৩৮. অরণ্য রাজ্য ১ [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৩৮
প্রথম প্রকাশ : জুলাই, ১৯৭৩
এক কালো রাত। ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল পীচঢালা রাস্তার উপর দিয়ে তুমুল বেগে উড়ে চলছে যেন কালো রঙের বিরাট হিলম্যান গাড়িটা। স্টিয়ারি থেকে ডান হাতটা সরিয়ে নিয়ে খানিকটা উপরে তুলে ঝাঁকি দিতেই আলখেল্লার আস্তিন সরে গেল। হাতটা চোখের সামনে নিয়ে এল কুয়াশা।
লিউমিস ঘড়িতে বাজে রাত এগারোটা।
নির্জন রাস্তা। হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় সামনের রাস্তাটা বহুদূর অবধি দেখা যাচ্ছে। •
রাস্তার দুই পাশেই ফাঁকা মাঠ। মাঠের শেষে, অনেক দূরে, বহুতল বিশিষ্ট বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ফিরিয়ে আবার পিছন দিকে তাকাল কুয়াশা। অন্ধকারে দেখা গেল না এবারও কিছু।
দেখা না গেলেও পঞ্চাশ গজ পিছনেই অস্টিন কেমব্রিজ গাড়িটা আছে। নাছোড় বান্দার মত অনুসরণ করে আসছে অস্টিনের আরোহীর কুয়াশাকে। হেডলাইট অফ করে দিয়েছে ওরা। সাইডলাইটও। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে এক সেকেণ্ড চিন্তা করল কুয়াশা। তাকাল ড্যাশবোর্ডের উপর পাশাপাশি বসানো সাতটা প্লাস্টিক বোতামের দিকে।
সাতটা বোতামের কাজ সাত রকম। বোতাম টেপা মাত্র কাজ শুরু হয়ে যায়। সাতটার মধ্যে একটির রঙ লাল। লাল মানে ডেঞ্জার, বিপদের প্রতীক। লাল বোতামটার ওপর আঙুল রেখে চাপ দেবার সাথে সাথে ঘটে যাবে কল্পনাতীত এক, অঘটন। এতবড় গাড়িটা চোখের পলকে সহস্র টুকরো হয়ে যাবে।
| বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল আবিষ্কার করা কুয়াশার অনেক নেশার অন্যতম। মানুষের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনের জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে সে। তার ধারণা মানুষের কল্যাণ সাধন করতে পারে একমাত্র বিজ্ঞানই। তাই বিজ্ঞানের পূজারী সে।
অন্য বোতামগুলোর রঙ কালো।
লম্বা, কালো আলখেল্লার পকেট থেকে বড় সাইজের একজোড়া মোটা রঙিন কাঁচ ফিট করা একটি চশমা বের করল কুয়াশা। ধীরে ধীরে ডান হাতটা ড্যাশবোর্ডের বোতামগুলোর দিকে বাড়িয়ে দিল সে। কুয়াশা ৩৮
:৪৫
কালো একটি বোতামে চাপ দিল কুয়াশা।
হড়িয়ে পড়ল ইনভিজিবল রে হিলম্যানের পিছন দিকে। কিন্তু দেখা গেল না কিছুই।
এবার চশমাটা পরে নিল কুয়াশা। চোখের সামনে নেমে এল ঘন কালো “অন্ধকার। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কুয়াশা। অথচ হেডলাইট দুটো ঠিকই জ্বলছে।
ঘড়ি ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল কুয়াশা।
আগের মতই অন্ধকার আছে পিছনে। কিন্তু কুয়াশার চোখে পিছন দিকের কহুদূর অবধি আলোকিত দেখাচ্ছে।
মাত্র পঁচিশ গজ পিছনে রয়েছে অস্টিনটা। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে কুয়াশা। অস্টিনের ড্রাইভার বা আরোহীরা টের পায়নি কিছুই। টের পাবার কথাও নয়। ইনভিজিল রে কুয়াশার আবিষ্কৃত বিশেষ চশমা না পরে চাক্ষুষ করা অসম্ভ।
ঘাড় ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকাল কুয়াশা। সামনের রাস্তাটা অন্ধকারে ঢাকা।
কুয়াশা যে চশমা পরেছে সে চশমা পরে স্বাভাবিক আলোর কিছুই দেখা যায় না। টের পাওয়া যায় না সে আলোর অস্তিত্ব। ‘ | চোখ থেকে চশমা নামিয়ে ড্যাশবোর্ডের বোতামগুলোর দিকে আর একবার তাকাল কুয়াশা। ডান হাতটা এগিয়ে গেল আবার তার।
এবার কুয়াশা অন্য একটি বোতামে চাপ দিল।
লোকগুলো বিদেশী। শ্বেতাঙ্গ। ছোট ছোট করে আমেরিকান স্টাইলে ছাঁটা চুল, পেশীবহুল লম্বাচওড়া চেহারা। বড় বড় মুখ। ক্লিনশেভড়। প্রত্যেকেরই বয়স বাইশ থেকে আটাশের মধ্যে। চোখের দৃষ্টি সতর্ক। গতকাল সকাল থেকে পিছু লেগেছে ওরা কুয়াশার। * কুয়াশা গতরাতটা কাটিয়েছে ঢাকায় তার তিন নাম্বার ল্যাবরেটরিতে। আজিমপুরের একটি বাড়িতে তিন নাম্বার ল্যাবরেটরি। বাড়ির আশপাশে ঘুর ঘুর করেছে লোকগুলো গাড়ি নিয়ে সারাটা রাত। তারপর আজ সকাল থেকে এই গভীর রাত অবধি কুয়াশাকে ছায়ার মত অনুশ্রণ করে চলেছে ওরা।
অথচ আক্রমণাত্মক কোন তৎপরতা দেখায়নি ওরা এখন অবধি। কুয়াশা প্রথম থেকেই জানে ওদের অনুসরণের কথাটা। কিন্তু ওদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানে
সে।
উদ্দেশ্যটা ওদের জানার জন্যে গতকাল থেকে অপেক্ষা করে ছিল কুয়াশা। জানতে পারেনি সে। অনুসরণ করা ছাড়া ওদের আর কোন তৎপরতা টের পায়নি। কুয়াশা।
দ্বিতীয় কালো বোতামটায় চাপ দেয়ার সাথে সাথে সশব্দে সবেগে একটি বুলেট বেরিয়ে গেল গাড়ির পিছনের লাল বালবের পাশের হোট একটি গর্ত থেকে।
৪৬
ভলিউম ১৩
গর্তটা রাইফেলের নলের গর্তের মতই দেখতে।
অস্টিনের সামনে উইণ্ডীন ভেদ করে কুয়াশার আবিষ্কৃত বুলেট ভিতরে গিয়ে পড়ল। উইণ্ডস্ক্রীনের সাথে বুলেটটার ধাক্কা লাগার সাথে সাথে ফেটে গেল সেটা।
| ড্যাশবোর্ড থেকে তুলে চশমাটা পরে নিল কুয়াশা আবার। তাকাল সে পিছন ফিরে অস্টিনের দিকে।
সাদা ধোঁয়ায় ভরে গেছে অস্টিনের ভিতরটা। আরোহী কিংবা ড্রাইভার কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।
চাকার সাথে পিচ্ছিল রাস্তার ঘষা লাগার প্রকট শব্দ উঠল। তীব্র একটা ঝাঁকানি | দিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল অস্টিন।
প্রায় একই সময়ে ব্রেক কষে দাঁড় করাল কুয়াশা নিজের গাড়ি।
অস্টিনের ভিতর সাদা ধোয়ার মেঘ। দেখা যাচ্ছে না কিছু। স্টার্ট দেয়া অবস্থায় পঁড়িয়ে রয়েহে গাড়িটা। ভিতর থেকে কেউ নামছে না।
কোন রকম চিৎকার বা শোরগোলের শব্দ ভেসে আসছে না অস্টিনের ভিতর থেকে।
স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে হিলম্যান থেকে নেমে পড়ল কুয়াশা।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হিলম্যানের ভিতরটা ছিল শীতল। বাইরে বেরুতেই মৃদ গরম বাতাসের ঝাঁপটা লাগল চোখে মুখে।
| চশমাটা খোলেনি কুয়াশা চোখ থেকে। লম্বা লম্বা পা ফেলে অস্টিনের পাশে। গিয়ে দাঁড়াল সে। আলখেল্লার পকেট থেকে একটি মাস্ক রে করে পরে নিল এবার। তারপর হাতল ঘুরিয়ে খুলে ফেলল অস্টিনের সামনের দরজাটা।
সামনের সীটে ড্রাইভার ছাড়াও একজন আরোহী রয়েছে। পিছনের সীটে একজন।
| ড্রাইভারের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রয়েছে সামনের লোকটা। পিছনের সীটের লোকটি এক কোণে কুণ্ডুলী পাকিয়ে রয়েছে। ড্রাইভার স্টিয়ারিঙের উপর মাথা ঠেকিয়ে পড়ে রয়েছে নিঃসাড়।
| জ্ঞান হারিয়েছে ওরা। বিষাক্ত ধোয়া নাক দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করা মাত্র অচেতন হয়ে ঢলে পড়েছে তিনজন।
“ সামনের সীটের আরোহী এবং ড্রাইভারকে টেনে বের করল কুয়াশা। অবলীলাক্রমে দুজনকে দুই কাঁধে তুলে নিয়ে ফিরে এল সে গাড়ির কাছে। | হিলম্যানের পিছনের সীটে জ্ঞানহীন তিনজন শ্বেতাঙ্গকে তুলে দিয়ে নিজে আবার ড্রাইভিং সীটে বসল কুয়াশা।
অস্টিন সার্চ করে কোন তথ্য পায়নি সে। লোকগুলোর উদ্দেশ্য জানতে হলে জেরা করতে হবে। জ্ঞান ফিরতে এখনও এক ঘণ্টা লাগবে ওদের।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিল কুয়াশা। ফিরতি পথে মিনিট দুয়েক গাড়ি চালিয়ে মোড় নিল
কুয়াশা ৩৮
৪৭
সে ডানদিকে। প্রকাণ্ড একটি লোহার গেটের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল হিলম্যান। | গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মরিস। মরিসের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল কুয়াশা। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল এদিক-ওদিক।
গেট খোলা কেন? গার্ড নেই কেন গেটে?
গাড়ি বারান্দার সামনে এবং দুই পাশে সুন্দর বাগান। বাগানের ভিতর থেকে উঁকি মারছে একটি মুখ। কুয়াশার দৃষ্টি সেদিকে পড়ার আগেই মুখটি একটি গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কুয়াশার এই নতুন বাড়ির বাগানে লুকিয়ে রয়েছে রাসেল। কিছুদিন থেকে কুয়াশার গতিবিধি কথাবার্তা কেমন যেন রহস্যময় ঠেকছে-তাই রাসেল কুয়াশার মুভমেন্ট লক্ষ করার জন্যে ওত পেতে আছে।
| গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে রাসেল দেখল কুয়াশা এদিকেই তাকিয়ে আছে। দেখে ফেলেছে নাকি? কথাটা মনে হতেই রাসেলের চোখমুখ মলিন হয়ে উঠল। ধরা পুড়ে গেলে বড় লজ্জায় পড়তে হবে। সরাসরি সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার একটি হাত ধরে হয়তো বলবে, ‘ফুল নিতে এসেছ বুঝি? তাহলে বললেই তো হত, মালী
পেড়ে দিত। এসো, ড্রয়িংরূমে বসে গল্প করতে করতে কফি পান করি।’
আশ্চর্য একটা মস্ত হৃদয় আছে কুয়াশার। মনে মনে স্বীকার না করে পারে না রাসেল। সে কুয়াশার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। কুয়াশা কোন অপরাধ করে কিনা | দেখার জন্যে, অপরাধ করলে তার প্রমাণ সংগ্রহের জন্যে দিত হন্যে হয়ে ফেরে অথচ কুয়াশা সব জেনেশুনেও তার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি। ক্ষতি করা তো দূরের কথা বিপদে পড়লে সে তাকে উদ্ধার করার জন্যেই যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শত্রুকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করা শুধুমাত্র কুয়াশার পক্ষেই সম্ব।
| করিডরে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চলল কুয়াশা। নির্জন, করিডর। ডানদিকের করিডরে এসে পৌঁছুল কুয়াশা। শেষ প্রান্তের একটি রুমের দরজা খোলা দেখা যাচ্ছে। পর্দা ঝুলছে দরজায়। স্যানন ডি. কস্টার রূম থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
ভাষণ দিচ্ছে ডি কস্টা। কুয়াশা মুচকি হেসে এগিয়ে চলল ডি. কস্টার রূমের দিকে।
L
ইউরেনিয়ামের খোঁজে ফিরছিল কিছুদিন থেকে কুয়াশা। বিশেষ এক ধরনের ইউরেনিয়াম যুক্ত বালি নাকি পাওয়া যায় কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে। খবর পেয়ে গিয়েছিল কুয়াশা ।
আণবিক শক্তি উৎপাদনে ইউরেনিয়াম একটি অপরিহার্য পদার্থ। হাইড্রোজেন বোমা, যে বোমা এতবড় পৃথিবীকে ধ্বংস করার শক্তি রাখে, বানাতে গেলেও লাগে ইউরেনিয়াম।
ভলিউম ১৩
–
কক্সবাজারে সে ধরনের বালি পেলেও ইউরেনিয়াম পায়নি কুয়াশা। পরিমাণ নিতান্ত কম। ওর প্রয়োজন মিটবে না এখানে।
অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ভিক্টোরিয়া ডেজার্টে সেই বালি আছে শত শত মাইল ব্যাপী। নমুনা পেয়েছে কুয়াশা। ড, মূরকোট কুয়াশার অনুরোধে মাত্র তিন দিন আগে গ্রেট ভিক্টোরিয়া মরুভূমির এক পাউণ্ড বালি পাঠিয়েছেন। নমুনা দেখেই কুয়াশা বুঝে ফেলেছে ইউরেনিয়াম আছে ওখানে।
| বালি পরীক্ষা করে পরদিনই কুয়াশা তা কন্ট্রোলরূমের প্রকাণ্ড ট্রান্সমিটারের সাহায্যে সুদূর অস্ট্রেলিয়ার মূলারবর প্লেনের বিশাল বনভূমিতে বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছে। বে অভ বেঙ্গলের তীরে যেমন বাংলাদেশ, তেমনি গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান বাইটের তীরে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া অবস্থিত। ইউক্লা, উলডি, মেডুনা ফরেস্ট, জানথুস ইত্যাদি নিয়ে নুলার প্লেন । এক হাজার মাইল লম্বা, পঁচিশ থেকে তিন শ মাইল প্রভূখণ্ড। তারপর গ্রেট ভিক্টোরিয়া মরুভূমি। নৃলার প্লেনের কোন এক জঙ্গলে
আদিবাসীদের মধ্যে বাস করেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মূরকোট+ কুয়াশা যাচ্ছে। সেখানে। আগামী পরশু রওনা হবে সে। কক্সবাজারে অপেক্ষা করছে ‘গাঙচিল’। কুয়াশার সর্বাধুনিক ইয়ট। ড. মূরকোটকে রওনা হবার দিন-তারিখ জানিয়েই বার্তা পাঠিয়েছে কুয়াশা।
| একদিন আগে ডি কস্টার পৌঁছবার কথা কক্সবাজারে। আজ রাতেই তার ঢাকা থেকে রওনা হবার কথা,
| রওয়ানা হবার আগে ডি কস্টা চেয়েছিল বাড়ির সবাই মিলে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিদায় জানাবে। একটি বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করবে। বিয়োগান্তক একটি নাটিকা মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেবে সবাই। সবশেষে তার জন্যে।
সবাই দু’এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবে।
কিন্তু হা হতোস্মি! ডি, কস্টার মনের আশা কেউ বুঝতে সক্ষম হলো না। তার বিদায় লগ্ন যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল সবাই তত আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠতে লাগল। চোখের জল ফেলা তো দূরের কথা।
অবশেষে খেপে উঠল ডি, কস্টা।
ড্রাইভারকে গাড়ি বের করার নির্দেশ দিল সে। যাকে তাকে অকারণে এটা আনতে বলল, ওটা করতে বলল। বাড়ির পাহারাদারকে বললঃ ফ্রম নাউ অন আই অ্যাম ইন এ গ্রেট ডেঞ্জার! অ্যাট এনি মোমেন্ট আমার উপর অ্যাটাক হইটে পারে। বিকজ আমি একটি সিক্রেট অ্যাসাইনমেন্ট নিয়া ওয়ার্লডের ক্ষুটম মহাডেশে যাইটেছি। হামার এবং আমার বস, সরি, ব মি. কুয়াশার এনিমি আছে। এভরিহোয়্যার । টারা হামাডেরকে, বিশেষ করিয়া আমাকে মার্ডার করিটে চায়। বাড়ি পাহারা ডিবার চেয়ে বেশি উরকার এখন টোমার হামাকে পাহারা ডেয়া। যটোক্ষণ হামি এ বাড়িটে আছি টটোক্ষণ টুমি আমাকে পাহারা ডাও, আজি এ ৪-কুয়াশা ৩৮
৪৯.
বডিগার্ড…। | ডি. কস্টার কথা শেষ হবার আগেই ড্রাইভার রূমে ঢুকে জানাল, মি. ডি.
কস্টা, গাড়ি বের করেছি।
প্রায় একসাথে আরও দুজন রূমে ঢুকল। রূমে ঢুকে দুজন দুটো হাত বাড়িয়ে দিল ডি কস্টার দিকে। দুজনের হাতেই দুটো কাঁচের গ্লাস। একটি গ্লাসে দুধ। অন্য গ্লাসে বাংলা মদ।
আড়চোখে গ্লাস দুটো দেখে নিল একবার ডি. কস্টা। কিন্তু হাত বাড়িয়ে দুটো গ্লাসের কোনটাই না নিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে টাইয়ের নট ঠিক করতে লাগল
সে। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথার হ্যাটটা সিধে করে নিল।
আপনার স্টিমার ক’টায়, মি. ডি, কস্টা? দেরি হলে যে ছেড়ে দেবে।’ জিজ্ঞেস করল ড্রাইভার। কিন্তু মাঝ পথে থেমে গেল ডি কস্টার চাউনি দেখে।
কড়া দৃষ্টিতে তাকাল ডি. কস্টা ড্রাইভারের দিকে। বলল, বেয়াড়প কোথাকার। জানো টুমি, কার সাটে কঠা বলিটেছে? ইংরেজের জাট হামি, টাইম সম্পর্কে নেটিভডেরকে শট শট বহুর ঢারিয়া শিক্ষা দিয়া আসিটেছি! আর টুমি কিনা আমাকে উপডেশ ডিটেছো…।’
হঠাৎ থেমে গেল ডি কস্টা। একে একে তাকাল সকলের দিকে। তারপর গলার স্ক বদলে অত্যন্ত গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, টোমরা ডেকছি সবাই এখানে উপঠিট হইয়াহ। শুভ, গুড়। টোমরা জানো, হামি আজ ঢাকা ট্যাগ করিয়া কক্সেসবাজার যাইটেছি। ফ্রম দেয়ার হামি রওয়ানা হইব টুয়ার্ডস্ অস্ট্রেলিয়া। সঙ্গে লইব মি. কুয়াশাকে। টাকে ছাড়া হামি এনজয় করিটে পারি না কিছু। হউক সে নেটিভ, বাট আই লাভ হিম ভেরি মাচ। কারণ হইল এই যে নেটিভডের মধ্যে হামি হামার সমান বুড়িমান একজনকেও ডেখি নাই, একমাত্র মি. কুয়াশাকে ছাড়া। যডিও কোন কোন ম্যাটারে টার বুড়ি এখনও কাঁচা। যেমন ইকনমি সে বুঝিটে পারে না। মিলিয়ন অ্যান্ড মিলিয়ন টাকা ইনকাম করে মি. কুয়াশা, বাট, সব খরচ করিয়া ফেলে নেটিভপুওর ম্যানদের জন্যে। এটা-ভেরি ভেরি ব্যাড। গরীবডেরকে হেলপ করিয়া কোন লাভ নাই। বাট সে হামার কঠীয় কান ডেয় না। কারণ ইকনমি বোঝে না সে-। যাহা হউক, টবু টাকে আমি লাভ করি। টাই হাড়ের ডেশে যাইবার সময় টাকে নিয়ে যাইটেছি…।’
বাড়ির গার্ড ফস্ করে বলে ফেলল, আপনার দেশ মানে? আপনি তো অ্যাংলো, বাংলাদেশেই জন্মেছেন।
| ‘স্টপ! ইডিয়েট কাহিকে। হামি ইংরেজের জাট…।’ চিৎকার করে উঠল ডি. কস্টা। কিন্তু হঠাৎ সে চুপসে গেল দোরগোড়ায় কুয়াশাকে দেখতে পেয়ে।
ভারি গলায় কুয়াশা জিজ্ঞেস করল, আপনি স্টিমার ধরতে যাননি, মি. ডি
ভলিউম ১৩
• ৫০
কস্টা?
ডি, কস্টা গম্ভীর গলায় বলল, এই যাইব আর কি। হামাকে বিডায় ডেবার আগে এরা সবাই চাইল একটি ফেয়ার ওয়েসের ব্যবস্থা করিটে, টাই…।’
সময় পেরিয়ে গেছে স্টিমারের, কুয়াশা বলল। আজ আর গিয়ে লাভ নেই। যাগগে আপনি এদেরকে নিয়ে আমার গাড়ি থেকে তিনজন বিদেশী লোককে নামিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে রেখে আসার ব্যবস্থা করুন। জ্ঞান ফিরতে ঘন্টা খানেক দেরি। হবে ওদের। জ্ঞান ফিরলে আমাকে জানাবেন।’
কথাগুলো বলে দরজা থেকেই ফিরে গেল কুয়াশা। কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে যেতে ডি. কস্টা একে একে সকলের দিকে তাকাল।
ফেয়ার ওয়েল মানে কি, মি. ডি. কস্টা?’ জিজ্ঞেস করল ড্রাইভার।
উত্তর দিল না ডি কস্টা। শব্দটার অর্থ কেউ জানে না বুঝতে পেরে স্বস্তি পেল সে। ঢোলা প্যান্টে ঢাকা রু সরু পা দুটো দরজার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গভীর স্বরে আদেশ করল সে, হামাকে ফলো করো টোমরা।’
কিন্তু গ্লারে দুধ আর বাংলা মদ | একজন কথাটা বলতেই ডি কস্টা চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল।
‘ডাও, ড্রিঙ্ক না করে গেলে ব্যাটা নেটিভ বীডেরকে পেটাই করিটে মজা পাইব না।’
| ঢক ঢক করে এক গ্লাস বাংলা মদ পান করল ডি কস্টা। তারপর দুধের গ্লাসটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে সেটুকু নিঃশেষ করল এক চুমুকে। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘ফলো মি!
গাড়ি বারান্দার নিচে এসে দাঁড়াল ডি. কস্টা। তার পিছনে সার বেঁধে এসে দাঁড়াল গার্ড, ড্রাইভার এবং চাকদ্বয়।
আলো জ্বলছে গাড়ির ভিতর।
ডি. কস্টা হিল্যানের জানালা দিয়ে ভিতরে মাথা গলিয়ে দিয়েই চিৎকার করে। উঠল, ফর গডস সেক, চিড়িয়া ভাগিয়া গিয়াছে।
কথাটা মিথ্যে নয়। হিলম্যানের ভিতরে তিনজন বিদেশী লোক থাকার কথা। অজ্ঞান অবস্থায়। কিন্তু অজ্ঞান বা সজ্ঞান কোন অবস্থাতেই কেউ নেই গাড়ির ভিতর।
| ডি. কস্টা জানালা থেকে মাথা বের করে রীতিমত লাফাতে লাগল, মি. কুয়াশাকে খর ডাও। ‘এনিমিরা পলাইয়া গিয়াছে। ড্রাইভার, গাড়ি স্টার্ট ডাও! ফলো করতে হোবে এনিমিডেরকে। সার্চ করো বাড়ি-হামার রূমের ভিতরে সূকাইয়া থাকিটে পারে দুশমনরা, হামার উপর ওদের আকোরোশ আছে…।’ কুয়াশা ৩৮
ড্রাইভার গার্ডের উদ্দেশ্যে বলল, এমনটি যে হবে তা আমি জানতাম। মদের ওপর দুধ খেলে মাথা বিগড়ে যাবেই তো…!”
| ডি. কস্টা দুটল কুয়াশাকে দুঃসংবাদ জানাতে। হুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলছে সে, ‘মি. কুয়াশা, বী কেয়ারফুল! ডুশমন পলাইয়াছে, আপনার আশেপাশেই আছে টাহারী…!’
এক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি বারান্দার নিচে এসে হাজির হলো কুয়াশা। বাড়ির ভিটরই কোঠাও ডুশমনরা•••।’ আপনি চুপ করে দুরে সরে গিয়ে দাঁড়ান,’ গভীর কণ্ঠে বলে উঠল কুয়াশা। উঁচু করিডরে উঠে পড়ল ডি কস্টা। অন্যান্যরা আগেই উঠে পড়েছে।..
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করল কুয়াশা। গাড়ির সীট, দরজা, গাড়ি বারান্দার পাকা মেঝে, পার্শ্ববর্তী বাগান কিছুই বাদ দিল না সে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখে লাগিয়ে গাড়ি বারান্দার পাকা মেঝে পরীক্ষা করে দু’জোড়া বুট জুতোর ছাপ পেল কুয়াশা। তার মানে কুয়াশা গাড়ি রেখে চলে যাবার পর দু’জন লোক এসেছিল গাড়ির কাছে। তারাই জ্ঞানহীন শেতাঙ্গগুলোকে নিয়ে গেছে।
কিন্তু তারা এল কোন পথে? গেলই বা কিভাবে? কুয়াশা জানে কোন গাড়ি তাকে অনুসরণ করেনি।
দু’জোড়া জুতোর হাপ কোন্ দিক থেকে এসেছে পরীক্ষা করতে শুরু করল কুয়াশা।
সময় লাগল না বিশেষ জুতো জোড়ার দাগ গেটের দিকে যায়নি। গেছে বাগানের দিকে। বাগানের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে থেমেছে দাগগুলো। তারপর আর কোন হদিস নেই।
বাগানের মাটি পরীক্ষা করতে করতে ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠছিল কুয়াশার চোখমুখ।
জুতো জোড়ার ছাপ যেখানে এসে থেমেছে সেখানে একটি ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখতে পেল কুয়াশা।
ঘোড়া এল কোথা থেকে?
কোন্ দিক থেকে যে ঘোড়াটা বাগানে এসেছিল তা বুঝবার কোন উপায় নেই। বাগানের মাটিতে একটি ঘোড়ার চারটি পায়ের দাগ ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। : ঘোড়াটা যে হেঁটে এসেছে তার কোন প্রমাণ নেই। হেঁটে এলে অসংখ্য পায়ের দাগ থাকার কথা। তা নেই। যেন আকাশ থেকে নেমেছিল ঘোড়াটি। আবার আকাশেই
উড়ে গেছে।
. আরও খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে কুয়াশা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল আকাশের দিকে।
নির্মল, মেঘমুক্ত আকাশ। নক্ষত্রদের মেলা বসেছে গোটা আকাশ জুড়ে। সেখানে আর কিছু নেই। ‘
ভলিউম ১৩
. |
* ..
গাড়ি বারান্দা থেকে করিডরে উঠে নিজের ল্যাবরেটরির দিকে এগিয়ে চলল কুয়াশা। বড় চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।
কুয়াশাকে নিঃশব্দে চলে যেতে দেখে ডি. কস্টা কি যেন জিজ্ঞেস করতে গিয়েও শেষ অবধি সাহস পেল না।
কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে যেতে ড্রাইভার ও গার্ড হেঁকে ধরুল ডি. কস্টাকে। | ব্যাপার কি?’ জানতে চাইল গার্ড। ভয় পেয়েছে সে।
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, মনিবকে খুব চিন্তিত মনে হলো, তাই না?
গার্ড বলল, এর মধ্যে রহস্য আছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি বুঝতে পারলাম না•••।’ | ডি. কস্টা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, ভেংচে বলে উঠল, কি ব্যাপারটা কি বুঝিটে পারলাম না! আরে, আমি আঙরেজের বাচ্চা হামিই বুঝিটে পারিলাম না আর টোরা
টো নেটিভ, কালা আদমী..!!
ল্যাবরেটরিতে এসে ঢুকল কুয়াশা সোজা। ল্যাব-এর দরজা বন্ধ করে একটি চেয়ারের দিকে পা বাড়াতেই যান্ত্রিক ধ্বনি ভেসে এল পাশের কন্ট্রোলরূম.থেকেঃ বী-বীপ! বীপ-বী-টক-টক-টক্কা, টক-টক-টক্কা।
ল্যাবের মেঝেতে দাঁড়িয়ে কন্ট্রোলরূমের দরজার দিকে তাকাল কুয়াশা । ওভারসীজ মেসেজের সঙ্কেত। সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে কেউ মেসেজ পাঠাচ্ছে।
| বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে সঁাড়াল কুয়াশা। লম্বা আলখেল্লার পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে কন্ট্রোলরূমের ভিতর ঢুকল সে।
* মিনি সাইজের যন্ত্র থেকে শুরু করে দৈত্যাকার বিরাট বিরাট যন্ত্রে কন্ট্রোলরুম ঠাসা। বিরাটাকার ট্রান্সমিটারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। একটা পর্দায় লাল, নীল, সবুজ এবং নীল রঙের সরল রেখা ছুটোছুটি করছে এক কোণ থেকে আর এক কোণ অবধি। পার্শ্ববর্তী একটি বোর্ডে জ্বলছে বিভিন্ন রঙের বলি। কোন কোনটা জ্বলে উঠছে কোন কোনটা দপ করে নিভে যাচ্ছে। স্পীকারে ভেসে আসছে নানারকম যান্ত্রিক শব্দ। সঙ্কেত!
উঁচু টেবিল থেকে কাগজ কলম টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করল কুয়াশা সঙ্কেতগুলো।
লিখতে লিখতে বিস্ময় ফুটে উঠল কুয়াশার চোখে মুখে।
বার্তা পাঠাচ্ছেন সঁসিয়ে মূরকোট। তিনি বলছেন, আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার। হেলপ মি, মি. কুয়াশা। কাম শার্প! কুয়াশা ৩৮
আশ্চর্য ব্যাপার। বার্তা পাঠালেন সঁসিয়ে ড, মূরকোট, কিন্তু উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই কানেকশন কাট করে দিলেন।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে মাত্র তিন দিন আগে কুয়াশা যখন কথা বলেছিল এই কন্ট্রোলরূম থেকে তখন ড, মূরকোট নিজের বিপদের কোন আভাস দেননি।
ড. মূরকোট জানেন, কুয়াশা অতি শীঘ্র রওনা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে। তা সত্ত্বেও দ্রুত তার কাছে যেতে বলছেন তিনি। কি এমন বিপদে পড়লেন বৃদ্ধ? হঠাৎ কি এমন বিপদ ঘটতে পারে তার?
তবে বিপদটা নিশ্চয়ই মারাত্মক ধরনের। তা না হলে বৃদ্ধ এমন জরুরীভাবে কুয়াশার সাহায্য চাইতেন না।
কন্ট্রোলরুম থেকে বেরিয়ে ল্যাবরেটরিতে এসে বসল কুয়াশা। টেবিলের উপরকার একটি বোম টিপে দিল সে। ‘ দেড় মিনিট পরই ল্যাবরেটরির দরজার বাইরে ডি কস্টার কণ্ঠ শোনা গেল,
মে আই কাম ইন?’
আসুন, মি. ডি. কস্টা। কুয়াশা কলল। তার হাতে ভারত মহাসাগরের একটি ম্যাপ।
| ডি, কস্টা মাথার হ্যাট ঠিক করতে করতে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করল। কুয়াশার দিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে থেকে সে কলল, “ইয়েস?’
কুয়াশা ম্যাপের উপর চোখ রেখে বলল, রাসেলের হোস্টেল চেনেন আপনি?’
দ্যাট পুওর চাইল্ড!, হাপনাডের সুইট বাংলা ভাষায় যাহাকে বলে শিশু! কি ডকার বলুন ওই শিশুর ঠিকানা জানিয়া…!’
দরকার আছে। চেনেন কিনা বলুন,’কুয়াশা কাল। ‘ ‘না, চিনি না। একবার চিনিটে ট্রাই করিয়াছিলাম, আই মীন, ফলো করিয়াছিলাম, কিন্টু হামাকে তাড়া করিয়াছিল বলিয়া সাকসেসফুল হইটে পারে নাই অ্যাসাইনমেন্টটা…।’
ঠিকানা লিখে নিন, কুয়াশা কলল। ঠিকানা লিখে নিল ডি, কস্টা। ‘টাকে, দ্যাট শিশুকে, কি বলিটে হইবে?’ জিজ্ঞেস করল ডি. কস্টা।
কলবেন আমি তাকে দেখা করতে বলেছি আজ রাতেই। আগামীকাল সকালে আমরা কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হব। আমার কপ্টারে যাব। কালকেই পৌঁছুতে হবে ওখানে। কালকেই রওনা দেব অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে। সব কথা জানাবেন ওকে। ও যদি যেতে চায় তাহলে আজ রাতের মধ্যেই এখানে আসতে বলবেন। যান।
৫৪
ভলিউম ১৩
ডি. কস্টা প্রায় লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেল ল্যাবরেটরি থেকে।
রাসেলের সাথে কথা হয়েছিল শহীদের বাড়িতে কুয়াশার। শহীদকে দেখতে গিয়েছিল কুয়াশা। সেখানে ছিল রাসেল। শহীদের খোঁজ খবর নিতে রোজই একবার করে যায় রাসেল।
শহীদ বাইরের দুনিয়ার সাথে সব সম্পর্কচ্ছেদ করে নিজের লাইব্রেরির নির্জন কোণে রাতদিন বই নিয়ে পড়াশোনা করে চলেছে। কুয়াশা, রাসেল এবং মি. সিম্পসন ছাড়া সে আর কারও সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে না। সাক্ষাৎ প্রার্থীর সংখ্যা অসংখ্য হলেও সবাইকেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়। চাকরবাকররা ডেকে স্নান করায়, তাগাদা দিয়ে খাওয়ায়। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়ে শহীদ। পৃথিবীর কোন ব্যাপারে সে মাথা ঘামায় না। কারও বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ নেই। একমনে বই পড়ে। কখনও কখনও ভোলা জানালা পথে ইউক্যালিপটাস গাস্ত্রে দিকে তাকিয়ে থেকে ঘণ্টার পর ঘন্টা কি যেন ভাবে। বাইরে মোটেই রে হয় না শহীদ। কুয়াশা, রাসেল কিংবা মি. সিম্পসন গেলে সে খুশি হয়ে ওঠে। তার চোখ মুখ দেখলে সেটা বুঝা যায়। কিন্তু কথা বড় একটা বলে না সে কারও সাথেই। | কুয়াশা শহীদকে দেখতে গিয়ে রাসেলকে পেয়ে কথায় কথায় গতকাল তার অস্ট্রেলিয়া যাবার পরিকল্পনার কথা বলেছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিল রাসেল। সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছিল কুয়াশা। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্যের কথা বলেনি
সে। সে যে ইউরেনিয়ামের সন্ধানে অস্ট্রেলিয়ায় যাবে তা রাসেল কেন, ড.’ মূরকোটকেও বলেনি কুয়াশা।
কুয়াশা আমন্ত্রণ জানিয়েছিল রাসেলকে । বলেছিল, যাবে নাকি হে? মহাদেশটা বড় সুন্দর। যেতে চাও বেড়াতে?’।
রাসেল কেন যেন গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, আপনি তো নিশ্চয়ই কোন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছেন। আপনার উদ্দেশ্য না জেনে আপনার সাথে যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু এ-ও সত্যি যে উদ্দেশ্যটা আপনি আমাকে জানাবেন না। ঠিক আছে, আগামী পরশুদিন আমি জানাব আপনাকে।
কুয়াশা বলেছিল, তাই জানিয়ো। আমি পরশুদিন বিকেলেই রওনা হব।
কিন্তু ঢাকা শহরে কোথাও পাওয়া গেল না রাসেলকে। ডি, কস্টা আধঘণ্টা পরই ফিরে এসে জানাল সে হোস্টেলে নেই। বিকেলে সে’বেরিয়েছে, তারপর আর ফিরে যায়নি। তার বন্ধু-বান্ধবরা খুব চিন্তা করছে।
কুয়াশা রাসেলের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুর বাড়িতে লোক পাঠাল। কিন্তু তারাও কেউ বলতে পারল না রাসেলের খবর। শেষ অবধি রাসেলের সাভারের বাড়িতে ফোন করল কুয়াশা। কিন্তু আশ্চর্য! রাসেল সেখানেও যায়নি।
কুয়াশা ৩৮
৫৫
মি. সিম্পসনকে ফোনে জানাল কথাটা কুয়াশা। কিন্তু তিনিও কোন হদিস দিতে পারলেন না রাসেলের। :
সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করা হলো। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না রাসেলকে। সে যেন আচমকা বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
| রাসেলকে পাওয়া না গেলেও কুয়াশাকে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হলো না। ছেলেটার মাথা খুব ভাল, জানে সে। সেজন্যেই তাকে স্নেহ করে কুয়াশা। কুয়াশা। জানে রাসেল যে-কোন বিপদেই পড়ুক না কেন, শেষ পর্যন্ত সে উদ্ধার পাবেই। নিজের ভালমন্দ বুঝে চলবার ক্ষমতা তার আছে। তার জন্যে চিন্তিত হবার কিছু নেই। ১
পরদিন সকালে আর একবার খোঁজ নেবার চেষ্টা করল কুয়াশা। মি. সিম্পসন জানালেন, কোন খবর নেই রাসেলের।’
কুয়াশা কলল, “দেখা হলে ওকে বলবেন যে আমি অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছি। তার জন্যে অপেক্ষা করার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না।’
মি. সিম্পসন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করে কুয়াশার হঠাৎ অস্ট্রেলিয়া যাবার উদ্দেশ্য কি জানার চেষ্টা করলেন। বাকি সব প্রশ্নেরই উত্তর দিল, শুধু আসল প্রশ্নটার উত্তর এড়িয়ে গেল কুয়াশা।
| ভোর রাতের দিকে আবার মেসেজ এসেছিল ড. মূরকোটের। আশ্চর্য মেসেজ। মাত্র তিন ঘন্টা আগে তিনি যে বিপদগ্রস্ত জানিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছেন সে-কথা উল্লেখই করলেন না।
বিপদের কথা উল্লেখমাত্র না করে ড. মুরকোট তার শেষ মেসেজে জানতে চাইলেন কুয়াশার কুশল সংবাদ। তারপর বললেন, সুপারম্যান তৈরি করার জন্যে তিনি গত বিশ বছর ধরে যে গবেষণা চালাচ্ছেন সে ব্যাপারে কুয়াশার পরামর্শ এবং সাহায্য দরকার তার। প্রথম মেসেজে তিনি জানিয়েছিলেন, শীঘ্রি আসুন। কিন্তু দ্বিতীয় মেসেজে সে কথার উল্লেখ না করে জানালেন পনেরো দিনের মধ্যে কুয়াশা যদি অস্ট্রেলিয়ায় তার সাথে দেখা করে তাহলে তিনি খুশি হবেন। আরও অদ্ভুত কথা বললেন তিনি। বললেন, গত পাঁচ বছর আগে প্যারিসে কুয়াশার সাথে তাঁর, লেসার-রে সম্পর্কে যে আলাপ হয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করবেন দেখা হলে।
অথচ ড. মূরকোটের সাথে গত দশ বছর ধরে দেখা হয়নি কুয়াশার ।
ভ, মূরকোটের দ্বিতীয় মেসেঁজ পেয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল কুয়াশা। এর মানে কি? নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন রহস্য আছে।
মাত্র পাঁচ মিনিট পর উজ্জ্বল হয়ে উঠল কুয়াশার চোখ দুটো। বুঝে ফেলেছে, সে ড. মূরকোটের মনের কথা । ইচ্ছা করেই উল্টো-পাল্টা কথা বলেছেন তিনি। কুয়াশা যাতে সাবধান হয়ে যায়। তারমানে ড, মৃরকোট সত্যি সত্যি বিপদে
ভলিউম ১৩
পড়েছেন। ড. মূরকোটের প্রথম মেসেজটাই সঠিক। বিপদে পড়েছেন তিনি। কুয়াশার সাহায্য চেয়েছেন তাই।
| কিন্তু কুয়াশা সাহায্য করতে গিয়ে যদি নিজে বিপদে জড়িয়ে পড়ে তাহলে বিপদের উপর বিপদ হবে। সেজন্যেই দ্বিতীয় মেসেজে উল্টোপাল্টা কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি কুয়াশাকে। তিনি জানেন কুয়াশা বুদ্ধিমান। সে ঠিক তার মনের কথা বুঝতে পারবে। তিন
যাত্রা হলো শুরু।
| প্রায় চার হাজার নটিক্যাল মাইল দূরত্ব অতিক্রম করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে সাদা ধবধবে ইয়ট গাঙচিল, কুয়াশা, ডি. কস্টা এবং একজন ক্যাস্টেন, দুজন সহকারী ক্যাপ্টেন, কয়েকজন নাবিক, জনাকয়েক বাবুর্চি-বেয়ারা, প্রচুর খাদ্য সভার, কুয়াশার আবিষ্কৃত অদ্ভুত সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নিয়ে পরদিন সকাল আটটায় বঙ্গোপসাগরের শান্ত, সমাহিত জলরাশির উপর দিয়ে হাঁসের মত সাবলীল গতিতে এগিয়ে যেতে শুরু করল।
বেলা নটায় ডেকে সভা বসল। .. সভার আহ্বায়ক ডি কস্টা। বক্তাও সে, সভাপতিও সে ।
নাবিকের দল এবং সহকারী ক্যাপ্টেনদ্বয় দাঁড়িয়ে রইল ডেকে । বাতাসে কাপড় চোপড় উড়ছে সকলের ।
একটি সৌখিন লাঠিতে ভর দিয়ে লম্বা রোগা দেহটা খানিকটা নত করে বলে চলেছে ডি, কস্টা, ‘পৃঠিবীর স্মলেস্ট, আই মীন, কন্টিনেন্ট, আই মীন, মহাডেশ । হলো অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া হামাডের ডেশ। হামার পূর্ব পুরুষের পূর্বপুরুষ ছিলেন। জেমস কুক। আমি টার গ্রেট গ্রেট গ্র্যাণ্ড সনের গ্রেট গ্রেট গ্র্যাণ্ড সন কিংবা..কঠা যাই হউক, জেমস কুক কে ছিলেন জানেন নিশ্চয়? অস্ট্রেলিয়ার আবিষ্কর্টা! সেভেনটিন সেভেনটিতে টিনি এই মহাডেশ আবিষ্কার করিয়াছিলেন!’.
খুক খুক করে কাশল সহকারী ক্যাপ্টেন আলম। কিন্তু ডি, কস্টা সেদিকে কর্ণপাত না করে বলে চলল, সায়েন্টিস্টডের ঢারণা হোয়েন আই ওয়াজ-ডুট্টরি ছাই, আঙরেজী টো বুঝবেন না-হাপনাডের লাইফই বরবাড়লেট দ্যাট গো, যেটে ডিন, যা বলিটেছিলাম, সায়েন্টিস্টডের ঢারণা পৃঠিবীটা যখন কোল্ড হয়ে গিয়ে রেস্ট নিচ্ছিল, যখন পৃঠিবীর ফিজিক্যাল চেঞ্জ হবার বিগ ধরনের কোন সম্ভাবনা ছিল না, জাস্ট অ্যাট দ্যাট মোমেন্ট এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প হইল।’ * ডি, কস্টা সহকারী ক্যাপ্টেনের দিকে হাত বাড়াল, সিগারেটের প্যাকেট
ফেলিয়া আসিয়াছি কেবিনে-ডিন টো হাপনার একটা ‘
সিগারেট ধরিয়ে ডি.কস্টা আবার শুরু করল সেই ভূমিকম্পের ফলে ক্রিয়েট : কুয়াশা ৩৮
হয় ইণ্ডিয়ান ওশেন, আই মীন, ভারট মহাসাগর। ভারট মহাসাগর অ্যাট দিস মোমেন্ট যেখানে রহিয়াছে সেখানে ছিল না। ভারট মহাসাগর টো ডুরের কঠা, ওয়াটার বলটেই এখানে কিছু ছিল না। ছিল মাটি। বিস্টীর্ণ, বিশাল মাঠ, ফিল্ড। কিন্তু ভূমিকম্প হবার পর সব ওলটপালট হয়ে গেল। বিশাল ভূ-পীস আই মীন ভূ-খণ্ড কাঁপতে কাঁপতে নিচু হটে হটে অভৃশ্য হয়ে গেল-যেমন আমার ফ্রেণ্ড হঠাৎ একএক সময় অড়শ্য হয়ে যায়।’
হেসে ফেলল সবাই।
‘কন্তু ডি কস্টা নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। লাঠির উপর দেহের ভার আরও বেশি করে দিয়ে কোনরকমে দাঁড়িয়ে রইল সে। দাঁড়িয়ে থাকতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে তার কেননা ঢেউ বাড়ার সাথে সাথে ইয়ট দুলছে একটু একটু। ডি কস্টা অসুস্থবোধ করছে। । আপনি বরং আপনার কেবিনে গিয়ে বিশ্রাম নিন,’ বলল নাবিক শাজাহান,
সমুদ্রে বোধহয় আগে আসা হয়নি সাহেরে?
| ‘হোয়াট!’ গর্জে উঠল ডি কস্টা, জানো, জন্মের পর থেকে আমি সমুদ্রে! হামাডের বংশের এটা একটা ট্রেডিশন। ভারট মহাসাগরে একা একটা ইয়ট নিয়ে মাসের পর মাস কাটাইয়াছি। জেমস কুক ছিলেন হামাডের রিলেটিভ, টার রক্ত বহিটেছে আমার শরীরে!
আলমগীর সান্ত্বনা দিয়ে বলল, শাজাহানের কথা ধরবেন না, মি. ডি। ও তো আর আপনাকে চেনে না।’ | ডি, কস্টা একটু হাসল আলমগীরের দিকে তাকিয়ে। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ভূ-পীস টো কাঁপতে কাঁপতে নিচ হয়ে গেল। সেই জায়গা দখল করল ওয়াটার। সেই অগাধ ওয়াটার বিরাট এক সমুদ্র হয়ে ডেখা ডিল। যার নাম হলো ভারট মহাসাগর। কিন্টু এশিয়ার সেই বিশাল মাঠ অদৃশ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত গেল কোঠায়? সেই ভূ-পীস, আই মীন, ভূ-খণ্ড চার হাজার মাইল দূরে, ট্রপিক. অভ ক্যাপ্রিকর্ণের উপর, আই মীন, মকরক্রান্তির উপর মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল। এই ভূ খণ্ডই হইল অস্ট্রেলিয়া, হামার স্বজাটিডের মহাডেশ।’
| একটু থেমে সকলের মুখের দিকে তাকাল ডি. কস্টা। সবাই মুচকি মুচকি হাসছে। কিন্তু শরীর ভাল ঠেকছে না বলে ওদের সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছা ত্যাগ করল সে। সে ভেবেছিল খানিক আগেই স্বয়ং কুয়াশার কাছ থেকে শেখা তথ্যগুলো এদেরকে শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দেবে। কিন্তু এরা কেউ তার জ্ঞানের বহর দেখে অবাক হয়নি বুঝতে পারল সে। সে দুঃখ পেল না। লোকগুলো মূর্খ, তার ধারণা। ওদের জন্যে রং করুণাই বোধ করল সে। | আপনি আমাদের সম্মানিত ব্যক্তি,’ বলল শাজাহান, সমুদ্র ভ্রমণের প্রচুর অভিজ্ঞতা আপনার। আপনার সম্মানে আমরা আজ সন্ধ্যায় একটা পার্টি দিতে
ভলিউম ১৩
৫৮
চাই। আপনি স্টোর কিপারকে ভজিয়ে কয়েক বোতল…!’, অলরাইট। অলরাইট!’
‘ ডি কস্টা আনন্দে গর্বে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল, সে কঠা আপনাকে ভাবটে হবে
। হামি ওয়াইনের ব্যবস্তা করিব। | হঠাৎ বমি বমি ভাব উঠল ডি, কস্টার। ইয়ট যতই দুলছে ততই সি-সিকনেসের
মুঠোয় চলে যাচ্ছে সে।
হামাকে এখন পড়াশুনা করিটে হইবে, ডি, কটা বলল। “টাছাড়া আমার ফ্রেণ্ড মি, কুয়াশাকে কিছু বুড়ি পরামর্শও ডিটে হবে। জানেনই টো. হামার পরামর্শ ছাড়া টার চলে না-চলিলাম ডেকা’হবে সন্ধ্যার সময়।
চলে গেল ডি. কস্টা। পিছন থেকে নিজেদের মধ্যে ডি কস্টার সম্পর্কে আলাপ করতে করতে হোঃ হোঃ হেসে ফেলল ওরা সবাই। কিন্তু ডি, কস্টা ভুলেও পিছন ফিরে তাকাল না। এক সেকেণ্ড সময় নষ্ট করার উপায় নেই তার এখন। বমি প্রায় : গলায় এসে ঠেকেছে। দেরি করলে ওদের সামনেই হয়তো বমি করে ফেলবে।
| সবাই জেনে ফেলবে সে সমুদ্র ভ্রমণে একেবারে নতুন। সেটা বড় লজ্জার ব্যাপার হবে।
সমুদ্র রুদ্রমূর্তি ধারণ করল বিকেলের পর থেকে। সন্ধে যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল ঢেউয়ের উচ্চতা বাড়তে বাড়তে ছোটখাট এক একটা টিলার সমান হয়ে দাঁড়াল। | চারদিকে অ:ৈ— রাশি। কোথাও কোনদিকে তীরের চিহ্ন নেই। নেই কোন প্রাণের সাড়া। শুধু ৩. আর জল, টেউ আর ঢেউ। ঢেউয়ের মাথায় চড়ে নাচছে। গাঙচিল! যেন বিশাল সীমাহীন আকাশে একটি গ্যাস বেলুন উড়ছে।
প্রকাণ্ড লাল সূর্য অস্ত যাচ্ছে পশ্চিম সমুদ্রে। সে তেজ নেই সূর্যের। তাকিয়ে থাকলে ঝলসে যাচ্ছে না চোখ। ঢেউয়ের আড়ালে কখনও হারিয়ে যাচ্ছে অতবড় সূর্যটা কখনও দেখা যাচ্ছে আবার ঢেউ নেমে গেলে।
| পুবাকাশে মেঘ। মেঘ মাথার উপর। আকাশের কোথাও একটি পাখি নেই। সারাটা দিনে মাত্র দুটো সি-গাল দেখেছে কুয়াশা।
শক্তিশালী লেন্সের বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে পূবাকাশের কোনায় সুপীকৃত কালো মেঘের দিকে তাকাল কুয়াশা। গম্ভীর হয়ে উঠল সে। লক্ষণ ভাল নয়। হাতঘড়ি দেখে পকেট থেকে মিনি ট্রানজিসটর সেটটা পর করে অন করল সে।
নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। বাংলাদেশ-রেডিও থেকে খানিক পর দুই সামুদ্রিক যানবাহনগুলোকে নিকটবর্তী বন্দরে আশ্রয় নেবার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
ঘাড় ফিরিয়ে কুয়াশা কন্ট্রোলরূমের দিকে তাকাল। ক্যাপ্টেন হাফিজ হাসি মুখে কুয়াশা ৩৮
৫৯
তাকিয়ে আছে উইণ্ডীনের ওপাশ থেকে কুয়াশার দিকে। কুয়াশা হাত ইশারায় ডাকল তাকে।
ডেকে নেমে এল ক্যাপ্টেন।
কুয়াশা বসল ডেকের উপর একটি চেয়ারে। চেয়ারের সামনে একটি ছোট টেবিল। টেবিলের উপর একটা ম্যাপ। ভারত মহাসাগরের ম্যাপ।
ক্যাপ্টেন সামনে এসে দাঁড়াল।
কেমন বুঝছেন আবহাওয়া, জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। ভাল নয়। কি হবে বুঝতে পারছি না, স্যার।’
কুয়াশা ম্যাপের দিকে চোখ রেখে বলল, আমরা বঙ্গোপসাগরের শেষ সীমায় চলে এসেছি। সন্ধ্যার পরই ইয়ট পড়বে ভারত মহাসাগরের আওতায়। নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে, এই যে, এখানটায়।’ কুয়াশা ম্যাপে আঙুল নির্দেশ করে দেখাল । বলল, “যদি নিম্নচাপ দক্ষিণ দিকে সরে না আসে তাহলে আমরা নিরাপদ থাকব। তাই না?
এক গাল হাসি দেখা দিল প্রৌঢ় ক্যাপ্টেনের মুখে। বলল, “ঠিক তাই, স্যার।’
কুয়াশা বলল, ‘সেক্ষেত্রে নিকোবর দ্বীপে ইয়ট নোঙর করার কোন দরকারই নেই। চট্টগ্রাম থেকে আটশো পঁচিশ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে রয়েছি এখন আমরা। তার মানে নিকোবরের মাত্র কয়েক মাইলের মধ্যে । বিপদ মনে করলে ইয়ট ঘুরিয়ে ‘ নিন। তবে সময় নষ্ট করতে চাই না আমি।’
কোন দরকার নেই, স্যার। আমরা নিরাপদেই এগিয়ে যেতে পারব।’ বাড়িয়ে দিন স্পীড । টোয়েনটি ফাইভ নট করুন।’ ইয়েস, স্যার।’ দ্রুত চলে গেল ক্যাপ্টেন ডেক ছেড়ে।
ক্যাপ্টেন চলে যাবার খানিক পর এল বেয়ারা কফি নিয়ে। কফির কাপসহ ট্রে টেবিলে রেখে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ঘুরে পঁড়াল বেয়ারা। কুয়াশা মুখ তুলে তাকাল ম্যাপ থেকে বলল, “ডি. কস্টা কোথায়?’
তিনি তার কেবিনে, হুজুর । ডেকেছিলাম, ভিতর থেকে বললেন যে কফি দরকার নেই তার। বই-পত্র নিয়ে খুব ব্যস্ত।
তাচ্ছা, যাও। বেয়ারা চলে গেল।
ডি. কস্টাকে কুয়াশাও ডেকেছিল খানিক আগে একবার। দরজা খোলেনি সে। বন্ধ দরজার ভিতর থেকে সে জানিয়েছে, প্লীজ, হামাকে ডিসটার্ব কাঁবেন না, মি. কুয়াশা। স্বজাতিদের দেশ অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে শিক্ষা আহরণ করিটেছিঃ ভেরি বিজি ইনডিড।’ মুচকি হেসে সরে এসেছে কুয়াশা। খানিক পর সে ইয়টের ডাক্তার মল্লিককে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাকেও পাত্তা দেয়নি ডি. কস্টা।
.
৬০
ভলিউম ১৩
লেখা পড়া করছে? অসম্ভব!’ বলল নাবিক জোয়াবদার, ইয়ার্কি মারার জায়গা পায়নি! নিশ্চয়ই আমাদেরকে ফাঁকি দেবার মতলব ওর। স্টোরকিপারের কাছ থেকে হুইস্কি আদায় করতে পারেনি বলে বের হচ্ছে না সে।
আলম বলে উঠল, “উঁহু, আমার তা মনে হয় না…।’ :
লাঞ্চ পরিবেশন করার জন্যে আলাদা একটি গ্রুপ আছে বেয়ারাদের। সেই গ্রুপের সাদেক আলী বলল, কিন্তু ডি, কস্টা সাহেব যে দুপুর থেকেই দরজা বন্ধ করে রেখেছে। দুপুরে খায়ওনি সে কিছু। লাঞ্চ নিয়ে গিয়েছিলাম। দরজা খুলল না। বলল, কাজে ব্যস্ত, খাওয়াদাওয়ার সময় নেই।’
। সহকারী ক্যাপ্টেন বলল, ‘সবাই মিলে একবার যাই চলে। রীতিমত । সন্দেহজনক ব্যাপার। দেখা দরকার কি কারণে সে দরজা খুলছে না।
সে-ও ঠিক। তবে তাই যাওয়া যাক। নিচে বসে কথা বলছিল ওরা। সবাই এবার এলিভেটরের দিকে পা বাড়াল উপরে ওঠার উদ্দেশ্যে। ডি. কস্টার কেনিটা তিন তলাতেই। | এলিভেটর থেকে নেমে প্যাসেজ ধরে হৈ হৈ করতে করতে ডি কস্টার কেবিনের দিকে এগিয়ে চলল ওরা। আশপাশ থেকে আরও কয়েকজন ভিড়ল দলে। সবাই একসাথে ডি, কস্টার কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল।
| প্রথমে কলিংকেল টেপা হলো।
ডি কস্টা কোন সাড়া দিল না ভিতর থেকে। আলম ধাক্কা দিল দরজার গায়ে। তবু কোন সাড়া নেই ডি কস্টার।
নাম ধরে ডাকাডাকি করল জোয়ারদার। কিন্তু তবু সাড়া পাওয়া গেল না ডি. কস্টার।
কি করা যায়?’ জিজ্ঞেস করল শাজাহান। দরজা ভাঙো,’ বলল অপর সহকারী ক্যাপ্টেন সামাদ।
তাছাড়া আর উপায়ই বা কি। তবে মিস্ত্রিকে ডেকে গুলো খুলে দরজা, খোলার ব্যবস্থা করলে হয়।
শাজাহান ছুটল মিস্ত্রিকে ডাকতে। তিন মিনিটের মধ্যেই মিস্ত্রি তার যন্ত্রপাতি নিয়ে এল। দরজা খোলার পর দেখা গেল আশ্চর্য এক দৃশ্য।
সাদা একটি চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে আছে ডি, কস্টা। চাদরের উপরে একটি সাদা কাগজ। বড় বড় অক্ষরে তাতে লেখাঃ হামি সুইসাইড করিটেছি। আপনারা যখন দরজা ভাঙিয়া এই কেবিনে ইন করিবেন টখন আমি হেভেনে চলিয়া যাই। আমার সুইসাইডের, আই মীন, আত্মহত্যার কারণ আছে। কিন্তু সে কারণের কঠা হামি বলিয়া যাইটেছি না। আমার ডেডবডি সমুদ্রে যেন না ফেলা হয়।
কুয়াশা ৩৮
| ৬১
কোল্ড স্টোরে রাখিয়া ডিটে হইবে। টারপর অস্ট্রেলিয়ায় গিয়া কবরস্থ করিটে হইবে । বিড়ায়।
কেবিনের চারদিকে বমি। টেবিলে বমি। মেঝেতে বমি। এমনকি ডি. কস্টা যেখানে শুয়ে রয়েছে সেখানেও বমি।
ডি, কস্টার লেখাটা পড়ে অবাক বিস্ময়ে সকলে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল। কারও মুখে কোন কথা ফুটল না। | খবর পেয়ে ছুটে এল কুয়াশা এবং ডাক্তার মল্লিক। ডাক্তার মল্লিক সকলকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দিল কেবিন থেকে। সবাই যেতে দরজা বন্ধ করে দিল সে।, কুয়াশা ইতিমধ্যে ডি, কস্টার শরীর থেকে চাদরটা সরিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে! দেড় মিনিট পরই মুচকি একটু হাসল কুয়াশা।
ডাক্তার মল্লিকের দিকে তাকিয়ে কুয়াশা বলল, বেঁচে আছে এখনও। তবে বলা। যায় না কি হবে। তাড়াতাড়ি পাম্প করে পয়জন রে করার ব্যবস্থা করুন।’
মৃদু হাসি ঠোঁটে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল কুয়াশা।
কুয়াশা বেরিয়ে যেতেই ডাক্তার মল্লিক একটা লম্বা রাবারের পাইপ ব্যাগ থেকে বের করে ডি. কস্টার গালের ভিতর পুরে দেবার কাজে লেগে গেলেন।
কিন্তু গালের ভিতর দিয়ে পেটে পাইপ নামাবার কোন দরকারই হলো না। ডি. কস্টা আচমকা এক ঝটকায় পাইপটা গলি থেকে বের করে ফেলে দিল মেঝেতে। সাথে সাথে বিছানার উপর উঠে বসল সে।
ঠোঁটে আঙল চাপা দিয়ে ডি কস্টা ডাক্তার মল্লিকের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘খবরডার, চিৎকার-টিকার করিবেন না, ডক্টর! হামি সুইসাইড করি নাই, আই মীন মৃত্যুবরণ করি নাই। পয়জনও খাই নাই, সঢ্যি বলিটেছি। কিন্তু কঠাটা যেন কেউ না জানে••• |’ ।
• ‘তাহলে এই ধরনের আচরণের কি কারণ বলুন?’ ডাক্তার অবাক হয়ে প্রশ্ন। করলেন।
কারণটা টো আপনাকে বলিবই। ডি. কস্টা বলল, “কিটু কঠা ডিন আপনি কাহাকেও বলিবেন না।’
কথা দিচ্ছি।’ ‘আসলে সকাল ডশটার পর হইটে হামি বমি করিটে শুরু করি। কারণ জীবনে এই প্রঠম সমুদ্র-ভ্রমণে বাহির হইয়াছি টো, ইয়টের ডোলাটা সহ্য করিটে পারিটেছি
। কিন্তু কথাটা যডি সবাই জানিটে পারে টাহলে আমার প্রেস্টিজ বলিটে কিছু ঠাকে না। টাই যখন ডেখিলাম: ভরজা ভাঙিয়া উহার কেবিনে ইন করিবার চেষ্টা। করিটেছে টখন একটি লেটার লিখিলাম বাঢ্যি হইয়া। আসলে পয়জন-টয়জন ভক্ষণ করি নাই। খবরডার, কেউ যেন কঠাটা না জানিটে পারে..’
টপ ডেকে দাঁড়িয়েছিল ওরা। বাতাসে পত পত করে উড়ছে ওদের প্ল্যান্ট
৬২
ভলিউম ১৩
শার্ট।
কুয়াশা ডি. কস্টার কেবিন থেকে ডেকে আসতেই উদ্বিগ্ন মুখে সবাই তাকাল ।
কুয়াশা বলল, “চিন্তা করার কিছু নেই। এ যাত্রা বেঁচে যাবে ডি কস্টা; তবে বেশ কদিন অসুস্থ থাকবে সে এখন। বিশ্রাম দরকার। ওকে তোমরা কেউ বিরক্ত কোরো না।
কুয়াশা বসল একটি ডেক-চেয়ারে।
সবাই ফিরে যেতে উদ্যত হলো। | হঠাৎ চিৎকার করে উঠল শাজাহান? আরে! ওটা কি!’ সামনে জলরাশির খানিকটা উপরে আঙুল তুলে দেখাল শাজাহান।
সকলে তাকাল সেদিকে।
সন্ধ্যা না নামলেও সূর্য অস্ত গেছে এইমাত্র। চারদিকে ডানা মেলে দিয়েছে মেঘ। আবছা অন্ধকার। তবু সবাই দেখতে পেল জিনিসটা মাত্র ‘পলকের
জন্যে।
| সমুদ্রের জল থেকে দশ বারো হাত উপরে যখন জিনিসটা তখন সবাই দেখল। শাজাহান আরও কয়েক সেকেণ্ড আগেই দেখেছে অবশ্যি।
সবেগে শূন্য থেকে সমুদ্রের পানিতে পড়ল জিনিসটা। আবছা অন্ধকারে মনে হলো একটি মানুষ।
সকলে তাকাল আকাশের দিকে। আকাশে মেঘ। মেঘ ছাড়া আর কিছু নেই। আকাশ থেকে মানুষ পড়ল এ যেন অবিশ্বাস্য কথা। কিন্তু চোখের দেখা তো ভুল হতে পারে না।
উঠে দাঁড়িয়েছে কুয়াশা ডেক-চেয়ার ছেড়ে। বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে আকাশ দেখছে সে । কিন্তু কিছুই দেখা গেল না আকাশে।
ওই যে! ভেসে উঠেছে!’ চিৎকার করে উঠল জোয়ারদার। মানুষ! মানুষ!’ একযোগে চিৎকার করে উঠল বাকি সকলে সবিস্ময়ে।
বিনকিউলার দিয়ে সমুদ্রে তাকাল কুয়াশা। পনেরো সেকেণ্ড পর বিনকিউলার চোখ থেকে নামিয়ে শান্ত গলায় কুয়াশা বলল, ইয়ট থামাতে বলো। সিঁড়ি নামিয়ে দাও বোটে ওঠার। ওকে বাঁচাতেই হবে!
বিনকিউলার দিয়ে কুয়াশা মানুষটাকে দেখেছে। শুধু দেখেইনি, চিনতেও পেরেছে সে।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল কুয়াশা তর তর করে। প্রায় বারো ফুট উপরে থাকতেই লোহার সিঁড়ি থেকে লাফ দিল কুয়াশা।
বোটের উপর গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা শূন্য থেকে। দ্রুত হাতে ইয়টের গা থেকে দড়ির বাঁধন খুলে ফেলল সে।
কুয়াশা ৩৮
ইয়টের পাশে ক্ষুদ্র বোটটা প্রকাণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় ভীষণভাবে লাফাচ্ছে । ইয়টের স্পীড কমে গেছে। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছে ক্যাপ্টেন।
বাতাসের দাপটে পঁড়িয়ে থাকা দায়। ঝটপট খুলে ফেলল কুয়াশা পরনের আলখাল্লা। বৈঠাটা হাতে নিয়ে বসল সে।
সার্চ লাইটের আলো ফেলা হয়েছে জলে। কিন্তু ঢেউয়ের আড়ালে, স্রোতের টানে হারিয়ে গেছে মানুষটা। ইয়টের ডেক থেকে আলো জ্বেলে খোঁজার চেষ্টা করছে সবাই। | ইয়ট থামছে। ইয়টের পিছন দিকে এগিয়ে চলেছে কুয়াশার বোট। স্রোতের টানে অচেতন দেহটা ইয়টকে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছে নিশ্চয়ই পিছন দিকে।
দুই মানুষ সমান উঁচু ঢেউয়ের মাথায় চড়ে দুলছে বোটটা। আবার ঢেউ সরে গেলেই নেমে আসছে সেটা নিচে। বোটের দুই পাশে উঁচু উঁচু ঢেউ। একটি ক্রমশ কাছে সরে আসছে পাহাড় সমান উঁচু হয়ে, অপরটি দূরে সরে যাচ্ছে। * ঢেউয়ের মাথায় আবার বোট উঠে যেতেই কুয়াশা দেখতে পেল কালো মত কি
একটা ভাসছে দূরে। স্রোতের টানে দূরে সরে যাচ্ছে জিনিসটা।
কুয়াশার বোটও তীব্র বেগে এগিয়ে চলেছে সেদিকে স্রোতের টানে। কিন্তু স্রোতের উপর ভরসা করলে কোন লাভই হবে না। দূরত্ব একই থেকে যাবে। স্রোতের চেয়ে দ্রুত গতি দরকার এখন। কিন্তু ঢেউয়ের জন্যে বৈঠা চালিয়েও গতি বাড়ানো যাচ্ছে না।
| আর একবার ঢেউয়ের চুড়ায় বোট উঠলে কুয়াশা দেখল কালো মত জিনিসটা একই দূরত্বে রয়েছে। পিছন ফিরে তাকাল কুয়াশা।’
পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইয়ট। হাত নেড়ে ইশারা করল কুয়াশা ক্যাস্টেনের । উদ্দেশ্যে।
স্টার্ট দিল ইয়ট। কুয়াশা আর দেরি করল না। বোট থেকে লাফ দিয়ে পড়ল সে অথৈ সাগরে।
প্রাণের ঝুঁকিটা ইচ্ছা করেই নিল কুয়াশা। ঝুঁকি না নিলে রাসেলকে বাঁচানো। যাবে না–তার ধারণা। চার শত সহস্র হিংস্র, প্রতিশোধপরায়ণ রাক্ষস দুটি মানব সন্তানকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলার জন্যে হাউ-মাউ-খাউ রবে ছুটে আসছে। | দুটি মানব সন্তানের মধ্যে একটি শিশু। অসহায়! অচেতন। রাসেল আকাশ থেকে সাগরে পড়ার আগেই জ্ঞান হারিয়েছে ।
| অপর সন্তানটি কুয়াশা। এক একটি পাহাড় সমান ঢেউ এক একটি রাক্ষসের মত ছুটে আসছে সাদা ফেনা মাথায় নিয়ে, বিকট গর্জনে চারদিক প্রকম্পিত করে। সেই
৬৪.
ভলিউম ১৩
সাথে প্রচণ্ড বাতাস। বাতাস না যেন রাক্ষসদের অট্টহাসি।
. কিন্তু বড় দামাল মানব সন্তান কুয়াশা। পরাজয় বরণ করা তার ধর্ম নয়। প্রাণপণ শক্তিতে সে শুধু জলের উপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করারই চেষ্টা করছে না, রাসেলের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাবার চেষ্টাও করে চলেছে সে।
স্টার্ট নিয়েছে আবার ইয়ট। দিক পরিবর্তন করে এগিয়ে আসছে সেটা পিছন দিকে। | তীরবেগে সাঁতার কেটে চলেছে কুয়াশা। রাসেলও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে স্রোতের
টানে। কিন্তু স্রোতের চেয়ে কুয়াশার গতি অনেক বেশি। ফলে রাসেলের এবং তার মধ্যবর্তী দূরত্ব কমে আসছে ক্রমশ।
অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে চারদিকে। ইয়ট থেকে সার্চ লাইট ফেলা হয়েছে। রাসেলকে দেখতে পাচ্ছে কুয়াশা। মাত্র দশ পনেরো হাত দূরে সে এখন।
ইয়ট এগিয়ে এসেছে। কুয়াশাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইয়ট।
দূরত্ব কমে এল। কুয়াশার প্রায় হাতের নাগালের মধ্যে রাসেল। প্রতে গিয়েও ধরতে পারছে না সে রাসেলকে। ঢেউগুলো যেন তামাশা করছে ওদের দুজনকে নিয়ে।
কিন্তু অনমনীয় মনোবলের পরাজয় নেই। শেষ অবধি রাসেলের শার্টের একটি প্রান্ত ধরে ফেলল কুয়াশা।
ইয়টের উপর থেকে সবাই উল্লাসে চিৎকার করে উঠল।
ইয়টের স্টার্ট বন্ধ করে দিল আবার ক্যাস্টেন। নাবিকরা মোটা দড়ির শেষ প্রান্ত কোমরে বেঁধে নেমে পড়ল সিঁড়ি বেয়ে সাগরে।
কুয়াশা রাসেলকে এক হাত দিয়ে পাঁজরের সাথে সেঁটে ধরে সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে ইয়টের দিকে।
কুয়াশাকে ঘিরে রাখল নাবিকের দল। ইয়টের গায়ে এসে থামল কুয়াশা। সহকারী ক্যাপ্টেন এবং একজন নাবিক সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে কুয়াশার কাছ থেকে রাসেলের ভার গ্রহণ করল। অপর দুজন নাবিক হাত বাড়িয়ে দিল কুয়াশার দিকে।
মৃদু হাসল কুয়াশা। বলল, দরকার নেই। সরো, আমি উঠে যাচ্ছি।’
রাসেলকে সাগরের গ্রাস থেকে উদ্ধার করা হলো। কিন্তু তাকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি চলল সারাটা রাত ধরে।
শূন্য থেকে সাগরে পড়ার ফলে করে হাড় সরে গেছে রাসেলের। ডান উরুর ত্বক মাংস কেটে গেছে প্রায় আধহাত জায়গা জুড়ে। এছাড়াও পেটে নোনা পানি ঢুকেছে প্রচুর।
ডাক্তার মল্লিককে সহকারী হিসেবে সঙ্গে রেখে রাসেলকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে
৫-কুয়াশা ৩৮
৬৫
ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিল কুয়াশা নিজেই।
| ইয়টের সিক-বেতে কর্মব্যস্ত সময় বয়ে চলল। রাসেলের পেট থেকে পাম্প করে বের করা হলো পানি। কোরামিন দেয়া হলো। দেয়া হলো অক্সিজেন। তবু রাসেলের জ্ঞান ফেরার কোন লক্ষণ নেই।
নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুয়াশা রাসেলের মুখের দিকে। অপারেশন টেবিলে শুয়ে আছে রাসেল। পাশে দাঁড়িয়ে কুয়াশা।
রাত শেষ হয়ে গেল।
সকাল আটটায় একটু যেন নড়ে উঠল রাসেলের ঠোঁট। সাফল্যের আনন্দে মৃদু একটু হাসল কুয়াশা। চোখের পাতা কাঁপল রাসেলের।
আবার কুয়াশা মগ্ন হয়ে পড়ল রাসেলকে নিয়ে। জ্ঞান ফিরছে রাসেলের বুঝতে পেরেছে কুয়াশা। জ্ঞান ফেরার লক্ষণ পরিষ্কার হবার সাথে সাথে নতুন কয়েকটি ওষুধের ব্যবস্থা করা দরকার। তার আগে দরকার রাসেলকে আর একবার ভাল করে পরীক্ষা করা।
বেলা ন’টার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে ডাক্তার মল্লিকের দিকে তাকাল কুয়াশা। ঘুমাচ্ছে রাসেল।
আর কোন বিপদ নেই। বেঁচে গেল দামাল ছেলেটা এ যাত্রা। ডাক্তার মল্লিককে রাসেলের দায়িত্ব দিয়ে সিক-বে থেকে বেরিয়ে গেল কুয়াশা।
.
আপনি মহৎ লোক তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সেদিন সন্ধ্যায় একটি কেবিনের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কৃতজ্ঞ কণ্ঠে রাসেল বলল, তা না হলে, আমি আপনাকে পছন্দ করি না, আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করি সব সময় জেনেও কেন আমাকে বাঁচালেন!
| স্নেহের হাসি কুয়াশার চোখে মুখে। সে বলল, মহৎ আমি নই, রাসেল। সাধারণ একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। সব মানুষেরই আছে। অনেক মানুষ আছে যারা নিজ দায়িত্ব পালন করতে উদ্যোগী হয়। না। সে-সব মানুষের চেয়ে আমি খুব একটা শক্তিশালী নই। তারা উদ্যোগী নয়, আমি উদ্যোগী। আমি আমার ক্ষুদ্র ক্ষমতা অনুযায়ী মানুষের কল্যাণ করতে চাই। মানুষের কষ্ট দূর করতে চাই। এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার, এর মধ্যে মহত্ত্ব কোথায়, বলো?’ | ‘আপনি মহৎ বলেই নিজেকে মহৎ বলে স্বীকার করেন না, রাসেল বলল। যাই হোক, আমি আপনার এ ঋণ এ জীবনে হয়তো শোধ করতে পারব না।’
বাদ দাও,. ভাই, ওসব কথা। কুয়াশা রাসেলের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, কেমন বোধ করছ এখন? সন্ধ্যায় ডেকে গিয়ে বসতে পারবে তো?
ভলিউম ১৩
কুয়াশার দেয়া হাত ঘড়ি দেখল রাসেল। বিকেল পাঁচটা। ‘পারব। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
করে। কি কথা? ‘আপনি বলেছিলেন যে অস্ট্রেলিয়ায় এমনি বেড়াতে যাচ্ছেন। কথাটা কি সত্যি?
কুয়াশা গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, না, সত্যি নয়। আমি অস্ট্রেলিয়ায় যাবার প্ল্যান করেছিলাম বিশেষ একটি প্রয়োজনীয় জিনিসের খোঁজে।
“কি সেই জিনিস? আমি কি তার নাম জানতে পারি?’ ‘পারো। ইউরেনিয়াম।’
‘ইউরেনিয়াম!’ চমকে উঠে বিছানার উপর বসে পড়ল রাসেল। ইউরেনিয়ামের খোঁজে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায়? কেন, কি দরকার আপনার ইউরেনিয়াম? হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করতে লাগে ইউরেনিয়াম, মাই গড, আপনি কি আণবিক শক্তির অধিকারী হতে চান? তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় কার কাছে পাবেন ইউরেনিয়াম?’
উত্তেজিত হয়ো না, রাসেল। নরম স্বরে বলল কুয়াশা, উত্তেজিত হওয়া তোমার উচিত নয় এখন। বিশ্রাম নাও, পরে তোমাকে সব বলব।
উঠে দাঁড়াল কুয়াশা রাসেলের বিছানার পাশ থেকে।
না।’ করে দুর্বল হাতে কুয়াশার একটি হাত ধরে ফেলল রাসেল, এখুনি সব বলতে হবে আপনাকে।
আবার বসল কুয়াশা। বলল, পরে ধীরেসুস্থে শুনলেও পারতে। শোনো রাসেল, ইউরেনিয়াম আমার দরকার। বিশ্বাস করো, খারাপ কোন উদ্দেশ্য আমার নেই। মানুষের কল্যাণ ছাড়া আমি আর কিছু ভাবি না। মানুঘ্নে, দুঃখ কষ্ট সইতে পারি না বলেই বিজ্ঞানের পূজারী আমি। আমি বিশ্বাস করি বিজ্ঞানই একমাত্র পারে মানুষের সব দুঃখ দূর্দশার অবসান ঘটাতে। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ করে মানুষ মারা যাচ্ছে বাংলাদেশে টর্নেডোতে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার জন্যে দরকার আমার আণবিক শক্তি। আণবিক শক্তি তৈরি করতে হলে ইউরেনিয়াম দরকার। অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ভিক্টোরিয়া ডেজার্টে ইউরেনিয়াম আছে। তাই যাচ্ছি। তবে আরও একটি কারণ আছে?’
কি কারুণ?’
আমার এক বৃদ্ধ বন্ধু আছে ওখানে। ভদ্রলোকও বিজ্ঞানী। বিপদের কথা জানিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছেন তিনি। তাকে বিপদমুক্ত করতে হবে। সেজন্যই একদিন আগে রওয়ানা হতে বাধ্য হয়েছি।’
কি বিপদে পড়েছেন আপনার বন্ধু? কুয়াশা ৩৮
* ৩৭
কুয়াশা বলল, জানি না।
কুয়াশা তারপর সঁসিয়ে মূরকোটের মেসেজ পাঠাবার রহস্যময় ঘটনাটা বর্ণনা করল।
রাসেল কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ বলল, ‘কিন্তু একটি কথা আপনি বেমালুম চেপে যাচ্ছেন, কেন বলুন তো।’
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল কুয়াশা। বলল, “কি কথা?
আপনি জানেন না? আপনাকে একদল লোক অনুসরণ করছে চব্বিশ ঘণ্টা?’
তার মানে?’ বেশ অবাক হয়েই বলল কুয়াশা । রাসেল বলল, হ্যাঁ। একদল বিদেশী লোক চব্বিশ ঘণ্টা অনুসরণ করছে আপনার ইয়টকে।’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইল কুয়াশা রাসেলের দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, স্পেস-ক্রাফট ধরনের আকাশ যানে চড়ে অনুসরণ করছে ওরা তাই না?’
‘আপনি জানেন কিভাবে? আপনার তো জানার কথা নয়!’ রহস্যময় হাসি হাসল রাসেল।
| কুয়াশা বলল, ‘লোকগুলোকে, আমি রাস্তায় কাবু করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ির ভিতর থেকে পালিয়ে গেছে তারা। জানলাম কিভাবে জিজ্ঞেস করছ? আমি ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখেছিলাম।’’ | সপ্রশংসদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাসেল কুয়াশার দিকে। বলল, ঘোড়ার পায়ের ছাপ পরীক্ষা করেই ব্যাপারটা কি বুঝতে পেরেছিলেন?’
খুব সহজ ব্যাপার, কুয়াশা বলল, ‘একটি ঘোড়ার চারটে পা। দাগ দেখেছি মাত্র চারটেই। অথচ ঘোড়া হেঁটে আসলে চারটের চেয়ে বেশি দাগ থাকতে বাধ্য। তা ছিল না। ছিল না বলেই বুঝতে পারলাম যে ওটা আসলে সাধারণ ঘোড়া নয়-পঙ্খীরাজ ঘোড়া।
হেসে উঠল রাসেল। বলল, হ্যাঁ, পঙ্খীরাজ ঘোড়া। যাকগে, ওরা কারা? কেন অনুসরণ করছে আপনাকে?’
| ‘জানি না, বিশ্বাস করো। তবে ড, মূরকোটের বিপদের সাথে ওদের কোন যোগ থাকতে পারে। কুয়াশা বলল, “আচ্ছা, তুমি পঙ্খীরাজে চড়লে কখন? পড়লেই বা কেন সাগরে?’
চড়েছিলাম আপনার বাড়ি থেকে। হ্যাঁ, আপনি যখন লোকগুলোকে গাড়িতে রেখে বাড়ির ভিতর ঢুকলেন তখন আমি আপনার বাগানে লুকিয়ে ছিলাম। আপনি চলে গেলেন। তারপর, অবিশ্বাস্য হলেও দেখলাম, একটি পঙ্খীরাজ ঘোড়া বাগানে নামল। গাড়ির ভিতর থেকে অজ্ঞান লোকগুলোকে উদ্ধার করে ফেলল পঙ্খীরাজের
৬৮
ভলিউম ১৩
আরোহীরা। আমি আর চেপে রাখতে পারলাম না কৌতূহল। পঙ্খীরাজ উড়তে শুরু করার পরমুহূর্তেই আমি তার লেজ ধরলাম দুই হাত দিয়ে মুঠো করে। পঙ্খীরাজ ঘোড় উড়ে চলল আমাকে নিয়ে। •
তারপর? পড়লে কেন?’ ‘পড়লাম কেন? শত্রুলকে হটিয়ে দিয়ে পঙ্খীরাজের মালিক হবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু রা, পড়ে গেলাম। ওরা সংখ্যায় বেশি। সবাই মিলে ধরে ফেলে দিল আমাকে। ভাগ্য ভাল, পড়লাম আপনার ইয়টের সামনে। আপনারা যদি দেখতে না পেতেন তাহলে এতক্ষণ কোন এক হাঙর হজম করে ফেলত আমাকে।
হঠাৎ কেবিনের দরজায় টোকা পড়ল।
কে?’ গম্ভীর গলায় জানতে চাইল কুয়াশা। মি, স্যানন ডি কস্টা। মে আই কাম ইন স্যার। আসুন।’
ডি. কস্টা আজ দুপুরে খানিকটা সুস্থ হয়েছে। সুস্থ হয়েই খবর পেয়েছে সে। আলমই তাকে জানিয়েছে যে আকাশ থেকে একটি যুবক পানিতে পরে ডুবে যাচ্ছিল, কুয়াশা তাকে উদ্ধার করেছে।
কেবিনের দরজা ঠেলে ছড়ি ঠুকে ঠুকে ভিতরে প্রবেশ করল ডি কস্টা। রাসেলকে দেখে হাঁ হয়ে গেল তার মুখটা।
ইউ? দ্যাট ভেরি চাইল্ড!’ হেসে ফেলল রাসেল। বলল, “খুব অবাক হয়েছেন মনে হচ্ছে?
ডি. কস্টা বলল, হাপনি নাকি স্কাই ঠেকে সমুদ্রে পড়িয়াছেন? ইজ দ্যাট এ. ফ্যাক্ট?’
কে বলল আপনাকে?’ সব্বাই বলিটেছে।’ মিথ্যে বলছে না তারা,’ রালে কলল ।
‘আলবত্ মিঠ্যা বলিটেছে। চালাকী করিবার স্থান পান নাই! আমি বলিটে পারি আসল ব্যাপারটা কি ঘটিয়াছে! আপনি হামাডের ইয়টে লুকাইয়া ছিলেন, তারপর ওয়াটারে লাফ ডিয়া পড়িয়াছেন, বোকা বানাইবার জন্য আপনি…।’
রেগে উঠল ডি, কস্টা। আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল সে। যেতে, যেতে বলতে লাগল, নাম্বার ওয়ান লায়ার। মিঠ্যা কঠা বলিয়া আর যাহাকেই ঠকাও, কি মি. স্যানন ডি. কস্টাকে ঠকাইটে পারিবে না, সে নেটিত নয়, ফর গড়স সেক••!’
দাঁড়িয়ে আছে সবাই অধীর আগ্রহে ইয়টের ডেকে। সকলের চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কুয়াশা ৩৮
৬১
সমুদ্রের কূল নেই, কিনারা নেই।
| বিষুবরেখা পেরিয়ে এসেছে ওরা গত পরশুদিন।
গতকাল সকালে কোকোস্ আইল্যাণ্ড এবং ক্রিস্টমাস আইল্যান্ডের মধ্যবর্তী জলপথ অতিক্রম করেছে ইয়ট।
কোকো অস্ট্রেলিয়ানদের দ্বীপ। ক্রিস্টমাস ব্রিটিশদের। দুটো দ্বীপের মাঝখান দিয়ে ইয়ট এলেও তীরের চিহ্ন ওরা কেউ দেখেনি। দুটো দ্বীপের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় সাড়ে পাঁচশো মাইল। মাঝখান দিয়ে ইয়ট গেছে। তীর দেখতে পাবার কথা
নয়।
ভারত মহাসাগরের সব চেয়ে গভীরতম এলাকা কোকোস কলিং বেসিন পেরিয়ে এসেছে গাঙচিল গতকালই। এই বিশেষ জায়গায় সমুদ্র অত্যন্ত গভীর। আঠারো হাজার ফুট নিচে মাটি।
অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র সীমায় পৌঁছে গেছে গাঙচিল। উত্তর বা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া যদি গন্তব্যস্থান হত তাহলে এতক্ষণ তীর দেখতে পেত ওরা।
| কিন্তু গাঙচিল নোঙর ফেলবে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায়। তাই কনিষ্ঠতম মহাদেশের পশ্চিমাংশকে পাশ কাটিয়ে, কারনায়তন, গেরাল্ডটন বন্দরদ্বয়কে হাতের বাঁ দিকে, রেখে এগিয়ে এসেছে গাঙচিল।.
ইয়ট মোড় নিয়েছে। মোড় নিয়ে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র সীমায় প্রবেশ করেছে। আজ দুপুরের আগে গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান বাইটে পৌঁছে যাবে ইয়ট। |
বেলা এগারোটা বাজে।
তীর এখনও দেখা যাচ্ছে না, তবে দেখা যাবে যে-কোন মুহূর্তে! ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে খবর শুনে সবাই ডেকে এসে দাঁড়িয়েছে। তীর দেখার উদগ্র বাসনায় সবাই অস্থির হয়ে পড়েছে।
কন্ট্রোলরূমে ক্যাপ্টেনের দুই পাশে বসে আছে কুয়াশা এবং রাসেল।
বিনকিউলার দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। ডেকে যারা আছে তারা তীর দেখতে না পেলেও কন্ট্রোলরূমের ওরা তিনজন বিনকিউলারের সাহায্যে দেখতে পাচ্ছে নূলারবর প্লেনের গভীর বনভূমির অস্পষ্ট চিহ্ন।
‘ডেকে ডি. কস্টাকে দেখছি না যে?’ ডেকের দিকে অপেক্ষারত লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল রাসেল।
কুয়াশা বলল, বেচারা ইয়ট জার্নিতে একেবারে অনভ্যস্ত। বেলা বারোটা অবধি মাখা ঘোরে, বমি হয়। লাঞ্চের আগে কেবিন থেকে বের হয় না।’
কিন্তু ঠিক সেই সময়, কুয়াশা যখন ডি, কস্টা সম্পর্কে বলছিল রাসেলকে, একজন বেয়ারা প্যাসেজ দিয়ে যাবার সময় ডি, কস্টার কেবিনের দরজায় টোকা দিচ্ছিল।
ভিতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে বেয়ারাটি ডাকল, মি. ডি. কস্টা?
ভলিউম ১৩
৭০
তবু কোন সাড়া নেই। বেয়ারা ধাক্কা দিল দরজার গায়ে। খুলে গেল দরজা। দরজা ভিতর থেকে খোলা দেখে অবাকই হলো বেয়ার। খোলা দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে কেবিনের ভিতরে তাকাল সে। কেউ নেই কেবিনে। বেয়ার ভাল ডি কস্টা বেরিয়ে গেছে কেবিন থেকে।
আধ ঘণ্টা পর ডেকে আনন্দে উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সবাই। তীর দেখতে পেয়েছে সবাই।
হৈ-চৈ-এর শব্দ পেয়ে সেই বেয়ারাটি ডেকে উঠে এল। সকলের সাথে সে-ও দেখল তীরভূমির সরলরেখা । তারপর কি মনে করে আশপাশে তাকাল সে।
| ডি, কস্টা সাহেব কোথায় গেলেন?’ পাশের একজন বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করল সে।
তিনি এখনও ঘুমাচ্ছেন।’ না তো! খানিক আগে আমি তার কেবিন থেকে ফিরে এলাম! নেই কেবিনে।
এক কান থেকে অনেক কানে কথাটা গেল। ডি. কস্টা কেবিনে নেই। অথচ ডেকেও নেই সে। গেল কোথায়?
খোঁজ পড়ল। কিন্তু খোঁজাখুঁজিই সার। ইয়টের কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না ডি কস্টাকে।
বেলা দুটো অবধি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। এমনকি কুয়াশা স্বয়ং এবং রাসেলও ইয়টের সর্বত্র সন্ধান চালাল। কিন্তু কোথাও তার ছায়ারও দেখা পাওয়া
গেল না।
গভীরভাবে কুয়াশা শেষ পর্যন্ত মন্তব্য করল, ইয়টে নেই।’ গেল কোথায়?’ উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করল রাসেল।
কুয়াশা বলল, সমুদ্রে পড়ে গেছে কিনা কে জানে। রাতের বেলা, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে একবার করে ডেকে উঠে আসত।’
কেন?’
‘সারাদিন বমি করত আর রাতে সবাইকে লুকিয়ে চাদর, বালিশের কভার ইত্যাদি পানিতে ফেলার জন্যে ডেকে আসত। একদিন আমি দেখে ফেলেছিলাম। হয়তো গতরাতেও তাই এসেছিল। রোগা মানুষ, হয়তো বাতাসের ঝাঁপটা খেয়ে, রেলিং টপকে পড়ে গেছে…।’
| কুয়াশার অনুমানটা অনেকাংশে সত্য।
গতরাতে ডি কস্টা বমিসিক্ত চাদর এবং বালিশের কভার সমুদ্রে ফেলার জন্যে সকলের অগোচরে উঠে এসেছিল ডেকে। সমুদ্রে সে ফেলেও ছিল জিনিসগুলো । তারপর ডেক অতিক্রম করার সময় হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ে আকাশের দিকে।
কুয়াশা ৩৮
আকাশের দিকে দৃষ্টি পড়তেই অবিশ্বাসে চোখ জোড়া বিস্ফারিত হয়ে যায় ডি, কস্টার। প্রাণপণ শক্তিতে চিৎকার করে ওঠে সে, ‘ও মাই গড!’
কিন্তু ডি কস্টার চিৎকার কারও কানে ঢোকেনি। গতরাতে বাতাসের দাপট ছিল। ফলে সেই সাথে ছিল সমুদ্রের একটানা গর্জন।
| কেউ শোনেনি ডি. কস্টার আতঙ্কিত চিৎকার। কারও কানে যায়নি তার সাহায্যের ব্যাকুল আবেদন। পাঁচ ইউক্লা বন্দর থেকে আড়াইশো মাইল পূবে নোঙর ফেলল গাঙচিল। | নির্জন তীরভূমি। কালুকাবেলার পর গভীর জঙ্গল। আড়াইশো মাইলের মধ্যে সভ্যতার কোন চিহ্ন নেই। জঙ্গলে বাস করে জংলীরা। | অস্ট্রেলিয়ার জংলীরা পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশের সব জংলীদের চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন, কোন কোন উপজাতি অনেক বেশি অসভ্য। সভ্যতার আলো এখনও পায়নি তারা। এখনও তারা নরমাংস ভক্ষণ করে। উলঙ্গ থাকে। আদিম যুগের মানুষের মত তারা বন্য পশু শিকার করে কাঁচা মাংস খায়। অস্ত্র বলতে তারা ব্যবহার করে একমাত্র বুমেরাংকে। এই অস্ত্রই তাদের একমাত্র সম্বল। বুমেরাং দিয়েই তারা খাদ্য সংগ্রহ করে, এটা ব্যবহার করেই তারা আত্মরক্ষার চেষ্টা। করে।
মাত্র সতেরোশো সত্তর সালে জেমস কুক আবিষ্কার করেন এই মহাদেশ। তার আগে সভ্য মানুষ এই মহাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানত না। অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কৃত হবার পর শ্বেতাঙ্গরা ভাগ্যান্বেষণে এই সম্পদশালী মহাদেশে এসে ভিড় জমাতে থাকে। | উনত্রিশ লক্ষ পঁচাত্তর হাজার বর্গ মাইলে বাস করে মাত্র এক কোটির মত
লোক। প্রতি বর্গ মাইলে মাত্র তিনজন বাস করে। প্রায় নির্জন মহাদেশ।
| সোনার প্রায় পনেরোটি খনি আছে এখানে। জংলীরা পর্যন্ত পাঁচ-রে দশপ্রে ওজনের সোনার তোড়া পায়ে পরে থাকে। এই সোনার লোভেই শেতাঙ্গরা ভীড় জমিয়েছিল এখানে।
ল্যাণ্ড অভ দ্য গোল্ডেন ফ্লীজ বলা হয় অস্ট্রেলিয়াকে। লক্ষ লক্ষ ভেড়া বাস করে এখানে। পৃথিবীর অধিকাংশ উল পাওয়া যায় এখান থেকেই।
এখন প্রায় আড়াইটা বাজে।
কুয়াশা তৈরি হয়ে নিতে বলল রাসেলকে। ড, মূরকোট বিপদগ্রস্ত। তাঁকে সাহায্য করাটাই সবচেয়ে আগের কাজ। কাল সকাল অবধি অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। জঙ্গলে প্রবেশ করলে আজ সন্ধ্যার আগেই বিশ মাইল অতিক্রম করা যাবে। রাতটা জঙ্গলে কাটিয়ে আগামীকাল সকালের দিকে ড. মূরকোটের আস্তানায়
৭২
ভলিউম ১৩
পৌঁছানো সম্ব।
অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো ওরা। কুয়াশা এবং রাসেল ছাড়া বাকি সবাই থাকবে ইয়টেই।
ডি. কস্টার সানন্য মন খারাপ সকলের। এই কদিনেই সকলে ভালবেসে ফেলেছিল লোকটাকে। গর্বিত ছিল সে। কিন্তু সকলের দুঃখ বুঝত। ভাল গল্প করতে পারত। তার গল্প বলার ভঙ্গি দেখে হেসে গড়াগড়ি যেত সবাই। সেই লোক সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে, জেনে সবাই হতভম্ব, ভিত। তাই কুয়াশা এবং রাসেলকে যখন সবাই বিদায় দিল তখন কারও মুখে কোন কথা ফুটল না। সবাই ভাবছিল ডি কস্টার কথা। ডি. কস্টা সবাইকে বলেছিল তীরে নামার আগে সকলকে সে ডিনার খাওয়াবে।
কিন্তু কে জানত তীরে নামার ভাগ্য করে আসেনি বেচারা।
কুয়াশার কাঁধে একটি লেসার গান। অপর কাঁধে ঝুলছে একটি চামড়ার ব্যাগ। তাকে কিছু খাবার, টর্চ, ওষুধপত্র, পানির ফ্লাস্ক, মিনি ওয়্যারলেস সেট একটা।
রাসেলের কাঁধে লেসার গানের বদলে একটা রাইফেল ঝুলছে। তার অপর কাঁধেও একটা চামড়ার ব্যাগ।
বালুকাবেলার উপর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। গভীর জঙ্গল সামনে। জঙ্গলের ধারে এসে পিছন ফিরে তাকাল ওরা দুজনেই।
দেখা যাচ্ছে গাঙচিলকে। গাঙচিলের ডেকে দাঁড়িয়ে বিষণভাবে হাত নাড়ছে সবাই। রাসেল ভাবল, আবার ফিরতে পারবে তো তারা ইয়টে?
রাসেল হাত নেড়ে উত্তর দিল। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে নিল। দেখল কুয়াশা জঙ্গলে প্রবেশ করেছে।
দ্রুত পা চালাল রাসেল। কয়েক মিনিটের মূধ্যে জঙ্গলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা।
অচেনা গভীর বনভূমির ভিতর দিয়ে পথ চলা বড় কষ্টকর দু’চার পা এগিয়েই থামতে হয়। কাঁটা গাছের কাটায় আটকে যায় শার্ট-প্যান্ট। এঁকেবেঁকে গাছের পাশ দিয়ে, উঁচু ঝোঁপ এড়িয়ে হাঁটতে হয়। সদা-সতর্ক চোখ মেলে রাখতে হয় সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে।
অজানা জঙ্গল। প্রতি পদে বিপদের ভয়।
পরিচিত জঙ্গলে হাঁটা অনেক সহজ। জন্তু জানোয়ারদের চলাচলের পথ পাওয়া গেলে বেশ দ্রুত এগিয়ে যাওয়া যায়। মিনিট দশেক পর কুয়াশা বলল, ‘এভাবে এগোলে দেরি হয়ে যাবে অনেক। দুজন বরং আলাদা হয়ে যাই। তুমি ডান দিকে সরে গিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকো। আমি বাঁ দিকে সরে গিয়ে হাঁটতে থাকি। জন্তুদের পায়ে চলা পথ পেয়েও যেতে পারি দুজনের একজন। মাঝে মাঝে সাড়া দিয়ে। তা না হলে হারিয়ে ফেলব, পরস্পরকে।
কুয়াশা ৩৮
৭৩
তাই হলো। আলাদা হয়ে গেল ওরা দুজন।
একা হাঁটতে হাঁটতে রাসেল ভাবছিল, অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গলে এমন সব রহস্যময় জীব-জানোয়ার বাস করে যা দুনিয়ার আর কোথাও নেই। প্রাচীন পৃথিবীর সব জায়গা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় নাকি এখনও কোন কোন প্রাচীন জীব-জানোয়ার দেখা যায়।
ঘন্টাখানেক পর পঞ্চমবারের মত হুইসেল বাজাল রাসেল। বেশ খানিকটা দূর থেকে কুয়াশা হুইসেল বাজিয়ে সাড়া দিল।
আবার এগিয়ে চলল রাসেল। এক ঘন্টার উপর হাঁটছে তারা। অথচ জরা যাতায়াত করে এমন একটি পথও ওদের চোখে পড়ল না।
তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে রাসেল। বেশিরভাগ ইউক্যালিপটাস গাছ। গামট্রিও অসংখ্য। জাররা গাহও আছে, সংখ্যা খুব কম। জারা গাছের ছবি দেখেছে আগে রাসেল, কাঠও দেখেছে কিন্তু গাছগুলোকে স্বচক্ষে এই প্রথম দেখল।
দেশের রেললাইনের উপর আড়াআড়িভাবে যে কাঠগুলো ফেলা থাকে সেগুলোর বেশিরভাগই অস্ট্রেলিয়ার জাররা গাছের কাঠ, বড় মজবুত হয় এই গাছের কাঠ। তাছাড়া পিঁপড়ে উই বা অন্যান্য পোকা-মাকড় এই গাছের কাঠের কোন অনিষ্ট করতে পারে না। ‘ ঝোঁপগুলো যেমন উঁচু তেমনি গভীর। নাম না জানা বুনো ফুল ফুটে রয়েছে ঝোঁপগুলোর মাথায়।
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রাসেল। এক সেকেণ্ড সময় লাগল রাসেলের সতর্ক হতে। সামনের ঝোঁপটা নড়ছে।
বিদ্যুৎবেগে কাঁধ থেকে রাইফেলটা নামিয়ে সেফটি ক্যাচ সরিয়ে ঝোঁপের দিকে তাক করে ধরল সে।
ধীরে ধীরে স্থির হয়ে গেল ঝোঁপটা। বোকার মত ঝোঁপটার দিকে তাকিয়ে রইল রাসেল। রহস্যটা কোথায়?
ঝোঁপটা নড়ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাতাসে যে নড়ছিল না তাও বুঝতে পারছিল সে।
অপেক্ষা করা দরকার। তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে রইল রাসেল। ঝোঁপের ভিতর বা অপর পাশে নিশ্চয়ই কিছু আছে। নেকড়ে-টেকড়ে নয়ত? :
হায়েনা? ।
প্রচুর হায়েনা আছে অস্ট্রেলিয়ায়।
ঈমু হওয়াও বিচিত্র নয়। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখি ঈমু। পাখি, কিন্তু উড়তে পারে না। আরও অনেক মজার ব্যাপার আছে ঈম সম্পর্কে। কিন্তু সে যাই হোক, রাসেল ভাবল, ঝোঁপটা আর নড়ছে না কেন? হুইসেল বাজালে কেমন হয়?
৭৪
ভলিউম ১৩.
হুইসেল বাজাবার কথা মনে ভাবতেই আবার দুলে উঠল ঝোঁপটা। বেশ খানিকক্ষণ ধরে দুলল বড়সড় ঝোঁপটা। কিন্তু কেউ বেরিয়ে এল না ভিতর
থেকে।
ধীরে ধীরে পা বাড়াল রাসেল। মাত্র দশ হাত দূরে ঝোঁপটা। জিনিসটা কি না দেখে গুলি করা যায় না। হয়তো ঝোঁপের ভিতর বা অপর পাশে বিশ্রাম নিচ্ছে একটি ঈমু। সেক্ষেত্রে গুলি করাটা হবে নিতান্ত বোকামি। কারণ ঈমু পেলে ধরার চেষ্টা করবে সে।
ঝোঁপের প্রায় কাছে পৌঁছে গেছে রাসেল। ভিতরে কিছু আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। ভিতরে হয়তো কিছু নেই। আছে অপর পাশে। | ঝোঁপটা ঘুরে অপর পাশে যাবার জন্যে পা চালাল রাসেল। রাইফেল উঁচিয়ে ধরে রেখেছে সে ঝোঁপের দিকে প্রথম থেকেই।
ঝোঁপের অপর পাশে গিয়ে দাঁড়াল রাসেল। দম বন্ধ হয়ে গেল তার। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে ঝোঁপটার দিকে।
| হঠাৎ বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নিজের চোখ দুটো কচলাল রাসেল। না, ভুল দেখছে না সে।
চিমটি কাটল রাসেল নিজের শরীরে ব্যথা লাগে। না, স্বপ্নও দেখছে না সে।
কিন্তু এ দৃশ্য সত্য হলেও অবিশ্বাস্য। রূপকথার অপূর্ব সুন্দরী রাজকুমারী গহীন বনের ভিতর শুয়ে ঘুমাচ্ছে যেন।
মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঝোঁপের পাশে, লম্বা ঘাসের উপর শুয়ে রয়েছে সে।
পরনে মেয়েটির কোন পোশ নেই অথচ মেয়েটি জংলীও নয়। শ্বেতাঙ্গ। ধবধব করছে গায়ের রঙ। খুব বেশি বয়স নয় মেয়েটির। বড় জোর ষোলো বছর হবে। ঝোঁপের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রয়েছে সে। দেখা যাচ্ছে না তাই মুখটা ।
খুক করে কাশল রাসেল। রাসেলের কাশির শব্দ কানে যাওয়া মাত্র মেয়েটি একলাফে উঠে দাঁড়াল।
রাসেলকে রাইফেল বাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় বিস্ময়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল সে। দুই হাত দিয়ে কোনরকমে নিজের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করে মেয়েটি পালাবার পথ খুঁজতে লাগল চঞ্চল দৃষ্টিতে।
হাতের রাইফেল মাটিতে ফেলে দিল রাসেল। ব্যাগটাও নামাল সে। নিজের শার্টটা খুলে ফেলল আস্তে আস্তে।..
মেয়েটির দিকে শার্টটা ছুঁড়ে দিয়ে রাসেল ইংরেজিতে বলল, ‘এটা পরে নাও।
শার্টটা পেয়ে যেন স্বর্গ পেল মেয়েটি। ঝটপট পরে নিল সে রাসেলের শার্ট। গায়ে অতিরিক্ত লম্বা হলো। উরু দুটো প্রায় ঢেকে ফেলল শার্টটা।
আপনিই মি. কুয়াশা, তাই না?’ রাসেলের দিকে উজ্জ্বল, চকচকে দৃষ্টিতে কুয়াশা ৩৮
৭৫
তাকিয়ে প্রশ্ন করল মেয়েটি, ‘আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।
| রাসেল অবাক হলো। বলল, কিন্তু তোমার পরিচয় কি? তুমি জানলে কিভাবে যে কুয়াশা এখানে আসছে?
মঁসিয়ে মূরকোট আমার বাবা। আমার নাম জোশন ফোম। বাবা আমাকে বলেছিলেন আপনি এই পথ দিয়ে আসবেন, তাই আমি পালিয়ে এসেছি শত্রুদের হাত থেকে।
রাসেল বলল, আমি কুয়াশা নই। তবে আশপাশেই কুয়াশা আছে। ডাকব?’
তুমি কুয়াশা নও?’ হতাশা যেন ছায়া ফেলল জোশন ফোমের চোখে। মনের ভাবটা যেন এইরকম, রাসেল কুয়াশা হলেই ভাল হত।
বাতাসে উড়ছে জোশন ফোমের শার্ট। শার্টের প্রান্ত ধরে সোজা রাখার চেষ্টা করছে সে।
রাসেল হুইসেল বের করে পরপর তিনবার বাজাল। দূর থেকে কুয়াশার হইসেলের শব্দ ভেসে এল।
তুমি কুয়াশা নও, তবে তুমি কে?’ রাসেলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ প্রশ্ন করল জোশন ফোম।
কুয়াশার দেশেরই ছেলে আমি। ছাত্র। আমার নাম রাসেল।
তুমি কুয়াশার সাথে এই বিপদের জায়গায় এসেছ কেন? তুমি জানো এখানে এলে এখান থেকে ফিরে যাওয়া প্রায় অসম্ব?”
হেসে ফেলল রাসেল। বলল, জানলেই কি, না জানলেই কি। বিপদের মধ্যে পড়বার একটা নেশা আছে আমার।’
অ্যাডভেঞ্চার খুব ভালবাস বুঝি?’ সকৌতুকে প্রশ্ন করল ফোম, তোমার হবি কি?
| দেশ-বিদেশের ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচিত হওয়া আমার হবি। পাহাড়ে চড়তে ভালবাসি। জঙ্গলে রাত কাটাতে, শিকার করতে ভালবাসি। সমুদ্রে সাঁতার কাটতে ভালবাসি…’
খিলখিল করে হেসে উঠল ফোম। হাসি থামতে বলল, আমরা তাহলে বন্ধু, কেমন? আমিও ভালবাসি তোমার মত-যাকগে, এই, বাদাম খাবে?
ঘাসের উপর থেকে একটি বড় পাতার মোড়ক তুলল ফোম। বলল, ‘জংলী বাদাম। এর নাম চিমি। খুব স্বাদ। এখানে ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এ বাদাম পাবে না। নাও।’
এগিয়ে গিয়ে ফোমের হাত থেকে কয়েকটি বাদাম তুলে নিল রালে। | বাদামগুলো খুব ছোট-ছোট। বাদামের গা বাদামী রঙের কিন্তু এটার গা খয়েরী। খেতে সত্যি অপূর্ব ।
তুমি কে গো?’ কুয়াশা সবিস্ময়ে বলে উঠল ডান পাশ থেকে। চুপিসারে কখন
৭৬
ভলিউম ১৩
যে এসে দাঁড়িয়েছে তা ওরা বুঝতে পারেনি।
চমকে উঠে তাকলি ফোম কুয়াশার দিকে। রাসেল বলল, ফোম, ইনিই মি, কুয়াশা। তোমার বাবার বন্ধু।’
তুমি সঁসিয়ে মূরকোটের মেয়ে নাকি? অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।
ফোম বলল, হ্যাঁ। বাবা খুব বিপদে পড়েছেন। একদল পাজী লোক বন্দী করে রেখেছে বাবাকে। আমাকেও বন্দী করে রেখেছিল। কিন্তু আমি পালিয়ে এসেছি।’
কুয়াশা বলল, দাঁড়িয়ে কেন তোমরা, বসো। সব কথা আগে শোনা যাক। তারপর এগোনো যাবে।
পাশাপাশি বসল রাসেল এবং ফোম মাটিতে পা ছড়িয়ে। | ওদের দু’জনার মুখোমুখি বসে কুয়াশা আপনমনে হাসতে হাসতে, ভাবল–ওদের দুজনকে মানিয়েছে বড় চমৎকার।
আধঘণ্টা পর জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা তিনজন। জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে সিনেমার পর্দায় যেমন বিচিত্র দৃশ্য ফুটে ওঠে, তেমনি অপূর্ব সব দৃশ্য ফুটে উঠল ওদের চোখের সামনে।
প্রায় শ দুয়েক বন্য ঘোড়া তীরবেগে দলবদ্ধভাবে ছুটে যাচ্ছে প্রকাণ্ড লম্বা মাঠের উপর দিয়ে। সূর্যের কিরণ লেগে ঘোড়াগুলোর লাল গা চকচক করছে। আর এক দিকে গোটা পাঁচেক ঈমু দাঁড়িয়ে আছে।
চার ফুট থেকে ছয় ফুট উঁচু এক একটি ঈমু। বড় আশ্চর্য পাখি। মানুষের চেয়ে লম্বা কম নয় এরা। পা জোড়া সরু কিন্তু অসত্ব শক্ত। ঈমুর পায়ের লাথি খেয়ে বহু মানুষ মারা গেছে। একটা তেজী ঘোড়াকেও লাথি মেরে ভূপাতিত করতে পারে একটা ঈম। উড়তে না জানলে কি হবে, এদের মত দৌড়বিদ গোটা পৃথিবীতে আর কোন পাখি নেই। ঘন্টায় ষাট মাইল বেগে একটা ঈমূকে দৌড়াতে দেখলেও আশ্চর্য ‘হবার কিছু নেই।
গাছে চড়তে পারে না ঈমু। এরা বাস করে মাটির নিচে, গর্ত করে। ঝোঁপের ভিতরও থাকে এরা।
সূর্যের দিকে পিছন ফিরে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে ঈমুগুলো । মাঝেমধ্যে এমনি করে দাঁড়িয়ে থেকে ধ্যান করা ওদের অভ্যাস।– মাঠের পর খাড়া একটি পাহাড়।
পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল কুয়াশা।
পিছনে রাসেল এবং ফোম। মানুষের মত বড় বড় পাখিগুলোর দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে, ওরা দুজন। ফোম রাসেলকে ঈমুর পিঠে চড়িয়ে দিয়ে শখ মেটাতে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কুয়াশা ৩৮
৭৭
মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। পিছন ফিরে একবার তাকাল সে। রাসেল এবং ফোম মাঠের মাঝখানে ছুটোছুটি করছে। ওদের দুজনের আগে আগে ছুটছে দলবদ্ধ ভাবে ঈমুগুলো। ধরতে পারছে না’ওরা একটাকেও।
পাহাড়ে চড়তে শুরু করল কুয়াশা । দূর থেকে যতটা খাড়া মনে হয়েছিল ততটা। খাড়া আসলে নয় পাহাড়টা। তবে তরতর করে উঠে যাবারও উপায় নেই। ভেবেচিন্তে, মাথা খাঁটিয়ে দেখেশুনে পা ফেলতে হচ্ছে কুয়াশাকে।
প্রায় বিশ মিনিট অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর কুয়াশা পাহাড়ের প্রায় মাথার কাছে পৌঁছুল। সামনেই একটি গুহা। গুহা থেকে পাহাড়ের চূড়া মাত্র পনেরো হাত দূরে। প্রায় সমতলই বলতে হবে অবশিষ্ট জায়গাটুকু।
গুহার ভেতর ঢুকে বসে পড়ল কুয়াশা বিশ্রাম নেবার জন্যে।
মাঠে দেখা যাচ্ছে না রাসেল এবং ফোমকে। সৃভত পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছে ওরা।’
বিশ্রাম শেষ করে ওঠার সময় হঠাৎ কুয়াশার চোখে পড়ল একটি জিনিস।
গুহা থেকে বাইরে যাবার একটা পথ দেখা যাচ্ছে। অনেকদিন থেকে যাওয়া আসা করার ফলে পাথরের উপর দাগ পড়েছে। তারমানে এই গুহায় জন্তু জানোয়ারা যাওয়া আসা করে থাকে।
ঘাড় ফিরিয়ে গুহার ভিতর দিকে তাকাল কুয়াশা।
গুহাটা বেশ বড়ই বলতে হবে। গুহার শেষ প্রান্তে একটি বড়সড় গর্ত দেখা যাচ্ছে।
| গর্তের দিকে তাকিয়ে রইলকুয়াশা। হঠাৎ চোখ পড়ল গর্তের পাশে একটি হ্যাঁটের দিকে।
বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠল কুয়াশার । অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল হ্যাটটার দিকে।
হ্যাটটা অতি পরিচিত কুয়াশার। কিন্তু এ হ্যাট এখানে আসে কি করে? ডি. কস্টা ডুবে মরেছে সমুদ্রে। তার হ্যাট এই পাহাড়ের গুহায় কেন?
ছয়
হ্যাটের দিক থেকে দৃষ্টি সরে গেল আবার গর্তের দিকে।
গর্তের ভিতরটা দেখা যাচ্ছে না।
গর্তের মুখটা দেখা যাচ্ছে। গর্তের ভেতর থেকে কালো রঙের একটি মাথা উঁচু হয়ে উঠছে ক্রমশ। খাড়া খাড়া কালো চুল। কালো না বলে কটা রঙের বলাই ভাল।
ধীরে ধীরে গর্তের উপর উঠছে মাথাটা। | একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুয়াশা ।
ভলিউম ১৩
৭৮
ধীরে ধীরে উঠতে উঠতে হঠাৎ এক লাফে গর্তের বাইরে বেরিয়ে এল মাথাটা। কুয়াশাকে দেখে তীক্ষ্ণ দু’সারি দাঁত বের করে গর্জে উঠল নেকড়েটা। পরমুহূর্তে লাফ দিল বিদ্যুৎবেগে।
তৈরি হয়েই ছিল কুয়াশা। নেকড়ে লাফ দিলেও নিজের জায়গা থেকে সরল না। কুয়াশা।
শূন্য থেকে দুই হাত দিয়ে লুফে নিল কুয়াশা আড়াই হাত লম্বা নেকড়েটাকে। লুফে নিয়ে এক সেকেণ্ড কালক্ষেপ না করে ছুঁড়ে দিল গুহার বাইরে হিংস্র জানোয়ারটাকে সবেগে।..
পাহাড় থেকে ঝড়ের বেগে নিচের দিকে গেল নেকড়েটা । নিচের মাটিতে পড়ার সাথে সাথে ইহলীলা সাঙ্গ হবে তার।
| ধীরে ধীরে গর্তের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। গর্তের ভিতর হাড় এবং রক্ত। গর্তের পাশ থেকে ডি. কস্টার হ্যাটটা তুলে নিল কুয়াশা। রক্তের দাগ ছাড়া আর কিছু নেই হাটে।
গর্তের পাশেই ফেলে দিল কুয়াশা হ্যাটটা। গুহা থেকে রুেবার আগে ব্যাগ এবং লেসার গানটা তুলে নিল ও।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এল কুয়াশা। রাসেল আর ফোমের হাসির শব্দ ভেসে আসছে পিছন থেকে। বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে গল্প করতে করতে উঠে আসছে ওরা।
মিনিট পাঁচেক পর পাহাড় থেকে নামতে শুরু করল কুয়াশা। এদিকে পাহাড় থেকে নামাটা সহজ। ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাহাড়।
আরও খানিকদূর নামার পর সমতল একটি জায়গা পেল কুয়াশা। এখানে পাথর মাটি মেশানো। মাটির পরিমাণ আবার কোথাও কোথাও বেশি। গোটাতিনেক ইউক্যালিপটাস গাছ দাঁড়িয়ে আছে একধারে। গাছগুলোর পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে একটি পাহাড়ী ঝর্না ।
ঝর্নার পাশে দাঁড়িয়ে লেসার গান এবং চামড়ার ব্যাগটা নামিয়ে রাখল কুয়াশা। ঝর্নার পানি হাতের আঁজলা ভরে পান করতে লাগল। ঘোত।’ । বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল কুয়াশা। শারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল কুয়াশার। ধীরে ধীরে সোজা হলো কুয়াশা। প্রকাণ্ড দৈত্যাকার মানুষটি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল, ‘ঘো!’
পা তুলল দৈত্য। সামনে বাড়ল একপা। মাটিতে পা ফেলায় কেঁপে উঠল মাটি।
. অতি ধীরে ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। দাঁতে দাঁত চেপে, মাথা ঘুরিয়ে বিদঘুঁটে রবে প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করল দৈত্য।
কুয়াশা ৩৮
কখন, কুয়াশার অজান্তে ড. মূরকোটের দৈত্যকার সুপারম্যান মাত্র পাঁচ হাতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে।
| আড়চোখে তাকাল কুয়াশা দুই হাত দূরে মাটিতে রাখা লেসার গানের দিকে। | কিন্তু পরমুহূর্তে কুয়াশা ভাবল, লেসার গান ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না। অনেক সাধনা, অনেক পরিশ্রম, অনেক ঝুঁকি এবং অনেক ত্যাগের পর এই সুপারম্যান, তৈরি করেছেন ড. মূরকোট। এখনও সম্পূর্ণ করতে পারেননি তিনি সুপারম্যানকে। সুপারম্যান তৈরি করেছেন ঠিক, কিন্তু তাকে কন্ট্রোল করতে পারছেন না। নিজের হাতে তৈরি সুপারম্যান এখন ড, মূরকোটকে হত্যা করতে চায়-ধ্বংস করে ফেলতে চায় বৃদ্ধের ল্যাবরেটরি। নিশ্চয়ই অপারেশন করে সুপারম্যানের ব্রেনে যন্ত্র ঢুকিয়ে দেবার সময় কোন ত্রুটি রয়ে গেছে। সেই ত্রুটি রতে পারলেই অনেকদিনের আশা সফল হবে বৃদ্ধের।
| সুপারম্যানকে হত্যা করা চলবে না, ভাবল কুয়াশা। ড. মূরকোট তাহলে হয়তো পাগলই হয়ে যাবেন।
কিন্তু এই হিংস্র অতিমানবের হাত থেকে বাঁচার উপায় কি? হিপনোটিজম!
সম্মোহিত করা যায় না সুপারম্যানকে? সুপারম্যানের দুই চোখের দিকে তাকাল কুয়াশা।
কিন্তু চোখ সরিয়ে নিল দৈত্য কুয়াশার চোখের ওপর থেকে।
দুই হাত দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে নিজের বুকে ঘা মারল দৈত্য। কুয়াশার প্রায় চারগুণ স্বাস্থ্য দৈত্যের। টেনিস বলের মত বড় বড় এক জোড়া চোখ। হাতির পায়ের মত পা। প্রায় একশো ইণ্ডি বুকের হাতি।
হঠাৎ দৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়ল কুয়াশাকে লক্ষ্য করে।
বিদ্যুৎবেগে একপাশে সরে গেল কুয়াশা। সরে গিয়ে লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড এক। ঘুসি মারল দৈত্যের নাক বর। | ঘুসি লাগল। কিন্তু চোয়ালে, নাকে নয়। ব্যথায় টন টন করে উঠল কুয়াশার হাত। কিছুই হয়নি তার।
এর সাথে লড়ে জয়ী হওয়া অস্ব। বুঝতে পারল কুয়াশা। কিন্তু আত্মরক্ষার চেষ্টা করতেই হবে। একটা শক্তিশালী কিন্তু প্রায় বুদ্ধিহীন অতিমানরে হাতে প্রাণ হারানোর কথা ভাবাই যায় না।
আবার হুঙ্কার ছাড়ল দৈত্য। তারপর এগিয়ে আসতে শুরু করল দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে। এবার আর লাফিয়ে পড়ার ইচ্ছা নেই তার। কুয়াশার গলা ধরবে সে। গলা ধরে দম বন্ধ করে হত্যা করবে।
পিছিয়ে যেতে শুরু করল কুয়াশা। দ্রুত ভাবছে সে। নিশ্চয়ই দুর্বল কোন জায়গা আছে দৈত্যের শরীরে। নার্ভগুলোর উপর আক্রমণ চালাতে হবে।
৮০
ভলিউম ১৩
হঠাৎ দৈত্য উৎকট স্বরে উল্লাস ধ্বনি করে উঠল। চমকে উঠল কুয়াশা।
দৈত্য কুয়াশার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে আছে অন্য দিকে। দৈত্যের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাল কুয়াশী।
জোশান ফোম এবং রাসেল দাঁড়িয়ে আছে অদূরে।
ফোম ধাক্কা মারহে রাসেলকে। ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে বলেছে, ‘পালাও, রাসেল, পালিয়ে যাও! প্লীজ, আমার কথা ফেলো না । জোনজাকে তুমি চেনো না। ধরতে পারলে ফেড়ে ফেলবে চোখের পলকে–পালাও•••?’
‘কিন্তু তুমি? রাসেলের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো না ফোমের।
হঠাৎ পাহাড় কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল দৈত্য জোনজা। ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করল সে।
ফোমের সামনে গিয়ে থামল ঝড়। বিদ্যৎবেগে দুই হাত দিয়ে ফোমের সরু কোমর জড়িয়ে ধরল সে। এক ঝটকায় দৈত্য তুলে নিল নিজের কাঁধে ফোমকে। তারপর আবার দৌড়তে শুরু করল।
কুয়াশা ছুটতে শুরু করেছিল দৈত্যের পিছু পিছু। কিন্তু ফোম চিৎকার করে বলল, “মিথ্যে চেষ্টা করে লাভ নেই। আমাকে জোনজা ছাড়বে না। আপনারা বাবাকে উদ্ধার কার জন্যে এগিয়ে যান। আমি যে পথে বলেছি সে পথেই যাবেন।
কিন্তু তুমি?’ চিৎকার করে জানতে চাইল রাসেল। সে-ও ছুটছে প্রাণপণে দৈত্যের পিছু পিছু।
ঝড়ের বেগে নেমে যাচ্ছে দৈত্য পাহাড় থেকে।
দৈত্যের কাঁধ থেকে চিৎকার করে বলল ফোম, আমার জন্যে চিন্তা কোরো না রাসেল। আমার কোন ক্ষতি করবে না জোনজা। ছেলেবেলার বন্ধু ও আমার। বিদায়, আবার হয়তো দেখা হবে…।’
ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এল ফোমের কণ্ঠস্বর।
দৌড়ানো বৃথা। দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। রাসেল বলল, ফোমকে খুন করবে দৈত্যটা, আরা কি তা জেনেও ওকে উদ্ধার করার চেষ্টা করব না?’
কুয়াশা বলল, ‘খুন করবে বলে মনে হয় না। ফোম কি বলল শুনলে না?’ কিন্তু ফোমের ধারণা তো ভুলও হতে পারে?’ ব্যাকুল গলায় বলল রাসেল।
কুয়াশা হাসল মৃদু। বলল, “চিন্তা কোরো না, রাসেল। ফোমের ধারণা ভুল হবার সম্ভবনা কম।’
কুয়াশা ঝর্ণার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল। ‘ওদিকে যাচ্ছেন যে?’
৬-কুয়াশা ৩৮
‘এসো একটা জিনিস দেখাই তোমাকে।
ঝর্ণার কাছে এসে কুয়াশা মাটি থেকে একটা শার্ট তুলল। রাসেলের দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ডি. কস্টার শার্ট।
‘ডি. কস্টার শার্ট! কি বলছেন আপনি!. গুহায় ডি.কস্টার হ্যাট দেখার কথাও বলল কুয়াশা রাসেলকে। ‘এই রহস্যের মানে? ডি কস্টার হ্যাট, শার্ট-কোথা থেকে এল।
জানি না!’ বলল কুয়াশা, জানার চেষ্টা করা দরকার। কিন্তু হাতে সময় বড় কম। আগে আমাদেরকে পৌঁছতে হবে ড. মূরকোটের শত্রুদের আস্তানায়। ড. মূরকোটকে উদ্ধার না করে আমি আর কোন কাজে হাত দিতে চাই না।’
রাসেল বলল, “সন্ধ্যার আগে কি আমরা ড, মূরকোটের শত্রুদের আস্তানায় পৌঁছুতে পারব।’
কুয়াশা বলল, কিন্তু ফোমের কথা অনুযায়ী ড, মুরকোট সেখানে নেই। তিনি তার ল্যাবরেটরিতেই বন্দী আছেন। জংলীদের একটি গ্রামে। আমরা প্রথমে ধ্বংস করব শত্রুদের আস্তানা।’’ ..
। তাই চলুন।
পাহাড় থেকে নামতে শুরু করল ওরা।
পাহাড়ের নিচে জঙ্গল। জঙ্গল ধরে ফোমের নির্দেশিত পথে গেলে আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে ওরা শত্রুদের সুরক্ষিত দুর্গে।
লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল পেটের ঝোলা থেকে একটি ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা। মায়ের ঝোলা থেকে বেরিয়েই চার পায়ে ছুটতে ছুটতে একেবারে সামনা-সামনি এসে পড়ল রাসেলের ।
‘এসো, কোলে উঠবে?’
রাসেলের কথা শুনল বাচ্চাটা কান খাড়া করে। সবজান্তার মত মাথা নাড়ল, তার পিছন ফিরে তাকাল। মাকে দেখতে পেয়েই ঘুরে ছুটল আবার। পাঁচ হাত দূর থেকেই লাফ দিল সে। লাফ দিয়ে মায়ের ঝোলার ভিতর সেঁধেয়ে গেল। মা ছুটল দ্রুত। দেখতে দেখতে মা সন্তানকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ঝোঁপের আড়ালে।
দাঁড়াও!’ ফিসফিস করে নির্দেশ দিল কুয়াশা।
দাঁড়িয়ে পড়ল রাসেল। অদূরে ডেকে উঠল একটা লিয়ার পাখি। লিয়ারের ডাক থামতেই একসাথে সাড়া দিল দুটো পুরুষ গাধা।
• পাতার ফাঁক দিয়ে সামনের দিকে তাকাল কুয়াশার দেখাদেখি রাসেল।
পাতার ফাঁক দিয়ে ওরা দেখল মাত্র দশ-পনেরো হাত দূরে একটা পাঁচিল । প্রায় দু’মানুষ উঁচু হবে পাচিলটা! পাঁচিলের মাথায় কাঁটা তারের বেড়া।
৮২
ভলিউম ১৩
ইলেট্রিফায়েড তার, তাই না?’ মৃদু হেসে তাকাল রাসেল কুয়াশার দিকে। সত!’ বলল কুয়াশা।
পাচিলের ভিতরের রহস্য বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই। নৃলারবর প্লেনের গহীন জঙ্গলে মোটা কংক্রিটের পাচিল-কল্পনাই করা যায় না! সভ্য মানুষ এই জঙ্গলে একাধিকবার প্রবেশ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। হিংস্র জন্তু জানোয়ারগুলোকে হত্যা করে কেউ কেউ এক আধ মাইল গভীরে ঢুকতে সমর্থ হলেওঁ জংলীদের বুমেরাং এবং বিষ মেশানো তীরের আক্রমণে শেষ অবধি প্রাণ হারিয়েছে সবাই। বর্তমান শতাব্দীতে কোন মানুষ এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে ঢোকার চেষ্টা করেছে বলে শোনেনি কুয়াশা। একমাত্র ড. মূরকোটই এই বিপদসঙ্কুল বনভূমিতে প্রবেশ কর মত দুঃসাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু বীরত্ব দেখাবার জন্যে এই ঝুঁকি নেননি তিনি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মঁসিয়ে মূরকোট পুলিসের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন এখানে। ক্যানবেরা থেকে পালাবার সময় পুলিসের গুলিতে নিহত হন ড. মূরকোটের স্ত্রী। ছেলে এবং মেয়েকে নিয়ে কোন মতে পালিয়ে। এসেছেন তিনি। কোন পথে কিভাবে এই রহস্যময় বনভূমিতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি কেউ তা জানে না। কুয়াশা শুধু জানে ড. মূরকোটকে জংলীরা হত্যা করেনি। হত্যা করা তো দূরের কথা, অসভ্য লোকগুলো তাকে দেবতার মতই শ্রদ্ধা করে। জংলীদের হৃদয়ে স্থান পেয়ে আর কোন চিন্তা নেই ড, মূরকোটের। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার আজও তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। দুজন মানুষকে হত্যা করার দায়ে উ, মূরকোটের অনুপস্থিতিতেই বিচার হয়ে গেছে। রায় দিয়েছে জুরীরা,
মৃত্যুদণ্ড’।
মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে শুনে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন ড. মূরকোট। তখন তিনি ক্যানবেরা থেকে দু’হাজার মাইলেরও বেশি দূরে পোর্ট হেড ল্যাণ্ডের ছোট একটা হোটেলে আত্মগোপন করে আছেন। প্রাণের ভয়ে বিচলিত হননি ড, মূরকোট। ধরা পড়লে তার সাধের বিজ্ঞান সাধনা সফলতার চরম মুহূর্তে ব্যর্থ হয়ে যাবে মনে করে চঞ্চল হয়ে পড়লেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন, পালাতে হবে। | খুন ঠিক করেননি ড. মূরকোট । দু’জন তরুণ সহকারীর দেহের উপর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। পরীক্ষা ব্যর্থ হয়। ফলে মারা যায় তার প্রিয় দুই সহকারী।
ড, মুরকোট ছাড়া এ গভীর জঙ্গলে আর কোন সভ্য মানুষ আজ অবধি প্রবেশ করতে পারেনি বলেই জানত কুয়াশা। কিন্তু জোশান ফোমের কথা শুনে এখন বোঝা যাচ্ছে একদল সশস্ত্র শয়তান কুমতলব নিয়ে এই গহীন বনভূমিতে প্রবেশ করেছে।
আমরা ভুল পথে এসেছি,’ বলল রাসেল ।
‘হ্যাঁ,’ বলল কুয়াশা, ফোমের বলে দেয়া পথ ধরে আমরা যদি আসতাম তাহলে শত্রুদের এই আস্তানার সামনের দিকে পৌঁছুতাম আমরা। কিন্তু এ বরং কুয়াশা ৩৮ |
, ৮৩
ভালই হয়েছে। পিছন দিক দিয়েই ভিতরে ঢুকব আমরা।
কুয়াশা হঠাৎ ভুরু কুঁচকে তাকাল। কি যেন শোনার চেষ্টা করছে সে।
হ্যাঁ। দূরে কোথাও শোরগোল হচ্ছে, রাসেল বলল।
কুয়াশা বলল, ‘ফোম বলেছিল শত্রুদের আস্তানা থেকে জংলীদের গ্রাম বেশ খানিকটা দূরে। উত্তরে।’ ‘
উত্তর দিক থেকেই আসছে গোলমালের শব্দটা। জোনজা ফোমকে নিয়ে গ্রামেই হয়তো ঢুকেছে।’
হতে পারে।’
কুয়াশা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় পা দিল। এসো। ওপরে ওঠার চেষ্টা করি।’
| ব্যাগ থেকে দড়ির সিঁড়ি বের করে পাঁচিলের উপর দিকে ছুঁড়ে দিল রাসেল। প্লাস্টিকের হাতলওয়ালা একটা টেস্টার দিল কুয়াশা; এই নাও।
* উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে রাসেল খানেকটা উপরে।
কাঁটাতারের বেড়া, পরীক্ষা করে উপর থেকে নিচু গলায় রাসেল বলল, ইলেকট্রিফায়েড।’
‘এই নাও।’
লম্বা হাতটা উপর দিকে তুলে ধরল কুয়াশা। কুয়াশার হাত থেকে তার কাটার প্লায়ার্সটা নিল রাসেল।
| তার কেটে ফেলল রাসেল দ্রুত। পাঁচিলের উপর উঠে দাঁড়াল ও। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল কুয়াশা। | পঁচিলের উপর থেকে শত্রুদের আস্তানার দিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল
ওরা। নিচে ঝোঁপঝাড়। নিঃশব্দে নেমে পড়ল দুজন। ঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর সামনে দেখা গেল সাদা চুনকাম করা একটা একতলা বাড়ির পিছনের দিক। কেউ নেই কোথাও। ছোট্ট একটা বারান্দা দেখা যাচ্ছে। বারান্দার উপর একটা দরজা। বন্ধ।
বারান্দার দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে চলল ওরা।
‘আমরা আসছি তা ওরা জানে, রাসেল বলল। অথচ কেউ নেই কেন বাধা দেবার জন্যে?’
কুয়াশা নিচু গলায় বলল, ‘ওরা চায় আমরা ভিতরে ঢুকে ফাঁদে পা দিই। ওরা ঠিকই নজর রাখছে আমাদের ওপর।
রাসেল বলল, কিংবা ওরা হয়তো ভেবেছে আমরা প্রথমে জংলীদের গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করব। ফোমের সাথে আমাদের দেখা হয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে তা
তো আর ওরা জানে না।
ভলিউম ১৩
কুয়াশা হঠাৎ ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘সাবধান রাসেল। বাড়ির ছাদে ওত পেতে আছে একজন লোক। মুভমেন্ট লক্ষ্য করেছি আমি। তাকিয়ো না ওদিকে। রাইফেলের নল দেখেছি, কিন্তু গুলি প্রবে বলে মনে হয় না।’
সামান্য খানিকটা দূরেই বারান্দা। স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে চলল ওরা। কুয়াশার কাঁধে লেসার গান।
রাসেলের রাইফেলটা ওর হাতেই রয়েছে। আড়চোখে একবার ছাদের দিকে তাকাল ও। দেখা গেল পলকের জন্যে একটা রাইফেলের নল আর একজন লোকের মাথার খানিকটা অংশ।
নিরাপদেই বারান্দায় উঠল ওরা।
শত্রুরা আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে,’ বলল রাসেল। হঠাৎ হাসি ফুটে উঠল কুয়াশার ঠোঁটে। হাসছেন যে?’ রাসেল জানতে চাইল। ‘এবার আমরা শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য করব। কিভাবে বলো তো?’ হেসে ফেলল রাসেল।
বলল, ‘বুঝেছি। তাদের লোকটা আমাদেরকে বারান্দায় উঠতে দেখে দলের অন্যান্যদেরকে খবর দেয়ার জন্যে নামতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। এই মুহূর্তে আমরা যদি ছাদে উঠি তাহলে ওদেরকে ‘বোকা বানানো সহজ হবে। চলুন তাহলে।’
বারান্দা থেকে নেমে ওরা ছাদের দিকে তাকিয়ে এবার কিছু দেখতে পেল না।
দড়ির সিঁড়ি ছুঁড়ে দিল আবার রাসেল। রেলিংয়ে আটকে গেল সেটা। তরতর করে উঠে গেল কুয়াশা ছাদে। পিছন পিছন উঠে এল রাসেল। ফাঁকা ছাদ। কেউ
নেই।
| সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলল ওরা ছাদের উপর দিয়ে। কিনারার কাছাকাছি পৌঁছে মাথা নিচু করে ফেলল কুয়াশা। তারপর বসে পড়ল । বসে বসেই উঁকি দিয়ে তাকাল
নচের দিকে।
দু’জন গার্ড চাপা স্বরে কথাবার্তা বলছে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে। দুজনের যতেই রাইফেল।
‘খবরদার! নড়াচড়া করলেই গুলি করব।’
লোক দুজন শ্বেতাঙ্গ। ইংরেজিতেই হুকুম করল রাসেল, রাইফেল ফেলে দয়ে মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও।’
অবাক বিস্ময়ে লোক দুজন চোখ তুলে তাকিয়ে আছে ছাদের উপর দিকে। লেসার গান র ডান হাতটা মাথার উপর তুলে দিয়ে ছাদ থেকে প্রকাণ্ড এক দুড়ের মত লাফ দিয়ে উঠানে নামল কুয়াশা।
পিছিয়ে গেল গার্ড দুজন এক পা করে ভয়ে। রাসেলও লাফ দিয়ে একতলার ওয়াশী ৩৮
৮৫
ছাদ থেকে সবেগে নেমে এল নিচে।
রাইফেল দুটো ফেলে দিল গার্ড দুজন। মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াল তার
ওই যে তোমার পঙ্খীরাজ ঘোড়া, রাসেল। উঠানের বা প্রান্তে আঙুল তুলে দেখাল কুয়াশা । রাসেল সেদিকে তাকাল। ‘ওর ভিতরে কেউ আছে?’ কুয়াশা একজন গার্ডকে জিজ্ঞেস করল।
না।’ আর সবাই কোথায়? তোমাদের বস?’ গার্ড দুজন পরস্পরের দিকে তাকাল ।.উত্তর দিল না।
রাসেল বলল, আপনি ওদের কাছ থেকে কথা আদায় করার চেষ্টা করু আমি ঘোড়াটার কলকজা নষ্ট করে দিয়ে আসি।’
কুয়াশা বলল, নষ্ট করতে চাও কেন?
‘শত্রুরা পালাবার চেষ্টা করতে পারে।’ রাসেল যুক্তি দেখাল, এই গর্ত জঙ্গলে ওই যান্ত্রিক ঘোড়া ছাড়া শত্রুদের পালাবার উপায় নেই। আমরা বা ভিতরটা তল্লাশি চালিয়ে গ্রামের দিকে যাব, তাই না? সেই ফাঁকে শত্রুপক্ষ এখ। ফিরে আসতে পারে। বিপদ টের পেলেই পালাবার চেষ্টা করবে।’ | কুয়াশা গার্ড দুজনকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা ছাড়া আর কে কে আ বাড়িতে
কেউ নেই। কোথায় গেছে সবাই?’ ‘জংলীদের গ্রামে?’,
কেন? গ্রামে কি হয়েছে?’
জোনজাকে চেনেন? জোনজা খেপে গেছে। অনেক লোককে খুন ব ফেলেছে সে। কেউ তাকে সামলাতে পারছে না।
দ্বিতীয় গার্ডটি বলল, “মি. মূরকোটের মেয়ে মিস ফোম ছাড়া আর কে– জোনজাকে সামলাতে পারে না। কিন্তু মিস ফোম পালিয়ে গেছে গতকাল আমার
এখান থেকে। | প্রথম গার্ডটি বলল, বেঁচে আছে বলে মনে হয় না। গোটা জঙ্গলের কোং
আমরা খুঁজতে বাকি রাখিনি। নেকড়ে কিংবা হায়েনারা ছিঁড়ে খৈয়ে ফেলেছে । ফোমকে।
‘তোমার বসের নাম কি?
মি. ডেভিড। জংলীদের আস্তানায় গেছে সে? হ্যাঁ,
ভলিউম
কুয়াশা তাকাল রাসেলের দিকে, এদের দুজনকে বেঁধে ফেলো। একটা ঘরে দুজনকে বন্দী করে রেখে দ্রুত বাড়িটা পরীক্ষা করে চলো আমরা গ্রামের দিকে যাই।
জোনজা কি করছে দেখা দরকার।
ব্যাগ থেকে নাইলনের কর্ড বের করল রাসেল।
লোক দুজনকে বেঁধে রাসেল ওদের পকেট ‘সার্চ করল। দুজনের পকেট থেকে ছোরা পাওয়া গেল। একজনের পকেটে পাওয়া গেল একগোছা চাবি।
কুয়াশা বলল, চলো! বাড়ির ভিতরে তোমাদেরকে বন্দী করে রাখা হবে।’ | পা বাড়াল লোক দুজন। ‘ মনে মনে বেশ একটু বিস্মিত হলো রাসেল। গার্ড দুজনের এমন শান্ত-শিষ্ট আচরণ করার কারণ কি?
| ‘তোমরা আমাদেরকে দেখে গুলি করনি কেন? তোমাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আমাদের হাতে বন্দী হতেই যেন চেয়েছিলে? আসল ব্যাপারটা কি?’ রাসেল প্রশ্ন করল।
বস্ গুলি করতে নিষেধ করে গেছেন, আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে বলল একজন লোক।
_ কেন? তোমাদের বসের উদ্দেশ্যটা কি? ‘
আপনাদেরকে বন্দী করার নির্দেশ ছিল আমাদের ওপর। তবে বসের ধারণা ছিল আপনারা এখানে আসবেন না। গ্রামের দিকেই আপনারা যাবেন ভেবেছিলেন তিনি। তাই আমাদের চারজনকে এখানে রেখে তিনি চারজুনকে নিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন।
চারজন?’ রাসেল তাকাল কুয়াশার দিকে।
দ্বিতীয় গার্ডটি বলল, হ্যাঁ। গ্রামের দিক থেকে হৈ-চৈ-এর শব্দ হতে দু’জনকে আমরা পাঠিয়েছিলাম। তারা ফিরে এসে জোনজার কীর্তিকলাপের কথা জানিয়ে আবার চলে গেছে গ্রামে।
কতদিন হলো তোমরা এখানে আস্তানা গেড়েছ?’ মাস দুয়েক হয়েছে।’ ‘উদ্দেশ্য কি তোমাদের? প্রথম গার্ডটি বলল, আমাদের বসের মুখেই শুনবেন সব।’ তোমাদের ধসের পেশা কি?’ চুপ করে রইল গার্ড দুজন।
মৃদু হেসে রাসেল কলল, ‘ভেবেছ আমরা কিছু জানি না? ভুল করছ তোমরা । তোমাদের আসল পরিচয় এবং উদ্দেশ্য আমরা জানি। তোমরা মাফিয়ার পলাতক আসামী। মাফিয়ার সদস্য হলেও তোমরা দলের নির্দেশ পালন করতে ব্যর্থ হয়েই বলে ভয়ে পালিয়ে এসেছ। পুলিসও খুঁজছে তোমাদেরকে। এখানে এসে তোমরা ড.
কুয়াশা ৩৮
৮৭
মূরকোটের সুপারম্যান তৈরি করার ফমূলা ছিনিয়ে নেবে ড. মূরকোটের কাছ থেকে। তাই না?’
অবাক বিস্ময়ে গার্ড দুজন পরস্পরের দিকে তাকাল। প্রথম গার্ডটি জিজ্ঞেস করল, কিন্তু এতগুলো কথা আপনাদেরকে কে বলল?
| ‘আমরা পৃথিবীর সব অপরাধী সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখি। তোমাদের বসের নাম শুনেই বুঝতে পেরেছি সব। বাকিটা অনুমান। ১ বারান্দায় উঠে চাবি দিয়ে একটি দরজার তালা খুলল রাসেল। গার্ড দুজনকে পিছনে রেখে ভিতরে ঢুকল ও .।
| প্রকাণ্ড একটা হলরূম। হলরূমের চারদিকে বড় বড় বাক্স। মাঝখানে বড় একটা টেবিল। টেবিলের দুইধারে অনেকগুলো চেয়ার।
বাক্সগুলোয় কি?’ জিজ্ঞেস করল রাসেল।
বন্দী দুজন হলরূমে ঢুকল। রাসেলের প্রশ্নের উত্তর দিল না তারা। বন্দীদ্বয়ের পিছু পিছু ঢুকল কুয়াশা।
রাসেল একটি বাক্স খোলার চেষ্টা করল।
বাক্স খুলতে দেখা গেল পঁচিশটা গ্রেনেড রয়েছে ভিতরে। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রাসেল বলল, অস্ত্র এবং গোলাবারুদের বাক্স এগুলো। ‘
* পাশের রূমটা খোলো,’ কুয়াশা নির্দেশ দিল।
পাশের রূমটা খুলল রাসেল। এটা একটা বেডরূম। গার্ড দুজনকে বসানো । হলো দুটো চেয়ারে। চেয়ারের সাথে বাঁধা হলো দুজনের দু’ জোড়া পা।
বেডরূমের দরজায় তালা দিয়ে দিল রাসেল বাইরে থেকে। বাড়ির অন্যান্য রামগুলো দ্রুত পরীক্ষা করে নিল ওরা। কেউ নেই আর।
দ্রুত বাড়ির গেট পেরিয়ে বাইরের জঙ্গলে চলে এল ওরা। বন্দীদের রাইফেল দুটো থেকে কার্তুজ বের করে একটা ঝোঁপের ভিতর লুকিয়ে রাখল রাসেল।
গ্রামের দিক থেকে আর্তনাদ ভেসে আসছে অবিচ্ছিন্ন ভাবে! হৈ-চৈ-এর শব্দ। ক্রমশ বাড়ছেই।
শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল ওরা দুজন।
সাত এদিকের জঙ্গল খুব একটা গম্ভীর হবে না বলে মনে করেছিল ওরা। কিন্তু ওদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।
জঙ্গল এদিকে এতই ঘন এবং গভীর যে দশ-বারো হাত দূরের দৃশ্য দেখারও উপায় নেই। ছোটার চেষ্টা ত্যাগ করেছে ওরা।
| মিনিট তিনেক দ্রুত হাঁটার পর হঠাৎ কুয়াশা থমকে দাঁড়াল। | কি হলো?’ পিছন থেকে প্রশ্ন করল রাসেল।
ভলিউম ১৩
৮৮
উত্তর দিল না কুয়াশা। রাসো পাশে এসে দাঁড়াল। পাঁচ হাত দূরে একজন জংলী মুখ থুবড়ে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। কাঁধ অবধি লম্বা চুল জংলীটার। পেশী বহুল অত্যন্ত শক্তিশালী দেই। গায়ের রঙ উজ্জ্বল তামাটে। দু’কানের ললিতে ঝুলছে দুটো সোনার মাকড়ি। গলায় মুক্তোর মালা। হাতে সোনার বালা। পায়েও তাই।
এই প্রথম নৃলার প্লেনের একজন জংলীকে দেখল ওরা। জংলীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা।
বেঁচে নেই, রাসেল বলল।
জংলী এতটুকু নড়ছে না। মাথার পিছন দিকে ছোট একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে। গুলি করে মেরেছে কেউ।’ | জংলীকে পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা, প্রায় পনেরো মিনিট আগে মারা গেছে।’
| ‘ডেভিডের লোকেরাই মেরেছে,’ মন্তব্য করল রাসেল।
আবার এগিয়ে চলল ওরা। মাত্র পঁচিশ ত্রিশ গজ যাবার পর আবার থামতে বাধ্য হলো ওরা।
আর একজন জংলীর লাশ।
কুয়াশা এবং রাসেল পরস্পরের দিকে নিঃশব্দে তাকাল। লাশটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা।
প্রধম জংলী লোকটার মতই চেহারা লোকটার। একই রকম মজবুত স্বাস্থ্য। কোমরে গাছের পাতা দিয়ে তৈরি করা আচ্ছাদন।
লোকটার মাথার মগজ বেরিয়ে পড়েছে খানিকটা। মাথার পাশে, ঘাসের উপর, জমাট বেঁধে রয়েছে রক্ত।
কেউ মাথায় ভারি কিছু দিয়ে ঘা মেরেছে,’ বলল রাসেল, বুলেট না। হয়তো জোমজার কাণ্ড।
গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। প্রচণ্ড শোরগোলের শব্দ হচ্ছে। ছুটতে ওরু করল ওরা।
পঞ্চাশ গজের মত এগোবার পর হঠাৎ সামনে দেখা গেল জংলীদের গ্রাম। গাছের আড়াল থেকে গ্রাম দেখতে পেয়েই থমকে দাড়াঁল ওরা।
| গাছের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক জংলী। নিঃশব্দে আতঙ্কিত চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে জংলীরা গ্রামের দিকে। ডালপালা, গাছের বড় বড় পাতা দিয়ে তৈরি ছোট ছোট ঘর। ঘরগুলোর পিছন দিক দেখা যাচ্ছে। | জংলীদের হাতে তীর ধনুক। কারও কারও হাতে একটু বাঁকা লম্বা লাঠি। বুমেরাং। কিন্তু তীর বা বুরোং ব্যবহার করছে না কেউ।
জংলীদেরকে কুয়াশা এবং রাসেল লক্ষ্য করলেও জংলীরা ওদের দিকে মোটেই
{
কুয়াশা ৩৮
“ ৮৯
তাকাচ্ছে না। | ছোট ছোট ঘরগুলোর মধ্যবর্তী সরু পথ দিয়ে তীর বেগে বেরিয়ে এল দুজন
জংলী।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল রাসেল। দু’জন জংলীরই শরীরের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে দর দর করে রক্ত ঝরছে। আর্তচিৎকার করতে করতে কুয়াশা এবং রাসেলকে পাশ কাটিয়ে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল জংলী দু’জন। একজন জংলীর মাথা ফেটে গেছে।
অপর জংলীটার ডান হাতটা নেই। কে যেন টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে গোটা হাতটা।
হঠাৎ ছুটতে শুরু করল কুয়াশা। পিছু নিল রাসেল। ঘরগুলোর মাঝখান দিয়ে কয়েক পা যেতেই ওরা গ্রামের ভিতর প্রবেশ করল। *
সামনে ওরা মস্ত একটা খোলা উঠান দেখতে পেল। উঠানের চারধারে ছোট ছোট ঘর।
উঠানের উপর শত শত জংলী প্রাণভয়ে ছুটোছুটি করছে। আতঙ্কিত কণ্ঠে সবাই চিৎকার করছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে সবাই। কুয়াশা এবং রাসেলের পায়ের কাছে দু’জন শ্বেতাঙ্গের লাশ পড়ে রয়েছে।
উঠানের সর্বত্র জংলীদের লাশ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। কচি কচি উলঙ্গ বাচ্চাদের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে এদিক-সেদিক। নগ্ন মেয়েদের লাশই সবচেয়ে
বেশি।
. উঠানের পুবদিকে দেখা যাচ্ছে জোনাকে। একদল জংলী খালি হাতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে তাকে। জোনজীর হাতও খালি।
| মেঘ যেমন গর্জে ওঠে তেমনি বিকট স্বরে গর্জন করছে জোনজা। বিদ্যুৎবেগে জংলীদেরকে তাড়া করছে সে। জংলীরা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ‘জোনজা একটি বড় ঘরের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। পর মুহূর্তে জংলীরা বাধা দেবার জন্যে এগিয়ে আসছে দলবদ্ধ ভাবে।
| জংলীদের পিছনে দু’জন শ্বেতাঙ্গকে দেখা যাচ্ছে। তাদের হাতে রাইফেল। “শ্বেতাঙ্গদের পিছনে একটি বড় ঘর। ঘরের ভিতর দেখা যাচ্ছে দু’জন লোককে। তারা দরজার দিকে পিছন ফিরে ঘরের ভিতর কি যেন করছে। দু’জনার মধ্যে
একজনের হাতে একটা রিভলভার।
ওই ঘরটাই ড. মূরকোটের ল্যাবরেটরি, বলল রাসেল। ভিতরে যন্ত্রপাতি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’ | কুয়াশা বলল, জংলীদের পিছনে শ্বেতাঙ্গ দু’জন রাইফেল নিয়ে কি করছে বুঝতে পারহু?’
| ‘পারছি!’ বলল রাসেল, ‘জংলীদেরকে বাধ্য করছে জোনজাকে বাধা দেবার
ভলিউম ১৩
জন্যে। কেউ পালাবার চেষ্টা করলেই গুলি করবে।
কথাগুলো বলেই রাইফেল তুলল রাসেল। রাসেল!’ কুয়াশা বাধা দিতে চাইল। কিন্তু কুয়াশার কথায় কান না দিয়ে পর পর দুটি গুলি করল রাসেল।
শ্বেতাঙ্গদের হাতে গিয়ে বিঁধল বুলেট। দু’জনের হাত থেকেই খসে পড়ল রাইফেল । | ভালই করেছ।’
| বড় ঘরটার দরজার সামনে একজন লোক এসে দাঁড়াল। গুলির শব্দ শুনেছে
সে ।
ওই লোকটাই ডেভিড । ডেভিড প্রকাণ্ড পুরুষ। অসুরের শক্তি ওর দেহে, দেখেই বোঝা যায়। কুয়াশা এবং রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছে ডেভিড। তার হাতে রিভলভার।
ডেভিড তাকাল তার দুই আহত গার্ড দু’জনের দিকে। তারপর আবার চোখ তুলল। কি মনে করে ঘাড় ফিরিয়ে ঘরের ভিতর দিকে তাকাল সে। কাকে যেন কি বলল।
রাসেল আবার রাইফেল তুলল। শব্দ হলো গুলির।
ডেভিডের মাথার দু’ইঞ্চি উপর দিয়ে রাসেলের রাইফেলের বুলেট চলে গেল। ঘরের ভিতর গিয়ে ঢুকল ডেভিড। ‘ব্যাটা হয়ত পালাবে!’ বলে উঠল রাসেল। কুয়াশা ছুটল বড় ঘরটার দিকে।
জংলীদের মাঝখান দিয়ে ছুটতে ছুটতে বড় ঘরটার দরজার সামনে দাঁড়াল কুয়াশা। ওর হাতে লেসার গান।
ঘরের ভিতর ডেভিড নেই। ঘরের দ্বিতীয় দরজাটা খোলা। বাইরে থেকে ঘরটাকে বড় দেখালেও ভিতরে ঢুকে কুয়াশা দেখল টা তার চেয়েও অনেক বড়।
ঘরের এক কোণায় প্রকাণ্ড একটা ইন্সল্টমেন্ট প্যানেল। | ড. মূরকোটের ল্যাবরেটরি এবং কন্ট্রোলরূম এটা। ঘরের অপর কোণায় প্রকাণ্ড একটা ট্রান্সমিটার।
ড. মূরকোট বয়ঃভারে কুঁজো হয়ে গেছেন। দরজার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মাথার পিছনের ধবধবে সাদা চুল দেখা যাচ্ছে । ইন্সস্টমেন্ট প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে সুইচ টিপছেন তিনি দ্রুত এলোপাতাড়ি ভাবে।
প্রচণ্ড শব্দ হলো পিছনে।
ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল কুয়াশী। জোনজা ঘরের সামনে এসে পড়েছে। রাসেল খালি হাতে তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। ‘
| থমকে দাঁড়িয়েছে জোনজা দাঁতে দাঁত চাপছে সে। টেনিস বলের মত বড় বড় দুটো চোখ টকটকে লাল। দুহাত দিয়ে নিজের বুকে চাপড় মারছে সে। কুয়াশা ৩৮
রাসেল দ্রুত ভাবছে। খালি হাতে বাধা দিতে হবে জোনজাকে। গুলি করা চলবে না। জোনজাকে বাধাও দিতে হবে আবার বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
মি. কুয়াশা!’ ঘাড় ফিরিয়ে ঘরের দিকে তাকাল কুয়াশা।
সামনে এসে পঁড়িয়েছেন ড. মূরকোট। দুই চোখের নিচে কালি। ঠোঁট জোড়া মৃদু মৃদু কাঁপছে তাঁর। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে আতঙ্ক।
কেমন আছেন, ডক্টর?’ প্রশ্ন করল কুয়াশা।
ড. মূরকোট বললেন, ভাল না, মি. কুয়াশা। সর্বনাশ ঘটে যাবে এখুনি, দয়া করে বাঁচাবার চেষ্টা করুন। জোনজা এই ঘরে ঢুকে যন্ত্রপাতি ভেঙে ফেলতে চাইছে। ও আমাকে মেরে ফেলুক, কিন্তু যন্ত্রপাতিগুলো যেন ছুঁতে না পারে।’
কুয়াশা দ্রুত প্রশ্ন করল, জোনজীর মাথার ভিতর রিসিভিং যন্ত্র প্রবেশ করিয়েছেন নিশ্চয়? সেটা কাজ করছে না বুঝি?
অপারেশনের সময় কোথাও কোন ত্রুটি রয়ে গেছে। সেই জন্যেই শর্ট-ওয়েভ সিগন্যাল রিসিভ করছে না ঠিকমত রিসিভিং যন্ত্রটা…।’
| ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল কুয়াশা। আশঙ্কায় হিম হয়ে গেল কুয়াশার সর্ব শরীর। ছুটে যেতে চাইল ও জোনজার দিকে। কিন্তু পারল না। হাত পা নড়ল
তার।
জোনজা দু’হাত দিয়ে অবলীলাক্রমে তুলে ধরেছে রাসেলকে মাথার উপর। রাসেল মেরুদণ্ড বাঁকা করে ছটফট করছে। জোনজা সবেগে দূরে ফেলে দিল রাসেলকে। একটি ঘরের ছাদে গিয়ে পড়ল রালে।
জোনজা কুয়াশার দিকে তাকাল। পর মুহূর্তে গর্জে উঠল সে। মি, কুয়াশা!
ড. মূরকোট আতঙ্কিত কণ্ঠে ডেকে উঠলেন। ছুটে ঘরের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। চোখ ঢাকলেন দুহাত দিয়ে।
জোনজাকে বাধা দেয়ার কেউ নেই। জোনজা এগিয়ে আসছে ঘরের দিকে।
একলাফে ইস্টমেন্ট প্যানেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। অসংখ্য সুইচ আর হাতলের সমষ্টি একটি প্যানেল। দ্রুত কয়েকটা সুইচ টিপল কুয়াশা। * ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। জোনজা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এগিয়ে আসছে দরজার দিকে।
দরজা বন্ধ করার কোন মানে হয় না। এক সেকেণ্ডও লাগবে না জোনজার দরজা ভাঙতে। |
দরজার তুলনায় অনেক বড় দৈহ জোনজার। দরজা দিয়ে ঢুকতে পারবে না
ভলিউম ১৩
সে।
কিন্তু বাধাকে বাধা বলে মনে করার পাত্র নয় মূরকোটের আবিষ্কৃত সুপারম্যান জোনজা। দরজা ভেঙে ঘরের ভিতর ঢুকল সে।
পাগলের মত ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের সুইচ টিপছে কুয়াশা ।
রিসিভিং সেট ফিট করার সময় ত্রুটি থাকলেও সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে বলে, মনে হয় না যন্ত্রটা। সেই আশাতেই সুইচ টিপছে কুয়াশা।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
দ্রুত হাতে কাজ করে চলেছে কুয়াশা ইস্ট্রমেন্ট প্যানেলে। পিছন ফিরে তাকাচ্ছে সে বারবার। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া নেই জোনজার মধ্যে। বিকট স্বরে হষ্কার ছাড়ছে সে। রক্তে তার সর্বশরীর সিক্ত। এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে
সে। এগিয়ে আসছে কুয়াশার দিকে।
Leave a Reply