্পিত। সেই সাথে নিজের বুকে আধষণ ওজনের ঘুসি মারছে সে। ঢাক-ঢোল বাজছে যেন। | ইট্টমেন্ট প্যানেলের উপর একটা হাত কুয়াশার। কিন্তু তাকিয়ে আছে সে । জোনঞ্জার দিকে।
| এদিকে সঁসিয়ে মূরকোট পিছন থেকে কাপ পায়ে এগিয়ে আসছেন জোনার দিকে।
| দুর্বোধ্য ভাষায় গর্জন করছে জোনজা। কখনও সে হেসে উঠছে, কখনও দমাদম ঘুসি মারছে বুকে। দাঁতে দাঁত চাপছে অকারণ আক্রোশে। কট কটু করে শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ বিপুল বেগে মাথা নাড়ছে। মুখ নেড়ে, বড় বড় হলুদ দাঁত রে করে কুয়াশাকে সামনে বাড়তে বলছে! নাকেমুখে রক্ত জোনজার। পরনে কোন পোশাক নেই। উদোম গা। সারা গায়ে শুকনো রক্ত। বড় বড় নখের ভিতর কাঁচা মাংস, চর্বি। সারা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। টেনিস বলের মত বড় বড় দুটো লাল চোখ থেকে যেন আগুন বেরুচ্ছে ঠিকরে।
ঘরের দরজার বাইরে প্রকাণ্ড উঠান। আহত এবং নিহত রক্তাপ্লুত জংলীদের বীভৎস লাশ উঠানের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। সুস্থ একজন জংলীকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও! ঘরের ভিতর লুকিয়েছে তারা। অনেকে প্রাণের ভয়ে গ্রামের বাইরে উঁচু গাছের মগডালে চড়ে বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে আছে এদিকে,
রাসেলকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। জোনজা তাকে মাথার উপর তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে খানিক আগে। ডালপালা আর গাছের শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি ঘরের চালে গিয়ে পড়েছিল ও। সেখানে এখন নেই রাসেল ।
• ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের বোম টিপছে কুয়াশা একটার পর একটা । জোনার মাথার ভিতর ফিট করা রিসিভিং সেটে রেডিও ওয়েভ পাঠাবার অক্লান্ত চেষ্টা করছে
সে। এক একটা বোতাম টিপছে আর জোনজার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছে।
ভলিউম ১৩
কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শান্ত হবার কোন লক্ষণ নেই জোনজার মধ্যে।
আরও এক পা এগোল জোনজা।
নিরস্ত্র কুয়াশার চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠছে আস্তে আস্তে। জীবনে এই প্রথম ভয় পেল কুয়াশা। জোনজাকে ইচ্ছা করলে হত্যা করা যায়। কিন্তু জোনজাকে হত্যা করা মানে ড. মূরকোটকে হত্যা করা। জোনজা মারা গেলে শোক কাটিয়ে উঠতে পারবেন না ড. মূরকোট। সারা জীবনের কঠোর ত্যাগ, নিরলস সাধনা এবং অমানুষিক পরিশ্রম করে তিনি তৈরি করেছেন, জোনজাকে। চীন দেশে যাযাবর খিরগিজ আমা সম্প্রদায়ের সাথে পাঁচ বছর কাটিয়েছেন তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে।
খিরগিজেই বসবাস করত খিরগিজ আমার সম্প্রদায়। কিন্তু পরে তারা চীন দেশে বসতি স্থাপন করে যাযাবরের জীবন ত্যাগ করে। এই খিরগিজ আমারাই প্রথম। আবিষ্কার করে এই মানুষাকৃতি দৈত্য। খিরগিজ আমারা শল্য চিকিৎসার যাদুকর হিসেবে পরিচিত। তারা পিটুইটারী গ্ল্যাণ্ডটাকে বিশেষ এক প্রক্রিয়ায় উত্তেজিত করে বড় করে তোলে। এর ফলে এক রোগের উৎপত্তি হয় মানবদেহে। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে তার নাম দেয়া হয়েছে জাইগ্যান্টিজম। এই রোগে আক্রান্ত লোক তার স্বাভাবিক চেহারার চেয়ে দু’ণ বা চারগুণ বড় হয়ে যায়। দৈত্যের মতন বড় দেখায় তাকে। কিন্তু প্রকাণ্ড দেহের অধিকারী হলেও লোকটা তত ভয়ঙ্কর, হিংস্র শক্তিশালী হয় না। তাই আধুনিক বিজ্ঞান সাধক ড. মূরকোট জাইগ্যান্টিজম। প্রক্রিয়াটাকে আরও উন্নত করে জোনার দেহের লম্বা হাড়গুলো শক্ত না হওয়া। অবধি গ্ল্যাণ্ডটাকে বেশি ঘাটাননি। গ্ল্যাণ্ডটাকে না ঘটিয়ে তিনি acroegoly stage-এ নিয়ে আসেন। এরই ফলে তৈরি হয়েছে তাঁর নতুন আবিষ্কার সুপারম্যান-জোনজা।
. জোনার দৈহিক ক্ষমতা সম্পর্কে কুয়াশার কোন সন্দেহ নেই। কারও বুকে একটা পা রেখে শুধুমাত্র দেহের ভর দিয়ে দাঁড়ালেই হাড়গোড় গুঁড়ো করে তার মত চ্যাপ্টা করে দিতে পারে জোনজা। কারও মাথায় একটা ঘুসি মারলে মাথার খুলি । চার দু’গুণে আট টুকরো করে দিতে পারে অনায়াসে। পিঠে লাথি মারার সাথে সাথে ভেঙে দিতে পারে শিরদাঁড়া। পাঁচজন লোককে একসাথে ধরে শূন্যে তুলে ঘোরাতে পারে বনবন করে ।
দুশ্চিন্তার রেখা কুয়াশার কপালে। কালো আলখাল্লার নিচে ত্বকের উপর দিয়ে ঘামের স্রোত নামছে নিচের দিকে। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে কপালে।
আর কোন পথ নেই। পালাবার কথা আর চিন্তা করাও যায় না। কুয়াশা পারবে না জোনার সাথে দৌড়ে।
শক্তি পরীক্ষায় নামাটা আরও ভয়ঙ্কর হবে লড়ে জেতবার আশা নেই বললেই চলে। তবে বুঝতে পারবে কুয়াশা খানিকক্ষণ। কিন্তু কুয়াশার উভয় সংকট। চরম
কুয়াশা ৩৯
আঘাত যে আগে হানবে সেই জিতবে। জোনজাকে হত্যা করা চলবে না। অথচ নিজের প্রাণও রক্ষা করতে হবে।
কিন্তু দুটো সফলতা এক্ষেত্রে অর্জন করা অসাধ্য ব্যাপার। যে কোন একটা পথ বেছে নিতে হবে কুয়াশাকে। এখুনি।
ড. মূরকোট জোনার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। নিচু, কাঁপা, করুণ গলায় তিনি জোনজাকে শান্ত হবার অনুরোধ জানাচ্ছেন। জোনজা ফিরেও তাকাচ্ছে না।
কাঁপা হাত দুটো উপর দিকে তুললেন ড. মূরকোট। দুচোখ ভরা জল তার। জোনার কাঁধ অবধি নাগাল পেলেন না তিনি! আলতো ভাবে হাত রাখলেন তিনি জেনজার পিঠে।
সবেগে বাঁ হাত দিয়ে পিছন দিকে ঝাপ্টা মারল জোনজা। ভয়ঙ্কর অট্টহাসিতে কেঁপে উঠল চারদিক। ছিটকে দরজা দিয়ে উঠানে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন ড. মূরকোট। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।
| দমাদম ঘুসি মারল জোনজা নিজের বুকে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ড, মূরকোটের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে আবার গর্জন করে উঠল সে।
মুহূর্তের জন্যে প্যানেলের দিকে তাকাল কুয়াশা। কালো একটা বড় বোতামে চাপ দিল সে। তাকাল জোনজার দিকে।
‘অ্যা-অ্যা-অ্যা–অ্যা-অ্যা:••!’
বিকট স্বরে কেঁদে উঠল জোনজা। তড়াক করে লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল এক পা। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে, থরথর করে কাঁপছে জোনজা নামের পাহাড়টা। দুটো হাত মুখের সামনে তুলে আতঙ্কিত ভঙ্গিতে আঙ্গুলগুলো ভাঁজ করছে আর ভাঁজ খুলছে জোনজা। অসহায়, ভীত ভাব ফুটে উঠেছে তার মুখের রেখায়, চোখের দৃষ্টিতে। হাত নাড়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ক্ষমা চাইছে সে। মুখ নাড়ার ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে পরিষ্কার প্রাণ ভিক্ষার আবেদন।
| বিদঘুঁটে স্বরে আবার কেঁদে উঠল জোনজা। তড়াক করে লাফ দিয়ে আরও একপা পিছিয়ে গেল।
| কুয়াশা বড় কালো বোতামটা চেপে ধরে রেখেছে। প্রতিক্রিয়া ঘটছে, বুঝত্রে পারছে কুয়াশা। সাফল্যের উজ্জলতা ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে। একটা বোম অন্তত পাওয়া গেছে, যেটা জেনজার মাথার ভিতর ফিট করা রিসিভিং
সেটে রেডিও ওয়েভ পাঠাতে সক্ষম।
রাসেলকে দেখা গেল দরজার বাইরে ড. মূরকোটকে তুলে নিয়ে সরে যাচে সে। হঠাৎ আবার দুর্বোধ্য স্বরে ককিয়ে উঠল জোনজা। বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়া সে। ছুটল।
ঘরের দরজার দিকে গেল না জোনজা। দেয়ালে গিয়ে বন্য হাতির মত ধাৰ।
ভলিউম ১
দিল সে। ভেঙে পড়ল দেয়াল। দেয়াল ভেদ করে তীরের মত বেরিয়ে গেল জোনজা বাইরে।
: বিকট স্বরে কাঁদতে কাঁদতে, আর্তচিৎকার করে ছুটছে, জোনজা।
ড. মূরকোটকে ছেড়ে জোনজার পিছু পিছু তেজি ঘোড়ার মত ছুটতে শুরু করল রাসেল।
দ্রুত ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল কুয়াশা। বজ্রকণ্ঠে সে চিৎকার করে বলল, ‘ফিরে এসো, রাসেল! ওকে তুমি রতে পারবে না।
কিন্তু দেখতে দেখতে তীরবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল রাসেল ঘন জঙ্গলে। চিন্তিত ভাবে ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। ড, মূরকোট সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ‘কোথায় লেগেছে আপনার, ড. মূরকোট?’ কুয়াশা প্রশ্ন করল।
চোখ ভরা পানি নিয়ে দুহাত দিয়ে কুয়াশাকে আলিঙ্গন করলেন ড. মূরকোট। কাঁপছেন বৃদ্ধ। কিন্তু ভয়ে নয়, আনন্দে।
বললেন, ‘আপনার ঋণ সারা জীবনেও শোধ করতে পারব না আমি, ড, কুয়াশা। আপনিই আমার একমাত্র শুভানুধ্যায়ী।
‘ছেলেটা কে?’ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে একদিকে আঙুল তুলে দেখাল কুয়াশা, খুব সুন্দর তো!’ | উঠানের এক কোনা থেকে বারো তেরো বছরের একটি স্বাস্থ্যবান কিশোর এক গাল হাসি নিয়ে ছুটে আসছে।
যোশান রোম!’ বললেন ড. মূরকোট, আমার ছেলে। ওর মা ওকে একমাসের রেখে মারা গেছে।
| ছেলেটার বড় ভাল স্বাস্থ্য। বারো-তেরো বছর বয়স, সুন্দর, কিন্তু দেখতে আঠারো-উনিশের মত। বাপের মতই দেখতে। খাড়া নাক। বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চঞ্চল চোখ। উদোম গা! পরনে লতাপাতার আচ্ছাদন। কাঁধ অবধি তেলহীন কটা রঙের চুল। বাপের পাশে এসে দাঁড়াল রোম।
কুয়াশাররামের কাঁধে হাত রাখল, জোনজার ভয়ে পালিয়েছিলে বুঝি?
না,’ রোম বুক ফুলিয়ে বলল, “পালাইনি। বাবার হিকচিকরা আমাকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, আপনি কে? উ, কুয়াশা?’
কুয়াশা মাথা নাড়ল।
বোম বলল, বাবা প্রায়ই আপনার কথা বলেন। আমার অ্যামবিশন কি ছিল। জানেন?’
“কি?’দু’চোখে কৌতুক কুয়াশার । রোমকে বড় ভাল লাগছে তার। কাছে টেনে নিল সে রোমকে। ৭-কুয়াশা ৩৯
আমার টারজান হবার ইচ্ছা ছিল,’ বলতে লাগল রোম, কিন্তু বাবার কাছে আপনার কথা শুনতে শুনতে আমি এমনই মুগ্ধ হয়েছি যে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাকে আপনার মত হতে হবে।’
| ‘আমি আশীর্বাদ করছি তুমি আমার চেয়ে অনেক বড় হও,’ কুয়াশা হেসে ফেলে। বলল।
গম্ভীর হয়ে উঠল রোম। গলা ভারি করে বলল, আমি জানি আপনার মত হতে চাওয়াটা সহজ নয়। সারাজীবন আমাকে সাধনা করতে হবে।’
কুয়াশা বলল, চেষ্টা করলে আমার চেয়ে বড় হতে পারবে তুমি, রোম।’
হ্যাঁ, বাবা তাই বলেন।’ রোম বলল, ‘জানেন, জোনজাকে আমি একটুও ভয় করি না। ইচ্ছা করলে ওকে মেরে ফেলার একটা উপায় ব্বে করতে পারি আমি। কিন্তু না, তা আমি সত্যি সত্যি পারি না। কেন জানেন? জোনজা আমার না হলেও, আপার বন্ধু ছিল। সেজন্যে আমি ইচ্ছা করলেও পারি না ওর কোন ক্ষতি করতে, তাছাড়া বাবা চান না।
কুয়াশা রোমের মাথার চুলে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, তোমার আপামণিকে তুমি বুঝি খুব ভালবাসো?’ .. ।
. আমি আর কত ভালবাসি, আপা আমাকে অনেক বেশি ভালবাসে…।
হঠাৎ মনোযোগ সরিয়ে ফেলল কুয়াশা নোমর উপর হতে। আড়চোখে তাকাল ও চারপাশে।
ভুরু কুঁচকে তাকাল কুয়াশা ড. মূরকোটের দিকে। ড. মূরকোট পিছন ফিরে তাকিয়ে আছেন।
উঠানের চারধারে জংলীদের ঘর। ঘরের ভিতর থেকে শত শত জংলী ঢাল তরোয়াল, বর্শা, তীর, ধনুক ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে আসছে।
আস্তে আস্তে চারধার থেকে ঘিরে কুয়াশার দিকেই এগিয়ে আসছে জংলীরা । ‘ ব্যাপার কি?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।
ড, মূরকোট ফিরে তাকালেন। বিস্মিত হয়েছেন তিনিও। রোম অস্ফুটে বলে উঠল, ‘বাবা!’
জংলীদের কারও মুখে কোন কথা নেই। তারা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকের চোখ-মুখ থমথম করছে। নিঃশব্দে, সরাসরি কুয়াশায় দিকেই
এগিয়ে আসছে সবাই।
| লেসার গান এবং কাঁধের ব্যাগটার কথা মনে পড়ল কুয়াশার। ঘরের ভিতর ওগুলো আছে। দরকার পড়বে এখুনি হয়তো। কিন্তু নড়াচড়া করা কি উচিত হবে?
জংলীরা কি কুয়াশাকে শত্রু হিসেবে মনে করেছে?
ড. মূরকোট চিৎকার করে উঠলেন, আলখালনল হিকচিক বাগডুম আগডুম। আম্পা জাপা মাল পো?’
৯৮।
ভলিউম ১৩
হিকচিক মানে, জংলীদের ভাষায়, বন্ধু। জংলীদের সর্দারের উদ্দেশ্যে ড, মা-কোট বললেন, তারা কি তার নবাগত বন্ধুকে গ্রহণ করতে রাজি নয়? তারা কি তাকে হত্যা করতে চায়?
| জংলীদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। তারা ভুলেও তাকাল না ড. রকোটের দিকে। শত শত জংলীর দৃষ্টি কুয়াশার উপর নিবদ্ধ। কেউ টু শব্দটিও রিল না । ড. মূরকোটের কথা যেন তারা শুনতেই পায়নি। সরাসরি এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে তারা।
অসহায়ভাবে তাকালেন ড. মূরকোট কুয়াশার দিকে। কুয়াশা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
‘আগে কখনও তো এমন হয়নি। আমাকে এরা শ্রদ্ধা করে। আমাকে না জানিয়ে কিছুই করে না। সব ব্যাপারে আমার প্রামর্শ নেয়। সর্দার আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ
বন্ধু।’
কথাগুলো বলে ড, মূরকোট আবার জংলীদের সর্দারের দিকে তাকালেন। তারপর চিৎকার করে বললেন, ‘হাফুলা বাগডুম-আগডুম হিকচিক তেই তেই তেই পা তাপে তাপো। আমার বন্ধুর কোন ক্ষতি করতে পারবে না তোমরা। তার আগে আমাকে খুন করতে হবে।’
আশ্চর্য! ড, মূরকোটকে জংলীরা যেন চেনেই না। ফিরেও তাকাল না কেউ র দিকে। | কাছে এসে পড়েছে জংলীরা চারধার থেকে। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর। কি ঘটতে ||চ্ছে বলা যায় না। এতগুলো সশস্ত্র লোকেন্দ্র সাথে একা পেরে উঠবে না কুয়াশা। মংলীরা হঠাৎ যদি একযোগে আক্রমণ করে বসে তাহলে মৃত্যু অনিবার্য। অথচ সভ্য, জংলী, বুনো লোকগুলোর আচরণের মধ্যে, এমন একটা কিছু আছে যা গুণতে না পারলেও অনুভব করে কুয়াশা খানিকটা যেন সাহস পাচ্ছিল মনে।
সর্দার হাত পাঁচেক দূরে থাকতে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ল ‘। পিছনের এবং আশপাশের শত শত জংলী।
সর্দারের চেহারাটা ঋজু। সটান, বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কপালের সখান থেকে সোজা নাকের শেষ প্রান্ত অবধি পাশাপাশি লাল এবং কালো আধ ঞ্চি চওড়া রঙ মাখানো। ঠিক যেন লাল কালো ফিতে সেঁটে দেয়া হয়েছে। পরে ডান এবং বাঁ পাশ থেকেও রক্তের ফিতে নেমে এসেছে দু’গাল বেয়ে চিবুক মাধ। সর্দারের গলায় মুক্তোর মালা। পরনে লতাপাতার বদলে পাটের দড়ি দিয়ে
•|• আচ্ছাদন। সেটা পচ রঙে রঙ করা। লাল, হলুদ, কালো, সবুজ, নীল।
র্দারের হাতে লম্বা একটা বর্শা। স্পিলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সর্দার কুয়াশার দিকে। তাকিয়ে আছে জংলীরা ‘নাই। ‘শ ৩৯।
৯৯
চঞ্চল হয়ে উঠেছেন ড.মূরকোট। অসহায়ভাবে তিনি কুয়াশার দিকে একবার সর্দারের দিকে একবার তাকাচ্ছেন।
অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জংলী সর্দার চেঁচিয়ে উঠলেন, সামপা আমপা হিকলি । চিপচা চিপচু। শোলক মোলক কড়কড়া হুঁ আবচা নাবচু। ইকলুম তা না না । বিকলুম তা না না না।’
বিস্ময় ফুটে উঠল ড. মৃকোটের চোখে মুখে। ঘাড় ফিরিয়ে কুয়াশার দিন তাকিয়ে কি যেন বলতে চাইলেন তিনি।
কিন্তু বলা হলো না ড. মূরকোটের। সর্দার এক লাফে কুয়াশার মুখোমুখি এে দাঁড়াল।
সর্দারের দেখাদেখি শত শত জংলী হুমড়ি খেয়ে পড়ল কুয়াশার উপর আচমকা কুয়াশা কিছুই বুঝতে পারছিল না।
সর্দার কোমর থেকে গাথরের ধারাল একটা ছোট অস্ত্র কে করে কুয়াশার মুখে সামনে তুলে ধরে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। তারপর সেই অস্ত্র দিয়ে কে ফেলল তার হাতের খানিকটা মাংস। রক্ত বেরিয়ে এল কাটা জায়গা দিয়ে সবেগে সেই রক্ত ডান হাতের চেটোয় নিল সর্দার। তারপর হঠাৎ, বলা নেই কওয়া নেই হাত তুলে ঢেলে দিল কুয়াশার মাথার মাঝখানে।
বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করছে শত শত জংলী। যাদের মন্ত্র উচ্চারণ শে। হয়েছে তারা নিজের শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে রক্ত নিয়ে কুয়াশার মাথা। ঢালছে।
| প্রমাদ গুণল কুয়াশা। জংলীদের এই অদ্ভুত আচরণের কোন কারণ সে বুঝ পারল না। কিন্তু ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সবগুনে জংলী যদি এভাবে তার মাথায় রক্ত ঢালতে থাকে তাহলে রক্তে ভেসে যেতে হয় তাকে।
| ড. মূরকোট পাশেই ছিলেন। কিন্তু তাকে কোথাও দেখতে পেল না কুয়াশা সর্দারও কখন যেন অদৃশ্য হয়েছে।
চারদিক থেকে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে কুয়াশা। অবশ্যি একটি জিনিস লক্ষ করল সে জংলীরা চেষ্টা করছে যাতে তার গায়ে ধাক্কা না লাগে। কিন্তু চেষ্টা ব্য হচ্ছে। চারদিক থেকে ধাক্কা খাচ্ছে কুয়াশা। অস্বাভাবিক শক্ত মানুষ সে, তা। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে এখনও।
কুয়াশার মাথা, কপাল, গলা, কাঁধ, বুক, পিঠ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু এম উদ্ভট সমস্যায় পড়েও হাসি পেল তার।
যদিও হাসি ফুটল না কুয়াশার ঠোঁটে। হঠাৎ যে ভয়ানক গম্ভীর হয়ে উঠল ভারি গলায় সে বলে উঠল, সরে যাও তোমরা সবাই। অনেক হয়েছে, আর নয়।’
থমকে দাঁড়াল জংলীরা । কেউ এক চুল নড়ল না আর। এতটুকু শব্দ করল না ।
১০০
ভলিউম ১
সর্দারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, চামুক চামুক হুকড়া ভোলতাজ।’ |
পরমুহূর্তে প্রচণ্ড উল্লাসে হর্ষধ্বনি করে উঠল শত শত জংলী। আনন্দে নাচতে নাচতে কুয়াশার কাছ থেকে সরে যেতে লাগল তারা।
এদিক-ওদিক তাকাতে কুয়াশা দেখল ড. মূরকোট, রোম এবং সর্দার এগিয়ে আসছে তার দিকে। রোম দাঁত বের করে হাসছে।
| সবচেয়ে আগে কাছে এসে পঁাড়াল নোম। কুয়াশার রক্ত মাখা হাতটা ধরে সে চেঁচিয়ে উঠল, “আমাদের জংলীরা আপনাকে তাদের পূর্বপুরুষদের দেবতা বলে মনে করছে। তাদের ধারণা আপনি পূনর্জন্ম লাভ করে ওদের মঙ্গল করার জন্যে সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে এসেছেন।’
ড. মূরকোট পাশে এসে দাঁড়ালেন, ‘ওরা যা বলে তাই মেনে নেন, ড. কুয়াশা। এরা আপনার ওপর সরল বিশ্বাস পোষণ করছে তা ভেঙে দেয়ার চেষ্টা। করবেন না। ভয়ানক আঘাত পাবে তাতে। ওরা মনে করবে তাহলে সৃষ্টিকর্তা ওদের ওপর সন্তুষ্ট নন। আর একবার এ-ধরনের চিন্তা ওদের মনে জাগলে কি কাণ্ড শুরু হবে জানেন?
রোম বলল, আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না, ড. কুয়াশা। ওরা সবাই আত্মাহুতি দেবে আগুনে।’
হ্যাঁ,’ বললেন ড. মূরকোট, ‘সবাই আত্মহত্যা করে নিজেদের গোটা অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন করে ছাড়বে।’
কুয়াশা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল জংলী সর্দারের দিকে। কথা সরল না তার মুখে।
জংলী সর্দার ড. মূরকোটের উদ্দেশ্যে কি যেন বলল।
ড, মূরকোটও কি যেন বললেন জংলী সর্দারকে। তারপর কুয়াশার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘সর্দার জানতে চাইছে তারা যে আপনাকে তাদের পূর্বপুরুষদের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা বলে মনে করছে, তা কি সত্যি?
উত্তর দিতে পারল না কুয়াশা। প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে তার। কিন্তু হেসে ফেলাটা চরম বোকামি হবে মনে করে নিজেকে সামলে রাখল সে। মৃদুস্বরে বলল, কাজটা কি উচিত হচ্ছে?
| ড, মূরকোট জংলীদের ভাষায় সর্দারকে আবার কি যেন বললেন।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল প্রৌঢ় সর্দার। ড. মূরকোট জানিয়ে দিয়েছেন উত্তর। সর্দারকে তিনি বলেছেন, হ্যাঁ, তোমাদের ধারণাই ঠিক।’
পর্দারকে নাচতে দেখে শত শত জংলী ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে দিল।
পরিবেশ স্বাভাবিক হতেই কাজ এবং কর্তব্যের কথা মনে পড়ল কুয়াশার! ড. মূরকোটকে বলল, জংলীদেরকে বলুন তাদের সামনে ভীষণ বিপদ। তারা যেন কিছু দিনের জন্যে আনন্দ উৎসব বিসর্জন দেয়। এখন কাজের সময়। মন দিয়ে কাজ কুয়াশা ৩৯ “
১০১,
করলে বিপদ কেটে যাবে। | ড. মূরকোট সর্দারকে কথাগুলো জানালেন। সর্দারের নির্দেশে জংলীরা না থামিয়ে চুপ করে দাঁড়াল।
| কুয়াশা বলল, আমাকে পানির ব্যবস্থা করে দিতে বলুন। শক্ত সমর্থ দশজ লোককে তৈরি হতে বলুন। ডেভিডের আস্তানায় হামলা চালাতে হবে।’ | ড. মূরকোটের মুখ থেকে কুয়াশার আদেশ-নির্দেশ শুনল সর্দার।
কুয়াশা ড. মূরকোটকে বলল, আপনি এইবার আহত জংলীদেরকে কোন এক ঘরের ভিতর নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন। যারা আহত হয়েছে তাদেরকে দেখাশোন
করলে এমনিতেই মারা যাবে। আর এক দলকে নির্দেশ দিন মৃত দেহগুলোর সদগতি করার।’
পনেরো মিনিটের মধ্যে স্নান সেরে নতুন একটি টকটকে লাল আলখাল্লা নিজেকে আবৃত করল কুয়াশা। খানিক পরই ড. মূরকোটের সাথে ল্যাবরেটরিতে ঢুকল সে।
ভিতরে পা ফেলেই থমকে দাঁড়াল কুয়াশা ।
কি হলো, ড, কুয়াশা?’ প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ মূরকোট। ‘আমার ব্যাগ আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্ত লেসার গানটা এখানেই ছিল। সেটা দেখছি না।’
রোম বাবার নির্দেশে একছুটে ডেকে আনল জংলী সর্দারকে।
সর্দারকে ব্যাপারটা ড. মূরকোট বললেন। সর্দার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলো, যে চুরি করেছে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেল সর্দার
ড, মূরকোটের ঘর থেকে। । কিন্তু জংলীদের মধ্যে কেউ স্বীকার করল না চুরির কথা। এমনকি কেউ দেখেওনি জিনিসটা কারও হাতে। | কুয়াশাকে ভয়ানক চিন্তিত দেখাল । ড. মূরকোটকে সে বলল, ‘শত্রুর হাতে ওটা যদি পড়ে তাহলে নির্ঘাৎ মৃত্যু হবে আমাদের। পৃথিবীর যাবতীয় মারাত্মক মারণাস্ত্রের মধ্যে আমার এই লেসার গানটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। ওটার ক্ষমতা কল্পনাতীত। যার হাতে পড়বে, সে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে হত্যা করতে পারবে অনায়াসে। পাহাড়কে চোখের পলকে ছাই করে দেয়া যায় ওটা দিয়ে। নদীকে শুকিয়ে ফেলা যায় আধমিনিটের মধ্যে। আমার কি ধারণা জানেন?
‘কি, ড, কুয়াশা?’
জংলীদের মধ্যে কেউ একজন বিশ্বাসঘাতক আছে। যে ডেভিডের হয়ে কাজ করছে। লেসার গানটা সেই চুরি করেছে। এতক্ষণে সেটা নিশ্চয়ই ডেভিডের হাতে পৌঁছে গেছে।’
‘তাহলে উপায়? ১০২
ভলিউম ১৩
‘এক মুহূর্ত দেরি না করে এখুনি ডেভিডের আস্তানা আক্রমণ করা উচিত। খোঁজ নিয়ে দেখুন তো আমার সঙ্গী ডেভিডের যে দুজন লোককে আহত করেছিল তাদের। রাইফেল দুটো আছে কি না?’
রাইফেল তিনটেই পাওয়া গেল। অতিরিক্ত রাইফেলটা রাসেল ফেলে গেছে।
সর্দারের অনুমতি পেতে এক সেকেণ্ডও দেরি হলো না। শজন মাত্র লোক চাইল কুয়াশী। কিন্তু প্রায় শ দুয়েক জংলীকে নিয়ে সর্দারও চলল কুয়াশার পিছু পিছু।
ড. মূরকোট রইলেন গ্রামেই। তাঁর সাথে রইল কয়েকজন মাত্র জংলী আহতদেরকে দেখাশুনা করার জন্যে।
কুয়াশার ডান পাশে জংলী সর্দার। বাঁ পাশে জোশান রোম। রোমের হাতেও একটি রাইফেল। চালাতে জানে সে। রোম এবং কুয়াশা ছাড়া আর কেউ রাইফেল চালাতে জানে না।
জংলীরা পিছনে। তারা নিঃশব্দে অনুসরণ করছে ওদের তিনজনকে। তাদের। কাঁধে তীর ধনুক। হাতে বুমেরাং বা বর্শা।
পিছনের দশ বারোজন জংলীর কাছে ঢাক-ঢোল দেখতে পেয়ে রোমকে কুয়াশা বলল, ‘সর্দারকে বলে, ঢাক-ঢোল যেন ভুলেও না বাজানো হয়।
• যুদ্ধ যাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ ঢাক-ঢোল। কিন্তু, দেবতার ইচ্ছাই চরম ইচ্ছা। সর্দার নির্দেশ দিল। দশ বারোজন জংলী দাঁড়িয়ে পড়ল। এগিয়ে চলল অন্যান্যরা।
শত্রুদের আস্তানা দূর থেকেই দেখা গেল। কুয়াশা নির্দেশ জারি করার আগেই জংলীরা যে-যার ইচ্ছা মত তীর এবং বর্শা ছুঁড়ে মারতে শুরু করল।’ বিরক্ত বোধ করল কুয়াশা।
কুয়াশা সর্দারকে কিছু বলার জন্যে থামতেই শত্রুদের পক্ষ হতে গর্জে উঠল একজোড়া রাইফেল।
বুকে গুলি খেয়ে বাঁকা হয়ে গেল দুজন জংলীর দেহ। পড়ে গেল তারা সশব্দে। কুয়াশার নির্দেশ সর্দারকে জানিয়ে দিল রোম।
| সর্দার জংলীদের মধ্যে আদেশ জারি করল। জংলীরা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করল দ্রুত। কুয়াশা জংলীদেরকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে শুরু করল কিভাবে আক্রমণ করতে হবে, কিভাবে গা-ঢাকা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে ইত্যাদি। সর্দারু গভীর ভাবে ধমক মারছে জংলীদেরকে। গাছের মগডালে গিয়ে উঠে পড়েছে রোম। কুয়াশা শত্রুদের বাড়ির ছাদের দিকে তাকাল। হঠাৎ চারদিক সচকিত করে দিয়ে শব্দ হলো রাইফেলের। হঠাৎ ছিটকে পড়ে গেল কুয়াশা । মুহূর্তে অদূরে
প্রচণ্ড শব্দে ফাটল একটি হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড।
কুয়াশা ৩৯
১০৩
ডি.কস্টা সহাস্যে, যুবতী কুমারীদের গালে চুমো খেতে লাগল।
| জোনজা যখন জংলীদের গ্রামে হামলা চালিয়েছে, ডি কস্টা তখন সর্দারের সাথে শুয়োরের কলিজা ভাজা, টিকটিকির লেজ সেদ্ধ, বানরের মগজ, ক্যাঙ্গারুর কোর্মা, ঈমুর রোস্ট, তেলেপোকা এবং কাঠপিঁপড়ের আচার সহকারে বৈকালিক নাস্তা সারছিল। .: জোনজার আগমন বার্তা শোনার সাথে সাথে সর্দার ছুটে বেরিয়ে পড়ে তার ঘর থেকে। ডি কস্টাও বেরোয়। তবে খানিক পর অভুক্ত যাবতীয় খাবার একটা পুটলিতে বেঁধে দুমিনিট পরই সে হাজির হয় সর্দারের কাছে।
সর্দার তখন গ্রামের যুবতী এবং কুমারী মেয়েদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। কথা হলো ফললার নেতৃত্বে মেয়েরা গ্রাম থেকে দূরে
একটি উঁচু গাছের মাথায় যে ঘরখানি আছে সেখানে যাবে।
| ফললা হলো গ্রামের অন্যতম বীরদের একজন। ডি.কস্টার সাথে তার বনিবনা হয় না । ‘ সেই মুহূর্তে ফললা সেখানে উপস্থিত ছিল না। সর্দার গেল তাকে খুঁজতে। এই ফাঁকে ডি কস্টা মেয়েদেরকে বলল, তোমরা আমার সাথে যাইটে রাজি আছ কি? হামি টোমাডের শাসক সম্প্রদায়ের প্রতিনিঢ়ি। টোমাডের ভাল মণ্ড ডেখিবার ডায়ি] হামার উপরই। তাছাড়া তোমরা কালা আদমী, মাঠায় বুড়ি নাই, আছে ওনলি গোবর-বাট হামি আংরেজের জাট, টোমাডেরকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন হামার এক পূর্ব পুরুষ, জেমস কুক-সুতরাং টোমরা ফললার বড়লে হামার সাটে যদি যাইটে রাজি ঠাকো টো বলো…।’
মেয়েরা ডি.কস্টার কথা না বুঝলেও ভাব ভঙ্গি দেখে প্রশংসা না করে পারল । তাছাড়া সাদা চামড়ার লোকদের প্রতি তাদের এমনিতেই একটা শ্রদ্ধা এবং সমীহ ভাব আছে। ডি.কস্টার মনোভাব বুঝতে পেরে কেলকেলা এবং চুলচুলা নামে দুটি কুমারী রাজি হয়ে গেল। তাদের দেখাদেখি বাকি সব মেয়েরাও বেরিয়ে এল গ্রাম থেকে ডি কস্টার পিছু পিছু। * মোট তেরোজন কুমারী মেয়েকে নিয়ে বীরদর্পে এগিয়ে চলল ডি কস্টা জঙ্গলের ভিতর দিকে। চুলচুলা কয়েকবার ডি কস্টাকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে সর্দার,
তাদেরকে যেখানে আশ্রয় নিতে বলেছে সেখানে যাবার পথ এটা নয়।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। ডি.কস্টা কারও কথায় কান দিল না। হাঁটতেই লাগল সে।
মেয়েদের সবাই কুমারী বলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার ভাব ফুটে
১০৪,
ভলিউম ১৩
উঠল। ডি কস্টাকে স্বামী হিসেবে পেলে বর্তে যাবে তাদের মধ্যে যে-কেউ। ফলে কেউ ডি কস্টার ইচ্ছায় বাদ সাধল না ।
কিন্তু সবকিছুরই তো একটা সীমা আছে। হাঁটার অভ্যাস থাকলেও উদ্দেশ্যহীন ভাবে মেয়েরা বেশিক্ষণ হাঁটবে কেন? এদিকে সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। সাত। মাইলের মত হেঁটে এসেছে সবাই ইতিমধ্যে। | সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে মনে মনে ডি.কস্টাও চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না সে। এখন আর গ্রামের দিকে ফিরে যাবার মানে হয়
। পথেই রাত্রি নামবে। গর্ত থেকে বের হবে হিংস্র নেকড়ে, ধূর্ত হায়েনা, বিষাক্ত সাপ। এদিকে সবাই অস্ত্রহীন।
নিজেকে মনে মনে গালাগালি করছিল ডি.কস্টা। বড় ভুল করে ফেলেছে সে। মেয়েদের মন জয় করার আনন্দে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে পৃথিবীর যাবতীয় কথা।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল ডি কস্টা। মেয়েগুলো বড় দুষ্ট তো! পিছন থেকে চাপা স্বরে সবাই হাসছে। ফিসফিস করছে।’
কারণ কি? ওদের মনে কি ভয় বলতে কিছু নেই? ঘুরে সঁড়াল ডি.কস্টা। মেয়েগুলোর মুখোমুখি.দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল সে।
| চাপা উল্লাস মেয়েদের চোখেমুখে। আশায় আনন্দে সবাই অধীর হয়ে উঠেছে। ডি.কস্টা বোকার মত তাকিয়ে রইল। হঠাৎ চার-পাঁচজন মেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার উপর।
| ‘টোমরা আমাকে ঢাক্কা মারিটেছ কেন? হোয়াট্স দ্য ম্যাটার? টোমরা…।’
কথা শেষ করার অবকাশ ওরা দিল না ডি.কস্টাকে। কেউ প্রল ডি.কস্টার হাত, কেউ জড়িয়ে ধরল সরু কোমরটা, কেউ ধরল তার শার্টের কোণা। প্রায় হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল সবাই তাকে। | ‘মেয়েদের নিজেদের মধ্যে পরস্পরের সাথে পরস্পরের কেমন যেন একটা রেষারেষির সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল হঠাৎ। তর্ক করছে তারা তাদের দুর্বোধ্য ভাষায়। সবাই ছুঁতে চায় ডি কস্টাকে। একজন আরেকজনকে ল্যাং মেরে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করছে। সঁত মুখ খিঁচিয়ে গালাগালি করছে কেউ কেউ। | কি যে আসলে ঘটছে তা বুঝতেই পারল না ডি.কস্টা। বিড় বিড় করে সে · বলতে শুরু করল, ‘গড আমার সহায় হোন।’
মিনিট তিনেক পর দেখা গেল জঙ্গলের মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড ঘর।
ঘরটাকে দেখে আনন্দে উল্লাসে মেয়েরা চিৎকার করে উঠল। অথচ ডি কস্টা ঘরের সামনে কাউকে দেখতে পেল না। | ঘরের সামনে এসে মেয়েরা দাঁড়াল। শক্ত লতা দিয়ে দরজা বাঁধা। সেটা খোলা হলো । ঘরের ভিতর সদলবলে একযোগে ঢুকল মেয়েরা ডি কস্টাকে নিয়ে। ঘরের ভিতর লতাপাতা দিয়ে তৈরি কয়েকটা লম্বা লম্বা বাক্স এবং মেঝেতে পাতা কুয়াশা ৩৯
১০৫
দিয়ে তৈরি করা বিছানা ছাড়া আর কিছু নেই।
ঘরের ভিতর ঢুকে মেয়েদের রহস্যময় আচরণ আরও চরম আকার ধারণ করল ।
ডি.কস্টাকে ছেড়ে দিয়ে মেয়েরা সবাই আঁপিয়ে পড়ল বাক্সগুলোর উপর। কে কার আগে বাক্স খুলতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে।
| পালাবার এই সময়!
ডি.কস্টা ভাবল মেয়েরা হয়তো তার উপর খেপে গেছে কোন কারণে। জংলী মেয়ে, বাপরে বাপ! এদের দ্বারা অসত্ব কিছু নেই।
| কি আছে বাক্সের ভিতর? তীর ধনুক? হত্যা করতে চায় নাকি মেয়েগুলো তাকে?
পালাতে হবে।
কিন্তু বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রাণ বাঁচাবার শেষ এবং একমাত্র উপায়টাও গ্রহণযোগ্য বোধ হলো না ডি কস্টার। সন্ধ্যা নেমেছে। বাইরে, অদুরেই, শোনা যাচ্ছে হায়েনার ভয়ানক হাসি এবং নেকরে কর্কশ হুঙ্কার।
, পালানো চলবে না। এই ঘর থেকে বের হলেও হজম করে ফেলবে হিংস্র জন্তু জানোয়াররা। | মেয়েদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেছে।
| জংলী মেয়ে। অসভ্য! সভ্য জগতের যে কোন পুরুষের চেয়ে বেশি শক্তি এক একটির শরীরে। বাক্স খোলা নিয়ে তারা পরস্পরের সাথে মারামারি করতে শুরু করেছে। বড় ভয়ানক দৃশ্য।
.দাঁতে দাঁত চেপে প্রকাণ্ড দেহী মেয়েগুলো পরস্পরের উপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। চুলোচুলি, ঘুষোঘুষি, হাতাহাতি চলছে। প্রায় উলঙ্গ মেয়েরা কেউ কারও সাথে পেরে উঠছে না। তবে মারামারি করার ফাঁকে সবাই চেষ্টা করছে বাক্সগুলো খোলার।
অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে শুধু একটার পর একটা চিমটি কাটছে ডি কস্টা। চিমটি কাটার ব্যথায় চোখ মুখ বিকৃত হয়ে উঠছে তার। তবু সে তার সামনের দৃশ্যকে সত্য বলে মেনে নিতে পারছে না। তার ধারণা এসব ঘটছে স্বপ্নে। ০ মিনিট পাঁচেক পর দুটো মেয়ে তড়াক করে লাফাতে লাফাতে এসে পড়ল ডি কস্টার উপর। ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল ডি কস্টা। কিন্তু মেয়েগুলোর সেদিকে খেয়াল নেই। তাদের দুজনের হাতে দুটো ফুলের মালা। দুজনেই ভূপাতিত স্যানন ডি কস্টার গলায় মালা দুটো পরিয়ে দেবার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
একটি মেয়ে ধপাস করে বসল ডি.কস্টার পাজর বের হওয়া বুকে। মটু করে একটা শব্দ হলো। দ্বিতীয় মেয়েটি বসল ডি কস্টার মাথার পিছনে। ডি.কস্টার হাতটা পিছন দিকেই ছিল। সেটার উপর বসল মেয়েটি আঙুল মটকে শব্দ হলো।
| ডি কস্টা ভাবল তার পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে।
১০৬
ভলিউম ১৩
হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল ডি.কস্টা। এমন সময় মেয়ে দুটো উঠে দাঁড়াল। পরমুহূর্তে দেখা গেল আরও তিন চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে ডি কস্টার উপর।
মেয়েগুলো নির্মমভাবে ডি.কস্টার মাথায়, বুকে চেপে বসে তার গলায় মালা পরিয়ে দিতে লাগল। প্রায় পনেরো মিনিট পর দেখা গেল মি. স্যানন ডি কস্টা নড়াচড়া করছে না। জ্ঞান হারিয়েছে সে।
প্রত্যেকটি মেয়ে ডি.কস্টার গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছে। ফুলের মালায় ঢেকে, গেছে অচেতন ডি কস্টার মুখ এবং বুক। মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে, বসে আছে তাকে ঘিরে।
খানিক পর জ্ঞান ফিরল ডি কস্টার। কিন্তু দম ফেলতে পারল না। হাত দিয়ে ফুলের মালা সরিয়ে পিট পিট করে তাকাল সে। মনে মনে একটু সাহস হলো।
জংলী মেয়েগুলো শান্ত হয়ে গেছে।
উঠে বসল ডি কস্টা। মেয়েরা একযোগে আনন্দ ধ্বনি করে উঠল। বোকার মত তাকিয়ে রইল ডি.কস্টা। তারপর নিজের গলার মালাগুলো দেখিয়ে ইঙ্গিতে জানতে চাইল, এগুলো কেন? | চুলচুলা কিছু কিছু ইংরেজি জানে। কারণ সে ড. মূরকোটের ঘর পরিষ্কার করার কাজে নিযুক্ত গত কয়েক বছর ধরে। ড. মূরকোটের কাছ থেকে ইংরেজি কিছু কিছু শিখেছে সে।
ডি,কস্টার জ্ঞাতার্থে চুলচুলা জানাল জঙ্গলের ভিতর এই ঘরটা আসলে তাদের সমাজের অত্যন্ত পবিত্র স্থান। জংলীদের মধ্যে অবিবাহিত কোন পুরুষ এবং কুমারী নারী যদি এই ঘরে এক রাত কাটায় তাহলে ধরে নিতে হবে তারা পরস্পরকে বিয়ে করল। এই ঘরে রোজ তাজা ফুলের মালা রেখে যাওয়া হয়। যে কোন একটি কুমারী মেয়ে এবং কুমার পুরুষ এই ঘরে ঢুকে রাত কাটাতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী মেয়ে পুরুষকে মালা পরিয়ে দেবে। ব্যস, তাহলেই তারা স্বামী-স্ত্রী হয়ে গেল। * চুলচুলা আরও কয়েকটা কথা জানাল। ডি কস্টাকে স্বামী হিসেবে চেয়েছিল তারা সবাই গ্রামের কুমারী মোট তেরোজন মেয়েই। প্রত্যেকেই ডি.কস্টাকে মালা পরিয়েছে। এবং তারা প্রত্যেকে আজ রাতটা এই ঘরে ডি.কস্টার সাথে কাটাবে। তারমানে তেরোজন মেয়েরই স্বামী হতে যাচ্ছে ডি.কস্টা।
সব কথা জানতে পেরে গলা শুকিয়ে গেল ডি.কস্টার। আবার জ্ঞান হারাবে বলে ভয় হলো তার। মনে মনে সে ভাবল টেরোজন বড় বড় আনম্যারেড উওম্যান। আর টাহাড়ের স্বামী সে একা।
নিয়মানুযায়ী খুলে নেয়া হলো ডি.কস্টার পরনের সব পোশাক। পরিয়ে দেয়া হলো লতা পাতার তৈরি কোমর বন্ধনী। একদল মেয়ে তার গায়ের সাথে চোখ ঠেকিয়ে দেখতে লাগল সাদা চামড়া। মশালের ধোঁয়ায় ঘর ভরে যাচ্ছে । কিন্তু সেদিকে কারও খেয়াল নেই। কেউ কেউ শুঁকছে নাক ঠেকিয়ে ডি কস্টার গায়ের কুয়াশা ৩৯
১০৭
গন্ধ। হাত দিয়ে পরখ করছে কেউ কেউ তার শরীর। আর একদল মেয়ে ডি.কস্টার মুখে লাল কালো রং মাখিয়ে দিচ্ছে।
| আরও পনেরো মিনিট পর মেয়েরা ঘিরে বসল ডি.কস্টাকে। এবার তারা ডি.কস্টাকে বিশেষ ধাক্কা টাক্কা মারল না। একে একে, বেশ সুশৃংখল ভাবে তারা চুমো দিতে লাগল ডি.কীর কপালে ।
সহাস্যে দাঁত বের করে, ঠোঁটের দুই প্রান্ত কান অবধি নিয়ে গিয়ে, তেরোজন বউয়ের আদর নিতে থাকল ডি.কস্টা। জীবনটা দারুণ মধুর বলেই মনে হলো তার।
তিন
ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে কি কেউ কোনদিন পেরেছে?
ছুটন্ত ঘোড়ার মত দ্রুত পা ফেলে মরিয়া হয়ে ছুটছে রাসেল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দৌড়াবার চেষ্টাটাই হাস্যকর। কিন্তু জোনৰ্জার ভ্রূক্ষেপ নেই কোন দিকে।
ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে সে।
এখনও বিকট স্বরে কেঁদে উঠছে জোনজা। ভিষণ ভয় পেয়েছে সে। ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে। গাছের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে ঘনঘন, ঝোঁপের সম্মুখীন হচ্ছে, হাত পা ছিঁড়ে যাচ্ছে বুনোগাছের কাঁটা লেগে। কিন্তু ছোটার বিরাম নেই তবুও।
রাসেলেরও সেই একই অবস্থা। সামনের সব বাধাকে তুচ্ছ করে জোনজাকে অনুসরণ করে চলেছে সে। দু’এক মিনিট পরপরই চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে জৈানজা। কিন্তু তবু পিছু ছাড়ছে না রাসেল। অনুমানের উপর নির্ভর করে ছুটেই চলেছে সে।
‘ আকারে ছোট, অপেক্ষাকৃত কম হিংস্র বুনো জীব-জানোয়াররা সন্ধ্যার আগে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছে। খানিক পরই রাত নামবে। গর্ত থেকে বের হবে হিংস্র মাংশাসী, ভয়ংকর জীব-জন্তু। তাসমানিয়ান ডেভিল পড়ল সামনে হঠাৎ । আতঙ্কে বোকার মত থমকে দাঁড়াল সে। কিন্তু রাসেলকে মানুষ হিসেবে চিনতে পেরেই বাদামী জিভ বের করে ঠোঁট চেটে নিল সে। প্রায় চব্বিশ ইঞ্চি লম্বা নেকড়ের মত দেখতে ভয়ানক হিংস্র জানোয়ারটি লাফ দিয়ে ধরতে গেল রাসেলের একটি পা। রাসেল দেখতেই পায়নি তাকে। যেমন ছুটছিল তেমনি ছুটতে লাগল ও। মিনিট খানেক রাসেলকে অনুসরণ করে পঁড়িয়ে পড়ল তাসমানিয়ান ডেভিল। নাহ, মানুষটার জানের মায়া আছে! কি রকম দৌড়াচ্ছে হরিণের মত! অন্য শিকারের উদ্দেশ্যে একটি ঝোঁপের ভিতর ঢুকে গেল সে।
সন্ধ্যার সময় হারিয়ে ফেলল রাসেল জোনজাকে। | প্রায় মাইল দশেক দৌড়ে এসেছে সে। হঠাৎ আতঙ্কিত বোধ করল রাসেল। সঙ্গে কোন অস্ত্র নেই পকেটের ছোট ছুরিটা ছাড়া। জংলীদের গ্রামে ফিরে যাওয়া
১০৮
ভলিউম ১৩
এখন আর সম্ভব নয়। রাত নামছে অচেনা অজানা গহন অরণ্যে।
জোনজাকে অনুসরণ করার পিছনে বড় একটি কারণ ছিল রাসেলের। জোনজা ভয় পেয়েছে তাও বুঝতে পেরেছিল। জোনজা যখন ছুটে পালাতে শুরু করল তখন কেন যেন ওর মনে হলো যে ফোমের কাছেই যাবে সে। ফোমকে জঙ্গলের কোন গোপন জায়গায় রেখেছে জোনজা এই ধারণার উপর ভিত্তি করে তাকে অনুসরণ করতে কে করেছিল রাসেল। ফোমকে উদ্ধার করা দরকার ।
কিন্তু জোনার পিছু পিছু প্রায় দশমাইল এসে রাসেলের হঠাৎ মনে হলো ফোমকে এত দূরে নিশ্চয়ই রাখেনি সে। | নানা দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ল রাসেল। কুয়াশা নিশ্চয়ই তার খোঁজে লোক পাঠাবে। মনে পড়ল, কুয়াশা পিছন থেকে নিষেধ করেছিল রাসেলকে জোনজার পিছু
ধরতে।
সকাল হবার আগে কেউ খুঁজে পাবে না ওকে। অবশ্য যদি ও সকাল অবধি বেঁচে থাকে। রাসেল বুঝতে পারল হিংস্র জীব জানোয়ারে ভর্তি অচেনা অজানা এই গহীন অরণ্যে নিরস্ত্র অবস্থায় একা রাত কাটানো অসম্ভ। নির্ঘাৎ মৃত্যু ঘটবে।
জোনজাকে হারিয়ে ফেলার পর আর ছুটছে না ও। কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকারও কোন মানে হয় না। গাছের উপর চড়ে রাতটুকু নিরাপদে কাটাবার চেষ্টা
করতে হবে।
উঁচু একটা অচেনা গাছে চড়ল রাসেল। গাছের মগডালে উঠে দিনের শেষ অস্পষ্ট আলোয় এদিক ওদিক তাকাতেই একটি মাটির ঢিবি দেখতে পেল রাসেল অদূরে। জোনজাকে দেখল ও মাটির ঢিবির নিচে একটি মাঝারি আকারের গুহায়।
| গুহা.মুখের সামনে হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে আছে জোনজা। গুহার ভিতরটা গাছের মাথা থেকে দেখতে পাচ্ছে না রাসেল পরিষ্কার। তবে মাঝে মাঝে মাথা তুলে জোনজা গুহার ভিতর কি যেন দেখছে।
| কেউ আছে কি গুহার ভিতর?
প্রশ্নটা মনে জাগতেই ফোমের কথা মনে পড়ে গেল রাসেলের, কেন যেন হঠাৎ আশঙ্কায় ভূরে উঠল ওর বুক।
দ্রুত সন্ধ্যা নামছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। ফোম যদি গুহার ভিতর থাকে…! আর যেন ভাবতে পারে না রাসেল।
জোনজা উঠে বসছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাসেল। অবাক হলো ও। জোনজা হাত নেড়ে কাকে যেন ডাকছে। গুহার ভিতর কেউ আছে।
কয়েক সেকেণ্ড পরই সব সন্দেহের অবসান ঘটল? গুহার ভিতর থেকে গুহামুখে বেরিয়ে এল ফোম।
ফোমের পরনে রাসেলের দেয়া বুক.খোলা শার্টটাই দেখা যাচ্ছে। আবছা আলোতেও রাসেল, দেখতে পেল, ভয়ে আতঙ্কে চুপসে গেছে ফোমের মুখ। কুয়াশা ৩৯
১০৯
জোনার সামনে এসে দাঁড়াল ফোম। ফোমকে বসতে বলল সামনে জোনজা। আতঙ্ক ফুটে উঠল ফোমের হাবভাবে। কি যেন বলল সে।
হঠাৎ গর্জন করে উঠল জোনজা।
কেঁপে উঠল ফোম। আস্তে আস্তে বসল সে জোনজার সামনে। জোনজা দু’হাত দিয়ে ধরল ফোমকে। প্রকাণ্ড একটা দৈত্য যেন কোলে তুলে নিল একটা পুতুলকে।
| ফোমকে কোলে নিয়ে আদর করতে শুরু করল জোনজা। গাল ঘষছে সে ফোমের মাথায়, গালে, গলায়। | চমকে উঠল রাসেল। সর্বত্রীর হিম হয়ে গেল তার হঠাৎ! চিৎকার করছে ফোম। নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে জেনজার হাত থেকে।
জোনজা দুহাত দিয়ে চেপে ধরছে ফোমকে। ফোমের মুক্তি পাবার কোন আশা নেই।
জোনজা ফোমের তরফ থেকে বাধা পেয়ে আরও মরিয়া এবং উত্তেজিত হয়ে উঠল। শক্ত করে ফোমকে চেপে ধরেছে সে নিজের বুকের সাথে। জোর করে ফোমের মুখটা নিজের মুখের সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
গহীন অরণ্যে ফোমের তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার অটুট নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে।
| তরতর করে গাছ থেকে নামতে শুরু করল রাসেল। কিছু একটা করা দরকার । চুপচাপ বসে দেখতে পারবে না ও জোনজার হাতে একটি অসহায় মেয়ের মৃত্যু।
* গাছ থেকে নামতেই অদূরে কোথাও থেকে হুঙ্কার ছাড়ল একটি নেকড়ে। চমকে উঠে পিছন দিকে তাকাল রাসেল। দেখা যাচ্ছে না নেকড়েটাকে। নেকড়েটা হয়তো দেখতে পাচ্ছে তাকে।
দ্রুত চিন্তা করল রাসেল। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারল না। ওর এক হাতে একটা গাছের মোটা ভারি ডাল। অপর হাতে ছোট ছুরিটা। মাটির ঢিবির দিকেই পা বাড়াল রাসেল। খানিকটা দূরে শোনা গেল নেকড়ের ডাক। পিছন দিক থেকে এল ডাকটা। প্রথম নেকড়েটাই শিকারকে দেখতে না পেয়ে দূরে গিয়ে ডাকছে কিনা বুঝতে পারল না রাসেল।
কয়েক পা এগোবার পরই জোনজাকে এবং ফোমকে দেখতে পেল রাসেল।
একইভাবে সমানে চিৎকার করে চলেছে ফোম। ব্যথা পাচ্ছে সে জোনজার অত্যাচারে ।
একপা দু’পা করে, সন্তর্পণে, নিঃশব্দে জোনার দিকে এগিয়ে চলল রাসেল । | আস্তে আস্তে জোনজার ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াল ও ।
| পিছন ফিরে তাকাল জোনজা । রাসেল ওর ডান হাতের মোটা ভারি ডালটা সর্বশক্তি দিয়ে বসিয়ে দিল জোনার কপালে। ১১০
ভলিউম ১৩
বিকট স্বরে গর্জন করে উঠল জোনজা।
যে-কোন স্বাভাবিক মানুষকে ওরকম একটা আঘাত করলে সেই মুহূর্তে মৃত্যুব্বণ করত সে। কিন্তু জোনজারি কপালে এতটুকু আঁচড় অবধি কাটল না।
গর্জে উঠেছে জোনজা রাগে । ফোমকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল
রাসেল আবার প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালাল। দু’হাত দিয়ে ডালটা ধরে জোনার মাথা লক্ষ্য করে আঘাত হানল ও। কিন্তু খপ করে ধরে ফেলল জোনজা ডালটা। সেটাকে ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। তারপর দাঁত মুখ বিকৃত
করে অবোধ্য একটা চিৎকার করে দমাদম ঘুসি মারল নিজের বুকে।
হঠাৎ জোনজা পা বাড়াল রাসেলের দিকে।
• রাসেল পিছিয়ে আসছে।
দ্রুত করল জোনজা তার হাঁটা। রাসেল হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটল। রাসেলকে ধরার জন্যে এবার ছুটতে শুরু করল জোনজাও।
ক্যাঙ্গারুর মত বড় বড় কয়েকটা লাফ দিয়ে চোখের পলকে সামনেরই একটা ঝোঁপের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল রাসেল।
| ঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দ্রুত দিক পরিবর্তন করে আগের সেই উঁচু গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল।
মাত্র বিশ-পঁচিশ হাত দূরে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে জোনাকে। ঝোঁপের ভিতর খুঁজছে সে রাসেলকে।
| দ্রুত গাছে চড়তে শুরু করল রাসেল। প্রায় দু’মানুষ সমান উঁচুতে উঠে গেল রাসেল। হঠাৎ এদিকে তাকাল জোনজা। বিকট স্বরে হুঙ্কার ছাড়ল সে। লাফাতে লাফাতে গাছটার দিকে ছুটে আসতে দেখা গেল তাকে।
. উঁচু গাছটার প্রায় মগডালে উঠে এল রাসেল। ছোট ছুরিটা বের করে শক্ত করে, ধরে রেখেছে সে হাতে। এই একটি মাত্র অস্ত্র তার। জোনজার হাত থেকে এই ছুরির সাহায্যে রেহাই পাবার কোন আশা নেই জানে রাসেল। তবু প্রাণ বাঁচাবার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি করবে না সে। | গা বেয়ে উঠে আসছে জোনজা। প্রকাণ্ড ভারি দেহটা নিয়ে উঠতে অসুবিধে হচ্ছে তার। কিন্তু কোন কিছুতেই পিছিয়ে যেতে রাজি নয় সে। শত্রুর রক্ত না দেখা অবধি তার প্রাণ ঠাণ্ডা হবে না।
| আরও একটু উপরে উঠে গেল রাসেল। ক্রমশ উপরে উঠে আসছে জোনজা। আতঙ্কিত হয়ে উঠল রাসেল।
হঠাৎ জোনজা তাল হারিয়ে ফেলল। রাসেল সবিস্ময়ে তাকিয়ে আছে।
দু’ইঞ্চি ডায়ামিটারের একটা ডালে পা রেখেছে জোনজা। ডাল ভাঙার শব্দ
কুয়াশা ৩৯
১১১
।
৫
হচ্ছে। জোনজার দেহের ভার ডালটা সহ্য করতে পারছে না। * ডালটা ভেঙে গেল। সশব্দে গাছের নিচে পড়ল জোনজা সাড়ে তিন মানুষ সমান উঁচু থেকে।
কিছুই হলো না জোনজার। গাছ থেকে পড়ে মাটিতে বসে পড়েছিল সে। তখুনি উঠে দাঁড়াল। একটি সেকেণ্ডও নষ্ট করল না জোনজা । চিন্তা-ভাবনারও চেষ্টা করল না সে। উঠে দাঁড়িয়েই গাছের গোড়ায় আবার চলে এল। মাথা তুলে তাকাল রাসেলের দিকে। মাথার উপর রাসেল। গাছটার খানিকটা পুব দিকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় রাত্রিকালীন গভীর অরণ্য বড় রহস্যময় লাগছে। গাছের মোটা কাণ্ডে দুটো হাত রাখল জোনজা। | অবাক বিস্ময়ে দমবন্ধ করে রাখল, রাসেল পাঁচ সেকেণ্ড । জোনজা গাছের গায়ে ধাক্কা দিয়ে গাছটাকে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে। | বিস্ময়ের ঘোর কাটল রাসেলের পরমুহূর্তে । বিপদ টের পেল ও। গাছটা
নড়ছে। একটু একটু হেলে পড়ছে।
সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে জোনজা গাছে। গাছ নুইছে। থরথর করে কাঁপছে সরু ডাল পালা, পাতা।
দুরু দুরু করছে রাসেলের বুক। জোনজাকে বোকা মনে করা সত্যিই বোকামি হবে। প্রচণ্ড অমানুষিক শক্তি ওর গায়ে, সেই সাথে বুদ্ধিটাও পাকা।
ঘন জঙ্গল। গাছগুলোর ডালপালা পরস্পরের সাথে গা ঠেকিয়ে আছে। এক গাছ থেকে আরেক গাহে যাওয়াটা খুব একটা কঠিন হবে না। মেপে, হিসেব করে সাবধানে পা রাখল রাসেল একটা সরু ডালে।
সরু ডাল। রাতের আঁধারে ভাল দেখাও যাচ্ছে না। ডালটা দুর্বল হলে, পোকায় খাওয়া হলে কিছু বুঝতে না দিয়ে মট করে ভেঙে পড়বে। রক্ষা নেই ভাঙলে। নিচে জোনজা তৈরি হয়েই আছে। স্রেফ ধরে ফেড়ে ফেলবে। কিন্তু তার আগেই বারোটা বেজে যাবে তার। প্রায় তিন তলা একটা বাড়ির সমান উঁচুতে এখন সে। নিচে পড়লে ভর্তা হয়ে যাবে শরীর।
‘ তাল সামলে এক ডাল থেকে আর এক ডালে যাওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছে। গাছটা নুয়ে পড়ছে কাঁপতে কাঁপতে। পা সিধে রাখতে পারছে না রাসেল।
আস্তে আস্তে এক ডাল থেকে আরেক ডালে পা রাখছে। মিনিট কয়েক পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ও।
দ্বিতীয় একটা গাছের ডালে চলে এসেছে ও। প্রথম গাছটা নুয়ে পড়ছে দ্রুত। মোটা গাছটার গোড়া ভাঙছে সশব্দে। দেখতে দেখতে প্রকাণ্ড গাছটা সশব্দে আছড়ে পড়ল মাটিতে।
গাছটাকে ধরাশায়ী করে খুঁজতে শুরু করল জোনজা। রাসেলকে না পেয়ে বিকট স্বরে গর্জে উঠল সে। তারপর আবার উপর দিকে তাকাল। ১১২
ভলিউম ১৩
রাসেলকে দেখে দমাদম ঘুসি মারল সে নিজের বুকে।
একদল নেকড়ে ডেকে উঠল কাছেই একটা ঝোঁপের পাশ থেকে। লাফিয়ে উঠে ‘রে দাঁড়াল জোনজা।
. নেকড়ের দলটিকে গাছের উপর থেকে দেখতে পেয়ে খানিকটা স্বস্তি বোধ করল রাসেল। জোনার মনোযোগ তার উপর থেকে সরে যাবে.এখন,
নেকড়ের দলে চারটে নেকড়ে। জোনার প্রকাণ্ড দেহটা দেখে হঠাৎ আক্রমণ করার সাহস পাচ্ছে না তারা। ধারাল দাঁত বের করে ডাক ছাড়তে ছাড়তে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তারা।
জোনজা সেই একই ভাবে গর্জন করছে। হঠাৎ সে ঝাঁপিয়ে পড়ল নেকড়ের দলের উপর। | দুটো নেকড়ে বিপদ টের পেয়ে পিছন ফিরে ছুট দিল। বাকি দুটো পালাবার সময় পেল না।
জোনজা দুটো নেকড়েকে ধরল দু’হাত দিয়ে। শূন্যে তুলে অবলীলাক্রমে সে ছুঁড়ে দিল নেকড়ে দুটোকে দূরে ।
মাটিতে পড়েই ছুট দিল তারা। | রাসেলের দিকে তাকাল জোনজা। বুকে আবার দমাদম শব্দে ঘুসি মারতে লাগল। কিন্তু এবার সে কোন শব্দ উচ্চারণ করল না। গাছের নিচে বসল সে আস্তে আস্তে।
এদিক-ওদিক তাকাল রাসেল। ঘন অন্ধকার চারদিকে। মাটির ঢিবিটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে।
রাসেলের দৃষ্টি আটকে গেল প্রথম গাছটার উপর । যে গাছটা ছেড়ে সে খানিক। আগে দ্বিতীয় গাছটায় চলে এসেছে। গাছটার উপর বড়সড় একটা জন্তুকে দেখে । কেঁপে উঠল রাসেলের বুক।
জন্তুটা এগিয়ে আসছে রাসেলের দিকেই। ‘কি ওটা?’
অনুমান করে চেনার চেষ্টা করল রাসেল। ভাল্লুক?’।
খুব সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ান ভালুক সম্পর্কে বইয়ে পড়েছে রাসেল। বড় ভয়ঙ্কর হয়, এরা। যার পিছনে লাগে তাকে শেষ না করে পিছু হটে না। হয় মারে, নয়
মরে।
গাছের পাতার ফাঁক গলে ছোট ছোট চাঁদের আলোর টুকরো যা আশপাশে এসে পড়েছে তাতে জন্তুটাকে পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে না।
হাতের ছুরিটা বাগিয়ে ধরে ঢোক গিলল রাসেল। নতুন এই বিপদ থেকে প্রাণ বাঁচাতে পারবে কি সে?
কয়াশা ৩৯
১১৩
পাঁচ হাত সামনে চলে এসেছে জন্তুটা সন্তর্পণে। এগিয়ে আসছে সে।
হঠাৎ রাসেলের পিছন থেকে ডেকে উঠল একটি নেকড়ে। চমকে উঠে গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছিল রাসেল। কোনক্রমে তাল সামলে একটা ডাল ধরে ফেলল ও।
. ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না রাসেল।
আবার ডেকে উঠল নেকড়েটা। ভয়ে আতঙ্কে নির্জীবের মত বসে রইল রাসেল। গাছে চড়েছে একটা নেকড়ে। মাত্র হাত পাঁচ ছয় দূর থেকে হুঙ্কার ছাড়ছে সে। অন্ধকারে সে হিংস্র জানোয়ারটাকে দেখতে না পেলেও তাকে জানোয়ারটা ঠিকই দেখতে পাচ্ছে।’
কুয়াশার কথা মনে পড়ে গেল রাসেলের। তার এই চরম বিপদে একমাত্র পরম উপকারী বন্ধু হতে পারে কুয়াশা।
কুয়াশার মধ্যে মানবতা আছে। তার বিপদে সে প্রাণ বিপন্ন করে বাঁচাবার চেষ্টা করবে তাকে।
কিন্তু কুয়াশা কি জানে তার এই বিপদের কথা?–
আবার গর্জে উঠল নেকড়েটা।
পিছনদিকে তাকাতে সাহস পেল না রাসেল। সামনের জন্তুটা থমকে গেছে। মাত্র হাত চারেক দূরে সে। এবার হয়তো লাফ দিয়ে রাসেলের উপর পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।
নিচের দিকে তাকাল রাসেল। জোনজা মাথা তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চার
জংলীরা বোবা বনে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। রাইফেলের শব্দ হতেই কুয়াশা ছিটকে পড়ে গেছে মাটিতে। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দে একটা গ্রেনেড ফাটল কুয়াশার কাছ থেকে মাত্র হাত পনেরো দূরে।
কুয়াশা নড়ছে না।
এক মুহূর্ত পর জংলীরা গগনবিদারী কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। যে যার আশ্রয় ছেড়ে ছুটে আসতে শুরু করল কুয়াশার দিকে। দেবতা আহত হয়েছে দেখে শোকে দিশেহারা সবাই।
সর্দারও সব ভুলে হাপুস নয়নে কাঁদছে। গলা ফাটিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে শোক প্রকাশ করছে সে।
গর্জে উঠল কয়েকটা রাইফেল! মাথা তুলে তাকাল কুয়াশা। .. জংলীদেরকে ছুটে আসতে দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়াল সে। জংলীরা বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠল। | ধমকে উঠল কুয়াশা বজ্রকণ্ঠে। ইঙ্গিতে সকলকে আত্মগোপন করার হুকুম দিল সে। রাইফেলের শব্দ হয়েছিল ঠিক। কিন্তু গুলি কুয়াশাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়নি।
১১৪
• ভলিউম ১৩
সুতরাং রাইফেলের গুলিতে আহত হবার প্রশ্নই ওঠে না তার।
| ছিটকে পড়ে গিয়েছিল কুয়াশা ইচ্ছে করেই। শত্রুপক্ষ তাদের বাড়ির ছাদের উপর থেকে একটা গ্রেনেড ছুঁড়ছে দেখতে পেয়েই আত্মরক্ষার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী শুয়ে পড়েছিল সে।
সময় মত শুয়ে না পড়লে কুয়াশাকে খুঁজে পাওয়া যেত না।
কুয়াশা সবার আগে। তার পিছনে জংলীরা। কয়েকটা ঝোঁপের ভিতর গোঙাচ্ছে কয়েকজন। রাইফেলের গুলিতে তারা আহত হয়েছে। কুয়াশা নির্দেশ দিল আহতদেরকে গ্রামে পৌঁছে দিতে। তারপর নির্দেশ দিল আক্রমণ করার।
| দেবতার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে জংলীরা তীর ছুঁড়তে লাগল শত্রুপক্ষের বাড়ির দরজা জানালা লক্ষ করে।
কুয়াশা তার ব্যাগ থেকে বের করল ছোট দুটো গোল যন্ত্র। চিনেমাটির মারবেলের মত দেখতে ওগুলো। উঁত দিয়ে গোল জিনিস দুটোর গা থেকে দ্রুত। দুটো ক্ষুদ্র পেরেক তুলে নিল সে। তারপর একটি একটি করে ছুঁড়ে দিল শত্রুদের বাড়ির দিকে।
চোখের পলকে অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটে গেল। গোটা বাড়িটা দেখতে না দেখতে গাঢ় রঙের ধোয়ায় ঢাকা পড়ে গেল।
জংলীরা সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল। দেবতা তার কেরামতি দেখাতে শুরু করেছে, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তাদের।
গোটা বাড়িটা ধোয়ায় ঢাকা পড়ে যেতে কুয়াশা সর্দারকে ইঙ্গিতে, ডাকল । সর্দার এগিয়ে আসছে। | রোমকে নিচে নামতে বলল কুয়াশা। রোম দ্রুত নেমে এল নিচে। কুয়াশার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কৌতূহল মেটাবার জন্যে সে প্রশ্ন করল, “ব্যাপার কি, ডক্টর :
য়াশা? কি ছুঁড়ে মারলেন আপনি।
মৃদু হেসে কুয়াশা বলল, সামান্য দুটো বোমা ছুঁড়ে মেরেছি। আমার ল্যাবে তৈরি। বাড়ির ভিতর যারা আছে তারা যদি মুখোশ ব্যবহার না করে তাহলে জ্ঞান হারাবে।
আনন্দে উত্তেজনায় হাতসলি দিয়ে উঠল রোম।
কুয়াশা বলল, রোম, তুমি সর্দারকে বলল সে যেন তার লোকদেরকে জানিয়ে দেয় ধোয়া বাতাসে উড়ে না যাওয়া অবধি কেউ যেন ওদিকে পা না বাড়ায়।’
রোম নির্দেশ পালন করল ।
কুয়াশা ধোয়ায় ঢাকা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল তার লেসার গানের
•া ।
শত্রুপক্ষ লেসার গান ব্যবহার করেনি। তবে কি তাদের হাতে পড়েনি । সনিসটা? কোনও জংলী কৌতূহল বশত সেটা চুরি করে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে?
•য়াশা ৩৯
১১৫
লেসার গান ছাড়া এই বিপদসঙ্কুল অরণ্যে নিজেকে দুর্বল লাগল কুয়াশার। তা বিশেষ দুশ্চিন্তা শত্রুপক্ষকে নিয়ে।
তাদের হাতে যদি লেসার গানটা পড়ে এবং তারা যদি ওটা ব্যবহার করা কলাকৌশল শিখে ফেলে, তাহলে মহা বিপদ আছে কপালে।
ধোয়া, সরে যাচ্ছে। অধীর হয়ে উঠছে-জংলীরা। রোম হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “ডক্টর কুয়াশা!’
রোমের দিকে ঝট করে তাকাল কুয়াশা। রোম, তাকিয়ে আছে আকাশে দিকে।
পঙ্খীরাজ ঘোড়াটাকে অনেক উঁচুতে এক মুহূর্তের জন্যে দেখতে পেল কুয়াশা।
শত্রুপক্ষ পালাচ্ছে নিরাপদে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আবার একবার দেখ গেল যান্ত্রিক ঘোড়াটাকে। পরিষ্কার দেখা গেল ঘোড়ার পেটের কাছের একটা খোল জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে লেসার গানের লম্বা, সরু চকচকে ইস্পাতে ব্যারেলটা।
ধোয়া সরে যেতে বাড়ির ভিতর ঢুকল কুয়াশা সর্দার এবং বোমকে সাথে নিয়ে জংলীরা রইল বাড়ির চারদিকে।
বাড়ির ভিতর রাইফেলের গুলিতে নিহত তিনজন শ্বেতাঙ্গকে পাওয়া গেল ছাদের উপর পাওয়া গেল বাকি চারজনকে। বিষাক্ত তীর বিদ্ধ হয়ে মারা গেছে
তারা।
পালিয়েছে কেবল ডেভিড। পালের গোদা ডেভিড বুদ্ধিমান এবং চতুর লোক বুঝতে পারল কুয়াশা। তা না হলে সময় মত পালাতে পারত না সে।
জংলীরা বাড়ির যাবতীয় জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল গ্রামের দিকে কুয়াশার নির্দেশে। সর্দার ও কুয়াশা ফিরে চলল গ্রামের দিকে।
তখন সন্ধ্যা হবো হবো।
গ্রামে ফিরে এসে সর্দার গেল মেয়েদের খোঁজ খবর নিতে। কুয়াশা জংলীদে বিচারালয়ে ঢুকল।ড, মূরকোট সেখানে আহত জংলীদের চিকিৎসা করছেন। | একা পেরে উঠছিলেন না বৃদ্ধ। কুয়াশা তাকে দম ফেলার ফুরসত দিয়ে দায়ি) নিল চিকিৎসার। দ্রুত অপারেশন করে ছয়জন জংলীর শরীর থেকে মোট নয়টা বুলে বের করল সে। ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে জোনজা কর্তৃক আহত জংলীদের ক্ষতস্থা পরীক্ষা করতে শুরু করল কুয়াশা। কিন্তু কাজের মাঝপথে বাধা পড়ল।
ঝড়ের বেগে বিচারালয়ে প্রবেশ করল জংলী সর্দার। | দেবতা অর্থাৎ কুয়াশার সামনে হাঁটু ভেঙে নামাজ পড়ার ভঙ্গিতে বসে সর্দ উত্তেজিত গলায় দুর্বোধ্য ভাষায় কি সব বলতে লাগল।
১১৬
ভলিউম ১
সর্দারের কথা শেষ হতে ড. মূরকোট কুয়াশাকে সর্দারের বক্তব্য বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, গতকাল একজন বাঙালী অ্যাঙলো এই গ্রামে এসেছিল। লোকটা নিজের পরিচয় দেয় আপনার বন্ধু বলে। নাম বলে স্যানন ডি কস্টা তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কখন থেকে?
ডি. কস্টা বেঁচে আছে মনে মনে ধারণা করেছিল কুয়াশা। পঙ্খীরাজ ঘোড়া তাদের ইয়টে নেমেছিল এবং কোন না কোন ভাবে ডি. কস্টা তাতে চড়ে ইয়ট থেকে উড়ে এসেছে-বুঝতে পারল কুয়াশা।
* জোনজা গ্রাম আক্রমণ করার পর থেকেই। | ড. মূরকোট আবার বলতে শুরু করলেন, “ফললা নামে এক জংলী বীরের ওপর দায়িত্ব ছিল গ্রামের সব কুমারী যুবতী মেয়েদেরকে গ্রাম থেকে খানিক দূরে একটা নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাবার । কিন্তু ফললা মেয়েদেরকে দেখতেই পায়নি। তখন থেকে সে মেয়েদেরকে খুঁজছে। গ্রামে বা গ্রামের আশপাশে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। কিন্তু কোথাও নেই তেরোজন মেয়ে। সেই সাথে আপনার সঙ্গী স্যানন ডি, কস্টাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। ফললা যেখানে মেয়েদেরকে নিয়ে যাবে স্থির হয়েছিল সেখানেও লোক পাঠিয়ে দেখা হয়েছে। কেউ নেই সেখানে।
কুয়াশাকে চিন্তিত দেখাল। মেয়েগুলোর নিখোঁজ হওয়ার সাথে ডি, কস্টার অদৃশ্য হবার যে একটা সম্পর্ক আছে তা অনুমান করতে পারল সে। কিন্তু আসলে কি ঘটেছে তা ভেবে পেল না।
কুয়াশা প্রশ্ন করল, রাসেল ফেরেনি?”
না,’ ড, মূরকোট জানালেন। এদিকে রাত নেমেছে বনভূমিতে।
কুয়াশা পরামর্শ দিল সশস্ত্র কয়েকটি দল কয়েক দিকে যেন এখুনি ওদের খোঁজে রওনা হয়ে যায়।
কুয়াশার হুকুম অনুয়ায়ী কাজ হলো ।
রাত আটটা অবধি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রইল সবাই। কিন্তু ফিরল না কেউ । মেয়েরাও ফিরল না, ডি, কস্টাও ফিরল না, ওদেরকে যারা খুঁজতে গেছে তাদের কোন দলও ফিরল না।
রাত সাড়ে আটটার সময় সশ্রদ্ধভঙ্গিতে সর্দার অনুরোধ করল খাওয়াদাওয়া সেরে নিতে ।
ড. মূরকোট, রোম এবং কুয়াশা চলল সর্দারের বাড়ির দিকে।
ড, মূরকোটের জন্যে আলাদা রান্নাবান্নার ব্যবস্থা চালু আছে। সর্দার তাদের দেবতার জন্যেও আলাদা রাঁধতে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল।
বুনো হাঁসের রোস্ট, যবের রুটি ও গরুর দুধ পান করে আহার শেষ করল কুয়াশা ৩৯
১১৭
ওরা। | রাত বারোটা অবধি গল্পগুজব চলল। ড. মূরকোট জানালেন পঙ্খীরাজ ঘোড়া তার নিজেরই তৈরি।
সর্দার ড. মূরকোটকে বলল, ‘পঙ্খীরাজ ঘোড়া নিয়ে উত্তর দিকে উড়ে গেলে ডেভিড।
চমকে উঠলেন ড, মূরকোট। | কুয়াশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে তিনি বিচলিত গলায় বললেন, উত্তর দিতে জঙ্গল খুব বেশি দূর নেই। জঙ্গলের শেষে গ্রেট ভিক্টোরিয়ার মরুভূমি। মরুভূমি উপর পাহাড় শ্রেণী। পাহাড় শ্রেণীর পর আবার মরুভূমি। এই পাহাড়ে বাস ক ভয়ঙ্কর পিশাচ হাহা জাতি। হাহারা পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর লোক। আজ অব তাদের ওদিক থেকে কেউ জ্যান্ত ফিরে আসতে পারেনি। দেখামাত্র ধরে বলি দে তাদের ধর্ম। ডেভিডকে হাহারা খুব ভয় করে। কারণ পঙ্খীরাজ ঘোড়া আমার কা থেকে কেড়ে নিয়ে ওদের এলাকায় গিয়েছিল। হাহারা সেটা দেখে খুব ভয় পায় তবে ডেভিড ওদের কোন ক্ষতি করেনি। ডেভিড যদি ওদের ওখানে গিয়ে আশ্রয় নে। তাহলে বড় বিপদের কথা।
কুয়াশাকেও চিন্তিত মনে হলো। খানিক পর সে প্রশ্ন করল, আপনি আমার বালির নমুনা পাঠিয়েছিলেন কোথা থেকে নিয়ে?
‘ডেভিডের সাথে গ্রেট ভিক্টোরিয়ার মরুভূমিতে গিয়েছিলাম আমি। হাহাদে পাহাড় ছাড়িয়ে আরও মাইল ত্রিশেক দূরে ওই বালি সংগ্রহ করি আমি। ডেভি আমাকে নিয়ে গিয়েছিল পঙ্খীরাজে চড়িয়ে।
| কুয়াশার গলায় বিস্ময়, ‘আপনি বলতে চান ডেভিডের সাথে তখন আপনা সম্পর্ক ভাল ছিল?
ভাল ছিল! বলেন কি! আপনি বালি চেয়ে মেসেজ পাঠাবার সাথে সাথে সে কথা জানতে পারে ডেভিড। তখন ডেভিডের হাতে বন্দী আমি। ডেভিড আমারে চাপ দিচ্ছে জোনাকে ত্রুটিমুক্ত করার জন্যে। জোনজকে ত্রুটিমুক্ত করা হলে সুপারম্যান তৈরি করার ফর্মুলাটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবার পরিকল্পনা ছি তার। কিন্তু আমি ত্রুটিমুক্ত করতে সফল হতে পারছিলাম না। ডেভিড অবশ্যি । বিশ্বাস করেনি। তার ধারণা আমি ইচ্ছা করে জোনজাকে ত্রুটিমুক্ত করিনি। । ব্যাপারে আমাকে সে মারধরও করেছে।’
ড, মূরকোট দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘শে অবধি সে আমাকে জিজ্ঞেস করল জোনজাকে ত্রুটিমুক্ত করা আমার দ্বারা সম্ভ কিনা। আমি বললাম-না, আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তবে একজনের দ্বারা সম্ব। তিা হলেন ড. কুয়াশা। ডেভিডের সাথে আমার এ কথা হবার তিনদিন পর আপনা মেসেজ এল। সে-খবর স্বভাবতই জানত ডেভিড। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে বালি সংগ্র
ভলিউম ১
১১৮
করে দিল আমাকে। এরপর একদিন একটা সুযোগ পেয়ে আপনাকে মেসেজ পাঠালাম সকলের অজ্ঞাতে। তারপর ডেভিড আপনাকে একটা মেসেজ পাঠাতে নির্দেশ দিল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আবার একটা মেসেজ পাঠালাম।’
কুয়াশা বলল, আপনার মেসেজের পরস্পর বিরোধিতা দেখেই আমি বুঝতে পারছিলাম আপনি কোন জটিল বিপদে পড়েছেন।
‘বিপদ বলে বিপদ। স্বচক্ষেই তো সব দেখেছেন। জোনজাকে কি ত্রুটিমুক্ত করা সম্ভব, ডক্টর কুয়াশা?’
চিন্তিত ভাবে কুয়াশা বলল, ‘সম্ভ, ডক্টর মূরকোট, অবশ্যই সম্ভব।
আপনি পারবেন?’ আশায় আনন্দে বৃদ্ধ বিজ্ঞানীর দু’চোখের কোনে জল এসে পড়ল। | চেষ্টার ত্রুটি করব না, উ, মূরকোট। এবং চেষ্টা করে আজ অবধি কোন কাজে আমি ব্যর্থ হইনি। এখন সবচেয়ে আগে দরকার জোনজাকে ধরে আনা।’
| বৃদ্ধ বললেন, “সে দায়িত্বও আপনাকে নিতে হবে, ডক্টর কুয়াশা। জোনজার জন্যে রাতে আমি ঘুমাতে পারি না আজ মাসখানেক ধরে। তার ওপর ফোমকে নিয়ে প্রায়ই সে পালাচ্ছে। ওরা ছোটবেলা থেকে বন্ধু ছিল। দুজন দুজনকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারত না। মাত্র বছর দুয়েকের বড় জোনজা আমার ফোমের চেয়ে। জোনজা সর্দারের ছেলে, তা নিশ্চয়ই জানেন?’
বৃদ্ধের চোখ থেকে টপটপ করে দু’ফোঁটা জল পড়ল।
কুয়াশা বলল, আপনি মুষড়ে পড়লে চলবে না, ড. মূরকোট। ধৈর্য ধরুন। আমি যখন এসে পৌঁছেছি তখন আপনার কোন ভয় নেই।’
খানিক পর আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। হাহাদের সম্পর্কে সব কিছু জানতে চাইল কুয়াশা। ড, মূরকোট বলতে শুরু করলেন। | হাহাদের সম্পর্কে শুনতে শুনতে কুয়াশার মত অসমসাহসী বীরও শিউরে উঠল । হাহারা ভয়ঙ্কর নরমাংসভক্ষণকারী অসভ্য জাতিদের মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র এবং দুর্ধর্ষ তাতে কোন সন্দেহ রইল না কুয়াশার।
মনে মনে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করল সে। হাহাদের এলাকা পেরিয়েই তাকে যেতে হবে ইউরেনিয়ামের সন্ধানে।
রাত গম্ভীর হয়েছে। মধ্যরাত্রি পেরিয়ে যাবার পর সর্দার কুয়াশাকে তার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে দিল।
কুমারী মেয়েরা, ডি, কস্টা বা তাদেরকে খুঁজতে গেছে যারা তারা কেউ ফিরে আসেনি তখনও।
পাঁচ তখনও সূর্য ওঠেনি। তবে সকাল হয়েছে। হৈ-চৈ-এর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল কুয়াশা ৩৯
১১৯
কুয়াশার। বিছানা ছেড়ে উঠে বসল ও। ডি, কস্টার গম্ভীর গলা শোনা যাচ্ছে, উহাড়ের কোই ডোষ নাই! উহাডেরকে টরচার করিবেন না, প্লীজ! টাহা ছাড়া উহারা অবলী মেয়েলোক। টাহাছাড়া উহারা বর্নমানে হামার ওয়াইফ।
হেসে ফেলল কুয়াশা। উঠে দাঁড়িয়ে আলখাল্লাটা পরে দরজার দিকে এগোেল। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে কিন্তু কুয়াশার হাসি উবে গেল এক মুহূর্তে।
উঠানে জংলীদের ভিড়। সর্দারকেও দেখা যাচ্ছে। রোম দাঁড়িয়ে রয়েছে সর্দারের পাশেই। ড, মূরকোটকে কোথাও দেখতে পেল না কুয়াশা। | উঠানের শিশির ভেজা মাটিতে সারবন্দীভাবে শুইয়ে রাখা হয়েছে পাশাপাশি তেরোজন মেয়েকে। প্রতিটি মেয়ের হাত পা চেপে ধরেছে কয়েকজন করে শক্ত সমর্থ পুরুষ।
| প্রতিটি মেয়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে একজন করে জংলী ধারাল এক একটা অস্ত্র নিয়ে কি যেন করছে। ডি কস্টা সর্দারের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। দ্রুত সেদিকে পা বাড়াল কুয়াশা।
কুয়াশাকে দেখে জংলীরা আনন্দ-ধ্বনি করে উঠল। কিন্তু যে-যার কাজ থেকে বিরত হলো না।
কুয়াশা মেয়েগুলোর মাথার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রতিটি মেয়ের সামনের দুটো করে দাঁত অস্ত্র দিয়ে ঘা মেরে তুলে ফেলা হচ্ছে।
কুয়াশা রোমকে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার, রোম?’, | রোম কুয়াশার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, মি. ডি কস্টা গ্রামের তেরোজন কুমারী মেয়েকে গতরাতে বিয়ে করেছেন। নিয়ম মত বিয়ের আগে মেয়েদের একটি করে দাঁত তুলে নিতে হচ্ছে। কোন মেয়ে যদি বিয়ের আগে দাঁত তুলে নেবার কাজটা না সারে তাহলে বিয়ের পরদিনই তার দুটো দাঁত তুলে নেবার নিয়ম আছে।’
ডি. কস্টা লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে কুয়াশার দিকে। সর্দারও আসছে।
‘মি, কুয়াশা।’ করুণ কণ্ঠে ডেকে উঠল ডি কস্টা। •
বলুন।’ একটু যেন বিরক্ত হলো কুয়াশা। বিপদে পড়লে ডি. কস্টা কুয়াশাকে স্যার স্যার করে অস্থির হয়ে পড়ে।
হামাকে, “স্যার, ওরা বিপদে ফেলে দিয়েছে, স্যার!’ ডি, কস্টা বলতে শুরু করল, হামাকে নাকি একডজন একটা হাহা খুন করতে হবে। তা না হোলে হামাকে উহারা জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। ওনলি ডশডিনের টাইম ডিটে চাইছে সম্ভার, স্যার। স্যার, হাপনি আমাকে বাঁচান, স্যার আপনার ডুটো পায়ে ঢারি!… “
ডি. কস্টা নিচু হলো কুয়াশার পা জড়িয়ে ধরার অভিপ্রায়ে।
কড়া একটা ধমক দিল কুয়াশা, চুপ করে দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ান। যা জিজ্ঞেস করব তার বেশি একটাও কথা বলবেন না। ১২০
ভলিউম ১৩
= =
= =
=
=
=
. কুয়াশা রোমের দিকে তাকাল। বলল, ‘সর্দারের বক্তব্য কি জিজ্ঞেস করো তো, বোম।
সর্দার জানাল তাদের পূর্ব পুরুষদের দেবতা ছিলেন আলআলতালা। আলআলতালাই নতুন করে জন্মলাভ করে তাদের মাঝখানে এসেছেন। প্রাচীন যুগে। স্বয়ং আলআলতাল যে আইন প্রণয়ন করেছিলেন সেই আইনই আজ অবধি চালু আছে। সুতরাং দুইটার বেশি বিয়ে করলে সেই আইন অনুযায়ী যে শাস্তি ডি, কস্টার। পাবার কথা তাই সে পাবে বলে সর্দারের ধারণা।
জংলীরা কুয়াশাকে আলআলতালা নামে দেবতা বলে মনে করছে।
কুয়াশা খানিকক্ষণ চিন্তা করল। সর্দার যে শান্তি ডি. কস্টাকে দিয়েছে তা বদলাতে গেলে জংলীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। এদিকে দশ দিনের মধ্যে তোরোজন হাহাকে হত্যা করাও ডি, কস্টার পক্ষে অসম্ভব। একজন হাহাকে হত্যার করার চেষ্টা করতে গেলেও হাহারা ডি. কস্টাকে ধরে জীবন্ত অবস্থায় ছিঁড়ে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। হাহারা সাধারণত তাই করে।
কুয়াশা আরও খানিকক্ষণ চিন্তা করে সর্দারকে জানাল, ডি, কস্টাকে এক মাসের সময় দেয়া যেতে পারে। এবং এরপর থেকে সমাজে কেউ দুটোর বেশি বিয়েই করতে পারবে না। যে করবে তাকে বের করে দেয়া হবে সমাজ থেকে। পুরানো আইন আজ থেকে বাতিল হলো । আগুনে নিক্ষেপ করার চেয়ে সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়াটাই উচিত শাস্তি।’
সর্দার দেবতার সমাজ সংস্কারের নমনীয় পদ্ধতি দেখে আনন্দে হর্ষধ্বনি করে উঠল।
ডি. কস্টা কুয়াশার ধমক ভুলে গিয়ে বলে উঠল, ‘কিন্তু, স্যার, আমি ওনলি ওয়ান মান্থের মডেই বা কি করে একডজন একটা হাহা খুন করিব, স্যার?’
| কুয়াশা বলল, কি করে করবেন তা আমি কি জানি। বিয়ে যখন করতে পেরেছেন তেরোজন মেয়েকে তখন তেরোজন হাহাকেই বা খুন করতে পারবেন না কেন?’
| রোম ডি কস্টার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি সময় নষ্ট করবেন না, মি. ডি. । এখানকার নিয়ম আপনি জানেন না। জানলে এক সেকেণ্ড নষ্ট করার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না। সন্ধ্যার আগে অবধি কি কি কাজ সারতে হবে। আপনাকে জানেন?’
‘কি?’ ঢোক গিলে জানতে চাইল ডি কস্টা ।
‘তেরোজন মেয়ের গুরুজন আপনাকে তেরোটা শুয়োর ছানা দেবে। সেগুলোকে জবাই করে ছাড়িয়ে ধুয়ে লবণ দিয়ে পোড়াতে হবে। তেরোজন মেয়ের ছাব্বিশটা দাঁত, পাথর দিয়ে খুঁড়িয়ে আটার মত করে তেরোজন মেয়ের মা খালার মাথায় ছড়িয়ে দিয়ে আপনি চলে যাবেন পাহাড়ী নদীতে। নদী সাঁতরে ওপারে যেতে
কুয়াশা ৩৯
১২১
হবে। সেখান থেকে মাটি নিয়ে এসে মেয়েদের মা-খালার মাথায় মাখিয়ে ধুইয়ে দিতে হবে। নতুন কোমরবন্ধনী তৈরি করতে হবে চোদ্দটা। একটা অবশ্য আপনার নিজের জন্যে। বাকিগুলো আপনার স্ত্রীদের। সেগুলো আপনারা পরবেন সন্ধ্যার পর। সন্ধ্যার পরে খাওয়া দাওয়া পরিবেশন করবেন আপনি। গ্রামের প্রতিটি লোককে পেট ভরে খাওয়াতে হবে। তারপর আর কোন কঠিন কাজ আপনাকে করতে হবে না। তবে নাচতে হবে আগামীকাল সকাল অবধি।’
| ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ডি, কস্টার মুখ । কুয়াশার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে করুণ কণ্ঠে সে বলতে লাগল, ‘স্যার, এবারের মত আমাকে মাফ করে ডিন, স্যার। সর্দারকে বুঝিয়ে নিয়ে আপনি একটা ব্যবস্থা করুন। তা না হলে আপনি অনুমতি ডিন, স্যার, পালিয়ে যাই ইয়টে…।’ | কুয়াশা, আবার ধমকে উঠল, “খবরদার! পালাবার চেষ্টা করবেন না। সে চেষ্টা করলে ওরা মেরে ফেলবে আপনাকে। যা যা করতে হবে শুরু করুন। সব কাজ, শেষ করতে না পারলে সর্দারকে বুঝিয়ে বলব আমি। কিন্তু সব কাজ যাতে শেষ হয় সেই চেষ্টাই করুন। | | রোমকে কুয়াশা পঁচটা ঘোড়া সংগ্রহ করার জন্যে বলল। চারজন জংলীকেও দরকার। সর্দার কুয়াশার নির্দেশ পেয়ে ঘোড়া যোগাড় করে দিল। চারজন জংলীকে নিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে গেল কুয়াশা তীরবেগে ঘোড়ার পিঠে চড়ে।
রাসেলের সন্ধানে গেল কুয়াশা।
।
ছয় আড়াই তিন হাত দূর থেকে সামনের জানোয়ারটা কথা বলে উঠল, ‘রাসেল।– আবার চমকে ওঠায় তাল হারিয়ে ফেলেছিল রাসেল। অপ্রত্যাশিত ঘটনার
জন্যে কেইবা আর আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকে।
মাথার উপরের ডালটা ছেড়ে দিয়ে রাসেল সামনের একটা ডালে গিয়ে বসল।
নেকড়েটা সেই একই জায়গা থেকে ডাকছে। ভয়ে পিছন ফিরে তাকায়নি রাসেল অনেকক্ষণ। মাত্র চার পাঁচ হাত পিছনে নেকড়েটা আছে বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার ডাক শুনে। কিন্তু কেন যে সে এগিয়ে আসছে না বা ঝাঁপিয়ে পড়ছে না তার উপর তা বুঝতে পারছে না রাসেল।
সামরে বিপদটা কেটে গেছে।
ফোম আবার দু’হাত দূর থেকে নিচু গলায় ডাকল, রাসেল। কথা বলছ না কেন? খুব ভয় পেয়েছ বুঝি?’
এগিয়ে আসছে ফোম। ফোম, আমার পিছনের ডালে একটা নেকড়ে বসে আছে।
চাপা হাসি শোনা গেল। ফোম হাসছে শুনতে পেয়ে বিস্মিত হলো রাসেল।— ১২২
ভলিউম ১৩
হাসছে কেন মেয়েটা? নেকড়ের ডাক না শোনার কথা নয় ওর।
মুখোমুখি এসে থামল ফোম। নিচের দিকে তাকাল। বিদ্যুৎবেগে হাত নেড়ে অবিরাম মশার সাথে যুদ্ধ করছে জোনজা। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে তাকে।
তোমাকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম, রাসেল বলল, আমার পিছনে একটা নেকড়ে অনেকক্ষণ থেকে…’
‘ওটা নেকড়ে নয়, রাসেল,’ বলল ফোম। নেকড়ে কি গাছে চড়ে? ওটা আসলে লিয়র পাখি। দেখতে ময়ূরের মত। বড় পাজি পাখিটা। ভয় পাইয়ে দিয়ে মজা পায় খুব। লিয়র যে কোন জীব জানোয়ারের ডাক হুবহু নকল করতে পারে। ফিসফিস করে কথা বলছে ফোম। জোনজা যেন তার কথা শুনতে না পায়।
জোনজা কি গ্রামে গিয়েছিল?’ জানতে চাইল ফোম। হ্যাঁ। বহু জংলীকে খুন করে এসেছে ও। ‘এবার নিয়ে চারবার হলো।’ চিন্তিতভাবে বলল কথাটা ফোম।
ডক্টর মূরকোট ওকে মেরে ফেলছেন না কেন? এভাবে যদি মানুষ খুন করতে থাকে•••।’
| ‘ও কথা বোলো না, রাসেল।’ ফোম দীর্ঘশ্বাস ফেলল, জোনজাকে আজ আমিও ভয় পাই। কিন্তু একদিন ও আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল। সারাটা দিন আমরা একসাথে থাকতাম। আমাকে না নিয়ে কোথাও যেত না জোনজা। আমাকে ছাড়া একদণ্ডও থাকতে পারত না।’
দুষ্ট, লিয়র পাখিটা আবার ডেকে উঠল নেকড়ের নকল করে।
ফোম আবার বলল, জোনজাকে ধরে বন্দী করা দরকার। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও বাবা তা পারছেন না।
রাসেল বলল, “জোনজা আবার স্বাভাবিক এবং সুস্থ হবে বলে তুমি আশা করো?”
বাবা তো আশা করেন। বাদ দাও ওর কথা।’ ফোম উদাস হয়ে উঠল। রাসেল প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যে জিজ্ঞেস করল, “তোমার খিদে পায়নি?
পেয়েছে। তোমার?’
‘আমারও। কিন্তু সকাল না হওয়া অবধি পেটে কিছু দেয়ার কথা তো ভাবাই যায় না।
যায়।’ ফোম নড়ে উঠল, তুমি চুপচাপ বসে থাকো । দেখি আমি কি করতে পারি।’ ফোম ঘুরে দাঁড়াল ডালের উপর।
কোথায় চললে?’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল রাসেল।
ভয়ের কিছু নেই। এই জঙ্গলে আমি বড় হয়েছি। অচেনা অজানা কিছু নেই কুয়াশা ৩৯
১২৩
আমার।’
চলে যাচ্ছে ফোম।
দেখতে দেখতে এক ডাল থেকে আর এক ডালে পা দিতে দিতে অদৃশ্য হয়ে গেল সে!
প্রায় আধঘন্টা পর আবার দেখা গেল ফেমিকে। ফিরে আসছে সে। কাছাকাছি এসে ফোম সহাস্যে বলল, হাত পাত্রে তো দেখি, রাসেল।
দুহাত একত্রিত করে ফোমের সামনে মেলে ধরল রাসেল। ফোম ওর হাতে একরাশ বাদাম দিয়ে বলল, এগুলো কিন্তু সাধারণ বাদাম নয়। নিড়ি বলে এগুলোকে এখানে। কি রকম স্বাদ খেয়ে দেখো।
সত্যি নিড়ির স্বাদ অপূর্ব লাগল রাসেলের।
বাদাম খেতে খেতে রাসেল জিজ্ঞেস করল, জোনজার হাত থেকে নিষ্কৃতির উপায় কি বলো তো? গাছ থেকে নামব কিভাবে আমরা?’
ভেবো না। সে ব্যবস্থাও করে এসেছি। এই নাওঁ, ধরো। এগুলো রেখে দাও পকেটে। ‘ | হাত পাতল রাসেল। ছোট ছোট আমের মত চার পাঁচটা অচেনা ফল দিল ফোম।
কি এগুলো?
বুনো ফল। মুশো বলে এগুলোকে জংলীরা। বিষাক্ত। একটা খৈলেই অজ্ঞান হয়ে যাবে যে-কোন লোক। সকাল হলে জোনার কোলে ফেলব ওপর থেকে। ওরও খিদে লাগবে তখন। দু’একটা যদি খায় তাহলে কাজ হবে।’
কিন্তু যদি না খায়, বা খেলেও কোন কাজ না হয়?’
‘কাজ হবেই। যদি না খায়? না খেলে তখনকার কথা তখন ভাবা যাবে। অকারণে দুশ্চিন্তা না করে এসো গল্প করে রাতটা কাটিয়ে দিই।’
“কি গল্প শুনতে চাও?
দাঁড়াও আগে তোমার পাশে গিয়ে বসি।
ফোম সরে এসে রাসেলের গায়ে গা ঠেকিয়ে পাশে বসল। বলল, হ্যাঁ, এবার বলো। তোমার দেশের কথা বলো রাসেল, তোমার নিজের কথা বলো। আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাই। বাংলাদেশের মানুষদের সম্পর্কে জানতে চাই। ওখানকার যুবকরা কি সবাই তোমার মত সাহসী আর বুদ্ধিমান?’
. গল্প শুরু করল রাসেল। রাত আস্তে আস্তে বাড়ছে। এক সময় রাসেলের গল্প শেষ হলো। এবার ফোমের পালা। ফোম নিজের সম্পর্কে, জংলীদের সম্পর্কে জেনজার সম্পর্কে অনেকক্ষণ গল্প করল। জোনজার.. সাথে ফোমের সম্পর্ক চিরকালের জন্যে স্থায়ী করার কথা ভেবেছিলেন ফোমের বাবা এবং জংলী সর্দার একথাটাও প্রকাশ করল ফোম। জোনাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে ফোমের পছন্দ ছিল
ভলিউম ১৩
১২৪
খুব। তখন জোনজা ছিল জংলীদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র, শান্ত, বুদ্ধিমান এবং আন্তরিক। কেউ কোনদিন না হেসে কথা বলতে দেখেনি জোনজাকে। একটা পিঁপড়ের উপরও অসীম দয়া ছিল তার। ক্ষমা করা ছিল জোনজার মহৎ একটা গুণ । কারও মনে কখনও সে আঘাত দিত না। জোনুজার প্রতি প্রচণ্ড একটা আকর্ষণ ছিল ফোমের।
কথার শেষে ফোম বলল, আমি কাউকে কোনদিন এ সম্পর্কে কিছু বলিনি। | কিন্তু সবার বিরুদ্ধে আমার অনেক বড় অভিযোগ আছে। বাবা কেন তার পরীক্ষার জন্যে ওকে বেছে নিলেন? জানো, রাসেল, মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয়?’–
আস্তে জিজ্ঞেস করল রাসেল, “কি মনে হয়?
মনে হয় বাবাকে আমার ঘৃণা করা উচিত। মনে হয়..।’..
“ছিঃ, ফোম।ড. মূরকোট ইচ্ছা করে জেনজার এই ক্ষতি করেননি। একথা তোমার ভোলা উচিত নয়। বিজ্ঞানের সাধক তিনি••।’. | ‘জানি, সব জানি। কিন্তু চোখের সামনে জোনজার হাল দেখে আমার যে কি | কষ্ট হয় রাসেল তা কেউ বুঝবে না।’
ফোমের কাঁধে হাত রাখল রাসেল। বলল, “আর কেউ না বুঝুক, আমি বুঝি ফোম।
যুঁপিয়ে উঠে ফোম রাসেলের কাঁধে মাথা রাখল।
সূর্য ওঠার আগেই বনভূমি কাঁপিয়ে তুলল জোনজা রাসেলের সাথে গাছের উপর ফোমকে দেখে।
উপর থেকে জোনজাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। বড় বড় মাটির টুকরো ছুঁড়ে মারতে লাগল সে ওদের দিকে। অবশ্য তাতে কোন ক্ষতি হলো না ওদের।
ফোম চাপা স্বরে রাসেলকে বলল, রাসেল, তুমি বাদাম খাও তোমাকে খেতে | দেখলে ওরও খিদে পাবে।
রাসেল বাদাম ছাড়িয়ে মুখে দিতে লাগল।
দমাদম ঘুসি মারছে জোনজা নিজের বুকে। প্রচণ্ড ক্রোধে গর্জে উঠছে সে বিকটস্বরে। বুকের রক্ত ঠাণ্ডা হিম হয়ে যাবার অবস্থা সে গর্জনে।
ফোমের হাতে বিষাক্ত ফলগুলো দিল রাসেল পকেট থেকে বের করে।
• একটি একটি করে নিচে ফেলল ফোম সেগুলো। মুহূর্তের জন্যে শান্ত হলো জোনজা.। মাটিতে পড়া ফলগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেশ কয়েক মুহূর্ত। তারপর একপা-দু’পা করে এগিয়ে এসে মাটি থেকে তুলে নিল দুটো ফল। দুটো ফলই একসাথে মুখের ভিতর ফেলল জোনজা। | চাপা স্বরে রাসেল বলে উঠল, “খাচ্ছে। কুয়াশা ৩৯.
| ‘
.
১২৫
.
ফোমের শঙ্কিত, গলা শোনা গেল, জেনেশুনে মারাত্মক কোন ক্ষতি করে ফেললাম না তো? জোনজা যদি মারা যায়…’
ফোমের কথা শেষ হবার আগেই প্রচণ্ড আর্তনাদ করে উঠল জোনজা। দুটো হাত উপর দিকে তুলে দিয়ে দাঁতে দাঁত চাপছে সে। তাকিয়ে আছে সে বিস্ফারিত চোখে উপর দিকে।
. জোনজা কাঁপছে,
একমুহূর্ত পরই সশব্দে মাটিতে পড়ে গেল জোনজা। পড়েই স্থির হয়ে গেল তার প্রকাণ্ড শরীরটা। | নিঃশব্দে নামতে শুরু করল ওরা। আশঙ্কায় কালো হয়ে গেছে ফোমের চোখ
মুখ ।
নিচে নেমে এসে রাসেল গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করল জোনার পালস।
না ভয় পেয়ো না, ফোম। জোনজা মরেনি। শুধু জ্ঞান হারিয়েছে।’ ‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি যে হয়…’
জোনজার কাছ থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে সরে এসে বসল ওরা পাশাপাশি।
সময় বয়ে চলল। চুপচাপ বসে রইল ওরা জোনজার দিকে তাকিয়ে। কারও মুখে কোন কথা নেই।
গাছের উপর শব্দ হতে মাথা তুলে এক সময় তাকিয়ে গতরাতের লিয়র পাখিটাকে দেখতে পেল রাসেল। ঠিক ময়ূরের মতই দেখতে। ফোম পাখিটা সম্পর্কে আরও অনেক কথা বলেছে ওকে। লিয়রের লেজের পালক সংখ্যা ষোলোটা। লম্বা পাখিটা দেখতে বড় সুন্দর লাগল রাসেলের। গায়ের পালকের রঙ খয়েরী, লাল লাল ফোঁটা সারা গায়ে। আকারে মাঝারি হাঁসের মত। রাসেলের দিকেই সকৌতুকে তাকিয়ে আছে পাখিটা। লিয়রের বয়স তিন কি চার হলে লেজের পালকগুলো বড় হয়। সঙ্গিনীকে ডাকার সময় পেখম মেলে ধরে সে। লিয়র শিকার করা জংলীদের মধ্যে দণ্ডনীয় অপরাধ। জংলীরা অসভ্য হলেও দুষ্প্রাপ্য পাখিকুলকে বাঁচিয়ে রাখার প্রবণতা আছে জেনে অবাক না হয়ে পারেনি রাসেল। সাধারণত গাছে বা পাহাড়ের চূড়ায় বাসা বানিয়ে বাস করে ওরা।
: প্রায় আধঘণ্টা পর আবার একবার পরীক্ষা করল রাসেল জোনাকে।
মারা যায়নি জোনজা। পালস ঠিকমতই চলছে। তবে জ্ঞান ফেরার কোন লক্ষণ তার মধ্যে নেই। বুনো লতা দিয়ে দুটো দড়ি বানাল, রাসেল। একটি গাছের সাথে জোনুজার পা দুটো বাধল ও একটা দড়ি দিয়ে। বাকি দড়িটা দিয়ে বাধল হাত দুটো ।
কতক্ষণ লাগবে গ্রামে ফিরতে আমাদের?’ হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল । রাসেল।
১২৬
ভলিউম ১৩
‘ঘন্টা তিনেক তো বটেই। অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিল ফোম।
ফোমের পরনে রাসেলের দেয়া সেই শার্টটা অতিরিক্ত লম্বা বলে রক্ষে। তবু হাঁটু অবধিও ঢাকতে পারেনি সে। ফোমের ফর্সা মাংসল উরুর খানিকটা দেখা যাচ্ছে।
অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে শার্টটা । জোনজার কাণ্ড। বোম ছিঁড়েছে চারটে। বাতাসে কঁক হয়ে যাচ্ছে মাঝখান থেকে মাঝে মাঝেই। লজ্জায় অস্থির হয়ে উঠছে ফোম। রাসেলের চোখে ধরা পড়ে যাবে ভেবে ভীষণ খারাপ লাগছে তার।
দ্রুত হাঁটছিল রাসেল।
ঘন্টা দুয়েক পর হঠাৎ পিছন থেকে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ফোম রাসেলের উপর। রাসেলের একটা হাত ধরে বাঁ দিকে ছুটতে শুরু করল সে।
“কি হলো ফোম?’ | একটা ঝোঁপের ভিতর রাসেলকে নিয়ে এল ফোম । হাঁপাতে হাঁপাতে ও বলল, কথা বোলো না। বসে পড়ো। শুনতে পাচ্ছ না ঘোড়া ছুটিয়ে কারা যেন আসছে?’
‘কান পাতল রাসেল। হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছে সে। কারা যেন এদিকেই আসছে ঘোড়া হুটিয়ে।
. চাপাস্বরে রাসেল জিজ্ঞেস করল, এতে ভয় পাবার কি আছে? গ্রামের জংলীরা হয়তো আমাদেরকে খুঁজতে এদিকে আসছে।
হয়তো। কিন্তু জংলীরা সাধারণত ঘোড়ায় চড়ে না। যারা আসছে তারা। জংলী না-ও হতে পারে।’
তারা ছাড়া আর কে আসবে এ জঙ্গলে? ডেভিডের লোক?
। হাহারা হতে পারে। তারা ঘোড়া ছাড়া আধ গজও যায় না।
• হাহা? অরা আবার কারা?
‘গ্রেট ভিক্টোরিয়া মরুভূমিতে থাকে হাহারা। ভয়ঙ্কর লোক ওরা। তাজা মানুষ ধরে ধরে খায়। ওদের সম্পর্কে তোমাকে অন্য সময় বলব।’
হঠাৎ সামনের গাছ পালার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল কুয়াশাকে। কুয়াশার পিছনে একদল জংলী ।
ঝোঁপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ওরা দু’জন হাঁসতে হাসতে লাগাম টেনে ধরে ছুটন্ত ঘোড়াকে তখুনি দাঁড় করাল কুয়াশা। ঘামে চিক চিক করছে তার কপাল । লাল টকটকে আলখাল্লা পরে সাদা একটা প্রকাণ্ডদেহী ঘোড়ার উপর বসে আছে সে । মুগ্ধ হলে রাসেল। বড় সুন্দর মানিয়েছে কুয়াশাকে গহীন এই অরণ্যে।
“ রাসেল এরং ফোমের দিকে সকৌতুকে তাকিয়ে রইল কুয়াশা খানিকক্ষণ । মিটিমিটি হাসি তার ঠোঁটে।
‘বিরক্ত করলাম নাকি হে তোমাদেরকে?’ কুয়াশা ৩৯.
১২৭
‘
। •
সহাস্যে জিজ্ঞেস করল কুয়াশা, বেড়াচ্ছ বুঝি? হেসে ফেলল রাসেল।
ফোম কুয়াশার রসিকতার অর্থ অনুধাবন করতে পেরে লজ্জা পেল। মাথা নামিয়ে নিল ও। কিন্তু পরমুহূর্তে ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাল। বলল, জানেন, খুব বাঁচা বেঁচে গেছি আমরা।’
রাসেল বলল, “জোনজাকে বিষাক্ত বুনো ফল খাইয়ে আমরা অজ্ঞান করে বেঁধে রেখে এসেছি মাইল তিনেক,পিছনে।’
কুয়াশা বলল, গুড। কিন্তু তোমার ওই বাধায় কি কাজ হবে? কিসের সাথে বেঁধেছ?
‘গাছের সাথে। জ্ঞান ফিরতে দেরি আছে এখনও ওর।’ ‘জায়গাটা ঠিক কোথায় বলতে পারো? | ফোম বলল, আপনি ঠিক চিনবেন না, ড, কুয়াশা। তবে জংলীদেরকে বলে দিলে ওরা চিনবে। ওদেরকে বলে দিচ্ছি। আপনারা সময় মত গিয়ে পৌঁছুতে পারলে ঘোড়ার পিঠের সাথে বেঁধে ওকে গ্রামে আনার একটা উপায় হয়। গ্রামে একবার ধরে আনতে পারলে আর কোন সমস্যা থাকে না।’
জংলীদেরকে পথের নির্দেশ জানিয়ে দিল ফোম।
• কুয়াশা বলল, বোধহয় সারারাত ঘুমাওনি?’
, মানে…।’ “থাক, থাক। বুঝতে পারছি সব। ঠিক আছে, তোমাদেরকে আর বিরক্ত করব নী। যাও তোমরা। গ্রামে গিয়ে ঘুমিয়ে পোড়ো কিন্তু। তা না হলে শরীর খারাপ করবে। সামনে অনেক কাজ।’ | মৃদু হাসি কুয়াশার ঠোঁটে। বিদায় নিল সে ওদের কাছ থেকে। ঘোড়া ছুটিয়ে জংলী চারজনকে নিয়ে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশা।
রাসেল এবং ফোম হাঁটতে শুরু করল আবার।
সাত ঘন্টা দুয়েক পর গ্রামের কাছাকাছি এসে পড়ল ওরা।
ফোম কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ ও তাকাল রাসেলের দিকে।
কান পেতে আছে রাসেলও। অদূরেই গ্রাম। গ্রামের দিক থেকে শোরগোলের শব্দ আসছে।
দ্রুত পা বাড়াল ওরা। শোরগোলের শব্দ ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। ছুটল ফোম । রাসেলও দেখাদেখি দৌড়াতে শুরু করল।..
মিনিট খানেক পর একদল জংলীর দেখা পেল ওরা। পড়িমরি করে ছুটে আসছে
ভলিউম ১৩
১২৮
জংলীরা ঝোঁপ ঝাড় টপকে।
ফোম চিৎকার করে থামতে বলল জংলীদেরকে। কিন্তু তারা থামল না। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে লোকগুলোর মুখ। আতঙ্কিত অরে বিড় বিড় করে তারা বলছে, ‘হহাহাহাহাহা.••।’
ফোম থমকে দাঁড়াল। কি হলো?’
গ্রামে হারা হামলা চালিয়েছে। দিনের বেলায় তো কখনও হামলা চালায় না। ওরা। এ নিশ্চয়ই ডেভিডের কাজ। ডেভিড লেলিয়ে দিয়েছে ওদেরকে।’.
রাসেল দেখল গ্রামের দিক থেকে জংলীরা প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়ে আসছে। চলো, দেখি।’ না!’ রাসেলের একটা হাত ধরে ফেলল ফোম। বলল, “যেতে পারবে না তুমি। একবার ওদের হাতে ধরা পড়লে কেউ ফিরে আসতে পারে না।’
রাসেল ফোমের চোখে চোখ রেখে হাসল। বলল, সকলের সম্পর্কে সে কথা। প্রযোজ্য নয়, ফোম। আমি ধরাই পড়ব না।’
ফোমের হাত থেকে নিজের হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটল রাসেল।
তীক্ষকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ফোম, রাসেল, যেয়ো না! রাসেল, শোনো! রাসেল, কথা শোনো•••!’
দুটল ফোম রাসেলের পিছু পিছু।
জংলীরা রাসেল এবং ফোমকে গ্রামের দিকে ছুটতে দেখেও ভ্রূক্ষেপ করল না। তারা প্রাণ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত।
এক প্রান্ত দিয়ে গ্রামে ঢুকল রাসেল।
গ্রামের অপর প্রান্তে দেখা গেল পনেরো বিশ জন ঘোড়সওয়ারকে। রোদে চকচক করছে লাল, ঘোড়াগুলোর শরীর। চকচক করছে ঘোড়সওয়ারদের নিখুঁত ভাবে কামানো ন্যাড়া মাথা। ঘোড়সওয়ারদের পরনে পর চামড়া দিয়ে তৈরি করা উরুর অর্ধেক অবধি ঢাকা পোশাক। ঊধ্বাঙ্গে পরেনি কিন্তু তারা। পেশী বহুল তামাটে গায়ের ত্বক ঘামে পিচ্ছিল। তাগড়া ঘোড়ার পিঠে শক্তভাবে বসে আছে হাহারা। হাহাদের স্বাস্থ্য দর্শনীয় বস্তু। ভরাট মুখ, বড় বড় না, ছোট ছোট চোখ। প্রতিটি হাহার চেহারায় ফুটে আছে হিংস্র খুনীর নির্মমতা । হাহাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে বর্শী।
রোমকে ঘোড়ার উপর তুলে নিয়েছে একজন হাহা। গ্রাম ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত তারা। | উঠানের এক ধারে পড়ে রয়েছেন ড. মূরকোট। তার কোমরে বিঁধেছে একটা বর্শা। একটু একটু নড়ছেন তিনি। উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। বেঁচে আছেন এখনও। ৯-কুয়াশা ৩৯
| ১২৯
রাসেল মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। ড. মূরকোটের দিকে প্রাণপ ছুটল ও।
ড. মূরকোটের কাছে এসে বসে পড়ল রাসেল । ড. মূরকোটের শরীরের নির চাপা পড়ে রয়েছে একটা রাইফেল। নলটা দূর থেকে দেখেই ছুটে এসেছে রাসেল
| হাহারা পালিয়ে যাচ্ছে। রোমকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা। চিৎকার করছে রে সাহায্যের জন্যে।
ড. মূরকোটের শরীরের নিচ থেকে হেঁচকা টান দিয়ে রাইফেলটা বের করে লম্ব হয়ে শুয়ে পড়ল রাসেল।
একটা বর্শা এসে পড়ল মাথার কাছ থেকে আধ হাত সামনে।
শুয়ে শুয়ে রাইফেলের ট্রিগারে টান দিল রাসেল। চারিদিকের নিস্তব্ধতাকে খাত খান করে দিয়ে গুলির শব্দ হলো। |
হা-আ-আ-আ-আ-হা!”
হাহারা অদ্ভুত কণ্ঠে অবিরাম চিৎকার করছে। সবচেয়ে পিছনের ঘোড়সওয়ারটির মেরুদণ্ডে গিয়ে বিদ্ধ হলো বুলেট।
| বাকা হয়ে গেল হাহার পিঠ। আকাশের দিকে মুখ তুলে মৃত্যু-যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল সে। দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ তার ঘোড়া। হাহার দেহটা পড়ে গেল ঘোড়ার পিঠ থেকে।
রাইফেল হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল রাসেল। হাহাদের দলটা অদৃশ্য হয়ে গেছে জঙ্গলের আড়ালে।
রাসেল!’ | পিছন থেকে ব্যাকুল গলায় ডাকল ফোম। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ঘোড়াটার দিকে হুটল রাসেল। হাত চারেক দূর থেকে লাফ দিল ও। প্রায় উড়ে গিয়ে দু’পা দুদিকে মেলে দিয়ে, ঘোড়ার পিঠে গিয়ে নামল রাসেল।
লাগাম ধরে টান দিতেই পা বাড়াল ঘোড়া।
পিছন থেকে ফোমের কান্নাজড়িত কণ্ঠ ভেসে আসছে, রাসেল, ফেরো, রাসেল, ফিরে এসো…।
| জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঘোড়া ছুটছে। ছুটছে না বলে হাঁটছে বলাই ভাল । নানা রকম বাধা সামনে। এঁকেবেঁকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। ইচ্ছা থাকলেও ছুটতে পারছে না ঘোড়া।
হাহাদের ঘোড়াগুলোরও সেই একই অবস্থা। রাসেল হাহাদেরকে দেখতে না পেলেও শব্দ শুনে বুঝতে পারছে শক্ররা সামনেই আছে।
ঘোড়াটা হাহাদেরই। পথ ভুল হবার উপায় নেই। সুমনের ঘোড়াগুলোকে ঠিকই অনুসরণ করে যাবে রাসেলের ঘোড়া।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর জঙ্গল ক্রমশ হালকা হয়ে আসতে লাগল।
১৩০
ভলিউম ১৩
—
।–
।
–
গতি বাড়ল ঘোড়ার।
আরও মিনিট পনেরো পর জঙ্গলের শেষ সীমায় এসে পৌঁছুল রাসেল ঘোড়ার পিঠে চড়ে।
জঙ্গলের যেখানে শেষ, মরুভূমির সেখানে শুরু। দিগন্তরেখা অবধি বিস্তৃত প্রকাণ্ড বিশাল সীমাহীন ধু-ধু মরুভূমি।
মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য। রাসেলের ঘোড়া তীর বেগে ছুটে চলেছে।
সামনের দিকে, যতদূর দৃষ্টি যায়, মরুভূমি এবং মরুভূমির শেষ সীমায় আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই সেই ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক গ্রেট ভিক্টোরিয়া ডেজার্ট। এই মরুভূমিতে পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম বাসিন্দারা এখনও বাস করে। এই মরুভূমিতে পথ হারিয়ে কত শত লোক প্রাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। | হাতের বাঁ দিকে এবং ডান দিকে, প্রায় মাইল খানেক দূরে, উঁচু পাহাড় শ্রেণী। এই পাহাড়েই বাস করে হাহারা।’
কিন্তু পাহাড়ের দিকে মুখ করে হুটছে না হাহারা। সোজা ছুটে চলেছে পনেরো বিশজন খুনী নরমাংসভোজী হাহা।
হাহাদের অনেক পিছনে পড়ে গেছে রাসেল। ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে হাহাদের তাগড়া ঘোড়াগুলো।
রাসেলের ঘোড়াটাও কারও চেয়ে কম নয়। একহাতে লাগাম ধরে রেখেছে রাসেল। পা দিয়ে খোঁচা মারছে ও ঘোড়ার পাজরে। ওর ডান হাতে ধরা রাইফেল।
খোঁচা খেয়ে আরও জোরে হুটতে শুরু করল ঘোড়া।
মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য। ঘামে সর্বশরীর ভিজে গেছে। সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি রাসেলের গায়ে। ওর চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।
রাইফেলের শব্দ হলো। লক্ষ ব্যর্থ হলো রাসেলের। দূরত্ব কমেছে অনেকটা এতক্ষণে। বড় জোর পঞ্চাশগজ পিছনে এখন রাসেল হাহাদের কাছ থেকে। সোজা ছুটছে হাহাদের ঘোড়া। হাহাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ডান এবং বাঁয়ের পাহাড় শ্রেণীর দদেশের দিকে ওর দৃষ্টি পড়ল।
স্তম্ভিত হলে রাসেল। মাইলের পর মাইল ব্যাপী পাহাড়শ্রেণী। পাহাড়ের পাদদেশে সার বন্দী হয়ে বড়িয়ে আছে অসংখ্য ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে হাহারা ।
| হাহাদের সংখ্যা যে এত বেশি তা কল্পনা করেনি আগে রাসেল। য়াশা ৩৯
১৩১
সম্মুখবর্তী ঘোড়সওয়ারদের দিকে তাকাল রাসেল। সন্দিহান হয়ে উঠল ও। হাহাদের ঘোড়া সোজা ছুটে চলেছে। একটি ঘোড় তাদের সাথে যাচ্ছে না। সে ঘোড়াটা বাঁ দিকের পাহাড়শ্রেণীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটছে। ঘোড়ার সওয়ার একা নয় পিঠে। তার সামনে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে রোম।
| ঘোড়াটা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকের পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশে অপেক্ষারত হাহারা নেই। আরও খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে হাহাদের ঘোড়াগুলো।
ওদিকে যাবার কারণ কি?
ঘোড়ার লাগাম টেনে দাঁড় করাল রাসেল। দ্রুত রহস্যটার সমাধান পেতে চাইল ও।
ঘোড়াটা একা যেদিকে ছুটছে সেদিকে পাহাড় শ্রেণীর মাঝখান দিয়ে একটা গিরিপথ দেখা যাচ্ছে। এই গিরিপথ দিয়ে পালিয়ে যেতে চায় ঘোড়ার পিঠের হাহা। তাই সে দল ছাড়া হচ্ছে।
গিরিপথ, হাহার ঘোড়াটা এবং রাসেল-তিনটে বিন্দু একটি ত্রিভুজের সৃষ্টি করেছে। ঘোড়াটিকে অনুসরণ করা হবে সময়ের অপচয়। রাসেল হিসেব করে পরিষ্কার বুঝতে পারল গিরিপথ লক্ষ করে ছুটলে হয়তো রোমকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। হাহার ঘোড়াটিও গিরিপথের দিকে যাচ্ছে। রাসেল যদি সরাসরি গিরিপথের দিকে ঘোড়া হোটায় তাহলে হাহার ঘোড়ার চেয়ে আগে গিরিপথের মুখে পৌঁছতে পারবে ও।
তীরবেগে গিরিপথের দিকে ছুটল লাল ঘোড়াটা টগবগিয়ে। পাঁচ মিনিট পরই আশায় আনন্দে ভরে উঠল রাসেলের বুক।
গিরিপথের কাছাকাছি চলে এসেছে সে। হাহার ঘোড়াটাও কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে তার ঘোড়াটা রাসেলের ঘোড়ার চেয়েও দ্রুত।
বড় জোড় পঁচিশ গজ সামনে থেকে গিরিপথে ঢুকবে হাহার ঘোড়। কিন্তু গিরিপথে ঢোকার সুযোগ হাহাটিকে দিতে রাজি নয় রাসেল।
পঁচিশ-ত্রিশ গজ পিছন থেকে রাইফেলের ট্রিগার টানল রাসেল। গুলির শব্দের সাথে সাথে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেল হাহাটা । পড়ে গেল রাসেলের ঘোড়াও অপ্রত্যাশিত ভাবে।
ঘোড়াটা বালির উপর পড়ে ছটফট করছে। বালির উপর ঘোড়ার পাশেই পড়েছে রাসেল। উঠে বসার চেষ্টা করল ও।
মাথাটা ঘুরে গেল রাসেলের। ইলেকট্রিক শক খেল যেন ও ব্রেনে! ঘোড়াটা উঠে দাঁড়াবার জন্যে চেষ্টা করছে। পারছে না।
দ্রুত বালির নিচে ডুবে যাচ্ছে প্রকাণ্ড ঘোড়াটা। দ্রুত নড়াচড়া করছে বলে প্রতি মুহূর্তে ইঞ্চি খানেক করে ডুবে যাচ্ছে অবোধ জানোয়ারটা। চি-হি চি-হি করে করুণ কণ্ঠে সাহায্য চাইছে সে। তাকিয়ে আছে জলভরা চোখে রাসেলের দিকে।
১৩২
ভলিউম ১৩
আমি নিরুপায়! মনে মনে ঘোড়াটার উদ্দেশে শপ রাসেল । এতটুকু নড়ল না ও। ঘোড়াটার চোখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকাল রাসেল।
| হাহার ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে রোমের দিকে তাকিয়ে। নোম বালিতে উঠে বসে খোলার চেষ্টা করছে পায়ের বাঁধন। হাতের বাধন খুলে ফেলেছে সে। হাহাটা পড়ে আছে মুখ থুবড়ে উত্তপ্ত বালিতে। নড়ছে না। মাথার পিছনে লেগেছে বুলেট। বেচে নেই।
নিজের ঘোড়াটার দিকে তাকাল রাসেল ঘাড় ফিরিয়ে। নেই ঘোড়াটা! চোরাবালি গ্রাস করেছে প্রকাণ্ড ঘোড়াটাকে।
এতটুকু নড়ছে না রাসেল। কিন্তু তাতেও বাঁচার কোন আশা নেই পরিষ্কার বুঝতে পারছে। নড়াচড়া না করলেও একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে তার শরীর। ক্রমশ বালি ওকে গ্রাস করছে।
চোখ তুলল রাসেল।
হাহাদেরকে ফিরে আসতে দেখে নতুন করে ভয় পেল না ও। মৃত্যু তো অনিবার্য। চোরাবালিতেই হোক আর হাহাদের বর্শার আঘাতেই হোক।
রোম পায়ের বাধন খুলতে পারছে না। সেদিকে তাকিয়ে মনটা কেঁদে উঠল রাসেলের। পায়ের বাঁধন খুলতে ব্যস্ত সে। জানতেও পারছে না হাহারা ফিরে আসহে তাকে ধরার জন্যে। রোমকে বাঁচাতে পারলে মরেও শান্তি পেত সে। কিন্তু
তা হবার নয়।
ঘোড়সওয়ার হাহাদের দিকে তাকাল রাসেল ধীরে ধীরে। এখনও অনেক দূরে ওরা। অর্ধেকের বেশি ডুবে গেছে রাসেল ইতিমধ্যে । ওরা এসে পৌঁছুবার আগেই ডুবে যাবে সে।
বড় বিপজ্জনক এই চোরাবালি। এ ধরনের চোরাবালি গ্রেট ভিক্টোরিয়া মরুভূমিতেই বেশি দেখা যায়। হাহাদের বুদ্ধি আছে, মনে মনে স্বীকার করল রাসেল। চোরাবালির ফাঁদে তাকে ফেলার জন্যেই দিক পরিবর্তন করেছিল হাহাটা।
বুকের আর সামান্য বাকি আছে ডুবতে। এবার কষ্ট সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। দম নিতে পারছে না রাসেল। আকাশের দিকে তাকাল ও।
– চোখ নামাল ও রোমের কান্না শুনে। চিৎকার করে কাঁদহে নোম। এদিকে পায়ের বাধন খুলতে পারছে না সে।
| বালির নিচে ডুবতে আর বড় জোর একমিনিট দেরি রাসেলের। শহীদের কথা মনে পড়ল ওর। তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শহীদ ভাই চমকে উঠবেন নিশ্চয়ই। ভীষণ আঘাত পাবেন মনে। তাকে তিনি ভালবাসেন। আঘাত পাবে আরও একজন। সে হলো কুয়াশা। বড় মায়া লোকটার মনে। মহৎ পুরুষ।
কুয়াশা ৩৯
ফোম খবরটা শুনে কাঁদকে। কষ্ট হচ্ছে রাসেলের। একটু হাসি ফুটল তবু ঠোঁটে।
গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। আস্তে আস্তে চিবুক, ঠোঁট, নাক এবং চোখ ডুবে যাহে।
কপালটা দেখা গেল খানিকক্ষণ। তারপর সেটাও গেল। বালি গ্রাস করছে তাজা প্রাণবান ছেলেটাকে।
রাসেলের মাথাটাও দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল বালির নিচে।
হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে উঠল রোম। কিন্তু সে আনন্দ বনি শোনার জন্যে পৃথিবীর উপর নেই রাসেল তখন।
Leave a Reply